- বইয়ের নামঃ উইটনেস ফর দ্য প্রসিকিউশন
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- প্রকাশনাঃ আদী প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর, গোয়েন্দা কাহিনী
উইটনেস ফর দ্য প্রসিকিউশন
১-২. স্বেচ্ছাকৃত খুনের অভিযোগ
০১.
মিঃ মেহার্ন চশমাটা ঠিক করে সামনে বসা লোকটির দিকে তাকালেন। লোকটি স্বেচ্ছাকৃত খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত।
মিঃ মেহার্ন ছোটোখাটো ধরনের মানুষ, বাদামী চোখ দুটো চতুর এবং অন্তর্ভেদী। তুখোড় আইনজীবী হিসাবে তাঁর সুনাম আছে।
আমি আপনাকে বোঝাতে চাইছি যে আপনি ভীষণ বিপদের মধ্যে পড়েছেন, এই অবস্থায় সবকিছু খোলাখুলি বলা অত্যন্ত জরুরী।
লেনার্ড ভোল এতক্ষণে মিঃ মেহানের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। আমি তা জানি। সে আশাহীন স্বরে বলল। আপনি আমাকে তখন থেকে একথা বলে আসছেন। তবে আমি একথা জানি যে খুন করা একটা কাপুরুষের কাজ।
মিঃ মেহার্ন মোটেই আবেগপ্রবণ নন। তিনি বাস্তববাদী, তিনি মিঃ ভোলকে বলেন আমার কথা ভালো ভাবে শুনুন, আমরা আপনাকে রক্ষা করবার চেষ্টা করব। আশাকরি আমরা সফল হবই তবে সমস্ত ঘটনাটা জানা দরকার, মামলাটা আপনার বিরুদ্ধে কতখানি খারাপ দিকে যেতে পারে সেইমত আমরা পদক্ষেপ নেব।
অল্প বয়সী যুবক মিঃ ভোল সেই একই ভাবে বিমূড় ও নিরাশ ভাবে মিঃ মেহানের দিকে তাকিয়ে রইল। মিঃ মেহানের মতে আসামীর মুক্তি পাওয়া সুদূর পরাহত, তার মনে সন্দেহের ছায়া পড়ল।
লেনার্ড ভোল নীচু গলায় বলল, ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি আমি দোষী নই।
আমি জালে আটকে গেছি, যেদিকে যাচ্ছি সেদিকেই আটকে পড়ছি।
কিন্তু মিঃ মেহার্ন আমি খুন করিনি।
এরকম অবস্থায় যেকোন মানুষ প্রতিবাদ করতে বাধ্য। হতেও পারে মেহার্ন খুন করেনি সে আদৌ অপরাধী নয়।
আপনি ঠিকই বলেছেন মিঃ ভোল সত্যই ঘটনাবলী আপনার নির্দোষিতার বিপক্ষে, এইজন্য প্রকৃত ঘটনাগুলো আপনি নিজের ভাষায় বলুন, মিস এমিলি ফ্রেঞ্চের সঙ্গে আপনার পরিচয়ের কথা।
ঘটনার সূত্রপাত অক্সফোর্ড স্ট্রীটের রাস্তায়। একদিন এক মহিলা রাস্তা পার হচ্ছিলেন তার দুহাত ভর্তি পার্সেল কিন্তু পার্সেলগুলো হঠাৎ রাস্তায় পড়ে গেল। নীচু হয়ে কুড়াতে যাবেন এই সময় একটা বাস এসে তার উপর পড়ল। তিনি কোন রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে একটা ঘোড়ার সামনে এলেন, তিনি কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। আমি রাস্তা থেকে তার পার্সেলগুলো তুলে ধুলো ঝেড়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে, তার হাতে দিলাম।
ও, আপনি তাহলে তার জীবন বাঁচাননি?
না, মোটেই না। আমি যা করেছি তা সাধারণ ভদ্রতার পর্যায়ে পড়ে। আমার ঐ কাজে তিনি আমাকে ধন্যবাদ জানান এবং বলেন আমি অন্য অল্প বয়সী যুবকদের মত নই। এরপর আমি তাকে অভিবাদন করে চলে গেলাম, আমি আশা করিনি আর কোনদিন তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হবে কিন্তু ঐদিন সন্ধ্যাবেলাতেই আমার এক বন্ধুর বাড়িতে তার সঙ্গে পার্টিতে দেখা হয়। তিনি আমাকে চিনতে পারেন এবং আমার সাথে কথা বলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তার সঙ্গে আমি কিছুক্ষণ কথা বললাম। তিনি ক্রিকলউডে বাস করেন। নাম এমিলি ফ্রেঞ্চ। আমার মনে হল তিনি হঠাৎ হঠাৎই লোকের প্রতি ভীষণভাবে নজর দেন। সেই কারণে তিনি আমার প্রতিও নজর দিলেন। এটা স্বাভাবিক ঘটনা। যে কোন মানুষ এইরকম হতেই পারেন। তিনি যাবার সময় তার বাড়িতে যাবার অনুরোধ করলেন এবং দিন ধার্য করার কথাও বললেন। তাই ভদ্রতার খাতিরে সামনের শনিবার আমি যাব বললাম।
মহিলা বেশ ধনী, একটু ক্ষ্যাপা ধরনের একা থাকেন, তার কম করে আটটা বিড়াল আছে।
মিঃ মেহার্ন বললেন, আচ্ছা, ঠিক কে আপনাকে বলেছিল যে মিস এমিলি ফ্রেঞ্চ ধনী?
আমার বন্ধু জর্জ হার্ভে। ওর বাড়িতেই পার্টি হয়েছিল।
তিনি কি এখন সেকথা মনে করতে পারবেন?
আমি সঠিক বলতে পারব না অনেকদিন আগেকার ঘটনা।
আচ্ছা, দেখুন আপনাকে দোষী সাব্যস্ত করা প্রথম প্রচেষ্টা হবে আমি আপনি ঐ সময় আর্থিক অনটনে ভুগছিলেন এবং অনেক কষ্টে ঐ বয়স্কা মহিলার সাথে পরিচয়টা হৃদ্যতায় রূপান্তরিত করেছিলেন। এখন আপনি যদি বলেন যে মহিলা ধনী আপনি জানতেন, তাহলে কেসটা জটিল হয়ে উঠবে। আসলে হার্ভের কথাবার্তার উপর সব কিছু নির্ভর করছে। হার্ভে যদি স্বীকার করে যে সে আপনাকে বলেছে যে মহিলা ধনী তবেই।
লেনার্ড ভোল বিবর্ণ মুখে বেশ জোর দিয়ে বলল, ঐদিন উপস্থিত অনেকেই ঐ কথা শুনতে পেয়েছিল এবং দু-একজন তো আমাকে এই বলে ঠাট্টা করতে লাগল যে আমি একজন ধনী মহিলাকে জয় করতে পেরেছি।
মিঃ মেহার্ন বললেন আপনার দুর্ভাগ্য তবে আপনি যে কিছু গোপন করছেন না তার জন্য আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। তাহলে আপনি মিস ফ্রেঞ্চের সঙ্গে পরিচিত হলেন তাঁর বাড়িতে গেলেন, এবং আপনাদের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেল।
কিন্তু আপনার মত একজন অল্প বয়সী যুবকের সাথে একজন বয়স্ক মহিলার এত ঘনিষ্ঠতা হবে কেন যখন তার সঙ্গে কোন মিল নেই।
লেনার্ড ভোল বললেন ঐ মহিলা আমাকে তার বাড়ি যাবার জন্য চাপ দিতেন, বলতেন তিনি অসুখী এবং একাকী তাই তার কথা ফেলা আমার পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়ল। আর তাছাড়া আমার মা যখন মারা যান তখন আমার বয়স খুব অল্প, পিসি তখন আমাকে মানুষ করেন। কিছুদিন যাবার পর তিনিও মারা যান। যদি বলি ঐ মহিলার সান্নিধ্যে এসে আমি মায়ের ভালোবাসা পেয়েছি তাহলে নিশ্চয়ই আপনি হেসে উঠবেন।
মিঃ মেহার্ন গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে উঠলেন। তারপরে আস্তে আস্তে বললেন, আমি আপনার যুক্তি মেনে নিলেও কোনো জুরি এটা মানবে কিনা সন্দেহ।
মিস ফ্রেঞ্চ প্রথম কখন আপনাকে তার ব্যবসাপত্তার দেখাশুনা করতে বলেন?
তার বাড়িতে তিন চারবার যাবার পর তিনি কয়েকটা বিষয়ে টাকা লগ্নী করার ব্যাপারে বেশ চিন্তিত ছিলেন।
সাবধানে কথা বলুন মিঃ ভোল, মিস ফ্রেঞ্চের চাকরাণী জেনেট ম্যাকেঞ্জি কিন্তু বলেছেন, তিনি অর্থাৎ তার মনিব ব্যবসাপত্তর খুব ভালো বুঝতেন।
ভোল আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, কিন্তু মিস ফ্রেঞ্চ আমাকে ঐ রকম কথাই বলেছিলেন।
মিঃ মেহার্ন কিছুক্ষণ চিন্তা করে দেখলেন যে মিঃ ভোলের বয়স্কা মহিলাদের আচার আচরণ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান আছে। লেনার্ড ভোলের নির্দোষিতা সম্পর্কে তার বিশ্বাস আরও বেড়ে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন মহিলা সুন্দর যুবকটির মোহে পড়ে গিয়ে বাড়িতে আনার জন্য নানা অজুহাত সৃষ্টি করতেন।
সুতরাং লেনার্ড ভোল এই চালাকির শিকার হয়েছিল। খুব সম্ভব মিস ফ্রেঞ্চ জানাতে দ্বিধা করেননি যে তিনি বেশ ধনী। সুতরাং তিনি যা চান তা করায় ও করতে পিছ পা হন না।
মিঃ মেহর্নের এইসব কথা দ্রুতগতিতে বলে গেল। কিন্তু তিনি তা বুঝতে দিলেন না।
আপনি কি তাঁর অনুরোধ মত তার ব্যবসার কাজে সহায়তা করেছিলেন।
হা করেছিলাম।
এবার আপনাকে গুরুতর প্রশ্ন করব–এর সঠিক উত্তর জানা খুব জরুরী। সেই সময় আপনি তার ব্যবসার কিছু অর্থ নিজের কাজে লাগিয়েছিলেন যা সহজে প্রকাশ হবার সম্ভাবনা খুব কম ছিল।
আমাদের সামনে এখন দুটো রাস্তা খোলা আছে। হয় আমাদের প্রমাণ করতে হবে যে আপনি সৎলোকের মতই তার কারবার দেখাশুনো করতেন, এবং তিনি ইতিমধ্যেই আপনার কাছে অর্থাগমের একটা উৎস হয়ে উঠেছিলেন। এই দুটো রাস্তার পার্থক্য আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন? এখন ভেবে চিন্তে উত্তর দিন।
লেনার্ড ভোল বললেন মিস ফ্রেঞ্চের সঙ্গে আমার ব্যবহার সুন্দর ও আন্তরিক ছিল। আমি আমার সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে তার স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করেছি।
ধন্যবাদ আপনাকে, মিঃ মেহার্ন বললেন, আপনি আমার কাছে কিছু গোপন করলেন না তার জন্য আপনার প্রশংসা না করে পারছি না।
ভোল ব্যগ্রভাবে বলল, জানেন আমার পক্ষে জোরালো যুক্তি হলো খুন করা আমার কোন উদ্দেশ্য নেই। সত্যি তার মৃত্যুতে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হলাম।
মিঃ মেহার্ন তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি জানেন না মিঃ ভোল, মিস ফ্রেঞ্চ উইলের বয়ান অনুযায়ী আপনাকে বেশ কিছু ধন সম্পত্তির মালিক করে গেছেন?
মিঃ ভোল লাফিয়ে উঠে বললেন, হায় ভগবান, আপনি কি সব বলছেন? তিনি আমাকে সবকিছু দিয়ে গেছেন?
কেন আপনি জানেন না? মিস ফ্রেঞ্চের পরিচারিকা জেনেট ম্যাকেঞ্জি শপথ করে বলেছে যে আপনি উইলের কথা সব জানেন।
মিঃ ভোল চেঁচিয়ে উঠে বলল, পরিচারিকা মিথ্যে কথা বলেছে। জেনেট মনিবের প্রতি বিশ্বস্ত ছিল কিন্তু আমার প্রতি সে ঈর্ষাপরায়ণ ও সন্দেহবাতিক ছিল।
আপনি কি মনে করেন জেনেট আপনাকে অপছন্দ করে এবং তার জন্য ইচ্ছে করে মিথ্যে বলছে?
মিঃ ভোল হতাশ সুরে বলল, না তা মোটেই নয়। কেন সে মিথ্যে বলবে? তবে আমি বুঝতে পারছি। সবাই একটা ভয়ঙ্কর ধারণা করেছে আমি মিস ফ্রেঞ্চকে আমার নামে উইল করিয়েছি তারপর ঐ রাতেই তাকে খুন করেছি। ওহ, কি ভয়ঙ্কর, কি সাংঘাতিক। বাড়িতে কেউ ছিল না। এই সুযোগ নিয়ে তাকে খুন করেছি এটা সবাই ভাবছে।
আপনি ভুল করছেন, বাড়িতে ঐ সময় কেউ ছিল না এটা ঠিক নয়। জেনেট বাইরে গিয়েছিল কিন্তু ঠিক সাড়ে নটায় সে বিশেষ কাটের একটা ব্লাউজ নিতে ফিরে এসেছিল। যাবার সময় সে সিটিং রুমে দুজনের গলার স্বর স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিল। তার মধ্যে ছিল একজন পুরুষের গলা আর অন্যজন তো মিস ফ্রেঞ্চ।
লেনার্ড ভোল লাফ দিয়ে উঠল। সাড়ে নটার সময়, তাহলে আমি বেঁচে যাচ্ছি
সাড়ে নটার সময় আমি আমার ঘরে ছিলাম তার প্রমাণ আমার স্ত্রী দেবে।
নটা কুড়ির সময় আমি বাড়ি পৌঁছাই। সেখানে আমার স্ত্রী আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। লেনার্ড ভোল নিজের আনন্দে মশগুল ছিল। কিন্তু মিঃ মেহার্ন মুখ গম্ভীর করে বললেন, আপনার মতে তাহলে কে মিস ফ্রেঞ্চকে খুন করেছে?
কেন? একজন চোর। জানালা ভেঙে ঢুকেছে–শাবল দিয়ে জোরে আঘাত করে মৃতদেহের পাশেই শাবলটা রেখে জিনিষপত্র নিয়ে সরে পড়েছে। শুধু মাত্র জেনেটের সন্দেহ হতেই পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করেছে।
মিঃ মেহার্ন বললেন ওগুলো পুলিশকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য খোয়া গেছে। এবার আপনার কথা ভাবুন, আপনি বলেছেন সাড়ে নটার সময় আপনি ছিলেন না। অথচ সিটিং রুমে জেনেট পুরুষ মানুষের গলা শুনতে পেয়েছে। মিস ফ্রেঞ্চ নিশ্চয়ই চোরের সাথে কথা বলবে না।
মিঃ ভোলকে কেমন যেন হতবুদ্ধি এবং নিরুৎসাহ মনে হলো। তারপরেই উদ্যম নিয়ে বলতে আরম্ভ করল, আমি এই খুনের দায়ে পড়ছি না আপনি এক্ষুনি আমার স্ত্রী রোমেনের সঙ্গে দেখা করুন।
নিশ্চয়ই দেখা করব, মিঃ মেহার্ন সম্মতি জানালেন। আপনার গ্রেপ্তারের সময় তিনি ছিলেন না। তাঁকে স্কটল্যান্ডে টেলিগ্রাম করেছি, তিনি আজ রাতে ফিরে আসছেন, এখান থেকে গিয়েই আমি তার সঙ্গে দেখা করব।
হ্যাঁ রোমেন আপনাকে সব বলবে সে পতিপরায়ণা, আমার প্রতি বিশেষ অনুরক্তা আমার জন্য সব কিছু করতে পারে সে।
মিঃ মেহার্ন হঠাৎ বলে উঠলেন আচ্ছা এমন কি কেউ আছে যে আপনাকে নটা কুড়িতে বাড়ি ফিরতে দেখেছে? যেমন ধরুন কোনো চাকরানি?
না, আমাদের কোনো চাকরানি নেই।
ফেরার পথে রাস্তায় আপনার সাথে কারও দেখা হয়েছিল?
কিছুটা পথ তো আমি বাসে চড়ে এসেছি, সেরকম কারও সঙ্গে দেখা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না, তবে কণ্ডাকটর হয়ত মনে করতে পারে।
মিঃ মেহার্ন মাথা নাড়লেন, তিনি নিশ্চিত হতে পারছেন না। তাহলে আপনার স্ত্রীর কথা প্রমাণ করবার মত কেউ নেই। আচ্ছা মিস ফ্রেঞ্চ কি জানতেন, আপনি বিবাহিত?
ও, হ্যাঁ।
তাহলে আপনি, কোনদিন স্ত্রীকে ওনার কাছে নিয়ে যাননি কেন?
মিঃ ভোল তোতলাতে লাগল?
