স্টিফেন ফারই প্রথম কথা বলল–ট্রেনে খুব ভিড়।
-ও, হা, তা ঠিক। আমার মনে হয় লণ্ডন থেকে এখন সবাই চলে যাচ্ছে, কারণ এখানে এখন ব্ল্যাকআউট চলছে।
স্টিফেন দেখল মেয়েটি নির্ভুল ইংরাজী বলে তবে একটু জোর দিয়ে কথা বলে সে।
অপর দিকে পিলার চিন্তা করছে ট্রেনে একজন আগন্তুকের সঙ্গে কথা বলাটা অপরাধ। আবার স্টিফেন যদি নতুন হয় তাহলে একজন যুবতী মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তার অস্বস্তিবোধ করা উচিত ছিল। কিন্তু স্টিফেনের কথাবার্তা ছিল বন্ধুর মতো, তাই সে ভাবল, যে কোনো মানুষের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারে সে।
স্টিফেন নিজে সচেতন না হয়েই বলল-এই লণ্ডন শহরটা খুবই ভয়ঙ্কর জায়গা তাই না?
-হ্যাঁ, আমিও অপছন্দ করি।
–আমারও পছন্দ নয়।
–তুমি কী ইংরেজ?
–আমি ব্রিটিশ, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসছি।
–হ্যাঁ, তোমার কথায় সেটা প্রকাশ পাচ্ছে।
–তুমিও কী বিদেশ থেকে আসছে?
পিলার মাথা নেড়ে বলল-স্পেন থেকে।
স্টিফেন কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করল–তুমি স্পেন থেকে আসছ, তাহলে তো তুমি স্প্যানিশ?
–বলতে পারেন আধা স্প্যানিশ। আমার মা ইংরেজ সেই কারণে আমি ভালো ইংরাজী বলতে পারি।
-যুদ্ধের খবর কী? স্টিফেন বলল।
–খুব খারাপ, ভয়ঙ্কর। তুমি কোন দিকে?
পিলারের রাজনীতির বক্তব্য স্পষ্ট নয়–যে গ্রাম থেকে আসছি সেখানে কেউ যুদ্ধের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না।
–তার মানে সেখানে তোমাদের কারো মধ্যে কোনো বিবাদ নেই?
পিলার তার কথায় মাথা নেড়ে সায় দিল।
–তুমি তাহলে তোমাদের শত্রু সেনোরিটারদের ক্ষমা করবে?
পিলার মাথা নেড়ে বলল–আমার কোনো শত্রু নেই। কিন্তু যদি আমার একজন শত্রু থাকত কিংবা আমাকে ঘৃণা করত তাহলে আমি সেই শত্রুর গলা এইভাবে কাটতাম। বলে হাত নেড়ে শত্রুর গলাকাটা দেখাল।
-তুমি তো দেখছি রক্তের নেশায় পাওয়া তরুণী।
–কেন, তুমি তোমার শত্রুর সঙ্গে কেমন করে মোকাবিলা করবে জানতে পারি কী?
-আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি এই ভেবে যে…প্রসঙ্গ বদলে ফেললো স্টিফেন।-তুমি কী জন্য ইংল্যাণ্ড থেকে এসেছ?
পিলার গম্ভীর হয়ে বলল–আমি আমার এক ইংরেজ আত্মীয়ের সঙ্গে থাকতে যাচ্ছি।
স্টিফেন আশ্চর্য হয়ে গেল–নম্র, ভদ্র একটি ব্রিটিশ পরিবার খ্রীস্টমাসের সময় এই স্প্যানিশ আগন্তুককে নিয়ে কী করতে পারে? তার একটা ছবি মনে মনে এঁকে নিল।
পিলার জিজ্ঞাসা করল–দক্ষিণ আফ্রিকা দেশটা খুব সুন্দর, তাই না?
