- বইয়ের নামঃ সেভেন ডায়ালস মিস্ট্রি
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- প্রকাশনাঃ সমতট
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর, ভূতের গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী
সেভেন ডায়ালস মিস্ট্রি
১. ভোরে ওঠার ব্যাপার
হাসিখুশী জিমি থেসিজার আজও দেরি হয়ে যাওয়ার জন্য দুটো সিঁড়ি টপকে প্রায় লাফাতে লাফাতে ঘরে এসে ঢুকতেই ধাক্কা খেলো বাটলার ট্রেডওয়েলের সঙ্গে।
ঘরে তখন কেবল বসেছিলেন গৃহকত্রী লেডি কুট। তার মুখে বিরক্তির ছাপ। দেরি করে প্রাতঃরাশ সারা তাঁর মোটেই পছন্দ নয়। বিয়ের প্রথম দশ বছর স্যার অসওয়াল্ড কুট প্রাতঃরাশ আটটার আধ মিনিট দেরি হলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করতেন। সেই থেকে এটা একটি নিয়মের মধ্যে হয়ে গেছে। দেরি করে প্রাতঃরাশ করা লেডি কুটের কাছে মারাত্মক অপরাধের সামিল।
খুব অল্প বয়সে লেডি কুট ছিলেন ভারী সুন্দর। ভারিক্কি গুরুগম্ভীর চেহারা। স্বামী-স্ত্রীর সুখেই দিন কেটেছে। অসওয়াল্ড কুটের যখন ধীরে ধীরে উন্নতি হলো তখন সারা ইংল্যান্ডের মধ্যে বিখ্যাত এই চিমনি নামের প্রাসাদটি দুবছরের জন্য ভাড়া করলেন। স্যার অসওয়াল্ড বাড়িটি ভাড়া নিয়েছেন–মার্কুইস অব কেটারহ্যামের কাছ থেকে। তার পরেই তার আশা-আকাঙ্ক্ষায় যবনিকা পড়েছে।
লেডি কুট যেন একাকীত্বে ভোগেন, প্রথমে তার সময় কাটতো মেয়ের সঙ্গে কথা বলে। এখন তো অনেক লোক। পাত্রীর মত বাটলার, বাড়ির দেখাশোনার জন্য বিশাল দেহের এক মহিলা, ফাইফরমাস খাটার জন্য বেশ কয়েকজন চাকর। তিনি যেন বানের জলে দ্বীপে আটকা পড়া একজন।
চেয়ার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন লেডি কুট। জিমি থেসিজার হাঁফ ছেড়ে খাওয়ায় মন দিলো।
খাওয়া শেষ করে জিমি এসে দাঁড়ালো বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা লেডি কুটের পাশে।
–বাকিরা কোথায় গেল? নৌকা চড়তে? জিমি জানতে চাইলো
–সম্ভবতঃ তাই। দ্বিতীয় প্রশ্নের অপেক্ষায় না থেকে তিনি ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
সামনে ট্রেডওয়েলকে দেখে জানতে চাইলেন, মিঃ ওয়েড প্রাতঃরাশ করতে নিচে নেমেছেন কিনা? আদৌ নামবেন কিনা সে ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করলেন।
নিশ্চয়ই মাদাম। উনি নামবেন। ট্রেডওয়েল জবাব দিলো। গতকাল উনি সাড়ে এগারোটায় নেমেছিলেন।
এই মুহূর্তে চশমাপরা এক যুবক ঘরে এসে ঢুকলো।
লেডি কুট দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে গেলেন।
অন্য দরজা দিয়ে বেরোতে গিয়ে স্যার অসওয়ার্ল্ডের প্রাইভেট সেক্রেটারি রিউপার্ট বেটম্যানের সঙ্গে জিমির দেখা হয়ে গেলো। ও একটু মাথা ঝাঁকিয়ে লাইব্রেরির দিকে চলে গেল। বেটম্যানের ডাকনাম পঙ্গো।
জিমি অলস পায়ে লেকের দিকে এগোতেই তিনজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। হেলেন, যার স্বভাব-কথায় কথায় হেসে ফেলা, দ্বিতীয় জন হলো ন্যান্সি, বাকি মেয়েটিকে শকস নামে ডাকা হয়।
-হ্যালো জিমি। ন্যান্সি বলে উঠলো। কিন্তু সে কোথায়?
–এখনও বিছানা ছেড়ে ওঠেনি জেরি ওয়েড? কিছু একটা না করলেই নয়। বিল এভারসলে বলে উঠলো।
–এরপর কোনদিন দেখবে ওর সকালের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ফোড়ন কাটলো রনি ডেভোরো।
–চলো ওকে বিছানা থেকে চ্যাংদোলা করে টেনে তুলি। বিল প্রস্তাব দিলো।
তার চেয়ে ওর গায়ে কবালতি ঠান্ডা জল ঢেলে দিলে কেমন হয়? জিমি মত প্রকাশ করলো।
কিন্তু ঠিক কি করা উচিত সেটা ওরা ভেবে ঠিক করতে পারলো না। সবাই মিলে এলো পঙ্গোর কাছে। সে এই দিকেই এগিয়ে আসছিলো।
সমস্যাটা গম্ভীর মুখে শুনে পঙ্গো বললো–ঘুম ভাঙাতে যার জুড়ি নেই সেই অ্যালার্ম দেওয়া ঘড়ি চাই। পঙ্গো অপেক্ষা না করে চলে গেল।
পঙ্গোর কথাটা সকলের মনে ধরলো। তার মানে একডজন ঘড়ি লাগবে জেরির ঘুম ভাঙাতে। বিল আর রনি ঘড়ির খোঁজে বেরিয়ে পড়তেই জিমি খাওয়ার ঘরে উঁকি মেরে দেখলো, জেরি গোগ্রাসে মার্মালেড আর টোস্ট খাচ্ছে। কিন্তু ও যাতে ওদের দলে এসে না ভেড়ে তার পরিকল্পনা শুরু হলো আবার।
আলোচনা অনুযায়ী ওরা লেডি কুটকে সব জানালো
-জেরিকে নিয়ে তোমরা মজা করতে চাও? বেশ, কিন্তু দেখো, কোনো জিনিসপত্রের কোনো ক্ষতি যেন না হয়, সামনের সপ্তাহে লর্ড কেটারহ্যামকে বাড়িটা ছেড়ে দিতে হবে। লেডি কুট বললেন।
-না না, আপনি চিন্তা করবেন না। বিল বলে উঠলো। লর্ড কেটারহ্যামের মেয়ে বান্ডল ব্রেন্ট আমার খুব বন্ধু।
জেরি ওয়েড প্রাতঃরাশ সেরে বেরিয়ে এলো।
সুপ্রভাত লেডি কুট। জেরি বললো, বাকিরা কোথায়?
–মার্কেট বেসিং-এ গেছে। নিস্পৃহ গলায় উত্তর দিলেন লেডি কুট।
এই সময় সেখানে?
–মজা করতে।
–এত সকালে মজা, আশ্চর্য।
–এখন আর সকাল নেই, আর…
–আজ আমার একটু দেরি হয়ে গেছে। একটু হেসে জেরি বললো, তাই বলে আমি কুড়ে নই। সকাল এগারোটাতে আমাকে পররাষ্ট্র দপ্তরে হাজির হতে হয়।
এদিকে দোকানদার বেশ কয়েকটা অ্যালার্ম দেওয়া ঘড়ির প্রয়োজন জেনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন।
দোকানের মালিক মিঃ মার্গাটরয়েড ওদের বোঝালেন একটু দামী জিনিষই ভালো।
–না, আমাদের দামী জিনিষের প্রয়োজন নেই। কাজে লাগলেই হলো। ন্যান্সি বললো।
–কেবল একদিনের জন্য দরকার। হেলেন বলে উঠলো।
জিমি সবকটা ঘড়ি অ্যালার্ম দিয়ে একসঙ্গে বাজাতে শুরু করলো। সেই আওয়াজ কান পাতা দায় হয়ে উঠলো।
ঘড়িগুলো পকেটে নিয়ে সবাই ফিরে এলো।
.
অ্যালার্ম ঘড়ি নিয়ে
ইতিমধ্যে দুপুরের খাওয়ার পাট চুকেছে।
ব্রিজ খেলতে বসেছেন স্যার অসওয়াল্ড, তার পার্টনার হলেন রিউপার্ট বেটম্যান। অন্যদিকে লেডি কুট ও জেরি ওয়েড। মাঝে মাঝে তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল, দুটো নো ট্রামস, ডাবল, তিনটে ইস্কাবন..ইত্যাদি।
অন্যদিকে জেরির ঘরে ঘড়িগুলি লুকিয়ে রাখার তোড়জোড় চলছে। সেই সঙ্গে চলছে চাপা হাসির মস্করা।
এবার শুরু হলো ঘড়িগুলি কিভাবে রাখা হবে এবং কটার সময় অ্যালার্ম দেওয়া হবে তার জল্পনা-কল্পনা। অনেক তর্কবিতর্কের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, সাড়ে ছটা থেকে পর পর অ্যালার্ম বাজতে শুরু করবে।
কারো এদিকে এগিয়ে আসার আওয়াজ পেয়ে সকলে সচকিত হলো।
–ভয় পাওয়ার কিছু নেই। জিমি বললো, পঙ্গো আসছে।
এবার সকলে পঙ্গোকে চেপে ধরলো; উপায় বলে দেওয়ার জন্য।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে পঙ্গে বললো, অতগুলো ঘড়ির একসঙ্গে টিকটিক শব্দ শুনে জেরি আগেই ধরে ফেলবে।
শেষে স্থির হলো, জেরি ঘুমিয়ে পড়লে চুপি চুপি ওর ঘরে ঢুকে ঘড়িগুলি মেঝেতে বসিয়ে দিলেই চলবে।
অন্যদিকে ব্রিজ খেলা বেশ পুরোদমে চলছিল। দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলায় বসেছেন স্যার অসওয়াল্ড ও লেডি কুট। অন্যদিকে জেরি ওয়েড আর বেটম্যান।
-তোমাকে কতবার বলেছি, লিড দেওয়ার সময় অত সময় নেবে না।
স্যার অসওয়াল্ড তখন ডামি। তার কথা বলা উচিত নয় জেনেও লেডি কুট মুখে কিছু না বলে একটু হাসলেন।
–আবার আমিই জিতলাম।
হাতের তাস নামিয়ে রেখে লেডি কুট বাজির টাকা গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হলেন।
রাত সাড়ে বারোটায় শুভরাত্রি জানিয়ে যে যার ঘরের দিকে এগোলেন। জেরি ওয়েডের পাশে রনি ডেভোনোর ঘর। ততক্ষণে ষড়যন্ত্রকারীরা নৈশ-পোশাক পরে জমা হয়েছে। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে ফিসফিসানি আর চাপা হাসি।
-ওর ঘরে কুড়ি মিনিট আগে আলো নিভেছে। জেরির ঘরে নজর রাখার দায়িত্ব ছিল রনির ওপর–এখন কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
পঙ্গোর ওপর দায়িত্ব পড়লো ঘরে ঢুকে ঘড়িগুলো রেখে আসার। কারণ পঙ্গে বেড়ালের মত নিঃশব্দে চলতে পারে। তাছাড়া ধরা পড়ে গেলে সামলে নেওয়ার কায়দাও সে জানে।
অবশেষে একটি একটি করে আটখানা ঘড়ি পঙ্গো জেরির ঘরে যথাস্থানে বসিয়ে রেখে চলে এলো। জেরি তখন নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে।
.
যে মজা ব্যর্থ হলো
বেলা বারোটার সময় জেরি ওয়েডের দেখা পাওয়া গেল না।
ব্যাপারটা মজার হলো না মোটেও। ঠিক ভোর সাড়ে ছটায় এক এক করে আটটা ঘড়ির আলার্ম বেজে উঠলো। রানি এগিয়ে শিগগির দরজায় কান পাতলো।
কোনো সাড়াশব্দ নেই ঘরে। আটটা অ্যালার্ম ঘড়ির সঙ্গে পাল্লা দেবার ক্ষমতা জেরির আছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আবার মিটিং বসলো।
মনে হয় কানের কোনো রোগ আছে। ওর ডাক্তার দেখানো উচিত।
—আমার মনে হয়, ওর ঘুম ঠিকই ভেঙেছে, শকস বলে উঠলো। কিন্তু ও আমাদের সেটা বুঝতে দিয়ে চায় না।
-আচ্ছা, পঙ্গো ঘড়িগুলো কোথায় রেখেছিলে? রনি জানতে চাইলো।
–ওর কানের কাছে একটা ছোট টেবিলের ওপর।
-আমি হলেও তাই করতাম। কিন্তু অন্য কেউ হলে কি করতো? রনি সংশয় প্রকাশ করলো। এবার বোঝা যাচ্ছে, সত্যিই ওর কানে কোনো অসুখ আছে।
এ সময়ে ঘরে ঢুকলো ট্রেডওয়েল। জিমি আর রনির দিকে তাকাতেই ওরা উঠে এলো বাইরে।
–কি ব্যাপার, ট্রেডওয়েল? রনি প্রশ্ন করলো।
–মিঃ ওয়েড এখনও নিচে নামেননি দেখে উইলিয়ামকে উপরে পাঠিয়েছিলাম। পরমুহূর্তে উইলিয়াম ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ছুটে এলো। ট্রেডওয়েল কপালের ঘাম মুছলো। মনে হয় মিঃ ওয়েড ঘুমের মধ্যে মারা গেছেন?
–কি যা তা বলছো? রনি ধমকে উঠলো। উইলিয়াম একটা গণ্ডমূর্খ। দাঁড়াও আমি গিয়ে দেখে আসছি।
ট্রেডওয়েল তার যাওয়ার পথ আটকে দিলো। বললো, ঘরের দরজা এখন বন্ধ, ডাঃ কার্টরাইটকে খবর দিয়েছি। এখন স্যার অসওয়াল্ডকে জানাতে হবে। তার আগে বেটম্যানকে প্রয়োজন।
ট্রেডওয়েল চলে যেতেই রনি বিড়বিড় করে উঠলো–জেরি…
জিমির ধারনা ছিল না, রনির সঙ্গে জেরির বন্ধুত্ব কত গভীর ছিল।
ঘড়ির ব্যাপারটা বিশ্রী লাগছে। জিমি উত্তর দিল। একটা মজা করতে গিয়ে সেটা এমন মর্মান্তিক ব্যাপারে দাঁড়াবে সেটা কে জানতো।
রনি তখনও নিজেকে সামলে উঠতে পারেনি।
–কি করে জেরি মারা গেল সেটা জানতে চাই।
–হয়তো হার্টের ব্যাপার। জিমি ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে বললো।
এমন সময় ট্রেডওয়েল ঘরে এসে ঢুকলো।
-স্যার, আপনাদের দুজনের সঙ্গে ডাক্তারবাবু কথা বলতে চান।
ওরা দুজনে বেরিয়ে গেল।
পঙ্গো ডাক্তারের সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিলো। ডাঃ কার্টরাইট, রোগা চেহারার অল্পবয়সী মানুষ। চোখে বুদ্ধির ছাপ।
রনিকে লক্ষ্য করে ডাক্তার বললো–আপনি তো মিঃ ওয়েডের ঘনিষ্ঠ বন্ধু?
-হ্যাঁ, ওর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।
–আচ্ছা, আপনি কি জানেন আপনার বন্ধু ঘুমের জন্য বড়ি ব্যবহার করতেন?
রনি যেন আকাশ থেকে পড়লো।ঘুমের ওষুধ। ও তো নাক ডেকে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোত।
–অত্যন্ত দুঃখপূর্ণ ব্যাপার। ওর পাশে ওষুধের বোতল ও গ্লাস পাওয়া গেছে। অত্যাধিক বেশি মাত্রায় ক্লোরাল পান করার ফলে ওর মৃত্যু ঘটেছে।
–এই মৃত্যুর পেছনে কারো কোনো ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে হয় না?
কথাটা জিমি বলতে চেয়েছিল। তার আগে রনি সন্দেহ প্রকাশ করলো।
ডাক্তারের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো।-কেন, সন্দেহের কিছু আছে নাকি? নাকি মনে করেন যে এটি একটি আত্মহত্যা?
-না, ওসব কিছু নয়।
ডাক্তার ঠিক খুশী হতে পারলেন না রনির জবাব শুনে–ওর নিকট আত্মীয় থাকলে তাকে খবর দিন।
-হ্যাঁ, ওর এক সৎ বোন আছে। এখান থেকে কুড়ি মাইল দূরে। শহরে না এলে জেরি ওখানেই থাকতো।
-বেশ, তাকে জানান।
রনির ব্যবহারে জিমি একটু অবাক হলো। ও যদি কিছু সন্দেহ করে থাকে সেটা প্রকাশ করছে না কেন?
দুজনে গাড়ি করে বেরিয়ে পড়লো। পথে যেতে যেতে রনি বললো–জিমি, এখন থেকে তুমি আমার প্রিয় বন্ধু। তাই তোমকে কিছু কথা বলতে চাই। সেটা তোমার জেনে রাখা প্রয়োজন।
জিমি একটু বিস্মিত হয়ে বললো–জেরি ওয়েড সম্পর্কে?
–হ্যাঁ, আমি শপথ করেছিলাম কাউকে বলবো না বলে। কিন্তু তবু বলতে হবে কারণ তুমি আমার চেয়ে বেশি বুদ্ধি রাখো।
বেশ বল।
হঠাৎ রনি চেঁচিয়ে উঠলো-না, আমি পারবো না।
জিমি ওকে বলার জন্য অনুরোধ করলো না। ডিন প্রিয়রি পৌঁছনো পর্যন্ত ওরা চুপ করে রইলো। খবর পেলো জেরির বোন জিম লোরেন বাগানে আছেন।
ওরা পায়ে পায়ে সেই দিকে এগোলো।
দুটো কালো স্প্যানিয়েলের সঙ্গে ফর্সা ছোটখাটো চেহারার একটু পুরোনো টুইডের স্কার্ট পরা। একটি মেয়ে তাদের দিকে এগিয়ে এলো।
জিমি দ্রুত কথা বলে উঠলো–এ হলো রনি ডেভেরো। জেরি নিশ্চয়ই ওর কথা বলেছে?
-হ্যাঁ, মিস লোরেন জবাব দিল। আপনাদের সঙ্গে জেরি এলো না কেন?
মিস ওয়েড, একটা দুঃসংবাদ আছে।
লোরেন সতর্ক হয়ে উঠলো। অস্থির ভাবে জিজ্ঞাসা করলো, ওর কি হয়েছে? বলুন, চুপ করে থাকবেন না। ও রনির দিকে তাকালো, আপনি বলুন।
-জেরি মারা গেছে।
কথাটা শুনে লাফিয়ে উঠলো লোরেন, তার চোখে সপ্রশ্ন ব্যথা।
রনির মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে লোরেন বললো, জেরি ঘুমের ওষুধ খেয়েছে? অবিশ্বাস ঝরে পড়লো ওর কথায়।
মিস লোরেন, ওদের সঙ্গে আসতে চাইলো না। ওরা আবার চিমনিতে ফিরে এলো।
লেডি কুট বারবার চোখ মুছছিলেন।
জেরির ঘর থেকে রনিকে বেরোতে দেখে জিমি অবাক হলো।
–একবার ওকে দেখে এলাম। রনি বললো, শেষ সম্মান জানানো উচিত।
মন না চাইলে রনির সঙ্গে জিমি ঢুকলো জেরির ঘরে।
শ্বেত ফুলে ঢেকে আছে জেরির নিশ্চল দেহ। জিমির ভেতরটা একটু কেঁপে উঠলো। এই সেই জেরি ওয়েড।
ঘড়িগুলো পরপর সাজানো রয়েছে। কিন্তু আটটার পরিবর্তে সাতটা। আশ্চর্যের ব্যাপার, একটা ঘড়ি কোথায় গেল?
.
একখানা চিঠি
–যারা নিজের ক্ষমতায় বড় হয় তারা প্রচুর টাকা করতে পারে। লর্ড কেটারহ্যাম শান্ত ভাবে বললেন।
বাবার কথা শুনে মেয়ে লেডি এইলিন ব্রেন্ট, বন্ধুদের কাছে যে বান্ডল নামে পরিচিত, হেসে উঠলো।
–তোমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। তবে বুড়ো কুটকে জায়গাটা ভাড়া দিয়ে ভলোই লাভ করেছে।
-হ্যাঁ, তবে লোকটা ভীষণ বিরক্তিকর। আমার ওরকম লোক পছন্দ হয় না।
–এরকম লোক না হলে তোমার ঐ ভাঙাচোরা বাড়িটার জন্য এত টাকা পেতে?
–আঃ, জ্বালাতন করিস না। আগের ঘটনা মনে পড়ে যায় লর্ড কেটারহ্যামের। একজন অচেনা লোক তাই বলে আমার বাড়িটা মৃত্যুর জন্য বেছে নেবে? এই নিয়ে দুবার হলো। চারবছর আগের ঐ ঘটনার জন্য অবশ্য জর্জ লোম্যাক্স দায়ী।
তবে এবারে দোষ পড়লো স্টিম রোলার কুটের ওপর। অবশ্য এটা আগের মত খুন নয়।
–ঐ তো মোটা ইনসপেক্টর যেমন ভাব করছিলেন যে মনে হচ্ছিল, এখানে যত মানুষ মরে সবগুলোই খুন। আমি ট্রেডওয়েলের কাছ থেকে সব শুনেছি।
জেরি ওয়েডকে আমি একবারই দেখেছি। ভারি হাসিখুশী ছেলে। বান্ডল বললো, ওকে কেউ খুন করবে ভাবতেই পারি না।
-কিন্তু ঐ গাধা ইনসপেক্টরের গবেট মাথায় সেটা তো ঢুকছে না।
বান্ডল উঠে পড়ল–যাই, ম্যাকডোনাল্ডের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
বাগানে ম্যাকডোনাল্ডের মুখোমুখি হলো বান্ডল–ম্যাকডোনাল্ড, আমার এক থোকা আঙুর চাই, আধপাকা হলেও চলবে।
সে আবার ঘরে এসে ঢুকলো।
-আচ্ছা বাবা, লেডি কুটকে কেমন লাগে তোমার?
–অনেকটা মিসেস সিডন-এর মতো। ঐ ঘড়ির ব্যাপারটা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। বান্ডল ঘড়ির ব্যাপারটা জানত না। তাই তাকে বুঝিয়ে সব বললো।
-বান্ডল একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি, লর্ড কেটারহ্যাম বললেন। ছেলেটা তোর ঘরে মারা যায়।
বান্ডল মুখ কুঁচকে নিলো-কেন যে লোকে আমার ঘরে মরে।
নিজের ঘরে সন্ধ্যেবেলা আগুনের সামনে বসে বান্ডলের বারবার জেরি ওয়েডের কথা মনে পড়লো।
তাকের দিকে চোখ যেতেই ঘড়ির কথা মনে পড়লো। ওর পরিচারিকার মুখে শুনেছে, সাতটি ঘড়ি ছিল, একটি ঘড়ি বাগানের ঝোপে পাওয়া গেছে। বাগানের মধ্যে ঘড়ি আসবে কি করে? তবে কি জেরি প্রথমটির অ্যালার্ম শুনে বিরক্ত হয়ে ছুঁড়ে দিয়েছিল বাগানের দিকে। ব্যাপারটা খুব ভাবিয়ে তুললো বান্ডলকে। না, এ ব্যাপারে বিল এভারসলের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
সে লেখার টেবিলের সামনে গিয়ে বসলো। কি মনে করে ডেস্কের তলার দিকটা টানলো। কিন্তু আটকে গেল। একটা ছুরি দিয়ে চাপ দিতেই একটু ফাঁক হলো। একটা কাগজের অংশ দেখতে পেয়ে টেনে বের করলো। একটা চিঠি।
২১ শে সেপ্টেম্বর, চিঠির তারিখটা দেখে বান্ডলের চোখ ঐখানেই আটকে রইলো, তার মানে জেরি যেদিন মারা যায় তার আগের দিন চিঠিটা সে লিখেছে। চিঠিটা সম্পূর্ণ লেখা হয়নি।
সে চিঠিটা পড়তে লাগলো।
আমার প্রিয় লোরেন,
আগামী বুধবার আমি তোমার কাছে যাচ্ছি। বেশ আছি। খুব মজা হবে। আর সেই সেভেন ডায়ালের যে কথা বলছিলাম সেটা ভুলে যেও। ব্যাপারটা ঠাট্টা মনে করে তোমাকে বলেছিলাম। কিন্তু সে ধারণা আমার নষ্ট হয়েছে। তুমি কিছু মনে করো না। তোমার মত ছোটদের এই ধরনের ব্যাপারে সাবধান থাকা উচিত নয়।
ভীষণ ঘুম পেয়েছে। ইচ্ছে থাকলেও আর লিখতে পারছি না।
ঐ লার্চারের ব্যাপারে আমার ধারণা…
সেভেন ডায়ালস। জায়গাটা কোথায়? মনে করার চেষ্টা করলো কিন্তু বান্ডল পারলো না। তার মানে চিঠির কয়েকটা কথা খচখচ করে বিধতে লাগলোবেশ আছি, ভীষণ ঘুম পেয়েছে কথাগুলো খাপ খাওয়াতে পারছে না বান্ডল। চিঠির কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে সে ঘুমের ওষুধ খাবে কেন?
নিঃস্তব্ধ ঘরে বান্ডল বসে ভাবছে। কেবল শোনা যাচ্ছে ঘড়ির টিকটিক শব্দ। ঘরের চারপাশে তাকিয়ে বান্ডল একটু কেঁপে উঠলো।
.
পথের সেই লোকটি
বান্ডল তাড়াহুড়ো করে গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করলো। তাড়াহুড়ো করা তার স্বভাব। এতে যে বিপদে পড়েনি কখনোও তা নয়। অবশ্য সে ভালো গাড়ি চালায়।
অক্টোবর মাস। রোদ্দুর ঝলমল করছে। বান্ডল তাই যেন চঞ্চলতায় মুখর।
জেরি ওয়েডের অর্ধসমাপ্ত চিঠির সঙ্গে দুলাইন লিখে সকালেই লোরেনের কাছে সে পাঠিয়ে দিয়েছে। এবার সে বিল এভারসেলের সঙ্গে দেখা করে সেদিনের পার্টির সব কথা জানবে।
মাইলের পর মাইল পার হলো বান্ডলের হিসপানো। বান্ডল নিজের চিন্তার মধ্যে ডুবে ছিল।
হঠাৎ একটা লোক ঝোঁপের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে টলতে টলতে রাস্তায় পড়লো। লোকটাকে বাঁচানোর জন্য বান্ডল প্রাণপণে ব্রেক কষলো। একটা নয়ানজুলির মধ্যে গিয়ে পড়তে পড়তে দুর্ঘটনার হাত থেকে রেহাই পেলো বান্ডল। লোকটাকে বাঁচাতে পেরেছে ভেবে নিশ্চিন্ত হলো।
কিন্তু পেছনে তাকাতেই তার চক্ষু বিস্ফারিত হলো। লোকটি চাপা পড়েনি ঠিকই, কিন্তু ধাক্কা খেয়েছে মনে হয়। নতুবা উপুড় আর স্থির হয়ে আছে কেন?
সে প্রায় ছুটে এলো লোকটির কাছে। তার বুকে তখন হাতুড়ি পেটানোর আওয়াজ হচ্ছে।
লোকটাকে চিৎ করলো। সুন্দর চেহারার এক যুবক। তার শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। বান্ডল নিশ্চিত যে লোকটা মারা গেছে বা মরতে চলেছে। এমন সময় লোকটির দুটি ঠোঁট নড়ে উঠলো। অস্ফুট স্বরে কিছু বলার চেষ্টা করলো। বান্ডল ঝুঁকে পড়লো একটু।
-সেভেন ডায়ালস…ওকে বললেন…
বান্ডল আরো একটু কান নামিয়ে আনলোবলুন, কি বলবো?
–জিমি থেসিজারকে…বলবেন
লোকটির মাথা একপাশে হেলে পড়ে স্থির হয়ে গেল।
এরকম ভয়ঙ্কর একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে সেটা জানা ছিল না বান্ডলের। একটা মানুষকে সে চাপা দিয়ে মেরে ফেললো। কিছুক্ষণের মধেই নিজেকে সংযত করল। লোকটা জ্ঞানও হারাতে পারে। সে লোকটাকে টানতে টানতে গাড়িতে তুললো।
দুমাইল পার হয়ে একটা ছোট শহরে একজন ডাক্তারের দেখা পেল।
ডাঃ ক্যাসল তার চেহারা দেখে একটু বিচলিত হলেন।
–মনে হয় আমি একজন লোককে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছি। বান্ডল বলে উঠলো।
ডাক্তার তাকে ওখানে বসতে বলে নির্দিষ্ট ঘরে ঢুকলেন। পাঁচ মিনিট পরে ফিরে এলেন।
-এবার বলুন তো, ঠিক কি ঘটেছে?
ডাক্তারের প্রশ্নে বান্ডল সব ঘটনা গুছিয়ে বললো।
-না, গাড়িটা ওর দেহের ওপর দিয়ে যায়নি। লোকটা কি টলছিল?
–হ্যাঁ, আমি মনে করেছিলাম, লোকটা মাতাল।
-লোকটাকে গুলি করা হয়েছে। তাতেই ওর মৃত্যু হয়।
.
আবার সেভেন ডায়ালস
এতক্ষণে বান্ডল একটু ধাতস্থ হলো।
-কিন্তু ওকে কি করে কেউ গুলি করলো? বান্ডল জানতে চাইলো।
-সেটা বলতে পারবো না। ডাক্তার জবাব দিলেন। রাইফেলের বুলেট বিঁধেছে ওর শরীরে। ভিতরে রক্তপাত হয়েছে। আচ্ছা, ওর পেছন পেছন কেউ কি ছুটে এসেছিল?
–না, কাছাকাছি কাউকে দেখিনি।
–মারা যাওয়ার আগে কিছু বলেছে?
-খুব অস্পষ্ট ভাবে কয়েকটা কথা বলেছিল। ও একজনকে কিছু বলতে বলেছিল। সেভেন ডায়ালস কথাটা সে বলেছিল।
-হুম। ডাক্তার একটু চিন্তিত হলেন, এই ধরনের মানুষের ওটা জায়গা নয়। মনে হয় খুনী সেখান থেকে এসেছিল। পুলিসকে জানানো দরকার। আপনি বরং আমার সঙ্গে থানায় চলুন।
পুলিশ ইনসপেক্টর বান্ডলের পরিচয় পেয়ে শিরদাঁড়া টান করে বসলো। তাকে বিস্তারিত জানানো হলো।
–মৃতের নাম জানেন? ইনসপেক্টর জানতে চাইল।
–ওর নামের কার্ড সঙ্গে ছিল। রনি ডেভেলরা। ঠিকানা আলবাম।
নামটি শুনে বান্ডলের ভুরু কুঁচকে গেল। নামটা নিশ্চয়ই আগে কোথায় শুনেছে।
.
চিমনির কাছাকাছি আসতেই বান্ডলের পরিস্কার মনে পড়লো রনি ডেভেরো ছিল বিল আর জেরি ওয়েডের বন্ধু। পররাষ্ট্র দপ্তরে কাজ করতো। এই মৃত্যুর পেছনে একটা রহস্যের গন্ধ পেল সে।
সেভেন ডায়ালস–শব্দ দুটি তাকে বার বার ভাবিয়ে তুললো। জেরির চিঠিতে এবং রনির মুখে এই শব্দটা সে পেয়েছে।
বাড়িতে ঢুকে সে সোজা বাবার কাছে এগিয়ে এলো। এই মুহূর্তে তাকে ভীষণ প্রয়োজন। লর্ড কেটারহ্যাম তখন বইয়ের নতুন একখানা ক্যাটলগ দেখতে ব্যস্ত ছিলেন।
পথে যা যা ঘটেছে সমস্ত সে তার বাবাকে শোনালো।
-বুঝলাম। লর্ড কেটারহ্যাম একটা চাপা নিঃশ্বাস ফেললেন। যারা ঝামেলায় জড়াতে চায় তাদের কপালে ঠিক জুটে যায়।
-বাবা, সেভেন ডায়ালস কোথায় জানো?
–সম্ভবতঃ ইস্ট এন্ডের কাছে। শুনেছি ওখানে বাস যায়। আমি কোনদিন যাইনি।
–তুমি জিমি থেসিজার নামে কাউকে জানো?
লর্ড কেটারহ্যাম ক্যাটালগের দিকে চোখ রেখে বললেন, কোন থেসিজার? কত তো থেসিজার আছে। তোর ঠাকুরমার বাবা এক থেসিজারকে বিয়ে করেছিলেন।
-ওঃ, তোমাকে নিয়ে পারা যায় না। বিলকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
–সেই ভালো। লর্ড কেটারহ্যাম এবার ক্যাটালগের দিকে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করলেন।
বান্ডলকে চলে যেতে দেখে তিনি আবার ডাকলেন, সেভেন ডায়ালস-এর কথাটা মনে পড়লো। জর্জ লোম্যাক্স এসেছিল। তুই তো ওকে চিনিস। পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি। আর ক্যাবিনেট মন্ত্রী। সামনের সপ্তাহে প্যারিতে কি একটা রাজনৈতিক সভা আছে। ও একটা চিঠি পেয়েছে, যাতে সাবধান এমন ধরনের কিছু লেখা আছে। চিঠিটা পাঠিয়েছে সেভেন ডায়াল। স্টকল্যান্ড ইয়ার্ডে যাবে পরামর্শ করতে।
বান্ডল অন্যমনস্ক হয়ে জেরির চিঠিটার কথা ভাবতে লাগলো। যতই ভাবলো ততই ওর মনে হলো, এ ধরনের চিঠি কোনো বোনকে লেখা সত্যিই আশ্চর্য।
-বাবা, জেরি ওয়েডের বোন লোরেন ওয়েডের কথা তুমি বলেছিলে। বান্ডল প্রশ্ন করলো।
-সত্যি কথা বলতে কি লোরেন ওর বোন নয়। ওয়েড দ্বিতীয়বার যে মহিলাটিকে বিয়ে করেছিলেন তার প্রথম স্বামীর মেয়ে লোরেন। লোকটি মেয়েকে দেখাশোনা করতো না। তাই ওয়েড তাকে বড়ো করে তোলে এবং তার পদবী দেয়।
-বুঝলাম। এবার সব পরিষ্কার হলো।
.
দেখা করলো বান্ডল
পরদিন সকালে গাড়ি নিয়ে বান্ডল সোজা এলো শহরে। ফোনের মাধ্যমে বিলের সঙ্গে যোগাযোগ করলো। ওর ফোন পেয়ে বিল আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো। সিনেমা বা রেস্তোরাঁয় যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালো। কিন্তু বান্ডল জানালো, সে খুব ব্যস্ত। কয়েকদিন পরে ওসব নিয়ে ভাববে।
–বিল, কাজের কথা শোন। জিমি থেসিজার নামে কাউকে চেনো?
–অবশ্যই চিনি। তুমিও চেনো।
–না, আমি চিনি না।
–নিশ্চয়ই চেনো। গাধার মতো লালচে মুখ। তবে আমার চেয়ে বেশি বৃদ্ধি ধরে।
–কি করে? বান্ডল জানতে চাইলো।
কাজকর্মের কথা বলছো? কিছু করে না। ঘোরা ওর চাকরি। আর চাকরি করার প্রয়োজন ওর নেই।
বান্ডল একটুক্ষণ চুপ করে রইলো। জিমি থেসিজার কি তাকে সাহায্য করতে পারবে, অবশ্য মৃত লোকটি তার নাম-ই উচ্চারণ করেছিল।
রনি ওর বুদ্ধির প্রশংসা করতো। বিলের কণ্ঠ ভেসে এলো বান্ডলের কানে। রনি ডেভেরো, জিমি থেসিজারের প্রিয় বন্ধু।
বান্ডল বুঝলো, বিল এখনো রনির মৃত্যুর খবর জানে না। কোনো কারণে পুলিস হয়তো সেটা চেপে রেখেছে।
-রনির সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি। সপ্তাহখানেক আগে তোমাদের বাড়িতে শেষ দেখা হয়েছিল। ঐ সময়ে বেচারী জেরি মারা গেল। বান্ডল, তুমি নিশ্চয়ই শুনেছে।
রনির ব্যাপারটা ফোনে জানাতে চায় না বান্ডল।
–তুমি কি জিমি থেসিজারের ঠিকানা জানো?