মিঃ মেহার্ন বললেন, মিস ফ্রেঞ্চ আপনাকে বিয়ে করবে বলে চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়ে ছিলেন।
মিঃ ভোল হেসে উঠলে আমাদের মধ্যে চল্লিশ বছরের প্রায় তফাৎ। আপনাকে আমি সব খুলে বলছি। আমার আর্থিক অনটন চলছিল–আমি আশা করেছিলাম মিস ফ্রেঞ্চ আমাকে কিছুটা ধার দেবেন। তাছাড়া তিনি ধরে নিয়েছিলেন আমাদের দুজনের সম্পর্ক ভালো নয়। আমরা আলাদা থাকি।
তার এই ভাবনাকে আমি তেমন আমল দিইনি। তিনি আমাকে তার পালিত পুত্র বলতেন।
আপনার বক্তব্য এখানেই শেষ?
হ্যাঁ, আমার কিছু আর বলার নেই।
মিঃ মেহার্ন আবেগ ভরে বলে উঠলেন আমি আপনার নির্দোষিতায় বিশ্বাস করি, আমি তা প্রমাণ করে আপনাকে মুক্ত করব।
তবে এই মামলার অনেক কিছুই জেনেট ম্যাকেঞ্জির সাক্ষ্যর উপর নির্ভর করছে। তিনি তো আবার আপনাকে ঘৃণা করে।
মিঃ ভোল প্রতিবাদ করে বললেন, সে আমাকে মোটেই ঘৃণা করে না।
মিঃ মেহার্ন মাথা নাড়তে নাড়তে বাইরে চলে গেলেন। তিনি ভোলদের আস্তানা প্যাডিংটন স্ট্রীটের বাড়িতে হাজির হলেন।
পরিচারিকা দরজা খুলে দিল। মিঃ মেহার্ন তার কার্ডটি পরিচারিকার হাতে দিয়ে বললেন এটি দেখাও তোমার মনিবকে তাহলে উনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন। কিছুক্ষণ পরে দাসী তাকে ড্রইংরুমে নিয়ে গেল। মিঃ মেহার্ন বসে আছেন এমন সময় হঠাৎ একজন লম্বা, ফ্যাকাশে মহিলার সম্মুখীন হয়ে ভীষণ চমকে গেলেন।
মহিলা ঘরে প্রবেশ করে মিঃ মেহার্নকে বললেন, আপনিই মিঃ মেহার্ন। আপনিই আমার স্বামীর উকিল? আপনি কি অনুগ্রহ করে বলবেন আমার স্বামীর মামলাটির ফলাফল কি হতে পারে? সবকিছু জানা আমার অবশ্যই দরকার শত খারাপ ঘটনা হলেও আমি তা শুনতে প্রস্তুত।
মিঃ মেহার্ন বলতে শুরু করলেন, আমি জানি আপনি নিশ্চয়ই মানসিক কষ্টে আছেন
যাই হোক মিঃ মেহার্ন মিঃ ভোলের সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারের ঘটনার বিবরণ জানালেন।
মিসেস ভোল মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, তার পর বললেন আমার স্বামী চায় আমি যেন বলি সে ঐ দিন রাত্রে নটা কুড়িতে বাড়ি এসেছিল। তাই না?
মিঃ মেহার্ন তীক্ষ্ণভাবে জিজ্ঞাসা করলেন কেন তিনি ঐ সময় বাড়ি আসেননি?
রোমেন ভোল ঠাণ্ডা লাগায় বলল, প্রশ্ন হচ্ছে আমি যদি ঐ রকম সাক্ষ্য দিই তবে আদালত তাকে মুক্ত করবে? আচ্ছা এমন কেউ কি আছে যে আমার বক্তব্য সমর্থন করতে পারে?
তার ব্যগ্রতা দেখে মিঃ মেহার্ন একটু অস্বস্তি বোধ করলেন এবং আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তারপর বিষণ্ণ ভাবে রোমেন ভোলের দিকে তাকিয়ে বললেন মিসেস ভোল আপনার মনের উপর খুব চাপ পড়েছে, আপনি স্বামীর প্রতি এত অনুরক্ত যে
মিসেস ভোল তীক্ষ্ণভাবে বলে উঠলেন, আমার স্বামী কি আপনাকে বলেছে যে আমি তার প্রতি অনুরক্ত? তবে শুনে রাখুন আমি তাকে ঘৃণা করি, আমি চাই তার ফাঁসি হোক।
রোমেন ভোলের হঠাৎ ঐ বিষোদগারণ দেখে মিঃ মেহার্ন কিছুটা কুঁকড়ে গেলেন।
রোমেন ভোল আর এক পা এগিয়ে এসে বলতে আরম্ভ করলেন, খুব সম্ভব আমি তার ফাঁসিতে মরণ দেখব। আমি যদি বলি সেদিন রাত্রে সে দশটা কুড়িতে এসেছিল, আর সে আপনাকে বলেছে যে সে মিস ফ্রেঞ্চের উইলের ব্যাপারে জানে না কিন্তু সে সবই জানে।
সে ঐজন্যই তাকে খুন করেছে। যাতে সে প্রচুর অর্থের মালিক হয়। যদি বলি ঐ রাতে সে আমার কাছে সব কবুল করেছে যে, সে খুন করে এসেছে? তার জামায় রক্ত লেগেছিল কি হবে তা হলে?
মিঃ মেহার্ন অনেক কষ্টে বুদ্ধিগ্রাহ্য ভাবে বললেন, স্বামীর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবার জন্য কখনই আপনাকে ডাকা হবে না।
সে আমার স্বামী নয়।
মিঃ মেহার্ন ভাবল তিনি যেন ভুল শুনছেন। আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
লেনার্ড ভোল আমার স্বামী নয়। আমি ভিয়েনায় একজন অভিনেত্রী ছিলাম। আমার স্বামী বেঁচে আছেন তবে পাগলাগারদে আছেন। ফলে লেনার্ড ভোলের সঙ্গে আমার বিয়ে হতে পারেনি।
মিঃ মেহার্ন বললেন, আচ্ছা আমি জানতে চাই লেনার্ড ভোলের প্রতি আপনার মনোভাব এত তিক্ত কেন?
রোমেন ভোল মাথা নাড়িয়ে বললেন এটা গোপন রাখতে চাই।
মিঃ মেহার্ন শুকনো কেশে উঠে দাঁড়ালেন আচ্ছা আমাদের কথাবার্তা আর চালিয়ে যাবার প্রয়োজন নেই। তিনি বললেন গুড ইভনিং ম্যাডাম। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। নিজের মনে বললেন সমস্ত ব্যাপারটা অদ্ভুত মামলার জট আরো পাকিয়ে উঠল।
যুবকটি এখন অথৈ জলে, তার বিরুদ্ধে খুব বেশী প্রমাণ রয়ে গেছে, অত প্রমাণ রেখে কেউ খুন করে না মহিলা নিশ্চয়ই মিথ্যা বলছে।
পুলিশ কোর্টের কাজকর্ম চুকে গেল এই মামলার প্রধান সাক্ষীদ্বয় হলো মৃতার পরিচারিকা জেনেট ম্যাকেঞ্জি এবং তার স্ত্রী রলে পরিচিত রোমেন হেলজার।
অভিযুক্ত আসামী নিজের নির্দোষিতা আঁকড়ে রইল। এদিকে বিচারের জন্য কেসটা ফৌজদারী আলাদতে পাঠান হল।
লেনার্ড ভোলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ খুবই জোরাল। মিঃ মেহার্ন এবং ভোলের নির্দোষ তা প্রমাণ করার জন্য যে দুদে ব্যারিষ্টার লাগান হয়েছে তিনিও হতাশ হয়ে পড়লেন। আমরা যদি ঐ অষ্ট্রিয়ান মহিলার সাক্ষ্যে চিড় ধরাতে পারি তাহলে হয়ত একটা উপায় বার করতে পারি।
মিঃ মেহার্ন ভাবল, ধরে নেওয়া যাক লেনার্ড ভোল সত্যিই মিস ফ্রেঞ্চের বাড়ি থেকে চলে এসেছিল রাত নটার সময়। তাহলে সিটিংরুমে সাড়ে নটার সময় কোন ব্যক্তির গলার স্বর শোনা গিয়েছিল। এই ব্যাপারে একমাত্র আশার আলো জেনেট ম্যাকেঞ্জির ভাইপো জেনেট তার মনিবকে উইলে অর্থ সংস্থানের জন্য চাপ দিত। এছাড়া অন্য পথে গেলে নেতিবাচক উত্তর পাওয়া যাচ্ছে।
বিচারের আগের দিন মিঃ মেহার্ন একটা চিঠি পেলেন। ঐ চিঠিই ঘটনার গতি অন্য দিকে ফেরাল। চিঠিটা একটা সাধারণ কাগজে লেখা, যে লিখেছে সে অশিক্ষিত। বানান ভুল।
চিঠিটা লেখা এই ভাবে…
প্রিয় মহাশয়,
আপনি উকিল যে ঐ যুবকের হয়ে মামলা লড়ছেন। আপনি যদি তার স্ত্রীর সাক্ষ্যে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণ করতে চান তবে আজ রাতেই ১৬নং শস রেন্টস স্টেপনিতে চলে আসুন। ঐ ঠিকানায় মিসেস মগসনের খোঁজ করলেই হবে।
মিঃ মেহার্ন বার বার চিঠিটা পড়লেন। এই চিঠিটার উপর আসামীর বাঁচার একমাত্র আশা নির্ভর করছে। এখন চেষ্টা করতে হবে রোমেন হেলজার যা বলছেন সব মিথ্যা।
মিঃ মেহার্ন ঠিক করে ফেললেন তার মক্কেলকে যেভাবেই হোক বাঁচাবেন। সুতরাং সে শস রেন্টস এ গেলেন। তিনতলার উপরে উঠে দরজায় টোকা মারলেন।
একবার, দুবার তারপর আস্তে আস্তে ন্যুজ চেহারার একজন রমণী দরজা খুলে দিলেন।
মিঃ মেহার্ন নিস্পৃহ ভাবে ছোট্ট নোংরা ঘরটায় ঢুকলেন, ভিতরে গ্যাসের আলো জ্বলছে।
রমণী মধ্যবয়স্কা, ঝুঁকে পড়া চেহারা, মাথায় একরাশ চুল, মুখের চারধারে স্কার্ফ শক্ত করে বাঁধা।
মহিলা বললেন অবাক হচ্ছ নিশ্চয়ই, দেখবে আমার সৌন্দৰ্য্য, বলে রমণী স্কাটা একদিকে খুলে ফেলল। মিঃ মেহার্ন ভয়ে গুটিয়ে গেলেন। মুখে বিশ্রী দগদগে লাল দাগ। রমণী মুখটা আবার ঢেকে দিল।
জান আমি কিন্তু এক সময় দেখতে খুব সুন্দরী ছিলাম। অ্যাসিড! অ্যাসিডে আমার এই অবস্থা। কিন্তু আমি তাদের উপর প্রতিশোধ নেব।–মিঃ মেহার্ন তাকে থামাবার চেষ্টা করলেন। একসময় মহিলা থেমে গেলেন। এবার মেহান বললেন, তুমি আমাকে এমন কিছু খবর দিতে পারবে যাতে আমার মক্কেল লেনার্ড ভোল খুনের অভিযোগ থেকে মুক্তি পাবে।
রমণী বলে উঠল আমার দুশ পাউণ্ড লাগবে। তুমি দুশ পাউণ্ড দাও, আমি তোমাকে দু-একটা খবর দেব। বুঝতে পারছ?
কি রকম খবর?
একটা রোমেন ভোলের লেখা চিঠি, ঐ চিঠিতেই তোমার কাজ হবে কিন্তু বদলে দুশ পাউণ্ড চাই।
মিঃ মেহার্ন বললেন, আমি তোমাকে দশ পাউণ্ড দেব, এর বেশী এক কানাকড়িও দেব না।
মহিলা চেঁচিয়ে উঠলেন, তারপর কুড়িপাউণ্ড রফা হল। মহিলা গালাগাল দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল।
তারপর এক বাণ্ডিল চিঠি নিয়ে বলল, এই নাও অপদার্থ এই বাণ্ডিলের উপরের চিঠিটা তোমার কাজে লাগবে।
মিঃ মেহার্ন প্রত্যেকটা চিঠি ভালো করে পড়ে উপরের চিঠিটা নিলেন। একবারের উপরের চিঠিটা লেনার্ড ভোলের গ্রেপ্তারের দিন লেখা।
রমণী নাকি সুরে বলল, ঐ চিঠিটা বারোটা বাজাবে কি বল? আদালতে ঐ বেহায়া বউটা কি বলেছে আমি তা শুনেছি, খুঁজে বার কর দশটা কুড়িতে সে কোথায় ছিল; লায়ন রোড সিনেমায় খোঁজ নাও।
কিন্তু লোকটা কে? মিঃ মেহার্ন জিজ্ঞাসা করলেন? চিঠিতে শুধু একটা খৃষ্টান নাম পাচ্ছি।
ঐ লোকটাই তো আমার এই হাল করেছে। সে অনেকদিন আগেকার কথা ঐঠক মেয়েটাই তাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে।
আমি অনেকদিন ধরেই মেয়েটার উপর প্রতিশোধ নেবার সুযোগ খুঁজেছিলাম আজ তাকে বাগে পেয়েছি। বউটা এবার ফল ভোগ করবে তাই না উকিল সায়েব?
খুব সম্ভবত মিথ্যা সাক্ষ্য দেবার জন্য তার জেল হবে, মিঃ মেহার্ন শান্ত ভাবে বললেন। তারপর সে কোন কথা না বলে টেবিলের উপর প্রতিশ্রুত কুড়ি পাউণ্ড অর্থ রাখলেন। এবং লায়ন রোডের সিনেমা হলের দিকে এগোলেন।
খুব সহজেই সিনেমা হলটি পেয়ে গেল। রোমেন হেলজারের একটা ফটো হলের কেয়ার টেকারকে দেখাবার সঙ্গে সঙ্গেই সে রোমেন হেলজারকে চিনতে পারল।
ঘটনার দিন রোমেন হেলজার রাত দশটার একটু পরে একজন পুরুষের সঙ্গে সিনেমা হলে আসে। তারা দুজন সিনেমা শেষ হওয়া পর্যন্ত ছিল, প্রায় এক ঘণ্টা।
যেটুকু খবর পেলেন তাতে মিঃ মেহার্ন সন্তুষ্ট হলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে রোমেন হেলজারের সাক্ষ্য প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মিথ্যেয় ভর্তি। সে রাগে ঐসব মিথ্যে বলেছে। কিন্তু কেন এই রাগ।
মিঃ মেহার্ন ভাবলেন ব্যাপারটা দুজনের মধ্যে গোপন আছে। কোনদিন হয়ত ব্যাপারটা জানতে পারবে।
তিনি এবার হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটি ট্যাক্সি নিলেন এবং নিজের মনে বললেন এক্ষুনি স্যার চার্লসকে খবরটা জানাতে হবে।
মিস এমিলি ফ্রেঞ্চকে খুনের জন্য লেনার্ড ভোলের বিচার চারিদিকে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। সাক্ষ্য প্রমাণ জেরা প্রভৃতি প্রথমে খুব শান্তভাবে শুরু হল। নানারকম বৈজ্ঞানিক তথ্য সংক্রান্ত প্রমাণ দাখিল করা হল।
এরপর ম্যাকেঞ্জিকে ডাকা হল। সে আগে যা বলেছে সেই কথাই বলল।
জেরা করার সময় আসামী পক্ষে উকিল তার স্ব-বিরোধী সাক্ষ্যের উপর বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। সেটা হলো মিস ফ্রেঞ্চের সঙ্গে ভোলের সম্পর্ক; আসামী পক্ষের উকিল জোর দিয়ে বললেন যে যদিও জেনট ম্যাকেঞ্জি ঐ রাতে মিস ফ্রেঞ্চের সিটিংরুমে পুরুষের গলা শুনতে পেয়েছিল, কিন্তু ঐটা যে ভোলের গলা তা প্রমাণিত হয়নি। উকিল এখন প্রমাণ করবে সাক্ষী অভিযুক্তকে ঈর্ষা করে তাই ঐ রকম সাক্ষ্য দিচ্ছে।
এরপর পরবর্তী সাক্ষী রোমেন হেলজার আপনি গত তিন বছর আসামীর সঙ্গে একত্রে স্ত্রী হিসেবে থেকেছেন?