সেই উত্তর দিতে গিয়ে স্টিফেন দক্ষিণ আফ্রিকার গল্প এমন করে শুরু করল যেমন করে ঠাকুরদা নাতনীকে রঙচরিয়ে রূপকথার গল্প বলে।
কিছুক্ষণ পর যাত্রীরা ফিরে আসতে থাকলে স্টিফেন রূপকথায় ইতি টেনে করিডোরে ফিরে এলো। চলে আসার সময় স্টিফেনের চোখে পড়ল লাগেজের ওপরে লেখা নামটার উপর–মিস পিলার এস্ট্রাভাজেস। তারপর ঠিকানার উপর চোখ পড়তেই চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকমের বড় বড় হয়ে গেল। সেই সঙ্গে একটা আশ্চর্যরকমের প্রতিক্রিয়া হল–গারস্টন হল, লংডেল, এ্যাডেলসফিল্ড।
মুখটা পেছন দিকে ঘুরিয়ে স্থির চোখে মেয়েটিকে সে এক নতুন অনুভূতিহতভম্ব, বিরক্ত সন্দেহভাবে দেখল।
গারস্টন হলে বিরাট নীল ও সোনালী রং-এর ডাইনিং রুমে বসে অ্যালফ্রেড লী এবং তার স্ত্রী লিডিয়া আসন্ন খ্রীস্টমাসে তাদের পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ আলোচনা করছিল। আলফ্রেডের চেহারা ছিল মাঝামাঝি, মুখটা নষ, চোখ দুটো ফিকে বাদামী রং-এর। তার গলার স্বরে ছিল স্পষ্টতা, শান্ত এবং সংযত ভাব। তার স্ত্রী লিডিয়ার চোহারা ছিল তোগাটে। তার রোগা মুখে কোনো সৌন্দর্যের চিহ্ন না থাকলেও কণ্ঠস্বরটা ছিল খুব সুন্দর।
অ্যালফ্রেড বলে উঠল-বাবার মতামতটা একবার নেওয়া প্রয়োজন।
লিডিয়া খুব সতর্কতার সঙ্গে উত্তর দিল–তুমি কিছু মনে করো না, তোমার বাবা খুব খেয়ালী আর অত্যাচারীও।
–তিনি বুড়ো।
–আর তার বয়স যত বাড়বে অত্যাচারের মাত্রাও তত বাড়বে? এর শেষ কোথায় বলতে পারো? আমরা যা করি না কেন সব ব্যাপারেই তিনি খবরদারি করেন, আমরা নিজের ইচ্ছামতো কোনো কাজই করতে পারি না, যদি বা কখন করতে যাই উনি সব ভণ্ডুল করে দেন।
-কিন্তু একথা ভুলো না যে, তিনি আমাদের কাছে খুব ভালো।
–ওহো, উনি আমাদের কাছে খুব ভালো তাই না? তুমি কী আর্থিক দিক দিয়ে বলতে চাইছ? শান্ত কণ্ঠে বলে লিডিয়া।
-হ্যাঁ, ওনার নিজস্ব চাহিদা খুবই অল্প। কিন্তু টাকা দেবার ব্যাপারে এতটুকুও কৃপণতা করেন ।না তুমি তোমার ইচ্ছামতো জামাকাপড় কিনতে পারো, মনের মতো করে বাড়ি সাজাতে পারে। তাতে যতো টাকাই লাগুক না কেন তিনি এতোটুকুও দ্বিধা করেন না। তুমি তো নিজের চোখেই দেখলে গত সপ্তাহতেই তিনি আমাদের একটা নতুন গাড়ি কিনে দিয়েছেন।
আমি তা অস্বীকার করছি না, যে তিনি টাকার ব্যাপারে উদার। কিন্তু তার বদলে তিনি আমাদের সঙ্গে চাকরের মতো ব্যবহার করবেন?
–চাকর?
তাছাড়া, আর কী? হ্যাঁ, অ্যালফ্রেড তুমি ওঁর চাকর ছাড়া আর কী? আমরা যদি কোথাও যাবো বলে স্থির করি, তক্ষুনি উনি বাধা দিয়ে বলবেন, না ওখানে যাওয়া হবে না। ওনার ইচ্ছা মতো উনি আমাদের যেখানে পাঠাবেন সেখানে যেতে হবে। আর তুমিও তো তাই মেনে নাও, ওঁর অন্যায় হুকুম মেনে নেওয়া চাকরের কাজ নয় কী? আমাদের জীবন, স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই।