- বইয়ের নামঃ স্পার্কলিং সায়ানাইড
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- প্রকাশনাঃ সমতট
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, ভূতের গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী
স্পার্কলিং সায়ানাইড
১. আইরিস মারলে
১.১
স্মৃতি ভীষণ ভয়ঙ্কর, বড়ই বেদনাদায়ক, ফতে আক্রান্ত হন রোজমেরি। হাসিখুশী সুন্দরী রোজমেরিকে মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে গেল বোন আইরিস মারলের কাছ থেকে, নীল বর্ণ মুখ, আঙুলগুলো মুঠোর মধ্যে বন্দী।
তবে কি রোজমেরি আত্মহত্যা করেছিলেন? ভাবতেও মন চায় না আইরিশের।
মৃত্যুর কারণ জানার জন্য অনুসন্ধান চললো এবং একদিন তা শেষও হলো। তারপর থেকে আইরিস ঐ ভয়ঙ্কর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় না। কেবল নিজের মনকে বুঝিয়েছেন, ভুলে যাও।
কিন্তু ভুললে তাকে চলবে না। এটা তিনি বুঝতে পারছেন।
আগের দিন জর্জের সঙ্গে সেই বিস্ময়কর সাক্ষাৎকার। জর্জের আচরণ, তার অন্যমনস্কতা, তার আচ্ছন্ন ভাব, তার সন্দেহজনক আচরণ, এসবের মধ্যে কি কোনো অর্থ লুকিয়ে নেই?
তার প্রিয় বোন রোজমেরি। তার মনে পড়ে যায় সুদূর অতীতের কথা। যখন তারা বাচ্চা ছিলেন তখনকার কথা স্মৃতি পটে ভেসে ওঠে, রোজমেরি তার থেকে ছবছরের বড় ছিলেন।
মনে পড়ে কত বিচ্ছিন্ন ঘটনা, টুকরো টুকরো দৃশ্য। রোজমেরির সখ ছিলো, শূকরের লেজের মতো বেনী দোলানো।
রোজমেরি বোর্ডিং-এ থেকে পড়াশুনা করতেন। ছুটিতে বাড়িতে আসতেন। যখন আইরিস স্কুলে ঢুকলেন তখন রোজমেরি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে চলে এসেছেন। তখন তার পরিবর্তন এসেছে সবকিছুতেই। আগের সেই হ্যাঁবলা ক্যাবলা রোজমেরি নেই। পোষাকে-আশাকে ফুটে উঠেছে, রুচির আভাস, কোমল কণ্ঠস্বর, মাধুর্যভরা চেহারা। গাঢ় নীল দুটি চোখে অন্তর্ভেদী চাউনি, সোনালি চুল মাথায়, যেন এক নিখুঁত সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি। এক পাগল করা রূপ।
তারপর থেকে দুজনের দেখা খুব কমই হতো।
তখন আইরিসের চলছে স্কুল জীবন, আর রোজমেরি এদিকে একা একা জীবনকে উপভোগ করছে। ছুটিতে আইরিস বাড়ি এলেও তাদের মধ্যে একটা ব্যবধান থেকে গেল। হয়তো ছবছরের ব্যবধান।
একদিন জর্জ বারটনের সঙ্গে রোজমেরির বাগদান পর্বচুকলো, কেনাকাটা, বিয়ের আয়োজনে কয়েকটা দিন হুল্লোড়ে কেটে গেল।
কিন্তু ঐ অল্প বয়সে আমার মনে এটা প্রশ্ন জেগেছে–রোজমেরি কেন তার থেকে পনেরো বছরের বড় জর্জকে স্বামী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন? এটা কি তার দয়া দেখান, না কি বোকামির পরিচয়?
অবশ্য রোজমেরির নিজের যথেষ্ট টাকা ছিলো, পল কাকার টাকা। আসলে তিনি ওদের আসল কাকা ছিলেন না। আইরিস যতটুকু শুনেছেন, তাদের মায়ের সঙ্গে পল বেনেটের ভালোবাসা ছিল। তাদের মা অন্য একজন গরীব লোককে পছন্দ করেন। পল বেনেট তার সেই পরাজয় রোমান্টিক মনোভাব নিয়ে মেনে নেন এবং সেই থেকে তাদের পরিবারে পল কাকা হিসাবে থেকে যান। রোজমেরির কাছে তিনি ছিলেন ধর্ম পিতা, তাঁর মৃত্যুর পর জানা যায়, তার সমস্ত অর্থ সম্পত্তির একমাত্র মালিকানা হলেন তার ছোট্ট ধর্ম কন্যা রোজমেরি।
আইরিসের কখনও মনে হয় না, রোজমেরি জর্জকে ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু তাকে দেখে বোঝা যেতো না যে তিনি দাম্পত্য জীবনে অসুখী। রোজমেরির বিয়ের এক বছর পর মারা যান মা ভায়োলা মারলে। মায়ের মৃত্যুর পর আইরিস চলে আসেন দিদি-জামাইবাবুর সংসারে। তখন তার বয়স সতেরো, তখনই তিনি উপলব্ধি করেন দিদি এবং তার স্বামীর প্রকৃত সম্পর্কের কথা।
অবশ্য ঐ বয়সে আইরিসের গভীর ভাবে চিন্তা করার মত ক্ষমতা জন্মায়নি। তাদের মা তাদের ঠিক মত যত্ন করতে পারতেন না কারণ তিনি ছিলেন রুগ্ন। কাজের লোকের ওপর তাকে ভরসা করতে হতো, কিন্তু মেয়েরা কাছে এলে তিনি তার ভালোবাসা উজার করে দিতেন। আইরিসের যখন পাঁচ বছর বয়স তখন অতিরিক্ত মদ্যপান করার জন্য অসময়ে মারা যান হেকটর মারলে। আর সতেরো বছর বয়সে তিনি মাকে হারালেন।
দিদির বাড়িতে তার মন বসতো না, কিন্তু এক বছর না হলে অন্য কোথাও চলে যেতে পারবেন না। তিনি এইসময় ফরাসি আর জার্মান ভাষা শিখতে লাগলেন। ডোমেস্টিক সায়েন্সের ক্লাসও শুরু করলেন। এক এক সময় হাতে কাজ থাকতো না, তখন আপন মনে বসে থাকতে হতো।
তখন রোজমেরি মার্কেটিং ককটেল পার্টি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত। তার সঙ্গে গল্প করার সময় কোথায়। একই বাড়িতে দুই বোনের বাস ছিল, অথচ অন্তরঙ্গতা ছিল না বললেই চলে। এ অবস্থায় দিদি রোজমেরির সম্পর্কে তিনি কতটুকু জানতে পারেন? তবু তাকে ঘাঁটতে হবে অতীতের ফেলে আসা দিনগুলিকে।
ঘটনাটা ঘটার এক সপ্তাহ আগে আইরিস ভুলতে পারবেন না সেই দিনটির কথা। চোখ বন্ধ করে স্মৃতি রোমন্থন করলেন আইরিস।
রোজমেরির বসার ঘরে ঢুকে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়া
তিনি কি দেখেছেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। রোজমেরি লেখার টেবিলের ওপর মাথা হেঁট করে কাঁদছেন। কেন এই কান্ন? আগে তো কখনো কাঁদতে দেখেননি। দারুণ ভয়ে পেয়ে যান আইরিস।
তবে রোজমেরির শরীর ক্লান্ত ছিল। কারণ দুদিন আগে ফ্লু থেকে উঠেছেন তিনি।
আইরিস নিজেকে সামলাতে না পেরে জোরে কেঁদে ওঠেন।
রোজমেরি ধাতস্থ হয়ে দাঁড়ালেন, এলোমলো চুলগুলি কপালের ওপর থেকে সরিয়ে দিলেন, সম্ভব মতো নিজেকে সহ্য করে নিয়ে রোজমেরি বললেন-ও কিছু না, ঘর থেকে দৌড়ে পালিয়ে গেলেন।
দিদির আচরণে আইরস হতাশ হয়ে পড়লেন। বসার ঘরে আবার এসে ঢুকলেন। টেবিলের ওপর তিনি তার সন্ধানী দৃষ্টি মেলে ধরলেন, প্যাডের ওপর একটা চিঠির ওপর তার দৃষ্টি আটকে গেল। চিঠিতে নিজের নাম দেখে আইরিস চমকে উঠলেন। তবে কি রোজমেরি তাকে চিঠি লিখছিলেন।
চিঠির ওপর ঝুঁকি চোখ রাখলেন তিনি,
প্রিয় আইরিস,
তোমার জন্য আলাদা করে আর উইল করার দরকার নেই। আমি খুব ভালো করেই জানি, আমার সব অর্থ তোমারই হবে। তবে আমার একান্ত যে সব জিনিস সেগুলো আমি কয়েকজনকে দিয়ে যেতে চাই।
চিঠি পড়ে আইরিস পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।
এর মানে কি? তবে কি রোজমেরি বুঝতে পেরেছেন, তার মৃত্যু আসন্ন? কিন্তু সামান্য ফুতে কেউ মারা যায় না, অথচ অনেকটা সুস্থ ও।
বারবার একটা লাইন তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো–আমার সব অর্থ তোমারই হবে।
অবশ্য পল বেনেটের উইলের শর্ত কি ছিল সেটা সঠিক জানেন না আইরিস। তিনি জানতেন কাকা পলের প্রচুর অর্থের একমাত্র উত্তরাধিকারিণী হয়েছেন রোজমেরি। যে প্রশ্ন এতদিন তার মনের মধ্যে গেঁথে ছিল সে উত্তর তো উনি এই চিঠিতেই পেলেন। রোজমেরির মৃত্যুর পর সমস্ত সম্পত্তির মালিক হবেন আইরিস, স্ত্রী বা স্বামীর তো টাকাটা পাওয়া আইনসম্মত উচিত। কিন্তু বোনের কি সে অধিকার আছে? মনে হয় রোজমেরি নিশ্চিত। তাই তিনি লিখেতে পেরেছেন, আমি ভালো করেই জানি যে আমরা সব অর্থ তোমারই হবে।
তবে মাঝে মাঝে আইরিসের মন যে বিদ্রোহ করে ওঠেনি তা নয়। একই মায়ের দুই মেয়ে। অতএব পল কেন তার সমস্ত অর্থ একা বরাজমারিকে দিয়ে যাবেন?
রোজমেরি নিত্য নতুন পোষাক পরে, বেড়াতে যায়, পার্টিতে যায়, বন্ধুদের ভালোবাসা, স্বামী সংসার, তার কিছুর অভাব নেই, অথচ আইরিস?
চিঠিটা তিনি দুভাজ করে টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিলেন।
সেই অভিশপ্ত জন্মদিনের উৎসবের পর চিঠিটা আবার ড্রয়ার থেকে বের করা হয়। রোজমেরির আত্মহত্যা করার স্বপক্ষে এটা একটা বাড়তি প্রমাণ। দরকারে এই চিঠি প্রমাণ করে দেবে যে দুদিনের ফুতে ভুগে সেরে ওঠা শরীর ও মন নিয়ে রোজমেরি খুশী ছিলেন না, হয়তো তাই তিনি আত্মহত্যার কথা ভেবে থাকবেন।
তদন্তের সময় ইনফ্লুয়েঞ্জা আর হতাশা প্রকাশ পায়। রোজমেরির চিঠিটা সেই মোটিভটা জোরদার করতে সাহায্য করলো।
রোজমেরির মৃত্যুর স্বপক্ষে তখন অন্য কোনো উদ্দেশ্য দেখাতে পারেননি আইরিস, বা জর্জ বারটন বা অন্য কেউ।
সেদিনের সেই চিলেকোঠায় দুর্ঘটনার কথা ভাবতে গিয়ে আইরিস অবাক হচ্ছেন।
.
রোজমেরির মৃত্যুর ছমাস পরে ঘটলো সেই চিলেকোঠার ঘটনা।
আইরিস তখনো বোনের সংসারে আছে। তিনি একদিন মারলে পরিবারের সলিসিটারের সঙ্গে দেখা করলেন। বয়স্ক ভদ্রলোক, ভদ্র অথচ চোখে শয়তানির ছাপ। তিনি আইরিসকে বোঝালেন যে পল বেনেটের উইলের শর্ত অনুযায়ী প্রথম উত্তরাধিকারী হলেন রোজমেরি। তার মৃত্যুর পর তার সন্তানেরা হবে অর্থের মালিক। আর যদি অপুত্রক হন তাহলে তার বোন আইরিস পাবেন সেই অর্থ। তবে একটা শর্তে, একুশ বছর হলে কিংবা বিবাহ হলেই সেই অর্থের অধিকারিণী হবেন, নতুবা নয়।
রোজমেরির মৃত্যুর পর আইরিসের থাকা নিয়ে একটা সমস্যা হয়েছিল। জর্জ বারটনের ইচ্ছা ছিল, তার পিসি মিসেস ড্রেকের কাছে আইরিস যেন থাকেন। কিন্তু আইরিস এই প্রস্তাব মেনে নেননি। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো আইরিস আপাতত জর্জ বারটনের বাড়িতে ছোট বোনের মতো থাকবেন। সাংসারিক বিধি-ব্যবস্থাও শান্তিপূর্ণ ভাবে মিটে গেল।
অনেকদিন ধরেই আইরিস তার অতি প্রিয় পুরোনো লাল পুলওভারটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ওটা খুঁজতেই তিনি গিয়ে ঢুকলেন চিলেকোঠার ঘরে। ট্রাঙ্ক ভর্তি পুরোনো পোশাক ঐ ঘরে রাখা ছিল। ট্রাঙ্ক ঘাঁটতে গিয়ে একটি সিল্কের ড্রেসিং গাউন আবিস্কার করলেন যেটা রোজমেরি বহুদিন ব্যবহার করেছেন। রোজমেরির সমস্ত পোশাক পরিচিত আত্মীয়-স্বজনদের দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অথচ এই ড্রেসিং গাউনটা কিভাবে এখানে পড়ে রইলো।
তিনি ট্রাঙ্কে ওটা আবার রাখতে গিয়ে চমকে উঠলেন। পকেটের মধ্যে এটা কি? দ্রুত হাত ঢুকিয়ে দিলেন। বেরিয়ে এলো একটা কাগজের টুকরো। খুলে ধরলেন। রোজমেরির হাতে লেখা একটা চিঠি।
প্রিয়তম লিওপার্ড,
তোমার হয়তো জানা নেই, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি জানো না,…আমরা পরস্পরকে তো ভলোবাসি। আমরা ওকে অপরের জন্য। একথা তোমারও জানা উচিত। যে যার জীবন নিয়ে আমরা বাঁচতে পারি না। আমাদের হৃদয় অভিন্ন। চলো আমরা কোথাও পালিয়ে যাই। আমি তোমায় কথা দিচ্ছি, তোমাকে আমি সুখী করবোই। লিওপার্ড, তোমার হয়তো মনে নেই, তুমি বলেছিলে আমি ছাড়া তোমার জীবন অপূর্ণ। অথচ তুমি লিখেছে, যা কিছু আমাদের মধ্যে হয়েছে সব ভুলে যেতে। সবকিছুর এখানেই সমাপ্তি টানতে। সেটা অসম্ভব, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। লিওপার্ড, সাহসী হও। আমি জর্জকে জানাবো। তবে জন্মদিনের উৎসবের পরে।
আমি জানি, আমি যা করতে যাচ্ছি, তা ঈশ্বরের ইচ্ছায়। তোমাকে আমি ভালোবাসি। তোমাকে আমি কখনোই ছাড়তে পারবো না। ওঃ প্রিয়তম–
পলকহীন চোখে চিঠির দিকে আইরিস তাকিয়ে রইলেন। তার দিদির যে একজন প্রেমিক ছিলেন, তা তিনি জানতেন না? অবশ্য কতটুকুই বা তার সম্পর্কে তিনি জানতেন?
এই চিঠি তিনি পাঠাননি। তাহলে কোন্ চিঠি রোজমেরি পাঠিয়েছিলেন? শেষ পর্যন্ত ওরা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?
কে এই লিওপার্ড? তিনিও নিশ্চয়ই রোজমেরিকে খুব ভালোবাসতেন। হয়তো তিনি শেষ পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই ভালো লাগা-ভালোবাসার জের টানতে আর চাননি তাই তিনি সব সম্পর্কের সমাপ্তি চেয়েছিলেন।
অথচ রোজমেরি? তিনি তাদের ভালোবাসাটাকে ব্যর্থ হতে দিতে চাননি। তাই তিনি স্থির করে ফেলেছিলেন
আইরিস কেঁপে উঠলো।
তবে তার ধারণা ছিলো অন্ধ। নতুবা তার দিদির জীবনে এতবড় পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছিল, তিনি এক বিন্দুও আন্দাজ করতে পারেননি।
কিন্তু কে এই ভদ্রলোক?
আইরিস স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকেন। কত পুরুষ তো রোজমেরির কাছে আসতো, গল্প করতো, ফোন করতো। তাদের মধ্যে কি এই প্রতারক ছদ্মবেশে লুকিয়ে ছিল? কে সে?
এদের মধ্যে স্টিফেন ফ্যারাডেকে মনে পড়ে আইরিসের। ওঁর মধ্যে রোজমেরি কি এমন দেখলেন। যুবক বয়েস। উঠতি রাজনীতিবিদ। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশা রাখে। এটাকেই কি রোজমেরি বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলো? তবে লোকে বলে স্টিফেনের স্ত্রী ওকে ভীষণ ভালোবাসে। শোনা যায় বাড়ির প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও মেয়েটিকে স্টিফেন বিয়ে করে, তার রাজনৈতিক জীবন মেয়েটির একান্ত কাম্য ছিল বলে। একটি মেয়ে যদি স্টিফেনের মধ্যে ভালোবাসার গন্ধ পেয়ে থাকে তাহলে অন্য মেয়ের পক্ষে তাকে ভালোবাসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। হ্যাঁ সেই লোক স্টিফেন ফ্যারাডেই বটে।
তবে স্টিফেন যদি না হয় তবে এ্যানথনি ব্রাউন তো হবেই। সে ছিল রোজমেরির অনুগত। ঠিক যেন চাকর। হুকুম তামিল করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করে। লোকটা রসিকপ্রিয়। কিন্তু রোজমেরির কাছে নিজেকে এতো খেলো করে ফেলেছিল যে মনে হয় না তার মধ্যে কোনো গভীরতা আছে।
রোজমেরির মৃত্যুর পর তাকে আর কেউ দেখতে পায়নি। মনে হয় ভদ্রলোক আমেরিকান নতুবা কানাডিয়ান ছিলেন।
সে ছিল রোজমেরির বন্ধু। তাই তার মৃত্যুর পর ব্রাউনের আসা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রয়োজন তো নেই।
তখনও হাতের মধ্য চিঠিটা ছিলো। আইরিস সেটা আবার ভাজ করে দাঁড়িয়ে রইলেন হাতে নিয়ে। এটা এবার কি করবেন?
পরক্ষণে মনে হলো, চিঠিটা পরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। প্রমাণ হিসাবে কাজে লাগতে পারে। তাই তিনি গহনার বাক্সে সেটা রেখে দিলেন।
.
তারপর?
আইরিস আবার তার স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেলেন।
আগের দিন রাতে সেই বিস্ময়কর সাক্ষাৎকারের রহস্যটা একটু একটু করে স্মৃতির পর্দায় পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠেছে। ঠিক তখনই এ্যানথনি ব্রাউনের আবির্ভাব ঘটলো।
নভেম্বরে মারা যান রোজমেরি, পরের মে মাসে লুসিল ড্রেকের তত্ত্বাবধানে তিনি তার সামাজিক জীবন শুরু করেন। দিনের পর দিন পাটি নাচ-গানে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন।
জুনের শেষে এক অতি নীরস নাচের আসরে আইরিসের কানে হঠাৎ ভেসে এলো একটা পুরুষ কণ্ঠস্বর।
-আপনিই কি আইরিস মারলে?
