আরো জোরে জোরে পুতুল-মাটি তুলে আনে। টেবিলে গড়িয়ে পড়লো একটা জিনিস…তারপর আরেকটা। দেখতে দেখতে ছোট্ট একটা সুপ হয়ে গেলো।
জুলিয়া জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে তো আছেই।
তরল আগুন, লাল সবুজ, ঘন নীল, ঝকঝকে সাদা।
জুলিয়া সেই মুহূর্তে অনেক বড় হয়ে গেল। ছোটো মেয়েটি আর রইলো না। নারীত্ব বিকশিত হল, রত্ন দেখছে এক নারী…মাথায় রাশি রাশি চিন্তা খেলে গেল। আলাদীনের গুহা…কালো ভেলভেটের গাউন পরে আছে সে, গলায় দুলছে চোখ ধাঁধানো হীরের হার। বসে বসে স্বপ্ন দেখে, চকচক চোখ মেলে দেখে। আঙুলে তুলে রত্নগুলো দেখে ছেড়ে দিতেই আগুনের নদী হয়ে ওগুলো পড়ে যায়..বিস্ময় ও আনন্দের উজ্জ্বল ঝর্না। তারপর সে বেসিনের কাছে যায়। তার স্পঞ্জ ব্যাগের মধ্যে সেগুলো ঠুসে তার ওপর স্পঞ্জ আর নখের ব্রাশ ভরে দেয়। বিছানার কাছে ফিরে এসে টেনিস র্যাকেটের ভেতরে পট্টিটাকে ভরে দিয়ে কাঠের মাথাটা আবার এঁটে দেয়। চামড়াটাকে তার ওপরে জোড়বার চেষ্টা করে কিন্তু সেটা ওপর দিকে বেঁকে ওঠে। ওটাকে ঠিক করবার জন্য কাঠের গোল চাকতির ওপর উল্টো করে সরু সরু আঠালো টেপ রেখে তার ওপর চামড়াটাকে চেপে ধরে।
র্যাকেটটাকে এখন প্রায় আগের মতোই দেখতে লাগে। হাতে নিয়ে ওজনের তারতম্য বোঝা যায় না। র্যাকেটটাকে নেড়ে চেড়ে দেখে, একটা চেয়ারের ওপর অযত্নে ফেলে রাখে।
সুন্দর পাতা বিছানার দিকে দেখে, যেন তার জন্য অপেক্ষা করছে। জুলিয়া কিন্তু পোশাক ছাড়লো না।
কান পেতে শোনে…বাইরে কি? হঠাৎ ভীষণ ভয় হলো, দুজন খুন হয়ে গেছে। যদি কেউ জানতে পারে তাহলে সেও খুন হয়ে যাবে…
ঘরের মধ্যে কাঠের বেশ ভারি একটা দেরাজ আলমারি আছে। জুলিয়া সেটাকে কোনমতে টানতে টানতে দরজার সামনে নিয়ে আসে। মেডোব্যাঙ্কের কী রীতি, মেয়েদের ঘরের ভেতর থেকে তালা দেবার ব্যবস্থাই নেই। জানালার কাছে গিয়ে ওপরের পাল্লা টেনে বন্ধ করে ছিটকিনি লাগায়, তার জানালার কাছে অবশ্য কোনো গাছ নেই, তাই তার ঘরে ঢোকা সম্ভব নয়, তবু সাবধানের মার নেই।
টেবিলের ঘড়িতে দেখলো দশটা, দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলো নিভিয়ে দিলো, তার ঘরে যেন অস্বাভাবিক কিছু না দেখা যায়, জানালা থেকে পর্দাটা সামান্য একটু সরিয়ে দিল। চুপ করে খাটের একপাশে জুলিয়া বসে থাকে। হাতে ধরে রেখেছে খুব শক্ত একপাটি বুট।
ভাবতে থাকে যদি কেউ ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করে, আমি এই দেওয়ালে এত জোরে বুটটা ঠুকে দেব যে পাশের ঘরের মেরী কিং জেগে যাবে। ভীষণ জোরে চেঁচিয়ে উঠবো। তারপর যদি অনেক লোক এসে জড়ো হয় বলবো দুঃস্বপ্ন দেখা কিছু অসম্ভব নয়, কেউই কিছুই ভাববে না।
