বাড়িতে? হ্যাঁ।
একেবারে; আর আসব না?
বারে তা কী করে হয়।…এখানে আমার টেনিস খেলায় কত উন্নতি হয়েছে। সিঙ্গলসে আমি জিতবোই। ভীষণ সম্ভাবনা। জুলিয়া আর আমি হয়তো ডাবলসেও জিতবো, অবশ্য ততটা আশা করছি না আমি।
তুমি আজ আমার সঙ্গে বাড়ি আসছো কেন?
প্রশ্ন করো না।
মিস স্প্রিঙ্গার আর ভ্যান্সিটার্ট খুন হয়েছে বলে, কিন্তু কোনো মেয়ে তো খুন হয়নি।
আমি জানি মেয়েদের কেউ খুনটুন করবে না। তাছাড়া তিন সপ্তাহের মধ্যে খেলার প্রতিযোগিতা আসছে। লংজাম্পে আমার জেতার আশা আছে।
তর্ক করো না জেনিয়া, তুমি আজ আমার সঙ্গে ফিরে যাবে, তোমার বাবা বলে দিয়েছেন।
কিন্তু মা,
মায়ের সঙ্গে প্রবল তর্ক জুড়ে দেয়, তর্ক করতে করতে তার সঙ্গে স্কুলবাড়ির দিকে চলে গেলো। হঠাৎ জেনিয়া একদৌড়ে টেনিস মাঠে ছুটে এলো।
বিদায় জুলিয়া। মা দেখছি ভয়ে একেবারে সিটিয়ে আছে। মনে হচ্ছে বাবাও তাই।
জুলিয়া আস্তে আস্তে ক্রীড়ামঞ্চের দিকে হাঁটতে থাকে। ক্রমশ বলতে বলতে একেবারেই থেমে যায়। দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবে…গভীর চিন্তা।
মধ্যাহ্নভোজের ঘণ্টা বাজলো তবু জুলিয়ার হুঁশ নেই। হাতের র্যাকেটটাকে একদৃষ্টিতে দেখে। রাস্তা দিয়ে দু-এক পা এগোয়। তারপরে একপাক ঘুরে স্কুলবাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। এবারে পদক্ষেপ দৃঢ় সুনিশ্চিত, সামনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকা নিষেধ তবু সে নিষেধ না মেনে সামনের দরজা দিয়ে ঢোকে। যাতে অন্য মেয়েদের এড়ানো যেতে পারে। হলঘর শূন্য সিঁড়ি দিয়ে চলে আসে নিজের ছোটো শোবার ঘরটায়। চকিতে চারিদিকে ভালো করে দেখে চট্ করে হাতের র্যাকেটটাকে বিছানার গদির নিচে শুইয়ে দেয় তারপর চুল ঠিক করে নিয়ে গম্ভীরভাবে সিঁড়ি বেয়ে নিচে খাবার ঘরে চলে যায়।
.
আলাদীনের গুহা
সেই রাত্রে মেয়েরা শুতে চলে গেলো। হৈ-হট্টগোল অনেক কম। তিরিশ জনের মতন তো বাড়িতে চলে গেছে। যারা রয়ে গেছে তাদের উপর ঘটনার প্রভাব যথেষ্ট। যার যেমন স্বভাব, সেইরকম প্রতিক্রিয়া করে।
কেউ উত্তেজিত, কেউ ভয়ে সিঁটিয়ে আছে, কেউ হয়তো ঘাবড়ে গিয়ে বাইরে সেটা প্রকাশ না করে কেবল খিলখিল করে হাসছে। অনেকে আবার একেবারেই চুপ হয়ে ভাবছে। সবাই নিজের নিজের ঘরে শুতে গেলো। জুলিয়াও তাদের মধ্যে ছিলো, ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো, কান পেতে শোনে দরজার বাইরে কত ফিসফিস কথা। খিলখিল হাসি, পায়ের শব্দ, রাতের শুভেচ্ছা, তারপরেই সব চুপ হয়ে গেলো, প্রায় নিস্তব্ধ। দূরেই শুধু ক্ষীণ কণ্ঠে আর কখনো কখনো স্নান ঘর থেকে আসা-যাওয়ার পায়ের আওয়াজ।
