দক্ষিণ দিকে বেরোলেই আপনার চোখে পড়বে হোটেলের বিস্তৃত বাঁধানো উঠোন। সমুদ্রতীর তার নিচেই। পাহাড়টার কোল ঘেঁষে আরও একটা দ্বীপকে ঘিরে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গেছে। কিছুটা গেলে কয়েক ধাপ সিঁড়ি সেই পথ ধরে আপনাকে নামিয়ে নিয়ে যাবে পাহাড়র পাথর কেটে তৈরি কতকগুলো কৃত্রিম কুঠুরির দিকে। সানি লজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে হোটেল থেকে প্রচারিত দ্বীপের মানচিত্রের এই জায়গাটাকেই। কতকগুলি বেদি বসাবার জন্য কৃত্রিম গুহাগুলোর ভেতর পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। প্যাট্রিক রেডফার্ন ও তার স্ত্রী এসে বসলো নৈশভোজের ঠিক পরেই এই রকমের একটা গুহায়। রাতের উজ্জ্বল চাঁদ স্পষ্ট চোখে পড়ছে। চুপচাপ রইল কিছুক্ষণ ওরা। ক্রিস্টিন আজকের রাতটা খুব সুন্দর তাই না, মুখ খুললো প্যাট্রিক রেডফার্ন। হু–
প্যাট্রিক অস্বস্তি বোধ করলো, কণ্ঠস্বরে একটা অদ্ভুত সুরের আভাস পেল। চুপচাপ বসে রইলো ওর দিকে না তাকিয়ে। ক্রিস্টিন শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলো, তুমি কি জানতে যে, ওই মেয়েটি এখানে আসছে?
বললো, তার মানে, প্যাট্রিক চমকে ঘুরে তাকালো।
মানেটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছো আমার মনে হয়। ক্রিস্টিন হঠাৎ তোমার কি হয়েছে জানি না।
ক্রিস্টিন বাধা দিলো, ওর স্বরে আবেগের স্পর্শ। শরীর কাঁপছে ওর।
কি হয়েছে আমার? কিছু হয়নি আমার; হলে তোমার হয়েছে। কিছু একটা হয়েছে প্যাট্রিক। তুমি প্রথম থেকেই জোর করছিলে, এখানে আসার জন্য। আমাদের টিণ্টাজেলে হানিমুন কেটেছিলো, আমি ওখানেই যেতে চেয়েছিলাম, আমার কোনো কথা কানে তোলনি তুমি, গোঁ ধরেছিলে এখানে আসার জন্য। জায়গাটা অত্যন্ত চমৎকার তাতে কি হয়েছে, তুমি যেহেতু এখানে আসতে চেয়েছিলে সেহেতু ও এখানেই আসছে। ও মানে তুমি যার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে, মিসেস মার্শাল।
ক্রিস্টিন, ভগবানের দোহাই বোকার মতো কথা বলো না, কাউকে ঈর্ষা করা তো স্বভাব নয় তোমার। প্যাট্রিকের স্বরে উন্মত্ত ক্রোধের অনিশ্চিত সুর এবং তার তীব্রতা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি।
আমরা কত সুখী ছিলাম, ক্রিস্টিন বললো। সুখী, নিশ্চয় সুখী তো ছিলাম। হ্যাঁ এখনও আছি। তুমি যদি কোনো মেয়ের সঙ্গে দুটো কথা বলতে আমাকে দেখ, তাহলে অমনি খুঁচিয়ে ঝগড়া করো। এরকম করতে থাকলে আর বেশি দিন সুখে থাকা সম্ভব নয়।
না, তা নয়?