আইরিস ঘুরে তাকলেন, সামনে দাঁড়িয়ে এ্যানথনি, মুখে তার হাসির ঝিলিক।
সে আবার বললো, আপনি যে আমাকে চিনতে পারবেন সেটা অশা করিনি।
–হ্যাঁ, আপনাকে আমার মনে আছে। সম্ভবত রোজমেরির জন্মদিনের পর থেকে আর
আইরিস আর শেষ করলেন না কথাটা। তার মুখের রঙ ফ্যাকাসে হয়ে উঠলো। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে তার দিকে তাকালেন।
এ্যানথনি অপ্রস্তুত হলেন। তিনি ক্ষমা চাইলেন–আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কথাটা আপনাকে মনে করিয়ে দিয়ে, অত্যন্ত নিষ্ঠুরের মতো ব্যবহার করেছি।
একটু থেমে আবার বললো, আসুন আমরা ওসব ভুলে একটু নাচ করি।
এ্যানথনির কথায় আইরিস রাজী হয়ে গেলেন। এ্যানথনির বাহুপাশে নিজেকে ধরা দিলেন।
এ কি সেই লোক, যে রোজমেরির বন্ধু ছিল। সেই চিঠিটা এর উদ্দেশ্যেই কি রোজমেরি লিখেছিলেন? তবে কি এর ছদ্মনাম লিওপার্ড? আইরিস বুকের মধ্যে একটা যন্ত্রণা অনুভব করলো।
-এতদিন আপনি কোথায় ছিলেন? আইরিস লোকটির দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন।
মুহূর্তের মধ্যে নাচ থেমে গেল। আইরিসের থেকে একটু দুরে সরে গেল সে। তার মুখের হাসি নিমেষে উধাও হয়ে গেল।
-ব্যাবসা সংক্রান্ত কাজে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল।
–তাহলে আবার ফিরে এলেন কেন? আইরিস প্রশ্ন করলো।
এবার সে হেসে বললো–তোমাকে দেখার জন্য আমি আবার ফিরে এসেছি, আইরিস মারলে।
এ্যানথনি তাকে কাছে টেনে নিলো। নাচের তালে তালে আইরিসের সঙ্গে সে ছন্দ মিলিয়ে নাচে। এ্যানথনির স্পর্শে তার দেহ মনে শিহরণ জাগছে কেন?
এরপর থকে এ্যানথনি সপ্তাহে অন্তত একবার তার সঙ্গে দেখা করতোই। যখন যেখানে ভালো লাগতো সেখানে ওরা পরস্পরের সঙ্গে মিলতো, কিন্তু এ্যানথনি কখনো এলভাস্টন স্কোয়ারে আসতো না। কারণ একদিন আইরিস তাকে ঐ বাড়িতে আসার নিমন্ত্রণ জানাল। কিন্তু এ্যানথনি সেটা অগ্রাহ্য করে। তখনি তার মনে হলো, কেন, কেন এই প্রত্যাখ্যান? তবে কি রোজমেরি আর সে
একদিন আইরিসকে চমকে দিয়ে জর্জ বারটন বললেন-তুমি কি এ্যানথনি ব্রাউনকে জানো? সে কি রোজমেরির বন্ধু ছিল? জর্জের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো।
আইরিস গম্ভীর গলায় বললেন–ছিলো বৈ কি। কিন্তু সে তো আজ অতীত। পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করে বললেন, একথা মনে করিয়ে দেওয়ায় আমি দুঃখিত।
-আমি রোজমেরিকে ভুলতে চাই না। জর্জের কণ্ঠস্বর শান্ত। সে আমার স্ত্রী ছিল। আজ আমার কাছে কেবল স্মৃতি। আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বললেন, আইরিস, তোমার দিদিকে আমি ভুলতে চাই না। কিন্তু এই এ্যানথনি ব্রাউনকে রোজমেরি হয়তো পছন্দ করতো। তার সম্বন্ধে রোজমেরি বিশেষ কিছু জানতো বলে আমার মনে হয় না। তাই তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি। মনে রেখো, তুমি একজন ধনী মহিলা। হতে পারে সে একজন সম্মানিত ও পয়সাওয়ালা লোক। কিন্তু তার ব্যাপারে খুব কম লোকেরই আগ্রহ আছে।
আইরিস রাগে জ্বলে উঠলো।
–হয়তো তাই কিন্তু এ বাড়িতে সে বেশি একটা আসে না।
–ভেবেছিলাম তোমার ব্যাপারে মাথা ঘামাবো না। কিন্তু তুমি আমার আত্মীয়। তাই তোমাকে আগে থেকে সাবধান করে দিচ্ছি। জর্জ বলতে থাকেন, নতুবা মাকে পরিষ্কার জানাতে হবে, তোমার বয়স কম, তোমার সুখ-সুবিধার ব্যবস্থা তো আমাকেই করতে হবে। আমি চাই, তুমি তোমার জীবন সম্পূর্ণ ভাবে উপভোগ করো।
–জর্জ, তুমি ভেবো না। আমি তা করছি।
পরে মিসেস ড্রেকের সঙ্গে এ্যানথনি ব্রাউনের ব্যাপারে তার কথা হয়েছিল। কিন্তু এমন কপাল খারাপ যে তখন লুসিল তার অকর্মণ্য ছেলের তারবার্তা নিয়ে ব্যস্ত। ভিক্টর ছিলো মায়ের চোখের মণি। দুর্বল মায়ের মনের ওপর বার বার চাপ সৃষ্টি করে সে টাকা আদায় করে নিতো। এবার ভিক্টর দুশো পাউন্ড পাঠাতে বলেছে। জীবন তার বিপন্ন। লুসিল তাই কাঁদছিল।
এই টাকা না পেলে সে নিশ্চয়ই নিজেকে গুলি করবে।
-না, তা সে করবে না। জর্জ অন্যমনস্কভাবে কথাটা বললো।
–আমার নিজের ছেলের স্বভাব আমার খুব ভালো ভাবে জানা আছে। তাই ভাবছি আমার শেয়ারগুলো বিক্রি করে দেবো।
–দেখো লুসিল, জর্জ বললেন, তুমি দু-একদিন অপেক্ষা করো, ওখানে আমার একজন লোক আছে। তার মাধ্যমে আমি তোমার ছেলের প্রকৃত অবস্থা জেনে নিচ্ছি। তবে আমি বলি কি, তুমি ওর স্বভাব পাল্টাতে সাহায্য করো। ও নিজের অভাব নিজেই মেটাক।
লুসিল একটু ঠান্ডা হলো, তবে অন্তত পঞ্চাশ পাউন্ড পাঠাতে চাইলো ছেলের কাছে। টাকাটা জর্জ দিতে চাইলেন, কিন্তু ভিক্টর জানবে যে তার মা শেয়ার বিক্রি করে টাকা পাঠিয়েছে।
-সে ত তোমার পরিবারের কেউ নয়, তাহলে তোমার অত দায় কেন? আইরিস প্রশ্ন করলো।
-রোজমেরির পরিবার মানে আমার পরিবার।
–সত্যি তুমি কত মহান জর্জ। আবেগ জড়ানো গলায় আইরিস বললেন।
জর্জ এখন ভাবছেন রিও-ডি জেনেরিওর সেই যুবকটিকে নিয়ে। যে যুবক বিবেকহীন, কেবল বাক চাতুর্যের কলাকৌশল রপ্ত করেছে।
আইরিসের কথা ভেবে জর্জ ঠিক করলেন, লুসিলকে ওর দায়িত্ব পুরোপুরি নিতে বললেন। এ্যানথনি ব্রাউনের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের ফলাফলের ওপর সতর্ক নজর রাখা উচিত।
রোজমেরির মৃত্যুর কয়েকদিনের মধ্যে জর্জের মধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখা যায়। অনেক যেন বয়েস হয়ে গেছে, চেহারায় একটা ভারিক্কী ভাব। এটাই স্বাভাবিক কিন্তু এই পরিবর্তন যখন স্বাভাবিক সীমারেখা অতিক্রম করে তখন অন্যের কাছে সেটা চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
জর্জের সঙ্গে এ্যানথনি ব্রাউনের মতবিরোধ হওয়ার পর তিনি নিজেকে আইরিসের কাছ থেকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলেন। বিনা প্রয়োজনে স্টাডিরুমে গিয়ে বসে থাকতেন। তার দৃষ্টিতে উদাস ভাব, হতবুদ্ধি হয়ে গেছেন এমন গোছের। প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর পাননি আইরিস। কেবল তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। মনে হয় কোথায় যেন তার একটা আঘাত লেগেছে।
দিনে দিনে জর্জকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হলো। এ ব্যাপারে কেউ মাথা ঘামার্লো না।
কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন জর্জ বললেন, আইরিস। রোজমেরি কি তোমার সঙ্গে বেশি কথাবার্তা বলতো।
প্রশ্ন শুনে আইরিস অবাক হলেন, কেন জর্জ। ছোট বোনের সঙ্গে কথা বলবেন না তো আর কার সঙ্গে কথা বলবেন?
–ও কি নিজের প্রসঙ্গে কথা বলতো? না কি ওর বন্ধুবান্ধবদের কথাও তোমার সঙ্গে আলোচনা করতে?
–তিনি বেশি কথা বলতেন না। তার কাজ নিয়ে বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকতেন?
ভেবেছিলাম, রোজমেরি হয়তো তোমাকে কিছু বলে থাকবে।
এই ধরনের নানা প্রশ্ন করতেন জর্জ। যেমন রোজমেরির কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল কিনা? তারা কারা? ওর কোনো গোপন কথা বলেছে কিনা ইত্যাদি।
–আচ্ছা আইরিস, রোজমেরির কোনো শত্রু ছিল? সত্যিকারের শত্রু? যার কাছ থেকে তার ক্ষতির আশঙ্কা করা যেতে পারে? হঠাৎ একদিন এই বিস্ময়কর প্রশ্নটা করে বসলেন জর্জ।
আইরিসের চোখের চাউনি দেখে জর্জ ঘাবড়ে যান।
আবার কয়েকদিন পর জর্জ জানতে চাইলেন ফ্যারাডেদের সঙ্গে রোজমেরির দেখাসাক্ষাৎ হত কিনা।
–আচ্ছা, ফ্যারাডেদের সম্বন্ধে তোমার দিদি তোমাকে কিছু বলেছিল?
না, মনে পড়ে না। তবে রাজনৈতিক আলোচনায় ওর খুব আগ্রহ দেখতাম।
–হ্যাঁ, রাজনৈতিকের রা পর্যন্ত জানতো না। সুইজারল্যান্ডে ফ্যারাডেদের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পরে ও এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
…তবে ও ছিলো চাপা স্বভাবের শান্ত মেয়ে। স্টিফেনের জন্য যে রোজমেরি পাগল ছিল, এ খবর আমি অনেকের কাছ থেকে শুনেছি।
হতে পারে।
–আচ্ছা, এ্যানথনি ব্রাউনকে দেখে তোমার কি মনে হয়?
সুন্দর স্বভাবের কেতাদুরস্ত এক ভদ্রলোক।
–সে কিসের ব্যাবসা করে জানো?
–না, সেটা জানি না। এটা সে আমাকে বলেনি।
-আমি জানি। জর্জ বলেন। অস্ত্র উৎপাদনকারী কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সে যুক্ত। গত হেমন্তে ইউনাইটেড আর্মস লিমিডেটের চেয়ারম্যান ডিউস বেরিলর সঙ্গে তার অনেক টাকার ব্যাবসার একটা চুক্তিপত্র সাক্ষরিত হয়। এই এ্যানথনি ব্রাউনের মধ্যে অনেক সম্ভাবনা দেখেছিলেন রোজমেরি। কিন্তু
জর্জ বলে চললেন, ওদের পরিচয় অল্প কয়েকদিনের। মাঝে মাঝে তারা নাচের আসরে যেতো। রোজমেরি এই অল্প পরিচয়ের সূত্র ধরে কেন যে জন্মদিনের আসরে ওকে কামনা করে ছিল সেটা আমার কাছে আজও রহস্য বলে মনে হয়।
চকিতে ভেসে উঠলো সেই সন্ধ্যার দৃশ্য আইরিসের চোখের পর্দায়।
লাক্সেমবার্গের গোল টেবিল। মিষ্টি নীলাভ আলো, বাতাসে ফুলের গন্ধ। নাচের তালে তালে বাজনার মিষ্টি সুর। টেবিলের চারধারে বসেছিলেন সাতজন লোক। তার পাশে বসেছিল এ্যানথনি ব্রাউন, রোজমেরি, স্টিফেন ফ্যারাডে, রুথ লেসিং, জর্জ এবং জর্জের ডানদিকে স্টিফেন ফ্যারাডের স্ত্রী লেডি আলেকজান্ডার ফ্যারাডে।
সেই পার্টি চলাকালীন মাঝপথে রোজমেরিনা না, আইরিস সে কথা ভাবতে চায় না।
-আইরিস, ব্রাউনকে একদিন নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিও, তার সঙ্গে আবার আমি আলাপ করতে চাই।
খুশীতে আইরিস লাফিয়ে উঠলেন। জর্জ আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে উঠেছেন। এ্যানথনি সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল ঠিকই। কিন্তু ব্যাবসার কাজে তাকে বাইরে চলে যেতে হয়। ফলে সে কথা রাখতে পারেনি।
একদিন জুলাই মাসের শেষে জর্জ একটা চমকপ্রদ খবর দিলো আইরিস আর লুসিলকে। একটা বাড়ি তিনি কিনেছেন। যে জায়গাটা প্রায়রস নামে পরিচিত সেখানে। দশ একর জমির ওপর বাড়িটা। ছোট-খাটো জর্জিয়ান হাউস।
পুরোনো বাড়ি আবার নতুন করে সাজাতে হবে। মিসেস ড্রেক বললেন।
–ওদিকটা দেখার দায়িত্ব রুথের। ওর ওপর কাজ দিয়ে ভরসা করা যায়।
জর্জের অতি বিশ্বস্ত সেক্রেটারি হলো রুথ লেসিং। রূপে গুণে চমৎকার। হাসতে হাসতে সব সমস্যা সহজ সরল ভাবে সমাধান করে ফেলে সে। জর্জের অফিস চালায় সে। অনেকের ধারণা জর্জকেও সে চালনা করে। তার সিদ্ধান্ত জর্জকে মাথা নত করে মেনে নিতে হয়। আর রুথকে দেখে মনে হয় যেন ওর কোনো চাহিদা নেই।
–আচ্ছা জর্জ, সেখানে টেনিস কোর্ট আছে?
-হ্যাঁ, গলফ লিঙ্ক থেকে মাত্র ছমাইল দূরে, সমুদ্র মাত্র চোদ্দ মাইলের মধ্যে। তাছাড়া সেখানে আমাদের প্রতিবেশী হিসাবে যাদের পাচ্ছি–
-প্রতিবেশী? আইরিস কথার মাঝখানে প্রশ্ন করলেন।
আইরিসের চোখে চোখ রাখতে পারলেন না জর্জ। অন্য দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বললেন–হ্যাঁ, মাত্র মাইল দেড়েক দূরে, পার্কটা পেরিয়ে ফ্যারাডেদের বাড়ি।
আইরিসের বুঝতে দেরি হলো না কেন হঠাৎ গোপনে জর্জ সাসেক্সে ঐ বাড়িটা কিভাবে পেলেন। আসলে স্টিফেন এবং সান্দ্রা ফ্যারাডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্যই তাদের বাড়ির কাছাকাছি একটা বাড়ি তিনি কিনেছেন।
কিন্তু এর কারণ কি?
তাহলে কি জর্জের বিশ্বাস স্টিফেন আর রোজমেরির মধ্যে বন্ধুত্ব ছাড়া অন্য কোনো সম্পর্ক ছিলো? সেই গোপন তথ্যটা জানার জন্যই সেখানে তার যাওয়া?
ইদানিং জর্জকে কেমন সন্দেহজনক পুরুষ বলে মনে হয়েছে।
ধীরে ধীরে জর্জকে সন্দেহ রোগে ধরলো। তার দেহ ও মনের অবস্থার অবনতি ঘটলো।
আগস্টের বেশির ভাগ সময় তারা কাটালেন লিটল পায়রসে। মস্ত বাড়িটার অদ্ভুত নির্জনতা আইরিসকে বিরক্ত করে তোলে। সাজানো গোছানো, সুন্দর পরিবেশ। তবু আইরিসের সহ্য হয় না। মাঝে মাঝে ভয়ে কেঁপে ওঠেন তিনি।
সপ্তাহের শেষে টেনিস খেলা, ফ্যারাডেদের বাড়িতে নৈশভোজে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়া এ যেন একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিলো। সেখানকার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সান্দ্রাই পরিচয় করিয়ে দেন। কিন্তু লুসিল ডিনার পার্টি বা নাচ-গান পছন্দ করতেন না। কিন্তু তার ঠোঁটে হাসিটুকু লেগে থাকতো সবসময়।
কে বলতে পারে তিনি তার হাসির আড়ালে কি অভিসন্ধি লুকিয়ে রেখেছেন? তিনি যেন এক রহস্যময় নারী।
স্টিফেন নাকি রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ত। তাই তাকে বেশি দেখা যেতো না। কিন্তু আইরিসের মনে হয়, তিনি ইচ্ছে করেই লিটল প্রায়রসের বাড়িতে আসছেন না।
এইভাবে কেটে গেল সেপ্টেম্বর মাস। ঠিক হলো নভেম্বরে তারা লন্ডনে ফিরে যাবেন।
ওখান থেকে চলে আসার ঠিক আগের দিন, ঠিক রাত একটায় আইরিসের চোখে সবে মাত্র ঘুম এসেছে এমন সময় দরজার কড়া নাড়ার শব্দ। আইরিস উঠে দরজা খুলে দিলেন। জর্জ দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি যে এখনো ঘুমোতে যাননি সেটা তার পোশাক দেখেই আইরিস বুঝতে পারলেন। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। মুখের রঙ পাল্টে গেছে।
-আইরিস, তুমি আমার স্টাডিরুমে এসো। তোমার সঙ্গে কথা আছে। আর একজনের সঙ্গেও আমাকে কথা বলতে হবে।
তারা দুজনে স্টাডিরুমে এসে ঢুকলেন। জর্জ দরজা বন্ধ করে দিলেন। জর্জের নির্দেশে তার উল্টোদিকের একটা চেয়ারে আইরিস বসলেন।
–কি ব্যাপার জর্জ? আইরিস আচমকা প্রশ্ন করলো। তোমাকে এত উত্তেজিত দেখাচ্ছে কেন?
আমি আর একা একা ভাবতে পারছি না। জর্জ অস্পষ্ট কণ্ঠে বলতে থাকেন, তোমাকেও বলতে হবে, তুমি কি ভাবছে–এটা কি সম্ভব?
