Site icon BnBoi.Com

ইভিল আনডার দ্য সান – আগাথা ক্রিস্টি

ইভিল আনডার দ্য সান - আগাথা ক্রিস্টি

ইভিল আনডার দ্য সান

০১. ক্যাপ্টেন রজার অ্যাংমারিং

প্রথম পরিচ্ছেদ

১.১

ক্যাপ্টেন রজার অ্যাংমারিং যখন লেবারকোম্ব উপসাগরের এক দ্বীপে ১৮৭২ সালে একটা বাড়ি তৈরি করলেন, তার খামখেয়ালিপনার চূড়ান্ত বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিলো তখন সেটাকে। একজন ব্যক্তির পক্ষে নদী বয়ে যাওয়া সবুজ ঘাসে ছাওয়া বিস্তীর্ণ প্রান্তরে প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করাই বেশি স্বাভাবিক ছিল।

এর পরম ভালোবাসা ছিল, ক্যাপ্টেন রজার অ্যাংমারিং বাড়িটা তৈরি করলেন বেশ শক্ত কাঠামোয়। জোয়ারের সময়ে সেটা মূল ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো, চঞ্চল বাতাস ও গাঙচিল ছোট পাথুরে অন্তরীপের ওপর।

তাঁর প্রথম ও শেষ সঙ্গিনী ছিলো সমুদ্রই। সেই বাড়ি এবং দ্বীপের মালিক হলেন তার মৃত্যুর পর। তাদের নিজেদের জমি-জমা ক্রমশ কমে আসছিলো, এই সম্পত্তি নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামালেন না। খারাপের দিকে তাদের উত্তরাধিকারীদের অবস্থা ক্রমে ক্রমে কমে যেতে লাগলো।

সমুদ্রতীরে অবসর যাপনের সৌখিন রীতি যখন ১৯২১ সালে। ডেভন ও কর্ণওয়াল উপকুল গ্রীষ্মকালেও আর অসহ্য বলে মনে হলো না। তার বাড়ি বিক্রি হবার নয়, কিন্তু তিনি ভালো দামই পেলেন। কারণ সমুদ্রচারী ক্যাপ্টেন রজারের সংগ্রহ করা সম্পত্তির বিনিময়ে।

একটা কংক্রীটের সেতু মূল ভূখণ্ড থেকে দ্বীপ পর্যন্ত। দ্বীপের সর্বত্র তৈরি হলো পরিকল্পনা মাফিক। তৈরি হলো মনোরম পথ ও অবসর যাপনের নিভৃত স্থান। জলি রজার হোটেল, স্মাগলার্স দ্বীপ দুটো টেনিস কোর্ট, ভেলা ও স্প্রীং-পাটাতনে সাজানো সৈকতের দিকে নেমে আসা খোলা চত্ত্বর। বিজয়ীর ভঙ্গিতে লেদারকোম্ব উপসাগর একই সঙ্গে আত্মপ্রকাশ করলো। জলি রজার হোটেলে সাধারণত তিলধারণের জায়গা থাকতো না, এবং জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাথা পিছু থাকার খরচও বেড়ে গেল।

লেদারকোম্ব উপসাগরে গেছেন কখন, জায়গাটা একটা দ্বীপের মতো। ওখানে ভীষণ ভালো একটা হোটেল আছে। জায়গাটা খুব আরামের, কোনো উটকো লোক বা শ্যারাব্যাং-গাড়ির ঝামেলা নেই। ওখানে যাওয়া উচিত আপনার।

.

১.২

রজারে বাস করছেন একজন বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তি জলি। তিনি আসল দৃষ্টি মেলে দিয়েছেন সামনের সমুদ্রতীরের দিকে, ডেক চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছেন। গোঁফজোড়া বাঁকানো রাজকীয় পদ্ধতিতে, পরনে তার দুধ-সাদা ধবধবে স্যুট, মাথায় পানামা টুপি চোখের উপর নামানো।

সমুদ্রতীরের দিকে সিমেন্ট বাঁধানো একাধিক চত্ত্বর ঢালু হয়ে নেমে এসেছে। রবার ও ক্যাম্বিশের তৈরি নৌকো, পলিথিনের বল, খেলনা এবং কয়েকটা ভেলা ও একটা দীর্ঘ স্প্রীং পাটাতনের সামনের দিকে ছড়িয়ে রেখেছে।

কথাবার্তার স্রোত ভেসে আসছে, পোয়ারোর বাঁ দিক থেকে মিসেস গার্ডেনারের অবিশ্রান্ত একঘেয়ে বুলি মুহূর্তের জন্যেও বিচলিত হচ্ছে না মিসেস গার্ডেনারের কর্মব্যস্ত হাত। কথার স্রোত এবং উল বোনার কাটার দক্ষতায় তাল রেখে এগিয়ে চলেছে। একটা দোলনা-চেয়ারে গা এলিয়ে শুয়ে আছেন তাঁর স্বামী ওডেল সি. গার্ডেনার। মাথার টুপিটা টেনে নামানো নাকের ওপর এবং কোনোরকম উৎসাহ পেলেই তিনি সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে সরব হচ্ছেন।

মিস ব্রুস্টার পোয়ারোর ডান পাশে বসে। তার মাথায় ধূসর চুল; মুখমণ্ডলে প্রকৃতি-সহিষ্ণুতার ছাপ; শরীরের গঠনটা অনেকটা অ্যাথলেটিকদের মতো।শিকারী হাউন্ড যেন কোনো পমেরেনিয়ান কুকুরের যতিহীন তীক্ষ্ণ চীৎকারকে কর্কশ ধমকের সাহায্যে বাধা দিতে চেষ্টা করছে।

মিসেস গার্ডেনার তখন বলে চলেছে, আমি বললাম মিঃ গার্ডেনারকে, প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা খুব ভালো, যে কোনো জায়গা তন্ন তন্ন করে ঘুরে দেখতে চাই। আমি বললাম, মোটামুটি ভালোভাবে ঘুরে দেখেছি গোটা ইংলন্ডটা। সমুদ্রের কাছাকাছি শান্ত পরিবেশে গিয়ে বিশ্রাম করতে আমি চাই। আমি ওকে বলেছি, আমার এখন বিশ্রামের প্রয়োজন।

হ্যাঁ সোনা, বলে টুপির নিচ থেকেই অনুচ্চ কণ্ঠে জবাব দিলেন।

তার কাহিনীর পশ্চাদ্ধাবনে মনোনিবেশ করলেন মিঃ গার্ডেনার। বেড়ানোর ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি যেচে, আর সে কারণেই যখন আমি কুক-এর মিঃ কেলসোকে একথা জানালাম। একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। তিনি না থাকলে আমরা যে কি করতাম। এর চেয়ে ভালো জায়গা নেই, মিঃ কেলসোকে এ জায়গাটার কথা বলা মাত্রই তিনি বললেন। জলি রজার অন্য সব হোটেলের চেয়ে আলাদা। নির্জন মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, সঙ্গে পরিচর্যার সুব্যবস্থা, জল কলের ব্যবস্থার কথা জানতে চেয়েছিলেন, মিঃ গার্ডেনার, মিঃ গার্ডেনারের এক বোন একবার এই জাতীয় একটি অতিথিশালায় দিন কয়েক ছিলেন, বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, শুনলে অবাক হবেন নিতান্তই গ্রামের মতো, কলঘরের ব্যবস্থা ছিলো মাটির তৈরি। এ ধরনের নির্জন সুন্দর জায়গা সম্পর্কে মিঃ গার্ডেনার সন্দেহপ্রবণ তা না, ওডেল, বলেছেন মিঃ গার্ডেনার নিশ্চয়ই শোনা।

আমাদের আশ্বাস দিলেন মিঃ কেলসো, সঙ্গে সঙ্গে বললেন–এখন দেখছি সে কথা সত্যি, জলকলের ব্যবস্থা আধুনিক এবং রান্না অত্যন্ত চমৎকার, সময়ানুবর্তিতা আমি সবচেয়ে পছন্দ করি; বুঝতেই পারছেন কি বলতে চাইছি। এলাকাটা ছোট হওয়ায় সুযোগ রয়েছে প্রত্যেকের সঙ্গেই প্রত্যেকের পরিচয়ের। তারা একটু আলাদা থাকতে চায়, যদি ইংরেজদের কোনো দোষ থেকে থাকে তাহলে আপনার সঙ্গে পরিচয় বছর দুয়েকের পুরানো না হওয়া পর্যন্ত। এখন দেখতে পাচ্ছি, মিঃ কেলসো আরও বললেন, নানান ধরনের বিচিত্র সব মানুষেরা এসে ভীড় করে এই স্মাগলার্স দ্বীপে। সে কথা মিথ্যা নয়, আমার তো পালকের ঘায়ে মূৰ্ছা যাবার মতো অবস্থা আপনার আসল পরিচয় পেয়ে তাই না, ওডেল।

হ্যাঁ সোনা, সত্যি কি রোমাঞ্চকর ব্যাপার তাই না মঁসিয়ে পোয়ারো। সামান্য সুযোগ পেয়েই সরব হলেন মিস ব্রুস্টার।

এরকুল পোয়ারো ক্ষীণ প্রতিবাদে হাত তুললেন, নিছক ভদ্রতাবশেই সে প্রতিবাদ এড়িয়ে চললেন মিসেস গার্ডেনার সাবলীলভাবে।

জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার সম্বন্ধে আমি অনেক কিছু শুনেছি কর্নেলিয়া রবসনের কাছে। আমি এবং মিঃ গার্ডেনার ব্যাডনহফে ছিলাম গত মে মাসে। সেই সময়েই লিটেন বিজওয়ে খুন হয়। কর্নেলিয়া মিশরের ব্যাপারটা আমাদের বলেছে। আপনাকে দেখার জন্য আমি একবারে পাগল, আপনি যেভাবে ঘটনাটার সমাধান করছেন তাই না ওডেল?

হ্যাঁ সোনা, মিস ডার্নলির কথা। পোষাকগুলোর একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে কারণ বেশিরভাগ জামাকাপড়ই রোজমন্ড থেকে কেনা। আর রোজমন্ডের মালিক উনিই। ওর দোকান থেকেই কেনা গত রাতের পোষাকটা। মেয়েটিকে সব দিক দিয়ে ভীষণ ভালো লাগে।

মেজর ব্যারী তার বিস্ফারিত চোখ ওপরে নিবদ্ধ রেখে বসেছিলেন মিস ব্রুস্টারের পেছনে। গম্ভীর স্বরে মন্তব্য করলেন, মেয়েটির চেহারায় বিশেষত্ব আছে।

মিসেস গার্ডেনারের উল বোনার কাঁটা সশব্দে সচল হলো।

মঁসিয়ে পোয়ারো, একটা কথা স্বীকার না করে পারব না। ভীষণ অবাক হয়েছি আপনাকে এখানে দেখে! মিঃ গার্ডেনারও সে কথা জানেন। আমি কি বলতে চাইছি, আশা করি বুঝতে পারছেনও। নিশ্চয়ই আপনার পেশার প্রয়োজনে এসেছেন এখানে। মিঃ গার্ডেনারও সেই কথাই বলবেন, আমার অনুভূতি প্রখর। আমি একেবারেই বরদাস্ত করতে পারি না, যে কোনো ধরনের অপরাধকে।

দেখতেই পাচ্ছেন, মিঃ গার্ডেনার গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলেন। বললেন, মিসেস গার্ডেনারের যষ্ঠেন্দ্রিয় সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি প্রখর। দুহাত শূন্যে বিক্ষিপ্ত হলো পোয়ারোর। মাদাম, আমাকে অন্তত একবার আশ্বাস দেবার সুযোগ দিন। কোনো অপরাধের কথা আমি এখন চিন্তাও করছি না; আপনাদের মতোই ছুটি কাটাতে আনন্দ করতে এসেছি।

স্মাগলার্স দ্বীপে কোনো দেহ নেই, রুক্ষ স্বরে মন্তব্য করলেন মিস ব্রুস্টার।

পুরোপুরি সত্যি নয়–এরকুল পোয়ারো বলেন। নিচের বেলাভূমির দিকে আঙুল তুলে নির্দেশ করলেন, সারি সারি শুয়ে থাকা শরীরগুলো তাকিয়ে দেখুন, কি ওগুলো, মহিলা কিংবা পুরুষ নয়। ওরা শুধুই দেহ ওদের কোনো বৈশিষ্ট্য নেই।

সপ্রশংস সুরে বললেন, মেজর ব্যারী, ওদের মধ্যে কয়েকটা মেয়ের চেহারা দেখবার মতো। যদিও একটু রোগার দিকে।

জোরালো কণ্ঠে পোয়ারো বললেন, মানছি সুন্দর চেহারা, কিন্তু কি আবেদন আছে এর, রহস্য আছে কি? আমি বৃদ্ধ সেকালের লোক, বড়জোর গোড়ালিটুকু দেখা যেত যখন আমি ছোট ছিলাম। লুব্ধ করার মতো সফেন সেমিজের। মেজর ব্যারী কর্কশ স্বরে বলে উঠলেন, দুষ্টু দুষ্টু।

মিস ব্রুস্টার বললেন, আজকাল আমরা যে সব পোশক পরি, তা অনেক বেশি মনোজ্ঞ।

মিসেস গার্ডেনার বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, জানেন আজকালকার ছেলেমেয়েরা বেশি স্বাভাবিক জীবনযাপন করে। সুন্দর মনের পরিচয় পাওয়া গেল, মুখের রক্তিম আভাসে মিসেস গার্ডেনার, বুঝতেই পারছেন তো মেলামেশার ফলাফলের কথা চিন্তা করে না।

এরকুল পোয়ারো বললেন, রীতিমতো দুঃখের কথা, আপনি ঠিকই বলেছেন।

মিসেস গার্ডেনার তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, দুঃখের কথা!

সব কিছুরই মানদণ্ড নির্দিষ্ট হয়ে গেছে আজকাল দুঃখের কথা নয়, তিনি হাত তুলে নির্দেশ করলেন অর্ধশায়িত দেহগুলোর। এ কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে প্যারিসের লাশ রাখা ঘর।

মিসেস গার্ডেনার অস্বস্তি অনুযযাগের সুরে বলে উঠলেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, অনেকটা মাংসের দোকানের মতো পাথরের ওপর সাজানো দেহগুলি। এ বড্ড কষ্টকল্পিত পোয়ারো, তাই না।

স্বীকার করলেন এরকুল পোয়ারো, হয়তো–হ্যাঁ।

আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত একটা বিষয়ে মিসেস গার্ডেনার দ্রুত হাতে বুনতে শুরু করলেন। তাদের হাতে পায়ে অতিরিক্ত লোম জন্মাতে বাধ্য। এভাবে খালি গায়ে মেয়েরা রোদে শুয়ে থাকে। মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি সেই কথাই বলেছি আমার মেয়ে আইরিনকে, ওকে বলেছি তুমি যদি এভাবে খালি গায়ে রোদে শুয়ে থাকো, সারা শরীর লোমে ছেয়ে যাবে, তোমার হাতে লোম হবে, পায়ে লোম হবে। তাহলে কি রকম দেখাবে বলতো তোমাকে। বলিনি ওডেল মিঃ গার্ডেনার বললেন, হ্যাঁ সোনা। তারা মনে মনে চেহারাটা কল্পনা করার চেষ্টা করছিলেন। কিছুক্ষণ সকলেই চুপচাপ। সেলাই গুছিয়ে নিয়ে মিসেস গার্ডেনার বললেন, তাই ভাবছি।

কি হলো সোনা, মিঃ গার্ডেনার বললেন।

মিসেস গার্ডেনারের কাছ থেকে সেলাই ও সেলাইয়ের বইটা নিলেন। দোলনা চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন হাত বাড়িয়ে। মিস ব্রুস্টার আসবেন নাকি, জিজ্ঞেস করলেন। একসঙ্গে বসে একটু গলা ভেজানো যাবে।

নাঃ, ধন্যবাদ, এখন নয়।

গার্ডেনাররা হোটেলের দিকে এগিয়ে চললেন। মার্কিন স্বামীরা দারুণ চমৎকার, মিস ব্রুস্টার বললেন।

.

১.৩

মিসেস গার্ডেনারের শূন্যস্থান পূরণ করলেন ধর্মযাজক স্টিফেন লেন, শরীরের সতেজ আভাস সুস্পষ্ট দীর্ঘকায় পঞ্চাশস্পর্শী। মুখের রঙ তামাটে, পরনের গাঢ় ধূসর প্যান্টে অগোছালো ছাপ। লেদারকোম্ব উপসাগর থেকে হারফোর্ড পর্যন্ত গিয়েছিলাম, উৎসাহভরে বললেন। চমৎকার জায়গা পাহাড়ি রাস্তা ধরে ফেরার সময় এলাম। মেজর ব্যারী বললেন, আজকের দিনে পরিশ্রমের কাজ হেঁটে বেড়ানো। হাঁটাহাঁটি তিনি একদম পছন্দ করেন না।

মিস ব্রুস্টার বললেন, ভালো ব্যায়াম, আমার নৌকো নিয়ে বেরোনো হলো না। নৌকো চালানোর চেয়ে ভালো ব্যায়াম আর নেই, পেটের পেশীর পক্ষে।

নিজের স্ফীত মধ্যপ্রদেশের দিকে পোয়ারোর বিষণ্ণ দৃষ্টি ধীরে ধীরে নেমে এল।

মিস ব্রুস্টার সেটা লক্ষ্য করে সান্ত্বনার সুরে বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, রোজ যদি নৌকো নিয়ে বেরোন, আপনার ভুড়ি দিন কয়েকের মধ্যেই মিলিয়ে যাবে।

আমি অত্যন্ত অপছন্দ করি ঘোট নৌকো, মাপ করবেন। মাদমোয়াজেল চোখ বুজে শিউরে উঠলেন ছোট বড় সব রকমের নৌকো। মোটেই সুখের নয় সমুদ্রের দুলুনি। পুকুরের মতো শান্ত সমুদ্র আজ। উত্তর দিলেন পোয়ারো প্রত্যয়ের সুরে-সমুদ্র বলে সত্যি কিছু নেই, মাদমোয়াজেল। সেখানে সব সময় রয়েছে আলোড়ন। মেজর ব্যারী বললেন, যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে বলবো-সমুদ্র রোগের দশভাগের ন ভাগই হচ্ছে স্নায়ুর ব্যাপার। মেজর ঠিক বলেছি তো, সামান্য হেসে ধর্মযাজক বললেন, একজন অভিজ্ঞ নাবিকের কথা শুনুন। ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। সমুদ্র-রোগ জিনিষটাকে মনে একেবারেই আমল দেবেন না। আমার মত এই সমুদ্র রোগটা ভারী অদ্ভুত। মিস ব্রুস্টার আনমনা সুরে বললেন, এ ভারি অন্যায়, সবার হয় না কারো কারো হয় কেন? নিজের স্বাস্থ্যের উপর কারোর হাত নেই। রীতিমতো রুগ্ন চেহারার লোকও দক্ষ। আমাকে একজন নাবিক বলেছিলো। শিরদাঁড়ার কি একটা রোগের সঙ্গে নাকি এটার যোগ আছে। আবার অনেকে উঁচু জায়গা একেবারে সহ্য করতে পারে না। আমিও ঐ দলের কিন্তু মিসেস রেডফার্মের আরও অবস্থা খারাপ। এই তো সেদিন হারফোর্ডের পাহাড়ি পথে মাথাঘুরে গিয়ে তিনি আমাকে জড়িয়েই ধরলেন। তাঁর মুখেই শুনেছি, মিলান গির্জা পথে মাঝ-সিঁড়িতে আটকে পড়েছিলেন। চিন্তা না করেই উঠে গেছেন ওঠবার সময়। বিপদ হয়েছে নামার সময়।

মন্তব্য করলেন স্টিফেন লেন, পিক্সি কোভে নামার মইটা ব্যবহার না করাই উচিত, মুখভঙ্গী করলেন, মিস ব্রুস্টার কাওয়ান আর মাস্টারম্যানদের ছেলেরা দৌড়ে ওঠানামা করতে ভালোবাসে। ওটাকে আম ভয় করি। ছোটদের পক্ষে মইটা ঠিক আছে।

মিসেস রেডফার্ন স্নান সেরে ফিরে আসছেন, লেন বললেন।

উনি সূর্যস্নান করেন না। ওঁকে মঁসিয়ে পোয়াবোর পছন্দ হওয়া উচিত। মিস ব্রুস্টার মন্তব্য করলেন।

তরুণী মিসেস রেডফার্ন মাথা থেকে টুপিটা খুলে চুল ঝাড়ছিলো। মাথার চুল ছাইরঙা, ত্বকের রংও চুলের সঙ্গে মানানসই। অত্যন্ত সাদা হাত পায়ের রং। অন্যদের তুলনায় রোদে কম ভাজা হয়েছেন, তাই না। মেজর ব্যারী চাপা হাসিতে মুখ খুললেন। ক্রিস্টিন রেডফার্ণ বেলাভূমি ধরে এগিয়ে এলো, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলো দীর্ঘ স্নান-পোশাকে নিজেকে আবৃত করে। মুখের ছায়া সুন্দর গম্ভীর হাত পায়ের গড়ন ছোট হলেও নিখুঁত। স্নান পোষাকটাকে ভালো করে জড়িয়ে ওদের পাশে এসে বসলো।

আপনি মঁসিয়ে পোয়ানোর মূল্যবান প্রশংসা অর্জন করেছেন। মিস ব্রুস্টার বললেন। তিনি একদম পছন্দ করেন না সূর্যস্নান করা। কসাইয়ের দোকানে সাজানো মাংসের মতো দেখায় যদি সত্যিই সূর্যস্নান করতে পারতাম।

ক্রিস্টিন রেডফার্ন বিষণ্ণভাবে হাসলো, বললো, আমার গায়ের রং বাদামী হয় না, ফোস্কা পড়ে শুধু ফোঁটা ফোঁটা দাগ পড়ে যায় বিশ্রী, সারা হাতে।

মিস স্টার বললেন, মিসেস গার্ডেনারের মেয়ে আইরিনের মতো সারা গায়ে চুল গজানো তবু ভালো, সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে ক্রিস্টিন বলে চলেন, আজ সকালে দারুণ মেজাজে ছিলেন মিসেস গার্ডেনার। এক নাগাড়ে একেবারে চালিয়ে গেছেন। তাই না ওডেল? হ্যাঁ সোনা। একটু থেমে গিয়ে-মঁসিয়ে পোয়ারো আমার মনে হচ্ছে, একটা চালাকি করলে ওঁর সঙ্গে পারতেন। করলেন না কেন? আপনি এখানে একটা খুনের সমাধান করতে এসেছেন বলবেন না কেন, সেই হোটেলের অতিথিদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে উন্মাদ হত্যাকারীকে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, বললেন, পোয়ারো। সেটা হয়তো তিনি বিশ্বাস করে বসতেন।

মেজর ব্যারী সশব্দে হেসে উঠলেন, নির্ঘাত বিশ্বাস করতেন তিনি।

মিসেস গার্ডেনারের মতো মানুষও বিশ্বাস করতেন এমন খুনের কথা। কারণ এটা ঠিক জায়গা নয় আপনি মৃতদেহ পাবেন। এমিলি ব্রুস্টার বললেন, আমার মনে হয় না।

সামান্য নড়েচড়ে বসলেন পোয়ারো চেয়ারে। মাদমোয়াজেল, প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, কেন নয়, আমার স্মাগলার্স দ্বীপে মৃতদেহ পাওয়া কোনো অসুবিধেটা দেখলেন আপনি।

কতগুলো জায়গা খুনের পক্ষে উপযুক্ত নয়, এমিলি ব্রুস্টার বললেন, নিজের বক্তব্যকে ঠিক ভাবে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে চুপ করে গেলেন তিনি।

এরকুল পোয়ারো বললেন, জায়গাটা স্বপ্নময় মানছি। শান্তি রয়েছে এখানে গভীর নীল সমুদ্র রয়েছে, উজ্জ্বল সূর্যের কিরণ, ভুলে যাচ্ছেন আপনি। পৃথিবীতে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে অশুভ শক্তির ছায়া। মিস ব্রুস্টার নড়েচড়ে বসলেন, ধর্মযাজক ঝুঁকে এলেন সামনে। তার গভীর নীল চোখ চকচক করে উঠলো।

কাঁধ ঝাঁকালেন মিস ব্রুস্টার। ও হ্যাঁ, সে কথা মিথ্যে নয়। কিন্তু তবুও আমার মনে হচ্ছে, এ জায়গাটা ঠিক উপযুক্ত নয় কোনো অপরাধ সংঘটিত হবার পক্ষে।

মাদমোয়াজেল, একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন।

বোধহয় মানব-চরিত্রের কথা, হ্যাঁ, প্রথম এবং শেষ কথা সেটাই। আমি সে কথা বলতে চাইনি। এখানে সবাই ছুটিতে বেড়াতে এসেছেন। আপনাকে মনে করিয়ে দিতে যাচ্ছিলাম।

এমিলি ব্রুস্টার তাকালেন তার দিকে বিহ্বল চোখে। বুঝতে পারলাম না ঠিক, তর্জনী না নাচিয়ে বোঝাতে চাইলেন তার বক্তব্যের ইঙ্গিত। এরকুল পোয়ারো করুণার হাসি হাসলেন।

আপনাকে যথেষ্ট উপযুক্ত কারণ দেখাতে হবে। যদি তার বাড়িতে অফিসে বা রাস্তায় তাকে খোঁজ করেন। আপনাকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে। কিন্তু এখন কাউকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে না সমুদ্রতীরে উপস্থিতির জন্য। আপনি কেন লেদারকোম্ব উপসাগরে এসেছেন?

অতি সহজ উত্তর। এখন আগস্ট মাস-লোকে এই মাসেই ছুটি কাটাতে আসে। আসাটা স্বাভাবিক, সমুদ্রতীরে ছুটি কাটাতে আসাটা ইংল্যান্ডের রীতি। অস্বীকার করা যায় না আপনার কথা। স্বীকার করলে আপনি কি বলবেন মিস ব্রুস্টার ও গার্ডেনার সম্পর্কে। মার্কিন তো ওরা, মৃদু হাসলেন পোয়ারো। বিশ্রামের প্রয়োজন অনুভব করেন মিসেস গার্ডেনারও। আমাদের বলেছেন তিনি নিজেই সমুদ্রতীরে তার সপ্তাহ দুয়েক কাটানো উচিত কারণ তিনি গোটা ইংল্যান্ডটা ঘুরে দেখেছেন। তিনি একজন ভালো ট্যুরিস্ট হিসেবে বিভিন্ন ধরনের মানুষ দেখতে ভালোবাসেন তাই না?

আমি মানুষ দেখতে ভালোবাসি মাদাম সে কথা আমি স্বীকার করি।

আপনি অনেক বেশি দেখতে পান, ও চিন্তিত সুরে বললো।

.

১.৪

অপ্রতিভ কণ্ঠে বললেন, স্টিফেন লেন–সশব্দে গলা খাঁকারি দিয়ে, মঁসিয়ে পোয়ারো, কথাগুলো আপনি বললেন, সে সম্পর্কে আমি একটু কৌতূহলী। পৃথিবীর সর্বত্রই অপরাধ সংঘটিত হয় আপনি বলছেন। আপনার কথাগুলোর সঙ্গে বিশেষ মিল আছে, বাইবেলেরইক্লিসিয়াস্তেস অধ্যায়ের একটি উদ্ধৃতির। মুহূর্তের জন্য থামলেন তারপর ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলেন সত্য, মানুষের প্রতিটি পুত্রের হৃদয় অপরাধবাসনায় পরিপূর্ণ এবং জীবকালে তাদের সহিত জড়িত থাকে। ধর্মীয় দীপ্তিতে তার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। একথা শুনে আমি খুব খুশী হয়েছি। অশুভ শক্তিতে আজকাল বিশ্বাস করে না বড়জোর শুভর বিপরীত হিসেবে বিচার হয় মাত্র যাদের বুদ্ধি-জ্ঞানে যারা অসম্পূর্ণ অসৎ কাজ তারাই করেন। অশুভ শক্তির অস্তিত্ব আছে মঁসিয়ে পোয়ারো। বাস্তবে সত্য। আমি যেন অশুভ বিশ্বাস করি, তেমনি বিশ্বাস করি শুভ। পৃথিবী জুড়ে বিস্তৃত এর রাজত্ব। নিজস্ব ক্ষমতা আছে, প্রভাবও আছে। তিনি হঠাৎ ক্ষমাপ্রার্থীর দৃষ্টিতে তাকালেন। তার শ্বাস ও প্রশ্বাস ঘন হয় উঠেছে। রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন।

দুঃখিত! একটু আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়েছিলেন।

শান্ত স্বরে বললেন, পোয়ারো, আমি আপনার অর্থ বুঝতে পারছি। আমার সঙ্গে আংশিকভাবে একমত অশুভর রাজত্ব সারা পৃথিবীতে রয়েছে তার স্বরূপ আমাদের জানা আছে। গলা খাঁকারি দিলেন মেজর ব্যারী। কয়েকজন ফকির ভারতবর্ষে এ ধরনের কথা বলেছিলেন।

ভারতীয় প্রতি সর্বনাশা কাহিনীর বিরুদ্ধে প্রত্যেকের সাবধান হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। জলি রজারে কাটিয়েছেন মেজর ব্যারী। মিস ব্রুস্টার-ও মিসেস রেডফার্ন, দুজনেই বক্তব্যে কাঁপয়ে পড়লেন। সাঁতার থেকে ফিরে আসছে আপনার স্বামী তাই না, মিসেস রেডফার্ন ওর হাত টানার ভঙ্গী দেখবার মতো। আপনার স্বামী ভীষণ ভালো সাঁতারু।

ওই দেখুন! লাল রঙের পাল দেওয়া সুন্দর একটা ছোট নৌকা, বললো, মিসেস রেডফার্ন। ওটা মিঃ ব্ল্যাটের তাই না?

উপসাগরের সীমানা অতিক্রম করছে লাল পালের নৌকোটা।

ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বললেন মেজর ব্যারী–আজব পছন্দ লাল-রঙা পাল। আতঙ্ক এড়ানো গেল না, ফকির কাহিনীর সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকে দেখছিলেন এরকুল পোয়ারো। যুবকটি তখন সাঁতরে পাড়ে এসে পৌঁছেছে। প্যাট্রিক রেডফার্ন মানুষটির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তামাটে দীর্ঘকায় শরীর। সুগঠিত সঙ্কীর্ণ উরু, কাঁধ প্রশস্ত। তাকে ঘিরে রয়েছে একটা হাসিখুশি আনন্দের ঢেউ। তাকে সমস্ত মহিলা ও অধিকাংশ পুরুষের কাছে করে তুলেছে প্রিয়। সৈকতে দাঁড়িয়ে শরীরে জল ঝাড়ল সে, খুশিতে হাত নেড়ে ইশারা করলো স্ত্রীর দিকে। ইশারার প্রতি উত্তর ফিরিয়ে দিলো ক্রিস্টিন, ডেকে উঠলো, এসো এখানে প্যাট। আসছি। প্যাট্রিক আরো কিছুটা এগিয়ে গেল, সৈকত বালিতে পড়ে থাকা ভোয়ালেটা তুলে নিয়ে গেল। হোটেলের দিক থেকে একজন মহিলা তাদের অতিক্রম করে নেমে গেলো বেলাভূমির দিকে। নাটকীয় আবির্ভাবের সমস্ত বৈশিষ্ট্য ছিলো তার উপস্থিতিতে। এ তার অজানা নয় উপরন্তু তার চলার ছন্দ জানিয়ে দিচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে সেখানে অদৃশ্য আত্মসচেতনভাবে তার উপস্থিতির প্রভাব নাটকীয়তার কাছে নতুন কিছু নয়। এটা হওয়াই স্বাভাবিক। নাটকীয় প্রভাব তার কাছে নতুন কিছু নয়।

শরীরের উন্মুক্ত প্রতিটি অংশে সূর্যস্নানে সুষম ব্রোঞ্জ প্রলেপ, পরনে সাধারণ পিঠ খোলা সাদা সাঁতার পোশাক, ভাস্কর্যের মতোই নিখুঁত তার গড়ন। উজ্জ্বল আগুন রঙ ঘাড়ের কাছে এসে নিয়েছে অন্তর্মুখী বাঁক। মুখমণ্ডলে সামান্য কাঠিন্য বিদায় নিলেও তিরিশ বছর বয়স। সব মিলিয়ে রয়েছে জমকালো গর্বিত সজীবতা, আর তারুণ্যতার চৈনিক স্থৈর্য ছড়িয়ে রয়েছে সারা মুখে, তার চোখের উপর দিকে সামান্য টানা মাথায় তার সবুজ পিচবোর্ডের এক স্বপ্নময় চীনে টুপি।

এমন একটা কিছু ছিল মহিলাটির মধ্যে, যা সৈকতে উপস্থিত অন্যান্য মহিলাদের তুচ্ছ ও নিষ্প্রভ করে দিলো। অনিবার্যভাবে উপস্থিত প্রতিটি পুরুষের চোখ সমান আকর্ষিত হয়ে গেঁথে গেলো তার শরীরে। মেজর ব্যারী সোজা হয়ে বসলেন, তার বিস্ফারিত চোখ আরও বিস্ফারিত হলো। এরকুল পোয়ারোর চোখ পুরোপুরি খুলে গেলো, গোঁফজোড়া প্রশংসায় নেচে উঠল।

স্টিফেন লেন গভীর শ্বাস নিলেন, শরীরে প্রতিটি পেশী হয়ে উঠল কঠিন।

ফিসফিসে স্বরে বললেন, মেজর ব্যারী, আর্লেনা স্টুয়ার্ট অভিনয় ছেড়ে দেবার আগে ওর শেষ নাটক কাম অ্যান্ড গো আমি দেখেছিলাম। কি বলেন দেখার মতো চেহারা।

ধীর স্বরে বললো ক্রিস্টিন রেডফার্ন। শীতলতার পরশ যেন ওর কণ্ঠে। সত্যি ও সুন্দরী। তবে কি ওকে দেখে পশুর মতো মনে হয়।

এমিলি ব্রুস্টার হঠাৎ বলে উঠলেন, আপনি অশুভ শক্তির কথা এসব বলেছিলেন মঁসিয়ে পোয়ারো। আমার ধারণা সেই অশুভ শক্তির মানব রূপ এই মেয়েটি। ওর মধ্যে এতটুকু ভালোর ছোঁয়া নেই। ওর সম্পর্কে আমি অনেক কিছুই জানি।

স্মৃতি রোমন্থনের সুরে বললেন মেজর ব্যারী, সিমলার একটা মেয়ের কথা আমার মনে পড়েছে। মেয়েটির চুল ছিল লাল। মেয়েটি জনৈক নিম্নপদস্থ সৈনিকের বউ ছিলো। মেয়েটি সেখানে অশান্তির সৃষ্টি করেছিল। সেখানে গিয়ে অন্যান্য মহিলারা সুযোগ পেলে ওর চোখ উপড়ে নিতে ছাড়ত না, কারণ পুরুষেরা ওর অর্থাৎ মেয়েটির জন্য পাগল হয়ে যেত। তাছাড়া মেয়েটি অনেক সংসার ছারখার করে দিয়েছিলো।

তিনি চাপা হাসিতে স্মৃতিচারণ করলেন, শান্তশিষ্ট চমৎকার মানুষ ছিল তার স্বামীটি। বউয়ের অন্যায়কে অন্যায় বলে মনে করতো না। বউকে প্রায় পুজোই করতো। স্টিফেন লেন তীব্র আবেগভরা চাপা স্বরে বললেন, সমাজের পক্ষে এধরনের মেয়ে ভীষণ-ভীষণ ক্ষতিকারক।

তিনি থামলেন, ইতিমধ্যে আর্নেনা স্টুয়ার্ট জলের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছেন। যুবক দুটি সবে মাত্র কৈশোরের সীমারেখা পেরিয়েছে, যুবক দুটি আগ্রহের সঙ্গে চট করে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসেছে ওর দিকে। হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। ওর দিকে তাকিয়ে যুবক দুজনকে অতিক্রম করে নজরে পড়লো সৈকত ধরে এগিয়ে আসা প্যাট্রিক রেডফানের দিকে।

ব্যাপারটা যেন অনেকটা কাঁটা কম্পাসের মতো–এরকুল পোয়ারো ভাবলেন, ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করার মতো। গতিপথের বিচ্যুতি ঘটলো প্যাট্রিকের। রেডফার্নের পা-জোড়া দিক পরিবর্তন করলো। চুম্বক কম্পাসের কাটা সর্বদা উত্তরমুখী হবেই বিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী। প্যাট্রিক রেডফানের পা তাকে নিয়ে এলো আর্লেনা স্টুয়ার্টের কাছে। তখন অল্প অল্প হাসলেন প্যাট্রিকের দিকে তাকিয়ে। তারপর সৈকত ধরে ও এগিয়ে চলে, ঢেউয়ের পাশাপাশি পা ফেলে প্যাট্রিক রেডফার্ন ওর সঙ্গ নিলো। ও শরীর এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো একটা পাথরের পাশে। রেডফার্ন বসলো ওর পাশে।

ক্রিস্টিন রেডফার্ন আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে হোটেলে ঢুকে পড়লো।

.

১.৫

একটা অস্বস্তিকর নীরবতা ক্ষণেকের জন্য জমাট বেঁধে রইল, ও চলে যাবার পর। এমিলি স্টার বললেন ও ভীষণ ভালো মেয়ে, সত্যি খুব খারাপ লাগছে। মাত্র কয়েক বছর হলো ওরে বিয়ে হয়েছে। মেজর ব্যারী বললেন, আমি যে মেয়েটির কথা বলেছিলাম, সেই মেয়েটি সিমলার মেয়ে। ও বেশ কয়েকটা সত্যিকারের সুখের বিয়ে বিগড়ে দিয়েছিলো কি বলেন।

দুঃখের কথা, মিস ব্রুস্টার বললেন, এ ধরনের মেয়ে আছে, যারা পরের সংসার ভেঙে দিতে ভালোবাসে। মিনিট কয়েক থেমে গিয়ে যোগ করলেন, প্যাট্রিক রেডফানটা এক নম্বরের বোকা।

এরকুল পোয়ারো একদৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন নীরবে বেলাভূমির দিকে। কিন্তু প্যাট্রিক রেডফার্ন বা আর্লেনা স্টুয়ার্ট তার লক্ষ্য ছিল না। মিস ব্রুস্টার বললেন, আমি বরং যাই নৌকা নিয়ে বেরিলয়ে পড়ি। তিনি বিদায় নিলেন। পোয়ারোর দিকে মেজর ব্যারী ঘুরে তাকালেন। তার চোখ বিস্ফারিত, চাপা উত্তেজনা ও কৌতূহল। মঁসিয়ে পোয়ারো, বলুন কি এত ভাবছেন? কই আপনি মুখ খুললেন না তো, এই অপ্সরাটি সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?

জব্বর চিজ, বললেন, পোয়ারো, তাই হয়তো…

মশাই ঝেড়ে কাশুন! আমি হাড়ে হাড়ে চিনি ফরাসিদের।

আমি ফরাসি নই। শীতল স্বরে বললেন পোয়ারো।

সুন্দরী মেয়েরা আপনার নজর কাড়ে না। তা বলে একথা বলবেন না, আপনার হুঁ বলে মনে হয় না ওকে দেখে কি?

উনি মোটেই তরুণী নন, এরকুল পোয়ারো বললেন,

তাতে কী আসে যায়? যে কোনো মহিলার চেহারা দেখে যা মনে হয়, বয়েস ঠিক তাই তার। কোনো গলতি নেই ওর চেহারায়।

এরকুল পোয়ারো বললেন মাথা নাড়িয়ে, হ্যাঁ, উনি সুন্দরী। কিন্তু শেষ কথা সুন্দরই নয়। সৈকতে উপস্থিত প্রত্যেকে যে তার দিকে তাকিয়েছে, তার কারণ সৌন্দর্য নয়। মেজর বললেন, মশাই ওটাই একমাত্র কারণ। তিনি হঠাৎ কৌতূহলী কণ্ঠে বললেন, কি দেখছেন বলুন তো একদৃষ্টে আপনি?

উত্তর দিলেন এরকুল পোয়ারা, তাকিয়ে আছি আমি ব্যতিক্রমটির দিকে। একমাত্র মানুষের দিকে; যিনি ভদ্রমহিলা যাওয়ার সময় চোখ তুলে তাকাননি।

পোয়ারোর দৃষ্টিকে অনুসরণ করে মেজর ব্যারী সেই ব্যাতিক্রমটির দিকে তাকালেন। ভদ্রলোকের বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ, মুখশ্রী শান্ত সুন্দর, মাথার চুল হাল্কা রঙের, তামাটের গায়ের রঙ। তার ঠোঁটে ধূমায়িত পাইপ, চোখের নজর হাতের দি টাইমস-এ নিবদ্ধ।

মেজর ব্যারী বললেন, ওঃ উনি, আমাদের স্বামীদেবতা মশাই হলেন উনি। ক্যাপ্টেন মার্শাল।

হা, জানি–এরকুল পোয়ারো বললেন। মেজর নিজে অবিবাহিত, তিনি চাপা হাসি হাসলেন। স্বামীর ভূমিকা মাত্র তিন রকমের তার দৃষ্টিভঙ্গীতে প্রতিবন্ধক, অসুবিধে সৃষ্টিকারী এবং রক্ষাকর্তা।

দেখে মনে হয় চমৎকার লোক তিনি। আমার টাইমসটা নিয়ে গেলো?

পা বাড়ালেন হোটেলের দিকে উঠে দাঁড়িয়ে স্টিফেন, লোনের দিকে তাকালেন ধীরে ধীরে তার দৃষ্টিতে পোয়ারো। প্যাট্রিক রেডফার্নকে লক্ষ্য করছিলেন স্টিফেন লেন, আর্লেনা মার্শান পোয়ারোর দিকে হঠাই তিনি ফিরে তাকালেন, তার দুচোখে ঝিলিক মারলো বিতৃষ্ণার তীব্র আলো। আপনার কি এতে কোনো সন্দেহ আছে? তিনি বললেন, শয়তান বাসা বেঁধেছে মেয়েছেলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া শক্ত–ধীর স্বরে উত্তর দিলেন পোয়োরো। বাতাসের উপস্থিতি টের পাচ্ছেন না। স্টিফেন লেন বললেন, আপনার চারপাশে অশুভ উপস্থিতি।

এরকুল পোয়ারো ধীরে ধীরে মাথা দুলিয়ে নীরব সম্মতি জানালেন।

০২. রোজামন্ড ডার্নলি

২.১

পোয়ারোর পাশে বসলো রোজামন্ড ডার্নলি এসে। তিনি গোপন করার চেষ্টা করলেন না, তার মনের খুশিকে।

পোয়ারো কখনোও অস্বীকার করেননি, মহিলাদের মতো রোজামন্ড ডার্নলিকেও আন্তরিক শ্রদ্ধা করেন। ওর শরীরের কমনীয় সৌষ্ঠব, চলার গর্বিত ভঙ্গী তার ভালো লাগে। ঠোঁটের হাসিতে ছোট্টশ্লেষের আভাস। তার ভালো লাগে মেঘ-কালো চুলের সাবলীল ঝর্ণা।

তার মাঝে ইতস্ততঃ শুভ্রতার ছোঁয়া পরনে গাঢ় নীল পোশাক। পোয়ারোর নজর এড়ালো না। প্রথম দৃষ্টিতে পোশাকটা সাধারণ মনে হলেও তত্ত্বাবধানে পরিচালিত রোজামন্ড লিমিটেড, লন্ডনের শ্রেষ্ঠ পোশাক তৈরির প্রতিষ্ঠান।

এখানে আমার একদম ভালো লাগছে না, রোজামন্ড বললো, ভাবছি কেন বেড়াতে এলাম, এতো জায়গা থাকতে।

আসেননি, আপনি এখানে আগে।

ইস্টারের ছুটিতে এসেছিলাম, বছর দুয়েরক আগে, এখানে তখন এত লোক ছিল না।

চোখ ফেরালেন এরকুল পোয়ারো ওর দিকে। আপনাকে ভাবিয়ে তোলার মতো কিছু একটা হয়েছে, শান্ত স্বরে বললেন, তাই না?

ধীরে ধীরে পা দোলাতে দোলাতে সম্মতি জানালো। চঞ্চল্ল পায়ের দিকে চোখ নামিয়ে তাকালো। আমি একটা প্রেতাত্মার মুখোমুখি হয়েছি, তারপর বললো, আমার চিন্তার কারণ প্রেতাত্মা মাদমোয়াজেল। হ্যাঁ কিসের কার প্রেতাত্মা, ওহো! নিজেরই আমার। শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলেন, প্রেতাত্মা দুঃখ দিয়েছে আপনাকে। ভীষণ দুঃখ দিয়েছে, জান সে আমাকে নিয়ে গেছে অতীতে। তারপর বললো–ছেলেবেলাকার কথা একবার ভাবুন তো আমার, আপনি তো আর ইংরেজ নন। আপনি পারবেন না, পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, আপনার ছেলেবেলা পুরোপুরি ইংরেজ পরিবেশে কেটেছে? সম্পূর্ণ ইংরেজ পরিবেশে, সবুজ গ্রাম, বিশাল জীর্ণ বাড়ি, কুকুর ঘোড়া, পথ হাঁটা বৃষ্টিতে, বাগানে আপেল গাছ। ছেঁড়া সান্ধ্য পোশাক, যা বছর বছর চলছে। একটা অবহেলিত বাগান। শরৎকাল, মাইকেল ম্যাস ডেইজিরা চোখ-ধাঁধানো নিশানের মতো হাজির হতো।

পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, আপনি অতীতে ফিরে যেচে চান?

মাথা নাড়লো রোজামন্ড, বললো, ফিরে যেতে কেউ পারবে না, কখনও হয় না। কোনো ভাবে ফিরে যেতে পারলে খুশি হতাম, আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে পোয়ারো বললেন। সশব্দে হাসলো রোজামন্ড। সে তো আমারও আছে। পোয়ারো বললেন, যখন ছোট ছিলাম, একটা খেলা ছিল তখন, তার নাম, তুমি যদি না হতে চাও–তুমি কি হতে চাও তবে। এর উত্তর ছোট ছোট মেয়েলি অ্যালবাম রাখা হতো লিখে। নীল চামড়ায় বাঁধানো অ্যালবামগুলো ছিলো, সোনালি পাতে মোড়া ধারগুলো। মাদমোয়াজেল এর উত্তরটা কিন্তু সহজ নয়।

হ্যাঁ, আমারও তাই ধারণা, রোজামন্ড বললো। কেউই বোধহয় রানি এলিজাবেথ হতে চাইবে না। সেটা একটা বিরাট ঝুঁকি। বন্ধু-বান্ধবের কথা যদি বলেন, তাদের ব্যাপারে আমরা বড্ড বেশি জানি। একবার-এক চমৎকার দম্পতির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। পরস্পরের প্রতি ব্যবহার এত উচ্ছল, এত সুন্দর, নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক এত ভালো ছিলো। বিয়ের বহু বছর পরেও আমি মাহিলাটিকে রীতিমতো ঈর্ষা করতাম, ওঁর সঙ্গে জায়গা বদল করতে স্ব-ইচ্ছায় রাজি ছিলাম। কে যেন বললো, আমাকে, পরে ওরা নাকি এগার বছর ধরে কেউ কারো সঙ্গে কথা বলেন না।

ও হাসলো সশব্দে।

বোঝা যায় কারো সম্পর্কে কেউ বলতে পারে না, তাই না?

কয়েক মুহূর্তে নীরবতার পরে পোয়ারো বললেন, অনেকেই আপনাকে কিন্তু ঈর্ষা করবে, মাদমোয়াজেল।

শীতল স্বরে জবাব দিলো রোজামন্ড ডার্নলি, ওহ, হ্যাঁ। স্বাভাবিক ভাবেই। কপালে ভাঁজ পড়লো চিন্তায় ওর, শ্লেষের হাসির ফুটে উঠলো ঠোঁটের বক্রতায়।

আমি সার্থক সত্যিই কোনো মহিলার নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। আমি কোনো শিল্পীর মতো সফল সৃজনশীল আনন্দ পাই (ভালোবাসি জামা-কাপড়ে নকশা করতে সত্যি আমি), সেই সঙ্গে পাই সফল কোনো ব্যবসায়ীর আর্থিক পরিতৃপ্তি। অবস্থা ভালো আমার, ভালো স্বাস্থ্য, মুখশ্রী মোটামুটি, আর তেমন বেশি নয় জিভের ধার। বিস্তৃত হলো ওর হাসি, একটু থামলো ও। আমার কোনো স্বামী নেই অবশ্য। মঁসিয়ে পোয়ারো একটা জায়গায় আমি হেরে গেছি, তাই না?

