মেজর ব্যারী বললেন, ওঃ উনি, আমাদের স্বামীদেবতা মশাই হলেন উনি। ক্যাপ্টেন মার্শাল।
হা, জানি–এরকুল পোয়ারো বললেন। মেজর নিজে অবিবাহিত, তিনি চাপা হাসি হাসলেন। স্বামীর ভূমিকা মাত্র তিন রকমের তার দৃষ্টিভঙ্গীতে প্রতিবন্ধক, অসুবিধে সৃষ্টিকারী এবং রক্ষাকর্তা।
দেখে মনে হয় চমৎকার লোক তিনি। আমার টাইমসটা নিয়ে গেলো?
পা বাড়ালেন হোটেলের দিকে উঠে দাঁড়িয়ে স্টিফেন, লোনের দিকে তাকালেন ধীরে ধীরে তার দৃষ্টিতে পোয়ারো। প্যাট্রিক রেডফার্নকে লক্ষ্য করছিলেন স্টিফেন লেন, আর্লেনা মার্শান পোয়ারোর দিকে হঠাই তিনি ফিরে তাকালেন, তার দুচোখে ঝিলিক মারলো বিতৃষ্ণার তীব্র আলো। আপনার কি এতে কোনো সন্দেহ আছে? তিনি বললেন, শয়তান বাসা বেঁধেছে মেয়েছেলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া শক্ত–ধীর স্বরে উত্তর দিলেন পোয়োরো। বাতাসের উপস্থিতি টের পাচ্ছেন না। স্টিফেন লেন বললেন, আপনার চারপাশে অশুভ উপস্থিতি।
এরকুল পোয়ারো ধীরে ধীরে মাথা দুলিয়ে নীরব সম্মতি জানালেন।
০২. রোজামন্ড ডার্নলি
২.১
পোয়ারোর পাশে বসলো রোজামন্ড ডার্নলি এসে। তিনি গোপন করার চেষ্টা করলেন না, তার মনের খুশিকে।
পোয়ারো কখনোও অস্বীকার করেননি, মহিলাদের মতো রোজামন্ড ডার্নলিকেও আন্তরিক শ্রদ্ধা করেন। ওর শরীরের কমনীয় সৌষ্ঠব, চলার গর্বিত ভঙ্গী তার ভালো লাগে। ঠোঁটের হাসিতে ছোট্টশ্লেষের আভাস। তার ভালো লাগে মেঘ-কালো চুলের সাবলীল ঝর্ণা।
তার মাঝে ইতস্ততঃ শুভ্রতার ছোঁয়া পরনে গাঢ় নীল পোশাক। পোয়ারোর নজর এড়ালো না। প্রথম দৃষ্টিতে পোশাকটা সাধারণ মনে হলেও তত্ত্বাবধানে পরিচালিত রোজামন্ড লিমিটেড, লন্ডনের শ্রেষ্ঠ পোশাক তৈরির প্রতিষ্ঠান।
এখানে আমার একদম ভালো লাগছে না, রোজামন্ড বললো, ভাবছি কেন বেড়াতে এলাম, এতো জায়গা থাকতে।
আসেননি, আপনি এখানে আগে।
ইস্টারের ছুটিতে এসেছিলাম, বছর দুয়েরক আগে, এখানে তখন এত লোক ছিল না।
চোখ ফেরালেন এরকুল পোয়ারো ওর দিকে। আপনাকে ভাবিয়ে তোলার মতো কিছু একটা হয়েছে, শান্ত স্বরে বললেন, তাই না?
ধীরে ধীরে পা দোলাতে দোলাতে সম্মতি জানালো। চঞ্চল্ল পায়ের দিকে চোখ নামিয়ে তাকালো। আমি একটা প্রেতাত্মার মুখোমুখি হয়েছি, তারপর বললো, আমার চিন্তার কারণ প্রেতাত্মা মাদমোয়াজেল। হ্যাঁ কিসের কার প্রেতাত্মা, ওহো! নিজেরই আমার। শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলেন, প্রেতাত্মা দুঃখ দিয়েছে আপনাকে। ভীষণ দুঃখ দিয়েছে, জান সে আমাকে নিয়ে গেছে অতীতে। তারপর বললো–ছেলেবেলাকার কথা একবার ভাবুন তো আমার, আপনি তো আর ইংরেজ নন। আপনি পারবেন না, পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, আপনার ছেলেবেলা পুরোপুরি ইংরেজ পরিবেশে কেটেছে? সম্পূর্ণ ইংরেজ পরিবেশে, সবুজ গ্রাম, বিশাল জীর্ণ বাড়ি, কুকুর ঘোড়া, পথ হাঁটা বৃষ্টিতে, বাগানে আপেল গাছ। ছেঁড়া সান্ধ্য পোশাক, যা বছর বছর চলছে। একটা অবহেলিত বাগান। শরৎকাল, মাইকেল ম্যাস ডেইজিরা চোখ-ধাঁধানো নিশানের মতো হাজির হতো।
পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, আপনি অতীতে ফিরে যেচে চান?