–কিন্তু জর্জ, তুমি কি বলতে চাইছে, আমি তো বুঝতে পারছি না।
জর্জ দুহাতে কপাল টিপে ধরলেন।
–তুমি বুঝতে পারছো, তাই না? তুমি ওরকমভাবে আমার দিকে তাকিও না। আমার ভীষণ ভয় করছে, আইরিস। তোমার সাহায্য আমার প্রয়োজন। তুমি বিশ্বাস করো, আর একটু দেরি হলে আমি সত্যিই পাগল হয়ে যাবো।
টেবিলের ড্রয়ার খুলে দুটি কাগজ বের করলেন তিনি। এগিয়ে দিলেন আইরিসের দিকে।
–পড়ে দেখো।
চিঠিতে নজর দিলো আইরিস। চিঠির বক্তব্য অতি সহজ ও সরল।
–তুমি ভাবছো, তোমার স্ত্রী রোজমেরি আত্মহত্যা করেছে? না, সে খুন হয়েছে।
দ্বিতীয় চিঠিতেও ঐ একই লেখা।
-চিঠিগুলো তিনমাস আগে পেয়ে প্রথমে কোনো গুরুত্ব দিইনি। জর্জ বলতে থাকেন। তারপর গভীর ভাবে ভাবতে শুরু করি, কেন রোজমেরি আত্মহত্যা করতে যাবে?
–হয়তো ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভুগে তার মন ভেঙে গিয়েছিল, নতুবা তিনি ছিলেন অসুখী?
আইরিসের দ্বিতীয় মন্তব্য জর্জ মেনে নিলেন সহজভাবে–তা হতে পারে। তবে আমার মনে হয় না, অসুখী ছিলো বলে সে আত্মহত্যা করবে। ও আমাকে ভয় দেখাতে পারতো। তারপর যদি বাধা পেতো তাহলে তো অন্য পথ বেছে নিতে পারতো, যেটা এখনো আছে।
..আমি অনেক কথা ভেবেছি। এর মধ্যে নিশ্চয়ই একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। তাই তো তোমার কাছে রোজমেরি সম্পর্কে নানারকম প্রশ্ন করছি। যাই হোক, যে-ই ওকে খুন করুক না কেন, খুনের উদ্দেশ্য কি ছিল তার।
–জর্জ, তুমি কি পাগল হলে–
-না, না, আইরিস, আমাকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। তোমাকেও এ ব্যাপারে ভাবতে হবে, আইরিস। ফলে কাজটা আমার এগিয়ে যাবে আরো। বার বার সেই অভিশপ্ত রাতটার কথা স্মরণ করো। তুমি ওর কাছাকাছি ছিলে, রোজমেরির খুনী নিশ্চয়ই ওর আশেপাশে কোথাও থাকবেন। তুমি নিশ্চয়ই খুনীকে দেখে থাকবে?
সেই দৃশ্যটা আইরিসের নিশ্চয়ই মনে আছে। স্বল্প নীলাভ আলোর স্বপ্নময় পরিবেশে বাজনার তালে তালে ড্রামের আওয়াজ। একসময় রোজমেরি টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। মুখের রঙ পাল্টে নীল হয়ে গিয়েছিল।
আইরিস কেঁপে ওঠে।
রোজমেরি এক স্মৃতি, বড় মর্মান্তিক স্মৃতি।
.
রুথ লেসিং
১.২
কাজের অবসরে রুথ লেসিং ভাবছিল তার বসের স্ত্রী রোজমেরি বারটনের কথা।
রোজমেরিকে খুব একটা পছন্দ করতো না সে। তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু সে জানতো না। ভিক্টর ড্রেক তাকে অনেক কিছু জানায় ওর সম্বন্ধে।
জর্জ বারটনের ওপর তার আনুগত্য কখনো শিথিল হয়নি। যখন সে জর্জের কাছে চাকরিতে আসে তখন তার বয়স মাত্র তেইশ বছর। জর্জের দায়িত্ব নেওয়া তার একান্ত প্রয়োজন। সেই থেকে রুথ সেই ভার বহন করে চলেছে। রুথের উপস্থিতি জর্জের পছন্দ হতো। তার সব কাজই নির্ভুল বলে মনে হতো জর্জের। জর্জ তার ব্যক্তিগত ব্যাপারেও রথের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন।
কখনো কখনো জর্জ ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে রুখের সঙ্গে আলোচনা করতেন। রুথ মন দিয়ে শুনে তার সমাধান করে দিতো। প্রয়োজনে উপদেশ দিতো। রোজমেরির সঙ্গে জর্জের বিয়েটা মন থেকে মেনে সায় না দিলেও মেনে নেয় শেষ পর্যন্ত।
ধীরে ধীরে রুথ বারটন ফ্যামিলিতে নিজের আধিপত্য বিস্তার করলো। সকলের তাকে পছন্দ। এখন রুথের বয়েস ঊনত্রিশ। কিন্তু সে আগের মতো পূর্ণ যুবতী উজ্জ্বল এবং ভাস্বর।
বিয়ের পর আনন্দমুখর দিনগুলির কথা রুথের অজানা নয়। যেমন অজানা নয় পরবর্তীকালে তার অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়ার কথা।
কিন্তু জর্জের অন্যমনস্কতার কারণ তার জানা ছিল না।
একদিন ভিক্টর ড্রেকের কথা জর্জ তাকে বললেন।
-রুথ আমার হয়ে তোমাকে একটা অপ্রিয় কাজ করতে হবে।
রুথ চোখ তুলে তাকিয়েছিল।
–আমাদের পরিবারে একটা গাধা আছে। সে হলো আমার স্ত্রীর পিসতুতো ভাই। সে একটা অকালকুষ্মাণ্ড। ইতিমধ্যে সে তার মায়ের শেয়ার কিছু বেনামে বিক্রি করে দিয়েছে। এইভাবে তার মাকে প্রায় শেষ করে দিয়েছে। সে এখন বেকার উদ্দেশ্যহীন ভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
…এখন সে লন্ডনে। আমার স্ত্রীকে টাকার জন্য চিঠি পাঠিয়ে ভীষণ জ্বালাতন করে। কথাবার্তায় সে চোস্ত। আমি ওর অন্যায় জুলুম আর সহ্য করতে পারছি না। তাই আজ বেলা বারোটার সময় ওকে হোটেলে আসতে বলেছি। আমি চাই, তুমি আমার হয়ে ওর সঙ্গে মোকাবিলা করো।
–কিন্তু এখন তার চাহিদা কি? রুথ এই ধরনের চরিত্র মোটেও পছন্দ করে না।
-নগদ একশো পাউন্ড ও বুয়েন্স এয়ারসে যাওয়ার জন্য একটা টিকিট। জাহাজে ওঠার সময় তাকে টাকাটা দিতে হবে।
তার মানে আপনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে চান যে সে জাহাজে উঠলো কিনা, তাই তো?
-হ্যাঁ, তুমি আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে দেখছি। জর্জ বললেন, ছেলেটার নাম ভিক্টর ড্রেক, ঠিকানা রুপার্ট রাসেল স্কোয়ার। তার নামে ক্রিস্টোপস জাহাজের টিকিট কাটা আছে। আগামী কাল টিলবাড়ি থেকে জাহাজ ছাড়ছে।
জাহাজের চিকিটটা হাতে নিয়ে রুথ তার হাত ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো।
–প্রিয় রুথ, তোমার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করি আমি। জর্জ বললেন, তুমি জানো না রুথ, তুমি আমার কত প্রিয়।
রুথ তার আনন্দ ঢাকতে হেসে উঠলো–আপনি এইসব সুন্দর সুন্দর কথা বলে আমাকে দেখছি নষ্ট করে দেবেন।
-না না, রুথ আমাকে তুমি বলতে দাও। তুমি আমার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের একজন বিশেষ অংশীদার। তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অচিন্ত্যনীয়।
তার কথার উষ্ণ আবেশ ছড়িয়ে পড়ে রুথের সর্বাঙ্গে।
ঠিক সময়ে সে রুপার্ট হোটেলে এসে পৌঁছালো।
ভিক্টরকে দেখে তার মনে হলো, মেকী ব্যক্তিত্বসর্বস্ব একটি লোক। তবে রীতিমতো আকর্ষণীয়। রুথ তাকে বেশি প্রশ্রয় দেয় না, পাছে সে ভাবাবেগে অভিভূত হয়ে পড়ে।
জর্জের গুপ্তচর? কিন্তু আপনার দেখা পেয়ে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। ভিক্টর তাকে চিত্ত সম্ভাষণ জানায়।
জর্জের শর্তের কথা রুথ তাকে জানায়। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে ভিক্টর সব শর্ত মেনে নিতে রাজী হয়ে গেল।
সুন্দরী পিসতুতো বোন আইরিসকে স্পর্শ না করা, সুযোগ্য পিসতুতো ভগ্নিপতি জর্জকে কোনো ব্যাপারে বিরক্ত না করে, আমি সব মেনে নিচ্ছি। সান ক্রিস্টোপলে সে আমাকে বিদায় জানাতে আসছে। প্রিয় মিস লেসিং আপনি?
আবেগে ভিক্টরের কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে আসে, সে ভালো করেই জানে মেয়েদের কাছে সে দারুণ ভাবে আকর্ষণীয়।
–আচ্ছা মিস লেসিং, বারটন আপনাকে ছাড়া এক পাও এগোতে পারে না, তাই না? আমি সব কিছু জানি। রোজমেরি আমাকে বলেছে। ভিক্টর হাসে
-রোজমেরি?
–এই পর্যন্ত থাক। রোজমেরি খুব ভালো মেয়ে। অত্যন্ত সহানুভূতিশীল তিনি। ইতিমধ্যেএকশো পাউন্ড তার কাছ থেকে পেয়ে গেছি আমি।
–আপনি
ভিক্টর হাসতে থাকে। মনে হয় ওর হাসিটা সংক্রামক। রুথ লেসিংও হাসতে থাকে।
–এ আপনার খুব অন্যায়, মিঃ ড্রেক। আপনার লজ্জা হওয়া উচিত।
-লজ্জা? আমি আপনার কথার প্রতিবাদ করছি? মিস লেসিং। আপনি জানেন না, আমি কতো খারাপ একজন দুর্নীতি পরায়ণ লোক, কেন আমি খারাপ হলাম আপনাকে সেটা বলতে চাই।
-কেন? রুথ কৌতূহলী হয়ে বললো।
-জীবনে আমি অনেক উপভোগ করেছি। ভালো দিকটাও আমি দেখেছি। ভিক্টর আপন মনে বলে চলে। অনেক দেশ আমি ঘুরেছি। একসময় আমি ছিলাম অভিনেতা, স্টোরকীপার, রেস্তোরাঁর ওয়েটার, মালবাহী পোর্টার, সার্কাসে অংশ নেওয়া। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি একসময়। কিছুদিন জেলে কাটিয়েছি। কিন্তু একদিনের জন্য সৎ হওয়ার চেষ্টা করিনি এবং আমার নিজের পথে কখনো চলিনি। এই দুটোকে আমার জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছি।
ভিক্টর রুথের দিকে তাকিয়ে হাসলো। তার সম্মোহন শক্তির কাছে রুথের প্রতিবাদ করার ইচ্ছাশক্তি হেরে গেল।
মিস লেসিং, আপনার চোখে ঐ সরল চাহনি মানায় না। আপনি অফিসের বসকে বিয়ে করা মেয়েদের পর্যায়ে আছেন। সাফল্য আপনার অন্ধ প্রত্যাশা। রোজমেরিকে বিয়ে না করে জর্জের উচিত ছিলো আপনাকে বিয়ে করা।
–আপনি আমাকে অপমান করছেন?
—না, মোটেও না। রোজমেরি যেমন স্বর্গের মতো সুন্দরী তেমনি খরগোসের মতো বোকা, ওকে ভালোবাসা যায়, কিন্তু সে ভালোবাসাকে জড়িয়ে থাকা যায় না। কিন্তু আপনি তার বিপরীত। আপনার প্রেমে যে পুরুষ পড়বে সে কোনোদিন ভালোবাসায় ক্লান্তি অনুভব করবে না।
-কিন্তু আমার প্রেমে তিনি পড়বেন না।
–জর্জ আপনার প্রেমে পড়েনি? নিজেকে আপনি বোকা বানাবার চেষ্টা করবেন না, রুথ। রোজমেরির কোনো অঘটন ঘটলে জর্জ আপনাকে বিয়ে করতেন।
রুথ মনে মনে ভাবে, তার সূত্রপাত হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুথের দিকে তাকালো ভিক্টর–আপনি একথা খুব ভালো ভাবেই জানেন। শান্ত গলায় বলতে থাকে, আমি আপনার ভালো কামনা করি। নিজের ওপর আরো বিশ্বাস রাখুন। জর্জকে চাপ দিন।
ভিক্টর, আসল কথাই বলেছে। কথ ভাবে। মাঝখানে রোজমেরি না থাকলে এতদিনে সে জর্জকে বিয়ে করতো। তার আরো কাছে আসতে পারতো। তার ভালো মন্দ দেখতে পারতো।
এইভাবেই শুরু হলো ঘটনা। ভিক্টরের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ব্যাপারটা আরো দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললো। রুথ অফিসে ফিরে এলো, তার মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটেছে সেটা কেউ লক্ষ্য করলো না।
একটু পরেই রোজমেরি ফোন করলেন–রুথ, জানো, কর্ণেল রেস আমার পার্টিতে আসতে পারবেন না টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিয়েছেন। ওর পরিবর্তে কাকে নিমন্ত্রণ করা যায় সেটা তুমি জর্জের কাছ থেকে জেনে নাও। আসলে আমাদের এখানে একজনকে দরকার। আমি ভেবে পাচ্ছি না, সেই একজন কে হতে পারে।
-কেন, ঐ একজন তো আমি হতে পারি। আমাকে আপনি দয়া করে ঐ পার্টিতে থাকতে বলেছেন।
–ও হ্যাঁ, ভুলেই গিয়েছিলাম।
রোজমেরি উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন। এদিকে রুথের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। রোজমেরি যা দেখতে পেলেন না।
রোজমেরিকে সে একেবারেই পছন্দ করে না। তিনি ধনী, সুন্দরী, অমনোযোগী এবং বুদ্ধিহীন। জর্জের স্ত্রী হওয়ার একেবারে অনুপযুক্ত।
সেদিন অপরাহ্নে রোজমেরি বারটনকে সে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল। আজ এক বছর পরেও সেই মনোভাব অটুট আছে। সেই নভেম্বরের দিনগুলোর কথা রুথ ইচ্ছা করে ভাবতে লাগলো।
পরদিন সকালে সাম ক্রিস্টোরাল জাহাজ ছাড়ার খবর পেয়ে জর্জ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন– তাহলে শেষ পর্যন্ত জাহাজে উঠেছে সে?
–হ্যাঁ।
–রুথ, তার সম্বন্ধে তোমার কি ধারণা?
ইচ্ছে করে রুথ নিরুত্তাপ গলায় উত্তর দেয়, আমি যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি। দুর্বল মনের নোক সে।
কিন্তু তার বুকের ভেতর তখন অব্যক্ত যন্ত্রণায় ফেটে পড়ছিল। কান্না জড়ানো গলায় নিজেই বলে ওঠে–আপনি কেন আমাকে ওর কাছে পাঠালেন? গতকাল থেকে আমি যে অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছি। আপনি জানেন না, কি দারুণ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছি আমি? কেউ জানে না, আমি এখন কি করতে পারি?
মুখে সে কিছু প্রকাশ করলো না।
রোজমেরির জন্মদিনের কাজে সবাই ব্যস্ত। আয়নায় নিজের মুখ দেখে রুথ চমকে উঠলো। অন্য এক মুখ। থমথমে দৃঢ়তার ছাপ সেই মুখে স্পষ্ট। সত্যিই তার দয়ামায়া বলে কিছু নেই। রোজমেরির কাঁপা কাঁপা ঠোঁট, নীল চোখের দিকে তাকিয়ে তার একটুও মায়া হলো না।
এগারো মাস পরে, সেই কথা ভাবতে বসে সে শঙ্কিত হলো।
.
এ্যানথনি ব্রাউন
১.৩
রোজমেরি বারটনের কথা মনে করতে গিয়ে এ্যানথনি ব্রাউন ভুরু কোঁচকায়।
সে প্রচণ্ড ভাবে রোজমেরির প্রেমে পড়ে যায়। তার সঙ্গে যে সে মিশেছিল সেজন্য সে অনুতপ্ত। কিন্তু সেই ঘটনার জের যে আজও তাকে টানতে হবে সেটা কে জানতো?
আজ ভাবতে আশ্চর্য লাগে, সেই সব দিনগুলির কথা, স্বপ্নমধুর দিন অন্যের ঈর্ষা জাগানো দিন। তাকে নিয়ে যেখানে সে গেছে, তার ভক্তরা তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থেকেছে। ওরা পরস্পরের সঙ্গ পেয়ে ধন্য হয়েছিল একদিন। সঙ্গীতের প্রয়োজন হতো না, রোজমেরির পায়ের ছন্দে একটা অদ্ভুত ব্যঞ্জনা এনে দিতো, তার পায়ের সঙ্গে তাল রেখে নাচতো এ্যানথনি।
আজ একটা কথা ভেবে এ্যানথনি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায়। রোজমেরির সঙ্গে তার বিয়ে হয়নি, তার ভাগ্য ভালো। তাহলে কি যে হাল হতো, কে জানে। তাকে সে বিয়ে করেনি বটে, কিন্তু তার প্রেমে পড়েছিল সে এটা তো অস্বীকার করা যায় না।
তার নাচ দেখা, তাকে টেলিফোন করা, তার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, নাচা ট্যাক্সিতে তার ফুলের মতো নরম ঠোঁটে ঠোঁট লাগানো, সেই অভিশপ্ত দিনটির আগে সে কি একটুও টের পেয়েছিল যে তার পেছনে এভাবে ছুটে বেড়ানো নিজেকে মুখের পর্যায়ে ফেলা ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না।
এ্যানথনির আজও স্পষ্ট মনে পড়ে, সেদিন কিরকম অদ্ভুত চোখে তাকিয়েছিলেন রোজমেরি। এলোমেলো চুল কানের দুপাশে ছড়ানো। নীল চোখের ভেতর দিয়ে বোকা বোকা চাউনি। লাল নরম ঠোঁটের স্পর্শ।
রোজমেরির ডাকে ইশ হয় এ্যানথনির।
–আমার প্রতি আপনার দেখছি দারুণ মোহ।
–হ্যাঁ, নামটা যে খুব সুন্দর।
তারপর হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত একটা কথা শোনালো রোজমেরি।
টমি মোরেলির থেকেও চমৎকার।
এ্যানথনি বেশ কিছুক্ষণ সময় নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। এ যেন অবিশ্বাস্য অসম্ভব।
রোজমেরির হাত চেপে ধরে কর্কশ গলায় সে বললো–আপনি ঐ নাম কোথা থেকে শুনলেন?
অদ্ভুত কথাটি শুনে রোজমেরি হাসতে থাকেন। ওঁর হাসি দেখে এ্যানথনির গা-পিত্তি জ্বলে যায়।
-রোজমেরি, ব্যাপারটা সাধারণ নয়। আমি জানতে চাই, তার নাম কি?