মনে রাখা সুরে জবাব দিলেন পোয়ারো, আপনি যদি অবিবাহিতা হয়ে থাকেন তার কারণ আমাদের পুরুষদের কেউই আপনাকে তেমনভাবে আকর্ষণ করেনি। নিজস্ব পছন্দ থেকেই আপনি নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নিয়েছেন, প্রয়োজনের জন্য নয়।

আপনিও হয়তো মনে মনে বিশ্বাস করেন, অন্য সব পুরুষদের মতো স্বামী-পুত্র ছাড়া কোনো স্ত্রীলোকাই পূর্ণতা পায় না, রোজামন্ড ডার্নলি বললো।

কাঁধ ঝাঁকালেন পোয়ারো। সাধারণ স্ত্রীলোকের জন্য বিয়ে করা এত সন্তানের মা হওয়া আপনার মতো খ্যাতি প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন এমন মহিলা শয়ে একটা বেশি আরও একটা দেখা যায় হাজারে।

বিস্তৃত হাসলো রোজামন্ড, আমি একটা বিচ্ছিরি আইবুড়ি ছাড়া কিছু নয়, কিন্তু তবুও আজকাল একটা কথাই সব সময় মনে হয়, একটা ছাপোষা শান্ত জোয়ান স্বামী আর এক পাল বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে আমি হয়তো বেশি সুখী হতাম, কথাটা সত্যি তাই না। কাঁধ ঝাঁকালেন পোয়ারো, আপনি যখন বলছেন মাদমোয়াজেল, তখন সত্যি।

রোজামন্ড হেসে উঠলো, একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে রাখলো, ওর ভারসাম্য যেন আবার ফিরে এলো।

মঁসিয়ে পোয়ারো বললেন, আপনি ভালোভাবেই জানেন কিভাবে মহিলাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়।

আপনাদের সঙ্গে আবার তর্ক জুড়ে দিই। মহিলাদের প্রতিষ্ঠার পক্ষে আমি এখন যেভাবে আছি তা আপনি বেশ ভলোভাবেই জানেন বেশ সুখেই আছি। বাগানের নাকি বলবো এই সৈকতের সমস্ত খুবই সুন্দর, মাদমায়াজেল, ঠিক বলেছেন।

সিগারেট কেস বের করলেন পোয়ারো, সন্তর্পণে তুলে নিলেন ছোট্ট সিগারেট। নিতান্তই ধূমপানের প্রতি করুণা বশে। ক্যাপ্টেন মার্শাল একজন পুরনো বন্ধু মাদমোয়াজেল, পোয়ারো উচ্চারণ করলেন মৃদু স্বরে।

রোজামন্ড সোজা হয়ে বসলো। বললো, ওহ কেউ হয়তো বলে থাকবে, মাথা নাড়লেন পোয়ারো। আমি একজন গোয়েন্দা আমাকে কেউ কোনো কথা বলেনি। শত হলেও মাদমোয়াজেল একটু ভেবে দেখুন আমি তো বুঝতে পারছি না। ব্যাপারটা বোঝাতে চাইলেন ক্ষুদে মানুষটি হাত নেড়ে। এখানে এসেছেন এক সপ্তাহের বেশি। আপনি হাসিখুশি মানুষ আজ হঠাৎ বলছেন প্রেতাত্মার কথা। গত কয়েকদিনে কেউ এখানে আসেননি, কাল রাত্রে এসেছেন ক্যাপ্টেন মার্শাল, স্ত্রী ও মেয়ে। আজ এই পরিবর্তন একটা অত্যন্ত স্পষ্ট।

রোজামন্ড ডার্নলি বললো, কথাটা সত্যি। মার্শালরা আমাদের বাড়ির পাশেই থাকতো। মার্শাল আমাদের ছেলেবেলাকার বন্ধু। ভালো ব্যবহার করতো আমার সঙ্গে। কম করে পনেরো বছরের বেশি আমার সঙ্গে দেখা নেই। ও, আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড় হলেও সমবয়েসির মতো মিশতে। গভীর চিন্তার সুর ভেসে উঠলো কণ্ঠে, পনেরো বছর ছিল সুদীর্ঘ সময়। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো রোজামন্ড।

এরকুল পোয়ারো বললেন, কিছুক্ষণ নীরবতার পর, দরদী মানুষ কি বলেন ক্যাপ্টেন মার্শাল উষ্ণ স্বরে রোজামন্ড বললো, খুব ভালো লোকেদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো একজন। ভীষণ শান্ত ও চাপা স্বভাবের মানুষ ও। আজেবাজে বিয়ে করানো ঝোঁক ওর একমাত্র বড় দোষ।

গভীর সমব্যাথীর সুরে বললেন পোয়ারো, হু।

মেয়েদের ব্যাপারে একদম বোকা রোজামন্ড ডার্নলি বলে চললল, আপনার মনে আছে মার্টিংড়োল মামলাটা।

ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠলো পোয়ারোর, মার্টিংডেল! মার্টিংডেল! আর্সেনিক, তাই না।

মহিলাটিকে স্বামীকে খুন করার অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। সতেরো আঠারো বছর আগেকার ঘটনা। ভদ্রলোক নিয়মিত আর্সেনিক খেতেন এ কথা প্রমাণিত হওয়ার পর তার স্ত্রীকে মুক্তি দেওয়া হয়, মেয়েটিকে বিয়ে করে বসলো। তার ছাড়া পাবার পর সাধারণত এই ধরণের বোকার মতো কাজ করে থাকে ও।

মৃদু স্বরে বললেন, এরকুল পোয়ারো, মেয়েটি নির্দোষ হয়ে থাকে যদি। আমার ধারণা মেয়েটি নির্দোষ ছিলো। তার কোনো মানে নেই কাঠগড়ার মেয়েটিকে বিয়ে করতে হবে। বিয়ে করার মতো মেয়ে অনেক আছে, পোয়ারো নীরব রইলেন। নীরব থাকলে জানতেন রোজামন্ড ডার্নলি ওর কথা বলে যাবে। তাই করলো ও, অবশ্য তখন কেনের বয়স ছিল কম। সবে একুশ, প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো ও। বউ মারা গেল লিন্ডার জন্মের সময়। বিয়ের ঠিক এক বছর পর ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলো। স্ত্রীর মৃত্যুতে সে দুঃখকে ভুলবার জন্য কিছুদিন হৈ-চৈ করে কাটিয়ে দেয়।

থামলো ও একটু। এই আর্লেনা স্টুয়ার্টের ব্যাপারটা তারপরেই ঘটলো। আর্লেনা বিভূতে ছিলো তখন। সেখানে কডরিংটন বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা চলছিল। লেডি কডরিংটন তার স্বামীকে ডিভোর্স করেন আর্লেনা স্টুয়ার্টের জন্যই। লোকে বলে একেবারে মজে গিয়েছিলেন লর্ডকডরিংটনের জন্য। সবাই ভেবেছিল ও বিয়ে করবে আদালতের চুড়ান্ত রায় বেরেলেই। কিন্তু তা হল না কার্যক্ষেত্রে। সরাসরি ওকে পাশ কাটালেন লর্ড কডরিংটন। যদুর মনে পড়ে তার নামে মামলা ঠুকছিলো আর্লেনা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অপরাধে। যাই হোক তখন এই ব্যাপারটা নিয়ে প্রচুর হৈ চৈ হয়েছিলো। তার একটা ঘটনা ঘটলো, কেন গিয়ে ওকে বিয়ে করে বসলো। বোকা এক নম্বরের। মিস স্টুয়ার্ট এ ধরনের বোকামির জন্য ক্ষমা করা যায় কোনো পুরুষকে? মৃদু স্বরে বললেন এরকুল পোয়ারো। সে বিষয়ে সন্দেহ নেই বছর তিনেক আগে ওকে নিয়ে হলো আর এক কেলেঙ্কারি। স্যার রজার আরস্কিন মারা যাবার সময় তার সম্পত্তি আর্লেনাকে দিয়ে গেলেন। এই ব্যাপারটাই কেনের চোখ খুলে দেবে। আর কিছু না থোক। তাই কি হয়নি, কাঁধ ঝাঁকালো রোজামন্ড ডার্নলি। বহুদিন দেখা হয়নি ওর সাথে। অবশ্য লোকে বলে–ব্যাপারটা ও ঠান্ডা মেজাজে নিয়েছিলো। সেটাই আমার জানতে ইচ্ছে করে। কেনই বা অন্ধভাবে বিশ্বাস করে ও ওর স্ত্রীকে। হয়তো অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে।

সব ব্যাপারেই নির্বিকার থাকা, নিজের সম্পর্কে সত্যি সত্যি ও কি ধরাণা করে, জানি না। কেউই জানে না। শুধু আমি কেন মিসেস মার্শাল, নিজের স্বামীর সম্পর্কে কি ধারণা তার। পোয়োরোর দিকে রোজামন্ড স্থির চোখে চেয়ে রইল। ও বললো, আর্লেনা? সেরা স্বর্ণসন্ধানী ও পৃথিবীর একটা নরখাদক বাঘিনী। সেই সঙ্গে নতুন খেলা তখন শুধু হতো, যখন কোনো বস্তু ওর একশো গজের মধ্যে আসে। ও ওই ধরনের মেয়ে। ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন পোয়ারো পূর্ণ সম্মতি জানিয়ে। মিসেস মার্শালের চোখ শুধু একটা জিনিসই খুঁজে বেড়ায়, পুরুষ। তিনি বললেন, হ্যাঁ, আপনার কথা মিথ্যে নয়। প্যাট্রিক রেডফানের উপর নজর পড়েছে রোজামন্ড বললো, একটা সোজা ধরনের নিজের স্ত্রীকে ভালোবাসেন তিনি এবং তথাকথিত কলির কেষ্ট নয় আর্নেলার পুরুষরাই এই ধরনের প্রিয় খাদ্য। আমার ভালো লাগে তার বিবর্ণ চেহারায় সৌন্দর্য আছে একটা নিজস্ব প্রতিযোগিতায় তিনি পেরে উঠবেন নরখাদক বাঘিনী আর্লেনার সঙ্গে আমার মনে হয় না। আপনি ঠিক বলেছেন না, পোয়ারো বললেন, যন্ত্রণার ছায়া মুখমণ্ডলে তার।

যতদূর জানি, ক্রিস্টিন রেডফার্ন ইস্কুলের দিদিমণি ছিলেন, রোজামন্ড বললো। যারা বিশ্বাস করেন, সেই ধরনের মহিলা তিনি। ঘটনার প্রভাব থাকে মনের উপর। তিনি এক কঠিন আঘাত পাবেন খুব শিগগীরই।

বিহ্বলভাবে মাথা নাড়লেন পোয়ারো। রোজামন্ড উঠে দাঁড়ালো, বললো, পরিস্থিতি বলুন তো কি বিশ্রী। তারপর অনিশ্চিত সুরে যোগ করলো, কারো অত্যন্ত কিছু করা উচিত এ ব্যাপারে।

.

২.২

লিন্ডা মার্শাল শোবার ঘরের আয়নায় নিজের মুখমণ্ডল শান্তভাবে জরিপ করছিলো। ভীষণ অপছন্দ হলো ওর নিজের মুখ ওর কাছে। এই মুহূর্তে সে মুখের অধিকাংশ হাড় ও বিন্দু বিন্দু দাগের উপস্থিতি প্রকট বলে মনে হলো। ওর একরাশ নরম বাদামী চুল, ধূসর সবুজ চোখ, উঁচু হাড় ও গালের চিবুকের দীর্ঘ উদ্ধত রেখা। ততটা খারাপ নয় মুখ, দাঁতও বিরক্তভাবে লক্ষ্য করলো। দাঁতের সৌন্দর্যে কি আসে যায় নাকের পাশে ওটা কি কোনো দাগ? নিশ্চিত হলাম ওটা কোনো দাগ নয়। ও আপন মনে ভাবছে ভীষণ বিচ্ছিরি ষোলো বছরে পা দেওয়া।

কেউ বুঝতে পারে না এ সময় তার সত্যিকারের অবস্থাটা। লিন্ডা ছোট অশ্বশাবকের মতো হতবুদ্ধি, কোনো শজারুর মতো স্পর্শবিরূপ। প্রতিটি মুহূর্তে সচেতন, নিজের অগোছালো অবস্থা সম্পর্কে প্রতিটি মুহূর্তে ও জানে, দ্বীধাগ্রস্ত ওর মন, খারাপ ছিলো না স্কুলের দিনগুলো। স্কুল ছেড়ে এসেছে এখন ওর ঠিক কেউ জানে বলে মনে হয় না, এরপর ও কি করবে। ওকে প্যারিসে পাঠিয়ে দেবার কথা ওর বাবা ভাসা ভাসা ভাবে বলেছিলেন সামনের শীতে। লিন্ডা প্যারিসে যেতে চায় না, ভালো লাগছে না বাড়িতে থাকতেও। কোনোদিনও স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেনি, ওকি এর আগে ভীষণ অপছন্দ করে আর্লেনাকে। লিন্ডার সবুজ চোখজোড়া হয়ে উঠলো কঠিন, মুখ টান টান হলো উত্তেজনায়।

আর্লেনা, আপন মনেই ভাবলো ও একটা পশু, সবাই বলে সৎমা থাকাটাই ভীষণ বিচ্ছিরি, কথাটা সত্যি। আর্লেনা ওর সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করে তা নয়। বেশির ভাগ সময় খেয়ালই করে না লিন্ডাকে। যখন করে ওর চোখে থাকে এত অবজ্ঞাভরা কৌতুক। আরো বেশি প্রকট করে তোলে, লিন্ডার কিশোরীসুলভ বিশৃঙ্খল অবস্থাকে। আর্লেনার আশেপাশে কেউই নিজেকে ভীষণ অপরিণত অমার্জিত ভেবে লজ্জা পায়…। হাতড়ে চললো লিন্ডা আনাচে-কানাচে খাপছাড়াভাবে। মনের ভাবকে আলাদা করে বেছে নিয়ে নামকরণে অভ্যস্ত নয় ও। মানুষগুলোকে, বাড়িটাকে আর্লেনা কি যেন একটা করে।

লিন্ডা সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবলো ও ভীষণ ভীষণ খারাপ। কিন্তু এখানেই থাকলে চলবে না। নৈতিক উন্নাসিকতায় নাক সিটকে ওকে মনে থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় না। কি যেন করে মানুষগুলোকে, অবাক হয়ে ভাবলো ও এখন সম্পূর্ণ অন্যরকম। ওকে বাবা স্কুল থেকে ফিরিয়ে নিতে আসছেন। জাহাজে করে বেড়াতে যাচ্ছেন বাবা ওকে নিয়ে আর্লেনার সঙ্গে বাবার বাড়িতে। তার মন সেখানে থাকে না। যেন নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নেন।

আমার কাছে অসহ্য দিনের পর দিন মাসের পর মাস এইভাবে চলবে, লিন্ডা ভাবলো। ওর সামনে জীবন দীর্ঘায়িত হলো। আর্লেনার উপস্থিতিতে অন্ধকার ও বিষাক্ত একরাশ দিনের মিছিলে শিশুসুলভ মনে সময় সম্পর্কে এখনও কোনো স্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠেনি। এক একটা বছর যেন অনন্তকাল মনে হয় লিন্ডার কাছে। আর্লেনার প্রতি ঘৃণার এক বিশাল জলন্ত কালো

দূর সমুদ্রের দিকে তাকালো আয়নার উপর চোখ তুলে, সত্যি এ জায়গাটা চমৎকার। সমুদ্রতীর মনোরম, নির্জন উপকূল আর পায়ে চলার আঁকাবাঁকা পথ বিচিত্র। অজানা জায়গা আবিষ্কারের আনন্দ। একা একা খুশিমতো হুল্লোড় করার জায়গা। ছেলেরা তাই ওকে বলেছিলো, গুহাও আছে। লিন্ডা ভাবলো, আর্লেনা যদি এখান থেকে চলে যেত আমি আনন্দ করতে পারতাম তাহলে। এখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলো মন ফিরে গেলো সেই বিকেলে। বেশ মজা হয়েছিল মূল ভূখণ্ড থেকে দ্বীপে আসাটা। তখন জোয়ারের জলে ডুবে ছিল কংক্রিটের সেতুটা। ওরা আসে নৌকা করে। অদ্ভুত বলে মনে হয়েছিল। হোটেলটাকে দেখে, সামনে বসে থাকা একজন লম্বা তামাটে চোহারার মহিলা ওদের দেখে লাফিয়ে উঠেছেন, আরে কেনেথ বললেন। ওর বাবা বিস্মিতভাবে বলে উঠেছেন ভীষণ অবাক চোখে তাকিয়ে রোজামন্ড।

রোজামন্ড তারুণ্যের চুল চেরা বিচার করলো, লিন্ডা সিদ্ধান্ত নিলেও মেনে নিতে পেরেছে রোজামন্ডকে বেশ বুদ্ধিমতী। রোজামন্ড ভাবলো চোহারার সঙ্গে মানিয়ে তৈরি ওর চুলটা। বেশিরভাগ লোকের চোহারার সঙ্গে চুল মানায় না। এছাড়া ওর পোষাক ছিল সুন্দর, ওর মুখে যেন এ অদ্ভুত খুশি। এই খুশির লক্ষ্য রোজামন্ড নিজে অন্য আর কেউ নয়। রোজামন্ড লিন্ডার সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করেছে। আজেবাজে কথা বলেনি কখনও। যাতে মনে হয় লিন্ডাকে ও বোকা ভাবছে। রোজামন্ড কখনো এমন ভাবে করেনি। সত্যি কথা বলতে কি, লিন্ডাকে সত্যিকারের মানুষ মনে করেই ওর সঙ্গে কথা বলছে রোজামন্ড। লিন্ডার নিজেকে কম সময় সত্যিকারের মানুষ বলে মনে হয়, কেউ ওকে মর্যাদা দিলে তার প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ হয়ে পড়ে।

বাবা খুশি হয়েছে মিস ডার্নলিকে দেখে। আশ্চর্য, মুহূর্তে বদলে গেছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। ওকে দেখে মনে হচ্ছে লিন্ডা। হ্যাঁ অনেক ভেবে ঠিক করলো কমে গেছে বয়স। তিনি হেসে উঠলেন। এক অদ্ভুত বালকসুলভ হাসি। বাবাকে সে খুব কম সময়ে হাসতে দেখেছে। লিন্ডার হঠাৎ মনে পড়লো।

অন্য এক মানুষের ঝলক দেখতে সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ। ও কেমন বিহ্বল হয়ে পড়ল। ও ভাবলো আমার বয়েসের সময় বাবা কেমন ছিল।

ও হাল ছেড়ে দিলো ও ভাবা অনেক শক্ত। ওর মনে একটা নতুন চিন্তা ঝলসে উঠলো। এখানে এসে মিস ডার্নলির সঙ্গে দেখা পেতো শুধু ও আর ওর বাবা, কি মজাই না হতো।

ফুটে উঠলো এক কল্প-দৃশ্য, কিছুক্ষণের জন্য খুলে গেলো কল্পনার দরজা। ছোট ছেলের মতো হাসছে বাবা, মিস ডার্নলি, আর ও নিজে এই দ্বীপের সমস্ত মজা, গুহা, আনন্দ অন্ধকারের ঢেউয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। কেন সম্ভব নয়, আর্লেনার সঙ্গে থাকলে কে জানে ওর পক্ষে সম্ভব, কিন্তু লিন্ডারের পক্ষে সম্ভব নয়। কাছাকাছি থাকে এমন কেউ কে সুখী হতে পারে। ঘৃণা করে আর্লেনাকে, ও ঘৃণা করে।

অত্যন্ত ধীর ঘৃণায় জ্বলন্ত ঢেউ আবার উথলে উঠলো। ফ্যাকাসে হয়ে গেলো লিন্ডার মুখ। সামান্য ফাঁক হলো ঠোঁট দুটো চোখের তারা তীক্ষ্ণ হয়ে এলো। বাতাস আঁকড়ে ধরলো আঙুলগুলো ক্রমশ।

.

২.৩

কেনেথ মার্শাল স্ত্রীর ঘরের দরজায় টোকা মারলেন। ওর সাড়া পেতেই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। আর্লেনা তখন শেষবারের মতো সাজগোজ দেখে নিচ্ছিলো। ওর পরনে মৎসকন্যার মতো চোখ ধাঁধানো সবুজ পোশাক। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ম্যাস্কারা লাগাচ্ছিল চোখের পাতায়। ও, তুমি। হ্যাঁ, তোমার হলো কিনা দেখতে এলাম। কেনেথ মার্শাল এগিয়ে গেল ধীর পায় জানলার কাছে, সমুদ্রের দিকে তাকালেন। তার মুখমণ্ডল বরাবরের মতোই অভিব্যক্তিহীন। সেই সঙ্গে শান্ত ও স্বাভাবিক। আর্লেনা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল।

তুমি চিনতে না রেডফার্নকে আগে। হ্যাঁ সোনা, আর্লেনা সহজ ভাবেই উত্তর দিলেন। কোনো এক পার্টিতে দেখা হয়েছিল। ওকে আমার বেশ ভালো লেগেছিলো।

তুমি কি জানতে সে এবং তার স্ত্রী বেড়াতে আসছে। আর্লেনা গভীর আয়তন চোখ মেলে ধরলো। ভীষণ অবাক হয়ে গেছো না সোনা।

শান্ত স্বরে কেনেথ মার্শাল বললেন, ভাবছিলাম আমি এ জায়গার কথা তোমার মাথায় এসেছে, কারণ সেটা তুমি জানতে। আমরা যাতে এখানে আসি তুমি বরাবরই একটু বেশি আগ্রহ দেখিয়েছো, আর্লেনা স্বামীর দিকে ঘুরে তাকাল, ম্যাস্কারা নামিয়ে রাখল। নেশা ধরানো নরম হাসি হাসলো। বললো, এ জায়গাটার কথা কে যেন আমাকে বলেছিলো। মনে হয় রাইল্যান্ডরা! ওরা বলেছিলো জায়গাটা খুব সুন্দর চমৎকার। কেন তোমার ভালো লাগছে না।

কি জানি, জানি না, কেনেথ মার্শাল বললেন। কেন তুমি তো ভালোবাসো সমুদ্রে স্নান করতে ঘুরে বেড়াতে। তোমার নিশ্চয় ভালো লাগবে এখানে। জায়গাটা তোমার অত্যন্ত ভালোই লাগবে, বেশ বুঝতে পারছি।

আর্লেনার চোখের আয়ত আরও বিস্তৃত হলো। কেনেথ মার্শালের দিকে তাকালো অনিশ্চিত দৃষ্টিতে। কেনেথ মার্শাল বললেন, আসল ব্যাপারটা হলো, তুমি রেডফার্নকে জানিয়েছে আগেই, তুমি এখানে এসেছে।

আর্লেনা বললো, তুমি এরকম কথা বলছ কেন কেনেথ সোনা?

শোনো আর্লেনা, কেনেথ মার্শাল বললেন, তুমি কি ধরনের মেয়ে আমি জানি। তাই বলছি মোটামুটি সুখী স্বামী-স্ত্রী রেডফার্নরা। ওর বউকে ভালোবাসে ছেলেটা সত্যি। ওদের সুখের সম্পর্কে চিড় ধরুক তুমি কি চাও?

আর্লেনা বললো, দোষ দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? কেন আমি তো কিছু করিনি। আমি কি করতে পারি, কিছুই করিনি। চোখের পাতায় কাঁপন ধরলো আর্লেনার।

আমি অবশ্য জানি; পুরুষরা আমাকে দেখে পাগল হয়ে যায়। ওদের অমনি হয়, কিন্তু সে আমার দোষ নয়।

রেডফার্ন তোমার জন্য পাগল তুমি তাহলে স্বীকার করছে। নিছকই ওর বোকামি, আর্লেনা অস্পষ্ট স্বরে জবাব দিলো। এক পা এগিয়ে গেল স্বামীর দিকে।

তুমি ছাড়া আর কারো কথা আমি ভাবি না, তুমি তো জানো।

কৃষ্ণাভ চোখের পাতার ফাঁকে কেনেথ মার্শালের চোখে তাকালো আর্লেনা। সে দৃষ্টি এক কথায় বিস্ময়কর… যা খুব কম পুরুষই প্রতিরোধ করতে পারে। কেনেথ মার্শাল গম্ভীরভাবে চোখ নামালেন আর্লেনার চোখে। তার মুখ অভিব্যক্তিহীন। শান্ত কণ্ঠে আর্লেনা বললেন, আমার ধারণা আমি বেশ ভালোভাবেই চিনি।

.

২.৪

দক্ষিণ দিকে বেরোলেই আপনার চোখে পড়বে হোটেলের বিস্তৃত বাঁধানো উঠোন। সমুদ্রতীর তার নিচেই। পাহাড়টার কোল ঘেঁষে আরও একটা দ্বীপকে ঘিরে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গেছে। কিছুটা গেলে কয়েক ধাপ সিঁড়ি সেই পথ ধরে আপনাকে নামিয়ে নিয়ে যাবে পাহাড়র পাথর কেটে তৈরি কতকগুলো কৃত্রিম কুঠুরির দিকে। সানি লজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে হোটেল থেকে প্রচারিত দ্বীপের মানচিত্রের এই জায়গাটাকেই। কতকগুলি বেদি বসাবার জন্য কৃত্রিম গুহাগুলোর ভেতর পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। প্যাট্রিক রেডফার্ন ও তার স্ত্রী এসে বসলো নৈশভোজের ঠিক পরেই এই রকমের একটা গুহায়। রাতের উজ্জ্বল চাঁদ স্পষ্ট চোখে পড়ছে। চুপচাপ রইল কিছুক্ষণ ওরা। ক্রিস্টিন আজকের রাতটা খুব সুন্দর তাই না, মুখ খুললো প্যাট্রিক রেডফার্ন। হু–

প্যাট্রিক অস্বস্তি বোধ করলো, কণ্ঠস্বরে একটা অদ্ভুত সুরের আভাস পেল। চুপচাপ বসে রইলো ওর দিকে না তাকিয়ে। ক্রিস্টিন শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলো, তুমি কি জানতে যে, ওই মেয়েটি এখানে আসছে?

বললো, তার মানে, প্যাট্রিক চমকে ঘুরে তাকালো।

মানেটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছো আমার মনে হয়। ক্রিস্টিন হঠাৎ তোমার কি হয়েছে জানি না।

ক্রিস্টিন বাধা দিলো, ওর স্বরে আবেগের স্পর্শ। শরীর কাঁপছে ওর।

কি হয়েছে আমার? কিছু হয়নি আমার; হলে তোমার হয়েছে। কিছু একটা হয়েছে প্যাট্রিক। তুমি প্রথম থেকেই জোর করছিলে, এখানে আসার জন্য। আমাদের টিণ্টাজেলে হানিমুন কেটেছিলো, আমি ওখানেই যেতে চেয়েছিলাম, আমার কোনো কথা কানে তোলনি তুমি, গোঁ ধরেছিলে এখানে আসার জন্য। জায়গাটা অত্যন্ত চমৎকার তাতে কি হয়েছে, তুমি যেহেতু এখানে আসতে চেয়েছিলে সেহেতু ও এখানেই আসছে। ও মানে তুমি যার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে, মিসেস মার্শাল।

ক্রিস্টিন, ভগবানের দোহাই বোকার মতো কথা বলো না, কাউকে ঈর্ষা করা তো স্বভাব নয় তোমার। প্যাট্রিকের স্বরে উন্মত্ত ক্রোধের অনিশ্চিত সুর এবং তার তীব্রতা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি।

আমরা কত সুখী ছিলাম, ক্রিস্টিন বললো। সুখী, নিশ্চয় সুখী তো ছিলাম। হ্যাঁ এখনও আছি। তুমি যদি কোনো মেয়ের সঙ্গে দুটো কথা বলতে আমাকে দেখ, তাহলে অমনি খুঁচিয়ে ঝগড়া করো। এরকম করতে থাকলে আর বেশি দিন সুখে থাকা সম্ভব নয়।

না, তা নয়?

হ্যাঁ তাই। বিয়ের পর কোনো পুরুষের অন্য লোকেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়াটা নেহাই। স্বাভাবিক। এ ধরনের সন্দেহজনক মনোভাব মোটেই ঠিক নয়। তোমার এই ধারণা কোনো সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে কথা বললে তার আমি প্রেমে পড়েছি। সে থামলো তারপর কাঁধ ঝাঁকালো।

তুমি সত্যিই ওর প্রেমে পড়েছো, ক্রিস্টিন রেডফার্ন বললো।

ক্রিস্টিন, ও বোকামি করো না, আমি ওর সঙ্গে ভালো করে কথা পর্যন্ত বলিনি।

মিথ্যে কথা।

প্রতিটি সুন্দরী মেয়েকে ঘিরে আমাকে সন্দেহ করা ছাড়ো, দোহাই তোমার। ক্রিস্টিন বললো, ও মেয়ে একটা সুন্দরী নয়। ও, ও একটা নষ্ট মেয়েছেলে। প্যাট্রিক ও আমার ক্ষতি করবে। চলো আমরা এখান থেকে চলে যাই, আমার কথা শোনো। এসব ছেড়ে দাও।

প্যাট্রিক রেডফার্নের বিদ্রোহী ভাব চিবুকে ফুটে উঠল। তাকে বয়সের তুলনায় অনেক তরুণ দেখালো। প্রতিবাদের সুরে বলে উঠলো, ক্রিস্টিন একটু ভেবে চিন্তে কথা বলে। এ নিয়ে আর ঝগড়া করো না।

ঝগড়া তো করছি না আমি। সুস্থ-স্বাভাবিকের মতো আচরণ করো, এসো হোটেলে ফিরে যাওয়া যাক, উঠে দাঁড়ালো প্যাট্রিক। ক্রিস্টিন রেডফার্নও উঠে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ নীরব থেকে, আচ্ছা চলো, ও বললো।

কুঠুরীতে বসে গভীর দুঃখে মাথা নাড়লেন এরকুল পোয়ারো। কেউ হয়তো সাধারণ ভদ্রতাবোধেই এই ব্যক্তিগত কথাবার্তার শ্রবণ-সীমার বাইরে নিজেকে সরিয়ে নিতেন। এরকুল পোয়ারো তা নয়, এ ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ বিবেকহীন।

তার বন্ধু হেস্টিংসের কাছে ব্যাখ্যা করছিলেন পরে কোনো একদিন। এই ঘটনার সঙ্গে কোনো খুনের প্রশ্ন জড়িয়ে ছিল।

অবাক চোখে চেয়ে দেখে বলছেন হেস্টিংস, তখন তো খুনটা হয়নি। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এরকুল পোয়ারো, বললেন, না হয়নি। কিন্তু বন্ধু সেই মুহূর্তেই আমি তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পেয়েছিলাম।

তুমি রুখলে না কেন তাহলে। এরকুল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলছিলো..এই কথাটা তিনি একবার মিশরেও বলেছিলেন, মানুষ খুন করার জন্য সে যদি বদ্ধপরিকর হয় তাকে বাধা দেওয়া নেহাৎ সহজ কাজ নয়। তিনি কখনো দোষারোপ করেননি পরবর্তী ঘটনার জন্য। অনিবার্য ছিলো তার মতে খুনটা।

০৩. নরম ঘাসের সমতলে

৩.১

রোজামন্ড ডার্নলি ও কেনেথ মার্শাল গাল কোভ-এর নরম ঘাসের সমতলে পাশাপাশি বসেছিলেন।গাল কোভ দ্বীপের পূর্বদিকে অবস্থিত। ভোরের দিকে লোক এসে গেছে নির্জনে স্নান করতে। রোজামন্ড বললো, নির্জনে কাটাতে বেশ ভালো লাগে নোকজনের সঙ্গ ছেড়ে। মার্শাল নিচু স্বরে বিড়বিড় করলেন,—হুঁ। তিনি উপুড় হয়ে ছোট ছোট ঘাসের গন্ধ নিলেন। শিপলির সেই মাঠগুলোর কথা মনে পড়ে, চমৎকার গন্ধ।

কি সুন্দর ছিলো দিনগুলো। হু। রোজামন্ড তুমি বেশি বদলাওনি।

বদলে গেছি হ্যাঁ, অনেক বদলে গেছি।

তুমি সেই রোজামন্ডই আছে। এখন তোমার অনেক নাম হয়েছে, টাকা পয়সা হয়েছে অনেক। মৃদুস্বরে বললো-রোজামন্ড যদি তাই থাকতে পারতাম। তার মানে? ছেলেবেলাকার সুন্দর স্বভাব কিছু না। ভাবতেও অবাক হয়। কোনোটাই চিরকাল ধরে রাখতে পারি না, উঁচু আদর্শ তাই না?

কোনোকালেই সুন্দর ছিলো না তোমার স্বভাব। বৎসে তার পরিচয় আমি পাই। তুমি মাঝে মাঝে যে ভাবেই রেগে উঠতে একদিন তো আমার গলাই টিপে ধরেছিলে রাগে ঝাঁপিয়ে।

সশব্দে হাসলো রোজামন্ড, সেদিন ভোঁদর ধরতে গিয়েছিলাম, টোবিকে নিয়ে। তোমার মনে আছে সেদিনটা। বেশ কিছু সময় কেটে গেল অতীত অভিযানের স্মৃতিচারণে। কয়েক মুহূর্তের নীরবতা অবশেষে নেমে এল। রোজামন্ড ব্যাগের ফিতে নিয়ে খেলা করতে লাগলো, কেনেথ, অবশেষে বললো। অস্পষ্ট স্বরে উত্তর এলো কেনেথ মার্শালের, তখনও তিনি সবুজ ঘাসে মুখ লুকিয়ে আছেন।

এমন কিছু বলি আমি হয়তো যা পুরোপুরিই অনধিকার চর্চা তুমি তাহলে কি আমার সঙ্গে আর কথা বলবে না, ঘুরে উঠে বসলেন কেনেথ মার্শাল। আমার মনে হয় না, আন্তরিক সুরেই বললেন তিনি। তোমার কোনো কথাকেই অনাধিকার চর্চা বলে ভাবতে পারি? তোমার সে অধিকার আছে, তুমি তো জানেনা।

কেনেথ মার্শালের শেষ কথাগুলোর অর্থ মেনে নিলো রোজামন্ড, ও গোপন করলো ক্ষণিকের পাওয়া সুখটুকু।

কেনেথ তুমি বিবাহ বিচ্ছেদ চাইছ না কেন তোমার স্ত্রীর কাছে? কেনেথ মার্শালের মুখমণ্ডলে পরিবর্তন এলো। খুশি খুশি অভিব্যক্তিটুকু ধীরে ধীরে মিলিয়ে গিয়ে নেমে এলো কঠিনতার ছোঁয়া। তামাক ভরতে লাগলেন পকেট থেকে পাইপ বের করে। রোডমন্ড বললো, দুঃখিত তোমায় আঘাত দিয়ে থাকলে।

তিনি বললেন শান্ত স্বরে, না আঘাত তুমি দাওনি। কেন তা করছি না, বুঝবে না তুমি।

খুব ভালোবাসো তুমি কি ওকে?

আমি ওকে বিয়ে করেছি, এটা শুধু ভালোবাসার প্রশ্ন নয়, ওর অনেক বদনাম আছে জানি। কিছুক্ষণ কথাটা ভাবলেন তিনি সতর্ক হাতে তামাক ঠুকতে ঠুকতে। হয়তো আছে, কি জানি তুমি ওকে ডিভোর্স করতে পারো না কেন।

মার্শাল বললেন, সোনা এ নিয়ে তোমার মাথা না ঘামানোই ভালো। এ কথা মনে করার কোনো কারণ নেই। পুরুষরা ওকে দেখে জ্ঞানগম্যি হারিয়ে ফেলে বলে, ওর ঐ একই অবস্থা হয়। মুখের মতো একটা জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেলো রোজামন্ড। তারপর বললো, এমন একটা ব্যবস্থা করো, যাতে তোমাকে ডিভোর্স করে তুমি যেভাবেই চাও।

সম্ভব নয় বোধহয়।

পারতেই হবে তোমাকে ঠাট্টা করে বলছি না। মেয়ের কথাটা তত তোমায় ভাবতে হবে। লিন্ডা, লিন্ডা হা। লিন্ডার সঙ্গে এর কি সম্পর্ক? আর্লেনা মোটেই ভালো নয় লিন্ডার পক্ষে। আজকাল লিন্ডা অনেক কিছু বেশ বুঝতে পারে।

দেশলাই জ্বেলে পাইপে অগ্নিসংযোগ করলেন কেনেথ মার্শাল। সে মিথ্যা কথা নয়, ধোঁয়া ছাড়বার ফাঁকে তিনি বললেন। আমার মনে হচ্ছে আর্লেনা ও লিন্ডা মানিয়ে চলতে পারছে না। এটা ভালো নয়, ছোট মেয়ের পক্ষে। দুশ্চিন্তা সেই জন্য আমার।

লিন্ডাকে আমার খুব ভালো লাগে। রোজামন্ড বললো, ওর মধ্যে ভালো লাগার মতো কি যেন একটা আছে।

ও ঠিক ওর মায়ের মতো, কেনেথ বললেন, সব কিছুই ভীষণ গভীরভাবে নেয়, যেমন রুথ নিতো। এরপর মনে হয় না, রোজামন্ড বললো, আর্লেনাকে ত্যাগ করা উচিত তোমার মামলা সাজিয়ে বিবাহ-বিচ্ছেদের। হা, সবাই তাই করে আজকাল। কেনেথ মার্শাল রুক্ষ স্বরে বলে উঠলেন। হ্যাঁ, এ জিনিষটা সব চেয়ে ঘেন্না করি। ঘেন্না করো? ও ভীষণ চমকে গেলো। আজকাল জীবন যেন বড়ো খেলো হয়ে গেছে। যদি কোনো জিনিষ নিয়ে পড়ে সেটা ভালো লাগে না। সেটাকে ত্যাগ করতে আজকাল আর বাধা নেই। আশ্চর্য, মানুষের মনে বিশ্বাস বস্তুটা থাকা উচিত। একমাত্র তোমারই দায়িত্ব যদি কোনো মেয়েকে বিয়ে কর তাহলে তার ভরণপোষণের ভার একমাত্র তোমার। কারণ এ খেলা তুমিই শুরু করেছে। আমার ঘেন্না ধরে গেছে, বিয়ে হচ্ছে সহজ এবং আরও সহজ বিবাহ বিচ্ছেদ। আমার কাছে সব চেয়ে বড় কথা আর্লেনা আমার স্ত্রী।

রোজামন্ড সামনে ঝুঁকে নিচু স্বরে বললো, ব্যাপারটা অনেকটা সে রকমের তোমার কাছে অনেকটা। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন কেনেথ মার্শাল। হ্যাঁ ঠিক তাই, তিনি বললেন। ও রোজামন্ড বললেন।

.

৩.২

একটা সঙ্কীর্ণ সর্পিল পথে লেদারকোম্ব উপসাগরে ফেরার পথে একটা বাকের মুখে মিসেস রেডফার্নকে একটু হলেই চাপা দিচ্ছিলেন হোরেস ব্ল্যাট। ক্রিস্টিন রাস্তার পাশে সারি দেওয়া গা ঘেঁষে দাঁড়াতেই সশব্দে ব্রেক কষে থামলেন মিঃ ব্ল্যাট। বিশাল চোহারার পুরুষ মিঃ ব্ল্যাট। লালচে আভাস মুখের রঙে, তার চকচকে টাককে বৃত্তাকার পথে ঘিরে রেখেছে হালকা লাল চুলের আস্তরণ। সে জায়গার মধ্যমণি হয়ে থাকার ইচ্ছেটাই মিঃ ব্ল্যাটের একমাত্র উচ্ছ্বাস। যে জায়গাতেই নিয়ে যাক না কেন, তিনি এ মত প্রকাশ করেছেন সোচ্চারই। জলি রজার আনন্দ সঞ্জীবনীসুধার কিঞ্চিত প্রয়োজন আছে। ঘটনাস্থলে যখনই উপস্থিত হন, সেখানকার লোকেরা যে পদ্ধতিতে নিজেদের ক্রমশ অদৃশ্য এবং দ্রবীভূত করে ফেলে। রীতিমতো অবাক লাগে তার।

স্ট্রবেরিলর আচার বানিয়ে ফেলেছিলাম, আরেকটুকু হলেই বলেন কি? মিঃ ব্ল্যাট খুশির সুরে বললেন, হ্যাঁ সে আর বলতে, ক্রিস্টিন জবাব দিলো। মিঃ ব্ল্যাট বললেন, ঝটপট উঠে আসুন। আমার হাঁটতে ভালো লাগছে, ধন্যবাদ।

মিঃব্ল্যাট বললেন, যত্তো সব। তাহলে গাড়ির জন্ম হয়েছে কি করতে? ক্রিস্টিন রেডফার্ন নিরুপায় হয়েই উঠলো গাড়িতে।

ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো আচমকা ব্রেক কষে রাখার ফলে। বোতাম টিপে আবার চালু করলনে। মিঃ ব্ল্যাট প্রশ্ন করলেন, আপনি একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন কেন বলুন তো? আপনার মতো সুন্দরী মেয়ের পক্ষে ব্যাপারটা ঠিক নয়।

উঁহু একা থাকতে আমার ভালো লাগে, ক্রিস্টিন বললো। এক খোঁচা মারলেন কনুই দিয়ে ওকে মিঃ ব্ল্যাট। একই সঙ্গে গাড়িটা নিয়ে আর একটু হলে পাশের ঝোপে ধাক্কা মারছিলেন। ওই কথাই বলে মেয়েরা সবসময়–তিনি বললেন। ওদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। মনের কথা আসলে ওটা ওদের। জলি রজার হোটেল, আমাদের ওটাকে ঘষে মেজে চাঙ্গা করে তোলার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কোনো মিল নেই, মনের সঙ্গে চরিত্রে প্রাণ নেই কোন। শুধু ভিড় করেছে একগাদা বাজে লোক এসে। প্রথমেই একপাল বাচ্চাকাচ্চা ধরুন। আর নীরস বুড়োবুড়িগুলি। এছাড়া রয়েছে বিরক্তিকর বুড়োটা ভারতবর্ষ ঘুরে আসা। আমাদের পাদ্রীসাহেব আর ঐ বিদেশীটা গোঁফওয়ালা। আমার হাসি পায় ওর গোঁফ দেখলেই। লোকটা নাপিত-টাপিত না হয়ে যায়। মাথা নাড়লো ক্রিস্টিন, উনি একজন গোয়েন্দা। উঁহু, মিঃ ব্ল্যাটের গাড়ি অল্পের জন্য সংঘর্ষের জন্য হাত থেকে রেহাই পেলো।

উনি ছদ্মবেশে রয়েছেন, আপনি বলতে চান গোয়েন্দা? হালকাভাবে হাসলো ক্রিস্টিন। না ও বললো, ওকে দেখতেই ওইরকম এরকুল পোয়ারো, শুনে থাকবেন আপনি নিশ্চয়ই ওঁর নাম।

নামটা প্রথমে ঠিক বুঝতে পারিনি, মিঃ ব্ল্যাক বললেন, হ্যাঁ ভদ্রলোকের নাম শুনেছি। যাই বলুন, আমার ধারণা ছিলো তিনি মারা গেছেন। উনি এখানে এসেছেন কি মতলবে? এরকম গোঁফওয়ালা গোয়েন্দারা মরে যাওয়াই উচিত। এমনিই ছুটিতে বেড়াতে এসেছেন, কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আসেননি।

হতে পারে হু। মিঃ ব্ল্যাটকে এ ব্যাপারে মনে হয় লোকটা একটু কাঠখোট্টা ধরনের তাই না?

ইতস্ততঃ করে বললো, হ্যাঁ। মানে–অদ্ভুত ধরনের একটু বলতে পারেন।

মিঃ ব্ল্যাট বললেন, আমার কথা হলো, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড কি ঘুমিয়ে রয়েছে? আমি আর কাউকে ভরসা করি না শুধুমাত্র ইংরেজ ছাড়া।

মিঃ ব্ল্যাট বিজয়ীর ভঙ্গীতে ঘনঘন হর্ণ বাজিয়ে জুলি রজারের গ্যারেজে ঢুকিয়ে দিলেন, গ্যারেজটা হোটেলের ঠিক বিপরীত দিকে মূল ভূ-ভণ্ডে অবস্থিত।

.

৩.৩

লেদারকোম্ব উপসাগরের একটা বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে ছিল লিন্ডা মার্শাল। দোকানে সারি সারি বই সাজানো কতকগুলো বইয়ের তাক। বই পড়ে নিতে পারেন দু পেনির বিনিময়ে। বইগুলো দশ বছরের পুরানো। আবার অনেকগুলো বিশ বছরের পুরানো আর বাকিগুলো আরো পুরানো।

লিন্ডা তাক থেকে বই নামানো প্রথমে একটা, তারপর আর একটা। মনে হল দি ফোর ফেদার অথবা ভাইসি ভার্সা কোনোটাই ভালো লাগবে না ওর পড়তে। তাই বাদামি মলাটের একটা ছোট বই নামিয়ে নিলো।

ক্রিস্টিন রেডফার্নের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েই চমকে উঠলো লিন্ডা, তাকে আবার বইটাকে গুঁজে রাখলো নিমেষের মধ্যে। লিন্ডা কি বই পড়ছো?

লিন্ডা জবাব দিলো তাড়াতাড়ি, না কিছু না। খুঁজছি এখটা ভালো বই, দি ম্যারেজ অফ উইলিয়াম অ্যাশ বইটা ভালো করে না দেখেই টেনে বার করল। কাউন্টার দুপেনি দিলো। মিঃ ব্ল্যাট আমাকে পৌঁছে দিলেন, ক্রিস্টিন বললো, আমার সাহসে কুলোবে না সেতুটা পার হওয়া। কেনাকাটা করার বাকি আছে বলে তাই চলে এসেছি।

ভদ্রলোক বড় সাংঘাতিক তাই না। লিন্ডা বললো, যত সব বীভৎস রসিকতা করেন। আর শুধু টাকার গরম দেখান।

বেচারা। ওঁর জন্য দুঃখ হয়, ক্রিস্টিন বললো, একমত হতে পারলাম না। লিন্ডা মিঃ ব্ল্যাটের জন্য দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ওঁর জন্য দুঃখিত কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। ও কিশোরী এবং নির্মম। লিন্ডা দোকান ছেড়ে বেরিলয়ে পড়লো। ক্রিস্টিন রেডফার্ন কংক্রীটের সেতুর দিকে এগিয়ে চললো ঢালু রাস্তা ধরে।

লিন্ডা তখন নিজের চিন্তায় ব্যস্ত। ওর ভালো লাগে ক্রিস্টিন রেডফার্নকে। মনে হয় ওর ক্রিস্টিন রেডফার্নকে এবং ক্রিস্টিন এই দুজনকেই সহ্য করা যায় কেবল। প্রথমত লিন্ডার সঙ্গে বেশি কথা বলে না ওরা। ওর পাশে পাশে হাঁটছে ক্রিস্টিন নীরবে। বুদ্ধিমতীর পরিচয় এটাই। লিন্ডা ভাবলো, সত্যি যদি কিছু বলার না থাকে শুধু শুধু বকবক করার দরকার কি আছে।

কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেল নিজের জটিলতায় নিজেই।

মিসেস রেডফার্ন হঠাৎ এক সময় বললো, কখনও মনে হয়নি আপনার। এত বিশ্রী এত ভয়ঙ্কর যেন ঠিক ফেটে পড়ার মতো এখানে সবকিছু।

প্রায় কথাগুলো হাস্যকর, চিন্তা-কুটিল কঠিন মুখে হাসির লেশমাত্র নেই লিন্ডার। ওর দিকে তাকালো ক্রিস্টিন রেডফার্ন, অনিশ্চিত অবুঝ কিন্তু ওর নজরে পড়লো না ও কিছু উপহাস করার মতো। ওর শ্বাস-প্রশ্বাস স্তব্ধ হল মুহূর্তের জন্য। হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক এই জিনিষটাই ও বলছে।

.