অনেকক্ষণ বসার পর শুনলো…প্যাসেজে মৃদু পায়ের শব্দ, ঘরের সামনে এসে শব্দটা থামলো…ও শুনতে পেলো। তারপর দেখলো দরজা খোলার হাতলটা আস্তে আস্তে কে ঘোরাচ্ছে। চিৎকার করবে? না এখন নয়। দরজাটাকে ঠেললো–সামান্য একটু ঠেলা। কিন্তু দেরাজ আলমারিতে ঠেকে গেলো। এতে নিশ্চয়ই বাইরের লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে। আবার বিরতি, তারপর একটা ছোট্ট মৃদু টোকা পড়ল দরজার ওপরে।
জুলিয়া নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকে। আবার টোকা–কিন্তু এবারও খুব আস্তে নরম হাতে। জুলিয়া নিজের মনে ভাবে আমি এখন ঘুমোচ্ছি, আমি কিছু শুনিনি।
জুলিয়া অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকলো। আর টোকা পড়লো না বা হাতটাও ঘোরালো না। কিন্তু জুলিয়া অত্যন্ত সজাগ হয়ে বসে রইলো।
এরকম ভাবে বসে থাকতে থাকতে জানতেও পারলো না কখন ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে পড়েছে। স্কুলের ঘণ্টাই তাকে জানিয়ে দেয়। কোঁচকানো বিছানায় এক কোণে কোনোরকমে কষ্টেসৃষ্টে সে শুয়েছিলো।
প্রাতঃরাশের পর মেয়েরা ঘরে গিয়ে বিছানা গুছিয়ে রাখলো। তারপর বড়ো হলঘরে প্রার্থনার জন্য সমবেত হল। প্রার্থনার পরে যে যার ক্লাসে চলে গেলো।
যখন সবাই নিজের নিজের ক্লাসে যেতে ব্যস্ত জুলিয়া একটা ক্লাস ঘরের মধ্যে ঢুকে ওপাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। মেয়েদের একটা দল দালানের দিকে বেশ তাড়াতাড়ি হেঁটে আসছিল তাদের সঙ্গে সঙ্গে জুলিয়াও ওপাশটা দিয়ে এগুতে থাকে। একটা রডোডেনড্রন গাছের পেছনে হঠাৎ লুকিয়ে পড়ে। এদিক-ওদিক দিয়ে লাফ-টাফ মেরে অবশেষে বাইরের দেওয়ালের কাছে এসে পৌঁছায়। সেখানটায় একটা বাতাবিলেবু গাছের ঘন ঝোঁপ। যার ডালপালা প্রায় মাটি ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জুলিয়া গাছে চড়তে ওস্তাদ। গাছে উঠে অনেকক্ষণ ঘন পাতার আড়ালে গুটি মেরে বসে রইলো। হাতের ঘড়িটার দিকে বার বার দেখে। ঠিক জানতে কিছুক্ষণের জন্য কেউ অন্তত তার খোঁজ করবে না, আজ স্কুলের জীবনটাই এলোমেলো হয়ে গেছে। দুজন শিক্ষিকা নিহত, অর্ধেকের বেশি মেয়ে বাড়ি চলে গেছে।
সরসর করে গাছ থেকে দেওয়ালের মাথা পর্যন্ত নেমে আসে। অনায়াসে দেওয়াল ডিঙিয়ে ওধারে লাফ দেয়, শখানেক গজ দূরেই বাসস্টপ। কয়েক মিনিটের মধ্যে বাস আসবে…এলোও তাই। জুলিয়া হাত দেখিয়ে বাসে চড়লো। সুতি ফ্রকের নিচে একটা ফ্লেট-হ্যাট নিয়ে এসেছিল, অগোছালো চুলের ওপর টুপিটা পরে নিল। স্টেশনে নেমে জুলিয়া লন্ডনের ট্রেনে চড়লো।
আসবার আগে জুলিয়া ওর ঘরে বেসিনের ওপর বুলস্ট্রোডের নামে চিঠি লিখে রেখে এসেছিল।