- বইয়ের নামঃ এ হলিডে ফর মার্ডার
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, গোয়েন্দা কাহিনী
এ হলিডে ফর মার্ডার
১. স্টিফেন প্ল্যাটফর্মের উপর
০১.
২২ শে ডিসেম্বর।
স্টিফেন প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে কোটের কলারটা উঁচু করল। স্টীম ইঞ্জিনের ধোঁয়া আকাশে বাতাসে আর কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে প্ল্যাটফর্ম। এখন সমস্ত কিছু নোংরা আর ধোঁয়া ধোঁয়া।
হঠাৎ এই পরিবর্তন স্টিফেনকে একটু চিন্তান্বিত করে তুলেছে। যেমন নোংরা দেশ–তেমনি নোংরা শহর। এই প্রথম তার লণ্ডনের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া হল, এখানকার দোকান, রেস্তোরাঁ, সুবেশা মহিলারা সমস্ত কিছু মলিন হয়ে গেছে। মনে করা যাক এখন সে দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে গেছে।.স্বদেশে ফেরার জন্য কিছুক্ষণের জন্য সে উতলা হয়ে উঠল। রোদ ঝলমলে আকাশ…ফুলের বাগান…সুন্দর ঠাণ্ডা বাতাস–আর এখানে আছে শুধু অগণিত মানুষের ভিড় এবং কয়লার ধোয়া আর গাদাগাদি ব্যস্ততা।
কিছুক্ষণের জন্য সে চিন্তা করল। তারপর দরকারের কথা মনে পড়ল। সে বহুবছর ধরে প্ল্যান করে আসছে।
সে ইচ্ছা স্বল্পস্থায়ী, সে নিজেকে নিজে জিজ্ঞাসা করল : কী জন্য? এতে তার কোন লাভ আছে? আর কেনই বা অতীতের দিকেমনোসংযোগ করা? সে কেন সমস্ত মুছে ফেলতে পারছে না? এ-সমস্ত কিছুই কী দুর্বলতা? সে বাচ্চা ছেলে নয় যে সে খেয়ালের বশে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার বয়স এখন চল্লিশ। সে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
যে কাজের জন্য ইংল্যাণ্ডে আসা সেই কাজ সে করবেই।
সে ট্রেনে উঠে করিডোর দিয়ে যেতে যেতে বসবার জায়গার সন্ধানে চারিদিকে তাকায়। একটির পর একটি কামরা পার হয়ে যায় সে। ট্রেনটা যাত্রী বোঝাই, তিন দিন বাকী আছে খ্রস্টমাস আসতে।
সে হঠাৎ দক্ষিণ আমেরিকার মুক্ত অরণ্যের জন্য উতলা হয়ে ওঠে। নির্জন সূর্যস্নাত একখণ্ড জমির জন্য।
পরক্ষণেই কামরার দিকে দেখতে গিয়ে তার দম বন্ধ হয়ে যায়। এই মেয়েটি আর সমস্ত মেয়ের থেকে আলাদা। কালোচুল, বিবর্ণ চোখে গভীরতা, নিশীথ রাতের অন্ধকারাচ্ছন্ন নিঃস্তব্ধতা। সুখের না হলেও অহংকার করার মতো ছিল সেই চোখ। এইসব রসকষহীন লোকগুলোর মধ্যে বসে থাকা মেয়েটার মানায় না। তার মধ্যে ইংল্যাণ্ডের এই জায়গা; যেখানে কোনো আনন্দ নেই–সেই জায়গায় যাওয়াটা তার ঠিক নয়। অন্য জায়গা হলেও তাকে ভালোই মানাতে, তৃতীয় শ্রেণীর কামরার এক কোণে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা তার ভালো দেখায় না।
সে একজন পর্যবেক্ষক। মেয়েটির পরণে কালো কোট এবং মলিন স্কার্ট, সস্তা ফেব্রিকের দস্তানা। রংচটা জুতো এবং বহুদিনের পুরোনো হাতব্যাগ–কোনো কিছুই তার নজর এড়িয়ে গেল না। তা সত্ত্বেও তার শরীরে সৌন্দর্য্য এতটুকু ম্লান হয়নি। ভারী সুন্দর এবং আশ্চর্য মেয়ে সে…
এত মানুষের ভিড়ে, ঠাণ্ডা কুয়াশায় সে কী করছে? সে চিন্তা করল মেয়েটি কে? আমাকে জানতেই হবে এখানে সে কী করতে এসেছে? হ্যাঁ, আমায় অবশ্যই জানতে হবে…
জানলার ধারে কুঁকড়ে বসে থাকা পিলার তখন চিন্তা করছিল, কী আশ্চর্যরকম গন্ধ ইংরেজদের গায়ে।
হুইসেল দেওয়া হয়ে গিয়েছিল একটা উচ্চ কণ্ঠস্বর কী যেন বলল। একসময় ট্রেনটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে আরম্ভ করল। যাত্রা আরম্ভ মেয়েটি তার পথে এগিয়ে চলেছে।
তার বুক ধড়ফড়ানি বাড়তে লাগল। সমস্ত কিছু ঠিক ঠিক বলবে তো? সে যে কাজে যাচ্ছে তাতে সে অসফল হবে না তো? নিশ্চয়ই এত বেশী সতর্কতার সঙ্গে সে চিন্তা করছিল। যে কোনো চরম অবস্থার জন্য তৈরী সে। তাকে সফল হতেই হবে…সফল সে হবেই।
মেয়েটি সরল সাদাসিধে শিশুর মত চারপাশে দেখল–সমস্ত লোকগুলোর মধ্যে সাতজন…এই ইংরেজরা কীরকম মজার লোক। তারা সবাই বড়লোক। তাদের জুতো জামাকাপড় সব দামী…ওঃ? সে সবসময় শুনে এসেছে ইংল্যাণ্ড খুব ধনী দেশ, কিন্তু তারা সুখী নয়।
ঐ যে করিডোরে একজন সুপুরুষ লোক দাঁড়িয়ে আছে–পিলার ভাবল সে খুব সুন্দর। তার গায়ের রঙ তামাটে, টিকালো নাক, চৌকো কাধ সে পছন্দ করে। সে তাকে সামনাসামনি একবারও দেখেনি, কিন্তু সে বেশ ভালো করেই জানে, প্রায় প্রতিক্ষণই সে তাকে দেখেছে। আর ঠিক কী ভাবেই বা সে দেখেছে?
মেয়েটি খুব একটা আগ্রহ দেখালো না। তাদের দেশে পুরুষেরা মেয়েদের দিকে দেখে আচমকা চোখ পড়ে যাবার মতো, অযথা দেখে না দেখার ভান করে। তাই ভয় হয় লোকটি বোধহয় ইংরেজ না। পিলার ঠিক করল, যা হোক সে তাকে সত্যিকারের ইংরেজ বলে মেনে নেবে। লোকটিকে তবু ভালো বলতে হয়, সে একজন আমেরিকানও হতে পারে।
সে চিন্তা করল লোকটিকে অনেকটা চিত্রাভিনেতাদের মতো দেখতে। সে পাশ্চাত্য ছায়াছবিতে যেমন দেখেছিল।
প্রথম রাত্তিরের আহারের ডাক পড়তেই কামরায় সেই সাতজন যাত্রী ডাইনিংকারের দিকে চলে যেতেই সেখানে মরুভূমির নির্জনতা এবং শান্ত ভাব লক্ষ্য করল পিলার। খোলা জানালা দিয়ে লণ্ডনের দক্ষিণ শহরতলীর দৃশ্য চোখে পড়ল তার। ওপারে দরজা খোলার আওয়াজ হওয়া সত্ত্বেও পিলার ফিরে দেখল না। যেমন ভাবে জানালার উপর চোখ রেখে পিছনে হেলান দিয়ে বসেছিল সেই ভাবেই বসে রইল। পিলার অনুভব দিয়ে বুঝল যে, নিশ্চয়ই করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি তার সঙ্গে কথা বলার জন্য কামড়ায় ঢুকেছে।
স্টিফেন ফারই প্রথম কথা বলল–ট্রেনে খুব ভিড়।
-ও, হা, তা ঠিক। আমার মনে হয় লণ্ডন থেকে এখন সবাই চলে যাচ্ছে, কারণ এখানে এখন ব্ল্যাকআউট চলছে।
স্টিফেন দেখল মেয়েটি নির্ভুল ইংরাজী বলে তবে একটু জোর দিয়ে কথা বলে সে।
অপর দিকে পিলার চিন্তা করছে ট্রেনে একজন আগন্তুকের সঙ্গে কথা বলাটা অপরাধ। আবার স্টিফেন যদি নতুন হয় তাহলে একজন যুবতী মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তার অস্বস্তিবোধ করা উচিত ছিল। কিন্তু স্টিফেনের কথাবার্তা ছিল বন্ধুর মতো, তাই সে ভাবল, যে কোনো মানুষের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারে সে।
স্টিফেন নিজে সচেতন না হয়েই বলল-এই লণ্ডন শহরটা খুবই ভয়ঙ্কর জায়গা তাই না?
-হ্যাঁ, আমিও অপছন্দ করি।
–আমারও পছন্দ নয়।
–তুমি কী ইংরেজ?
–আমি ব্রিটিশ, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসছি।
–হ্যাঁ, তোমার কথায় সেটা প্রকাশ পাচ্ছে।
–তুমিও কী বিদেশ থেকে আসছে?
পিলার মাথা নেড়ে বলল-স্পেন থেকে।
স্টিফেন কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করল–তুমি স্পেন থেকে আসছ, তাহলে তো তুমি স্প্যানিশ?
–বলতে পারেন আধা স্প্যানিশ। আমার মা ইংরেজ সেই কারণে আমি ভালো ইংরাজী বলতে পারি।
-যুদ্ধের খবর কী? স্টিফেন বলল।
–খুব খারাপ, ভয়ঙ্কর। তুমি কোন দিকে?
পিলারের রাজনীতির বক্তব্য স্পষ্ট নয়–যে গ্রাম থেকে আসছি সেখানে কেউ যুদ্ধের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না।
–তার মানে সেখানে তোমাদের কারো মধ্যে কোনো বিবাদ নেই?
পিলার তার কথায় মাথা নেড়ে সায় দিল।
–তুমি তাহলে তোমাদের শত্রু সেনোরিটারদের ক্ষমা করবে?
পিলার মাথা নেড়ে বলল–আমার কোনো শত্রু নেই। কিন্তু যদি আমার একজন শত্রু থাকত কিংবা আমাকে ঘৃণা করত তাহলে আমি সেই শত্রুর গলা এইভাবে কাটতাম। বলে হাত নেড়ে শত্রুর গলাকাটা দেখাল।
-তুমি তো দেখছি রক্তের নেশায় পাওয়া তরুণী।
–কেন, তুমি তোমার শত্রুর সঙ্গে কেমন করে মোকাবিলা করবে জানতে পারি কী?
-আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি এই ভেবে যে…প্রসঙ্গ বদলে ফেললো স্টিফেন।-তুমি কী জন্য ইংল্যাণ্ড থেকে এসেছ?
পিলার গম্ভীর হয়ে বলল–আমি আমার এক ইংরেজ আত্মীয়ের সঙ্গে থাকতে যাচ্ছি।
স্টিফেন আশ্চর্য হয়ে গেল–নম্র, ভদ্র একটি ব্রিটিশ পরিবার খ্রীস্টমাসের সময় এই স্প্যানিশ আগন্তুককে নিয়ে কী করতে পারে? তার একটা ছবি মনে মনে এঁকে নিল।
পিলার জিজ্ঞাসা করল–দক্ষিণ আফ্রিকা দেশটা খুব সুন্দর, তাই না?
সেই উত্তর দিতে গিয়ে স্টিফেন দক্ষিণ আফ্রিকার গল্প এমন করে শুরু করল যেমন করে ঠাকুরদা নাতনীকে রঙচরিয়ে রূপকথার গল্প বলে।
কিছুক্ষণ পর যাত্রীরা ফিরে আসতে থাকলে স্টিফেন রূপকথায় ইতি টেনে করিডোরে ফিরে এলো। চলে আসার সময় স্টিফেনের চোখে পড়ল লাগেজের ওপরে লেখা নামটার উপর–মিস পিলার এস্ট্রাভাজেস। তারপর ঠিকানার উপর চোখ পড়তেই চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকমের বড় বড় হয়ে গেল। সেই সঙ্গে একটা আশ্চর্যরকমের প্রতিক্রিয়া হল–গারস্টন হল, লংডেল, এ্যাডেলসফিল্ড।
মুখটা পেছন দিকে ঘুরিয়ে স্থির চোখে মেয়েটিকে সে এক নতুন অনুভূতিহতভম্ব, বিরক্ত সন্দেহভাবে দেখল।
গারস্টন হলে বিরাট নীল ও সোনালী রং-এর ডাইনিং রুমে বসে অ্যালফ্রেড লী এবং তার স্ত্রী লিডিয়া আসন্ন খ্রীস্টমাসে তাদের পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ আলোচনা করছিল। আলফ্রেডের চেহারা ছিল মাঝামাঝি, মুখটা নষ, চোখ দুটো ফিকে বাদামী রং-এর। তার গলার স্বরে ছিল স্পষ্টতা, শান্ত এবং সংযত ভাব। তার স্ত্রী লিডিয়ার চোহারা ছিল তোগাটে। তার রোগা মুখে কোনো সৌন্দর্যের চিহ্ন না থাকলেও কণ্ঠস্বরটা ছিল খুব সুন্দর।
অ্যালফ্রেড বলে উঠল-বাবার মতামতটা একবার নেওয়া প্রয়োজন।
লিডিয়া খুব সতর্কতার সঙ্গে উত্তর দিল–তুমি কিছু মনে করো না, তোমার বাবা খুব খেয়ালী আর অত্যাচারীও।
–তিনি বুড়ো।
–আর তার বয়স যত বাড়বে অত্যাচারের মাত্রাও তত বাড়বে? এর শেষ কোথায় বলতে পারো? আমরা যা করি না কেন সব ব্যাপারেই তিনি খবরদারি করেন, আমরা নিজের ইচ্ছামতো কোনো কাজই করতে পারি না, যদি বা কখন করতে যাই উনি সব ভণ্ডুল করে দেন।
-কিন্তু একথা ভুলো না যে, তিনি আমাদের কাছে খুব ভালো।
–ওহো, উনি আমাদের কাছে খুব ভালো তাই না? তুমি কী আর্থিক দিক দিয়ে বলতে চাইছ? শান্ত কণ্ঠে বলে লিডিয়া।
-হ্যাঁ, ওনার নিজস্ব চাহিদা খুবই অল্প। কিন্তু টাকা দেবার ব্যাপারে এতটুকুও কৃপণতা করেন ।না তুমি তোমার ইচ্ছামতো জামাকাপড় কিনতে পারো, মনের মতো করে বাড়ি সাজাতে পারে। তাতে যতো টাকাই লাগুক না কেন তিনি এতোটুকুও দ্বিধা করেন না। তুমি তো নিজের চোখেই দেখলে গত সপ্তাহতেই তিনি আমাদের একটা নতুন গাড়ি কিনে দিয়েছেন।
আমি তা অস্বীকার করছি না, যে তিনি টাকার ব্যাপারে উদার। কিন্তু তার বদলে তিনি আমাদের সঙ্গে চাকরের মতো ব্যবহার করবেন?
–চাকর?
তাছাড়া, আর কী? হ্যাঁ, অ্যালফ্রেড তুমি ওঁর চাকর ছাড়া আর কী? আমরা যদি কোথাও যাবো বলে স্থির করি, তক্ষুনি উনি বাধা দিয়ে বলবেন, না ওখানে যাওয়া হবে না। ওনার ইচ্ছা মতো উনি আমাদের যেখানে পাঠাবেন সেখানে যেতে হবে। আর তুমিও তো তাই মেনে নাও, ওঁর অন্যায় হুকুম মেনে নেওয়া চাকরের কাজ নয় কী? আমাদের জীবন, স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই।
অ্যালফ্রেড বিরক্ত হয়ে রুক্ষস্বরে বলল–লিডিয়া, আমার ইচ্ছা নয় যে, তুমি এধরনের কথা বল। এটা একটা অকৃতজ্ঞের পরিচয়। আমার বাবা আমাদের জন্য সমস্ত কিছুই করেছেন। তাছাড়া, তুমি ভালো করেই জানো, তুমি ঐ বুড়ো মানুষটির অত্যন্ত প্রিয়।
-না, মোটেই আমি তার প্রিয় নই।
ছিঃ ছিঃ লিডিয়া, তোমার মুখ থেকে এ ধরনের কথা শুনতে খুবই খারাপ লাগছে। অবিবেচকের মতো কথাবার্তা। বাবা যদি বুঝতে পারেন।
–তোমার বাবা খুব ভালো করেই জানেন, আমি ওনাকে অপছন্দ করি। আমার মনে হয় তিনি তাতে আনন্দ পান।
-তুমি খুব ভুল করছো লিডিয়া। জানো তিনি আমাকে প্রায়ই কী বলেন? তোমার স্বভাব তার কাছে খুব মিষ্টি।
অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমার স্বভাব সবসময়েই নষ থাকে এবং চিরকাল থাকবেও। শোন, অ্যালফ্রেড ওঁর সম্পর্কে আমার মনোভাব কী তা আমি তোমাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছি, আমি তোমার বাবাকে পছন্দ করি না। আমার মতে উনি একজন খেয়ালী আর অত্যাচারী বুড়ো। ওঁর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা আর দুর্বলতার সুযোগ নিতে চাইছেন উনি। তাই অনেক আগেই তোমার ওনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত ছিল।
অ্যালফ্রেড তীক্ষ্ণ স্বরে বলে–আমি তাই করবো লিডিয়া। দয়া করে তুমি ওঁর সম্বন্ধে আর কিছু বল না।
আমি দুঃখিত, মনে হয় আমি ভুল করছি-ওসব কথা বাদ দিয়ে এসো আমরা সামনে খ্রস্টমাসের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করি। তা তুমি কী মনে করো তোমার ভাই ডেভিড কী সত্যি সত্যই এখানে আসবে?
–আসবে নাই বা কেন?
লিডিয়া সন্দিগ্ধ চোখে দেখল–বড় আশ্চর্য মানুষ এই ডেভিড। জেনে রাখো বহু বছর হল এ বাড়ির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। সে তোমার মায়ের খুব ভক্ত ছিল। জায়গাটার প্রতি তার একটু ভালোবাসা ছিল।
অ্যালফ্রেড বলল–এও আমার জানা আছে, যে, উত্তেজনার বশে বাবা হয়তো কোন সময়ে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে থাকবেন। তবু আমার মনে হয় ডেভিড আর হিলডা খ্রীস্টমাসের সময় ঠিক আসবে। তুমি দেখো।
লিডিয়া মুখটা বিরক্ত করে বলল–জর্জ আর ম্যাগজলেন সম্ভবতঃ আগামীকালই এসে পৌঁছাবে। আমার ভয় যে, ম্যাগজলেনের একঘেয়ে লাগবে।
কেন? জর্জ কী তার থেকে কুড়ি বছরের ছোট মেয়েকে বিয়ে করেছে? এটা আমি ভাবতেও পারি না, কারণ, জর্জ খুব একটা চালাক ছিল না।
–না, সে তার জীবনে খুবই সফল। নির্বাচন কেন্দ্রের লোকেরা তাকে খুব ভালোবাসে। আমার বিশ্বাস রাজনীতির ক্ষেত্রে ম্যাগজলেন তার হয়ে খুবই পরিশ্রম করে।
-ম্যাগজলেনকে আমার খুব ভালো লাগে। তাকে দেখতে খুব সুন্দর। কিন্তু মাঝে মাঝে তার কী মনে হয় জানো? গোলাপের মতো সুন্দর সুন্দর মেয়েদের ও একজন। আরো ভালো করে বলতে গেলে ওর মিষ্টি চেহারা, মিষ্টি ব্যবহারের উপর যেন একটা মেঘের আস্তরণ ছড়ানো আছে।
–মানে তারা ভেতরে ভেতরে খুব খারাপ। লিডিয়া তাকে বলল–অ্যালফ্রেড তুমি এইরকম আশ্চর্য কথা বলতে পারলে? আমি জানতাম তোমার ভেতরটা ভদ্র, খারাপ কথা তুমি কাউকে বলতে পারো না। আমার মাঝে মাঝে তোমার উপর রাগ হয় কেন জানো? তুমি কোনো কোনো ব্যাপারে সন্দেহপ্রবণ নও এবং এই পৃথিবী সম্পর্কে তোমার জ্ঞানও খুব সীমিত।
তার স্বামী হাসল।–তোমার মতো এ পৃথিবী সম্পর্কে সবসময়েই আমি। না! একজনের মনের মধ্যেই কেবল অসৎ বাসা বাঁধেনি, অসৎ চারিদিকেই ছড়িয়ে আছে। এ পৃথিবীর অসৎ অন্যায়, অসাধুতা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই। কিন্তু তা আমার আছে।
আমি সেটা সবসময়ই উপলব্ধি করতে পারি এই বাড়িতে, এইখানে। লিডিয়া মুখটা ঘুরিয়ে নিল।
-লিডিয়া..অ্যালফ্রেড তার কথা শেষ না করতেই ঘাড় ঘোরাতে দেখল মসৃণ মুখের একজন কালোলোক তার দিকে সশ্রদ্ধচিত্তে তাকিয়ে আছে।
লিডিয়া কঠিন স্বরে বলল-খবর কী-হারবারি:
হারবারি নীচু গলায় বিনীতভাবে বলল–ম্যাডাম, খ্রীস্টমাসের সময় আরো দুজন অতিথি আসবে সেকথা আপনাকে বলতে বললেন, আর তাদের জন্য ঘর ঠিক করে রাখতে বললেন।
লিডিয়া চমকে উঠে বলে আরো দুজন অতিথি?
