উঁহু একা থাকতে আমার ভালো লাগে, ক্রিস্টিন বললো। এক খোঁচা মারলেন কনুই দিয়ে ওকে মিঃ ব্ল্যাট। একই সঙ্গে গাড়িটা নিয়ে আর একটু হলে পাশের ঝোপে ধাক্কা মারছিলেন। ওই কথাই বলে মেয়েরা সবসময়–তিনি বললেন। ওদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। মনের কথা আসলে ওটা ওদের। জলি রজার হোটেল, আমাদের ওটাকে ঘষে মেজে চাঙ্গা করে তোলার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কোনো মিল নেই, মনের সঙ্গে চরিত্রে প্রাণ নেই কোন। শুধু ভিড় করেছে একগাদা বাজে লোক এসে। প্রথমেই একপাল বাচ্চাকাচ্চা ধরুন। আর নীরস বুড়োবুড়িগুলি। এছাড়া রয়েছে বিরক্তিকর বুড়োটা ভারতবর্ষ ঘুরে আসা। আমাদের পাদ্রীসাহেব আর ঐ বিদেশীটা গোঁফওয়ালা। আমার হাসি পায় ওর গোঁফ দেখলেই। লোকটা নাপিত-টাপিত না হয়ে যায়। মাথা নাড়লো ক্রিস্টিন, উনি একজন গোয়েন্দা। উঁহু, মিঃ ব্ল্যাটের গাড়ি অল্পের জন্য সংঘর্ষের জন্য হাত থেকে রেহাই পেলো।
উনি ছদ্মবেশে রয়েছেন, আপনি বলতে চান গোয়েন্দা? হালকাভাবে হাসলো ক্রিস্টিন। না ও বললো, ওকে দেখতেই ওইরকম এরকুল পোয়ারো, শুনে থাকবেন আপনি নিশ্চয়ই ওঁর নাম।
নামটা প্রথমে ঠিক বুঝতে পারিনি, মিঃ ব্ল্যাক বললেন, হ্যাঁ ভদ্রলোকের নাম শুনেছি। যাই বলুন, আমার ধারণা ছিলো তিনি মারা গেছেন। উনি এখানে এসেছেন কি মতলবে? এরকম গোঁফওয়ালা গোয়েন্দারা মরে যাওয়াই উচিত। এমনিই ছুটিতে বেড়াতে এসেছেন, কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আসেননি।
হতে পারে হু। মিঃ ব্ল্যাটকে এ ব্যাপারে মনে হয় লোকটা একটু কাঠখোট্টা ধরনের তাই না?
ইতস্ততঃ করে বললো, হ্যাঁ। মানে–অদ্ভুত ধরনের একটু বলতে পারেন।
মিঃ ব্ল্যাট বললেন, আমার কথা হলো, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড কি ঘুমিয়ে রয়েছে? আমি আর কাউকে ভরসা করি না শুধুমাত্র ইংরেজ ছাড়া।
মিঃ ব্ল্যাট বিজয়ীর ভঙ্গীতে ঘনঘন হর্ণ বাজিয়ে জুলি রজারের গ্যারেজে ঢুকিয়ে দিলেন, গ্যারেজটা হোটেলের ঠিক বিপরীত দিকে মূল ভূ-ভণ্ডে অবস্থিত।
.
৩.৩
লেদারকোম্ব উপসাগরের একটা বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে ছিল লিন্ডা মার্শাল। দোকানে সারি সারি বই সাজানো কতকগুলো বইয়ের তাক। বই পড়ে নিতে পারেন দু পেনির বিনিময়ে। বইগুলো দশ বছরের পুরানো। আবার অনেকগুলো বিশ বছরের পুরানো আর বাকিগুলো আরো পুরানো।
লিন্ডা তাক থেকে বই নামানো প্রথমে একটা, তারপর আর একটা। মনে হল দি ফোর ফেদার অথবা ভাইসি ভার্সা কোনোটাই ভালো লাগবে না ওর পড়তে। তাই বাদামি মলাটের একটা ছোট বই নামিয়ে নিলো।
ক্রিস্টিন রেডফার্নের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েই চমকে উঠলো লিন্ডা, তাকে আবার বইটাকে গুঁজে রাখলো নিমেষের মধ্যে। লিন্ডা কি বই পড়ছো?