ভিক্টর ড্রেক, আমার পিসতুতো ভাই বলেছে।
–ঐ নামে কারো সঙ্গে আমার আলাপ নেই।
–হয়তো, আসল নাম সে তোমার কাছে চেপে রেখেছে।
–তাই বুঝি? ধীরে ধীরে এ্যানথনির মনে পড়ে, হা, জেলহাজতে।
-আমি একদিন ভিক্টরকে বলেছিলাম, তুমি একটা অপদার্থ। সেকথা অবশ্য সে গায়ে মাখে না। উল্টে আমাকে বললো, তুমি কি নিজের সম্বন্ধে সচেতন? এক প্রাক্তন জেল ঘুঘুর সঙ্গে তোমাকে সেদিন নাচতে দেখলাম। তোমার যত ছেলে বন্ধু আছে তাদের মধ্যে সে অন্যতম তাই না? শুনেছি, সে নিজেকে এ্যানথনি ব্রাউন নামে পরিচয় দেয়, কিন্তু তার একটা কুখ্যাত নাম আছে টমি মোরেলি।
-ভিক্টর ড্রেক আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমরা দুজন জেল ফেরত বন্ধু। আমরা দুজনে একসঙ্গে থাকতে চাই।
গতকালই সে জাহাজের টিকিট কেটে দক্ষিণ আমেরিকায় রওনা হয়েছে। রোজমেরি মাথা নেড়ে বলেন।
একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে এ্যানথনিবলে, তাহলে তুমি একমাত্র আমার গোপন অপরাধের কথা জানো।
–সে কথা আমি তোমাকে বলতে বাধ্য নই।
-দেখ রোজমেরি, তুমি তোমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। শাসনের ভঙ্গিতে এ্যানথনি বললো, তুমি জানো যে মেয়েদের জীবনে রূপ হলো আসল সম্পদ। সেই সম্পদ যদি তোমার নষ্ট হয়ে যায়, বীভৎস হয়ে যায় তোমার মুখশ্রী, তাহলে তুমি কি পুরুষদের জগতে ঠাই পাবে? তুমি ভেবো না, সিনেমা গল্পে এরকম ঘটনা কেবল ঘটে থাকে। বাস্তবেও ঘটে, এটা খেয়াল রেখো।
তবে তিনি তো মুখ বন্ধ করে থাকবার মতো মহিলা নন। এ্যানথনি তাই প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য বলে, টমি মোরেলির নাম যে তুমি শুনেছো, সেটা তুমি ভুলে যাও, বুঝলে?
তুমি কি জানো না, আমার মনটা কত উদার। একজন আসামীর সঙ্গে আমি যে মেলামেশা করছি, এর মধ্যে একটা উত্তেজনা অনুভব করি আমি। এতে তোমার লজ্জা পাওয়া উচিত নয়।
কি অপদার্থ। গাধার মতো কথা বলে। তারপর থেকে এ্যানথনির কেবল মনে হয়েছে, তার জীবনের পৃষ্ঠা থেকে রোজমেরির নাম কেটে দেবে। এ ধরনের মহিলার ওপর ভরসা রাখা যায় না।
ফিক ফিক করে হাসছিলেন রোজমেরি–অত ক্ষেপে যেও না। আগামী সপ্তাহে জ্যাগের নাচ দেখতে নিয়ে যেও। কথাটা মনে থাকে যেন।
-আমি বাইরে যাচ্ছি। এখানে থাকছি না।
–যেখানে খুশী যাও। কিন্তু আমার জন্মদিনের পার্টিতে তোমার আসা আমি কামনা করি। তুমি ওরকমভাবে বলো না। রোজমেরি বলতে থাকেন। তুমি তো জানো ইনফ্লুয়েঞ্জা আমাকে দেহের ও মনের দিক থেকে কতখানি দুর্বল করে দিয়েছে। এ অবস্থায় তোমার কাছ থেকে আমি ব্যথা পেতে চাই না। তোমাকে আসতে হবেই।
ঐ মুহূর্তে রোজমেরির জীবন থেকে সরে পড়া-উচিত ছিলো এ্যানথনির।
কিন্তু তার পরিবর্তে
খোলা দরজা দিয়ে তার চোখ চলে গেল সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকা আইরিসের দিকে। রোজমেরির মতো সুন্দরী না হলেও চারিত্রিক ও মানসিক দৃঢ়তা অনেক বেশি।
সেই মুহূর্তে নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হলো, ঘৃণা করতে ইচ্ছে হলো, রোজমেরির প্রেমে পড়ার জন্য।
আইরিসকে দেখা মাত্র তার সমস্ত কিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল।
নিজের মত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সম্পূর্ণ পাল্টে ফেললল এ্যানথনি ব্রাউন। সে তখন অন্য মানুষ অন্য মন নিয়ে হাজির হলো রোজমেরির সামনে।
.
স্টিফেন ফ্যারাডে
১.৪
স্টিফেন ফ্যারাডের সেই অবিশ্বাসী মন আজও বিহ্বল করে তোলে রোজমেরির কথা ভাবতে বসলে। বার বার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই রেস্তোরাঁর প্রথম দৃশ্যটা।
এক অদ্ভুত আচ্ছন্নতা তাকে মনে করিয়ে দেয় তার জীবনের অতীতকে। জীবন তার দুটি ভাগে বিভক্ত। বড় অংশে আছে স্থির মস্তিষ্কসম্পন্ন একজন মানুষের আশা-আকক্ষা, উন্নতির নাসনা–অন্যটি মেরুদণ্ডহীন, অনুভূতিশূন্য জীবন।
মাত্র সাত বছর বয়সে সে জেনে গিয়েছিল তার কপালের লেখা কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। সেই লেখা ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সৎ ইচ্ছা ও মনের জোর। অভিভাবকদের দ্বারা তার কোনো উপকার হবে না। নিজের ভবিষ্যৎ নিজেকেই গড়ে তুলতে হবে। এটা সে ঐ বয়সেই উপলব্ধি করতে পেরেছিল।
এই দৃঢ় মনোভাব নিয়ে স্টিফেন নিজের জীবন সুচারুরূপে চিত্রায়িত করেছিল। সে একটু তোতলা ছিল। তাই প্রথমেই সে আন্তরিক চেষ্টার ফলে স্বাভাবিকভাবে কথা বলা শিখলো। লেখা পড়ায় ভালো ছিল। স্কলারশিপ পেতে তার খুব বেশি দেরি হয়নি।
মাত্র বাইশ বছর বয়সে অক্সফোর্ড থেকে ডিগ্রি নিয়ে সসম্মানে বেরিয়ে এলো স্টিফেন। হয়ে উঠলো একজন নামকরা লেখক ও সুবক্তা। স্বাভাবিক জড়তা কাটিয়ে উঠে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মেলামেশা করার প্রবণতা জাগে তার মধ্যে। পরবর্তীকালে রাজনীতি তাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করলো। লেবার পার্টিতে যোগ দিল। কিছুদিনের মধ্যে নিজেকে প্রতিভাবান যুবক হিসাবে চিহ্নিত করলো।
কনজারভেটিভ পার্টি তখন স্টিফেনকে লেবার পার্টির একটা শক্ত ঘাঁটি থেকে তাদের প্রার্থী মনোনীত করে। জয়ী হয়ে হাউস অব কমন্সের আসনে বসলো। সেই থেকে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা তার মধ্যে ছিলো। কখন তাদের তোষামোদ করতে হয়, কখন তাদের বিপক্ষে যেতে হয় সে সম্পর্কে সে ছিল সচেতন। ক্যাবিনেটে তাকে প্রবেশ করতেই হবে এই ছিল তার প্রতিজ্ঞা।
বিয়ে করা তার এখনও হয়ে ওঠেনি। সে ব্যাপারে খুব কমই চিন্তা করেছে। তবে এমন একজন জীবনসঙ্গিনী তার চাই, যে হবে সুন্দরী। তার সঙ্গে কাজে সহযোগিতা করবে। তার সুখ-দুঃখে সমান অংশীদার হবে, খুশী মনে তার সন্তানদের প্রতিপালন করবে। সেই নারী তার সাফল্যে যেমন গর্বিত হবে তেমনি ব্যর্থতায় সমবেদনা জানাতে এগিয়ে আসবে তার হৃদয়ের সব অনুভূতি উজাড় করে দিয়ে।
সেদিন কিডারমিনস্টার হওয়াতে এক বিরাট অভ্যর্থনা সভার আয়োজন হলো। স্টিফেনও ওখানে অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলো।
ইংলন্ডে কিডারমিনস্টার দারুণ প্রভাবশালী। লর্ড কিডারমিনস্টারের চেহারায় রীতিমতো রাজকীয়, দীর্ঘদেহী সুপরিচিত। এককথায় সবাই তাকে চেনে। যে কোন পাবলিক মিটিং-এ বা ইংলন্ডের যে কোনো কমিটির সভানেত্রীর স্থান অলঙ্কৃত করতে দেখা যায় লেডি কিল্ডারমিনস্টারকে। তাদের পাঁচ কন্যা, একটি পুত্র। কন্যাদের মধ্যে তিনজন ছিলো খুব সুন্দরী, গম্ভীর প্রকৃতির।
লোকে লোকারণ্য। জনারণ্য থেকে দূরে একটা নির্জনে দাঁড়িয়েছিল সে। হঠাৎ স্টিফেনের নজরে পড়লো টেবিলের সামনে একা দাঁড়িয়ে দীর্ঘাঙ্গী এক মহিলা, পরনে মেঘে ঢাকা পোশাক, অগোছালো ভাব, লেডি আলেকজান্ডার হেইলি আর্নের, কিডারমিনস্টারের তৃতীয় কন্যা।
কিডারমিনস্টারদের পাঁচ,মেয়ের মধ্যে এই আলেকজান্ডার মেয়েটিই অন্য মেয়েদের থেকে আলাদা। স্টিফেন জানতো মেয়েটা অসুস্থ ও অসুখী।
মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। টেবিলের ওপর থেকে একটুকরো স্যান্ডউইচ তুলে নেয়। তারপর ঘুরে গিয়ে বললো, আপনার সঙ্গে কথা বললে আপনি কি কিছু মনে করবেন? সত্যি কথা বলতে কি আমি ভীষণ লাজুক। আপনিও মনে হয় লাজুক, তাই না?
মেয়েটি শান্তভাবে স্টিফেনের অনুমানকে স্বীকার করে নিলো।
–এক একসময় আমার কথা জড়িয়ে যায়। এরকম অবস্থায় আর কেউ পড়েছে কিনা জানি না।
-আমারও তাই।
স্টিফেন তার সঙ্গে চলতি একটা নাটকের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। সেই নাটকটা সান্দ্রাও দেখেছিল।
সেই সময় লেডি কিডারমিনস্টার ঘরে এসে প্রবেশ করলেন।
নিজের পরিচয় গোপন রেখে সে অস্ফুটে বিদায় সম্ভাষণ জানায়।
-আপনার সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পেলাম। এখানে সব কিছু একঘেয়ে। ওদের মেপে মেপে কথা বলা, নোক দেখানো ভদ্রতা আমার অসহ্য লাগে।কিন্তু আপনার সঙ্গ খুব ভালো লাগলো। তার জন্য ধন্যবাদ।
বেশ কয়েকদিন পর সান্দ্রাকে আবার সে দেখতে পেলো কিডারমিনস্টার হাউসের বাইরে চার বোনদের সঙ্গে বা কখনো একা। তারপর সেদিন সেই পার্টির এক সপ্তাহ পরে এক সকালে একটি কালো কুকুর সঙ্গে নিয়ে অলস পায়ে পায়ে পার্কের দিকে এগিয়ে চললো।
পাঁচ মিনিট পরে সান্দ্রার সামনে এসে দাঁড়ায় স্টিফেন। চোখে মুখে হাসি উপছে পড়ছে।
–আমার কি সৌভাগ্য। আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে ভাবতে পারিনি।
মেয়েটির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো।
কিছুক্ষণ ওদের মধ্য কুকুরটির সম্পর্কে আলোচনা চললো।
–সেদিন আপনাকে আমার পরিচয় দিইনি। আবেগ জড়ানো গলায় বললো–আমার নাম স্টিফেন ফ্যারাডে। আমি এক অজ্ঞাত এম.পি.।
মেয়েটির চোখে মুখে লজ্জার আভা তখনো লেগে আছে।
–আমি আলেকজান্ডার হেইলি।
সেই থেকে তারা ঐ পার্কে অনেকবার মিলিত হয়েছে। সে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা তাকে জানায়। কখনো রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে। ওর কথা শুনে স্টিফেনের ধারণা হয়, মেয়েটি ভীষণ বুদ্ধিমতী, যথেষ্ট জ্ঞান আছে। সেই সঙ্গে সহানুভূতিশীলও বটে।
লেডি কিডারমিনস্টারের মনটা পরখ করার জন্য একদিন শান্তস্বরে সান্দ্রা বলে–আচ্ছা, স্টিফেন ফ্যারাডেকে তোমার কি মনে হয়?
স্টিফেন ফ্যারাডে?
–হ্যাঁ, সেদিন সে ত তোমার পার্টিতে এসেছিল। পরে কয়েকবার তার সঙ্গে আমি দেখা করেছি।
–দারুণ মেধাবী যুবক। প্রখর বুদ্ধি। জনসাধারণের সঙ্গে তার খুব বেশি পরিচয় নেই। তবে একদিন সে নাম করবেই।
সেই থেকে স্টিফেন নিজেকে কিডারমিনস্টার পরিবারের মধ্যে খুব সহজেই মানিয়ে নিলো। সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলো।
মাস দুই পরে স্টিফেন নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করার জন্য সারপেনটাইনে সান্দ্রার সঙ্গে দেখা করলো।
সান্দ্রা, তোমাকে আমি ভালোবাসি। স্টিফেন বলতে থাকে। তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাই। আমাকে তুমি তোমার জীবনসঙ্গিনী করে লজ্জা পাবে না।
-না না, লজ্জা পাবো কেন? আমিও তো তোমার কথা ভাবি। তুমি বুঝতে পারো না?
-পারি, কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে পারি না। তোমাকে প্রথম যেদিন দেখি সেদিনই তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।
–আমিও তোমাকে ঐ দিন ভালোবেসে ফেলি।
সান্দ্রার পরিবারের সকলে যখন জানতে পারলো যে সে স্টিফেন ফ্যারাডেকে বিয়ে করতে চলেছে। তখন সবাই প্রতিবাদ করে উঠলো। কি তার পরিচয়? ওর সম্বন্ধে সান্দ্রা কতটুকুই বা জানে?
লর্ড কিডারমিনস্টার জানতেন তার মেয়ের স্বভাবের কথা। তার মেয়ে যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে, অনমনীয় মনোভাব তার। যদি সে মনে করে স্টিফেনকে বিয়ে করবে তাহলে তাকে কেউ সেই ইচ্ছে থেকে বিরত করাতে পারবে না।
-সত্যি, ছেলেটার মধ্যে প্রতিভা আছে। সুযোগ পেলে উন্নতি করতে পারবে। আমরা হয়তো এই যুবকটিকে আমাদের কাজে লাগাতে পারি।
লেডি কিডারমিনস্টারের মত কিন্তু অন্য। তার মেয়ের সঙ্গে স্টিফেন যে একেবারেই খাপ খাওয়াতে পারবে, সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। তার অন্য মেয়েদের চেয়ে সান্দ্রার আকর্ষণ নিশ্চয়ই কম, তাছাড়া লাজুক মেয়ে। কিন্তু যুবকটির মধ্যে ভবিষ্যত অছে, সেকথা সকলে ভেবেই–
লেডি কিডারমিনস্টার একটি শর্তে রাজী হলেন এই বিয়েতে, যে তার হয়ে কাউকে প্রভাব খাটাতে হবে।
অতএব আড়ম্বরের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল আলোকজান্ডার ক্যাথেলিন হেইলির সঙ্গে স্টিফেন লিওনার্ড ফ্যারাডের। ইটালিতে তারা মধুচন্দ্রিমা কাটিয়ে এলো। ওয়েস্ট-মিনিস্টারে ছোটোখাটো একটা সুন্দর বাড়িতে ফিরে এলো। তাদের বিবাহিত জীবন সুখেই কাটতে লাগলো। স্টিফেন পার্লামেন্টের জীবনে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করলো আর সান্দ্রা তার আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেললো তার মনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়ে। তার ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন ভেবে স্টিফেন নিজেই এক একসময় অবাক হয়ে যেতো।
প্রকৃত জীবনসঙ্গিনী হিসাবে সান্দ্রা যথার্থ। প্রতিটি কাজে ওর বুদ্ধিদীপ্ত ছাপ স্পষ্ট। স্টিফেনের সঙ্গ সান্দ্রার আদর্শ বলে মনে হয়। তাদের দুজনের ভালোবাসা যেন একই খাতে প্রবাহিত। মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে সাফল্যকে হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে নিয়েছে।
সাফল্যের আতিশয্যে স্টিফেন তখন আত্মহারা। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সে পনেরো দিনের জন্য যায় মরটিজে। হোটেল লাউঞ্জ অতিক্রম করতে গিয়েই রোজমেরি বারটনকে দেখতে পায়।
সেই মুহূর্তটুকু তার যে কি হয়েছিল সেই অনুভূতি কোনদিন সে উপলব্ধি করতে পারেনি। কাব্য করে বলা যায়, সেই মুহূর্তটি যেন এক বিদ্যুতের ঝলকানি। স্পর্শে আঁকুনি কিন্তু তার রেশ বহুদূর বিস্তৃত। সে অনুভব করে রোজমেরির প্রেমে পড়ে গেছে সে, সে প্রেমে আছে এক বেপরোয়া উন্মাদনা। তবে একথা ঠিক স্টিফেন কখনোই ভাবপ্রবণ নয়। ভালোবাসা হলো তার কাছে সীমাহীন, বলগাহীন, অনন্ত তত্ত্বহীন প্রেম।
তবে কি সে সান্দ্রাকে ভালোবাসে না। নিশ্চয়ই ভালোবাসে। কিন্তু সান্দ্রার বাবা যদি ধনী না হতেন তাহলে তাকে বিয়ে করার কথা ভাবত না। আজও সান্দ্রাকে সে ভালোবাসে, তার প্রতি আছে তার মমত্ববোধ, আর কৃতজ্ঞতাবোধ। তার সঙ্গ সাহচর্যে সে আজ সাফল্যের শিখরে পৌঁছতে পেরেছে।
কিন্তু রোজমেরির প্রেমে সে তখন হাবুডুবু খাচ্ছে, পাগল করে দেওয়া রূপ, সোনালি চুল, নীল রঙের চোখের দৃষ্টি তাকে করে দিলো দিশেহারা। ঘুম-খাওয়া বিদায় নিলো তার কাছ থেকে। সেদিন সন্ধ্যায় সান্দ্রার সঙ্গে সে নাচলো বটে, কিন্তু সেই নাচে ছিল না উন্মাদনা, কেমন বিমর্ষ ভাব। কিন্তু রোজমেরি জানে না স্টিফেনের আবির্ভাবটা তার মনে ঠিক কি রকম আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
বারটনরা এক সপ্তাহ আগে সেন্ট মরটিজ ছেড়ে চলে গেছে। তাদের আরো সাতদিন সেখানে থাকার কথা। কিন্তু স্টিফেনের মন বসলো না। স্টিফেন লন্ডন ফিরে এলো। সান্দ্রা কোনো আপত্তি করলো না।
লন্ডনে ফেরার পনেরো দিনের মধ্যে রোজমেরির সঙ্গে তার প্রেম হলো। মাত্র ছমাস তাদের ভালোবাসা স্থায়ী হয়েছিল। সেই ছমাস স্টিফেন কিন্তু কাজে একটুও গাফিলতি দেয়নি। সে তার রুটিনমাফিক কাজ করে গেছে। নির্বাচন এলাকা পরিদর্শন করেছে, পার্লামেন্টে রাজনীতি বিষয়ক প্রশ্ন নিয়ে ঝড় তুলেছে। বিভিন্ন জনসভায় উপস্থিত থেকেছে, সান্দ্রার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করেছে, এরই ফাঁকে রোজমেরির সঙ্গে দেখা করেছে।
একটা গোপন ফ্ল্যাটে তাদের দেখা হতো। রোজমেরির রূপের মাধুর্য, তার প্রতি স্টিফেনের দুর্বার আকর্ষণ, তার আবেগভরা আলিঙ্গন-সব যেন স্বপ্ন। সাড়া জাগানো মন মাতানো স্বপ্ন।
কিন্তু প্রেমিকার বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে স্টিফেন ভাবতো, সে আর রোজমেরির সঙ্গে দেখা করবে না। সে হচ্ছে সান্দ্রার স্বামী। যদি সান্দ্রা তাকে সন্দেহ করে বসে। এতখানি ঝুঁকি নেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু সান্দ্রা স্বামীর প্রতি কখনো সন্দেহ প্রকাশ করে না। রোজমেরির স্বামী বড় অদ্ভুত ধরনের ভদ্রলোক। স্ত্রীর ন্যায়-অন্যায়ের দিকে কি তার নজর পড়ে না? না কি বয়সে অনেক বড় বলে সে তার যুবতী স্ত্রীকে হারাবার ভয়ে কোনো খবরদারি করতে চায় না।
-ফেয়ারহেভনে গেলে কেমন হয়? স্টিফেন স্ত্রীকে কাছে টেনে নিয়ে বলে, গলফ খেলে একঘেয়েমিটা কাটাতে চাই।
-বেশ তো কালই চলে। তবে তোমার কয়েকটা মিটিং বাতিল করতে হবে।
–ওতে কিছু অসুবিধা হবে না। পরে উদ্যোক্তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেই হবে।
স্টিফেন মনে মনে ভাবে গলফ খেলার নাম করে রোজমেরির সঙ্গে তার দেখা হওয়াটাই বড় কথা।
রোজমেরি তাকে চিঠি লেখে। নিষেধ করেছে স্টিফেন। এ মারাত্মক খেলা। এ অন্যায়। সান্দ্রা অবশ্য কোনোদিন তাকে প্রশ্ন করেনি এ ব্যাপারে। কিন্তু এটা যে অন্যায় তা তো স্বীকার করতেই হবে। তাছাড়া চাকর-বাকরদের ওপর সবসময় বিশ্বাস করা যায় না।
খাম খুলে স্টিফেন তাজ্জব। পাতার পর পাতা প্রেমপত্র। রোজমেরি লিখেছে, স্টিফেনকে রোজ না দেখতে পেয়ে সে থাকতে পারে না। স্টিফেনেরও কি একই অবস্থা হয়? আদর করে রোজমেরি তাকে লিওপার্ড বলে ডাকতো এবং স্টিফেন তার নাম রেখেছিল ব্ল্যাক চিউটি।
এই চিঠি লেখালেখি তাদের জীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে, রোজমেরিকে সেটা বোঝানো যাচ্ছে না।
ব্রেকফাস্টের টেবিলে আর একটা চিঠি এলো। খামের ওপরে সান্দ্রা চোখ বুলিয়ে নিলো। স্টিফেন ভয়ে সচকিত হয়ে রইলো। তবে অহেতুক প্রশ্ন করার স্বভাব নেই সান্দ্রার, সেটা স্টিফেন জানে। হলোও তাই। চিঠিটা দেখলো। কিন্তু কিছুই জানতে চাইলো না।
স্টিফেন গাড়ি নিয়ে বেরোলো! শহর থেকে আট মাইল দূরে একটা বাজার থেকে সে রোজমেরিকে ফোন করলো।
-হ্যালো রোজমেরি, তুমি আর চিঠি লিখো না।
প্রিয়তম স্টিফেন, আমার চিঠি কি তোমার পছন্দ হয়নি? আমার চিঠি পড়তে পড়তে তোমার কি মনে হয়নি যে আমি তোমারই পাশে আছি। তোমাকে আমি প্রতি মুহূর্তে কাছে পেতে চাই স্টিফেন। তোমারো কি তাই মনে হয়?