হারবারি নরম গলায় বলল-ম্যাডাম একজন ভদ্রলোক ও আর একজন তরুণী।
অ্যালফ্রেড অবাক হয়ে বলল-তরুণী?
-হ্যাঁ, স্যার মি. মিলি সেই কথাই বলছিল।
লিডিয়া সঙ্গে সঙ্গে বলল–আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে ওপরে যাচ্ছি।
–ম্যাডাম, আমায় ক্ষমা করবেন। মিঃ লী এখন ঘুমোচ্ছেন তিনি আমায় একথাও বলে দিয়েছেন যে এখন কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করে।
হারবারি চলে যেতেই লিডিয়া বলল–এবার বুঝতে পারলে তো কেন আমি লোকটাকে পছন্দ করিনা। বেড়ালের মতো কেমন চুপচাপ বাড়িতে চলাফেরা করেন। তার চলার শব্দ কেউ শুনতেও পায় না।
লোকটিকে আমিও অপছন্দ করি। কিন্তু একটা কথা কী জান আজকালকার দিনে একটা ভালো পুরুষ নার্স পাওয়া কঠিন। আর তাছাড়া লোকটা ভালো কাজ জানে। আসল যে ব্যাপারটা হল বাবা ওনাকে পছন্দ করেন।
-সেটা না হয় হল কিন্তু অ্যালফ্রেড ঐ তরুণী লেডিটি কে?
তার স্বামী মাথা নেড়ে বলল তারও অজানা, তারা দুজনে দুজনকে দেখল। লিডিয়া আবার বলল–আমি কী চিন্তা করছি জান অ্যালফ্রেড? আমার ধারণা তোমার বাবা একঘেয়েমিতে ভুগছেন। তাই খ্রীস্টমাসে একটা নতুন বৈচিত্র্য আনতে চান।
আমাদের পরিবারে দুজন নুতন লোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে? বেচারা বুড়ো হয়েছে তাছাড়া খোঁড়া পায়ের জন্য পঙ্গু হয়ে আছেন অথচ কিছুদিন আগেও তার জীবন ছিল নানা অভিযানে পূর্ণ।
লিডিয়া আচমকা রাগে চিৎকার করে উঠল, তার কপাল যে তোমার মতো ছেলে পেয়েছিলেন। তুমি ওঁর এতো প্রিয় কেন জানো, তুমি ওঁকে পুজো কর বলে।
অ্যালফ্রেড উল্টে প্রতিবাদ করল।–তোমার বাড়াবাড়ির মাত্রাটা একটু বেড়ে যাচ্ছে। এটাতো অস্বাভাবিক কিছু নয়, ছেলে তার বাবাকে ভালোবাসবে, শ্রদ্ধা করবে, করাটাই স্বাভাবিক। অ্যালফ্রেড লিডিয়ার হাতের উপর হাত রেখে নরম ভাবে বলল–তোমার চিন্তার সঙ্গে সবকিছু আগে আগে যায়। এতে তোমার ঈর্ষার তো কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না।
লিডিয়া অনুশোচনা ভরা ঠোঁটে তাকে একটা চুমু খেল।
লিডিয়া বলল–এখন অবধি যখন আমি জানতে পারলাম না, আমার সেই রহস্যজনক অতিথি কে? তখন আমি বাগান পরিচর্যা করতে চললাম।
–প্রিয়া, বাইরে খুব ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া কীরকম তীরের মতো গায়ে ফুটছে দেখছ না?
–সারা শরীর গরম জামাকাপড়ে ঢেকে নিলেই হবে।
লিডিয়া ঘর থেকে চলে গেল। অ্যালফ্রেডের একা একা ঘরে থাকতে ভালো লাগছিল না। লিডিযা খেয়াল করেনি কখন সে চুপচাপ গলায় মাফলার গায়ে কোট চাপিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। লিডিয়া ততক্ষণে দুটো পাথরের মাঝখানে ছোট ছোট কয়েকটা ক্যাকটাস গাছের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। এটাই আমি চাইছিলাম।
তোমার কাজের শেষ নিদর্শন লিডিয়া। একটু ইতস্তত করে সে বলল–এই যে এগুলো? তোমার কী এগুলো পছন্দ, অ্যালফ্রেড?
এগুলো রোদে পুড়ে শুকনো হয়ে গেছে তাই না?
এগুলো আমার মতে মৃত সমুদ্র।
এগুলো অন্য সব ফুলের মতো তেমন আকর্ষণীয় নয়।
ঠিক সেই সময় জোরে একটা পদশব্দ শোনা গেল। বৃদ্ধ খানসামা, একমাথা সাদা চুল সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়েছে। তাদের দিকে তাকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল।
-ম্যাডাম, মিস জর্জ লী ফোন করে জানতে চাইছেন তিনি এবং মিঃ জর্জ আগামীকাল ৫টা ২০ মিনিটে এলে অসুবিধা হবে?
-না না, ওকে বল ঐ সময় আসতে।
—ধন্যবাদ ম্যাডাম।
খানসামা তাড়াতাড়ি চলে যেতেই লিডিয়া বলে-বুড়ো ট্রেসিলিয়ান, এই বয়সেও কী পরিশ্রম করতে পারে, দেখেছে। ওকে ছাড়া আমি কিছু চিন্তাই করি না।
অ্যালফ্রেডও মাথা নেড়ে সায় দিল।
কথার ফাঁকে লিডিয়া তার বাগান পরিচর্যার কাজও শেষ করলো।
ক্যাকটাস গাছগুলোর ওপর ছাউনির কাজ শেষ করে সে বলে উঠল–এবার আমি তৈরী।
অ্যালফ্রেড বোকার মতো বলল-তৈরী!
লিডিয়া হেসে ফেলল।
খ্রস্টমাসের জন্য। আমাদের এই চিন্তাশীল পরিবারের জন্য আমরা বারে আমাদের খ্রীস্টমাসের আয়োজন করতে যাচ্ছি।
ডেভিড তার পত্রখানি আর একবার পড়ে দেখছিল। তার স্ত্রী তাকে চুপচাপ নিরীক্ষণ করছিল। দ্বিতীয়বার চিঠিটা পড়ার পর সে বলল-ডেভিড শোন, সবকিছু তোমার উপলব্ধির উপর নির্ভর করছে।
হিলডা খুব সুন্দর না হলেও তার মনটা ছিল উদার এবং তার মধ্যে একটা যাদুকরী গুণ ছিল। অনেকটা জলছবির মতো। এছাড়া স্বীকার করতেই হয় হিলডা লীর মধ্যে বাড়তি একটা তেজ ছিল।
ডেভিড চারদিকে পায়চারি করতে থাকে। তার চুল এখনো পাকেনি। তার ছেলেমানুষী চেহারাটা সত্যিই আশ্চর্যের।
ডেভিড বলল–হিলডা তোমাকে বারবার আমার মনোভাবের কথা জানিয়েছি। আমি আমাদের বাড়ি দেশের পরিবেশ সবকিছুকে ঘৃণা করি। আমি যখন আমার বাবার কথা চিন্তা করি তখন আমার মার কথা মনে পড়ে যায়। আমার মার বিষণ্ণতার মূলে ছিলেন তিনি। প্রেমঘটিত ব্যাপার। আমার মার প্রতি ওনার বিশ্বাসঘাতকতা আমার ঘৃণাকে আরো বাড়িয়ে দেয়।
হিলডা বলে ওখানে তার পড়ে থাকার কোন অর্থ হয় না। অনেক আগেই তার চলে যাওয়া উচিত ছিল তাহলে তিনি আবার নতুন জীবন শুরু করতে পারতেন।
ডেভিডের মেজাজ হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল, যেটা সে সময় অসম্ভব ছিল–তুমি জানো না, ঐ সময় মহিলারা ওরকম ব্যবহার করতে পারত না, তাছাড়া আমার মার চিন্তাধারা হল সব স্ত্রীদের স্বামীর ঘরেই থাকা উচিত। এছাড়া এটা তার নিজের ঘর। তিনি যাবেনই বা কোথায় আর ডিভোর্স করলেই বা কী হতো, বাবা হয়তো আবার বিয়ে করতেন। আর একটা পরিবারের জন্ম হতো; তখন আমাদের অবস্থা আরো খারাপ হতো। মা এইসব কথা চিন্তা করেছিলেন।
হ্যাঁ, তবে আমার মনে হয় তুমি বিশেষ কিছু জানোনা ডেভিড।
-হ্যাঁ, তিনি আমাকে সব কিছু বলে গেছেন। আমি যে তাকে কী রকম ভালোবাসতাম তা তিনি ভালো করেই জানতেন। যখন তিনি মারা যান, তার গলার স্বর বন্ধ হয়ে আসে। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলেন। জানো হিলডা, কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার একেবারে একাকী জীবন। তিনি তখন প্রায় যুবতী। তাঁর মৃত্যুর কোনো দরকার ছিল না। কিন্তু তিনি তাঁকে খুন করেছিলেন।…আমার বাবা। তাঁর মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী। তিনি আমার মার বুক ভেঙে ছিলেন। সেই সময় আমি ঠিক করি যে, তার ছত্রছায়ায় আর থাকব না।
হিলডা তাকে সমর্থন জানিয়ে বলে–তুমি বিবেচকের মতো কাজ করেছ। তুমি ঠিক করেছ।
-বাবার ইচ্ছা ছিল আমি ওয়ার্কস-এ যাই। তার বাড়িতে থাকি। কিন্তু আমি তাকে একদম সহ্য করতে পারিনি। তার প্রস্তাবটা আমি প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। কিন্তু জানিনা অ্যালফ্রেড কী করে এতদিন ধরে সহ্য করে আসছে। অ্যালফ্রেডের আর্মিতে যাবার সব ব্যবস্থাই বাবা করে দিয়েছিল। অ্যালফ্রেড বড় ছেলে ক্যালভোনরি রেজিমেন্ট যাওয়ার কথা। হ্যারির যাওয়ার কথা ছিলো ওয়াকর্স-এ যেমন আমার আর জর্জের রাজনীতিতে প্রবেশ করার কথা।
-কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি এই তো?
ডেভিড মাথা নাড়ল-হ্যারিই সমস্ত ব্যবস্থা বানচাল করে দেয়। তাকে সর্বক্ষণ ভয়ঙ্কর বলে মনে হতো। তার অনেক ঋণ হয়ে গিয়েছিল। আরো অনেক গণ্ডগোল ছিল। অবশেষে একদিন সে কয়েক হাজার পাউণ্ড নিয়ে পালিয়ে যায়। টাকাটা অবশ্য ওর ছিল না। একটা ছোট্ট চিঠি লিখে সে বলে যায়, অফিসের কাজ তার ভালো লাগছে না, তাই সে পৃথিবী পরিক্রমায় বেরোচ্ছে।
-তার আর কোনো সংবাদ পাওনি?
ডেভিড হেসে বলল–যা পেয়েছি। প্রায় সংবাদ পেতাম, টাকার জন্য খবর পাঠাতত সেটা পেয়েও যেত।
–আর অ্যালফ্রেড।
আমার বিশ্বাস সে বাবার কলের পুতুল হয়ে গেছে।
–আর তুমি তার হাত থেকে রেহাই পেয়ে গেছ, তাই না?
–আমি তার পর লণ্ডনে গিয়ে পেন্টিং নিয়ে পড়াশোনা করি। বাবা আমাকে হুমকি দেন যে, বাড়ি ছাড়লে আমি ঠিক করব না। শুধু তিনি বেঁচে থাকতে তার কাছ থেকে মাসোহরা বাবদ কিছু টাকা পাবে। এছাড়া তার মৃত্যুর পর তার কাছ থেকে আর কিছুই পাবো না। আমি যে মূর্খ সেটা আমায় জানিয়ে দিলেন। এরপর আমি আর তাকে দেখিনি।
হিলডা সহজভাবে প্রশ্ন করল তার জন্য তোমার দুঃখ হয় না?
-না, আমি হয়তো কোনোদিনই বড় শিল্পী হতে পারব না। তবে আমি আমার এই ছোট্ট কুটীরে বেশ সুখেই আছি। তুমি আমার মৃত্যুর পর তোমার নামে জীবন বীমা করা মোটা টাকা পাবে। সে আবার বলতে থাকে, চিঠিতে সে খ্রীস্টমাসের সময় স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি যাবার জন্য লিখেছে। তার আশা আমাদের পরিবারের সবাই আবার একসঙ্গে হই। এর মানেটা কী বলতে পারো?
-তোমার বাবা এখন বৃদ্ধ হয়েছেন। তার পরিবারের এরকম অচল অবস্থা বোধহয় ওনাকে চিন্তান্বিত করে তুলেছে, তিনি তার অবসান ঘটাতে চান। এইরকম হয়েই থাকে।
ডেভিড আস্তে আস্তে বলে–আমারও তাই মনে হয়। এখন হিলডা তুমিই বল আমায় যেতে দেবে, না দেবে না?
প্রশ্নটা খুবই স্পর্শকাতর। আমি একটু সেকেলে গোছের মেয়ে, বলতে সাহস হয় না তবু বলছি খ্রীস্টমাসের সময় যদি একটু সুখ আর শান্তি হয় তবে কী কোনো অসুবিধা হবে?
-আমি তো তোমায় অতীতের সব ঘটনার কথাই বলেছি। তবু তুমি কী আমায়…
হিলডা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে–প্রিয়তম আমি জানি। তবে অতীত অতীতই, যা হবার তো হয়েই গেছে। আমি বলি কী তুমি তোমার মধ্যে অতীতকে জীবন্ত রেখে বর্তমানের কথা ভাব।
-কিন্তু হিলডা আমি যে আমার অতীতকে কোনোমতেই ভুলতে পারছি না।
–অতীতকে ভুলে যেতেই হয়। আমার মনে হয় আমরা যদি অতীতকে ধরে বসে থাকি তাহলে আমরা একদিন শেষ হয়ে যাবো। তাছাড়া আমার ধারণা তখন তুমি ছোট ছিলে, তোমার বোঝার ক্ষমতাও তখন ভালো করে হয়নি। তাই তুমি আমার বাবাকে ঠিক বুঝতে পারোনি। এখন বোঝার বয়স হয়েছে। এখন তুমি তোমার চোখ দিয়ে সবকিছু দেখতে পাবে। আমার মনে হয় তুমি যদি এখনকার চোখ দিয়ে তাকে দেখ তাহলে তুমি বুঝতে পারবে তিনি একজন সাধারণ মানুষ। তখন হয়তো তার মধ্যে কিছুটা আবেগ ছিল। সেই আবেগই তাকে ছুটিয়েছে শুধু। তিনি হয়তো সেরকম মানুষ। যার ওপর কোনো দোষ দেওয়া যায় না। এছাড়া, তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি মানুষ, অমানুষ নন।
-তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না, আমার মার প্রতি তার ব্যবহার।
হিলডা গম্ভীর ভাবে বলে-নম্রতা, ভদ্রতা বলে একটা কথা আছে, যা হয়তো কোনো কোনো কারণে একটা সময় মানুষের মন খারাপের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে। হয়তো অন্যের সঙ্গে একটা পার্থক্য থাকতে পারে। এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এতে তাকে দোষ দেওয়া যায় না।
তার মানে তুমি বলতে চাও দোষটা আমার মারই।
হিলডা আপত্তি জানিয়ে বলে–না আমি তা বলছি না। আমি নিঃসন্দেহ যে, তোমার মার প্রতি তোমার বাবা দুর্ব্যবহার করেছিলেন। তবে একটা ব্যাপার কী জান, বিয়েটা কোনো সাধারণ জিনিষ নয়, আমার সন্দেহ বাইরের কেউ, এমন কী নারী পুরুষের বিবাহের ফসল অর্থাৎ তাদের একটা ছেলেরও এ ব্যাপারে বিচার করার অধিকার নেই। তাছাড়া তোমার এখনকার দুঃখবোধ কোনোভাবেই তোমার মাকে এখন সাহায্য করতে পারবে না। সব শেষ হয়ে গেছে। সেসব ঘটনা তুমি পেছনে ফেলে এসেছ। এখন আছে এক পঙ্গু, বৃদ্ধ মানুষ যিনি শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর দিন গুনছেন। তিনি তার ছেলেকে খ্রীস্টমাসের সময় বাড়িতে ফিরে যেতে বলেছেন।
–তাহলে তুমি আমায় যাবার অনুমতি দিচ্ছ?
হিলডা একটু চিন্তা করে নিয়ে মনটা ঠিক করে নিল, সে বলল-হা, আমি চাই তুমি তোমার সব মান অভিমান ভুলে চিরকালের মতো ওখানে যাও।
ওয়েস্টারিংহামের এম.পি. জর্জ লী যথার্থ ভদ্রলোক। একচল্লিশ বছর বয়স, তার চোখ দুটো নীল, স্বচ্ছ এবং ফ্যাকাশে। তবে চোখে একটু সন্দেহের ছাপ থেকেই যায়। তার কথাবার্তার মধ্যে একটা ব্যক্তিত্বের ছাপ ধরা পড়ে।
–আমি তো তোমায় বলেছি ম্যাগজলেন, যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বলি, আমার মনে হয় যাওয়াটা কর্তব্য।
তার স্ত্রী ধৈর্য হারিয়ে গা ঝাঁকালো। তার গড়নটা ছিল রোগা, চুলটা সোনালী, জ্বটা প্লাক করা, মুখটা ডিম্বাকৃতি। এক এক সময় তার মুখটা ভাবলেশহীন হয়ে পড়ে। এখনও তাকে সেইরকম দেখাচ্ছিল।
সে বলে উঠল-প্রিয়তম আমি নিশ্চিত যে সেটা দুর্দান্ত হবে।
হঠাৎ তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মুখ দেখে মনে হল তার মাথায় যেন একটা বুদ্ধি খেলে গেছে। সে বলল-হা, খ্রীস্টমাসের সময় আমরা আমাদের খরচ কমাতে পারব। খ্রীস্টমাস যে একটু ব্যয়বহুল সেটা সবাই জানে। আমরা যদি সেইসময় চাকর বাকরদের ছুটি দিয়ে দিই তাহলে ব্যয় কিছুটা কমবে।
ম্যাগজলেন বলল–সেটা তো খুব ভালো কথা। সব জায়গাতেই খ্রীস্টমাস খুব বড় ব্যাপার। ম্যাগজলেন একটু থেমে তারপর বলে–জর্জ তোমার বাবা খুব বিত্তবান, কোটিপতি বলা যায়। যায় না?
