-কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি এই তো?
ডেভিড মাথা নাড়ল-হ্যারিই সমস্ত ব্যবস্থা বানচাল করে দেয়। তাকে সর্বক্ষণ ভয়ঙ্কর বলে মনে হতো। তার অনেক ঋণ হয়ে গিয়েছিল। আরো অনেক গণ্ডগোল ছিল। অবশেষে একদিন সে কয়েক হাজার পাউণ্ড নিয়ে পালিয়ে যায়। টাকাটা অবশ্য ওর ছিল না। একটা ছোট্ট চিঠি লিখে সে বলে যায়, অফিসের কাজ তার ভালো লাগছে না, তাই সে পৃথিবী পরিক্রমায় বেরোচ্ছে।
-তার আর কোনো সংবাদ পাওনি?
ডেভিড হেসে বলল–যা পেয়েছি। প্রায় সংবাদ পেতাম, টাকার জন্য খবর পাঠাতত সেটা পেয়েও যেত।
–আর অ্যালফ্রেড।
আমার বিশ্বাস সে বাবার কলের পুতুল হয়ে গেছে।
–আর তুমি তার হাত থেকে রেহাই পেয়ে গেছ, তাই না?
–আমি তার পর লণ্ডনে গিয়ে পেন্টিং নিয়ে পড়াশোনা করি। বাবা আমাকে হুমকি দেন যে, বাড়ি ছাড়লে আমি ঠিক করব না। শুধু তিনি বেঁচে থাকতে তার কাছ থেকে মাসোহরা বাবদ কিছু টাকা পাবে। এছাড়া তার মৃত্যুর পর তার কাছ থেকে আর কিছুই পাবো না। আমি যে মূর্খ সেটা আমায় জানিয়ে দিলেন। এরপর আমি আর তাকে দেখিনি।
হিলডা সহজভাবে প্রশ্ন করল তার জন্য তোমার দুঃখ হয় না?
-না, আমি হয়তো কোনোদিনই বড় শিল্পী হতে পারব না। তবে আমি আমার এই ছোট্ট কুটীরে বেশ সুখেই আছি। তুমি আমার মৃত্যুর পর তোমার নামে জীবন বীমা করা মোটা টাকা পাবে। সে আবার বলতে থাকে, চিঠিতে সে খ্রীস্টমাসের সময় স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি যাবার জন্য লিখেছে। তার আশা আমাদের পরিবারের সবাই আবার একসঙ্গে হই। এর মানেটা কী বলতে পারো?
-তোমার বাবা এখন বৃদ্ধ হয়েছেন। তার পরিবারের এরকম অচল অবস্থা বোধহয় ওনাকে চিন্তান্বিত করে তুলেছে, তিনি তার অবসান ঘটাতে চান। এইরকম হয়েই থাকে।
ডেভিড আস্তে আস্তে বলে–আমারও তাই মনে হয়। এখন হিলডা তুমিই বল আমায় যেতে দেবে, না দেবে না?
প্রশ্নটা খুবই স্পর্শকাতর। আমি একটু সেকেলে গোছের মেয়ে, বলতে সাহস হয় না তবু বলছি খ্রীস্টমাসের সময় যদি একটু সুখ আর শান্তি হয় তবে কী কোনো অসুবিধা হবে?
