এমন একটা কিছু ছিল মহিলাটির মধ্যে, যা সৈকতে উপস্থিত অন্যান্য মহিলাদের তুচ্ছ ও নিষ্প্রভ করে দিলো। অনিবার্যভাবে উপস্থিত প্রতিটি পুরুষের চোখ সমান আকর্ষিত হয়ে গেঁথে গেলো তার শরীরে। মেজর ব্যারী সোজা হয়ে বসলেন, তার বিস্ফারিত চোখ আরও বিস্ফারিত হলো। এরকুল পোয়ারোর চোখ পুরোপুরি খুলে গেলো, গোঁফজোড়া প্রশংসায় নেচে উঠল।
স্টিফেন লেন গভীর শ্বাস নিলেন, শরীরে প্রতিটি পেশী হয়ে উঠল কঠিন।
ফিসফিসে স্বরে বললেন, মেজর ব্যারী, আর্লেনা স্টুয়ার্ট অভিনয় ছেড়ে দেবার আগে ওর শেষ নাটক কাম অ্যান্ড গো আমি দেখেছিলাম। কি বলেন দেখার মতো চেহারা।
ধীর স্বরে বললো ক্রিস্টিন রেডফার্ন। শীতলতার পরশ যেন ওর কণ্ঠে। সত্যি ও সুন্দরী। তবে কি ওকে দেখে পশুর মতো মনে হয়।
এমিলি ব্রুস্টার হঠাৎ বলে উঠলেন, আপনি অশুভ শক্তির কথা এসব বলেছিলেন মঁসিয়ে পোয়ারো। আমার ধারণা সেই অশুভ শক্তির মানব রূপ এই মেয়েটি। ওর মধ্যে এতটুকু ভালোর ছোঁয়া নেই। ওর সম্পর্কে আমি অনেক কিছুই জানি।
স্মৃতি রোমন্থনের সুরে বললেন মেজর ব্যারী, সিমলার একটা মেয়ের কথা আমার মনে পড়েছে। মেয়েটির চুল ছিল লাল। মেয়েটি জনৈক নিম্নপদস্থ সৈনিকের বউ ছিলো। মেয়েটি সেখানে অশান্তির সৃষ্টি করেছিল। সেখানে গিয়ে অন্যান্য মহিলারা সুযোগ পেলে ওর চোখ উপড়ে নিতে ছাড়ত না, কারণ পুরুষেরা ওর অর্থাৎ মেয়েটির জন্য পাগল হয়ে যেত। তাছাড়া মেয়েটি অনেক সংসার ছারখার করে দিয়েছিলো।
তিনি চাপা হাসিতে স্মৃতিচারণ করলেন, শান্তশিষ্ট চমৎকার মানুষ ছিল তার স্বামীটি। বউয়ের অন্যায়কে অন্যায় বলে মনে করতো না। বউকে প্রায় পুজোই করতো। স্টিফেন লেন তীব্র আবেগভরা চাপা স্বরে বললেন, সমাজের পক্ষে এধরনের মেয়ে ভীষণ-ভীষণ ক্ষতিকারক।
তিনি থামলেন, ইতিমধ্যে আর্নেনা স্টুয়ার্ট জলের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছেন। যুবক দুটি সবে মাত্র কৈশোরের সীমারেখা পেরিয়েছে, যুবক দুটি আগ্রহের সঙ্গে চট করে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসেছে ওর দিকে। হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। ওর দিকে তাকিয়ে যুবক দুজনকে অতিক্রম করে নজরে পড়লো সৈকত ধরে এগিয়ে আসা প্যাট্রিক রেডফানের দিকে।
ব্যাপারটা যেন অনেকটা কাঁটা কম্পাসের মতো–এরকুল পোয়ারো ভাবলেন, ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করার মতো। গতিপথের বিচ্যুতি ঘটলো প্যাট্রিকের। রেডফার্নের পা-জোড়া দিক পরিবর্তন করলো। চুম্বক কম্পাসের কাটা সর্বদা উত্তরমুখী হবেই বিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী। প্যাট্রিক রেডফানের পা তাকে নিয়ে এলো আর্লেনা স্টুয়ার্টের কাছে। তখন অল্প অল্প হাসলেন প্যাট্রিকের দিকে তাকিয়ে। তারপর সৈকত ধরে ও এগিয়ে চলে, ঢেউয়ের পাশাপাশি পা ফেলে প্যাট্রিক রেডফার্ন ওর সঙ্গ নিলো। ও শরীর এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো একটা পাথরের পাশে। রেডফার্ন বসলো ওর পাশে।
ক্রিস্টিন রেডফার্ন আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে হোটেলে ঢুকে পড়লো।
.