–আমার মনে হয় ডবল কোটিপতি।
ম্যাগলেজ একটু ঈর্ষার ভাব মেশানো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে–এত টাকা তিনি কী করে পেলেন? দক্ষিণ আফ্রিকায়?
-হ্যাঁ, প্রথম জীবনে তিনি হীরের ব্যবসা করে প্রচুর টাকা করেছেন। তারপর ইংলণ্ডে এসে নতুন করে ব্যবসা ফেঁদে সেই টাকা দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণ করেন।
–তার মৃত্যুর পর এত অর্থ সম্পত্তি কীভাবে ভাগ হবে তুমি জানো?
-বাবা এই সব ব্যাপারে খুব একটা কথা বলেন না। তবে আমার ধারণা তার অর্থের সিংহভাগ পাবে অ্যালফ্রেড আর আমি। অ্যালফ্রেড অবশ্য আমার থেকে একটু বেশী পাবে। আমার আর এক ভাই ডেভিড, সে বিশেষ কিছু পাবে না, কারণ, সে বাবার অমতে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় চিত্রশিল্পী হওয়ার জন্য। বাবা তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবে বলে শাসিয়েও ছিল। উত্তরে সে বলেছিল ওঁর টাকার তোয়াক্কা সে করে না। আর আছে আমার বোন জেনিফা। একজন বিদেশী আর্টিস্টের সঙ্গে দেশ ছেড়ে সে চলে যায়। কিছুদিন আগে সে মারা গেছে। তার একটা মেয়ে আছে। আমার মনে হয় বাবা তাকে কিছু দিয়ে যাবেন। আরো একজন আছে তার নাম হ্যারি।
একটা অস্বস্তিবোধ তাকে থামিয়ে দেয়।
ম্যাগজলেন অবাক হল-কে এই হ্যারি?
–আঃ আমার ভাই সে।
–কিন্তু তোমার যে আরো একটা ভাই আছে সে কথা তো আগে শুনিনি।
শোন প্রিয়তমা, সে খুব একটা বিখ্যাত লোক নয়। সেই কারণে তার নাম তোমার কাছে আমরা করিনি। অনেকদিন তার কোনো খবর নেই। মনে হয় সে মারা গেছে।
ম্যাগজলেন হঠাৎ হেসে উঠল।
–তুমি হাসছ কেন? কী ব্যাপার?
–ম্যাগজলেন হাসতে হাসতে বলে-হাসির কথা বললে হাসব না? আমি এখন তোমার ভাই হ্যারির কথা চিন্তা করছি। সে অখ্যাত আর তুমি কতই না বিখ্যাত। কিন্তু জর্জ তোমার বাবা তো খুব একটা বিখ্যাত নন। শেষে অভিমানের সুরে বলেন, মাঝে মাঝে তিনি আমাকে এমন এমন কথা বলেন যে আমার শুনতে খুব খারাপ লাগে।
-ম্যাগজলেন তোমার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। লিডিয়াও কী এই রকম কিছু ভাবে?
-না, লিডিয়াকে সেরকম কিছু বলে না। ম্যাগজলেন ক্রুদ্ধ স্বরে বলে–জানি না কেন তাকে কিছু বলেন না।
সে যা হোক এই বয়সে বাবাকে সবার ক্ষমা করা উচিত। তাছাড়া, ওনার শরীর খুব একটা ভালো নয়।
-আচ্ছা, জর্জ, তোমার বাবার শরীর সত্যিই কী খারাপ?
–আমি তা কী করে জানাব? তবে তিনি যখন পরিবারের লোকদের একসঙ্গে দেখবার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন, তখন আমাদের সবার যাওয়াই উচিত। হয়তো এটাই তার শেষ খ্রীস্টমাস। অতএব আমরা যে বাড়িতে গিয়ে ঠিক কাজই করবো। তাতে সন্দেহ নেই।
-কিন্তু আমার ঘেন্না করে। অ্যালফ্রেড একটা গবেট। লিডিয়া কথায় কথায় আমাকে ধমকায়। আর ঐ জানোয়ারের মতো চাকরটা।
-কে বৃদ্ধ ট্ৰেলিলিয়ান?
–না, হারবারি। বেড়ালের মতো নিঃশব্দে চলাফেরা করে আর বোকার মতো হাসে। সে যাই হোক ঐ নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই ওই বুড়ো লোকটিকে কোনো অজুহাতে অপমান কোরো না। আমি বরং লিডিয়াকে জানিয়ে দিচ্ছি, আগামীকাল ৫-২০ মিনিটে আমরা যাচ্ছি। ম্যাগজলেন মাথা নীচু করে ঘর থেকে চলে গেলো।
গরস্টন হলের দোতলায় লম্বা বারান্দা পার হয়ে একটা বিরাট ঘর। পুরোনো ফ্যাশানে ঘর সাজানো। সবকিছুই চমৎকার, দামী এবং মজবুত। ঐ বৃদ্ধ মানুষটা আরাম কেদারায় বসে থাকেন। তাঁর পরনে নীল রং-এর নোংরা ড্রেসিং গাউন। পায়ে কার্পেট চটি। তার চুল সাদা এবং তার মুখের চামড়া হলদেটে। তাঁর চেহারাটা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। তাঁর নাকটা ঈগলের ঠোঁটের মতো বাঁকানো, চোখ দুটো গভীর এবং ভয়ঙ্কর জীবন্ত। এসব দেখেশুনে প্রত্যক্ষকারীকে মত পরিবর্তন করতে হবে। আগুনের মত তেজদীপ্ত প্রাণশক্তিতে তার জীবন ভরপুর।
রাজহংসের মতো ভক-ভক আওয়াজ করে বললেন-সাইমন লী, মিসেস অ্যালফ্রেডকে সংবাদ দিয়েছে।
হারবারি তার চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়েছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সে উত্তর দিল-হ্যাঁ, স্যার, আপনি আমাকে যা যা বলতে বলেছিলেন আমি তাই তাই বলেছি ওদের।
-খুব ভালো…ওরা সারাটা বিকেল নিশ্চয় খুব ভেবেছে। আমি ওদের জন্য বসে আছি। ওদের নিয়ে এসো।
-হা স্যার। বলে সে চুপচাপ চলে গেলো।
হারবারির দিকে স্থির দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে বৃদ্ধ লী নিজেই নিজেকে অভিশাপ দেয়। লোকটি সত্যিই নিঃশব্দে বেড়ালের মতো হাঁটে, কোথায় কখন থাকে বোঝা যায় না।
তিনি শান্ত ভাবে চেয়ারে বসেছিলেন, ঠিক সেই সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল। অ্যালফ্রেড ও লিডিয়া ভেতরে ঢুকলো।
-আহ, তোমরা এসে গেছ? লিডিয়া এসো, আমার কাছে এসে বস।
–অ্যালফ্রেড জিজ্ঞাসা করল–কেমন আছ বাবা? দুপুরে তোমার ঘুম হয়েছিল তো?
-খুব সুন্দর, পুরোনো দিনের স্বপ্ন দেখলাম। এখানে চিরকালের মতো স্থিত হয়ে আর সমাজের স্তম্ভ হয়ে বসার আগে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখলাম, কক-কক আওয়াজ করে তিনি হেসে উঠলেন।
তার পুত্রবধূ নিঃশব্দে হাসতে লাগল।
অ্যালফ্রেড এবার কাজের কথাটা বলল–বাবা ব্যাপারটা কী? শুনলাম খ্রীস্টমাসের সময় আরো দুজন অতিথি আসছে। তারা কারা?
-হ্যাঁ, তাদের সম্পর্কে আমি তোমাদের অবশ্যই বলব। এবছরটা আমার কাছে হবে গ্র্যাণ্ড খ্রস্টমাস। আমাকে একবার দেখতে দাও এখানে কে কে আসছে। জর্জ আর ম্যাগজলেন আসছে।–বুড়ো সাইমন বলেন-বেচারা জর্জ গ্যাসব্যাগ ছাড়া সে আর কিছুই নয়। তবু সে আমার পুত্র।
অ্যালফ্রেড বলে-তার নির্বাচন কেন্দ্রের লোকেরা তাকে পছন্দ করে।
সাইমন আবার কক কক করে আওয়াজ করলেন-তারা মনে করে সে সৎ! এখনো কোনো লী-ই সৎ হতে পারেনি।
-ওঃ বাবা…
–হা পুত্র, তুমি অবশ্য তার ব্যতিক্রম। লিডিয়া প্রশ্ন করল–আর ডেভিড?
বহুবছর পরে ওকে দেখার কৌতূহল আমার অনেক। বেচারা বড় ছেলেমানুষ আর অভিমানী। আমি ভাবছি ওর স্ত্রী কেমন হবে? সে তার বয়স থেকে কুড়ি বছরের ছোট কোনো মেয়েকে বিয়ে করেনি তো? ঐ বোকা জর্জের মতো।
লিডিয়া বলল–খুব সুন্দর একটা চিঠি লিখেছে হিলডা। এইমাত্র তার একটা বার্তা পেলাম। তারা অবশ্যই আগামীকাল এসে পৌঁছাবে।
শ্বশুরমশাই কৌতূহল সহকারে তার দিকে তাকিয়ে বললেন–আমি তো কখনো লিডিয়ার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখতে পাই না। লিডিয়া, আমি তোমাব সম্বন্ধে কী বলি জান, তুমি একজন ভালো বংশের সুশিক্ষিতা মেয়ে, এটাই তোমার প্রকৃত পরিচয়। তুমি ভালো ভালো কথা বল, এটা একটা বংশের ব্যাপার। তুমি আমার প্রতি যেরকম যত্ন নাও আর কেউ তা নেয় না।
এবার তার চোখদুটো আনন্দে নেচে উঠল–এখন অনুমান করে বলত খ্রীস্টমাসের সময় কারা কারা আসছে? তোমাকে আমি তিনটে নাম বলতে বলব। কিন্তু আমি বাজী রেখে বলতে পারি তুমি তা পারবে না। তিনি তিনজনের মুখের দিকে তাকাতে থাকেন। অ্যালফ্রেড ক্রু কুঁচকে বলে–আপনি নাকি একটা যুবতী মেয়েকে চঞ্চল করে দিয়েছেন?
-আমি আন্দাজ করতে পারি তোমার সেটাই হয়েছে। তবে বলি শোন, পিলার যে কেননা সময় এখানে এসে পরবে।
অ্যালফ্রেড রুস্বরে জিজ্ঞাসা করল–পিলার?
–পিলার একটা ভাডোস। জেনিফারের একমাত্র কন্যা, আমার নাতনী। তার কী পছন্দ তাই চিন্তা করছি।
অ্যালফ্রেড উঁচু গলায় বলল–তুমি তো আগে আমায় একথা জানাওনি কখনো।
বৃদ্ধ দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলেভেবেছিলাম গোপন রাখব। এখানে আসার জন্য চার্লটনকে দিয়ে ওকে পত্র লেখাই। এই বাড়ির একই ছাদের তলায় ঐ তরতাজা মেয়েটাকে কেমন দেখায় তাই দেখতে চাই একবার। পিলারকে আমি কখনো দেখিনি। জানি না তাকে কার মতো দেখতে হয়েছে? বাবা না মার মতো।
অ্যালফ্রেড সবদিকে বিচার করে তার মতামত জানায়–বাবা তুমি কী মনে কর কাজটা ঠিক হচ্ছে?
বৃদ্ধ তার কথায় বাধা দিয়ে বলে–নিরাপত্তা আর নিরাপত্তা–তুমি খুব বেশী নিরাপত্তার কথা চিন্তা করছ অ্যালফ্রেড। আমার সেটা ভাববার বিষয় নয়। তুমি যাই চিন্তা করো না কেন আমার একটাই কথা যে, সে আমাদের পরিবারের একমাত্র নাতনী এবং আমার নাতনী। ওর বাবা কী করেছিল কে ছিল তা নিয়ে আমার মাথা ঘামাবার দরকার নেই। ওর সঙ্গে যে আমার রক্তের সম্পর্ক আছে এটাই বড় কথা। আর একথাও বলছি সে আমার বাড়িতে বাস করতেই আসছে।
লিডিয়া তীক্ষ্ণ মেজাজে বলল–ও এখানে বসবাস করতে আসছে?
–তিনি তার চেয়েও তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞাসা করল, কেন তাতে তোমার আপত্তি আছে?
লিডিয়া মৃদু উত্তর দিল–আপনার বাড়িতে কেউ এসে থাকবে তাতে আমার আপত্তির কী আছে–আমি শুধু মেয়েটি সম্পর্কে চিন্তা করছি।
তুমি মেয়েটি সম্পর্কে কী বলতে চাইছ? এখানে কী ও সুখে থাকবে? এই পৃথিবীতে কী ওর এক পেনিও নেই? ওকে ধন্যবাদ জানাতেই হবে। তারপর অ্যালফ্রেডের দিকে তাকিয়ে বলল–এটা একটা বড় খ্রীস্টমাস হতে চলেছে। আমার সব ছেলেরা ওকে ঘিরে থাকবে। তোমাকে একটা সংকেত দিয়ে রাখলাম। বলতো অপর অতিথিটা কে?
অ্যালফ্রেড তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে দেখল।
–আমার সব ছেলেরা মানে তার মধ্যে তোমার ভাই হ্যারিও আসছে।
অ্যালফ্রেডের মুখটা চুপসে গেল। আমতা আমতা করে বলল–কিন্তু আমরা তো জানি সে আর বেঁচে নেই।
-না সে মরেনি।
–এতকিছুর পরও তুমি তাকে ফিরিয়ে আনছ?
–তুমি ঠিকই বলছ ও একটা বাউণ্ডুলে ছেলে। তবুও আমরা তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাবো।
–কিন্তু সে আমাদের সবাইকে বিরক্ত করে তুলেছিল।
–তার অপরাধের ময়লা ঘাটাবার প্রয়োজন নেই। শুধু একটা কথাই মনে রাখো যে, খ্রীস্টমাস উৎসব হচ্ছে ক্ষমা করার উৎসব। ওকে আমরা আমাদের বাড়িতে সাদরে অভ্যর্থনা জানাবো।
অ্যালফ্রেড উঠে দাঁড়ালো এবং মনে মনে বলল–এটা নেহাৎই একটা সখ। আমি কোনো দিনই ভাবিনি হ্যারি আবার এই চার দেওয়ালের মধ্যে ফিরে আসবে।
সাইমন সামনের দিকে মাথা নোয়ালেন। নরম স্বরে বললেন–আচ্ছা, তুমি তো হ্যারিকে কোনোদিন পছন্দ করতে না করতে কী? সে যাইহোক অতীতের ঘটনা এখন অতীতই, খ্রীস্টমাসের এটাই মূলনীতি। তাই না লিডিয়া?
লিডিয়ার মুখটা অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল। সে শুকনো গলায় বলল–দেখা যাচ্ছে, এবার খ্রস্টমাসে আপনি ভালো ব্যবস্থাই করছেন।
–আমার ইচ্ছা আমার পরিবারের সকলে শান্তি আর শুভেচ্ছা নিয়ে আমার চারপাশে ঘিরে থাকুক। তোমরা কী চলে যাচ্ছ?
অ্যালফ্রেড ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। লিডিয়া তাকে অনুসরণ করল।
অ্যালফ্রেড উত্তেজিত হয়ে চলে যেতে দেখে, সাইমন বলে উঠলেন–হ্যারির ফিরে আসার সংবাদে অ্যালফ্রেডের মাথা গরম হয়ে গেছে। হ্যারি আর ও কখনো মিলেমিশে থাকতে পারেনি। হ্যারি সবসময় ওকে ঠাট্টা করে বলতে শ্লথ তবে নিশ্চিত।
লিডিয়া কিছু একটা বলবে বলে ভেবেছিল কিন্তু বুড়ো লোকটা কষ্ট পাবে ভেবে চুপ করে গেল।নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখল। সে কথাটা একটু ঘুরিয়ে বলল-কচ্ছপ আর খরগোসের দৌড়ে শেষপর্যন্ত কিন্তু কচ্ছপেরই জিৎ হয়।
সাইমন বলে উঠল–না লিডিয়া সব সময় তা হয় না।
লিডিয়া মৃদু হেসে বলল–আমাকে ক্ষমা করবেন, আমাকে এক্ষুনি অ্যালফ্রেডের কাছে যেতে হবে। ও উত্তেজনা হলে ঘাবড়ে যায়।
সাইমন কক কক করে হেসে উঠলেন–অ্যালফ্রেড কোনো পরিবর্তন অপছন্দ করে।
লিডিয়া বলল-ও কিন্তু আপনার খুব অনুরক্ত।
–তোমার কাছে সেটা স্বাভাবিক নয় তাই না?
অনেক অনেক আনন্দের ব্যাপার। এখনো অনেক মজার ঘটনা ঘটতে বাকী আছে। তিনি নিজের মনে বলে উঠলেন–আমি এই খ্রীস্টমাসটা উপভোগ করতে যাচ্ছি।
সাইমন চেয়ার থেকে উঠে লাঠিতে ভর দিয়ে ঘরের এক কোণে আলমারীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি কাঁপতে কাঁপতে আলমারীর তালাটা খুলে একটা হরিণের চামড়ার ব্যাগ বের করলেন। ব্যাগটা খুলতেই হীরের টুকরোগুলো ঝলসে উঠল। তিনি কাঁপা কাঁপা আঙুলগুলো দিয়ে হীরেগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগলেন।
আমার সৌন্দর্য সেই এক ঔজ্জ্বলতা এখনো পুরোনো বন্ধুর মতো রয়ে গেছে। আমার পুরোনো দিনের সাথী। ওরা কাটবেও না, ছিলবেও না।
আমার পুরোনো দিনের সাথীরা তোমরা নারীদের গলায়, কানে, আঙুলে ঝুলে আর কোনো দিন শোভাবর্ধন করবে না, তোমরা শুধু আমার, আমার সাথী হয়েই তোমরা থাকবে। আমি আর তোমরা শুধু একটা ব্যাপার জানি, ওরা বলে আমি নাকি বুড়ো হয়ে গেছি, সুস্থ নই, পঙ্গু। তাতে আমার কিছু এসে যায় না। আমার জীবনের অনেকটা পথ বাকী পড়ে আছে। আমি এখন তোমাদের বৃদ্ধ কুকুর প্রহরীর মতো পাহারা দিচ্ছি। আরো অনেক মজার ঘটনা বাকী রয়ে গেছে।
২. বেল বাজার সঙ্গে
০২.
২৩ শে ডিসেম্বর।
বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে ট্রেসিলিয়ান এগিয়ে গেল। সে এমনিতেই একটু শ্লথ; আবার বেল বেজে উঠল। মনে মনে বিরক্ত হল সে, লোকটা যে কী তার ঠিক নেই ভদ্রলোকের বাড়িতে কীভাবে বেল বাজাতে হয় তাও জানে না। সে তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজার কাঁচে চোখ রেখে দেখল। তার অনুমানই ঠিক। লোকটার চেহারায় একটা কাঠখোট্টা ভাব। মুখে এতটুকু মিষ্টতা নেই। চেহারাটা তার বিশাল, মাথায় স্নাউট টুপি। দরজা খুলতেই সে আগন্তুককে দেখতে পেল। সামনাসামনি দেখলে তার পোষাকের মধ্যে একটা নোংরা ভাব একটা ঔদ্ধত্য ভাব দেখা যাবে।
আগন্তুক তাকে বলে–তুমি ট্রেসিলিয়ান না?