জারমিন স্ট্রিট। একটু ধরো, নম্বরটা দেখে দিচ্ছি।
খানিকক্ষণ নীবর রইলো ফোনের দু প্রান্ত।
-বান্ডল, নম্বরটা লিখে নাও। ১০৩, জারমিন স্ট্রিট। তুমি যে বললে ওকে চেনো না। তবে ওর ঠিকানা নিয়ে কি করবে?
চিনি না ঠিকই। তবে আধঘণ্টার মধ্যে চিনে নেবো। আর শোন, আগামীকাল রাতে ডিনারে তোমার সঙ্গে দেখা করছি।
বান্ডল ঘড়ি দেখলো। এগারোটা পঁচিশ। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সে জারমিন স্ট্রিটের দিকে ছুটলো।
একজন বয়স্ক ভদ্রলোক দরজা খুলে দিলো। তাকে বসবার ঘরে নিয়ে গেল। বড় ঘর। কয়েকটা সোফা রয়েছে। একটি সোফায় ছোটখাটো চেহারার কালো পোষাক পরে একটা ফর্সা মেয়ে বসে আছে।
বান্ডল লোকটিকে জানালো জিমি থেসিজারের সঙ্গে দেখা করতে চায়। নাম তাকে না বললেও চলবে।
লোকটি ঘাড় কাত করে ভেতরে চলে গেল।
বান্ডল মেয়েটিকে দেখে বিরক্ত হয়েছিল। কারণ সে চায় না কোনো অপরিচিতার সামনে জিমির সঙ্গে কথা বলতে। সে মেয়েটিকে খুঁটয়ে দেখতে লাগলো। পরনে শোকের পোশাক। তবে কি এই মেয়েটিই সে?
বান্ডল সময় নষ্ট না করে প্রশ্ন করলো, আপনি কি মিস লোরেন ওয়েড?
-হ্যাঁ, আপনি আমাকে চিনলেন কি করে?
–আমি বান্ডল ব্রেন্ট। গতকাল আপনাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছি।
–ধন্যবাদ, জেরির চিঠিটা আমি পেয়েছি, কিন্তু আপনি এখানে?
–আপনি রনি ডেভোরোকে চিনতেন?
–হ্যাঁ, যেদিন জেরি–যাক, ও সেদিন এসেছিল। জেরির কাছের বন্ধু ছিল।
–সে মারা গেছে।
লোরেন হাঁ করে তাকিয়ে রইলো, বান্ডল গতকালের ঘটনার বিবরণ দিলো।
লোরেনের চোখে ভয়ের ছায়া–তাহলে গত একসপ্তাহ ধরে যা ভাবছিলাম তাই। জেরির স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। ওকে কেউ খুন করেছে।
-আপনারও ধারণা এইরকম?
কারণ জেরি ছিল ঘুম কাতুরে। তাকে ঘুমের জন্য ওষুধ খেতে হতো না। আপনার পাঠানো চিঠিটা নিয়ে রনির কাছে এসেছিলেন। ওকে না পেয়ে জিমির কাছে এসেছি। আমার এখন কি করা উচিত ওর কাছ থেকে পরামর্শ নেবার আশায়।
.
জিমির অতিথি
–স্যার, আপনার সঙ্গে একজন তরুণী দেখা করতে চাইছেন।
ঘুম জড়ানো গলায় জিমি বললো, কি বললে স্টিভেনস? আর একবার বলো।
–একজন অল্পবয়স্কা সুন্দরী তরুণী, স্যার। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।
জিমি বিরক্ত হলো–কেন?
কারণ কিছু বলেননি। স্যার, এই চা ঠান্ডা হয়ে গেছে, আপনার জন্য আর এক কাপ আনছি।
স্টিভেনস খানিক বাদেই এক কাপ গরম চা এনে জিমির সামনে ধরলো।
দরজায় ঘন্টার আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে গেল। ফিরে এসে বললো–স্যার, আর একজন মহিলা এসেছেন।
-কি? জিমি দুহাতে মাথা চেপে ধরলো।
–নাম বলেন নি, জরুরী দরকার আছে বললেন।
–স্টিভেনস, কাল রাতে কটায় ফিরেছি।
–পাঁচটায়, স্যার।
-একটা কথা ভাবছিলাম আমি। গভর্নেসের জন্য আমি কি বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। দু-দুজন তরুণী আমার সাক্ষাৎপ্রার্থী।
পোশাক পরে তৈরি হয়ে জিমি বসবার ঘরে এসে ঢুকলো। অজানা অতিথিদের দিকে নজর বোলালো। সোফায় সে বসে আছে সে লোরেন। কিন্তু গাঢ় রোগাটে চেহারার ঐ তরুণী?
পরমুহূর্তেই লোরেনের কাছ থেকে সে তার প্রশ্নের জবাব পেলো।
–আমাকে দেখে অবাক হচ্ছো, তাই না? বিশেষ প্রয়োজনে আসতে হলো, আর ইনি হলেন লেডি এইলিন ব্রেন্ট।
–আমি বান্ডল নামে পরিচিত। এই নাম আপনি বিল এভারসলের কাছ থেকে শুনে থাকবেন।
–ও হ্যাঁ, শুনেছি। বসুন। বলুন কি ব্যাপারে এসেছেন? জিমি বললো।
–আগে জেরি, লোরেন বললো, এবার রনি। গতকাল কেউ ওকে গুলি করেছে।
কথাটা শুনে জিমি চিৎকার করে উঠলো। সমস্ত ঘটনার বিবরণ শুনলো বান্ডলের কাছে। সে চুপ করে সব শুনে গেল। বসে রইলো অনেকক্ষণ গুম হয়ে। একসময় মুখ খুললো।
একটা ব্যাপার আপনাদের জানা দরকার। যেদিন জেরি মারা যায়, লোরেন, সেদিন তোমার বাড়িতে খবর দিতে যাওয়ার সময় রনি একটা কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু বলতে পারেনি, কারণ সে নাকি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল।
আমি তাই ওর কাছ থেকে জানার আর চেষ্টা করিনি। তবে রনির মনে একটা সন্দেহ ছিল। ডাক্তারকেও সে সেটা বোঝাতে চেয়েছিল।
-রনির সন্দেহ ছিল, এটা আপনি এখনও মনে করেন? বান্ডল প্রশ্ন করল।
–হ্যাঁ, আমার ধারণা তাই। রনি একাই রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করেছিল হয়তো। হত্যাকারী সেটা টের পেয়ে ওকেই খুন করেছে। ও নিশ্চয়ই আমাকে ঐ দুটো কথা বলতে চেয়েছিল।
-সেভেন ডায়ালস!
–আমাদের এগোতে হবে সেভেন ডায়ালসকে লক্ষ্য করে। জিমি জানালো।
এইবার লোরেন ব্যাগ থেকে চিঠিটা বের করে জিমির হাতে দিলো, যেটি লোরেনকে উদ্দেশ্য করে জেরি ওয়েডের অর্ধসমাপ্ত লেখা, বান্ডল তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলো।
চিঠিটা পড়ে নিয়ে জিমি বললো, আপনিই এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন, আপনাকে কি ভুলে যেতে লিখেছিল?
লোরেন একটু বিহ্বল চোখে তাকালো–ঠিক মনে পড়ছে না। তবে একদিন আমি ভুল করে একটা খাম থেকে চিঠি বের করে ফেলেছিলাম। অশিক্ষিতের মত হাতের লেখা। বিশেষ কিছু লেখা ছিল না। ওপরে ছিল সেভেন ডায়ালসের ঠিকানা। আর কিছু নাম আর তারিখ। আমি ভয়ে না পড়ে ওটা আবার খামের মধ্যে রেখে দিই।
-কেবল নাম আর তারিখ? জিমিকে কেমন চিন্তিত দেখালো।
–জেরি কিছু মনে করেনি। ও কেবল জানতে চেয়েছিল, মাফিয়ার নাম আমি শুনেছি কিনা। ইংল্যান্ডে এরকম একটা মাফিয়া দল খুললে কেমন হয় আমার কাছে জানতে চেয়েছিল। আমাদের দেশের অপরাধীদের কল্পনা শক্তির অভাব, এ কথাও বলেছিল।
-এবার বুঝতে পেরেছি। জিমি একটু উৎফুল্ল হয়ে বললো। প্রথমে জেরি ভেবেছিল ওটা একটা কোনো মজার ব্যাপার, পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তোমাকে ওটা স্মরণে রাখতে নিষেধ করেছিল। তাহলে সেভেন ডায়ালস হলো ঐরকম কোনো দলের প্রধান কার্যালয়।
জিমি বান্ডলের দিকে তাকালো-আপনারা যা করার করেছেন। এবার আমার পালা। এ ব্যাপারে আপনারা আর এগোবেন না।
–আমার প্রিয় জেরিকে যারা খুন করেছে তাদের বিরুদ্ধে আমি রুখে দাঁড়াবো না? লোরেন বলে উঠলো। তুমি নিশ্চয়ই আমার কথা বুঝতে পারছো।
-তাহলে আমরা কি ভাবে এগোবো? জিমি ওদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলো।
২. পরিকল্পনা
শুরু হলো আলোচনা। সেভেন ডায়ালস একমাত্র সূত্র। কিন্তু এটাকে লক্ষ্য করে এগোতে গেলে সারা দেশ তোলপাড় করতে হয়।
–আচ্ছা সেটা না হয় ধরে নিলাম, জিমি বললো, প্রথমে যেখানে রনিকে গুলি করা হয়েছে সে জায়গাটা পরীক্ষা করতে পারি। অবশ্য পুলিস সে কাজ আগেই করে ফেলেছে।
-আপনি অত্যন্ত আশাব্যাঞ্জক কথা বলেন। বান্ডল বলে উঠলো।
–ধৈর্য ধরুন। সেরা গোয়েন্দারা এইভাবে এগোয়। তিন নম্বর প্রশ্ন হলো, জেরির মৃত্যু যে খুন এ ব্যাপারে আপনারা আমার সাথে একমত, তাই তো?
-হ্যাঁ, লোরেন বললো।
–তাহলে জেরি যদি নিজের হাতে ক্লোরাল না খেয়ে থাকে কেউ তার গ্লাসে জলের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। যাতে জেরি ঐ জল খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিরজীবনের মত ঘুমিয়ে পড়বে। এটা নিশ্চয়ই বাইরের কেউ করেনি। তাহলে লোকটা ঐ বাড়িতেই ছিল।
–ঠিক বলেছেন। বান্ডল সায় দিল।
–বাড়ির লোকজন আপনাদের বেশ পুরোনো তাই না?
-হ্যাঁ, বান্ডল বললো, ভাড়া দেবার সময় সবাই ছিল। তবে নতুন দুএকজন ছাড়া বাকিরা সবাই রয়েছে।
-কতজন চাকর-বাকর আছে, কারা নতুন এসেছে, কারা গেছে, তাদের নামের একটা তালিকা আপনাকে করতে হবে।
-কিন্তু চাকরদের মধ্যে কেউ, নাকি অতিথিদের মধ্যে কেউ?
–তিনজন মেয়ে ছিল, ন্যান্সি, হেলেন আর শকস। আর ছিল জেরি ওয়েড, আমি, বিল এভারসলে ও রনি। স্যার অসওয়াল্ড আর লেডি কুট তো ছিলেনই। তাছাড়া ছিলো পঙ্গো, যার আসল নাম বেটম্যান, স্যার কুটের সেক্রেটারি।
এদের মধ্যে সন্দেহজনক কেউ নেই। লোরেন বললো।
-আমারও তাই মনে হয়। বান বললো, বাড়ির চিত্রকরদের ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে। আচ্ছা, যে ঘড়িটা জানলা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় তার সঙ্গে এই ঘটনার কোনো সম্পর্ক আছে?
-হ্যাঁ, সাতটা ঘড়ি পরপর সাজানো ছিল। জিমি বলে উঠলো। আটটা নয়। ভাবলেই কেমন লাগে। ঐরকম ঘড়ি অন্ধকার কোনো ঘরে থাকলে আমি ঢুকছি না সেই ঘরে।
-যদি রেডিয়াম বসানো না থাকে তাহলে অন্ধকারে তো দেখতে পাবেন না। বান্ডল বললো, সে মাথা ঝাঁকিয়ে আবার বললো, আমি নিশ্চিত, এটা হবে। একটু চুপ করে আবার বললো, ঘড়িগুলো কে কিনেছিল?
–আমরা সবাই মিলে?
–মতলবটা কার?
আমরা সবাই ভেবেছিলাম। আসলে জেরি ওয়েডকে কিভাবে ঘুম ভাঙিয়ে তোলা যায়, তারই শলা পরামর্শ চলছিল। অ্যালার্ম দেওয়া ঘড়ির কথা প্রথম বলেছিল পঙ্গো। আমরা রাজী হয়েছিলাম। খুব সম্ভব বিল বলেছিল, বারোটা ঘড়ি কেনার জন্য। শেষ পর্যন্ত আটটা ঘড়ি কেনা হয়। আমাদের প্রত্যেকের জন্য একটা করে, বাকি দুটো পঙ্গো আর লেডি কুটের জন্য। কিছু ভেবে চিন্তে এটা করা হয়নি। নিছক ঘটে গিয়েছিল।
বান্ডল ঠিক মেনে নিতে পারলো না। কিন্তু চুপ করে রইলো।
জিমি সমস্ত ঘনা গুছিয়ে বলার চেষ্টা করলো।
-মাফিয়া গোষ্ঠীর গন্ধ রয়েছে এর মধ্যে নিঃসন্দেহে। জেরি ওয়েডের কাছে এর অস্তিত্ব ধরা পড়ে যায়। তবে এটা যে বিপজ্জনক কিছু সেটা সে বুঝতে পারেনি। অথবা পরে এমন কিছু ঘটেছিল যা ওর ধারণাকে পালটে দিয়েছিল। মনে হয় রনি ডেভেরোকে এ বিষয়ে কিছু বলেছিল। ফলে জেরিকে প্রাণ দিতে হলো। যতটুকু রনি জানতে পেরেছিল সেটাকে সম্বল করে সে এগোবার চেষ্টা করেছিল। সে-ও খুন হলো। কিন্তু ওরা দুজন যা জেনেছে আমরা কিছুই জানি না। আমাদের অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে এগোতে হবে।
-মনে হয় এটা ভালোই হবে। ওরা আমাদের সন্দেহ করতে পারবে না। লোরেন বললো। ফলে আমাদের বিপদের সম্ভাবনা কম হবে।
হঠাৎ কি মনে হতে জিমি দেওয়ালে ঘড়ির দিকে তাকালো। তারপর মুখ দিয়ে একটা অস্পষ্ট শব্দ করে দরজা খুলে স্টিভেনসনকে ডাকলো মাধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করার জন্য।
প্রথমে ওমলেট দিয়ে খাওয়া শুরু হলো। এছাড়া রয়েছে পাখির মাংস ও হালকা একটা স্যুপ।
খেতে খেতে কথা হচ্ছিল।
হঠাৎ বান্ডল চিৎকার করে উঠলো।আমি একটা গাধা, ভাবতে ভাবতে কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম।
-কি?
–আপনি নিশ্চয়ই কর্ডাসকে চেনেন, যার নাম জর্জ লোম্যাক্স?
–হ্যাঁ, নামটা নিশ্চয় শুনেছি। বিল আর রনি দুজনেই বলেছিল।
–তিনি সেভেন ডায়ালস-এর কাছ থেকে একটা সাবধানী চিঠি পেয়েছেন।
–এটা কি সত্যি? জিমি ঝুঁকে পড়লো।
-সত্যি, বাবাকে তিনি কথাটা বলেছেন, এবার বুঝেছেন, এটা কোনো ব্যাপার নির্দেশ করছে?
জিমি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে খুব ভালো ভাবে চিন্তা করলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, তাহলে কর্ডাসের দেওয়া পার্টিতে কিছু একটা হতে চলেছে।
-হ্যাঁ। আমার ধারণাও তাই। বান্ডল বললো।
এবার জিমি লোরেনের দিকে তাকিয়ে বললো, যখন বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তখন মনে হয় জেরির বয়স ছিল কুড়ি বছর। সবাই ঐ বয়সে যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু জেরি করেনি। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত জেরি ইংল্যান্ডে ছিল না। ঐ সময় ও কোথায় ছিল তা কেউ জানে না। কিন্তু আমি বেশ খুঁটিয়ে দেখেছি। ও ঐ সময় জার্মানিতে ছিল। কারণ ও জার্মান ভাষা বেশ ভালো বলতে পারতো।
লোরেনের গালদুটো লাল হয়ে উঠলো।
জিমি আবার বলতে শুরু করলো, জেরি পররাষ্ট্র দপ্তরে চাকরি করতো। সে ছিল হাসিখুশী, বোকা বোকা গোছের। কিন্তু এটা তার ওপরের আবরণ। আমার ধারণা ভেতরে ও ঐ দপ্তরে বেশ উঁচু পদে বহাল ছিল।
-এর থেকে কি বোঝা যাচ্ছে? বান্ডল জানতে চাইলো।
–এটা আন্তর্জাতিক ব্যাপার। লোম্যাক্সের বাড়ির ঐ পার্টিতে নামকরা কেউ একজন থাকছে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। বিল নিশ্চয়ই সেখানে কর্ডাসের ডান হাত হয়ে হাজির থাকবে। ও আমাকে কায়দা করে সেখানে নিয়ে যেতে পারে।
তার আগে বিলকে তালিম দিয়ে নিতে হবে। কারণ ও এ ব্যাপারে একদম আনাড়ী।
–আপনিই বলুন, সরল মনে জিমি বললো।
–বিল আমাকে এক ধনী তরুণ রাজনীতিবিদ হিসাবে পরিচয় দেবে। এই সব পার্টিতে ওরা ধনীদের কবজা করতে ব্যস্ত থাকে। আমি আগামীকাল বিলের সঙ্গে ডিনারে দেখা করছি। ওর কাছ থেকে জেনে নেবো কারা কারা পার্টিতে আসছেন।
–আপনি তো ঐ পার্টিতে থাকছেন না?
-কার্ডস আমাকে বিষের মতো ঘেন্না করে জানি। তবে এটাও ঠিক, উপায় অনেক আছে।
ঠিক হলো লোরেন যাবে না। বাইরে থাকবে। তাকে এখন বাড়ি গিয়ে শান্ত হয়ে বসে থাকতে হবে।
–তাহলে ঐ কথাই রইলো, জিমি বললো, তুমি কিছু করছে না।
–আমি কিছুই করছি না। লোরেন তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জবাব দিলো।
লোরেন যেমন ভীরুর মতো কথাটা উচ্চারণ করলে, বান্ডলের কাছে সেটা অস্বাভাবিক ঠেকলো।
.
বান্ডল গেল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে
সবাই সব কথা বলে না, এটা একটা প্রবাদ বাক্য আছে। জিমি থেসিজার, বান্ডল ও লোরেনের মধ্যে কথাবার্তা হলো ঠিকই, কিন্তু তারা পরস্পরের কাছে কিছু কথা গোপন করে রেখেছে, এটা স্পষ্টতই বলা যেতে পারে।
জিমি থেসিজারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বান্ডল সোজা চলে গেল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সারে অফিসে।
সুপারিন্টেন্ডন্ট ব্যাটল বেশ ভারিক্কি চেহারার মানুষ। গোপন রাজনৈতিক কাজকর্ম দেখা তার প্রধান দায়িত্ব। এই ধরনের একটা তদন্তের কাজে জিমি চিমনিতে বছর চারেক আগে এসেছিলেন।
যখন বান্ডলকে সুপারিন্টেন্ডেটের ঘরে নিয়ে আসা হলো তখন তিনি জানলা দিয়ে বাইরে চড়াইপাখির খেলা লক্ষ্য করছিলেন।
-শুভ সন্ধ্যা, লেডি এইলিস। উনি জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে বললেন।
ধন্যবাদ।
বান্ডল কোনো ভূমিকা না করে কাজের কথায় এলো।
–স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে লন্ডন বা তার আশেপাশে যতগোপন ডেরা আছে তার একটা তালিকা আপনাদের কাছ থেকে শুনেছি। এদের মধ্যে অনেকগুলো বিপজ্জনক বলে মনে হয় না। আপনাদের?
এ ব্যাপারে একটা চমৎকার নিয়ম আছে। ব্যাটল বললেন। যারা যত বেশি কথা বলে, তারা তত কম বিপজ্জনক হয়ে থাকে।
–তাই আপনারা তাদের কাজে বাধা দেন না।
-ঠিক তাই। ওরা নিজেদের বুদ্ধির দূত বলে। সপ্তাহে যদি কোথাও গোপনে বসে রক্তের নদী নিয়ে কথাবার্তা বলে, তাহলে বাধা কোথায়। এতে আমাদের বা ওদের কারো ক্ষতি হয় না।
-কিন্তু কখনও কখনও এমনও তো হতে পারে যে, কোনো সমিতি যা তারা চায় তার চেয়েও বেশি মারাত্মক হয়ে উঠেছে? বান্ডল প্রশ্ন করলো।
হতে পারে।
-সুপারিন্টেভেট ব্যাটল, আপনি এমন একটা তালিকা আমাকে দিতে পারেন…যাদের সদর দপ্তর সেভেন ডায়ালস-এ আছে?
কথাটা শুনে ব্যাটল একটু চমকে উঠলেন। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, লেডি এইলিন, বর্তমানে ঐ নামে কোনো জায়গা নেই। জায়গাটা আগে বেশ খারাপ ছিল। বর্তমানে বেশ কিছু অংশ ভেঙে নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। জায়গাটা কখনোই কোনো সমিতির তীর্থক্ষেত্র নয়। তবে রোমান্টিক জায়গাও বলা যায় না।
–ওহ! বান্ডল কি বলবে বুঝতে পারলো না।
–আচ্ছা, এই জায়গাটার কথা আপনার মনে এলো কেন, বলতে পারেন?
বান্ডল একটু ইতস্ততঃ করে বলে ফেললোগতকাল একজন লোককে কেউ গুলি করেছিল। আমার ভয় হচ্ছিল লোকটি আমার গাড়িতে চাপা পড়েছে ভেবে।
–মিঃ রনি ডেভেরো কি?
–আপনি ব্যাপারটা জানেন, অথচ কাগজে কিছু ছাপা হয়নি।
–আমরা ঘটনাটা চব্বিশ ঘন্টা চেপে রাখতে চেয়েছিলাম। আগামীকাল সব কাগজেই এই ঘটনা প্রকাশিত হবে।
বান্ডল বললো, উনি মারা যাওয়ার আগে সেভেন ডায়ালস কথাটা বলেছিলেন।
মনে রাখবো।
বান্ডল এবার অন্য পথে এগোল।
–গতকাল আপনার কাছে একটা ভয় দেখানো চিঠি নিয়ে মিঃ লোম্যাক্স এসেছিলেন। চিঠিটা সেভেন ডায়ালস-এর লেখা।
হতে পারে।
বান্ডল ভাবলো, বৃথায় ওঁর সঙ্গে কথা বলছে, যেন একটা শক্ত কাঠ।
সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল বললেন, আপনাকে একটা কথা বলবো, লেডি এইলিন।
–আমি জানি, আপনি কি বলতে চান। আমি বাড়ি গিয়ে চুপ করে বসে থাকবো। আর এই ব্যাপারটা আপনাদের হাতে ছেড়ে দেবো। বান্ডল বললো, তবে মনে রাখবেন, আপনাদের মত পেশাদারী জ্ঞান বা দক্ষতা আমার নেই। কিন্তু আমি আড়ালে থেকে সব কিছু কাজ করতে পারি। সেটা ভালো করে জানবেন।
সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল যেন একটু মর্মাহত হলো।
–অবশ্য, বান্ডল বললো, আপনি যদি গোপন রহস্যময় সমিতিগুলোর ঠিকানা আমাকে না দেন।
–নিশ্চয়ই দেবো।
ব্যাটল চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজায় মুখ বাড়িয়ে কাউকে কিছু বলে আবার নিজের জায়গায় ফিরে এলেন। বান্ডলের কেমন সন্দেহ হলো, ব্যাটলের তৎপরতা লক্ষ্য করে।
একসময় একজন লোক একটা টাইপ করা কাগজ সুপারিন্টেন্ডন্ট ব্যাটলের হাতে দিয়ে গেল।
কাগজটি হাতে নিয়ে ব্যাটল বললেন, নামগুলো শুনুন, ব্লাড ব্রাদার্স অব সেবাস্তিয়ান। দি উলফ হাউন্ডস, দি কমরেডস্ অপ পিস, দি কমরেডস ক্লাব, দি ফ্রেন্ডস অব অপ্রশেন, দি চিলড্রেন অব মস্কো, দি রেড স্কটল্যান্ড বেয়ারার্স, দি হেরিংস, দি কমরেডস অফ দি ফলস, এমনই আরো অনেক।
বান্ডল চিন্তা করল, এই নামগুলো দিয়ে ওর কোনো কাজ হবে না। তাই তাকে ওগুলো দেওয়া হলো। তাই সে বললো–আপনি কি চান, সব ব্যাপারটা আপনাদের ওপর ছেড়ে দিই?
-হ্যাঁ, আমি সেটাই চাই।
বান্ডল উঠে দাঁড়ালো। এই শক্ত কাঠকে কিছুতেই গলানো গেল না। হঠাৎ তার একটা কথা মনে পড়লো। তুরুপের তাসের মতো কাজে লাগালেন।
সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল, আমি আপনার কাজে বাধা দিতে চাই না। কিন্তু আপনি জানেন, আমি সব কিছুতেই নির্দ্বিধায় ঝাঁপিয়ে পড়ি। চার পছর আগে চিমনির ব্যাপারটার জন্য আপনি আমাকে সাহায্য করতে দিয়েছিলেন, তাই বলছি, যদি কোনো আপেশাদারের পক্ষে কিছু করার থাকে তাহলে সেই দায়িত্ব আমাকে দিন।
সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল চুপ করে রইলেন খানিক্ষণ। তারপর বললেন, আপনার জন্য একটা ছোট্ট ইঙ্গিত দিচ্ছি। আপনি বলি এভারসলের সঙ্গে দেখা করুন। সেভেন ডায়াল-এর ব্যাপারে ও আপনাকে অনেক কথা বলতে পারবে। ওর কাছ থেকে জেনে নিন। আর এ নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।
.
বিলের সঙ্গে ডিনার
পরদিন সন্ধ্যায় কথামত বান্ডল এলো ডিনার খেতে। বিল ওকে দেখে খুশীতে উপচে পড়লো। সে তার খুশী নানারকম ভঙ্গী করে প্রকাশ করলো।
-বিল, তুমি কিছুদিন ধরে কি কাজ করছিলে? বান্ডল প্রশ্ন করলো।
–তোমাকে সেই কথাটাই বলার চেষ্টা করছিলাম। তোমার বুদ্ধি আছে যথেষ্ট। তাই তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতে চাই। জুটেছে এক ইয়াঙ্কি মেয়ে, নাম সেন্ট মাউর। ওর আসল নাম গোল্ড স্মিথ বা আব্রোসিয়ার।
বিলের বান্ধবীদের বায়নার ব্যাপারটা নানারকম। ওদের সংখ্যাও কম নয়। ওসব উড়িয়ে দিয়ে বান্ডল কাজের কথায় এলো, বললো–বিল, গতকাল আমি জিমি থেসিজারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ওর সঙ্গে তোমার দেখা হয়?
–আজই সকালে দেখা হয়েছে। বিল নিজের কথায় ফিরে এলো। জানো, বেবকে যেমন সুন্দরী দেখতে, তেমনি গুণের। অন্য মেয়েরা হিংসে করে ভীষণ।
ইচ্ছা না থাকলেও বান্ডলকে বিলের কথা শুনতে হলো।
–আচ্ছা বিল, জিমি কি আগামী সপ্তাহে অ্যাবীতে আমার কথা কিছু বলেছিলো?
এতক্ষণে বিল বান্ডলের কথায় কান দিলো।
-হ্যাঁ, কর্ডাসকে বলতে হবে সেই ধরনের অনেক কথা বলে গেল। কিন্তু ব্যাপারটা খুবই ঝুঁকির।
–ঐটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে। এবার বলল কারা কারা আসছে?
–সব সাধারণ মানুষ। তবে পার্লামেন্টের সদস্য মিসেস মাকাটা থাকছেন। আর থাকছেন সেই তরুণ হাঙ্গেরির বিমান পরিবহন মন্ত্রী স্যার স্ট্যানলি ডিগবি, ও তার সেক্রেটারি টেরেন্স ও’রুরকে। এছাড়া রয়েছেন হের এবারহোর্ড, একজন বিষাক্ত জার্মান ভদ্রলোককে বার দুই লাঞ্চে নিয়ে যাওয়ার হুকুম পেয়েছিলাম আমি। তবে তার সম্পর্কে নানারকম গুজব শোনা যায়। লোকটা সারাক্ষণ দাঁত দিয়ে নিজের আঙুলের নখ কাটে।
-ইস, কি নোংরা, বান্ডল বললো।
–আর হ্যাঁ, স্যার অসওয়াল্ড কুট থাকবেন। লেডি কুটও আসতে পারেন।
বান্ডলের এখন চিন্তা করার অবকাশ নেই। সময় নষ্ট করতে যে চায় না। তাই সরাসরি বিলকে প্রশ্ন করলো–বিল, সেভেন ডায়ালস-এর ব্যাপারটা কি? এ ব্যাপারে তুমি সব জানো।
বিল তার দৃষ্টি বান্ডলের দিক থেকে সরিয়ে নিলো।
বান্ডল বুঝলো, ও এড়িয়ে যেতে চায়। তাই বললো, এত গোপনীয়তার কি আছে, বুঝি না।
-গোপনীয়তার কিছু নেই। মাঝে লোকের হুজুগ উঠেছিল তাই যেতো। বেশি দিন ভালোও লাগতো না।
–জায়গাটা কি?
বিল এবার ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল–তার মানে? তুমি তো সেভেন ডায়ালস-এর সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিলে, তার কথাই বললাম।
-ওর যে ঐ নাম জানতাম না।
—-ওটা একটা নোংরা জায়গা, টটেনহ্যাম কোর্ট রোডের দিকে। পুরানো সবকিছু ভেঙে বর্তমানে নতুন করে সবকিছু বানানো হয়েছে। তবে সেভেন ডায়ালস ক্লাবটার কোনো পরিবর্তন হয়নি। মাছ আর আলু ভাজা পাওয়া যায়। তবে কোনো অনুষ্ঠান দেখে আসার পর বেশ প্রতিক্রিয়া হয়। নানারকমের লোক আসে। বিভিন্ন রকম মজার আলোচনা হয়। সস্তায় সময় কাটাবার বেশ উপযুক্ত জায়গা।
-বাঃ বেশ ভালোই। বান্ডল বললো, তাহলে আমরা আজ রাতে ওখানেই যাবো।
-না না, ওখানে যাওয়া চলবে না, বিল অসহায় ভাবে কথাটা বললো। আগেই তো বলেছি, আজকাল ওখানে কেউ যায় না।
কেউ যাক বা না যাক, আমাকে তুমি আজ রাতে ওখানে নিয়ে যাবে। কথাটা মনে রেখো, বান্ডল জেদ ধরলো, নিশ্চয়ই কোন গপন রহস্য আছে, তাই আমাকে নিয়ে যেতে তোমার আপত্তি?
– গোপন রহস্য? ওসব কিছু নয়। বিল বলতে থাকলো, মানে, একদিন রাতে বেব সেন্ট মাউরকে নিয়ে আমি ওখানে গিয়েছিলাম।
-তারপর? বান্ডল উদগ্রীব হয়ে উঠলো।
-বেব গলদা চিংড়ি খাওয়ার বায়না ধরলো। একটা গলদা চিংড়ি লুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। টানাটানিতে সেটা বেরিয়ে পড়লো।
গলদা চিংড়ির গল্প আর শেষ হয় না। অধৈর্য হয়ে বান্ডল বললো, ওসব গলদা চিংড়ির কথা বাদ দাও। তুমি জেনে রাখো, আজ আমরা ওখানে যাচ্ছি-ই।
বিল বার বার আপত্তি জানিয়ে বান্ডলের একগুঁয়েমির কাছে হার স্বীকার করলো।
জায়গাটা দেখে বান্ডল চমকে উঠলো, অবিকল তার ভাবনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে সব। ১৪ নং হ্যাঁন্স্যামটন স্ট্রিটের একটি উঁচু বাড়ি। বাড়ির নম্বর বান্ডল লিখে রাখলো।
একটা অপরিচিত লোক দরজা খুলে দিল। বান্ডলকে দেখে সে একটু চমকে উঠলো। সঙ্গে বিলকে লক্ষ্য করে একটু ধাতস্থ হলো। লোকটার লম্বা চেহারা, গায়র রঙ ফর্সা, চঞ্চল দুটি চোখ। কোথায় যেন বান্ডল এই লোকটাকে দেখেছে।
ধোঁয়ায় ভর্তি একটা ঘরে ওরা নাচতে শুরু করলো। ধোঁয়ার জন্য ঘরটা নীলচে দেখাচ্ছিল। কিছু বিদেশী ইহুদী এছাড়া নানাধরনের মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অনেক মহিলাও ছিল, যাদের মধ্যে অনেকে প্রাচীন জীবিকা নির্বাহ করে।
বিল দোতলার যে ঘরে জুয়া খেলা হচ্ছিল সেখানে বান্ডলকে নিয়ে গেল, সেখানেও ঐ লোকটিকে দেখে আচমকা ওর স্মরণে এলো তার পরিচয়।
–আরে এ তো চিমনিতে কিছুদিনের জন্য ফুটম্যানের কাজ করেছিল। অ্যালফ্রেড, ভালো আছো তো? বান্ডল প্রশ্ন করলো।
-হ্যাঁ, ভালো আছি, মাদমোয়াজেল।
–তুমি চিমনির চাকরি কবে ছাড়লে?
একমাস আগে। এটা ভালো চাকরি। খুব ভালো মাইনে পাই।
ঘরে পা দিয়েই বান্ডল বুঝতে পারলো ক্লাবটির আসল বৈশিষ্ট্য। টেবিলের চারপাশে যারা জড়ো হয়েছিল তারা প্রত্যেকে জাত জুয়াড়ি নিঃসন্দেহে।
বিল প্রায় অধঘন্টা পর অধৈর্য হয়ে বান্ডলকে নিয়ে নিয়ে নেমে এলো। মাছ ভাজা, আলু ভাজা খাওয়া হলো।– তারপর ওরা বাড়ির দিকে রওনা হলো।
.
.
চিমনিতে খোঁজখবর
বান্ডলের মেজাজ ও চরিত্র ওর বাবার ঠিক উল্টো। ওর বাবা ঠান্ডা ধরনের অলস প্রকৃতির মানুষ। বান্ডল মনে মনে তিনটে মতলব তৈরি করেছিল। একদিনেই সেগুলো করতে হবে।
ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা বান্ডলের বরাবরের অভ্যাস। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে প্রাতঃরাশ সেরে সে হিসপানোয় চড়ে চিমনির দিকে রওনা হলো।
–যাক, তুই এসে আমাকে বাঁচালি। ওর বাবা ওকে দেখে খুব খুশী। টেলিফোন করতে আমার ভীষণ বিরক্তি জানিস তো। গতকাল কর্নেল মেলরোজ ইনকোয়েস্টের জন্য এসেছিলেন। আগামীকাল বেলা বারোটায় রনি ডেভেয়োর ইনকোয়েস্ট হবে। মৃতদেহ যেহেতু তুই আবিষ্কার করেছিস, অতএব সনাক্ত করার দায়িত্ব তোর। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মেলরোজ তোকে নিতে আসবে।
-বারোটা। বান্ডল বললো, ঠিক আছে তৈরি থাকবো।
–আর একটা কথা। জর্জ লোম্যাক্স আগামী সপ্তাহে প্যারীতে যাওয়ার কথা বলেছিল। আমি ওটা নাকচ করে দিয়েছি।
-ভালো করেছে। কোনো উদ্ভট ব্যাপারে না জড়ানোই ভালো।
-কেন সেরকম কিছু ঘটার আশঙ্কা আছে নাকি? আচমকা লর্ড কেটারহ্যাম আগ্রহ প্রকাশ করলেন?
