আর্লেনা স্টুয়ার্ট মঞ্চের নামেই ওকে সম্বোধন করা যায়, এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে জীবনে কখনও একা থাকতে চেয়েছেন কিনা। এর আসল কারণ সহজেই অনুমান করলেন এরকুল পোয়ারো। কারও সঙ্গে দেখা করতে চলেছেন, আলেনা মার্শাল নিঃসন্দেহে। এবং কার সঙ্গে সে বিষয়েও পোয়ারো মনে সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে একটা। পোয়ারো দেখলেন ও মনে মনে ভাবলেনও নিজের অনুমানকে ভ্রান্ত প্রমাণিত হতে দেখলেন পোয়ারো।
যেই পাহাড়ের বাঁকে অদৃশ্য হলো, সাদা ভেলাটা। তখনই তার নজরে পড়লো প্যাট্রিক রেডফার্ন লম্বা পা ফেলে হোটেলের দিক থেকে সমুদ্র তীরে নেমে আসছে। ঠিক পেছনেই আসছে তার প্রতিদ্বন্দ্বী কেনেথ মার্শাল।
ঈষৎ মাথা নোয়ালেন মার্শাল পোয়ারোকে দেখে, সুপ্রভাত মঁসিয়ে পোয়ারো। স্ত্রীকে দেখেছেন, আমার। পোয়ারো কূটনীতিবিদের মতো জবাব দিলেন, তাহলে মাদাম সকালে উঠেছেন আজ। ওকে ওর ঘরে দেখলাম না, মার্শাল বললেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, আজকের দিনটা চমৎকার। স্নানটা সেরে ফেলি এখনই। একগাদা কাগজ টাইপ করতে হবে ফিরে গিয়ে। প্যাট্রিক রেডফার্ন অপেক্ষাকৃত চাপা দৃষ্টিতে সমুদ্রতীরের দুপাশে চোখ বুলিয়ে নিলেন একবার। তারপর পোয়ারোর পাশে বসে তার প্রেমিকের প্রতীক্ষা করতে লাগলো। আর মাদাম রেডফার্ন, পোয়ারো বললেন, তিনিও কি ভোরে উঠেছেন।
জবাব দিলো প্যাট্রিক, ক্রিস্টিন? ছবি আঁকতে বেরোবে। ইদানীং দেখছি ওর ছবি আঁকার ঝোঁক বেড়ে গেছে। প্যাট্রিক রেডফার্নে স্পষ্টই বোঝা গেল, তার মন পড়ে রয়েছে অন্য কোথাও, সময় যতোই যেতে লাগলো, ততই প্রকট হতে লাগলো আর্লেনার জন্য তার অসহিষ্ণু ভাব। কোনো পায়ের শব্দ শোনামাত্রই সে উৎসুক হয় ঘুরে তাকিয়ে দেখছে, কে আসছে হোটেলের দিক থেকে। কিন্তু হতাশার পর হতাশা শুধুই। প্রথমে এলেন মিঃ এবং মিসেস গার্ডেনার সেলাই ও সেলাইয়ের বইয়ের সুসজ্জিত হয়ে। মিস ব্রুস্টার এলেন তারপর। তারা চেয়ারে গুছিয়ে বসলেন। মিসেস গার্ডেনার অসীম উৎসাহে বুনতে শুরু করলেন যথারীতি। তার কথার স্রোত সেই সঙ্গে শুরু হলো।
ব্যাপারটা কি? আচ্ছা মঁসিয়ে পোয়ারো সমুদ্রতীর আজ এত ফাঁকা লাগছে, গেল কোথায় সব। পোয়ারো বললেন, মাস্টারম্যান ও কাওয়ানরা বাচ্চাকাচ্চা সমেত দুটি পরিবারই সারাদিন ব্যাপী নৌকাবিহারে বেরিলয়েছে।
ও, সেই জন্যেই আজ এত চুপচাপ লাগছে, চেঁচামেচি হাসাহাসি করার জন্যে তো নেই ওরা। মাত্র কয়েকজনই দেখছি স্নান করছে, ক্যাপ্টেন মার্শাল।
মার্শাল তার সাঁতার শেষ করে পাড়ে এলেন; তোয়ালে দুলিয়ে সৈকত ছেড়ে উঠে এলেন ওপরে। চমৎকার আজ সমুদ্রের জল। তিনি বললেন, এমনই দুর্ভাগ্য ওদিকে একগাদা কাজ পড়ে রয়েছে। উপায় নেই না গিয়ে।