সাক্ষী এক মুহূর্তের জন্য আসামীর দিকে তাকাল তারপর তার অদ্ভুত দৃষ্টি এবং তার অভিব্যক্তি কিছু বোঝা গেল না।
প্রশ্ন চলতে লাগল, ক্রমশ সেই ভয়ানক ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়ল। ঘটনার দিন রাত্রে আসামী একটা শাবল নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল।
দশটা কুড়িতে বাড়ি ফিরে এল এবং স্বীকার করল যে সে বৃদ্ধা মহিলাকে খুন করেছে। তার জামার হাতায় রক্ত লেগেছিল। সে ঐ জামাটা রান্নাঘরের স্টোভের আগুনে পুড়িয়ে দিল। সে ভয় দেখিয়ে স্ত্রীকে চুপ থাকতে বাধ্য করল।
আদালতে উপস্থিত জনসাধারণ আসামীর বিরুদ্ধে সহানুভূতিহীন হয়ে পড়ল এবং আসামী নিজে মাথা নীচু করে বসে রইল। সে ভাবতে লাগল তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে।
এই বার আসামী পক্ষের উকিল উঠে দাঁড়ালেন। তিনি হেলজারকে বললেন তার সাহায্য সব বানানো সে দশটা কুড়ির সময় নিজে বাড়ি ছিল না। সে অন্য পুরুষের প্রণয়াসক্ত, সে ভোলকে ফাঁসিতে ঝোলাবে বলে এইরূপ মিথ্যা সাক্ষী দিচ্ছে।
রোমেন দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ করল। এরপরই সেই মারাত্মক চিঠিটা দাখিল করা হল। আদালতে চিঠিটা পড়া হল। ম্যাক্স, প্রিয় আমার, ভাগ্য তাকে আমাদের হাতে এনে ফেলেছে। খুনের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি ভেবে অবাক হচ্ছি যে লেনার্ড ভোল একটা মাছি পর্যন্ত মারতে পারে না। সে কি না মিস ফ্রেঞ্চকে খুন করল। হায় বেচারা সে রক্ত মাখা অবস্থায় বাড়ি এসেছিল আমার কাছে সব স্বীকার করেছে আমি তাকে ফাঁসিতে ঝোলাবো। সে যখন ফাঁসিতে ঝুলবে তখন বুঝতে পারবে রোমেন হেলজারই তার ঐ অবস্থা করেছে। তারপর আমরা দুজন সুখে বাকি জীবন কাটাতে পারব।
চিঠিটা প্রকাশ হয়ে পড়তেই রোমেন হেলজার একেবারে ভেঙে পড়ল সবকিছু স্বীকার করল সে। লেনার্ড নটা কুড়িতেই বাড়ি ফিরেছিল।
মামলা এবার অন্যদিকে মোড় নিল। আসামীর উকিল স্যার চার্লস তার কয়েকজন সাক্ষীকে ডাকলেন। আসামীকেও সাক্ষ্য দিতে ডাকা হলো, সে জেরার চাপে একটু ঘাবড়ালো না।
বিবাদী পক্ষের উকিল অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু তেমন কিছু করতে পারলেন না। সাক্ষ্য জেরা শেষ হতে জুরীরা গোপন বৈঠকে গেলেন। একটু পরেই ফিরে এসে তারা বললেন, আসামী নির্দোষ।
লেনার্ড ভোল বেকসুর খালাস পেল। মিঃ মেহার্ন তাড়াতাড়ি উঠে তার মক্কেলকে অভিনন্দন জানালেন। এই কেসটা সত্যিই অদ্ভুত, বিশেষ করে রোমেন হেলজার একটা অদ্ভুত চরিত্র। রোমেন হেলজারের আকর্ষণীয় চেহারার জন্য কেসটা তার স্মৃতিপটে জীবন্ত হয়ে থাকবে।
রোমেন হেলজারকে দেখতে একজন বিবর্ণ, শান্ত মহিলা, কিন্তু আদালতে এসে সে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের আকার ধারণ করেছিল।
স্যার চার্লস মিঃ মেহার্নকে বললেন, আমাদের মক্কেল খুব অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে চলুন তাকে অভিনন্দন জানিয়ে আসি। কিন্তু মিঃ আর একজনের সঙ্গে মুখোমুখি হতে চান তিনি হলেন রোমেন হেলজার। তার দেখা পেতে একটু দেরি হলো কিন্তু কোথায় দেখা হলো সেই কথা এখানে অবান্তর। মিঃ মেহার্ন রোমেন হেলজারকে সব কথা খুলে বলতে রোমেন বলল, আমি আমার মুখটা কি করে পাল্টালাম সেটা তো খুব সোজা।
গ্যাসের আলো এত কম ছিল যে আপনি মেক-আপ ধরতেই পারেননি।
কিন্তু আপনি ঐরকম করতে গেলেন কেন?
শুনুন, যে করেই হোক তাকে আমার মুক্ত করার দরকার ছিল। আমি জানতাম মানসিকতা বুঝি তাই আমি চাইলাম আমাকে অপদস্থ করা হোক, অপরাধী করা হোক, তাহলেই স্বয়ংক্রিয় ভাবেই আসামীর পক্ষে সহানুভূতির উদ্রেক হবে।
কিন্তু চিঠির বাণ্ডিলগুলো?
ঐ চিঠিটা আমারই তৈরি করা, বাকিগুলো লেনার্ডকে লেখা আমার সত্যিকারের প্রেমের চিঠি।
তাহলে ম্যাক্স নামের লোকটা কে?
ঐ নামে কোনো লোকের অস্তিত্ব নেই।
মিঃ মেহার্ন দুঃখিত হয়ে বললেন, আমরা তো তাকে সোজা রাস্তাতেই আনতে পারতাম।
আমি ঝুঁকি নিতে চাইনি। আপনি তো নিজেই মনে করতেন যে সে নিরপরাধ।
কিন্তু মিঃ মেহার্ন আপনি মোটেই বুঝতে পারেননি, কিন্তু আমি জানি লেনার্ড সত্যিসত্যই খুন করেছিল।
.
০২.
জোয়ান অ্যাসবি ঘণ্টার আওয়াজ শুনে দৌড়ে সিঁড়ির দিকে গেল। দৌড়ে যেতে গিয়ে একজন যুবকের সঙ্গে বেশ জোরে ধাক্কা খেল।
আরে জোন যে। এত তাড়াহুড়ো কিসের? দুঃখিত হ্যারি। আমি তোমাকে দেখতে পাইনি। কিন্তু এত তাড়াহুড়ো কেন?
ঘণ্টা বেজে গেছে এটা দ্বিতীয় ঘণ্টা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে নাও।
হ্যারি ডেলহাউস পুরোনো ক্লকের দিকে তাকাল। আটটা বারো, সে বলল।
বাটলারকে উদ্দেশ্য করে প্রথম ঘণ্টাটা বাজালে না কি দ্বিতীয় ঘণ্টাটা?
প্রথম ঘন্টা স্যার।
আটটা বারোতে প্রথম ঘণ্টা বাজালে? তোমার তো চাকরি চলে যাবে?
বাটলার হেসে বলল, আজ সাতটার ট্রেন আধঘণ্টা দেরিতে পৌঁছচ্ছে তাই দশ মিনিট দেরিতে ডিনারের আয়োজন করা হয়েছে।
মনিবের হুকুমে।
কোথায় একটা গুলির শব্দ হলো হ্যারি বলল। ইতিমধ্যে কালো মতন পঁয়ত্রিশ বছর বয়স একজন লোক তাদের ড্রইংরুম থেকে বের হয়ে এলো।
এদিকে এরা তিনজন আওয়াজ সম্বন্ধে নানা রকম আলোচনা করতে লাগল। কিসের আওয়াজ কোন দিক থেকে আওয়াজটা এলো ইত্যাদি, সুদর্শন লোকটি শুধু মাথা নাড়ল। সে বলল, শব্দটা ঘণ্টা ও সামনের দরজাটা দিয়ে এল মনে হয়। হ্যারি বলল, উত্তর দিক থেকে শব্দটা এসেছে, শব্দটার উৎপত্তি আমাদের পিছন দিক থেকে।
জেফ্রি কিন বলল, আজকাল খুনখারাপি লেগেই আছে, মিস অ্যাসবি বলল, খুনের কথা শুনলে আমার হাত পা কাপে।
হ্যারি বলল খুন? কিন্তু কোনো রক্তপাত নেই, কোনো গোঙানি নেই, এরকম খুন আমি কোনোদিন দেখিনি।
আমার মনে হয় কোনো চোরাশিকারী খরগোশ মারছে, তারই গুলির শব্দ।
যাক বাবা বাঁচা গেল, বলে হাসতে হাসতে তিনজন বড় ড্রইংরুমটায় ঢুকল।
ইংল্যাণ্ডের প্রাচীন বাড়ির মধ্যে লাইচাম ক্লোজ অন্যতম বিখ্যাত বাড়ি।
হিউবার্ট লাইচাম রোচ পরিবারের সর্বশেষ বংশধর। টুপি বিক্রেতার মত রাগী সে, হতভাগ্য বেচারা! হিউবার্ট লাইচাম খ্যাতনামা সঙ্গীতজ্ঞ, তিনি একটা উগ্র স্বভাবের, রাগ হলে জ্ঞান থাকে না। জোর করে নিজের গুরুত্ব অপরের উপর চাপায়।
গান বাজনা নিয়ে তার খুঁতখুতানি সবচেয়ে বেশী। তিনি যখন অতিথিদের সামনে বাজাবেন তখন সবাইকে একেবারে চুপ করে থাকতে হবে। আর একটা ব্যাপারে খুঁতখুতানি আছে, সেটা হল রাতের খাওয়া।
রাতের খাওয়া রীতিমত একটা উৎসব, একটা অনুষ্ঠান। রাতের খাওয়ার সময় সবাইকে ঠিক সময় হাজির হতে হবে।
রাত আটটা পাঁচের সময় একটা ঘণ্টা পড়ে। আটটা পনেরোয় আর একটা ঘণ্টা পড়ে। তারপর ডাইনিংরুমের দরজা খুলে যায়, বলা হয় টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে। অতিথিরা তখন শোভাযাত্রা করে খাবার ঘরে ঢোকে। দ্বিতীয় ঘন্টা পড়ার পরে কেউ যদি দেরি করে তবে তার জন্য সে রাতের খাবার ঘরের দরজা বন্ধ।
তাই এই পবিত্র অনুষ্ঠানটা আজ হঠাৎ দশ মিনিট পিছিয়ে গেছে বলে সবাই খুব অবাক।
জোন অ্যাসবি দেখতে খুব সুন্দর। চোখদুটো নীল মাথার চুল সোনালী, চোখের চাউনি কিছুটা অস্থির, দুষ্টমী ভরা। সে এই প্রথমবারই লাইচাম ক্লোজ এসেছে।
দরজা খুলে ডায়না ক্লিভস ঘরের ভেতর ঢোকে সে রোচের পালিতা কন্যা। ডায়নার সৌন্দৰ্য্য পুরুষের বুকে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। চেহারাটা আবেদনময় কিন্তু কাছে গেলে মনে হয় বরফের ডেলা। যুবতীকে দেখেই যুবক দুজন এগিয়ে গেল। ডায়না দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসল। জেফ্রি কিনের মুখটা কালো হয়ে গেল।
মিসেস রোচ ঘরে ঢুকলেই সে নিজেকে সামলে নিল। মিসেস রোচ বেশ লম্বা, রংটা ময়লা, আচরণে দ্বিধা জড়িত। পরে সবুজ রঙের গাউন। তার সঙ্গে মধ্যবয়স্কা একজন ঘরে ঢুকলেন নাম গ্রেগরী বেয়ারলিং।
ঘণ্টা বেজে উঠলো। ডিগবি দরজা খুলে ঘোষণা করল ডিনার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একটা আশ্চর্য্য ঘটনা সবাই আছে কিন্তু হিউবার্ট লাইচাম রোচ নেই। কি হতে পারে তাঁর। সবাই কিছুটা আশঙ্কিত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
অবশেষে দরজাটা আর একবার খুলে গেল। সবাই ভাবল গৃহস্বামী কিন্তু তা নয়। যে ঘরে ঢুকল তাকে দেখে মনে হয় সে বিদেশী, ছোট্টখাট্ট লোক, মাথায় পুরো টাক বেশ বড় বড় গোঁফ; পরণে সাদাসিধা ইভনিং ড্রেস।
আগন্তুক মিসেস রোচের কাছে দেরি হওয়ার জন্য ক্ষমতা চাইল।
মিসেস রোচ বললেন, আপনার মোটেই দেরী হয়নি মি–তিনি থেমে গেলেন।
পোয়ারো, ম্যাডাম, আমার নাম এরকুল পোয়ারো, তার পিছনে কে যেন বলে উঠল ও কোনো মহিলা বোধ হয়। আপনি কি জানতেন আমি আসব?
মিসেস রোচ বললেন, হ্যাঁ। তবে আমার সবসময় সবকিছু মনে থাকে না। ডিগবি সব দিকে নজর রাখে।
এরকুল পোয়ারো বললে রেল লাইনে একটা দুর্ঘটনার জন্য আমার ট্রেন দেরিতে পৌঁছেছে। জোন তখন বলে উঠল সেই জন্যই দেরি করে ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মিসেস লাইচাম রোচ বললেন, আমি বুঝতে পারছি না কেন মানে, তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বলতে লাগলেন হিউবার্ট তো কোনোদিন এরকম দেরি করে না।
পোয়ারোর চোখ দুটো খুব তাড়াতাড়ি সবাইকে জরিপ করল।
এদিকে জেপ্রি কিন ব্যাখ্যা করল, মিঃ রোচ ডিনারে কোন দিন দেরি করে আসেননি একজন আগন্তুকের কাছে পরিস্থিতিটা খুবই অদ্ভুত, সবাই কেমন যেন অপ্রস্তুত, দ্বিধা জড়ানো।
হঠাৎ মিসেস লাইচাম রোচ বললেন, আমি ডিগবিকে পাঠাচ্ছি কেন মিঃ লাইচাম রোচ আসেননি ডিনারে।
ডিগবিকে ডাকা হলো এবং তাকে বলতে সে উত্তর দিল মিঃ লাইচাম রোচ আটটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে নীচে নেমে স্টাডিরুমে গিয়েছেন।
ডিগবি বলল, আচ্ছা আমি তাকে জানাচ্ছি যে ডিনার প্রস্তুত।
ধন্যবাদ ডিগবি।
ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণের নীরবতা। একটু পরেই ডিগবি ঘরে ঢুকল। জোরে জোরে তার নিশ্বাস পড়ছে এরকম হবার কথা নয় তার। আমাকে মাফ করবেন ম্যাডাম, স্টাডিরুম ভিতর থেকে দরজা বন্ধ।
এই সময়ই এরকুল পোয়ারো পরিস্থিতিটা নিজের হাতে নিল। সে বলল, আমাদের সবারই এখন স্টাডিরুমে যাওয়া দরকার।
হলঘরের মধ্য দিয়ে সিঁড়ি অতিক্রম করে, গ্র্যাণ্ডফাদার ক্লকটা এবং ডিনার গং এর পাশ দিয়ে সে করিডর দিয়ে চলল। করিডর শেষ হয়েছে স্টাডিরুমের বন্ধ দরজার সামনে।
মিঃ পোয়ারো দরজায় নক করলেন। কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পেলেন না, তারপর দরজার ফুটোতে চোখ দিয়ে তাকাল, তারপরই বললেন এক্ষুনি আমাদের দরজা ভাঙতে হবে। পোয়ারোর নির্দেশ মত জেফ্রি কিন ও গ্রেগারি বেয়ারলিং তারা দুজনে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল।
কিন্তু দরজা ভাঙা মুখের কথা নয়। অনেক চেষ্টার পর বেশ কিছুক্ষণ পরে সবার সমবেত ধাক্কায় দরজাটা শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে গেল। বাড়ির সবাই দরজার সামনে অপেক্ষা করতে লাগল কি দেখবে সেই ভেবে তারা যা ভয় করছিল তা-ই দেখতে পেল। জানালাটা তাদের দিকে মুখ করে বাঁ দিকে দরজা আর জানালার মাঝখানে একটা বড় লেখার টেবিল। টেবিলের দিকে মুখ না দিয়ে একটু বেঁকে একজন লম্বা চেহারার মানুষ বসে আছেন।
শরীরটা চেয়ারের উপর ঝোকানো তার পিছন দিকটা দরজার দিকে, মুখটা জানালার দিকে তাঁর ডান হাতটা মেঝের দিকে ঝুলে পড়েছে, আর হাতের নীচে কার্পেটের উপর একটা চকচকে পিস্তল।
পোয়ারো তীক্ষ্ণ গলায় গ্রেগরি বেয়ারলিংকে বলল, মিসেস রোচ ও অন্য দুজন মহিলাকে এখান থেকে নিয়ে যান।
মিসেস লাইচাম কেঁপে উঠে বললেন বোচ নিজেকে গুলি করেছে, উঃ কি সাংঘাতিক! গ্রেগরি বেয়ারলিং তাকে এবং অন্য দুজন মহিলাকে নিয়ে অন্যদিকে গেলেন।
পোয়ারো ঘরের মধ্যে ঢুকল, যুবক দুজন তার পিছনে। বুলেটটা মাথার ডান দিক ফুটো করে বের হয়ে গিয়ে নিশ্চয়ই বাঁ দিকের ঝোলানো আয়নাটায় আঘাত করেছে। আয়নাটা ভেঙ্গে গেছে। লেখার টেবিলের উপর এক টুকরো কাগজ, তাতে শুধু একটা শব্দ লেখা দুঃখিত।
পোয়ারো দরজার দিকে ফিরে তাকাল। দরজার তালায় ভিতর থেকে তো চাবি লাগানো নেই, সে বলল আমার মনে হয়।
পোয়ারো খুব তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গেল। জানলাটা বেশ বড়।
সে নীচে বাইরের দিকে ঘাসগুলো পরীক্ষা করে জানলাটা আবার বন্ধ করে দিল।
সে বলল, আমাদের এখুনি পুলিশে ফোন করা দরকার। তারা যতক্ষণ না এটা আত্মহত্যা বলছেন ততক্ষণ আমাদের কোনো কিছুতে হাত দেওয়া উচিত নয়।
মনে হয় মিঃ রোচ পনেরো মিনিট আগে মারা গেছেন।
পোয়ারো ডিগবিকে স্টাডিরুমের সামনে পাহারা দিতে রেখে গেল। হ্যারি মহিলাদের কাছে চলে গেল।
মিঃ পোয়ারো বলতে আরম্ভ করলেন আপনি মিঃ লাইচাম রোচের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাই আপনার সঙ্গে আমার প্রথম কথা বলা উচিত। কারণ এই সময় মিসেস লাইচামকে প্রশ্ন করা উচিত নয়। আমি সহজ ভাবে ঘটনাগুলো আপনার সামনে রাখব। তাহলে শুরু করি। আমার লণ্ডনের ঠিকানায় মিঃ রোচের কাছ থেকে একটা চিঠি পাই। তাতে লেখা আছে তার ব্যবসা থেকে কেউ প্রচুর অর্থ আত্মসাৎ করেছে। তিনি পুলিশকে খবর দিতে নারাজ। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন আমি এসে ব্যাপারটার তদন্ত করি। আমি রাজী হয়েছিলাম কিন্তু আমার আসতে কয়েকদিন দেরী হয়ে গেল।
বেয়ারলিং সামান্য হাসলেন। তিনি মাঝে মাঝে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতেন কিন্তু বিকৃত মস্তিষ্ক নয় কারণ আত্মহত্যা বিকৃত মস্তিষ্কের কাজ নয়। তদন্তকারী জুরীরা তাই বল বেয়ারলিং দৃঢ়ভাবে বলল, হিউবার্ট মোটেই স্বাভাবিক লোক ছিল না। তিনি কিছুটা উন্মাদগ্রস্ত ছিলেন পারিবারিক ব্যাপারে। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও খুব বুদ্ধিমান ছিলেন।
মিঃ পোয়ারো বললেন, রহস্যটা খুব শীঘ্র উন্মোচন করতে হবে। তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন পারিবারিক কারণেই অনেকে আত্মহত্যা করেন। তিনি একটা অপরাধের ছায়া দেখেছিলেন সেই জন্যই তাকে মরতে হল। যাইহোক আমি এই ব্যাপারে তদন্ত করব এবং খুব তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ করার চেষ্টা করব।
বেয়ারলিং বললেন, আমি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করব বুঝতে পারছি না। হিউবার্ট কোনদিন গোপন কিছু আমাকে বলেননি।
আপনি আমাকে বলুন মিঃ বেয়ারলিং আপনার মতে কার পক্ষে মিঃ রোচের অর্থ চুরি করার সম্ভাবনা রয়েছে।
বলা মুশকিল। তবে ক্যাপ্টেন মার্শাল বলে একজন এজেন্ট আছে তার বিষয় সম্পত্তি দেখার জন্য। তিনি খুব চমৎকার লোক। যুদ্ধে তার একটা হাত কাটা গেছে।
হিউবার্ট এই ভদ্রলোককে বেশ পছন্দ করতেন।
মিঃ! পোয়ারো বেয়ারলিংকে অনুরোধ করলেন আপনি আমায় সব খুলে বলুন।
বেয়ারলিং বললেন, ঠিক আছে বলছি তাহলে আপনি ড্রইংরুমে একজন সুন্দরী মহিলা দেখেছেন?