-না, তুমি তো কি যেন ভয় দেখানো চিঠির কথা বলছিলে।
— বোধ হয় জর্জ খুন হতে চলেছে। বান্ডল, আমার কি যাওয়া উচিত?
-তুমি বরং বাড়িতে চুপ করে বসে থাকো। আমি মিসেস হাওয়েলের সঙ্গে কথা বলবো। বান্ডল বললো।
চিমনির আসল গৃহকত্রী হলেন মিসেস হাওয়েল। বান্ডল যখন ফ্রক পরে খেলা করতো তখন থেকে তিনি এখানে আছেন।
বেশ অনায়াসে বান্ডল তার প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেল মিসেস হাওয়েলের কাছ থেকে। বাড়ির চাকর-বাকরদের সম্পর্কে বান্ডল যা জানতে পারলো, তাতে ওদের সন্দেহ করার কিছু নেই। তবে লেডি কুটকে যে বেগ দিয়েছিল মিসেস হাওয়েল তা তার কথা শুনে বোঝা গেল।
-স্যার অসওয়াল্ড কুটকে আমি কখনও দেখিনি। বান্ডল বললো।
-খুব চালাক ভদ্রলোক। অবশ্য সমস্ত কাজ দেখাশোনা করতেন মিঃ বেটম্যান। কোন কাজ কেমন ভাবে করা উচিত সে বিষয়ে তিনি দক্ষ ছিলেন।
বান্ডল এবার কৌশলে জেরি ওয়েডের মৃত্যুর প্রসঙ্গ টেনে আনলো।কিন্তু মিসেস হাওয়েলের কাছ থেকে নতুন কিছু আবিষ্কার করা গেল না। বান্ডল নিচে নেমে এসে ট্রেডওয়েলকে ডেকে পাঠালো।
–ট্রেডওয়েল, আর্থার কেন এবং কবে চলে গিয়েছিলো, বলতে পারো।
–ও একমাস আগে নিজের ইচ্ছাতেই চলে গেছে, মাই লেডি। মনে হয় ও লন্ডনে গেছে। তবে নতুন যে এসেছে, জন সে-ও ভালো কাজ করে।
-ও কোথা থেকে এসেছে?
–আগে জন লর্ড মাউন্ট ভারননের কাছে কাজ করতো।
–ওর পদবী কি?
–বাওয়ার, মাই লেডি।
–বান্ডল চিন্তার মধ্যে ডুবে গেল। সেই অবসবে ট্রেডওয়েল ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
একটু পরেই জন ঘরে এসে ঢুকলো। বান্ডল তাকে লক্ষ্য করলো। একজন পাকা চাকর বলে মনে হয়, হাবভাব একজন দক্ষ সৈনিকের মত। কিন্তু ওর পেছন মাথার দিকটা কেমন যেন অদ্ভুত।
বান্ডল একমনে একটা ব্লটিং পেপারে বাওয়ার নামের বানান লিখে চললো।
হঠাৎ ওর দৃষ্টি ব্লটিং-এর এক জায়গায় আটকে গেল। ডেকে পাঠালো ট্রেডওয়েলকে।
–ট্রেডওয়েল বাওয়ার বানানটা কি রকম? –বি.এ.ইউ.ই.আর, মাই লেডি। এটি সম্ভবতঃ সুইশ নাম। ট্রেডওয়েলকে বিদায় দিয়ে সে আবার ভাবতে লাগলো, এটা জার্মান নাম ছাড়া অন্য কিছু নয়। মাথাটা ঐরকম। তাছাড়া জেরি ওয়েড মারা যাওয়ার পনেরো দিন আগে ও চিমনিতে এসেছিল।
বান্ডল বাবার কাছে ফিরে এলো।
-বাবা, আমি মার্সিয়া কাকিমার কাছে যাবো।
–এমন মতলব মাথায় এলো কেন তোর? লর্ড কেটারহ্যাম মেয়ের দিকে আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকালেন।
মর্সিয়া অর্থাৎ মার্সিওনেস হলেন তার ভাই হেনরির বিধবা স্ত্রী। একসময় এই মহিলার নামডাক ছিল। পররাষ্ট্র দপ্তরের সেক্রেটারিরপদ তার ভাই পেয়েছিল। ওর স্ত্রীর গুণে এটা নিশ্চিত। আবার এদিকে লর্ড কেটারহ্যাম ভাবেন, অমন চোরের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে তার ভাই অকালে মৃত্যু হয়ে শান্তি লাভ করেছে। মহিলাটি অত্যন্ত সন্দেহজনক। কেনসিংহের গুহায় বান্ডল বোকার মতো মাথা গলাতে যাচ্ছে, বুঝে পেলেন না লর্ড কেটারহ্যাম।
-বাবা, তোমাকে আবার বিরক্ত করছি, বান্ডল বললো, স্যার অসওয়াল্ড কি ভাবে ধনী হলেন?
ইংল্যান্ডে যে ইস্পাতের কারখানা আছে সেটা ওর। বর্তমানে লিমিটেড কোম্পানী হয়ে গেছে। তার একটার ডিরেক্টার ওর অনুরোধে আমি হয়েছি। কাজকর্ম কিছু থাকে না। বছরে কেবল দু একবার ক্যাসন স্ট্রিটে বা লিভারপুল স্ট্রিটের বড় হোটেলে খাওয়াদাওয়া ছাড়া।
এসব শোনার আর প্রয়োজন নেই বান্ডলের। সে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
শিশু পরিচর্যা আর ইস্পাতের সঙ্গে খাপ খায় না। অর্থাৎ মিসেস মার্কাটার সঙ্গে স্যার অসওয়াল্ডকে মেলানো যায় না। হাঙ্গেরির কাউন্টেসকে বাদ দেওয়া যায় বোধহয়। হের এবারহোর্ড হল আসল। তিনি এমন কোন কেউকেটা নন যে জর্জ লোম্যাক্স তাকে আমন্ত্রণ জানাবেন। ইস্পাত সম্রাট স্যার অসওয়াল্ড তো আছেনই
এরকম আকাশ-পাতাল ভেবে কিছু থৈ পাওয়া যাবে না ভেবে বান্ডল তার কাকিমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলো।
বিশাল চেহারা লেডি কেটারহ্যামের। লন্ডনের উচ্চবিত্ত এলাকায় একটি মস্ত বড় গোমড়ামুখো বাড়িতে তিনি থাকেন।
বাড়িতে ঢুকতেই বান্ডলের নাকে ভেসে এলো মোমবাতি, পাখির দানা আর শুকনো ফুলের গন্ধ।
বান্ডলকে দেখে লেডি কেটারহ্যাম অবাক হলেন একটু।
-এইলিন, তুমি হঠাৎ দারুণ আনন্দের ব্যাপার। ঠান্ডা কণ্ঠস্বর লেডি কেটারহ্যামের।
–আমরা সবে ফিরেছি, কাকিমা। বাবা চিমনিতে এখন রয়েছেন।
–চিমনি ভাড়া দেওয়া আমরা কোনো কারণেই পছন্দ নয়। কত ঐতিহাসিক চিহ্ন আছে ঐ বাড়িতে। একে সস্তা করে দেওয়া উচিত নয়।
-বাবার রাজনীতি ভালো লাগে না। কিন্তু রাজনীতির মধ্যে কত ভালো ভালো ব্যাপার আছে সেটা জানতে পারলে আরো কত সুন্দর হয়।
বান্ডল আহ্লাদে আটখানা হয়ে মিথ্যে বলে গেল কায়দা করে। লেডি কেটারহ্যাম অবাক চোখে তাকালেন।
-তোমার ভাবনার ধরন দেখে খুব অবাক লাগছে। মনে হয় তোমার ভালো ঘরে বিয়ে হলে তুমি একসময় রাজনীতিতে বেশ চমৎকার জায়গা করে নিতে পারবে।
-ধন্যবাদ কাকিমা। বান্ডল এবার তার দিক পরিবর্তন করলো, ভাবছিলাম, তুমি মিসেস মার্কাটকে চেনো কিনা।
খুব চিনি। দারুণ বুদ্ধিমতী মহিলা। তবে, সাধারণতভাবে মেয়েরা পার্লামেন্টে দাঁড়াক এটা আমার পছন্দ নয়। লেডি কেটারহ্যাম বলে চললেন, অবশ্য তিনি যে কাজ করেন, তার দাম এখন খুব। ভদ্রমহিলার সঙ্গে তোমার পরিচয় হওয়া দরকার।
বান্ডল ছদ্ম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, জর্জ লোম্যাক্সের বাড়ির এক পার্টিতে উনি যাচ্ছেন, আমি জানি বাবাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন, কিন্তু যাবেন না, অবশ্য আমাকে নেমন্তন্ন করেননি। উনি মনে কবেন আমি একটা গবেট।
ভাসুরঝির এত উন্নতি দেখে লেডি কেটারহ্যাম খুশী হলেন।
–তুমি চিন্তা করো না এইলিন, তুমি যে বড়ো হয়েছে, এটা জর্জ লোম্যাক্স ভাবতেই পারছে না। আমি জর্জকে দিয়ে একাজ করাবোই। রাজনীতিতে অল্পবয়েসী মেয়েদের প্রয়োজন আছে, ওটা ও বুঝবে। দেশের স্বার্থে এটা দরকার।
লেডি কেটারহ্যামের পছন্দ করা কিছু বইপত্র নিয়ে বান্ডল ব্রুক স্ট্রিটের দিকে রওনা হলো।
জিমি থেসিজারকে ফোন করলো। রাজনীতি গুলে খাওয়া মার্সিয়া কাকিমার কথা বান্ডল জানালো। পড়ার জন্য অনেক বই দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা জর্জের পার্টিতে নেমন্তন্ন করাচ্ছেন।
জিমি জানালো, সে বিলকে শেষপর্যন্ত বোঝাতে পেরেছে। একগাদা কাগজপত্র দিয়েছে পড়ার জন্য। একেবারে নীরস ব্যাপার। সান্টা ফে সীমান্ত বিরোধ কেউ কোনো কালে শুনেছে নাকি সন্দেহ।
লোরেনকে এসব না বলাই ভালো। জিমি বললো, এরকম মেয়েকে বিপদের মুখে ফেলা ঠিক নয়।
–বোধ হয়।
–কাল ইনকোয়েস্টে যাচ্ছেন তো?
–হ্যাঁ, আপনি?
–আমিও যাবো। আজই সন্ধ্যার কাগজে এককোণে খবরটা ছাপা হয়েছে। খুব হৈ চৈ পড়ে গেছে।
-এবার পড়ায় মন দেবো, আপনি?
–আমিও তাই। শুভরাত্রি।
দুজনেই মিথ্যেবাদী নিঃসন্দেহে। লোরেন ওয়েডকে নিয়ে জিমি এখনই নৈশভোজে যাবে, সেটা সে ভালো ভাবে জানে। ওদিকে বান্ডল একজন সাধারণ পরিচারিকার পোশাক পরে সোজা রাস্তায় এলো। সেভেন ডায়ালস-এ যেতে বাসে না টিউবে গেলে সুবিধা হবে সেটাই ভাবছিল।
.
দি সেভেন ডায়ালস ক্লাব
১৪ নং হ্যান্সস্ট্রামট স্ট্রিটে যখন বান্ডল পৌঁছলো তখন সন্ধ্যে ৬টা। ওর উদ্দেশ্য ছিল ফুটম্যান আলফ্রেডের সঙ্গে দেখা করা। যদি তা সম্ভব হয় তাহলে বাকি কাজটা সহজ হয়ে যাবে। বেশি লোকের মুখোমুখি হতে ও চায় না।
মেঘ না চাইতেই জল।
দরজা খুলে সামনে দাঁড়ালো অ্যালফ্রেড।
বান্ডল মিষ্টি হেসে বললো-শুভসন্ধ্যা, অ্যালফ্রেড।
অ্যালফ্রেড প্রথমে চমকে উঠলো। তারপর নিজের ভুল বুঝতে পেরে বললো, শুভসন্ধ্যা, মাদমোয়াজেল। আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারিনি।
বান্ডল নিজের মনে মনে ঐ পোশাকের জন্য তারিফ করলো।
–অ্যালফ্রেড, তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। কোথায় গেলে ভালো হয়? ক্লাবে এখন কারা আছে?
-এখন কেউই নেই লেডি।
অ্যালফ্রেড চাবি বের করে দরজা খুললো। বান্ডল ভেতরে ঢুকলো। অ্যালফ্রেড গোবেচারীর মত তার পেছন পেছন এলো।
অ্যালফ্রেড, তুমি নিশ্চয়ই জানো, এখানে যা হয় সব বেআইনী।
অ্যালফ্রেড ভীত পায়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
–এর আগে দুবার পুলিস এসেও আপত্তিকর কিছু পায়নি। কারণ মিঃ মসগোরোভস্কির চালাকি ছিল। এখানে কেবল জুয়া খেলা হয় না। অনেক কিছুই হয়, যা তোমার হয়তো জানা নেই। আমি তোমার থেকে জানতে চাই যে চিমনির চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য তুমি কত টাকা পেয়েছিলে? বান্ডল স্পষ্ট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
অ্যালফ্রেড চুপ করে শুনছিল। সাহস সঞ্চয় করছিল মনে হয়। কয়েকবার ঢোক গিললো।
–বলছি, মাই লেডি, যেদিন অনুষ্ঠান ছিল মিঃ মসগোরাভস্কি সেদিন কিছু লোক নিয়ে চিমনিতে এসেছিলেন। মিঃ ট্রেডওয়েলের পায়ে সেদিন পেরেক ফুটে যন্ত্রণা হচ্ছিল বলে আমাকে সব দেখাশোনা করতে হয়েছিলো। মিঃ মসগোরোভস্কি বিশ্রাম করার অজুহাতে আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে থাকেন। তিনি আমাকে একশো পাউন্ড হাতের মধ্যে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, এই মুহূর্তে যেন চিমনি ছেড়ে চলে যাই এবং তার ক্লাবের দায়িত্ব নিই। ঈশ্বরের আশীর্বাদ মনে করে আমি মেনে নিলাম। বর্তমান মাইনে তিনগুণ টাকা। কথাটা মিঃ ট্রেডওয়েলকে বলতেই সব ঠিক হয়ে গেল।
বান্ডলের সন্দেহের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, সে মাথা নুইয়ে সায় দিলো।
–মিঃ মসগোরোভস্কি কে?
–এই ক্লাবটা চালান। রাশিয়ান। খুব বুদ্ধিমান লোক।
–এর মধ্যে কোনো রহস্য আছে বলে তোমার মনে কোন সন্দেহ হয়নি?
–রহস্য, মাই লেডি?
–অ্যালফ্রেড, জেল খাটতে রাজী নও নিশ্চয়ই।
–হায় ঈশ্বর, আপনি সেরকম কিছু ভাবছেন না তো?
বান্ডল গম্ভীর ভাবে বললো–গত পরশু স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে গিয়েছিলাম। কিছু অদ্ভুত কথা শুনলাম। তোমার সাহায্য আমার প্রয়োজন। যদি সাহায্য করো, তাহলে তার বিনিময়ে তুমি পাবে নিরাপত্তা।
অ্যালফ্রেড রাজী হতেই বান্ডল প্রথমে সারা বাড়ি ঘুরে দেখতে লাগলো। তারপর এসে পৌঁছলো জুয়াখেলার ঘরে। চোখে পড়ে না, এমন একটা দরজা বান্ডলের দৃষ্টি এড়াতে পারলো না। তালা দিয়ে দরজাটি বন্ধ।
দরজাটা সম্পর্কে অ্যালফ্রেড বলতে শুরু করলো,-পুলিসের ঝামেলা এড়ানোর জন্য অনেকটা দেয়াল আলমারীর মতই এই দরজা করা হয়েছে। দরজার ওপাশে একখানা ঘর আর সিঁড়ি আছে। পাশে রাস্তা। পুলিস হামলা করলে লোকেরা ঐ পথ দিয়ে পালায়।
–আমি ভেতরে ঢুকবোই। বান্ডল উত্তেজনা অনুভব করলো।
–আপনার পক্ষে সম্ভব নয়, মাই লেডি। চাবি রয়েছে মিঃ মসগোরোভস্কির কাছে। বান্ডল বুঝেছিল, তালাটা অত্যন্ত সাধারণ। অন্য চাবি দিয়েও খোলা যায়। বান্ডলের চাপে পরে আলফ্রেড খুঁজে নিয়ে এলো। কয়েকবারের চেষ্টার ফলে তালা খুলে গেল।
ঘরের মধ্যে বান্ডল ঢুকলো। মাঝখানে একটা টেবিল, কয়েকখানা চেয়ার চারপাশে। ফায়ার প্লেসের দুপাশে দুটো গা-আলমারি। বিশেষ ধরনের তালা লাগানো আছে। অতএব চেষ্টা করা বৃথা।
অ্যালফ্রেড বুঝিয়ে দিলো, সাধারণ তাক বলে মনে হয়, কখানা লেজার রয়েছে। কিন্তু ঠিক বোতামটা টিপলেই ওটা খুলে যাবে।
ঘরের চারপাশে ও চিন্তিত মুখে দেখতে লাগলো। শব্দ নিরোধক ঘর। সাতখানা চেয়ার সাজানো। টেবিলের দুপাশে তিনটে করে আর টেবিলের মাথায় একটি।
বান্ডলের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। এটাই সেই গোপন সমিতির জায়গা, ও নিশ্চিত। আপাতদৃষ্টিতে কিছু বোঝার উপায় নেই।
–অ্যালফ্রেড, বান্ডল বললো, আমার লুকিয়ে থাকার মত একটা জায়গা তোমার ব্যবস্থা করতে হবে।
অ্যালফ্রেড মাথা নেড়ে বললো, এ অসম্ভব, মাই লেডি। আমার চাকরি তাহলে বাঁচাতে পিরবো না।
যখন তুমি জেলে ঢুকবে, তখন এমনিতেই চাকরি যাবে। তুমি চিন্তা করো না, কেউ কোনো কিছু জানতে পারবে না।
বান্ডলকে এখন অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় পেয়ে বসেছে।
বান্ডল ঝুঁকি নেবেই। সে খুব ভালো ভাবে ঘরের চারদিকে আবার তাকালো। এগিয়ে গেল দ্বিতীয় আলমারির কাছে। তালা লাগানো ছিল। বান্ডল পাল্লা খুলতেই একরাশ বাসন বেরিয়ে এলো। তাকগুলো খালি করার ইচ্ছাতে সে বললো–অ্যালফ্রেড, সময় খুব কম, তুমি একটা ট্রে নিয়ে এসে বাসনগুলো নিচে নিয়ে যাও। দাঁড়িয়ে তর্ক করলে বিপদে পড়ে যাবে।
অগত্যা অ্যালফ্রেড বাধ্য ছেলের মত বান্ডলের আদর্শে অনুযায়ী কাজ করলো।
তাকগুলো খুলে ফেলা যায়। বান্ডল দ্রুত হাতে তাকগুলো খুলে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজে ভেতরে ঢুকে গেল।
–হু, বড় ছোট, ভেতরে কাঠ হয়ে থাকতে হবে। অ্যালফ্রেড, এবার একটা তুরপুনের ব্যবস্থা করো। যদি এখানে না পাও তাহলে কিনে আনতে হবে।
অ্যালফ্রেড দ্রুত চলে গিয়ে আবার ফিরে এলো কতগুলো যন্ত্র নিয়ে। ঐসব যন্ত্রের মধ্যে থেকে একটা বাছাই করে নিয়ে নিজের চোখ বরাবর কাঠের পাল্লায় একটা ফুটো করলো। ফুটোতে চোখ লাগিয়ে বান্ডল বললো, এতেই কাজ হবে। আমি ভেতরে ঢুকছি, তুমি তালা লাগিয়ে চাবি নিয়ে চলে যাও।
-যদি মিঃ মসগোরোভস্কি চাবি চান?
–কেউই চাবির জন্য মাথা ঘামাবে না। আর যদি চায় বলবে হারিয়ে গেছে। আর শোন, একটু চকোলেট এনে দাও। ওতেই কাজ হবে। সবাই চলে গেলে খুলে দিয়ো। আর একটা কথা মনে রেখো, বেশি করতে যেয়ো না, কোনো গোলমাল হলে তোমার কিন্তু রেহাই নেই।
অ্যালফ্রেড চকোলেট রেখে দিয়ে তালা লাগিয়ে চাবি নিয়ে চলে গেল।
৩. সেভেন ডায়ালস-এর অধিবেশন
ভেতরে ঢুকে বান্ডল ভাবছে, হয়তো, এখান থেকে বেরোতে ছটা বেজে যাবে। খুব কষ্ট হবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু কিছু করার নেই। হঠাৎ দরজার তালা খুলে গেল।
বৈদ্যুতিক আলোতে ঘর ভরে গেল। অনেক লোক যে ঘরে ঢুকেছে সেটা বান্ডল বুঝতে পারলো। দরজায় খিল দেওয়ার আওয়াজ শুনতে পেলো।
একজন লম্বা, শক্তিশালী, কালো দাড়িওয়ালা মানুষকে বান্ডল ফুটো দিয়ে দেখলো যাকে গতরাতে জুয়ার টেবিলে দেখেছিল।
এই তাহলে সেই মিঃ মসগোরোভস্কি, ক্লাবের মালিক। উত্তেজনায় বান্ডলের হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল।
লোকটি পকেট থেকে ঘড়ি বের করে সময় দেখলেন। মাথা দুলিয়ে পকেট থেকে আবার কি বের করলেন। তারপরের ব্যাপারটা বান্ডলের দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে না।
পরক্ষণে লোকটি যখন দৃষ্টি বরাবর এলো তখন বান্ডল চমকে উঠলো, লোকটার মুখে একটা মুখোস। আলগা হয়ে চোখের ওপর পরদার মতো ঝুলছিল। অনেকটা ঘড়ির ডায়ালের মত মুখোসটা। ছটার দিকে ঘড়ির কাটা রয়েছে।
–সেভেন ডায়ালস! বান্ডল এবার নিশ্চিত।
দরজায় সাতবার টোকা মারার শব্দ।
বান্ডল যে আলমারির মধ্যে বসে ছিল তার পাশের চেয়ারে মসগোরাভস্কি বসলেন।
ঘরে এসে ঢুকলো দুজন, তাদরে প্রত্যেকের মুখে মুখোস, মুখোসে ঘড়ির কাঁটা চারটে আর পাঁচটায়। তাদের পোশাক ভদ্র অভিজাত সম্পন্ন।
এদের মধ্যে একজন বিদেশী। অন্যজনকে বান্ডল ফরাসি ভেবেছিল। কিন্তু কথা শুনে বুঝলো, অস্ট্রিয়ান বা হাঙ্গেরিয় হতে পারে। রাশিয়ান হবে হয়তো।
–এক নম্বর দারুণ সফল হওয়ায় আপনাকে ঝুঁকি নেবার জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি। ভদ্রলোক বললেন।
পাঁচটা কাঁধ ঝাঁকালেন।
ঝুঁকি না নিলে…
কথা শেষ হলো না। দরজায় আবার সাতটা টোকা পড়লো।
বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথা শুনতে পেলো না বান্ডল। কারণ ওরা ওর দৃষ্টির বাইরে চলে গিয়েছিল।
–আমরা তাহলে কাজ শুরু করতে পারি। রুশ ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
টেবিলের মাথায় যে চারটি ছিল সেখানে গিয়ে বসলেন। ফলে বান্ডলের একেবারে মুখোমুখি হলেন তিনি। তার পাশে বসে পাঁচ নম্বর। তৃতীয় চেয়ারটি বান্ডল দেখতে পাচ্ছে না। চার নম্বর আমেরিকান ভদ্রলোক।
টেবিলের ধারে দুটি চেয়ারই বান্ডলের নজরে পড়ছিল।
মসগোরোভস্কির উল্টোদিকের চেয়ারে বসলেন একজন, যার পেছনটা বান্ডলের দিকে। বান্ডল তার পেছনটাই ভালো করে দেখছিল। কারণ তিনি একজন মহিলা।
–আমরা আজ রাতে পাঁচ নম্বরের দেখা পাবো না। মহিলার সুরেলা বিদেশী ছোঁয়া লাগানো কথা শোনা গেল। আপনারা সত্যি করে বলুন তো কোনো কালে আদৌ ওর দেখা পাবো আমরা?
–চমৎকার প্রশ্ন। আমেরিকানটি বললো, বান্ডল সম্মোহিতের মতো মহিলার পিঠের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রাখলো। ডানদিকের ঘাড়ের পাশে ছোট্ট একটা আঁচিল, ফর্সা চামড়ায় ওটা ঠিক মানাচ্ছে না।
রুশ ভদ্রলোকের কর্তৃত্বব্যাঞ্জক কণ্ঠস্বর শুনে বান্ডলের চমক ভাঙলো।
–যদি দুই নম্বর আমাদের আজ থাকতেন। কিন্তু কিছু ঘটনা ঘটে গেছে আর অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছে।
–বিপদ ঘটার সম্ভবনা আছে। পাঁচ নম্বর বললো।
–হ্যাঁ, আমাদের এই জায়গা সম্পর্কে খুব বেশি জানাজানি হয়ে গেছে।
–তাহলে চিমনি সম্পর্কে নতুন কিছু জানা যায়নি?
–না, মসগোরোভস্কি উত্তর দিলেন।
–আমাদের প্রেসিডেন্ট কোথায় সাত নম্বর? কখনো আমরা ওর দেখা পাই না কেন?
–ওর নিজস্ব কর্মপদ্ধতি আছে। রুশ উত্তর দিলেন।
–আপনি আগাগোড়া ঐ কথাই বলে আসছেন।
কিছুক্ষণের জন্য থমথমে নীরবতার মধ্যে কাটলো।
-এবার আমরা কাজ শুরু করবো। মসগোরাভস্কি বলে উঠলো। তিন নম্বর, আপনি কি ওয়াইভেন অ্যাবীর নকসা পেয়েছেন?
তিন নম্বরকে বান্ডল না দেখলেও গলার স্বরে বুঝতে পারল, একজন শিক্ষিত ইংরেজের গলা। মিষ্টি ও নরম।
টেবিলের ওপর কিছু রাখার আওয়াজ হলো।
–এই যে সেই নক্সা, আর এটা অতিথিদের তালিকা।
রুশ ভদ্রলোক পড়তে লাগলেন।
-স্যার স্ট্যানলি ডিগবি, মিঃ টেরেন্স ও’রুরকে, স্যার অসওয়াল্ড, লেডি কুট, মিঃ বেটম্যান, কাউন্টেস অ্যানা র্যাজকি, মিসেস মার্কাটা, মিঃ জেমস থেসিজার। পড়া থামিয়ে বললেন, এটি আবার কে?
-ওটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ও আজম্মের গাধা একটা। আমেরিকান ভদ্রলোক হেসে বললেন।
-হের এবারহোর্ড আর মিঃ বিল এভারসলে।
–তাহলে ধরে নিতে পারি এবারহোর্ডের আবিষ্কারের ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ নেই?
–না নেই।
–দামের দিক থেকে এর মূল্য লক্ষ লক্ষ টাকা। বিভিন্ন দেশের লোভের মাত্রা কতখানি সেটা আন্তাতিক দিক থেকে বুঝতে পারছেন।
একটু থেমে আবার বললেন–হ্যাঁ, এটা হলো সোনার খনি। যাইহোক, আপনারা নকসাটা পেয়েছেন। আমার মনে হয় না, আমাদের আগের পরিকল্পনা আরো ভালো করা সম্ভব। একটা কথা, জেরি ওয়েডের লেখা একটি চিঠির কথা শুনলাম, যাতে এই সমিতির নাম উল্লেখ আছে। চিঠিটা কে পেয়েছে?
-লর্ড কেটারহ্যামের মেয়ে, লেডি এইলিন ব্রেন্ট।
–বাওয়ারের কাজে গাফিলতি দেওয়ার ফল। চিঠি কাকে লেখা?
–সম্ভবতঃ ওর বোনকে, তিন নম্বর জবাব দিলো।
–তবে আর কিছুই করার নেই। আগামীকাল রোনাল্ড ডেভেয়োর ইনকোয়েস্ট। সব ব্যবস্থা করা আছে নিশ্চয়ই।
স্থানীয় ছেলেদের রাইফেল ছুঁড়ে অনুশীলন করার কাহিনী চারদিকে রটানো আছে। আমেরিকান উত্তর দিল।
–আর কিছু বলার নেই আমার। এক নম্বর যে ভাবে একাজে অংশ নিয়েছেন, আমার মনে হয় সকলে তাকে অভিনন্দন জানানো উচিত।
সমস্ত হাত অদ্ভুত ভঙ্গীতে চেয়ারের কাছে এগিয়ে এলো। বিদেশী কায়দায় এক নম্বর তা স্বীকার করলেন।
এবার বান্ডল তিন নম্বরকে দেখতে পেলো, বিরাট চেহারার দীর্ঘকায় এক পুরুষ।
সবাই এক এক করে বেরিয়ে যেতে মসগোরোভস্কি দরজায় তালা দিলেন। কয়েকমুহূর্ত অপেক্ষা করার পর আলো নিভিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
সভা শেষ হওয়ার প্রায় দুঘন্টা পর অ্যালফ্রেড এলো। আলমারির দরজা খুলতেই বান্ডলের শরীরটা তার দিকে ঝুঁকে পড়লো।
–শরীর কাঠ হয়ে গেছে। বান্ডল বললো, একটু বসিয়ে দাও।
হাত-পা মালিশ করতে করতে বান্ডল বললো, খুব মজার মানুষ ওরা। অ্যালফ্রেড, শিক্ষার বোধহয় শেষ নেই।
.
ইনকোয়েস্ট
ভোর ছটায় বাড়ি পৌঁছে সাড়ে নটার মধ্যে তৈরি হয়ে নিলো বান্ডল। তারপর জেমি থেসিজারকে ফোন করলো।
ফোনে জিমি দ্রুত কথা বলতে চাইলো। ইনিকোয়েস্টে যাবে বলে তাড়া আছে।
–আমিও যাচ্ছি। বান্ডল বললো, অনেক কথা তোমাকে বলার আছে।
–তাহলে তোমাকে আমি গাড়িতে নিয়ে যাবো। যেতে যেতে কথা হবে।
–বেশ, তবে চিমনি হয়ে যেতে হবে। চিফ কনস্টেবল আমাকে নিতে আসবেন।
–কেন?
–তিনি একটু দয়ালু।
গতরাতে তুমি কি করছিলে বান্ডল?
–ভাবছিলাম, সেটার কথাই বলবো। যেতে যেতে কথা হবে। এখন রাখছি।
বান্ডলের কর্মক্ষমতার ওপর জিমির অপরিসীম শ্রদ্ধা আছে ঠিকই, কিন্তু আবেগ ছিল না তার মধ্যে এতটুকু।
প্রায় কুড়ি মিনিট পর জিমি তার টু-সীটার নিয়ে হাজির ব্রুকলিন স্ট্রিটে। বান্ডল দ্রুত নেমে এলো নিচে। জিমি লক্ষ্য করলো, বান্ডলের চোখে রাত জাগার ছাপ।
গাড়ি চালাতে চালাতে মন দিয়ে বান্ডলের গত রাতের কাহিনী শুনলো। অবশ্য পথে দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সেদিকেও সে সজাগ।
-বান্ডল, তুমি আমার সঙ্গে মজা করছে না তো?
–কি বলছো?
–মাপ চাইছি, জিমি বললো, আসলে সব যেন স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে ঘটছে।
–বিদেশিনী উত্তেজনা শিকারী, আন্তর্জাতিক দস্যুদল, রহস্যময় ৭ নম্বর, যাকে কেউ কখনো দেখেনি। এরকম তো বইয়ে পড়েছি।
-বইয়ের পড়া কখনোও বাস্তবে রূপ পায়। বান্ডল বলে উঠলো।
–একটা খিচুড়ি মার্কা জমায়েত বলা যেতে পারে। একজন রুশ, একজন আমেরিকান, একজন ইংরেজ, এক অস্ট্রিয়ান বা হাঙ্গেরিয়, আর সেই মহিলা যে কোনো জাতি হাতে পারে।
–আর একজন জার্মান। বান্ডল মনে করিয়ে দিলো। আর দুনম্বর হলো বাওয়ার, যে গতরাতে সভায় ছিল না।
-ওরা চিঠির খবরটা জানে তাই তো? আগামী সপ্তাহে ওয়াইভের্ন অ্যাবীতে আমার যাওয়ার কথা, সেটাও অজানা নয় ওদের, তাই না?
–হ্যাঁ, রুশ না আমেরিকান বললো, ভাববার কারণ নেই। কারণ ওদের মতে তুমি একটা গর্দভ।
-কথাটা বলে ভালোই করলে। ঘটনাটা আমার আগ্রহ বেশি করে জাগিয়ে তুলছে। আর ঐ জার্মান লোকটির নাম এবারহোর্ড।
-হ্যাঁ, কিন্তু কেন?
দাঁড়াও একটু ভেবেনি। হ্যাঁ মনে পড়েছে।
….এবারহোর্ড হলো একজন আবিষ্কারক, যিনি জিনিষ আবিষ্কার করে সেটা পেটেন্ট নিয়ে বিক্রি করতে ইচ্ছুক। তবে তার আবিষ্কার হলো একটা তার ইস্পাতের চেয়ে শক্ত আর তাপসহ হয়ে যায়। উড়োজাহাজ আবিষ্কার করার পরে সে ভাবে, ওটার ওজন দারুণভাবে কমিয়ে দেবে। দামের দিক থেকে এ হবে বৈপ্লবিক। আমার ধারণা, তিনি এই আবিষ্কারকে জার্মান সরকারের কাছে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ওরা নিতে রাজী হয়নি। ওরা কিছু ত্রুটি লক্ষ্য করে। ওদের ব্যবহারে সে আঘাত পায়। মনে মনে ঠিক করে, কোনোভাবেই ওদের এই আবিষ্কারের ফল ভোগ করতে দেবে না। প্রথমে ভেবেছিলাম, এসব বাজে কথা। এখন দেখছি উল্টো ব্যাপার।
-তোমার কথাই ঠিক জিমি, বান্ডল বলে উঠলো। এবারহোর্ড নিশ্চয়ই আমাদের সরকারের কাছে ওটা বিক্রি করার প্রস্তাব দিয়েছে। স্যার অসওয়াল্ড কুটের বিশেষজ্ঞের অভিমত সরকার নিশ্চয়ই যাচাই করে নিতে চাইছে। তাই এই বেসরকারী সভার আয়োজন। ওখানে থাকছেন স্যার অসওয়াল্ড, জর্জ, বিমানমন্ত্রী আর এবারহোর্ড। নিশ্চয়ই ওর কাছে পরিকল্পনাটার খসড়া আছে।
-একে ফর্মুলা বলে।
-হ্যাঁ, ঐ বিশেষ ফর্মুলাটা সেভেন ডায়ালস হস্তগত করতে চাইছে। ঐ রুশ লোকটা যার দাম লক্ষ লক্ষ টাকা বলছিল, মনে পড়েছে।
রনি কি জানতো; একবার যদি জানতে পারতাম, জিমি বললো। তবে আমরা আবিষ্কার করেছি, জেরি ওয়েডের মৃত্যুর জন্য ফুটম্যান বাওয়ার দায়ী। পরের শিকার কে হবে? এরকম ব্যাপারে কোনো মেয়ের জড়িয়ে পড়া ঠিক নয়।
বান্ডল বুঝলো, জিমি তাকে লোরেনের দলে ফেলতে চায়।
–আমার চেয়ে তোমার শিখার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, বান্ডল হাসতে হাসতে বললো।
–তা যা বলেছো। আচ্ছা, আমরা যদি অপর পক্ষের কয়েকটা মৃত্যু ঘটাতে পারি, কেমন হয়? বান্ডল, ওদের কাউকে দেখলে তুমি চিনতে পারবে?
–পাঁচ নম্বরটাকে চিনতে পারি। বান্ডল ইতস্ততঃ করে বললো। ওর হিস-হিস শব্দটাই চিনিয়ে দেবে।
–দলে একজন মহিলা রয়েছে। সে নিশ্চয় তার শরীর দেখিয়ে কামুক ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের হাতের মুঠোয় নিয়ে গোপন কাগজপত্র বের করে নেয়। আচ্ছা, সাত নম্বর সম্বন্ধে তোমার কোনো ধারণা আছে কি?