ট্রেসিলিয়ান এক বুক নিঃশ্বাস নিয়ে আগন্তুককে ভালোভাবে দেখল। হ্যাঁ সেই চোখ, সেই নাক, বহু বছর আগে সে মানুষটিকে দেখেছিল। তখন সে আরো বেশী ঔদ্ধত্যপূর্ণ ছিল। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে-মিঃ হ্যারি।
হ্যারি হেসে বলল–তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমাকে দেখে তুমি শক পেয়েছ কেন তুমি কী আমার আসা পছন্দ করোনি?
-হ্যাঁ স্যার, নিশ্চয়ই স্যার।
–তাহলে তুমি আমাকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলে কেন?
দুতিন পা পিছিয়ে গিয়ে সে বাড়িটাকে ভালো করে দেখল। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল সেই পুরোনো কুৎসিত ম্যানসন।–আমার বাবা কেমন আছেন ট্রেসিলিয়ান?
-স্যার, তিনি অনেকটা পঙ্গুর মতো আছেন। তিনি তার নিজের ঘরেই থাকেন, বড়ো একটা বাইরে বেরোতে চান না। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা থাকলেও মনের দিক থেকে তিনি সতেজ।
হ্যারি ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন–পুরোনো পাপী, আমার ভাই অ্যালফ্রেড কেমন আছেন?
–তিনি এখন খুব ভালো আছেন।
হ্যারি দাঁত বের করে হাসল-আশাকরি আমায় দেখার জন্য সে উঁচিয়ে আছে।
–বাউণ্ডুলেটা আবার ফিরে এসেছে। মনে রেখো ভালো মানুষটি সেজে বসে আছে। মনে রেখো এ সবকিছুই তার অপছন্দ। আমি হলফ করে বলতে পারি সে সুস্থ হয়ে থাকুক অ্যালফ্রেড তা চায় না। একটু থেমে সে বলে–আঙুল দেখিয়ে তিনি বলেন এই পথে তিনি সেখানে যাবেনই।
সে মাথা নেড়ে ট্রেসিলিয়ানকে অনুসরণ করল ড্রইংরুমে যাবার জন্য। হ্যারি বলল–তুমি এখন তোমার কাজে যেতে পারো ট্রেসিলিয়ান। দেখি মিঃ এবং মিসেস অ্যালফ্রেডকে খুঁজে পাই নাকি?
হ্যারি ড্রইংরুমে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। হঠাৎ সে জানলার ধারে একটি মেয়েকে বসে থাকা অবস্থায় দেখতে পেল। মেয়েটির কালো চুল, সুন্দর মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে তার চোখ দুটো বিস্ময়ে থমকে দাঁড়ালো।
সে বলে উঠলো-হায় ঈশ্বর। তুমি কী আমার বাবার সপ্তম এবং পরমাসুন্দরী স্ত্রী?
পিলার তার দিকে এগিয়ে এসে বলল–আমি পিলার এস্ট্রাভাডোস; তুমি নিশ্চয় আমার মায়ের ভাই, হ্যারি মামা।
হ্যারি মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল–ও, তাহলে তুমি জেনির মেয়ে।
–তাহলে কেন তুমি আমাকে তোমার বাবার সপ্তম স্ত্রী কী না জিজ্ঞাসা করলে?
হ্যারি হেসে বলল–আমার মনে হয় ওর সরকারী স্ত্রী একজনই। পিলার তোমাকে মৌসেলিয়ামে দেখে মনে হচ্ছিল তুমি যেন একটা সুন্দর ফুলের কুঁড়ি।
-কি যেন একটা বললে মৌস?
-হ্যাঁ, ঠিক তাই। তুমি একটা মিউজিয়াম ছাড়া আর কী? এখানে যতসব বাজে জিনিষ ভর্তি।
পিলার অত্যন্ত আহত কণ্ঠে বলল–আমার তো তা মনে হয় না। আমার মনে হয় সব জিনিষগুলো সুন্দর, কার্পেটগুলো অতি উচ্চমানের আর ফার্নিচারগুলোও।
হ্যারি দাঁত বের করে বলল–তুমি ঠিককথাই বলেছ। পিলারের দিকে চেয়ে সে বলল তোমাকে এর মাঝে দেখে লাথি মেরে বের করে দেওয়ার লোভটা সামলাতে পারছি না।
লিডিয়াকে ছুটে আসতে দেখে হ্যারি চুপ করে গেল।
-হ্যারি তুমি কেমন আছো? আমি লিডিয়া, অ্যালফ্রেডের স্ত্রী।
হ্যারি লিডিয়ার বুদ্ধিদীপ্ত মুখটা ভালো করে দেখে নিয়ে বলল-লিডিয়া তুমি ভালো আছো তো?
লিডিয়াও তাকে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। সে চিন্তা করে দেখল-রুক্ষ স্বভাবের মনে হল তাকে। যদিও সে শ্যামবর্ণীয়, তবু তাকে আমি অবিশ্বাস করব।
এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই নেই। যদি না তুমি তাকে দেখলে তার ভেতর কোনো পরিবর্তন দেখতে পাবে কী না।
–আর সব ভায়েরা ইংল্যাণ্ড শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
–না তারা সকলে খ্রীস্টমাসের জন্য এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে।
হ্যারি স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার মানে এটা একটা পারিবারিক মিলনের ব্যবস্থা। তা ঐ বুড়ো লোকটির সংবাদ কী? আগে তো তিনি মানুষের অনুভূতির মর্যাদা দেননি, এরকম ভাবে কারো জন্য তিনি মাথা ঘামাননি। এখন নিশ্চয়ই ওনার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে।
-লিডিয়া বলে–তাই তো মনে হয়।
পিলার চোখ দুটো বড় বড় করে আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইল।
জর্জের খবর কী? পকেট থেকে আধ পেনি বের করতে হলে এখানো কী আগের মতো হৈ চৈ করে?
লিডিয়া উত্তরে বলে–জর্জ এখন পার্লামেন্টের সদস্য–ওয়েস্টারিংহ্যামের।
–কি বললে? ঐ পাজীটা এখন পার্লামেন্টের সদস্য। ঈশ্বর ওকে ক্ষমা করুন। হ্যারি শব্দ করে হেসে উঠল।
একটা সময় তার হাসি থেমে গেল। আর কারো পদশব্দ শুনতে পায়নি সে।…
অ্যালফ্রেড কখন যে চুপ করে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তা সে টেরও পায়নি। সে শুধু শান্ত হয়ে হ্যারিকে দেখছিল।
হ্যারি মিনিট কয়েক দাঁড়িয়ে থাকার পর এক-পা তার দিকে এগিয়ে গেল। তার ঠোঁটে একটুকরো হাসি ফুটে উঠল। সে বলল–কেন তুমি অ্যালফ্রেড নও?
অ্যালফ্রেড মাথা নেড়ে বলল–হ্যালো হ্যারি।
তারা একে অপরের দিকে চেয়ে রইল। লিডিয়া জোরে নিঃশ্বাস নিল। কী অবাস্তব ঘটনা। দুটো কুকুরের মতো, তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে।
পিলারের চোখ দুটো আরো বড় বড় হল। সে নিজের মনে চিন্তা করল, তারা ওরকম ভাবে একে অপরের দিকে চেয়ে না থেকে কেন দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরছে না? ইংরেজরা অবশ্য তা করে না। কিন্তু তারা তো বলতে পারে, তবে কেন কেবল একে অপরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে?
শেষকালে হ্যারিই মুখ খুলল,–অনেকদিন পর আবার বেশ আনন্দ পেলাম।
-আমারও তাই মনে হয়। বহু বছর তুমি বাইরে ছিলে।
হ্যারি এমন ভাবে চোয়ালে আঙুল ঠেকাল যে তাকে দেখে মনে হল সে যেন যুদ্ধের জন্য তৈরী। সে বলল–হ্যাঁ, আমি আমার বাড়িতে ফিরে এসে খুব খুশী।
সাইমন লী বলে ওঠেন–আমার খালি মনে হয় আমি খুব বাজে লোক ছিলাম। তিনি চেয়ারের উপর হেলান দিয়ে বসলেন। তার পাশে বসেছিলেন নাতনী পিলার।
মনে হয় তিনি মেয়েটি ছাড়া নিজের সাথে আরো কথা বলতে চাইছেন। কিন্তু কী ভেবে আবার চুপ করে গেলেন।
তিনি বলেন–আচ্ছা, আমি যে খুব বাজে লোক ছিলাম, সে সম্বন্ধে তোমার মতামত কী পিলার?
পিলার কাঁধ নাচিয়ে বলল–সবমানুষই খারাপ। একথা নানেরা বলেন। তাই জন্য তাদের সবার জন্য আমার প্রার্থনা করা উচিত।
সাইমন হেসে বলেন–কিন্তু আমি যে সবার থেকে খারাপ কাজ করে এসেছি। তার জন্য আমার এতটুকু অনুশোচনা হয় না। একেবারেই তা হয় না। আমি প্রতিটা মিনিট নিজে উপভোগ করছি। সবাই বলে বয়স হলে তোমার অনুশোচনা হবে। ওসব শুধু আমাকে দেওয়া সান্ত্বনা। আমার অনুশোচনা হয় না। আমি অনেক ভালো ভালো পাপ করেছি। আমি চুরি করা, লোক ঠকানো, মিথ্যা বলা..কী না করেছি আমি।…হা ঈশ্বর। এছাড়া, সর্বদা মেয়েদের সঙ্গও আমার ভালো লাগত। একদিন একজন আমাকে একটা কথা বলেছিল। একজন আরব চীফের চল্লিশটা ছেলে ছিল তার দেহরক্ষী, সবকটাই প্রায় এক বয়সের। আহা! চল্লিশটার ব্যাপার যদিও আমি কিছু জানি না তবুও আমি হলফ করে বলতে পারি যদি আমি বাচ্চার কথা ভাবতাম তাহলে খুব সহজেই বেশ কিছু দেহরক্ষী জন্ম দিতে পারতাম। পিলার তুমি নিশ্চয়ই অন্য কিছু ভাবছ? তুমি কী আঘাত পেলে?
-না, আমি কেন আঘাত পেতে যাবো, সব পুরুষরাই সবসময়েই মেয়েদের কামনা করে। আমার পিতাও সেই কারণে সেইরকমই ছিলেন। আর সেইজন্যই তাদের স্ত্রীরা কখনই সুখী হয় না। এবং তার জন্যই চার্চে গিয়ে প্রার্থনা জানায়।
বৃদ্ধ সাইমন ভ্রু কুঁচকিয়ে বলে–আমি এডেলডাকে সুখী করিনি। তিনি নিজের কাছে কৈফিয়ত দেওয়ার মত বলল, হায় ঈশ্বর মেয়েছেলে জাতটা যেন কেমন। এডেলডাকে যখন আমি বিবাহ করি তখন সে হাসিখুশীতে ভরা ছিল। কিন্তু বিবাহের পর সে সম্পূর্ণ বদলে গেল। সর্বক্ষণ সে খালি কাদত। এখানেই এডেলডার দুর্বলতা সে যদি একবার আমার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত। কিন্তু কোনোদিন একবারের জন্যও সে তা করেনি। আমার বিশ্বাস আমি তাকে বিয়ে করে স্থিতি হতেই চেয়েছিলাম। মনে আশা ছিল–একটা সুখী পরিবার গড়ে তুলব এবং আমার পুরোনো জীবন পরিত্যাগ করব।
তার কণ্ঠস্বর বন্ধ হয়ে এল। তিনি তার বুকের আগুনের দিকে চেয়ে রইলেন।
–ঈশ্বর যে সুখী পরিবার গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম সেটা কেমন পরিবার? বলে সে দুঃখের হাসি হেসে উঠল।
-আমার ছেলেদের দিকে তাকিয়ে দেখ তাদের একটাও মানুষ হয়নি। কেন? তারা কী ধমণীতে রক্তের স্বাদ পায়নি? তারা বৈধ না অবৈধ জানি না। যেমন প্রথমেই ধরা যাক অ্যালফ্রেডের কথা। অ্যালফ্রেডের সঙ্গ আমার কাছে একঘেঁয়ে এবং ভয়ঙ্কর লেগেছে। সে তার কুকুরের চোখ দিয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকে। আমি তাকে যে কাজই বলি না কেন ও ঠিকই করে দেবে। হায় ঈশ্বর কী বোকা সে। ডেভিড অবশ্য সবসময়ই বোকা ছিল। স্বপ্নে পাওয়া মানুষের মতো। ও আসলে ঠিক ওর মায়ের মতো ছিল। সে তার জীবনে একটাই ভালো কাজ করেছে। সুন্দরী একটি মেয়েকে বিবাহ করেছে। তিনি চোয়াল থেকে হাতটা নামিয়ে চেয়ারের উপর রাখলেন। হ্যারি অবশ্য এদের থেকে আলাদা এবং সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছেলে। সে যে এখন জীবিত আছে সেটা খুবই আনন্দের।
পিলার তার কথায় সায় দিল।
-হা সে খুব সুন্দর ছেলে, মন খুলে সে হাসতে পারে। আমি তাকে খুব ভালোবাসি।
বয়স্ক লোকটি পিলারের দিকে তাকিয়ে বললেন–হ্যারিই আমার উপযুক্ত ছেলে। তার মেয়েদের সঙ্গে একটা গোপন সম্পর্ক ছিল। আমার জীবনটাও খুব ভালো ছিল। সবকিছুই পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিল।
পিলার বলে উঠল–আমাদের স্পেনে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে। সেটা এইরকম–ঈশ্বর বলেছেন তোমার যা পছন্দ নিয়ে নাও তার দাম দিয়ে দাও।
–এটাই ভালো। তোমার যা পছন্দ নিয়ে নাও..আমি তাই করেছি। আমার সারা জীবন যখন যা মনে হয়েছে…
–হঠাৎ পিলার গম্ভীর গলায় বলে উঠল–তার দাম দিয়েছিলেন?
সাইমনের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল–এ তুমি কী প্রশ্ন করছ?
-ঠাকুরদা আমি প্রশ্ন করছি–আপনি তার দাম দিয়েছিলেন?
তিনি আস্তে আস্তে বললেন–আমি জানি না। তিনি তার মুঠো করা হাতটা চেয়ারে ঠুকে বললেন-তুমি একথা কেন বলতে গেলে নাতনী?
পিলার উত্তরে বলল–আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।
সাইমন বললেন-তুমি একটি শয়তানের বাচ্চা।
পিলার ঠাণ্ডা গলায় বলল–আপনিই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
-হ্যাঁ, তুমি আমার কন্যা জেনিয়ার মেয়ে। তোমার সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক আছে। আর তাছাড়া, অনেকদিন তোমার মতো সুন্দরী যুবতী দেখিনি তাই।
পিলার মুচকি মুচকি হাসছিল।
সাইমন বলে উঠলেন–কিন্তু মনে রেখো তুমি আমাকে বোকা বানাতে পারবে না। আমি জানি তুমি কেন এতক্ষণ ধরে ধৈর্য ধরে আমার পাশে বসেছিলে–শুধু আমার টাকার লোভে। অথবা তুমি তোমার ঠাকুর্দাকে ভালোবাসার ভান করো।
না, আমি আপনাকে ভালোবাসিনা আপনাকে অপছন্দ করি। এটা সত্য এবং আপনার বিশ্বাস করা উচিত। আমি ভালো করেই জানি আপনি তোক ভালো নন। আমি সেটা পছন্দ করি আর এটাও ঠিক আপনি বাড়ির অন্য সব লোকেদের চেয়ে খাঁটি। এছাড়া, আমার যেটা সবচেয়ে পছন্দ যে, আপনি অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। যাকে বলে অ্যাডভেঞ্চারস লাইফ।
–জানো পিলার, আমাদের মধ্যে জিপসির রক্ত আছে যাকে বলে ভবঘুরে বা যাযাবর। তবে হ্যারি ছাড়া আর কারো ওপর এ প্রভাব পড়তে দেখিনি। দরকার হলে আমি ধৈর্য ধরতে পারি। আমার যে ক্ষতি করেছে তাকে ধরার জন্য পনেরো বছর অপেক্ষা করে আছি। এটাই লী বংশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আমি পনেরো বছর পরে সুযোগ পেয়েছি তাকে আমি ধ্বংস করে দিয়েছি। তিনি খুব হাল্কা ভাবে হাসলেন।
পিলার প্রশ্ন করল–ঘটনাটা নিশ্চয়ই দক্ষিণ আফ্রিকায় ঘটেছিল?
হ্যাঁ, খুব ভালো দেশ। বিয়ের পাঁচ বছর পর আমি সেখানে ফিরে গিয়েছিলাম।
-কিন্তু বিয়ের বহুবছর আগেও আপনি ওখানে থাকতেন।
–হ্যাঁ।
–আমাকে সেই সম্বন্ধে কিছু বলুন।
তিনি কাহিনীটা বলতে শুরু করলেন। পিলার অবাক হয়ে কাহিনীটা শুনতে লাগল। তারপর তিনি একটা বড় আলমারীর কাছে এগিয়ে গেলেন লাঠিতে ভর দিয়ে। আলমারীর পাল্লাটা খুলে হরিণের চামড়ার ব্যাগটা খুলে পিলারের করুণ মুখের দিকে চেয়ে রইলেন–এগুলো কী জান? অখচিত সব হীরের টুকরো। এখন এগুলো এ অবস্থায় পাওয়া যায়। এগুলো কাটার পর আসল হীরে বেরিয়ে পড়বে। তখনি সেগুলো চমকে দেবে, ঝলসে উঠবে।
পিলার বাচ্চা মেয়ের মতো অবাক হয়ে বলল-ও আমি অবিশ্বাস করি।
তিনি খুব মজা পেলেন, বললেন,-এ একেবারে খাঁটি হীরে।
—খুব দামী?
কয়েক হাজার পাউণ্ড হবে। এগুলো বড় বড় হীরে। নয় কিংবা দশ হাজার ধরতে পারো।
–এগুলো বিক্রি করছেন না কেন?
–আমার টাকার প্রয়োজন নেই তাই। আমি এগুলোকে আমার কাছেই রেখে দিতে ভালোবাসি।
তিনি আবার ঐগুলোকে আলমারীতে রেখে দিলেন এবং হারবারিকে ডাকলেন–এসো।
হারবারি ভেতরে এসে বলে–চা তৈরী।
হিলডা বলে উঠল–তাহলে সত্যিই তুমি এখানে এলে ডেভিড। আমি তোমায় কত খুঁজেছি। ঘরটা ভীষণ ঠাণ্ডা। চল এখান থেকে চলে যাই।
ডেভিড তার কথায় কান না দিয়ে একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল–এই সেই চেয়ার, যেখানে আমাদের মা সবসময় বসে থাকতেন। এটা তেমনি তাই আছে; শুধু রঙটা একটু চটে গেছে। ডেভিড বলে চলল–তিনি সবসময় এখানে বসে থাকতেন আর আমাদের বই পড়ে শোনাতেন। আমি তখন বছর ছয়েকের শিশু ছিলাম।
হিলডা তার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল–চলো, ড্রইংরুমের দিকে যাওয়া যাক। এখন ওরা কোথায় আছে, চায়ের সময় হয়ে গেছে।
ডেভিড বহুদিন পর পিয়ানোটার ওপর হাত রাখল, তার খুব সখ ছিল পিয়ানো বাজানোর। কিছুক্ষণ বাজাবার পর হঠাৎ সে উঠে দাঁড়াল। সে খুব কাঁপছিল। হিলডা দৌড়ে তার কাছে গেল।
–কী হয়েছে ডেভিড?
–না না, তেমন কিছু নয়। ডেভিড উত্তরে বলল।
কর্কশভাবে বেলটা বেজে উঠল দরজার কাঁচ দিয়ে বাইরে তাকাতেই ট্রেসিলিয়ানের স্ত্র জোড়া কুঁচকে উঠল বাইরে দাঁড়ানো আগন্তুককে দেখে। সে কপালে হাত দিয়ে চিন্তা করল। মনে হয় সবকিছুই যেন দ্বিতীয়বার ঘটে। এর আগে আরো একবার এরকম ঘটনা ঘটে থাকবে। সে নিশ্চিত মনে করে দরজা খুলে দিল।
তারপরই দরজার ওপারে থাকা ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করেন–এটা কী মিঃ সাইমন লীর বাড়ি?