আমি দুজন সুন্দরী মহিলাকে দেখেছি।
হা একজনের নাম মিস অ্যাসবি, হ্যারি ডেলহাউস তাকে এনেছেন। কিন্তু আমি আর একজন মহিলার কথা বলছি তার নাম ডায়না ক্লিভস। তিনি একজন সাংঘাতিক মহিলা। এখান থেকে কুড়ি মাইলের মধ্যে যত পুরুষ আছে সবার সঙ্গে উনি ফষ্টিনষ্টি করেছেন এই জন্য তাকে কেউ না কেউ একদিন খুন করবেই। এদিকে আর একজন মহিলা মিঃ বেয়ারলিংকে সমানে লক্ষ্য করে যাচ্ছেন তিনি হলেন লাইচাম রোচের পালিতা কন্যা। ডায়না ক্লিভস একদিক দিয়ে তাদের দূর সম্পর্কের ভাইঝি হয়। হিউবার্ট তাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি চাইতেন না ডায়না ক্লিভসের বিয়ে হোক। তবে হিউবার্টের পছন্দ মত পাত্র যদি হয় তাহলে তার কোন আপত্তি ছিল না। বেয়ারলিংকে হিউবার্টের খুব পছন্দ ছিল। বেয়ারলিংও ডায়নার প্রেমে পড়েছিল তবে ডায়নার চরিত্র একেবারেই ভালো ছিল না সে সবাইকেই খেলাত!
কিন্তু ক্যাপ্টেন মার্শাল তার নজরে পড়েছিল লোকে বলাবলি করত।
আচ্ছা, মিঃ ডেলহাউস কে হন?
ভাগ্নে। সেই তো সব সম্পত্তি পাবে, তাই না?
মিঃ রোচের মৃত্যুর পর তাঁরই নাম নেওয়া উচিত কারণ বংশে আর কোন লাইচাম রোচ নেই। সম্পত্তির কোনো উত্তরাধিকারী ঠিক করা নেই তবে লাইচাম রোচের সম্পত্তি পেতে গেলে ডায়নার স্বামীকে লাইচাম রোচের নাম গ্রহণ করতে হবে।
মিঃ পোয়ারো বলল, আপনি সব কথা বলে আমার খুব উপকার করেছেন, এবার লাইচাম রোচকে অনুরোধ করুন তিনি যেন একমিনিটের জন্য আমার সঙ্গে দেখা করেন।
কিছুক্ষণ পরই মিসেস লাইচাম ঘরে ঢুকলেন, চেয়ারে বলেন তিনি, বললেন, আমার পরিবারের মধ্যে কোনোরকম কেলেংকারি চাই না।
তবে আমি যে মুহূর্তে আয়নাটাকে দেখছি তখনই আমার একটা প্রতীকের কথা মনে পড়ছে। হিউবার্ট যেন অভিশাপগ্রস্ত, সে খুব অদ্ভুত ধরনের মানুষ ছিল।
পোয়ারো বললেন, আচ্ছা ম্যাডাম আপনাদের কি কোনো আর্থিক অনটন চলছিল?
আমি এসব ব্যাপারে ভাবিই না।
আপনাকে ধন্যবাদ ম্যাডাম, আমার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই।
পোয়ারো এবার ডিগবিকে ডাকল।
তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব, তুমি এখন আমাকে বল গুলির শব্দ সম্বন্ধে তোমার কি বলার আছে।
আমরা চারজন ছিলাম হলঘরে। মিঃ ডেলহাউস, মিস অ্যাসবি এবং মিঃ কিন।
বাকিরা কোথায় ছিল?
মিসেস লাইচাম বোচ ও মিঃ বেয়ারলিং পরে এসেছিলেন, আর মিস ক্লিভস বোধহয় ড্রইংরুমে ছিলেন স্যার। পোয়ারো ডিগবিকে আরও দু-একটা প্রশ্ন করে বিদায় দিল। তাকে বলে দিল মিস ক্লিভসকে পাঠিয়ে দাও।
মিস ক্লিভস সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকল। সাদা সার্টিনের পোষাকে তাকে অপূর্ব দেখাচ্ছে।
মিঃ পোয়ারো মিস ক্লিভসকে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন সে মার্শাল সম্বন্ধে ভালোমতই প্রকাশ করল কিন্তু বেয়ারলিং-এর কথা উঠতেই সে উত্তেজিত হয়ে উঠল। সে বলল, লেকটা পাজি, আমি রোচকে লোকটা সম্বন্ধে জানিয়ে ছিলাম কিন্তু মিঃ রোচ কারও কথা শুনবে না।
আচ্ছা মিস ক্লিভস আপনার বাবার মৃত্যুতে কি আপনি দুঃখিত।
নিশ্চয়ই দুঃখিত। আমি বাবাকে খুবই ভালোবাসতাম। তবে তাঁর মৃত্যু হয়ে তিনি বেঁচে গেছেন। কারণ তার মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীনতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল।
পোয়ারো চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ল তারপর বলল, আমি যদি আপনার ব্যাগটা পরীক্ষা করি তাহলে নিশ্চয়ই আপত্তি থাকবে না।
ও, হ্যাঁ, আপনি গুলির শব্দটা শুনে কি ভাবলেন? কোথায় ছিলেন তখন?
আমি ভেবেছিলাম কোনো গাড়ির শব্দ এবং আমি তখন বাগানে ছিলাম।
আচ্ছা ধন্যবাদ মাদমোয়াজেল। এরপর আমি মিঃ কিনের সঙ্গে কথা বলব। একটু পরে কিন ঘরে প্রবেশ করল। মিঃ পোয়ারো তাকে বলল, আমি জানতে চাই আজ সন্ধ্যাবেলায় স্টাডিরুমে আপনি নীচু হয়ে মেঝে থেকে কি তুলছিলেন? এবং সেটা আপনার জ্যাকেটের ডান পকেটে রেখেছিলেন।
কিন তার পকেটটা উল্টিয়ে ভিতরের জিনিষগুলো বার করল। একটা সিগারেট হোল্ডার, একটা রুমাল, ছোট্ট সিল্কের গোলাপ কুঁড়ি এবং একটা সোনার দেশলাই বাক্স।
সত্যি বলতে কি আমি এই দেশলাই বাক্সটা কুড়িয়েছিলাম।
মিঃ পোয়ারো বললেন, না মিঃ কিন, অন্য কোন ছোট জিনিষ আপনি কুড়িয়েছেন, খুব সম্ভব এই গোলাপ কুড়িটা।
একমুহূর্ত চুপ করে থেকে কিন হেসে উঠে স্বীকার করল।
এমন সময় একজন লম্বা শুভ্র কেশ, লাউজ স্যুট পরা ব্যক্তি ঘরে ঢুকল।
তিনি অবাক হয়ে কিনকে মিঃ রোচের মৃত্যুর সংবাদ দিলেন।
মিঃ কিন! পোয়ারোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে বললেন ইনি মিঃ মার্শাল।
মিঃ মার্শাল বললেন, মিঃ পোয়ারো আমি আপনার একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত।
পোয়ারো দেখল তার গলার স্বর এবং হাবে-ভাবে ছেলেমানুষী আছে।
পুলিশ এসেছে তাদের সঙ্গেই আমি এসেছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি লাইচাম নোচ সদাই ভাবত যে তাকে ছাড়া এই পৃথিবী অচল তাই তার আত্মহত্যায় আমি অবাকই হয়েছি।
পোয়ারো বললেন, আমি একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি আপনার কি এরকম মনে হয় যে মিঃ লাইচাম রোচ তার হিসাবপত্রের ব্যাপারে আপনাকে সন্দেহ করছিলেন?
এরকম ধারণা খুবই অবাক করার মত।
তিনি কি সন্দেহ করতেন যে তার পালিতা কন্যার সঙ্গে আপনার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠতে চলেছে?
মার্শাল লাজুকভাবে হেসে মাথা নাড়ল। তবে মিঃ বোচ এসব কিছুই জানতেন না। তিনি জানলে চাকরি থেকে আমাকে বরখাস্ত করতেন, ডায়নার মাসোহারা বন্ধ করে দিতেন।
ইতিমধ্যে জেফ্রি কিন বললেন, পুলিশ ইনসপেক্টর আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায় মিঃ পোয়ারো।
চলুন যাচ্ছি।
পুলিশ ইনসপেক্টর মিঃ পোয়ারো সাথে করমর্দন করল তারপর বললেন কেসটা মোটেই জটিল নয় কারণ দরজা জানালা বন্ধ ছিল, দরজার চাবি মৃতের পকেটে পাওয়া গেছে, এটা আত্মহত্যা সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আপনি বুলেটটা পেয়েছেন?
হ্যাঁ, এই তো। ডাক্তার বুলেটটা দেখাল।
দেয়ালের কাছে আয়নার নীচে পড়েছিল। তাঁর পিস্তলটা সবসময় ডেক্সের ড্রয়ারে রাখতেন।
মৃতদেহ শোবার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একটু পরেই পুলিশ চলে গেল।
আপনাদের কি একটা জোরালো ফ্লাশলাইট আছে? পোয়ারো হ্যারিকে জিজ্ঞাসা করল।
হ্যাঁ আছে বলে জোন ও হ্যারি দুজনে মিলে লাইটটা নিয়ে এল।
পোয়ারো বলল, আপনারা আমার সাথে আসতে পারেন। সে ঘাসের উপর আলো ফেলে নীচু হলো তারপর উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ল। সে বলল, এখানে নয়। তারপর পোয়ারোর নজর ডান দিকের কেয়ারির উপর পড়ল, সে ফুলের সামনের জমির উপর আলো ফেলল। দেখতে পেল পায়ের পরিষ্কার ছাপ। চারটে পায়ের ছাপ, দুটো ছাপ আসা এবং দুটো যাওয়া।
জোন বলল, মালীর পায়ের ছাপ বোধ হয়।
পোয়ারো বলল, না না, যে ছাপ দেখা যাচ্ছে সেটা কোনো মহিলার পায়ের ছাপ। এই ছাপ হাইহিল জুতোর ছাপ।
মিঃ পোয়ারো ডায়না ক্লিভসের সঙ্গে কথা বলবার জন্য ড্রইংরুমে বসলেন।
মিঃ পোয়ারো বললেন, একটা ছোট্ট প্রশ্ন করব মাদমোয়াজেল। আপনি কি আজ কোন সময়ে স্টাডিরুমের জানালার পাশে ফুলের কেয়ারির কাছে গিয়েছিলেন।
হা, সে মাথা নেড়ে সায় দিল। একবার সাতটার সময় আর একবার ডিনারের ঠিক আগে।
মিঃ পোয়ারো ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলুন।
ডায়না বললেন, আমি টেবিলে ফুল সাজাবার জন্য ঠিক সাতটার সময় বাগানে যাই। আর একবার পোষাকে ফুল আটকাবার জন্য ফুল তুলতে গেছি কারণ পোষাকে একটু তেল পড়ে গেছিল। ফুলটা ঠিক আটটার সময় তুলতে গেছি।
আচ্ছা আপনি জানালা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি কেন? আর গুলির আওয়াজ যখন হয়েছিল তখন আপনি কোথায়?
ডায়না বললেন, আমি চেষ্টা করে ছিলাম ঐ পথ দিয়ে যেতে কিন্তু জানালা বন্ধ ছিল। আর গুলির শব্দ আমি বাগান থেকে আসার দু-তিন মিনিট পরে শুনেছিলাম। পাশের দরজা দিয়ে ঢোকার ঠিক আগে।
পোয়ারো একটা ছোট সিল্কের গোলাপ কুড়ি ডায়না ক্লিভসকে দেখাল। এটা আপনি মিঃ কিনকে দিয়েছিলেন।
ডায়না বললেন, হ্যাঁ, এটা আমি কাল রাতে মিঃ কিনকে দিয়েছিলাম।
যাইহোক পোয়ারো এবার সবাই এর উদ্দেশ্যে বললেন, আপনারা সবাই অনুগ্রহ করে স্টাডিরুমে ঢলুন। এবং ম্যাডামকে আসতে অনুরোধ করুন। মিঃ পোয়ারো এবার তার কথা আরম্ভ করলেন। এই কেসটা আপনারা জানেন মিঃ নোচ নিজে আত্মহত্যা করেছেন কিন্তু তা নয় তাকে খুন করা হয়েছে।
খুন করা হয়েছে? মার্শাল হেসে উঠল।
দরজা জানালা বন্ধ। তিনি ঘরে একা। কে তাকে খুন করবে?
আমি একটা জিনিষ দেখাব। দেখুন জানালা বন্ধ করছি হাতল না ঘুরিয়েই কিন্তু এখন দেখুন সে আস্তে একটু ধাক্কা দিল এবং জানালার হাতলটা ঘুরে গিয়ে ছিটকিনিটা ঠিক জায়গায় আটকে গেল। সুতরাং জানলাটা বন্ধ হবার কায়দাটুকু খুব ঢিলে। এবার সে দৃঢ়তার সাথে বলল, যখন আটটা বারো মিনিটে গুলি করা হয় তখন চারজন হলঘরে ছিল। চারজেনরই খুন করার সুযোগ নেই কিন্তু বাকি তিনজন কোথায় ছিল? ম্যাডাম আপনি ঘরে ছিলেন। মঁসিয়ে বেয়ারলিং আপনিও আপনার ঘরে ছিলেন। আর মাদমোয়াজেল, আপনি ছিলেন বাগানে আপনি তাই স্বীকার করেছেন। এবার পোয়ারো মিসেস লাইচাম রোচের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি বলুন মিঃ রোচ কিভাবে উইল করে গেছেন। হিউবার্ট তার উইল আমাকে পড়ে শুনিয়েছিল। আমি যতদিন জীবিত থাকব ততদিন সম্পত্তি থেকে বছরে তিন হাজার পাউণ্ড পাব তাছাড়া নিজের পছন্দ মত বাড়ি পাব। কিন্তু তারপর সে কয়েক সপ্তাহ আগে উইল কিছু প্রবর্তন করে। সে সব সম্পত্তি ডায়নাকেই দিয়েছে। তবে শর্ত হলো তাকে বেয়ারলিংকে বিয়ে করতে হবে। যদি অন্য কাউকে বিয়ে করে তবে সমস্ত সম্পত্তি তার ভাগ্নে হ্যারি ডেল হাউস পাবে।
এবার মিঃ পোয়ারো ডায়নাকে এগিয়ে গিয়ে বললেন আপনি তো ক্যাপ্টেন মার্শালকে বিয়ে করতে চান নাকি মিঃ কিনকে?