৩.৪

আঁ আপনি মশাই বিখ্যাত গোয়েন্দা। ওঁরা বলেছিলেন জলি রজারের পানশালায়। মিঃ ব্ল্যাটের প্রিয় বিচরণ ক্ষেত্র।

এরকুল পোয়ারো স্বভাবসিদ্ধ বিনীত ভঙ্গিতে ব্ল্যাটের বক্তব্যকে সমর্থন করলো। বলে চললেন মিঃ ব্ল্যাট, কোনো কাজের জন্য এখানে এসেছেন? না-না এমনি ছুটিতে বেড়াতে এসেছি। আমারও তো মাঝে মাঝে বিশ্রামের প্রয়োজন। চোখ টিপলেন মিঃ ব্ল্যাট। মশাই ঐ কথাই বলবেন তাই না?

মিথ্যা বলে লাভ কি বিনা প্রয়োজনে–জবাব দিলেন পোয়ারো।

সত্যি কথা বলতে কি আমার কাছে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, হোরেস ব্ল্যাট বললেন, বলেই ফেলুন না বহু বছরের বিদ্যেটা মশাই যা শুনি হজম করে দিই। এ কাজ যদি না পারতাম আজকে এই অবস্থায় পৌঁছতে পারতাম না। বেশির ভাগ লোক কিছু কথা শুনলে যতক্ষণ না সেই শোনা কথা উগরে দিতে পারে ততক্ষণ সেই লোকেদের স্বস্তি পায় না। জিনিষটাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। সেই কারণেই আপনাকে ভান করতে হবে যে, আমি শুধু এখানে ছুটি কাটাতেই এসেছি। আর অন্য কোন কারণ নেই।

আপনি এর উল্টোটাই বা ভাবছেন কেন? পোয়ারো প্রশ্ন করলেন। মিঃ ব্ল্যাট মশাই ঘোড়েল লোক, চোখ টিপে বললেন। চরিত্র চেহারা দেখেই বুঝতে পারি। স্বাভাবিক ছিলো আপনার মতো লোকের পক্ষে দভিল লা টোকে অথবা জুয়ান-লা-পিন্স আত্মিক যোগ থাকা সম্ভব। জায়গাগুলোর সঙ্গে আপনার মন কি বলে? দীর্ঘশ্বাস ফেললেন পোয়ারো, তিনি জানলা দিয়ে বাইরে চোখ রাখলেন। অঝোর বর্ষণ কুয়াশা ঘেরা দ্বীপে শুধু হয়েছে। আপনার কথাই ঠিক, তিনি বললেন। সেখানে বর্ষার আবহাওয়ার আয়োজন রয়েছে ভিন্ন। জুয়ার আড্ডা আমার প্রিয়, মিঃ ব্ল্যাট বললেন। কঠোর পরিশ্রমে বেশির ভাগ সময় কেটে গেছে, জীবনের কোনো সময় নেই আজ তা পেয়েছি, চেয়েছিলাম সম্মান, আমার টাকার দাম কারোর থেকে কম না, আমার যা মন চাইবে তাই করব বা করতে পারি। এটুকু বলতে পারি এ বছরে কিছু কিছু সুখ আনন্দ আমি দেখেছি।

অস্পষ্ট স্বরে পোয়ারো বললেন, তাই নাকি? মিঃ ব্ল্যাট বলে চললেন, কেন আমি এলাম। আমিও ভেবে অবাক হয়েছি, পোয়ারো বললেন। কি বললেন আঁ?

অর্থপূর্ণভাবে হাত নাড়লেন পোয়ারো। পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা কিঞ্চিৎ আমারও নেই তা না নয়। আমার পছন্দের প্রশ্ন উঠলে, এ জায়গার চেয়ে আপনি সহজেই ভিল বেছে নিতেন। আর আমরা তার বদলে দুজনে এসে হাজির হয়েছি এখানে। মিঃ ব্ল্যাট কর্কশ স্বরে হেসে উঠলেন। কেন এলাম সত্যিই ভেবে পাই না। তিনি বলে চললেন আনমনাভাবে, মনে হয় নামের সঙ্গে কেমন যেন অলীক গন্ধ জড়িয়ে ছিলো। জলি রজার হোটেল, স্মাগলার্স দ্বীপ আপনাকে চঞ্চল করে তোলে, ছেলেবেলার কথা মনে করিয়ে দেয় তাই না। চোরাচালান, জলদস্যু এই সব।

নৌকা নিয়ে প্রচুর ঘুরে বেরিলয়েছে ছেলেবেলা থেকেই। পূর্ব উপকূল অঞ্চলে। এমনই পেশা এক পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা যায় না। ইচ্ছে করলে প্রমোদতরীও কিনে ফেলতে পারতাম একটা সাজানো গোছানো। আমার মনে ধরে না, এই জিনিষটা ঠিক তার চেয়ে ভালো নৌকায় ভেসে বেড়ান। রেডফার্নও ভালোবাসে নৌকা বইতে। এখন তো পাত্তা নেই ওর, বার তিনেক আমার সঙ্গে বেড়িয়েছে, মার্শালের বউয়ের পিছনে শুধু দিনরাত ঘুরছে।

ব্ল্যাট গলা নামিয়ে বলে চললেন, বেশির ভাগ লোক হোটেলের রসকষহীন শুকনো মাল। মিসেস মার্শালের প্রাণের ছোঁয়া একটু পাওয়া যায়। ওর পুরো দিনটা পার হয়ে যায় ওর বউয়ের পিছনে। মিসেস অভিনয় জগতে যখন ছিলেন গপ্পো চালু ছিল তার নামে। এখন যে নেই তা নয়। পুরুষদের মাথার ঠিক থাকে না ওকে দেখলে; কেলেঙ্কারী না বাধিয়ে ছাড়বে না এখানে।

কি কেলেঙ্কারী? প্রশ্ন করলেন পোয়ারো। সেটা অবস্থার উপর নির্ভর করছে, হোরেস ব্ল্যাট উত্তর দিলেন। আমার মনে হয় মার্শাল একটু বদ মেজাজের লোক। আমি এটা ভালোভাবেই জানি। ওর সম্বন্ধে কয়েকটা কথা আমার কানে এসেছে, এদের মুখভাব দেখে কিছু বোঝা যায় না। শান্ত লোক আর খুব কম কথা বলে সাবধান থাকা উচিত। গল্পের নায়ককে পানশালায় প্রবেশ করতে দেখেই থেমে গেল মাঝপথে তিনি।

বলেছিলাম না আপনাকে, সমুদ্রে নৌকা চালিয়ে সত্যিই মজা আছে..আসুন রেডফার্ন এক গ্লাস হয়ে যাক। আচ্ছা ড্রাই মার্টিনি খাবেন মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি? মাথা নেড়ে পোয়ারো অসম্মতি প্রকাশ করলেন। প্যাট্রিক রেডফার্ন বললো, পৃথিবীতে নৌকা চালানোর মতো নেশা আর কিছু নেই; এর পেছনে আমি অনেক সময় দিতে পারি। ছেলেবেলা থেকেই আমার এই সখ ছিলো। বেশির ভাগ সময়ই তো এই নৌকা নিয়ে থাকতাম। এ দিকটা তাহলে আপনি ভালোভাবেই জানেন, পোয়ারো বললেন। বলতে পারেন, হোটেল তৈরি হবার আগেই জায়গাটা চেনা আমার। এই দ্বীপে কেউ ছিলো না। লেদারকোম্ব উপসাগরে পুরানো আমলের বাড়ি। বাড়ি ছিলো এখানে একটা। এক পোডড়া বাড়ি বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত। প্রায় ধ্বংসাবশেষই বলা যায়। নানারকম গল্প চালু ছিলো, ওই বাড়ি থেকে পিক্সির গুহায় অনেকগুলো যাওয়ার পথ নাকি আছে। গুপ্ত পথ খুঁজে বেড়াতাম সব সময় মনে পড়ে। হোরেস ব্ল্যাটের গ্লাস কেঁপে উঠলো, পানীয় ছলকে পড়লো। তিনি প্রশ্ন করলেন, এই পিক্সির গুহাটা কি জিনিষ?

ও আপনি জানেন না? প্যাট্রিক বললো, চট করে খুঁজে পাবেন না গুহার ঢোকবার পথটা, পিক্সি কোভে আছে। পথটা একগাদা পাথরের মাঝে লুকানো রয়েছে। শুধু লম্বা একটা সরু ফাটল। কোনো মতে একজন ঢুকতে পারবে। গুহাটা সৃষ্টির কারণ, গুহার ভেতরটা বেশ বড়বড় চওড়া। ছোট ছেলেদের কাছে কেমন মজার ছিল বুঝতেই তো পারছেন, আমাকে বলে দিয়েছিল এক বুড়ো জেলে। ওখানকার জেলেরাও এ খবর জানে না। কেউ জবাব দিতে পারে না কেন এই জায়গাটাকে পিক্সি কোভ বলা হয়।

এরকুল পোয়ারো বললেন, ঠিক এখনো আমি বুঝে উঠতে পারিনি কি জিনিষ?

প্যাট্রিক রেডফার্ন বললো, খাস ডেভনশায়ারের চীজ বলতে পারেন আপনি। শীপস্টোরের জলাভূমিতেও পিক্সির গুহা আছে একটা। পিক্সির জন্যে উপহার হিসেবে লোকে একটা করে আলপিন রেখে আসে। এ ধরনের আত্মা হল পিক্সি জলাভূমিতে বাস করে যারা।

হুঁ, বেশ কৌতূহলের ব্যাপার, এরকুল পোয়ারো বললেন।

প্যাট্রিক রেডফার্ন বলে উঠলেন, ডর্টমুরে এই পিক্সি নিয়ে অনেক কিংবদন্তী চালু আছে। মনে করা হয় পাহাড়ের চূড়ায় অনেক পিক্সি আছে। শোনা গেছে, কৃষকরা কুয়াশা ঘেরা রাতে দেরি করে বাড়ি ফেরার পথ ভুলিয়ে দিয়েছিলো।

হোরেস ব্ল্যাট বললেন, তার মানে তারা দু-এক বোতল চড়িয়ে টং হয়ে থাকে।

হাসলো প্যাট্রিক। এছাড়া আর কি ব্যাখ্যা হতে পারে বলুন। ব্ল্যাট চোখ রাখলেন হাত গাড়িতে, বললেন, এবার আমি চলি ডিনার সারতে। রেডফার্ন যা-ই বলুন, পিক্সিদের জলদস্যুদের আমি ঢের বেশি পছন্দ করি।

তিনি বেরিলয়ে যেতেই প্যাট্রিক রেডফার্ন সশব্দে হেসে বললো, আমার দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে ভদ্রলোকের কি দশা হয় পিক্সির পাল্লায় পড়ে।

পোয়ারো মন্তব্য করলেন আত্মগতভাবে, একজন ব্যবসায়ীর পক্ষে মঁসিয়ে ব্ল্যাটের চিন্তাধারা একটু বেশি মাত্রায় কল্পনাবিলাসী।

তার কারণ ভদ্রলোক অর্ধশিক্ষিত, রেডফার্ন বললো। আমার স্ত্রী অন্তত তাই বলেন। এখন পর্যন্ত ভদ্রলোক যেসব বই পড়েন দেখুন, শুধু রহস্য রোমাঞ্চ আর কাউবয়দের কাহিনী।

আমার মন কি এখনও ছোট ছেলের মতো আপনি এই কথাই বলতে চান। আপনার কিন্তু তা মনে হয় না কেন? আমি ওকে কতটুকুই বা জানি। বারকয়েক তার সঙ্গে নৌকা নিয়ে বেরিলয়েছি। আমিও জানি না। একা একা থাকতেই ভালোবাসেন, সঙ্গীসাথী খুব একটা পছন্দ করেন না।

আমার কাছে ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত লাগছে। তার ডাঙার ব্যবহারের সম্পূর্ণ বিপরীত।

রেডফার্ন সশব্দে হাসলো, বললো, জানি, ওঁর কাছ থেকে সর্বদা শত হস্তেন থাকতে আমাদের রীতিমতো অসুবিধেয় পড়তে হয়। জায়াটাকে ম্যারগেট এবং লা টোকে-র মাঝামাঝি কিছুতে তৈরি করতে পারলে তিনি খুশি হন।

পোয়ারো নীরব রইলেন কয়েক মিনিট; তিনি মনোযোগর সঙ্গে হাস্যময় মুখমণ্ডলে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তারপর আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিতভাবে বলে বসলেন, মঁসিয়ে রেডফার্ন আমার মনে হয় আপনি জীবনকে উপভোগ করতে ভালোবাসেন।

প্যাট্রিক তার দিকে চেয়ে রইলেন অবাক হয়ে, ভালোবাসি, নিশ্চয়; কেন বাসবো না? কেন বাসবো না কেন?

পোয়ারো সমর্থন করলেন, আপনাকে আমি এ জন্মের জন্যে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

রেডফার্ন মৃদু হেসে বললো, ধন্যবাদ এই প্রসঙ্গে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে।

অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে, ছোট উপদেশ দিতে সাহস করছি আপনাকে বলুন? পুলিস বাহিনীর বিচক্ষণ বন্ধু বহু বছর আগে বলেছিলেন আমাকে, ভাই এরকুল যদি তুমি শান্তি চাও তাহলে স্ত্রীলোকদের এড়িয়ে চলবে।

প্যাট্রিক রেডফার্ন বললো, আপনার একটু দেরি হয়ে গেছে, আমি বিবাহিতা আপনি তো জানেন।

হ্যাঁ, জানি আপনার স্ত্রী একজন সুন্দরী মহিলা, এক মার্জিত রুচির; তিনি আপনাকে যথেষ্ট ভালোবাসেন, আমার ধারণা।

প্যাট্রিক রেডফার্ন বলে উঠলো তীব্র স্বরে–আমিও ওকে যথেষ্ট ভালোবাসি।

এ কথা শুনে বড় সুখী হলাম। বললেন এরকুল পোয়ারো। রাগে ফেটে পড়লো প্যাট্রিক, আপনি কি বলতে চাইছেন?

হেলান দিয়ে চোখ বুজে চেয়ারে বসলেন পোয়ারো। কিছু কিছু অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে ওদের সম্পর্কে। ওরা জীবনটাকে জটিল করে তুলতে পারদর্শিনী। তাদের ইংরেজরা প্রণয়ঘটিত ব্যাপারে বড় অদ্ভুতভাবে আচরণ করে। মঁসিয়ে রেডফার্ন, আসাটা যদি এতোই জরুরী ছিলো আপনার, আপনি তাহলে আপনার স্ত্রীকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন না কেন?

রেডফার্ন বললো রাগী সুরে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, আপনি কি বলছেন।

এরকুল পোয়ারো শান্ত স্বরে বললো, স্পষ্টই বুঝতে পারছি আমি। তর্ক করার মতো নির্বোধ আমি নই; আমি শুধু আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি।

তাহলে আপনি ওই বেহদ্দ মেয়েছেলেগুলোর কথা শুনেছেন। মিসেস গার্ডেনার ওই রুস্টার মেয়েটা দিনরাত জিভ চালানো ছাড়া ওদের আর কোনো কাজ নেই। মেয়েটি যেহেতু ওদের মধ্যে বেশি সুন্দরী, সেহেতু ওকে ঘিরে যত সব নোংরা গাল-গল্প মুখিয়ে তুলেছে।

পোয়ারো উঠে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বললেন, এখনও কি আপনার এ সব করার বয়স আছে? পোয়ারো মাথা নেড়ে পানশালা থেকে বেরিলয়ে গেলেন। প্যাট্রিক রেডফান আগুনঝরা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইলো তার গমনপথের দিকে।

.

৩.৫

এরকুল পোয়ারো খবার ঘর ছেড়ে হলঘরে এসে দাঁড়ালেন থমকে। সবকটা দরজাই ভোলা। রাতের ঠাণ্ডা হাওয়া এক ঝলক অনধিকার প্রবেশ করলো ঘরে।

ঘন কুয়াশাও মিলিয়ে গেছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। তারা ঝলমলে রাত যেন আত্মপ্রকাশ করছে। পাহাড়ের কিনারায় ওর প্রিয় আসনে ক্রিস্টিন রেডফার্নকে আবিষ্কার করলেন এরকুল পোয়ারো। ওর পাশে দাঁড়ালেন। বললেন, মাদাম আপনি ভিজে আসনে বসছেন, ঠান্ডা লাগবে আপনার এখানে বসা ঠিক নয়।

কিছু হবে না আর হলেই বা কার কি আসে যায়।

মাদাম আপনি তো আর শিশু নন, একজন শিক্ষিত মহিলা আপনি। অন্তত আপনার সব বুঝে শুনে করা উচিত।

উত্তর দিলো শীতল স্বরে, মঁসিয়ে পোয়ারো নিশ্চিত থাকুন ঠান্ডায় আমার কিছু হয় না।

আজকের দিনটা ছিলো বৃষ্টি ভেজা দিন, পোয়ারো বললেন। উঠেছিলো ঝড়, বর্ষা এসেছিলো, ঘন কুয়াশা আমাদের করে দিয়েছিলো অন্ধ। এখন কিন্তু মিলিয়ে গেছে কুয়াশা, আগের মতো আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। চিকমিক করছে আকাশের তারারা জীবনটাও এইরকমের মাদাম।

ক্রিস্টিন চাপা স্বরে বললো, অসহ্য লাগে আমার সবচেয়ে কোন জিনিষটা বলবো।

মাদাম কি?

দয়া জিনিষটা। ওর শব্দটা যেন চাবুকের মতো আছড়ে পড়লো তীক্ষ্ণ স্বরে। ও বলে চললো, আমি কিছু বুঝিনা আপনারা ভাবেন? সর্বক্ষণ বলে বেড়াচ্ছে কিছু দেখি না? ইস্ বেচারা মিসেস রেডফার্নকে দেখে কষ্ট হয়, আমি এই জিনিষটা দেখে সহ্য করতে পারি না। আমাকে দেখে ওঁদের কষ্ট হচ্ছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে সাবধানে পাথরের আসনে বিছিয়ে দিলেন পোয়ারো, বসলেন। তাঁর সুচিন্তিত বক্তব্য রাখলেন, মিথ্যে নয় আপনার একথাটা।

মেয়েদের মাঝপথেই থেমে গেলো, ক্রিস্টিন। গম্ভীর স্বরে পোয়ারো বললেন-যদি কিছু না মনে করেন, তাহলে মাদাম, কয়েকটা কথা বলি। কথাটা উজ্জ্বল নক্ষত্রদের মতোই সত্যি? এই পৃথিবীর আলেনা স্টুয়ার্টরা অথবা মার্শালরা ধর্তব্যের মধ্যে কখনও আসে না।

বাজে কথা। ক্রিস্টিন রেডফার্ন বললো।

উঁহু, আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি সত্যি। কয়েক মুহূর্তের জন্য, তাদের রাজত্ব হয় ক্ষণস্থায়ী। এক মাত্র তারাই, সত্যিকারের স্থায়ী দাগ কাটেন তারাই; একমাত্র প্রশংসনীয় গুণ আছে, বুদ্ধি আছে, যাদের মধ্যে।

ক্রিস্টিন বললো ঘৃণাভরা স্বরে, আপনি কি ভাবেন পুরুষেরা গুণ বুদ্ধির কোনো গুরুত্ব দেয়? এ সবের নিশ্চয়ই দেয় শান্ত স্বরে বললেন পোয়ারো। আমি কিন্তু একমত হতে পারলাম না, ক্রিস্টিন সংক্ষেপে হেসে বললো এইসব কথাগুলো! আপনার স্বামী আপনাকে ভালোবাসেন, পোয়ারো বললেন, তা জানা সম্ভব নয় আপনার পক্ষে।

হ্যাঁ, আমি তাকে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি আমি জানি, ক্রিস্টিন ভেঙে পড়লো। হঠাৎ-ই ফুলে কাঁদতে লাগলো পোয়ারোর কাঁধে মাথা রেখে। ও বলে উঠলো, আর সইতে পারছি না…আর সইতে পারছি না…পোয়ারো সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন। ওর পিঠে হাত রেখে। ধৈর্য ধরুন, মাদাম ধৈর্য ধরুন শুধু একটু, আশ্বাসের সুরে বললেন।

ও উঠে বসলো অবশেষে। নিজেকে সামলে নিয়ে রুমালে চোখ মুছে রুদ্ধ স্বরে বললো, মঁসিয়ে পোয়ারো এখন আপনি যান। আমি একটু একা থাকতে চাই।

ক্রিস্টিনকে একা রেখে পোয়ারো আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে হোটেলের দিকে ফিরে চললেন। হোটেলের কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ কানে এল এক চাপা কথাবার্তার শব্দ।

কিছুটা এগোতেই তিনি দেখলেন আর্লেনা মার্শাল ও প্যাট্রিক রেডফার্ন ঝোঁপের সারির মাঝে ফাঁকা অংশে পাশাপাশি বসে আছে। পুরুষটির আবেগকল্পিত কণ্ঠস্বর তিনি শুনতে পেলেন, আর্লেনা আমি সবকিছু ভুলে যেতে বসেছি তোমার জন্য। আমাকে তুমি পাগল করে দিয়েছো, তুমি কি আমায় ভালোবাসো না। আমার জন্য একটুও ভাব না তুমি বলো। আর্লেনা মার্শালের মুখমণ্ডল স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন পোয়ারো। তার মনে হলো, যেন কোনো বেড়াল আদরের উত্তাপে বসে অনুভব করছে, সুখ ভঙ্গীর সঙ্গে মানুষের চেয়ে পশুর সাদৃশ্য অনেক বেশি। আর্লোর হালকা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, নিশ্চয়ই প্যাট্রিক সোনা তোমাকে আমি ভালোবাসি তুমি তা জানো।

প্রথম তার অপশ্রবণে ক্ষান্তি দিলেন পোয়ারো। সরু ঢালু পথ ধরে হোটেলের দিকে আবার ফিরে চললেন। হঠাৎ মাঝপথে একজন সঙ্গ নিলেন। ক্যাপ্টেন মার্শাল। মার্শাল বললেন, চমৎকার রাত কি বলেন? বিশেষ করে ওরকম একটা জঘন্য দিনের পর। চোখ তুলে তাকালেন আকাশের দিকে তিনি। মনে হচ্ছে কালকের আবাহাওয়া ভালোই থাকবে।

০৪. উজ্জ্বল নির্মেঘ দিন

৪.১

২৬ শে জুলাই সকাল বয়ে নিয়ে এলো উজ্জ্বল নির্মেঘ দিনের আশ্বাস। সুন্দর সকাল এমন কোনো চূড়ান্ত অলসকেও বিছানা ছাড়তে লোভ দেখায়।

আজ সকাল সকাল উঠেছেন। জলি রজারের সাজের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বাদামী রঙের মোটা বাঁধানো বইটা ভোলা অবস্থাতেই উপুড় করে রাখলো লিডা। তারপর তাকালো আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে, এখন সকাল আটটা।

এক অদ্ভুত দৃষ্টান্ত ওর ঠোঁটজোড়ায়, চোখের তারা স্বাভাবিকের চেয়ে ঈষৎ সঙ্কুচিত। আমাকে পারতেই হবে ও রুদ্ধশ্বাসে উচ্চারণ করলো।

লিন্ডা পাজামা ছেড়ে সাঁতারের পোশাক পরে নিলো। তার উপর পরলো স্নানের ঢোলা পোশাক। বারান্দা ধরে চলতে শুরু করলো ও ঘর থেকে বেরিলয়ে। বারান্দার শেষে একটা দরজা খুলতেই দেখা গেলো একটা ঘোরানো লোহার সিঁড়ি সোজা নেমে গেছে পাথুরে জমিতে। সমুদ্রের জলে একটা ঝোলানো লোহার মই নেমে গেছে। প্রাত্যহিক প্রাতঃরাশ সেরে নেবার আগে হোটেলের যে সব অতিথিরা একটু শরীর ভিজিয়ে নিতে চান, সময় সংক্ষেপ করার জন্য তারাই প্রধান সৈকতে না গিয়ে এই মইটা ব্যবহার করেন।

যখন বারান্দা থেকে সিঁড়িতে নামছে লিন্ডা বাবার সঙ্গে মুখোমুখি হলো তখন। তিনি উপরে উঠছিলেন সিঁড়ি বেয়ে। ওকে দেখে বললেন, দেখছি আজ সকাল সকাল উঠেছ। স্নান করতে যাচ্ছো বুঝি? মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো লিন্ডা। ওরা পাশ কাটিয়ে চলে গেল পরম্পকে।

কিন্তু ঝোলানো মইয়ের দিকে না এগিয়ে হোটেলের বাঁ পাশ দিয়ে যে পথটা কংক্রিটের সেতুর দিকে চলে গেছে, লিন্ডা সেই পথটা ধরল। সেতু এখন জলের নিচে জোয়ারের কারণে। অতিথিদের পারাপারের নৌকোটা কাছেই পাড়ে বাঁধা রয়েছে। যার উপর ওটার দায়িত্ব তাকে কাছাকাছি পাওয়া গেল না কোথাও। নৌকা ছেড়ে দিল লিন্ডা।

ওপারে পৌঁছে, নৌকা পাড়ে বেঁধে ও ঢালু পথ বেয়ে এগিয়ে চললল…গ্যারেজ ছাড়িয়ে থামলো ছোট দোকানটার কাছে। দোকানের মহিলাটা সবেমাত্র দোকান খুলে ঘর ঝাঁট দিতে শুরু করেছে। রীতিমতো লিন্ডা অবাক হলো। মিস আপনি খুব সকাল সকাল উঠেছেন। স্নান-পোশাকের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলো কিছু টাকা লিন্ডা। তারপর তার কেনাকাটায় মন হলো।

.

৪.২

ক্রিস্টিন রেডফার্ন ওর ঘরে দাঁড়িয়ে। লিন্ডা যখন ফিরে এলো, ক্রিস্টিন বিস্মিত স্বরে বললো, ও এই তো! আমি ভাবছিলাম তুমি হয়তো এখন ঘুম থেকে ওঠোনি।

লিন্ডা বললো, না স্নান করতে করতে লক্ষ্য করলো ক্রিস্টিন একটু অবাক হয়ে বললো বেশ তাড়াতাড়িই পিয়ন আজ ডাক বিলি করে গেছে দেখছি।

লিন্ডা চমকে উঠলো। ওর স্বভাবসিদ্ধ অগোছালো প্রকৃতির কাগজের জন্য প্যাকেটটা ওর হাত ফস্কে পড়ে গেলো মেঝেতে। পলকা সুতোটা ছিঁড়ে গিয়ে ভেতরের কয়েকটা জিনিস গড়িয়ে পড়লো বাইরে। ক্রিস্টিনের চোখে ফুটে উঠলো বিস্ময়। মোমবাতি কিনেছো কি জন্যে তুমি?

লিন্ডার সৌভাগ্যবশত ক্রিস্টিন ওর উত্তরের অপেক্ষা করলো না। ওর জিনিষগুলো মেঝে থেকে তুলতে তুলতে বলে চললো, জানতে এসেছিলাম তুমি আমার সঙ্গে পাল কোভে যাবে কিনা? আমি সেখানে ছবি আঁকতে যাবো। বিনা দ্বিধায় সম্মতি জানালো লিন্ডা। ক্রিস্টিনকে গত কয়েকদিনে ওর চিত্রাঙ্কন-অভিযানে সঙ্গ দিয়েছেন। ক্রিস্টিন শিল্পী হিসেবে খুবই উঁচু দরের না হলেও, লিন্ডার ধারণা, এই ছবি আঁকার সম্ভবত কপট অজুহাতেই এখনও অক্ষুণ্ণ রেখেছে ওর অহঙ্কারকে। আর্লেনা মার্শালের সান্নিধ্যে কাটিয়ে দেয় ওর স্বামী দিনের বেশির ভাগ সময়। লিন্ডা দিনের পর দিন ক্রমশ খিটখিটে এবং বদ-মেজাজী হয়ে পড়ছে, ক্রিস্টিনের ভালো লাগে ওর সঙ্গে সময় কাটাতে কারণ ক্রিটিন ছবি আঁকার সময় গভীর মনোযোগে ডুবে থাকে এবং কম কথা বলে অভ্যস্ত। লিন্ডা তাতে একরকম নিঃসঙ্গতার স্বাদ অনুভব করে। ওর মধ্যে থাকে কারও সঙ্গলাভের এক অদ্ভুত আকুলতা। পরস্পরের প্রতি কেমন ওদের যেন একটা সূক্ষ্ম সহানুভূতির যোগ রয়েছে, সম্ভবত বিশেষ একজনকে সমানভাবে অপছন্দের করার মধ্যেই লুকিয়ে আছে কারণ, বারোটায় আমি টেনিস খেলতে যাবো, ক্রিস্টিন বললো। তাই একটু তাড়াতাড়ি বেরোলেই ভালো হয়। ধরো সাড়ে দশটা। এই সব বললেন ক্রিস্টিন। আমি তৈরি হয়ে থাকবো ঠিক আছে; হলঘরেই তাহলে আপনার সঙ্গে দেখা হবে।

.

৪.৩

রোজামন্ড ডার্নলি খাবার ঘর ছেড়ে শ্লথ পায়ে বেরোতেই সিঁড়ি বেয়ে ত্বরিতে নেমে আসা লিন্ডার সঙ্গে ধাক্কা লাগলো ওর। মিস ডার্নলি দুঃখিত। চমৎকার সকাল, রোজামন্ড বললো, গতকালের পর এরকম একটা দিন বিশ্বাসই করা যায় না।

ঠিক বলেছেন। আমি মিসেস রেডফার্নের সঙ্গে পাল কোভে যাচ্ছি। তার সঙ্গে দেখা করবার কথা সাড়ে দশটায়। হয়তো দেরিই হয়ে গেলো ভাবছিলাম। দশটা পঁচিশ সবে এখন। না তাহলে নিশ্চিন্তে যাক। রোজমন্ড উৎসুক হয়ে তাকালো ওর দিকে লিন্ডাকে একটু হাঁপাতে দেখে। লিন্ডা তোমার জ্বর হয়নি তো! লিন্ডার চোখ অস্বাভাবিক উজ্জ্বল এবং দু-গালে লালচে আশা বেশ স্পষ্ট। আমার…কই না তো কখনও জ্বর হয় না।

আজকের দিনটা এত সুন্দর, রোজামন্ড হেসে বললো, আমি বিছানায় বসে প্রাতঃরাশ খাওয়ার পুরনো অভ্যাস ছেড়ে নিচে চলে এসেছি। এবং বীরপুরুষের মতোই খাওয়ার টেবিলে ডিম ও বেকনের মুখোমুখি হয়েছি। আজকের দিনটা সত্যি অপূর্ব গতকালের পর। গাল কোভে খুব ভালো লাগে সকালে। আমি তেল মেখে শুয়ে থাকবো। হ্যাঁ সকালের দিকে ভালো। রোজামন্ড বললো, সৈকতের তুলনায় অনেক শান্ত, নির্জন এখানকার জায়গাটা। লাজুক স্বরে লিন্ডা বললো, আপনিও চলুন না।

মাথা নাড়লো রোজামন্ড, না অন্য কাজ আছে কতকগুলো। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো ক্রিস্টিন রেডফার্ন। ওর পরনে আবহাওয়ার উপযোগী লম্বা হাতার ঢোলা পোশাক সবুজ কাপড়ের উপর হলদে কাজ করা। ওর গায়ের ফ্যাকাসে পাণ্ডুর রঙের সঙ্গে সবুজ এবং হলদে রঙটাই যে সবচেয়ে বেশি বেমানান, রোজামণ্ডের জিভ পিসপিস করতে লাগলো, সে কথা বলার জন্য পোশাক সম্পর্কে কোনো বোধ শক্তি নেই, এমন কাউকে দেখলে রোজামণ্ডের ভীষণ অস্বস্তি হয়। মেয়েটিকে যদি আমি মনের মতো করে সাজাতে পারতাম, ও ভাবলো ওর স্বামী সচেতন হয়ে ঠিক ওর দিকে নজর দিতো কয়েকদিনের মধ্যেই। আর্লেনা বোকা হলেও সে জানে নিজেকে কিভাবে সাজাতে হয়।

লিন্ডাকে তারপর ও বললো, তোমাদের ভালোই কাটবে সময়টা। একটা বই নিয়ে সানি লজ-এর দিকে যাচ্ছি আমি।

.

৪.৪

ঘরে বসেই কফি ও রোল সহকারে প্রাতঃরাশ সারলেন এরকুল পোয়ারো যথারীতি। সকালের সৌন্দর্য তাকে অভ্যাস-নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাধ্য করলো হোটেল ছাড়তে। দশটায় সমুদ্রতীরে নেমে এলেন। তার দৈনন্দিন উপস্থিতির সময় হতে তখনও আধঘন্টা দেরি। একজন ছাড়া শুধু বেলাভূমিকে কাউকে নজর পড়লো না। আর্লেনা মার্শাল সেই একজন। আর্লেনার পরনে প্রিয় ওর সাঁতারের পোশাক, সবুজ টুপি মাথায় ও একটা সাদা কাঠের ভেলাকে জলে ভাসানোর চেষ্টা করছিলো। ওকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে গেলেন পোয়ারো। পরোপকারিতার পুরস্কার স্বরূপ নিজের ধবধবে সাদা জুতো জোড়াকে সমুদ্রের জলে স্নান করালেন।

পোয়ারোকে ধন্যবাদ জানালো আর্লেনা–ওর নিজস্ব তির্যক দৃষ্টিতে। ভেলায় চড়ে এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে আর্লেনা তাকে ডাকলো, মঁসিয়ে পোয়ারো? পোয়ারো তৎপর ভঙ্গীতে নিমেষে হেলের কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালেন। আমার জন্যে একটা কাজ করবেন, আর্লেনা বললো। নিশ্চয়ই ও পোয়ারোর দিকে চেয়ে হাসলো। কাউকে বলবেন না আমি কোথায় যাচ্ছি। তারপর মৃদু স্বরে বললো। অন্তর স্পর্শ করা দৃষ্টি ওর চোখে। আমার পিছু করবে প্রত্যেকেই। আমি আজ একটু একলা থাকতে চাই। বৈঠা বেয়ে এগিয়ে চললো নিপুণ হাতে আলেনা। সমুদ্র ছেড়ে উঠে এলেন পোয়ারো। আপনমনেই বিড়বিড় করতে লাগলেন, উঁহু অসম্ভব একেবারেই। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না।

আর্লেনা স্টুয়ার্ট মঞ্চের নামেই ওকে সম্বোধন করা যায়, এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে জীবনে কখনও একা থাকতে চেয়েছেন কিনা। এর আসল কারণ সহজেই অনুমান করলেন এরকুল পোয়ারো। কারও সঙ্গে দেখা করতে চলেছেন, আলেনা মার্শাল নিঃসন্দেহে। এবং কার সঙ্গে সে বিষয়েও পোয়ারো মনে সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে একটা। পোয়ারো দেখলেন ও মনে মনে ভাবলেনও নিজের অনুমানকে ভ্রান্ত প্রমাণিত হতে দেখলেন পোয়ারো।

যেই পাহাড়ের বাঁকে অদৃশ্য হলো, সাদা ভেলাটা। তখনই তার নজরে পড়লো প্যাট্রিক রেডফার্ন লম্বা পা ফেলে হোটেলের দিক থেকে সমুদ্র তীরে নেমে আসছে। ঠিক পেছনেই আসছে তার প্রতিদ্বন্দ্বী কেনেথ মার্শাল।

ঈষৎ মাথা নোয়ালেন মার্শাল পোয়ারোকে দেখে, সুপ্রভাত মঁসিয়ে পোয়ারো। স্ত্রীকে দেখেছেন, আমার। পোয়ারো কূটনীতিবিদের মতো জবাব দিলেন, তাহলে মাদাম সকালে উঠেছেন আজ। ওকে ওর ঘরে দেখলাম না, মার্শাল বললেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, আজকের দিনটা চমৎকার। স্নানটা সেরে ফেলি এখনই। একগাদা কাগজ টাইপ করতে হবে ফিরে গিয়ে। প্যাট্রিক রেডফার্ন অপেক্ষাকৃত চাপা দৃষ্টিতে সমুদ্রতীরের দুপাশে চোখ বুলিয়ে নিলেন একবার। তারপর পোয়ারোর পাশে বসে তার প্রেমিকের প্রতীক্ষা করতে লাগলো। আর মাদাম রেডফার্ন, পোয়ারো বললেন, তিনিও কি ভোরে উঠেছেন।

জবাব দিলো প্যাট্রিক, ক্রিস্টিন? ছবি আঁকতে বেরোবে। ইদানীং দেখছি ওর ছবি আঁকার ঝোঁক বেড়ে গেছে। প্যাট্রিক রেডফার্নে স্পষ্টই বোঝা গেল, তার মন পড়ে রয়েছে অন্য কোথাও, সময় যতোই যেতে লাগলো, ততই প্রকট হতে লাগলো আর্লেনার জন্য তার অসহিষ্ণু ভাব। কোনো পায়ের শব্দ শোনামাত্রই সে উৎসুক হয় ঘুরে তাকিয়ে দেখছে, কে আসছে হোটেলের দিক থেকে। কিন্তু হতাশার পর হতাশা শুধুই। প্রথমে এলেন মিঃ এবং মিসেস গার্ডেনার সেলাই ও সেলাইয়ের বইয়ের সুসজ্জিত হয়ে। মিস ব্রুস্টার এলেন তারপর। তারা চেয়ারে গুছিয়ে বসলেন। মিসেস গার্ডেনার অসীম উৎসাহে বুনতে শুরু করলেন যথারীতি। তার কথার স্রোত সেই সঙ্গে শুরু হলো।

ব্যাপারটা কি? আচ্ছা মঁসিয়ে পোয়ারো সমুদ্রতীর আজ এত ফাঁকা লাগছে, গেল কোথায় সব। পোয়ারো বললেন, মাস্টারম্যান ও কাওয়ানরা বাচ্চাকাচ্চা সমেত দুটি পরিবারই সারাদিন ব্যাপী নৌকাবিহারে বেরিলয়েছে।

ও, সেই জন্যেই আজ এত চুপচাপ লাগছে, চেঁচামেচি হাসাহাসি করার জন্যে তো নেই ওরা। মাত্র কয়েকজনই দেখছি স্নান করছে, ক্যাপ্টেন মার্শাল।

মার্শাল তার সাঁতার শেষ করে পাড়ে এলেন; তোয়ালে দুলিয়ে সৈকত ছেড়ে উঠে এলেন ওপরে। চমৎকার আজ সমুদ্রের জল। তিনি বললেন, এমনই দুর্ভাগ্য ওদিকে একগাদা কাজ পড়ে রয়েছে। উপায় নেই না গিয়ে।

চমৎকার আজকের মতো দিনেও আপনার কাজ রয়েছে ক্যাপ্টেন মার্শাল? তাহলে তো সত্যিই দুর্ভাগ্য বলতে হয়। কি বিশ্রীই না গতকাল দিনটা গেছে। আমি মিঃ গার্ডেনারকে বলেছিলাম যে রোজই যদি এইরকম বৃষ্টি বাদলা চলতে থাকে তাহলে আমাদের এ জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই। এইরকম কুয়াশা ঢাকা পরিবেশে কেন যেন আমার মনমরা লাগে, আর অদ্ভুত ভাব মনকে ঘিরে থাকে। ছেলেবেলা থেকেই আবহাওয়া আর পরিবেশের প্রতি আমি যথেষ্ট সংবদেনশীল। আপনি হয়তো জানেন না। আমার মনে হয় মাঝে মাঝে শুধু আমি চিৎকার করে যাই। তার মানে বুঝতেই পারছেন, মা-বাবার কাছে এটা একটা সমস্যাই হয় উঠতো। আমার মা কিন্তু খুব ভালো ছিলেন। মা বাবাকে বলতো সিনক্লেয়ার বাচ্চাটার যদি সত্যিই ইচ্ছে হয় চিৎকার করতে, তাহলে উচিত নয় বাধা দেবার। ওর মনের ভাব প্রকাশ করতে চাইছে। এবং স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে আমার বাবা দ্বিমত করতো না। বাবা-মায়ের অনুগত ছিলো এমনিতেই; মা যা বলতো বিনা দ্বিধায় তাই করতে। সত্যিই তারা সুখী দম্পতি ছিলো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস মিঃ গার্ডেনারও আমার সঙ্গে একমত হবেন। এক কথায় তারা ছিলো অসাধারণ স্বামী-স্ত্রী, ছিলো না ওডেল? সোনা হ্যাঁ, মিঃ গার্ডেনার বললেন। ক্যাপ্টেন মার্শাল আপনার মেয়ে কোথায় কি জানি, জানি না লিন্ডা? হয়ত দ্বীপে কোথাও এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ক্যাপ্টেন মার্শাল, জানেন মেয়েটাকে আমার বড় দুর্বল আর রোগা বলে মনে হয়। ভালো মতো ওকে খাওয়া-দাওয়া করানো দরকার, আর খুব দরদ দিয়ে যত্ন-আত্তি করা দরকার। কেনেথ মার্শাল সংক্ষিপ্তভাবে জবাব দিলেন, লিন্ডা ঠিক আছে। কথা শেষ করে তিনি হোটেলের দিকে পা বাড়ালেন।

প্যাট্রিক রেডফার্ন জলে নামলো না। অলসভাবে সে হোটেলের দিকে চেয়ে বসে রইলো। হতাশা ও অভিমানের কালো ছায়া তার মুখমণ্ডলে নেমে এসেছে। যখন সিম ব্রুস্টার এসেছেন, তাকে দেখে বেশ প্রাণবন্ত এবং হাসিখুশি বলেই মনে হয়েছে।

সেদিন সকালের মতোই চলতে লাগলো আজকের কথাবার্তা। মিসেস গার্ডেনারের শান্ত একঘেয়ে শব্দস্তোতকে কাটা কাটা তীক্ষ্ণ মন্তব্যে যতি চিহ্নিত করতে চাইছেন মিস ব্রুস্টার। মিস স্টার শেষে একসময় মন্তব্য করলেন, আজ সমুদ্রতীর একটু নির্জন মনে হচ্ছে। সবাই কি বেড়াতে টেড়াতে গেছে নাকি? মিসেস গার্ডেনার বললেন, আজ সকালেই তো, আমি মিঃ গার্ডেনারকে বলেছিলাম আমাদের ডর্টমুরে অবশ্যই একবার বেড়াতে যাওয়া দরকার। জায়গাটা এমনিতেই বেশ কাছে, তার ওপর ওখানকার পরিবেশ চমৎকার অত্যন্ত। আমার তো অপরাধীদের সেই কয়েকখানাটা দেখবার খুব ইচ্ছে, কি নাম যেন প্রিন্সটাউন তাই না? মনে হয় আমার আজই সব ব্যবস্থাপত্র সেরে কাল ডর্টমুরে রওনা দিলে ভালো হয়, কি বলো ওডেল। মিঃ গার্ডেনার বললেন, হ্যাঁ সোনা। এরকুল পোয়ারো মিসস্টারকে লক্ষ্য করে বললেন, স্নান করতে নামবেন আপনি কি এখন, মাদমোয়াজেল? নাঃ, আমি স্নানের পালা প্রাতঃরাশের আগেই সেরে নিয়েছি। একজন পরোপকারী ব্যক্তি সেই সময় একটা শিশি আর একটু হলেই আমার মাথায় বসিয়ে দিয়েছিলো। বোধহয় হোটেলের কোনো জানলা দিয়ে বাইরের সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে থাকবে।

উঁহু এ ধরনের ছুঁড়ে ফেলার অভ্যেস রীতিমতো বিপজ্জনক। মিসেস গার্ডেনার বললেন, একবার আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু টুথপেস্টের টিন মাথায় পড়ে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। পঁয়ত্রিশ তলার জানলা দিয়ে কোনো বাড়ি থেকে কেউ ওটাকে ছুঁড়ে ফেলেছিলো। কিরকম সাংঘাতিক ভাবুন! অনেক ক্ষতি হয়েছিল এর জন্য আমার বন্ধুর। এবার তিনি তার উলের ভাণ্ডার হাতড়াতে লাগলেন, ওজেল, মনে হচ্ছে বেগুনী উলের বলটা আমি ফেলে এসেছি। ওটা শোবার ঘরের টেবিলের দ্বিতীয় কি তৃতীয় টানাতে আছে দ্যাখো তো একবার। হ্যাঁ সোনা দেখছি। অনুগতভাবে মিঃ গার্ডেনার উঠে দাঁড়ালেন এবং রওনা হলেন তার অনুসন্ধানের কাজে। সাদা জুতোজোড়া পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন পোয়ারো। এমিলি ব্রুস্টার বললেন, জুতো পরেই জলে নেমেছেন আপনি কি মঁসিয়ে পোয়ারো? মৃদু স্বরে পোয়ারো বললেন, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে কাজ করার ফল। গলার স্বরকে খাদে নামিয়ে বললেন, এমিলি ব্রুস্টার আমাদের শ্রীমতী কোথায়? এখনও দেখছি না তাকে।

মিসেস গার্ডেনার সেলাই থেকে তার চোখ তুলে প্যাট্রিক রেডফার্নেনের দিকে তাকালেন। তাকে লক্ষ্য করতে করতে চাপা স্বরে বললেন, ওকে দেখে মনে হচ্ছে থমথমে মেঘ বলে। ওঃ বিশ্রী লাগছে না এই পুরো ব্যাপারটা। এ বিষয়ে কি ভাবেন কে জানে ক্যাপ্টেন মার্শাল। এত শান্ত মানুষ ভদ্রলোক এত চমৎকার। একজন সত্যিকারে ইংরেজ এবং বিনয়ী কোনো বিষয় তিনি কি ভাবেন, আপনি তা টের পাবেন না। উঠে দাঁড়িয়ে সমুদ্রতীরে পায়চারি করতে লাগলো প্যাট্রিক। বিড়বিড় করলেন মিসেস গার্ডেনার, ঠিক যেন একটা বাঘ। রেডফার্নকে লক্ষ্য করতে লাগলো তিন জোড়া চোখ। তাকে যেন অস্বস্তিতে ফেললো তাদের পর্যবেক্ষণ। এখন শুধু গম্ভীর নয় তার মুখভাব, তাতে এসে মিশেছে চাপা ক্রোধের কালো ছায়া। এখুনি যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটবে। তাদের কানে এলো এই থমথমে আবহাওয়া। মূল ভূ-খণ্ড থেকে ভেসে আসা ঘণ্টার হাল্কা শব্দ।

মৃদু স্বরে বললেন এমিলি ব্রুস্টার, পূর্ব দিক থেকে আবার হাওয়া বইছে। এখানে সুলক্ষণ এটাই–গির্জার ঘণ্টা শুনতে পাওয়াটা। মিঃ গার্ডেনার বেগুনী উলের বল নিয়ে ফেরা পর্যন্ত কেউ আর কোনো কথা বললেন না। ওডেল, কি ব্যাপার এত দেরি হলো। কিন্তু দুঃখিত সোনা, এটা টেবিলের কোনো টানাতেই ছিল না। খোঁজাখুজির পর অনেক শেষে আনুমারির তাকে পেলাম। কিন্তু ওঃ আশ্চর্য, আমার ধারণা ছিলো, এটা আমি টেবিলের টানাতেই রেখেছি। আমার সত্যি সৌভাগ্যই বলতে হবে কখনও যে কোনো আদালতে সাক্ষী দিতে আমার ডাক পড়েনি। কোনো কথা ঠিকমতো সেখানে মনে করতে না পারলে অস্বস্তি আর চিন্তায় হয়তো আমি মরেই যেতাম। মিঃ গার্ডেনার বললেন, মিসেস গার্ডেনার অত্যন্ত নীতিবোধসম্পন্ন মহিলা।

.