-একটুও না।
–ওরা সময়মত চিমনিতে পৌঁছে গেল। কর্নেল মেলরোজ অপেক্ষা করছিলো। বান্ডল জিমির পরিচয় দিলো।
সমস্ত ব্যাপারটা ভালো ভাবে মিটলো, বান্ডল সাক্ষী দিলো, ডাক্তার দিলেন। রায় দেওয়া হলো দুর্ঘটনাতেই রনি ডেভেরো মারা যায়।
কাজ শেষ করে কর্নেল মেলরোজ বান্ডলকে নিয়ে চিমনিতে ফিরে গেলেন, আর জিমি থেসিজার লন্ডনের দিকে রওনা হলো।
জিমি লোরেনেকে ফোন করে জানালো যে দুর্ঘটনা বলেই রায়ে বেরিয়েছে।
–লোরেন, আমার মনে হচ্ছে, কিছু একটা ঘটে চলেছে। তুমি সাবধানে থেকো, অন্ততঃ আমার জন্যে।
-তোমার পক্ষেও তো বিপদের সম্ভাবনা আছে। লোরেনের কণ্ঠে ভয়
–ও নিয়ে ভেবো না। এখন রাখছি।
জিমি স্টিভেনসকে ডাকলো।–স্টিভেনস, আমার জন্যে একটা অটোমেটিক আর নীলচে নলওয়ালা পিস্তল কিনে আনতে পারো। দোকানদার আর তোমার যদি এ সম্বন্ধে জ্ঞান থাকে কিছু, ঠিক আমেরিকান গল্পে নায়ক যেমন পেছনের পকেট থেকে পিস্তল বের করে সেইরকম।
স্টিভেনসের মুখে হাসি খেলে গেল–বেশির ভাগ আমেরিকান কিন্তু তাদের পকেট থেকে পিস্তলের বদলে অন্য কিছু বের করে।
জিমি না হেসে পারলো না।
.
অ্যাবীতে পার্টি
শুক্রবার বিকেলে ঠিক সময়ে বান্ডল এসে হাজির হলো ওয়াইভেন অ্যাবীতে চায়ের আমন্ত্রণে। জর্জ লোম্যাক্স তাকে বেশ খাতির করে অভ্যৰ্তনা জানাতে এগিয়ে এলেন।
প্রিয় এইলিন, তোমার যে এ ধরনের পার্টিতে আসতে ইচ্ছে করে সেটা আমার জানা ছিল না। রাজনীতিতে তোমার আগ্রহ আছে শুনলাম লেডি কেটারহ্যামের কাছ থেকে। শুনে যেমন খুশি হয়েছিলাম তেমনি অবাক হয়েছি।
–আমার খুবই ভালো লাগে। বান্ডল বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে উত্তর দিলো।
মিসেস মার্কাটা গত রাতে ম্যানচেস্টারে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন। উনি পরের ট্রেনে আসছেন। তুমি জিমি থেসিজারকে চেনো? ওর ওপরটা দেখলে বোঝা যায় না। আসলে বিদেশের রাজনীতিতে একদম পাকাঁপোক্ত।
জিমি এই দিকেই এগিয়ে আসছিল। বান্ডল, তারদিকে হাত বাড়িয়ে বললো–আমি তাকে চিনি।
জর্জ একটু দুরে সরে যেতেই জিমি বললো-বান্ডল, আমি বিলকে সব বলেছি। একটু একটু করে ওর মাথায় সব ঢুকিয়েছি। অতএব আমৃত্যু ও আমাদের সঙ্গে থাকবে।
জর্জ হঠাৎ হাজির হলেন। তিনি এক এক করে বান্ডলের সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিলেন–স্যার স্ট্যানলি ডিগবি, হাসিখুশী ভরা একজন বিমানমন্ত্রী, মি ও’রুরকে, লম্বা চেহারা, মুখে আইরিশ আদল স্পষ্ট।
মিসেস মার্কাটার জন্য বান্ডল অপেক্ষা করছিল। তিনি কালো লেস লাগানো ফ্রক পরে গম্ভীর মুখে হল ঘর পেরিয়ে এলেন। সেখানে ফুটম্যানের পোশাকে একজন উপস্থিত ছিল। বান্ডল চিনতে পারলো ইনি সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল। ছদ্মবেশে নিজেকে ঢাকতে পারেনি।
–সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল, বান্ডল ফিসফিস করে বললো।
-হ্যাঁ, সবকিছুর ওপর নজর রাখতে এসেছি। মিঃ লোম্যাক্স ঐ সাবধানী চিঠি পেয়ে খুব ভয় পেয়ে গেছেন। আমার ওপর ওর ভীষণ বিশ্বাস। তাই আমাকে আসতে হলো।
কিন্তু আপনি কি ভাবেন, বান্ডল বলতে গিয়েও বলতে পারলো না, ছদ্মবেশের। আড়ালে একজন পুলিস অফিসারের ভাব স্পষ্ট ফুটে আছে।
–আপনি কি ভাবছেন, অপরাধীরা সতর্ক হয়ে যাবে? কিন্তু এটা করলে ক্ষতিই বা কি?
–ক্ষতি কি? বোকার মত বান্ডল কথাটার পুনরাবৃত্তি করে এগিয়ে গেল। ড্রয়িং রুমে একটা কমলা রঙের খাম হাতে নিয়ে ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছেন।
–খুবই বিরক্তিকর। জর্জ বললেন, টেলিগ্রাম এসেছে, মিসেস মার্কাটার ছেলেমেয়েরা মাম্পসে আক্রান্ত, তাই তিনি হাজির হতে পারছেন না।
কথাটা শুনে বান্ডল স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো, ওর মুখোমুখি হতে সে চায় না।
–এইলিন, তুমি দুঃখ করো না, আমি জানি কত আগ্রহ নিয়ে তুমি এখানে এসেছে, তার সঙ্গে দেখা করবে বলে। জর্জ বলতে থাকেন, এজন্য অনেক সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কাউন্টেস বেচারি শুধু
বান্ডল আচমকা বলে উঠলো, উনি হাঙ্গেরিয় না?
-হ্যাঁ, কাউন্টেস ঐ তরুণ হাঙ্গেরীয় দলের নেত্রী। শিশু মৃত্যুর সমস্যা নিরসনে তিনি নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। তিনি স্বাস্থ্যবতী, অল্প বয়সে স্বামী হারান। আরে, ঐ এবারহোর্ড এসে গেছেন।
তেত্রিশ বা চৌত্রিশ বছরে এক সপ্রতিভ হাসিখুশী মানুষ এই জার্মান ইঞ্জিনীয়ার এবারহোর্ড। ভদ্রলোকের চেহারা দেখলে মনে হয় রক্তশূন্যতায় ভুগছেন।
ওরা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল তখন এসে হাজির হলেন মিঃ ও’রুরকে। এর একটু পরেই হাঁফাতে হাঁফাতে বিল এলো।
হ্যালো বান্ডল, তুমি এসেছো শুনেছি আগে, বিল বলতে থাকে। কিন্তু সারা বিকেল নাকে দড়ি দিয়ে যা ঘুরিয়েছে যে আগে তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি।
–সেই কাউন্টেসের সেবায় মনোনিবেশ করেছিলে নিশ্চয়ই। জিমি বললো।
–মানে, ইয়ে, আমি বাধা দেবো কি করে বলো? বিলের গালদুটো লাল হয়ে উঠেছে। তবে ভদ্রমহিলা বেশ মজার, বুদ্ধিমতী। বাড়িটা যখন ঘুরে দেখছিলেন তখন বান্ডল, তুমি দেখলে পারতে, কতরকম প্রশ্ন করছিলেন।
–কি রকম প্রশ্ন?
বান্ডলের প্রশ্ন শুনে বিল হচকচিয়ে গেল। ঠিক সরাসরি জবাব দিলো না। বললো, বিশেষ কিছু নয়। এই বাড়ির ইতিহাস জানতে চাইছিলেন। আসবাবপত্র সম্পর্কেও আগ্রহ তার। এইরকম অদ্ভুত প্রশ্ন আর কি।
ঠিক এই সময় কালো মখমলের আঁটোসাঁটো পোশাক পরে কাউন্টেস ঘরে ঢুকলেন। সেই সময় চশমা পরা গম্ভীর মুখে ঢুকলেন এক ভদ্রলোক যিনি পঙ্গো নামে পরিচিত।
.
নৈশভোজের পর
নৈশভোজের পর মহিলারা ড্রয়িংরুমে ঢোকার পর সান্ধ্য পোশাকে বেশ অপ্রতুল বলেই ভাবতে লাগলেন। অ্যাবীতে আধুনিক তাপ বিকিরণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাই তারা ঘরে যে কাঠের চুল্লির ব্যবস্থা ছিল, তার পাশে গিয়ে বসলেন।
লেডি কুট বলে উঠলেন–মিসেস কার্টার ছেলেমেয়েদের মাম্পস হওয়াটা বেশ আশ্চর্য ব্যাপার।
–মাম্পস কি? কাউন্টেস জানতে চাইলেন।
বান্ডল ও লেডি কুট দুজনে মিলে বেশ কায়দা করে মাম্পসের বর্ণনা তাকে দিলেন।
-হাঙ্গেরিয় শিশুদের বোধহয় এ রোগ হয়, লেডি কুট বললেন।
–আমি জানি না, কাউন্টেস বললেন।
-সে কি! আপনি শুনেছি শিশুদের মধ্যে কাজ করেন, লেডি কুট আশ্চর্য হয়ে তার দিকে তাকালেন।
–এই কথা, কাউন্টেস পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে বলতে আরম্ভ করলেন–কত ভয়ঙ্কর সব ব্যাপার দেখেছি শুনলে স্তম্ভিত হবেন।
যুদ্ধের পর অনাহার আর অন্যান্য ভয়ানক পরিস্থিতি তিনি দেখেছেন, কাউন্টেস একটানা বর্ণনা করে গেলেন, বান্ডলের মনে হলো যেন গ্রামোফোনে রেকর্ড বেজে চলেছে।
লেডি কুট প্রায় মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন তার কথা।
একসময় কাউন্টেস বললেন–আমাদের সমস্যাটা কোথায় জানেন? আমাদের টাকা আছে, কিন্তু ভালো সংগঠন নেই।
-আমার স্বামীও তাই বলেন, লেডি কুট সায় দিলেন। তার মনের পরদায় স্যার অসওয়াল্ডের জীবনের নানা ঘটনার ছবি ফুটে উঠতে চাইছিল।
কি মনে করে তিনি বান্ডলকে বললেন, আচ্ছা, লেডি এইলিন, বলুন তো, আপনাদের বাগানের ঐ প্রধান মালীকে পছন্দ করেন আপনি?
–কে? ঐ ম্যাকডোনাল্ড? মানে, একটু ইতস্ততঃ করলো বান্ডল, ওকে নিজের কাজ করতে দিলে ও ঠিক আছে।
এমন সময় জিমি এসে ঢুকলো। বান্ডলকে লক্ষ্য করে বললো, সেই ছবিগুলো দেখবে নাকি? তোমার অপেক্ষায় আছে।
জিমিকে অনুসরণ করে বান্ডল ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
–কোনো ছবির কথা বললে?
-ধৎ ওসব বাজে কথা। জিমি উত্তর দিলো। লাইব্রেরিতে বিল আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সেখানে আর কেউ নেই।
বিল চঞ্চল মনে লাইব্রেরি ঘরে পায়চারি করছিল।
বান্ডলকে লক্ষ করে বললো–তুমি যে এ ব্যাপারে ঢুকে পড়েছো, এটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না। এ বাড়িতে একটা ঝামেলা সৃষ্টি হতে চলেছে। তারপর
বান্ডল জিমির দিকে তাকালো-ওকে কি বলেছো?
–সবই বলেছি।
–তোমার ঐ সেভেন ডায়ালসে যাওয়ার ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। বিল কাতরভাবে বান্ডলের দিকে তাকালো, কাজটা তুমি ভালো করোনি বান্ডল।
-কোনো কাজ?
–এই সব ব্যাপারে জড়ানো।
-হ্যাঁ, বান্ডল বললো, আমি যখন জড়িয়েছি তখন তোমার আর চেঁচিয়ে তোক জানাতে হবে না।
-ওসব কথা না ভেবে পরিকল্পনা তৈরি করে নাও চটপট। জিমি বললো।
বান্ডল হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
বিল আর কথা না বাড়িয়ে রাজী হয়ে গেল।
-ফর্মুলার ব্যাপারে তোমার কথাই ঠিক। বিল বললো। বোধহয় ফর্মুলাটা হয় এবারহোর্ড নতুবা স্যার অসওয়াল্ডের কাছে আছে। ওরা সবাই এখন স্টাডিতে, তার মানে আসল কাজ শুরু করতে চলেছেন।
-স্যার স্ট্যানলি ডিগবি কতদিন থাকবেন? জিমি জানতে চাইলো।
–তিনি আগামীকাল শহরে ফিরবেন।
–তাহলে কোনো ঝামেলা রইলো না। জিমি বললো, আমার ধারণা যদি ঠিক হয় তাহলে স্যার স্ট্যানলি ফর্মুলাটা সঙ্গে নিয়ে যাবেন। অতএব বিশেষ মজার যা ঘটার তা আজ রাত্রিতেই অবশ্যই ঘটবে।
-প্রথম কথা হচ্ছে ফর্মুলাটা রাত্রিতে কোথায় থাকবে? এবারহোর্ডের কাছে না অসওয়াল্ডের কাছে থাকবে?
–আমাদের যদি ধারণা হয়ে থাকে যে আজ রাতে কেউ ওটা চুরি করার ধান্দায় আছে তাহলে আমাদের কাজ হলো সতর্ক দৃষ্টি রেখে সেটা বন্ধ করা।
-তাহলে সে কথাই রইলো। তবে রাতে পাহারা থাকার জন্য টস করে ভাগাভাগি করে নিতে হবে।
বান্ডল চুপ করে শুনছি, কিছু বলার ইচ্ছা থাকলেও বললো না।
–বেশ, টস করো। হেড হলে তোমার আগে, আমার পরে। টেল হলে ওর উল্টোটা হবে। একটা কয়েন বের করে টস করা হলো। প্রথম রাতের দায়িত্ব পড়লো জিমির ওপর।
এতক্ষণে বান্ডল মুখ খুললো–আমি কি করবো?
–তুমি বিছানায় গিয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘুমোও
–খুব উত্তেজনার ব্যাপার বলে মনে হলো না। বান্ডল বললো।
-কে বলতে পারে, তুমি হয়তো ঘুমের মধ্যে খুন হয়ে গেলে, জিমি বললো, আর আমরা বেকসুর খালাস পেয়ে যাবো।
–জিমি, তুমি হয়তো ঠিকই বলেছো। কাউন্টেসের ভাবভঙ্গী আমার কাছে কেমন বেখাপ্পা লাগছে। ওকে আমার সন্দেহ হয়।
-না, উনি সমস্ত রকম সন্দেহের বাইরে। বিল খুব উৎসাহ নিয়ে কথাটা বললো। কারণ হাঙ্গেরির দূতাবাসের একজন ওর ব্যাপারে সবই আমাকে বলেছে।
-বেশ, তোমার বিশ্বাসের কথাটা ওর কানে কানে বলে এসো। বান্ডল বিরক্ত হয়ে বললো, আমার মাথা ধরেছে, শুতে চললাম।
বান্ডল চলে গেলে বিল জিমির দিকে তাকালোবান্ডলের বুদ্ধি আছে বলল। কখন কোনো ব্যাপার অসম্ভব, সেটা ও ভালো বোঝে। একটা কথা এই ধরনের কাজে নামতে গেলে একটা জোরালো অস্ত্র লাগে। আমাদের সঙ্গে সেই জাতীয় কিছু থাকা দরকার।
আমার কাছে একটা নীল নলের অটোমেটিক আছে। জিমি বললো, কি মনে হলো, তাই সঙ্গে নিয়ে এসেছি। তোমার পাহারা দেওয়ার সময় তোমাকে ওটা দেবো।
.
জিমির অ্যাডভেঞ্চার
তিনজন মানুষের তিন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে দৃশ্যমান হবে আজকের এই রাত।
-তাহলে জিমি, ঐ কথাই রইলো, রাত তিনটে। বিল বিদায় নেবার সময় জিমিকে বললো। কিন্তু কডার্স দেখলাম আমার চেয়েও বোকা। বান্ডলের কথা ও পুরো বিশ্বাস করে বসে আছে। যাক, শুভরাত্রি। আমার ঘুম ভাঙাতে তোমার কষ্ট হবে হয়তো, তবুও সময়মত ভাঙিও বিল ওর দিকে তাকালো। আশা করি তুমি ঠিক মতো থাকবে। যখনই বেচারি জেরি আর রনির কথা ভাবি–
জিমি ভাবলো, বিল তার মনের কথাই বলেছে। তারপর সে পকেট থেকে অটোমেটিক রিভলবার বের করে ওকে দেখালো–এটা সত্যি ভালো জিনিস।
বিল মুগ্ধ হয়ে দেখলো।
-শুধু ট্রিগার টানার অপেক্ষা। তারপরের কাজটুকু এটার দায়িত্বে। জিমি গর্বের সঙ্গে কথাটা বললো।
বিল আবার শুভরাত্রি বলে বিদায় নিলো।
জিমি পাহারা দেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলো।
পশ্চিমের একেবারে শেষ প্রান্তে স্যার স্ট্যানলি ডিগবির ঘর। এই ঘরের একদিকে বাথরুমে, অন্যদিকে আর একটা দরজা দিয়ে যাওয়া যায় ছোট্টো একটা ঘরে যেটা দখল করেছেন মিঃ টেরেন্স ও’রুরকে। এইসব ঘরের বাইরে ছোট্ট বারান্দা। যেখানে সহজেই পাহারা দেওয়া যায়। একটা ওক কাটের আসবাবের আড়ালে শরীর লুকিয়ে রেখে সহজে সম্পূর্ণ জায়গার ওপর নজর রাখা যায়। পশ্চিমে যেতে হলে এই পথ দিয়েই সকলকে যেতে হবে। একটা বৈদ্যুতিক আলোও জ্বলছে।
হাঁটুর ওপর লিওপোন্ড নিয়ে বেশ আরাম করে বসলো জিমি।
চারদিক নিস্তব্ধ। ঘড়িতে একটা বাজতে বিশ মিনিট বাকি।
এইভাবে বসে থাকা একটা বিরক্তিকর ব্যাপার সন্দেহ নেই। ওর মনে পড়লো প্ল্যানচেটের কথা। এই সময় নাকি অদ্ভুত সব ব্যাপার ঘটে। রনি ডেভেরো আর জেরি ওয়েড, ওরা এখন কোথায় আছে কে জানে? ভয়ঙ্কর চিন্তা তার মনে উদয় হলো।
ঘড়িতে একটা বেজে কুড়ি হয়েছে। সময় যেন অত্যন্ত ধীর পায়ে এগোচ্ছে।
সত্যি, বান্ডলের সাহসের প্রশংসা করতে হয়। না হলে সেভেন ডায়ালসের মতো জায়গায় গিয়ে সে ঢোকে।
সাত সম্বর কে হতে পারে? সে কি এখন তার বাড়িতে আছে? নাকি চাকরের ছদ্মবেশ নিয়েছে।
ঘুমে চোখ বুজে এলো। চোখ খুলে রাখার চেষ্টা করলো। হাই তুললো, ঘড়ির দিকে তাকালো, দুটো বাজতে দশ।
ঠিক এই সময় কানে এলো কিছু। সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ঝুঁকে পড়লো। কান খাড়া করলো।
শক্ত কাঠের ওপর ঠুকলে যেমন শব্দ হয় তেমন আওয়াজ। শব্দটা আস্তে কিন্তু ভয় জাগানো। নিচে কোনো লোক নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে-লাইব্রেরি থেকে আওয়াজটা ভেসে আসছে।
সে সন্তর্পণে লিওপোল্ডকে ডান হাতে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো। লাইব্রেরির দরজার সামনে এসে দরজায় কান পাতলো। কোনো শব্দ নেই। সে আচমকা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালালো।
ঘর খালি। ঘরটি বেশ বড়ো। তিনদিকে তিনটে জানলা। বারান্দার দিকে সব জানালাই খোলা। মাঝখানের জানালাটার খিল খোলা।
সে সেটা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে সজাগ দৃষ্টিতে চারপাশ দেখলো। না, কিছুই নেই।
মুহূর্ত খানেক পর আবার লাইব্রেরিতে ঢুকলো। দরজার তালা বন্ধ করে চাবি নিজের কাছে রেখে আলো নিভিয়ে কান পেতে রইলো, চট করে খোলা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
খুব হালকা পায়ে চলার আওয়াজ বারান্দায় শোনা যাচ্ছে?
না, কিছুই নেই। এটা কি তার কল্পনা মাত্র।
রাত দুটো বাজার ঘন্টা পড়লো।
.
বান্ডলের অ্যাডভেঞ্চার
বান্ডল ব্রেন্ট যেমন বুদ্ধিমতী তেমনি কল্পনাশক্তি প্রবল। সে বুঝতে পেরেছিল, বিল এই রাতের বিপজ্জনক কাজে ওকে অংশ নিতে দেবে না। তাই আগে থেকে নিজের মনে পরিকল্পনা করে রেখেছিল। সে তার শোবার ঘর থেকে বাড়ির বাইরেটা এ ঝলক দেখে নিয়েছিল। ওর ঘরের জানলার পাশে চমৎকার আইভি লতার ঝোঁপ রয়েছে, সেইরকম লতার অ্যাবী সাজানো আছে।
বিল আর জিমির কাজে বাধা দেওয়ার কোনো কারণ সে খুঁজে পায়নি। ওদের দুজনকে যে এত সহজে বোকা বানাতে পারলো সেটা ভেবে ও মনে মনে অবাক হলো।
সে নিজের ঘরে এসে চট করে সান্ধ্যপপাশাক ছেড়ে পরে নিলো একটি পোশাক যেটি সে স্যুটকেসে করে নিয়ে এসেছিলো। ঘোড়সওয়ারের ব্রিচেস, রবারের সোলের জুতো আর গাঢ় রঙের একটা পুলওভার পরে বান্ডল তৈরি হয়ে নিলো। রাত একটাতে কাজ শুরু করবে সেটা সে আগেই ভেবে রেখেছিল। কারণ ততক্ষণে সকলে ঘুমের মধ্যে ডুবে যেতে পারবে।
নির্দিষ্ট সময়ে সে জানলার কাঁচ তুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। বিড়ালের মতো গাছে উঠতে বান্ডল অভ্যস্ত। তাই নিঃশব্দে কিছু ফুলগাছের ঝোঁপের ওপর সে লাফিয়ে পড়লো।
পশ্চিম দিকের ঘরে আছেন বিমানমন্ত্রী আর তার সেক্রেটারি। বাড়ির দক্ষিণে আর পশ্চিমে একটা লম্বা বারান্দা আছে।
বাড়ির ছায়ার আড়ালে নিজেকে গোপন রেখে সে পায়ে পায়ে দক্ষিণের বারান্দার দিকে এগোলো। দ্বিতীয় কোনটা পার হতেই সে বাধা পেলো। সামনে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ, সে তার পথ রোধ করতে চায়।
বান্ডল চিনতে পারলো।
–সুপারিন্টেন্ডন্ট ব্যাটল, আমাকে বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছেন।
–সেইজন্যই এখানে রয়েছি।
–আপনি এখানে কি করছেন?
–যাদের বাইরে আসার কথা নয়, তারা যেন না আসে, সেটা দেখছি। যেমন আপনি, আশা করি এত রাতে আপনি যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবেন না?
–আপনি আমাকে ফিরে যেতে বলেছেন? বান্ডল বললো। ভাবছিলাম একটু পশ্চিম দিকটায় যাবো। না যেতে পারলে বড় মন খারাপ হয়ে যাবে।
বেশ তাড়াতাড়ি বুঝতে পারে ব্যাটল, লেডি এইলিন। আপনি জানলা দিয়ে না দরজা দিয়ে বাইরে এসেছেন?
–জানলা দিয়ে। আইভি লতা বেয়ে সহজেই নিচে নেমেছি।
এবার আপনার পক্ষে শুতে যাওয়াই মঙ্গল, লেডি এইলিন দৃঢ়তা স্পষ্ট। বান্ডল হতাশ হয়ে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলো। আইভি লতা বেয়ে উঠতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়লো, আচ্ছা সুপিরন্টেন্ডেন্ট ওকে সন্দেহ করবে না তো?
অবশ্য ব্যাটলের হাবভাব সেটা বেশ স্পষ্ট। জানলার কার্নিসে পা রেখে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আপন মনে হেসে উঠলো। উনি ওকে সন্দেহ করেন এর চেয়ে মজার ব্যাপার আর হয় না।
বিছানায় শুয়ে ঘুমোনোর মেয়ে বান্ডল নয়। আবার অন্যদিকে যখন কোনো দুঃসাহসিক আর উত্তেজনাকর ঘটনা ঘটতে চলেছে তখন চুপচাপ বসে থাকার মত মেয়ে সে নয়।
ঘড়িতে তখন দুটো বাজতে দশ মিনিট বাকি। কয়েক মুহূর্ত কি ভেবে চুপচাপ দরজা খুললো। নিঃশব্দে বারান্দা দিয়ে এগোলো।
যেতে যেতে একটু থমকে দাঁড়ালো। কিসের যেন আওয়াজ আসছে। পরক্ষণে কিছু নয় ভেবে আবার পা বাড়ালো। এবার প্রধান বারান্দায় উঠে পশ্চিম দিকে চললো। ঠিক এখানেই কিছু একটা সামনে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল।
জিমির তো এখানে থাকার কথা। কিন্তু ও গেল কোথায়?
রাত দুটো বাজার ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেলো তখনই।
কি করবে ভাবছে এমন সময় তার হৃদপিণ্ড ছলাৎ করে লাফিয়ে উঠলো। টেরেন্স ও’রুরকের ঘরের দরজার হাতলটা আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করেছিল।
সে নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ করে হাতলটার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু দরজাটা খুললো না। হাতলটা আবার নিজের জায়গাতেই ফিরে এলো। এ সবের মানে কি?
বান্ডল আচম্বিতে সচেতন হলো। জিমি যে কারণে হোক ওর জায়গা ছেড়ে চলে গেছে। বিলকে ডাকতে হবে।
সে দ্রুত পায়ে বিলের ঘরে চাপা স্বরে বিলকে ডাকতে লাগলো। কয়েকবার ডাকার পর বিলের সাড়া না পেয়ে আলো জ্বালালো। একি বিছানা খালি! বিল কোথায় গেল তাহলে?
হঠাৎ খেয়াল হলো সে ভুল করে অন্য ঘরে ঢুকে পড়েছে। কারণ পাতলা রাত্রিবাস, টুকিটাকি মেয়েলি জিনিষ পড়ে আছে। কালো ভেলভেটের কিছু পোশাক ড্রেসিং টেবিলে রয়েছে বুঝতে অসুবিধা হলো না, এটা কাউন্টেস র্যাডকির ঘর। কিন্তু তিনিই বা কোথায়?
বান্ডল হতভম্ব হয়ে ভাবতে লাগলো। ঠিক সেই মুহূর্তে নিচ থেকে উঠে আসা গোলমালের আওয়াজে তার সম্বিত ফিরে এলো।
শব্দ লক্ষ্য করে বান্ডল দ্রুত নিছে নেমে লাইব্রেরির দিকে ছুটলো, কেউ যেন প্রচণ্ড শব্দে চেয়ার টেবিল আছড়ে ফেলছে।
লাইব্রেরির দরজা বন্ধ। দরজায় আঘাত করলো। খুললো না। ভেতরে লড়াই যে ভালো চলছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না বান্ডলের।
তারপরেই পরপর দুটো গুলির আওয়াজে আর স্পষ্টভাবে খান খান হয়ে গেল রাতের নিস্তব্ধতা।
.
লোরেনের অ্যাডভেঞ্চার
ঠিক রাত সাড়ে নটার লোরেন শুতে গিয়েছিল। একটা বাজতে দশ-এ তার ঘুম ভাঙলো। কয়েকঘন্টা ঘুমিয়ে তার শরীর ঝরঝরে হয়ে গেছে।
ঐ ঘরে ওর সঙ্গে কুকুরদুটোও ঘুমোচ্ছিল। ওদের একজন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে লোরেনের দিকে তাকালো।
-চুপ করে ঘুমো, লার্চার। কুকুরটা মাথা নিচু করে তাকিয়ে রইলো।
লোরেন ওদের কথা মতো যুক্তি মেনে চুপ করে থাকাই ঠিক ভেবেছিল। কিন্তু ওর মুখ দেখে, ওর শক্ত ছোট্ট চোয়লের দৃঢ়তার ছাপ দেখলে যে কেউ বুঝে নিতে পারবে ওর মনের জোর কতখানি।
একটা টুইডের কো আর স্কার্ট পরে পকেটে সে চট করে পুরে নিলো একটা টর্চ। হাতির দাঁতের হাতলের ছোট্ট একটা পিস্তল নিলো।
লোরেনকে তৈরি হতে দেখে লার্চার সামনে এসে ল্যাজ নাড়তে লাগলো।
-না, লার্চার, এখন নয়। চুপ করে ঘরে থাকো।
বাইরে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করলো সে। তারপর বাইরে একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে টুসীটারে উঠে বসলো।
কয়েক মিনিটের মধ্যে সে এসে পৌঁছালো ওয়াইভার্ন অ্যাবীর বাগানে।
ধীর পায়ে বাড়িটার দিকে এগোলো। দুটো বাজলো কোথাও। বারান্দার কাছে আসতেই তার বুকের ওঠানামা বেড়ে গেল। বারান্দায় উঠে চারিদিকে সজাগ দৃষ্টি দিলো।
আচমকা তার পায়ের সামনে একটা কি এসে পড়লো। সে নিচু হয়ে তুলে নিলো। বাদামী রঙের একটা কাগজের প্যাকেট। ওপর দিকে তাকালো।
ওর ঠিক মাথার ওপরের দিকে খোলা জানলা দিয়ে একটা পা বেরিয়ে এলো আর একটা লোক আইভি লতা বেয়ে নামতে শুরু করলো।
এক মুহূর্ত দেরি না করে প্যাকেট হাতে নিয়ে লোরেন ছুটতে লাগলো। পেছন থেকে ভেসে আসা হুটোপাটির শব্দ ও তখনও শুনতে পাচ্ছে। ভয়ে সিঁটিয়ে পড়িমড়ি করে তখন ছুটছে লোরেন। বারান্দা পেরোতে গিয়ে সে বাধা পেলো। একজন স্বাস্থ্যবান পুরুষ ওকে জাপটে ধরেছে।
–ভয় নেই, সুপারিন্টেন্ডেন্টের দয়ার্দ্র কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
লোরেন হাঁফাতে হাঁফাতে বললো, তাড়াতাড়ি চলুন, ওরা বোধহয় পরস্পরকে মেরে ফেলেছে।
সেই সময় দুবার গুলির আওয়াজ ভেসে এলো।
দুজনে দ্রুত পায়ে লাইব্রেরির খোলা জানলার সামনে এসে দাঁড়ালো। ব্যাটল টর্চ জ্বালাতে গিয়ে ধাক্কা খেল।
জানালার প্রায় নিচে রক্তের স্রোতের মধ্যে পড়ে আছে জিমি থেসিজারের অচৈতন্য দেহ, ডানহাতটা অদ্ভুতভাবে বাঁকানো।
লোরেন নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না। কান্না জড়ানো গলায় বললো, ও মনে গেছে। জিমি–জিমি মরে গেছে।
–উনি মারা যাননি। ঠিক আছে। ব্যাটল ওকে আশ্বস্ত করলেন। দেখুন আলোটা জ্বালতে পারেন কিনা।
লোরেন ঘরে ঢুকে সুইচ টিপতেই সারা ঘর আলোকিত হয়ে উঠলো।
ততক্ষণে দরজার বাইরে শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন কণ্ঠের কোলাহল। তারা ঘরে ঢুকতে চাইছিল।
একটা রুমাল বের করে জিমির ডান হাতে যেখানে গুলি লেগেছে, সেখানে বেঁধে দিতে দিতে ব্যাটল বললেন–বেশি রক্তপাত হওয়ার জন্য উনি জ্ঞান হারাননি। পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছেন।
দরাজায় তখন উধ্বশ্বাসে করাঘাত হচ্ছে। ব্যাটল ঘরের চারিদিকে একবার খুঁটিয়ে দেখে নিলেন। একটা অটোমেটিক পিস্তল জিমির পাশে পড়েছিল। সেটা তুলে টেবিলের ওপর রেখে দরজার খিল খুলে দিলেন।
একসঙ্গে কয়েকজন লোক ঢুকে পড়লো। জর্জ লোম্যাক্স বললেন, সুপারিন্টেভেট ব্যাটল, আপনি এখানে? মানে, কি হয়েছে?
মেঝেতে পড়ে থাকা জিমির দিকে তাকিয়ে বললো-হা ঈশ্বর!
দামী রাত্রিবাস পরিহিতা লেডি কুট বললেন–উঃ বেচারী।
বান্ডল বললো লোরেন!
হের এবারহোর্ড মন্তব্য করলেন–হা ভগবান!
স্যার স্ট্যানলি ডিগবিহা ঈশ্বর, এসব কি?
অত রক্ত দেখে বাড়ির এক পরিচারিকা নরম উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, উঃ কি রক্ত দেখেছেন।
ততক্ষণে প্রধান পরিচারক অন্যান্য ঝি-চাকরদের ঘর থেকে বের করে দিয়ে ভিড়টা হালকা করে নিলো।
জর্জ লোম্যাক্স বলে উঠলেন–ব্যাটল, কি ঘটেছে?
ব্যাটল বললেন–এখানে একটা ইয়ে মানে, আপনারা যে যার ঘরে শুতে যান দয়া করে। তারপর একটু সহজ ভাবে বললেন, এখানে একটা ছোট দুর্ঘটনা ঘটেছে।
-হা মানে এটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। সবাই শুতে গেলে খুশী হবো।
কিন্তু কেউ ঘর ছাড়তে রাজী নয় বোঝা গেল।
এই সময় জিমি নড়েচড়ে উঠে বসলো-হ্যাল্লো, ও গম্ভীর গলায় বসে উঠলো, কী হয়েছে?
এবার ঘরের চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
–আপনারা লোকটাকে ধরতে পেরেছেন? আইভি লতা বেয়ে লোকটা যখন উঠছিল তখন আমি জানলার তলায় ছিলাম। ধরে ছিলাম লোকটাকে প্রচণ্ড মারামারি করেও
-এই সেই খুনী বদমাইস নিশ্চয়ই, লেডি কুট মন্তব্য করলেন।
–মনে হছে, আমরা সব ভণ্ডুল করে দিয়েছি, যা ষাড়ের মতো শক্তি লোকটার।
ঘরের চেহারা দেখলে তা মালুম পাওয়া যায়।
জিমি কি যেন খুঁজছিল। হঠাৎ বললল–আমার লিওপোল্ড?
ব্যাটল টেবিলের ওপরে রাখা পিস্তলটা ইঙ্গিত করলেন। আশা করি এটাই আপনার লিওপোল্ড?
–হ্যাঁ, জিমি বললো, এটার ওপর ভরসা করেছিলাম খুব। ঠিক মত ট্রিগার টানতে পারলে একটা কেন, আরো কয়েকটা গুলি চালানো যেত। লোকটা জানলার কাছে দৌড়ে যেতে আমি গুলি ছুঁড়ি প্রথমে। সে ঘুরে আমাকে গুলি করে।
স্যার স্ট্যানলি ডিগবি এতক্ষণে শিরদাঁড়া সোজা করলেন।
–লোম্যাক্স, ওরা সেটা নিয়ে পালায়নি তো? হা ভগবান!