-হা মহাশয়।
–ওনার সঙ্গে আমি একটু সাক্ষাৎ করতে চাই।
ঠিক তক্ষুনি ট্রেসিলিয়ানের মনের স্মৃতিতে একটা অস্পষ্ট স্মৃতি ভেসে উঠল। বহুদিন ধরে সে এই গলার স্বর শুনে এসেছে। মিঃ লী তখন ইংল্যাণ্ডে থাকতেন।
ট্রেসিলিয়ান দ্বিধা চিত্তে মাথা নেড়ে বলল–কিন্তু স্যার মিঃ লী যে এখন অথর্ব। তিনি এখন খুব একটা লোকের সংগে দেখা-সাক্ষাৎ করেন না। আপনি যদি আপনার দরকারটা
তাকে বাধা দিয়ে আগন্তুক বলল–ঠিক আছে আপনি শুধু মিঃ লীকে এটা দিয়ে আসুন। বলে পকেট থেকে একটা খাম বের করে তার হাতে দিল।
–ঠিক আছে।
কাগজটা খামের ভেতর থেকে পড়তে গিয়ে সাইমন লী অবাক হয়ে গেলেন। তার স্ত্র জোড়া কুঁচকে উঠল ঠিকই তবুও তিনি হেসে উঠলেন। বললেন–সবদিক দিয়েই তাহলে ভালোই হল।
এই মূহুর্তে আমি এবেনেজাপকারের কথাই ভাবছিলাম। সে আমার পার্টনার ছিল কিম্বারলীতে। তার ছেলে এসেছে এখন।
স্টিফেন ফারকে খুব নার্ভাস লাগছিল। ওর কথা বলার সময় দক্ষিণ আফ্রিকার একটা টান লক্ষ্য করা যাচ্ছিল।
–তুমিই তাহলে এদের ছেলে। তোমাকে দেখে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। বুড়ো পিলারের দিকে তাকিয়ে বলল–আমার নাতনী, পিলার এস্ট্রাভাডোস।
পিলার গম্ভীর স্বরে বলল–কেমন আছ তুমি?
ফার মেয়েটির আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। মিস এস্ট্রাভাডোস, তোমার পরিচয় জানতে পেরে আমি খুব খুশী হলাম।
পিলার ধন্যবাদ জানাল।
সাইমন কী বলল–বস স্টিফেন, বড় দিনের সময় তোমার কিন্তু আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে। অবশ্য যদি তোমার অন্য কোনো প্ল্যান না থাকে।
না না, আমার তেমন কিছু নেই এবং আমার পছন্দও নয়।
বুড়ো পিলারের দিকে তাকিয়ে বলল–সব ঠিক হয়ে যাবে, লিডিয়া বল আমাদের একজন অতিথি এসেছে।
পিলার চলে যেতেই সাইমন লী তার কাছ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা দেশটার খবর নিতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর লিডিয়া ঢুকতেই সাইমন লী ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল–এ আমার এক বন্ধুর ছেলে। আমাদের সঙ্গে বড়দিনের উৎসব উপভোগ করতে চায়। তার জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করো।
আগন্তুককে ভালো করে দেখে নিয়ে লিডিয়া বলে–অবশ্যই।
সাইমন বলে–এটি আমার পুত্রবধূ।
–এইরকম পারিবারিক উৎসবে আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছে।
সাইমন বলল–কেন বাছা, তুমি তোমাকে আমাদের পরিবারের একজন ভাবার চেষ্টা করো।
৩. ভীমরুলের বাসা
০৩.
২৪শে ডিসেম্বর।
হ্যারি বলল–বাবা আপনি সত্যি আমায় এখানে থাকতে বলছেন? এ যেন ভীমরুলের বাসায় থাকা।
সাইমন রুক্ষকণ্ঠে বলল–তুমি কী বলতে চাইছ?।
হ্যারি বলল–অ্যালফ্রেড ভাই হিসাবে ভালো, তবে আমি থাকলে সে বিরক্ত হবে।
–তোমাকে আমি যা বলছি তাই হবে। বাড়িটা যখন আমার তখন আমি যা চাইব তাই হবে। আমার ইচ্ছা তুমি এখানে চিরকালের মতো থাকে বিবাহ কর।
–আমি কাকে বিবাহ করবো? কেউ তার নিজের ভগ্নীকে বিবাহ করতে পারে না। আর তরুণী পিলার সত্যিই আকর্ষণীয়া।
–তুমি সেটা লক্ষ্য করেছ নাকি?
–জর্জ এদিক থেকে খুব ভালো করেছে। এ মেয়েটি কে?
–আমি তা কী করে জানবো? তবে আমার শোনা কথা সে নাকি একজন অবসরপ্রাপ্ত নৌবাহিনীর অফিসারের মেয়ে।
–জর্জ সতর্ক না হলে ঐ মেয়েটাকে নিয়ে ঝামেলায় পড়তে পারে।
সাইমন বলে উঠলেন–জর্জ চিরকালই একটু বোকা ধরনের ছেলে ছিল।
হ্যারি বলে উঠল-মেয়েটি কীসের জন্য বিয়ে করতে চায়? টাকার জন্য? হ্যারি নিজে থেকে পুনরায় বলল–আপনার কী মনে হয় অ্যালফ্রেডের ব্যাপারটা কী আপনি মিটিয়ে নিতে পারবেন?
সাইমন গম্ভীর ভাবে বলল–খুব শীঘ্রই আমরা এই ব্যাপারে একমত হতে পারব। তারপর হারবারিকে বললেন অ্যালফ্রেডকে ডেকে আনার জন্য।
অ্যালফ্রেড দৌড়তে দৌড়তে এসে জিজ্ঞাসা করল–বাবা আপনি আমায় ডেকেছেন?
-হ্যাঁ বস, আবার সবকিছু নতুন করে সাজিয়ে নিতে হবে। এই বাড়িতে আরো দুজন মানুষ আমাদের সঙ্গে থাকবে।
–আরো দুজন?
-এখন থেকে এটাই পিলারের নিজের বাড়ি। হ্যারি আমাদের ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে।
অ্যালফ্রেড জিজ্ঞাসা করল–হ্যারি এখানে থাকতে এসেছে?
হ্যারি নিজেই বলল–কেন নয় বস?
অ্যালফ্রেড তার দিকে তাকিয়ে বলল-তুমি বাবার সঙ্গে যেমন খারাপ ব্যবহার করে চলে গিয়েছিলে তারপরও তুমি এখানে থাকতে চাও?
হ্যারি হাত নেড়ে বলল–সেটা এখন অতীত হয়ে গেছে আর সেটা তোমার ব্যাপার না আমার ব্যাপার। তিনি যদি সব ভুলে আমায় ক্ষমা করতে চান।
সাইমন বলে উঠল-হা, সেটাই আমার ইচ্ছা। যতই হোক হ্যারি আমার পুত্র।
সাইমন অ্যালফ্রেডের কাঁধে হাত রেখে বলল–ও যখন এখানে এসেছে তখন এখানেই থাকুক। তাছাড়া, ও আমার খুব প্রিয়।
অ্যালফ্রেড মুখটা বিবর্ণ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
হ্যারিও হাসতে হাসতে তার পিছু নিল।
ওরা চলে যাবার পর সাইমন হারবারির দিকে তাকিয়েই বলল–তোমার এখন অনেক কাজ বাকী আছে। মধ্যাহ্নভোজের পর সবাইকে এখানে নিয়ে আসবে।
-হা মহাশয়।
দাঁড়াও তোমাকে আমার আরো কিছু বলার আছে। ওরা যখন এখানে আসবে তুমিও তখন ওদের সঙ্গে সঙ্গে এখানে আসবে। আর যদি কখনো বারান্দায় আসো তাহলে এমনভাবে মুখে আওয়াজ করবে যাতে আমি শুনতে পাই। কোনো রকম ভনিতা করবে না বুঝতে পারলে?
-হ্যাঁ মহাশয়।
নীচে নেমে সে ট্রেসিলিয়ানকে বলল–তুমি না বলেছিলে আমরা একটা সুন্দর খ্রীস্টমাস উপভোগ করতে চলেছি।
-তুমি কী বলতে চাও? ধৈর্য ধরো সবকিছুই দেখতে পাবে আমরা একটা সুন্দর খ্রীস্টমাস ভোগ করতে চলেছি।
ওরা যখন দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো সাইমন তখন ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন। হাত নেড়ে সকলকে ঘরের ভেতরে আসতে বললেন এবং বসতে বললেন-আমার কথা বলতে এক মিনিটও লাগবে না।
হকিন্স এ্যাণ্ড ব্রেসের চার্লটন,-চার্লটন তুমি? আমি সাইমন লী কথা বলছি। আমার একটা নতুন উইল তৈরী করার আছে। হা হা, যা বলছি শোন, তাড়াতাড়ির কিছু নেই। সবকিছুর পরিবর্তন হয়ে গেছে। তোমার খ্রীস্টমাস নষ্ট করো না। বক্সিং দিবস কিংবা তার পরের দিন এসো। না না, আমি ঠিক আছি এতো তাড়াতাড়ি মরছি না।
রিসিভারটা নামিয়ে রেখে সে আটজনের মুখের দিকে একবার দেখে নিয়ে বলল–কী ব্যাপার বল তো? তোমাদের সবাইকে খুব বিষণ্ণ লাগছে। ব্যাপার কী?
অ্যালফ্রেড বলল–আপনি আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন?
সাইমন তক্ষুনি বলে উঠল-ওহো দুঃখিত-সেরকম কিছুই নয় খুবই স্বাভাবিক। আচ্ছা, তোমাদের কী মনে হয়? এটা একটা পারিবারিক মিলন সভা? না, মোটে সেটা না। মধ্যাহ্নভোজের পর তোমাদের কারুরই আসার দরকার নেই। আমি খুব ক্লান্ত আমি একটু ঘুমবো। খ্রীস্টমাসের উৎসবের জন্য একটু সতেজ হয়ে উঠতে চাই আমি। তিনি এ সমস্ত কথা বলার পর দাঁত বার করে হাসলেন।
জর্জ বলল–নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
সাইমন জর্জের দিকে তাকিয়ে বলল-শোন, জর্জ তোমায় একটা কথা বলি। তোমার মাসোহারা বোধহয় কমতে পারে। কারণ এখানকার খরচ বেড়েছে কিন্তু আয় আগের তুলনায় কমেছে।
জর্জের মুখটা রাগে লাল হয়ে গেল। সে বলল-কিন্তু যেহেতু সংসারের খরচ আগের থেকে বেড়েছে সেহেতু আমার মাসোহারা বাবদ টাকাটা যদি কমিয়ে দেন তাহলে আমাকে খুব অসুবিধায় পড়তে হবে।
-কেন তোমার স্ত্রী ইচ্ছা করলেই বাজে খরচ কমিয়ে ঐ টাকায় সংসার চালাতে পারে। আর তাছাড়া, তিনি তো খুবই বুদ্ধিমতী আশা করি এখন থেকে তিনি তাই করবেন। জানি তুমি আগে কখনও এরকম আর্থিক সংকটে পড়োনি। এখন তুমি যেতে পারো।
এরপর সাইমন ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন।
এক এক করে সবাই চলে গেল। শুধু হিলডা দরজার সামনে এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে আবার ফিরে এল সাইমনের সামনে।
সাইমন একবার চোখ মেলে তাকাতে গিয়ে চোখের সামনে হিলডাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হল এবং বলল-কী ব্যাপার তুমি এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছ?
হিলডা বলল-দেখুন, আপনার চিঠির বক্তব্য অনুযায়ী আমি ডেভিডকে অনুরোধ করেছিলাম এখানে আসার জন্য।
-হ্যাঁ, তাতে কী হল?
-আপনি পরিবারের সকলকে চারপাশে রেখে আনন্দ উপভোগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যা বললেন তার জন্য তো নয়। আপনি কী আমাদের নিয়ে কৌতুক করতে চেয়েছিলেন?
সাইমন মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করে বলল–আমি কৌতুক বিশেষজ্ঞ। কিন্তু তা বলে কেউ আমায় তার জন্য প্রশংসা করুক তা আমি চাই না। আমি কেবল সেটা উপভোগ করতে চাই।
হিলডা কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। সাইমনের মাথায় একটা চিন্তা হল। সে তীক্ষ্ণ স্বরে জানতে চাইল–কী চিন্তা করছ তুমি?
–আমার ভয় করছে।
–ভয়-কাকে আমাকে?
–না আপনাকে নয়। আপনার জন্য আমার ভয় হচ্ছে।
বিচারপতি যেমন শেষ রায় দিয়ে চলে যায়। হিলডাও তেমন করে তার শেষ কথাটা বলে ঘর থেকে চলে গেল।
সাইমন খুব আশ্চর্য হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল এবং বিড়বিড় করে নিজের মনে বলে উঠল–আমার সুন্দর জিনিষগুলো একবার দেখাই যাক না…
পৌনে আটটার সময় দরজার বেলটা বেজে উঠল। ট্রেসিলিয়ান দরজা খুলতে গেল। সে ফিরে আসতেই হারবারির সঙ্গে মুখোমুখি হল। সে তখন ট্রেতে কফির কাপগুলো সাজিয়ে রাখছিল।
-পুলিশ সুপারিনটেন্টে মিঃ সাগডেন। আরে তুমি ভালো করে চেয়ে দেখ তুমি কী করছ।
কফির একটা কাপ তার কাঁপা কাঁপা হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল।
ট্রেসিলিয়ান দুঃখ প্রকাশ করে বলল–ছিঃ ছিঃ আমি এগারো বছর ধরে কাপ ডিস ঘোয়া মোছা করছি। একটা কাপ বা একটা ডিস আজ পর্যন্ত আমার হাত থেকে ভাঙেনি। আর তুমি একদিন হাত দিয়েই ভাঙলে।
আতঙ্কিত মুখ করে সে বলল–আমি দুঃখিত মিঃ ট্রেসিলিয়ান। জানি না কেমন করে আমার কাছ থেকে এমন অঘটন ঘটে গেল। তুমি কী যেন বলছিলে? এ বাড়িতে পুলিশ সুপার এসেছেন?
-হ্যাঁ, মিঃ সাগডেন।
হারবারি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল–কেন কী চায় সে?
–দুঃস্থ পুলিশদের সাহায্য নিতে এসেছেন।
–ও, আচ্ছা, তাই বল। ঠিক আছে এখন আমি চললাম, এবার তার গলার স্বর স্বাভাবিক হল।
–কোথায়? সিনেমায়?
–সেই রকমই মনে হয়। টা টা মিঃ ট্রেসিলিয়ান।
পুলিশ সুপার চলে যাওয়ার পর নৈশভোজের আয়োজন করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। শেষ অতিথি ম্যাগজলেন ড্রইংরুমে প্রবেশ করতেই বৃদ্ধ খানসামা সেখানে উপস্থিত হয়ে বললেন–নৈশভোজের খাবার টেবিলে দেওয়া হয়ে গেছে।
আর এদিকে মিঃ ডেভিডের ব্যাপার। তাকে দেখে খুব চিন্তান্বিত লাগছিল। ডেভিডকে দেখতে ঠিক তার মায়ের মত। আর এখন তাকে পরিপূর্ণ পুরুষের মত লাগে। তবে সে চশমার কাঁচ দিয়ে দেখল সে একটু নার্ভাস।
কিছুক্ষণ আগে পুলিশ আসার খবরে হারবারির মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল ঠিক সেই রকম লাগছিল ডেভিডের মুখ।
আজ রাতে হ্যারিকে সবচেয়ে বেশী মন মরা দেখাচ্ছিল। মাঝে মাঝে সে অ্যালফ্রেডের দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছিল যে তাদের ভ্রাতৃপ্রেম নষ্ট হবার নয়। অ্যালফ্রেড তবুও হ্যারিকে সহ্য করতে পারছে না।
কিন্তু মিঃ সাইমন সর্বাপেক্ষা স্নেহ করেন হ্যারিকে যেটা অ্যালফ্রেডের কাছে অসহ্য। আর সে যতই বাবাকে শ্রদ্ধা করুক না কেন মিঃ লী তাকে বেশী পাত্তা দেয় না।
রাতের আহারের শেষে লী পরিবারের পুরুষরা একে একে গিয়ে ড্রইংরুমে বসল। এদিকে ডাইনিংরুমে চারজন মহিলা পর পর বসে আছে অথচ কেউই কারো সাথে কথা বলতে প্রয়োজন বোধ করছে না। বৃদ্ধ ট্রেসিলিয়ানের এই ব্যাপারটা খুবই খারাপ লাগল।
প্যান্ট্রি থেকে কফির ট্রেটা হাতে করে নিয়ে সে এবার ডাইনিংরুমে হাজির হল। ডাইনিংরুম থেকে প্যান্ট্রিতে ফিরে যাবার সময় সে ডাইনিংরুমের দরজা খোলার শব্দ পেল। ডেভিড লী যে এতক্ষণ ডাইনিংরুমে বসেছিল সে তা লক্ষ্য করেনি। এখন ডেভিড ডাইনিংরুম থেকে ড্রইংরুমে প্রবেশ করল।
খ্রীস্টমাস ইভে লী পরিবারের সকলের মুখে একটা থমথমে ভাব তার ভালো লাগল না। সবাইয়ের মুখে একটা উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা আর অপছন্দ।
ট্রেসিলিয়ান একটু বাদে খালি কফির কাপগুলো আনার জন্য ড্রইংরুমে ঢুকতেই দেখল, লিডিয়া জানলার ধারে বাইরের অন্ধকারে কী দেখছে।
পাশের ঘর থেকে পিয়ানোর আওয়াজ আসছিল। ডেভিড বাজাচ্ছিল। কিন্তু কেন? ট্রেসিলিয়ান নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল। ডেভিড কোনোদিন এইরকম করুণ সুরে পিয়ানো বাজায় না। মনে হয় এই খ্রীস্টমাস ইভে কোথাও কিছু একটা অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে। আস্তে আস্তে সে হাঁটতে হাঁটতে প্যান্ট্রিতে ফিরে গেল।
হঠাৎ সে ওপরতলা থেকে গণ্ডগোল শুনতে পেল। টেবিল চেয়ার, ফার্ণিচার ছুঁড়ে ফেলার আওয়াজ শুনতে পেল।
ট্রেসিলিয়ান চিন্তা করল-মনিব একী করছেন? উপরতলা থেকে এইরকম আওয়াজ শোনা যাচ্ছে কেন?