ডায়না তখন মার্শালের হাতটা পেঁচিয়ে ধরল। মিঃ পোয়ারো ঠিক সেই সময়ে ডায়নাকে নানা রকম জেরা করে এবং এমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে যেন ডায়নাই খুন করেছে। তারপর অবশেষে ডায়নার দিকে তাকিয়ে হাসে এবং বলেন ঘটনাটা এইরূপ হতে পারত, কিন্তু তা না হয়ে পোয়ারো ঘরের চারিদিকে একবার চোখ বোলাল, তারপর বলতে লাগল, আপনারা মৃতদেহটা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন। তিনি ডেক্সের দিকে কোনাকুনি বসে জানালার দিকে মুখ করেছিলেন। ঐভাবে বসে কেউ আত্মহত্যা করে না। কিন্তু এখন মনে করুন তিনি খুন হয়েছেন।
মিঃ রোচ ডেস্কের দিকে মুখ করে বসেছিলেন। খুনী তার পিছনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। কথা বলতে বলতেই গুলি করল। বুলেট তাহলে মাথা ভেদ করে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে ঘন্টাটায় গিয়ে লাগবে। অবশ্য দরজাটা যদি ভোলা থাকে।
তাহলে বুঝতে পারছেন? বুলেটটা যখন ঘণ্টায় লাগল ঐটাই হলো প্রথম ঘণ্টা। ঐ ঘণ্টার শব্দ শুনেছিলেন জোন, কারণ তাঁর ঘরই ঐ ঘণ্টাটার উপরে।
এবার আসি খুনী কি করল? দরজাটা বন্ধ করে তালা লাগাল, চাবিটা রাখল মৃতের পকেটে তার পর মৃতদেহটা একটু কোনাচে করে রাখল এবং পিস্তলে মৃতের আঙুলের ছাপ নিয়ে পাশে ফেলে রাখল। সবশেষে আয়নাটা ভেঙে ফেলল, যাতে মনে হয় ঘটনাটা আত্মহত্যা ছাড়া কিছুই নয়। খুনী জানালা দিয়ে বাইরে যায় এবং জানালার ছিটকিনি আটকায় কিন্তু ঘাসের উপর পা না ফেলে ফুলের জমির উপর পা ফেলেছিল যাতে পরে সেটা মসৃণ করে দেওয়া যায়। আটটা বারোতে সে ঘরে চলে গেল। যখন সে ড্রইংরুমে একা তখন সে পিস্তল থেকে গুলি করেই হলঘরে ঢোকে।
আপনি তো এরকমই করেছিলেন জেফ্রি কিন?
বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে সেক্রেটারি জেফ্রি কিন পোয়ারোর দিকে তাকাল এবং একটু পরেই মিঃ কিন সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ল।
ডায়না বিড়বিড় করে বলতে লাগল কিন্তু জেফ্রি কিন খুন করল?
আমার মনে হয় সেক্রেটারি হিসাবে কাজ করায় তার পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। মিঃ রোচের হয়ত কোনো সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিল।
তাই তিনি আমাকে খবর দেন। মিঃ কিন বুঝতে পারেন আমি এখানে আসছি তাই তিনি আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি কাজটা সারলেন। তার পরিকল্পনা ছিল খুনটা করা হবে আটটা বারো মিনিট কেননা অন্য জায়গায় তার অবস্থানের প্রমাণ থাকবে। কিন্তু বুলেটটা তিনি ঠিক সময়ে কুড়িয়ে নেবার সময় পাননি। তিনি যখন কুড়োন তখন আমি লক্ষ্য করে ফেলেছি।
হ্যারি জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু আসল গুলির শব্দটা কেউ শুনতে পায়নি কেন?
সাইলেন্সার থেকে গুলি করা হয়েছিল। সাইলেন্সারটা খুঁজে পাওয়া যাবে, আর পিস্তলটা পাওয়া যাবে ঝোঁপের মধ্যে। পোয়ারো বুলেটটা তুলল আমি যখন মিঃ ডেল হাউসকে সঙ্গে নিয়ে জানলাটা পরীক্ষা করেছিলাম তখন মিঃ কিন আয়নার নীচে বুলেটটা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।
ডায়না মার্শালের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল জন আমাকে বিয়ে করে এখান থেকে নিয়ে চল। ডায়না আরও বলে উঠল, আমি উইলের অর্থ চাই না। আমরা ফুটপাতে ছবি এঁকে দিন কাটাব।
হ্যারি বলল, ঐসব কোন দরকার নেই। আমরা সম্পত্তি ভাগাভাগি করে নেব।
মিসেস লাইচাম রোচ কেঁদে উঠলেন। মিঃ পোয়ারো আয়নাটা কিন ইচ্ছে করেই ভেঙেছে? হ্যাঁ ম্যাডাম। মিঃ জেফ্রি কিনের পক্ষে এটা খুবই দুর্ভাগ্য বলে প্রমাণিত হল।
৩-৫. শক্ত সমর্থ পুরুষ
০৩.
মিঃ ডিনমিড বেশ শক্ত সমর্থ পুরুষ, কাঁধ দুটো একটু ঝোকানো, মুখটা বেশ বড় সড় ও লালচে।
মিঃ ডিনমিড গোল টেবিলটা লক্ষ্য করলেন ফায়ার প্লেসের আগুনে সাদা টেবিলক্লথ, মিঃ মেহার্ন বললেন, ছুরি কাঁটা ও অন্যান্য সরঞ্জাম চক্ করছে।
মিসেস ডিনমিড জিজ্ঞাসা করলেন, দেখ সব কিছু ঠিক আছে তো?
হ্যাঁ সব প্রস্তুত, মিঃ ডিনমিড বললেন।
তাহলে রান্নাগুলো করে ফেল, শার্লট রান্নাঘরে আছে তোমাকে সাহায্য করবে।
ডিম, কোল্ড কর্ড বিফ, রুটি আর চিজ এই হলো আজ রাতের খাবার। মিঃ ডিনমিড মিনিট দুয়েক ধরে শিস দিতে দিতে বললেন কি বিশ্রী আবহাওয়া আজ আর কেউ আসবে না। প্রায় দশমিনিট বাদে মিসেস ডিনমিড হাতে ডিম ভাজা নিয়ে ঢুকলেন এবং কিছু পরে তার দুই মেয়ে খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল। পিছন পিছন মিঃ ডিনমিড। ছেলে ডনিকে নিয়ে ঢুকলেন। তিনি সামনের চেয়ারে বসলেন। এবার মজা করে বলতে লাগলেন নানা কথাবার্তা।
যেমন তার মেয়ে মলিন বলল, লোকালয় থেকে এতদূরে বাড়ি করার জন্য কোন জন প্রাণীর দেখা পাই না।
শার্লট বলল, আমি কিছুতেই এই বাড়িতে একা একা ঘুমাব না।
ডিনমিড খুব রেগে গিয়ে বললেন, যত্তোসব বাজে কথা, তুমি কি কখনও কিছু দেখেছ? শার্লট কোনো উত্তর দিল না। এদিকে বাইরে বেশ জোরে বৃষ্টি শুরু হল।
মিঃ ডিনমিড জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি ভয় পাচ্ছ নাকি? আমরা আগুনের ধারে নিরাপদে আছি।
তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ দরজায় করাঘাত শোনা গেল।
মিসেস ডিনমিড আর্তনাদ করে শালটা গায়ে জড়ালেন।
কুড়ি মিনিট আগে মর্টিমার ক্লিভল্যাণ্ড বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে গাড়িটাকে দেখতে লাগলেন। দশ মিনিটের মধ্যে পর পর দুটো টায়ার ফেটে গেল আর তিনি এখন উইন্টশায়ারের এই লোকালয় বর্জিত জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন সত্যিই তার ভাগ্য খুব খারাপ।
চারিদিকে সন্ধ্যায় অন্ধকার নেমে আসছে। ধারে-কাছে আশ্রয়স্থল নেই। তার উচিত ছিল বড় রাস্তা দিয়ে যাওয়া। গাড়িটাকে সচল করার কোনো উপায় এখন আর নেই কারণ তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন পাহাড়ের পাশে সরু রাস্তায়। তিনি হতবুদ্ধি হয়ে চারিদিকে তাকিয়ে হঠাৎ আলোর ঠিকানা পেলেন এক মুহূর্ত চিন্তা করে তিনি গাড়ি ছেড়ে পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরে উঠলেন।
এবার তিনি একটা কুটিরের আলো দেখতে পেলেন। মর্টিমার ক্লিভল্যাণ্ড ভাবলেন ওখানে নিশ্চয়ই আশ্রয় পাওয়া যাবে।
ক্লিভল্যাণ্ড একজন বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী। তিনি অবচেতন মন নিয়ে দুটো টেক্সট বই লিখেছেন। তিনি রিসার্চ সোসাইটির সভ্য এবং অতিপ্রাকৃত বিদ্যার ছাত্র।
মিঃ ডিনমিডের বাড়ি পৌঁছে দরজায় ধাক্কা মারার পূর্ব মুহূর্তে একটা উত্তেজনার আঁচ পেলেন। তিনি পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া বিচার করে ভবিষ্যৎ ফল সম্পর্কে অনুমান করতে পারেন।
তিনি দরজায় ধাক্কা মারতেই ভিতরের সবাই চুপ করে গেল এবং কিছুক্ষণ পরে দরজাটা খুলে গেল। ক্লিভল্যাণ্ড ভিতরের সব দৃশ্য দেখতে পেলেন, মনে হলো ভেতরটা কোনো ডাচ শিল্পীর আঁকা ছবি।
একটা বড় গোল টেবিল, পরিবারের সবাই বসে আছে। বাড়ির কর্তা, গিন্নী এবং তাদের কিশোর পুত্র ও কিশোরী কন্যা। মেয়েটি আশ্চৰ্য্য সুন্দরী।
ঘরের মধ্যে নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ক্লিভল্যাণ্ড তার অসহায় অবস্থার কথা বললেন। অবশেষে কর্তা উঠে দাঁড়িয়ে মিঃ ক্লিভল্যাণ্ডকে ভিতরে ডাকলেন। আগুনের পাশে কাঠের টুলে ক্লিভল্যাণ্ড বসলেন। জনি দরজাটা বন্ধ করে দিল।
আমার নাম ডিনমিড কর্তা বললেন। আর ইনি আমার স্ত্রী এবং এরা দুজন আমার মেয়ে শার্লট এবং মদলিন। শার্লট অপূর্ব সুন্দরী। মলিন দেখতে একটু অন্য ধরনের। তার সৌন্দর্য্য যেন পটে আঁকা।
মর্টিমার ক্লিভল্যাণ্ডকে চা-পান করার জন্য অনুরোধ করলেন এবং কিছুক্ষণ বাদে তার স্ত্রী গরম চা ও নানারকম খাবার দিয়ে পরিচর্যা করলেন। পরিচর্যার ভিতর দিয়ে মিঃ ডিনমিড নানারকম কথাবার্তা শুরু করলেন। নিজের সম্বন্ধে সব কথা খুলে বললেন, তাঁর ব্যবসা, এই গ্রামে থাকা ইত্যাদি।
তার কথার তোড়ে মার্টিমার মন্ত্রমুগ্ধ। কিন্তু তবুও ঘরের ভিতর দৃষ্টির ফেলার সময় চারজনের মধ্যে একজনের অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করছেন।
আপনাকে আজ রাত্রিতে এখানেই থাকতে হবে। মিঃ ক্লিভল্যাণ্ড না হলে এত রাত্রিতে যাবেনইবা কোথায়?
আপনাদের আতিথেয়তার তুলনা হয় না। মেয়ে দুজন ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল।
একটু পরে মর্টিমার পায়ের শব্দ পেলেন।
আপনার মেয়েরা খুব সুন্দরী, ক্লিভল্যাণ্ড বললেন।
মিঃ ডিনমিড গর্বের সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ। আমার মতো বা মা-র মতো হয়নি।
একটু পরেই জানানো হলো ঘর প্রস্তুত। মর্টিমার আরও একবার ধন্যবাদ জানালেন।
ডিনমিড বললেন, তোমরা ওঁর সঙ্গে উপরে গিয়ে দেখ সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা।
মলিন জানালাটা পরীক্ষা করে দেখল এবং শার্ট ওয়াশ হ্যাঁণ্ড বেসিনের দিকে নজর দিল। তারপর গুডনাইট মিঃ ক্লিভল্যাণ্ড বলে বিদায় নিল।
দরজাটা বন্ধ করে তারা দুজন চলে গেল। ঘরে মর্টিমার এখন একা।
কিছুক্ষণ বাদে নিচ থেকে মিঃ ডিনমিডের গলার শব্দ তিনি পেলেন।
তারপর তিনি পায়চারি করতে করতে চিন্তায় ডুবে গেলেন। আচ্ছা মর্টিমার এমন ভাবে তাকাল কেন? তাহলে এই বাড়িতে কোথায় যেন একটা গোলমাল আছে।
এস.ও.এস। এটা বিপদ সংকেত কিন্তু ধুলোর মধ্যে কে এটা লিখল?
তার মনে পড়ল তারা দুজনেই ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু লিখল কে?
দরজার সামনে গিয়ে তিনি আবার দরজাটা খুললেন না, মিঃ ডিনমিডের গলার আওয়াজ আর শোনা যাচ্ছে না।
তিনি চিন্তা করলেন কাল যা কিছু করার করব।
ক্লিভল্যাণ্ড সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলেন। লিভিংরুমের ভিতর দিয়ে বাগানে চলে গেলেন। শার্লট সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে।
ক্লিভল্যাণ্ডকে শার্লট দেখতে পেয়েই সুপ্রভাত জানাল।
গুডমর্নিং, মর্টিমার হাসিমুখে বলল।
কিছুক্ষণ পর মর্টিমার একটা গাছের ডাল ভেঙে ঐটা দিয়ে বালুময় মাটিতে এস.ও.এস লিখে শার্লটকে ভালো করে লক্ষ্য করলেন। কিন্তু কিছু বুঝতে পারলেন না।
তুমি কি জান এই তিনটে অক্ষরের মানে কি? শার্লট ভ্রূ কোঁচকাল।
সে বলল, কোনো জাহাজ যখন বিপদে পড়ে তখনই তো এই সংকেত পাঠায়।
মর্টিমার সায় দিল মাথা নেড়ে। কিন্তু তুমি কি এটা লিখেছ।
শার্লট চোখ বড় করে অবাক হয়ে বলল, না আমি লিখিনি।
তাহলে আমার ভুল হয়েছে। হতাশায় মনটা তার ভরে গেল।
এবারে তারা দুজনে বাড়ির দিকে চলল। যেতে যেতে শার্লট হঠাৎ নীচু গলায় বলে উঠল, কথাটা আমি লিখিনি বটে কিন্তু যে কোন সময় লিখে ফেলতে পারতাম। কারণ আমি ভীষণ ভয়ের মধ্যে ছিলাম। কিন্তু আপনি আসার পর যেন কিছু উত্তর পেলাম।
তুমি কিসের ভয় পেয়েছিলে?
আমি তা জানি না, শার্লট বলল। তবে মনে হয় বাড়িটা। এখানে আসার পর সবাই কেমন যেন পালটে গেছে, তাছাড়া এই বাড়িতে ভূত আছে।
মর্টিমারের আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। শার্লট বলল, এই বাড়িতে একজন লোক তার স্ত্রীকে খুন করেছিল। এখানে আসার পর আমরা তা জানতে পারি। মর্টিমার চিন্তা করতে লাগলেন। আমাকে বল কাল রাতে আমি যে ঘরে ছিলাম খুনটা কি সেই ঘরেই হয়েছিল?
শার্লট বলল, আমি ও সম্বন্ধে কিছুই জানি না।
মর্টিমার প্রায় নিজের মনে বললেন, খুনটা ঐ ঘরে হয়ে থাকতে পারে।
আমার মনে হয় কাল রাতে তুমিই এস.ও.এস লিখেছিলে! তুমি অবচেতন অবস্থায় লিখেছ। অনেক বছর আগে যে খুন হয়েছিলো সে হয়ত এস.ও.এস লিখেছিল, এখন তুমি অবচেতন মনে লিখে ফেলেছ।
শার্লটের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বলল, আপনি এই ভাবে ব্যাখ্যা করছেন। বাড়ির ভিতর থেকে কে যেন তাকে ডাকল সে ভেতরে চলে গেল।
মর্টিমার একাই বাগানে পায়চারি করতে লাগলেন। কাল রাতে এই বাড়িতে ঢুকে তিনি যে উত্তেজনার আভাস পেয়েছিলেন এই ব্যাখ্যা কি তার সঙ্গে যুক্তিযুক্ত? তিনি নিজের মনে বললেন, আমার আবির্ভাব জনি ছাড়া সবাইকে ভীষণ চমকে দিয়েছিল কিন্তু কেন?