-আমি তো তোমায় অতীতের সব ঘটনার কথাই বলেছি। তবু তুমি কী আমায়…
হিলডা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে–প্রিয়তম আমি জানি। তবে অতীত অতীতই, যা হবার তো হয়েই গেছে। আমি বলি কী তুমি তোমার মধ্যে অতীতকে জীবন্ত রেখে বর্তমানের কথা ভাব।
-কিন্তু হিলডা আমি যে আমার অতীতকে কোনোমতেই ভুলতে পারছি না।
–অতীতকে ভুলে যেতেই হয়। আমার মনে হয় আমরা যদি অতীতকে ধরে বসে থাকি তাহলে আমরা একদিন শেষ হয়ে যাবো। তাছাড়া আমার ধারণা তখন তুমি ছোট ছিলে, তোমার বোঝার ক্ষমতাও তখন ভালো করে হয়নি। তাই তুমি আমার বাবাকে ঠিক বুঝতে পারোনি। এখন বোঝার বয়স হয়েছে। এখন তুমি তোমার চোখ দিয়ে সবকিছু দেখতে পাবে। আমার মনে হয় তুমি যদি এখনকার চোখ দিয়ে তাকে দেখ তাহলে তুমি বুঝতে পারবে তিনি একজন সাধারণ মানুষ। তখন হয়তো তার মধ্যে কিছুটা আবেগ ছিল। সেই আবেগই তাকে ছুটিয়েছে শুধু। তিনি হয়তো সেরকম মানুষ। যার ওপর কোনো দোষ দেওয়া যায় না। এছাড়া, তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি মানুষ, অমানুষ নন।
-তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না, আমার মার প্রতি তার ব্যবহার।
হিলডা গম্ভীর ভাবে বলে-নম্রতা, ভদ্রতা বলে একটা কথা আছে, যা হয়তো কোনো কোনো কারণে একটা সময় মানুষের মন খারাপের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে। হয়তো অন্যের সঙ্গে একটা পার্থক্য থাকতে পারে। এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এতে তাকে দোষ দেওয়া যায় না।
তার মানে তুমি বলতে চাও দোষটা আমার মারই।
হিলডা আপত্তি জানিয়ে বলে–না আমি তা বলছি না। আমি নিঃসন্দেহ যে, তোমার মার প্রতি তোমার বাবা দুর্ব্যবহার করেছিলেন। তবে একটা ব্যাপার কী জান, বিয়েটা কোনো সাধারণ জিনিষ নয়, আমার সন্দেহ বাইরের কেউ, এমন কী নারী পুরুষের বিবাহের ফসল অর্থাৎ তাদের একটা ছেলেরও এ ব্যাপারে বিচার করার অধিকার নেই। তাছাড়া তোমার এখনকার দুঃখবোধ কোনোভাবেই তোমার মাকে এখন সাহায্য করতে পারবে না। সব শেষ হয়ে গেছে। সেসব ঘটনা তুমি পেছনে ফেলে এসেছ। এখন আছে এক পঙ্গু, বৃদ্ধ মানুষ যিনি শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর দিন গুনছেন। তিনি তার ছেলেকে খ্রীস্টমাসের সময় বাড়িতে ফিরে যেতে বলেছেন।
–তাহলে তুমি আমায় যাবার অনুমতি দিচ্ছ?
হিলডা একটু চিন্তা করে নিয়ে মনটা ঠিক করে নিল, সে বলল-হা, আমি চাই তুমি তোমার সব মান অভিমান ভুলে চিরকালের মতো ওখানে যাও।
ওয়েস্টারিংহামের এম.পি. জর্জ লী যথার্থ ভদ্রলোক। একচল্লিশ বছর বয়স, তার চোখ দুটো নীল, স্বচ্ছ এবং ফ্যাকাশে। তবে চোখে একটু সন্দেহের ছাপ থেকেই যায়। তার কথাবার্তার মধ্যে একটা ব্যক্তিত্বের ছাপ ধরা পড়ে।
–আমি তো তোমায় বলেছি ম্যাগজলেন, যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বলি, আমার মনে হয় যাওয়াটা কর্তব্য।
তার স্ত্রী ধৈর্য হারিয়ে গা ঝাঁকালো। তার গড়নটা ছিল রোগা, চুলটা সোনালী, জ্বটা প্লাক করা, মুখটা ডিম্বাকৃতি। এক এক সময় তার মুখটা ভাবলেশহীন হয়ে পড়ে। এখনও তাকে সেইরকম দেখাচ্ছিল।
সে বলে উঠল-প্রিয়তম আমি নিশ্চিত যে সেটা দুর্দান্ত হবে।
হঠাৎ তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মুখ দেখে মনে হল তার মাথায় যেন একটা বুদ্ধি খেলে গেছে। সে বলল-হা, খ্রীস্টমাসের সময় আমরা আমাদের খরচ কমাতে পারব। খ্রীস্টমাস যে একটু ব্যয়বহুল সেটা সবাই জানে। আমরা যদি সেইসময় চাকর বাকরদের ছুটি দিয়ে দিই তাহলে ব্যয় কিছুটা কমবে।