তারপরই আর্তনাদ শোনা গেল বাড়ির মধ্যে। ট্রেসিলিয়ান চুপচাপ সেখানে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর সে হলঘরে ছুটে এসে সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিকে ছুটে গেল। সবাই তার সঙ্গে ছিল। ওপরে সবার লক্ষ্য ছিল বৃদ্ধ লীর ঘর। তার আগেই ওখানে মিঃ ফার এবং মিসেস ডেভিড পৌঁছে গেছেন। মিসেস ডেভিড দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে, ওদিকে দরজার হাতল ধরে ঘুরিয়ে–মিঃ ফার সেটা খোলবার চেষ্টা করছিল।
স্টিফেন ফার বলছিল দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।
হ্যারিও ততক্ষণে সেখানে পৌঁছে গেছে এবং ফারের মত দরজার হাতল ঘুরিয়ে খোলার চেষ্টা করছে।
সে চেঁচিয়ে বলল–বাবা, আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিন।
অন্যেরা চুপচাপ শুনছিল। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। ঘরের ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ আসছিল না।
বাড়ির সদর দরজার বেল বেজে উঠল সেদিকে কারো নজর গেল না।
ফার বলল-দরজা এখনি ভেঙে ফেলতে হবে। এছাড়া আর অন্য কোনো উপায় নেই।
হারি বলল–কাজটা কঠিন হবে, পুরু কাঠের দরজা। যাই হোক অ্যালফ্রেড এসো আমরা কাজটা শুরু করি।
সবাই মিলে জোরে ধাক্কা দিল। কিন্তু তাতে কোনো ফল পাওয়া গেল না। কে যেন শেষে একটা বেঞ্চ নিয়ে এসে সজোরে দরজায় আঘাত করল। দরজার ফ্রেমটা অবশেষে নড়ে উঠল। এইভাবে কয়েকবার ধাক্কা মারার পর দরজাটা সব সুদ্ধ ভেঙে ঘরের ভেতর পড়ল।
ভেতরে ঢুকে সবাই অবাক হয়ে গেল। তারা চিন্তা করতে পারেনি ভেতরে ঢুকে তারা এমন দৃশ্য দেখবে।
ভেতরে ঢুকে বোঝা গেল যে কিছুক্ষণ আগে ঘরের মধ্যে একটা লড়াই হচ্ছিল। সব আসবাবপত্র উল্টে পড়ে আছে; চায়না ভাসটা ভেঙে মেঝের উপর টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে। সাইমন লীর দেহটা রক্তে মাখামাখি অবস্থায় ফায়ার প্লেসের সামনে কম্বলের উপর পড়ে আছে। জায়গাটা কসাই-এর দোকানের মতো লাগছে।
দুটি কণ্ঠস্বর সেই নিস্তব্ধতাকে ভেঙে চুরমার করে দিল।
ডেভিড লী বলে উঠল–ঈশ্বরকে যেন ধীরে ধীরে ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
লিডিয়া বলে উঠল–কে জানত ঐ বৃদ্ধ মানুষটার দেহে এত রক্ত আছে?
সুপারিনটেন্টে সাগডেন তিন বার বেল বাজিয়ে তারপর জোরে জোরে দরজায় ঘুষি মারতে লাগল। শেষপর্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত ওয়ালটার দরজা খুলে দিল।
-ওহো আপনি? ওয়ালটারের মুখে একটা স্বস্তির ছাপ দেখা গেল। আমি এক্ষুনি পুলিশে সংবাদ দিতে যাচ্ছিলাম।
সুপারিনটেন্টে সাগডেন রুস্বরে বলে উঠল–বেল? কীসের জন্য? এখানে কী হয়েছে?
ওয়ালটার ফিসফিস করে বলল,-বৃদ্ধ মিঃ লী…তাকে…
সুপারিনটেন্ডেন্ট তাকে একপ্রকার ধাক্কা মেরে উপরে ছুটলেন। তার আসার খবর কেউ জানতেও পারলো না। সে ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল পিলার কী যেন মেঝে থেকে তুলে নিল। সে দুহাত দিয়ে চোখ ঢেকে ডেভিড লীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। অ্যালফ্রেড বিষণ্ণ মুখে তার বাবার মৃত দেহের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।
জর্জ লীকে একটা ঘোষণা করতে শোনা গেল–পুলিশ না আসা পর্যন্ত এই ঘরের কোনো জিনিষে কেউ হাত দেবে না। এখানকার একটা জিনিষও কেউ ছুঁয়ো না। এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
অ্যালফ্রেড লী সুপারিনটেন্টে সাগডেনকে বলল–আপনি খুব তাড়াতাড়ি এসে গেছেন দেখছি।
-হ্যাঁ, মিঃ সি। কিন্তু এসব কী ব্যাপার বলুন তো?
অ্যালফ্রেড ধরা গলায় বলল–আমার বাবা খুন হয়েছেন।
সুপারিনটেন্টে হাত তুলে বলল–একমাত্র মিঃ লী আর মিঃ জর্জলী ছাড়া সবাই আপনারা ঘর থেকে চলে যাবেন।
সবাই ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকলে সুপারিনটেন্টে পিলারকে বাধা দিয়ে বললেন এখানকার কোনো জিনিষ এখন স্পর্শ বা সংগ্রহ করা যাবে না।
স্টিফেন ফার পিলারের দিকে তাকিয়ে বললেন,–সে কথা উনি ভালো করেই জানেন।
সুপারিনটেন্টে গলার স্বর নরম করে বলল–কিন্তু একটু আগে আমি মেঝে থেকে ওনাকে কী একটা কুড়িয়ে নিতে দেখেছি।
-আমি নিয়েছি?
–হ্যাঁ, আমি আপনাকে নিতে দেখেছি।
–ওহো!
–তাহলে ওটা আমাকে দিয়ে দিন। ওটা আপনার হাতের মুঠোয় রয়েছে।
–আস্তে আস্তে পিলার হাতের মুঠোটা খুলল। খুলতেই দেখা গেল সেখানে খড়ের আংটির মতো একটা রবার আর একটা কাঠের বস্তু রয়েছে। ওর হাত থেকে সেগুলো নিয়ে সুপারিনটেন্টে ভেতরে রেখে দিলেন। তারপর সেই খামটা যে তার বুক পকেটে চালান করলেন।
সে বলল-ধন্যবাদ।
তারা দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে শুনলো-যদি আপনারা আর।
মিণ্ডলশয়ারের চীফ কনস্টেবল কর্নেল জনসনের ছুটি কাটাতে এসে এরকুল পোয়ারোর আলোচনা হচ্ছিল-খ্রীস্টমাসের সময় কোনো অপরাধ অনুষ্ঠান হয় কী না!
-খ্রীস্টমাসটা হল শান্তি, শুভেচ্ছা বিনিময়ের সব জায়গায় শুধু প্রীতি আর শুভেচ্ছা জানানো।
এরকুল পোয়ারো তার চেয়ারে বসে ভালো করে জনসনকে দেখছিল। সে এখানে খ্রীস্টমাস উপলক্ষে জনসনের অতিথি হয়ে এসেছে। সে বলে উঠল তাহলে তোমাদের ধারণা হল-খ্রীস্টমাসের সময় কোনো অপরাধ অনুষ্ঠান হয় না? কেন হয় না? এর কারণটাই বা কী হতে পারে?
জনসন একটু চিন্তা করে নিয়ে বলল–কেন? তোমাকে আমি আগেই বলেছি না খ্রীস্টমাসের সময় মানুষের মনে সৎ চিন্তা প্রতিষ্ঠা করার সময়। অতীতের সমস্ত হিংসা, বিবাদ ভুলে পরস্পর মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এইরকম আর কী?
এরকুল পোয়ারো নিজের মনে বলে উঠল–ইংরেজরা এত অনুভূতিপ্রবণ ছিল যে, তারা কখনও মন্দ কিছু কল্পনাই করতে পারত না।
জনসন জোর গলায় বলল–সেই পুরানো দিনের ঐতিহ্যপূর্ণ উৎসবের কথা ভাবলে বরং লাভই হয়।
যাই হোক, এসো আমরা ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখি তোমার মতে খ্রীস্টমাস হল–আনন্দ উপভোগ করার সময়। তার মানে প্রচুর খাওয়া-দাওয়া আর মদ্যপান করা। আর তার মানেই অতিরিক্ত ভক্ষণ। আর তার ফলে হজমের গণ্ডগোল, তার থেকে শরীরে অস্বস্তি।
পোয়ারো বলল-জনসন, এর থেকেই অপরাধের উৎপত্তি হয়ে থাকে।
–আমি ঠিক এই ব্যাপারে একমত নই। এর আর একটা দিক হল–খ্রস্টমাস হল প্রীতি ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের পন্থা।
–এর অর্থ হল যুদ্ধ থেকে বিরত থাকা। পোয়ারো তার স্বপক্ষে মত প্রকাশ করল–যেমন ধরুন পরিবারের কিছু সদস্য বিদেশে কাটিয়ে খ্রীস্টমাসের সময় মিলিত হয়। আবার বন্ধু তুমি এটা অস্বীকার করবে না যে, দীর্ঘদিন অদর্শনের জন্য পুরোনো ক্ষোভ, মনোমালিন্য জমে থাকার ফলে পরে সাক্ষাতের সময় সেটা সুখের না হয়ে দুঃখেরও হতে পারে। আর এই অশান্তি থেকে অপরাধের জন্ম হতে পারে।
কর্নেল জনসন বলল–আমি কিন্তু ঠিক এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছি না।
-আরে, তোমার তো গ্রহণ করার দরকার নেই। যা গ্রহণ করার আমিই করছি। মানুষের স্বভাব বা ব্যবহারে যে কোনো পরিস্থিতিতে বদলে যেতে পারে। আর সেক্ষেত্রেও শান্ত প্রকৃতির মানুষও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে যেতে পারে।
কর্নেল তার দিকে একবার সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে দেখল।
–আমি বুঝতে পারি না কখন যে তুমি অস্থির হয়ে ওঠো আর কখনই তুমি আমার পেছনে লাগার জন্য তৎপর হয়ে ওঠো।
পোয়ারো হেসে বলল–আমি খুব মজার লোক। আমি এক কৃত্রিম পরিবেশ তৈরী করে মানুষের স্বাভাবিক অবস্থার কথা জানতে পারি।
ঠিক সেই সময়ই কর্নেল জনসনের চাকর এসে বলল–স্যার, সুপারিনটেন্ডেন্ট সাহেবের ফোন এসেছে।
-তুমি যাও আমি আসছি।
ঠিক তিন মিনিট পরে সে ফিরে এল এবং জানাল–স্যার, যতসব অনাসৃষ্টির কাজ এই খ্রীস্টমাস ইভের শুভ দিনে।
পোয়ারো ভ্রূ উপরে তুলে বলল–অবশ্যই এটা খুন।
বৃদ্ধ সাইমন লী ছিলেন অনেক ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। আমার বিশ্বাস তিনি হীরের ব্যবসা করে প্রচুর টাকার মালিক হয়েছিলেন। তারপর তিনি সেই টাকা মেসিন তৈরীর কারখানায় লাগিয়ে ফুলিয়ে ফাপিয়ে তোলেন।
পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন–তিনি সবার প্রিয় ছিলেন তো?
–তাকে সবাই অপছন্দ করত। বহুবছর তিনি পঙ্গু ছিলেন। অবশ্য তাঁর সম্পর্কে আমি বিশেষ কিছুই জানি না। শুধু আমি এইটুকু জানি যে, তিনি আমাদের দেশের এক বিরাট পুরুষ ছিলেন।
–এই কেসটা তাহলে একটা বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে?
–আমাকে খুব শীঘ্রই লংডেন গিয়ে পৌঁছতে হবে।
জনসন বলল–একটা কথা তোমাকে বলতে লজ্জা পাচ্ছি। সাগডেন মানুষ হিসেবে ভালো সাবধানী এবং পরিশ্রমী। কিন্তু অনুমান ক্ষমতা অতটা প্রখর নয়। তাই মনে হয় তোমার উপদেশ এখানে কাজে লাগতে পারে।
পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে জানালো–এতে আমি খুশীই হবে। আমাকে তোমার একজন করে ধরে নিতে হবে। আমি সুপারিনটেন্ডেন্টের মনে আঘাত দিতে চাই না।–এই কেসটা তার আমার নয়, যে সরকারী ভাবে আমি তার পরামর্শদাতা।
জনসন বলল-পোয়ারো তুমি একজন সজ্জন ব্যক্তি। তারপর তারা দুজন লংডেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল।
একজন কনস্টেবল সামনের দরজা খুলে দিল।
সাগডেন বলল–স্যার আপনাকে পেয়ে আমি খুব খুশী। প্রথমে আমরা মিঃ লীর স্টাডিরুম থেকে ঘুরে আসি। সেখানে এই সম্বন্ধে একটু আলোচনা করে নিতে চাই।
চীফ কনস্টেবল পোয়ারোর সঙ্গে সাগডেনের পরিচয় করিয়ে দিল।
কর্নেল জনসন অধৈর্য হয়ে বলল-সাগডেন তাহলে এবার ঘটনাটা জানা যাবে।
-হ্যাঁ, স্যার এটা যে খুন সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ। ডাক্তারের কাছ থেকে জেনেছি গলার শিরা কেটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন যেন অদ্ভুত।
-আপনাকে আমি সমস্ত ঘটনা জানাতে চাই স্যার।
-আজ বিকেল পাঁচটার পর এগজেনফিল্ড পুলিস স্টেশনে মিঃ লী ফোন করে আমাকে বলেন, আজ সন্ধ্যে আটটায় তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আর তার সঙ্গে তিনি এও বলে দেন, বাড়ির খানসামা যদি জিজ্ঞাসা করে কেন আসছি তাহলে আমি যেন বলি পুলিশ চ্যারিটির চাঁদা আদায় করতে।
–তার অর্থ এই দাঁড়াচ্ছে কোনো একটা অজুহাতে এই বাড়িতে প্রবেশ করা।
–ঠিক তাই স্যার। মিঃ লী একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি তাই ওনার অনুরোধ রাখতে আটটার কিছু আগেই আসি।লী আমাকে তার ঘরে ডেকে পাঠান। তিনি একটা ফায়ার প্লেসের সামনে বসেছিলেন। তিনি একটা ড্রেসিং গাউন পরেছিলেন, আমি বসার পর তিনি আমাকে জানালেন যে, ওনার আলমারি থেকে কতকগুলি মূল্যবান হীরে চুরি গেছে। সেগুলো কয়েক হাজার পাউণ্ডের।
চীফ কনস্টেবল জিজ্ঞাসা করলেন হীরে?
আমি তখন তাকে জিজ্ঞাসা করি আপনি কী করতে বলেছেন? তিনি তখন আমায় বললেন ঠিক আছে আপনি রাত নটা নাগাদ একবার আসুন। আপনাকে তখন সঠিক খবর জানাবো হীরেগুলো চুরি গেছে না যায়নি। ব্যাপারটা আমার কাছে রহস্যজনক লাগলেও আমি তার প্রস্তাবে রাজী হয়ে যাই।
জনসন বলল–এটা সত্যিই রহস্যজনক।
অনেক রকম ধারণাই আমার আছে। এখানে কৌতুকের কোনো প্রশ্নই নেই। আমার দৃঢ়বিশ্বাস হীরেগুলো চুরিই হয়েছে। কিন্তু ঐ বৃদ্ধ লোক নিশ্চিত নন? কে চুরি করতে পারে ঠিক জানেন না। তবে তিনি দুজন লোকের ওপর সন্দেহ করেছেন। এক তার বাড়ির চাকর, আর দ্বিতীয় জন তার পরিবারের একজন সদস্য।
পোয়ারো মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলেন–এর থেকে বোঝা যায় তার মনোভাব বেশ ভালোই ছিল। হয়তো তিনি এ কারণে পুলিশকে জানিয়েছেন, যদি তারা অপরাধ কবুল করেন তাহলে তিনি ব্যাপারটা ধামাচাপা দেবেন।
জনসন বললেন–আর যদি তার সন্দেহ নিরশন না হয়?
তিনি তাহলে পুলিশের হাতে কেসটা তুলে দেবেন।
–আচ্ছা, পরিবারের কে সেই সদস্য। সেই বিষয়ে আপনার কোনো ধারণা আছে?
–না স্যার।
মাথা নেড়ে জনসন বলল–ঠিক আছে তারপর কী হল বলুন।
সাগডেন আবার বলতে শুরু করল। ঠিক নটা পনেরো, আমি দরজায় বেল টিপতে যাবো আর ঠিক সেই সময়ই আমি ভেতর থেকে একটা আর্ত চিৎকার এবং সকলের সম্মিলিত চিৎকার শুনতে পাই। শুনে আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি এবং ঘনঘন বেল টিপতে থাকি। কিন্তু তিন-চার মিনিটের আগে দরজা খোলা হয়নি। যাই হোক যে চাকরটা এসে দরজা খোলে সেই চাকরটা জানায় লী খুন হয়েছে। আমি তখন তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে যাই। গিয়ে দেখি ঘরের সব আসবাবপত্র ছড়ানো ছেটানো। আর লীর রক্তাপ্লুত দেহটা ফায়ার প্লেসের সামনে পড়ে আছে। তার গলা দিয়ে তখন রক্ত বেরোচ্ছে। কার্পেটটা লালে লাল হয়ে গেছে।
চীফ কনস্টেবল তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন হয়তো তিনি নিজেই এইরকম করেছেন।
সাগডেন মাথা নেড়ে বলল–অসম্ভব স্যার, যেভাবে চেয়ার টেবিল ওলটপালট ছিল তাতে মনে হয় না, তিনি তার পঙ্গু পা নিয়ে এসব করতে পারেন। আর তিনি যদি সত্যিই আত্মহত্যা করতেন তবে সেই ধারালো ছুরিটা পাশে পরে থাকতে দেখা যেত। এখানে কিন্তু সেইরকম কিছুই হয়নি।
-হ্যাঁ, আপনার সিদ্ধান্তই ঠিক।
–এর থেকে কী অনুমান করা যায়? এই বাড়ির কেউ এইরকম নিষ্ঠুর কাজ করে থাকবে। বাইরের কেউ তাকে খুন করে পালাবে কী ভাবে?
-জানালাগুলো বন্ধ ছিল না ভোলা ছিল?
–তার ঘরের দুটো জানালার একটা বন্ধ আর লক করা ছিল। আর অপরটি ইঞ্চিখানেক ফাঁক করা ছিল। সেখানে কারো পায়ের বা হাতের ছাপ ছিল না। আর সেখান দিয়ে কেউ পালাতে পারে আমি তা চিন্তাই করতে পারি না।
জনসন বলে উঠল–আশ্চর্য, একটা বন্ধ ঘরে একজন খুন হল অথচ খুনী কোন পথে পালালো তা বোঝা যাচ্ছে না। এইরকম অদ্ভূত হত্যাকাণ্ড গোয়েন্দা গল্পেও পাওয়া যায় না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এক অতি প্রকৃত শক্তির কাজ।
সাগডেন সূক্ষ্ম হাসি হেসে বলল–না স্যার, ঠিক ততটা মন্দ আমার মনে হয় না।
–কিন্তু আপনি যে বলেছিলেন দরজাটা ভেতের দিক থেকে বন্ধ ছিল।
সুপারিনটেন্টে একটা চাবি বের করে টেবিলের উপর রেখে বলল-দেখুন এতে কোনো হাতের ছাপ নেই। একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখুন।
সামনের দিকে ঝুঁকে দুজনে চাবিটাকে ভালো করে পরীক্ষা করতে লাগল। পোয়ারো চাবির শেষ প্রান্তে কতকগুলো দাগ দেখতে পেল।
-হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি। চাবির গর্তের ভেতর দিয়ে চাবিটা সাঁড়াশি জাতীয় কোনো বস্তু দিয়ে ঘরের ভেতরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এর থেকে মনে হতে পারে ভেতর থেকে যখন দরজা বন্ধ ছিল তখন এটা একটা আত্মহত্যার ঘটনা। খুনী নিশ্চয়ই প্রথমে ঘটনাটা এইভাবে সাজিয়ে থাকবে। কিন্তু একটা প্রশ্ন আপনাদের খুনী যদি এতই চতুর, তাহলে একটা অস্ত্র ফেলে গেল না কেন? যাতে মনে হতে পারে সেই অস্ত্র দিয়েই মিঃ লী আত্মহত্যা করেছেন। পোয়ারো বলল –অস্ত্র যখন নেই তাহলে ধরে নেওয়া যাক এটা একটা আত্মহত্যার ঘটনা না। এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে খুনীর পক্ষে একটা মারাত্মক ভুল।
সুপারিনটেন্টে সাগডেন বললেন,–আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি সব অপরাধীই একটা ভুল করে যাবেই।
পোয়ারো বলে–যাই হোক; ভুল করা সত্ত্বেও অপরাধী অপরাধ এড়িয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছে। আমার অনুমান তাকে আমরা খুব শীঘ্রই সনাক্ত করতে পারব।
এই বাড়ির কাউকেই তো আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করিনি। সাগডেন দৃঢ়ভাবে বলল।
কর্নেল বলল-দুর্ঘটনার সময় যারা এ বাড়িতে ছিল তাদের কোনো তালিকা আছে?