এমন সময় জনি অতিথিকে বলল, ব্রেকফাস্ট রেডি আপনি ভেতরে আসুন।
মর্টিমার লক্ষ্য করলেন জনির হাতের আঙুলে কিসের দাগ। জনি বুঝতে পেরে বলল, আমি রসায়ন নিয়ে পরীক্ষা করি। বাবা পছন্দ করেন না। তবুও আমার ইচ্ছা রসায়ন নিয়ে আমি গবেষণা করি।
ইতিমধ্যে মর্টিমার ব্রেকফাস্ট টেবিলে এলেন এদিকে মিঃ ডিনমিড মিসেস ডিনমিড, খাবার টেবিলে এসে মর্টিমারকে সুপ্রভাত জানাল। মর্টিমারের মনে হলো মিসেস ডিনমিড যেন ভয় পেয়েছে তাঁকে দেখে। সবার শেষে মলিন এল, সে মর্টিমারকে অভিবাদন জানিয়ে জিজ্ঞাসা করল কাল আপনার ভালো ঘুম হয়েছে তো?
মর্টিমার বললেন, হ্যাঁ তার ভালোই ঘুম হয়েছে। মদলিনের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল মর্টিমারের উত্তরে। মর্টিমার এবার গৃহস্বামীকে জিজ্ঞাসা করলেন আপনার ছেলে রসায়ন বিদ্যায় আগ্রহী। হঠাৎ মিসেস ডিনমিড তার হাতের কাপটা মেঝেতে ফেলে দিলেন অর্থাৎ পড়ে গেল। তার স্বামী বলে উঠলেন কি হলো ম্যাগি? তার গলার স্বরে মনে হলো ধমক ও সাবধান করে দেওয়া। তারপর অতিথির দিকে তাকিয়ে অন্য কথা শুরু করলেন।
প্রাতঃরাশের পর মর্টিমার নিজেই বাগানে চলে গেলেন। তার যাবার সময় হয়ে এসেছে। কিন্তু তার যেতে ইচ্ছে করছে না মনের মধ্যে চিন্তা করতে করতে তিনি একটা রাস্তা ধরে বাড়িটার অন্য দিকে চলে এসেছেন। তার জুতোর তলা ক্রেপসোলের তাই মোটেই শব্দ হচ্ছিল না। তাই তিনি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মিঃ ডিনমিডের কথাগুলি শুনতে পেলেন, তিনি বলছিলেন প্রায় ষাট হাজার পাউণ্ডের মত উকিল বলছিল।
তাদের এই কথাবার্তা শুনে ব্যাপারটা রহস্যময় হয়ে উঠল। মদলিন বাড়ি থেকে বের হয়ে আসছিল কিন্তু তার বাবার ডাকে সে বাড়িতে ফিরে গেল।
মিঃ ডিনমিড খুশি মনে বললেন, আশা করি আপনার গাড়ির বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়নি। মর্টিমার উঁচু গলায় মিঃ ডিনমিডকে বিপদে আশ্রয় দেবার জন্য ধন্যবাদ জানালেন।
মলিন ও শার্লট বলল, না না, এটা আমাদের কর্তব্য তারপর তারা হাত ধরাধরি করে দুজনে দূরে একটা বেঞ্চে বসল।
মর্টিমার হঠাৎ বলে ফেললেন, আপনার মেয়ে দুজনকে দেখতে কিন্তু মোটেই একরকম নয় তাই না মিঃ ডিনমিড।
মিঃ ডিনমিড কথাটা শুনে একটু হতচকিত হয়ে গেল।
আপনার তাই মনে হচ্ছে না কি? হা ওরা দেখতে আলাদা।
মর্টিমার সহজ গলায় বলল, তবে ওরা দুজনেই নিশ্চয়ই আপনার মেয়ে নয়।
মিঃ ডিনমিড এবার সত্যি কথা বললেন, ঠিক ধরেছেন মশাই, ওরা দুজনই আমাদের মেয়ে নয়। একজনকে শিশু বয়স থেকে পালন করে আসছি। সে কিন্তু এসবের কিছু জানে না। তবে তাকে এবার সব জানাতে হবে।
মর্টিমার জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু সম্পত্তি ও পাচ্ছে বোধহয়?
মিঃ ডিনমিড ভাবলেন সব খুলে বলাই ভালো। আপনি কি করে ধরলেন মশাই।
এটা আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের পারদর্শিতা।
হ্যাঁ, আপনার কথাই ঠিক। আমরা তাকে পালিতা কন্যা হিসাবে গ্রহণ করি। মদলিনের সম্বন্ধে খবরে কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম। তার বাবা খুব ধনী ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর আগে তিনি তার সন্তানের অস্তিত্ব সম্বন্ধে জানতে পেরেছিলেন। তিনি লোকও লাগিয়ে ছিলেন এবং উইল করে গিয়েছেন যে মেয়েকে খুঁজে পাওয়া গেলে তার সব সম্পত্তি মেয়ে পাবে।
মিঃ মর্টিমার মন দিয়ে সৰু শুনলেন এইজন্যই মদলিন অন্যরকম দেখতে, চুলগুলো কালো কেমন যেন নিস্পৃহ ভাব। মিঃ ডিনমিডের কাহিনী সত্য হলেও কিছু তথ্য গোপন আছে।
তবু মর্টিমার মিঃ ডিনমিডকে বুঝতে দিলেন না।
তিনি বললেন, বাঃ মদলিন সুন্দরী এবং প্রচুর অর্থের মালিক তার ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল।
এবার এখন আমার যাবার সময় হয়েছে আপনাদের আতিথেয়তার জন্য আর একবার ধন্যবাদ। মিসেস ডিনমিডের দুচোখে ভয়ের ছায়া দেখতে পেলেন।
মেয়ে দুটোকে মর্টিমার দেখতে পেলেন না কিন্তু আগের রাতে গাড়িটাকে যেখানে ফেলে এসেছিলেন সেই রাস্তায় ধারের ঝোপে মদলিন দাঁড়িয়েছিল।
আপনার সাথে আমার দেখা করার দরকার ছিল। মদলিন বলল, দেখুন, আমি বিচার বুদ্ধি দিয়ে চলি কুসংস্কারে বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমাদের বাড়িতে কিছু রহস্যজনক ঘটনা ঘটেছে তা ধরা ছোঁওয়ার মধ্যে, এটা ভূত প্রেতের সৃষ্টি নয়। প্রতিদিনই রহস্যটা ঘনীভূত হচ্ছে। বাবা, মা, শার্লট সব বদলে যাচ্ছে, একমাত্র জনি পাল্টায়নি।
মদলিন বলল, আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম কাল রাতে। কিন্তু আপনি আসায় সেটা থেমে গেছে। আমি বিপদের আশঙ্কায় এস. ও. এস হঠাৎ লিখে ফেলেছি।
মর্টিমার মদলিনকে ভরসা দিয়ে বললেন, ভয়ের কিছু নেই। যা করার আমি করব। শুধু আপনি চিন্তা করে বলুন কাল রাতে এমন কোনো কথা আপনার মনে দাগ কেটেছিল কিনা?
মদলিন বলল সে রকম কিছু মনে পড়ছে না। শুধু শার্লটকে দেখতে হুবহু মার মত হয়েছে এই কথা বাবা বলেছিলেন মাকে।
ঠিক আছে আপনি চিন্তা করবেন না আপনি এখন বাড়ি যান। আমার হাতে সব কিছু ছেড়ে দিন।
এবারে মর্টিমার চোখ বন্ধ করলেন। তাঁর মনে বার বার জনির মুখটা ফিরে আসতে লাগল। জনি নিরীহ তবু তাকে কেন্দ্র করেই সব ঘটনা ঘটেছে। আজ সকালে প্রাতঃরাশের সময় মিসেস ডিনমিডের হাত থেকে কাপটা পড়ে গেল কেন? উত্তেজনার কারণটা কি? তিনি বলেছিলেন জনি রসায়ন ভালোবাসে সেই জন্য কি? তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন মিঃ ডিনমিডের চায়ের কাপটা ঠোঁটের কাছে ধরা।
এই সব ভাবতে ভাবতে শার্লটের কথা মনে পড়ে গেল। কাল রাতে সে কেমন অদ্ভুত ভাবে মিঃ মর্টিমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আরও একটা ব্যাপার মিঃ ডিনমিড একটার পর একটা চায়ের কাপ খালি করে বললেন, চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে কিন্তু তখনও চা দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
মাসখানেক আগে একটা ঘটনা তিনি পড়েছিলেন একটা ছেলের অমনোযোগিতার জন্য পুরো একটা পরিবার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
আধঘণ্টা পরে মর্টিমার তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন এবং তিনি মিঃ ডিনমিডের বাড়িতে আবার ছুতো করে গেলেন। মর্টিমার বললেন, আমি দুঃখিত একটা জিনিষের জন্য আমাকে আবার আসতে হল।
মিঃ ডিনমিড চেঁচিয়ে উঠলেন, তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে, শিরাগুলো ফুলে উঠেছে, আপনি কিসের জন্য ফিরে এলেন আমি তা জানতে চাই।
একটু চায়ের জন্য তড়িৎগতিতে তিনি পকেট থেকে কি একটা বার করে টেবিলে থেকে একটা চায়ের কাপ তুলে বাঁ হাতে ধরা একটা টেস্টটিউবে খানিকটা চা ঢাললেন।
মিঃ ডিনমিড জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি করছেন? তিনি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ভয়ে কেঁদে উঠলেন। আমি নিশ্চিত মিঃ ডিনমিড যে, আপনি খবরের কাগজ পড়েন। কিছুদিন আগে একটা খবর বের হয়েছিল যে, একটা পুরো পরিবার বিষক্রিয়ার অসুস্থ হয়ে পড়েছিল কিন্তু আজকে ঘটনায় মাত্র একজন মারা যেত।
প্রথম প্রশ্ন হলো টিনের যে হ্যাম খেয়েছিলেন তাতে কিছু ছিল। আপনার ভাড়ার ঘরে এক প্যাকেট আর্সেনিক আছে। তার নীচের শেলফে এক প্যাকেট চা আছে। উপরের শেলফে একটা ফুটো আছে। ঐ আর্সেনিক ফুটো দিয়ে চায়ের প্যাকেটে পড়েছে এটা সবাই স্বাভাবিক ভাববে।
মর্টিমার আরও বললেন, আপনি নিজের মেয়ে শার্লটের চায়ের কাপে কিছু মেশাননি কিন্তু মদলিনের চায়ের কাপে চার পাঁচগুণ বেশি আর্সেনিক আছে। এটা ঠিক নয় আসল যেটায় লাল লেবেল লাগানো হলো সেটায় আপনার মেয়ে শার্লটের কাপের চা আর দ্বিতীয়টায় মদলিনের কাপের চা। আমি শপথ করে বলতে পারি প্রথম টেস্টটিউবে দ্বিতীয় টেস্টটিউবের চেয়ে চার পাঁচগুণ বেশী আর্সেনিক রয়েছে।
ডিনমিড বললেন, আপনি পাগল হয়ে গেছেন।
না, আমি পাগল হইনি। আপনি মিথ্যে কথা আমাকে বলেছিলেন আসলে শার্লট আপনার মেয়ে নয়। মদলিনই আপনার নিজের মেয়ে। আপনি চেয়েছিলেন শার্লটকে লুকিয়ে, আপনার মেয়ে মদলিনই সম্পত্তিটা পাক। তাই আপনি শার্লটকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেন কিন্তু সম্ভব হয়ে উঠল না কারণ তার মায়ের সাথে খুবই মিল তার। যারা তার মাকে চেনে শার্টকে দেখলেই তারা চিনতে পারবে, তাই আপনি শার্লটের চায়ের কাপে সাদা আর্সেনিক মিশিয়ে দিয়েছিলেন। মিসেস ডিনমিড হঠাৎ হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মত করতে লাগলেন। মিঃ ডিনমিড স্ত্রীকে ধমক দিলেন।
মর্টিমার দেখলেন শার্লট চোখ বিস্ফারিত করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মলিন বলল, চল আমরা একটু দূরে গিয়ে বসি।
মর্টিমার বললেন, তিনি যদি এই বিশেষ বাড়িটায় না আসতেন তাহলে হয়ত তিনি ঐ রকম পরিকল্পনা করতেন না। আমি এই টেস্টটিউব দুটো শার্লটের নিরাপত্তার জন্য আমার কাছে রেখে দেব। আচ্ছা, বিদায়।
.
০৪.
মিসেস হার্টার একজন হার্ট পেশেন্ট। তাকে ডাক্তার দেখতে এসেছেন। ডাক্তার তাকে বললেন আপনি একদম দুশ্চিন্তা করবেন না, উত্তেজিত হবেন না, আপনার হার্ট একটু দুর্বল ঠিকই তবে ভয় পাবার কিছু নেই। সবচেয়ে ভালো হয় আপনি যদি একটা পেসমেকার বসিয়ে নেন তাহলে কোনো চিন্তা থাকবে না।
রোজ সকালে একটু ব্যায়াম করবেন, পাহাড়ে উঠবেন না, মনকে সর্বদা প্রফুল্ল রাখবেন তাহলেই হবে। মিসেস হার্টারের ভাইপো চার্লস রিডাওয়ের কাছে ডাক্তার আরও কিছুটা বিশদ করে বললেন। তিনি বললেন, আপনার পিসীর বহু বছর বাঁচার সম্ভাবনা আছে তবে তাকে যেগুলি বললাম সেগুলি পালন করতে অবশ্যই হবে।
চার্লস একজন বিবেচক যুবক, সে নিজের বিবেচনা প্রয়োগ করে ঐদিন সন্ধ্যায় একটা রেডিও সেট আনবার প্রস্তাব করল।
কিন্তু মিসেস হার্টার আপত্তি করলেন। তিনি বললেন, ঐসব বৈদ্যুতিক তরঙ্গ আমার স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। চার্লস তার যুক্তি দিয়ে পিসীর অযৌক্তিকতা প্রমাণ করল। মিসেস হার্টার শেষ পর্যন্ত চার্লসের ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করলেন।
ডঃ মেনেলের ব্যবস্থামত পেসমেকার বসানো হল। পেসমেকারের পর রেডিও এসে হাজির হল। চার্লস এসে তাকে সব বোঝাল।
মিসেস হার্টার একটা হাইব্যাক চেয়ারে শান্ত, সংযত ভাবে বসে রেডিও শুনতে লাগলেন; তবু তাঁর মনে হতে লাগল যে এসব জিনিষ কোনো কাজের নয়।
রেডিওতে নানা সেন্টার ঘুরিয়ে চার্লস পিসীর সাথে ঠাট্টা করতে লাগলেন। পিসীও তাতে যোগ দিলেন। মিসেস হার্টার চার্লসকে খুব ভালোবাসেন। কয়েক বছর আগে ভাগ্নী মিরিয়াম হার্টার তার সঙ্গে এই বাড়িতে থাকত কিন্তু সে বেশীদিন থাকতে পারেনি তার মামীর সঙ্গে থাকতে ভালো লাগত না। সে অবশেষে একটা ছোকরার প্রেমে পড়ে। বিয়ে হয়ে যায় তার।
চার্লস কিন্তু পিসীর প্রতি সদয়। সে কখনও পিসীর সান্নিধ্যে বিরক্ত বা একঘেয়ে বোধ করেনি। দিনের মধ্যে অনেকবারই সে পিসীকে বলে আন্টি তুমি একটি দারুণ মহিলা।
ভাইপোর উপর সন্তুষ্ট হয়ে মিসেস হার্টার তার উকিলকে নির্দেশ দিলেন একটা নতুন উইল তৈরী করতে। তিনি উইলটা পড়ে সন্তুষ্ট হয়ে সই করে দিলেন।
এবার রেডিও সম্বন্ধে ও নতুন করে পিসীর প্রশংসা পেল। প্রথম প্রথম মিসেস হার্টার রেডিওটাকে পছন্দ করতেন না। কিন্তু এখন সে ভালো ভাবে উপভোগ করছে রেডিও নিয়ে। তিনি দুটো সুইচ ঘুরিয়ে দিয়ে হাইব্যাক চেয়ারে বসে মনের সুখে সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠান শোনেন।
রেডিওটা কেনার তিন মাস পরে এই প্রথম একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটল। চার্লস ঐ সময় ব্রীজ খেলতে বাইরে গেছে।
সেদিন সন্ধ্যার অনুষ্ঠান ছিল ব্যালাড কনসার্ট। একজন বিখ্যাত গায়িকা গাইছিলেন। গানের মাঝে অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। গানটা হঠাৎ থেমে গেল তারপর একজন লোকের পরিষ্কার গলার আওয়াজ শোনা গেল। কে যেন তাকে উদ্দেশ্য করে বলছে মেরি, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? আমি প্যাট্রিক কথা বলছি। আমি শীঘ্রই তোমার কাছে আসব তুমি নিশ্চয়ই প্রস্তুত থাকবে, একটু পরেই আবার অ্যানি লবির সুরে ঘর ভর্তি হয়ে গেল।
মিসেস হার্টার নিথর হয়ে চেয়ারে বসে রইলেন তিনি কি স্বপ্ন দেখছিলেন?