দরজায় একটা হুড়কো নেই। একটা চেয়ার দিয়ে দরজার সঙ্গে এমনভাবে রাখলো যাতে চেয়ারের মাথাটা দরজার হাতলের ঠিক নিচে শক্ত হয়ে এঁটে থাকে, কেউ ভেতরে ঢুকতে চাইলে…যাতে টের পাওয়া যায়, কিন্তু কারো আসার সম্ভাবনা খুবই কম কারণ মেয়েদের একে অন্যের ঘরে যাওয়া কড়া নিষেধ। মাস্টারনীদের মধ্যেও শুধু মিস জনসনই আসতেন–যখন কারো অসুখ হত। শরীর খারাপ হত।
তোশকের তলায় হাত বাড়িয়ে জুলিয়া টেনিস র্যাকেটটা বের করে এনে সেটা হাতে নিয়ে একমিনিট দাঁড়িয়ে রইল। মনে মনে ঠিক করলো, এখুনি ওটাকে দেখতে হবে, সব ঘরে যখন আলো নিভে যাবে তখন তার ঘরে যদি আলো দেখা যায়। তবে সন্দেহ জাগতে পারে। ঘরে সাড়ে দশটা পর্যন্ত আলো জ্বলতে পারে। কাজেই এখুনি দেখা যাক। মেয়েরা এই সময়টাতে পোশাক-টোশাক বদলায় আবার বিছানায় শুয়ে বই পড়ে।
র্যাকেটটাকে খুঁটিয়ে দেখে ভালোভাবে। এর মধ্যে কী লুকোনো থাকতে পারে।
কিন্তু থাকতেই হবে যে। থাকতে বাধ্য। জেনিয়াদের বাড়িতে চুরি হল…ওই মেয়েছেলেটা এসে একটা আজেবাজে গল্প ছুঁড়লো নতুন র্যাকেট নিয়ে…।
…জেনিয়া ছাড়া আর কেউ অমন গল্প বিশ্বাস করে। নাঃ এ নিশ্চয়ই পুরানো প্রদীপের বদলে নতুন প্রদীপ। তার মানে আলাদীনের কাহিনীর মতো এই র্যাকেটটাতে কিছু আছে। জেনিয়া বা জুলিয়া কেউই র্যাকেট বদলাবদলি করে নেবার কথা কাউকে বলেনি। অন্তত, ও তাই বলে। তবে কি এই র্যাকেটটাকেই ক্রীড়ামঞ্চে সবাই খুঁজে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু কেন? কারণটা তাকেই খুঁজে বের করতে হবে। সুন্দর র্যাকেট অনেক, ব্যবহারে জীর্ণ কিন্তু নতুন করে বেঁধে নেওয়ায় এখনো বেশ ব্যবহারযোগ্য। জেনিয়া কিন্তু বলতো এটার নাকি ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।
টেনিস র্যাকেটে যদি কিছু লুকিয়ে রাখতে হয় তাহলে হাতলটাতে ছাড়া অন্য কোনো জায়গা নেই। হাতলের গোড়া অবশ্য জুড়ে দেওয়া থাকে। ওটা খুললে কেমন হয়।
কাজের টেবিলে বসে জুলিয়া একটা পেনসিল ছুরি নিয়ে খুলতে চেষ্টা করে, চামড়াটা কেটে একটানে খোলে। ভেতরে পাতলা কাঠের গোল মতন কী একটা বেরোয়। হাতলের ভেতরে থাকে নাকি অমন? মনে তো হয় না, তার চারপাশটায় আবার জোড়া। ছুরি বিধিয়ে দেয় জুলিয়া। ফলাটা মট করে ভেঙ্গে যায়।
নখ কাটার কাঁচি দিয়ে কিন্তু কাজ হয়। অনেক ধস্তাধস্তি করে ফল হয়। লাল-লাল নীল-নীল একটা পদার্থ দেখা গেল। জুলিয়া ওটাকে খোঁচাতেই বুঝতে পারে জিনিসটা কী, পুতুল গড়ার আঠালো মাটি। টেনিস র্যাকেটের হাতলে এমন মাটি। নখকাটার কাঁচি দিয়ে কাচিয়ে এই মাটি তুলে আনে। ওগুলো দিয়ে বোধহয় কোনো একটা জিনিস মোড়া আছে। মনে হল বোতামের মতো কিছু নুড়িও হতে পারে।