মিস বুলস্ট্রোড জানালা খুলে দেন, ঘরে ঢুকলো মার্গারেট ও তাঁর মেয়ে জুলিয়া, বয়স তিরিশের শেষ কোঠায়, ঝরঝরে চুল মুখভরা দাগ। টুপিটা বেমানান তার অভ্যাস নেই, মেডোব্যাঙ্কে আসছেন মেয়েকে ভর্তি করাতে। সাদাসিধে মেয়ে, ললাটে বুদ্ধির ছাপ, হাসিখুশি মেয়ে। তাড়াতাড়ি ভূমিকা শেষ করে মার্গারেট হাত দিয়ে জুলিয়াকে চালান করে দিলেন জনসনের কাছে, মেয়েটা কিন্তু তার মাকে সাবধান করে দিয়ে বললেন যে সে থাকবে না। গ্যাসট্যাসগুলো সাবধানে জ্বালাতে বললো। জুলিয়া একেবারেই সাধারণ মেয়ে, স্বাস্থ্য ভালো, বুদ্ধিসুদ্ধি রাখে, মিস বুলস্ট্রোড গম্ভীরভাবে বললেন জুলিয়া যে এখানে আসতে পেরেছে সেটাই বিরাট ব্যাপার।
হঠাৎ জানালা দিয়ে কী যেন দেখে মিসেস আপন অবাক হয়ে বিস্ময়ে চিৎকার করে বললেন, আরে কী অদ্ভুত, মিস বুলস্ট্রোডের কানেও গেল না। সামনের জানালা দিয়ে দেখতে পেয়েছেন রডোডেনড্রন গুচ্ছ পেরিয়ে স্কুলবাড়ির দিকে এগিয়ে আসছেন লেডি ভেরোনিকা কার্লটন, মদে চুর, তার পা টলছে। একটা আপদ বিশেষ লেডি ভেরোনিকা। যমজ মেয়েদুটির ওপরে খুব টান, কিন্তু মহিলা খুব ভালো কিন্তু প্রায় তিনি তা থাকেন না, তখন তিনি আরেক মানুষ হয়ে যান, কখন যে চুর হয়ে যান তিনি নিজেও জানেন না। স্বামী মেজর কার্লটন খুব চেষ্টা করেন তার স্ত্রীকে আয়ত্তে আনার জন্য। কিন্তু পারেন না। স্কুলে স্পোর্টসের দিন তারা সবাই এসেছিলেন, লেডি ভেরোনিকাকে সঙ্গে নিয়ে মেজরসাহেব ও তার বোন সেদিন প্রকৃতিস্থ অবস্থায় চমৎকার পোশাক পরে এসেছিল। তার বাৎসল্য প্রেম দেখে মনে হচ্ছিল আদর্শ এক মাতৃমূর্তি। কিন্তু যখন স্বামী ও ননদের চোখ এড়িয়ে মদে চুর হয়ে স্কুলে আসতেন যমজ মেয়ে দুটোকে স্নেহ জানাতে তখনই হত বিপদ, আজ সকালের ট্রেনে এসেছে।
মিস বুলস্ট্রোড মিসেস আপভানের কথা কিছুই শুনছেন না। তখন তিনি বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়ার কথা ভাবছেন, হঠাৎ মিস চ্যাডউইক জোর কদমে পা চালিয়ে লেডি ভেরোনিকার কাছে গেল। আরামে নিঃশ্বাস ফেললেন তখন বুলস্ট্রোড। চ্যাডিকে সব সময় বিশ্বাস করা যায়। কোনো মেয়ের রগ ছিঁড়ে রক্ত পড়ুক বা মাতাল বাপ-মা আসুন চ্যাডিই পরম ভরসা। লেডি ভেরোনিকা জোরেই মিস চ্যাডাইককে বলেছিলেন কি বিচ্ছিরি! বলে কিনা তাকে সরিয়ে রাখবে, আসতে দেবে না। তারপর তিনি বললেন, বুলস্ট্রোডকে গিয়ে তিনি বলবেন যে তার বাচ্চাদের নিয়ে যাবে কত আদর-টাদর করবে মায়ের স্নেহ দিয়ে। চ্যাডউইক বললেন, নিশ্চয়ই তারা খুব খুশি হয়েছে। নতুন স্পোর্টস প্যাভিলিয়নটা তাকে দেখাবেন বললেন, লেডি ভেরোনিকা কায়দা করে দালানের উল্টো দিকের পথটা ধরল, টলটলে পায়ে ভদ্রমহিলা মিস চ্যাডউইকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলবাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে যান। তারপর চ্যাডউইক বলেন যে তার মেয়ে দুটোকে তিনি ওখানেই পাবেন। কি চমৎকার স্পোর্টস প্যাভিলিয়ন, ঝকঝকে নতুন নাম্বার, সাঁতারের পোশাক শুকিয়ে নেবার জন্য আলাদা ঘর আছে। মিস বুলস্ট্রোড বললেন, সত্যিই চ্যাডি অতুলনীয়া–ওর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা যায়। মেয়ে হিসাবে মোটেই আধুনিকা নয়। অঙ্ক ছাড়া কোনো বিষয়ে মাথা নেই। মিস বুলস্ট্রোড বললেন, আজ স্কুলে গ্রীষ্মপর্ব শুরু হলো, এখন অনেক লোকের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
.