১.৫
একটা অস্বস্তিকর নীরবতা ক্ষণেকের জন্য জমাট বেঁধে রইল, ও চলে যাবার পর। এমিলি স্টার বললেন ও ভীষণ ভালো মেয়ে, সত্যি খুব খারাপ লাগছে। মাত্র কয়েক বছর হলো ওরে বিয়ে হয়েছে। মেজর ব্যারী বললেন, আমি যে মেয়েটির কথা বলেছিলাম, সেই মেয়েটি সিমলার মেয়ে। ও বেশ কয়েকটা সত্যিকারের সুখের বিয়ে বিগড়ে দিয়েছিলো কি বলেন।
দুঃখের কথা, মিস ব্রুস্টার বললেন, এ ধরনের মেয়ে আছে, যারা পরের সংসার ভেঙে দিতে ভালোবাসে। মিনিট কয়েক থেমে গিয়ে যোগ করলেন, প্যাট্রিক রেডফানটা এক নম্বরের বোকা।
এরকুল পোয়ারো একদৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন নীরবে বেলাভূমির দিকে। কিন্তু প্যাট্রিক রেডফার্ন বা আর্লেনা স্টুয়ার্ট তার লক্ষ্য ছিল না। মিস ব্রুস্টার বললেন, আমি বরং যাই নৌকা নিয়ে বেরিলয়ে পড়ি। তিনি বিদায় নিলেন। পোয়ারোর দিকে মেজর ব্যারী ঘুরে তাকালেন। তার চোখ বিস্ফারিত, চাপা উত্তেজনা ও কৌতূহল। মঁসিয়ে পোয়ারো, বলুন কি এত ভাবছেন? কই আপনি মুখ খুললেন না তো, এই অপ্সরাটি সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?
জব্বর চিজ, বললেন, পোয়ারো, তাই হয়তো…
মশাই ঝেড়ে কাশুন! আমি হাড়ে হাড়ে চিনি ফরাসিদের।
আমি ফরাসি নই। শীতল স্বরে বললেন পোয়ারো।
সুন্দরী মেয়েরা আপনার নজর কাড়ে না। তা বলে একথা বলবেন না, আপনার হুঁ বলে মনে হয় না ওকে দেখে কি?
উনি মোটেই তরুণী নন, এরকুল পোয়ারো বললেন,
তাতে কী আসে যায়? যে কোনো মহিলার চেহারা দেখে যা মনে হয়, বয়েস ঠিক তাই তার। কোনো গলতি নেই ওর চেহারায়।
এরকুল পোয়ারো বললেন মাথা নাড়িয়ে, হ্যাঁ, উনি সুন্দরী। কিন্তু শেষ কথা সুন্দরই নয়। সৈকতে উপস্থিত প্রত্যেকে যে তার দিকে তাকিয়েছে, তার কারণ সৌন্দর্য নয়। মেজর বললেন, মশাই ওটাই একমাত্র কারণ। তিনি হঠাৎ কৌতূহলী কণ্ঠে বললেন, কি দেখছেন বলুন তো একদৃষ্টে আপনি?
উত্তর দিলেন এরকুল পোয়ারা, তাকিয়ে আছি আমি ব্যতিক্রমটির দিকে। একমাত্র মানুষের দিকে; যিনি ভদ্রমহিলা যাওয়ার সময় চোখ তুলে তাকাননি।
পোয়ারোর দৃষ্টিকে অনুসরণ করে মেজর ব্যারী সেই ব্যাতিক্রমটির দিকে তাকালেন। ভদ্রলোকের বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ, মুখশ্রী শান্ত সুন্দর, মাথার চুল হাল্কা রঙের, তামাটের গায়ের রঙ। তার ঠোঁটে ধূমায়িত পাইপ, চোখের নজর হাতের দি টাইমস-এ নিবদ্ধ।