মেয়েদের মাঝপথেই থেমে গেলো, ক্রিস্টিন। গম্ভীর স্বরে পোয়ারো বললেন-যদি কিছু না মনে করেন, তাহলে মাদাম, কয়েকটা কথা বলি। কথাটা উজ্জ্বল নক্ষত্রদের মতোই সত্যি? এই পৃথিবীর আলেনা স্টুয়ার্টরা অথবা মার্শালরা ধর্তব্যের মধ্যে কখনও আসে না।
বাজে কথা। ক্রিস্টিন রেডফার্ন বললো।
উঁহু, আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি সত্যি। কয়েক মুহূর্তের জন্য, তাদের রাজত্ব হয় ক্ষণস্থায়ী। এক মাত্র তারাই, সত্যিকারের স্থায়ী দাগ কাটেন তারাই; একমাত্র প্রশংসনীয় গুণ আছে, বুদ্ধি আছে, যাদের মধ্যে।
ক্রিস্টিন বললো ঘৃণাভরা স্বরে, আপনি কি ভাবেন পুরুষেরা গুণ বুদ্ধির কোনো গুরুত্ব দেয়? এ সবের নিশ্চয়ই দেয় শান্ত স্বরে বললেন পোয়ারো। আমি কিন্তু একমত হতে পারলাম না, ক্রিস্টিন সংক্ষেপে হেসে বললো এইসব কথাগুলো! আপনার স্বামী আপনাকে ভালোবাসেন, পোয়ারো বললেন, তা জানা সম্ভব নয় আপনার পক্ষে।
হ্যাঁ, আমি তাকে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি আমি জানি, ক্রিস্টিন ভেঙে পড়লো। হঠাৎ-ই ফুলে কাঁদতে লাগলো পোয়ারোর কাঁধে মাথা রেখে। ও বলে উঠলো, আর সইতে পারছি না…আর সইতে পারছি না…পোয়ারো সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন। ওর পিঠে হাত রেখে। ধৈর্য ধরুন, মাদাম ধৈর্য ধরুন শুধু একটু, আশ্বাসের সুরে বললেন।
ও উঠে বসলো অবশেষে। নিজেকে সামলে নিয়ে রুমালে চোখ মুছে রুদ্ধ স্বরে বললো, মঁসিয়ে পোয়ারো এখন আপনি যান। আমি একটু একা থাকতে চাই।
ক্রিস্টিনকে একা রেখে পোয়ারো আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে হোটেলের দিকে ফিরে চললেন। হোটেলের কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ কানে এল এক চাপা কথাবার্তার শব্দ।
কিছুটা এগোতেই তিনি দেখলেন আর্লেনা মার্শাল ও প্যাট্রিক রেডফার্ন ঝোঁপের সারির মাঝে ফাঁকা অংশে পাশাপাশি বসে আছে। পুরুষটির আবেগকল্পিত কণ্ঠস্বর তিনি শুনতে পেলেন, আর্লেনা আমি সবকিছু ভুলে যেতে বসেছি তোমার জন্য। আমাকে তুমি পাগল করে দিয়েছো, তুমি কি আমায় ভালোবাসো না। আমার জন্য একটুও ভাব না তুমি বলো। আর্লেনা মার্শালের মুখমণ্ডল স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন পোয়ারো। তার মনে হলো, যেন কোনো বেড়াল আদরের উত্তাপে বসে অনুভব করছে, সুখ ভঙ্গীর সঙ্গে মানুষের চেয়ে পশুর সাদৃশ্য অনেক বেশি। আর্লোর হালকা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, নিশ্চয়ই প্যাট্রিক সোনা তোমাকে আমি ভালোবাসি তুমি তা জানো।
প্রথম তার অপশ্রবণে ক্ষান্তি দিলেন পোয়ারো। সরু ঢালু পথ ধরে হোটেলের দিকে আবার ফিরে চললেন। হঠাৎ মাঝপথে একজন সঙ্গ নিলেন। ক্যাপ্টেন মার্শাল। মার্শাল বললেন, চমৎকার রাত কি বলেন? বিশেষ করে ওরকম একটা জঘন্য দিনের পর। চোখ তুলে তাকালেন আকাশের দিকে তিনি। মনে হচ্ছে কালকের আবাহাওয়া ভালোই থাকবে।
