সব ব্যাপারেই নির্বিকার থাকা, নিজের সম্পর্কে সত্যি সত্যি ও কি ধরাণা করে, জানি না। কেউই জানে না। শুধু আমি কেন মিসেস মার্শাল, নিজের স্বামীর সম্পর্কে কি ধারণা তার। পোয়োরোর দিকে রোজামন্ড স্থির চোখে চেয়ে রইল। ও বললো, আর্লেনা? সেরা স্বর্ণসন্ধানী ও পৃথিবীর একটা নরখাদক বাঘিনী। সেই সঙ্গে নতুন খেলা তখন শুধু হতো, যখন কোনো বস্তু ওর একশো গজের মধ্যে আসে। ও ওই ধরনের মেয়ে। ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন পোয়ারো পূর্ণ সম্মতি জানিয়ে। মিসেস মার্শালের চোখ শুধু একটা জিনিসই খুঁজে বেড়ায়, পুরুষ। তিনি বললেন, হ্যাঁ, আপনার কথা মিথ্যে নয়। প্যাট্রিক রেডফানের উপর নজর পড়েছে রোজামন্ড বললো, একটা সোজা ধরনের নিজের স্ত্রীকে ভালোবাসেন তিনি এবং তথাকথিত কলির কেষ্ট নয় আর্নেলার পুরুষরাই এই ধরনের প্রিয় খাদ্য। আমার ভালো লাগে তার বিবর্ণ চেহারায় সৌন্দর্য আছে একটা নিজস্ব প্রতিযোগিতায় তিনি পেরে উঠবেন নরখাদক বাঘিনী আর্লেনার সঙ্গে আমার মনে হয় না। আপনি ঠিক বলেছেন না, পোয়ারো বললেন, যন্ত্রণার ছায়া মুখমণ্ডলে তার।
যতদূর জানি, ক্রিস্টিন রেডফার্ন ইস্কুলের দিদিমণি ছিলেন, রোজামন্ড বললো। যারা বিশ্বাস করেন, সেই ধরনের মহিলা তিনি। ঘটনার প্রভাব থাকে মনের উপর। তিনি এক কঠিন আঘাত পাবেন খুব শিগগীরই।
বিহ্বলভাবে মাথা নাড়লেন পোয়ারো। রোজামন্ড উঠে দাঁড়ালো, বললো, পরিস্থিতি বলুন তো কি বিশ্রী। তারপর অনিশ্চিত সুরে যোগ করলো, কারো অত্যন্ত কিছু করা উচিত এ ব্যাপারে।
.
২.২
লিন্ডা মার্শাল শোবার ঘরের আয়নায় নিজের মুখমণ্ডল শান্তভাবে জরিপ করছিলো। ভীষণ অপছন্দ হলো ওর নিজের মুখ ওর কাছে। এই মুহূর্তে সে মুখের অধিকাংশ হাড় ও বিন্দু বিন্দু দাগের উপস্থিতি প্রকট বলে মনে হলো। ওর একরাশ নরম বাদামী চুল, ধূসর সবুজ চোখ, উঁচু হাড় ও গালের চিবুকের দীর্ঘ উদ্ধত রেখা। ততটা খারাপ নয় মুখ, দাঁতও বিরক্তভাবে লক্ষ্য করলো। দাঁতের সৌন্দর্যে কি আসে যায় নাকের পাশে ওটা কি কোনো দাগ? নিশ্চিত হলাম ওটা কোনো দাগ নয়। ও আপন মনে ভাবছে ভীষণ বিচ্ছিরি ষোলো বছরে পা দেওয়া।
কেউ বুঝতে পারে না এ সময় তার সত্যিকারের অবস্থাটা। লিন্ডা ছোট অশ্বশাবকের মতো হতবুদ্ধি, কোনো শজারুর মতো স্পর্শবিরূপ। প্রতিটি মুহূর্তে সচেতন, নিজের অগোছালো অবস্থা সম্পর্কে প্রতিটি মুহূর্তে ও জানে, দ্বীধাগ্রস্ত ওর মন, খারাপ ছিলো না স্কুলের দিনগুলো। স্কুল ছেড়ে এসেছে এখন ওর ঠিক কেউ জানে বলে মনে হয় না, এরপর ও কি করবে। ওকে প্যারিসে পাঠিয়ে দেবার কথা ওর বাবা ভাসা ভাসা ভাবে বলেছিলেন সামনের শীতে। লিন্ডা প্যারিসে যেতে চায় না, ভালো লাগছে না বাড়িতে থাকতেও। কোনোদিনও স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেনি, ওকি এর আগে ভীষণ অপছন্দ করে আর্লেনাকে। লিন্ডার সবুজ চোখজোড়া হয়ে উঠলো কঠিন, মুখ টান টান হলো উত্তেজনায়।