৪.৫

প্যাট্রিক রেডফার্ন প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে মুখ খুললো, আজ বেরোবেন না। মিস ব্রুস্টার নৌকা নিয়ে আপত্তি আছে আমি সঙ্গে গেলে। আপত্তি..বরং অত্যন্ত খুশি হলো। মিস ব্রুস্টার আন্তরিক সুরে বললেন, তাহলে চলুন আজ গোটা দ্বীপটাকে এক চক্কর দিয়ে আসা যাক। প্রস্তাব করলো রেডফার্ন।

অত সময় পাওয়া যাবে কি? হাত ঘড়ি দেখলেন মিস ব্রুস্টার, ও হ্যাঁ, এখনও সাড়ে এগারোটাই বাজেনি। চলুন বেরিলয়ে পড়া যাক, আর দেরি না করে।

ওরা নেমে চললো সমুদ্রের কিনারার দিকে। প্রথম বৈঠার কাছে বসলো প্যাট্রিক রেডফানই। সে বৈঠা বাইতে লাগলো সবল হাতে। গতিবেগ নিয়ে চলতে শুরু করলো নৌকো।

প্রশংসার সুরে বললেন এমিলি ব্রুস্টার। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে এভাবে বাইতে পারেন কিনা। রেডফার্ন মিস ব্রুস্টারের চোখে তাকিয়ে হাসলো। মানসিক অবস্থা তার আগের চেয়ে অনেক হাল্কা হয়ে গেছে।

নৌকো নিয়ে ফিরবো যখন আমরা দেখবেন ততক্ষণে আমার গায়ে এক-গাদা ফোস্কা গজিয়ে গেছে। মাথা ঝাঁকিয়ে কপালে নেমে আসা কালো চুল স্বস্থানে ফেরত পাঠালো রেডফার্ন। ওঃ আজকের দিনটার তুলনা হয় না। যদি ইংল্যান্ডে কখনও একটা চমৎকার গ্রীষ্মের দিন পান, তাহলে তার চেয়ে ভালো আর কিছু হয় না। একটু রুক্ষ স্বরেই জবাব দিলেন এমিলি ব্রুস্টার, সব কিছুই ভালো ইংল্যান্ডের, ওই একটাই পৃথিবীতে থাকার মতো জায়গা।

ঠিক বলেছেন। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে পশ্চিমে মোড় নিয়ে এগিয়ে চললো ওরা। প্যাট্রিক রেডফার্ন বাইতে বাইতে হঠাৎই চোখ তুলে তাকালো। কেউ গেছে নাকি সানি লজ-এ আজ। হু, একটা ছাতা দেখতে পাচ্ছি। তাই ভাবছি কে হতে পারে।

মিস ডার্নলি মনে হয়, এমিলি ব্রুস্টার বললেন। ওরকম জাপানী ছাতা ওঁর কাছে আছে। একটা। নৌকা বেয়ে চললো ওরা উপকূল ধরে। ওদের বাঁ দিকে উন্মুক্ত সমুদ্র। বললেন এমিলি ব্রুস্টার, উলটো দিক ধরে যাওয়া উচিত ছিলো আমাদের। এদিকে স্রোতের বিরুদ্ধে বাইতে হচ্ছে। না তেমনি বেশি নেই এদিকে স্রোত। এখানে সাঁতার কেটেছি, আমি তো কখনও টের পাইনি স্রোতের টান। আমরা যেতে পারতাম না ওদিকে। কারণ সেতুটা এ সময় জলের ওপরেই থাকবে। ঢেউয়ের ওপর নির্ভর করছে সেটা অবশ্য। কিন্তু সকলে বলে পিক্সি কোভে স্নান করতে নামলে বেশি দুর সাঁতরে যাওয়া বিপজ্জনক। প্যাট্রিক এখনও সমান উদ্যমে বৈঠা বাইছে। বেশ মনোযোগ সহকারে একই সঙ্গে বেশ পাহাড়ের কোলে প্রতিটি অংশে অনুসন্ধানী চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। এমিলি ব্রুস্টার হঠাৎ ভাবলেন, ও নিশ্চয়ই মিসেস মার্শালের খোঁজ করছে।

নৌকা করে আসতে চেয়েছিল আমার সঙ্গে। আজ সারা সকালটা আলোর দেখা পাওয়া যায়নি এবং অনুপস্থিতির কারণ প্যাট্রিক ভেবে ভেবে এখন রীতিমতো দুশ্চিন্তায় পড়েছে। এই ছল আর্লেনা সব জেনে শুনেই করছে। ওর প্রতি প্যাট্রিকের আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলার নিঃসন্দেহে এ এক নতুন চাল।

পিক্সি কোভের দক্ষিণ দিকে সমুদ্রে বেরিলয়ে আসা পাথুরে অংশটার কাছে ওরা বাঁক নিলো। পিক্সি কোভ জায়গাটা বেশি বড় নয়। অজস্র পাথরের টুকরো বেলাভূমিতে ছড়িয়ে রয়েছে। পাহাড়ের কিছুটা অংশ গাড়ি-বারান্দার মতো ঝুলে রয়েছে বেলাভূমির উপর। উত্তর-পশ্চিমে মুখ করে অবস্থিত। অনেকের কাছে এই জায়গাটা অত্যন্ত প্রিয় কারণ পিকনিকের জন্য। পাথরের আড়ালে মাথার উপরটা থাকার জন্য। সকালের দিকে সূর্যের কিরণ এখানে এসে পৌঁছয় না, সেই কারণেই এ সময় কেউ এদিকে আসে না প্রায় বললেই হয়।

কিন্তু আজ একজনকে দেখা গেল এই মুহূর্তে। প্যাট্রিক রেডফার্নের কর্মরত হাত ক্ষণিকের জন্য নিশ্চল হলো আবার বাইতে শুরু করল তারপর। আরে, কে ওখানে? সে স্বাভাবিক এবং সহজ সুরে বললো। নির্লিপ্ত জবাব দিলেন মিস ব্রুস্টার, দেখে তো মিসেস মার্শাল বলেই মনে হচ্ছে।

হঠাৎ-ই খেয়াল হয়েছে, প্যাট্রিক রেডফার্ন এমন ভাবে ঘুরে আবাক হয়ে বললো, হ্যাঁ সত্যি তো! সুতরাং নৌকা চালানোর গতি তার পরিবর্তিত হলো। নৌকা এগিয়ে চললো তীর অভিমুখে। ক্ষীণ প্রতিবাদ করতে চাইলো এমিলি ব্রুস্টার, আমরা কি ওখানে পাড়ে নামবো? চটপট জবাব দিলো প্যাট্রিক রেডফার্ন, ক্ষতি কি। প্রচুর সময় আছে হাতে এখন।

নিষ্পলকে তাকালো সে মিস ব্রুস্টারের চোখে, তার দৃষ্টিতে যেন সরল আকুতি ঝরে পড়লো। অনেকটা কোনো কুকুরের প্রভুভক্ত নীরব মিনতির মতো। আর কিছু বলতে পারলেন না মিস ব্রুস্টার মুখ ফুটে। হায় বেচারা! তিনি মনে মনে ভাবলেন, একেবারে অন্ধ হয়ে গেছে প্রেমে। কি উপায়! সময় হলেই ও এটা কাটিয়ে উঠবে।

নিঃশব্দে এগিয়ে চললো তরতর করে পাড়ের দিকে। আর্লেনা মার্শাল নুড়ি-ছাওয়া বেলাভূমিতে উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে। ওর হাত দুটো দুপাশে বিস্তৃত। অদূরে চোখ পড়লো সাদা ভেলাটা। কিছু একটা এমিলি ব্রুস্টারকে অস্বস্তিতে ফেললো। যেন তার অত্যন্ত পরিচিত স্বাভাবিক কোনো দৃশ্যের দিকে চেয়ে আছেন তিনি, অথচ তার কোথায় যেন একটা অসঙ্গতি রয়েছে। অসঙ্গতিটা তার নজরে পড়লো। আরও প্রায় মিনিট কয়েক পরে আলেনা মার্শালের শুয়ে থাকার ভঙ্গী কোনো সূর্যনার্থীর শুয়ে থাকার ভঙ্গীর মতো নিখুঁত। সৈকতে ওকে প্রায়ই এই একই ভঙ্গিমায় শুয়ে তাকতে দেখা গেছে হোটেলের সামনে। ব্রোঞ্জ রঙের শরীর সূর্যপিপাসার টান টান, আর সবুজ পিচবোর্ডের টুপিটা ওর মাথা ও ঘাড় প্রখর সূর্যকিরণ থেকে রক্ষা করছে। কিন্তু সূর্যকিরণের এতটুকু আভামাত্র নেই পিক্সি কোভের বেলাভূমিতে এবং আগামী কয়েক ঘণ্টাতেও থাকবেনা। সূর্যকে বেলাভূমি থেকে সম্পূর্ণ অপসারিত করেছে ওপরের ঝুলন্ত পাথরের আড়াল। আশঙ্কার এক অদ্ভুত ইশারা এমিলি ব্রুস্টারের মনকে ধীরে ধীরে গ্রাস করলো।

নৌকা এসে থামলো ওদের বেলাভূমির পাথুরে কিনারায়, এই আর্লেনা, প্যাট্রিক রেডফার্ন চেঁচিয়ে ডাকলো। এটা নির্দিষ্ট রূপ নিলো। তখনই এমিলি স্টারের ভিত্তিহীন আশঙ্কা। কোনো উত্তর এলো না, কারণ রের্ডফানের আহ্বানে শায়িত শরীরে কোনো চাঞ্চল্য দেখা গেলো না।

এমিলির চোখে পড়লো প্যাট্রিক রেডফানের মুখের আকস্মিক পরিবর্তনটা। সে এক লাফে নৌকো থেকে নামলো, এমিলি স্টারও তাকে অনুসরণ করলেন, দুজনে নৌকাটাকে টেনে পাড়ে তুললো, তারপর বেলাভূমি ধরে এগিয়ে চললো পাহাড়ের কোলে, নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকা নিরুত্তর শুভ্র দেহটার দিকে, প্রথমে এসে পৌঁছালো প্যাট্রিক রেডফার্নেহ, মিস স্টার তার ঠিক পেছনেই।

যেন স্বপ্নে দেখার মতো তিনি দেখলেন, এখটা ব্রোঞ্জ রঙের শরীর, সাদা পিঠ-খোলা সাঁতার পোশাক, সবুজ টুপির সীমানা ছাড়িয়ে বেরিলয়ে আসা লাল চুলের গুচ্ছ আরো একটা জিনিষ দেখলেন। দুবাহুর বিস্তৃত অদ্ভুত অস্বাভাবিক অবস্থান। তিনি অনুভব করলেন এই মুহূর্তে দেহটা ঠিক স্ব-ইচ্ছায় শায়িত নয়, বরং কেউ যেন অবহেলাভরে ওটাকে ছুঁড়ে দিয়েছে উন্মুক্ত বেলাভূমিতে…।

তিনি শুনতে পেলেন প্যাট্রিকের কণ্ঠস্বর..নিছকই এক আতঙ্ক-বিকৃত ফিসফিসে স্বর। নিথর দেহটার পাশে সে হাঁটু ভেঙে বসলো স্পর্শ করলো একাট হাত-বাহু…।

তার স্বর কেঁপে উঠলো, চাপা ফিসফিসে শব্দ, হায় ভগবান ও মারা গেছে এবং তারপর, সে সবুজ টুপিটা সামান্য তুলে ঘাড়ের কাছ উঁকি মারলো, কেউ গলা টিপে খুন করেছে, ওঃ ভগবান!

.

৪.৬

এমনি এক মুহূর্ত সেটা, যে মুহূর্তে সময় নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এক অদ্ভুত অপ্রাকৃত অনুভূতির সঙ্গে। এমিলি ব্রুস্টার শুনতে পেলেন নিজের কণ্ঠস্বরে, কিছুতে হাত দেওয়া ঠিক হবে না আমাদের, অন্তত যতক্ষণ না পুলিশ আসে।

রেডফার্নের উত্তর যান্ত্রিকভাবে ভেসে এলো, না না, আপনি ঠিকই বলেছেন। তারপর ফিসফিসে স্বরে সে বললো, গভীর যন্ত্রণাক্লিষ্ট। কিন্তু সে কে, কে? কে এই অবস্থা করলো আর্লেনা? ওকে কেউ-ওকে কেউ, খুন করতে পারে না! এ মিথ্যে, সব মিথ্যে।

উত্তর খুঁজে না পেয়ে নীরবে মাথা নাড়লেন এমিলি ব্রুস্টার। রেডফার্নের আচমকা গভীর শ্বাস টানার শব্দ শুনতে পেলেন। ক্রোধে উত্তেজিত সংযত স্বর তার কানে এল, ওঃভগবান, যে এ কাজ করেছে সে শয়তানটাকে যদি একবার হাতের মুঠোয় পেতাম।

শিউরে উঠলেন এমিলি ব্রুস্টার। তার কল্পনায় ভেসে উঠলো কোনো পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ওৎ পেতে বসে থাকা কোনো হত্যাকারীর ছবি। তিনি শুনতে পেলেন অনিশ্চয়তায় ভরা নিজের কণ্ঠস্বর, যেই এ কাজ করে থাকুক, এখানে বসে আছে সে কি আর! আমাদের উচিত পুলিশে খবর দেওয়া। অবশ্য তিনি সামান্য ইতস্ততঃ করলেন, আমাদের একজনের থাকা দরকার মৃতদেহের কাছে। আমি থাকছি, প্যাট্রিক রেডফার্ন বললো।

ছোট নিঃশ্বাস ফেললেন এমিলি স্টার, তিনি সেই ধরনের মহিলা নন, নিজেদের ভয় পাওয়ার কথা যারা স্বীকার করেন, কিন্তু বেলাভূমিতে আশেপাশে কোনো উন্মাদ হত্যাকারীর উপস্থিতিরক্ষীণ সম্ভাবনা নিয়ে, তাকে একা থাকতে হবে না দেখে মনে মনে তিনি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন।

সেই ভালো, তিনি বললেন। আমি যত তাড়াতাড়ি পিরবো ফিরে আসবো। নৌকা নিয়ে আমি যাচ্ছি, ওই মই বেয়ে ওপরে ওঠা আমার কম্ম নয়। লেদারকোম্ব উপসাগরের কাছাকাছি একজন কনস্টেবল আছে তাকেই খবর দিচ্ছি।

যান্ত্রিক স্বরে বিড়বিড় করলো প্যাট্রিক রেডফান, হা-হা আপনি যা ভালো বোঝেন। এমিলি ব্রুস্টার সুপটু হাতে নৌকো নিয়ে এগিয়ে চললেন। যেতে যেতেই দেখলেন, মৃতদেহের পাশে প্যাট্রিক ঝুঁকে পড়ল, দুহাতে মুখ ঢাকলো, এমন একটা তার ভঙ্গীতে সর্বহারা হতাশার ভাব ছিলো যে অনিচ্ছাসত্বেও তিনি প্যাট্রিকের জন্য দুঃখ অনুভব করলেন। মনে হলো তাকে দেখে, যেন কোনো অনুগত কুকুর তার প্রিয় প্রভুর মৃতদেহের পাশে বসে অপলকে তাকিয়ে আছে। মিস ব্রুস্টার কিন্তু তবুও সরল স্বাভাবিক বুদ্ধি তাকে নীরবে বললো ওর স্ত্রীর এবং ওর ভালোর জন্য মার্শাল ও তার মেয়ের জন্যে এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারতো না। কিন্তু আমার মনে হয় না, সেদিক থেকে কখনও ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখবে…বেচারা! এধরনের মহিলা এমনিল স্টার। সর্বদা তৎপর হতে পারেন প্রয়েজানে।

 ০৫. পাহাড়ের গা ঘেঁষে

৫.১

পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ইনসপেক্টর কলগেট, আর্লেনার মৃতদেহ নিয়ে পুলিস-সার্জেনের পরীক্ষা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছিলেন। একপাশে দাঁড়িয়ে নীরবে প্যাট্রিক ও এমিলি ব্রুস্টার।

হাঁটু ভেঙে বসেছিলেন ডাঃ নিসডন, সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, অভ্যস্ত ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে বললেন, শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে–এক জোড়া শক্ত সবল হাতের কাজ। মনে হচ্ছে না ওকে দেখে, বাধা দেবার খুব একটা চেষ্টা করেছিলেন। আচমকাই আক্রান্ত হয়েছেন বলতে পারেন, বড় বিশ্রী ব্যাপার, হুম…

মৃতদেহের মুখের দিকে একপলক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলেন এমিলি স্টার। নীলাভ রক্তিম যন্ত্রণাবিকৃত মুখমণ্ডলের বীভৎসতা কল্পনা করা যায় না।

প্রশ্ন করলেন ইনসপেক্টর কলগেট, মারা গেছেন বলে আপনার কটার সময় মনে হয় ডাক্তার, অস্বস্তিভাবে নিসডন জবাব দিলেন, ওর সম্পর্কে আরও কিছু না জেনে নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। আমাদের বিবেচনা করতে হবে অনেকগুলো ব্যাপার। আচ্ছা, এখন বাজে পৌনে একটা, মৃতদেহ কটার সময় আপনারা অবিষ্কার করেন। শেষ প্রশ্নটা যাকে লক্ষ্য করে করা হয়েছে প্যাট্রিক রেডফার্ন অস্পষ্টভাবে বললো, বারোটার কিছু আগে সঠিক বোধহয়। বলতে পারছি না। এমিলি ব্রুস্টার বললেন, বুঝলাম আমরা যখন মিসেস মার্শাল মারা গেছেন, পৌনে বারোটা বাজে তখন ঠিক।

ও আচ্ছা, নৌকো করে এসেছেন তো আপনারা এখন, যখন আপনার দূর থেকে ওঁকে এখানে পড়ে থাকতে দেখেন তখন কটা বাজে। কিছুক্ষণ ভাবলেন এমিলি ব্রুস্টার।

আমরা পাথরের বাঁকটা ঘুরেছি। ধরুন তার প্রায় মিনিট পাঁচ ছয় আগে। রেডফার্নের দিকে তিনি ফিরলেন, কি মনে হয় আপনার? অনিশ্চিত সুরে বললেন প্যাট্রিক রেডফার্ন, আমার মনে হয় এরকমই হবে। ইনসপেক্টরকে প্রশ্ন করলেন নিসডন নিচু গলায় পাশে দাঁড়ানো। ইনিই কি মৃত মহিলার স্বামী, আমারই ভুল হয়েছে ও তাহলে। রীতিমতো ভেঙে পড়েছেন ভদ্রলোক দেখছি। সেই জন্যেই ভাবছিলাম হয়তো স্বামী হলেও হতে পারেন। অপেক্ষাকৃত উঁচু স্বরে বললেন তিনি একবার, ধরা যাক তাহলে মোটামুটি বারোটা বাজতে কুড়ি মিনিটের সময় আপনারা ওকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। মনে হয় না আমার, খুব একটা অগে উনি মারা গেছেন :হয়তো ঐ সময় থেকে এগারোটা কিংবা খুব বেশি হলে পৌনে এগারোটার মধ্যে।

নোটবই সশব্দে বন্ধ করে মুখ তুলে তাকালেন ইনসপেক্টর। তিনি বললেন, ধন্যবাদ এতে অনেক সাহায্য হবে আমাদের বিশেষ করে খুনের সময়টাকে খুব অল্প পরিসরে বাঁধা গেছে এক ঘন্টারও কম বলতে গেলে।

মিস ব্রুস্টারের দিকে তিনি ফিরলেন এবার। যাক, সবকিছুই এ পর্যন্ত তাহলে পরিষ্কার। মিস এমিলি ব্রুস্টার আপনি হলেন এবং ইনি ইমঃ প্যাট্রিক রেডফার্ন। বর্তমানে দুজনেই আপনারা জলি রজার হোটেলে রয়েছেন। এই মৃত মহিলাকে আপনারা সেই হোটেলেরই অতিথি এবং জনৈক ক্যাপ্টেন মার্শালের স্ত্রী বলে সনাক্ত করছেন? নিঃশব্দে এমিলি ব্রুস্টার মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। আমার মনে হয় তাহলে..ইনসপেক্টর কলটে বললেন, আমাদের এখন হোটেলে ফিরে যাওয়াই ভালো। ইশারায় তিনি একজন কনস্টেবলকে ডাকলেন। তুমি এখানে থাকো হক্স আর কাউকে আসতে দেবে না এখানে। আমি একটু পরেই ফিলিপসকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

.

৫.২

কর্নেল ওয়েস্টন বললেন, সত্যি বলছি। আশা করিনি আপনাকে এখানে দেখবো বলে। পুলিশ প্রধানের অভিবাদনের উত্তরে যথাযোগ্য ভঙ্গিতে প্রত্যাভিবাদন জানালেন এরকুল পোয়রো। মৃদুস্বরে বললেন, হুঁ, সেন্টলুর সেই ঘটনার পর বহু বছর কেটে গেছে। তা হলেও আমার এখনও মনে আছে সে ঘটনা! ওয়েস্টন বললেন, আমার জীবনের সে এক বিরাট বিস্ময়। আজও ভুলতে পারিনি যে জিনিসটা তা হলো সেই অন্তোষ্টি ক্রিয়ার ব্যাপারটার আপনি যেভাবে আমাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন। বেনিয়মী পুরোপুরি অদ্ভুত আপনার পদ্ধতি। এক কথায় অবিশ্বাস্য।

তার ফল কি ভালে হয়নি? কর্নেল বললেন, হয়ত হয়েছে। তবে আমার ধারণা নিয়মাফিক শেখা পথেই পৌঁছাতে পারতাম আমরা। পারতেন হয়তো। পোয়ারো অভিজ্ঞ কূটনীতিবিদের মতো সমর্থন জানালেন।

এখানে এসে আর একটা খুনের জটিল পরিবেশ আপনাকে আবিস্কার করলাম। বললেন, পুলিস-প্রধান। কিছু ভেবেছেন, এটা নিয়ে? ধীরে ধীরে জবাব দিলেন, কিছু ভাবিনি এখানও–কিন্তু ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে কৌতূহল জাগিয়ে তোলে। একটু-আধটু আমাদের সাহায্য করছেন তো? সে অনুমতি দিচ্ছেন আপনি?

আপনাকে আমাদের সঙ্গে পেলে ভীষণ খুশি হবো মঁসিয়ে পোয়ারো। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাতে ব্যাপারটা তুলে দেবো কিনা এখনও আমার পাইনি সে সিদ্ধান্ত নেবার মতো যথেষ্ট খবর। এমনিতে দেখে মনে হচ্ছে, আমাদের খুনীকে খুঁজে পাওয়া যাবে, একটা সীমিত এলাকার মধ্যে। এদিকে দেখুন আবার যাঁরা হোটেলে উপস্থিত রয়েছেন, কেউই তাদের স্থানীয় বাসিন্দা নন। সুতরাং তাদের সম্বন্ধে খোঁজ খবর করতে গেলে এবং খুন করার পেছনে তাদের উদ্দেশ্যের সন্ধান করতে গেলে লন্ডনে যেতেই হবে আপনাকে। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন, পোয়ারো বললেন।

আমাদের সর্বপ্রথম জানতে হবে মৃত মহিলাটিকে শেষ কে দেখেছেন। ওয়েস্টন বললেন, পরিচারিকা সকাল নটায় মিসেস মার্শালকে প্রাতঃরাশ পৌঁছে দেয়। দশটা নাগাদ প্রায় একতলার দপ্তরে বসে থাকা হোটেল ছেড়ে বেরিলয়ে যেতে দেখে মেয়েটি।

ওয়েস্টন, পোয়ারো বললেন, বন্ধু সম্ভবত আমিই আপনার প্রার্থিত ব্যক্তি।

কটার সময়? আপনি তাকে আজ সকালে দেখেছেন? দশটা বেজে পাঁচ মিনিটে। ভেলা ভাসাতে সাহায্য করেছিলাম আমি তখন সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে তাকে। ভেলায় চড়ে চলে গেলেন তিনি। হ্যাঁ একা। একা? সেটা কি আপনি খেয়াল করেছেন কোনোদিকে গেলেন? তিনি পাহাড়ের আড়ালে চলে যান ডানদিকে মোড় ঘুরে। তার মানে পিক্সি কোভের দিকে, তাই না? হা সময় কত ছিলো তখন? তিনি সমুদ্রতীর ছেড়ে রওনা হন ঠিক সওয়া দশটায় আমি বলবো। ওয়েস্টন কিছুক্ষণ ভাবলেন। সব মিলে যাচ্ছে মোটামুটি। ভেলায় চড়ে পিক্সি কোভে পৌঁছাতে তার কতক্ষণ লাগতে পারে বলে মনে হয় আপনার? আমি সম্পূর্ণ এ ব্যাপারে অনভিজ্ঞ। আমি ঘোর বিরোধী নৌকো বা ভেলা চড়ায়। তবুও মনে হয়, আধ ঘণ্টার বেশি লাগা উচিত নয়।

তাই ধারণা আমারও, কর্নেল বললেন, অবশ্য যদি তিনি স্বাভাবিক ভাবে তাড়াহুড়ো না করে ভেলা চালিয়ে থাকেন। তাই যদি হয় তিনি পিক্সি কোভে পৌঁছেছেন পৌনে এগারোটা। মোটামুটি খাপ খেয়ে যাচ্ছে। সবই। তিনি মারা গেছেন কটার সময় আপনাদের ডাক্তার মনে করেন?

নিসডন কখনও নিজের ঘাড়ে দায়িত্ব বা ঝুঁকি নেয় না। সাবধানী লোক সে বড়। পৌনে এগারোটা নাগাদ তার মতে, খুনটা খুব বেশিক্ষণ হয়নি। নীরবে মাথা নাড়লেন পোয়ারো। তারপর বললেন, আরও একটা ছোট্ট ঘটনাটা আমার উল্লেখ করা হয়নি। মিসেস মার্শাল চলে যাওয়ার সময় আমাকে অনুরোধ করেন, আমি যে তাকে দেখেছি কাউকে যেন না বলি সে কথা। কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন ওয়েস্টন একদৃষ্টে। ব্যাপারটা ভাবার মতো, তাই না তারপর।

অস্পষ্ট স্বরে পোয়ারো বললেন, হ্যাঁ, মনে হয়েছিলো আমারও তাই। ওয়েস্টন বার কয়েক গোঁফে মোচড় দিলেন। আচ্ছা মঁসিয়ে পোয়ারা, একটা কথা। আপনার অভিজ্ঞতা সাধারণের চেয়ে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি। বলতে পারেন মিসেস মার্শাল, ঠিক কি ধরনের মহিলা ছিলেন?

পোয়ারোর ঠোঁটে একটা হালকা হাসির ছোঁয়া দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেলো। প্রশ্ন করলেন তিনি, এখন কিছু শোনেনি আপনি কি?

নীরস কণ্ঠে জবাব দিলেন পুলিস প্রধান, শুনেছি। তার সবটাই অন্যান্য মহিলাদের বক্তব্য। সুতরাং বুঝতেই পারছেন সে সব বক্তব্যের কতটুকু সত্যি তাই আমি জানতে চাই। রেডফার্নের সঙ্গে মিসেস মার্শালের সত্যি কি কোনো ইয়ে চলছিলো? আমি অন্তত নিঃসন্দেহ এ ব্যাপারে।

.

৫.৩

মিসেস ক্যাসল-এর সঙ্গে পুলিশ প্রধান ওয়েস্টন তার স্বভাবসিদ্ধ কুশলী পদ্ধতিতে কথা বলছিলেন।

মিসেস ক্যাসল জনি রজার হোটেলের একমাত্র স্বত্বাধিকারিণী, চল্লিশোর্ধ বয়সেও উজ্জ্বল, মাথায় একরাশ লাল চুল, কথা বলার ভঙ্গী অপ্রত্যাশিত রকম পরিমার্জিত।

তিনি বলছিলেন, এইরকম একটা ঘটনা আমার হোটেলে ঘটতে পারে, আশ্চর্য ব্যাপার। এরকম একটা শান্ত জায়গায় সাধারণতঃ ভদ্র এবং চমৎকার অতিথিরাই এখানে আসে। সেন্ট লু-এর বড় বড় হোটেলগুলোর মতো এখানে কোনো জঘন্য ব্যাপার হয় না।

কর্নেল ওয়েস্টন বললেন, মিসেস ক্যাসল অত্যন্ত সুনিয়ন্ত্রিত–গৃহস্থ বাড়িতেও দুর্ঘটনা ঘটে

কিন্তু ব্যবসার অনুমতিপত্রের ব্যাপারে আমি খুব সাবধানী এবং মনোযোগী।

আমরা আপনাকে কোনো দোষ দিচ্ছি না।

কিন্তু তবুও নিঃসন্দেহ এটা নিন্দের ব্যাপার। একমাত্র হোটেলের অতিথিরা ছাড়া বাইরের কোনো লোককে দ্বীপে ঢুকতে দেওয়া হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওরা আমার হোটেলের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে নোংরা আলোচনা করবে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।

ইনসপেক্টর কলগেট বললেন, দ্বীপটাকে আপনি আয়ত্তে রাখেন কী করে? আপনি বাইরের লোকেদের বাধা দেন কি করে?

ও ব্যাপারে আমি খুব সাবধানী থাকি।

হ্যাঁ, কিন্তু কি দিয়ে তাদের আটকান? কারণ গ্রীষ্মকালে ভ্রমণকারীরা এখানে মাছির মতো ছেয়ে ফেলে।

শিউরে উঠলেন ক্যাসল। এসব দোষই হলো বেড়াবার জন্যে তৈরি ওই আ-ঢাকা ল্যারাব্যাং গাড়িগুলোর। একসঙ্গে আঠারোটা গাড়ি লেদারকোম্ব উপসাগরের নৌকাঘাটার কাছে রয়েছে।

অধৈর্যভাবে কলগেট বললেন, কিন্তু এই দ্বীপে আসতে তাদের বাধা দেন কি করে?

সে জন্যে অনেকগুলো নোটিশ লাগানো আছে। তাছাড়া জোয়ারের সময় এমনিতেই আলাদা হয়ে পড়ি। সেতুটা দ্বীপের যে প্রান্তে এসে মিশেছে সেখানে এটা বড় দরজায় লেখা আছে জলি রজার হোটেল। নিজস্ব এলাকা। হোটেল ব্যতীত অন্য কোথাও বহিরাগতের প্রবেশ নিষেধ। দরজার দুপাশে পাহাড়ের পথ খাড়া সমুদ্রে নেমে গেছে, সে প্রাচীর বেয়ে ওঠা সম্ভব নয়।

কিন্তু যে কেউ তো নৌকো বেয়ে দ্বীপের পাশ দিয়ে পিক্সি অথবা গানকোভে সহজেই। পৌঁছতে পারে? তারা সমুদ্রতীরে জোয়ার-ভাটার সময়ে জলের দুইপ্রান্তের মাঝখানে বেলাভূমির যে অংশ, সেখানে বাইরের লোকেদের প্রবেশের অধিকারে আপনি হস্তক্ষেপ করতে পারেন না।

গানকোভ এবং পিক্সি কোভে আমার লোহার মইয়ের পক্ষেও যথারীতি বিজ্ঞপ্তি লাগানো … আছে। জর্জ এবং উইলিয়াম, মূল ভূখণ্ডের বেলাভূমিতে সর্বক্ষণ নজর রাখে। জর্জ সারাদিন বেলাভূমির তদারকিতে থাকে আর উইলিয়াম এখানকার মালি। রাস্তাঘাটের দেখাশোনা, টেনিস কোর্ট ঝাট দেওয়ার কাজ করে।

আমরা জর্জ এবং উইলিয়ামের সঙ্গে এ বিষয়ে এখুনি একবার কথা বলতে চাই।

মিসেস ক্যাসল বললেন, মিসেস মার্শালের মতো একজন ভদ্রমহিলা কিনা খুন হলে? আর সেও আবার ইয়ে, মানে-গলা টিপে…। আর খবরের কাগজগুলো হয়েছে আর এক উৎপাত। আমার হোটেলের সুনাম নিয়ে ওরা কিরকম ছিনিমিনি খেলে।

তবে একদিক দিয়ে সেটা আপনার হোটেলের বিজ্ঞাপনের কাজ করবে।

এবার কর্নেল ওয়েস্টন বললেন, আচ্ছা, মিসেস ক্যাসল, বর্তমানে হোটেলের অতিথিদের নামের তালিকাটি দিন। এখানে আপনি আমাদের হয়তো সাহায্য করতে পারবেন, মিসেস ক্যাসেল।

মিসেস ক্যাসেল অতিথিদের এবং হোটেলের চাকর-বাকরদের একটা তালিকা দিলেন।

পরিচারকরা কিরকম লোক?

ওদের মধ্যে অ্যালবার্ট প্লিমাউথের ভিনসেন্ট হোটেল ছেড়ে এখানে কাজ নেয়। ওর তদারকিতে তিনজন কাজ করে। আর হেনরি তো হোটেলের শুরু থেকেই-বলতে গেলে ও নিজেই এখন প্রতিষ্ঠান।

ওয়েস্টন মাথা নেড়ে বললেন, কলগেট, সন্দেহজনক না হলেও তুমি তোমার নিয়মমাফিক খোঁজ চালিয়ে যাবে। আচ্ছা, ধন্যবাদ মিসেস ক্যাসল।

মিসেস ক্যাসল চলে গেলে ওয়েস্টন বললেন, আমাদের প্রথম কাজ হবে ক্যাপ্টেন মার্শালের সঙ্গে কথা বলা।

.

৫.৪

কর্ণেল ওয়েস্টন বলছিলেন, এ ঘটনা যে আপনাকে কতখানি আঘাত করেছে তা আমি বুঝি, ক্যাপ্টেন মার্শাল। কিন্তু এই খুন সম্পর্কে সমস্ত তথ্য জোগাড় করলে আমাদের তদন্তের সুবিধে হবে।

হা, কর্তব্য তো আপনাদের করতেই হবে। বলুন কি জানতে চান?

মিসেস মার্শাল আপনার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। আপনাদের কিতদিন বিয়ে হয়েছে? এবং আপনার স্ত্রীর বিয়ের আগের নাম কি ছিল?

চার বছরের সামান্য বেশি আমাদের বিয়ে হয়েছিলো। হেলেন স্টার্ট নাম ছিলো। তবে অভিনয় জগতে ওর নাম ছিলো আর্ণেনা স্টুয়ার্ট।

বিয়ের পর তিনি অভিনয় ছেড়ে দেন?

না। বছর দেড়েক হলো অভিনয় জগৎ থেকে অবসর নিয়েছিলো।

বিয়ের পরে তার অভিনয় করাটাকে তাহলে আপনি মেনেই নিয়েছিলেন?

আমি অখুশী হলেও তা নিয়ে আমি কখনও উচ্চবাচ্য করিনি।

এই বিয়েতে আপনারা সুখী ছিলেন?

নিশ্চয় ছিলাম।

ক্যাপ্টেন মার্শাল, আপনার স্ত্রীর খুনের ব্যাপারে কারো প্রতি কোনো সন্দেহ আছে? তার কি কোনো শত্রু ছিলো?

হয়তো ছিলো। আমাকে ভুল বুঝবেন না স্যার। আমার স্ত্রী একজন অভিনেত্রী এবং অত্যন্ত সুন্দরী ছিলো। এই দুটো কারণেই অন্যান্য মহিলারা ওর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কিন্তু এই ঈর্ষার মানে এই নয় যে, তাদের মধ্যে কারো পক্ষে এরকম নৃশংসভাবে খুন করা সম্ভব।

এরকুল পোয়ারো বললেন, আপনি তাহলে বলতে চান যে, আপনার স্ত্রীর শত্রুরা প্রধানতঃ মহিলা ছিলেন।

হ্যাঁ, তাই।

পুলিসপ্রধান বললেন, এমন কোন পুরুষের কথা জানেন না যার সঙ্গে আপনার স্ত্রীর শত্রুতা ছিলো কিংবা এ হোটেলের কারো সঙ্গে তার পুরনো আলাপ ছিলো?

যতদূর জানি, মিঃ রেডফার্নের সঙ্গে কোনো এক ককটেল পার্টিতে আলাপ হয়েছিলো। এছাড়া আর কিছু জানি না।

ওয়েস্টন বললেন, এবার আজ সকালের কথায় আসা যাক। আপনার স্ত্রীর সঙ্গে শেষ কখন দেখা হয়?

নিচে প্রাতঃরাশ সারতে যাওয়ার সময় একবার ওর ঘরে গিয়েছিলাম–নটার কাছাকাছি হবে।

তখন তিনি কি করছিলেন? ও আপনারা কি আলদা ঘরে থাকতেন?

হা। ও চিঠিপত্রগুলো খুলে দেখছিলো। বিশেষ কোনো কথা হয়নি। শুধু সুপ্রভাত জানানো।

তার চালচলনে, কথাবার্তায় কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেননি?

বরং স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছে।

পোয়ারো বললেন, তিনি কি চিঠিপত্রের বিষয়বস্তুর কথা কিছু বলেছিলেন?

মার্শালের ঠোঁটে হাল্কা হাসি, ও বলেছিলো, সব কটা চিঠিই নাকি রশিদ সংক্রান্ত।

আপনার স্ত্রী কি বিছানায় বসেই প্রাতঃরাশ সারেন?

হ্যাঁ, ওটা ওর বরাবরের অভ্যেস। সাধারণতঃ এগারটার মধ্যে নিচে নামেন।

পোয়ারো বললেন, সেক্ষেত্রে তিনি যদি ঠিক দশটায় নিচে নামেন তাহলে কি অস্বাভাবিক হবে?

হা। কারণ অত সকালে আর্লেনা নামে না।

কিন্তু, আজ তিনি নিয়ম ভঙ্গ করে দশটায় নিচে নেমেছিলেন।

হয়তো আজকের সুন্দর আবহাওয়াই তার কারণ

আপনি তাকে ঘরে না পেয়ে অবাক হয়েছিলেন?

প্রাতঃরাশের পর ওর ঘরে গিয়ে ওকে দেখতে না পেয়ে একটু তো অবাক হয়েছিলাম।

আর তারপরেই আপনি সমুদ্রতীরে এসে আমাকে প্রশ্ন করেন, আপনার স্ত্রীকে দেখেছি কি না?

হ্যাঁ, আপনি বলেন যে ওকে দেখেন নি…।

ওয়েস্টন বললেন, আপনার স্ত্রীর খোঁজ করার পেছনে বিশেষ কোনো কারণ ছিলো?

না, শুধু ভেবেছিলাম এত সকালে ও কোথায় যেতে পারে–তার বেশি কিছু নয়।

ক্যাপ্টেন মার্শাল, আপনি বলেছেন যে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে মিঃ প্যাট্রিক রেডফার্নের পূর্বপরিচয় ছিলো। কিন্তু আপনার স্ত্রী মিঃ রেডফার্নকে কতখানি জানতেন?

সামান্য ধূমপানে নিশ্চয়ই আপনার আপত্তি হবে না। মার্শাল পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে, এই যাঃ। নিশ্চয়ই পাইপটা কোথাও ফেলে এসেছি।

পোয়ারো একটা সিগারেট এগিয়ে দিলেন। মার্শাল সেটা অগ্নিসংযোগ করে, আপনি রেডফার্নের কথা বললেন, আমার স্ত্রীর সঙ্গে এক ককটেল পার্টিতে আলাপ হয়েছিলো।

পুলিশ প্রধান বললেন, কিন্তু তারপর–সেই পরিচয় ক্রমশ অন্তরঙ্গতায় পরিণত হয়

তীক্ষ্ণস্বরে, একথা আপনাকে কে বলেছে?

এটাই তো হোটেলের গুজব।

হোটেলের গুজব একরাশ মিথ্যে ছাড়া কিছু নয়।

হয়তো তাই, কিন্তু মিঃ রেডফার্ন ও আপনার স্ত্রী বেশিরভাগ সময়ই একসঙ্গে থাকতেন।

হতে পারে, তবে তেমনভাবে আমার চোখে কখন পড়েনি।

আপনি মিঃ রেডফার্নের সঙ্গে আপনার স্ত্রীর বন্ধুত্বে বাধা দেননি?

নিশ্চয় না। স্ত্রীর সমার্লোচনা করা ঠিক নয়।

ব্যাপারটা কেলেঙ্কারীর পর্যায়ে যাচ্ছে দেখেও আপনি চুপচাপ ছিলেন।

গুজব অথবা পরচর্চামূলক খবরে আমার তেমন আগ্রহ নেই।

মিঃ রেডফার্ন আপনার স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন; এটা নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না?

হয়তো ছিলো। আমার স্ত্রী সুন্দরী ছিলো তাই বেশিরভাগ পুরুষই ওর প্রতি আকৃষ্ট হতো।

কিন্তু এমন কোনা সাক্ষী যদি আমাদের হাতে থাকে যে, তাদের সম্পর্ক সীমানা ছাড়িয়ে চরম অন্তরঙ্গে পৌঁছিয়েছিলো।

দেখুন, আমার স্ত্রী মৃতা। ওর পক্ষে নিজেকে নির্দোষ প্রতিপন্ন করা আর সম্ভব নয়। এ ধরনের গালগল্পে বিশ্বাস করা আমার ইচ্ছে নয়। তাছাড়া আপনার প্রয়োজনীয় প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছেন না?

এরকুল পোয়ারো বললেন, আপনি ব্যাপারটা ঠিক উপলব্ধি করতে পারছেন না ক্যাপ্টেন মার্শাল। দশটার মধ্যে অন্ততঃ নটা ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নিহত ব্যক্তির চরিত্র এবং তার পারিপার্শ্বিকের মধ্যেই খুনের প্রথম এবং প্রধান কারণ নিহিত রয়েছে। সুতরাং যতক্ষণ না আমরা সম্পূর্ণভাবে জানতে পারছি–আর্লেন মার্শাল ঠিক কি ধরনের মহিলা ছিলেন, ততক্ষণ বুঝতেই পারবো না কি ধরনের লোকে তাকে খুন করতে পারে।

ওয়েস্টন বললেন, আমারও একই মত।

মার্শাল হেসে বললেন, ভেবেছিলাম চরিত্র সংক্রান্ত ব্যাপারে মঁসিয়ে পোয়ারোরই শুধু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে।

পোয়ারো সহাস্যে বললেন, ক্যাপ্টেন মার্শাল। আমাকে সাহায্য করার মতো কিছুই এখনো বলেননি।

তার মান?

আপনার স্ত্রী সুন্দরী ও আকর্ষণীয় ছিলেন এর চেয়ে বেশি কিছু আপনি আমাদের বলেছেন কি?

আপনি আমার কাছে আর কিছু জানতে চান?

হা–আজ সকালে আপনার গতিবিধির কথা।

রোজকার মতো সকাল নটায় আমি প্রাতঃরাশ সারতে নিচে যাই। পরে আমার স্ত্রীর ঘরে গিয়ে দেখি ও ঘরে নেই। সমুদ্রতীরে এসে মঁসিয়ে পোয়ারোকে দেখে আমার স্ত্রীর কথা জিজ্ঞেস করি। তারপর সংক্ষেপে স্নান সেরে আবার হোটেলে ফিরে যাই। তখন এগারোটা বাজতে কুড়ি হবে। ওপরে গিয়ে দেখি পরিচারিকা কাজ করছে। ওকে তাড়াতাড়ি সারতে বলে নিচে বারে এসে হেনরির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে আবার এগারোটা বাজতে দশ মিনিটে ঘরে ফিরে যাই। আমার কতগুলো জরুরী চিঠি সকালের ডাকেই পোস্ট করবো বলে টাইপরাইটার নিয়ে বসি। বারোটা বাজতে দশে কাজ শেষ; টেনিস খেলার পোশাক পরি কারণ বারোটায় আমাদের টেনিস খেলার কোর্ট আগে দিন বুক করেছিলাম–

কারা ছিল এই খেলায়?

মিসেস রেডফার্ন, মিস ডার্নলি, মিঃ গার্ডেনার এবং আমি। প্রায় ঘন্টাখানেক খেলে হোটেলে ফিরতেই–আমি খবরটা পাই।

ধন্যবাদ, ক্যাপ্টেন মার্শাল। আপনি যে এগারোটা বাজতে দশ থেকে বারোটা বাজতে দশ পর্যন্ত টাইপ করছিলেন। এ বক্তব্যকে সমর্থন করার মতো কেউ আছে?

ক্ষীণ হেসে তিনি বললেন, আপনি কি সন্দেহ করছেন যে আমিই আমার স্ত্রীকে খুন করেছি। পরিচারিকাটি অন্যান্য ঘর পরিষ্কার করার সময় নিশ্চয়ই টাইপরাইটারের শব্দ শুনে থাকবে। এত সব ঘটনার পর সেগুলো ডাকে দেওয়া হয়নি। মনে হয়, আমার বক্তব্যের সমর্থনে ওই চিঠিগুলোই পর্যাপ্ত প্রমাণ। চিঠিগুলো পকেট থেকে বের করে বললেন, এই চিঠিগুলোর বিষয়বস্তু একান্ত গোপনীয়। কিন্তু খুনের মামলায় এগুলো আপনাদের হাতে তুলে দিতে আমি বাধ্য। এগুলোয় আমার বিভিন্ন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিবৃতি ও সঠিক অঙ্ক লেখা রয়েছে। আশা করি এবারে আপনারা সন্তুষ্ট হয়েছেন।

ওয়েস্টন বললেন, এটা কোনো সন্দেহের প্রশ্ন নয়। ক্যাপ্টেন মার্শাল এ দ্বীপে উপস্থিত প্রত্যেকেই সকাল পৌনে এগারোটা থেকে এগারোটা চল্লিশ পর্যন্ত গতিবিধির জবাবদিহি দিতে হবে। আর আপনার স্ত্রীর নিজস্ব কোনো বিষয় সম্পত্তি থাকলে সেগুলো সম্পর্কে আপনি কি কিছু জানেন?

আপনি কি কোনো উইলের কথা বলছেন? একবার ও আমাকে বলেছিলো, এইসব উইল-টুইল করার কথা শুনলে ওর জ্বর আসে।

সেক্ষেত্রে স্বামী হিসাবে তার সমস্ত-সম্পত্তির মালিকানা স্বত্ব আপনার ওপরেই বর্তাচ্ছে। তার কাছাকাছি কোনো আত্মীয়-স্বজন ছিলো।

সম্ভবত না। শুনেছি ছোটবেলাতেই ওর মা-বাবা দুজনেই মারা গেছে–ওর কেনো ভাই বোন নেই।

তাহলে রেখে যাওয়ার মতো তেমন বিষয় সম্পত্তি তার ছিলো না।

বরং তার উল্টো। বছর দুয়েক আগে ওর এ পুরনো বন্ধু, স্যার রবার্ট আরস্কিন মারা যান। তার প্রায় পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড তিনি আর্লেনাকেই উইল করে দিয়ে যান।

ইনসপেক্টর কলগেট এবারে মুখ খুললেন। তাহলে আপনার স্ত্রী একজন ধনী মহিলা ছিলেন। আর তা সত্ত্বেও আপনি বলতে চান তিনি কোনো উইল করে যাননি?

ওর সলিসিটার–বার্কেট, মার্কেট অ্যান্ড অ্যাপলগুড রেডফোর্ড স্কোয়ার। ওর কাছে জানতে পারেন। কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে জানি ও কোনো উইল করেনি, এটাকে ও অমঙ্গলসূচক মনে করতো।

ওয়েস্টন বললেন, আপাততঃ প্রশ্নের পালা শেষ ক্যাপ্টেন মার্শাল। আপনার এই আকস্মিক ক্ষতিতে আবার আপনাকে সমবেদনা জানাচ্ছি।

ধন্যবাদ বলে মার্শাল বেরিলয়ে গেলেন।

.

৫.৫

তিনজনেই পরস্পরের দিকে তাকালেন। ওয়েস্টন, ঠান্ডা মাথার মক্কেল। সহজে ধরা দেবার পাত্র নয় তাই না?

ইনসপেক্টর বললেন, বলা শক্ত। এ ধরনের লোকেরা সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও জুরিদের সহানুভূতিতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। সোজা কথায়, অভিব্যক্তি প্রকাশে তারা সম্পূর্ণ অক্ষম। ঠিক এই ধরনের স্বভাবের জন্যেই ওয়ালেসের বিরুদ্ধে জুরিরা অপরাধী রায় দিতে বাধ্য হয়। আপনি কি বলেন মঁসিয়ে পোয়ারো।

কিই বা বলা সম্ভব। ক্যাপ্টেন মার্শাল হলেন অবরুদ্ধ সিন্দুক। তিনি কিছুই শোনেননি, দেখেননি। কিছুই জানেন না। তবে খুনের কতগুলো উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমতঃ ঈর্ষা, আর রয়েছে মিসেস মার্শালের রেখে যাওয়া প্রচুর অর্থ। অবশ্য এমনিতেই স্ত্রীর মৃত্যুর ক্ষেত্রে স্বামীই প্রথম সন্দেহভাজন ব্যক্তি। আমার মনে হয় স্ত্রীর কথা তিনি সবই জানতেন, পোয়ারো বললেন।

আপনার এ ধারণার কারণ?

