লিন্ডা চমকে উঠলো। ওর স্বভাবসিদ্ধ অগোছালো প্রকৃতির কাগজের জন্য প্যাকেটটা ওর হাত ফস্কে পড়ে গেলো মেঝেতে। পলকা সুতোটা ছিঁড়ে গিয়ে ভেতরের কয়েকটা জিনিস গড়িয়ে পড়লো বাইরে। ক্রিস্টিনের চোখে ফুটে উঠলো বিস্ময়। মোমবাতি কিনেছো কি জন্যে তুমি?
লিন্ডার সৌভাগ্যবশত ক্রিস্টিন ওর উত্তরের অপেক্ষা করলো না। ওর জিনিষগুলো মেঝে থেকে তুলতে তুলতে বলে চললো, জানতে এসেছিলাম তুমি আমার সঙ্গে পাল কোভে যাবে কিনা? আমি সেখানে ছবি আঁকতে যাবো। বিনা দ্বিধায় সম্মতি জানালো লিন্ডা। ক্রিস্টিনকে গত কয়েকদিনে ওর চিত্রাঙ্কন-অভিযানে সঙ্গ দিয়েছেন। ক্রিস্টিন শিল্পী হিসেবে খুবই উঁচু দরের না হলেও, লিন্ডার ধারণা, এই ছবি আঁকার সম্ভবত কপট অজুহাতেই এখনও অক্ষুণ্ণ রেখেছে ওর অহঙ্কারকে। আর্লেনা মার্শালের সান্নিধ্যে কাটিয়ে দেয় ওর স্বামী দিনের বেশির ভাগ সময়। লিন্ডা দিনের পর দিন ক্রমশ খিটখিটে এবং বদ-মেজাজী হয়ে পড়ছে, ক্রিস্টিনের ভালো লাগে ওর সঙ্গে সময় কাটাতে কারণ ক্রিটিন ছবি আঁকার সময় গভীর মনোযোগে ডুবে থাকে এবং কম কথা বলে অভ্যস্ত। লিন্ডা তাতে একরকম নিঃসঙ্গতার স্বাদ অনুভব করে। ওর মধ্যে থাকে কারও সঙ্গলাভের এক অদ্ভুত আকুলতা। পরস্পরের প্রতি কেমন ওদের যেন একটা সূক্ষ্ম সহানুভূতির যোগ রয়েছে, সম্ভবত বিশেষ একজনকে সমানভাবে অপছন্দের করার মধ্যেই লুকিয়ে আছে কারণ, বারোটায় আমি টেনিস খেলতে যাবো, ক্রিস্টিন বললো। তাই একটু তাড়াতাড়ি বেরোলেই ভালো হয়। ধরো সাড়ে দশটা। এই সব বললেন ক্রিস্টিন। আমি তৈরি হয়ে থাকবো ঠিক আছে; হলঘরেই তাহলে আপনার সঙ্গে দেখা হবে।
.
৪.৩
রোজামন্ড ডার্নলি খাবার ঘর ছেড়ে শ্লথ পায়ে বেরোতেই সিঁড়ি বেয়ে ত্বরিতে নেমে আসা লিন্ডার সঙ্গে ধাক্কা লাগলো ওর। মিস ডার্নলি দুঃখিত। চমৎকার সকাল, রোজামন্ড বললো, গতকালের পর এরকম একটা দিন বিশ্বাসই করা যায় না।
ঠিক বলেছেন। আমি মিসেস রেডফার্নের সঙ্গে পাল কোভে যাচ্ছি। তার সঙ্গে দেখা করবার কথা সাড়ে দশটায়। হয়তো দেরিই হয়ে গেলো ভাবছিলাম। দশটা পঁচিশ সবে এখন। না তাহলে নিশ্চিন্তে যাক। রোজমন্ড উৎসুক হয়ে তাকালো ওর দিকে লিন্ডাকে একটু হাঁপাতে দেখে। লিন্ডা তোমার জ্বর হয়নি তো! লিন্ডার চোখ অস্বাভাবিক উজ্জ্বল এবং দু-গালে লালচে আশা বেশ স্পষ্ট। আমার…কই না তো কখনও জ্বর হয় না।
আজকের দিনটা এত সুন্দর, রোজামন্ড হেসে বললো, আমি বিছানায় বসে প্রাতঃরাশ খাওয়ার পুরনো অভ্যাস ছেড়ে নিচে চলে এসেছি। এবং বীরপুরুষের মতোই খাওয়ার টেবিলে ডিম ও বেকনের মুখোমুখি হয়েছি। আজকের দিনটা সত্যি অপূর্ব গতকালের পর। গাল কোভে খুব ভালো লাগে সকালে। আমি তেল মেখে শুয়ে থাকবো। হ্যাঁ সকালের দিকে ভালো। রোজামন্ড বললো, সৈকতের তুলনায় অনেক শান্ত, নির্জন এখানকার জায়গাটা। লাজুক স্বরে লিন্ডা বললো, আপনিও চলুন না।
