খ্রীস্টমাস ইভে লী পরিবারের সকলের মুখে একটা থমথমে ভাব তার ভালো লাগল না। সবাইয়ের মুখে একটা উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা আর অপছন্দ।
ট্রেসিলিয়ান একটু বাদে খালি কফির কাপগুলো আনার জন্য ড্রইংরুমে ঢুকতেই দেখল, লিডিয়া জানলার ধারে বাইরের অন্ধকারে কী দেখছে।
পাশের ঘর থেকে পিয়ানোর আওয়াজ আসছিল। ডেভিড বাজাচ্ছিল। কিন্তু কেন? ট্রেসিলিয়ান নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল। ডেভিড কোনোদিন এইরকম করুণ সুরে পিয়ানো বাজায় না। মনে হয় এই খ্রীস্টমাস ইভে কোথাও কিছু একটা অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে। আস্তে আস্তে সে হাঁটতে হাঁটতে প্যান্ট্রিতে ফিরে গেল।
হঠাৎ সে ওপরতলা থেকে গণ্ডগোল শুনতে পেল। টেবিল চেয়ার, ফার্ণিচার ছুঁড়ে ফেলার আওয়াজ শুনতে পেল।
ট্রেসিলিয়ান চিন্তা করল-মনিব একী করছেন? উপরতলা থেকে এইরকম আওয়াজ শোনা যাচ্ছে কেন?
তারপরই আর্তনাদ শোনা গেল বাড়ির মধ্যে। ট্রেসিলিয়ান চুপচাপ সেখানে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর সে হলঘরে ছুটে এসে সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিকে ছুটে গেল। সবাই তার সঙ্গে ছিল। ওপরে সবার লক্ষ্য ছিল বৃদ্ধ লীর ঘর। তার আগেই ওখানে মিঃ ফার এবং মিসেস ডেভিড পৌঁছে গেছেন। মিসেস ডেভিড দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে, ওদিকে দরজার হাতল ধরে ঘুরিয়ে–মিঃ ফার সেটা খোলবার চেষ্টা করছিল।
স্টিফেন ফার বলছিল দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।
হ্যারিও ততক্ষণে সেখানে পৌঁছে গেছে এবং ফারের মত দরজার হাতল ঘুরিয়ে খোলার চেষ্টা করছে।
সে চেঁচিয়ে বলল–বাবা, আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিন।
অন্যেরা চুপচাপ শুনছিল। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। ঘরের ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ আসছিল না।
বাড়ির সদর দরজার বেল বেজে উঠল সেদিকে কারো নজর গেল না।
ফার বলল-দরজা এখনি ভেঙে ফেলতে হবে। এছাড়া আর অন্য কোনো উপায় নেই।
হারি বলল–কাজটা কঠিন হবে, পুরু কাঠের দরজা। যাই হোক অ্যালফ্রেড এসো আমরা কাজটা শুরু করি।
সবাই মিলে জোরে ধাক্কা দিল। কিন্তু তাতে কোনো ফল পাওয়া গেল না। কে যেন শেষে একটা বেঞ্চ নিয়ে এসে সজোরে দরজায় আঘাত করল। দরজার ফ্রেমটা অবশেষে নড়ে উঠল। এইভাবে কয়েকবার ধাক্কা মারার পর দরজাটা সব সুদ্ধ ভেঙে ঘরের ভেতর পড়ল।
ভেতরে ঢুকে সবাই অবাক হয়ে গেল। তারা চিন্তা করতে পারেনি ভেতরে ঢুকে তারা এমন দৃশ্য দেখবে।
ভেতরে ঢুকে বোঝা গেল যে কিছুক্ষণ আগে ঘরের মধ্যে একটা লড়াই হচ্ছিল। সব আসবাবপত্র উল্টে পড়ে আছে; চায়না ভাসটা ভেঙে মেঝের উপর টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে। সাইমন লীর দেহটা রক্তে মাখামাখি অবস্থায় ফায়ার প্লেসের সামনে কম্বলের উপর পড়ে আছে। জায়গাটা কসাই-এর দোকানের মতো লাগছে।
দুটি কণ্ঠস্বর সেই নিস্তব্ধতাকে ভেঙে চুরমার করে দিল।
ডেভিড লী বলে উঠল–ঈশ্বরকে যেন ধীরে ধীরে ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
লিডিয়া বলে উঠল–কে জানত ঐ বৃদ্ধ মানুষটার দেহে এত রক্ত আছে?
