নৌকা করে আসতে চেয়েছিল আমার সঙ্গে। আজ সারা সকালটা আলোর দেখা পাওয়া যায়নি এবং অনুপস্থিতির কারণ প্যাট্রিক ভেবে ভেবে এখন রীতিমতো দুশ্চিন্তায় পড়েছে। এই ছল আর্লেনা সব জেনে শুনেই করছে। ওর প্রতি প্যাট্রিকের আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলার নিঃসন্দেহে এ এক নতুন চাল।
পিক্সি কোভের দক্ষিণ দিকে সমুদ্রে বেরিলয়ে আসা পাথুরে অংশটার কাছে ওরা বাঁক নিলো। পিক্সি কোভ জায়গাটা বেশি বড় নয়। অজস্র পাথরের টুকরো বেলাভূমিতে ছড়িয়ে রয়েছে। পাহাড়ের কিছুটা অংশ গাড়ি-বারান্দার মতো ঝুলে রয়েছে বেলাভূমির উপর। উত্তর-পশ্চিমে মুখ করে অবস্থিত। অনেকের কাছে এই জায়গাটা অত্যন্ত প্রিয় কারণ পিকনিকের জন্য। পাথরের আড়ালে মাথার উপরটা থাকার জন্য। সকালের দিকে সূর্যের কিরণ এখানে এসে পৌঁছয় না, সেই কারণেই এ সময় কেউ এদিকে আসে না প্রায় বললেই হয়।
কিন্তু আজ একজনকে দেখা গেল এই মুহূর্তে। প্যাট্রিক রেডফার্নের কর্মরত হাত ক্ষণিকের জন্য নিশ্চল হলো আবার বাইতে শুরু করল তারপর। আরে, কে ওখানে? সে স্বাভাবিক এবং সহজ সুরে বললো। নির্লিপ্ত জবাব দিলেন মিস ব্রুস্টার, দেখে তো মিসেস মার্শাল বলেই মনে হচ্ছে।
হঠাৎ-ই খেয়াল হয়েছে, প্যাট্রিক রেডফার্ন এমন ভাবে ঘুরে আবাক হয়ে বললো, হ্যাঁ সত্যি তো! সুতরাং নৌকা চালানোর গতি তার পরিবর্তিত হলো। নৌকা এগিয়ে চললো তীর অভিমুখে। ক্ষীণ প্রতিবাদ করতে চাইলো এমিলি ব্রুস্টার, আমরা কি ওখানে পাড়ে নামবো? চটপট জবাব দিলো প্যাট্রিক রেডফার্ন, ক্ষতি কি। প্রচুর সময় আছে হাতে এখন।
নিষ্পলকে তাকালো সে মিস ব্রুস্টারের চোখে, তার দৃষ্টিতে যেন সরল আকুতি ঝরে পড়লো। অনেকটা কোনো কুকুরের প্রভুভক্ত নীরব মিনতির মতো। আর কিছু বলতে পারলেন না মিস ব্রুস্টার মুখ ফুটে। হায় বেচারা! তিনি মনে মনে ভাবলেন, একেবারে অন্ধ হয়ে গেছে প্রেমে। কি উপায়! সময় হলেই ও এটা কাটিয়ে উঠবে।
নিঃশব্দে এগিয়ে চললো তরতর করে পাড়ের দিকে। আর্লেনা মার্শাল নুড়ি-ছাওয়া বেলাভূমিতে উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে। ওর হাত দুটো দুপাশে বিস্তৃত। অদূরে চোখ পড়লো সাদা ভেলাটা। কিছু একটা এমিলি ব্রুস্টারকে অস্বস্তিতে ফেললো। যেন তার অত্যন্ত পরিচিত স্বাভাবিক কোনো দৃশ্যের দিকে চেয়ে আছেন তিনি, অথচ তার কোথায় যেন একটা অসঙ্গতি রয়েছে। অসঙ্গতিটা তার নজরে পড়লো। আরও প্রায় মিনিট কয়েক পরে আলেনা মার্শালের শুয়ে থাকার ভঙ্গী কোনো সূর্যনার্থীর শুয়ে থাকার ভঙ্গীর মতো নিখুঁত। সৈকতে ওকে প্রায়ই এই একই