০৪. উজ্জ্বল নির্মেঘ দিন
৪.১
২৬ শে জুলাই সকাল বয়ে নিয়ে এলো উজ্জ্বল নির্মেঘ দিনের আশ্বাস। সুন্দর সকাল এমন কোনো চূড়ান্ত অলসকেও বিছানা ছাড়তে লোভ দেখায়।
আজ সকাল সকাল উঠেছেন। জলি রজারের সাজের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বাদামী রঙের মোটা বাঁধানো বইটা ভোলা অবস্থাতেই উপুড় করে রাখলো লিডা। তারপর তাকালো আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে, এখন সকাল আটটা।
এক অদ্ভুত দৃষ্টান্ত ওর ঠোঁটজোড়ায়, চোখের তারা স্বাভাবিকের চেয়ে ঈষৎ সঙ্কুচিত। আমাকে পারতেই হবে ও রুদ্ধশ্বাসে উচ্চারণ করলো।
লিন্ডা পাজামা ছেড়ে সাঁতারের পোশাক পরে নিলো। তার উপর পরলো স্নানের ঢোলা পোশাক। বারান্দা ধরে চলতে শুরু করলো ও ঘর থেকে বেরিলয়ে। বারান্দার শেষে একটা দরজা খুলতেই দেখা গেলো একটা ঘোরানো লোহার সিঁড়ি সোজা নেমে গেছে পাথুরে জমিতে। সমুদ্রের জলে একটা ঝোলানো লোহার মই নেমে গেছে। প্রাত্যহিক প্রাতঃরাশ সেরে নেবার আগে হোটেলের যে সব অতিথিরা একটু শরীর ভিজিয়ে নিতে চান, সময় সংক্ষেপ করার জন্য তারাই প্রধান সৈকতে না গিয়ে এই মইটা ব্যবহার করেন।
যখন বারান্দা থেকে সিঁড়িতে নামছে লিন্ডা বাবার সঙ্গে মুখোমুখি হলো তখন। তিনি উপরে উঠছিলেন সিঁড়ি বেয়ে। ওকে দেখে বললেন, দেখছি আজ সকাল সকাল উঠেছ। স্নান করতে যাচ্ছো বুঝি? মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো লিন্ডা। ওরা পাশ কাটিয়ে চলে গেল পরম্পকে।
কিন্তু ঝোলানো মইয়ের দিকে না এগিয়ে হোটেলের বাঁ পাশ দিয়ে যে পথটা কংক্রিটের সেতুর দিকে চলে গেছে, লিন্ডা সেই পথটা ধরল। সেতু এখন জলের নিচে জোয়ারের কারণে। অতিথিদের পারাপারের নৌকোটা কাছেই পাড়ে বাঁধা রয়েছে। যার উপর ওটার দায়িত্ব তাকে কাছাকাছি পাওয়া গেল না কোথাও। নৌকা ছেড়ে দিল লিন্ডা।
ওপারে পৌঁছে, নৌকা পাড়ে বেঁধে ও ঢালু পথ বেয়ে এগিয়ে চললল…গ্যারেজ ছাড়িয়ে থামলো ছোট দোকানটার কাছে। দোকানের মহিলাটা সবেমাত্র দোকান খুলে ঘর ঝাঁট দিতে শুরু করেছে। রীতিমতো লিন্ডা অবাক হলো। মিস আপনি খুব সকাল সকাল উঠেছেন। স্নান-পোশাকের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলো কিছু টাকা লিন্ডা। তারপর তার কেনাকাটায় মন হলো।
.
৪.২
ক্রিস্টিন রেডফার্ন ওর ঘরে দাঁড়িয়ে। লিন্ডা যখন ফিরে এলো, ক্রিস্টিন বিস্মিত স্বরে বললো, ও এই তো! আমি ভাবছিলাম তুমি হয়তো এখন ঘুম থেকে ওঠোনি।
লিন্ডা বললো, না স্নান করতে করতে লক্ষ্য করলো ক্রিস্টিন একটু অবাক হয়ে বললো বেশ তাড়াতাড়িই পিয়ন আজ ডাক বিলি করে গেছে দেখছি।