মাথা নাড়লো রোজামন্ড, না অন্য কাজ আছে কতকগুলো। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো ক্রিস্টিন রেডফার্ন। ওর পরনে আবহাওয়ার উপযোগী লম্বা হাতার ঢোলা পোশাক সবুজ কাপড়ের উপর হলদে কাজ করা। ওর গায়ের ফ্যাকাসে পাণ্ডুর রঙের সঙ্গে সবুজ এবং হলদে রঙটাই যে সবচেয়ে বেশি বেমানান, রোজামণ্ডের জিভ পিসপিস করতে লাগলো, সে কথা বলার জন্য পোশাক সম্পর্কে কোনো বোধ শক্তি নেই, এমন কাউকে দেখলে রোজামণ্ডের ভীষণ অস্বস্তি হয়। মেয়েটিকে যদি আমি মনের মতো করে সাজাতে পারতাম, ও ভাবলো ওর স্বামী সচেতন হয়ে ঠিক ওর দিকে নজর দিতো কয়েকদিনের মধ্যেই। আর্লেনা বোকা হলেও সে জানে নিজেকে কিভাবে সাজাতে হয়।
লিন্ডাকে তারপর ও বললো, তোমাদের ভালোই কাটবে সময়টা। একটা বই নিয়ে সানি লজ-এর দিকে যাচ্ছি আমি।
.
৪.৪
ঘরে বসেই কফি ও রোল সহকারে প্রাতঃরাশ সারলেন এরকুল পোয়ারো যথারীতি। সকালের সৌন্দর্য তাকে অভ্যাস-নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাধ্য করলো হোটেল ছাড়তে। দশটায় সমুদ্রতীরে নেমে এলেন। তার দৈনন্দিন উপস্থিতির সময় হতে তখনও আধঘন্টা দেরি। একজন ছাড়া শুধু বেলাভূমিকে কাউকে নজর পড়লো না। আর্লেনা মার্শাল সেই একজন। আর্লেনার পরনে প্রিয় ওর সাঁতারের পোশাক, সবুজ টুপি মাথায় ও একটা সাদা কাঠের ভেলাকে জলে ভাসানোর চেষ্টা করছিলো। ওকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে গেলেন পোয়ারো। পরোপকারিতার পুরস্কার স্বরূপ নিজের ধবধবে সাদা জুতো জোড়াকে সমুদ্রের জলে স্নান করালেন।
পোয়ারোকে ধন্যবাদ জানালো আর্লেনা–ওর নিজস্ব তির্যক দৃষ্টিতে। ভেলায় চড়ে এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে আর্লেনা তাকে ডাকলো, মঁসিয়ে পোয়ারো? পোয়ারো তৎপর ভঙ্গীতে নিমেষে হেলের কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালেন। আমার জন্যে একটা কাজ করবেন, আর্লেনা বললো। নিশ্চয়ই ও পোয়ারোর দিকে চেয়ে হাসলো। কাউকে বলবেন না আমি কোথায় যাচ্ছি। তারপর মৃদু স্বরে বললো। অন্তর স্পর্শ করা দৃষ্টি ওর চোখে। আমার পিছু করবে প্রত্যেকেই। আমি আজ একটু একলা থাকতে চাই। বৈঠা বেয়ে এগিয়ে চললো নিপুণ হাতে আলেনা। সমুদ্র ছেড়ে উঠে এলেন পোয়ারো। আপনমনেই বিড়বিড় করতে লাগলেন, উঁহু অসম্ভব একেবারেই। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না।