সাগডেন নোটবুক পড়তে লাগল–মিঃ এবং মিসেস অ্যালফ্রেড লী, এম. পি. মিঃ জর্জ লী এবং তার স্ত্রী। মিঃ হেনরি লী, মিঃ এণ্ড মিসেস ডেভিড লী, মিস পিলার এস্ট্রাভাডোস, মিঃ স্টিফেন ফার, তারপর চাকর-চাকরানি, খানসামা এডওয়ার্ড ট্রেসিলিয়ান, ভৃত্য ওয়ালটার চ্যাম্পিয়ান, রাঁধুনী এমিলি রীভস, রান্নাঘরের পরিচারিকা কুইন জোন্স, প্রধান পরিচারিকা গ্লোডিয়া সেপাট, দ্বিতীয় পরিচারিকা গ্রেস ব্রেটে, তৃতীয় পরিচারিকা বেগ্রিস মস্কোব, পরিচারিকা জোরন ফেঞ্চ, সাজভৃত্য সিডনি হারবারি।
–কতজন পরিবার এখানে স্থায়ীভাবে বাস করে, আর কতজনই বা খ্রীস্টমাসে বেড়াতে এসেছে? কর্নেল জিজ্ঞাসা করল।
–মিঃ এণ্ড মিসেস অ্যালফ্রেড লী স্থায়ীভাবে বাস করে আর বাকীরা বাইরে থেকে বেড়াতে এসেছে।
এরপর সাগডেন তাদের সাইমন লীর ওপরতলার ঘরে নিয়ে গেল।
ঘটনাস্থলে প্রবেশ করে চেয়ার যত্রতত্র ছড়ানো, সর্বত্র রক্তের ছিট দেখে কর্নেল জনসন মন্তব্য করলনে-খুবই ভয়ঙ্কর। এ যেন কসাইখানা।
বৃদ্ধের মৃতদেহের সামনে বসে একজন মাঝবয়েসী ছেলে কী যেন পরীক্ষা করছিল।
ডাক্তার কিছু পেলেন নাকি?
–তদন্তের সময় আমি আপনাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় জানাবোখন। শূকরছানার মত কণ্ঠনালী, কাটা হয়েছে। এক মিনিটের মধ্যে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলেই তার মৃত্যু হয়েছে।
পোয়ারো হামলা দুটো খুঁচিয়ে দেখে মৃত দেহের দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর ঘরের অবিন্যস্ত জিনিষগুলোর ওজন আন্দাজ করতে গিয়ে তার ভ্রু কুঁচকে উঠল।
বিড়বিড় করে পোয়ারো বলল–এমন দুর্বল বৃদ্ধ আর তবুও এসব ভারী ভারী জিনিষ।
জনসন সার্জেন্টের দিকে ফিরে বলল–ছাপগুলোর ব্যাপার কী?
–ঘরের সর্বত্র অনেক ছাপ দেখতে পেয়েছি স্যার। আর আলমারীর ওপর ঐ বৃদ্ধের হাতের ছাপ ছাড়া আর কারো হাতের ছাপ নেই।
এবার ডাক্তার অভিমত জানালোতাকে যেই খুন করুক না কেন নিশ্চয়ই তার গায়ে রক্ত লাগবে।
পোয়ারো বলল–প্রয়োজন নেই। রক্তক্ষরণ হয়েছে সম্পূর্ণভাবে কণ্ঠনালীর শিরা থেকে। অন্য শিরাগুলোর থেকে রক্ত ছিটকে যাবার সম্ভাবনাও কম। এখানে একটা কিছু আছে, সংঘর্ষ.. এবং রক্ত-রক্তের ধাঁধা…কিভাবে যে এর ব্যাখ্যা করব? চেয়ার, কার্পেট, টেবিলে এতে রক্তের ছড়াছড়ি। অমন শুকনো, রোগা, দুর্বল স্বাস্থ্যের বৃদ্ধের দেহে এত রক্ত আসে কী করে?
উত্তরে সাগডেন বলল–ঐ মহিলা, মিসেস অ্যালফ্রেড ফিসফিস করে বলেছিল–কে ভেবেছিল, ঐ বৃদ্ধটার দেহে এত রক্ত ছিল…,তখন কথাটার গুরুত্ব অনুভব করিনি।
পোয়ারো নরম গলায় বলল-ওটা লেডি ম্যাকবেথের উক্তি।
স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে অ্যালফ্রেড লী ছোট্ট স্টাডিরুমে এসে ঢুকল। সেখানে পোয়ারো, সাগডেন এবং চীফ কনস্টেবল অপেক্ষা করছিল।
কর্নেল জনসন এগিয়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে পরিচিত হল এরপর মিঃ এণ্ড মিসেস লীর সঙ্গে পোয়ারোর পরিচয় করিয়ে দিল।
তারপর বলল–আজ রাতে যারা এই বাড়িতে ছিল তাদের একটা তালিকা পেয়েছি।
সাগডেন তালিকাটা মিঃ লীকে পড়ে শোনালেন।
অ্যালফ্রেড বলল–তালিকাটা ঠিক আছে।
–শুনেছি আপনার সব ভাইয়েরা এবং তাদের স্ত্রীরা এখানে খ্রীস্টমাসের ছুটিতে বেড়াতে এসেছেন? তবে মিস্ এস্ট্রাভাভোস আর মিঃ ফার এরা কারা? জানতে চাইলেন কর্নেল।
-মিস এস্ট্রাভোস আমার ভাগ্নী। আর মিঃ ফার, দক্ষিণ আফ্রিকার আমার বাবার একসময়ের পার্টনারের ছেলে।
হঠাৎ লিডিয়া বলে ওঠে–আসলে মিঃ ফার হঠাই এখানে এসে পড়ে। আমার শ্বশুরমশাই ওর পরিচয় পেয়ে ওকে এখানেই থেকে যেতে বলেন।
–আচ্ছা, মিসেস লী, আপনাদের চাকর-বাকর সকলকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়?
-হ্যাঁ প্রায় সবাইকে বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হয়। কেবল নবাগতা জোয়ান আর আমার শ্বশুরমশাইয়ের সাজভৃত্য সিডনী হারবারি ছাড়া। সে মাত্র একবছর হয়েছে এসেছে। তবে আমার মনে হয় আমার শ্বশুরমশাই তার কাজে সন্তুষ্ট ছিলেন। জোয়ান ছিল বিশ্রী স্বভাবের মেয়ে।
এবার কর্নেল জনসনকে জিজ্ঞেস করল মিঃ লী, এবার আপনি আজ রাতের ঘটনার কথা বলুন।
অ্যালফ্রেড নীচু গলায় বলতে শুরু করল–তখন সোয়া ছটা হবে ওর কাছে কিছুক্ষণ থেকে ওকে শুভরাত্রি জানিয়ে চলে আসি।
বাধা দিয়ে পোয়ারো বলল–আপনি তাকে ছটার সময় শুভরাত্রি জানিয়ে আসেন কেন? রাত্রে ওর সাথে আপনার আর দেখা হয় না?
অ্যালফ্রেড জানালো যে, তার বাবা হাল্কা খাওয়ার জন্য সন্ধ্যে সাতটায় শুয়ে পড়েন আর তারা খেয়ে-দেয়ে ওঠে আটটায়। সেইদিন ওরা যখন নীচে ডাইনিংরুমে সকলে খাচ্ছে ঠিক সেইসময় ওপর থেকে আসবাবপত্র পড়ে যাওয়ার আওয়াজ আর ঠিক তার পরেই তার বাবার ভয়ঙ্কর চিৎকার যা ভোলা যাচ্ছে না। শুনে এক মিনিট হতবাক হওয়ার পরই ওরা ওপরে গিয়ে যখন দরজা বন্ধ দেখল তখন দরজা ভাঙতে বাধ্য হল এবং ভেতরে…
কর্নেল জনসন আলফ্রেডের উদভ্রান্ত দৃষ্টি ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনে তাকে থামতে বলল।
পোয়ারা জানতে চাইল-চিৎকারের সময় কে ছিল?
–আমার ভাই হ্যারি।
–আর কেউ ছিল না?
না।
-বাকী সকলে কোথায় ছিল?
-আমরা পারিবারিক আলোচনায় মেতে উঠি, জর্জ কাকে ফোন করতে চলে যায়, স্টিফেনও হঠাৎ উধাও হয় আর ডেভিড কোন ফাঁকে চলে যায় বুঝতেও পারিনি।
-তাহলে আপনি পরিবারের বিশেষ কোনো লোকের সাথে বিশেষ কিছু আলোচনা করছিলেন?
-আপনি কী বলতে চাইছেন মিঃ পোয়ারো? ফুঁসে উঠল লিডিয়া।
আপনার স্বামী এই মাত্র বললেন পারিবারিক আলোচনা, জর্জ, স্টিফেন, ডেভিড সকলেই চলে যায় যখন তখন এটা সীমাবদ্ধ আলোচনা!
-আমার দেওর হ্যারি বহুকাল বাইরে ছিল তাই তার সাথেই কথাবার্তা বলছিলেন আমার স্বামী।
এরপর জনসন হীরের কথা জানতে চাইলেন, অ্যালফ্রেড জানালো, সে হীরের ব্যাপারে জানে। তার বাবা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ঐ অখচিত হীরেগুলো এনেছিলেন এবং সবসময় নিজের ঘরের আলমারীতেই রাখতেন। এক একটা হীরের মূল্য দশ পাউণ্ডের কাছে তাও জানালেন অ্যালফ্রেড।
এরপর কর্নেল তাদের জানালো হীরেগুলো চুরি গেছে। ওরা দুজনে হতবাক হয়ে গেল।
পোয়ারো মিসেস লীকে কোনো চাকর-বাকরকে সন্দেহ হয় কী না বলতে জানা গেল সবাই বিশ্বাসী লোক। তবে শ্বশুরমশাইয়ের ঘরে সবসময় থাকত দ্বিতীয় পরিচারিকা হারবারি। অন্যান্য সব মেয়েদের কথা বলতে গিয়ে লিডিয়া জানালো ম্যাগজলেন ফোন করতে গেছিল, পিলার কোথায় গেছিল সে জানে না আর হিলডা ডেভিডের সঙ্গে অর্থাৎ সে একাই ছিল ডাইনিংরুমে।
এরপর মিঃ লীর কাছ থেকে জানা গেল পুরোনো আলমারী খোলার পদ্ধতি একটা নোটবুকে ছিল আর সেটা তার বাবার গাউনের মধ্যেই থাকে সবসময়।
আর বাকী সকলকে একে একে পাঠাতে বলে তাদের চলে যেতে বলল ওরা।
এরপর জর্জ এসে তার মতামত জানালো–সে তখন ফোনে কথা সবেমাত্র শেষ করেছে আর ঠিক সেই সময়ই তার ধারণা এটা কোনো পাগলের কাজ।
এরপর তাকে হীরের ব্যাপারে জানানো হল। তা শুনে জর্জ হতবাক হয়ে গেল। সে জানত না যে হীরেগুলো চুরি গেছে।
এরপর দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে ঘরে ঢুকলো হ্যারি, ঢুকেই কোনো একটা ব্যাপারে সে নার্ভাস হয়েছিল বটে কিন্তু কাউকেই বুঝতে দেয়নি।
হ্যারি জানাল দীর্ঘ কুড়ি বছর পর যখন তার বাড়িতে ফিরতে মন করছে ঠিক তখনই সে বাবার চিঠি পেল আর বাড়ি ফিরে এল স্থায়ী ভাবে থাকার জন্য। তার বাবাও খুবই খুশী হয়েছিল। কিন্তু তার ভাই অ্যালফ্রেড এতে রেগে যায়। তবে তার স্ত্রীর কথা সে জানে না। সে খুব ভালো মেয়ে। আর অ্যালফ্রেড খুব কর্তব্যপরায়ণ।
খুনী কে হতে পারে বলতে গিয়ে হ্যারি বলল যে, সে ঐ বুড়ো শয়তানকে কখনই সহ্য করতে পারে না আর যেহেতু তার বাবা তাই খুনের বদলা নিতে সে চায়, তার ধারণা বাড়ির কেউ খুনী। তবে চাকর-বাকরদের কেউ না। তারা খুব বিশ্বাসী। অ্যালফ্রেড বাবাকে খুব ভালোবাসত। জর্জের খুন করার সাহস নেই আর ডেভিড নিজের হাতের আঙুল কেটে গেলেই অজ্ঞান হয়ে যায়।
তবে কী ফারকে সন্দেহ করা যেতে পারে?
হ্যারি আরো জানালো চায়ের পর বাবা তার সাথে উইল বদলের কথা বলছিলেন। আগের উইলে তার আর ভাগ্নী পিলারের নাম ছিল না, তাই যোগ করতে তিনি সকলের সামনেই খ্রস্টমাসের পর উকিলকে দেখা করতে বলে। আর আর্তনাদ হওয়ার আগের মুহূর্তে সে তার ভাই আলফ্রেডের সঙ্গে ডাইনিংরুমে তর্ক করছিল, এই কথা জানিয়ে সে চলে যায়।
এরপর আঁটো পোষাকে শরীরের উঁচু নীচু রেখাগুলো স্পষ্ট করে সামনে এসে দাঁড়ায় ম্যাগজলেন।
ম্যাগজলেন জানালো সে খুনের ব্যাপারে কিছুই জানে না। তবে বিকেলে তারা সকলে মিঃ লীর ঘরে যায়। সেখানে হারি আর ডেভিডের এমন ঝগড়া হয় যে, সে যেন তক্ষুনি তার হ্যারিকে খুন করবে। কারণ তার স্ত্রীকে ইতর বলা হয়েছিল। এরপর ম্যাগজলেন সতর্ক হয়ে বলে সে এইভাবে ব্যাখ্যা করতে চায়নি। এই ঘটনার পর হিলডা ডেভিডকে শান্ত করে।
খুনের সময় সে কোথায় ছিল জানতে চাইলে ম্যাগজলেন বলল, সে একা ফোন করতে এসে ছিল। ঠিক তখনই আর্তনাদ।
সে চলে গেল। পোয়ারো জানাল উপরে মিঃ লীর ঘর ছাড়া এখানে একটা ফোন আছে। এখানে মিঃ এবং মিসেস জর্জ লী একসাথে দুজায়গায় ফোন করল তাও একা…এটা একটু অবাস্তব। আরো একটা ব্যাপার সাইমন লী যে সময় সকলকে তার ঘরে ডাকলেন ঠিক সেই সময়ই তিনি উকিলকে ফোন করে মানুষের মনে অর্থলিপ্সা, লোভ জাগিয়ে তুলে একটা আনন্দ অনুভব করতে চেয়েছিলেন।
এরপর ঘরে ঢুকল অস্বাভাবিক শান্ত এক মানুষ। মিঃ ডেভিড লী।
সে জানালো, সে আর তার স্ত্রী ডাইনিংরুমের পাশে মিউজিক রুমে ঘটনাটা ঘটার আগে পর্যন্ত পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন। চিৎকার শোনার পর ওপরে যায়।
তার বাবা আলোচনায় কী বলেছিল বলতে গিয়ে সে জানালো তার বাবার মতে তারা সকলে বাজে অকাজের। পৃথিবীর কোনো না কোনো জায়গায় কুপথে জন্মালেও তার ভালো ছেলেরা আছে ইত্যাদি। সব বাজে কথা।
খুনী কে বলতে গিয়ে সে জানালো কাউকে তার সন্দেহ হয় না এবং ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
এরপর শক্তসমর্থ চেহারায় সাধারণ পোষাক পড়ে ঘরে ঢুকল হিলডা।
পোয়ারো তাকে তার শ্বশুরমশাই-এর ঘরে সকলকে ডাকার পর তার শ্বশুরমশাই জর্জ লীকে কি বলেছিলে তাই জানতে চাইলে হিলডা বলল, তার শ্বশুরমশাই জর্জকে যে মাসোহারা পাঠাতো তা থেকে কম দেবেন বলেছিলেন। কারণ আয় কম আর পরিবারের সদস্য বাড়তে চলেছে বলে, মানে হ্যারির কথা তিনি বলেছিলেন। হীরের কথা বলতে হিলডা জানালো এই ব্যাপারে সে কিছু জানে না। তারপর তিনি আরো বলেন উইল বদল করুক আর না করুক, তার শ্বশুরমশাই আসলে সব ছেলেদের থেকে তারপর ফোন করার অর্থ ছেলেদের মনে অর্থলোভ জাগিয়ে তোলা। হিলডার ধারণা ছিল তার শ্বশুরমশাই সব ছেলেদের একত্র করে একটু আনন্দে দিন কাটাতেন কিন্তু তিনি একটা অদ্ভুত খেলায় মেতে উঠেছিলেন, সে আরো বলল, তার শাশুড়ির নামে তিনি সকলের কাছে নিন্দা করলেই ডেভিড তার উপর রেগে যায় কারণ ডেভিড মায়ের ভক্ত ছিল।
উইল বদল করার ব্যাপারে হিলডা জানালেন হয়তো পিলারের নাম ঢোকানোর জন্য উইল বদলাতে চয়েছিলেন তিনি। অবশেষে সে জানালো সে তার স্বামীর সাথে মিউজিক রুমে ছিলেন এই বলে সে ঘর থেকে চলে গেল।
জীবজন্তু ফাঁদে পড়ার ভয় নিয়ে ঘরে ঢুকলো পিলার।
তারপর পিলার শুরু করল। সে তার মার কাছ থেকে শুনে এসেছিল তার দাদামশাই বৃদ্ধ শয়তান! এখানে এসে তার মনে হয়েছিল তিনি যৌবনে সুপুরুষ ছিলেন। হীরেগুলো সে দেখেছে এবং ভেবেছে যদি সে রোজ তার কাছে এসে বলে তাহলে তাকে দাদামশাই হীরে দিতে বাধ্য।
হীরে চুরি যাবার কথা শুনে সে বলল, বেড়ালের মতো স্বভাব হারবারির সব বেড়াল চুরি করে আর হয়তো এটা তারই কাজ।
এরপর সে দাদামশাইয়ের ঘরে আলোচনার কথা বলতে গিয়ে বলল তার দাদামশাইয়ের কোনো বংশধর নেই বলেই তিনি রেগে গিয়েছিলেন আরো। তারপরই সকলে ঘর থেকে চলে যায় শুধু হিলডা বাদে। অবশেষে জানায় অপরাধ ঘটনার সময় সে তার ঘরে যায় প্রসাধন সারার জন্য আর তখনই…
এরপর ঘরে ঢুকল স্টিফেন ফার। তার বাবা আর সাইমন ছিল বিজনেস পার্টনার।
তাকে প্রথমে হীরে সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে সে বলে সে ঐ ব্যাপারে জানে না। সাইমন লীর চরিত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে সে বলে যে লী ছিলেন চরিত্রবান মানুষ এবং যৌবনে অনেক স্ত্রীঘটিত মামলাতে তিনি জড়িত ছিলেন। এবং একজনকে তিনি খুঁজছিলেন প্রতিশোধ নেবার জন্য। তবে সেটা আমার বাবা নয়। তার সঙ্গে আমার বাবার কখনই কোনা বিরোধ হয়নি। শেষে সে জানালো তার এই অঘটন ঘটার সময় সে এবং পিলার বলরুমে নাচ করছিল।
ফার চলে যেতে জনসন বলল হয়তো এ-ই হীরে চুরি করেছে। এর হাতের ছাপ নেবার ব্যবস্থা করো।
সাগডেন জানালো আগেই নেওয়া হয়ে গেছে।
এরপর জনসন বলল, ফোন কল কোন সময় এসেছিল তা জানার চেষ্টা করুন, হারবারি কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, কখন ঢুকেছে, কে তাকে দেখেছে খোঁজ নিন, প্রবেশ পথগুলো খুঁটিয়ে দেখুন। উকিলের সাথে কথা বলে বিষয়বস্তু কী জেনে নিন। বাড়ি ভালো করে সার্চ করুন কোথাও রক্তমাখা জামা বা হীরে পান কী না দেখুন।
পোয়ারো বলল বাড়ির সকলকে বারবার ধরে প্রশ্ন করলে আসল সত্যটা জানা যেতে পারে। এদের মধ্যে বেশীরভাগই মিথ্যা বলছে।
কর্নেল এক এক করে সকলের কথা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলল–অ্যালফ্রেড এবং তার স্ত্রী রমণীয়। জর্জ লী এম. পি. আর তার স্ত্রী আধুনিকা। ডেভিড ভীতু প্রকৃতির আর তার স্ত্রী সমঝদার। পিলার দাদুর গলায় ছুরি বসাতে পারে না। তাহলে স্টিফেন ফারের সম্ভাবনা থাকতে পারে।
পোয়ারো জানাল-স্টিফেন একমুহূর্তে বৃদ্ধকে খুন করতে পারে তার জন্য ধস্তাধস্তির দরকার হয় না। এটা কোনো দুর্বল লোক বা স্ত্রীলোকের কাজ।
এরপর বৃদ্ধ ট্রেসিলিয়ান ঘরে ঢুকতে তাকে হারবারি সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হলে জানালো পুলিশ আসার পর যা ঘটেছে। কাপ ভাঙার কথাও বলল সে এবং তার পরই হারবারি সিনেমা যায় তবে বাড়ির পেছনে যেখান দিয়ে চাকরেরা বের হয় সেখান দিয়ে নয় রান্নাঘর দিয়ে সে বেরিয়েছে সেখানকার পরিচারিকা তাকে দেখেছে। আরো জানালো পিছনে দরজার চাবি হারবারির কাছেই থাকে আর দরজাতে ছিটকানি দেওয়া থাকে না। তারপর সে চলে যায়।
হারবারি সবেমাত্র বাড়িতে প্রবেশ করে। তার ডাক পড়ল তখনই।
হারবারি জানালো সে সন্ধ্যে সাতটায় মিঃ সাইমনকে নৈশভোজ সারিয়ে সুপার হলে লাভ ইন ওল্ড সোভল সিনেমা দেখতে যায়। যেখানে তাকে কমিশনার দেখেন আর তারপর তার প্রেমিকা ডেরিসের সঙ্গে সে দেখা করে এসেছে। সে জানায় যে হীরের ব্যাপারে সে কিছু জানে না। কিন্তু তারপরই হঠাৎ সে বলে বসে হীরে চুরি নিয়ে অ্যালফ্রেডকে কখনই মিঃ লী সন্দেহ করতে পারে না। তার সঙ্গে হ্যারির থাকা নিয়ে মিঃ লীর ঝগড়া হচ্ছিল।
পোয়ারো তাকে বলে–হীরের কথা তুমি তো আমরা বলার আগে জানতে না-তাহলে এখন কী করে হীরের কথা বলছ?