নিশ্চয়ই মনে হয় রোজমেরি। কিন্তু তোমার জন্য আমার চিন্তা হয়। আমার জন্য তুমি কষ্ট পাও তা আমি চাই না।
-ও সব আমি তোয়াক্কা করি না। ছাড়ো ওসব কথা। তুমি কবে আসছো?
মঙ্গলবার।
–অতোদিন অপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় প্রিয়তম। কিন্তু কি আমাকে..
স্টিফেনের কোনো কাজে রোজমেরির আগ্রহ নেই। সে কেবল শুনতে চায় যে স্টিফেন তাকে ভালোবাসে কি না। এই একটি কথাই সে বার বার জিজ্ঞেস করে।
ভালোবাসে ঠিকই। কিন্তু বিবাহিতদের পক্ষে ঘন ঘন ফোন করা, চিঠি দেওয়া, দেখা করতে বলা, এটা কি সম্ভব।
কিন্তু স্টিফেন যদি তার কথার সায় না দেয় তাহলেই রেগে যাবে। তখনই ঐ একই সুরে বলতে হবে তোমাকে আগের মতোই ভালোবাসি প্রিয়তমা। তবেই তার মন ভাঙবে।
তারপর হঠাৎ একদিন রোজমেরি এক অস্বাভাবিক দাবী নিয়ে হাজির হলো তার কাছে। স্টিফেনকে নিয়ে দক্ষিণ ফ্রান্সে যেতে চায়, নতুবা সিসিলি অথবা কোরসিকায় যেখানে তাদের কেউ চিনবে না, সেখানে তারা একসঙ্গে মিলিত হবে।
কিন্তু এই দাবী মেনে নিতে পারেনি স্টিফেন।
এরপর রোজমেরি হাসতে হাসতে আর একটি প্রস্তাব দিলো। সেটা যে কত ভয়ঙ্কর তা তার মাথায় এলো না।
–প্রিয়তম লিওপার্ড, এরকম ভাবে লুকোচুরি খেলা আর ভালো লাগছে না। আমি জর্জকে ডিভোর্স করি, তুমিও সান্দ্রাকে ডিভোর্স নোটিস দাও। তারপর আমরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি।
স্টিফেন প্রবলভাবে ঘাড় নেড়ে জানালো, এ সম্ভব নয়। নিজের কবর নিজে খোঁড়ার মতো অবস্থা।
কিন্তু রোজমেরি বেপরোয়া।
-প্রেম মানুষের জীবনে এক অতি প্রয়োজনীয় বস্তু। লোকের কথায় কিছু যায় আসে না।
-না না, তা কখনো হয় না। আমার এতদিনের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠা নিমেষের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমার রাজনৈতিক জীবন একেবারে ধুলোর সঙ্গে মিশে যাবে।
–তোমাকে আর কাজ করতে হবে না। আমার অনেক অর্থ আছে। আমরা পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে বেড়াবো। নতুবা কোনো দ্বীপে আমরা দুজনে বাস করবো। সেখানে কেবল তুমি আর আমি থাকবো।
এসবও ভেবেছে স্টিফেন। কিন্তু এসবই নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। সে উপলব্ধি করলো, এখনো সময় আছে রোজমেরির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার। নতুবা তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। রোজমেরি কোনোরকম তার আপত্তি শুনবে না। অতএব তাকেই ওর কাছ থেকে সরে আসতে হবে।
তাকে ভালো করে বোঝাতে হবে, তাদের গোপন সম্পর্কের সমাপ্তি এখানেই।
রোজমেরির প্রেম যতই তাকে আকৃষ্ট করুক না কেন, সান্দ্রাকে হারানো তার চলবে না। সান্দ্রার ওপর অন্যায় করা হবে। তাহলে মস্ত অবিচার করা হবে। না সে কোনোমতেই সান্দ্রাকে হারাতে পারবে না। এর জন্য যদি রোজমেরির সঙ্গ ত্যাগ করতে হয়
কিন্তু রোজমেরির বন্ধন ছিন্ন করে সে কি করে বেরিয়ে আসবে? ওর কোনো যুক্তির ধার ধারে না। ওকে নিজের পথ থেকে সরাতে একটা মাত্র উপায় আছে, খুন করা। বিষ দিয়ে তাকে চিরদিনের মতো চুপ করিয়ে দেবে। অবশ্য এর জন্য তাকে সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
এর মধ্যে রোজমেরি ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হলো। ফুলের তোড়া উপহার দিয়ে রোজমেরিকে সৌজন্যতা জানিয়ে এলো।
পরের সপ্তাহে রোজমেরির জন্মদিনের পার্টিতে সস্ত্রীক আমন্ত্রিত হলো। স্টিফেন একান্তে ডেকে তাকে তার মনের কথা জানাতে চাইলো যে ওদের গোপন সম্পর্ক এখানেই শেষ। সম্ভবত রোজমেরি সেটা বুঝে থাকবে। তাই আগে ভাগে বলে দিলো–আজ ওসব আলোচনা নয়। জর্জকে দুদিন পর জানাবো। সে তো আমার স্বামী। তাকে আমি ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম। তাই ভাবছি দুদিন পর তাকে আমাদের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দেবো। তারপরেই আমি তোমার হবো, তুমি আমার হবে।
সর্বনাশ! এ অবস্থায় যদি স্টিফেন তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে সান্দ্রা জর্জের মুখ চেয়ে সে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায় তাহলে তো এক বিশ্রী পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে রোজমেরি। কান্নাকাটি করে জর্জকে সে সব কথা জানাবে। স্ত্রীর কথায় সায় দিয়ে সে ডিভোর্সে রাজী হয়ে যাবে। তারপর রোজমেরি যাবে সান্দ্রার কাছে। একজন নারীর মনে তার স্বামী সম্পর্কে একবার সন্দেহ ঢুকলে তার অবসান করা মুশকিল। সে চাইবে না, তার স্বামীকে মিথ্যে ধরে রাখার। অতএব রোজমেরির অনুরোধে সান্দ্রা স্টিফেনকে মুক্তি দিয়ে দেবে।
তাহলে উপায়?
বিষ মেশানো এক গ্লাস শ্যাম্পেন দিয়ে রোজমেরির জীবন শেষ করে দিতে হবে। রোজমেরির শ্যাম্পেনের গ্লাসে পটাশিয়াম সায়ানাইড। টেবিলের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় স্টিফেন দেখলো, সান্দ্রা তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আজ এক বছর পরেও সে দৃষ্টি তার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে।
.
আলেকজান্ডার ফ্যারাডে
১.৫
রোজমেরি বারটনকে আজও মনে পড়ে সান্দ্রা ফ্যারাডের। সেদিনের কথা মনে করতে গিয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে রেস্টুরেন্টে ডাইনিং টেবিল অতিক্রম করতে গিয়ে অদ্ভুত দৃশ্যটা। তার হঠাৎ মনে হয়েছিল, স্টিফেন তাকে লক্ষ্য করছে।
সে কি লক্ষ্য করেছিলো, তার চোখে কি পরিমাণে ঘৃণা, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল?
ওর স্মৃতির মণিকোঠায় আজও রোজমেরি উজ্জ্বল হয়ে বেঁচে আছে। সান্দ্রার মনে এমন কি স্টিফেনের মনেও রোজমেরি আজও জাগ্রত।
সান্দ্রা ভুলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সবই যেন চক্রান্ত। এমন কি ফেয়ারহেভেনও আজ আর প্রশ্নাতীত নয়, বিশেষ করে কাছেই লিটল প্রায়রসে জর্জ বারটনের বাড়ি কিনে বসবাসের পর থেকে।
জর্জ বারটন এক বিচিত্র মানুষ, বলা চলে বোকা। এরকম প্রতিবেশী সান্দ্রার পছন্দ নয়।
স্টিফেন আর সান্দ্রা খুব সুখেই ছিলো। চিরজীবন তারা এইভাবে কাটাতে পারতো। কিন্তু রোজমেরির আবির্ভাবে সব এলোমেলো হয়ে গেল। স্টিফেন পাল্টে গেল। সে যেন সান্দ্রার মধ্যে আগের মতো আর আকর্ষণ অনুভব করে না।
বিয়ের পরেই সান্দ্রা লক্ষ্য করেছিলো, স্টিফেনের মনোভাব। ও যেমন স্টিফেনকে ভালোবাসে, স্টিভেন কিন্তু তেমন করে তাকে ভালোবাসে না। হয়তো সান্দ্রা ভালোবাসার পক্ষে অযোগ্য। সেদিন হঠাৎ এ কথাটা তার মনে উদয় হয়েছিল। অথচ ওর একসময় মনে হয়েছিলো, স্টিফেনের ভালোবাসা ওর কাছে এতই তীব্র এবং আকাঙ্ক্ষিত ছিল যে তার জন্য ও স্বেচ্ছায় প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে, মিথ্যে কথা বলতে পারে, এমনকি প্রয়োজনে কষ্ট স্বীকার করতে পারে। বিনিময়ে সান্দ্রা চেয়েছিলো, ওর সাহচর্য, ওর সহানুভূতি, ওর বুদ্ধিদীপ্ত সাহায্য। এই সমস্ত সুযোগ এবং সুবিধা পাওয়ার জন্যই স্টিফেন বোধ হয় ওকে চেয়েছিলো, ওর হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করার জন্য নয়।
এই সেদিনও সান্দ্রার বিশ্বাস ছিলো, স্টিফেন তাকে ভালোবাসে।
তারপর একদিন ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব হলেন রোজমেরি। সেই থেকে শুরু হলো তার বেদনাদায়ক জীবন।
কিন্তু স্টিফেন কি বুঝতে পারেনি, রোজমেরির আবির্ভাবে সান্দ্রার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে? সে প্রথম দিনই সেন্ট মারটিজে রোজমেরির সঙ্গে স্টিফেনের প্রথম আলাপের সময় যে ভাবে তাকায়, ঠিক সেই রকম যেন, সেইদিনই সান্দ্রার বুঝতে দেরি হয় না, ভদ্রমহিলা স্টিফেনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে চায়।
তারপর থেকেই তার বুকের মধ্যে জ্বালা যন্ত্রণা অনুভব করে। তার মন বিষিয়ে উঠেছে তার পরের দিন থেকে। কিন্তু সমস্ত মুখ বুজে সহ্য করে গেছে। নিজের বংশমর্যাদা আভিজাত্য এবং মনের প্রসন্নতা দিয়েও উপলব্ধি করেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে স্থির করেছে, এইসব মানসিক যন্ত্রণার কথা স্টিফেনকে একটুও বুঝতে দেবে না। মনের সঙ্গে সমানে লড়াই করতে করতে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে, রাতের ঘুমও উধাও হয়েছে। সে কেন রাতের পর রাত জেগে কাটাচ্ছে, সে সব খোঁজ কখনো স্টিফেন নেয়নি। তার অত সময় কোথায়? তখন সে রোজমেরিকে নিয়ে ব্যস্ত। সেই জ্বালা-যন্ত্রণা ভুলে থাকার জন্য উত্তেজক ট্যাবলেট খেয়েছে, তবু স্টিফেনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ কখনো করেনি।
তবে সে একটা সত্যি উপলব্ধি করেছে স্টিফেনকে ত্যাগ করার ইচ্ছে তার নেই। অপরদিকে স্টিফেন নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য তাকে ছেড়ে কোনোদিন যাবে না। ওর আশা রোজমেরির ওপর মোহ একদিন লোপ পাবে, তার শুভবুদ্ধি জেগে উঠবে।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার যে রোজমেরির মধ্যে এমন কি আছে, যার জন্য স্টিফেন পাগলের মতো তাকে নিয়ে মেতে উঠেছে।
সান্দ্রার মতে, রোজমেরি একটা নিরেট বোকা। স্বীকার করতে হবে পুরুষদের ভোলানোর মতো রূপ আছে তার। বশ করার যাদুমন্ত্রও তার জানা আছে। কিন্তু একদিন না একদিন তার সেই রূপ ধসে যাবে। তখন তার সঙ্গের মধ্যে ক্লান্তি খুঁজে পাবে। তখন সে রোজমেরির প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসবে, এটা সান্দ্রার বিশ্বাস।
স্টিফেনের উচ্চাশাই সান্দ্রাকে বিশ্বাস করতে সাহায্য করেছে। স্টিফেন কখনো নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যত বিসর্জন দিয়ে চিরদিন একজন বিবাহিত মহিলাকে নিয়ে পড়ে থাকবে না। তাই সে হাজার দুঃখ-যন্ত্রণা নীরবে সহ্য করেছে।
তাই অন্তর থেকে নিজেকে বুঝিয়েছে, সে কেবল স্টিফেনের, স্টিফেন তার একার। সে তার দেহমন সব স্টিফেনকে সমর্পণ করেছে, এটা কখনো মিথ্যা হতে পারে না।
সেই আশাতে বুক বেঁধে একদিন স্টিফেনকে নিয়ে সে চলে আসে ফেয়ারহেভেনে। স্টিফেন আগের মতো তার সঙ্গে মেলামেশা শুরু করে। আবার আগের মানুষে সে ফিরে এলো। সব জ্বালা যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে স্টিফেনের ভালোবাসায় সাড়া দিলো সে। বোধহয় এখানেই সান্দ্রার ভালোবাসার সার্থকতা লাভ করলো। ও ঠিক করলো, এই ভাবেই রোজমেরি আর স্টিফেনের মধ্যে ব্যবধান তৈরি করবে।
একদিন তারা লন্ডনে ফিরে এলো। স্টিফেন তখন আর সেই মানুষ রইল না। কেবল চঞ্চল মন। কাজে মন বসাতে পারে না। আগের মতো উন্মনা ভাব।
রোজমেরি তাকে নিয়ে কোথায় পালিয়ে যেতে চায়, তাই স্টিফেনের মন উতলা, এটা সান্দ্রার কাছে অজানা রইলো না।
একদিন এক ককটেল পার্টিতে দুজনের গোপন কথাবার্তা সান্দ্রা আড়াল থেকে শুনছিল। তবে টুকরো টুকরো।
–আমাদের ইচ্ছের কথা জর্জকে জানাচ্ছি।
এর কয়েকদিন পর রোজমেরি ফ্রতে পড়ে। নিউমোনিয়া তাকে শয্যাশায়ী করে দিলো। অনেকে এই অসুখে মারা যায়। সেদিন সান্দ্রাও তার মৃত্যু কামনা করেছিল ঈশ্বরের কাছে।
কিন্তু তার ইচ্ছা পূরণ হলো না।
লুক্সেমবার্গের সেই ক্লোক রুমে সেদিন রোজমেরিকে অপরূপ লাগছিল। পরনে শৃগালের চামড়ার লাল স্টোল এলোমলা ভাবে রয়েছে, ধবধবে সাদা কাধ দেখা যাচ্ছে। মুখটা বিষণ্ণ। কিন্তু তার সৌন্দর্যে এতুকু ভাটা পড়েনি। হাতে তার শূন্য গ্লাস, মনে হয় স্বর্গ থেকে কোনো দেবী পৃথিবীতে নেমে এসেছে।
সান্দ্রা ঠিক তার পেছনেই ছিল। তার চোখ পড়লো আয়নায়। এ কার মুখ দেখছে সান্দ্রা। নিজের মুখকে চিনতে কষ্ট হলো তার। চোখে একরাশ ঘৃণা, পাথরের মতো শক্ত চোয়াল।
ও সান্দ্রা, রোজমেরির ডাকে সান্দ্রা সচেতন হয়। আমি কি আজ খুব ড্রিঙ্ক করেছি? আমার গ্লাস যে খালি হয়ে গেল। আমার একটু মাথা ধরেছে জানো। ইনফ্লুয়েঞ্জার পর থেকে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তোমার কাছে অ্যাসপিরিন আছে?
-না, অ্যাসপিরিন নেই। তবে ক্যাচেট ফেভর আছে।
-তাই দাও। তারপর রোজমেরি সেটা সান্দ্রার কাছ থেকে নিয়ে হাত ব্যাগে রেখে বললো, এখন থাক, প্রয়োজনে খাবো।
ওরা ক্লোক রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সান্দ্রার ঠোঁটে রূঢ় হাসি এবার আর স্টিফেন তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকবে না।
হলঘরে ঢুকে সান্দ্রা স্টিফেনের দুর্দান্ত চোখের দৃষ্টি দেখে অবাক হয়ে গেল।
.