তিনি ঘর থেকে ছুটে বেরোলেন, একটু পরে ফ্যাকাসে মুখে ফিরে এলেন। -ও’রুরকে নিশ্চয়ই কেউ ঘুমের ওষুধ খাইয়েছে। কিছুতেই ওর ঘুম ভাঙাতে পারলাম না। কাগজগুলোও নেই। নিশ্চয়ই ওরা হাতিয়েছে।
৪. ফর্মুলা উদ্ধার
হের এবারহোর্ডের মুখ দিয়ে আর কথা সরছে না। যেন অ্যানিমিয়া হয়েছে।
জর্জ এ ব্যাপারের জন্য সরাসরি দায়ী করলেন ব্যাটলকে।
-ব্যাটল, তোমার হাতেই আমি সব ছেড়ে দিয়েছিলাম, এটা তুমি অস্বীকার করতে পারো না? ব্যা
টলের কঠিন মুখের কোনো পরিবর্তন হলো না।
-সত্যিই তাহলে কাগজগুলো উধাও হয়ে গেছে, তাই বলতে চাও।
সুপারিন্টেন্ডেন্ট মাথা নাড়লেন। তিনি এগিয়ে গেলেন লোরেনের কাছে, তখনও তার হাতে বাদামী খামটা ধরা ছিল।
মিঃ লোম্যাক্স, আশা করি আপনার হারিয়ে যাওয়া জিনিষ সব এর মধ্যেই আছে। তবে এর কৃতিত্ব পাওয়ার কথা এই তরুণীর, এতে আমার কোনো ভাগ নেই।
জর্জ খামটা নেওয়ার আগে স্যার স্ট্যানলি ডিগবি চঞ্চল হাতে খামটা নিয়ে নিলেন। খুলে ফেললেন। স্বস্তির চিহ্ন ফুটে উঠলো তার মুখে।
তিনি লোরেনের দুহাত ধরে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললেন, প্রিয় মিস, আপনার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
–অবশ্যই! জর্জ বললেন।
তিনি তখন লোরেনের দিকে তাকিয়ে আছেন। কারণ মেয়েটিকে তিনি মোটেও চেনেন না।
লোরেন এই দৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জিমির দিকে তাকালো।
জিমি পরিচয় দিলো।
–এ হল মিস ওয়েড। মানে, জোরাল্ড ওয়েডের বোন।
জর্জ খুশী হয়ে লোরেনের হাতে চাপ দিয়ে বললেন, প্রিয় মিস ওয়েড, আপনাকে কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে পারছি না, কিন্তু আপনি কিভাবে
সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল এগিয়ে এসে বললেন, আমার মনে হয়, এটা আপাততঃ চাপা থাকাই ভালো।
প্রসঙ্গ পাল্টে মিঃ বেটম্যান বললেন, একজন ডাক্তার ডেকে আনার জন্য। মিঃ ও’রুরকে একবার দেখা উচিত।
জর্জের নির্দেশ মতো বিল বেরিয়ে পড়লো ডাঃ কার্টরাইটের উদ্দেশ্যে।
জর্জ বললেন, চলো ডাক্তার আসার আগে কি করা যায় দেখা যাক।
তিনি অসহায় ভাবে রিউপার্ট বেটম্যানের দিকে তাকাতেই পঙ্গো মুশকিল আসান করলো। বললো, স্যার, আমি সঙ্গে আসবো।
তিনজনে চলে যেতেই লেডি কুটও তাদের পেছন পেছন গেলেন।
–আমি ভাবছিলাম স্যার অসওয়াল্ড এই মুহূর্তে কোথায়?
লোরেন কেঁপে উঠলো–তাহলে তিনি কি খুন হয়েছেন?
-বাজে কথা বলার দরকার নেই। ব্যাটল একটু ধমকের সুরে বললেন।
বাইরে ভারী পায়ের শব্দ শোনা গেল। ঘরে এসে ঢুকলেন বিরাট চেহারার এক পুরুষ। তিনি চকিতে ঘরের চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন–অফিসার, এখানে কি ঘটেছে?
–চুরির চেষ্টা, স্যার। তবে এই তরুণী মিস ওয়েডের জন্য চোর সফল হয়নি।
তিনি অপরিচিত লোরেনের দিকে লক্ষ্য করলেন। ব্যান্ডেজ বাঁধা জিমির দিকেও দেখলেন। তারপর একটা মাউসার পিস্তল দেখিয়ে বললেন–এটা কি অফিসার? বাইরের লনে পেয়েছি। চোর সম্ভবত পালানোর সময় ফেলে রেখে গেছে। আপনি হাতের ছাপ পরীক্ষা করবেন নিশ্চয়ই। আমি তাই সাবধানে এনেছি।
–আপনার সবদিকেই নজর থাকে, স্যার অসওয়াল্ড।
ব্যাটল আলতো ভাবে পিস্তলটা নিয়ে টেবিলের ওপর জিমির অটোমেটিকের পাশে রেখে দিলেন।
এবার রাতে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তৃত বিবরণ দিলেন ব্যাটল।
–হুম, স্যার অসওয়াল্ড সব কিছু শুনে বললেন, তবু আমার মনে হয় একটু খোঁজ করা উচিত ছিল। কাউকে পাহারাতেও রাখা দরকার ছিল।
তিনজনকে রাখা হয়েছিল নিচে, ক্লান্তস্বরে ব্যাটল বললেন। স্যার অসওয়াল্ড একটু আশ্চর্য হলেন, আটকানোর আদেশ ছিল।
–তা সত্ত্বেও তা করেনি?
-না, করেনি, ব্যাটল গম্ভীর ভাবে বললেন। স্যার, আমি ভাবছি অন্য কথা, অবশ্য অদ্ভুত মনে হতে পারে। তবে সে ভাবনা কোথাও না পৌঁছে দিলে তা নিয়ে আলোচনা নিষ্ফল।
–আপনার আপত্তি না থাকলে আপনার কথা আমাকে বলতে পারেন, সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল।
-স্যার, এ ব্যাপারে আইভিলতার ভূমিকা বেশি। মাফ করবেন, আপনার কোটেও কিছু লেগে আছে।
স্যার অসওয়াল্ড অবাক হলেন। কিছু বলবার আগেই রিউপার্ট বেটম্যান এসে ঢুকলো।
-স্যার, আপনি এখানে। আপনাকে না দেখতে পেয়ে লেডি কুট ভেঙে পড়েছেন। আপনি দয়া করে গিয়ে ওকে একটু শান্ত করুন।
তিনি সেক্রেটারিকে সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
–খুব পাকা সেক্রেটারি। ব্যাটল মন্তব্য করলেন।
-হ্যাঁ, আমি ওর সঙ্গে স্কুলে পড়তাম। ডাক নাম পঙ্গো। ও বরাবার গাধাই রয়ে গেল। বড্ড বাস্তববাদী, রসকস একদম নেই।
ব্যাটল বললেন–কোনো ভদ্রলোকের নীরস হওয়া বড্ড খারাপ। তাতে গোলমালও হতে পারে।
-পঙ্গো গোলমাল করছে ভাবতে পারি না। জিমি বললো, বুড়ো কুটের সঙ্গে নিজেকে বেশ খাপ খাইয়ে নিয়েছে। চাকরিটাও পাকা হয়েছে।
—-সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল, বান্ডল বলে উঠলো, স্যার অসওয়াল্ড এত রাতে বাগানে কি করছিলেন, তা তো জানতে চাইলেন না?
তিনি হলেন সত্যিকার মস্ত বড় মানুষ। ব্যাটল বললেন, এঁরা জানেন কোনো ব্যাখ্যা জানতে না চাইলে তা দেওয়া উচিত নয় এবং চাওয়া উচিত নয়। তিনি ব্যাখ্যা করা বা মার্জনা চাওয়া পছন্দ করেন না। তিমি আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বলতে পারেন, বুঝেছেন।
এ প্রসঙ্গে বান্ডল আর কোনো কথা বললো না।
-এবার আমার বন্ধুর মত শুনতে পারবো। মিস ওয়েড কি করে এখানে এসে হাজির হলেন? ব্যাটল মজার গলায় কথাটা বললেন।
–আমাকে সব কিছুর বাইরে রাখা হয় কেন? জোরের সঙ্গে বান্ডল বললো। প্রথম দিনেই যখন আমায় তোমরা বলেছিলে ঘরে চুপ করে বসে থাকতে, তখনই আমি মন স্থির করে নিয়েছিলাম।
-তোমার ভীরু ভাব দেখে তখনই আমার বোঝা উচিত ছিল, লোরেন বললো।
–তুমি যে এতো বোকা, তা আমি জানতাম না, বান্ডল বললো।
–আমি তোমাকে বিবেচক বলেই জানতাম, জিমি বললো।
প্রিয় জিমি, তোমাকে ঠকানো খুব সোজা, লোরেন বললো। তুমি যখন ফোনে জানালে যে এ কাজে ঝুঁকি আছে, তখনই আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, কিছু করবোই। তাই হ্যাঁরোডে গিয়ে একটা পিস্তল কিনলাম, সাহস বাড়ানোর জন্য ওটার প্রয়োজন ছিল।
একটা ছোট্ট পিস্তল বের করে দেখালো লোরেন। আবার বলতে শুরু করলো, এখানে কি ঘটেছে সেটা দেখার খুব ইচ্ছে ছিল, তাই লতাগাছ বেয়ে বারান্দায় আসি। কি করবো এখন সেটা ভাবার মধ্যে পায়ের কাছে এসে পড়লো একটা বাদামী রঙের প্যাকেট। ওটা তুলে ওপরের দিকে তাকালাম। দেখি একটা লোক লতা ধরে নামছে। আমি সেখান থেকে ছুটলাম।
লোকটার চেহারার বর্ণনা লোরেন বিশেষ কিছু দিতে পারলো না। কারণ অন্ধকারে বিরাট চোহারা বলেই মনে হয়েছে, এই পর্যন্ত।
ব্যাটল এবার জিমির কাছে জানতে চাইলেন।
–লোকটার গায়ে অসম্ভব জোর। এইটুকুই বলতে পারি, যখন ওর গলা টিপে ধরি তখন সে চাপাকণ্ঠে কয়েকটা শব্দ করে আমাকে ছেড়ে দাও গোছের। লোকটাকে অশিক্ষিত বলেই মনে হয়েছে।
–প্যাকেটটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলো কেন, বুঝতে পারছি না, লোরেন বললো।
-লোকটা ইচ্ছে করেই আপনাকে দেয়। ব্যাটল বললেন, আমার বিশ্বাস চোর আপনাকে যে মানুষ ভেবেছিল তাকে।
–ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে ঠেকছে, জিমি বললো।
–মিঃ থেসিজার, এ ঘরে আপনি আলো জ্বালান?
–হ্যাঁ।
–ঘরে তখন কেউ ছিল না?
–না, কেউ না।
আলো নিভিয়ে আপনি আবার দরজা বন্ধ করেন? বলতে বলতে সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল একটা স্পেনীয় চামড়ার পরদা টাঙানো দেখে এগিয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে ওটার পেছনে উঁকি দিলেন। অস্ফুট একটা আওয়াজ তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো।
ব্যাটলকে লক্ষ্য করে বাকিরা ছুটে গেল।
কাউন্টেস র্যাডকি মেঝের ওপর অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছেন।
.
কাউন্টেস র্যাডকির কাহিনী
অনেক কসরত করার পর কাউন্টেস র্যাডকির জ্ঞান ফিরে এলো। অস্ফুট স্বরে কিছু বলে উঠলেন।
ঠিক তখনই ঝড়ের বেগে ঢুকলো বিল। কাউন্টেসের মুখের সামনে ঝুঁকে পড়ে বোকার মত বলতে লাগলো।
কাউন্টেস, আমি বলছি, ভয়ের কিছু নেই। একটা আঘাত পেয়েছেন, কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলে শরীর চাঙ্গা হয়ে যাবে। সুস্থ হয়ে তারপর যা বলার বলবেন। একটু জল খাবেন? বান্ডল, একটু ব্র্যাণ্ডি…
দয়া করে ওকে চুপ করে থাকতে দাও বান্ডল বেশ রেগেই বললো, উনি ঠিক আছেন।
বান্ডল আবার কিছুটা জল কাউন্টেসের চোখে মুখে ছিটিয়ে দিলো। উনি ধড়মড় করে উঠে বসলেন। তিনি তার পাতলা রাতপোষাকটা ভালো করে জড়িয়ে নিলেন।
-সব মনে পড়ছে, বিড় বিড় করে বললেন, তিনি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সকলের মুখের দিকে তাকালেন, কারো চোখে সহানুভূতির স্পর্শ পেলেন না, একমাত্র বিল ছাড়া।
বিলকে লক্ষ্য করে কাউন্টেস বললেন, চিন্তা করবেন না, আমি ভালো আছি, আমাদের হাঙ্গেরিয়দের স্নায়ু ইস্পাতের মত মজবুত।
-এবার বলুন তো কি হয়েছিল? ব্যাটল প্রশ্ন করলেন।
এতক্ষণে তিনি দীর্ঘদেহী সুপারিন্টেন্ডেন্টের দিকে নজর দিলেন।
–আপনার ঘরে অমি গিয়েছিলাম। বান্ডল বললো, আপনি ঘরে ছিলেন না, বিছানাতেও শোননি
-হা হা, মনে পড়ছে, কাউন্টেস বললেন। কি ভয়ঙ্কর ঘটনা!
ব্যাটল বলে উঠলেন–যদি বলেন?
বিল সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, সুস্থ না মনে করলে এখন বলতে হবে না।
সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটলের দৃষ্টিকে কাউন্টেস অগ্রাহ্য করতে পারলেন না।
-আমার ঘুম আসছিল না। তাই বই নিয়ে বসলাম। কিন্তু পড়ায় মন বসলো না। বাড়িটা আমার কেমন যেন লাগছিল। তাই বাইরে বেরোলাম। নিচে নেমে এলাম। নিস্তব্ধ নিঝুম বাড়ি। নিঃশব্দে লাইব্রেরি ঘরে ঢুকে পড়লাম।
–নিঃশব্দে?
-হ্যাঁ, আমি কাউকে জাগাতে চাইনি। আলো জ্বেলে একটা বই খুঁজতে লাগলাম। আচমকা একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পেলাম। চাপা পায়ের শব্দ। ভয়াল সে পায়ের আওয়াজ এগিয়ে আসছিল। অমি আলো নিভিয়ে পর্দার আড়ালে আত্মগোপন করলাম। ঘরে ঢুকলো কেউ, সুইচ টিপে আলো জ্বাললো।
-হ্যাঁ কিন্তু, জিমি বলতে গিয়ে বাধা পেলো। ব্যাটল তাকে চুপ করার ইঙ্গিত করলেন
–নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইলাম, ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম। লোকটাও একটু থেমে শুনতে চাইলো। আবার পায়ের আওয়াজ।
জিমি আবার কিছু বলার চেষ্টা করলো।
কাউন্টেস বলে চললেন–সে জানলার কাছে গিয়ে মাথা বের করে কি দেখলো। তারপর ফিরে এসে আলো নিভিয়ে দরজা বন্ধ করলো। ঘরের মধ্যে লোকটা নিঃশব্দে ঘুরছে। আমি ভয়ে মরছি। যদি আমার অস্তিত্ব সে টের পায়। সে জানলার কাছে আবার গেল। আবার সব নিস্তব্ধ। ভাবলাম লোকটা চলে গেছে। তাই টর্চ জ্বালার উপক্রম করতেই ব্যাপারটা সেই মুহূর্তে ঘটে গেল।
-তারপর?
–জীবনে কোনোদিন ভুলবো না এ দৃশ্য। দুজন লোকের মধ্যে প্রচণ্ড মারামারি হচ্ছে। ওরা পরস্পরকে খুন করতে চাইছে। জিনিষপত্র লণ্ডভণ্ড হলো। কোথাও কোনো মেয়ে যেন চিৎকার করে উঠলো। লোকটা কেবল কর্কশ ও চাপা গলায় বলছিল, আমাকে ছেড়ে দাও। ইংরেজের মত গলার আওয়াজ।
-তারপর? ব্যাটল বললেন।
-তারপর গুলির শব্দ। আমার পাশের বইয়ের আলমারিতে গুলিটা লাগলো। আমি যে কখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি জানি না।
কাউন্টেসের কথামত সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল বইয়ের আলমারির কাছে এগিয়ে গেলেন এবং মেঝে থেকে কিছু কুড়িয়ে নিলেন।
–এটা বুলেট নয়, কাউন্টেস। ব্যাটল বললেন, বুলেটের খোল। মিঃ থেইজার, গুলি করার সময় আপনি কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলেন?
জানলার কাছে গিয়ে একটা জায়গা দেখলো জিমি।
-তাহলে গুলিটা আলমারির গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে জানলা দিয়ে। যদি আক্রমণকারীরা সেটা না নিয়ে পালায়, তাহলে কাল সকালে পেয়ে যাবো।
–আপনার হাতে ব্যান্ডেজ। কাউন্টেস সপ্রশংস দৃষ্টিতে জিমির দিকে তাকালেন, তাহলে আপনিই কি কিন্তু কি হয়েছিল সেটা আমি জানতে চাই।
ব্যাটল বললেন–স্যার স্ট্যানলি ডিগবির কাছ থেকে কিছু দরকারী রাজনীতি সংক্রান্ত কাগজ নিয়ে চোর পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু এই তরুণীটিকে ধন্যবাদ। চোরেরা তা পারেনি, তিনি লোরেনকে দেখালেন।
কাউন্টেস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–শরীরটা আবার খারাপ লাগছে।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য বিল তার হাত ধরলো। বান্ডলের হঠাৎ নজর কাড়লো কাউন্টেসের কাঁধের ওপর ছোট্ট কালো একটা আঁচিল যা তার পাতলা রাত্রিবাসের পোষাকের ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে। বান্ডল প্রায় কাঠ হয়ে গেল।
-এবার ঘর বন্ধ করে চাবি দিয়ে দেবো। সুপারিন্টেন্ডেন্ট বললেন, লেডি এইলিন, আপনি কিছু বলবেন?
-হ্যাঁ, এখুনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
এই সময় ঘরে এসে ঢুকলেন জর্জ লোম্যাক্স ও ডঃ কার্টরাইট।
–শোন ব্যাটল, ও’রুরকের বিশেষ কিছু হয়নি। কড়া ইনজেকশান তাকে দেওয়া হয়েছিল। কাল সকালেই ভালো হয়ে যাবেন।
ডাক্তারের সঙ্গে জিমি আর লোরেন চলে গেল।ব্যাটলের দিকে বান্ডল কাতর চোখে তাকালো।
ব্যাটল আগ্রহান্বিত হয়ে বললেন, স্যার স্ট্যানলি ডিগবির সঙ্গে একটু আড়ালে কথা বলা । যাবে কি?
নিশ্চয়। জর্জ বললেন, আমি ওকে ডেকে আনছি।
সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটল বান্ডলকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন এবং ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
বান্ডল সংক্ষেপে ওর সেভেন ডায়ালস-এ যাওয়া, সেখানে কি কি কথা শুনেছে, সব বলে গেল। শুনে ব্যাটলের একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো। এই প্রথম তার কঠিন মুখে শিথিলতা ফুটে উঠলো।
-আপনার মত মেয়েদের কোনা পূর্বাভাস দেওয়া বিপজ্জনক। আমি কল্পনা করতে পারিনি যে এতদূর আপনি এগোবেন।
–ঠিক আছে, আমার মৃত্যু আপনাকে ঝামেলায় ফেলতে চায়নি।
এখনও পর্যন্ত নয়। একটু থেমে ব্যাটল কি ভাবলেন। তারপর বললেন, জিমি থেসিজারের কাজটা বুঝলাম না, আপনাকে এরকম বিপদে ঠেলে দিলেন কেন, বুঝতে পারছি না।
-আগে ও জানতো না। বান্ডল বললো, তাছাড়া মিস ওয়েডকে নিয়েই সে ব্যস্ত।
-তাই নাকি? ব্যাটল একটু হাসলেন। তাহলে বিল এভারসেলকে বলবো, আপনার ওপর নজর রাখতে।
সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল, আপনি আমার কথার শেষটুকু শোনেননি। যে মহিলাকে দেখলাম–একনম্বর, উনি হলেন কাউন্টেস র্যাডকি।কাউন্টেসেরকাঁধেরআঁচিলেরকথা বান্ডল বললো।
ব্যাটল কেবল হাই তুললেন, কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য না করে বান্ডল বিস্মিত হলো।
গালে হাত বোলাতে বোলাতে ব্যাটল বললেন–দেখুন লেডি এইলিন, কাউন্টেসের ব্যবহার সন্দেহজনক, আপনাকে বিশ্বাস করে কথাটা বললাম। খুবই সন্দেহজনক, এ ব্যাপারে আপনার এবং আমার মত এক। দূতাবাসের সঙ্গে কোনো অপ্রিয় ব্যাপার ঘটানো ঠিক নয়। তাই আমাদের অত্যন্ত পা মেপে এগোতে হবে। পুঁটি মাছদের দিয়েই রুই কাতলা ধরা যাবে। অতএব চূড়ামণি একদিন ধরা পড়বেই।
.
সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল দায়িত্ব নিলেন
সকাল ছটা থেকে সুপারিন্টেন্ডন্ট ব্যাটল লাইব্রেরি ঘরে কাজ করলেন, তারই অনুরোধে বেলা দশটা নাগাদ ঘরে এসে ঢুকলেন স্যার অসওয়াল্ড কুট, জর্জ লোম্যাক্স এবং জিমি থেসিজার।
পাশের টেবিলে সাজানো রয়েছে নানা জিনিষপত্র যেগুলো পাওয়া গেছে। এর মধ্যে জিমির লিওপোল্ড-ও আছে।
–সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল, জর্জ বললেন। ভাবছিলাম কতখানি কাজ এগোলো। লোকটার হদিস পাওয়া গেল?
-ধরা সে পড়বেন, তবে সময় লাগবে। ব্যাটল জোরের সঙ্গে বললেন, দুটো বুলেট আমরা পেয়েছি। বড়টা সেডার গাছে বেঁধা অবস্থায়। ৪.৫৫ পেয়েছি যেটি মিঃ থেসিজারের কোল্ট থেকে বেরিয়েছিল। আর মাউসার-২৫ থেকে ছোটটা বেরিয়েছে। ওটা মিঃ থেসিজারের হাতের মধ্যে দিয়ে ঐ আরাম কেদারায় আটকায়।
পিস্তলে কোনো হাতের ছাপ পেয়েছেন? খুব আগ্রহ ভরে স্যার অসওয়াল্ড জানতে চাইলেন।
না, অপরাধীদের হাতে দস্তানা ছিল। আমি কি ঠিক বলছি, যে অসওয়াল্ড পিস্তলটা সিঁড়ির বিশ গজ দূরে পেয়েছিলেন?
জানলার দিকে মুখ রেখে স্যার অসওয়াল্ড বললেন–হবে হয় তো।
-স্যার, কিছু মনে করবেন না, পিস্তলটা যেখানে ছিল সেখানে ফেলে রাখলেই ভালো করতেন।
-আমি দুঃখিত, স্যার অসওয়াল্ড কাঠ হয়ে বললেন।
–আমি সবটাই পর্যালোচনা করেছি। বাগান থেকে আসা আপনার পায়ের ছাপ দেখেছি, নিচু হয়ে পিস্তলটা তোলায় ওখানকার ঘাসগুলো লেপ্টে গেছে। স্যার, আপনি কি বলতে পারেন, পিস্তলটা ওখানে গেল কেন?
-মনে হয় পালানোর সময় লোকটা ফেলে গেছে।
ব্যাটল মাথা নাড়লেন–সে ফেলে যায়নি। কারণ খামের ওপর একটা পায়ের ছাপ আছে সেটা আপনার স্যার।
-বুঝেছি, স্যার ওসওয়াল্ডকে চিন্তিত দেখালো।
–তুমি নিশ্চিত হয়ে বলছে, ব্যাটল, জর্জ প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ, আর একটু দূরে আর এটা পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে যেটা মিস ওয়েডের। সম্ভবতঃ পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলে।
কিন্তু মাটি দেখে মনে হয় লোকটা এই বারান্দা থেকে পিস্তলটা ছুঁড়েছিল। জর্জ বললেন, এর কি কোনো বিশেষ তাৎপর্য আছে?
–হয়তো নেই। ব্যাটল বললেন, স্যার অসওয়াল্ড আপনি জানলায় দাঁড়িয়ে পিস্তলটা একবার ছুঁড়ে ফেলবেন।
স্যার অসওয়াল্ড কাজটি করলেন।
দেখুন মাটিতে সেই একই দাগ পড়েছে। ব্যাটল বললেন।
এমন সময় দরজায় এসে দাঁড়ালেন লেডি কুট, হাতে জলের গ্লাস।
–অসওয়াল্ড, তুমি ওষুধ খেতে ভুলে গেছে। আমি জানি, নিজের হাতে না দিলে তুমি ওষুধ খেতে না, নাও, খেয়ে নাও। লেডি কুট বললেন।
স্যার অসওয়াল্ড ছোট ছেলের মত ওষুধটা খেয়ে নিলেন।
লেডি কুট ঘরের চারপাশে তাকিয়ে ক্ষণিকের জন্য চোখ বুজলেন, উঃ কি ভয়ঙ্কর সব পিস্তল। তারপর চোখ খুলে বললেন, কাল সারারাত কি আতঙ্কে যে কেটেছে। শেষ পর্যন্ত মিঃ বেটম্যান বললেন, অসওয়াল্ড বাইরে গেছে।
-স্যার অসওয়াল্ড বুঝি ঘুমোতে পারেননি? ব্যালট জানতে চাইলেন।
-আমার ঘুম এমনি স্বাভাবিক, স্যার অসওয়াল্ড বললেন। কিন্তগত রাতে ঘুম না আসাতে একটু বাইরে বেরিয়েছিলাম।
–আপনি এই জানলা দিয়ে বেরিয়ে আসেন?
স্যার অসওয়াল্ড উত্তর দিতে চাইছিলেন না চট করে। কি ভেবে বললেন-হা।
-পুরু জুতোটা না পরে। লেডি কুট কান্না ভোজা কণ্ঠে বললেন, আমি না থাকলে তুমি যে কি করবে?
–মারিয়া, আমরা এখন ব্যস্ত আছি, তুমি এখন যাও।
লেডি কুট বিদায় নিলেন।
–লোকটা তাহলে মিঃ থেসিজারকে গুলি করে পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলে বারান্দা দিয়ে পালায়, জর্জ লোম্যাক্স বললেন।
–আমার পাহারাদারদের হাতে লোকটা ধরা পড়ার কথা, ব্যাটল বললেন।
–তোমার পাহারাদার। তোমাদের দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কে জানা আছে। তাহলে মিস ওয়েড তোমাদের চোখে ধুলো দিয়ে কি করে ভেতরে ঢুকলো?
লোকটা বোধহয় অত্যন্ত ধড়িবাজ। ব্যাটল হাসি মুখে বললেন। কথাটা বলছি এই কারণে যখন গুলি ছোঁড়া হয় তার পঞ্চাশ সেকেন্ডের মধ্যে সেখানে গিয়ে হাজির হই। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে লোকটা বেপাত্তা হয়ে গেল।
-ব্যাটল, তোমার কথা স্পষ্ট হচ্ছে না আমার কাছে। হয়তো তোমার নিজস্ব মত থাকতে পারে, যেটা আমার জানা নেই। লোকটা বাগান পেরিয়ে বা পথ দিয়ে যায়নি। তাহলে লোকটা গেল কোথায়?
মিঃ লোম্যাক্স, লোকটার যদি পালানোর ইচ্ছে থাকতো তাহলে সে বাড়িতে ঢুকতো না। তার পক্ষে এই বাড়িই নিরাপদ।
-কিন্তু যখন আমরা আসি তখন মিঃ ও’রুরকের ঘর ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।
–স্যার স্ট্যানলির ঘরের মধ্যে দিয়ে যে যাবে। দরজার হাতল নাড়তে দেখেছেন লেডি এইলিন। তখনই প্রথমবার আমাদের এই বন্ধু ঘরের মধ্যে ছিলেন। দ্বিতীয়বার বেরিয়েছে স্যার স্ট্যানলির ঘরের মধ্যে দিয়ে, তখন ওটা খালি ছিল। কারণ তখন সবাই লাইব্রেরির দিকে ছুটেছিল। অতএব লোকটির রাস্তাও পরিষ্কার।
-তবে লোকটি গেল কোথায়?
সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল তার শক্ত চওড়া কাঁধ ঝাঁকালেন–বেরোবার পথ আছে অনেক। কিন্তু যে ভেতরের সে কি বাইরে বেরোবার চেষ্টা করবে?
জর্জ বিস্ময়ে হতবাক হলো।
–ভীষণ ঝামেলায় পড়লাম। ব্যাটল, আমার পরিচারকেরা সকলেই বিশ্বাসী। তাদের সন্দেহ করার মত কিছু নেই। জিমি তার নজর কাড়ার জন্য টেবিলের দিকে তাকালো।
–এ জিনিষটা কি? ও বললো।
–এ হলো এক্সিবিট নং-জেড, ব্যাটল বললেন। এটাই শেষ, আর একটা দস্তানা।
–কোথায় পেয়েছেন? স্যার অসওয়াল্ড জানতে চাইলেন।
-আধপোড়া অবস্থায় ঐ চুল্লীর মধ্যে থেকে পেয়েছি। ব্যাটল বললেন। যেন কুকুরে চিবিয়েছে।
মিস ওয়েডের অনেক কুকুর আছে। মনে হয় এটা তার।
জিমি দস্তানাটা হাতে পরে নিলো।
-না, আপনার হাতেও বড়।
স্যার অসওয়াল্ড নিস্পৃহ গলায় বললেন, এ সবের কোনো গুরুত্ব আছে?
–কখন যে কোনটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, কেউ বলতে পারে না।
এমন সময় দরজায় আওয়াজ করে ঘরে ঢুকলো বান্ডল।
–আপনাদের বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। বান্ডল বললো, বাবা আমাকে এখুনি ফিরে যেতে বললেন। মনে হলো, এর সঙ্গে এখানকার কোনো যোগাযোগ আছে। তাই আপনাদেরকে জানালাম যে আমাদের একজন ফুটম্যান গতরাতে বেরিয়ে আর ফেরেনি। বাবা খুব চিন্তায় আছেন।
–লোকটার নাম কি? জর্জ প্রশ্ন করলেন।
–জন বাওয়ার। আমার ধারণা ও জার্মান। অবশ্য ভলো ইংরেজি বলে।
–লোকটি কতদিন চিমনিতে ছিল? হিস হিস করে উঠলেন অসওয়াল্ড।
–এক মাসের কিছু কম।
অন্য দুজনের দিকে তাকিয়ে স্যার ওসওয়াল্ড বললেন, লোম্যাক্স তুমি নিশ্চয় জানো, কত বিদেশী সরকার এই জিনিষটার পেছনে ঘুরছে। এই সেই হারিয়ে যাওয়া লোক। আমরা চলে যাওয়ার পনেরো দিন আগে আসে। নতুন চাকর এলে এখানে খোঁজখবর নেওয়া হয়। কিন্তু চিমনিতে তা হতো না।
–তার মানে পরিকল্পনা আগেই তৈরি হয়?
-বাওয়ার নিশ্চয়ই চিমনিতে আমার গোপন কাগজপত্র ঘেঁটেছে। লক্ষ লক্ষ টাকা ছড়িয়ে আছে ঐ ফর্মুলার সঙ্গে। বাড়ির ভেতরে তার কোনো লোক আছে যে মিঃ ও’রুরকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। আইভি লতা বেয়ে বাওয়ারকেই উঠতে দেখেন মিস ওয়েড।
.
বান্ডলের চিন্তাধারা
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দক্ষ গোয়েন্দা যে একটু আশ্চর্য হলেন সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
জর্জ বললেন, স্যার অসওয়াল্ড, ঠিকই বলেছেন। ঐ লোকটাই সেই লোক। তাকে ধরা যাবে?
–সেটাই স্বাভাবিক। অবশ্য লোকটি যদি চিমনিতে ফিরে আসে। যদি বাওয়ার হয়, তাহলে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে সে এখানে এলো কি করে?
–তবে আপনার লোকেরা সব অপদার্থ। আপনাকে অবশ্য দোষ দেবো না।
-বুঝেছি। ব্যাটল বললেন। যাই, আমাকে এখুনি টেলিফোন করতে হবে। তিনি দ্রুত পায়ে চলে গেলেন।
বান্ডল আর জিমি বাগানে চলে এলো।
–জিমি বান্ডলকে পিস্তল ছুঁড়ে ফেলার ঘটনা বললো।
-বান্ডল, গভীর জলের মাছ হলেন সুপিরেন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল। কিছু একটা আন্দাজ করেছেন নিশ্চয়।
বান্ডল গত রাতের কথা জানালো জিমিকে।
-তাহলে এক নম্বর হলেন কাউন্টেস এবং দুই নম্বর চিমনি থেকে আসা বাওয়ার। তার মানে ওদের পরিকল্পনা ছিল এইরকম, কাউন্টেস ওষুধ খাইয়ে ও’রুরকে অচৈতন্য করে রাখবে। বাওয়ার তখন ঘরে ঢুকে কাগজপত্রগুলো আত্মসাৎ করবে এবং জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবে কাউন্টসের দিকে। কাউন্টেস সেগুলো নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে আসবেন। আর বাওয়ার ভালো মানুষের মত বেরিয়ে আসবে। কিন্তু ওদের ছক উল্টে যায় আমার জন্য। আমার পায়ের শব্দ পেয়ে কাউন্টেস পর্দার আড়ালে গিয়ে লুকোন। তার সহকারীকে যে সতর্ক করবেন তার সুযোগও পাননি তিনি। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী বাওয়ার কাগজপত্রগুলো ছুঁড়ে ফেলে দেয়। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা লোরেনের দিকে, কাউন্টেস মনে করে। তারপর আইভি লতা বেয়ে নামতে গিয়ে আমার মুখোমুখি হয়ে যায়। অবশ্য কাউন্টেস গল্পটা বেশ জব্বর বানিয়েছেন।
-কিন্তু সাত নম্বরের খবর কি? নক্ষত্রদের লোকটিকে নাকি কখনো দেখা যায় না। আমার বিশ্বাস, ঐ নম্বরটি এই বাড়িতেই আছে।
–বিল কি ভাবছে?
–আহ, ওর কথা বাদ দাও। বান্ডল নিরুত্তর কণ্ঠে বললো।
–আমার মনে হয় ওকে সতর্ক করে দেওয়া উচিত। নতুবা কাউন্টেসকে সব ভুর ভুর করে বলে দেবে।
–কাউন্টেসের বিরুদ্ধে কোনো কথা ওরা কানে যাবে না। ও একটা গাধা। ওকে তাই আঁচিলের কথাটা বলা দরকার।
-ওসব বাদ দাও। জিমি বললো, ব্যাটল, চাইছেন, কাউন্টেসকে যেন এ ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন না করি, তাই তো?
-হ্যাঁ।
–তার মানে, কাউন্টেস হলেন তার টোপ। ঐ টোপ ফেলেই উনি মাছ গাঁথবেন ছিপে।
হতে পারে।
এমন সময় জর্জ লোম্যাক্স হাজির হলেন। জিমি দ্রুত ওখান থেকে সরে পড়লো।
জর্জ বান্ডলের পাশে বসলেন।–প্রিয় এইলিন, তুমি সত্যিই চলে যাচ্ছে।
-হ্যাঁ, বাবা খুব চিন্তায় আছেন।
বান্ডলের হাত নিজের হাতে নিয়ে জর্জ বললেন, উচ্চ এই হাতদুটি আমার প্রিয়। তোমার মতকে আমি অসম্মান করি না। বর্তমানের এই পরিবর্তিত অবস্থায়
নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছে-বান্ডল ভাবলো।
–আমি পুরানো মূল্যবোধের কথা বলছি। জর্জ আবার বলতে লাগলেন, তোমার যৌবনের সুবিধাকে আমি হিংসা করি। আমি চাই তুমি নানা বিষয়ে পড়াশোনা কর। আমার সম্পর্কে তোমার যেন কোন ভয় না থাকে, সেটাও আমি চাই।
-ধন্যবাদ। বান্ডল বললো।
–প্রিয় এইলিন, তুমি আমাকে ভয় পেয়ো না। এটা আমার অনুরোধ। আমাকে তোমার রাজনৈতিক গুরু ভাবতে পারো। তোমার বিখ্যাত কাকিমা লেডি কেটারহ্যামের নীতি তুমি হয়ত অনুসরণ করতে পারো।
এই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের কথা ভেবে বান্ডল ঘাবড়ে গেল। কিন্তু মুখে কিছু বললো না।
-প্রিয় এইলিন, রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে আমি কাজ করছি। তুমি এটা চিমনিতে নিয়ে গিয়ে পড়তে পারো। তারপর এ সম্পর্কে তোমার সঙ্গে আলোচনা করবো।
জর্জ চলে গেলেন। কিন্তু বান্ডলকে একটা আচ্ছন্নতার মধ্যে রেখে গেলেন। বিল আসতে তার চমক ভাঙলো।
কডার্স তোমার হাত নিয়ে কি করছিল? বিল প্রশ্ন করলো, মনে রেখো, ওর নজর যদি তোমার ওপর পড়ে তাহলে ওর রেহাই নেই আমার হাত থেকে।
–দুঃখিত বিল, বান্ডল বললো, তোমার কি ধারণা, জিমি এখানে খুব ঝুঁকি নিয়েছিলো?