না-কি তার দুর্বল মনের প্রতিক্রিয়া যাই হোক তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা কাউকে বললেন না, তবে তিনি দু-দিন ধরে কিছুটা চিন্তিত ও মনমরা হয়ে রইলেন।
তারপর ঘটনাটা আবার ঘটল ঐদিনও তিনি ঘরে একা ছিলেন রেডিওতে অর্কেস্ট্রা বাজছিল সেটা হঠাৎ থেমে প্যাট্রিকের গলা শোনা গেল।
মিসেস হার্টার ঘড়ির দিকে তাকালেন না, আজ তিনি মোটেই ঘুমিয়ে পড়েননি। পুরোপুরি সজাগ থেকে প্যাট্রিকের গলা শুনেছেন। তিনি মনে করলেন চার্লস বলছিল, তরঙ্গের মাপদণ্ডে অনেক ফাঁক থাকে খুব সম্ভব এসব হারিয়ে যাওয়া তরঙ্গই মনোবৈজ্ঞানিক ঘটনার ব্যাখ্যা করে। না এই রকম ধারণা অসম্ভব নাও হতে পারে।
মিসেস হার্টার ঘন্টা বাজিয়ে তার মেড এলিজাবেথকে ডাকলেন। সে মিসেস হার্টারকে খুব যত্ন করে তার প্রতি দরদ আছে।
এলিজাবেথ ঘরে ঢুকতে মিসেস হাটার তাকে তার কবরের জিনিষপত্র ঠিক আছে কিনা ইত্যাদি অসংলগ্ন কথা বলতে লাগলেন। এলিজাবেথ বলে উঠল, ম্যাডাম আপনি এসব চিন্তা করবেন না। আমার তো মনে হয়েছিল আপনি এখন একটু ভালো আছেন?
মিসেস হার্টার বললেন, আমার এখন সত্তর পার হয়ে গেছে। একদিন না একদিন আমাদের সবাইকে তো ওপারে যেতে হবে।
এলিজাবেথ তার কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে বাইরে চলে গেল।
মিসেস হার্টার স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। খুব বিশ্বাসী ওকে আমি উইলের কত দিয়েছি। ওকে একশ পাউণ্ড দেওয়া উচিত।
পরের দিন তিনি উকিলকে চিঠি লিখে অনুরোধ করলেন উইলটা দেখানোর জন্য। একদিন চার্লস তার পিসীকে বলল, গেস্টরুমে ঐ গোবদা মুখো ফটোটা কার? গালে দাড়ি লম্বা জুলফি মাথায় টুপি উনি কে?
মিসেস হার্টার চার্লসের কথায় খুব রেগে গেলেন। এবং বললেন, ওটা তোমার পিসেমশাইয়ের ফটো।
চার্লস ক্ষমা চেয়ে বলল, সরি আমি তোমাকে দুঃখ দিতে চাইনি। তবে একটা কথা আমি পিসেমশাইকে মানে ফটোর ঐ ব্যক্তিকে যেন দেখেছি। আমাদের বাড়িতে তিনি যেন শেষের জানালার ধারে বসে আছেন।
শেষের জানালায়? মিসেস হার্টার চঞ্চল হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
চার্লস বলল, হ্যাঁ কেন?
মিসেস হার্টার ভাবলেন তিনি আজ নিয়ে মোট তিনদিন সেই রহস্যময় গলা শুনতে পেয়েছেন। তাহলে আর কোন সন্দেহ নেই তার সঙ্গে অন্য এক জগতের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। তিনি রেডিওতে তার স্বামীর গলায় শুনতে পেয়েছেন। তিনি বলছেন, মেরি তুমি নিশ্চয়ই এখন প্রস্তুত শুক্রবার আমি তোমার জন্য আসব…সাড়ে নটার সময়…ভয় পেও না, কোনো যন্ত্রণা অনুভব করবে না…প্রস্তুত থেকো।
মিসেস হার্টারের মুখটা সাদা হয়ে গেছে, ঠোঁট দুটো নীল শুকনো দেখাচ্ছে।
তিনি কাঁপা হাতে নীচের লাইন কটা লিখলেন,
আজ রাতে সওয়া নটায় আমি আমার মৃত স্বামীর গলার স্বর পরিষ্কার শুনতে পেয়েছি। সে রাত সাড়ে নটায় শুক্রবার আমার কাছে আসবে।
আমি যদি ঐদিন মারা যাই তাহলে এটাই প্রমাণিত হবে
বিদেহী জগৎ আছে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব। মেরি হার্টার।
মিসেস হাটার চিঠিটা লিখে এলিজাবেথকে দিয়ে চিঠিটা পোষ্ট করালেন ডাঃ মেনেলের কাছে। এলিজাবেথকে কোনো কথা বলতে দিলেন না। তিনি বললেন, আমি অপার্থিব ব্যাপার অনুভব করছি।
আমি তোমাকে একশ পাউণ্ড দিতে চাই তবে মৃত্যুর আগে ব্যাঙ্কে যেতে যদি না পারি চার্লস তার ব্যবস্থা করবে।
এলিজাবেথ কোনো কথায় কান করলেন না।
মিসেস হার্টার বললেন, মনে রেখো চার্লস যদি আমার কিছু হয় তবে এলিকে অতিরিক্ত পঞ্চাশ পাউণ্ড দেবার ব্যবস্থা করবে।
চার্লস গলায় খুশির স্বর আনার চেষ্টা করল, তোমার কি হতে যাচ্ছে। ডাঃ মেনেল বলেছেন, তুমি আরও কুড়ি বছর বাঁচবে। তখন শততম জন্মদিন পালন করব।
মিসেস হার্টার স্নেহমাখা হাসি হেসে বললেন শুক্রবার তুমি কি করছ?
চার্লস অবাক হয়ে বলল, সন্ধ্যাবেলা ইউইং আমাকে তাস খেলতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তবে তুমি যদি চাও তাহলে আমি থাকতে পারি।
মিসেস হার্টার দৃঢ়ভাবে বললেন, না। আমি ঐ রাতে একদম একা থাকতে চাই। তার ইচ্ছা তিনি একাই কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হবেন।
শুক্রবার সন্ধ্যায় বাড়িটা খুবই নিস্তব্ধ মনে হল। মিসেস হার্টার চেয়ারে বসে আছেন তাঁর সব প্রস্তুতি শেষ।
তিনি চার্লসের জন্য একটা নির্দেশের তালিকা করলেন। তাঁর সব আত্মীয়দেরও কিছু কিছু জিনিস দেয়ার কথা লিখলেন। উইলের বক্তব্য খুব একটা দীর্ঘ নয়। মিসেস হার্টার ঘড়ির দিকে তাকালেন সাড়ে নটা বাজতে তিনি মিনিট বাকি। তিনি প্রস্তুত হয়ে আছেন শান্ত, সংযত। শেষ কথা কটি নিজের মনে বার বার বলার সময় তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল, কি যেন এখনি ঘটবে।
সাড়ে নটা, রেডিওটা তিনি চালিয়ে দিলেন। তিনি এবার কি শুনবেন?
কেউ কি আবহাওয়ার খবর বলতে নাকি পঁচিশ বছর আগে মারা গেছে এমন একজনের গলা শুনবে।
তিনি কিছুই শুনতে পেলেন না। তার বদলে সামনের দরজায় একটা যেন হাতড়ানো শব্দ। তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। দরজার বাইরে যেন মৃদু পায়ের শব্দ, দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল। মিসেস হার্টার টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালেন, তার দুচোখ ভোলা, দরজার দিকে নিবদ্ধ। তিনি চাপা আর্তনাদ করে উঠলেন।
আলোয় দেখলেন পুরোনো আমলের কোট গায়ে বাদামী রঙের দাড়ি ও লম্বা জুলফি সমৃদ্ধ পরিচিত মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।
প্যাট্রিক তাকে নিতে এসেছে। তার হৃদযন্ত্র শেষবারের মতো লাফিয়ে উঠে চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেল। তিনি মেঝেতে পড়ে গেলেন।
প্রায় একঘন্টা পরে কত্রীকে ঐ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখল এলিজাবেথ। সঙ্গে সঙ্গে ডাঃ মেনেলকে খবর পাঠিয়ে আনা হল। আর কিছু করার নেই। মিসেস হার্টার চিকিৎসার বাইরে চলে গেছেন।
এলিজাবেথের মিসেস হার্টারের ডাক্তারকে লেখা সেই চিঠিটার কথা মনে পড়ল। সে ডাঃ মেনেলেকে চিঠিটা পড়তে দিলো। ডাঃ মেনেলে চিঠিটা আগ্রহ সহকারে পড়ে চার্লসকে দেখালেন।
তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন, আপনার পিসী তার স্বামীর গলা শুনেছিলেন ভেবে নিয়ে ঐ বিশেষ সময়টিতে উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং তার হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যায়।
চার্লস বলল, অবচেতন মনের প্রতিক্রিয়া?
কিছুটা ঐরকম যতশীঘ্র পারি ময়না তদন্তের ফল আপনাকে জানাব।
চার্লস মাথা নাড়ল।
আগের দিন রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন সে রেডিওর ক্যাবিনেটের তার সরিয়ে নিল। ঐ তারটা চার্লসের শোবার ঘর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পিসেমশাইয়ের কিছু পোক কর্পূরের গন্ধ ভরা আলমারিতে রেখে দিল। এলিজাবেথকে ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালাতে বলেছিল। ঐ আগুনে বাদামী রঙের দাড়ি ও জুলফি পুড়িয়ে দিল।
চার্লস ভাবল এবার সে সম্পূর্ণ নিরাপদ। যখন ডাঃ মেনেলে তার পিসীকে সাবধানে থাকতে এবং আরও কুড়ি বছর বাঁচবে বলেছিলেন তখনই সে পরিকল্পনাটা এঁটে ফেলেছিল। এখন সে এই কাজে কৃতকার্য। চার্লস এবার যা যা করণীয় সব যন্ত্রচালিতের মত করে চলল। কবর দেবার ব্যবস্থা, আত্মীয়স্বজন যাবে তার ব্যবস্থা, কয়েক জন রাতে থাকবে তার ব্যবস্থা ইত্যাদি। সে যে কি সাংঘাতিক অবস্থার মধ্যে আছে তা মৃত আন্টি এবং অন্য কেউ-ই জানে না। তার কাজকর্ম সবই গোপন আছে। এখন আর সে ভয় নেই। চার্লস নিজের মনে হাসল। সে যা করেছে এতে অপরাধের কিছু নেই। শুধু পিসীর সাথে পিসেমশায়ের গলা নকল করে একটু ঠাট্টা করেছে। ব্যস এতেই সব সমাধান হয়ে গেল। এখন সে একজন ধনী ব্যক্তি।
এইসব চিন্তা করতে করতে এলিজাবেথ জানিয়ে গেল হপকিনস এসেছেন তার সঙ্গে দেখা করতে।
হপকিনস গত পঁচিশ বছর ধরে মিসেস হার্টারের উকিল। সে ঠিক সময়ে এসেছে।
চার্লস গম্ভীর মুখে লাইব্রেরী রুমে ঢুকল এবং মিঃ হপকিনসকে চেয়ারে বসার আমন্ত্রণ জানালেন।
আমি আপনার লেখা চিঠি ঠিক বুঝতে পারিনি মিঃ রিডাওয়ে। আপনার ধারণা হয়ত ভুল কারণ মিসেস হার্টারের উইলটা আমার হেপাজতে নেই। আমার কাছে ছিল কিন্তু তিনি মারা যাবার আগে গত মঙ্গলবার উইলটি চেয়ে পাঠান।
চার্লস অবাক হয়ে গেল তার শরীর কেমন হতে লাগল তার মনে হচ্ছে কোথাও গণ্ডগোল আছে।
সে তার আন্টির কাগজপত্রের মধ্যে উইলটা খুঁজতে লাগল কিন্তু কোথাও পেলো না।
মিঃ হপকিনসের ইচ্ছানুসারে এলিজাবেথকে ডাকা হলো। সে বলল, মৃত্যুর দিন সকাল পৰ্য্যন্ত তার কত্রীর হাতে উইলটা ছিল।
কিন্তু ম্যাডাম মারা যাবার পরদিন শুধু নীল খামটা টেবিলের উপর পড়েছিল।
দুজনই এলিজাবেথের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
এলিজাবেথ অনুমতি নিয়ে ঘরের দিকে চলে গেল।
মিঃ হপকিনস চার্লসকে প্রশ্ন করলেন, আপনার সাথে পিসীর কোনো মনোমালিন্য হয়নি তো?
চার্লস জোর গলায় বলে উঠল, আমাদের দুজনের সম্পর্ক মধুর ছিল।
চার্লসের এই সব কথা ভাবতে ভাবতে মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। সে জিজ্ঞাসা করল, যদি উইলটা আর কখনও না পাওয়া যায় তাহলে কি হবে?
মিসেস হার্টারের আগের উইলটা রয়েছে। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে করা ঐ উইল অনুযায়ী তার ভাগ্নী মিরিয়াম সব পাবে।
মিরিয়াম সব পাবে?
হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল,
ডাঃ মেনেলে মিঃ রিডাওয়ে বললেন এইমাত্র শব ব্যবচ্ছেদ শেষ হল। তাঁর হৃদযন্ত্র ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার জন্যই মৃত্যু হয়েছে। তিনি দুমাসের বেশী আর বাঁচতেন না।
চার্লস কিন্তু ইতিমধ্যে রিসিভারটা দুম করে নামিয়ে রেখেছে।
সে বুঝতে পারল তার সঙ্গে কেউ যেন চালাকি করছে। তার সামনে আর কোন আশা নেই। জেল ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
.
০৫.
সে বুঝতে পারল অলক্ষ্যে কেউ যেন তাকে দেখে হাসছে।
অ্যালিকসের স্বামী হেঁটে চলল গ্রামের দিকে যতক্ষণ না স্বামী দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল ততক্ষণ সে কাঠের গেট ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
অ্যালিকস মার্টিন সুন্দরী নয়, চেহারাটা নজর ধরাও নয় তবে একটা চটক আছে। ওর বাদামী চুল ওর গর্বের বিষয়। তার কথা বলার ধরনটিও বেশ মধুর। পোশাক পরিচ্ছেদে বেশ ছিমছাম, যে পোশাকটি পরলে তাকে মানায় সেই পোশাকটিই সে পরে।
আঠারো বছর বয়সে লেখাপড়া শেষ করে তাকে চাকরিতে ঢুকতে হয়েছে।
অ্যালিকস নামী ইস্কুলের গ্র্যাজুয়েট। তার রুগ্ন মাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাকে শর্টহ্যাণ্ড টাইপিস্টের চাকরি করতে হয়েছে।
এই পনেরো বছরের মধ্যে বিয়ে না হলেও প্রেম হয়েছে। প্রেমিক তার সহকর্মী কেরানী ডিক উইনডিফোর্ড। কিন্তু তারা কেউ পরস্পরের কাছে প্রেম নিবেদন করেনি। তবু অ্যালিকস ভাবত তারা দুজনে স্বামী স্ত্রী হবে।
এদিকে হঠাৎ অ্যালিকসসের কপাল খুলে গেল। তার দূর সম্পর্কের এক কাজিন মারা গেছে। সে তার সঞ্চিত বেশ কয়েক হাজার পাউণ্ড উইল করে গেছে তাকে।
অ্যালিকস ভাবল এবার তা হলে সে মিসেস অ্যালিকস উইনফোর্ড হবে। এই সুসংবাদে ডিকের কিছুই হলো না উল্টে সে অ্যালিকসকে এড়িয়ে চলে।
কিন্তু এর কারণ কি? ধনী পত্নীর স্বামী হতে তার পৌরুষে বাঁধছে? এইসব ভেবে ডিক নিজেও কষ্ট পাচ্ছে। অ্যালিকস তাকে ভালোবাসে সে শুধু অপেক্ষা করছে ডিকের হয়তো ভুল ভাঙবে।
এমন সময় সব উল্টে গেল, অ্যালিকসসের এক বান্ধবীর বাড়িতে ডোরাল্ড মারটিনের দেখা হল। সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রণয় সৃষ্টি হল। সে প্রেম নদীতে ঝাঁপ দিল। সে ডিককে ভুলে গেল।
কয়েকদিন পরে ডিককে সে সব বলল এবং শীঘ্র তারা বিয়ে করবে একথাও বলল।
ডিক বলল, লোকটি তোমার অপরিচিত। তুমি ওর বিষয়ে কিছু জান না। মাত্র কদিনের পরিচয়ে তুমি জেনে গেলে।
অ্যালিকস এবার রেগে গিয়ে বলল, আমি জানতাম না যে কোনো পুরুষ এগারো বছরেও জানতে পারে না ভালোবাসা কি?