মাথা নাড়লো রোজামন্ড, বললো, ফিরে যেতে কেউ পারবে না, কখনও হয় না। কোনো ভাবে ফিরে যেতে পারলে খুশি হতাম, আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে পোয়ারো বললেন। সশব্দে হাসলো রোজামন্ড। সে তো আমারও আছে। পোয়ারো বললেন, যখন ছোট ছিলাম, একটা খেলা ছিল তখন, তার নাম, তুমি যদি না হতে চাও–তুমি কি হতে চাও তবে। এর উত্তর ছোট ছোট মেয়েলি অ্যালবাম রাখা হতো লিখে। নীল চামড়ায় বাঁধানো অ্যালবামগুলো ছিলো, সোনালি পাতে মোড়া ধারগুলো। মাদমোয়াজেল এর উত্তরটা কিন্তু সহজ নয়।
হ্যাঁ, আমারও তাই ধারণা, রোজামন্ড বললো। কেউই বোধহয় রানি এলিজাবেথ হতে চাইবে না। সেটা একটা বিরাট ঝুঁকি। বন্ধু-বান্ধবের কথা যদি বলেন, তাদের ব্যাপারে আমরা বড্ড বেশি জানি। একবার-এক চমৎকার দম্পতির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। পরস্পরের প্রতি ব্যবহার এত উচ্ছল, এত সুন্দর, নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক এত ভালো ছিলো। বিয়ের বহু বছর পরেও আমি মাহিলাটিকে রীতিমতো ঈর্ষা করতাম, ওঁর সঙ্গে জায়গা বদল করতে স্ব-ইচ্ছায় রাজি ছিলাম। কে যেন বললো, আমাকে, পরে ওরা নাকি এগার বছর ধরে কেউ কারো সঙ্গে কথা বলেন না।
ও হাসলো সশব্দে।
বোঝা যায় কারো সম্পর্কে কেউ বলতে পারে না, তাই না?
কয়েক মুহূর্তে নীরবতার পরে পোয়ারো বললেন, অনেকেই আপনাকে কিন্তু ঈর্ষা করবে, মাদমোয়াজেল।
শীতল স্বরে জবাব দিলো রোজামন্ড ডার্নলি, ওহ, হ্যাঁ। স্বাভাবিক ভাবেই। কপালে ভাঁজ পড়লো চিন্তায় ওর, শ্লেষের হাসির ফুটে উঠলো ঠোঁটের বক্রতায়।
আমি সার্থক সত্যিই কোনো মহিলার নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। আমি কোনো শিল্পীর মতো সফল সৃজনশীল আনন্দ পাই (ভালোবাসি জামা-কাপড়ে নকশা করতে সত্যি আমি), সেই সঙ্গে পাই সফল কোনো ব্যবসায়ীর আর্থিক পরিতৃপ্তি। অবস্থা ভালো আমার, ভালো স্বাস্থ্য, মুখশ্রী মোটামুটি, আর তেমন বেশি নয় জিভের ধার। বিস্তৃত হলো ওর হাসি, একটু থামলো ও। আমার কোনো স্বামী নেই অবশ্য। মঁসিয়ে পোয়ারো একটা জায়গায় আমি হেরে গেছি, তাই না?
মনে রাখা সুরে জবাব দিলেন পোয়ারো, আপনি যদি অবিবাহিতা হয়ে থাকেন তার কারণ আমাদের পুরুষদের কেউই আপনাকে তেমনভাবে আকর্ষণ করেনি। নিজস্ব পছন্দ থেকেই আপনি নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নিয়েছেন, প্রয়োজনের জন্য নয়।