কারণ, গতরাত্রে আমি সানি লজে মিসেস রেডফার্নের সঙ্গে কথা বলে হোটেলে ফেরার পথে মিসেস মার্শাল ও রেডফার্নকে দেখতে পাই। কয়েক সেকেন্ড পরেই ক্যাপ্টেন মার্শালের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। তার অভিব্যক্তিহীন কঠিন মুখ দেখেই বোঝা গেলো যে, তিনিও ওদের দেখতে পেয়েছেন।

কর্নেল ওয়েস্টন বললেন, স্ত্রীর মৃত্যুকে তিনি বড় সহজেই মেনে নিয়েছেন।

ইনসপেক্টর বললেন, এইসব শান্ত লোকেরা ভেতরে ভেতরে ভীষণ উগ্র হয়। ক্যাপ্টেন হয়তো তার স্ত্রীকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন–কিন্তু সেই অনুভূতি বাইরে প্রকাশ করার মত লোক তিনি নন।

পোয়ারো বললেন, ক্যাপ্টেন মার্শাল বড় অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ। তার প্রতি আমার যথেষ্ট কৌতূহল হয়েছে যেমন রয়েছে তার অ্যালিবাই সম্পর্কে।

টাইপরাইটার অ্যালিবাই। এ ব্যাপারে তোমার মতামত কি কলগেট?

স্যার, অ্যালিবাইটা আমাকে সন্তুষ্ট করেছে কারণ ওটা নিখুঁত তো নয়ই বরং স্বাভাবিক।

কর্নেল বললেন, তাহলে কোনদিকে নজর দেবে?

.

৫.৬

নীরবতা ভঙ্গ করে কলগেট বললেন, কাজটা কি কোনো বাইরের লোকের না হোটেলের কোনো অতিথির? তাছাড়া প্রথমে আসে খুনের উদ্দেশ্য। এখানে সেটা আর্থিক লাভ। এই আকস্মিক মৃত্যুতে লাভবান হচ্ছেন তার স্বামী।

পোয়ারো বললেন, মানুষের মনের অসংখ্য আবেগের প্রকৃত চরিত্র কজন জানে–

ইনসপেক্টর ও পোয়ারোর একই মত যে মিসেস মার্শালের মতো মহিলার প্রচুর শত্রু থাকাটাই স্বাভাবিক।

কর্নেল সম্মতিসূচক একটা শব্দ করে বললেন, এই দ্বীপে মার্শালের একমাত্র শত্রু মহিলারা

পোয়রো বললেন, মনে হয় না যে, এই খুনটা কোনো মহিলার পক্ষে করা সম্ভব। আপনাদের ডাক্তারী সাক্ষ্য কী বলছে?

ওয়েস্টন বললেন, মিসেস মার্শাল যে কোনো পুরুষের হাতে শাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছেন, নিসডনের ওতে কোনো সন্দেহ নেই, বিশাল শক্তিশালী একজোড়া হাতের কঠিন নিষ্পেষণ।

তিনি বললেন, আর্লেনা মার্শালকে অপসারিত করে নিজের পথ নিষ্কণ্টক করতে চেয়েছেন এই হোটেলেরই দুজন মহিলা।

কর্নেল বললেন, তার মধ্যে একজন নিশ্চয়ই মিসেস রেডফার্ন।

হ্যাঁ, অবশ্য তার কারণও ছিলো। কিন্তু এই বিশেষ হত্যাকাণ্ড সম্পূর্ণ তার চরিত্র বিরোধী। তবে মানসিক অশান্তি ও ঈর্ষার কথা ভেবেও বলবো তিনি আবেগ তাড়িত মহিলা নন। চায়ের কাপে আর্সেনিক হয়তো সম্ভব–কিন্তু শ্বাসরোধ করে হত্যা, সম্পূর্ণ অসম্ভব।

ওয়েস্টন বললেন, না, এ কোনো মহিলার কর্ম নয়। আসামী নিঃসন্দেহে পুরুষ।

ইনসপেক্টর কেশে বললেন, ধরে নেওয়া যাক, এই, মিঃ রেডফার্নের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগে জনৈক পুরুষের সঙ্গে মিসেস মার্শালের একটু ইয়ে ছিলো, ধরা যাক, তার নাম এক্স। মিঃ রেডফার্ন রঙ্গমঞ্চে ঢোকা মাত্রই মিসেস মার্শাল এক্স-কে বিদায় দিলেন। তাই এক্স ঈর্ষায় অপমানের জ্বালায় উন্মাদ হয়ে উঠলো। সে তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে অনুসরণ করে এই দ্বীপে এসে তার অপমানের প্রতিশোধ নিল।

ওয়েস্টন বললেন, তোমার অনুমান যদি সত্যি হয় তাহলে কোনো অসুবিধে হবে না। এই এক্স পায়ে হেঁটে না নৌকায় এই দ্বীপে এলো সেটা জানতে হবে। হয়তো কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে নৌকা ভাড়া নিয়েছে, সেটা জানতে হবে।

পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে ওয়েস্টন বললেন, কলগেটের এই ধারণা সম্পর্কে আপনার কী মত?

এতে হত্যাকারীকে সুযোগ ও সম্ভাবনার উপর বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে। আর তাছাড়া এই ঈর্ষা ও অপমানের জ্বালায় উন্মত্ত লোকটিকে আমি ঠিক কল্পনায় আনতে পারছি না।

কলগেট বললেন, কিন্তু স্যার, মিসেস মার্শালের জন্যে পাগল হওয়া লোকের অভাব নেই, যেমন রেডফার্ন।

পোয়ারোর কপালে চিন্তার ভাঁজ, হা, মানছি..কিন্তু তবুও–কোথাও এমন কিছু একটা রয়েছে যেটা আমাদের এড়িয়ে গেছে…

০.৬. হোটেলের অতিথি

৬.১

হোটেলের অতিথি তালিকার নামগুলো কর্নেল ওয়েস্টন সশব্দে পড়লেন।

ইনসপেক্টর বললেন, মনে হয় মাস্টারম্যান ও কাওয়ান পরিবার দুটো বাদ দেওয়া যায়। আজ সকালে ওরা খাবার সঙ্গে নিয়ে দিনভর নৌকাভ্রমণে বেরিলয়েছিলেন। অ্যান্ড্রু বাস্টন ওদের নৌকা করে নিয়ে যায়। তার কাছেই আমরা মিসেস ক্যাসল-এর কথা যাচাই করে নিতে পারবো।

ওয়েস্টন বললেন, আমারও তাই ধারণা। অবশিষ্টদের মধ্যে কোনো ইঙ্গিত দিতে পারেন, মঁসিয়ে পোয়ারো।

ভাসা ভাসা ভাবে দেওয়া সম্ভব। গার্ডেনাররা মধ্যবয়স্ক বিবাহিত দম্পতি, আচরণে হাসিখুশী এবং ভ্রমণবিলাসী। সুতরাং নজরে পড়ার মতো কিছু নেই–মিঃ রেডফার্ন বয়সে তরুণ, মহিলাদের কাছ প্রলোভনের বস্তু, প্রতিদ্বন্দ্বী সাঁতারু। ভালো টেনিস খেলোয়াড় ও প্রথম শ্রেণীর নাচিয়ে। তাঁর স্ত্রী শান্ত প্রকৃতির, তিনি স্বামীর প্রতি যথেষ্ট অনুরক্ত। তার মতো বুদ্ধি কিন্তু আর্লেনা মার্শালের ছিলো না।

ইনসপেক্টর বললেন, মোহের কাছে বুদ্ধির কোনো গুরুত্ব থাকে না বলেই মনে হয়।

হয়তো থাকে না। কিন্তু মিসেস মার্শাল সম্পর্কে মোহাচ্ছন্ন হলেও মিঃ রেডফার্ন প্রকৃতপক্ষে তার স্ত্রীকেই ভালোবাসেন।

তিনি আবার বলতে লাগলেন। মেজর ব্যারী ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। নারীসৌন্দর্যের পূজারী। দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর কাহিনীর কথক মিঃ হোরেস ব্ল্যাট একজন ধনী ব্যক্তি। কিন্তু কেউই তাকে তেমন পছন্দ করে না। তাছাড়া মিঃ ব্ল্যাটের কোথাও একটা গোলমাল রয়েছে নিশ্চিত।

এরপর রোজামন্ড ডার্নলি। তার প্রতিষ্ঠানের নাম রোজামন্ড লিমিটেড। তিনি একজন বিখ্যাত পোশাক বিশেষজ্ঞ। তিনি ক্যাপ্টেন মার্শালের একজন পুরোনো বন্ধু।

ওয়েস্টন বললেন, বলেন কি? তাই নাকি?

হ্যাঁ, তবে মাঝে কয়েকবছর তাদের দেখা হয়নি।

পোয়ারো একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন, মিস স্টার সম্পর্কে আমি কিঞ্চিৎ আশঙ্কিত। তার কণ্ঠস্বর পুরুষ সাদৃশ্য। আচরণে রূঢ় হলেও আন্তরিকতা আছে। নৌকা বাইতে ভালোবাসেন এবং গলফ খেলায় পারদর্শিনী।

ওয়েস্টন বললেন, এরপর বাকি রইলেন ধর্মযাজক স্টিফেন সেন্ট। কে এই ধর্মযাজক? ব্যস, আমাদের লিস্ট শেষ। কিন্তু বন্ধুবর আপনাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে।

কারণ আজ সকালে মিসেস মার্শাল যখন ভেলা নিয়ে রওনা হন তখন আমাকে জানান তার কথা কাউকে না জানাতে। ভেবেছিলাম তিনি সম্ভবত প্যাট্রিক রেডফার্নের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন, তাই তিনি চান না তার গতিবিধি সম্পর্কে তার স্বামী অবহিত হোক। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পরই ক্যাপ্টেন মার্শাল সমুদ্রতীরে এসে আমাকে প্রশ্ন করেন, প্রায় একই সঙ্গে প্যাট্রিক রেডফানও ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে মিসেস মার্শালের খোঁজ নেয়। তাহলে আজ সকালে, আর্লেনা মার্শাল কার সঙ্গে দেখা করতে যান?

ইন্সপেক্টর কলগেট বললেন, আপনার বক্তব্য সমর্থন করছি। লন্ডন অথবা অন্য কোনো জায়গা থেকে আসা জনৈক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির সঙ্গে

এরকুল পোয়ারো মাথা নেড়ে বললেন, ইতিমধ্যে আপনার কাল্পনিক ব্যক্তির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। তাহলে মার্শাল কার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন?

পোয়ারো মাথা নেড়ে বললেন, সুন্দরী শ্রেষ্ঠা মেল অথবা নিউটনের মতো মানুষ–এই দুজনের ক্ষেত্রে আরোপিত নিঃসঙ্গ বন্দীজীবন-এর যে পার্থক্য, তা নিয়ে এক জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছিলেন এক ব্যক্তি। আর্লেনা মার্শালের নিঃসঙ্গতায় স্থান নেই, পুরুষের প্রশংসায় সর্বদা প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু কে সেই ব্যক্তি।

.

৬.২

কার্নেল ওয়েস্টন বললেন, এখন জবানবন্দীগুলো সেরে নেওয়া প্রয়োজন, তাহলে আমাদের কাজের সুবিধে হবে। প্রথমে তাহলে মার্শাল মেয়েটিকেই ডাকা যাক।

লিন্ডা মার্শাল অগোছালো ভঙ্গীতে এলো, শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত। লিন্ডাকে দেখে এক অদ্ভুত স্নেহের আবেগ অনুভব করলেন কর্নেল ওয়েস্টন। বেচারী মেয়েটা এই কচি বয়সে ভীষণ মানসিক আঘাত পেয়েছে।

আপনাকে এ অবস্থায় বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত-মিস লিন্ডা। আপনার ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমরা শুধু চাই, আপনি যেটুকু জানেন, আমাদের খুলে বলুন।

তার মানে–আর্লেনা সম্পর্কে?

হ্যাঁ, আজ সকালে তাকে দেখেছেন?

না। কারণ আর্লেনা বরাবরই বেলায় নিচে নামে।

ওয়েস্টন বললেন, আজ সকালে উঠে আপনি কি কি করেছিলেন, আমাদের একটু খুলে বলুন।

হা, প্রথমে স্নান সেরে তারপর প্রাতঃরাশ সেরে মিসেস রেডফার্নের সঙ্গে গাল কোভে যাই।

কটার সময় আপনারা রওনা হয়েছিলেন?

সাড়ে দশটার মিনিট তিনেক আগেই রওনা হয়ে যাই।

পোয়ারো বললেন, গাল কোভে আপনারা কি করলেন?

আমি গিয়ে সোজা তেল মেখে সূর্যস্নানে মন দিই। আর মিসেস রেডফান আপন মনে ছবি আঁকেন। তারপর আমি সমুদ্রে স্নান করতে নামি। আর ক্রিস্টিন হোটেলে ফিরে যান টেনিস খেলার জন্য পোশাক পালটে প্রস্তুত হতে।

সেই সময়টা আপনার মনে আছে।

কখন, যখন মিসেস রেডফার্ন হোটেলে ফিরে যান?-পৌনে বারোটা। আমি ঘড়ি দেখেছিলাম।

যে ঘড়িটা আপনি এখন পরে আছেন?

হা।

ঘড়িটা একবার দেখতে পারি?

লিন্ডা ওর মণিবন্ধ এগিয়ে ধরলো। ঘড়িটা মিলিয়ে হেসে বললেন, সেকেন্ড পর্যন্ত নির্ভুল… আচ্ছা–মিসেস রেডফার্ন যাওয়ার পর আপনি স্নান করতে নামেন? তারপর হোটেলে ফিরলেন কখন? প্রায় একটা নাগাদ। আর ফিরেই শুনলাম–আর্লেনা-মারা গেছে…

আশাকরি সম্মায়ের সঙ্গে মানিয়ে চলতে আপনার–ইয়ে–মানে অসুবিধা হতো না।

না-হতো না।

পোয়ারো বলেন, আপনি কি তাকে পছন্দ করতেন?

হ্যাঁ–আর্লেনা আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতো।

ওয়েস্টন বললেন, ভালো কথা। কখনও কখনও ঈর্ষা–সংসারে অশান্তির কারণ হয়। ধরুন মেয়ে ও বাবার মধ্যে মধুর সম্পর্ক। বাবা নতুন বিয়ে করাতে মেয়ে একটু বিরক্ত বা ক্ষুব্ধ হলেও হতে পারে। নিশ্চয়ই আপনার ক্ষেত্রে তা হয়নি? আমার ধারণা, আপনার বাবা ইদানীং তার স্ত্রীকে নিয়ে একটু বেশিই ব্যস্ত ছিলেন।…

আমি ঠিক জানি না।

মিস লিন্ডা, এবারের প্রশ্নটা খুব ভেবেচিন্তে উত্তর দিন। আপনার সম্মাকে কে খুন করতে পারে? এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য হয় এমন কিছু কি আপনি জানেন?

অনেক ভেবে বললো, না, আর্লেনাকে কে খুন করতে চেয়েছে জানি না, অবশ্য মিসেস রেডফান ছাড়া।

কিন্তু কেন?

কারণ তার স্বামী আর্লেনার প্রেমে পড়েছিলেন। হয়তো তার মনে হতো আর্ণেনা মরে গেলে ভালো হয়–এই চিন্তা আর সত্যি খুন করা এক জিনিষ নয়। তাছাড়া, মিসেস রেডফার্নের পক্ষে এ ধরনের কাজ করা অসম্ভব, মানে তিনি উগ্র প্রকৃতির নন।

পোয়ারো বললেন, আমি আপনার সঙ্গে একমত। মানসিক আবেগসঞ্জাত কোনো ঝায় তিনি বিচলিত হবেন না–যদিও সর্বদা একটা ঘৃণা মায়াবী মুখমণ্ডল তার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে–অথবা অনুভব করছেন নিজের আক্রোশে মুষ্টিবদ্ধ হাত–তা সত্ত্বেও তিনি বিচলিত হবেন না

কাঁপা স্বরে লিন্ডা বললো, আমি তাহলে এখন যাই। আপনাদের আর কিছু জিজ্ঞাসা আছে?

হ্যাঁ, যাবেন। আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ।

কর্নেল ওয়েস্টন হাফ ছেড়ে বললেন, বড় বিশ্রী আমাদের এই পুলিসের চাকরি। ওর বাবা ও সত্যয়ের সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে নিজেকে খুব ছোট লাগছিলো। খুন সবসময়েই খুন। এক্ষেত্রে লিন্ডাই একমাত্র ব্যক্তি যার পক্ষে সমস্ত ঘটনার চরিত্র জানা সম্ভব।

পোয়ারো বললেন, আমিও সেরকম অনুমান করি।

ওয়েস্টন বললেন, ওর কাছ থেকে আমরা খুব কম কথাই জানতে পেরেছি। শুধু রেডফার্ন মহিলাটির একটা অ্যালিবাই পাওয়া গেলো।

পোয়ারো বললেন, মিসেস রেডফার্নকে সন্দেহভাজনের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কারণ দৈহিক ও মানসিক দিক থেকে কাউকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা তার পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া তার হাতের গড়ন অস্বাভাবিক রকম হালকা ও ছোট।

কলগেট বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। মিসেস রেডফার্নকে আমরা স্বচ্ছন্দে বাদ দিতে পারি। ডাঃ নিসডন বলেছেন যে দুটো হাতের চাপে শ্বাসরোধ হয়ে মিসেস মার্শাল মারা গেছেন, তাদের হাতের গড়ন মোটেই হালকা ও ছোট নয়।

ওয়েস্টন বললেন, এবারে তাহলে রেডফার্নদের ডাকা যাক।

.

৬.৩

ইতিমধ্যে প্যাট্রিক রেডফার্ন পুরোপুরি সামলে উঠছে।

আপনিই মিঃ প্যাট্রিক রেডফার্ন! তা মিসেস মার্শালের সঙ্গে আপনার পরিচয় কতদিনের?

তিন মাসের;

ক্যাপ্টেন মার্শাল বলেছেন, একটা ককটেল পার্টিতে মিসেস মার্শালের সঙ্গে আপনার প্রথম আলাপ হয়।

হা–প্রথম পরিচয় এইভাবেই হয়।

ক্যাপ্টেন মার্শালের অজান্তে আপনাদের কি দেখা-সাক্ষাৎ প্রায়ই হতো?

রক্তিম মুখে রেডফার্ন বললো। হ্যাঁ, তবে তিনি জানতেন কি না–তা আমি বলতে পারছি না।

পোয়ারো বললেন, আশা করি আপনার স্ত্রীও এ সম্পর্কে কিছু জানতেন না?

আমি ওকে একদিন কথায় কথায় বলেছিলাম, বিখ্যাত আর্লেনা স্টুয়ার্টের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে।

ওয়েস্টন বললেন, আপনাদের এই দ্বীপে দেখা হওয়ার কথা কি আগে থাকতেই ছিলো?

দেখুন–ব্যাপারটা আজ না হয় কাল জানাজানি হবেই। আর্লেনার জন্যে আমার বিচারবুদ্ধি হিতাহিতজ্ঞান সবই যেন লোপ পেয়েছিলো–ও চেয়েছিলো আমিও এই দ্বীপে বেড়াতে আসি–ওর অনুরোধ এড়াতে পারিনি। পুরুষদের ওপর ওর প্রভাব ছিলো এতই মারাত্মক।

পোয়ারো বললেন, যা, তিনি ছিলেন পুরুষদের কাছে আকর্ষণের বস্তু-রূপোলী জলকন্যার মতো।

আপনাদের সঙ্গে আমি খোলাখুলি আলোচনা করছি–আর্লেনা আমাকে যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। ও সেই ধরনের মেয়ে যারা কোনো পুরুষদের দেহ-মন জয় করার পর তার সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে। আজ সকালে, পিক্সি কোভের সৈকতে, আমি যখন ওর মৃতদেহ আবিষ্কার করি তখন মনে হয়েছিলো–যেন আমার মাথায় সারা আকাশ ভেঙে পড়েছে।

পোয়ারো ঝুঁকে বললেন, আর এখন?

যা সত্যি, সবই আপনাদের বললাম। আর্লেনার মৃত্যুর সঙ্গে এ সবের তো আর কোনো যোগাযোগ নেই। আর এ ব্যাপারটা আলোচিত হলে আমার স্ত্রী ভীষণ কষ্ট পাবে। আপনারা ভাবছেন, এতদিন আমার স্ত্রীর খেয়াল কোথায় ছিল। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি। আর অন্য ব্যাপারটা নিছক একটা পাগলামো-পুরুষরা মাঝে মাঝে মোহাচ্ছন্ন হয়ে ভুল করে করুণ কণ্ঠে বললেন, এ কথাগুলো যদি আপনাদের বিশ্বাস করাতে পারতাম।

পোয়ারো বললেন, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি।

ধন্যবাদ

কর্নেল ওয়েস্টন বললেন, ইয়ে–মানে, আপনাদের এই অন্তরঙ্গতার সঙ্গে খুনের কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকতে পারে। হয়তো এই দৃষ্টিকোণ থেকেই আমরা খুনের উদ্দেশ্যটাকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবো।

হ্যাঁ, মিঃ রেডফার্ন। ক্যাপ্টেন মার্শাল সম্ভবত এ ব্যাপারটা হঠাৎই জানতে পারবেন।

আপনি বলতে চান, তিনি তখন সব দেখেশুনে তার স্ত্রীকে খুন করেছেন?

কেন, কথাটা আপনার কখনও মনে হয়নি?

না,-আশ্চর্য। কথাটা আমি একবারও ভাবিনি। মার্শাল অতি শান্তমানে এটা সম্ভব বলে, ভাবতে পারছি না।

ওয়েস্টন বললেন, আচ্ছা ব্যাপারটা তার স্বামীর কানে যাবে ভেবে তিনি কি কোনো অস্বস্তি অনুভব করতেন?

ও চাইতো না, ওর স্বামী এ নিয়ে কোনোরকম সন্দেহ করুক।

মাপ করলেন, মঁসিয়ে রেডফার্ন, এ প্রসঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের কথা কখনও ওঠেনি?

না। মার্শালকে বিয়ে করে ও পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলো। মার্শাল বলতে গেলে একজন রহিস আদমী–জমিদার–তাছাড়া পয়সাকড়িও আছে। ওর অনুগামী হতভাগ্য, অপদার্থ, মোহাবিষ্ট পুরুষদের তালিকায় আমি ছিলাম সর্বশেষ সংযোজন-নিছক সময় কাটানোর জিনিস। সব বুঝেও আমি ওর প্রতি আকর্ষিত ছিলাম…।

আচ্ছা মিঃ রেডফার্ন, আজ সকালে কি মিসেস মার্শালের সঙ্গে আপনার দেখা করবার কথা ছিলো?

না, সকালবেলা আমাদের সাধারণতঃ সৈকতে দেখা হতো। ভেলায় চড়ে সমুদ্রে আমরা ভেসে বেড়াতাম। আজ সকালে তাকে বেলাভূমিতে না দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। কারণ ভেবে পাচ্ছিলাম না।

যদি তিনি অন্য কারো সঙ্গে দেখা করবার ব্যবস্থা করে থাকেন, তাহলে সেই একজন কে, আপনি জানেন?

রেডফার্ন মাথা নাড়লো।

আপনি একান্তে তার সঙ্গে কোথায় সাক্ষাৎ করতেন?

গালকোভে, বিকেলের দিকে ভীড় কম থাকে তাই।

পিক্সি কোভ কখনও যাননি।

না। কারণ, পিক্সি কোভটা দ্বীপের পশ্চিম দিকে হওয়ায় পড়ন্ত সূর্যের আলো সেখানে অনেকক্ষণ থাকে। আর সেখানে নির্জনতা নেই। কোনো কোনো সুন্দর রাতে, নৈশভোজের পর আমরা দ্বীপের অনেক অজানা অংশে পায়চারি করে বেড়িয়েছি।

ওয়েস্টন বললেন, এ অঞ্চলের কাছাকাছি তার কোনো বন্ধুবান্ধব ছিলো?

উঁহু, সেরকম কেউ বোধ হয় ছিলো না।

মিঃ রেডফার্ন, খুব ভেবেচিন্তে উত্তর দিন এবার। মিসেস মার্শালকে আপনি লন্ডনে থাকতেই চিনতেন তাই তার বন্ধুবৃত্তের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যার মনে মিসেস মার্শালের প্রতি বিদ্বেষ ভাব ছিলো? হয়তো এমন কেউ, যাকে স্থানচ্যুত করে আপনি মিসেস মার্শালের মনে জায়গা করে নিয়েছেন?

না। সেরকম কাউকে মনে পড়ছে না।

তাহলে কোনো অজ্ঞাত পরিচয় খুনী–জনৈক বিকৃত মানসিকতার ব্যক্তি, যে ঘটনাচক্রে স্থানীয় অঞ্চলে উপস্থিত ছিলো।

রেডফার্ন বলে উঠলো, আমার বিশ্বাস এই সম্ভাবনাটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক।

উঁহু। এই ঘটনাটা ঠিক “পড়ে যাওয়া শিকার” ধরনের নয়। বিশেষ করে পিক্সি কোভ জায়গাটা যখন রীতিমতো দুর্গম। হয়তো সেই লোকটাকে কংক্রীট সেতু পেরিয়ে হোটেলের পাশ দিয়ে গোটা দ্বীপটা অতিক্রম করে মই বেয়ে পিক্সি কোভে নামতে হয়েছে-নৌকো বেয়ে নয়তো সে সমুদ্রের দিক থেকে এসেছে।

আপনি বলছেন তিনটে সম্ভাবনা রয়েছে

হ্যাঁ, কারণ প্রথম সম্ভাবনা এই দ্বীপে মাত্র দুজন ব্যক্তি রয়েছেন, যাদের এই খুনের পেছনে জোরালো উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথম জন তার স্বামী। দ্বিতীয়জন আপনার স্ত্রী।

আমার স্ত্রী ক্রিস্টিন! এ খুনের পেছনে ক্রিস্টিনের হাত রয়েছে। আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত ক্রিস্টিন! যা একেবারে অবিশ্বাস্য হাস্যকর।

তবুও মিঃ রেডফার্ন, ঈর্ষা, বড় সাংঘাতিক।

কিন্তু ক্রিস্টিন এ ধরনের মেয়েই নয়। হয়তো ও অসুখী–কিন্তু ওর মধ্যে এতটুকু উগ্রভাব নেই। আর তাছাড়া এ সন্দেহ অযৌক্তিক। কারণ আর্লেনা ক্রিস্টিনের চেয়ে দ্বিগুণ শক্তিশালী ছিলো। তার ওপর পাহাড়ের গায়ে ঝোলানো এই মইটা বেয়ে সমুদ্রতীরে নামা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। ওঃ পুরো ব্যাপারটাই একটা অবাস্তব, উদ্ভট কল্পনা।

হ্যাঁ, অবাস্তব হলেও আমাদের সর্বপ্রথম বিচার করতে হবে খুনের উদ্দেশ্য এবং সুযোগ।

.

৬.৪

রেডফার্ন চলে যেতেই পুলিসপ্রধান মন্তব্য করলেন, তার স্ত্রীর যে একটা নিশ্চিদ্র অ্যালিবাই রয়েছে সে সম্পর্কে তিনি কি বলেন সেটাই আমার শোনার ইচ্ছে ছিলো। ব্যাপারটা তাকে জোরালো ঝাঁকুনি দিয়েছে।

এরকুল পোয়ারো বললেন, রেডফার্ন যেসব যুক্তিতর্ক রেখেছেন। তাদের গুরুত্ব অ্যালিবাইয়ের চেয়ে কম নয়।

হ্যাঁ, সে কথা মানছি– ক্রিস্টিন ও কাজ করেননি। আর তার দৈহিক শক্তির দিক থেকে তো একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মার্শালও নির্দোষ।

কলগেট কেশে বললেন, আমার মনে হয়, তিনি যদি স্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা আগেই করে থাকেন তাহলে চিঠিগুলো আগে থাকতে টাইপ করে রাখাটা তার পক্ষে অসম্ভব নয়।

কথাটা মন্দ নয়, ব্যাপারটা আমাদের খোঁজ করে

ক্রিস্টিন রেডফার্ন ঘরে ঢুকলেন শান্তভাবে। পরনে দুধসাদা টেনিস ফ্রক এবং হাল্কা নীল সোয়েটার। তার মুখে সাহস ও শুভ বাস্তব বুদ্ধির ছোপ। পোয়ারো মাথা দোলালেন।

কর্নেল ভাবলেন, চমৎকার মহিলা। অবশ্য ছেলেটার বয়সও অল্প। বসুন, মিসেস রেডফার্ন। প্রত্যেককে তাদের সকালবেলার গতিবিধি সম্পর্কে বিশদভাবে প্রশ্ন করা হচ্ছে, অবশ্য সেটা পুলিসি নথিভুক্ত করার জন্য।

এরকুল পোয়ারো বললেন, প্রথমে বলুন আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনি কি করেছেন?

আজ সকালে উঠে প্রাতঃরাশ সারতে যাওয়ার পথে আমি লিন্ডা মার্শালের ঘরে গিয়ে ওর সঙ্গে গাল কোভে যাওয়ার কথা ঠিক করি। সাড়ে দশটায় নিচে হলঘরে আমরা দেখা করবো কথা হয়।

আপনার স্বামী তো প্রাতঃরাশেই স্নান সারেন; আপনি প্রাতঃরাশের আগে স্নান করেননি?

না। আমি একটু শীতকাতুরে। রোদের তাপে সমুদ্র বেশ গরম না হওয়া পর্যন্ত আমি জলে নামি না।

আচ্ছা, আপনি যখন লিন্ডা মার্শালের ঘরে যান, তখন কটা বাজে।

সাড়ে আটটা বা একটু বেশি হবে।

মিস মার্শাল কি তখন ঘুম থেকে উঠেছিলেন?

হ্যাঁ, ও কোথায় যেন বেরিলয়েছিলেন, ফিরে এসে বললো, ও নাকি স্নান করতে গিয়েছিলো।

তারপর?

তারপর নিচে থেকে প্রাতঃরাশ সেরে ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে আমরা হোটেল ছেড়ে বেরিলয়ে পড়ি।

তখন কটা বাজে?

সাড়ে দশটা হবে। তারপর গালকোভে গিয়ে দ্বীপের পূর্বদিকে, সমুদ্রের কোণ ঘেঁষে যে জায়গাটা আছে সেখানে গিয়ে আয়েস করে বসে ছবি আঁকতে শুরু করি আর লিন্ডা সূর্যস্নানে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

আপনারা ফিরলেন কখন?

পৌনে বারোটা নাগাদ। কারণ বারোটায় আমার টেনিস খেলার কথা ছিলো।

আপনার সঙ্গে ঘড়ি ছিলো?

না, আমি লিন্ডাকেই সময় জিজ্ঞেস করেছিলাম। তারপর ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে হোটেলে ফিরে আসি। আর লিন্ডা সমুদ্রে স্নান করতে নামে।

আপনি সৈকত ছেড়ে আসার আগেই কি লিন্ডা মার্শাল জলে নেমেছিলেন?

একটু ভেবে দেখি। ও সমুদ্রতীর ধরে ছুটে গেলো। আমি বাক্স বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালাম-হ্যাঁ, ফিরে আসার সময় ওর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ শুনেছিলাম।

এ নিয়ে আপনার কোনো সন্দেহ নেই তো মাদাম? বলে যান মিসেস রেডফার্ন–তারপর?

আমি হোটেলে ফিরে খেলার পোশাক পরে টেনিস কোর্টে গিয়ে অন্যান্যদের সাথে দেখা করি।

অন্যান্যরা বলতে?

ক্যাপ্টেন মার্শাল, মিঃ গার্ডেনার এবং মিস ডার্নলি। আমরা দু সেট শেষ করে সবে তৃতীয়টা ধরেছি। এমন সময় খবরটা এলো-মানে মিসেস মার্শালের মৃত্যু সংবাদটা।

পোয়ারো বললেন, খবরটা শুনে আপনার কি মনে হলো?

খবরটা শুনে–ঘটনাটা একটা জঘন্য বীভৎস ব্যাপার বলে মনে হয়েছিলো।

ক্রিস্টিন চকিত নয়নে পোয়ারোর দিকে তাকায়। ওর দৃষ্টিতে অনুরোধের ইশারা।

মাদাম, বুদ্ধিমতী বিচারবুদ্ধিসম্পন্না মহিলা হিসেবে বলছি। মিসেস মার্শাল কি ধরনের মহিলা ছিলেন, সে সম্পর্কে কিছু যদি বলেন।

আপনি কি বলতে চান সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। মিসেস মার্শালের আকস্মিক মৃত্যুতে আমি অবাক হইনি বরং আকস্মিক আঘাত পেয়েছিলাম। কিন্তু উনি ছিলেন সেই ধরনের মহিলা

পোয়ারো বললেন, সেই ধরনের মহিলা যাদের জীবনে এই পরিণতিই স্বাভাবিক…হ্যাঁ মাদাম, আজ সারা সকাল এ ঘরে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও চরম সত্য বক্তব্য এটা। মাদাম, মৃতা মিসেস মার্শাল সম্পর্কে আপনি সত্যি সত্যি কি ভাবেন, বলুন তো।

কিন্তু আমি কিই বা বলবো? উনি ছিলেন সেই ধরনের মহিলা যারা আমার মতে একেবারে অপদার্থ। ওর মন বলে কিছু ছিলো না। বুদ্ধি তো দূরের কথা। শুধু ভাবতেন পুরুষ, পোশাক ও প্রেম। উনি ছিলেন সমাজের এক স্বার্থপর পরগাছা মাত্র। পুরুষের কাছে ওর আকর্ষণ ছিলো ওর একমাত্র গুণ। ওর মতো চরিত্রের মেয়েরাই ব্ল্যাকমেল–ঈর্ষা প্রভৃতি নোংরা আবেগসংক্রান্ত জঘন্য ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে। মানুষের নিচ প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলতে ওর জুড়ি ছিলো না…।

তিনি সামনে ঝুঁকে বললেন, মিসেস রেডফার্ন। মিসেস মার্শালের কথা বলতে গিয়ে আপনি হঠাৎ ব্ল্যাকমেল শব্দ উল্লেখ করলেন কেন?

০৭. অভিব্যক্তিহীন চোখে

৭.১

কর্নেল ওয়েস্টনের দিকে অভিব্যক্তিহীন চোখে তাকিয়ে ক্রিস্টিন বললো, না-মানে, কেউ হয়তো ওকে ব্ল্যাকমেল করছিলো।

কিন্তু আপনি কি তা জানেন?

ঘটনাচক্রে ব্যাপারটা আমি জানতে পারি। একদিন হঠাই কিছু কথা আমার কানে আসে। ঘটনাটা ঘটে দুদিন–না তিনদিন আগে রাতে। আমরা তখন ব্রীজ খেলছিলাম। মনে আছে মঁসিয়ে পোয়ারো? আমি ও আমার স্বামী। আর আপনি এবং মিস ডার্নলি–এই চারজনে তাস খেলছিলাম। ঘরের বদ্ধ হাওয়ায় আমার শ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছিলো তাই একটু খোলা হাওয়ার লোভে বাইরে যাই। সমুদ্রতীরের উদ্দেশ্যে নামছি। হঠাৎ আর্লেনা মার্শালের কণ্ঠস্বর কানে এলো। আমাকে শুধু শুধু চাপ দিয়ে কোনো লাভ নেই। আর টাকার জোগাড় করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার স্বামী সন্দেহ করবে। তারপর কোনো পুরুষের কণ্ঠস্বর ভেসে উঠলো। ওসব হেঁদো কথায় আমি ভুলছি না। যেমন করে তোক টাকা আমার চাই। আর্লেনা বললো, নিচ, ইতর জানোয়ার কোথাকার? লোকটা বললো, জানোয়ার হই আর যাই হই, দেবী। টাকা তোমাকে দিতেই হবে। আমি তখন হোটেলের দিকে ফিরলাম। আর্লেনা ঝড়ের বেগে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। বিচলিতভাবে।

আর লোকটা, তাকে চিনতে পেরেছেন?

না, সে খুব নীচু গলায় কথা বলছিলো। তার গলার স্বর খুব অস্পষ্ট এবং কর্কশ ছিলো।

ধন্যবাদ, মিসেস রেডফার্ন।

.

৭.২

ইনসপেক্টর বললেন, যাক এতক্ষণে একটু আলোর ইশারা পাওয়া গোল। এই হোটেলেরই কোনো বাসিন্দা মৃতা মহিলাটিকে সযত্নে ব্ল্যাকমেল করছিলো।

পোয়ারো বললেন, কিন্তু সেই ব্ল্যাকমেলার নিহত হয়নি। মারা গেছে তার শিকার।

হ্যাঁ, ব্ল্যাকমেলার কখনও তার শিকারকে খুন করে না। কিন্তু মিসেস মার্শাল আজ সেই অজ্ঞাত ব্ল্যাকমেলারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন এবং সঙ্গত কারণেই তিনি চাননি, এ ঘটনা তার স্বামী বা রেডফার্ন জানতে পারুক। উপযুক্ত কাজের উপযুক্ত স্থানই বটে। মিসেস মার্শাল তার নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাস মতো ভেলায় ভেসে পড়লেন। তিনি পিক্সি কোভে গোপন সাক্ষাৎকারের জন্য রওনা হন।

পোয়ারো বলেন, হ্যাঁ, গোপন সাক্ষাৎকারের পক্ষে জায়গাটা আদর্শ স্থান। দ্বীপের দিক থেকে পৌঁছবার একমাত্র পথ, ঝোলানো ইস্পাতের মইটা। ঝুলন্ত পাহাড়ের নিচে বলে ওপর থেকে বেলাভূমি থেকে পাহাড়ের আড়ালে। তাছাড়া ওখানে না কি একটা গুপ্ত গুহা আছে। যার প্রবেশ পথ পাওয়া মুস্কিল। সেখানে যে কেউ আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে।

ওয়েস্টন বললেন, হ্যাঁ, পিক্সি গুহার কথা শুনেছি বটে।

কলগেট বললেন, জায়গাটা আমাদের–একবার সরেজমিনে তদন্ত করে দেখা উচিত, হয়তো কোনো সূত্র পেলেও পেতে পারি।

হ্যাঁ, কলগেট, তোমার কথাই ঠিক। মিসেস মার্শাল পিক্সি কোভে কেন গিয়েছিলেন? সেখানে কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন।

হোটেলের চাকর-বাকরদের বাদ দিয়ে থাকেন মার্কিন ভদ্রলোক গার্ডেনার, মেজর ব্যারী, মিঃ ব্ল্যাট, ধর্মযাজক স্টিফেন। মার্কিন ভদ্রলোক তো সারাটা সকাল সমুদ্রতীরেই ছিলেন, শুধু মাঝে একবার স্ত্রীর জন্য একটা উলের গোছ নিয়ে আসতে গিয়েছিলেন। মেজর ব্যারী আজ সকাল দশটায় বেরোন, ফিরে আসেন দেড়টা নাগাদ।মিঃ লেন বেরোন আরও সকালে। আটটার সময় তিনি প্রাতঃরাশ সেরে বলেন একটু পদব্রজে ভ্রমণে যাচ্ছেন। মিঃ ব্ল্যাট রোজকার মতো সাড়ে নটা নাগাদ নৌকা নিয়ে বেরোন। এখনো কেউ ফেরেননি।

ইনসপেক্টর বলেন, নৌকো নিয়ে বেরিলয়েছিলেন, আমাদের সন্দেহের কাঠামোয় এই ভদ্রলোক চমৎকার মানিয়ে যাচ্ছেন, স্যার।

আচ্ছা, এই ব্ল্যাট ভদ্রলোকের সঙ্গে একবার কথা বলবো। একবার রোজামন্ড ডার্নলি আর ওই ব্রুস্টার মহিলা, যিনি রেডফার্নের সঙ্গে মিসেস মার্শালের মৃতদেহ আবিষ্কার করেন।

বেশ বুদ্ধিমতী মহিলা স্যার। পরিচ্ছন্ন পরিপাটি।

এই মৃত্যু সম্পর্কে তার বক্তব্য কি?

যদ্দুর জানি কোনো খবর তার কাছে নেই। এছাড়া রয়েছেন মার্কিন ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী।

ওদের সবাইকে এখানে আসতে বল; যত তাড়াতাড়ি পার ঝামেলা মিটিয়ে ফেলা যাক। হয়তো এই ব্ল্যাকমেল সম্পর্কে কিছু জানা যাবে।

.

৭.৩

মিসেস গার্ডেনার তার বিশদ ব্যাখ্যা শুরু করলেন। আমাদের অবস্থাটা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, কর্নেল, এই ঘটনায় আমি মানসিক আঘাত পেয়েছি। আর মিঃ গার্ডেনার আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কে বরাবরই সতর্ক–তিনি আমাকে বললেন, ব্যারি তুমি একা যাবে না। আমি সঙ্গে যাবো। তদন্তের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ পুলিশের পদ্ধতি অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও উন্নতমানের আমি তা বিশ্বাস করি। যখন স্যাভয় হোটেলে আমার ব্রেসলেট হারিয়ে গেলো তখনকার তদন্তের সময় আমি বুঝতে পেরেছি। ব্রেসলেটটা সত্যি হারায়নি, আমি ভুল করে রেখেছিলাম। আর মিঃ গার্ডেনারও আমার সঙ্গে একমত হবেন, ব্রিটিশ পুলিশকে সাহায্য করার জন্য আমরা সর্বদাই উদগ্রীব।

কর্নেল ওয়েস্টন বলেন, মিসেস গার্ডেনার, শুনলাম আপনি ও আপনার স্বামী সারা সকালটা আজ সমুদ্রতীরেই কাটিয়েছেন?

হ্যাঁ, সেখানেই তো ছিলাম আমরা–কি সুন্দর, শান্ত ছিলো আজকের সকালটা। আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। বাঁক পেরিয়ে ওই নির্জন সৈকতে কি কাণ্ডটাই না ঘটে চলেছে।

মিসেস মার্শালকে আজকে দেখেছেন কি?

না, সেইজন্যই তো ওডেলকে বলছিলাম–মিসেস মার্শালকে তো দেখছি না। প্রথমে তার স্বামী খোঁজ করল, তারপর এলো ঐ সুদর্শন যুবকটি। সে ছেলেটির যে কি অধৈৰ্য্য কি বলবো। মিসেস মার্শালকে আমরা সাংঘাতিক মেয়ে বলে মনে করি। ক্যাপ্টেন মার্শালের মতো এমন চমৎকার ভদ্রলোক কি করে যে ওকে বিয়ে করে বসলেন, তাছাড়া তার মেয়ে এখন বড় হয়েছে। ক্যাপ্টেন মার্শালের যদি সামান্যতম বাস্তববুদ্ধি থাকতো। তাহলে তিনি ডার্নলির মতো মহিলাকেই বিয়ে করতেন। রোজামন্ড ডার্নলির দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন, তার বুদ্ধির অভাব নেই। যে কোনো কাজ পরিকল্পনা মাফিক শেষ করবে। আমি যে তাকে কতখানি শ্রদ্ধা করি। মিস ডার্নলি তো মার্শালের প্রেমে অন্ধ। শুনেছি ওরা নাকি ছোটবেলা থেকেই পরস্পরকে চিনতেন। আমাকে সংকীর্ণমনা ভাববেন না, আমি অভিনয় পছন্দ করি। কিন্তু ওই মেয়েটার মধ্যে কোথায় যেন একটা অশুভ ছায়া লুকিয়েছিল।

কর্নেল ওয়েস্টন মরিয়া হয়ে বললেন, আচ্ছা ধন্যবাদ। মিসেস গার্ডেনার তাহলে আপনারা কেউই কিছু দেখেননি।

উঁহু-সেরকম কিছুই না। মিসেস মার্শাল বেশিরভাগ সময়েই রেডফার্নের সঙ্গে ঘুরতো সে তো সবাই জানে।

কিন্তু তার স্বামী কি তাতে অসন্তুষ্ট হতেন?

ক্যাপ্টেন মার্শাল খুব চাপা স্বভাবের, বাইরে থেকে দেখে তার মনের কথা বোঝা যায় না।

.

৭.৪

মেজর ব্যারী যে সত্যি সত্যিই বিস্মিত ও আতঙ্কিত তা তার স্বরেই বোঝা যাচ্ছিল, যে কোনোভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারলে আমি খুশি হবো। অবশ্য পাত্রপাত্রী কারো সঙ্গেই অমার পরিচয় নেই, আমি কিছু জানি না। বস্তুত এই ঘটনাটা আমাকে সিমলার একটা ঘটনা মনে করিয়ে দেয়। লোকটির নাম ছিলো রবিনসন নাকি ফ্যালেকনার। সে ছিলো ইস্ট উইস্টশ অথবা নর্থ সারেস-এর লোক। শান্তবিষ্ট মানুষ বইয়ের পোকা–মনে হয় একেবোরে ভিজে বেড়ালটি। একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ নিজের স্ত্রীকে গলা টিপে ধরে। বউটা না কি অন্য কার সঙ্গে ইয়ে চালিয়ে যাচ্ছিলো। অল্পের জন্য মেয়েটা প্রাণে বেঁচে যায়। আমরা কখনো ভাবিনি, লোকটার ভেতর এত তেজ আছে।

পোয়ারো বললেন, আর এই ঘটনার সঙ্গে মিসেস মার্শালের মৃত্যুর একটা সাদৃশ্য আছে, তাই তো?

হা–মানে। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ভয়ঙ্কর কিছু একটা করে বসা।

আপনার ধারণা, ক্যাপ্টেন মার্শাল তাই করেছেন।

না, মিঃ মার্শাল সম্পর্কে কোনো কথাই আমি বলিনি, সে অত্যন্ত ভালোমানুষ।

কিন্তু, একটু আগে একজন প্রতারিত স্বামীর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার কথা বলেছেন।

হ্যাঁ, মানে, রেডফান ছেলেটাকে মিসেস মার্শাল একেবারে সুতোয় করে নাচাচ্ছিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার, নিজের স্ত্রীর ব্যাপারে স্বামী দেবতারা বিশ্বাসে একেবারে অন্ধ। পুনায় এরকম একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। খুব সুন্দরী মেয়েটি। ওঃ, নিজের স্বামীকে কম ঝাটে ফেলেনি সে।

কর্নেল ওয়েস্টন বললেন, ঠিক আছে মেজর-ব্যারী। আপনি তাহলে ব্যক্তিগতভাবে এমন কিছু জানেন না, যা আমাদের তদন্তে সাহায্য করতে পারে?

সেরকম কোনো তথ্য আমি দিতে পারছি না।

আজ সকালে মিসেস মার্শালকে দেখেননি?

সকালে কারও সঙ্গেই আমার দেখা হয়নি। সেন্ট লু-তে গিয়েছিলাম। এমনই দুর্ভাগ্য যে, ঘটনার দিনই আমি অনুপস্থিত।

আপনি তাহলে সেন্ট লু-তে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, একটু টেলিফোন করার দরকার ছিলো। এখানে ফোনের ব্যবস্থা নেই।

আপনার ফোনের বক্তব্য গোপনীয় ছিলো?

মেজর চোখ টিপে সহাস্যে বললেন, হ্যাঁ, চেয়েছিলাম আমার এক বন্ধুকে ডেকে তার মারফত একটা বিশেষ ঘোড়ার ওপর বাজি রাখতে। কিন্তু লাইন পেলাম না।

আপনি কোথা থেকে ফোন করেছিলেন?

সেন্ট লু-র প্রধান ডাকঘর থেকে। এই তো, সবে আধঘণ্টা হলো ফিরেছি।

সেন্ট লু-তে কারও সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিলো?