–জিমি ফাঁদে পড়লে বুঝতে পারবে।
–ফাঁদে জিমি নয়, আমি পড়েছি। বান্ডল বললো, আমাকে মিসেস মার্কাটার সঙ্গে দেখা করতে হবে, রাজনৈতিক অর্থনীতি পড়তে হবে এবং জর্জের সঙ্গে সে বিষয়ে আলোচনায় বসতে হবে। এর যে পরিণতি কি, তা একমাত্র ঈশ্বর জানেন।
-জর্জ মহিলাদের পার্লামেন্টে যাওয়া পছন্দ করে না। বিল সান্ত্বনা দিলো ওকে। তোমাকেও বক্তৃতা দিতে হবে না। চলো কিছু পান করা যাক।
ওরা এগিয়ে গেল। হলঘরের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে ওরা দাঁড়ালো। পাশের ঘরে ব্যাটল কিছু গলফ খেলার ক্লাব নিবিষ্ট মনে পরীক্ষা করছেন।
–গলফ খেলতে যাচ্ছেন নাকি? সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল, বান্ডল প্রশ্ন করলো।
-এর থেকেও খারাপ কিছু করতে পারি, লেডি এইলিন। যে কোনো খেলায় জয়ী হওয়ার গুণ আমার আছে। আর জানেন তো কোনো কিছু শিখতে বয়সের মাপকাঠি থাকে না।
ব্যাটল ওদের সঙ্গে পা মেলালেন।
.
পরিকল্পনা ছকে নিলো জিমি
জিমি খুব ভেঙে পড়েছিল। তাই সে ইচ্ছে করেই জর্জকে এড়িয়ে চলে এসেছিলো। ওর কাছে এলো লোরেন। ওরা একসঙ্গে বাগানে বেড়াতে বেরোলো।
-লোরেন!
–বল।
-আমি ঠিক সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে পারি না, জিমি বললো, আমি বলতে চাইছি যে আমরা দুজনে বিয়ে করতে পারি না।
আচমকা জিমির প্রস্তাব শুনে লোরেন কিন্তু ঘাবড়ে গেল না। ও উল্টে হেসে ফেললো।
-তুমি হাসছো কেন, লোরেন। একটা কিছু বলো।
– তোমাকে দেখে মজা লাগছে।
–তুমি অত্যন্ত পাজি মেয়ে।
–না, মোটেও তা নয়।
–যাক, হ্যাঁ কি না বলো।
-এখন এর জবাব দেওয়ার সময় আসেনি জিমি। লোরেন নরম সুরে বললো, আমরা এখনও বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
-জিমির মুখ থমথমে হয়ে উঠলো।-তুমি হয়তো ঠিক বলছো। বান্ডলের কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে সাত নম্বরকে খুঁজে বের না করা পর্যন্ত আমরা বিপদের মধ্যে থাকবো।
–আর বাকিরা?
–তাদের চিন্তা আমার করার কথা নয়। সাত নম্বর যে কে জানি না। ওর কাজের গতিবিধিকে ভয় পাচ্ছি।
-জেরির মৃত্যুর পর থেকে আমিও আতঙ্কিত হয়ে আছি।
-তুমি ভয় পেয়ো না লোরেন। ওটা আমার দায়িত্ব। সাত নম্বরকে খুঁজে বের করে বাকিদের ঠিক শায়েস্তা করবো।
–তোমাকে যদি সে ধরে।
–আমি অনেক বেশি চালাক। আমাকে ধরা সম্ভব নয়।
–মনে হয় তোমার কোনো পরিকল্পনা আছে। বলবে?
–উঁহু, তরুণ বীর সবকিছু গোপনে রেখে কাজ হাসিল করে।
–তুমি একটা গর্দভ।
–জানি, অনেকের মুখেই একথা শুনছি। জিমি বললো। তবে অনেকেই মাথা ঘামাচ্ছে। তোমার কোনো মতলব আছে নাকি?
–বান্ডলের সঙ্গে চিমনিতে যেতে বলেছে।
–খুব ভালো। ও যা মেয়ে, কখন কি করে বসবে। ওর ওপর নজর রাখা প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে বিল আছে। লোরেন বললো, তুমি ভাবছো, বিল কাউন্টেসকে নিয়ে ব্যস্ত, তা নয়। বান্ডলের ব্যাপারেও আহ্লাদিত। আজ সকালে লক্ষ্য করলাম, মিঃ লোম্যাক্স বান্ডলের হাত ধরে কি যেন বলছিলেন। ব্যাস, বিল ক্ষেপে লাল। ছুটলো ঝড়ের মত।
–মানুষের মন বোঝা দায়। আমি তোমাকে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, বিল কাউন্টেসের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। বান্ডলের ধারণাও এক।
-বান্ডলের ভাবা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু আমি বলছি, তুমি সম্পূর্ণ ভুল ভেবেছো।
–তাহলে আসলে কি?
–বিল নিজে কোনো তদন্ত করছে না তো? ওরকম পেশীওয়ালা ছেলে যখন সূক্ষ্ম নয় তখনই সন্দেহ দানা বাঁধে।
–ছাড়ো ওসব কথা। তুমি যা কিছু ভাবো। এখন দয়া করে চিমনিতে গিয়ে বান্ডলের ওপর নজর রাখবে। ও যেন সেভেন ডায়ালস-এ আর না যেতে পারে সেদিকে সতর্ক থাকবে। একটা কথা বলার জন্য এবার আমাকে লেডি কুটের কাছে যেতে হবে।
লেডি কুট বাগানে বসে উলের সোয়েটার বানাচ্ছিলেন। জিমি তার পাশে বসে তার হাতের কাজের প্রশংসা শুরু করলো।
–হাত কেমন আছে? লেডি কুট জানতে চাইলেন।
–ভালো। তবে ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে।
-একটু সতর্ক হয়ে চলাফেরা করবেন কিন্তু। লেডি কুট জননী সুলভ কণ্ঠে বললেন আপনারা এবার যাচ্ছেন কোথায়?
ডিউক অ্যানটনের বাড়িটা স্যার অসওয়াল্ড নিয়েছেন। লেডি কুট লম্বা একটা নিশ্বাস ফেললেন। লেদারবাড়িতে ওটা। বোধ হয় এর কথা জানেন আপনি?
–বিশেষ কিছু জানি না। তবে নামী জায়গা বলে শুনেছি।
হতে পারে। তবে মস্ত বড় বাড়ি। ভয়ঙ্কর সব মানুষের গাদা গাদা ছবি আছে গ্যালারিতে।
মিঃ থেসিজার আপনি যদি তখনকার ইয়র্কশায়ারের ছোট বাড়িটা দেখতেন ভারি ভালো লাগতো। তখন স্যার অসওয়াল্ড কেবল মিঃ কুট ছিলেন।
–নিশ্চয়ই, স্যার অসওয়াল্ড নিজেও একখানা বাড়ি কিনবেন! আপনি তখন নিজের খুশী মনে বাড়ি সাজাতে পারবেন।
–মনে হয় সেটার দায়িত্ব কোনো কোম্পানিকে দিচ্ছেন, বিষাদ ভরা গলায় লেডি কুট বললেন।
তিনি স্যার অসওয়াল্ডের সম্পর্কে বলতে ব্যস্ত। বলতে থাকলেন–উনি কেবল নিজের উন্নতির পেছনে ছুটতে জানেন। অথচ দেখুন, স্যার অসওয়াল্ড হলেন ইংল্যান্ডের সেরা ধনী। কাজ করতে করতে কখন যে অসুস্থ হয়ে পড়বেন, ভেবে আমার ভীষণ ভয় হয়। লেডি কুটের চোখে জল এসে গেল। জিমি সবজান্তার মত মাথা দোলালো।
তবে একটু আশ্বাস পাই ঐ মিঃ বেটম্যান আছে বলেন। উনি ওর বিচারবুদ্ধির প্রশংসা করেন। ওর মনে হয় মিঃ বেটম্যান সবসময়েই ঠিক।
জিমি বললো–আপনাদের সঙ্গে চিমনিতে গত সপ্তাহে বেশ আনন্দে কাটিয়েছি। বেচারি জেরি মারা গিয়েই সব
–আচ্ছা, ওখানে এমন কোনো মেয়ে নেই, লেডি কুট আচমকা প্রশ্নটা করলেন, যাকে বিয়ে করে সংসার করতে ইচ্ছে করে আপনার?
লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো জিমি, একটু ইতস্ততঃ ভাবে ফুটে উঠলো।
–আপনি তো ভেরা ডেভেনট্রির সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, অবশ্য এটা আমার ধারণা।
–আপনি শকস-এর কথা বলছেন? ওর সঙ্গে আমার দেখা করার ইচ্ছে আছে।
–সে এখানে থাকতে আসছে। আগামী সপ্তাহের শেষে আসবে।
–বাঃ, তাহলে খুব মজা হবে। জিমি উৎফুল্লতা প্রকাশ করলো।
–আপনি আসবেন।
–হ্যাঁ, আসবো। ধন্যবাদ লেডি কুট। জিমি ওখান থেকে সরে পড়লো।
খানিক পরেই স্যার অসওয়াল্ড এসে হাজির হলেন।
-ঐ ছোরা তোমাকে জ্বালাচ্ছিল কেন? ছেলেটিকে আমার একদম পছন্দ হয় না। স্যার অসওয়াল্ড বললেন। সব ব্যাপারে ওস্তাদি করা ওর স্বভাব।
-না, না অসওয়াল্ড, তোমার ধারণা ভুল। লেডি কুট পাল্টা জবাব দিলেন। ও খুব সাহসী। দেখলে না গত রাতে বিপদের মুখোমুখি হয়ে নিজেই কিভাবে আহত হলো।
–ছেলেটি কুড়ের বাদশা। জীবনে প্রথম ভালো কাজ করতে দেখলাম। স্যার অসওয়াল্ড বিরক্তি প্রকাশ করলেন।
গত রাতে তোমার বাইরে বেরোনো উচিত হয়নি। নিউমোনিয়া না হলে বাঁচি। একটা খুনী ঘুড়ে বেড়াচ্ছিল। তোমায় গুলি করতে পারতো। তাই তো ওকে আমি সপ্তাহের শেষে এখানে থাকতে বলেছি।
–মোটেই তুমি এটা ভালো করোনি। স্যার অসওয়াল্ড বললেন। ওকে আমি কিছুতেই এখানে ঢুকতে দেবো না, মরিয়া। বেটম্যানের কাছ থেকে অনেক কিছু শুনেছি ওর সম্বন্ধে। ছেলেটি ওর সঙ্গে একই স্কুলে পড়াশুনা করতো।
–মিঃ বেটম্যানের কাছ থেকে কি শুনেছো? লেডি কুট জানতে চাইলেন।
–ওর ব্যাপারে আমাকে সাবধান করে দিয়েছে। বেটম্যানের কথা আমি এড়াতে পারি না। ওর ওপর আমার বিশ্বাস আছে যথেষ্ট।
–তাহলে ভুল আমি করে বসেছি। আগে যদি জানতাম, লেডি কুট বলতে থাকেন, তাহলে ওকে থাকতে বলতাম না। বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
লেডি কুট এগিয়ে চললেন।
স্যার অসওয়াল্ড তার দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকালেন।
স্বামীকে তিনি খুব ভালোবাসেন কথাটা ভাবতে গিয়ে লেডি কুটের ঠোঁটে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠলো।
৫. প্রধানতঃ গলফের কথা
এক সপ্তাহ ধরে লোরেন চিমনিতে রয়েছে। লর্ড কেটারহ্যামের কাছে গলফ খেলা শিখে সে প্রশংসা অর্জন করেছে।
-বান্ডল, লর্ড কেটারহ্যাম বললেন, লোরেন খুব ভালো মেয়ে।
গলফ খেলায় লর্ড কেটারহ্যাম ভীষণ পারদর্শী। গলফ বলে শট নেওয়া তার দৈনন্দিন কাজের মধ্যে পড়ে।
-জানিস তো, ওকে ভালো করে খেলাটা শেখাচ্ছি। কটা যা শট মেরেছে, দারুণ। লর্ড কেটারহ্যাম বললেন।
-বাবা, ম্যাকডোনাল্ড কুটদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার জন্য বেশ শাস্তি ভোগ করেছে। বান্ডল অন্য প্রসঙ্গে এলো।
-কেন? আমার বাগানে আমি ইচ্ছেমত কাজ করতে পারি না? আমার ইচ্ছেটাই মাকডোনাল্ড প্রাধান্য দেয়। গলফের ব্যাপারে ঐ কুটরাও মন্দ নয়।
এমন সময় ট্রেডওয়েল এসে জানালো, মিঃ থেসিজার বান্ডলের সঙ্গে কথা বলতে চান ফোনে।
লোরেনকে সঙ্গে নিয়ে বান্ডল ছুটলো ফোনের কাছে।
-হ্যালো, জিমি নাকি?
–হ্যালো, কেমন আছো?
–খুব ভালো।
–লোরেনের খবর কি?
–দারুণ। কথা বলবে? ও এখানেই আছে।
-ওর সঙ্গে পরে কথা বলছি। শোন বান্ডল, আগামী সপ্তাহের শেষে আমি কুটদের বাড়িতে যাচ্ছি সময় কাটাতে। তুমি কি বলতে পারবে, সব-খোল চাবি কোথায় পাবো?
–তুমি কি ওদের বাড়ি সব-খোল চাবি নিয়ে যাবে? কিন্তু এ ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই।
–এটার দরকার হতে পারে। ভাবলাম, তোমার যথেষ্ট বুদ্ধি। একটা উপায় বাতলে দিতে পারো। তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। এখন দেখছি স্টিভেনসকে বলতে হবে। আমি অপরাধ জগতের সঙ্গে মিশে গেছি, এটা হয়তো ও ভাববে।
–জিমি, একটা কথা মনে রেখো, সব সময় হুশিয়ার হয়ে থাকতে হবে। ঐ সব-খোল চাবি নিয়ে তোমাকে ঘোরাফেরা করতে দেখলে স্যার অসওয়াল্ড ব্যাপারটা খুব জটিল করে দিতে পারেন।
–মেনে নিলাম তোমার কথা। কিন্তু পঙ্গো যেমন বেড়ালের মতো নিঃশব্দে সব জায়গায় হঠাৎ আবির্ভূত হয়, তাই ভয়টা ওকে নিয়েই বেশি আমার।
-বেশ ত তোমার ওপর নজরদারি করার জন্য আমি আর লোরেন ওখানে যেতে পারি।
-ধন্যবাদ। কিন্তু আমার একটা পরিকল্পনা আছে। মনে করো, লেদারবাড়ির কাছে তোমাদের দুজনের একটা গাড়ি দুর্ঘটনা হলো। ওটা কতটা দূরে হবে?
–চল্লিশ মাইল। এমন কিছু নয়।
-বেশ, তোমরা বারোটা, সাড়ে বারোটা নাগাদ কাজটা সারবে। দেখো, লোরেনের মৃত্যু যেন না হয়। ও আমার ভালোবাসা।
তার মানে, তুমি বলতে চাইছে তাহলে ওরা আমাদের লাঞ্চের জন্য নেমন্তন্ন করবে?
–ঠিক ধরেছে। ও’রুরকেও থাকছেন সেখানে। জানো শকসের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।
–আচ্ছা জিমি, তোমার কি ধারণা
সন্দেহের দৃষ্টি থেকে কাউকে বাদ দিতে নেই, বুঝেছো। গোপন সভায় তিনি থাকতে পারেন। তিনি এবং কাউন্টেস একজোট হতে পারেন। গত বছর তিনি হাঙ্গেরিতে গিয়েছিলেন।
-ফর্মুলাটা তো তিনি যখন খুশী নিজের হাতের মধ্যে নিতে পারতেন?
-যাতে কেউ তাকে সন্দেহ না করে, এমন ভাবে নেওয়া সম্ভব হতো না তার পক্ষে। শোন, তোমাদের মত সুন্দরীদের পক্ষে কোনো কাজ অসম্ভব নয়। তোমরা দুজনে মধ্যাহ্নভোজ পর্যন্ত পঙ্গো আর ও’রুরকে আটকে রাখবে।
-বুঝলাম। এবার লোরেনের সঙ্গে কথা বলো জিমি।
.
রাতের অ্যাডভেঞ্চার
রোদ ঝলমল করা এক বিকেল। জিমি হাজির হলো লেদারবাড়িতে। লেডি কুট এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানালেন। ঠান্ডা বিতৃষ্ণা ফুটে উঠেছে স্যার অসওয়ার্ল্ডের দৃষ্টিতে।
জিমি নিজেকে আদর্শবাদী প্রমাণ করার চেষ্টা করলো শকস ডেভেনট্রির কাছে।
ও’রুরকে ভীষণ খুশীতে ছিলেন। তিনি সে রাতের অ্যাবীর ঘটনার ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা করে গেলেও শকসের প্রশ্নের দাপটে এমনভাবে বর্ণনা দিলেন যে কোনটা সত্যি, আর কোনটা মিথ্যে সেটা উদ্ধার করা কষ্টকর ব্যাপার।
–চারজন মুখোস পরা লোক! তাদের হাতে একটা করে রিভলবাস? বাপরে! শকসের মূৰ্ছা যাওয়ার উপক্রম।
–প্রায় ছজন লোক আমাকে চেপে ধরেছিল মনে পড়ছে। জোর করে আমাকে হাঁ করিয়ে কিছু দেওয়া চেষ্টা করছিল। ভাবলাম বিষ, মৃত্যু আমার শিয়রে নিশ্চিত।
–কি খোয়া গেল?
-ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ডে জমা দেওয়ার জন্য মিঃ লোম্যাক্সকে পাঠানো রাশিয়ার রত্ন ছাড়া আর কি?
–আপনি ভীষণ মিথ্যে কথা বলেন। শকস জোরালো অভিযোগ করলো।
-আমি মিথ্যে বলছি? যা বলছি সম্পূর্ণ গোপন ইতিহাস। আচ্ছা, বিশ্বাস না হয় মিঃ থেসিজারকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে। অবশ্য ও যদি অন্য কিছু বলে তার জন্য আমি দায়ী নই।
–মিঃ লোম্যাক্স তার নকল দাঁত না পরেই নিচে নেমে আসেন, এটা কি সত্য? শকস জানতে চাইলো।
–দুটো রিভলবারও ছিল। লেডি কুট ফোড়ন দিলেন। কি ভয়ঙ্কর দেখতে।
–ফাঁসিতে ঝোলার জন্য আমার জন্ম। জিমি বললো।
-একজন রুশী কাউন্টেস নাকি ছিলেন, শকস বললো, বেশ সুন্দরী। বিলকে সহজে কবজা করে নিয়েছিলেন।
–হাতটা কেমন আছে? লেডি কুট জানতে চাইলেন।
–বেশ ভালোই। বাঁ-হাতে আপাততঃ কাজ চালিয়ে নিচ্ছি।
–সব বাচ্চাকেই দুহাত ব্যবহার করা শেখানো উচিত। স্যার অসওয়াল্ড বলে উঠলেন।
–সরকারী অফিসে ডান হাত বাঁ হাতের কথা না জানলে ভালো হতো, মিঃ ও’রুরকে
জানালেন।
–আপনি দুহাত ব্যবহার করেন?
–না, আমি ডান হাতে কাজ করি।
–কিন্তু আমি সেদিন দেখলাম আপনি বাঁ হাতে তাস বাঁটছেন, মিঃ বেটম্যান বলে উঠলেন।
–সেটা আলাদা ব্যাপার। মিঃ ওরুকে নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেন।
রাতের খাওয়া-দাওয়ার পরে আসর বসলো ব্রিজ খেলার।
এরপর কেটে গেল দুটি ঘণ্টা।
জিমি পায়ে কোনো আওয়াজ না করে সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে এলো। রান্নাঘরে একবার উঁকি দিলো। তারপর সোজা পা চালালো স্যার অসওয়াল্ডের স্টাডিরুমের দিকে। টেবিলের ড্রয়ার টেনে দেখলো। কয়েকটা তালা লাগানো। ও একটা তার লাগিয়ে সহজেই ড্রয়ারগুলি খুলে ফেললো৷ কাগজপত্রগুলো ঘেঁটে দেখলো। তারপর আবার জায়গামত গুছিয়ে রেখে দিলো।
জিমি খুঁজছিল সেই তথ্য, হের এবার হোর্ডের সেই ফর্মুলার কোনো উল্লেখ যার সাহায্যে রহস্যময় সাত নম্বরের পরিচয় জানা যায়। কিন্তু কিছু না পেয়ে সে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ করলো। সেই সময় কানে এলো একটা চাপা শব্দ; বুঝলো, হল ঘরে দ্বিতীয় একজন আছে, এটা নিঃসন্দেহে। হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল তার। সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আলো জ্বালালো ঘরের মধ্যে তীব্র আলোয় ও চোখের সামনে দেখতে পেলো মাত্র কহাত দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে রিউপার্ট বেটম্যান।
-হা ভগবান। জিমি নিজেকে সামলে নিলো পঙ্গো তুমি অন্ধকারে এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছো?
–একটা শব্দ শুনে দেখতে এলাম চোর ঢুকেছে ভেবে। বেটম্যানের পায়ে রবার সোলের জুতো জিমির দৃষ্টি এড়ালো না।
–সর্বত্র তোমার চোখ দুটি বিচরণ করে দেখছি। ওর পকেটের দিকে লক্ষ্য করে জিমি বললো, মারাত্মক অস্ত্রও সঙ্গে আছে।
-কখন কোন বিপদে পড়বো, আগে থেকে তৈরি থাকা ভালো।
–ভাগ্যিস, তুমি গুলি করোনি।
–হ্যাঁ, তোমার কপাল ভালো, তাই বেঁচে গেলে এ যাত্রা।
-তাহলে আর একটু হলেই একজন নিরীহ অতিথিকে খুন করছিলে, এটা আইনত অপরাধ। মনে রেখো আর ভবিষ্যতে আরো সাবধানী হয়ো।
–তুমি এখানে কি করছিলে? পঙ্গো প্রশ্ন করলো।
-ভীষণ খিদে পেয়েছে। তাই ভাবলাম, এখানে কিছু বিস্কুট পাওয়া যায় কিনা। অবশ্য আমার বিছানার পাশে একটা বিস্কুটের কৌটো আছে যার উপরে রয়েছে উপোসী অতিথিদের জন্য। অথচ খুললে দেখবো, টিন খালি। অগত্যা নিচে নেমে এলাম।
জিমি ওর ড্রেসিং গাউনের পকেট থেকে বেশ কিছু বিস্কুট বের করে ওকে দেখালো। মুখে ওর মিষ্টি হাসি, চোখে বুদ্ধির পরিচয়।
শিং-এর ফ্রেমের মধ্যে দিয়ে পঙ্গো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জিমিকে লক্ষ্য করলো।
জিমি যেন ওকে তোয়াক্কা করে না এমন একটা ভঙ্গী করে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো। বেটম্যানও তার পেছন পেছন হাঁটা দিলো।
নিজের ঘরের দরজার কাছে এসে জিমি বললো, শুভরাত্রি পঙ্গো।
–বিস্কুটের ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন গোলমেলে ঠেকছে, বেটম্যান চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, যদি দেখি বেচাল কিছু তাহলে?
–নিশ্চয়ই, দেখো।
বেটম্যান জিমির ঘরে ঢুকে বিস্কুটের টিন দেখে হাঁ। ভেতর ফাঁকা।
-কি বিশ্বাস হলো। জিমি বললো, এবার শুভরাত্রি।
বেটম্যান ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। জিমি তার বিছানায় বসে কান পেতে রইলো।
-খুব সন্দেহ ঐ পঙ্গোর। জিমি নিজের মনে উচ্চারণ করলো। অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। রাত্রি বেলা না ঘুমিয়ে রিভলবার নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এক বাজে অভ্যাস।
এবার সে বিছানা থেকে নামলো। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে কাগজপত্রের মধ্যে থেকে কতগুলো বিস্কুট বের করলো।
এখন ইচ্ছে না থাকলেও এগুলো পেটে চালান করতে হবে। নতুনবা কাল সকালে পঙ্গো যদি এসে দেখে
বেজার মুখে সে বিস্কুট একটা একটা করে চিবোতে লাগলো।
.
সন্দেহ
বান্ডল ওর হিসপানোকে একটা গ্যারেজে রেখে ঠিক বারোটার সময় পার্কের গেট দিয়ে লোরেনকে নিয়ে ঢুকলো।
লেটি কুট ওদের দুজনকে বেশ অবাক হয়ে অভ্যর্থনা করলেন। বেশ খুশী মনেই তিনি ওদের মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়ন করলেন।
একটা বিশাল আরাম কেদারায় মিঃ ও’রুরকে শুয়েছিলেন। তিনি লোরেনের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠলেন। কিন্তু লোরেনের কান রয়েছে অন্য জায়গায়। সে শুনতে পেলো, বান্ডলের গাড়িতে কি ধরনের গণ্ডগোল হয়েছে তার ব্যাখ্যা করছে সে নিজে।
–গাড়িটা বিগড়ে যেতেই একটুও চিন্তা হলো না। বান্ডল বলে চললো। এ বাড়ির কাছে খারাপ হয়েছে অতএব ভাবনা কিসের। একবার কি ঝামেলায় পড়েছিলাম। সেদিন ছিল রবিবার। পাহাড়ের কাছে লিট স্পেড়লিংটন নামে একটা জায়গায় গাড়ি গেল খারাপ হয়ে। যেমন জমি তেমনি জায়গা।
–ঠিক যেন সিনেমার দৃশ্য। ও’রুরকে মন্তব্য করলেন।
–মিঃ থেসিজারকে দেখছি না। লেডি কুট বললেন।
–মনে হয় বিলিয়ার্ড রুমে। আমি দেখছি। কথাটা শকস বলে চলে গেল।
ঠিক তখনই গম্ভীর মুখে এসে ঢুকলো রিউপার্ট ব্যেটম্যান।
লেডি কুট, আপনি আমায় ডাকছেন? তারপর বান্ডলের দিকে তাকিয়ে বললো, কেমন আছেন লেডি এইলিন?
মিঃ বেটম্যান, আপনি এখানে এসে ভালোই করেছেন। লোরেন বললো, কুকুরের থাবায় ঘা হলে কি করতে হয় আপনি সেদিন জানতে চেয়েছিলেন না?
-না, আমি না। বেটম্যান ঘাড় নাড়লো, উত্তরটা আমার জানা আছে।
–কত খবর আপনাকে রাখতে হয়?
আজকাল সব খবর রাখতেই হয়। বেটম্যান জবাব দিলো। কুকুরের পায়ে
বান্ডলকে একটু আড়াল নিয়ে মিঃ ও’রুরকে বলললেন, এই ধরনের লোকেরাই খবরের কাগজে নানা বিষয়ে লেখে। যেমন, পেতলের জিনিষ কিভাবে চকচকে হয় নতুনবা সিংহলী ভারতীয়দের বিয়েরে আচার হলো–ইত্যাদি। অবশ্য আমার এরকম কোনো জ্ঞান নেই, সেজন্য ভগবানকে ধন্যবাদ জানাই। আমি শিক্ষিত মানুষ।
-এখানে গলফ খেলা যায়? বান্ডল গলফের স্টিক লক্ষ করে লেডি কুটকে প্রশ্ন করলো।
–লেডি এই লিন, আপনি আমার সঙ্গে গলফ খেলতে যাবেন? ও’রুরকে বললেন।
-খুব ভালো, আমরা চারজনে খেলবো। বান্ডল উৎসাহিত হয়ে বললো। আমি আর মিঃ ও’রুরকে আর লোরেন ও বেটম্যান খেলবে।
বেটম্যানকে ইতস্ততঃ করতে দেখে লেডি কুট বললেন, যান, খেলে আসুন। আপনাকে নিশ্চয়ই আপনার স্যার এখন খুঁজবেন না।
–বেশ কায়দা করে কাজ শেষ করা গেছে। চাপা কণ্ঠে বান্ডল লোরেনকে বললো।
বেটম্যান আর লোরেন জয়ী হয়ে একটা নাগাদ খেলা সাঙ্গ হলো।
–আমরা যে খারাপ খেলেছি তা নয়, পার্টনার। পিছিয়ে পড়া বান্ডলকে লক্ষ্য করে ও’রুরকে বললেন। পঙ্গো কোনো ঝুঁকি নিতে নারাজ। খুব মেপে খেলে। তবে আমার মত একেবারে উল্টো। ফলে বহুবার ঝামেলায় পড়েছি। কিন্তু কায়দা করে বেরিয়ে এসেছি। আরে আমি ক্ষমতা রাখি। আমাকে ফাসাবে। আমি হলাম টেরেন্স ও’রুরকে।
ঠিক তখনই জিমি থেসিজার বেরিয়ে এলো বাড়ির কোণ থেকে।
–আশ্চর্য এরা আবার কোথা থেকে এলো? জিমি অবাক হওয়ার ভান করলো।
বান্ডল গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ার ঘটনা জিমিকে বললো।
গাড়ি সারাতে তো সময় নেবে। মধ্যাহ্নভোজের পর আমিই পৌঁছে দেবো। দুপুরের খাওয়ার ঘন্টা পড়তেই সকলে ভেতরে চলে গেল। বান্ডল জিমির গলার আওয়াজ লক্ষ্য করছিল নিখুঁত ভাবে, বুঝলো কাজ হাসিল হয়েছে।
মধ্যাহ্নভোজন শেষ হলো।
জিমি তার গাড়িতে বান্ডল আর লোরেনকে তুলে নিলো, কারণ ওদের গাড়ি পড়ে আছে গ্যারেজে।
এই সময় দুজনেই অর্থাৎ বান্ডল আর লোরেন একসঙ্গে বলে উঠলো।
-তারপর?
জিমি ওদের আশ্বাস দিলো–সব ভালো। তবে বেশি মাত্রায় বিস্কুট খাওয়ায় হজম ঠিক হয়নি।
-কি হলো তাই বলো না?
–বলছি।
জিমিকে চুপ করে থাকতে দেখে লোরেন আবার অনুযোগ করলো।
–ওঃ জিমি, বলো না।
জিমি নরম হলো–কি জানতে চাও?
–সবকিছু। আমাদের কাজটা কেমন হয়েছে বলো? বেটম্যান আর মিঃ ও’রুরকে আমরাই তো কায়দা করে খেলতে নিয়ে গিয়েছিলাম।
-পঙ্গোকে নিয়ে বেশি ভয়। ওকেসামলানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ। পঙ্গো আর ওককের মধ্যে অনেক তফাৎ আছে। পঙ্গো হলো সর্বত্র বিরাজমান। যেখানেই যাও না কেন, ও দেখবে ঠিক চোরের মতো সেখানে হাজির। এত নিঃশব্দে ওর চলাফেরা যে আগে থেকে আঁচ করা যায় না।
–তুমি কি ওকে বিপজ্জনক বলে মনে করছো?
-না, কখনোই নয়। ওকে বিপজ্জনক ভাবলে হাসি পায়। ও একটা গাধা। একটা নোংরা জীব। নিশাচর প্রাণীর মত রাতে জেগে থাকে।
সন্ধ্যার ঘটনাগুলো জিমি শোনালো।
–তোমার যে কি মতলব জানি না।
–সাত নম্বরকে আমার চাই। ওকে জানার চেষ্টা করছি মাত্র।
–এই বাড়িতে কি ওকে পাবে?
–কোনো তথ্য পাবো ভেবেছিলাম।
–সেটা পেয়েছো?
–গত রাতে পাইনি।
–আজ সকালে? লোরেন বলে উঠলো, তুমি আজ সকালে কিছু যে পেয়েছে, সেটা তোমার মুখ দেখলে বোঝা যাচ্ছে।
–একে কিছু পাওয়া বলে কিনা জানি না। বাড়ির এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে এই জিনিষটা পেয়েছি, একটা ছোট্ট বোতল জিমি ওদের দেখালো, সেটি সাদা গুড়ো পাউডারে ভর্তি।
–এটা কি হতে পারে? বান্ডল বললো।
–সাদা দানা। জিমি বললো, গোয়েন্দা কাহিনীতে আকছার পড়া যায় এরকম। অবশ্য জিনিষটা যদি কোনো নতুন ধরনের মাজন হয় তাহলে ভালো হবে না।
কিন্তু শিশিটা কোথায় পেয়েছে সেটা জানাতে রাজী হলো না জিমি।
ওরা দুজন জানার জন্য অনেক কায়দা করলো, অপমান পর্যন্ত করলো, কিন্তু জিমি মুখ খুললো না।
ইতিমধ্যে ওরা গ্যারেজে পৌঁছে গেল। গ্যারেজের লোকটা একটা বিল ধরিয়ে দিলো বান্ডলকে। সে মিষ্টি হেসে বিলের টাকা মিটিয়ে দিলো।
তিনজনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
–জিমি, তোমার মনে আছে সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল একটা আধপোড়া দস্তানা পেয়েছিলেন? যেটা তোমাকে পরেতে বলেছিলেন? বান্ডল বললো।
-হ্যাঁ, মনে আছে। জিমি উত্তর দিলো। আমার ওটা বড় ছিল। দেখে মনে হয়েছিল কোন বিরাট লোকেরই এটা হবে।
–সে যাক, ওটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নয়। বান্ডল বললো, তুমি এবার বলল, ঐ সময় স্যার অসওয়াল্ড আর জর্জ দুজনেই ছিলেন কিনা?
-হ্যাঁ, দুজনেই ছিলেন।
–তাহলে সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল ওদের দুজনকে ওটা পরতে দিলেন না কেন?
–হ্যাঁ, সেটা দিতে পারতেন, কিন্তু
–কিন্তু তিনি তা না করে উল্টে তোমায় বলেছিলেন, জিমি এর মানে বুঝতে পারছো?
জিমি থেসিজার আশ্চর্য হয়ে তাকালেন।
-বান্ডল আমি বুঝতে পারিছি না। আমার দুর্বল মস্তিষ্ক। দুঃখিত। তুমি যদি বুঝিয়ে বলো।
–লোরেন, তোমার কিছু ধারণা আছে?
লোরেনের জানা নেই এই প্রশ্নের জবাব। সে বোবার মত মাথা নাড়লো।
–আচ্ছা, তখন জিমির ডান হাত বাঁধা ছিলো না? বান্ডল বললো।
–আরে, এটা তো ভুলে গিয়েছিলাম, জিমি লাফিয়ে উঠলো। দস্তানাটা বাঁ হাতের তাই ব্যাটল কিছু বলেননি।
–তার সেটা ইচ্ছাও ছিল না। তোমাকে দস্তানাটা হাতে পড়তে বলে অন্য সকলের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সে লোক তোমাকে গুলি করেছিল সে যে বাঁ হাতি সেটা নিশ্চিত।
-তাহলে আমাদের বাঁ হাতি লোককে এবার থেকে খুঁজতে হবে। লোরেন বললো।
–হ্যাঁ, তাছাড়া ব্যাটল চান গলফ ক্লাবগুলি ঘুরে এইধরনের লোকের হদিস করতে।
-একটা কথা মনে পড়েছে। জিমি বললো, গুরুত্বপূর্ণ না হলেও ভাববার বিষয়। জেরি যে রাতে মারা গেল, তার আগে চিমনিতে ব্রিজ খেলার আসর বসেছিল। তখন দেখেছিলাম স্যার অসওয়াল্ডকে বাঁ হাতে তাস বাঁটতে।
কথাটা ঠিক মনে ধরলো না লোরেনের। প্রবলভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ওর মত একজন মানুষ। না না, এটা সম্ভব নয়।
–অসম্ভব বলে মনে হয়। তবু–জিমি বললো।
বান্ডল শান্ত ভাবে বললো–নিজস্ব কাজের ধারা সাত নম্বরের আছে। স্যার অসওয়াল্ডের মধ্যে যদি সেই আচরণ লক্ষ্য করা যায়? স্যার অসওয়াল্ড এই ভাবেই সৌভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন?