সুপারিনটেন্টে সাগডেন তিন বার বেল বাজিয়ে তারপর জোরে জোরে দরজায় ঘুষি মারতে লাগল। শেষপর্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত ওয়ালটার দরজা খুলে দিল।
-ওহো আপনি? ওয়ালটারের মুখে একটা স্বস্তির ছাপ দেখা গেল। আমি এক্ষুনি পুলিশে সংবাদ দিতে যাচ্ছিলাম।
সুপারিনটেন্টে সাগডেন রুস্বরে বলে উঠল–বেল? কীসের জন্য? এখানে কী হয়েছে?
ওয়ালটার ফিসফিস করে বলল,-বৃদ্ধ মিঃ লী…তাকে…
সুপারিনটেন্ডেন্ট তাকে একপ্রকার ধাক্কা মেরে উপরে ছুটলেন। তার আসার খবর কেউ জানতেও পারলো না। সে ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল পিলার কী যেন মেঝে থেকে তুলে নিল। সে দুহাত দিয়ে চোখ ঢেকে ডেভিড লীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। অ্যালফ্রেড বিষণ্ণ মুখে তার বাবার মৃত দেহের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।
জর্জ লীকে একটা ঘোষণা করতে শোনা গেল–পুলিশ না আসা পর্যন্ত এই ঘরের কোনো জিনিষে কেউ হাত দেবে না। এখানকার একটা জিনিষও কেউ ছুঁয়ো না। এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
অ্যালফ্রেড লী সুপারিনটেন্টে সাগডেনকে বলল–আপনি খুব তাড়াতাড়ি এসে গেছেন দেখছি।
-হ্যাঁ, মিঃ সি। কিন্তু এসব কী ব্যাপার বলুন তো?
অ্যালফ্রেড ধরা গলায় বলল–আমার বাবা খুন হয়েছেন।
সুপারিনটেন্টে হাত তুলে বলল–একমাত্র মিঃ লী আর মিঃ জর্জলী ছাড়া সবাই আপনারা ঘর থেকে চলে যাবেন।
সবাই ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকলে সুপারিনটেন্টে পিলারকে বাধা দিয়ে বললেন এখানকার কোনো জিনিষ এখন স্পর্শ বা সংগ্রহ করা যাবে না।
স্টিফেন ফার পিলারের দিকে তাকিয়ে বললেন,–সে কথা উনি ভালো করেই জানেন।
সুপারিনটেন্টে গলার স্বর নরম করে বলল–কিন্তু একটু আগে আমি মেঝে থেকে ওনাকে কী একটা কুড়িয়ে নিতে দেখেছি।
-আমি নিয়েছি?
–হ্যাঁ, আমি আপনাকে নিতে দেখেছি।
–ওহো!
–তাহলে ওটা আমাকে দিয়ে দিন। ওটা আপনার হাতের মুঠোয় রয়েছে।
–আস্তে আস্তে পিলার হাতের মুঠোটা খুলল। খুলতেই দেখা গেল সেখানে খড়ের আংটির মতো একটা রবার আর একটা কাঠের বস্তু রয়েছে। ওর হাত থেকে সেগুলো নিয়ে সুপারিনটেন্টে ভেতরে রেখে দিলেন। তারপর সেই খামটা যে তার বুক পকেটে চালান করলেন।
সে বলল-ধন্যবাদ।
তারা দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে শুনলো-যদি আপনারা আর।
মিণ্ডলশয়ারের চীফ কনস্টেবল কর্নেল জনসনের ছুটি কাটাতে এসে এরকুল পোয়ারোর আলোচনা হচ্ছিল-খ্রীস্টমাসের সময় কোনো অপরাধ অনুষ্ঠান হয় কী না!