স্বভাবসিদ্ধ চাপা হাসিতে মেজর ব্যারী বললেন, অ্যালিবাই প্রমাণ করতে বলছেন? সেন্ট লু-তে প্রায় হাজার পঞ্চাশ লোককে দেখেছি।

এ ধরনের মিয়মমাফিক প্রশ্ন আমাদের করতেই হয়।

সে কথা ঠিক। সাহায্য করতে পারলে খুশী হবো। আমিও চাই খুনী ধরা পড়ুক। নির্জন সমুদ্র সৈকতে হত্যাকাণ্ড।

ইনসপেক্টর ধন্যবাদ বলে তাকে বিদায় দিয়ে এসে বললেন, সেন্ট লু-তে কোনো খোঁজখবর নেওয়া একটা কষ্টকর হবে। কারণ সেখানে এখন ছুটির মরসুম।

পুলিশপ্রধান বললেন, হ্যাঁ, মেজর ব্যারীকে সন্দেহের তালিকাভুক্ত করা চলে। অবশ্য এইরকম ক্লান্তিকর বাঁচাল বৃদ্ধ বহু দেখা যায়। কিন্তু তবুও মেজরের দিকে নজর রাখতে হবে। কলগেট খোঁজ নিয়ে দ্যাখো, কটার সময় তিনি গাড়ি নিয়ে বেরিলয়েছেন, ট্যাঙ্কে কতটা তেল ছিলো। হয়তো কোনো নির্জন জায়গায় গাড়ি রেখে তিনি দ্বীপে ফিরে পিক্সি কোভে যান।

কলগেট বললেন, হ্যাঁ, বিশেষ করে আজই প্রচুর স্যারাব্যাং গাড়ি এখানে উপস্থিত আছে। জোয়ার ছিলো সাতটায়। আর ভাটা হবে বেলা একটায়। সুতরাং লোকেরা কংক্রীট সেতু এবং বেলাভূমিতে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছিলো।

ওয়েস্টন বললেন, কিন্তু তাকে সেতু পার হয়ে হোটেলের পাশ দিয়েই তো আসতে হবে।

ঠিক পাশ দিয়ে না এসে অন্য রাস্তায় গেছেন তিনি, হয়তো নৌকো বেয়ে ঘুর পথে পিক্সি কোভে গিয়ে থাকবেন।

ওয়েস্টন সম্মতি জানিয়ে, এটা অবশ্য যুক্তিগ্রাহ্য। যদি সমুদ্রের কিনারায় তিনি আগে থাকতেই নৌকাটা রেখে থাকেন, তাহলে পিক্সি কোভে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। সুতরাং ব্যাপারটা আমি তোমার ওপর ছেড়ে দিচ্ছি কলগেট। এখন, তাহলে মিস ফ্রস্টারের সঙ্গে কথা বলা যাক।

.

৭.৫

এমিলি ব্রুস্টার নতুন কোনো তথ্য দিতে পারলেন না।

ওয়েস্টন বললেন, তার মৃতদেহ আবিষ্কার ছাড়া আপনি এমন কিছু জানেন, যা আমাদের তদন্তে সাহায্য করতে পারে?

ব্রুস্টার বললেন, উঁহু। তবে আশা করি খুব শীগগির এর একটা সমাধান করতে পারবেন।

কি বলতে চান আপনি?

শুধু বলতে চাই, এ ধরনের ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে সমাধান সহজেই হওয়া উচিত।

আপনি তাকে পছন্দ করতেন না?

না, কারণ আমার খুড়তুতো ভাই আরস্কিনদের একজনকে বিয়ে করে। আপনারা হয়তো জানেন। আর্লেনা বৃদ্ধ রবার্টের ওপর এমন প্রভাব বিস্তার করে যে, তিনি নিজের আত্মীয়-স্বজনকে বঞ্চিত করে সমস্ত সম্পত্তি ওই মেয়েটিকে দিয়ে যান। প্রথমতঃ আর্লেনার সঙ্গে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক এক চরম কেলেঙ্কারীর সৃষ্টি করে তার ওপর ওকে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড উইল করে দেওয়ায় বোঝা যায় যে, সে কি চরিত্রের মেয়ে ছিলো। আর একজন হতভাগ্য যুবক ওর জন্য পাগল হয়ে ওর পেছনে খরচ করার জন্য কিছু শেয়ার তছনছ করে দিয়েছে। কেমন করে রেডফার্ন ছেলেটার মাথাটা চিবিয়ে খাচ্ছিলো। যদি জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে ভালো হতো। গলা টিপে খুন, ভীষণ বিশ্রী।

তাহলে আপনার ধারণা, খুনী মিসেস মার্শালের অতীত জীবনের কোনো শত্রু? সে সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মূল ভূখণ্ড থেকে এসেছে?

তাকে দেখবার লোক কোথায়? সকলেই তো সমুদ্রতীরে ছিলাম। অবশ্য মিস ডার্নলি ছাড়া…

কেন, মিস ডার্নলি কোথায় ছিলেন?

হোটেলের পশ্চিমদিকের পাহাড়ের কিনারায় সানি লজে। আমি ও মিঃ রেডফার্ন নৌকা বেয়ে যখন যাচ্ছিলাম তাকে বসে থাকতে দেখেছি।

কর্নেল ওয়েস্টন বললেন, আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, মিস ব্রুস্টার, মিসেস মার্শালের অতীত জীবনে নিহিত কোনো সূত্রই আমাদের নজর এড়িয়ে যাবে না।

.

৭.৬

ইনসপেক্টর বললেন, ভদ্রমহিলা একটু একরোখা প্রকৃতির। আর মৃতা মহিলার সম্পর্কে যা বললেন–তাতে বোঝা যাচ্ছে যে, মধুর সম্পর্ক ছিল না।

আপনি কি তার হাত দুটো লক্ষ্য করেছেন? যে কোনো পুরুষের মতো বড়সড়। তাছাড়া তার শরীরের গঠনও বেশ ঋজু–অনেক পুরুষের চেয়েও তার শক্তি বেশি…আপনি বলছেন মঁসিয়ে পোয়ারো, তিনি আজ সকালে একবারের জন্যও বেলাভূমি ছেড়ে যাননি?

প্রিয় ইনসপেক্টর, তিনি যখন সমুদ্রতীরে আসেন তখন মিসেস মার্শাল পিক্সি কোভেতে পৌঁছাননি এবং মিঃ রেডফার্নের সঙ্গে নৌকা নিয়ে বেরোবার সময় পর্যন্ত আমার চোখের সামনেই ছিলেন।

তাহলে তো তাকেও বাদ দিতে হয়।

.

৭.৭

রোজামন্ড ডার্নলি প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই এরকুল পোয়ারো খুশির একটা উদ্বেল অনুভব করলো।

রোজামন্ড বললো, আপনারা বোধহয় আমার নাম ঠিকানা জানতে চান? রোজামন্ড অ্যান ডার্নলি। রোজামন্ড লিমিটেড নামে, ৬২২, ব্রুক স্ট্রিটে আমার একটা পোশাক তৈরির প্রতিষ্ঠান আছে।

ধন্যবাদ, মিস ডার্নলি। আজ সকালে আপনার গতিবিধি

সাড়ে নটায় প্রাতঃরাশ শেষ করে ওপরে ঘরে গিয়ে কয়েকটা বই ও সূর্য আচ্ছাদন নিয়ে সানি লজ-এ চলে যাই। তখন দশটা পঁচিশ হবে। বারোটা বাজতে দশ নাগাদ আমি হোটেলে ফিরে আসি। টেনিস র‍্যাকেট নিয়ে টেনিস কোর্টে যাই, প্রায় মধ্যাহ্নভোজ পর্যন্ত খেলেছি।

আজ সকালে মিসেস মার্শালকে দেখেছিলেন?

না।

তিনি যখন ভেলা ভাসিয়ে পিক্সি কোভের দিকে যান তখন কি সানি লজ থেকে আপনি দেখেছিলেন?

না। হয়তো আমি সেখানে পৌঁছাবার আগেই উনি পার হয়ে যান।

মিঃ রেডফার্ন এবং মিস ব্রুস্টারকেও নিশ্চয় আপনি যেতে দেখেননি?

না, দেখিনি।

মিঃ মার্শালের সঙ্গে তো আপনার আগেই পরিচয় ছিলো, তাই না?

ক্যাপ্টেন মার্শাল আমাদের পরিবারের একজন পুরোনো বন্ধু। একসময় পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম। মাঝে প্রায় বারো বছর আমাদের দেখা হয়নি…।

আর মিসেস মার্শাল? ওদের সম্পর্ক কেমন ছিলো, জানেন কি?

আমি যদুর জানি-খুবই ভালো ছিলো।

মিসেস মার্শালকে আপনি পছন্দ করতেন?

না। মহিলা মহলে আর্লেনা মার্শাল তেমন জনপ্রিয় ছিলেন না। কিন্তু আর্লেনার পোশাকের প্রশংসা না করে পারছি না। ওকে আমার দোকানের খদ্দের করতে পারলে সত্যিই খুশি হতাম।

আচ্ছা, মিসেস মার্শালকে কেউ কি ব্ল্যাকমেল করছিলো?

ব্ল্যাকমেল করছিলো আর্লেনাকে।

কিন্তু অসম্ভব তো নয়।

না। এ পৃথিবীতে সবকিছুই সম্ভব। সেটা ঠেকে শিখতে হয়। কিন্তু আর্লেনাকে কেন ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছিলো?

হয়তো এমন কতগুলো বিষয় ছিলো যেগুলো তার স্বামীর কানে যাতে না যায়?

হতে পারে। আর্লেনা বরাবরই একটু বেপরোয়া। নিজেকে কখনো সতী সাবিত্রী বলে জাহির করতো না।

তাহলে তার স্বামী সবই জানতেন?

আসলে মনে হয় কেনেথ মার্শাল আর্লেনাকে আর্লেনা হিসেবেই মেনে নিয়েছেন, ওর সম্পর্কে কোনো ভ্রান্ত ধারণা ছিলো না। পুরুষেরা ভীষণ বোকা। আর কেনেথ মার্শালের পক্ষে স্ত্রীকে অন্ধ বিশ্বাস করাটা অসম্ভব নয়।

তাহলে আপনি মিসেস মার্শালের শত্রুকে জানেন না?

শুধুমাত্র ক্ষুব্ধ স্ত্রীদেরই আর্লেনার ওপর আক্রোশ ছিলো। কিন্তু শ্বাসরুদ্ধ করে ওকে নিশ্চয়ই কোনো পুরুষ খুন করেছে। আপনারা বরং আর্লেনার অন্তরঙ্গ সঙ্গীদের কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

ধন্যবাদ, মিস ডার্নলি।

মঁসিয়ে পোয়ারোর জিজ্ঞেস করার কিছু আছে।

এরকুল পোয়ারো হেসে বললেন, না–এই মুহূর্তে কোনো প্রশ্ন নেই।

০৮. আর্লেনা মার্শালের শোবার ঘরে

৮.১

আর্লেনা মার্শালের শোবার ঘরে দুটো বিশাল জানলা দিয়ে ঠিকরে পড়েছে সোনালি রোদ। আর্লেনার প্রসাধন টেবিলে সর্বপ্রকার প্রসাধন দ্রব্যই রয়েছে। ইনসপেক্টর ড্রয়ারগুলো দেখতে ব্যস্ত। তিনি একগোছা ভাজ করা চিঠি পেলেন। ওয়েস্টন ও তিনি চিঠিগুলো পড়ে দেখতে লাগলেন।

ইতিমধ্যে পোয়ারো পোশাকের আলমারি খুলে দেখলেন রাশি রাশি আধুনিক পোশাক। আর রয়েছে অন্তর্বাসের স্তূপ, অসংখ্য টুপি, যার পেছনে কয়েক গিনি করে খরচ করা হয়েছে। তিনি মৃদু স্বরে মন্তব্য করলেন, স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম।

কর্নেল চিঠিগুলো ভাঁজ করতে করতে বললেন। তিনটে লিখেছে রেডফার্ন।

আরেকটা চিঠি তিনি পোয়ারোর দিকে এগিয়ে দিলে—

প্রিয়তমা আর্লেনা–
আমার দুঃখ যদি বুঝতে। সুদূর চীনদেশে চলে যাচ্ছি। কোনো পুরুষ কোনো মেয়েকে এত গভীরভাবে ভালোবাসে ভাবিনি, যেমন তোমাকে বেসেছি। চেকার জন্যে ধন্যবাদ। ওরা এবার আমাকে মুক্তি দেবে। অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। এতসবের কারণ বড়লোক হতে চেয়েছিলাম শুধু তোমার জন্য। আমাকে ক্ষমা করবে তো? আমি চেয়েছিলাম তোমার সুন্দর নরম কানে হীরের বন্যা বইয়ে দিতে। আর গলায় মুক্তোর মালা পরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। একটা বিশাল পান্না, শীতল এবং সবুজ, প্রচ্ছন্ন আগুনে টইটুম্বুর। আমাকে ভুলে যেও না–তুমি চিরকালের জন্য আমার।

বিদায়–বিদায়–বিদায়
জে.এন.।

কলগেট বললেন, এই জে.এন. সত্যিই চীনে গিয়েছিলো কিনা দেখতে হবে। সম্ভবত সে-ই আমাদের প্রার্থিত ব্যক্তি। অন্ধের মতো মহিলাটিকে ভালোবাসত, হয়তো একদিন জানতে পারলো, তাকে ঠকানো হয়েছে। মনে হচ্ছে, মিস ব্রুস্টার এই ছেলেটির কথাই বলেছে।

পোয়ারো ঘরের আসবাবপত্রের দিকে, প্রসাধন টেবিলে, খোলা পোশাকের আলমারির দিকে, শেষ নজর পড়লো উদ্ধত অলস ভঙ্গীতে বিছানায় শুয়ে থাকা একা বড়সড় ডোবার পুতুলের দিকে।

কেনেথ মার্শালের ঘরটা তার স্ত্রীর ঘরের লাগোয়া। মাঝে কোনো দরজা নেই। প্রসাধন টেবিলে রয়েছে দুটো গজদন্তের বুরুশ; একটা পোশাক পরিষ্কারের বুরুশ এবং এক শিশি কেশ প্রসাধনের আরক। ঘরের অন্যপ্রান্তে লেখার টেবিলে রয়েছে একটা টাইপরাইটার পাশে একরাশ কাগজ।

কলগেট বললেন, এই তো সেই চিঠিটা, যেটার কথা উনি বলেছিলেন। ২৪ তারিখ দেওয়া আছে। আর এই যে সেই খামটালেদারকোষ বে ডাকঘরের আজকের ছাপ রয়েছে। এবার আমাদের জানতে হবে, এই চিঠির উত্তর আগেই তৈরি করেছিলেন কিনা!

কর্নেল বললেন, তোমাকে কিছুক্ষণের জন্য এখানে এ কাজে ছেড়ে যাচ্ছি। বাকি ঘরগুলো আমরা একবার চোখ বুলিয়ে নিই।

ওয়েস্টন লিন্ডা মার্শালের ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, মনে হয় না তেমন কিছু আছে তার। হয়তো মার্শাল তার মেয়ের ঘরে কিছু লুকিয়ে রেখেছে।

তিনি চলে গেলেন, এরকুল পোয়ারো ঘরেই রয়ে গেলেন। খুব সদ্য সেখানে কোনো কিছু পোড়ানো হয়েছে। তিনি হাঁটু গেড়ে বসে তার আবিষ্কার একটা সাদা কাগজে গুছিয়ে রাখলেন। অসম আকৃতির বিশাল এক টুকরো গলা মোম–কিছু সবুজ কাগজ অথবা পিচবোর্ডের ছিন্ন অংশ এ ছাড়াও রয়েছে একটা সাধারণ পিন এবং কোনো পশুর দগ্ধ লোম।

পোয়ারো সেগুলো সাজিয়ে মৃদু স্বরে, জীবনের মহৎ কর্ম চিন্তায় ফল নেই, সম্পাদনে ফল আছে। হয়তো এ কথাই লেখা ছিলো। কিন্তু এর অর্থ কি?

এই মুহূর্তে ছোট্ট পিনটা হাতে নিতেই তার চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো…হু..কিন্তু এও কিসম্ভব? শ্বেতপাথরের তাকে সাজানো কয়েকটা বই। একটা বাইবেল, সেক্সপীয়ারের নাটকের সংকলন। মিসেস হামফ্রি ওয়ার্ড রচিত দ্য ম্যারেজ অফ উইলিয়াম অ্যাস, সালট ইয়ং-এর লেখা দ্য ইয়ং স্টেপ মাদার, দ্য সুপসায়ার ল্যান্ড। ইলিয়টের মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল। ড্রিক কার-এর দ্য বার্নিং কোর্ট।

দ্য ইয়ং স্টেপমাদার ও উইলিয়াম অ্যাস বইদুটোর নামপত্রে বসানো অস্পষ্ট রবার ছাপগুলো দেখলেন। অন্যান্য বইগুলোর পেছনে একটা ছোট অথচ মোটা বাদামী চামড়া দিয়ে বাঁধানো বই রয়েছে।

তিনি বইটা খুলে, আমার ধারণাই দেখছি ঠিক। কিন্তু অন্য ব্যাপারটা কি সম্ভব? যদি না…

.

৮.২

কর্নেল ওয়েস্টন বললেন, কি হলো, মঁসিয়ে পোয়ারো, এখনও হয়নি।

পোয়ারো আসছি বলে তাড়াতাড়ি বারান্দায় বেরিলয়ে এলেন।

লিন্ডার পাশের ঘরটা রেডফার্নদের। পোয়ারো ভালো করে দেখলেন, দুটো ভিন্ন স্বাতন্ত্রের ছাপ নজরে পড়লো। এছাড়া তেমন কিছুই নজরে পড়লো না।

এর পরের ঘরটা রোজামন্ড ডার্নলির, বিছানার পাশে টেবিলে কয়েকটা বই ও প্রসাধন টেবিলে প্রসাধন সামগ্রী। এই ঘরের ঠিক পরেই, উত্তর প্রান্তে এখটা খোলা দরজা ও তার সংলগ্ন বারান্দা, বারান্দা থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে পাথুরে জমিতে।

ওয়েস্টন বললেন, প্রাতঃরাশের আগে স্নান করার থাকলে সবাই এই সিঁড়িটাই ব্যবহার করে

এরকুল পোয়ারো দেখলেন, একটা সরু পথ গিয়ে মিশেছে পাথর কেটে তৈরি আঁকাবাঁকা কয়েক ধাপ সিঁড়িতে। সিঁড়ি শেষ হয়েছে সমুদ্রে। এছাড়া, আরও একটা পথ হোটেলকে ঘিরে বাঁদিকে চলে গেছে। এই সিঁড়ি বেয়ে যে কেউ কংক্রিটের সেতুর কাছে প্রধান রাস্তায় পৌঁছতে পারে।

ওয়েস্টন বললেন, সুতরাং হোটেলের মধ্যে না গিয়েও কারও পক্ষে দ্বীপের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত যাওয়া সম্ভব। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও কারো জানলা দিয়ে নজরে পড়ার সম্ভাবনা। সবার স্নানঘরগুলোর জানলা উত্তর দিকে, এছাড়াও কর্মচারীদের স্নানঘর, একতলার মালপত্র রাখার ঘর।

কিন্তু প্রথম জানলাগুলোয় আছে ঘষা কাঁচ। আর সুন্দর সকালে কেউ বিলিয়ার্ড খেলে না। সুতরাং এ যদি তার কাজ হয়ে থাকে, তাহলে সকালে এই পথ ধরেই তিনি গিয়েছিলেন।

মানে ক্যাপ্টেন মার্শাল?

হা। মনে হচ্ছে, সব কিছু যেন তারই দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে।

পোয়ারো নীরস কণ্ঠে বললেন, হয়তো–কিন্তু শুধু ব্যবহারের অজুহাতে কাউকে খুনী সাব্যস্ত করা যায় না।

ওয়েস্টন বললেন, দেখা যাক, টাইপরাইটার অ্যালিবাই থেকে কলগেট কদুর কি করতে পারে। এবার হোটেলের পরিচারিকাটির সঙ্গে কথা বলা যাক।

তিরিশ বছরের পরিচারিকাটি চটপটে, কর্মঠ এবং বুদ্ধিমতী।

ক্যাপ্টেন মার্শালের ঘর ঝাড়মোছ করে এগারো বাজতে পাঁচ মিনিটে মিঃ এবং মিসেস রেডফানের ঘরে কাজ করার সময় মার্শালের টাইপরাইটারের শব্দ সে শুনেছে। তারপর মিস ডার্নলির ঘর পরিষ্কার করে সওয়া এগারোটা নাগাদ নিচে যায় প্রাত্যহিক চা জলখাবার খেতে। তারপরে হোটেলের অন্য অংশের ঘরগুলো ঝাড়গোছ করে।

ওয়েস্টন বললেন, আচ্ছা, মিসেস মার্শাল কি তার প্রাতঃরাশ রোজ বিছানাতেই সারতেন?

হা। অবশ্য প্রাতঃরাশ বলতে সামান্য এক কাপ চা, একটু কমলালেবুর রস ও একটুকরো সেঁকা পাউরুটি।

পোয়ারো বললেন, মিসেস মার্শাল সম্পর্কে তোমার ধারণা কি, মাদমোয়াজেল?

গ্ল্যাডিশ ন্যারাকেট বললো, তার মতো বড়লোকের কথা কি আমার ছোট মুখে মানায়?

হ্যাঁ, মানায়। তোমার নিজস্ব মতামত শুনতে আমরা আগ্রহী।

মিসেস মার্শাল-ভদ্রমহিলা বলতে যা বোঝায়; ঠিক তা ছিলেন না। মানে কেমন যেন অভিনেত্রী অভিনেত্রী মনে হতো। এই হয়তো হাসি খুশি আছেন, হাসছেন, পরমুহূর্তে হয়তো কিছু খুঁজে না পেলে বা তার ডাকে সাড়া দিতে দেরি করলে অত্যন্ত খারাপ নোংরা ব্যবহার করতেন। কিন্তু তার পোশাকগুলো ছিলো দারুণ চমৎকার, দেখতে তিনি ছিলেন সুন্দরী–সুতরাং সকলেই তাকে প্রশংসা করতো।

আচ্ছা, মিসেস মার্শাল ও তার স্বামীর মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল বলতে পারো?

আপনারা নিশ্চয়ই স্বামীকে সন্দেহ করছেন; না ক্যাপ্টেন মার্শাল এত চমৎকার ভদ্রলোক, তিনি একাজ করতে পারেন না।

পোয়ারো বললেন, কিন্তু তুমি পুরোপুরি নিশ্চিত নও।

এরকম ঘটনা কাগজে প্রায়ই বেরোয় এ ক্ষেত্রেও সেরকম একটা কানাঘুমো। মানে, মিসেস মার্শাল আর মিঃ রেডফানের ব্যাপার নিয়ে। মিসেস মার্শালের মতো মহিলার কাছে অবশ্য কোনো পুরুষই নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। কিন্তু ক্যাপ্টেন মার্শালের কানে যদি ব্যাপারটা উঠে থাকে–আমার মনে হতো–মিসেস মার্শাল এ সব ঘটনা তার স্বামীর কানে যাবে ভেবে ভয় পেতেন।

তোমার এই ধারণার পেছনে কোনো প্রমাণ নেই। আচ্ছা, আজ সকালে পাওয়া মিসেস মার্শালের চিঠিগুলো কি তুমি তার কাছে নিয়ে গিয়েছিলে?

হা স্যার। রোজকার মতো সেগুলো তার প্রাতঃরাশের ট্রেতে রেখে দিই।

চিঠিগুলোর চেহারা তোমার মনে আছে?

মাথা নাড়ল মেয়েটি।

চিঠিগুলো সাধারণ চিঠির মতোই দেখতে ছিল। মনে হয়, তার মধ্যে কয়েকটা বিল ও ইস্তাহার ছিলো, কারণ পরে সেগুলো ছেঁড়া অবস্থায় ট্রেতে থাকতে দেখি

কি হলো সেগুলো?

ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়েছে, স্যার। পুলিস অফিসারের একজনকে দেখে এলাম, ডাস্টবিন ঘেঁটে দেখছেন।

সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লেন ওয়েস্টন।

পোয়ারো সামনে ঝুঁকে, আজ সকালে লিন্ডা মার্শালের ঘর পরিষ্কার করার সময় ফায়ার প্লেসটা পরিষ্কার করেছিলে?

ফায়ার-প্লেসে কোনো আগুন জ্বালানো হয়নি তাই পরিষ্কার করতে হয়নি।

কটার সময় তুমি ও ঘর পরিষ্কার করেছিলে?

এই সোয়া নটা নাগাদ, তিনি তখন প্রাতঃরাশ সারতে গিয়েছিলেন। প্রায় পৌনে দশটায় তিনি ফিরেছিলেন।

তুমি তার ঘরে আর যাওনি?

না, স্যার।

আচ্ছা, আজ সকালে প্রাতঃরাশের আগে কারা কারা স্নান করেছিলেন?

মনে হয় ক্যাপ্টেন মার্শাল এবং মিঃ রেডফানেই স্নান করেছিলেন। এটা ওদের বরাজের অভ্যাস।

লিন্ডা মার্শাল আজ সকালে স্নান করেনি?

না স্যার। তার সমস্ত স্নানের পোশাকই শুকনো ছিলো।

পোয়ারো বললেন, এটাই জানতে চেয়েছিলাম। আচ্ছা এদিকের যেসব ঘর তুমি দেখাশোনা করো, তার কোনোটা থেকে কোনো শিশি খোয়া গেছে কি?

শিশি? কিসের শিশি?

মানে–সাধারণভাবে ব্যাপারটা কি তোমার চোখে পড়তো-যদি কোনো শিশি হারিয়ে যেতো।

মিসেস মার্শালের ঘর থেকে হারালে বলা সম্ভব নয়। তার ঘরে তে শিশি বোতল থাকে। মিস ডার্নলির ঘরেও একগাদা ক্রীম আর লোশনের শিশি আছে। কিন্তু অন্য ঘরেরটা আমার নজরে পড়তো স্যার। মানে যদি আমাকে তেমনভাবে নজর করে দেখতে বলা হতো।

তাহলে যাও। ঘরগুলো একবার ভালো করে দেখে এসো।

নিশ্চয় স্যার।

ওয়েস্টন বললেন, এসব কি ব্যাপার?

পোয়ারো বললেন, আজ সকালে প্রাতঃরাশের আগে মিস ব্রুস্টার পাথরের ঘাটের কাছাকাছি সমুদ্রে স্নান করছিলেন, তিনি বলেছেন, ওপর থেকে একটা শিশি নাকি সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলা হয়, অল্পের জন্য তিনি রক্ষা পান। কে এই শিশিটা ছুঁড়েছিলো এবং কেন?

সে তো যে কেউ ফেলতে পারে।

না, পারে না। যদি কোনো খালি অপ্রয়োজনীয় শিশি আপনার প্রসাধন টেবিলে থাকে, তাহলে সেটা কি আপনি বাজে কাগজের ঝুড়িতে না ফেলে পরিশ্রম করে বারান্দায় গিয়ে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলবেন? সুতরাং এই অসামান্য শ্রমস্বীকার আপনি তখনই করবেন যখন চাইবেন, সেই বিশেষ শিশিটা কারো নজরে না পড়ুক।

ওয়েস্টন বললেন, এই মুহূর্তে আপনি নিশ্চয়ই বলে বসবেন না যে, আর্লেনা মার্শালকে কোনো রহস্যময় শিশি থেকে কোনো রহস্যময় বিষপ্রয়োগে খুন করা হয়েছে।

না, না এই শিশিতে বিষ ছিল না। কি ছিল জানি না বলেই কৌতূহলী হয়ে পড়েছি।

গ্ল্যাডিশ ন্যারাকট ফিরে এসে রুদ্ধশ্বাসে বললেন, দুঃখিত স্যার। কোনো ঘর থেকে কিছু হারিয়েছে বলে মনে হয় না। শুধু মিসেস মার্শালের ঘরটা আমাকে ধাঁধায় ফেলেছে। একগাদা শিশি বোতল।

ঠিক আছে। আচ্ছা, এমন কোনো ঘটনা যা তোমার কাছে অস্বাভাবিক রহস্যময়, অদ্ভুত বলে মনে হয়েছে–যা দেখে তুমি আপনমনেই অথবা, কোনো সহকর্মীর কাছে বলতে বাধ্য হয়েছে–ভারী অদ্ভুত তো?

কিন্তু ব্যাপারটা খুবই সামান্য। নর্দমা দিয়ে স্নানের জল বয়ে যাওয়ার একটা শব্দ মাত্র। আর সত্যিই নিচের তলায় এলসিকে আমি তখন বলেছিলাম যে বেলা বারোটায় কারও স্নান করাটা অদ্ভুত ঠেকেছে।

কার স্নান ঘর থেকে জলটা আসছিলো তখন?

সেটা জানি না স্যার। নিচের নর্দমা দিয়ে জলটা যাওয়ার শব্দ শুনেছিলাম, ব্যাস।

ঠিক জানো, সেটা স্নানের জল?

হা স্যার। স্নানের জল বয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে কারো ভুল হয় না।

গ্ল্যাডিশ চলে গেলে ওয়েস্টন বললেন, এই স্নানের ব্যাপারটার সঙ্গে নিশ্চয়ই মূল ঘটনা জড়িয়ে নেই, মঁসিয়ে পোয়ারো? কারণ এখানে রক্তের দাগ ধুয়ে ফেলার ব্যাপার নেই

পোয়ারো বললেন, এটাই হলো গলা টিপে খুন করার সুবিধে কোনো কিছুর দরকার হয় না শুধু দৈহিক শক্তি আর খুনী মন ছাড়া স্নানের ব্যাপারটায় হয়তো কোনো গুরুত্ব নেই। যে কেউ, টেনিস খেলায় যাওয়ার আগে স্নান করতে পারে।

দরজায় টোকা দিয়ে পুলিশ কনস্টেবল বললো, মিস ডার্নলি আপনাদের সঙ্গে আবার দেখা করতে চান। কি জরুরী কথা বলতে ভুলে গেছেন।

আমরা নিচে যাচ্ছি–এখুনি।

.

৮.৩

বিষণ্ণ মুখে কলগেট বললেন, এক মিনিট স্যার।

সুতরাং তাকে অনুসরণ করে ওয়েস্টন ও পোয়ারো মিসেস ক্যাসল-এর অফিসে উপস্থিত হলেন।

কলগেট বললেন, হেল্ড-এর সঙ্গে আলোচনা করে জানলাম এক ঘণ্টার কমে ওটা টাইপ করা অসম্ভব। আর এই চিঠিটা দেখুন।

প্রিয় মার্শাল–ছুটির মাঝে বিরক্ত করছি বলে দুঃখিত, কিন্তু বালি অ্যাণ্ড টেন্ডারের চুক্তি নিয়ে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে…। তারিখ ২৪ শে–অর্থাৎ গতকালের খামে পোস্ট অফিসের ছাপ। গতকাল সন্ধ্যে, ই, শি-১-এর এবং আজ সকালের লেদারকোম্ব-এর চিঠিতে এবং খামে একই টাইপরাইটার ব্যবহার করা হয়েছে। এ চিঠির কয়েকটা সংখ্যা থেকে মার্শালের চিঠির সংখ্যাগুলো তৈরি–ব্যাপারটা ভীষণ জটিল।

ওয়েস্টন, হুম–মার্শালকে তাহলে সন্দেহ থেকে বাদ দিতে হচ্ছে, এবার মিস ডার্নলির সঙ্গে আমাদের দেখা করতে হবে।

রোজামন্ড সাবলীল ভঙ্গীতে ঢুকে অপরাধী মন নিয়ে বললো, দুঃখিত। হয়তো ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়, খুবই সামান্য। আমি বলেছিলাম যে আজ সকালটা আমি সানি লজ-এ কাটিয়েছি। সেটা ঠিক নয়। আমি একবার হোটেলে গিয়ে আবার ফিরে এসেছিলাম, রোদ-চশমাটা আনতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই হোটেলে গিয়ে ওটা নিয়ে এসেছি।

আপনি সোজা আপনার ঘরে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, তবে একবার মার্শালের ঘরে উঁকি দিয়েছিলাম। ওর টাইপ করার শব্দ শুনে ভাবলাম, আজকের মতো একটা সুন্দর দিন ও টাইপ করে নষ্ট করছে। কিন্তু দরজা খুলে দেখলাম এত গভীর মনোযোগে দুহাত দিয়ে টাইপ করছে যে, ওকে কিছু বলতে পারলাম না। ও আমাকে হয়তো দেখতেও পায়নি।

এটা ঠিক কটার সময় হয়েছে মিস ডার্নলি?

এগারোটা বেজে কুড়ি মিনিট নাগাদ।

.

৮.৪

কলগেট বললেন, পরিচারিকা তাকে দেখেছে এগারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট পর্যন্ত টাইপ করতে আর মিস ডার্নলি এগারোটা কুড়িতে দেখেছে। মিসেস মার্শাল নিহত হন পৌনে বারোটা নাগাদ। সুতরাং মার্শাল এখন এসব সন্দেহের বাইরে।

চিন্তাচ্ছন্ন ভাবে পোয়ারো বললেন, মিস ডার্নলি কেন যে এই অতিরিক্ত সাক্ষ্যটুকু যেচে দিলেন সেটাই ভেবে অবাক হচ্ছি।

আচ্ছা ধরে নেওয়া যাক, মিস ডার্নলি আজ সকালে সানি লজ-এ ছিলেন না। সুতারং তিনি চট করে একটা নতুন গল্প বানিয়ে আমাদের কাছে বিবৃত করলেন। তিনি কিন্তু বেশ সতর্কভাবেই বলেছেন ক্যাপ্টেন মার্শাল তাকে দেখতে পাননি।

ওয়েস্টন অবিশ্বাসের সুরে, আপনি কি বলতে চান! মিস ডার্নলি এর মধ্যে জড়িয়ে আছন?

ইনসপেক্টর কলগেট কেশে, ঐ মার্কিন ভদ্রমহিলার কথাগুলো নিশ্চয়ই মনে আছে। তিনি স্পষ্টই ইঙ্গিত করেছিলেন, ক্যাপ্টেন মার্শালের ওপর মিস ডার্নলির যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে।

ওয়েস্টন অধৈর্য হয়ে বললেন, আর্লেনা কোনো মহিলার হাতে খুন হননি। সুতরাং পুরুষদের পেছনে আমাদের আবার আঠার মতো লেগে থাকতে হবে।

কলগেট বললেন, হ্যাঁ, আমরা বার বার একই জায়গায় ফিরে আসছি, তাই না?

পুলিসপ্রধান বললেন, এবার মনে হয়, আমার একবার পিক্সি কোভে যাওয়া দরকার। তাছাড়া পিক্সি গুহাটাও একবার দেখা দরকার। কোনো পুরুষ অপেক্ষা করার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় কিনা? আপনি কি বলেন সঁসিয়ে পোয়ারো?

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

ওয়েস্টন বললেন, যদি বাইরে থেকে কেউ এসে থাকে তাহলে পিক্সি গুহাই হচ্ছে তার লুকোবার পক্ষে চমৎকার জায়গা–তবে স্থানীয় লোকেরা হয়তো গুহার খবরটা জানে।

আজকালকার ছেলেমেয়েরা হয়তো জানে না। কারণ হোটেল খোলার সঙ্গে সঙ্গেই এই দ্বীপ ও দ্বীপ সংলগ্ন কোভগুলো ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর হোটেলের লোকদের স্থানীয় অধিবাসী বলা যায় না। মিসেস ক্যাসল লন্ডনের লোক।

ওয়েস্টন বললেন, রেডফার্নকে সঙ্গে নিতে হবে, উনিই গুহার খবরটা দিয়েছেন। আর মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনিও।

আমি? আমার অবস্থাও মিস ব্রুস্টার ও মিসেস রেডফার্নের মতো, খাড়া মই বেয়ে ওঠানামা সয় না।

আপনি তাহলে নৌকা করে যেতে পারেন।

আমরা পাকস্থলী আবার সমুদ্রে সুস্থ বোধ করে না।

এই শেষ সময়ে আমাদের এভাবে ডোবাবেন না।

সেই মুহূর্তে মিসেস ক্যাসল দরজায় উঁকি মেরে, আশা করি বিরক্ত হবেন না, সেই ধর্মযাজক মিঃ লেন এইমাত্র ফিরে এসেছেন।

ধন্যবাদ মিসেস ক্যাসল, আমরা এখুনি যাচ্ছি। কয়েক পা এগিয়ে মিসেস ক্যাসল, বেলা একটা নাগাদ একজন ভদ্রলোক ও একজন ভদ্রমহিলা এখানে এসেছিলেন। দ্বীপের ওপার থেকে মধ্যাহ্নভোজ সারতে। তাদের বলা হয়েছে, এখানে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাই মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করা সম্ভব না। মনে হয়, তারা উঁচুদরের ট্যুরিস্ট, গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে বেরিলয়েছেন।

ঠিক আছে। এবারে মিঃ লেনকে এ ঘরে পাঠিয়ে দিন।

.

৮.৫

আমি এ অঞ্চলের পুলিসপ্রধান, মিঃ লেন। আশা করি এখানকার দুর্ঘটনার কথা আপনাকে জানানো হয়েছে।

হা, ফিরেই শুনলাম ব্যাপারটা। কি ভয়ানক..তার শরীর কেঁপে উঠলো…যেদিন থেকে এখানে এসেছি–অশুভ শক্তির উপস্থিত স্পষ্ট টের পেয়েছি। বর্তমানে অশুভ শক্তিকে আমরা বিশ্বাস করি না। নরকাগ্নিকে নির্বাসনে দিয়েছি। শয়তান বিশ্বাস করি না। কিন্তু শয়তান অতীতে যেমন শক্তিমান ছিলো, আজও তেমনি আছে।

ওয়েস্টন বললেন, হ্যাঁ হয়তো তাই। কিন্তু আমার এলাকা নীরস, বাস্তববাদী একটা খুনের কিনারা করা।

খুন, বড় নিষ্ঠুর শব্দ। বলুন, কিভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি।

আজ সারা সকালটা আপনি কিভাবে কাটিয়েছেন?

বরাবরের মতো আজও আমি সকালে পদব্রজে ভ্রমণে বেরিলয়ে পড়ি, হাঁটতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আজ গিয়েছিলাম সেন্ট-পেট্রক-ইন-দ্য কোম্ব-এ প্রায় সাত মাইল দূরে। সঙ্গে কিছু খাবার নিয়েছিলাম। তাই খেয়েছি। ওখানকার গীর্জাটাও দেখে এলাম।

ধন্যবাদ, পথে আপনার সঙ্গে কারও দেখা হয়েছিলো?

দেখা হলেও কথা হয়নি। গীর্জার খাতায় আমার নামটা লিখে এসেছি। খোঁজ করলে দেখতে পাবেন।

ওয়েস্টন বললেন, ভাববেন না যে আমরা আপনাকে সন্দেহ করছি। নেহাৎই নিয়মমাফিক কাজ। মৃত মহিলা সম্পর্কে আপনি কি এমন কিছু তথ্য জানেন যা আমাদের সাহায্য করবে?

এইটুকু বলতে পারি, আর্লেনা মার্শালকে দেখা মাত্রই ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের অনুভব করতে পারি যে, তিনি এক অশুভ শক্তির উৎসবিন্দু। পুরুষের চরিত্রের সব কটি হীন নিচ প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলতে তিনি তুলনাহীন। শেষ পর্যন্ত বিচারের দণ্ড নেমে এসেছে তার পাপাচারের সমাপ্তি ঘটাতে।

পোয়ারো বললেন, বিচারের দণ্ড না কোনো মানুষের হাত তাকে শ্বাসরোধ করে খুন করেছে।

ধর্মযাজকের হাত কেঁপে উঠলো, চাপা কণ্ঠে বললেন, কি ভয়ংকর–আপনার বর্ণনা, বড় নৃশংস

আপনি বলতে পারেন, সেই অদৃশ্য হাত দুটোর মালিক কে?

জানি না–আমি কিছুই জানি না..

ওয়েস্টন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এবারে আমাদের পিক্সি কোভে যাওয়া দরকার।

লেন বললেন, ওখানেই কি ব্যাপারটা ঘটেছে? আমি আপনার সঙ্গে গেলে কি আপত্তি আছে?

পোয়ারো বললেন, নিশ্চয়ই যাবেন। আপনি আমার সঙ্গে নৌকায় চলুন, মিঃ লেন। আমরা এখুনি রওনা হবো।

০৯. প্যাট্রিক রেডফার্ন

৯.১

প্যাট্রিক রেডফার্ন একইদিনে দ্বিতীয়বার পিক্সি কোভ অভিমুখে নৌকো বেয়ে চললো। নৌকোয় এরকুল পোয়ারো পেটে হাত চেপে বিবর্ণমুখে বসে আর অন্যজন স্টিফেন লেন। একজন পুলিস কনস্টেবল ও একজন সাদা পোশকী সার্জেন্ট ও ওয়েস্টনের সঙ্গে ওরা তিনজন নৌকো থেকে নেমে মিলিত হয়ে সার্জেন্টকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে তিনি বললেন, বেলাভূমিতে প্রতিটি অংশে খুঁটিয়ে দেখে সবকিছু একজায়গায় রেখেছি, দেখুন।

একটা কাচি, গোল্ড ফ্লেক সিগারেটের খালি প্যাকেট। একইরকম পাঁচটা বোতলের ঢাকনা, বেশ কয়েকটা পোড়া দেশলাইয়ের কাঠি। তিন টুকরো সুতো, খবরের কাগজ দু-টুকরো, একটা ভাঙা পাইপের ধ্বংসাবশেষ, চারটে বোতাম, একটা মোরগের পায়ের হাড় এবং সূর্যস্নানের তেলের খালি শিশি।

ওয়েস্টন দেখে বললেন, আজকালের সৈকতের যা অবস্থা তার থেকে ভালোই। শিশির লেবেলের রঙটা চটে গেছে–অন্যান্য জিনিষগুলোর অবস্থাও একইরকম! অবশ্য কাঁচিটা একেবারে নতুন। গতকাল বৃষ্টির সময়ে এটা নিশ্চয়ই এখানে ছিলো না। কোথায় ছিল এটা?

মইয়ের ঠিক নিচে, এই ভাঙা পাইপটাও ছিল।

হয়তো কারো হাত থেকে পড়ে থাকবে। জিনিসগুলো কার মনে হয়?

জানি না স্যার। কাচিটা অতি সাধারণ নখ কাটার কাঁচি। আর পাইপটা ভালো জাতের গোলাপ কাঠের তৈরি–নিঃসন্দেহে দামী।

ক্যাপ্টেন মার্শাল আমাদের বলেছিলেন, তার পাইপটা কোথায় হারিয়ে গেছে।

ওয়েস্টন বললেন, সে ছাড়াও তো আরও অনেকে পাইপ খায়।

পোয়ারো লক্ষ্য করলেন, মিঃ লেনের হাত একবার পকেটে ঢুকেই বেরিলয়ে এলো। আপনিও পাইপ ব্যবহার করেন, তাই না, মিঃ লেন?

চমকে বললেন, হাইয়ে-পাইপ আমার অনেক পুরানো বন্ধু এবং সঙ্গী। পাইপ বের করে তাতে তামাক ভরে অগ্নিসংযোগ করলেন।

স্টিফেন লেন বললেন, মৃতদেহটা কোথায় ছিলো?

সার্জেন্ট বললো, ঠিক যেখানটায় আপনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন স্যার।

ওয়েস্টন বললেন, ফটো তোলা হয়েছে?

হ্যাঁ, স্যার।

রেডফার্নকে বললেন এবার, আসুন মশাই, আপনার গুহার রাস্তাটা দেখান

প্যাট্রিক রেডফার্ন বললো, ওই তো, ওখানে চলুন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা দুটো বড় পাথরের মাঝামাঝি একটা সরু ফাটলের সামনে এসে বললো, এটাই গুহায় ঢোকার পথ।

ওয়েস্টন ফাটলে প্রবেশ করলেন। ফাটলটাকে দেখে যতটা সরু মনে হয়েছিল ততটা নয়।

এরকুল পোয়ারো ও স্টিফেন লেনও তাকে অনুসরণ করলেন। অন্যান্যরা বাইরেই রইলেন। ওয়েস্টন একটা টর্চ জ্বালিয়ে দেখে, বেশ জায়গা, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই।

পোয়ারো বাতাসের গন্ধ নিয়ে বুঝলেন যে, বাতাস বিশুদ্ধ কিন্তু সঙ্গে মিশে আছে একটা হালকা সুগন্ধ। দুজনকে তিনি জানেন। যারা এই সুগন্ধী ব্যবহার করেন…মাথার ঠিক ওপরেই একটা সরু তাক দেখে পোয়ারো বললেন, ওখানে কি আছে দেখলে ভালো হয় না?

পোয়ারো মিঃ লেনকে বললেন, আমাদের মধ্যে আপনিই সবচেয়ে দীর্ঘকায়, যদি কিছু মনে না করেন, দয়া করে দেখবেন কি আছে?

লেন তাকে উঠে বললেন, একটা বাক্স রয়েছে দেখছি।

ওয়েস্টন বললেন, সাবধান, কোনো হাতের ছাপ থাকলেও থাকতে পারে।

সবুজ রঙের টিনের বাক্সটার গায়ে লেখা স্যান্ডউইচ।

সার্জেন্ট বললো, হয়তো পিকনিক করতে এসে কেউ ফেলে গেছে। রুমালে ধরে বাক্সের ঢাকনা খুলল।

ভেতরে নুন, গোলমরিচ রাই লেখা কয়েকটা ছোট ছোট টিনের কৌটো আর দুটো বড় কৌটো রয়েছে। নুন, গোলমরিচ ও রাইয়ের কৌটোয় কানায় কানায় ভর্তি নুন। বড় কৌটো দুটোতেও সাদা স্ফটিকের মতো গুড়ো দেখে সার্জেন্ট সন্দেহ করে আঙুলে সাদা গুড়ো নিয়ে জিভে দিল।

এটা মোটেই নুন নয় স্যার। ভীষণ তেতো লাগছে। মনে হচ্ছে কোনো মাদকদ্রব্য।

.

৯.২

হোটেলে ফিরে পুলিসপ্রধান বললেন, যদি মাদকদ্রব্য চালানোর কোনো দলের সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে নতুন করে ভাবতে হবে। মহিলাটি হয়তো সেই দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল? হয়তো মাদকদ্রব্যের নেশা ছিলো?

পোয়ারো বললেন, হয়তো তা নয়। কারণ তার স্বাস্থ্য উজ্জ্বল ছিলো আর তার হাতে

ওয়েস্টন বললেন, হয়তো আকস্মিকভাবে এই মাদকদ্রব্যের ব্যবসাটা জানতে পেরেছিলেন তাই সেই দলের লোকেরা তার মুখ চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে। সাদা গুড়ো জিনিষটা যে কি এখুনি পরীক্ষা করে জানা যাবে।

মিঃ হোরেস ব্ল্যাট ঘরে ঢুকে, এইমাত্র ফিরেই খবরটা শুনলাম। আমার নাম হোরেস ব্ল্যাট। সেই ভোরে নৌকো নিয়ে বেরিলয়েছি আর সেই জন্যেই ঘটনা থেকে ফাঁকি পড়লাম। আরে, মঁসিয়ে পোয়ারো যে। আপনিও তাহলে এর মধ্যে রয়েছেন? নাঃ, আপনার শখের গোয়েন্দাগিরি দেখতে আমার ভালোই লাগবে।

মিঃ ব্ল্যাট এগিয়ে এসে ওয়েস্টনের দিকে সিগারেট কেস এগিয়ে। আমি মশাই এক নম্বরের পাইপ ভক্ত।

অন্তঃরঙ্গ সুরে ওয়েস্টন বললেন, তাহলে পাইপই ধরান না মশাই।

এই মুহূর্তে পাইপ সঙ্গে নেই। এ পর্যন্ত যেটুকু শুনেছি, মিসেস মার্শালকে নাকি এ অঞ্চলের কোনো বেলাভূমিতে নিহত অবস্থায় পাওয়া গেছে।

পিক্সি কোভে।

শুনলাম ওকে গলা টিপে খুন করা হয়েছে? ওঃ, বড় নৃশংস তবে মেয়েটা নিজেই নিজের মৃত্যু ডেকে এনেছিলো। ওরকম ঝাঝালো মশলা-কাজটা কে করলো কিছু আঁচ পেলেন?

আপনি আজ সকালে নৌকো বাইতে কটায় বেরিলয়েছেন।

পৌনে দশটা নাগাদ একাই বেরোই।

কদ্দুর গিয়েছিলেন?

সমুদ্রের তীর ধরে প্লিমাউথের দিকে, সঙ্গে খাবার ছিলো, কিন্তু বেশি দূর যেতে পারিনি হাওয়ার জন্যে।

ওয়েস্টন বললেন, আচ্ছা মার্শালের সম্পর্কে কিছু তথ্য জানেন কি, যা আমাদের কাজে সাহায্য করবে?