জর্জ বারটন
১.৬
রোজমেরি…
একটু ড্রিঙ্ক করে জর্জ বারটন আজ কেমন বিচলিত হয়ে পড়েছেন।
রোজমেরি জানতো, যে তার জন্য জর্জ পাগল ছিল। রোজমেরি সম্পর্কে কোনো চিন্তা ভাবনা, এমনকি বিয়ের প্রস্তাবের সময়েও তাকে কেন জানি না তার হাস্যকর বলে মনে হয়েছিল।
-রোজমেরি, আমি জানি এই বয়সে তুমি আমার দিকে তাকাবে না। সেটাই স্বাভাবিক। আমি বোকা বোকা ভাব নিয়ে সবসময় ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকবো। তবু তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাই।
রোজমেরি সেদিন হেসে উঠেছিলেন। জর্জের কপালে একটা চুমু দিয়ে বলেছিলেন, তুমি অনেক সুন্দর জর্জ। তোমার প্রস্তাব আমি মনে রাখবো। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি বিয়ের কথা ভাবছি না।
–বেশ তো, ভালো করে ভেবে নিয়ে সিদ্ধান্ত জানিও।
জর্জ খুব ভালো করেই জানতেন যে রোজমেরি তাকে কোনোদিনই ভালোবাসতে পারেনি। সত্যি কথা বলতে কি রোজমেরি বলেছিলেন–তুমি কি আমার মনের কথা বুঝতে পারো না। এতটুকু ভালোবাসার জন্য আমি পাগল হয়ে আছি। তোমাকে বিয়ে করে সংসারী হতে চাই। আমি জানি, সব ভালোবাসারই পরিণতি সুখের হয় না। তুমি আমাকে ভালোবাসো, এটাই আমার কাছে যথেষ্ট।
বিয়ের পর প্রথম দিকে তাদের সুখ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। জর্জ জানতেন, এই সুখ নামে পাখিটা একদিন আকাশে উড়তে চাইবে। একদিন না একদিন অপ্রত্যাশিত বাধা আসবেই। ওদিকে তাঁর মতো নিরুত্তাপ পুরুষের সঙ্গ পেয়ে রোজমেরি তৃপ্ত হতে পারলেন না।
তাই তিনি নিজের মনকে তৈরি করছিলেন সেই অপ্রিয় ঘটনাকে গ্রহণ করে নেওয়ার জন্য। রোজমেরির একটা দুর্বলতা ছিলো স্বামীর প্রতি। জর্জের ভালোবাসা স্থায়ী এবং অপরিবর্তিত।
রোজমেরির অসাধারণ রূপ, তার সন্দেহজনক আচরণের ফলে একটা কিছু যে ঘটবে তা আর বিচিত্র কি। কিন্তু কখনো তিনি তার মনে প্রতিক্রিয়া নিয়ে চিন্তা করেননি।
প্রথমদিকে জর্জ বিশেষ গুরুত্ব দেননি। একটি যুবকের সঙ্গে রোজমেরির প্রেমের ভাব হতে পারে। কিন্তু একদিন তিনি জানতে পারনে তার সন্দেহে কোনো ভেজাল নেই। সেটা যে কত নোংরা, জঘন্য বলে মনে হয়েছিল সেদিন জর্জের, তা বলার মতো নয়।
অতীতের পৃষ্ঠা ওলটাতে লাগলেন জর্জ বারটন। চোখের পরদায় ফুটে উঠলো সেই ছবি। রোজমেরির বসার ঘরে একদিন হঠাৎ জর্জ ঢুকে পড়লেন। ভূত দেখার মতো তিনি চমকে উঠলেন। দ্রুত হাতে টেবিলের ওপর কোর প্যাড আড়াল করলেন। জর্জ বুঝতে পারলেন, রোজমেরি তার প্রেমিকাকে চিঠি লিখছেন।
খানিক বাদে রোজমেরি চিঠির প্যাড সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। জর্জ টেবিলের কাছে এগিয়ে এলেন। ব্লটারটা হাতে তুলে নিলেন। সদ্য পড়া কালির দাগ স্পষ্ট। তিনি নিজের ঘরে সেটি নিয়ে এলেন। চশমা চোখে পড়ে ব্লটারের ওপর নজর দিলেন–আমার প্রিয়তম…রোজমেরির হাতের লেখা স্পষ্ট ভেসে উঠলো।
তার চোখ লাল হয়ে উঠলো। ক্রোধে কান দিয়ে আগুন বেরোতে লাগলো। তিমি মনে মনে। স্থির করলেন, ঐ যুবকটিকে চিরদিনের মতো পৃথিবী থেকে বিদায় দেবেন। কিন্তু কে সেই যুবক? কে রোজমেরির প্রেমিক? ব্রাউন? না কি নাছোড়বান্দা স্টিফেন ফ্যারাডে। এই দুটি নাম জর্জের মনে পড়লো কারণ ওরা রোজমেরির দিকে অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকাতো। রোজমেরির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ওরা কেমন হাবা হয়ে যায়।
জর্জের সব মনে পড়ে। উত্তেজনার চোটে তার হাত থেকে চশমা নিচে পড়ে যায়। এমন কি এখনো
তিনি আজ সেই সব বেদনাদায়ক স্মৃতি রোমন্থন করতে চান না। কোন লাভ নেই ওসব ভেবে। কেবল মন ক্ষত-বিক্ষত হয়। বরং রোজমেরির মৃত্যু তার জীবনে এনেছে শান্তি। পরম শান্তি।
আশ্চর্য, রুথকে তো একথা বলা হয়নি যে রোজমেরি মরে গিয়ে তাকে শান্তি দিয়ে গেছে। রুথকে বিশ্বাস করে সব বলা যায়। ঐ মুহূর্তে তিনি একটা জিনিস উপলব্ধি করেন, রুথ না থাকলে তার দারুণ কষ্ট হবে। তার প্রতিটি কাজে সে সহযোগিতা করে প্রয়োজনে উপদেশ দেয়, এমন কি দুঃখজনক ব্যাপারে সে সহানুভূতি জানায়। রুথের অবর্তমানে তার কাছে সব কিছু ফাঁকা লাগবে। শূন্য হয়ে যাবে সব। রোজমেরি কেবল দিয়ে গেছে, কখনো কিছু নেয়নি। এমনকি কখনো কামনা বাসনার কোনো আভাস দেয়নি সে।
আবার স্মৃতি উঁকি দিলো জর্জের মনের কোণে।
ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে ওঠার পর রোজমেরিকে যেন আরো বেশি সুন্দর লাগছিল। একটি রেস্তোরাঁর গোল টেবিলের সামনে সে বসেছিল, তার এক ঘণ্টা পরে
না, আর তিনি অতীতকে মনে করবেন না। অগে তিনি তার পরিকল্পনা ভেবে দেখবেন।
চিঠিগুলি রেসকে দেখাবেন তিনি। ঐ চিঠির ব্যাপারে আইরিসের যে বিন্দুমাত্র ধরাণা নেই সেটা তার বোবা মুখ দেখে বোঝা গেছে।
যা করার তিনি নিজেই করবেন।
দোসরা নভেম্বর, খ্রিস্টানদের পরবের দিন লুক্সেমবার্গে সেই টেবিলটা দখল করবেন তিনি।
এ্যানথনি ব্রাউন, স্টিফেন ফ্যারাডে, সান্দ্রা ফ্যারাডে আমন্ত্রিত হবেন এছাড়া থাকবেন রুথ, আইরিস এবং তিনি নিজে। সপ্তম অতিথি হবেন রেস। তারপরেও একটি চেয়ার খালি থেকে যায়। ব্যাপারটা অত্যন্ত নাটকীয় হবে। নতুন করে ফিরে আসবে সেই সব দৃশ্য।
রোজমেরির জন্মদিন, জর্জ বারটন উদাস হয়ে ভাবেন।
গোল টেবিলে ফুলের স্তূপ। হাত-পা ছড়ানো টানটান করে টেবিলের ওপর পড়ে আছে রোজমেরির-মৃত…
২. খ্রিস্টানদের পরবের দিন
২.১
আজ সকাল থেকেই লুসিলা ড্রেককে একটু মেজাজি মনে হচ্ছিল। এই বিশেষ দিনটিতে তার অনেক কাজ। কোন ব্যাপারে আগে মাথা গলাবেন সেটাই তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না। তবে সবচেয়ে জরুরী যে কাজ তার কাছে বিশেষ মনে হলো সেটা হচ্ছে আইরিসের ভালমন্দের প্রতি নজর রাখা।
প্রিয় আইরিস, তোমায় দেখে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে তোমার কতদিন যেন ঘুম হয়নি। তোমার এখন দরকার ইটনের সিরাপ। ছোটবেলায় আমাকেও ঐ টনিক খেতে দেওয়া হতো। আর শাক খাওয়া জরুরী। রাঁধুনিকে বলে দেবো, আজ দুপুরে খাওয়ার সময় যেন শাক ভাজা পরিবেশন করে।
মিসেস ড্রেকের যত্নের ঠেলায় আইরিস ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে। তার কিছু ভালো লাগছিল না। কিন্তু বিরক্তি প্রকাশ না করে দৃঢ় কণ্ঠে বললো–লুসিলা পিসি, আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
–কিন্তু মা, তোমার চোখের কোলে কালি পড়েছে। স্নেহার্দ্র কণ্ঠে মিসেস ড্রেক বললেন, তোমার বয়সের মেয়ের পক্ষে অতিরিক্ত টেনিস খেলা সহ্য হবে কেন? মনে হয়, এখানকার জল হাওয়া তোমার পক্ষে উপযুক্ত নয়। জর্জ যদি ঐ মেয়েটার সঙ্গে পরামর্শ না করে–
–কোন মেয়েটা?
—ঐ যে মিস লেসিং, যাকে নিয়ে জর্জের ভীষণ চিন্তা। মেয়েটিকে আমার মোটেও পছন্দ নয়। অফিসে তুমি যা খুশী করো তাই বলে বাইরে। এ ভাবা যায় না। আমাদের পরিবারের একজন ভাবতে দেওয়াটা মস্ত বড় ভুল।
-তুমি বোধ হয় জানো না, ও সত্যি আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গেছে।
–সে তাই ভাবে নাকি? মিসেস ড্রেক জোরে নিঃশ্বাস নিলেন। এর থেকেই তার মনোভাব স্পষ্ট বোঝা যায়। জর্জের জন্য দুঃখ হয়। আইরিস, জর্জকে যেভাবেই হোক রক্ষা করতে হবে। মিস লেসিং সুন্দরী হতে পারে, তাই বলে জর্জ ওকে বিয়ে করার কথা ভাবতে পারে না।
আইরিস মিসেস ড্রেকের কথা শুনে থ হয়ে গেল।
–রুথকে জর্জ বিয়ে করবে এ তো আমার কল্পনার বাইরে।
-তুমি কি কিছু দেখতে পাও না বাছা। তোমার চোখের সামনে সব কিছু ঘটে যাচ্ছে। অবশ্য তোমার তো আমার মতো অভিজ্ঞতা নেই। তুমি জানো না, আইরিস, মেয়েটা জর্জকে বিয়ে করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
আইরিস হেসে বলে–তাহলে তো ভালোই হবে। রুথের ব্যাপারে তুমি যা বললে আমার মনে হয় সেটা ঠিকই। জর্জ ওর খুব প্রিয়। তাছাড়া রুথ হবে ওর আদর্শ স্ত্রী।
-ভালো খাবার এবং এবং তার ভালো মন্দের দেখার ভার নিতে পারে এমন একটি মেয়ের কথা তুমি বলছো তো? সেক্ষেত্রে তোমার মতো আকর্ষণীয় এক যুবতীই তার পক্ষে উপযুক্ত। তুমি বাড়ির বাইরে ভেতরে দুদিক দেখতে পারবে। তার জন্য জর্জকে তো ঐ মেয়েটাকে প্রয়োজন নেই।
আইরিস মৃদু হেসে মাথা নাড়লো। তর্ক করলো না। রুথের কথা সে তখন ভাবছিল। রুথ দেখতে শুনতে ভালো। অফিসের কাজে উপযুক্ত। গৃহস্থলি কাজেও সে যে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবে না এটা বিশ্বাস হয় না আইরিসের। লুসিমা পিসি কেবল ঘর গৃহস্থলির কথাই ভাবতে পারেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে একটা ভালোবাসা, রোমান্স আছে সেটা যেন তিনি বুঝতে চান না।
কে জানে তার পিসেমশাই লুসিলা পিসিকে বিয়ে করার সময় এই দিকটা ভেবেছিলেন কি না।
লুসিলার বয়স যখন চল্লিশের কাছাকাছি, তখন তার স্বামী রেভারেন্ড ক্যালেব ড্রেকের বয়স পঞ্চাশ অতিক্রম করেছে। মাত্র দুবছর পিসি তার স্বামীর সঙ্গে সংসার করেছিলেন। একটি পুত্রসন্তান কোলে নিয়ে তিনি বিধবা হন। পরবর্তীকালে ঐ পুত্র ভিক্টর ড্রেক হয়ে ওঠে তার প্রধান চিন্তা এবং দুঃখের কারণ। ক্রমাগত চাপ দিয়ে তার ছেলে তার কাছ থেকে টাকা আদায় করতো। কিন্তু মহিলা কখনো বিরক্তি প্রকাশ করতেন না। বরঞ্চ তার ছেলের নামে কেউ অভিযোগ করলে বা অপবাদ দিলে তিনি ভীষণ রেগে যেতেন। কিছুতেই মেনে নিতেন না। এ ছিলো তার অন্ধ স্নেহের দুর্বলতা। ভিক্টর ছিলো অতি বিশ্বাসী। সেই সুযোগ নিয়ে অনেকে তাকে ঠকিয়েছে, তাকে প্রতারিত করেছে। তার বন্ধুরা তার প্রতি তার মায়ের অন্ধবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাকে দিয়ে অনেক অপ্রিয় কাজ করিয়ে নিতো।
ঠিক এমনি সময়ে আইরিসকে দেখাশোনার জন্য জর্জ তাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। কারণ তখন লুসিলা পিসি আর্থিক দিক থেকে খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল। তার পর থেকে একটি বছর এখানে তার সুখেই কেটেছে। বয়স্কা নারী হিসাবে সংসারে সমস্ত কর্তৃত্ব তাঁর হাতে ছিলো। যদি সেই কর্তৃত্ব তার থেকে কম বয়সের মেয়ে এ বাড়িতে এসে কেড়ে নেয় তার হাত থেকে তাহলে তো রুষ্ট হওয়া স্বাভাবিক।
কিন্তু লুসিলা পিসি বোঝেন না, রুথ কেন জর্জকে বিয়ে করতে চায়। রুথ হলো অর্থলোভী। তার ওপর জর্জের মতো অনুগত স্বামী পাবে। আসলে রুথ লেসিং বুদ্ধিমতী। সে আগে থেকে ঘরদোর সাজিয়ে গুছিয়ে জর্জকে বোঝাতে চেয়েছিল যে জর্জের পরিবারে সে কত অপরিহার্য। কিন্তু এ সংসারে একজনের কাছে রুথের চাওয়াটা ধরা পড়ে গেছে।
একদিন একটা কম্বল হাতে নিয়ে লুসিলা পিসি আইরিসের সামনে এসে দাঁড়লেন–আমার হয়েছে এক জ্বালা। আগামী বসন্তের আগে আবার এখানে ফিরে আসবে কিনা সেটা স্পষ্ট ভাবে জানালো না। সেই মতো ন্যাপথলিন দিয়ে রাখতে হবে। নতুবা পোকায় কেটে দেবে।
–আমার মনে হয় তিনি নিজেই জানেন না। আইরিস বললো, ভালোই হলো, আমরা যদি কখনো সখনো এখানে অসি! আমরা আসতে চাইলে বা না চাইলেও তবু এ বাড়িটা এখানে থাকবেই।
-হ্যাঁ, বাছা, সঠিক খবরটা জানতে হবে। সেই মতো ন্যাপথালিন দিয়ে রাখতে হবে। ন্যাপথলিনের গন্ধটা বাপু আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না।
বেশ তো ন্যাপথলিন দিয়ো না।
–যা গরম পড়েছে পোকামাকড়ের উৎপাত হবেই। আর আছে ভীমরুল। গতকাল হকিনস বলছিল।
হকিনস?
আইরিসের মন ছুটে চলে গেল অতীতে। অন্ধকারে সগর্বে পা ফেলতে ফেলতে, হাতের মুঠোর মধ্যেই সায়ানাইড, রোজমেরি–সায়ানাইড, কেন এইসব ভাবনা ঘুরে ফিরে একই জায়গায় এসে জড়ো হয়?
লুসিলা পিসি তখনো বলে চলেছন, গয়নাগুলো কাউকে দিয়ে ব্যাঙ্কে পাঠাবে? লেডি আলেকজান্ডার সেদিন বলেছিলেন আজকাল নাকি চুরি ছিনতাই খুব বেড়ে গেছে। তার মুখ কি কঠিন মনে হলো! হয়তো অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। আমরা সবাই এখন আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েছি। জর্জের দিকে চোখ মেলে তাকাতে পারি না। মনে হয় ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হবে। আবার ব্যাবসার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন থাকতে হবে। মাঝে মাঝে আমার দিকে যখন তাকায়, মনে হয় ওর মনে কিছু আছে।
আইরিসের শরীরটা কেঁপে উঠতে দেখে মিসেস ড্রেক সোল্লাসে জোরে বলে উঠেন– নিশ্চয়ই তোমার ঠান্ডা লেগেছে, আইরিস।
.