চমৎকার আজকের মতো দিনেও আপনার কাজ রয়েছে ক্যাপ্টেন মার্শাল? তাহলে তো সত্যিই দুর্ভাগ্য বলতে হয়। কি বিশ্রীই না গতকাল দিনটা গেছে। আমি মিঃ গার্ডেনারকে বলেছিলাম যে রোজই যদি এইরকম বৃষ্টি বাদলা চলতে থাকে তাহলে আমাদের এ জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই। এইরকম কুয়াশা ঢাকা পরিবেশে কেন যেন আমার মনমরা লাগে, আর অদ্ভুত ভাব মনকে ঘিরে থাকে। ছেলেবেলা থেকেই আবহাওয়া আর পরিবেশের প্রতি আমি যথেষ্ট সংবদেনশীল। আপনি হয়তো জানেন না। আমার মনে হয় মাঝে মাঝে শুধু আমি চিৎকার করে যাই। তার মানে বুঝতেই পারছেন, মা-বাবার কাছে এটা একটা সমস্যাই হয় উঠতো। আমার মা কিন্তু খুব ভালো ছিলেন। মা বাবাকে বলতো সিনক্লেয়ার বাচ্চাটার যদি সত্যিই ইচ্ছে হয় চিৎকার করতে, তাহলে উচিত নয় বাধা দেবার। ওর মনের ভাব প্রকাশ করতে চাইছে। এবং স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে আমার বাবা দ্বিমত করতো না। বাবা-মায়ের অনুগত ছিলো এমনিতেই; মা যা বলতো বিনা দ্বিধায় তাই করতে। সত্যিই তারা সুখী দম্পতি ছিলো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস মিঃ গার্ডেনারও আমার সঙ্গে একমত হবেন। এক কথায় তারা ছিলো অসাধারণ স্বামী-স্ত্রী, ছিলো না ওডেল? সোনা হ্যাঁ, মিঃ গার্ডেনার বললেন। ক্যাপ্টেন মার্শাল আপনার মেয়ে কোথায় কি জানি, জানি না লিন্ডা? হয়ত দ্বীপে কোথাও এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ক্যাপ্টেন মার্শাল, জানেন মেয়েটাকে আমার বড় দুর্বল আর রোগা বলে মনে হয়। ভালো মতো ওকে খাওয়া-দাওয়া করানো দরকার, আর খুব দরদ দিয়ে যত্ন-আত্তি করা দরকার। কেনেথ মার্শাল সংক্ষিপ্তভাবে জবাব দিলেন, লিন্ডা ঠিক আছে। কথা শেষ করে তিনি হোটেলের দিকে পা বাড়ালেন।
প্যাট্রিক রেডফার্ন জলে নামলো না। অলসভাবে সে হোটেলের দিকে চেয়ে বসে রইলো। হতাশা ও অভিমানের কালো ছায়া তার মুখমণ্ডলে নেমে এসেছে। যখন সিম ব্রুস্টার এসেছেন, তাকে দেখে বেশ প্রাণবন্ত এবং হাসিখুশি বলেই মনে হয়েছে।
সেদিন সকালের মতোই চলতে লাগলো আজকের কথাবার্তা। মিসেস গার্ডেনারের শান্ত একঘেয়ে শব্দস্তোতকে কাটা কাটা তীক্ষ্ণ মন্তব্যে যতি চিহ্নিত করতে চাইছেন মিস ব্রুস্টার। মিস স্টার শেষে একসময় মন্তব্য করলেন, আজ সমুদ্রতীর একটু নির্জন মনে হচ্ছে। সবাই কি বেড়াতে টেড়াতে গেছে নাকি? মিসেস গার্ডেনার বললেন, আজ সকালেই তো, আমি মিঃ গার্ডেনারকে বলেছিলাম আমাদের ডর্টমুরে অবশ্যই একবার বেড়াতে যাওয়া দরকার। জায়গাটা এমনিতেই বেশ কাছে, তার ওপর ওখানকার পরিবেশ চমৎকার অত্যন্ত। আমার তো অপরাধীদের সেই কয়েকখানাটা দেখবার খুব ইচ্ছে, কি নাম যেন প্রিন্সটাউন তাই না? মনে হয় আমার আজই সব ব্যবস্থাপত্র সেরে কাল ডর্টমুরে রওনা দিলে ভালো হয়, কি বলো ওডেল। মিঃ গার্ডেনার বললেন, হ্যাঁ সোনা। এরকুল পোয়ারো মিসস্টারকে লক্ষ্য করে বললেন, স্নান করতে নামবেন আপনি কি এখন, মাদমোয়াজেল? নাঃ, আমি স্নানের পালা প্রাতঃরাশের আগেই সেরে নিয়েছি। একজন পরোপকারী ব্যক্তি সেই সময় একটা শিশি আর একটু হলেই আমার মাথায় বসিয়ে দিয়েছিলো। বোধহয় হোটেলের কোনো জানলা দিয়ে বাইরের সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে থাকবে।