এ অপরাধ প্রেম প্রবঞ্চনার পরিণতি–তবে আমার জীবনে সুন্দরী আর্লেনার কোনো ভূমিকা ছিলো না। তবে ছোকরাটার সঙ্গে মেয়েটার ব্যাপারটা ক্রমশঃ মার্শালের নজরে আসছিলো। মার্শালকে চেনা অবশ্য বড় শক্ত। দেখে মনে হয় শান্ত ও নষ। একবার তো মারপিট করার জন্য আদালতমুখো হতে হতে বেঁচে গেছে। মার্শাল ওই ফরিয়াদী লোকটাকে বিশ্বাস করেছিলো, আর সে মার্শালের দুর্দিনে সেই বিশ্বাসে মুখে লাথি মেরে সরে পড়েছিলো। শোনা কথা–আপনাদের বললাম।

তাহলে ক্যাপ্টেন মার্শালের পক্ষে তার স্ত্রীকে হত্যা করা অসম্ভব নয়।

মোটেই না। শুধু বলেছি, মার্শাল এমন ধরনের লোক যে, হঠাৎই ক্ষেপে উঠতে পারে।

পোয়ারো বললেন, মিঃ ব্ল্যাট, আজ সকালে মিসেস মার্শাল পিক্সি কোভে একজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, সেই একজন কে হতে পারে জানেন?

মনে হয়টয় নয়। একেবারে সঠিক, রেডফার্ন।

না, মিঃ রেডফান নন।

তাহলে আমি ঠিক বলতে পারছি না। কিন্তু সেই একজনটি আমি নই। তবে পাদ্রীসাহেবকে দেখেছি আর্লেনাকে ধর্মীয় ঘৃণার দৃষ্টিতে প্রায়ই লক্ষ্য করছেন। গতমাসের মামলার খবরটা পড়েছিলেন? ধর্মযাজক ও গীর্জার দারোয়ানের মেয়ের কীর্তি।

আমাদের সাহায্যে আসতে পারে এমন কিছু তাহলে আপনি জানেন না?

সেরকম কিছু মনে পড়ছে না।

এখানে ছুটির দিনগুলো আপনার কেমন লাগলো?

ভালো লাগেনি। সবকিছুই ভালো কিন্তু এ জায়গাটায় মিশুকে ভাবটুকুর বড় অভাব। সবাই এসেছি আনন্দ করে ছুটি উপভোগ করতে। তা নয় কেবল দলাদলি, দায়সারা ঠান্ডা গলায় সুপ্রভাত, শুভরাত্রি জানাচ্ছে–যাকগে আমার কথায় কান দেবেন না।

.

৯.৩

এরকুল পোয়ারো বললেন, তাহলে মিঃ ব্ল্যাট সম্পর্কে আমাদের কি মতামত?

আপনার কি মতামত তাই আগে বলুন।

তিনি হয়তো উপহাস্যস্পদ, স্ফূর্তি প্রিয়। কিন্তু আমার মনে হয় বর্তমানে তিনি অত্যন্ত বিচলিত।

.

৯.৪

কলগেট বললেন, হোটেল থেকে বেরিলয়ে পিক্সি কোভে নামার মই পর্যন্ত পৌঁছতে তিন মিনিট। অবশ্য হোটেল থেকে চোখের আড়াল হলেই প্রচণ্ডবেগে দৌড়চ্ছেন। মই বেয়ে নেমে সৈকতে পৌঁছতে এক মিনিট পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড আর ওঠবার সময় দুমিনিট। তবে সাধারণতভাবে হেঁটে গেলে, মই বেয়ে ওঠা নামা ইত্যাদি সেরে ফিরে আসতে সময় লাগবে পনের মিনিট।

ওয়েস্টন বললেন, পাইপের ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে হবে।

কলগেট বললেন, ব্ল্যাট, মার্শাল ও পাদ্রীসাহেব পাইপের নেশা করেন। রেডফার্ন সিগারেট, মার্কিন ভদ্রলোক চুরুট, মেজর ব্যারী ধূমপান করেন না। মার্শালের ঘরে একটা পাইপ রয়েছে। ব্ল্যাটের ঘরে দুটো, পাদ্রীর ঘরে একটা। পরিচারিকা বলছে মার্শালের না কি দুটো পাইপ ছিলো।

হোটেল কর্মচারীদের মধ্যে তেমন কোনো গলদ নেই। পানশালার পরিচারক হেনরির সঙ্গে মার্শালের এগারোটা বাজতে দশে দেখা হয়েছে সে কথার সমর্থন করেছে।

জোয়ারের জল সেতুর নিচে কখন নেমেছে?

সাড়ে নটা নাগাদ, স্যার।

ওয়েস্টন গোঁফে তা দিয়ে বলল, তাহলে সেতু পার হয়ে কেউ দ্বীপে আসতে পারে। তাছাড়া আমার নতুন সূত্র পেয়ে গেছি। স্যান্ডউইচের বাক্স আবিষ্কার।

ওয়েস্টন বললেন, ভেতরে আসুন।

ক্যাপ্টেন মার্শাল এসে বললেন, কবে নাগাদ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করবো কিছু বলতে পারেন?

মনে হয়, করোনারের বিচার পরশু শেষ হয়ে যাবে। এক মিনিট, ওগুলো দয়া করে নিয়ে যাবেন।

চিঠি তিনটে নিয়ে মার্শাল ব্যাঙ্গের হাসি হেসে,-আমার টাইপ করার গতিবেগ পরীক্ষা করে নিশ্চয়ই আমাকে আপনাদের সন্দেহ থেকে মুক্ত করা হয়েছে

হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন মার্শাল। মিস ডার্নলি এগারোটা কুড়িতে আপনার ঘরে এসেছিলেন, আপনি টাইপ করতে এত ব্যস্ত ছিলেন যে–তাকে খেয়াল করেননি।

মিস ডার্নলি বুঝি তাই বলেছেন? কিন্তু আমি তাকে সামনের আয়নায় তার প্রতিবিম্ব দেখেছিল

কিন্তু আপনি টাইপ বন্ধ করেননি?

না, আমার শেষ করার তাড়া ছিল।

ধন্যবাদ, ক্যাপ্টেন মার্শাল।

মার্শাল চলে যেতেই ওয়েস্টন বললেন, ওই চলে যাচ্ছেন আমাদের প্রত্যাশিত হত্যাকারী নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রতিপন্ন করে…এইতো নিসডন এসেছেন।

সাংঘাতিক একটা জিনিস পাঠিয়েছেন মশাই।

কেন, কি ওটা?

ডায়ামরফিন হাইড্রোক্লোরাইড। সে জিনিসটাকে হেরোইন বলা হয়ে থাকে।

কলগেট বলে উঠলেন, এবার পায়ের তলায় শক্ত মাটি পাওয়া গেছে। এই মাদকদ্রব্যের ব্যাপারটা যে সমস্ত ঘটনার মূলে তা আমি বাজি ধরে বলতে পারি।

১০. করোনারের সংক্ষিপ্ত বিচার

১০.১

করোনারের সংক্ষিপ্ত বিচার আজকের মতো শেষ–পক্ষকালের জন্য মূলতুবী রাখা হয়েছে।

ডার্নলি নিচু গলায় বললো, যতটা ভেবেছিলাম সেরকম কিছু খারাপ হয়নি, কি বলল, কেন?

জনতার মধ্যে চাপা গুঞ্জন। এর কথাই তোমাকে বলেছিলাম। হ্যাঁ, ওই লোকটার বউটাকেই কে খুন করেছে। দেখতে পাচ্ছো, ওই যে যাচ্ছে…

গুঞ্জনের তীব্রতা তার কানে এলো, সেই শব্দগুচ্ছই আজকের প্রভাতী সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।

ক্লিক ক্লিক…ক্যামেরা ঝলসে উঠলো ক্লান্তিহীনভাবে। রোজামন্ড বললো, ক্যাপ্টেন মার্শাল ও তার জনৈক বান্ধবী বিচারের শেষে রেড বুল থেকে বেরিলয়ে আসছেন। কেন, এড়াবার চেষ্টা করে লাভ নেই। বাস্তবের মুখোমুখি তোমাকে হতেই হবে। পুরনো যত বস্তাপচা শব্দে এর জবাব দিয়ে বাষ্পভরা কুটিল ঠোঁটে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকো।

তুমি বুঝি তাই করতে?

হ্যাঁ, কিন্তু তোমার পথ হলো বর্ণচোরা বহুরূপীয় পথ। এখানে সকলের চোখে তুমি ভীষণভাবে স্পষ্ট কারণ তুমি নিহত মহিলার স্বামী।

দোহাই তোমার, রোজামন্ড

তোমার ভালোর জন্যেই এসব বলছি, সোনা।

ক্রমে মার্শাল ও রোজামন্ড গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে আসতে আসতে রোজামন্ড বললো, আমাদের সেই ক্ষুদে মানুষটি পোয়ারো–তিনি কি সত্যিই এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন?

আমি কি করে জানবো, রোজামন্ড?

ভদ্রলোকের বয়সের ভীমরতি ধরেছে।

ওরা কংক্রীটের সেতুর কাছে এসে দাঁড়ালেন। রোজামন্ড হঠাৎ বললো, এই মুহূর্তে আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, ওরকম একটা নৃশংস ঘটনা এখানে ঘটতে পারে…।

কিন্তু প্রকৃতি বড় নিষ্ঠুর-প্রকৃতির কাছে এটা একরকম তুচ্ছ, তার বেশি কিছু নয়।

.

১০.২

লিন্ডা সেতুর ও-প্রান্তে এসে দাঁড়ালো, চোখের কোলে কালি, ওষ্ঠাধারে শুষ্কতা ও রুক্ষতা। ও বললো, কি হলো–কি বললো ওরা?

বিচার দু-সপ্তাহের জন্য মূলতুবী রাখা হয়েছে।

কিন্তু–ওদের মনে কি হচ্ছে?

মার্শাল হেসে, বড় অবুঝ তুমি–পুলিস যাই ভাবুক–সেটা ওরা এখন কাউকে বলছে না।

মার্শাল হোটেলে প্রবেশ করলেন। লিন্ডা ডাকলো, রোজামন্ড।

এত বেশি ভেবো না, লিন্ডা। তোমার মানসিক আঘাত–সবই জানি। ঘটনার বীভৎসতা তোমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে-তার বেশি নয়। তুমি নিজেও আর্লেনাকে একটুও পছন্দ করতে না।

তুমি কিছু বুঝতে পারছে না। আর ক্রিস্টিনও কখনও বোঝে না। তোমরা শুধু ভাবো। আমি অযথা চিন্তা করে অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আসলে আমি যা জানি, তা যদি তুমি জানতে

কি জানো তুমি, লিন্ডা?

না, কিছু না।

শোনো লিন্ডা, সমস্ত ভুলে গিয়ে তুমি তোমার ভবিষ্যতের কথা ভাবো। আর সবচেয়ে প্রয়োজন, মুখে একেবারে কুলুপ এঁটে থাকবে।

লিন্ডা যেন কুঁকড়ে গেলো, তুমি তাহলে সব জানো।

আমি কিছুই জানি না। আমার মতে ভবঘুরে কোনো পাগল হঠাই এই দ্বীপে এসে আর্লেনাকে খুন করেছে আর প্রকৃতপক্ষে তাই ঘটেছে।

একটা কথা আমাকে বলতেই হবে। আমার মাকে

বলো, কি হয়েছে তোমার মায়ের

মাকে-মাকে খুনের অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল, তাই না?

হা।

আর তারপর, বাবা তাকে বিয়ে করে। তাতে মনে হয় না যে বাবা খুন করাটাকে সত্যি অন্যায় মনে করে না।

আর কখনও এ ধরনের কথা বলবে না। তোমার বাবার বিরুদ্ধে পুলিসের হাতে কোনো প্রমাণ নেই। তোমার বাবা সম্পূর্ণ নিরাপদ। আর এ জায়গা ছেড়ে চলে গেলেই, তুমি সব ভুলে যাবে–

আমি কোনোদিন ভুলবো না-বলেই ছুট দিলো।

.

১০.৩

একটা কথা আপনার কাছে আমি জানতে চাই, মাদাম

ক্রিস্টিন বললো, বলুন?

হ্যাঁ, বলছি। সেদিন দৈবক্রমে বলে ফেলা একটা সামান্য কথা–খুনের দিন সকালে আপনি মিস লিন্ডা মার্শালের ঘরে গিয়েছিলেন, ঘরে তাকে পাননি। তারপর কিভাবে তিনি ঘরে ফিরে আসেন। আপনি বলেছিলেন ও নাকি স্নান করতে গিয়েছিলো।

কিন্তু সে তো একই কথা।

না, মাদাম। আপনার উত্তর বিশেষ মনোভাবের ইঙ্গিত দিচ্ছে, আপনার কথাতেই এ সন্দেহ স্পষ্ট। ও বললো, ও নাকি স্নান করতে গিয়েছিলো। তাকে দেখে, তিনি স্নান করতে গিয়েছিলেন শুনে আপনি যথেষ্ট অবাক হন?

সত্যি, আপনার বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়…যখন লিন্ডা বললো, ও স্নান করতে গিয়েছিলো, তখন ওর হাতে একটা প্যাকেট দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম…

তার ভেতরে কি ছিলো আপনি জানেন কি?

হা জানি। সুতোটা ছিঁড়ে যাওয়ায় প্যাকেটটা আলগা হয়ে গিয়েছিল, তাই কতকগুলো মোমবাতি মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছিলো।

তার মোমবাতি কেনার কারণটা কি বলেছিলো?

না। তবে হয়তো ঘরের আলোটা কমজোরী তাই রাতে পড়াশোনা করার জন্য মোমবাতিগুলো কিনেছিলো

মিস মার্শালের বিছানার পাশে একটা চমৎকার বৈদ্যুতিক আলো আমার নজরে পড়েছে। আচ্ছা, মোমবাতিগুলো যখন পড়ে যায়, তখন তার মুখের অবস্থা কেমন ছিলো?

ওকে কেমন বিচলিত-হতবুদ্ধি মনে হয়েছিলো।

তার ঘরে একটা সবুজ ক্যালেন্ডার দেখেছেন?

একটা-সবুজ ক্যালেন্ডার-হা, ওরকম একটা ক্যালেন্ডার আমি দেখেছি কিন্তু কোথায় দেখেছি জোর দিয়ে বলতে পারবো না। কিন্তু আপনি কি বলতে চাইছেন, এ শব্দের অর্থ কি?

পোয়ারো বিবর্ণ-বাদামী চামড়ায় বাঁধানো ছোট্ট বইটা বার করে, এটা আগে কখনও দেখেছেন?

হ্যাঁ–মনে হয়, সেদিন গ্রামের লাইব্রেরিতে দাঁড়িয়ে লিন্ডা এই বইটা দেখছিলো, কিন্তু আমাকে দেখেই সে বইটা বন্ধ করে ফেললো–একটু অবাক হয়েছিলাম।

পোয়ারো নামপত্রটি খুলে ধরলেন।

ডাকিনীবিদ্যা, মায়াবিদ্যা ও লক্ষণহীন বিষের মিশ্রণ পদ্ধতির বিস্তারিত ইতিহাস।

ক্রিস্টিন বললো, আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। এ সবের মানে কি?

খুনের দিন সকালে টেনিস খেলতে যাবার আগে আপনি কি স্নান করেছিলেন?

উহু। স্নান করবার ইচ্ছে আমার ছিলো না।

হোটেলে ফিরে স্নান ঘরে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। হাতমুখ ধোবার জন্য, ব্যস।

স্নানের জন্য কল খুলে রাখেননি তাহলে।

.

১০.৪

এরকুল পোয়ারো মিসেস গার্ডেনারের টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালেন। ভদ্রমহিলা চমকে, আরে, মঁসিয়ে পোয়ারো, কখন এলেন, এইমাত্র বিচার সেরে ফিরলেন বুঝি? দেখুন না, এই টুকরো ছবির ধাঁধা নিয়ে মেতে আছি, এই সাদা টুকরোটা যে কোথায় লাগবে?

পোয়ারো টুকরোটা নিয়ে, এটা এইখানে বসবে, মাদাম। এটা বেড়ালটার একটা অংশ।

হতেই পারে না। এটা তো কালো বেড়াল।

কিন্তু লক্ষ্য করুন, বেড়ালটার লেজের প্রান্তভাগটা সাদা।

তাই তো, সত্যি আপনার বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হয়। যারা এই ধাঁধাগুলো তৈরি করে তারা কত ফন্দিই না আঁটে।

আর একটা টুকরো যথাস্থানে বসিয়ে, মঁসিয়ে পোয়ারো, বেচারা মেয়েটা খুন হলো ভাবলেই আমি শিউরে উঠি। আজ সকালে মিঃ গার্ডেনারকে বলেছিলাম–যে করে থোক এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো। কিন্তু গোয়েন্দাগিরির প্রসঙ্গে বলি। আপনার কায়দাকানুনগুলো জানতে ভীষণ ইচ্ছে করে–যদি একটু বলেন

ব্যাপারটা আপনার এই ধাঁধার মতো মাদাম। সমস্ত টুকরোগুলো একজায়গায় জড়ো করতে হয়। তারপর মানানসই জায়গায় নির্ভুলভাবে বসিয়ে দিতে হয়।

আপনার হাতে কি এইরকম অনেক টুকরো রয়েছে?

হ্যাঁ মাদাম। হোটেলের প্রত্যেকেই একটি করে টুকরো দিয়েছেন ধাঁধার জন্য। আপনিও তার মধ্যে রয়েছেন। আপনার একটা মন্তব্য আমাকে ভীষণভাবে সাহায্য করেছে।

দারুণ আনন্দ হচ্ছে, একটু খুলে বলুন না।

মাপ করবেন, শেষ দৃশ্যে দেখতে পাবেন।

.

১০.৫

এরকুল পোয়ারো মার্শালের দরজায় টোকা মারলেন, ভেতরে টাইপরাইটারের শব্দ।

ভেতরে আসুন, ঘুরে তাকালেন না মার্শাল। দেওয়ালে টাঙানো আয়নায় প্রতিবম্ব পোয়ারোর চোখে চোখ রেখে বিরক্তির সুরে, বলুন মঁসিয়ে পোয়ারো, কি চান?

অনধিকার প্রবেশের জন্য ক্ষমা চাইছি। একটা প্রশ্ন।

প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়ে আমি ক্লান্ত। পুলিসের প্রশ্ন ছাড়া আর কারো প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজন আমার নেই।

শুধু আপনার স্ত্রীর মৃত্যুর দিন সকালে টাইপ সেরে টেনিস খেলতে যাবার আগে কি আপনি মান…

স্নান? তার ঘন্টাখানেক আগেই তো আমার মান হয়ে গেছে?

ধন্যবাদ আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই। পোয়ারো নিঃশব্দে দরজা ভেজিয়ে চলে গেলেন।

লোকটা নির্ঘাত পাগল।

.

১০.৬

মিঃ গার্ডেনারের সঙ্গে পোয়ারোর পানশালার বাইরে দেখা। তিনি দুটো ককটেল নিয়ে মিসেসের কাছে যাচ্ছিলেন?

আসবেন নাকি, মঁসিয়ে পোয়ারো?

মাথা নেড়ে বললেন, করোনারের বিচার সম্পর্কে আপনার মতামত কি গার্ডেনার?

মনে হয়, ওরা ফলাফল সম্পর্কে অনিশ্চিত। তবে আপনার পুলিস তাদের তুরুপের তাস আস্তিনে লুকিয়ে রেখেছে। মিসেস গার্ডেনারকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারলে বাঁচি। ওর স্নায়ুর সহ্য ক্ষমতা কম।

পোয়ারো বললেন, স্পষ্ট করে বলুন তো, মিসেস মার্শাল সম্পর্কে আপনার ধারণা কী ছিলো?

নিচু পর্দায় গলার স্বর, জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো, মেয়ে মহলে কতগুলো কথা আমার কানে এসেছে। সত্যি, কিন্তু মেয়েটা ছিলো এক নম্বরের বোকা।

আপনার কথাটা ভেবে দেখার মতো…

.

১০.৭

ডার্নলি বললো, এবার তাহলে আমার পালা। আগের দিন পুলিসপ্রধান তার তদন্ত নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আপনি ছিলেন নীরব দর্শক। আর আজ আপনি নিজে তদন্ত শুরু করেছেন। প্রথমে মিসেস রেডফার্ন, তারপর মিসেস গার্ডেনার, এখন আমার পালা।

সানি লজ-এ পোয়ারো ওর পাশে বসলেন, আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। বর্তমান দুর্ঘটনা নিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে ভালোই লাগবে।

আমার তো মনে হয় ব্যাপারটা খুবই সহজ। মেয়েটার অতীত জীবনেই মূল সূত্র লুকিয়ে আছে।

অতীতে, বর্তমানে নয়!

আমার মনে হয়, হয়তো খুব তাড়াতাড়িই আলেনা মার্শাল পুরুষদের সম্পর্কে ক্লান্তি বোধ করতো। ওর অনুগামীদের মধ্যে এমন একজন ছিলো–যে এই ব্যবহারে তেমন খুশি হয়নি। আমার ধারণা সে আর্লেনার পিছু নিয়ে উপযুক্ত সুযোগে ওকে খুন করে।

আপনি বলতে চান যে বাইরের লোক, সেতু পার হয়ে দ্বীপে এসেছে?

হ্যাঁ। সম্ভবতঃ ওই গুহাটায় লুকিয়ে ছিলো।

কিন্তু খুনের পরিকল্পনা নিয়ে কোনো মানুষ প্রকাশ্য দিবালোকে সেতু পার হয়ে হোটেল অতিক্রম করার ঝুঁকি নেবে না।

সকলের চোখ এড়িয়ে আসাটা অসম্ভব নয়।

কিন্তু আবহাওয়া!

হ্যাঁ, খুনের দিনটা চমৎকার ছিলো। কিন্তু আগের দিনটা ঘন কুয়াশায় ঢাকা ছিলো এই দ্বীপটা। তাকে শুধু সমুদ্রতীরে রাতটা গুহায় কাটাতে হবে।

পোয়ারো নিচে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে, জানেন মাদমোয়াজেল, আমি সবসময় এই কথাটাই বিশ্বাস করি যে, সবচেয়ে সম্ভাব্য ব্যক্তিই কোনো অপরাধের নেপথ্য নায়ক। একেবারে শুরুতে একজনের প্রতি এই ইঙ্গিত স্পষ্ট। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে তার পক্ষে এ খুন করা অসম্ভব। আচ্ছা আপনাকে একটা প্রশ্ন করি।

নিশ্চয়ই।

সেদিন সকালে আপনি যখন টেনিস খেলার পোশাক পরতে আসেন, তখন কি স্নান করেছিলেন?

স্নান, কি বলতে চান আপনি!

চীনামাটির মসৃণ সুদৃশ্য আধার, কল খুলে জল ভর্তি করে শরীর ডুবিয়ে সেই জলে, শেষে বেরিলয়ে এসে হুশ-হুশ, অস্বচ্ছ জল চলে যায় পাইপ বেয়ে।

আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

বরং সম্পূর্ণ সুস্থ।

কি জানি, তবে আমি স্নান করিনি। কেউ হঠাৎ স্নান করতে যাবে কেন?

পোয়ারো হাসলেন, শান্তভাবে বাতাসের আঘ্রাণ নিলেন।

দুঃসাহসের সঙ্গে আমি বলবো যে সুগন্ধী আপনি ব্যবহার করেন তা অপূর্ব-এর একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে–আছে চমৎকার ছলনাময়ী আকর্ষণ। গ্যাব্রিয়েল, নম্বর ৮, তাই না?

হ্যাঁ, সবসময় আমি এটাই ব্যবহার করি।

মৃতা মিসেস মার্শালও এই সুগন্ধী ব্যবহার করতেন। অত্যন্ত আধুনিক ও দামী। খুনের দিন সকালে আপনি এখানে বসেছিলেন, মিস ব্রুস্টার এবং মিঃ রেডফার্ন সমুদ্রপথে যাওয়ায় আপনাকে অথবা আপনার রঙিন ছাতাটাকে দেখেছিলেন। হলফ করে বলতে পারেন যে সারা সকালে আপনি একবারের জন্যেও পিক্সির সেই গুহাতে ঢোকেননি?

জানতে চাইছেন, আমি আর্লেনাকে খুন করেছি কিনা?

না, পিক্সি গুহায় গিয়েছিলেন কিনা জানতে চাইছি।

ওটা কোথায় তাই আমি জানি না, তাছাড়া ওখানে যাবো কেন?

গ্যাব্রিয়েল নম্বর ৮ ব্যবহার করে এমন একজন খুনের দিন ওই গুহায় গিয়েছিলো।

আর্লেনা ওই সুগন্ধি ব্যবহার করতো। সেদিন ও পিক্সি কোভে গিয়েছিলো, গুহাতে ও গিয়ে থাকবে। আর সারা সকালে তো আমি এ জায়গা ছেড়ে কোথাও যাইনি।

শুধু একবার ক্যাপ্টেন মার্শালের ঘরে গিয়েছিলেন। টেবিলের মুখোমুখি ঝোলানো আয়নায় তিনি আপনাকে দেখেছিলেন, মাদমোয়াজেল।

পোয়ারার দৃষ্টি নিবদ্ধ রোজামন্ড ডার্নলির কোলে, ওর ভাঁজ করা হাতের দিকে, দীর্ঘ আঙুলের সমন্বয়ে সুন্দর গড়নের হাত।

আমার হাতের দিকে ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আপনার কি ধারণা

.

১০.৮

এরকুল পেয়ারো গালকোভে যাবার রাস্তার শীর্ষদেশে নির্জন সৈকতে লাল জামা ও গাঢ় নীল প্যান্ট পরিহিত এক কৃষকায় শরীরকে দেখতে পেলেন।

পোয়ারো বেলাভূমিতে এসে লিন্ডা মার্শালকে দেখলেন। তিনি নিঃশব্দে ওর পাশে বসে অনুভব করলেন, কত অনভিজ্ঞ এবং দিশেহারা মেয়েটি।

ও বললো, কি ব্যাপার? কি চান?

সেদিন আপনি বলেছেন, আপনার সত্যাকে আপনি ভালোবাসতেন এবং তিনিও ভালো ব্যবহার করতেন। কথাটা সত্যি নয়–আপনি তাকে পছন্দ করতেন না–এটা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট।

হয়তো সত্যি। কিন্তু মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে কথা বলা ঠিক নয়।

কোনো খুনের ঘটনায় লৌকিক ভদ্রতার চেয়ে সত্যভাষণের গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ আর্লেনা মার্শালের হত্যাকারীকে খুঁজে বার করাই আমার প্রধান কাজ।

উঃ কি ভয়ঙ্কর, আমি সব ভুলে যেতে চাই।

কিন্তু ভুলতে পারছেন কি?

আপনি এমনভাবে বলছেন আপনি সব জানেন।

হয়তো জানি। যদি বলি, তোমার চুড়ান্ত অশান্তিতে আমি তোমাকে সাহায্য করবো!

ও লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আমার কোনো অশান্তি নেই। আপনি কি জানতে চাইছেন?

আমি মোমবাতির কথা বলছি…।

আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো, আমি আপনার কথা শুনবো না। কিছুতেই শুনবো না।

ও সৈকত পার হয়ে ছুটে চললো, আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে নিমেষে মিলিয়ে গেলো।

১১. তদন্তের বিবরণ

১১.১

কলগেট তার তদন্তের বিবরণ দিচ্ছিলেন, একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনা স্যার। ব্যাপারটা মিসেস মার্শালের টাকা সম্পর্কে। ব্ল্যাকমেলের গল্পটার সমর্থনে আমার হাতে প্রমাণ এসেছে। স্যার আরস্কিন পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড মিসেস মার্শালকে দিয়েছিলেন, তা এখন মাত্র পনেরো হাজারে দাঁড়িয়েছে।

পুলিসপ্রধান শিস দিয়ে, তাই না কি! তাহলে বাকি টাকাগুলো গেলো কোথায়?

মাঝে মাঝে কিছু সম্পত্তি হাত বদল করেছেন। প্রতি ক্ষেত্রেই লেনদেন হয়েছে ঋণপত্রের বিনিময়ে–অর্থাৎ সে টাকা তিনি এমন কারো হাতে তুলে দিয়েছেন যার পরিচয় প্রকাশ পাক তিনি চাননি। সেই ব্ল্যাকমেলার এই হোটেলেই রয়েছে। নিঃসন্দেহে ওই তিনজনের একজন।

কিন্তু তেমন জোরালো কিছু তথ্য পাইনি স্যার। মেজর ব্যারী, তার নিজের কথা অনুযায়ী একজন অবসরপ্রাপ্ত ফৌজি অফিসার। আয় পেনশনের টাকা আর কিছু কোম্পানির শেয়ারের লভ্যাংশ। কিন্তু গতকয়েক দফায় বেশ মোটা টাকা ব্যাঙ্কে রেখেছেন, ওগুলা বাজী জেতা টাকা। সত্যি তার ছোট বড় সবরকমের রেসের মাঠে যাতায়াত আছে।

ধর্মযাজক স্টিফেন লেনের পরিচয়ে কোনো বুজরুকি নেই। ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য বছরখানেক হলো জীবিকা ত্যাগ করেছেন। এই কারণে মানসিক রুগীদের এক নার্সিংহোমে ছিলেন। ডাক্তারদের থেকে কাজের কথা আদায় করা কঠিন। কিন্তু ধর্মযাজকের প্রধান রোগ শয়তান সম্পর্কে আচ্ছন্নতা–বিশেষ করে স্ত্রীলোকের বেশে-রক্তবর্ণ স্ত্রীলোক–ব্যাবিলনের বেশ্যা। স্টিফেন লেনকে সন্দেহ করা যেতে পারে। নিহত মিসেস মার্শাল ছিলেন রক্তবর্ণ স্ত্রীলোক লাল চুল, সুতরাং এই অশুভ মেয়েটিকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়া কর্তব্য বলে মনে করেছিলেন।

ব্ল্যাকমেলের ব্যাপারে খাপখাওয়ার মতো কিছু পাওনি?

না স্যার। তবে নিজস্ব আয় আছে। আর খুনের দিন কেউই রাস্তায় কোনো পাদরিকে দেখেনি। গীর্জার খাতায় শেষ নামটা লেখা রয়েছে তিনদিন আগে। ধরুন দিন দুই গীর্জায় গিয়ে হয়তো নামটা ২৫ শে সই করে অসেন। দিন পনেরো খাতাটা নাকি কেউ খোলেওনি।

আর আমাদের তৃতীয় জন?

ওখানেই নির্ঘাত কোনো গোলমাল রয়েছে। ভদ্রলোক যে আয়কর দেন তা তার লোহার ব্যবসার তুলনায় অনেক বেশি। তিনি শেয়ার বাজারেও যাতায়াত করেন। তবে তিনি অজ্ঞাত কোনো উপায়ে বেশ রোজগার করেছেন।

ওয়েস্টন বললেন, তাহলে মিঃ ব্ল্যাট একজন পেশাদার ব্ল্যাকমেলার?

তা না হলে হেরোইনের মামলায় জড়িয়ে আছেন। যিনি মাদকদ্রব্যের চালানোর তদন্তে রয়েছেন তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। সম্প্রতি চোরাপথে বেশ কিছু হেরোইন এদেশে আসছে। কিন্তু কিভাবে আসছে সেটা এখনো খাজ পায়নি।

হেরোইন চালানোর দলে যদি জড়িয়ে পড়ায় মার্শাল মহিলার মৃত্যু হয় তাহলে উচিত হবে ব্যাপারটা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাতে তুলে দেওয়া।

বড় দুঃখের কথা, মার্শালের দু-দুটো জোরালো খুনের উদ্দেশ্যে থাকা সত্ত্বেও সে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে বসে রইলো।

ওয়েস্টন হাসলেন, দুঃখ করো না কলগেট। আমাদের কৃতিত্ব দেখাবার সুযোগ এখনও রয়েছে। ব্ল্যাকমেল সূত্র এবং উন্মাদ ধর্মযাজক-সমাধানের এ দুটো পথ আছে। আমার ধারণা মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত সমাধানটা অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত। যেভাবেই ধরো না কেন আমরা যথেষ্ট

কলগেট বললেন, ও, ভালো কথা, মিসেস মার্শালের জে.এন. সই করা যে চিঠিটা পাওয়া গিয়েছিলো তার খোঁজ নিয়েছি। ভদ্রলোক চীন দেশে নিরাপদেই আছেন। মিস ব্রুস্টার এই মক্কেলের কথাই বলছিলেন। সবকিছুই আমাদের খোঁজ নেয়া হয়ে গেছে; সব ফলাফলই শূন্য।

ওয়েস্টন বললেন, আমাদের বেলজিয়াম বন্ধুর খবর কি?

ভদ্রলোক অদ্ভুত ধরনের মানুষ, তাই না? পরশুদিন আমাকে বললেন যে গত তিন বছরে শ্বাসরোধে ঘটা প্রতিটি খুনের মামলার তথ্য তার চাই।

তাই নাকি? আচ্ছা আমাদের পাদরিসাহেব কবে নাগাদ ওই নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিলেন।

গত ইস্টারের একবছর আগে, স্যার।

ওয়েস্টন বললেন, একটা ঘটনা আমার মনে আছে–ব্যাগশট-এর কাছাকাছি কোনো অঞ্চলে একটা যুবতীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। মেয়েটা ওর স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে কোথায় যেন গিয়েছিলো আর ফেরেনি। আরও একটা ঘটনার নাম দিয়েছিলো। নির্জন জঙ্গলের রহস্য। দুটো ঘটনাই সারের।

কলগেট বললেন, সারে? তাহলে তো পুরোপুরি খাপ খেয়ে যাচ্ছে। যদি তাই হয়…

.

১১.২

এরকুল পোয়ারো দ্বীপের সর্বোচ্চ শিখরেবসেছিলেন, তিনি ইস্পাতের মইটা লক্ষ্য করছিলেন, মইয়ের শীর্ষপ্রান্তের কাছে কতগুলো বিশাল রুক্ষ পাথর পড়ে রয়েছে। যেগুলো নিচের সৈকতে নামতে ইচ্ছুক যে কোনো ব্যক্তিকে আড়াল করতে পারে। পোয়ারো মনে মনে টুকরো ছবির ধাঁধার টুকরোগুলো মিলিয়ে নিলেন। আর্লেনা মার্শালের মৃত্যুর দিন কয়েক আগে স্নান সৈকতে কাটানো একটি সকাল। ব্রিজ খেলার একটি সন্ধ্যা। কে কে ছিলেন তখন।

খুনের আগের দিন সন্ধ্যা। সমুদ্রের সামনের পাহাড়ের কিনারায় ক্রিস্টিনের সঙ্গে তার কথাবার্তা হোটেলে ফেরার পথে তার দেখা একটি দৃশ্য।

প্রতিটি টুকরো একই সম্পর্কহীন তথ্যগুলির প্রতিটি নিজের নিজের জায়গায় খাপ খেয়ে যেতে বাধ্য। তারপর নির্দিষ্ট জায়গায় প্রতিষ্ঠিত তথ্যগুলো হাতে নিয়ে তিনি পরবর্তী পদক্ষেপ ফেলবেন।

অশুভ শক্তি…

হাতের টাইপ করা কাগজটায় চোখ রাখলেন পোয়ারো। নীলি পার্সল–শবহ্যামে-এর কাছাকাছি এক নির্জন জঙ্গলে তাকে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। আজ পর্যন্ত সেই খুনীর কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি।

নীলি…?

অ্যালিস করিগানের মৃত্যুর প্রতিটি শব্দ তিনি গভীর মনোযোগে পড়তে লাগলেন।

.

১১.৩

ইনসপেক্টর কলগেট বসে থাকা পোয়ারোর কাছে এগিয়ে এলেন। পোয়ারোর হাতের কাগজগুলো এক পলক দেখে বললেন, ওই মামলাগুলো নিয়ে কিছু করলেন স্যার?

হ্যাঁ, ওগুলো খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছি।

আমি নিজেও ওগুলো সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে পড়েছি–বিশেষ করে অ্যালিস করিগানের ব্যাপার পড়ে পুলিসের সঙ্গে দেখা করেছি।

বলুন বন্ধু, আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে।

অ্যালিস কারিগানকে ব্ল্যাকরিজ হিথ-এর সিজার্স গ্রোভ-এ শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়–মলে কম্প যেখানে নীলি পার্সেলকে পাওয়া গিয়েছিলো। সেখান থেকে মাত্র মাইল দশেক দূরে–এবং দুটো জায়গাই হোয়াইটরিজের বারো মাইলের মধ্যে মিঃ লেন যেখানে ধর্মর্যাজক ছিলেন।

পোয়ারো বললেন, অ্যালিস করিগানের মৃত্যু সম্পর্কে আরও বলুন।

ওর মৃত্যুর সঙ্গে নীলি পার্সলের মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই কারণ পুলিস খুনী হিসেবে অ্যালিসের স্বামীকেই সন্দেহ করে, কিন্তু গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গ উঠতেই আমাদের স্বামীদেবতাটি সন্দেহের থেকে একেবারে মুছে গেলেন। অ্যালিসের মৃতদেহটি আবিষ্কার করেছিলো পল্লী অঞ্চলে ভ্রাম্যমান একজন শক্তসমর্থ খাটো প্যান্ট পরিহিতা যুবতী। মেয়েটি ল্যাংকাশায়ারে এক স্কুলের খেলার দিদিমনি। ঠিক সোরায় চারটেয় মৃতদেহটি সে আবিষ্কার করেছিলো এবং তার মতে মেয়েটি দশ মিনিট আগে মারা যায়। পুলিস সার্জন পৌনে ছটা নাগাদ মৃতদেহটি পরীক্ষা করে মেয়েটির মতে সমর্থন জানান। নীলি পার্সল মানে সেই অস্থিরমনা পরিচারিকা যাকে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় মর্লে কম্পে পাওয়া যায়। ওদের বিশ্বাস, একই লোক এই দুটো খুনের জন্য দায়ী। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই লোককে ওরা ধরতে পারেনি। আর এখন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তৃতীয় একজন মহিলা মারা গেলেন–জনৈক ভদ্রলোক একইভাবে সন্দেহের দৃশ্যপটে উপস্থিত।

পোয়ারো তখন অস্ফুট কণ্ঠে বললেন,-কোন টুকরোটা লোমের কম্বলের আর কোন টুকরোটা বেড়ালের লেজের বুঝে ওটা ভারী শক্ত।

কলগেট চমকে উঠলেন, কি বলছেন স্যার?

ক্ষমা করবেন। আমি একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। বলুন ইনসপেক্টর, যদি আপনার সন্দেহ হয় যে কেউ একজন মিথ্যে বলছে-কিন্তু আপনার হাতে প্রমাণ নেই, তাহলে কি করবেন?

ইনসপেক্টর কলগেট চিন্তা করলেন।

তবে আমার মনে হয়, অনর্গল কেউ যদি মিথ্যে কথা বলে যায়, তাহলে শেষের দিকে তালগোল পাকিয়ে ধরা পড়ে যেতে বাধ্য।

পোয়ারো জানালেন, হ্যাঁ, আপনার কথা সত্যি। কিছু বিবৃতি পুরোপুরি মিথ্যে।

আপনার মন অদ্ভুতভাবে কাজ করে, তাই না স্যার? তাহলে একটা প্রশ্ন করছি, শাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাওয়াগুলোর দিকে আপনার নজর গেলো কি কারণে? কখনও ভেবেছি এটাই খুনির প্রথম অপরাধ নয়।

কিন্তু অ্যালিস করিগানের মৃত্যু–বলুন, ইনসপেক্টর কলগেট, এই খুনের সঙ্গে এই মৃত্যুর একটা অদ্ভুত মিল আপনার নজরে পড়েছে না?

পোয়ারো হালকা স্বরে বললেন, ও আপনার নজরে পড়েছে?

.

১১.৪

পুলিসপ্রধান বললেন, একটা সিদ্ধান্ত নেবার আগে সে বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

ঠিক করেছি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে ডেকে মামলাটা ওদের হাতে দেবো। আমার মতে, পুরো ব্যাপার দাঁড়িয়ে আছে মাদকদ্রব্য চোরাচালানের ওপর। পিক্সি গুহাই ছিলো অন্যতম আস্তানা। তবে ব্যক্তিটি কে, তা আমি বলতে পারি। হোরেস ব্ল্যাট।

পোয়ারো বললেন, তাহলে আপনার বিশ্বাস ব্ল্যাটই খুনী?

সেটাই মনে হচ্ছে। এও হতে পারে আর্লেনা ব্যাপারটা জানতে পেরেছিলেন, সে সম্পর্কে ব্ল্যাটকে কিছু বলেছিলেন, মিথ্যে সাক্ষাৎকারের নাম করে আর্লেনাকে ডেকে পাঠায় ও তাকে খুন করে। সুতরাং যা বললাম। আমার মতে সবচেয়ে ভালো পথ হলো গোটা ব্যাপারটা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাতে তুলে দেওয়া। কি বলেন মঁসিয়ে পোয়ারো?

চিন্তান্বিত ভাবে পোয়ারো বললেন, হয়তো ঠিক হবে।

ওয়েস্টন বললেন, অবশ্য জানি, আপনার ও কলগেটের ধারণা অন্যরকম। কিন্তু আমার কেবলই মনে হচ্ছে এ মামলা আমাদের জন্য নয়।

পোয়ারো বললেন, এখন একটা পিকনিকে গেলে মন্দ হয় না।

 ১২. পিকনিকে রাজি

১২.১

পিকনিক, মঁসিয়ে পোয়ারো?

পোয়ারো বললেন, আপনার কাছে ব্যাপারটা অত্যন্ত খারাপ লাগছে, তাই না? কিন্তু আমার ধারণা বর্তমান পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করে তুলতে গেলে আমাদের প্রয়োজন স্বাভাবিক। এতে সকলেই খুব খুশি হবে। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করুন, মাদমোয়াজেল। প্রত্যেককে এ পিকনিকে রাজি করান।

অপ্রত্যাশিত মার্শালের সঙ্গে প্রস্তাবটা গৃহীত হলো। ক্যাপ্টেন মার্শাল নিজেই বলেছেন সেদিন তাকে প্লিউমাউথ যেতে হবে। পোয়ারো রোজামন্ডকে বুঝিয়েছেন যে, এই পিকনিকে লিন্ডাকে ওর বর্তমান মানসিক অবস্থা থেকে অন্তত সাময়িকভাবে হলেও মুক্তি দেবে। আপনি পারবেন ওকে রাজি করাতে।

মেজর ব্যারী বলেছেন, পিকনিক তিনি পছন্দ করেন না। সকালে সকলে জমায়েত হলেন। তিনটে গাড়ির ব্যবস্থা করা হলো। মিঃ ব্ল্যাট সরব ও উৎফুল্ল কণ্ঠে টুরিস্ট গাইডের অনুকরণ করলেন। এইদিকে আসুন। ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ–ডার্টমুরে যাওয়ার পথ এইদিকে। এখানে রয়েছে বুনো ঝোঁপ ও জাম গাছের ছায়া, রয়েছে ডেভনশায়ারের বৈশিষ্ট্য ও অভিযুক্ত অপরাধীদের সমাবেশ স্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে আসুন অথবা সঙ্গে নিন। সুন্দরী সঙ্গিনীদের প্রত্যেককে স্বাগত জানাই। জানাই স্বাৰ্গীয় প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখানোর প্রতিশ্রুতি। তাড়াতাড়ি চলুন।

শেষ মুহূর্তে ডার্নলি, লিন্ডা আসবে না। ও বলেছে ওর নাকি ভীষণ মাথা ধরেছে। আমি কয়েকটা অ্যাসপিরিন দিয়েছি। সেগুলো খেয়ে ও শুয়ে পড়েছে। আমার মনে হয় আমার যাওয়াতা ঠিক হবে না।

মিঃ ব্ল্যাট ইয়ার্কির ছলে ওর হাত চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন, সেটি হচ্ছে না দেবী। অনুষ্ঠানকে মধুর করে তুলতে আপনার উপস্থিতি প্রয়োজন। আপনাকে আমি বন্দী করলাম, হা। হা। ডার্টমুরের কারাগারে আপনাকে নির্বাসন দেওয়া হলো।

ক্রিস্টিন বললো, আমি লিন্ডার কাছে থাকছি।

প্যাট্রিক বললো, কি হচ্ছে ক্রিস্টিন–চলো

পোয়ারো বললেন, না না, মাথা ধরায় কারও পক্ষে একা থাকাটাই ভালো। চলুন রওনা হওয়া যাক।

তিনটে গাড়ি চলতে শুরু করলো।

ওরা প্রথমে গেলেন শীপস্টরের আসল পিক্সির গুহায়, তার প্রবেশপথ অনুসন্ধান করে যথেষ্ট আনন্দ পেলেন। অবশেষে একটা ছবি পোস্টকার্ডের সাহায্যে পথটা খুঁজে পেলেন।

বড় বড় পাথরে পা ফেলে চলার পথটা ছিলো অত্যন্ত বিপজ্জনক। এরকুল পোয়ারো অনুসরণ করলেন পাথর থেকে পাথরে লাফিয়ে যাওয়া ক্রিস্টিন ও মিঃ রেডফার্নকে। সবাই সন্তর্পণে এগিয়ে চললো, সেই সঙ্গে অনুসন্ধানকারীদের ছবি তুলতে ভুললেন না।

গার্ডেনাররা এবং পোয়ারো পথের পাশে বসে রইলেন।

জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো, আচমকা ছবি ভোলা অস্বস্তির কারণ হয়। অবশ্য, যদি না সেগুলো কেবল বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে ভোলা হয়। মিঃ ব্ল্যাটের সত্যিই কোনো কান্ডজ্ঞান নেই। সেদিন সমুদ্রতীরে তিনি সকলের বসা অবস্থায় একটা ছবি তুলেছেন। কিন্তু আগে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো। মিঃ ব্ল্যাট সবাইকে ওই ছবির কপি দিচ্ছেন। আপনাকেও একটা দিয়েছেন না?

পোয়ারো বললেন, ওই ছবির মূল্য আমার কাছে অনেক।

মিসেস গার্ডেনার বলে চললেন, আর আজ দেখুন। মামুলি হৈ-হুঁল্লোড়ে সর্বক্ষণ মেতে আছেন। এই লোকটাকে বাড়িতে রেখে এলেই ভালো হতো।

হায় মাদাম, সেটা অত্যন্ত কঠিন কাজ হতো।

কঠিন বলে কঠিন। ওই লোকটা গুতোণ্ডতি করে হলেও নিজের জায়গা করে নেয়।

সেই মুহূর্তে নিচ থেকে ভেসে আসা সমবেত উল্লাস চিৎকার জানিয়ে দিলো গুহার প্রবেশপথ পাওয়া গেছে।

পিকনিক দল এবার দেখলো পাহাড়ি ঝোঁপের পাশ দিয়ে একটা নদীর তীরেমনোরম এক সবুজ প্রান্তর। নদী পার হওয়ার একটা সরু কাঠের তক্তা দিয়ে পোয়ারো ও মিঃ ও মিসেস গার্ডেনার পার হয়ে গুল্ম ঝোপে ঘেরা একটি ছোট্ট সবুজ জায়গায় এলেন, যেটা পিকনিকের পক্ষে আদর্শ স্থান।

অন্যান্যরা সহজেই দৌড়ে কাঠের সেতুটা পার হয়েছেন কিন্তু এমিলি স্টার সেই সরু তক্তার মাঝখানে চোখ বোজা অবস্থায় দাঁড়িয়ে।

পোয়ারো ও রেডফার্ন ব্যস্তভাবে তাকে উদ্ধার করলেন।

খাবার ভাগ করে দেওয়া হলো, পিকনিক শুরু হলো।

এই ছোট্ট অনুষ্ঠানটুকু সন্দেহ ও ত্রাসে ঘেরা এক পরিবেশ থেকে তাদের মুক্তি দিয়েছে। এখানে চঞ্চল জলের স্বপন। জলজ উদ্ভিদের নেশা ধরানো হালকা গন্ধ এবং গুল্ম পর্ণের উষ্ণ রঙীন ছটা। হত্যা, পুলিসী তদন্ত সব অস্তিত্বকে ভুলিয়ে দিয়েছিলো। এমনকি মধ্যমণি মিঃ ব্ল্যাট পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়ার পর নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়লেন।

অবশেষে এই সুন্দর পরিকল্পনার জন্য পোয়ারোকে সবাই ধন্যবাদ জানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে হোটেলের দিকে ফিরলেন। আজকের দিনটা এককথায় চমৎকার ভাবে কাটলো।

.

১২.২

মেজর ব্যারী বেরিলয়ে, এই যে দিনটা ভালোই কাটলো তো?