২.২
–তারা এখানে যেন না আসে একথা আমি কি করে ভাবতে পারি।
কথাগুলো অস্বাভাবিক তিক্ততার সঙ্গে উচ্চারিত হলো সান্দ্রা ফ্যারাডের মুখ থেকে। তার স্বামী চকিতে তার দিকে ফিরে তাকালো। সান্দ্রা তো তার মনের কথাগুলোই উচ্চারণ করলো। তাহলে কি সান্দ্রার ভাবনার সঙ্গে তার ভাবনার মিল আছে? তাহলে ও-ও কি অনুভব করছে, পার্কের ওধারে মাইনখানেক দূরে নবাগত প্রতিবেশীদের আগমনে তাদের ফেয়ারহেভেনের সুখ শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে।
আবেগপূর্ণ কণ্ঠে স্টিফেন ফ্যারাডে বলে–ওদের সম্বন্ধে তোমারও যে ঐ ধারণা আমি জানতাম না।
–এখানে লন্ডনের মতো প্রতিবেশীরা নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করতে পারে না। এখানে কেউ রুক্ষ স্বভাবের কেউবা বন্ধুভাবাপন্ন।
-না, লন্ডনের মতো কেউ আজকাল করতে পারে না। স্টিফেন বলে।
এই বিশিষ্ট অতিথিদের কাছে আমরা এখন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তারা দুজনে নীরবে সেই নৈশভোজের দৃশ্যটা চোখের আয়নায় দেখছিল। জর্জ বারটন ছিলেন উচ্ছ্বাসে ভরপুর, কথা-ব্যবহার বন্ধুত্বসুলভ আচরণ ছিল তার মধ্যে। কিন্তু ফ্যারাডে পরিবার তার মধ্যে সবসময় একটা চাপা উত্তেজনা দেখতে পায়। যেটা তাদের সর্বদাই ভীত করে রেখেছে। রোজমেরির মৃত্যুর পর থেকে জর্জকে কেমন অস্বাভাবিক মনে হয়। আগে জর্জ ছিলেন বোকা গোবেচারা গোছের সুন্দরী যুবতী স্ত্রীর বয়স্ক স্বামীর যেরকম অবস্থা হয় ঠিক সেইরকম। স্টিফেনের সেইসময় একবারও সন্দেহ হয়নি, জর্জ বারটন তার স্ত্রী রোজমেরির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন এবং বলা যেতে পারে জর্জের মতো স্বামীরদের জন্ম হয় বারবার প্রতারিত হওয়ার জন্য। স্ত্রীর থেকে তার বয়সের ফারাক ছিল যথেষ্ট, ঐ কারণে বা অন্য কোনো কারণে হোক খেয়ালী সুন্দরী যুবতীর মনোরঞ্জন করার মতো শক্তি তার ছিলো না। তাহলে কি জর্জ বারটন প্রতারিত? স্টিফেনের তা মনে হলো না। জর্জ রোজমেরিকে ভালোবাসতেন, তিনি তার ক্ষমতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন, স্ত্রীর স্বার্থই তিনি বেশি করে দেখতেন।
রোজমেরির মৃত্যুতে জর্জের মনে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল? সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করে স্টিফেন।
রোজমেরির মৃত্যুর পর তাদের সঙ্গে জর্জের খুব একটা দেখা হয়নি। তারপর হঠাৎ একদিন লিটল প্রায়রসে তাদের প্রতিবেশী হয়ে এলেন জর্জ।
আজ যেন জর্জকে বেশ বিচিত্র মনে হলো। হঠাৎ তাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বসলেন। অষ্টাদশী আইরিসের জন্মদিনের পার্টি। সেই পার্টিতে জর্জ তাদের কামনা করেন।
অনেক কাজ থাকা সত্ত্বেও সান্দ্রা এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলো।
নিশ্চয়ই যাবো, খুব আনন্দ হবে।
–তাহলে দিনটা ঠিক করে নেওয়া যাক।
উজ্জ্বল হাসিতে জর্জের মুখ ভরে গেল।
–ভাবছিলাম, আগামী সপ্তাহের বৃহস্পতিবার অর্থাৎ দোসরা নভেম্বর আপনাদের ঐদিন কোনো কাজ নেই তো? তা না হলে অন্য কোনোদিন ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
স্টিফেন আইরিস মারলের দিকে তাকালো। ওর মুখ কেমন লাল হয়ে উঠেছে। একটা অস্বস্তিবোধ ধরা পড়লো স্টিফেনের চোখে।
কিন্তু সান্দ্রার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। ঐ দিনই উপযুক্ত বলে তার বিবেচনা করে জানালো।
কিন্তু স্টিফেন তীক্ষ্ণস্বরে বলে উঠলো–আমাদের যাওয়ার দরকার নেই।
সান্দ্রা তার দিকে ঘুরে তাকালো। সান্দ্রার চোখে প্রশ্ন লক্ষ্য করে স্টিফেন বলেনা যাওয়ার অজুহাত দেখানোটা কি খুব সহজ হবে?
-খুব হবে, বড় জোর অন্য আর একদিন যাওয়ার জন্য তিনি অনুরোধ করবেন। মনে হয় আমাদের যাওয়ার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত আগ্রহী।
–এটা আমার মাথায় ঢুকছে না যে ওঁর অত আগ্রহ কেন? তাছাড়া আইরিসের জন্মদিনের পার্টি। অথচ আমাদের সঙ্গ পাওয়ার জন্য আইরিস যে খুব বেশি আগ্রহী তা তত মনে হয় না।
-না, তা মনে হয় না। আচ্ছা তুমি কি জানো, পার্টিটা ওঁরা কোথায় দিচ্ছেন?
–লুক্সেমবার্গে।
কথাটা শোনামাত্রই স্টিফেনের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তার মুখ দিয়ে আর কথা বেরোলো না। নিজেকে সে গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। সেই মুহূর্তে সান্দ্রার চোখে তার চোখ পড়লো।
–ভদ্রলোক নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছেন। মনের অভিব্যক্তি চাপা রেখেই স্টিফেন জোরে কথা বলে উঠলো। লুক্সেমবার্গ। সেই পুরোনো স্মৃতি ঘেঁটে আর কি হবে?
সান্দ্রা স্বামীর কথায় সায় দিলো।
–তাহলে আমরা নিশ্চয়ই এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে অস্বীকার করবো। সমস্ত ব্যাপারটা অত্যন্ত অপ্রীতিকর। এক্ষেত্রে আমাদের রাজী হওয়া সম্ভব নয়।
-স্টিফেন, এ ব্যাপারে তিনি আমাকে একটা কারণ অবশ্য দেখিয়েছেন। সান্দ্রা বলে। নৈশভোজের পর তিনি আমাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে এই আমন্ত্রণের ব্যাখ্যা করে বলেন, আইরিস তার দিদির মৃত্যুর পর থেকে এখনও পর্যন্ত স্বাভাবিক হতে পারেনি।
-হ্যাঁ, নৈশভোজের পর আইরিসকে অসুস্থ দেখাচ্ছিল বটে।
–জর্জ বারটন আরো বলেছিলেন যে তার দিদির মৃত্যুর পর থেকে আইরিস লুক্সেমবার্গে যাওয়ার কথা হলে এড়িয়ে যায়।
তার কথা শুনে আমার মনে হয়, উনি কোনো নার্ভ স্পেশালিস্টের সঙ্গে আইরিসের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। আজকালের আধুনিক চিকিৎসকদের চিকিৎসার ওষুধ হলো যদি কোনো লোক অপ্রীতিকর ব্যাপারে মানসিক আঘাত পায় তাহলে তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য ঠিক সেইরকম অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হতে দেওয়া উচিত। এড়িয়ে যাওয়া নয়।
–সেই স্পেশালিস্ট কি আর একটি আত্মহত্যার পরামর্শ দিয়েছেন?
-না, তবে মিঃ বারটনের মতে, লুক্সেমবার্গে আবার সেই জমায়েতের ব্যবস্থা করলে আইরিস হয়তো কিছুটা স্বাভাবিকত্ব লাভ করবে। জর্জ চান, এক বছর আগে ঐ আসরে যারা এসেছিলেন তারা প্রত্যেকে যেন দোসরা নভেম্বর আসেন।
–আমার মনে হয়, এটা একটা জঘন্য চক্রান্ত। স্টিফেন বললো, অবশ্য ব্যক্তিগত ভাবে আমি কিছু বলতে চাই না। সত্যি কথা বলতে কি আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম। তুমি যদি কিছু না মনে করো
কথার মাঝখানে সান্দ্রা বলে উঠলো–আমি মনে করি এবং খুব ভালোভাবে মনে করি। কিন্তু মিঃ বারটনের অনুরোধ অগ্রাহ্য করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। সেদিনের সেই ঘটনার পর আমরা লুক্সেমবার্গে অনেকবার গিয়েছি।
–ঠিকই বলেছো, প্রত্যাখ্যান করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাছাড়া এখন অস্বীকার করলে পরে আবার এই আমন্ত্রণ পুনরাবৃত্তি হতে পারে। বেশ ঠিক আছে, তোমাকে যেতে হবে না। তুমি কেন এটা সহ্য করতে যাবে। আমি একাই যাবো। গিয়ে বলবো
–না স্টিফেন, তুমি গেলে আমিও যাবো। সান্দ্রা তার নরম হাতটি স্বামীর হাতের ওপর রাখলো। আইনত আমরা স্বামী-স্ত্রী। পরস্পর পরস্পরের সুবিধা-অসুবিধা ভাগ করে নেওয়া হলো স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য।
সান্দ্রার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো স্টিফেন। কিন্তু সান্দ্রার কথার মধ্যে কোথায় যেন একটা প্রচ্ছন্ন অভিযোগ আছে। তাই সে বললো-তুমি ওকথা বলছো কেন, তুমি জানো না, তোমায় পেলে আমি যেন পৃথিবীটা হাতের মধ্যে পেয়ে যাই।
স্টিফেনের দুহাতের মধ্যে আবদ্ধ সান্দ্রার কাঁপা কাঁপা দেহ। বুকের আরো কাছে টেনে নেয় স্টিফেন। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় তার লাল ঠোঁট।
সান্দ্রা, তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি প্রিয়তমা। কিন্তু তোমাকে হারাবার ভয় আমার ভীষণ!
-কেন, রোজমেরির জন্য।
স্টিফেন বিবর্ণ মুখে বলে-হা, তুমি রোজমেরির ব্যাপারটা জানো?
–সবটাই জানি। প্রথম থেকে।
–কি মনে হয়েছে?
–আমার কিছুই মনে হয়নি। কিছু বুঝিওনি। জানি না কখনো বুঝতে পারবো কিনা। তুমি তাকে ভালোবাসবে।
-না, আমি তোমাকেই শুধু ভালোবাসি।
অদ্ভুত তিক্ততায় ভরে গেল সান্দ্রার অন্তর। তুমি মিথ্যে বলল না। সেই প্রথম দেখার দিন থেকে তুমি আমায় এ ব্যাপারে মিথ্যে বলে এসেছে।
স্টিফেন কিন্তু একটুও না ঘাবড়ে সান্দ্রার কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর অকপটে স্বীকার করলো এমন সন্দেহজনক পরিস্থিতিতেও আমি বলবো, ওটা মিথ্যে নয়। সান্দ্রা দয়া করে তুমি বোঝার চেষ্টা করো। ক্ষমতার লোভে সব মানুষই একসময় অন্ধ হয়ে যায়, সেটা আমি স্বীকার করছি। ক্ষমতার শিখরে উঠে তখন আর মানুষের নিচের দিকে তাকানোর অবসর থাকে না। এসব ক্ষেত্রে মানুষকে সময় সময় কঠিন হতে হয়, হয়তো কঠিনতার মুখোসের আড়ালে নিজেকে সে ঢেকে রাখতে চায়। কিন্তু আমার দিক থেকে আমি এটুকু বলতে পারি, তোমার মতো মেয়েকেই আমি সেই ছোটবেলা থেকে খুঁজেছি। আমি আন্তরিক ভাবে বিশ্বাস করি, অতীতের দিকে ফিরে তাকালে আমার মনে হয়, যদি সেটা সত্যি না হতো তাহলে সেই পথ দিয়ে আমি এতটা পথ উঠে আসতে পারতাম না, কিছুতেই না।
–আমাকে তুমি ভালোবাসোনি।
সান্দ্রার মনে তখনও তিক্ততা।
-না, প্রথমে আমি তোমার প্রেমে পড়িনি। আমি তখন সেই পুরুষ যে নিজের গর্বেই গর্ব অনুভব করে। তারপর একদিন ঘরের গণ্ডি পেরোতেই আমার দণ্ডশীল যুবকের লজ্জাকর সেই প্রেম আমায় ঘিরে ধরে। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো নিমেষের প্রেম।
তারপর এই ফেয়ারহেভেনে আমার সত্যিকারের জাগরণ হলো। উপলব্ধি করলাম আমার জীবনের যা কিছু সত্যি তা হলো তুমি, তোমার ভালোবাসার মর্যাদা দেওয়া, আর সব মিথ্যে।
-তুমি তাকে নিয়ে পালাবার কথা ভেবেছিলে না?
–রোজমেরির সঙ্গে, তাহলে সেটা অবশ্যই আমার জীবনে সান্দ্রার কারাদণ্ডের সামিল হতো।
–কেন তিনি চাননি, তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে?
চেয়েছিলেন।
–তাহলে কি হলো।
স্টিফেন বলে, তারপর লুক্সেমবার্গের সেই বেদানায়ক ঘটনা সব এলোমেলো করে দেয়।
তারপরের কথা না বললেও চলবে। সায়ানাইড বিষে নীল হয়ে গেছে রোজমেরির সুন্দর মুখ। তার চোখ দুটি তখনো জ্বলজ্বল করছিল। সে চোখে অনেক জিজ্ঞাসা অনেক প্রত্যাশা।
একটু থেমে স্টিফেন প্রশ্ন করলো, তাহলে আমাদের কি করা উচিত?
চলো, সেই পার্টিতে অংশ নেওয়া যাক, তার অন্তরালে যে কারণই থাক না কেন।
–জর্জ বারটন আইরিস সম্বন্ধে যা বলে গেলেন তা কি ঠিক? তোমার কি ধারণা?
–জানি না স্টিকেন, তবে আমার মনে হয় তিনি জানেন।
–কি জানেন? প্রশ্ন করে স্টিফেন।
ফিসফিস করে উঠলো সান্দ্রা।
–আমাদের ভয় পাওয়া উচিত নয়। সাহস সঞ্চয় করা দরকার। তুমি একজন বিরাট প্রতিভাবান পুরুষ হতে চলেছে। মানুষ যেমন চায়। তার জন্য কোনো কিছু বাধা হতে পারে না। স্টিফেন, আমি তোমার স্ত্রী, তোমায় আমি ভালোবাসি।
-ঐ পার্টির ব্যাপারে তোমার কি ধারণা, সান্দ্রা?
-ওটা একটা ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করছেন জর্জ বারটন। তবে আমরা যে ঐ ফাঁদের কথা জেনে গেছি–সেটা আমরা বুঝতে দেবো না।
-না, তা অবশ্য ঠিক।
সহসা সান্দ্রা হেসে ওঠে।
–তুমি জিততে পারো না, স্টিফেন। তোমার রোজমেরিই হবে তোমার সর্বনাশের মূল কারণ। স্টিফেন দুহাত দিয়ে সান্দ্রার কাধ আঁকড়ে ধরে।
সান্দ্রা দয়া করে থামো। তাছাড়া রোজমেরি মৃত।
–তিনি কি সত্যিই মারা গেছেন? সান্দ্রার কখনো কখনো মনে হয়, রোজমেরি বেঁচে আছেন।
.
২.৩
পার্কে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন জর্জ বারটন, সঙ্গে আইরিস। কিছুটা হাঁটার পর আইরিস বললো–জর্জ, কিছু মনে করো না। আমি একটু একা ঘুরতে চাই। মাথাটা ভীষণ ধরেছে।
-বেশ, আমি ফিরে যাচ্ছি।
জর্জকে বিদায় জানিয়ে আইরিস যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলল। অক্টোবরের শেষের দিক কিন্তু শীত ভালো পড়েনি।
একটা ঝড়ে পড়ে যাওয়া গাছের ওপর বসে আইরিস নিচে উপত্যকার দিকে তাকালো। গালে হাত দিয়ে বিষণ্ণ নেত্রে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করলো। হঠাৎ পাতার খসখস শব্দ। সে পেছন ফিরে তাকালো। গাছের ডালপালা সরিয়ে এ্যানথনি ব্রাউন তার দিকে উঠে আসছে।
প্রায় রেগে গিয়ে আইরিস চিৎকার করে বললো–তুমি সবসময় চোরের মতো চুপি চুপি আসো কেন টমি?
এ্যানথনি ওর পাশে মাটির ওপর বসে একটা সিগারেট ধরালো। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললো আমার স্বভাব যেখানে সেখানে আবির্ভাব হওয়া। কাগজগুলো আমাকে রহস্যজনক মানুষ বলে ডাকে।
–বেশ বুঝলাম, কিন্তু তুমি কি করে জানলে, আমি এখানে আছি?
-তোমাকে পাহাড়ের ধারে আসতে দেখে আমি চুপি চুপি তোমার পেছন ধরি। কেন, এখানে এসে কোনো অন্যায় করেছি?
-অবশ্যই নয়। আইরিস একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, টমি, আমি এখানে থেকে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এ জায়গাটা আমার একদম পছন্দ হয় না। আমি লন্ডনে ফিরে যেতে চাই।
–তোমরা কয়েকদিনের মধ্যে ফিরে যাচ্ছো, তাই না?
–হ্যাঁ, আগামী সপ্তাহে।
–তাহলে ফ্যারাডেদের সঙ্গে এখানে এটাই শেষ বিদায়ের পার্টি।
–হ্যাঁ।
–আচ্ছা, ফ্যারাডেদের তুমি পছন্দ কর?
-আমার মনে হয় না খুব একটা পছন্দ হয়। কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করা যায় না। কারণ তারা আমাদের সঙ্গে চমৎকার ব্যবহার করেন।
–আচ্ছা আইরিস, তোমার কি মনে হয় ওঁরা তোমায় পছন্দ করে?
-মনে হয় পাশাপাশি প্রতিবেশী হিসেবে তারা আমাকে পছন্দ করেন। আসলে তারা ছিলেন রোজমেরির বন্ধু। বন্ধু বলতে যা বোঝায় আমরা তেমন ছিলাম না।
-ঠিক বলেছো তুমি। তবে আর একটা কথা, সান্দ্রা ফ্যারাডে আর রোজমেরির মধ্যে বন্ধুভাবাপন্ন অন্তরঙ্গতা ঠিক ছিল না।
একবার সিগারেট টান দিয়ে এ্যানথনি বললো–জানো, ফ্যারাডেদের সম্পর্কে আমার কি ধারণা?
কি?
–তারা যেন তোমাদের কাছে একটি অভিন্ন ফ্যারাডে পরিবার। তারা একই উদ্দেশ্য, একই মনোভাব, একই লক্ষ্য নিয়ে জীবনের পথে এগিয়ে চলেছে। এগুলো হলো তাদের বাইরের খোলস। আসলে তাদের দুজনের মনের দিক থেকে চরিত্রের দিক থেকে অনেক তফাৎ রয়েছে, এটা খুবই অদ্ভুত ব্যাপার। আমার মতে স্টিফেন ফ্যারাডে হলো অত্যন্ত বুদ্ধিমান, অন্যের মতামতের ওপর সহানুভূতিশীল। ওর চরিত্রের দোষ হলো, ভীষণ আত্মবিশ্বাসী এবং নৈতিকি সাহসের অভাব। অপর দিকে সান্দ্রা ফ্যারাডের মন ভীষণ সংকীর্ণ, ধর্মভীরু, মধ্যযুগীয় বেপরোয়া মনোভাব।
–তবে আমার মনে হয় স্টিফেন বোকা এবং ভীষণ অহঙ্কারী–আইরিস বলে।
–বোকা ঠিক নয়। তবে সাফল্যের দোড়গোড়ায় এসেও তিনি অসুখী।
–এর কারণ?
-তারা অবশ্য এ দিক থেকে সার্থক। কিন্তু তারা পরস্পরের মধ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই তাঁরা এমন একটা কিছু দেখাতে চান, যা দেখার জন্য সারা পৃথিবী উদ্বিগ্ন।
..আইরিস, তুমি একটু চিন্তা করলেই দেখবে, কথাগুলো সত্যি এবং খাঁটি। তুমি লক্ষ্য করে দেখবে, সুখী মানুষদের জীবনে ব্যর্থতা নেমে আসে। কারণ তাদের নিজেদের মধ্যে এমন বোঝাঁপড়া থাকে যে কেউ কারোর নিন্দে করতে পারে না। যেমন আমি।
–তোমার নিজের প্রশংসা তুমি নিজেই করছো?
হঠাৎ কি খেয়াল হতে আইরিস হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো।
–এসো, আমাদের বাড়িতে তোমার চায়ের নেমন্তন্ন রইলো।
–আজ নয়। এ্যানথনি মাথা নাড়লো। কাজ আছে, ফিরে যেতে হবে।
–কি ব্যাপার বলো তো?
আইরিস তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললো–আমাদের বাড়িতে তুমি আমো না কেন? নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে?
তোমার জামাইবাবু আমাকে ঠিক পছন্দ করেন না, সেটা তার হাবভাবে পরিষ্কার বুঝেছি আমি।
-জামাইবাবুর কথা বাদ দাও। লুসিলা পিসি আর আমি যদি বলি তাহলে তোমার আপত্তি করার কিছু নেই বলো।
-তোমার ভালো লাগলেও আমার আপত্তি থেকেই যাচ্ছে।
–কিন্তু রোজমেরির সময় তো আসতে।
–সেটা আলাদা ব্যাপার।
এ্যানথনির এ ধরনের কথা শুনে আইরিস আহত স্বরে বলে–তুমি এখানে এসেছো কেন? এখানে কি তোমার অন্য কাজ ছিলো?