ভঙ্গিমায় শুয়ে তাকতে দেখা গেছে হোটেলের সামনে। ব্রোঞ্জ রঙের শরীর সূর্যপিপাসার টান টান, আর সবুজ পিচবোর্ডের টুপিটা ওর মাথা ও ঘাড় প্রখর সূর্যকিরণ থেকে রক্ষা করছে। কিন্তু সূর্যকিরণের এতটুকু আভামাত্র নেই পিক্সি কোভের বেলাভূমিতে এবং আগামী কয়েক ঘণ্টাতেও থাকবেনা। সূর্যকে বেলাভূমি থেকে সম্পূর্ণ অপসারিত করেছে ওপরের ঝুলন্ত পাথরের আড়াল। আশঙ্কার এক অদ্ভুত ইশারা এমিলি ব্রুস্টারের মনকে ধীরে ধীরে গ্রাস করলো।
নৌকা এসে থামলো ওদের বেলাভূমির পাথুরে কিনারায়, এই আর্লেনা, প্যাট্রিক রেডফার্ন চেঁচিয়ে ডাকলো। এটা নির্দিষ্ট রূপ নিলো। তখনই এমিলি স্টারের ভিত্তিহীন আশঙ্কা। কোনো উত্তর এলো না, কারণ রের্ডফানের আহ্বানে শায়িত শরীরে কোনো চাঞ্চল্য দেখা গেলো না।
এমিলির চোখে পড়লো প্যাট্রিক রেডফানের মুখের আকস্মিক পরিবর্তনটা। সে এক লাফে নৌকো থেকে নামলো, এমিলি স্টারও তাকে অনুসরণ করলেন, দুজনে নৌকাটাকে টেনে পাড়ে তুললো, তারপর বেলাভূমি ধরে এগিয়ে চললো পাহাড়ের কোলে, নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকা নিরুত্তর শুভ্র দেহটার দিকে, প্রথমে এসে পৌঁছালো প্যাট্রিক রেডফার্নেহ, মিস স্টার তার ঠিক পেছনেই।
যেন স্বপ্নে দেখার মতো তিনি দেখলেন, এখটা ব্রোঞ্জ রঙের শরীর, সাদা পিঠ-খোলা সাঁতার পোশাক, সবুজ টুপির সীমানা ছাড়িয়ে বেরিলয়ে আসা লাল চুলের গুচ্ছ আরো একটা জিনিষ দেখলেন। দুবাহুর বিস্তৃত অদ্ভুত অস্বাভাবিক অবস্থান। তিনি অনুভব করলেন এই মুহূর্তে দেহটা ঠিক স্ব-ইচ্ছায় শায়িত নয়, বরং কেউ যেন অবহেলাভরে ওটাকে ছুঁড়ে দিয়েছে উন্মুক্ত বেলাভূমিতে…।
তিনি শুনতে পেলেন প্যাট্রিকের কণ্ঠস্বর..নিছকই এক আতঙ্ক-বিকৃত ফিসফিসে স্বর। নিথর দেহটার পাশে সে হাঁটু ভেঙে বসলো স্পর্শ করলো একাট হাত-বাহু…।
তার স্বর কেঁপে উঠলো, চাপা ফিসফিসে শব্দ, হায় ভগবান ও মারা গেছে এবং তারপর, সে সবুজ টুপিটা সামান্য তুলে ঘাড়ের কাছ উঁকি মারলো, কেউ গলা টিপে খুন করেছে, ওঃ ভগবান!
.
৪.৬
এমনি এক মুহূর্ত সেটা, যে মুহূর্তে সময় নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এক অদ্ভুত অপ্রাকৃত অনুভূতির সঙ্গে। এমিলি ব্রুস্টার শুনতে পেলেন নিজের কণ্ঠস্বরে, কিছুতে হাত দেওয়া ঠিক হবে না আমাদের, অন্তত যতক্ষণ না পুলিশ আসে।
রেডফার্নের উত্তর যান্ত্রিকভাবে ভেসে এলো, না না, আপনি ঠিকই বলেছেন। তারপর ফিসফিসে স্বরে সে বললো, গভীর যন্ত্রণাক্লিষ্ট। কিন্তু সে কে, কে? কে এই অবস্থা করলো আর্লেনা? ওকে কেউ-ওকে কেউ, খুন করতে পারে না! এ মিথ্যে, সব মিথ্যে।