রামাতে বিপ্লব
গ্রীষ্মপর্ব আরম্ভ হবার মাস দুয়েক আগে মেডোব্যাঙ্কে কতকগুলো অসাধারণ ঘটনা ঘটেছিল। নিতান্ত অপ্রত্যাশিত ভাবেই একটি মেয়ের স্কুলটার ওপর প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। দুজন যুবক রাজপ্রাসাদে বসে অদূর ভবিষ্যতের কথা ভাবছিল, তাদের মুখে পাইপ থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে কুণ্ডলী পাকাচ্ছিল। একজনকে দেখতে তেলতেলে মসৃণ, মুখ ভাসা ভাসা, উদাস চোখ। ইনিই শাহজাদা আলি ইউসুফ, ছোটো হলেও রামাত দেশটি মধ্যপ্রাচ্যের ধনবান দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। অন্য লোকটির শুকনো চুল, দাগ দাগ মুখ, মহামান্য শেখসাহেবের নিজস্ব বৈমানিক। মাইনে কয়েকটি টাকা মাত্র, এতটা সামাজিক বিভেদ সত্ত্বেও তারা দুজনে বন্ধু, কারণ দুজনে ইংল্যান্ডে একই পাবলিক স্কুলের ছাত্র।
বিশ্বাস করতে পারা যায় না রাজকুমার আলি আমাদের ওপর গুলি চালিয়েছিল, বব রবিনসনের কোনো দ্বিধা নেই, নির্ঘাত আমাদের বিমানটি নিচে ফেলে দিতে চাইছিল, বব দাঁত চেপে কথাটি বললো। একটু ভেবে আলি বলেন, বোধহয় আর তারা কোনো চেষ্টা করবে না। আমি ভীষণ দেরি করে ফেলেছি নসীবের ওপর আর কতবার ভরসা করা যায়।
রামাতে রাজা বলেন, পালিয়ে যেতে কি মন করে ববের কথা সে বোঝে। রুদ্ধকণ্ঠে যুবরাজ বলে–এই দেশের লোকের জন্য তিনি কি না করেছেন। কতটাকা ঢেলে গড়া হয়েছে স্কুল, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যবিভাগ। বব বললো দূতাবাস কিছু করতে পারে না, সে সেখানে আশ্রয় নেবে সেটা জিজ্ঞাসা করলে, ও বললো সে কখনো ও আশ্রয় নেবে না। তাহলে চরমপন্থীরা তাদের দূতাবাস গুঁড়িয়ে দেবে। আমার বিরুদ্ধে তাদের প্রধান অভিযোগই তো যে, সে বড় ইউরোপীয় ঘেঁষা। তার মনটা যেন দূরদূরান্তে চলে যায়। তার পিতামহ ছিল ভীষণ নিষ্ঠুর। শয়ে শয়ে তার ক্রীতদাস ছিল। আর সে যদি পিতামহের মতো নিষ্ঠুর অত্যাচারী হন সেটা বানানোই বোধহয় তাদের কাম্য ছিল। ববের ধারণা আলির এই অনাড়ম্বর নিরুত্তাপ চেহারাটা ইংল্যান্ডে মানিয়ে গেলেও মধ্যপ্রাচ্যে তেমন চলে না।