হ্যাঁ তাই। বিয়ের পর কোনো পুরুষের অন্য লোকেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়াটা নেহাই। স্বাভাবিক। এ ধরনের সন্দেহজনক মনোভাব মোটেই ঠিক নয়। তোমার এই ধারণা কোনো সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে কথা বললে তার আমি প্রেমে পড়েছি। সে থামলো তারপর কাঁধ ঝাঁকালো।
তুমি সত্যিই ওর প্রেমে পড়েছো, ক্রিস্টিন রেডফার্ন বললো।
ক্রিস্টিন, ও বোকামি করো না, আমি ওর সঙ্গে ভালো করে কথা পর্যন্ত বলিনি।
মিথ্যে কথা।
প্রতিটি সুন্দরী মেয়েকে ঘিরে আমাকে সন্দেহ করা ছাড়ো, দোহাই তোমার। ক্রিস্টিন বললো, ও মেয়ে একটা সুন্দরী নয়। ও, ও একটা নষ্ট মেয়েছেলে। প্যাট্রিক ও আমার ক্ষতি করবে। চলো আমরা এখান থেকে চলে যাই, আমার কথা শোনো। এসব ছেড়ে দাও।
প্যাট্রিক রেডফার্নের বিদ্রোহী ভাব চিবুকে ফুটে উঠল। তাকে বয়সের তুলনায় অনেক তরুণ দেখালো। প্রতিবাদের সুরে বলে উঠলো, ক্রিস্টিন একটু ভেবে চিন্তে কথা বলে। এ নিয়ে আর ঝগড়া করো না।
ঝগড়া তো করছি না আমি। সুস্থ-স্বাভাবিকের মতো আচরণ করো, এসো হোটেলে ফিরে যাওয়া যাক, উঠে দাঁড়ালো প্যাট্রিক। ক্রিস্টিন রেডফার্নও উঠে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ নীরব থেকে, আচ্ছা চলো, ও বললো।
কুঠুরীতে বসে গভীর দুঃখে মাথা নাড়লেন এরকুল পোয়ারো। কেউ হয়তো সাধারণ ভদ্রতাবোধেই এই ব্যক্তিগত কথাবার্তার শ্রবণ-সীমার বাইরে নিজেকে সরিয়ে নিতেন। এরকুল পোয়ারো তা নয়, এ ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ বিবেকহীন।
তার বন্ধু হেস্টিংসের কাছে ব্যাখ্যা করছিলেন পরে কোনো একদিন। এই ঘটনার সঙ্গে কোনো খুনের প্রশ্ন জড়িয়ে ছিল।
অবাক চোখে চেয়ে দেখে বলছেন হেস্টিংস, তখন তো খুনটা হয়নি। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এরকুল পোয়ারো, বললেন, না হয়নি। কিন্তু বন্ধু সেই মুহূর্তেই আমি তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পেয়েছিলাম।
তুমি রুখলে না কেন তাহলে। এরকুল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলছিলো..এই কথাটা তিনি একবার মিশরেও বলেছিলেন, মানুষ খুন করার জন্য সে যদি বদ্ধপরিকর হয় তাকে বাধা দেওয়া নেহাৎ সহজ কাজ নয়। তিনি কখনো দোষারোপ করেননি পরবর্তী ঘটনার জন্য। অনিবার্য ছিলো তার মতে খুনটা।
০৩. নরম ঘাসের সমতলে
৩.১
রোজামন্ড ডার্নলি ও কেনেথ মার্শাল গাল কোভ-এর নরম ঘাসের সমতলে পাশাপাশি বসেছিলেন।গাল কোভ দ্বীপের পূর্বদিকে অবস্থিত। ভোরের দিকে লোক এসে গেছে নির্জনে স্নান করতে। রোজামন্ড বললো, নির্জনে কাটাতে বেশ ভালো লাগে নোকজনের সঙ্গ ছেড়ে। মার্শাল নিচু স্বরে বিড়বিড় করলেন,—হুঁ। তিনি উপুড় হয়ে ছোট ছোট ঘাসের গন্ধ নিলেন। শিপলির সেই মাঠগুলোর কথা মনে পড়ে, চমৎকার গন্ধ।
কি সুন্দর ছিলো দিনগুলো। হু। রোজামন্ড তুমি বেশি বদলাওনি।
বদলে গেছি হ্যাঁ, অনেক বদলে গেছি।
তুমি সেই রোজামন্ডই আছে। এখন তোমার অনেক নাম হয়েছে, টাকা পয়সা হয়েছে অনেক। মৃদুস্বরে বললো-রোজামন্ড যদি তাই থাকতে পারতাম। তার মানে? ছেলেবেলাকার সুন্দর স্বভাব কিছু না। ভাবতেও অবাক হয়। কোনোটাই চিরকাল ধরে রাখতে পারি না, উঁচু আদর্শ তাই না?