লিন্ডা জবাব দিলো তাড়াতাড়ি, না কিছু না। খুঁজছি এখটা ভালো বই, দি ম্যারেজ অফ উইলিয়াম অ্যাশ বইটা ভালো করে না দেখেই টেনে বার করল। কাউন্টার দুপেনি দিলো। মিঃ ব্ল্যাট আমাকে পৌঁছে দিলেন, ক্রিস্টিন বললো, আমার সাহসে কুলোবে না সেতুটা পার হওয়া। কেনাকাটা করার বাকি আছে বলে তাই চলে এসেছি।
ভদ্রলোক বড় সাংঘাতিক তাই না। লিন্ডা বললো, যত সব বীভৎস রসিকতা করেন। আর শুধু টাকার গরম দেখান।
বেচারা। ওঁর জন্য দুঃখ হয়, ক্রিস্টিন বললো, একমত হতে পারলাম না। লিন্ডা মিঃ ব্ল্যাটের জন্য দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ওঁর জন্য দুঃখিত কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। ও কিশোরী এবং নির্মম। লিন্ডা দোকান ছেড়ে বেরিলয়ে পড়লো। ক্রিস্টিন রেডফার্ন কংক্রীটের সেতুর দিকে এগিয়ে চললো ঢালু রাস্তা ধরে।
লিন্ডা তখন নিজের চিন্তায় ব্যস্ত। ওর ভালো লাগে ক্রিস্টিন রেডফার্নকে। মনে হয় ওর ক্রিস্টিন রেডফার্নকে এবং ক্রিস্টিন এই দুজনকেই সহ্য করা যায় কেবল। প্রথমত লিন্ডার সঙ্গে বেশি কথা বলে না ওরা। ওর পাশে পাশে হাঁটছে ক্রিস্টিন নীরবে। বুদ্ধিমতীর পরিচয় এটাই। লিন্ডা ভাবলো, সত্যি যদি কিছু বলার না থাকে শুধু শুধু বকবক করার দরকার কি আছে।
কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেল নিজের জটিলতায় নিজেই।
মিসেস রেডফার্ন হঠাৎ এক সময় বললো, কখনও মনে হয়নি আপনার। এত বিশ্রী এত ভয়ঙ্কর যেন ঠিক ফেটে পড়ার মতো এখানে সবকিছু।
প্রায় কথাগুলো হাস্যকর, চিন্তা-কুটিল কঠিন মুখে হাসির লেশমাত্র নেই লিন্ডার। ওর দিকে তাকালো ক্রিস্টিন রেডফার্ন, অনিশ্চিত অবুঝ কিন্তু ওর নজরে পড়লো না ও কিছু উপহাস করার মতো। ওর শ্বাস-প্রশ্বাস স্তব্ধ হল মুহূর্তের জন্য। হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক এই জিনিষটাই ও বলছে।
.
৩.৪
আঁ আপনি মশাই বিখ্যাত গোয়েন্দা। ওঁরা বলেছিলেন জলি রজারের পানশালায়। মিঃ ব্ল্যাটের প্রিয় বিচরণ ক্ষেত্র।
এরকুল পোয়ারো স্বভাবসিদ্ধ বিনীত ভঙ্গিতে ব্ল্যাটের বক্তব্যকে সমর্থন করলো। বলে চললেন মিঃ ব্ল্যাট, কোনো কাজের জন্য এখানে এসেছেন? না-না এমনি ছুটিতে বেড়াতে এসেছি। আমারও তো মাঝে মাঝে বিশ্রামের প্রয়োজন। চোখ টিপলেন মিঃ ব্ল্যাট। মশাই ঐ কথাই বলবেন তাই না?
মিথ্যা বলে লাভ কি বিনা প্রয়োজনে–জবাব দিলেন পোয়ারো।
সত্যি কথা বলতে কি আমার কাছে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, হোরেস ব্ল্যাট বললেন, বলেই ফেলুন না বহু বছরের বিদ্যেটা মশাই যা শুনি হজম করে দিই। এ কাজ যদি না পারতাম আজকে এই অবস্থায় পৌঁছতে পারতাম না। বেশির ভাগ লোক কিছু কথা শুনলে যতক্ষণ না সেই শোনা কথা উগরে দিতে পারে ততক্ষণ সেই লোকেদের স্বস্তি পায় না। জিনিষটাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। সেই কারণেই আপনাকে ভান করতে হবে যে, আমি শুধু এখানে ছুটি কাটাতেই এসেছি। আর অন্য কোন কারণ নেই।