অ্যালিকস-এর কথা শুনে ডিক অনেক অনুনয় করল, তবু অ্যালিকস শুনল না। তখন সে ভয় দেখাল শান্ত শিষ্ট এই মানুষটার মধ্যে এত আগুন লুকিয়েছিল।
ডিক বলে ডোরাল্ডকে সে খুন করবে? অবশ্য সে যা বলছে রাগের মাথায় বলছে।
আজ সকালে স্বামীকে বিদায় দেবার পর ডিকের শাসানি তার মনে পড়ে গেল। বিয়ের পর অ্যালিকস তিনবার একই স্বপ্ন দেখেছে। ডিক তার স্বামীকে খুন করছে। ডোরাল্ড মরে পড়ে আছে, আর ডিক তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
সে স্বামীর মৃত্যুতে যেন খুশী। কি বাজে স্বপ্ন ডিকের কি কোনো অলৌকিক শক্তি আছে? নাকি সে অ্যালিকসকে সতর্ক করে দিচ্ছে।
এই সব কথা অ্যালিকস ভেবেই যাচ্ছে এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। সে টেলিফোন তুলে জিজ্ঞাসা করল, কে কথা বলছ? আমি ডিক, আমি এখন ছুটিতে আছি। তোমাদের গ্রামের সরাইখানাটা বেশ, এখানে মাছ ধরতে এসেছি, আমি যদি তোমার ওখানে যাই তাহলে আপত্তি আছে?
না, কড়া সুরে অ্যালিকস বলল, আসবে না তুমি।
ডিক থতমত খেয়ে বলল, আমাকে মাপ কর, আমি তোমাকে বিরক্ত করব না।
অ্যালিকস ভাবল এতটা রূঢ় না হওয়াই উচিত ছিল, সে স্বর কোমল করে বলল, আরে না, আজকে আমাদের বাড়িতে অন্য লোকের আসবার কথা আছে তুমি না হয় কাল রাত্রে ডিনারে এসো।
ডিকস বলল, সরি কাল আমি থাকব না, গুডবাই অ্যালিকস, বেস্ট অফ লাক টু ইউ মাই ডিয়ার। অ্যালিকস কোনো উত্তর না দিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখল। মনে মনে বলল, ভাগ্যিস ডিনারের নেমন্তন্ন নেয়নি। অ্যালিকস উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ভাবল, যাই একটু বাগান ঘেরা কটেজে ঘুরে আসি। কটেজটি ভারি সুন্দর ফুলে ফুলে ভরা হট ওয়াটার, ইলিকট্রিক টেলিফোন, মর্ডান রাথরুম চওড়া বারান্দা সব আছে।
কটেজটি অ্যালিকস ও ডোরাল্ড দুজনে মিলে কিনে নিয়েছে। কটেজটি সুন্দর তবে ভারী নির্জন। এতদুরে কাজের লোক পাওয়া যায় না।
বাগানটা পরিচর্যা করার জন্য একজন মালী রাখা হয়েছে, তার নাম জর্জ।
বৃদ্ধ জর্জ সপ্তাহে দুদিন আসে সোমবার ও শুক্রবার। কিন্তু জর্জ আজকে বুধবার এসেছে। কেন?
জর্জকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল, শুক্রবার তাদের বাড়িতে উৎসব তাই, তাছাড়া আপনি নাকি কাল লণ্ডন যাচ্ছেন? মিঃ মার্টিন বললেন।
অ্যালিকস অবাক হয়ে বলল, না, আমরা তো লণ্ডন যাচ্ছি না, তুমি হয়ত ভুল শুনেছ তাছাড়া আমার লণ্ডন ভালো লাগে না। জর্জ তাড়াতাড়ি উত্তর দিল আমারও লণ্ডন একদম ভালো লাগে না। সেখানে বড়বেশী মোটরকার।
এই বাড়ির আগের মালিক দুহাজার পাউণ্ড দিয়ে এই কটেজ বিক্রী করে চলে গেছে লণ্ডনে। কিন্তু আমরা তা তিন হাজার পাউণ্ডে কিনেছি।
না, আপনি তাহলে জানেন না আমি যতদূর জানি এই কজেট মিঃ মাটিন দু হাজার পাউণ্ডে কিনেছেন। মালীর সঙ্গে কি তর্ক করবে? সে ভাবল ডোরাল্ড কি তাকে মিথ্যা কথা বলেছে? ফুল তুলতে তুলতে সে সব ভুলে যেতে চেষ্টা করল।
অ্যালিকস হঠাৎ একটা সবুজ মত কি দেখতে পেল আরে এটা তো ডোরান্ডের পকেট ডায়েরি। অ্যালিস্ ডায়েরিটা পড়ে দেখল তাতে লেখা ১৫ মে তারিখে সেন্ট পিটার্স চার্চে বেলা ১-৩০ টায় অ্যালিকসের সাথে তার বিয়ে হল।
তারপর লেখা ১৮ জুন সে তো আজকে রাত্রি নটা, তারপর আর কিছু লেখা নেই। সে আরও দেখল ব্যবসা সংক্রান্ত অনেক নোট বা ঠিকানা ফোন নম্বর ইত্যাদি কিন্তু কোনো মিস বা মিসেসের নাম নেই।
যাই হোক অ্যালিকস আজকে ডিকের ফোনের কথা গোপন রাখল।
লাঞ্চের সময় ডোরান্ডকে বাড়ি ফিরতে দেকে অ্যালিকস কিচেনে ঢুকে নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
সন্ধ্যায় ডিনারের পর জানালা খুলে দিয়ে ওরা দুজনে লিভিং রুমে বসল। সাদা ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে।
অ্যালিকস বলল, আজ রাত্রি নটায় কি করবে গো? ডায়েরীতে লেখা
ও ডায়েরীটা বুঝি তুমি কুড়িয়ে পেয়েছ?
হ্যাঁ, তার সঙ্গে তোমার অনেক সিক্রেট জেনে ফেলেছি।
আমার কিছুই গোপন নেই। আর নটার সময় ডার্করুমে কাজ করব। তুমি আমাকে হেল্প করবে। ডোরাল্ডের ফটো তোলার শখ আছে। ছবি তোলার পর নেগেটিভ ডেভেলপ করা। এনলার্জ করা সব ডোরান্ড নিজে করে। সে সব কাজ ঘড়ি ধরে করে।
অ্যালিকস কিছু না ভেবে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল, ডোরাল্ড আমি তোমার বিষয় কিছুই জানি না কেন?
ডোরাল্ড চমকে উঠল, সে কি আমি তো সব বলেছি। নর্দাম্বারল্যাণ্ডে ছেলেবেলা, তারপর সাউথ আফ্রিকা সেখান থেকে কানাডা সেখানেই সাফল্য লাভ করেছি।
অ্যালিকস এবার ঠাট্টা করে বলল, এতদিন বিয়ে না করে প্রেম নিশ্চয়ই করেছ।
ডোরাল্ড গম্ভীর হয়ে বলল, একজনকেই আমার ভালো লেগেছিল কিন্তু তার সঙ্গে প্রেমের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
ডোরাল্ড জিজ্ঞাসা করল, আজ রাত্রেই তোমার এসব বাজে কথা মনে হলো কেন? কে জানে? আমার মনে হচ্ছে সবাই যেন আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
সবাই বলতে? এই যে বড় জর্জ বলল, কাল নাকি আমরা লণ্ডন যাচ্ছি। তারপর কটেজটা নাকি দু-হাজার পাউণ্ডে কেনা হয়েছে?
ডোরাল্ড ভীষণ রেগে গেল। চিৎকার করে বলল, লোকটা আস্ত বোকা আমি জানি লণ্ডন ওর কাছে খারাপ শহর, তাই চটাবার জন্য ওকে বলেছিলুম। আর এমসকে যখন টাকা দিচ্ছিলাম তখন ও হাজির ছিল। মিঃ এমসকে এক হাজার পাউণ্ড ক্রস চেকে দিয়েছি সেটা ও জানে না। আমাদের ব্যাপারে ও নাক গলায় কেন?
যাকগে বুড়ো হয়েছে তো! যেতে দাও। নটা বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি আমি কিন্তু ডার্করুমে যাচ্ছি না।
আমিও যাব না। ডোরাল্ড বলল।
মেয়েরা কত কি ভাবে? তারপর স্বামীর সাথে শোবার পর সব মেঘ সরে গেল।
পরদিন সকালটা বেশ ভালো রোদে ঝলমল দিন। বাগানে সব গাছে ফুল ফুটেছে। সারাদিন কাজ করল। কিন্তু সন্ধ্যা হতেই ঘাড়ে আবার ভূত চাপল ডিকের সেই কথা খালি মনে পড়ল। তার স্বামীকে সন্দেহ হলো আবার অজানা নারীর প্রতি হিংসা ও ঘৃণা জন্মাল। সে ভাবল পুরুষদের সে হাড়ে হাড়ে চেনে। জর্জের কথা শুনে সে সেদিন অত রেগে গেল কেন? তারপর একদিন কিছু কেনাকাটার জন্য গ্রামে যাবার দরকার কিন্তু ডোরাল্ড অ্যালিকসকে না যেতে দিয়ে সে নিজে গেল। সে ভাবতে বসল ডোরাল্ডের এত জেদ কেন? তাহলে তার স্বামী কি তাকে সন্দেহ করছে ডিককে নিয়ে? অ্যালিকসের মাথার ভেতর যেন একটা পোকা ঢুকেছে কিছুতেই তাকে তাড়ানো যাচ্ছে না। এইসব ভাবতে ভাবতে বিকেল হয়ে গেল। ডোরাল্ডের বাড়ি ফিরতে দেরি আছে।
এক কাজ করা যাক, ওর রাইটিং টেবিলের ড্রয়ারগুলো খুলে দেখা যাক যদি কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু ব্যবসা সংক্রান্ত চিঠি, ব্যাঙ্কের বই ইত্যাদি ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। হঠাৎ সব থেকে নীচের ড্রয়ারে একটা বড় খাম পেল তাতে অনেকগুলো ক্লিপিং পেল।
চার্লস ল্যামেটার নামে বিখ্যাত এক নারী হন্তাকারীর বিচার সংক্রান্ত। সে ধনী বিধবা ডিভোর্সী রমণীকে বিয়ে করত। তারপর সুযোগ বুঝে খুন করে ফেলত। প্রমাণ অভাবে সে খালাস পেয়ে যেত। ল্যামেটার ছবি ছাপা হয়েছে। তার লম্বা দাড়ি, খাড়া নাক, জ্বলজ্বলে চোখ কিন্তু মানুষটার ভুরু জোড়া, চোখ আর নাক যেন ডোরাল্ডের মতো, দাড়ি কামালেই আসল রূপ বেরিয়ে পড়বে।
তাহলে ল্যামেটার আমেরিকা থেকে পালিয়ে এসে এখানে ডোরাল্ড মার্টিন সেজে বসে নেই তো! সর্বনাশ এখন কি হবে? বুধবার রাত্রি নটায় সে বেঁচে গেছে।
না এখানে আর থাকা চলবে না কিন্তু সে পালাবার আগেই ডেরাল্ড ফিরে এসেছে।
জানালা দিয়ে দেখল ডোরাল্ডের হাতে সদ্য কেনা নতুন একটা বেলচা। তার শরীর বেলচা দেখেই হিম হয়ে গেল তখন সে উদভ্রান্তের মত নীচে নেমে এল কিন্তু ডোরাল্ড তাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
আমার ভীষণ মাথা ধরেছে, আমি রাস্তায় একটু বেড়িয়ে আসি।
তোমার কিছু একটা হয়েছে, চল আমিও তোমার সঙ্গে যাই।
অ্যালিকস বাধা দিল না, দুজনে রাস্তায় কিছুক্ষণ বেড়িয়ে বাড়ি ফিরল। বাড়ি ফেরার পর ডোরাল্ড অ্যালিকসের সঙ্গে সঙ্গে থাকতে লাগল। সে রাত্রে কোনো রকমে সাপার শেষ করল। তারপর অ্যালিকস মনে সাহস নিয়ে ভাবল, সে আজ রাত্রে এই বাড়িতে কিছুতেই এই খুনীর সাথে থাকবে না। সে সুযোগ বুঝে ডিককে ফোন করবে।
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ডোরাল্ড বলল, আজ নটা বাজলেই আমরা কিন্তু ডার্করুমে ঢুকব।
প্লিজ ডোরাল্ড আজ আমি ক্লান্ত আমায় মাপ কর তুমি, একা ম্যানেজ কর।
বেশিক্ষণের কাজ নয়, তুমি দেখো তোমার মাথা ধরবে না।
অ্যালিকস ভয় পেয়ে গেল, সে উঠে দাঁড়াল। আমি একটা বুচারকে ফোন করে আসি। অ্যালি তাড়াতাড়ি রিসিভার তুলে ট্রাভেলাস আমর্স-এর নম্বর বলল। মিঃ উইণ্ডিপোর্ডকে চাইল। ধরুন, ঠিক সেই সময়ে ডোরাল্ড ঘরে ঢুকল। অ্যালিকস বিরক্ত হলো।
কিন্তু ডোরাল্ড ঘর থেকে বেরোলো না, সে একটা বই মুখে দিয়ে বসে রইল।
এদিকে অ্যালিকস যতটা সম্ভব চালাকি করে আসল কথাটা জানিয়ে দিল।
সে বলল, ফিলোমেনা কটেজ থেকে কথা বলছি প্লিজকাম, ব্রিজটিপে এবং ছেড়ে সে কথা বলল যত শীঘ্র সম্ভব লাইফ অর ডেথ।
অ্যালিকস রিসিভার নামিয়ে রাখল। ডোরাল্ড তার বই রেখে বলল, বাঃ তুমি তো বেশ বুচারের সঙ্গে কথা বললে। ডোরাল্ড জিজ্ঞাসা করল, মাথা ধরা ছেড়েছে?
হা ছেড়েছে।
দুজনে আবার বসল। ডোরাল্ড সেই বইখানা পড়তে লাগল আর অ্যালিকস তার জামায় বোম বসাতে লাগল।
দেওয়াল ঘড়িতে ঢং করে একটা শব্দ হতেই ডোরাল্ড বলল, সাড়ে আটটা বাজল। চল অ্যালিকস আমরা ডার্করুমে যাই।
না, নটার সময় যাব।
কিন্তু আমার টাইম যে সাড়ে আটটা।
আজ আমার ভালো লাগছে না। তা বললে চলবে না তোমায় যেতেই হবে। অ্যালিকস এবার বুদ্ধি খাটাল যেভাবে হোক ওকে নটা পৰ্য্যন্ত আটকাতে হবে কারণ ডিক আসতে অন্তত আধঘন্টা লাগবে। কিন্তু ডোরাল্ড অ্যালিকসকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে ডার্করুমের দিকে চলল।
অ্যালিকস ভয় পেয়ে চীৎকার করে আবার থেমে ডোরাল্ডকে জরুরী কথা বলার অছিলায় ঘরে নিয়ে গেল।
তারপর সে বলল, আমি আমার বিষয় তোমাকে কিছুই বলিনি। আমি আগে দুবার বিয়ে করে ছিলুম। আমি যাকে বিয়ে করি তার বয়স আমার ডবল তার নামে দুহাজার পাউণ্ডের ইনসিওরেন্স করাই যাতে সে মারা গেলে টাকাটা আমি পাই। তাছাড়া আমি একটা হাসপাতালের ডিসপেনসারিতে কাজ করতুম সেখান থেকে তীব্র বিষ সংগ্রহ করি। বিষটার নাম হয়োসিন। কফির সাথে এক চিমটে মিশিয়ে দিলেই মানুষ একমিনিটে মরে যাবে। কিন্তু পোস্টমর্টেম করলে বিষের কোনো চিহ্ন পাওয়া যাবে না।
আমি সেই লোকটিকে কফির কাপে এক চিমটে বিষ মিশিয়ে দিয়ে দেখি লোকটি কিভাবে মরে। এক চুমুক খাবার পর দেখি লোকটি শুধু বলল, আমার শরীর কেমন করছে ব্যস এই তার শেষ কথা।
তার টাকাগুলি হাতিয়ে আবার অন্যগ্রামে গিয়ে পরিচয় গোপন করে অন্য এক ধনী ব্যক্তিকে বিয়ে করলুম। তবে এবারে বেশী টাকা পাইনি তবে লোকের সহানুভূতির জোরে এই টাইপিস্টের কাজটা যোগাড় করি।
ঘড়িতে ঠিক নটা বাজে। ডোরাল্ড চীৎকার করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, শয়তানী তুই তাহলে আমাকে কফিতে বিষ মিশিয়েছিস? ও মাইগড!
অ্যালিকস উঠে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছোরাল্ডকে বলল, হ্যাঁ লামেটার আমি তোমার কফিতে বিষ মিশিয়েছি। তুমি একাই মানুষ খুন করতে পারো?
ডোরাল্ড কি বলতে লাগল কিন্তু তার কথা গলায় আটকে গেল।
কিছুক্ষণ বাদে গেট খোলার আওয়াজ হলো। ডিক আসছে সঙ্গে একজন পুলিশ ম্যান।
ডিক বলল, কি হয়েছে মাই লিটল গার্ল। অ্যালিকস থর থর করে কাঁপছে। ঘরে গিয়ে ডিককে দেখতে বলল। ডিক দেখলো চেয়ারে একজন লোক বসে রয়েছে। কিন্তু সে মৃত।