আর্লেনা, আপন মনেই ভাবলো ও একটা পশু, সবাই বলে সৎমা থাকাটাই ভীষণ বিচ্ছিরি, কথাটা সত্যি। আর্লেনা ওর সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করে তা নয়। বেশির ভাগ সময় খেয়ালই করে না লিন্ডাকে। যখন করে ওর চোখে থাকে এত অবজ্ঞাভরা কৌতুক। আরো বেশি প্রকট করে তোলে, লিন্ডার কিশোরীসুলভ বিশৃঙ্খল অবস্থাকে। আর্লেনার আশেপাশে কেউই নিজেকে ভীষণ অপরিণত অমার্জিত ভেবে লজ্জা পায়…। হাতড়ে চললো লিন্ডা আনাচে-কানাচে খাপছাড়াভাবে। মনের ভাবকে আলাদা করে বেছে নিয়ে নামকরণে অভ্যস্ত নয় ও। মানুষগুলোকে, বাড়িটাকে আর্লেনা কি যেন একটা করে।
লিন্ডা সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবলো ও ভীষণ ভীষণ খারাপ। কিন্তু এখানেই থাকলে চলবে না। নৈতিক উন্নাসিকতায় নাক সিটকে ওকে মনে থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় না। কি যেন করে মানুষগুলোকে, অবাক হয়ে ভাবলো ও এখন সম্পূর্ণ অন্যরকম। ওকে বাবা স্কুল থেকে ফিরিয়ে নিতে আসছেন। জাহাজে করে বেড়াতে যাচ্ছেন বাবা ওকে নিয়ে আর্লেনার সঙ্গে বাবার বাড়িতে। তার মন সেখানে থাকে না। যেন নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নেন।
আমার কাছে অসহ্য দিনের পর দিন মাসের পর মাস এইভাবে চলবে, লিন্ডা ভাবলো। ওর সামনে জীবন দীর্ঘায়িত হলো। আর্লেনার উপস্থিতিতে অন্ধকার ও বিষাক্ত একরাশ দিনের মিছিলে শিশুসুলভ মনে সময় সম্পর্কে এখনও কোনো স্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠেনি। এক একটা বছর যেন অনন্তকাল মনে হয় লিন্ডার কাছে। আর্লেনার প্রতি ঘৃণার এক বিশাল জলন্ত কালো
দূর সমুদ্রের দিকে তাকালো আয়নার উপর চোখ তুলে, সত্যি এ জায়গাটা চমৎকার। সমুদ্রতীর মনোরম, নির্জন উপকূল আর পায়ে চলার আঁকাবাঁকা পথ বিচিত্র। অজানা জায়গা আবিষ্কারের আনন্দ। একা একা খুশিমতো হুল্লোড় করার জায়গা। ছেলেরা তাই ওকে বলেছিলো, গুহাও আছে। লিন্ডা ভাবলো, আর্লেনা যদি এখান থেকে চলে যেত আমি আনন্দ করতে পারতাম তাহলে। এখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলো মন ফিরে গেলো সেই বিকেলে। বেশ মজা হয়েছিল মূল ভূখণ্ড থেকে দ্বীপে আসাটা। তখন জোয়ারের জলে ডুবে ছিল কংক্রিটের সেতুটা। ওরা আসে নৌকা করে। অদ্ভুত বলে মনে হয়েছিল। হোটেলটাকে দেখে, সামনে বসে থাকা একজন লম্বা তামাটে চোহারার মহিলা ওদের দেখে লাফিয়ে উঠেছেন, আরে কেনেথ বললেন। ওর বাবা বিস্মিতভাবে বলে উঠেছেন ভীষণ অবাক চোখে তাকিয়ে রোজামন্ড।