মিসেস গার্ডেনার বললেন, নিশ্চয়ই খোলা সবুজ মাঠগুলোর তুলনা হয় না। একেবারে খাস ইংরেজি আর সাবেকী। সেখানকার সতেজ বাতাসে শুধু তৃপ্তির ছোঁয়া।

মেজর হেসে, জলার মাঝে বসে স্যান্ডউইচ খাওয়া–এ সবের বয়েস কি আর আছে?

হোটেল পরিচারিকা গ্ল্যাডিশ ন্যারাকট দ্রুত এসে বললো ক্রিস্টিনকে, মাদাম, ছোট দিদিমণি, মিস মার্শালের জন্য ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এইমাত্র চা নিয়ে তার ঘরে গিয়ে তাকে জাগাতে পারলাম না, আর তাকে এত–অদ্ভুত দেখাচ্ছে….

ক্রিস্টিন দিশেহারা, পোয়ারো তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ওরা সিঁড়ি ভেঙে লিন্ডার ঘরে উপস্থিত হলেন, এবং বুঝতে পারলেন কিছু একটা হয়েছে। ওর মুখের রঙ অদ্ভুত দেখে পোয়ারো নাড়ি দেখলেন, আর দেখলেন চাপা দেওয়া একটা খাম। তিনি বললেন, লিন্ডার নামে কি শুনছি? কি হয়েছে ওর?

পোয়ারো বললেন, যত শীঘ্রই পারেন একজন ডাক্তার নিয়ে আসুন। আমাদের হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে।

তিনি নিজের নাম লেখা খামটা খুললেন তাতে লিন্ডার ছিমছাপ কিশোরী হাতে লেখা কয়েকটা লাইন।

“আমার মনে হয় এটাই মুক্তির সহজ পথ। বাবাকে বলবেন তার বিচারে আমাকে ক্ষমা করতে। আমিই আর্লেনাকে খুন করেছি। এতে আমার খুশি হওয়ার কথা কিন্তু হইনি। সব কিছুর জন্য আমার ভীষণ দুঃখ হচ্ছে।”

.

১২.৩

সবাই বিশ্রাম কক্ষে জমায়েত হয়েছেন। প্রত্যেকেই চুপচাপ বসে–প্রতীক্ষারত।

ডাঃ নিসডন ভেতরে এসে বললেন, এ যাত্রা মেয়েটা টিকে গেলেও যেতে পারে–তবে আশা খুব বেশি নেই।

মার্শাল বললেন, কিন্তু জিনিষটা ও পেলো কেমন করে?

দরজা খুলে নিসডন পরিচারিকাটিকে ডেকে বললেন, তুমি যা দেখেছো আর একবার আমাদের বলল।

মেয়েটি কান্নাভেজা গলায় বললো, আমি মোটেই ভাবিনি ভেতরে ভেতরে কোনো গলদ রয়েছে–অবশ্য ছোট দিদিমণিকে দেখে একটু অবাক লেগেছিলো। মিস মার্শাল তখন মিসেস রেডফানের ঘরে বেসিনের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন একটা ছোট শিশি হাতে নিয়ে। আমাকে ঢুকতে দেখেই চমকে শুধু বললেন, এই তো এটা খুঁজছিলাম বলেই ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।

ক্রিস্টিন ফিসফিস করলো, আমার ঘুমের ট্যাবলেটগুলো।

ডাক্তার রূঢ়স্বরে, সে খবর মিস লিন্ডা পেলে কি করে?

ক্রিস্টিন বললো, আমি ওকে একটা দিয়েছিলাম আর্লেনা মারা যাওয়ার রাতে। ও বলেছিলো ঘুম আসছে না, একটাতেই হবে তো? আমি বলেছিলাম, হ্যাঁ, এগুলো খুব জোরালো-আমাকে একসঙ্গে দুটোর বেশি খেতে বারণ করা হয়েছে।

নিসডন বললেন, মেয়েটা একসঙ্গে ছ-ছটা ট্যাবলেট গিলেছে।

ক্রিস্টিন ফুঁপিয়ে কেঁদে, ওঃ, এসবই আমার দোষে হলো, শিশিটা তালাচাবি দিয়ে রাখা উচিত ছিলো।

সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ হতো।

ও মারা যাচ্ছে–সম্পূর্ণ আমার দোষে…।

মার্শাল বললেন, না আপনার কোনো দোষ নেই। ও ট্যাবলেট খেয়েছে স্ব-ইচ্ছায়। হয়তো–এই সবচেয়ে ভালো হলো।

ডার্নলি চিৎকার করে উঠলো। আমি বিশ্বাস করি না লিন্ডা আর্লেনাকে খুন করেছে। কারণ সেটা সাক্ষ্য প্রমাণ অনুযায়ী অসম্ভব।

ক্রিস্টিন বললো হয়তো, অতিরিক্ত মানসিক দুশ্চিন্তায় ও ব্যাপারটা কল্পনা করে নিয়েছে।

কর্নেল ওয়েস্টন ঘরে ঢুকে, এসব কি শুনছি?

ডাঃ নিসডন চিঠিটা পুলিসপ্রধানের হাতে দিলেন। তিনি বিস্ময়ভরা সুরে বললেন, কিন্তু এর কোনো মানে হয় না–একেবারে অর্থহীন। অসম্ভব। তাই না পোয়ারো?

না, আমার ধারণা অসম্ভব নয়।

ক্রিস্টিন বললো, কিন্তু আমি ওর সঙ্গে পৌনে বারোটা পর্যন্ত ছিলাম, পুলিসকেও তাই বলেছি।

পোয়ারো বললেন, আপনার সাক্ষ্যই ওকে অ্যালিবাই জুগিয়েছে–হ্যাঁ। কিন্তু লিন্ডা মার্শালের হাতঘড়ির ওপর নির্ভর করে আপনার সাক্ষ্য, আপনি নিজে নিশ্চিত নন যে ঠিক পৌনে বারোটায় আপনি মিস মার্শালকে ছেড়ে চলে আসেন–ও আপনাকে যা বলেছে তাই। এবারে ভাবুন মাদাম, যখন আপনি বেলাভূমি ছেড়ে আসেন তখন কি তাড়াতাড়ি গিয়েছিলেন?

যতদূর মনে পড়ছে–ধীরে সুস্থেই গিয়েছিলাম।

মাদাম, সে সময় আপনি কি চিন্তা করছিলেন?

আমি–এখান থেকে স্বামীকে না জানিয়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম।

পোয়ারো বললেন, ঠিক তাই। আপনি তখন একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেবার কথাই ভাবছিলেন। আমি বলবো, সেই সময়ে আপনার পারিপার্শ্বিকের প্রতি সম্পূর্ণ বধির ও অন্ধ ছিলেন এবং থমকে দাঁড়িয়ে আপনার মানসিক সমস্যার কথা ভাবছিলেন।

সত্যিই তাই, দেরি হয়ে যাবে ভেবে তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকি কিন্তু লাউঞ্জের ঘড়িটা দেখে বুঝলাম তখনও অনেক সময় রয়েছে।

ঠিক তাই, পোয়ারো মার্শালের দিকে ফিরে। খুনের পরে আপনার মেয়ের ঘর থেকে যেগুলো পেয়েছি আপনাকে এখন বলা প্রয়োজন। ঘরের চুল্লীতে পেয়েছি বিশাল এক টুকরো গলা মোম, কিছু পোড়া চুল। পিচবোর্ড ও কাগজের কিছু ছেঁড়া অংশ, একটা আলপিন। বইয়ের তাকে লুকানো অবস্থায় একটা ডাকিনীবিদ্যা ও মায়াবিদ্যা সংক্রান্ত বইয়ের একটি বিশেষ চিহ্নিত পৃষ্ঠায় মোমের পুতুলের সাহায্যে, যা ইঙ্গিত শত্রুর প্রতীক, মৃত্যুসাধনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া বর্ণনা করা আছে। তারপর সেই মোমের পুতুলকে গলিয়ে অথবা বিকল্প হিসেবে একটা আলপিন আপনি বসিয়ে দিতে পারেন এই পুতুলের হৃদপিণ্ডে। ফলে ইঙ্গিত ব্যক্তির আসন্ন মৃত্যুফল নির্ধারিত হয়ে যাবে। পরে মিসেস রেডফার্নের কাছ জেনেছি সেইদিন ভোরে লিন্ডা এক প্যাকেট মোমবাতি কিনে এনেছিলো। মোমবাতির মোম দিয়ে লিন্ডা কাঁচা হাতে একটি পুতুল তৈরি করে–সম্ভবত আর্লেনার মাথা থেকে কেটে নেওয়া চুল দিয়ে সেটাকেও সাজিয়ে নেয় যাদুশক্তি জাগিয়ে তোলার জন্য–তারপর একটা আলপিন হৃদপিণ্ডে বসিয়ে পুতুলটাকে পিচবোর্ড জ্বেলে গলিয়ে ফেলে। এটা একটা শিশুসুলভ মনের কুসংস্কার, খুনের আকাঙ্খ।

এই আকাঙ্খায় লিন্ডা মার্শালের পক্ষে ওর সৎমাকে খুন করা কি সত্যিই সম্ভব ছিলো?

কিন্তু আলেনা মার্শাল যে পিক্সি কোভে সেটা ওর জানা প্রয়োজন এবং দৈহিক শক্তির দিক থেকে সেই বিশেষ কর্ম সম্পাদনে ওকে হতে হবে সক্ষম।

যদি লিন্ডা মার্শাল অন্য কারো নামে আর্লেনাকে চিঠি দিয়ে থাকে পিক্সি কোভে যাবার জন্যে। আর এই মানসিক বিশৃঙ্খলার সঙ্গী হয় অমানুষিক শক্তি। এছাড়া লিন্ডা মার্শালের মাকে ও খুনের দায়ে অভিযুক্ত করে বিচার হয়।

মার্শাল বললেন, বিচারে ও মুক্তি পেয়েছিলো। আর আমার স্ত্রী রুথসম্পূর্ণ নির্দেী ছিলো। লিন্ডা মার্শাল আর্লেনাকে খুন করেছে এ আমি বিশ্বাস করি না। এ সম্পূর্ণ অবাস্তব।

পোয়ারো বললেন, তাহলে কি চিঠিটা জাল?

মার্শাল মনোযোগ দিয়ে চিঠিটা পরীক্ষা করে, না, এটা লিন্ডারই হাতে লেখা।

পোয়ারো বললেন, তাহলে এর দুটো ব্যাখ্যা হতে পারে। হয় চিঠিটা ও নির্ভেজাল বিশ্বাসে লিখেছে। নিজেকে সত্যিই খুনী জেনে অথবা–এই চিঠি লিখেছে অন্য কাউকে রক্ষা করার জন্য তাকে পুলিস সন্দেহ করছে।

আপনি আমার কথা বলছেন?

সেটা খুব সম্ভব নয় কি, মার্শাল?

না, অসম্ভব। লিন্ডা নিশ্চিতভাবেই জানতো। পুলিস আমার অ্যালিন্ডাই মেনে নিয়েছে এবং তাদের মনোযোগ এখন অন্যদিকে।

পোয়ারো বললেন, লিন্ডা শুধুই ভাবেনি যে পুলিস তাকে সন্দেহ করছে, বরং সে জানতো, আপনিই প্রকৃত অপরাধী।

এ রীতিমতো হাস্যকর।

কি জানি। মিসেস মার্শালের মৃত্যুর একটা ব্যাখ্যা বলছে, তাকে কেউ ব্ল্যাকমেল করছিলো। সেদিন সকালে তিনি সেই ব্ল্যাকমেলারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে খুন হয়েছিলেন। দ্বিতীয়টি হলো, পিক্সি গুহাকে মাদকদ্রব্য চোরাচালানের কাজে ব্যবহার করা হতো। তিনি সে সম্পর্কে কিছু জেনে ফেলায় তাকে খুন করা হয়। তৃতীয় সম্ভাবনা হলো কোনো ধর্মোন্মাদ ব্যক্তির হাতে তার মৃত্যু হয়। আর চতুর্থ–আপনার স্ত্রীর মৃত্যুতে আপনার আর্থিক লাভ। হ্যাঁ মানছি আপনার পক্ষে স্ত্রীকে খুন করা অসম্ভব কিন্তু কেউ যদি আপনাকে সাহায্য করে থাকে।

একটা কঠিন ক্রুদ্ধস্বরে, কি বলতে চাইছেন আপনি?

আমি বলতে চাই, দুজন মানুষ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। একথা সত্যি যে একই সঙ্গে আপনার পক্ষে পিক্সি কোভে যাওয়া আর চিঠিটা টাইপ করা সম্ভব ছিলো না–কিন্তু চিঠিটা শর্টহ্যান্ডে লিখে রাখার মতো সময় আপনার হাতে ছিলো–যখন আপনি জল্লাদ কর্মে ব্যস্ত ছিলেন, তখন অন্য কেউ হয়তো সে চিঠি আপনার ঘরে বসে টাইপ করে থাকবে।

মিস ডার্নলি বলেছে, তিনি এগারোটা দশে লজ ছেড়ে আসেন এবং আপনার ঘরে টাইপ করতে দেখেন। সেই সময়ে মিঃ গার্ডেনার হোটেলে আসে তার স্ত্রীর উলের বল নিয়ে যেতে। মিস ডার্নলির সঙ্গে দেখা হয়নি। দেখে মনে হচ্ছে মিস ডার্নলি লজ ছেড়ে আসেননি এবং আপনি বলেছেন যে, মিস ডার্নলি সওয়া এগারোটায় ঘরে উঁকি মারলে আপনার আয়নায় তাকে দেখতে পান। খুনের দিন আপনার ঘরে টাইপ ও কাগজ এক কোণে রাখা ছিলো। অথচ সেই বিবৃতি মিথ্যে। সবকিছু সরিয়ে দেন আপনার গল্পকে প্রমাণ করার জন্য কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমার মনে হয় দুজনেই মিথ্যা কথা বলছেন।

পোয়ারো বললেন, আর্লেনা মার্শালের খুনীর মতো অত চালাক নই। ভেবে দেখুন। হ্যাঁ, এতে সন্দেহ নেই।

প্যাট্রিক রেডফার্ন চাপা সুরে বললো, কোনো বদমাইশ আমার নাম ব্যবহার করে থাকবে। প্যাট্রিক রেডফার্ন চেয়ে রইলো। তারপর আইরিশ সুরে বললো, আপনি পাগল হয়ে গেলেন? আমি তো সৈকতে আপনার সঙ্গে ছিলাম। আপনি গুহায় লুকিয়ে থেকে রাস্তা পরিষ্কার হওয়ার অপেক্ষা করছিলেন।

কিন্তু সেই দেহটা! মিস ব্রুস্টার এবং আমি সেটা দেখেছি। মৃতদেহ নয়, সেই মহিলার জীবন্ত দেহ, যিনি আপনাকে সাহায্য করেছেন। তার হাতে পায়ে রঙের প্রলেপ আর মুখ ঢাকা ছিলো টুপিতে। ক্রিস্টিন, আপনার স্ত্রী অথবা স্ত্রী নয়–আপনার দুষ্কর্মের সাথী। এ খুনে সাহায্য করেছেন, যেমন করে ছিলেন অতীতে, যেমন তিনি অ্যালিশ করিগানের দেহ আবিষ্কার করেন অ্যালিশ করিগানের মৃত্যুর কুড়ি মিনিট আগে–অ্যালিশকে খুন করেছিলো তার স্বামী, এডওয়ার্ড করিগান–আপনি।

ক্রিস্টিনের স্বর তীক্ষ্ণ ও শীতল, সাবধান, প্যাট্রিক, মাথা গরম কোরো না।

পোয়ারো বললেন, শুনলে হয়তো খুশি হবেন। এখানে ভোলা একটা গ্রুপ ফটো দেখে সারে পুলিশ খুব সহজেই আপনাকে এবং আপনার স্ত্রীকে চিনতে পেরেছে। তারা সঙ্গে সঙ্গে আপনাদের সনাক্ত করেছেন এডওয়ার্ড করিগান ও ক্রিস্টিন ডেভারিন বলে–ক্রিস্টিন ডেভারিন অর্থাৎ সেই মহিলাটি যিনি অ্যালিশের মৃতদেহ আবিষ্কার করেছিলেন।

প্যাট্রিক রেডফার্ন ক্রোধে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার মুখ যেন কোনো খুনীর কোনো বাঘের। সে চিৎকার করে উঠলো, শালা হতচ্ছাড়া নাকগলানো টেকো গ্রুফো গোয়েন্দা।

সে ঝাপিয়ে পড়লো, এরকুল পোয়ারোর গলায় দুহাত চেপে বসলো, ক্ষিপ্ত স্বরে অশ্রাব্য শব্দের ফুলঝুরি।

১৩. সূর্যস্নান

১৩.১

পোয়ারো বললেন, কোনো এক সকালে সৈকতে আমরা বসে আলোচনা করছিলাম কসাইয়ের দোকানে সাজানো মাংসের মতো পড়ে থাকা সূর্যস্নান শরীরগুলো নিয়ে। তখনই আমার মনে হয়েছে, দুটো ভিন্ন শরীরের মধ্যে কী সামান্যই না পার্থক্য যদি সতর্ক দৃষ্টিতে দেখা যায়। একজন মোটামুটি স্বাস্থ্যের তরুণীর সঙ্গে দ্বিতীয় কোনো তরুণীর মিল প্রচুর। দুটো তামাটে পা। তামাটে বাহু, দুয়ের মাঝে এক টুকরো সাঁতার পোশাক–সূর্য কিরণে শুয়ে থাকা শুধুই একটা দেহ, যখন কোনো মহিলা চলাফেরা করেন,হাসেন, কথা বলেন-তখন একটা ব্যক্তিত্ব চোখে পড়ে-চোখে পড়ে স্বতন্ত্র। কিন্তু সূর্যসাধনার সময়–না।

সেইদিনই আমরা অশুভ শক্তির প্রভাব নিয়ে মিঃ লেনের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। তিনি অত্যন্ত সচেতন মানুষ–অশুভের প্রভাব তিনি অনুভব করেন। তাঁর মতে অশুভ শক্তি লুকিয়ে ছিলো আর্লেনার ব্যক্তিতে।

কিন্তু অশুভ শক্তি উপস্থিত থাকলেও সে আর্লেনা মার্শালের মধ্যে আদৌ কেন্দ্রীভূত ছিলো মা। যেহেতু উনি সুন্দরী ও চটক ছিলো চেহারায়, পুরুষরা যেহেতু ওর দিকে চোখ ফেরাতে, যেহেতু তার মতো মহিলারাই ঘর ও জীবন নষ্ট করেন। কিন্তু সে সর্বনাশা আকর্ষণে কখনোও পুরুষদের টানতো না–বরং পুরুষরাই তাকে টানতো। তার সম্পর্কে প্রথমে যে কথাটি শোনা যায় তা হলো, কিভাবে সেই লোকটি, যার বিবাহ বিচ্ছেদের মামলায় উনি জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করে। আর ঠিক তখন উপস্থিত হয় আমাদের কাপ্টেন মার্শাল। যার বিপদাপন্ন রমণী সেবার ব্রত চিকিৎসার অযোগ্য, ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন এবং তাকে বিয়ের প্রস্তাব জানালেন। ক্যাপ্টেন মার্শালের মতো লাজুক নিঃশব্দ মানুষের প্রকাশ্য বিচার ছিলো এক চরম যন্ত্রণা–সেই কারণেই আমরা দেখতে পাই প্রথম স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসা এবং করুণা, যাকে আদালতে অভিযুক্ত করা হয়েছিলো খুনের অপরাধে, যে খুন তিনি করেননি। তার মৃত্যুর পর আর একজন সুন্দরী মহিলা। হয়তো একই ধরনের অভিযুক্ত হলেন প্রকাশ্য কলঙ্কে। আবার মার্শাল তার প্রাণকার্য সম্পন্ন করলেন। আলেনা নির্বোধ। তার করুণা ও প্রতিরক্ষার অযোগ্য এবং হৃদয়হীনা, তা সত্ত্বেও স্ত্রীর মোটামুটি ছবিটা তার অজানা ছিলো না। স্ত্রীর সঙ্গে ভালোবাসা শেষ হয় কিন্তু তারপরে আর্লেনার প্রতি একটা দুঃখবোধ তার ছিলো। তার কাছে আর্লেনা ছিলো একটা শিশুর মতো, যিনি জীবন কেতাবের একটা বিশেষ পৃষ্ঠা কোনোরকমেই অতিক্রম করতে পারছিলেন না।

এক বিবেকহীন পুরুষের অনিবার্য শিকার হিসেবে আর্লেনাকে আমি দেখেছিলাম। আর সেই পুরুষকে আমি খোঁজ করে পেয়েছিলাম প্যাট্রিক রেডফার্নের মধ্যে। এ ধরনের ফটকাবাজ পুরুষেরা যেভাবেই হোক মহিলাদের মূলধন করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে। অশুভের কেন্দ্রবিন্দুতে আমি প্যাট্রিককেই দেখেছি, আর্লেনাকে নয়।

আর্লেনার জনৈক বয়স্ক প্রেমাস্পদ, যিনি তার বিশাল অঙ্কের অর্থ আর্লেনার জন্য রেখে গেছেন। সাধারণতঃ অর্থসংক্রান্ত ব্যাপারে কোনো পুরুষের হাতে অনিবার্যভাবে প্রতারিত হয়ে থাকেন ও ধরনের মহিলারা। মিস ব্রুস্টার একজন যুবকের কথা বলছেন। সে আর্লেনার জন্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। তার যে চিঠিটা মিসেস মার্শালের ঘরে পেয়েছি, সে আর্লেনাকে হীরে জহরত দিয়ে সাজাতে চাইলেও, প্রকৃতপক্ষে তার কাছ থেকে পাওয়া একটা চেকের প্রাপ্তিসংবাদ জানিয়েছে। যার সাহায্যে সে আদালত এড়াতে পারবে বলে আশা করে। সুতরাং তার কাছ থেকে ব্যবসায়িক লগ্নীর নাম করে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করাটা রেডফানের কাছে নিতান্তই ছেলেখেলা ছিলো। লম্বা গল্প ফেঁদে আর্লেনাকে মুগ্ধ করে ফেলেছিলেন–বলেছিলেন কিভাবে তিনি তার স্ত্রীর বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে কি কাণ্ডটা হচ্ছে, তাহলে প্যাট্রিকের অর্ধচন্দ্র প্রাপ্তির সম্ভাবনা ছিলো প্রবল।

রেডফার্ন ঠাণ্ডা মেজাজে স্থির করেছিলেন প্রয়োজন বুঝলেই আর্লেনাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবেন–অতীতের একটা খুনের সাফল্য তাকে আরও বেশি সাহসী করে তুলেছিলো–যে মেয়েটিকে তিনি খুন করেছিলেন, তাকে তিনি করিগান নাম নিয়ে বিয়ে করে এক বিশাল অঙ্কের জীবনবীমা করাতে মেয়েটিকে রাজি করান।

তার পরিকল্পনায় সবরকম সাহায্য করেছেন যিনি এখানে রেডফানের স্ত্রীর পরিচয়ে আছেন এবং যার সঙ্গে রেডফার্নের সত্যিকারের সম্পর্ক রয়েছে যার অবিশ্বাস্য অভিনয় ক্ষমতাকে অবহেলা করা যায় না। ক্রিস্টিন রেডফার্ন একটা বিশেষ ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছেন। হতভাগিনী বেচারা স্ত্রীর ভূমিকায় দুর্বল হলেও বুদ্ধিমতী। সূর্যানে তার শরীরে ফোস্কা পড়ে, যে কারণে তার গায়ের রঙ সাদা ফ্যাকাসে, উঁচু জায়গায় উঠলে তার মাথা ঘোরে, সব মিলিয়ে নিজের দুর্বল ভাবটাকে ফুটিয়ে তোলা–অথচ তিনি আর্লেনা মার্শালের সমান লম্বা। ক্রিস্টিন বলেছেন, তিনি স্কুলের দিদিমণি ছিলেন কিন্তু সেখানে তার চাকরি ছিলো খেলার দিদিমণি। নিজের হাতঘড়ি লুকিয়ে রেখে এগারোটা পঁচিশে লিন্ডাকে জিজ্ঞেস করলেন কটা বাজে। লিন্ডা পৌনে বারোটা বলে সমুদ্রে স্নান করতে নামে আর ক্রিস্টিন ছবি আঁকার সরঞ্জাম গুছিয়ে লিন্ডার হাতঘড়িটা তুলে নেন। কাটা ঘুরিয়ে সময়টা আবার ঠিক করে দেন। তারপর পাহাড়ি পথ ধরে সরু জমিটুকু একছুটে পার হয়ে মইটার কাছে পৌঁছে যান। ঢোলা জামা পাজামা ছেড়ে। সেগুলো এবং ছবি আঁকার সরঞ্জাম একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে তরতর করে মই বেয়ে নেমে যান।

তখন আর্লেনা সৈকতে দাঁড়িয়ে ভাবছিলেন প্যাট্রিকের এত দেরি হচ্ছে কেন। হঠাৎ মইয়ের সামনে প্যাট্রিকের স্ত্রীরত্নটিকে দেখে তাড়াতাড়ি সৈকত পার হয়ে পিক্সি গুহায় ঢুকে পড়ে।

ক্রিস্টিন লুকানো জায়গা থেকে টুপিটা বের করে। টুপিটার পেছনের কানায় লাল রঙের পরচুলার গুচ্ছ আলপিন দিয়ে আঁটা ছিলো। তারপর টুপি ও পরচুলায় ঘাড় ও মুখ ঢেকে হাত পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন তিনি। সময়ের হিসেব একেবারে নিখুঁত। কারণ মিনিট দুয়েক পরেই প্যাট্রিক ও এমিলি ব্রুস্টার নৌকো নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। মনে রাখবেন যে ব্যক্তি নিচু হয়ে মৃতদেহ পরীক্ষা করেছেন তিনি প্যাট্রিক। প্যাট্রিকই আঘাত পেয়েছেন–ভেঙে পড়েছেন তার প্রেমিকার মৃত্যুতে। তিনি জানেন মিস ব্রুস্টারের মাথা ঘোরে, তিনি কখনোই মইটা বেয়ে উপরে উঠবেন না। তিনি গেলে নৌকো নিয়েই যাবেন আর প্যাট্রিক থাকবেন মৃতদেহের কাছে কারণ খুনী হয়তো আশেপাশে কোথাও। লুকিয়ে আছে। মিস ব্রুস্টার চলে যেতে ক্রিস্টিন উঠে পড়লেন। প্যাট্রিকের লুকিয়ে আনা কাচিটা দিয়ে টুপিটাকে টুকরো করে ফেললেন আর টুকরোগুলো সাঁতার পোশাকের ভেতর লুকিয়ে ফেললেন এবং ছুটে গিয়ে মই বেয়ে উঠে ঢিলে জামা পাজামা পরে হোটেলের দিকে ছুটে চললেন। কোনোরকমে স্নান সেরে নকল সূর্যস্নানের প্রলেপ ধুয়ে। টেনিস খেলার পোশাক পরে বেরোবার মতো সময়টুকু হাতে রয়েছে। আরও একটা কাজ উনি করেছেন। পিচবোর্ডের টুপির টুকরোগুলো এবং লাল পরচুলার গুচ্ছ উনি লিন্ডার ঘরের তাপচুল্লীতে পুড়িয়ে ফেলেন–সঙ্গে একটা ক্যালেন্ডারের পাতা যাতে পোড়া পিচবোর্ডর সঙ্গে ক্যালেন্ডারের একটা যোগসূত্র রয়েছে। যা পোড়ানো হয়েছে সেটা ক্যালেন্ডার, টুপি নয়। তার সন্দেহানুযায়ী লিন্ডা যাদুবিদ্যা নিয়ে পরীক্ষা করছে–মোমের পিণ্ড ও আলপিন তারই সাক্ষী।

তারপর তিনি টেনিস কোর্টে উপস্থিত হলেন। আর ইতিমধ্যে প্যাট্রিক পিক্সি গুহায় ঢুকলেন। আর্লেনা কিছুই দেখেননি খুব সামান্য শুনতে পেয়েছেন। এখন তাকে প্যাট্রিক ডাকছেন।

আর ভয় নেই সোনা আর্লেনা, বাইরে বেরিলয়ে এলে প্যাট্রিকের হাত চেপে বসল তার গলায় –সেই হলো বেচারা নির্বোধ সুন্দরী আর্লেনা মার্শালের জীবনকাহিনীর পরিসমাপ্তি…

ডার্নলি শিউরে ওঠে, আপনি সবকিছু ছবির মতো দেখিয়ে দিচ্ছেন কিন্তু আপনি এখনও বলেননি কি করে আপনি আসল সত্যিটা জানতে পারলেন?

সেই প্রথম থেকেই আমার মনে হয়েছে যে সবচেয়ে সম্ভাব্য ব্যক্তিই আর্লেনা মার্শালকে খুন করেছেন এবং সম্ভবতঃ প্যাট্রিক রেডফার্ন, তিনি সেই ধরনের লোক যারা কোনো মহিলার সত্ত্বা শুনে নিয়ে তার গলা কাটতে পারেন। সেদিন সকালে আর্লেনা কার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন তার হাসি মুখই জানিয়ে দিয়েছে সে প্যাট্রিক। সুতরাং আর্লেনাকে প্যাট্রিক খুন করেছেন।

কিন্তু প্যাট্রিক রেডফার্নের পক্ষে আর্লেনাকে খুন করা সম্ভব ছিলো না কারণ মৃতদেহ আবিষ্কার করা পর্যন্ত তিনি মিস ব্রুস্টারের সঙ্গে ছিলেন। তাই আমাকে অন্যদিকে নজর দিতে হলো। তাদের সংখ্যা একাধিক। একবার মনে হয়েছিলো লিন্ডাকে কিন্তু পরে ওর সঙ্গে এক আলোচনায় একটা বিষয়ে আমার বিশ্বাস স্থির হয় যে লিন্ডা নিজেকে অপরাধী মনে করে। ও নেহাতই সিক্ত। ডাকিনীবিদ্যার বইটা পড়ে ও সেটা প্রায় বিশ্বাস করে বসে। ও আর্লেনাকে ঘৃণা করতো। সুতরাং মোমের পুতুল তৈরি করে তার হৃদপিণ্ড আলপিনবিদ্ধ করে। পুতুলটা গলিয়ে ফেললো–সেই দিনই আর্লেনা মারা গেলেন। স্বাভাবিকভাবে লিন্ডা বিশ্বাস করেছে যে যাদুবিদ্যার ক্ষমতায় ওর সম্মাকে ও খুন করেছে।

রোজামন্ড ডুকরে উঠলো, ও বেচারা লিন্ডা! আর আমি ভেবেছি–ও এমন কিছু জানতো যাতে

পোয়ারো বললেন, আপনি কি ভেবেছিলেনে আমি জানি। আপনার ব্যবহার লিন্ডাকে আরও বেশি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো। ক্রিস্টিনও ওর কানে মন্ত্র যোগান। ওর মনে গেঁথে দেন ঘুমের বড়ির কথা, দেখিয়ে দেন ওর অপরাধের দ্রুত যন্ত্রণাহীন প্রায়শ্চিত্তের পথ। একবার যদি প্রমাণিত হয় ক্যাপ্টেন মার্শালের অ্যালিবাই রয়েছে তাহলেই নতুন কোনো সন্দেহ হবে। ক্রিস্টিন অথবা তার স্বামী মাদকদ্রব্য চোরাচালানের ব্যাপারটা জানতেন না। সুতরাং বলির পাঁঠা হিসেবে লিন্ডাকেই বেছে নিলেন।

রোজামন্ড বললো, কি শয়তান!

পোয়ারো বললেন, হ্যাঁ আমি পড়লাম মহা মুস্কিলে। আমি চেষ্টা করেছি ওর কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করতে কিন্তু সবই বিফলে গেছে। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমি আবার সন্তর্পণে খতিয়ে দেখতে লাগলাম সব। প্রথমেই রয়েছে বেলাভূমিতে পাওয়া একটা কাচি–জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলা একটা শিশি–একটা স্নানের খবর যা কেউ স্বীকার করেননি–সেগুলির তাৎপর্য একটা রয়েছে। ক্যাপ্টেন মার্শাল, লিন্ডা অথবা চোরাচালানকারীদের দায়ী করলে ঐ ঘটনাগুলোর কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। সুতরাং আমি ফিরে গেলাম আমার প্রথম সমাধানে–যে প্যাট্রিকই খুনটা করেছেন। আর্লেনার তহবিল থেকে যে একটা বিশাল অঙ্কের টাকা উধাও হয়েছে আমরা জানি। আর্ণেনা ছিলেন সেইরকম মেয়ে যাদের সুন্দর চেহারায় যুবকেরা সহজেই ঠকিয়ে নিতে পারে কিন্তু সে ব্ল্যাকমেল হবার মতো মেয়ে নয়। প্রয়োেজনের বেশি খোলা মন ছিল তার, গোপন কথা উনি গোপন রাখতে পারতেন না। কিন্তু হঠাৎ শুনে ফেলা ব্ল্যাকমেলের গল্পটা শুনেছেন প্যাট্রিক রেডফানের স্ত্রী। এটা সম্পূর্ণ তার গল্প–দ্বিতীয় কোনো সাক্ষ্য নেই। এর উত্তর বিদ্যুতের মতো আমার মনে ঝলসে উঠলো।

প্যাট্রিক ও ক্রিস্টিন রেডফার্ন দুজনেই এর সঙ্গে জড়িত। আর্লেনাকে গলা টিপে খুন করার মতো দৈহিক শক্তি ক্রিস্টিনের ছিলো না; তাহলে নায়ক প্যাট্রিক নিজে–

দেহ–এই দেহ শব্দটা আমার মনে নাড়া দিল–সৈকতে শুয়ে থাকা সব দেহই একইরকম। প্যাট্রিক ও ব্রুস্টার পিক্সি কোভে গিয়ে একটা দেহ বেলাভূমিতে শুয়ে থাকতে দেখেছেন। যদি

কিন্তু একটা মৃতদেহই আমরা পেয়েছি–তাহলে সেই দেহ ছিল জীবন্ত–যিনি মৃতের ভান করে শুয়ে আছেন। তাহলে কার জীবন্ত দেহ–তার স্ত্রীই রেডফার্নকে সাহায্য করতে পারেন। তার গায়ের রঙ সাদা হলেও সূর্যস্নানের নকল প্রলেপ লাগানো যেতে পারে-শিশি–একটা শিশি আমার টুকরো ছবির ধাঁধার একটা টুকরো। তারপর প্রয়োজন একটা স্নানের–টেনিস খেলতে যাবার আগে সর্বনাশা প্রলেপের দাগ ধুয়ে ফেলতে হবে। আর তাড়াহুড়োতে কঁচিটা থেকে যায় অকুস্থলে-এই একটা জিনিষ যেটা আমাদের খুনী দম্পতি ভুল করে রেখে আসেন।

কিন্তু আর্লেনা এতক্ষণ কোথায় ছিলো? পিক্সির গুহায় সুগন্ধী আমাকে সেকথা জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পিক্সির গুহায় আর্লেনা লুকিয়ে ছিলেন যতক্ষণ না পথ পরিষ্কার হয়।

যখন ব্রুস্টার নৌকা নিয়ে চলে গেলেন তখন সৈকতে একা খুন করার পুরোপুরি সুযোগ। আর্লেনা খুন হয় পৌনে বারোটার কিছু পরে। কিন্তু পৌনে বারোটায় আর্লেনা মৃত ছিলেন, ডাক্তারী সাক্ষ্য সময়টা নিয়ে তাই মাথা ঘামায়।

আর দুটো রহস্য সমাধানের তখনও বাকি। লিন্ডার সাক্ষ্য ক্রিস্টিনকে অ্যালিবাই জুগিয়েছে। সে সাক্ষ্য লিন্ডার হাতঘড়ি। কিন্তু এখন প্রমাণ করা যে ওই হাতঘড়ির সময়ের বদল করার সুযোগ ক্রিস্টিন দুটো পেয়েছিলেন। সকালে যখন লিন্ডার ঘরে একা ছিলেন–এছাড়াও একটা পরোক্ষ প্রমাণ ছিলো। লিন্ডাকে বলতে শোনা গেছে যে ওর ভয় হচ্ছিলো হয়তো দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্রামকক্ষের ঘড়িতে তখন মাত্র দশটা পঁচিশ। দ্বিতীয় সুযোগ–লিন্ডা যখন পিছন ফিরে সমুদ্রে স্নান করতে নামে তখন ঘড়ির সময়টা আবার পিছিয়ে দেয় ক্রিস্টিন।

এরপর মইয়ের প্রশ্ন, ক্রিস্টিন বরাবরই বলেছেন যে, উঁচু জায়গা তার ধাতে সয় না। এটা সাজানো মিথ্যে।

প্রতিটি টুকরো এবার নিখুঁতভাবে খাপ খেয়ে গেছে নিজের নিজের জায়গায়। কিন্তু আমার হাতে নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ নেই।

তখনই আমার মাথায় এলো এই খুনের মধ্যে নিহিত রয়েছে একটা আত্মবিশ্বাসের ভাব –একটা পরিপাটি ছিমছাপ পরিকল্পনা। প্যাট্রিক যে ভবিষ্যতে তার দুষ্কর্মের পুনরাবৃত্তি করবেন তার কোনো সন্দেহ নেই। এই খুনের পদ্ধতি, শাসরোধ করে হত্যা করা। শুধু ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়, নিছক আনন্দের জন্যও তিনি খুন করেন। যদি এটা তার প্রথম খুন না হয় তাহলে অতীতেও তিনি একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। আমি কলগেটের কাছে শ্বাসরোধ করে খুন হয়েছে এমন মেয়েদের একটা তালিকা চাইলাম। নির্জন ঝোঁপের পাশে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় নীলি পার্সলের খুন হয়তো প্যাট্রিকের কাজ। কিন্তু অ্যালিস করিগানের মৃত্যুতে আমি ঠিক যা খুঁজছিলাম পেয়ে গেলাম। একই পদ্ধতি, সেই সময় নিয়ে কারচুপি। সওয়া চারটের আবিষ্কৃত হয় মৃতদেহ। আর একজন স্বামী, যার অ্যালিবাই রয়েছে চারটে পঁচিশ পর্যন্ত।

বলা হয়েছে যে এডওয়ার্ড করিগান পাইন রিজে গিয়ে তার স্ত্রীকে পায় না, তখন বাইরে এসে পায়চারি করতে থাকে। কার্যত সে প্রাণপণে ছুটে যায় সীজার্স গ্রোভে, স্ত্রীকে খুন করে কাফেতে ফিরে আসে। পথচারী যে মেয়েটিকে খবর দেয়, সে ছিলো একজন সম্ভ্রান্ত যুবতী, এক বালিকা বিদ্যালয়ের দিদিমনি। পুলিসের ডাক্তার মৃতদেহ পরীক্ষা করে পৌনে ছটা নাগাদ। এবারের মতো তখনও খুনের সময়টা সকলেই বিনা দ্বিধায় মেনে নেয়।

আমাকে সঠিকভাবে জানতে হবে মিসেস রেডফার্ন মিথ্যাবাদী কিনা। সুতরাং ডার্টমুরে যাওয়ার বন্দোবস্ত করলাম। উচ্চতা যার ধাতে সয় না এমন কেউ কখনও সুস্থভাবে জলের ওপর সরু সাঁকো পার হতে পারবে না। মিস স্টার প্রকৃত রোগী নিজেকে সুস্থ রাখতে পারেননি। কিন্তু ক্রিস্টিন নির্বিকারে ছুটে সাঁকোটা পার হয়ে যান। বিনা প্রয়োজনে যদি মিথ্যে বলতে পারেন তাহলে অন্যান্য মিথ্যেগুলোও অসম্ভব নয়। ইতিমধ্যে কলগেট সারে পুলিসকে দিয়ে ছবিটা সনাক্ত করিয়েছেন। আর রেডফার্নকে করিগান বলে সনাক্ত করা হয়েছে শুনেই তার আত্মসংযম হারিয়ে যায়।

আমি যা করেছি তা অত্যন্ত বিপদের ঝুঁকি নিয়ে করেছি কিন্তু জিতেছি।

মিসেস গার্ডেনার দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সত্যি, মঁসিয়ে পোয়ারো–কী ভীষণ ভালো লাগলো, শুনতে কিভাবে আপনি ধাপে ধাপে সমাধানে পৌঁছলেন–সত্যিই এটা একটা অপরাধ বিজ্ঞানের ওপর বক্তৃতা, আনন্দে আমি যে কি বলবো–ঠিক করতে পারছি না।

পোয়ারো বললেন, মিঃ গার্ডেনারও আমাকে সাহায্য করেছেন। আমি মিঃ গার্ডেনারকে প্রশ্ন করেছিলাম যে মিসেস মার্শালকে তার কিরকম মহিলা মনে হয়? তিনি বলেছিলেন আমার সেই মহিলাকে কেমন যেন বোকা-সাকা বলে মনে হয়েছে।

.

১৩.২

লিন্ডা মার্শাল গালকোভে পোয়ারোর কাছে বললো, ভাগ্যিস শেষ পর্যন্ত আমি মরে যাইনি। কিন্তু, মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার অপরাধ তো খুন করারই সমান, তাই না? আমি তো সেটাই চেয়েছিলাম। পোয়ারো বললেন, না, দুটো এক জিনিস না। যদি তোমার শোবার ঘরে সেই ছোট্ট মোমের পুতুলের বদলে তুমি তোমার সম্মাকে বন্দী অবস্থায় পেতে, আর তোমার হাতে আলপিনের বদলে ছুরি থাকতো, তাহলেও তুমি তার বুকে বিধিয়ে দিতে পারতে না। মোমের পুতুল বানিয়ে আলপিন ফুটিয়ে তোমার মনের ঘৃণা চলে গেছে সেই পুতুলের ওপর। তার মৃত্যুসংবাদ পাবার আগেই তুমি নিজেকে শুদ্ধ মনে করেছ–অনেক হাল্কা হয়ে গেছ–তুমি হয়েছ অনেক সুখী।

আপনি কি করে জানলেন? সত্যিই আমার সে রকম মনে হয়েছিলো।

সুতরাং ভবিষ্যতে এরকম বোকামি আর কোরো না। এর পরের সম্মাকে যাতে ভালোবাসতে পারো তার জন্য এখন থেকেই মনকে তৈরি করে নাও।

লিন্ডা চমকে বললো, ও বুঝেছি। আপনি কি রোজামন্ডের কথা বলছেন। ওকে আমার ভালো লাগে। ওর যথেষ্ট বুদ্ধি আছে।

.

১৩.৩

কেনেথ মার্শাল বললেন, রোজামন্ড তোমার মাথায় কি উদ্ভট চিন্তা ঢুকেছিলো যে আমি আর্লেনাকে খুন করেছি।

আমার মতো বোকা নেই। কিন্তু কেন তুমি ঝিনুকের মতো নিজেকে এমনভাবে গুটিয়ে রাখো যে, আলেনা সম্পর্কে তোমার সত্যি কি ধারণা কখনও বুঝিনি। আমি ভেবেছি তুমি যদি হঠাই জানতে পারো যে ও তোমাকে ঠকাচ্ছে তাহলে তুমি হয়তো রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়বে। তুমি সবসময়েই ভীষণ শান্ত থাকো, কিন্তু সময়ে সময়ে দেখলে ভয় হয়।

আর তাই তুমি ভেবেছো আমি ওকে গলা টিপে খুন করেছি।

হ্যাঁ, আর তোমার অ্যালিবাইটাও কেমন যেন হালকা ঠেকছিলো। তাই ঠিক করলাম তোমাকে সাহায্য করবো, তোমাকে টাইপ করতে দেখেছি বলে বোকার মতো একটা গল্প ফেঁদে বসলাম। পরে যখন শুনলাম তুমি বলেছো যে তুমি আমাকে দরজায় উঁকি মারতে দেখেছো-ইয়ে–ধরেই নিলাম আমার সন্দেহ, পুরোপুরি সত্য। এছাড়া রয়েছে লিন্ডার অদ্ভুত ব্যবহার।

সে কথাতো তোমার গল্পকে সমর্থন করবার জন্যেই বলেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি চাও যে তোমার গল্পটা আমি সমর্থন করি।

তার মানে তুমি ভেবেছো তোমার বউকে আমি খুন করেছি?

কেন, রোজামন্ড মনে নেই, একটা কুকুরের জন্য তুমি কিভাবে সেই ছেলেটাকে প্রায় খুন করে বসেছিলে? কিভাবে তুমি ওর গলা টিপে ধরেছিলে?

কিন্তু সে তো বহু বছর আগের কথা। তাছাড়া আর্লেনাকে খুন করার পেছনে আমার কোনো উদ্দেশ্যটা থাকতে পারে বলো? তুমি ভেবেছো তোমার সুখে জন্য আমি ওকে খুন করেছি? নাকি-নাকি ভেবেছো আমি তোমাকে চাই বলে আমার পথের কাঁটা সরিয়ে দিয়েছি?

না, মোটেও তা ভাবিনি, কিন্তু সেদিন তুমি কি বলেছিলে–লিন্ডার সম্পর্কে আমাদের সম্পর্কে–আর তখন তোমাকে আমার চিন্তিত মনে হয়েছিলো।

এ নিয়ে সবসময়ই আমি চিন্তা করেছি।

আমি তো তোমাকে অবিশ্বাস করিনি কিন্তু একটা কথা তোমাকে স্পষ্ট করে বলতে চাই। আর্লেনাকে আমি কখনো নিজের করে ভাবিনি–শুধু প্রথমদিকে একটু ভালোবেসেছিলাম–এছাড়া ওকে নিয়ে দিনের পর দিন কাটানো–সে যে কি দুঃসহ কষ্ট যেন এক নরকবাস। ও এত সরল আর বোকা ছিলো-পুরুষ দেখলেই আর নিজেকে সামলে রাখতে পারতো না–আর পুরুষেরাও ওকে ঠকাতে এবং ওর সঙ্গে বাজে ব্যবহার করতো। আমি ওকে বিয়ে করেছি সুতরাং ওর দেখাশোনা করা আমারই কর্তব্য। আর সে জন্যে আমার কাছে ও সত্যিই কৃতজ্ঞ ছিলো। ওকে দেখে আমার করুণার পাত্র বলে মনে হতো।

জানি কেন, এখন আমি সব বুঝতে পারছি।

তুমি–তুমি সব কিছু চট করে বুঝতে পারো।

আচ্ছা, তুমি কি এখনই আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে, কেন, না কি ছমাস অপেক্ষা করবে বলে কিছু ঠিক করেছো?

কেনেথের ঠোঁট থেকে পাইপটা খসে পড়লো, নিচের পাথরে পড়ে চুরমার হয়ে গেলো।

যাঃ, এখানে এসে এ নিয়ে আমার দুটো পাইপ গেলো। সঙ্গে আর পাইপও নেই। কিন্তু কি করে জানলে যে অপেক্ষা করার পক্ষে ছমাসই মোটামুটি আমি ভেবে রেখেছি।

কারণ সত্যিই সেটা ঠিক সময়। কিন্তু দয়া করে এখনই আমাকে স্পষ্ট করে কথা দাও। নয়তো আগামী ছমাসের মধ্যে তুমি হয়তো আবার কোনো নির্যাতিত অসহায় মেয়ের দেখা পাবে আর সঙ্গে সঙ্গে তাকে উদ্ধার করতে বীরের মতো ছুটে যাবে।

সশব্দে হেসে, এবার সেই নির্যাতিতা অসহায় মেয়ে তুমি, রোজামন্ড। তবে তোমার ওই হতচ্ছাড়া পোশাক তৈরির ব্যবসা তোমাকে ছাড়তে হবে, তারপর আমরা গ্রামে গিয়ে থাকবো।

ওইও ব্যবসা থেকে আমার অনেক আয়। বুঝতে পারছে না, ওটা আমার নিজস্ব ব্যবসা–আমি নিজে ওটা সৃষ্টি করেছি আর তার জন্যে আমার যথেষ্ট গর্ব আছে। তোমার এত সাহস, হঠাৎ বলে বসলে, ওসব ছেড়ে দাও, সোনা।

হা। আমার এতই সাহস।

আর তোমার বিশ্বাস তোমার জন্য এককথায় আমি রাজী হয়ে যাবো?

যদি রাজী না হও, তাহলে তুমি আমার আর কোনো উপকারেই আসবে না।

অস্ফুট স্বরে রোজামন্ড বললো, ওঃ কেন, সোনা, তোমাকে নিয়ে আমি সারাটা জীবন শুধু গ্রামেই কাটাতে চেয়েছি। আমার সে স্বপ্ন এখন সত্যি হবে…।

Exit mobile version