হারবারি জানালো মিঃলী ফোনে কাকে যেন হীরের কথা বলছিল তখনই সে শুনেছে। বলে সে চলে যায়।
পোয়ারো বলল–হয়তো সেই চোর আর খুনী। আবার বলল–হয়তো সে শুধুই চোর, আবার বলল, হয়তো আটটার সময় পুলিশ আসার কথা শুনে সে ভয়ে চলে গেছে পাছে তাকে সন্দেহ করা হয় তাই।
আলমারী খুঁজে হীরে পাওয়া গেল না, পাওয়া গেল খালি একটা ব্যাগ আর পনেরো বছর আগের একটা উইল, যাতে লেখা ছিল অর্ধেক সম্পত্তি অ্যালফ্রেডের বাকী অর্ধেক জর্জ, ডেভিড আর জেনিফার মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে।
৪-৬. আলো ঝলমলে দুপুরে
০৪.
২৫শে ডিসেম্বর।
আলো ঝলমলে দুপুরে পোয়ারো বাগানে বেড়াচ্ছিল। সেখান থেকে সে দেখল পিলার আর হ্যারিকে সাঁতার কাটতে।
এমন সময় মিসেস জর্জ লী এসে জানালো ব্যাপারটা কেমন যেন খাপছাড়া। কাল রাতে অমন ঘটনার পর এমন দৃশ্য বেমানান। তারপর সে পিলার সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করল এবং বলল, তার শ্বশুরের মৃত্যুটা ইংরেজ সুলভ নয়। এবং সে সেখান থেকে চলে যায়।
তারপর সাগডেন এসে জানায় হারবারি সত্যি কথা বলেছে। সে সত্যিই তার মেয়েবন্ধুর সাথে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল এবং তার লেখিকা তার সাথেই ছিল। আর ওয়েস্টবরিংহামের থেকে ফোন যে এসেছিল তার ছমিনিট পর সে ফোন কেটে যায়। আর এর থেকে বোঝা যায় মিসেস জর্জ লী মিথ্যে কথা বলেছিল তাহলে সে এখন কোথায় ছিল আর ফোন ছাড়ার দশমিনিট পর আর্তনাদ শোনা যায় তবে সেই সময় জর্জ কোথায় ছিল?
এবার পোয়ারো ম্যাগজলেনের কাছ থেকে জানা কথাটা সত্যি কীনা জানতে চাইল সাগডেনের কাছে। সাগডেন পিলার যে কুড়িয়েছিল তাই বলেছিল। কুড়িয়েছিল রবারের টুকরো ছিদ্রসহ আর একটা পেরেক।
এবার ওরা ডায়েরী খুলে সকলের কথাগুলো পড়ে সাগডেন বলল, হ্যারির নাম উঠে আসবে বলে সে বাবাকে না মেরে বাঁচিয়ে রাখতেই চাইবে। মিঃ আর মিসেস অ্যালফ্রেডকেও বাদ দেওয়া যায়। পিলারকেও সন্দেহ-এর বাইরে রাখা যায় আর স্টিফেন যে এমনিও বেড়াতে এসেছে তাকে বাদ দিলে জর্জলী আর মিঃ ও মিসেস ডেভিড। এদের মধ্যে জর্জ লীই সন্দেহজনক আর মিসেস জর্জ লীও সন্দেহ তালিকভুক্ত। কারণ তারও টাকার উপর সমান লোভ।
ডেভিড লীকে তারা সন্দেহ করছে এই ভেবে যে, সে তার মার মৃত্যুর ঘটনা ভুলতে পারছে না। তাই হয়তো…
তারা আলোচনা করতে করতে বলল, বিকেলে পারিবারিক মিলননোৎসবে সকলে যখন একত্র হবার পর চলে যাচ্ছিল তখন হিলডা কিছুক্ষণের জন্য ঘরে ছিল। তার পর আসে অ্যালফ্রেডও আর তার পর আসে হ্যারি। এরপর সে ফোন করে সাগডেনকে। হয়তো রাত আটটার পর সে আসল চোরকে ধরতে পারে মিঃ অথবা মিসেস জর্জ আবার পিলারও হতেপারে। তার বাবাও একজন অপরাধী আর তার জন্য সেও অপরাধ করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়, এবং ঐ বৃদ্ধকে খুন করতে বাধ্য হয়।
সাগডেন শহরের লোকের মতামত বলতে গিয়ে জানালো তারা বলছে মিঃ সাইমন লীর অনেক মেয়েকে বিয়ে করে আর সেই স্ত্রীকে পরে টাকা দিয়ে ছাড়ে এজন্য তার স্ত্রী ভগ্ন হৃদয়ে মারা যান। এই প্রতিশোধ নিতে গিয়েই হয়তো কোনো ছেলে তাকে খুন করে।
পোয়ারো একটা কথা বলতে গিয়ে থামল। তাদের দিকে হিলডা আসছে। সাগডেন বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
হিল পোয়ারোকে বলল, আপনাকে দেখে আমার সবচেয়ে বুদ্ধিমান বলে মনে হয়েছে, আর মনে হয়েছে আপনিই আমাকে সাহায্য করতে পারতেন। আমার স্বামী মায়ের ভক্ত। বলে সে স্বামীর মনোভাবের কথা, বাবার ওপর ডেভিডের মনোভাবের কথা জানালো। সে বলল, তার স্বামী তার বাবাকে সহজেই খুন করতে পারে কিন্তু সেই সময় সে পিয়ানো বাজাচ্ছিল।
এই কথা বলতে বলতে উপস্থিত হল ডেভিড। সে হিলডাকে নিয়ে গেল খ্রীস্টমাসের আনন্দ উৎসব দেখতে।
বাগানে হাঁটতে হাঁটতে তার দেখা হল লিডিয়ার সঙ্গে। সে জানালো তার স্বামী তার সাথে দেখা করে যায়। এখন সে ঘুমোচ্ছে তাই একটু পরই পোয়ারোর সাথে সে দেখা করবে।
তারপর লিডিয়া খুনের ব্যাপারে জানতে চাইলে পোয়ারো বলে বাড়ির কেউ একজন তাকে খুন করেছে।
এই কথার পর লিডিয়া চলে যায় আর পোয়ারো বাগানে হাঁটতে হাঁটতে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করছিল। হঠাৎ সে কতকগুলো নুড়ি সরিয়ে সরিয়ে কতকগুলো অদ্ভুত জিনিষ দেখতে পেল। ভাবতে লাগল এর অর্থ কী?
.
০৫.
২৬শে ডিসেম্বর।
কর্নেল জনসন আর সাগডেন তাকিয়ে আছে পোয়ারোর দিকে। একী এগুলো যে হীরে, পেলেন কোথা থেকে?
মিসেস অ্যালফ্রেডের সাজানো বাগান থেকে। এক সময় ওটা সমুদ্রের নীচে ছিল তাই এমন পাথর থাকা কোনো অস্বাভাবিকই নয়।
তাহলে বেশ আঁটঘাট বেধে নেমেছিল।
হয়তো মিসেস লী ওটা সরিয়ে ছিলেন কারণ হয়তো তিনি বুঝেছিলেন কিছু একটা ঘটতে চলেছে।
তবে হীরে সরালেও সে খুন করেনি। কারণ খুনের সময় বৃদ্ধ খানসামা তাকে ঘরে দেখেছিল।
সাগডনে জানালো সে কিছু নতুন তথ্য আবিষ্কার করেছে–ম্যাগজলেন কমাণ্ডার জোন্সের নিজের মেয়ে নয়। এই ঘটনা সাইমন লী জানত তাই মিসেস লী হয়তো ভয় পেয়েছিলেন। তার স্বামীকে জানালো বিবাদ হবে তাই হয়তো সে খুন করেছে। টেলিফোনের গল্পটা বানানো। জর্জ লী আর তার স্ত্রী ঘরে ঢোকার পর তাদের সুপ্রভাত জানিয়ে প্রশ্ন করা শুরু হয়।
আচ্ছা আপনি ফোনে কথা বলতে শুরু করেন আটটা উনষাটে আর কথা বলা শেষ হয় নটা চার-এ। আর খুন হয় সোয়া নটায়, এই মধ্যের সময় আপনি কোথায় ছিলেন?
–আমি ফোন করছিলাম।
–না, হয়তো ভুলে যাচ্ছেন; হয়তো অন্য কোথা ফোন করছিলেন
এরপর ম্যাগজলেনকে প্রশ্ন করা শুরু হয়–আপনি তো বলেছিলেন এই ঘরে আপনি একা ফোন করছিলেন আসল কথা আপনি ফোন করেনই নি। আপনি কোথায় ছিলেন?
পুলিশের জুলুমবাজী আমরা আলাদতে তুলব। এই বলে ঘর থেকে স্বামী-স্ত্রী চলে যায়।
তারা তিনজন ওদের নিয়ে আলোচনা করছিল ঠিক সেই সময় ঘরে ঢুকল ম্যাগজলেন। সে জানালো যে, সে তার ছেলেবন্ধুকে ফোন করতে গিয়ে দেখেছিল জর্জ ফোন করছে। সে যাতে জানতে না পারে তাই ম্যাগজলেন সিঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে ছিল আর তখনই..
ডাইনিংরুমের জানলার কাছে লিডিয়া দাঁড়িয়ে ছিল নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল পোয়ারো। হঠাৎ একটা আওয়াজ হললিডিয়া তাকিয়ে দেখল পোয়ারো।
পোয়ারো বলল, আমি নিঃশব্দে চলি।
–আমি ভেবেছি হারবারি। সে এমন ভাবে এসে অনেক গোপন কথা শোনে। আপনার কী মনে হয়? সে আমাদের এমন ভাবে কথা শুনে ব্ল্যাকমেল করতে পারে? যদি হারবারি চোর আর খুনী না হয় তাহলে–চোর বা খুনী আমাদের বাড়ির কেউ হবেই। তাই আমার আর আমার স্বামীর মত সেই মানুষকে যদি আদালতে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে আমাদেরই বদনাম। অনেক কেস তো চাপা পড়ে যায় তাই এটাকেও চাপা দিলে কেমন হয়?
আপনি হয়তো জানেন খুনী কে কিন্তু আমি ঠিক বলতে পারব না। তাই এখনই কোনো মতামত দিতে পারছি না।
মিউজিক রুমে পিলার আর স্টিফেন কথা বলছিল। তারা চলে যেতে চায় কিন্তু পুলিশ যেতে দেবে না। তারপর তারা কথা বলছিল উইল সম্পর্কে। হঠাৎ দেখা হল পোয়ারোর সাথে সে ঘরে বসে ছবি দেখছিল। আর বলল–লী পরিবারের বেশীর ভাগের মুখ মার মত। শুধুমাত্র হ্যারির বাবার মত।
একটা তরুণীর ছবি দেখিয়ে পোয়ারো বলল, একদম মিসেস সাইমন লী।
পিলার জানালো যে, ওটা তার মার ছবি তারপর নিজের গলার লকেটে তার বাবা-মার ছবি দেখালো।
পোয়ারো পিলারের পাশপোর্ট দেখতে চাইল এবং সেটা দেখার পর চলে গেল। তখন দেখা হল মিঃ আর মিসেস অ্যালফ্রেডের সাথে।
অ্যালফ্রেড বলল–আপনি আমার প্রস্তাবের কথা কী ভাবলেন?
পোয়ারো বলল–সে খুনীকে প্রায় ধরে ফেলেছে এবং হীরের ব্যাপারও জানালো। তারপর মিঃ সাইমন লীর যুবক অবস্থার ছবি চাইল।
.
০৬.
২৭শে ডিসেম্বর।
সলিসিটার মিঃ চার্লটন এসে উইলের কথা জানালো। এতে জানা গেল পরিবারের সকলে নিজেদের প্রাপ্য পেয়েছে বাদ পড়েছে কেবল পিলার। সকলে নিজেদের প্রাপ্য থেকে পোয়ারোকে দিতে রাজী হল। জর্জ লী তাকে পোষাকের জন্য কিছু দিতে রাজী হল। মনের দুঃখে সে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
খাওয়া-দাওয়ার পর অ্যালফ্রেড আর তার স্ত্রী পিলারকে তার সম্পত্তির ভাগ দিতে চাইল কিন্তু পিলার তা নিতে চাইল না।
ঠিক সেই সময় ট্রেসিলিয়ান পোয়ারোকে জানালো দরজার ধারে দুটো বড় ভারী পাথর ছিল তার একটা পাওয়া যাচ্ছে না। আর তার পর সাগডেন এসে জানালো স্টিফেন ফার মারা গেছে দুবছর আগে এখানে যে এসেছে সে মিথ্যে বলেছে।
তারপরই শোনা যায় একটা আর্তনাদ। ওপরে গিয়ে জানা গেল যে পাথরের বলটা পাওয়া যাচ্ছিল না সেই বলটা পিলারের দরজার উপরে রাখা ছিল তাকে খুন করার জন্য কিন্তু পেরেকে আর স্কার্টটা আটকে যায় তার ফলেই সে বেঁচে যায়।
পোয়ারো সকলকে একত্র হতে বলে আর সেই সময় স্টিফেন জানায় তার আসল পরিচয়। তার নাম স্টিফেন গ্রাণ্ড, স্টিফেন ফার তার বন্ধু ছিল তার কাছ থেকেই সাইমন লীর কথা আর ট্রেনে মিস পিলারের ব্যাগে এখনকার ঠিকানা দেখে সে চলে আসে।
পিলার বলল, সে আসলে পিলার নয়। বলল, গাড়িতে পিলারের সঙ্গে তার আলাপ। বোমায় পিলার মারা যায় কিন্তু তার কিছু হয়নি। আগেই সে শুনেছে পিলারের সব কথা আর তাদের পাশপোর্টের ফোটো একরকম তাই চলে এসেছে এখানে, তবে সে শপথ করে জানায় যে খুন। বা চুরি কিছুই করেনি।
পোয়ারো সকলকে সন্দেহ করতে করতে আসল কথায় আসে–এ খুন স্টিফেন বা পিলার কেউই করেনি। এ খুন করেছে রক্তের একজন। তারপর পোয়ারো সাগডেনকে বলে–আপনার মা টাকার জন্য সাইমন লীকে ছেড়ে অন্য লোককে বিয়ে করতে বাধ্য হন আর তার সেই অপমানের প্রতিশোধ নিতেই আপনি এই খুন করেন।
কিন্তু আমি যখন যাই তখন তিনি জীবিত।
তিনি তখন জীবিত কী মৃত কেউই তা দেখতে যায়নি। আপনাকে মিঃ লী ফোন করেননি বরং আপনিই তাকে মিথ্যে হীরে চুরির গল্প বলে আপনি এখানে আসেন তারপর দেখেন আসল হীরে আলমারীতে। তারপর ফায়ার প্লেসের সামনে আপনারা বসে কথা বলেন আর তখনই আপনার আসল পরিচয় জানান লীকে। এবং তখনই তার কণ্ঠনালী কেটে তাকে মেরে ফেলেন সঙ্গে করে দড়ি নিয়ে এসেছিলেন যা দিয়ে ঘরের সব আসবাবপত্র বাঁধেন এবং একটা বোতলে জানোয়ারের রক্ত নিয়ে এসেছিলেন সেটাকেও দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে যান। দড়িটাকে জানলে দিয়ে ঝুলিয়ে রেখে হীরেগুলো চুরি করে নিয়ে বাগানে সাজিয়ে রাখেন। যাতে চোর ও খুনী বাড়ির কাউকে মনে করে। এরপর চলে যাওয়ার সময় ঘরের দরজা বাইরে থেকে লক করে রেখে যান যাতে কেউ ঘরে ঢুকতে না পারে। তারপর সোয়া নটা নাগাদ এসে জানালা দিয়ে দড়ি টেনে সব জিনিষগুলো ফেলে দেন। আর একটা বেলুন রেখে যান যেটাতেও একটা দড়ি বাঁধা থাকে–যেটার দড়ি ফেলার সাথে ঐ বিকট আওয়াজ বেরিয়ে আসে। আমি মিঃ লীর ছবি নিয়ে গিয়ে তাতে নকল গোঁফ লাগিয়ে দেখি তার সাথে আপনার মুখের হুবহু মিল। আর পিলারও আপনাকে একই কথা বলেন, আর প্রথমে ওর বেলুনে রবারের ছিপি দেখে পিলার। তাই যদি আরো কিছু বলে দেয় তাই আপনি তাকেও মারার চেষ্টা করেন। এসব কথা শুনে সাইমন বলে হ্যাঁ, আপনার কথা সত্যি আমিই তাকে খুন করেছি। আমি এর জন্য নিজেকে অপরাধী বলে মনে করি না। আমি এর জন্য খুব খুশী, সত্যিই খুশী। এখানে মি সাইমন লীর আর্তনাদ নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে।
মিঃ জর্জ লী বলেন এটা একটা মানুষের আর্ত চিৎকার।
মিসেস জর্জ লী আর মিঃ ডেভিড বলল, এটা এমন একটা চিৎকার যার আত্মা নেই।
মিসেস ডেভিড লী বলেন একটা নারকীয় চিৎকার শোনা গেল।
মিঃ এণ্ড মিসেস অ্যালফ্রেড লী বলেন এই চিৎকার এক জানোয়ারের। মিঃ হ্যারি লী তিনি খুব কাছাকাছি গেছেন, তিনি বলেন এই চিৎকার শুনে মনে হয়েছিল শূকরছানার চিৎকার। আর মিস পিলার এমনই একটা বেলুন মেলায় কেনেন, আর তখনই আমার সন্দেহ বাস্তব রূপ পায়।