ফর্মুলা যখন নিজের হাতের মধ্যে তাহলে অ্যাবীতে ঐ ধরনের গল্প ফাদার ওর কি দরকার ছিল।
–প্রয়োজন ছিল। লোরেন সায় দিলো। নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানো।
–বাওয়ার আর কাউন্টেসকে সন্দেহ করা হচ্ছে। বান্ডল বললো, স্যার অসওয়াল্ডের মত লোককে কে সন্দেহ করবে?
-ব্যাটলের মনে এই সন্দেহ ঢুকেছে কিনা জানি না। জিমি বললো।
মুহূর্তের মধ্যে বান্ডলের চোখে সামনে ভেসে উঠলো স্যার অসওয়াল্ডের বিশাল চেহারা। সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল সেই কোটিপোতি মানুষের কোট থেকে আবিষ্কার করলেন একটা আইভি লতার পাতা।
.
জর্জ লোম্যাক্সের বিচিত্র ব্যবহার
নিঃশব্দে ঘরে এসে ঢুকলেন ট্রেডওয়েল।
-মাই লর্ড, মিঃ লোম্যাক্স আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।
লর্ড কেটারহ্যাম নিজের বাঁ হাতের কব্জি দেখায় ব্যস্ত ছিলেন। তিনি একটু চমকে উঠলেন। তিনি রেগে গেলেন না। একটু ব্যথিত কণ্ঠে বললেন–আজ সকালে আমি ব্যস্ত থাকবো এটা তোমাকে প্রাতঃরাশের সময়ে জানিয়েছি।
–হ্যাঁ, মাই লর্ড। কিন্তু
-যাও, তুমি মিঃ লোম্যাক্সকে জানিয়ে দাও যে তোমার ভুল হয়ে গেছে। তুমি তাকে বলল যে আমি বাড়ি নেই বা বলল হাতে কষ্ট পাচ্ছি। তবুও যদি না শোনে তাহলে বলল আমি মরে গেছি।
–মাই লর্ড, একথা এখন বলা যাবে না। উনি আপনাকে বাগানে পলকের জন্য দেখে ফেলেছেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লর্ড কেটারহ্যাম বললেন, অগত্যা আর কি করা। তুমি যাও, আমি আসছি।
লর্ড কেটারহ্যাম চরিত্রটি বড় বিচিত্র। মনে ঘা থাকলেও আচরণে সেটা প্রকাশ করেন না।
অত্যন্ত স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন–আরে বন্ধু যে, আপনাকে দেখে আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। বসুন বসুন। আজ কিছু পান করতেই হবে।
বড় আরাম কেদারায় বসালেন জর্জ লোম্যাক্সকে।
–একটা বিশেষ দরকারে আপনার কাছে এলাম। জর্জ বললেন।
–তাই নাকি, লর্ড কেটারহ্যাম তলিয়ে ভাবতে লাগলেন, এই কথার পেছনে কি আছে।
বিশেষ দরকার ছিল। জর্জ বললেন।
লর্ড কেটারহ্যাম ভেতরে ভেতরে চুপসে গেলেন। তার মানে আরো সাংঘাতিক কিছু মনে হয়।
-এইলিন কি বাড়িতে?
-হ্যাঁ, বান্ডল বাড়িতে আছে। ওর সঙ্গে ওয়েড় মেয়েটা আছে। লর্ড কেটারহ্যাম স্বভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন। জানেন মেয়েটা ভারী ভালো। দেখবেন ও একদিন গলফ খেলায়
জর্জ তাকে আর বলতে না দিয়ে থামিয়ে দিলেন-বান্ডলের সঙ্গে এখনই দেখা করা প্রয়োজন।
–নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। কিন্তু
–কোনো কিন্তু নেই। জর্জ বললেন, এইলিন আর ছোট্ট মেয়েটি নেই, এটা নিশ্চয়ই আপনার খেয়াল আছে। সে একজন বুদ্ধিমতী এবং সুন্দরী মহিলা হয়ে উঠেছে। যে ওকে ভালোবাসবে সে নিজেকে গর্বিত মনে করবে। আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না সে হবে খুবই ভাগ্যবান ব্যক্তি।
–কথাটা আপনি ভুল বলেননি, কিন্তু ও বড় চঞ্চল। একজায়গায় স্থির হয়ে থাকে না। অবশ্য অজকালকার ছেলেরা এসব গুরুত্ব দেয় না।
-সে উচ্চাকাঙ্ক্ষী। আধুনিক সমস্যা ওকে চিন্তিত করে তোলে। মনকেও আধুনিক করতে চায়।
লর্ড কেটারহ্যাম বিস্মিত হয়ে তাকালেন জর্জের দিকে। এসব কি বলছেন? অথচ তার নিজের ধারণা, বান্ডল এসবের বিপরীত। আধুনিক জীবনের ক্ষেত্রেও তাই।
–আপনি কি ঠিক বলছেন?
–উড়িয়ে দেওয়ার মত কথা আমি বলিনি লর্ড কেটারহ্যাম। আমার এখানে ছুটে আসার উদ্দেশ্য আশাকরি খানিকটা আন্দাজ করতে পেরেছেন। অনেক ভাবনা চিন্তা করে আমি নতুন দায়িত্ব নিতে রাজী হয়েছি, যা আমার মত লোক সহজে করে না। বংশমর্যাদা, রুচির ব্যাপার, ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা, এমন নানা বিষয় নিয়ে আমি ভেবেছি। আমি আমার স্ত্রীকে সমাজে এমন প্রতিষ্ঠা দিতে পারি যা তাচ্ছিল্য করার মত নয়।
…এইলিন আমার বংশমর্যাদা এবং প্রতিষ্ঠার সম্পূর্ণ উপযুক্ত। চমৎকার ভাবে ও এটা মানিয়ে নিতে পারবে। আমার আশা, ওর বুদ্ধি, রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা, এসব আমার প্রতিষ্ঠাকে আরো উন্নত করতে সাহায্য করবে। তবে বলতে পারেন, আমি এইলিনের থেকে বয়সে অনেক বড়। তবে মনে করবেন না, বয়সের সাথে সাথে আমার মধ্যে প্রাণ-প্রাচুর্যের অভাব আছে। বয়স কোনো ব্যাপার নয়। আমার মত প্রতিষ্ঠিত মানুষকে বিয়ে করা
…লর্ড কেটারহ্যাম, আপনি দেখে নেবেন, যৌবনমতী এইলিনের কোনো সম্মান নষ্ট হবে না।
কথাটা এত দেরিতে বুঝেছি বলে আফসোস হচ্ছে। আগে কেন বুঝিনি।
জর্জ লোম্যাক্স সম্মতির জন্য অপেক্ষা করলেন।
তার মানে, ইয়ে, লর্ড কেটারহ্যাম কেমন অসহায় বোধ করলেন, তুমি তাহলে বান্ডলকে বিয়ে করতে চাও?
আশ্চর্য হচ্ছেন? তাহলে কি বান্ডলের সঙ্গে কথা বলতে পারবো না?
কথা বলতে পারবে। তুমি যদি অনুমতি চাও আমি বাধা দেবো না। তবে একটা কথা জেনে রাখো, তোমার জায়গায় আমি হলে, এ প্রস্তাব করতাম না। আমি বলি বাড়ি যাও, এক থেকে কুড়ি গুনতে গুনতে বার বার ভাবো। বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বোকা বনে যাওয়ার চেয়ে ওটা ঢের বেশি মঙ্গলের হবে।
–আপনি যে হৃদয় থেকে কথাটা বললেন, সেটা মনে হলো না। আপনার কথাগুলো কেমন অদ্ভুত শোনালো, তবু আমি একবার আমার ভাগ্য পরীক্ষা করবোই। আমি কি এইলিনের সঙ্গে দেখা করতে পারি?
এ ব্যাপারে আমার মতামত খাটবে না। লর্ড কেটারহ্যাম উঠে দাঁড়ালেন, বান্ডল তার নিজের ব্যাপারে কারো কর্তৃত্ব পছন্দ করে না, ও যদি কাল এসে বলে, বাড়ির সোফারকে বিয়ে করবে তাহলেও আমি আপত্তি করবো না। ছেলেমেয়েদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে নিজের জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। এটা আজকালকার নিয়ম। আমি তাই বান্ডলকে জানিয়ে রেখেছি–যে এমন কোনো কাজ কখনো করিস না, যা আমাকে দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে। সত্যি কথা বলতে কি, এ পর্যন্ত আমার কথা রেখেছে।
জর্জ যেন প্রতিজ্ঞা করেই এসেছে। এমন ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়ালো।
-কোথায় পাবো ওকে?
-বলতে পারবো না। লর্ড কেটারহ্যাম চটপট জবাব দিল। আগেই বলেছি ও স্থির হয়ে থাকে না। ওর বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না। ও যে কোনো জায়গায় থাকতে পারে।
–লর্ড কেটারহ্যাম, আপনি যদি বাটলারকে ডেকে বলেন যে একবার এইলিনকে ডেকে দিতে, আমি তার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। তাহলে খুব ভালো হয়।
ঘন্টা ধ্বনি শুনে ট্রেডওয়েল ঘরে এসে ঢুকলো। লর্ড কেটারহ্যাম তাকে বললেন, লেডি এইলিনকে ড্রইংরুমে পাঠিয়ে দিতে, মিঃ লোম্যাক্স ওর সঙ্গে কথা বলতে চান।
জর্জ লোম্যাক্স আহ্লাদে ডগমগ হয়ে উঠলেন। লর্ড কেটারহ্যামের হাত ধরে বললেন, অনেক ধন্যবাদ। আশাকরি ভালো খবর দিতে পারবো। জর্জ দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন।
লর্ড কেটারহ্যাম নিজের মনে বললেন, বান্ডল যে কি করছে কে জানে।
একটু পরেই দরজা খুলে কলো ট্রেডওয়েল–মিঃ বিল এভারসলে এসেছেন, মাই লর্ড।
লর্ড কেটারহ্যাম বিলের হাতটা জড়িয়ে ধরে বললেন, হ্যালো বিল, তুমি কি জর্জের খোঁজে এসেছো? তুমি আমার একটা উপকার করলে খুশী হবো। ড্রইংরুমে লোম্যাক্সকে পাবে। তাকে জানাবে যে ক্যাবিনেটের জরুরী সভায় তার ডাক পড়েছে। নতুনবা তোমার যেমন খুশী বলে ওকে বিদায় দাও। একটা যুবতী মেয়ের পাল্লায় পড়ে এমন একজন বুড়ো লোককে হেনস্থায় ফেলা উচিত নয়।
–আমি বান্ডলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। বিল বলনো। জর্জ লোম্যাক্স যে এখানে এসেছেন আমি তা জানি না। তার খোঁজে আমি আসিনি। বান্ডল কোথায়? ধারে কাছে আছে কি?
-ওর সঙ্গে তোমার এই মুহূর্তে দেখা হবে না। ও জর্জের সঙ্গে কথা বলছে। লর্ড কেটারহ্যাম বললেন।
-তাতে কি ক্ষতি হবে?
–হবে, অনেক কিছুই। এতক্ষণে সব মনে হয় গুবলেট করে দিয়েছে। ব্যাপারটা ওর পক্ষে আরো খারাপ করে না দেওয়াই ভালো।
–কিন্তু ওর বক্তব্য কি?
-সেটা ঈশ্বরই জানেন। মনে হয় পাগলের প্রলাপ বকছে। বেশি কথা বলা আমি পছন্দ করি না। মেয়েটার হাত ধরো, দেখবে জলের মত এগিয়ে যাচ্ছে ঘটনা।
বিল অবাক হলো।
–কিন্তু স্যার, আমার সময় খুব কম। আমি এখুনি বান্ডলের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
–আমার মনে হয় বেশি সময় তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে না। কাজ মিটে গেলে লোম্যাক্স নিজেই আমার কাছে ফিরে আসবে। তুমি ততক্ষণ আমার কাছে থাকো সেটাই আমি চাই।
-কি কাজ? লোম্যাক্স কি করছে? বিল উগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো।
-সে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে বান্ডলকে। কারণ জানতে চেয়ো না। তবে আমার মনে হয় জর্জের এই বয়সে ভীমরতি হয়েছে। আমার তো আর কিছু মনে আসছে না।
–এই বয়সে বিয়ে? শুয়োর, শয়তান। বিলের মুখ কালো হয়ে গেল।
–জর্জ জানিয়েছে, ওর যৌবনে নাকি ভাঙন ধরেনি। লর্ড কেটারহ্যাম ফিস ফিস করে বললেন।
-লজ্জাশরমের বালাই নেই লোকটার। হতচ্ছাড়া
–ও আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোট।
–বান্ডলের মত মেয়ে? বান্ডল আর কডার্স। এ ব্যাপারে সায় দেওয়া আপনার উচিত হয়নি।
–এসবে আমি নাক গলাই না।
–হা ঈশ্বর! বেশ অনুভূতির সঙ্গে বিল কথাটা বলে উঠলো। আমাকে এখনই যেতে হবে স্যার। আমি চলি।
-না না, তুমি যেও না। তাছাড়া তুমি বান্ডলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
-এখন থাক। আপনি যা বললেন, শুনে আমার মাথা গরম হয়ে গেছে। দয়া করে আপনি বলবেন জিমি থেরিজারকে এখন কোথায় পাবো? ও নাকি কুটদের বাড়িতে ছিল, এখনও কি সেখানেই আছে? আপনি জানেন?
–মনে হয় গতকাল সে শহরে ফিরেছে। কারণ বান্ডল আর লোরেনও সেখানেই ছিল, গতকাল ফিরেছে। তুমি যদি ধৈর্য ধরে একটু বসো
বিলের একদম ভালো লাগছিলো না। অসহ্য লাগছিল সবকিছু। সে দ্রুত ঘাড় নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
নিঃশব্দে হলঘরে ঢুকলেন লর্ড কেটারহ্যাম। নিজের টুপিটা নিয়ে আবার চটপট পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। একটু দূরে বিলকে গাড়িতে উঠতে দেখলেন।
-কোনো দুর্ঘটনা না ঘাটিয়ে বসে ছেলেটা। লর্ড কেটারহ্যাম আপনমনে বললেন।
বিল নিরাপদে পৌঁছে গেলো লন্ডনে। সেন্ট জেমস স্কোয়ারে গাড়ি রেখে জিমির ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো।
বিলকে দেখে জিমি এগিয়ে এলো–হ্যালো বিল, কি খবর? তোমার মুখটা শুকনো দেখাচ্ছে কেন? কি হয়েছে?
-এমনিতেই দুশ্চিন্তায় ভুগছিলেন। বিল বললো, তার ওপর চরম ধাক্কা খেয়েছি।
ব্যাপারটা খুলে বল। দেখি, আমি তোমার দুশ্চিন্তা কিছুটা লাঘব করতে পারি কিনা? বিল নিরুত্তর। একদৃষ্টে মেঝের কার্পেটের দিকে তাকিয়ে রইলো।
–উইলিয়াম, অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে? জিমি শান্ত ভাবে জিজ্ঞাসা করলো।
–এমন অদ্ভুত ব্যাপার, যার মাথা মুণ্ডু বুঝতে পারছি না।
–তুমি সেভেন ডায়ালস-এর ব্যাপারে চিন্তিত?–হ্যাঁ, আজ সকালে একটা চিঠি এসেছে।
–কি ধরনের চিঠি?
–রনি ডেভেলোর আইনজীবী পাঠিয়েছে।
উঃ ভগবান, এতদিন পরে?
–রনি নির্দেশ ছিল, হঠাৎ যদি ওর মৃত্যু হয় তাহলে একটা খাম ঠিক পনেরো দিন পরে আমার কাছে যেন পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
–তুমি কি খামটা পেয়েছো?
হ্যা।
–খুলে দেখেছ, তাতে কি লেখা ছিল?
–বিল চোখ তুলে জিমির দিকে তাকালো। জিমি চমকে উঠলো ওর ঐ অদ্ভুত বিচিত্র চাউনি দেখে।
–বিল, মনে হয় এটা তোমাকে দারুণ ভাবে চিন্তিত করে তুলেছে। তুমি বরং একটু কিছু পান করে নিজেকে তাজা করে নাও।
হুইস্কি আর সোডা মিশিয়ে জিমি বিলের হাতে গ্লাস তুলে দিলো। কিন্তু বিলের স্বাভাবিকত্ব ফিরে এলো না।
–চিঠির বক্তব্য আমাকে পাগল করে দিয়েছে, বিল বললো। আমার কাছে এটা অবিশ্বাস্য।
–বিল, তুমি একটু শান্ত হও। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা খুলে বলল। দাঁড়াও।
জিমি বাইরে এসে স্টিভেনসকে ডেকে সিগারেট কেনার জন্য দোকানে পাঠালো।
বাইরের দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ পেয়ে জিমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর জিমি বসার ঘরে ফিরে এলো। এর মধ্যে বিল তার গ্লাসের তরল পানীয় পান করে নিজেকে একটু চাঙ্গা করে নিয়েছে।
-নাও, এবার শুরু করো। জিমি বললো, স্টিভেনসকে বাইরে পাঠিয়েছি। কেউ কোনো কথা শুনতে পাবে না। এবার বলো। -বিল একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিলোহা, তোমাকেই সব বলবো।
৬. জরুরী ডাক
একটা ছোট্ট কুকুরছানাকে নিয়ে আদর করছিল লোরেন।
প্রায় বিশ মিনিট পরে প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে সেখানে এসে হাজির হলো বান্ডল। এমন তার মুখের চেহারা যা বর্ণনা করাও যায় না।
একটা চেয়ারে বসে সে তখনও হাঁফাতে থাকলো।
-তোমার কি হলো? লোরেন অবাক হলো।
–জর্জ লোম্যাক্স আমাকে বিয়ে করবে বলছে। বান্ডল তখনও স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারছে না। একটু চুপ করে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, মনে হয় কোনো বই পড়ে ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তোতলানো পুরুষ আমি একদম পছন্দ করি না। ওকে কিছুতেই থামানো যাচ্ছিল না। এর উত্তরও আমার অজানা সেটাই আমার দুর্ভাগ্য।
–সেটা জানবে কি করে?
–জর্জের মত একটা বোকা তোতলাকে আমি বিয়ে করতে চাই না, এটাই স্বাভাবিক। নহমত শাখায় বইয়ের কোনো উত্তর আমার জানা ছিল না, সেটাই আমায় অসুবিধায় ফেললো। মুখের ওপর স্পষ্ট করে বলতেও পারিনি, যে আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। বরং আমার বলা উচিত ছিল, আপনার এই অসামান্য সম্মান দেখানোর জন্য আমি কৃতার্থ হয়েছি। এই ধরনের আর কি। আসলে প্রস্তাবটি শুনেই আমার সংজ্ঞা লোপ পাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কোনোরকমে জানলা গলিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
-বান্ডল, এটা কিন্তু স্বভাবের বিরুদ্ধে হয়ে গেছে।
–এরকম কিছু যে একটা ঘটতে পারে সেটা আমার ধারণার বাইরে ছিল। আমি আগাগোড়া জানতাম জর্জ আমাকে পছন্দ করে না, ঘৃণা করে। এখন খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারছি, কোনো পুরুষের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করা কতখানি সাংঘাতিক। লোরেন, তুমি যদি একবার শুনতে, জর্জ কেমন আমার প্রশংসা করে চলেছে। বলে কিনা, আমার মনকে প্রস্ফুটিত করে তুলতে চায়। ও যদি বুঝত তখন আমার মনে কি উদয় হচ্ছিল তাহলে ভয়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে যেতো।
বান্ডলের কথা বলা ধরন দেখে লোরেন হেসে উঠলো।
যাক, ছাড়ো ওসব কথা। ঐ যে বাবা রডোডেনড্রন গাছের ফাঁকে বেড়াচ্ছেন। হ্যালো, বাবা।
লর্ড কেটারহ্যাম এগিয়ে এলেন।
–লোম্যাক্স বিদেয় হয়েছে? বেশ জোর করেই খুশী ভাব প্রকাশ করলেন।
–বেশ ঝামেলায় ফেলেছিলে তুমি, বান্ডল বললো, জর্জ বললো, তুমি নাকি সায় দিয়েছে।
–বুঝলাম, আমি এ ধরনের কোনো কথাই বলিনি, বুঝেছিস।
–আমি জানি। বান্ডল বললো, আসলে তোমাকে কোণঠাসা করে দিয়েছিল। ফলে ও বক্তব্য গড়গড় করে বলতে কোনো অসুবিধা হয়নি আর তোমাকেও বাধ্য ছেলের মত ঘাড় নেড়ে যেতে হয়েছে।
–তুই ঠিক ধরেছিস। ওকে কেমন মনে হলো? খুব বাজে তাই না?
–ওসব দেখতে আমার বয়ে গেছে। আমি তার আগেই ওখান থেকে পালিয়েছি।
–এটাই ভালো হয়েছে। লর্ড কেটারহ্যাম বললেন। ঝামেলা যা করার করে গেছে। আর দ্বিতীয় দিন এসে আমাকে জ্বালাবে না। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। আমার গলফের স্টিকটা কোথায়?
–দু একবার খেললে আমার স্নায়ুগুলো টানটান হয়ে যাবে? বান্ডল বললো। লোরেন, তুমিও মাঠে যাবে খেলতে।
একট ঘণ্টা নিরুপদ্রবে কাটলো। তিনজনে প্রফুল্ল মনে বাড়িতে ঢুকলো।
টেবিলের ওপর পড়ে থাকা একটা চিঠি ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।
-মিঃ লোম্যাক্স, আপনার জন্য এটা রেখে গেছেন, মাই লর্ড। ট্রেডওয়েল খামটা এগিয়ে দিলো। আপনার সঙ্গে ফের দেখা না হওয়াতে উনি মর্মাহত হয়েছেন।
ট্রেডওয়েল চলে যেতে লর্ড কেটারহ্যাম খাম ছিঁড়ে চিঠি বের করলেন। একটা বিস্ময়সূচক শব্দ তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো।
-বান্ডল, তোর উচিত ছিল ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দেওয়া।
–কি বলছো?
–বেশ, তুমি নিজে পড়ে দেখ।
বান্ডল চিঠির দিকে দৃষ্টি দিলো।
প্রিয় কেটারহ্যাম
তোমাকে বলেছিলাম, এইলিনের সঙ্গে কথা বলার পর তোমার কাছে আসছি। কিন্তু, তোমাকে পেলাম না। ভীষণ দুঃখ পেলাম। বেচারা ছোট্ট এইলিন, বুঝতে পারেনি, ওর সম্পর্কে আমি কি মনোভাব পোষণ করি। আমার মনে হয়, আমার প্রস্তাব শুনে ও ঘাবড়ে গেছে। আমি এই মুহূর্তে ওর সিদ্ধান্ত শুনতে চাই না। ও ভেবেচিন্তে জবাব দেবে। ওর বালিকাসুলভ আচরণ আমায় মুগ্ধ করে। ওর রমণীসুলভ মনোভাবও আমার কাছে প্রশংসনীয়। ওর এই বিহ্বলতা দেখে আমার মনে হয়েছে, এ বিয়েতে ও রাজী আছে। আমিও জানি, আমি শেষ পর্যন্ত জয়ী হবো, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ রাখি না।
আমার ওপর বিশ্বাস রাখো, প্রিয় কেটারহ্যান।
তোমার একান্ত প্রিয় বন্ধু
জর্জ লোম্যাক্স
উঃ, আমি বুঝি পাগল হয়ে যাবো। বান্ডল মাথায় হাত দিলো।
নিশ্চয় লোকটার মাথা খারাপ হয়েছে। লর্ড কেটারহ্যাম বললেন। মাথা না বিগড়ে গেলে কেউ তোর সম্বন্ধে এমন চিঠি লিখতে পারাত। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করার মত। ধৈৰ্য্য আছে যথেষ্ট। এবার বুঝতে পারছি, ও ক্যাবিনেটে ঢোকার ক্ষমতা পেয়েছে কোথা থেকে। ওকে বিয়ে করলে, ও জব্দ হতো।
এসবের মধ্যে বেজে উঠলো ফোন।
বান্ডল রিসিভার তুলে নিলো। মুহূর্তের মধ্যে তার মন থেকে উধাও হলো জর্জ লোম্যাক্সের বিয়ের প্রস্তাব। সে লোরেনকে আহ্লাদিত স্বরে ডাকলো। লর্ড কেটারহ্যাম নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
–লোরেন, জিমি ফোন করেছে। বান্ডল বললো, মনে হয় কোনো ব্যাপারে ও ভীষণ উত্তেজিত হয়ে আছে।
-শোনো বান্ডল, নষ্ট করার মত সময় নেই। লোরেন কোথায়? এখানে আছে?
–হ্যাঁ, এখানে আছে।
–শোন, সংক্ষিপ্ত সময়। সব কথা বলা যাবে না। তাছাড়া ফোনেও সব কথা বলা অসম্ভব। বিল আমার সঙ্গে দেখা করে যে কাহিনী শোনালো সেটা যেমন অবিশ্বাস্য তেমনি অদ্ভুত। তবুও এটা সত্যি। নিখাদ সত্যি। বলতে পারো, এই শতকের সবচেয়ে চমকপ্রদ খবর। তোমরা কি করবে সেটা মন দিয়ে শোন। এখনই তোমরা দুজনে শহরে চলে আসবে। তোমার গাড়ি যে কোনো গ্যারেজে রেখে সোজা চলে যাবে সেভেন ডায়ালস-এ। আচ্ছা, তুমি কি ওখানে পৌঁছে ঐ ফুটম্যান লোকটাকে দূরে কোথাও নিয়ে যেতে পারবে?
-তুমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকো জিমি। অ্যালফ্রেডের ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও।
চমৎকার। তোমার কাজ শেষ করে তুমি সোজা ভেতরে ঢুকে যাবে। বিল আর আমি সেখানে থাকবো, বুঝেছো।
–ঠিক আছে।
–আর একটা কথা। কেউ যেন জানতে না পারে যে তোমরা লন্ডনে আসছে। যাইহোক একটা মিথ্যে বলে দিও। তোমার সঙ্গে যে লোরেন যাচ্ছে, সেটা জানিও। কি পারবে তো?
-অবশ্যই পারবো। ভেবে আমার যা উত্তেজনা হচ্ছে তোমায় কি বলবো, জিমি।
–হওয়া স্বাভাবিক, বেরোনোর আগে তোমরা বোধ হয় উইল করতে পারো।
–খুব ভালো হবে, তাই না? তবে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ জানলে আরো ভালো হতো।
–এখন এই পর্যন্ত থাক। আমার সঙ্গে দেখা হলেই সব জানতে পারবে। তবে এটুকু জেনে রাখো, সাত নম্বরের জন্য আমরা একটা বিরাট চমক হাজির করতে চলেছি।
রিসিভার নামিয়ে রাখলো বান্ডল। ফোনে যা কথা হলো তার সারাংশটুকু লোরেনকে চটপট বলে ফেললল। লোরেন ছুটে গেল নিজের ঘরে। সুটকেস গোছাতে বসলো। বান্ডলও দ্রুতপায়ে বাবার ঘরে গিয়ে উঁকি দিলো।
-বাবা, লোরেন বাড়ি যাচ্ছে। আমি ওকে পৌঁছে দিতে যাচ্ছি।
–সে কি, ও যে আজ চলে যাবে জানতাম না তো!
–টেলিফোন এসেছিলো, ওরা যেতে বলেছে। বান্ডল বললো। আমি আসছি।
–বান্ডল দাঁড়া। কখন বাড়ি ফিরবি?
–সেটা বলতে পারবো না। যখন ফিরবো, তখন তুমি দেখতেই পারবে।
বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বান্ডল দ্রুত পায়ে ওপরে ফিরে এলো। গাড়ি আগেই বের করতে বলেছিলো। একটা টুপি নিলো, লোমের কোটটা গায়ে পরে নিলো।
লন্ডন পর্যন্ত পৌঁছলো বিনা উত্তেজনায়। শুধু বান্ডল গাড়ি চালালে যেটুকু হয় কেবল সেইটুকু সম্বল ছিলো। গ্যারেজে গাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে ওরা পা বাড়ালো সেভেন ডায়ালস ক্লাবের উদ্দেশ্যে।
দরজা খুললো অ্যালফ্রেড। প্রায় ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বান্ডল ও লোরেন ভেতরে ঢুকে পড়লো।
-দরজা বন্ধ করো, অ্যালফ্রেড, বান্ডল বললো। শোন, তোমাকে পুলিস অনুসরণ করছে। তুমি সেদিন আমার যা উপকার হয়েছিলে তার বিনিময়ে তোমাকে সাবধান করে দিতে চাই।
-ওহ, মাই লেডি। বান্ডল বলে চললো। মিঃ মসগোরোভস্কির নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরিয়েছে। তাই তুমি যদি কোথাও পালাও সেটা তোমার পক্ষে মঙ্গলজনক ব্যাপার হবে। তোমাকে এখানে না পেলে, তোমার জন্য কেউ আর মাথা ঘামাবে না। তুমি যাতে সহজে পালাতে পারো তাই তোমাকে এই দশ পাউন্ড দিলাম। তুমি যেখানেই যাও নিরাপদে যেতে পারবে।
অ্যালফ্রেডের তখন ভয়ে হৃৎপম্পন শুরু হয়ে গেছে। তিন মিনিটের মধ্যে সে বেরিয়ে পড়লো ১৪ নং হান্সটন স্ট্রিট ছেড়ে। আপন মনে বিড় বিড় করতে লাগলো–একবার যেতে পারলে আর এখানে ফিরছি না।
শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারটা ভালোয় ভালোয় মিটলো। বান্ডল খুশী।
এত বাড়াবাড়ি করার কি প্রয়োজন ছিল? লোরেন প্রশ্ন করলো।
–এটাই নিরাপদ। বান্ডল বললো। কিন্তু ওদের মতলবটা যে কি সেটা বুঝতে পারছি না। তবে সব কিছুর মধ্যে অ্যালফ্রেডের উপস্থিতি সমস্ত পরিকল্পনাটা মাটি করে দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মনে হয় ওরা কোথাও লুকিয়ে থেকে অ্যালফ্রেডের চলে যাওয়া দেখছে। লোরেন, তুমি এক কাজ করো, দরজাটা খুলে রাখো।
লোরেন বান্ডলের কথামত কাজ করলো। ঠিক তখনই জিমি ওর গাড়ি থেকে নামলো।
–বিল, তুমি এখানে অপেক্ষা করো। কেউ লক্ষ্য করলে হর্ন বাজিও।
জিমি প্রায় দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলো।
ওদের দেখে খুশীতে প্রায় চিৎকার করে উঠলো-হ্যালো, বান্ডল, তোমরা এসে গেছে। এবার তাহলে অভিযান শুরু হোক। তুমি আগেরবার যে ঘরে ঢুকেছিলে তার চাবি কোথায়?
নিচের তলায় চাবির গোছর মধ্যে ছিল। সবগুলো নিয়ে এলেই হবে।
–তাহলে চটপট চাবি নিয়ে এসো। হাতে সময় খুব কম।
চাবি আনা হলো। সহজেই দরজা খুলে নির্দিষ্ট ঘরে তিনজনে ঢুকে পড়লো।
এর আগের দিন বান্ডল ঘরের চেহারা যেমন দেখেছিল তেমনিই আছে। মাঝখানে বড় টেবিল, তার চারপাশে সাতখানা চেয়ার সাজানো। জিমি সহজ দৃষ্টি মেলে ঘরের চারদিকে দেখলো। দেওয়াল আলমারি দুটোর দিকে ওর দৃষ্টি আটকে গেল।
-বান্ডল, তুমি কোনো আলমারির মধ্যে ঢুকেছিলে?
–এটা। বান্ডল আঙুল তুলে দেখালো।
জিমি এগিয়ে গিয়ে পাল্লা দুটো মেলে ধরলো। একরাশ বাসনে আলমারি ভর্তি।
–এগুলো এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে। জিমি বললো, লোরেন, তুমি বিলকে ডেকে আনো, ওর আর বাইরে থাকার দরকার নেই।
লোরেন চলে গেল।
–তুমি কি করতে বলছো? বান্ডল অসহিষ্ণু গলায় বললো।
আলমারি পরীক্ষা করতে করতে জিমি বললো–দাঁড়াও, আগে বিল আসুক। ওর সবকথা আগে শোন। এসব ওরই কাজের ফল। আরে লোরেনের কি হলো? ওকে পাগলা কুকুরে ধাওয়া করেছে?
লোরেন সত্যি প্রাণপণে ছুটে আসছিল। সিঁড়ি বেয়ে উঠে হাঁফাতে লাগলো। মুখ সাদা, চোখে রাজ্যের ভয়
-বিল-বিল-ওহ-বান্ডল-বিল?
–বিলের কি হলো?
জিমি ওর কাঁধে ঝাঁকুনি দিলো। লোরেন ভগবানের দোহাই, কি হয়েছে বলো?
লোরেন অস্পষ্ট স্বরে বললো-বিল-বিল, মনে হচ্ছে মরে গেছে। গাড়ির মধ্যে রয়েছে। নড়ছেও না, কথাও বলছে না। নিশ্চয়ই ও মরে গেছে।
কি একটা শপথ উচ্চারণ করতে করতে জিমি সিঁড়ি থেকে লাফিয়ে নামলো, পেছনে বান্ডল।
-হায় ভগবান, বিলের একি পরিণতি হলো। না কখনোও না।
লোরেনও ওদের পেছন পেছন গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো।
জিমি যখন বাড়ির মধ্যে ঢুকেছিল তখন বিল যেমন অবস্থায় ছিল এখনও সেইভাবে আসনে পিঠ রেখে বসে আছে। চোখ বন্ধ। ওর হাত ধরে টানলো জিমি। কিন্তু একটুও কেঁপে উঠলো না।
কি হলো? জিমি বললো। তবে ও মারা যায়নি। বান্ডল, তুমি মন খারাপ করো না। ওকে আগে বাড়ির মধ্যে নিয়ে যেতে হবে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, এখন যেন পুলিস এসে হাজির না হয়। তাহলেই বিপদ। কেউ কিছু জানতে চাইলে বলবে, আমাদের বন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তাই বাড়ির মধ্যে নিয়ে যাচ্ছি।
সহজেই তিনজনে ধরাধরি করে বিলকে গাড়ি থেকে নামিয়ে বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেল। একজন ভদ্রলোক দেখতে পেয়ে কিছু বললেন, মনে হয় পেটে একটু বেশি রঙিন জল পড়ে গিয়েছিল।
নিচের তলার পেছনের ঘরে একটা সোফায় শুইয়ে দিলো।
বান্ডল ওর একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিলো।
বুকে ধুকপুকানি চলছে। বান্ডল বললো, তাহলে ওর কি হলো?
একটু আগে আমি যখন এলাম, তখন তো ভালোই ছিল। জিমি বললো। মনে হয় কেউ ওকে ইনজেকশান দিয়েছে। এ তো আর কঠিন কাজ নয়। একজন ডাক্তার ডাকতে হবে। ততক্ষণ ওর ওপর লক্ষ্য রাখা।
দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে জিমি আবার ফিরে তাকালো।
-তোমরা কিন্তু নির্ভয়ে থাকবে। আমি বরং আমার রিভলবারটা রেখে যাই। প্রয়োজন হলে কাজে লাগাবে। আমি কাজ সেরেই ফিরে আসবো।
রিভলবার সোফার ওপর রেখে জিমি লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল। সদর দরজা বন্ধ করার শব্দ ওদের কানে পৌঁছলো।
বাড়িটায় কেমন থমথমে ভাব। ওরা দুজন চুপ করে বিলের পাশে বসে ছিল। বিলের নাড়ী আস্তে আস্তে চলছে ওরা সেটা টের পেলো।
–কিছু যদি করতে পারতাম। বান্ডল প্রায় ফিস ফিস করে বললো।
লোরেন ঘাড় নেড়ে বললো–ঠিক বলেছো। জিমি মাত্র দেড় মিনিট হয়ে গেছে। অথচ মনে হচ্ছে কখন গেছে।
–কি সব আমার কানে আসছে। মনে হয় ওপরে কারা যেন আসছে। বান্ডল বললো, নাকি এ আমার কল্পনা মাত্র।
–জিমি কেন রিভলবারটা রেখে গেছে, এবার বুঝতে পারছি। লোরেন বললো, সত্যিই কোনো বিপদ নেই কোথাও।
–যদি ওরা বিলের সন্ধান পেয়ে যায় তাহলে–শেষটা আর গলা দিয়ে বেরোলো না বান্ডলের।
–ঠিকই। তবে আমরা রয়েছি বাড়ির মধ্যে। আমাদের জানিয়ে তবে ওদের ঢুকতে হবে। তাছাড়া আমাদের সঙ্গে অস্ত্র আছে।
বান্ডল বিলের দিকে তাকালো–এ অবস্থায় একটু গরম কফি হলে ভালো হতো।
–আমার ব্যাগে ব্র্যান্ডি আর স্মেলিং সল্ট আছে। লোরেন বলল। ব্যাগটা রেখেছি ওপরের ঘরে।
দাঁড়াও আমি নিয়ে আসছি। বান্ডল বললো, ফল ভালো হতে পারে।
বান্ডল সিঁড়ি দিয়ে উঠে খেলার ঘরের দিকে হন হন করে চললো। দরজা দিয়ে ঢুকেই দেখলো, টেবিলের ওপর লোরেনের ব্যাগটা পড়ে আছে।
ব্যাগটা হাতে নিয়ে ফিরতেই পেছনে একটা আওয়াজ শুনতে পেলো। একটা বালির ব্যাগ নিয়ে একটা লোক দরজার আড়ালে লুকিয়ে ছিলো। বান্ডল মাথা ঘোরাবার আগেই ঐ বালির বস্তার আঘাত লাগলো তার মাথায়। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো অস্ফুট শব্দ। তারপরেই জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো।
.
সেভেন ডায়ালস
ধীরে ধীরে বান্ডলের জ্ঞান ফিরে আসছিল। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করলো। চারপাশে চাপ চাপ অন্ধকার যেন তাকে ঘিরে ধরেছে। বহুদূর থেকে যেন ভেসে আসছে কোনো চেনা প্রিয় কণ্ঠস্বর।
অন্ধকার আস্তে আস্তে ফিকে হলো। মাথার একপাশে যন্ত্রণায় দপদপ করছে। এবার সে কান পেতে রইলো, কে যেন বলছে।
-বান্ডল, আমার প্রিয় বান্ডল। নিশ্চয়ই ও আর বেঁচে নেই।
–বান্ডল, তুমি আমার একান্ত নিজের। তোমায় আমি ভালোবাসি। দারুণ ভালোবাসি। বান্ডল এখন সম্পূর্ণ সচেতন। চোখ বন্ধ করে নীরবে শুনে যাচ্ছিল। বিলের দুহাতের মধ্যে ও নিজেকে আবদ্ধ রেখেছে।
-ভগবান, আমি যে এখন কি করি? বান্ডল, আমার সোনা, তোমাকে আমিই মেরে ফেলেছি। এর জন্য আমি-ই দায়ী প্রিয়তমা।
বান্ডলের শুনতে খুব ভালো লাগছিল। চোখ খুলতে ইচ্ছা করছিল না। তবু আস্তে আস্তে ঠোঁট খুললো সে।
-না, তুমি আমাকে মারোনি। হাঁদারাম কোথাকার।
–বান্ডল তুমি বেঁচে আছো? বিল চমকে প্রায় লাফিয়ে উঠলো।
–নিশ্চয়ই, বেঁচে আছি।
–কখন তোমার জ্ঞান ফিরেছে?
–প্রায় পাঁচ মিনিট আগে।
–তুমি পাঁচ মিনিট ঘাপটি মেরে শুয়েছিলে।
–তোমার কথাগুলো শুনতে বেশ ভালো লাগছিল। এত সুন্দর সুন্দর কথা তুমি তো আর বলবে না কখনোও। কারণ তুমি সারাক্ষণ নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকো।
বিলের মুখ লাল হয়ে উঠলো।
-বান্ডল, তুমি কিছু মনে করো না। আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি। এটি আমি বহুদিন ধরে মনের মধ্যে পুষে রেখেছি। তোমাকে বলার সাহস হয়নি কখনো।
-তুমি একটা আহাম্মক। বান্ডল মিষ্টি সুরে ধমকে উঠলো। কেন বলতে পারোনি?
–কথাটা শুনে যদি তুমি ব্যঙ্গ করো। আমার মত সাধারণ একটা ছেলেকে বিয়ে করবে, এটা তো ভাবতে সাহস হয় না।
–তাহলে কি জর্জ লোম্যাক্সের মত লোককে বিয়ে করবো?
–আমি কর্ডাসের কথা বলছি না। বিল বললো। এমন কোনো নামী প্রতিষ্ঠিত লোক যে তোমার সবদিক থেকে উপযুক্ত, তেমন কেউ তোমার আছে কিনা জানি না।
-সত্যি, বিল তোমার তুলনা হয় না।
-বান্ডল, তাহলে তুমি কি কোনোদিন তোমার মনকে তৈরি করতে পারবে, আমাকে বিয়ে করার জন্য। আমি জানি, তোমার কাছে আমি নির্বোধ। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। পোষা কুকুর যেমন মনিবের কথা শুনে চলে, তেমনি আমি তোমার ক্রীতদাস হয়ে থাকবো।
সত্যি, কুকুরের সঙ্গে তোমার কোনো তফাত নেই। বান্ডল বললো।কুকুর আমি ভালোবাসি। ওরা ভীষণ বিশ্বাসী হয়, প্রভুভক্ত হয়, ওদেরও ভালোবাসা আছে। অবশ্য তোমাকে বিয়ে করার জন্য আমি আমার মনকে জোর করে পাল্টে দিতে পারি।
বিল বান্ডলকে ছেড়ে দিয়ে অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।
-তুমি কি অন্তর থেকে একথা বলছো?
–এবার চুপ করো, বান্ডল বলে উঠলো। মনে হচ্ছে, আবার অজ্ঞান হয়ে যাই।
–বান্ডল, তুমি জানো, তোমাকে আমি কতখানি ভালোবাসি। উত্তেজনায় বিল কাঁপছিল।
পরের দশ মিনিট একই কথাবার্তার মধ্যে কেটে গেল।
-তুমি এবার তোমার কথা বন্ধ করে মন দিয়ে আমার কথা শোনো। বান্ডল বললো, আমার মাথার ভেতরটা এখনও যন্ত্রণা করছে। তাছাড়া তুমি এমন জোরে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে যে আমার প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এখন বলল, আমরা কোথায় এবং কি ঘটেছে?
বান্ডল দৃষ্টি মেললো চারপাশে। ওর বুঝতে দেরি হলো না, ওরা সেই গোপন ঘরে বন্দী হয়ে আছে। কারণ বাইরের লুকোনো দরজাটা বন্ধ।
-বিল, বান্ডল বললো, নিজেকে সংযত করো। আমাদের এখান থেকে বেরোবার পথ বাতলাতে হবে।
–আঁ, বিল যেন সম্বিত ফিরে পেলো, তাই বুঝি। এর জন্য ভেবো না।
-তোমার মাথার কলকজা বিগড়ে দিয়েছে ঐ ভালোবাসা। বান্ডল বললো। আমারও মনে হচ্ছে, কাজটা কোনো কঠিন নয়।
-সত্যিই তাই। আমার আর কিসের ভাবনা, তুমি আমায় ভলোবাসো, একবার যখন জেনেছি, তখন কুছ পরোয়া নেহি।
-তুমি দয়া করে চুপ করবে? বান্ডল একটু ধমকে উঠলো। আসল কথাই চাপা পড়ে যাবে। তুমি নিজেকে সংযত করো। নতুবা দেখবে আমি মত পাল্টে ফেলেছি।
-না না, বান্ডল কখনো ওটা করো না। তোমাকে যখন একবার পেয়েছি, তখন আর পালিয়ে যেতে দিচ্ছি না।
আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তুমি নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে যেতে পারবে না। বালের কণ্ঠে গর্বিত ভাব।
–তাই বুঝি? বিল বললো। একবার পরখ করে দেখবে নাকি?
–সত্যি তোমার ভালোবাসা অতুলনীয়, ভেবেছিলাম, তুমি বুঝি ভীতু। এখন দেখছি তুমি সাংঘাতিক। মনে হয় আবার আধ ঘন্টা পরেই তুমি আমাকে হুকুম করা শুরু করবে। কিন্তু বিল, আবার বোধহয় আমরা সেই আগের মতো শুরু করতে চলেছি। শোন বিল, এখান থেকে বেরোবার চেষ্টা করতে হবে আমাদের।
–আমি তো আগেই বলেছি, এর জন্য ভেবো না। আমি
বান্ডল ওর হাতে এটা ছোট্ট চাপ দিল। বিল চুপ করে গেল। বান্ডল কান সজাগ করলো।
হাঁ, একটা শব্দ আসছে। পায়ের শব্দ দরজার কাছে এসে থামলো। তালায় কেউ চাবি লাগাচ্ছে। বান্ডল ভাবলো, জিমি কি তাদের উদ্ধার করতে এসেছে না কি অন্য কেউ?
দরজা খুলে গেল। ওদের চোখের সামনে আবির্ভূত হলেন মিঃ মসগোরোভস্কি, কালো দাড়ির বিশাল চেহারা।
বিল মুহূর্তের মধ্যে বান্ডলকে আড়াল করে লোকটির মুখোমুখি দাঁড়ালো।
-শুনুন আপনার সঙ্গে আমি কিছু কথা বলতে চাই। বিল বললো।
রুশ লোকটি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। রেশমের মতো দাড়িতে হাত বোলাতে লাগলেন, ঠোঁটে স্মিত হাসি।
ধীরে ধীরে তিনি বললেন, ঐ লেডিকে একবার আমার সঙ্গে আসতে হবে।
-বান্ডল, বিল বললো। ঘাবড়ে যেও না। সব ঠিক আছে। চিন্তার কোনো কারণ নেই। তুমি ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। ওর কথা মত ওর সঙ্গে তুমি যাও। আমি যা করছি সেটা আমার ঈশ্বর জানেন, তুমি ভীত হয়ো না।
শান্ত মেয়ের মত বান্ডল নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বিলের কণ্ঠস্বরে যেন আদেশের ভঙ্গী। এরকমটা বান্ডল এই প্রথম লক্ষ্য করলো, যেন সমস্ত ব্যাপারটা সে আগেই খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছে। তাই সাহস করে বান্ডলের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। বিলের যে একটা মতলব আছে সেটা ভেবে অবাক হলো।
বান্ডল ও রুশ লোকটি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দরজায় আবার তালা পড়লো।
একটা সিঁড়ি ইঙ্গিত করতে বান্ডল বাধ্য মেয়ের মত সেটা অনুসরণ করলো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ও একটা ঘরে এসে ঢুকলো। ঘরটা যে অ্যালফ্রেডের সেটা বান্ডল নিশ্চিত করে বলতে পারে।
-কোনো রকম টু শব্দ না করে এখানে আপনি অপেক্ষা করুন।
মসগোরোভস্কি একথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
বান্ডল একটা চেয়ারে বসে রইলো।
কয়েক মিনিট কাটলো এই ভাবে। চিন্তা করার ক্ষমতাও যেন লোপ পেয়েছে বান্ডলের। মনে হচ্ছে এক ঘন্টা ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে। কি যে ঘটতে চলেছে?
এমন সময় দরজা খুলে প্রবেশ করলেন মসগোরোভস্কি।
-লেডি এইলিন ব্রেন্ট, সেভেন ডায়াল সোসাইটির এক জরুরী সভায় আপনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দয়া করে আপনি আমার সঙ্গে আসুন।
এবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো ওরা। কি আশ্চর্য, সেই ঘরটা। একবার সে আলমারির ফুটো দিয়ে যে ঘর দেখেছিল। ঘরের সব কিছু দেখেছিল। মুখোস পরা সেই মানুষগুলি টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে। বান্ডল তাজ্জব বনে গেল। ততক্ষণে মসগোরোভস্কি নিজের আসনে বসে মুখোসটা পরে নিচ্ছিলেন।
টেবিলের মাথার চেয়ারে একজন ছিলেন। তার মানে সাত নম্বর আজ হাজির।
বান্ডলের বুকে ধড়ফড়ানি বেড়ে গেল বহুগুণ। বান্ডল সেই সাত নম্বরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। মুখোসের ওপর ঘড়ির সেই সংখ্যা বান্ডল হাঁ করে স্তম্ভিত ভঙ্গীতে লক্ষ্য করছিল।
লোকটি চুপ করে বসে আছে ঠিকই কিন্তু বাস্তলের মনে হলো যেন একটা ক্ষমতা ওর মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে। লোকটি কাঠের পুতুলের মত বসে না থেকে কিছু বলুক বা কোনো অঙ্গভঙ্গী করুন। বান্ডলের একঘেয়ে লাগলোলা। বান্ডলের মনে হলো, মকড়সা যেন তার শিকারের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে আছে।
এই সময় কানে ভেসে এলো মসগোরাভস্কির গলার আওয়াজ, যেন কত দূর থেকে কথা বলছেন।
-লেডি এইলিন, আপনি এই সভায় উপস্থিত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু কোনো মুখোস পরেননি। তাই আমাদের নীতি ও উদ্দেশ্য আপনাকে মানতে হবে। এটা এই সমিতির নিয়ম। তাকিয়ে দেখুন, দুই নম্বর চেয়ার শূন্য। আপনাকে ঐ চেয়ারে বসার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
এসব কি শুনছে বান্ডল। রাতের দুঃস্বপ্নে মনে হলো। প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। এটা কি সম্ভব, যে সমিতিকে সে ঘৃণা করে সেই রক্তপিপাসুক্লাব তাকে সদস্যা হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে? এই প্রস্তাব বিলকেও কি দেওয়া হয়েছিল? ও কি ঘেন্নায় তা ঠেলে দিয়েছিল?
–আমি এ প্রস্তাবে রাজী নই। বান্ডল স্পষ্ট জবাব দিলো।
–ভেবে চিনেত উত্তর দিন লেডি এইলিন।
মসগোরোভস্কি মুখোসের আড়ালে যে হাসছেন সেটা বান্ডল বুঝতে পারলো।
–আপনি কি আন্দাজ করতে পারছেন, কি প্রস্তাব আপনি প্রত্যাখ্যান করছেন?
–খুব ভালো ভাবেই সেটা ধরতে পারছি। বান্ডল বললো।
এবার সাত নম্বর ওকে চমকে দিলো। কণ্ঠস্বর বেশ পরিচিত। এই গলার আওাজের লোকটিকে সে চেনে। বান্ডলের মনে খুশীর দোলা লাগছে। দম বন্ধ করা অবস্থা তখন ওর। জানতে পারবে সব কিছু। যেটা জানার জন্য ওরা এতদিন উৎকণ্ঠিত হয়েছিল।
ধীরে ধীরে মুখোস খুলে গেল, লোকটির আসল মুখ বেরিয়ে পড়লো। কাঠের পুতুলের মত ওর সামনে ভেসে উঠলো সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটলের মুখ।
.
বান্ডল স্তম্ভিত
প্রায় লাফ দিয়ে উঠে এলেন মিঃ মসগোরাভস্কি। বান্ডলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন-খুব ধাক্কা খেয়েছে দেখছি। একটা চেয়ার দাও।
চোয়ারে গা এলিয়ে দিলো বান্ডল। বিস্ময়ের ধাক্কা ও সহ্য করতে পারেনি। ওর শরীর যেন ওর আয়ত্তের মধ্যে আর নেই। স্নায়ুগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে।
ব্যাটল তার নিজের স্বভাব অনুযায়ী কথা বলে উঠলেন।
লেডি এইলিন, আমাকে দেখে আপনি স্তম্ভিত হয়ে গেছেন, তাই না? এখানে যারা উপস্থিত আছেন তারাও আশা করেনি আমাকে এখানে দেখবেন বলে। বলতে গেলে এক্ষেত্রে মিঃ মসগারোভস্কি আমার সহকারীর কাজ করেছেন। এটা চালনার দায়িত্ব তার ওপর ছিল। অন্যেরা তার নির্দেশ অন্ধের মত পালন করেছেন মাত্র।
বান্ডলের কথা বলা দূরে থাক, ঠোঁট পর্যন্ত নড়লো না। কোনো এক অক্ষম শক্তি তার ওপর যেন ভর করে আছে।
ব্যাটল মাথা হেঁট করলেন, বোঝাতে চাইলেন যে, তিনি বান্ডলের মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছেন।
-আমি জানি, আপনার মনে দুএকটা কথা কাটার মত বিধে আছে। সেগুলো আপনাকে তুলে ফেলতে হবে। লেডি এইলিন, আপনি হয়তো অনেক এই ধরনের সমিতির গল্প পড়েছেন যাদের পেছনে থাকেন একজন পাকা অপরাধী যাকে কেউ কখনো দেখতে পায় না। বাস্তবে যে এমন কোনো সমিতি থাকতে পারে সেটা আমার জানা নেই। অবশ্য আমার অভিজ্ঞতা নেহাত কম নয়।
..তবে পৃথিবীতে রোমাঞ্চ ছড়িয়ে আছে অনেক। এই ধরনের বই পড়ে অল্প বয়েসের ছেলেমেয়েরা এ কাজে লিপ্ত হয়। আমি এরকম কয়েকজনকে জানি, যারা পেশাদার নয়, কিন্তু আমাদের দপ্তরের জন্য প্রশংসনীয় কাজ করেছে। অনেক সময় তাদের নাটক করতে হয়েছে চাপে পড়ে। এছাড়া তাদের কোনো উপায় থাকে না; যখন ভয়ঙ্কর বিপদের মুখোমুখি হয় তারা। দেশের জন্য তারা বিপদকে অগ্রাহ্য করেছে, ভালোবেসেছে।
..লেডি এইলিন, আপনি সামনে তাকিয়ে দেখুন। সকলের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিই। মিঃ মসগোরোভস্কি, একে আপনি নিশ্চয় চিনেছেন। এই সমিতি এবং আরো কিছু তিনি পরিচালনা করেন। এর সবচেয়ে বড় পরিচয়, ইনি হলেন ইংল্যান্ডে আমাদের সবচেয়ে বড় বলশেভিক বিরোধী বন্ধু এবং সিক্রেট এজেন্ট।
…হাঙ্গেরিয় দূতাবাসের কাউন্ট আন্দ্রাস হলেন পাঁচ নম্বর। মৃত জেরি ওয়েডের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। চার নম্বর যাকে দেখছেন, তিনি হলেন মার্কিনী সংবাদিক এবং আমাদের বন্ধু মিঃ হেওয়ার্ড ফেলপস্। আর তিন নম্বর হলেন।
ব্যাটল মুচকি হেসেই বলতে বলতে থেমে গেলেন। বান্ডল ভয়চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। দেখলো সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে বিল এভারসেল।
-যে সাহসী যুবক দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, ব্যাটল বলতে শুরু করলেন, সেই রনি ডেভেরার জন্য দুই নম্বর চেয়ারটি নির্দিষ্ট ছিল। সেটা আপততঃ খালি। আর এক নম্বর আসনটি মৃত জেরাল্ড ওয়েডের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। সে-ও বীরের মত একইভাবে প্রাণ দিয়েছেন। এখন সেই জায়গায় বসেছেন আমাদের একান্ত শুভাকাঙ্ক্ষী একজন মহিলা, আমাদের কাজে ভীষণ ভাবে সাহায্য করেছেন।
এতক্ষণে এক নম্বর তার মুখোস খুলে ফেললো। চমৎকার, সুন্দর কাউন্টেস র্যাডকির মুখের ওপর বান্ডলের নজর পড়লো।
আমার বোঝা উচিত ছিল। বান্ডল এতক্ষণে ধাতস্থ হয়ে উঠেছে। আপনি কোনো উত্তেজনা শিকারী হতে পারেন না।
কিন্তু বান্ডল, তুমি এখনও এর শেষ চমকপ্রদ কথাটি জানো না। বিল বললো। যার কথা তোমাকে আগেই বলেছিলাম ইনি সেই সেন্ট মাউর। ও প্রমাণ করে দিয়েছে যে কি দারুণ অভিনয় সে করতে পারে।
আমি গর্বিত বোধ করছি না, কারণ আমার বাবা-মা ইওরোপের ঐ এলাকা থেকেই আসে। একটু বিদেশিনী সুলভ নাকি সুর মিস মাউরের কথায় ফুটে উঠলো। তবে অ্যাবীতে যখন বাগান নিয়ে আলোচনা হয়েছিল তখন প্রায় ধরা পড়েছিলেন আর কি। তবে এর সবটাই মজা নয়। আমি রনির বাগদত্তা ছিলাম। যারা ওকে খুন করেছে তাদের ওপর আমি প্রতিশোধ নেবোই, এই আমার প্রতিজ্ঞা।
–সব যেন কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। বান্ডল বললো, সব কি সত্যি?
লেডি এইলিন, ব্যাটল বললেন, এর সবকিছু জলের মত সহজ। কিছু উত্তেজনা উপভোগ করার জন্য কিছু তরুণ উদ্যোগী হয়ে এই কাজ শুরু করে।
…কথাটা প্রথম আমাকে জানান মিঃ ওয়েড। গোপন সমিতি গড়ে তুলে গোপন গোয়েন্দাগিরি করা ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। আমি তাকে বলি, এসব কাজে অনেক ঝুঁকি আছে, জীবনও সংশয় হতে পারে। কিন্তু তারা তাদের প্রতিজ্ঞায় ছিল অটল। অতএব শুরু হলো এই ব্যাপারটা।
কিন্তু এর উদ্দেশ্য কি? বান্ডল প্রশ্ন করলো।
আমরা এমন একজনকে খুঁজছিলাম যে অপরাধ জগতে অসাধারণ ব্যক্তি, তার কাজ ছিল মিঃ ওয়েডের মত নানা রকমের রাইফেলের ব্যবস্থা করা, তবে তার কাজ সাধারণ ছিল না। আন্তর্জাতিক ব্যাপারে তার টান ছিল অত্যন্ত বেশি। এর আগে মূল্যবান গোপন কাগজপত্র এবং আবিষ্কার দুবার খোয়া যায়। এর সঙ্গে যে ভেতরের কেউ রয়েছে, সেটা আমাদের বুঝতে দেরি হয় না। পেশাদার গোয়েন্দারাও এর কোনো কূল-কিনারা করতে পারলো না। ফলে এইসব অপেশাদারী গোয়েন্দারা কাজে হাত লাগালো, অবশেষে সফল হলো।
–সফল হয়েছে?
হয়েছে। তবে এর বিনিময়ে আমাদের দিতে হয়েছে দুটি বীরের প্রাণ আর সে পালায়। লোকটি দারুণ বিপজ্জনক। কিন্তু সেভেন ডায়ালস পরাজয় স্বীকার করতে জানে না। তারা আঠার মতো লেগেছিল। অবশেষে জয় হলো সেভেন ডায়াল-এর। ধন্যবাদ জানাই বিল এভারসলেকে। গতকাল হাতে হাতে ধরা পড়েছে লোকটি।
আমি তাকে চিনি? বাঙল প্রশ্ন করলো। লোকটার নাম কি?
-লেডি এইলিন, আপনি তাকে খুব ভালো ভাবে জানেন। তার নাম মিঃ জিমি থেসিজার। আজ বিকেলে তাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে।
.
ব্যাখ্যা করলেন ব্যাটল
আয়েস করে বসলেন সুপারিন্টেন্টে ব্যাটল। সমস্ত রহস্য ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন।
জিমি থেসিজার যে অপরাধী একথা প্রথমে আমার মনে আসেনি। কিন্তু মি ডেভেরো শেষ কথাগুলো শোনার পর আমার মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। মিঃ থেসিজারকে মিঃ ডেভেরো জানাতে বলেছেন সেভেন ডায়ালস তাকে মেরেছে।
..আদৌ ব্যাপারটা তা নয়। মিঃ ডেভেরো বলতে চেয়েছিলেন যে জিমি থেসিজার সম্পর্কে সেভেন ডায়ালসকে জানাতে।
..মিঃ ডেভেরো আর মিঃ থেসিজার ছিলেন অন্তরঙ্গ বন্ধু, অতএব এটা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য লাগবে। তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম অপরাধী বাড়ির মধ্যেই আছে। সে পররাষ্ট্র দপ্তরে কাজ না করেও সেখানকার অনেক কথা জানতো। তাছাড়া কোনো কাজ কর্ম না করে বিলাসিতার মধ্যে দিন কাটাতে মিঃ থেসিজার প্রচুর টাকা কোথা থেকে পেতেন?
…এরপর চিমনির ঘটনা আমাকে আরো নিশ্চিত করে দিয়েছিলো। সবাই জানে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে মিঃ ওয়েডের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু রনি ডেভেলরা এটা মেনে নিতে পারেনি। তিনি বুঝেছিলেন, খুনী বাড়ির মধ্যে আছে। সে কথা মিঃ থেসিজারকে জানাতে গিয়েও জানাননি।
–তাহলে ফুটম্যান বাওয়ার নির্দোষ?
-হ্যাঁ, বাওয়ার আমাদেরই একজন, লেডি এইলিন, বাওয়ারের ওপর নজর রাখার নির্দেশ ছিলো। কিন্তু সে বিশেষ কিছু করতে পারেনি।
…মিস লোরেন ওয়েডের মাধ্যমে মিঃ থেসিজার সমস্ত খবরাখবর পেনে। লোরেন ওয়েডকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। থেসিজার যা বলতেন তাই তিনি নিৰ্বিাদেরতেন।মিস ওয়েড জেরি ওয়েডের বোন নন। তিনি মিস ওয়েডকে ভালোবাসতেন। এই কারণে মিঃ থেসিজারের হাতে তাকে খুন হতে হয়েছিল। ঐ একই কারণে রনি ডেভেরো তার মৃত্যু ডেকে আনে।
…তার ওপর আবীতে যখন আপনি আসতে চাইলেন তখন বিল এভারসলে আরো ঝামেলায় পড়লেন। আপনার এবং মিঃ থেসিজারের ঘনিষ্ঠতা ওকে অস্বস্তিতে ফেললো। যখন তিনি জানতে পারলেন সেভেন ডায়ালস-এ আপনি প্রবেশ করেছেন এবং সবকিছু শুনে ফেলেছেন তখন আরো আশ্চর্য হয়ে যান।
…সত্যি, লেডি এইলিন, আপনি আমাকেও টেক্কা দিয়েছিলেন।
— …আপনি সব কথা মিঃ থেসিজারকে বলে দেবেন এই ভেবে বিল এভারসেলে আপনাকে সব কিছু জানায়নি।
অ্যাবীতে রাতে পাহারা দেবার দায়িত্ব ভাগ করে নিলেন মিঃ থেসিজার আর মিঃ এভারসলে। মিস সেন্ট মাউর লাইব্রেরিতে জানলার পাশে পাহারায় ছিলেন। মিঃ থেসিজারকে আসতে দেখে উনি পর্দার আড়ালে আত্মগোপন করেন।
…এরপর মিঃ থেসিজার যা বলেন সব ঠিক। কিন্তু এমন কিছু ঘটলো যা আমার তদন্তে সাহায্য করলো।
দাঁতের কামড়ের দাগ বসানো একটা পোড়া দস্তানা আমি পেয়ে গেলাম।
মিস ওয়েড ও মিঃ থেসিজার আগেই পরিকল্পনা করে নিয়েছিলেন। অতএব নির্ধারিত সময়ে বেড়া ডিঙিয়ে মিস ওয়েড ভেতরে প্রবেশ করেন, আমার লোকজন তাকে ঢুকতে দেখে, কিন্তু আমার নির্দেশ ছিলো, ঢোকার মুখে কাউকে বাধা দেবে না। পরিকল্পনা মত তিনি বারান্দায় উঠে আসেন। পায়ের সামনে প্যাকেট পেয়ে তুলে নিয়ে ছোটেন। ওদিকে লাইব্রেরি ঘরের মধ্যে চলছে গল্পের মারামারি। চেয়ার টেবিল ছোঁড়াছুড়ি চলছে। ঐ সময় সকলেরই ঘটনাস্থলে যাওয়ার কথা। সেই ফাঁকে ফর্মুলা নিয়ে পালাবেন মিঃ ওয়েড।
কিন্তু দরজা দিয়ে বেরোতে গিয়ে ধরা পড়লেন আমার হাতে। এদিকে প্যাকেট ফেলে দিয়ে মিঃ থেসিজার নকল মারামারি শুরু করেছেন। চাপা স্বরে নিজেই কিছু বলে ওঠে। তারপর নিজের কোল্ট রিভলবার দিয়ে কাল্পনিক আততায়ীকে লক্ষ্য করে গুলি করেন। পরক্ষণে দস্তানা পরে নিয়ে একটা মাউসার পিস্তল বের করে নিজের হাতে গুলি করে অস্ত্রটা তিনি বাগানে ছুঁড়ে ফেলেন। আমি এসে দেখি তিনি অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। দস্তানাটা পেলাম চুল্লির মধ্যে। বুঝতে বেশি সময় নিলো না যে দস্তানাটাই আসল রহস্য।
…তাছাড়া মিঃ থেসিজার কোনো একজনকে লক্ষ্য করে প্যাকেটা ছুঁড়ে ছিলেন ঠিকই। কিন্তু মিস ওয়েড যদি আচমকা সেখান এসে থাকেন তাহলে আসল লোকটি কে? কাউন্টেস হতে পারে না, কারণ উনি আমাদের লোক। মিঃ থেসিজারকে সন্দেহ করলেও প্রমাণ না থাকায় কিছু করতে পারছিলাম না। মিঃ থেসিজারও মনে মনে ভীত হয়ে পড়ে। সেভেন ডায়ালস-এর সঙ্গে তাকে লড়তে হচ্ছে। তাই তো সাতনম্বরের জন্য মরীয়া হয়ে ওঠে। কুটদের বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে যাওয়ার পেছনে ওর একটা উদ্দেশ্য ছিল, কারণ স্যার অসওয়াল্ডকে ও সাত নম্বর বলে সন্দেহ করেছিল।
আমি কিন্তু সন্দেহ করেছিলাম তার সেক্রেটারিকে যাকে আপনারা পঙ্গো বলেন। সেক্ষেত্রেও আমার সন্দেহ টিকলো না। কারণ তিনি বাঁ-হাতি হলেও ডান হাত তার অকেজো নয়। যার ডান হাত অকেজো হবে তাকে দাঁত দিয়ে দস্তানাটা খুলতে হবে। অতএব তিনি রইলেন সন্দেহের বাইরে।
…তবে এটা স্বীকার করতেই হবে বিল এভারসেলে নিজের জীবন বিপন্ন করে ওকে ধরতে সাহায্য করেছে।
…মিঃ এভারসলে মিঃ থেসিজারকে একটা বানানো উকিলের চিঠি দেখালেন যেটা রনি ডেভোরোর উকিল পাঠিয়েছে। কাগজগুলি দেখে থেসিজারের কেমন সন্দেহ হয়। আমরা এটাও জানতাম, থেসিজার দোষী বলে বিলকে পথ থেকে সরিয়ে দিতে চাইবেন। হলোও তাই। তিনি বিলকে একটা পানীয় দেন যেটা গলায় যাওয়ার পর ধীরে ধীরে বিল এলিয়ে পড়বে। কিন্তু বিল সেটা পান না করে মিঃ থেসিজারের বাইরে যাওয়ার ফাঁকে একটা জারে পানীয়টা ঢেলে দেন। কিন্তু পানীয় খেয়ে তার যে ক্রিয়া শুরু হয়েছে সেটা মিথ্যে করে দেখাতে থাকেন। জিমি ভাবলেন ওষুধে কাজ হচ্ছে, তাই তিনি অকপটে সব কিছু স্বীকার করলেন এবং মিঃ এভারসলে তার তৃতীয় শিকার বলে জানায়।
..বিল এভারসলের বেহুঁশ দেহটা নিচে নিয়ে এসে গাড়িতে তোলেন। এরই মাঝে আপনাকে ফোন করেছিলেন, তাই না? মিঃ থেসিজার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর আমার দুজন লোক সেখানে গিয়ে জারের পানীয় সংগ্রহ করে নিয়ে আসে যার মধ্যে ছিল মরফিয়ার হাইড্রোক্লোরাইড। তারপর মিঃ এভারসলেকে গাড়িতে বসিয়ে তিনি সেভেন ডায়ালস ক্লাবে ঢুকে পড়েন।
…তারপর ডাক্তার ডাকার নাম করে তিনি ওপরে এই ঘরে দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকেন। মিস ওয়েড আপনাকে কায়দা করে ঐ ঘরে পাঠিয়ে দিলেন।
এরপর বিল এভারসলে বলতে শুরু করলো।
–আমার হুশ থাকলেও আমি কাউকে কিছু বুঝতে দিলাম না। সোফায় অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছি। লোরেনের গলা পেলাম, দারুণ ভাবে কাজ হাসিল হয়েছে।
থেসিজার বললো–ওদের দুজনকেই এক ঘরে রাখবো। তুমি আমায় একটু সাহায্য করো। এবার সাত নম্বর আঁৎকে উঠবে।
লোরেন বললো, ওর আর জ্ঞান ফিরবে না তো?
-না না, যা একখানা মোম আঘাত দিয়েছি, তুমি নিশ্চিত থাকো।
…ওরা দরজা বন্ধ করে চলে গেলে চোখ খুললাম। তোমাকে দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, তুমি মরে গেছে।
–আপনারা কি ওকেও ধরেছেন? বান্ডল জানতে চাইলো।
সুপারিন্টেন্ডন্ট ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন।
তবে, মনে হয় না ওর ফাঁসি হবে। কিন্তু জিমি থেসিজারকে ফাঁসির দড়িতে গলা দিয়ে হবে। এইবার লেডি এইলিন আপনি যদি এখন এখটু সুস্থ মনে করেন তাহলে চলুন আমরা সকলে মিলে আজকের দিনটাকে সেলিব্রেট করি। কাছে একটা ভালো রেস্তোরাঁ আছে।
বান্ডল খুশী হলো।
সেভেন ডায়ালস। বিল বলে উঠলো, হুররে। আজ শ্যাম্পেনের ফোয়ারা ছুটবে।
–সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্যাটল, বান্ডল বললো, আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে, কিন্তু আপসোস হচ্ছে যে আপনার বৌ আছে। অগত্যা বিলের সঙ্গে আমাকে ঘর বাঁধতে হবে।
.
লর্ড কেটারহ্যাম সমর্থন করলেন
-বাবা, বান্ডল বললো, তোমাকে একটা খবর জানাই। এবার তুমি আমাকে হারাতে যাচ্ছো।
–কেন, লর্ড কেটারহ্যাম বললেন, তোর কি হয়েছে যে তোকে হারাবো। বুকে কোন অসুখ নেই বা অন্য কিছু নেই, যার জন্য তুই একথা বলছিস।
–আমি আমার বিয়ের কথা বলছি, বাবা।
বাঃ ভালোই বলেছিস। বিয়ের সময় সেজেগুজে জর্জ লোম্যাক্সের হাতে তোকে তুলে দিতে হবে, এই তো।
তুমি কি মনে করছে, আমি জর্জকে বিয়ে করছি? ওর থেকে অনেক ভালো লোককে আমি বিয়ে করছি।
–ভালো হলেই ভালো। তবে লোকের চরিত্র বড় বিচিত্র। লর্ড কেটারহ্যাম বলতে থাকেন। তোর মুখে শুনেছি, জিমি কত ভালো ছেলে। অথচ দ্যাখ, একটা পাকা খুনী। চেহারা দেখে কিছু বোঝা যেতত? তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়নি, এটাই আমার দুর্ভাগ্য। ভাবছিলাম একটা জীবনী লিখবো।
বাবা, আমার মনে হচ্ছে, আমি না থাকলে তোমার ভীষণ কষ্ট হবে, বান্ডল বললো।
-সেটা মানিয়ে নিতে হবে। লর্ড কেটারহ্যাম বেরিয়ে যাওয়ার জন্য সামনে এগোলেন। একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন, হারে, তুই কাকে বিয়ে করছিস?
–এতক্ষণে তোমার একটা জানার কথা মনে পড়লো। বান্ডল বললো, বিল এভারসলেকে আমি বিয়ে করছি।
তিনি খুশীতে মাথা দোলাতে লাগলেন–খুব ভালো ছেলে তাই না? তবে মনে হয় মাথায় একটু গণ্ডগোল আছে। ঠিক বলেছি, চমৎকার। আসছে শরতে আমরা দুজনে জমিয়ে গলফ খেলতে পারবো।