-হ্যাঁ তোমার সঙ্গে অত্যন্ত জরুরী প্রয়োজন আছে। তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে এসেছি। আইরিস কৌতূহলী হয়ে ওঠে।
–কি কথা বলো?
–আমাকে তুমি বিশ্বাস করো, আইরিস? সত্যি করে বলবে?
এ ধরনের প্রশ্ন শুনে আইরিস চমকে উঠলো।
–এ প্রশ্ন তোমার ধারণার বাইরে তাই না? এ্যানথনি বলতে থাকে। এই একটা মাত্র জরুরী প্রশ্নের উত্তর তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই আইরিস। বলল, আমাকে তুমি বিশ্বাস করো?
ক্ষণিকের জন্য আইরিস ইতস্ততঃ বোধ করে। তারপর ধীরে ধীরে বলে-হ্যাঁ।
–তাহলে লন্ডনে এসে কাউকে না জানিয়ে তুমি আমাকে বিয়ে করবে?
বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে আইরিস তাকালো–আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করতে আমি পারি না।
-তুমি তো আমাকে ভালোবাসো, কি ভালোবাসো না?
–হ্যাঁ, তোমায় আমি ভালোবাসি।
–তাহলে তুমি ব্লুমসবেরিলর সেন্ট এলফ্রিডা চার্চে গিয়ে আমাকে বিয়ে করতে পারো।
-কি করে সম্ভব হবে? এভাবে বিয়ে করলে জর্জ মনে কষ্ট পাবে, লুসিলা পিসিও আমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না। তাছাড়া আমার বয়স মাত্র আঠারো। সেটাও একটা সমস্যা।
-বয়সের ব্যাপারে তোমাকে একটু মিথ্যা বলতে হবে। এর জন্য কত কাঠখড় পোড়াতে হবে আমাকে জানি না। তোমার অভিভাবক কে?
–জর্জ। উনি আমার ট্রাস্টিও বটে।
তবে বিয়েতে যত রকম ঝামেলা পোহাতে হোক না কেন, আমার আশা, আমাকে তুমি ফিরিয়ে দেবে না।
-আচ্ছা, তুমি এ ব্যাপারে আমাকে এতো চাপ দিচ্ছো কেন? তোমার মতলবটা কি?
-আমি বলতে চাই যে, আমার কাজের ওপর তোমাকে অবশ্যই আস্থা রাখতে হবে। তাই তো তোমাকে আগেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাকে তুমি বিশ্বাস করো কিনা।
-তোমার সম্পর্কে জর্জের কিছু জানার দরকার। তুমি আমার সঙ্গে চলো। জর্জ এখন বাড়িতে আছেন।
-মনে হয় না উনি এখন বাড়িতে আছেন। কারণ এখানে আসার সময় দেখলাম একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। মিঃ জর্জ তার দিকে এগিয়ে গেলেন। মনে হয় লোকটি কর্নেল রেস।
-হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম আমি, কর্নেল রেস জর্জের পরিচিত। সেদিন রাতের পার্টিতে তার আসার কথা ছিলো, রোজমেরি যখন–
একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা আইরিসের কণ্ঠ রোধ করে আসে।
–এ্যানথনি, তুমি কখনো এরকম নৃশংস পরিস্থিতির সামনে পড়েছে। কিন্তু রোজমেরি আত্মহত্যা করেননি। তিনি হয়তো খুন হয়ে থাকবেন। তোমার কি একবারও মনে হয়নি?
–এসব তুমি কি বলছো? তুমি এমন উদ্ভট চিন্তা কি করে করলে? আমার তো বিশ্বাস, রোজমেরি নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করেছিল।
আইরিস চুপ করে রইলো।
-ওসব বাজে চিন্তা বাদ দাও প্রিয়তমা। আইরিসকে কাছে টেনে নিলো এ্যানথনি। ওর গালে চুমু দিলো। রোজমেরির কথা সম্পূর্ণ ভুলে যাও। তুমি কেবল আমার কথা ভাবো, আইরিস।
.
২.৪
পাইপ থেকে একরাশ ধোঁয়া ছাড়লো কর্নেল রেস। তারপর কি যেন অনুমান করার জন্য জর্জ বারটনের দিকে তাকালো।
বারটনের কাকা ছিলেন রেসদের প্রতিবেশী। সেই সূত্রে কর্নেলের সঙ্গে জর্জের পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে বয়েসের ফারাক যথেষ্ট। কর্নেলের বয়স এখন ষাটের ওপর। রোদে পোড়া তামাটে গায়ের রঙ, কালো চোখে বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি।
জীবনের বেশির ভাগ সময় কর্নেলের কেটেছে বিদেশে। জর্জ মূলতঃ কেতাদুরস্ত শহুরে মানুষ। কখনো সখনো তাদের মধ্যে দেখা হয়েছে। ভদ্রতার খাতিরে পরস্পরের মধ্যে মত বিনিময় করেছে, ছেলেবেলার কথা মনে করেছে। তারপর নীরব থেকেছে।
কর্নেল এই মুহূর্তে জর্জের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, কেন যুবক জর্জ আজকের এই সাক্ষাতের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে চাইছে। জর্জকে সব সময় মনে হয়েছে অত্যন্ত সাবধানী, বাস্তববাদী, যার মধ্যে কল্পনার কোনো স্থান নেই। তার কথাবার্তার মধ্যে কোনো সঙ্গতি নেই। হাবভাবে একটা অদ্ভুত অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে। যে বারটন সিগারেট পছন্দ করতো না সে আজ অল্প সময়ের মধ্যে তিনটে সিগারেট ব্যবহার করেছে।
-বলো, যুবক জর্জ, তোমার কি সমস্যা?
–আমি তোমার পরামর্শ ও সাহায্য চাই কর্নেল। তোমার নিশ্চয়ই খেয়াল আছে, আজ থেকে এক বছর আগে আমাদের সঙ্গে এক নৈশভোজে তোমার যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তোমাকে বিদেশে চলে যেতে হয়। ঐ নৈশভোজের আসরে আমার স্ত্রীর মৃত্যু হয়।
-খবরটা আমি কাগজে পড়েছিলাম। ঐ অপ্রীতিকর প্রসঙ্গের পুনরাবৃত্তি করার ইচ্ছা ছিল না বলেই তোমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলিনি। আমি তার জন্য দুঃখিত।
-ধরে নেওয়া যেতে পারে, আমার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছিলো?
–কেন একথা বলছো?
–এটা পড়ে দেখো, তাহলেই বুঝতে পারবে আমি একথা বলছি কেন?
দুটি চিঠি কর্নেলের হাতে তুলে দিতে ভ্রু কুঁচকে দেখে বললো–বেনামা চিঠি দেখছি।
-হ্যাঁ, বেনামা চিঠি। কিন্তু চিঠির লেখাগুলি আমি অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করি।
–সেটাই তো আরো বেশি বিপজ্জনক। ধীরে ধীরে রেস মাথা নাড়লো। শুনলে তুমি অবাক হবে, খবরের কাগজ প্রচারের জন্য এরকম কোনো ঘটনা ঘটে যাবার পর এ ধরনের অনেক চিঠি পাওয়া যায়।
-জানি। কিন্তু চিঠিগুলো সেই সময়কার লেখা নয়। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে অন্তত ছমাস অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত লেখা হয়নি।
-হ্যাঁ, এটা একটা দিক বলতে পারো, কারা এই চিঠি লিখতে পারে বলে তোমার ধারণা হয়।
–জানি না, তবে আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, আমার স্ত্রী সেদিন খুন হয়েছিল।
–তোমার কি কোনো সন্দেহ হয়েছিল?
—আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর আচমকা মৃত্যু আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। তাই তদন্তের ফলাফল আমি যন্ত্রের মতো মেনে নিয়েছিলাম। সদ্য ফুঁ থেকে উঠে আমার স্ত্রীর শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্য বলতে যা বোঝায় তা ছিলো না। তাই আমার মনে হয় সেই মুহূর্তে কোনো সন্দেহ জাগেনি। তাছাড়া তদন্ত করার সময় তার হাতের মুঠোর মধ্যে গুঁড়ো জাতীয় কিছু পদার্থ পাওয়া যায়, সেই গুঁড়ো হলো সায়ানাইড।
-শ্যাম্পেনের সঙ্গে সায়ানাইডের গুঁড়ো মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
–আমারও তাই মনে হয়। তাছাড়া রোজমেরি কখনো আত্মহত্যা করবে বলে হুমকি পর্যন্ত দেয়নি। ওর বাঁচার ইচ্ছে ছিলো ভীষণ, জীবনকে উপলব্ধি করতে চেয়েছিল সে।
রোজমেরির সঙ্গে রেসের একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাকে দেখে তার মনে হয়েছিল, প্রেমিকা হিসাবে এই নারী হলেন অদ্বিতীয়া।
–মেডিক্যাল রিপোর্টে কি বলেছিল।
–মারলে পরিবারের বয়স্ক ডাক্তার তখন সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছিল। ছেলেবেলা থেকে সে-ই রোজমেরিকে চিকিৎসা করে আসছিল। তার অবর্তমানে তারই সহযোগী ডাক্তার রোজমেরির ফ্র হওয়ার সময় চিকিৎসা করেছিল। আমার যতদূর মনে আছে সে বলেছিল, ওই ধরনের ফ্লু থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পর প্রায় প্রতিটি রুগী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে রোগভোগের যন্ত্রণায়।
জর্জ একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন–ঐ চিঠিগুলো পাওয়ার পর আমি রোজমেরির বয়স্ক ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করি। সবকিছু শুনে সে বিস্মিত হলো। তার কাছে এটি অবিশ্বাস্য ঘটনা। তার ব্যক্তিগত ধারণা, রোজমেরি আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে ছিলো না। আমারও মন সায় দিলো, জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার মেয়ে তো সে ছিল না। হয়তো কখনো রাগে চেঁচামেচি করেছে, বাড়ির সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে, ব্যস, এই পর্যন্ত।
রেস ফিসফিসিয়ে বলে এমন কোনো ঘটনার কথা তুমি জানো, যা ওর মনকে ভেঙে দিতে সাহায্য করেছে। মানে আমি বলতে চাইছি কোনো কিছুর ব্যাপারে ও নিশ্চয়ই অসুখী ছিলো।
–আমি জানি না, মনে হয় একটু দাম্ভিক প্রকৃতির ছিলো। তবে আমি বলবো, সায়ানাইড ব্যবহার করার সম্ভাবনাটা একেবারে নেই বললেই চলে। এটা এমন কোনো জিনিস নয়, যেটা সহজে ব্যবহার করা যায়। এটা সবাই জানে।
–এটা আর একটা দিক। তবে ধরে নেওয়া যাক, রোজমেরি নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সে চাইবে না নিশ্চয়ই এমন যন্ত্রণাদায়ক কুৎসিত মৃত্যু।
-বুঝলাম, কিন্তু রোজমেরি যে সায়ানাইড কিনেছিল বা পেয়েছিল তার কোনো প্রমাণ আছে।
–না। তবে কিছুদিন ও বন্ধুদের সঙ্গে ছিলো। তারা তখন বোলতার বাসা নিয়ে আসে। তখন হয়তো পটাসিয়াম সায়ানাইড ক্রিস্টাল একটু ব্যবহার করে থাকবে।
এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে অসুবিধা হবে না। একটু থেমে রেস বলতে থাকে–এবার সম্পূর্ণ ব্যাপারটা একবার খতিয়ে দেখা যাক। এক নম্বর হলো, আত্মহত্যা করা কিংবা তার প্রস্তুতির কোনো প্রমাণ আপাততঃ পাওয়া যাচ্ছে না। আবার এদিকে দেখা যাচ্ছে, খুন করার কোনো প্রমাণ নেই আমাদের হাতে বা পুলিশও খুন হিসাবে সন্দেহ করেনি।
-আমার ধারণা, আমার অবচেতন মনটা এ ব্যাপারে ধীরে ধীরে তৈরি করে নিচ্ছিল নিজেকে। তারপরে এই চিঠি পাওয়ার পর সন্দেহ আরো গাঢ় হয়ে ওঠে।
–বেশ, তোমার কথাই মেনে নিলাম। রেস বললো, কাকে তোমার খুনি বলে মনে হয়, জর্জ।
জর্জের মুখে কুঞ্চনের রেখা ফুটে উঠলো–আমিও নিজের কাছে ঐ একই প্রশ্ন করি। যদি রোজমেরি সত্যিই খুন হয়ে থাকে তাহলে সেদিন রাতে আমাদের নিমন্ত্রিত বন্ধুদের মধ্যে কেউ একজন খুনী হবে। যারা টেবিলের সামনে বসেছিল তাদের মধ্যে কেউ
-কেন ওয়েটারদের মধ্যেও কেউ একাজ করতে পারে।
–লুক্সেমবার্গের প্রধান ওয়েটার চার্লসকে তুমি চেনো নাকি?
–চার্লসকে সবাই চেনে। সে ইচ্ছা করলে যে কোনো ব্যক্তির গ্লাসে মদের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিতে পারে। এটা তার পক্ষে কোনো অসম্ভব কাজ নয়। এছাড়া আছে গিউসেজ।
-সেদিন পার্টিতে কে কে ছিল?
–এম.পি.স্টিফেন ফ্যারাডে, তার স্ত্রী লেডি আলেকজান্ডার ফ্যারাডে, আমার সেক্রেটারি, রুথ লেসিং, এ্যানথনি ব্রাউন, রোজমেরির ছোট বোন আইরিস আর আমি। সব মিলিয়ে সাতজন ছিলাম। তুমি এলে আটজন হতাম।
-এবার বল, তুমি সেদিন কি ভাবে বসেছিলে?
-সান্দ্রা ফ্যারাডে বসেছিল আমার ডানদিকে, সান্দ্রার পাশে এ্যানথনি ব্রাউন, তার পাশে রোজমেরি, তারপর স্টিফেন ফ্যারাডে। আমার বাঁ পাশে ছিল আইরিস আর রুথ লেসিং।
-তোমার স্ত্রী আগে সন্ধ্যার সময় শ্যাম্পেন পান করেছিল?
-ক্যাবারে শো যখন চলছিল, তখন কয়েক গ্লাস পান করেছিলো। আলো নেভার আগে রোজমেরি টেবিলের সামনে ঝুঁকে পড়ে। হয়তো অস্ফুটে কিছু বলে থাকবে। কিন্তু আমরা সেটা শুনতে পাইনি। ডাক্তার জানায়, ওর মৃত্যুটা নাকি আকস্মিক।
-তাহলে সব দিক থেকে বিচার করে বলা যায়, রোজমেরির গ্লাসে সায়ানাইড মিশিয়ে দেওয়ার সবচেয়ে বেশি সুবিধা ছিলো স্টিফেন ফ্যারাডের। যদি তাই হয়, তাহলে খুনের কারণ কি সেটা জানতে হবে। কেন খুন করবে?
-ওরা দুজনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো। জর্জ শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলতে থাকেন, হয়তো এমন হতে পারে রোজমেরি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, সেই অপমানের প্রতিশোধ স্টিফেন এমন নৃশংস হত্যার মাধ্যমে নিয়েছে।
–এবার দ্বিতীয় সম্ভাবনা হলো, কোনো মহিলা আসামী। তোমাদের সাতজনের মধ্যে চারজন ছিলো মহিলা। তোমরা যখন জোড়ায় জোড়ায় ক্যাবারের সাথে নাচছিলে তখন একজন মহিলা কি করছিলো এবার মনে করে দেখো, কোনো মহিলা একা টেবিলের ধারে বসেছিল।
একটু সময় ভেবে জর্জ বললেন, প্রথমে আইরিস, তবে দুর্ঘটনার আগে রুথকে দেখেছি।
-তোমার স্ত্রী শ্যাম্পেনের গ্লাসে শেষ চুমুক কখন দিয়েছিলো?
ব্রাউনের সঙ্গে রোজমেরি তখন নাচছিল। তখন ওকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তারপর ও ওর গ্লাসে চুমুক দেয়। এরপরে রোজমেরি আর আমি নাচতে থাকি। রুথের সঙ্গে ফ্যারাডে এবং লেডি আলেকজান্ডারের সঙ্গে ব্রাউন নাচতে থাকে। তখন টেবিলের ধারে আইরিস একা একা বসেছিল।
-তাহলে তোমার স্ত্রীর বোনকেই সন্দেহ করা যায়। রেস বেশ গম্ভীর গলায় বললো, এই মৃত্যুর সঙ্গে আইরিসের কোনো স্বার্থ জড়িয়ে আছে বলে তোমার মনে হয়?
কথাটা শুনে জর্জ রেগে গেলেন। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে বললেন–রেস, আইরিস ছেলেমানুষ। তাছাড়া রোজমেরিকে ও ভালোবাসতো। ও ওর বোনের দারুণ অনুগত ছিলো।
–আমি জানি, তোমার স্ত্রী ধনী ছিলো। ওর টাকা কি তুমি পাবে?
-না, ওর সব টাকা আইরিস পাবে। তার নামে একটা ট্রাস্ট আছে। তারপর জর্জ সবিস্তারে সমস্ত কিছু রেসকে বললো।
আশ্চর্য ব্যাপার। যে কোনো মেয়ে এর ফলে ক্ষুব্ধ হতে পারে। কিন্তু তুমি বলছো ত হয়নি। তবুও তার মোটিভটা ঠিক থেকে যাচ্ছে। সেটা যাচাই করে দেখতে হবে। এছাড়া আর কার মোটিভ থাকতে পারে?
-রোজমেরির কোনো শত্রু ছিল না, আমি নিশ্চিত করে জানি। ফ্যারাডেদের বাড়ির কাছে আমার বাড়ি নেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য হলো, প্রত্যেককে প্রশ্ন করে কাউকে সন্দেহের তালিকায় ফেলা যায় কিনা সেটা যাচাই করে দেখতে।
পাইপে অগ্নিসংযোগ করতে মন দিলো রেস।
খানিক বাদে বললো-জর্জ, তুমি কিন্তু আমার কাছে কিছু লুকিয়ে যাচ্ছে। তোমার স্ত্রীর সুনাম রাখতে কিংবা সে খুন হলো কি না হলো, সেটা চেপে যেতে তুমি চেষ্টা করতে পারো। কিন্তু তোমাকে সব পরিষ্কার করে বলতে হবে।
জর্জ চুপ করে থাকে।
-তোমার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে রোজমেরির একজন প্রেমিক ছিলো। সে কি স্টিফেন ফ্যারাডে।
–আমি ঠিক জানি না এ ব্যাপারে। ও ছাড়া এ্যানথনি ব্রাউনও হতে পারে।
–ব্রাউন নামটা কেমন শোনা মনে হচ্ছে। তুমি কি ওর সম্বন্ধে কিছু জানো?
-জানি না, ওর ব্যাপারে কেউ বিশেষ কিছু জানে না। তবে আমুদে। আমেরিকান হতে পারে। কিন্তু তার কথাবার্তায় সেটা প্রকাশ পায় না।
বেশ, এবার ধরা যাক, স্টিফেন ফ্যারাডে তোমার স্ত্রীর প্রেমিক ছিলো। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবে আলেকজান্ডার ফ্যারাডের নাম জড়িয়ে পড়ে। কারণ স্বামীকে অন্য নারীর প্রতি আসক্ত হতে দেখে কোনো নারীর পক্ষে মাথা ঠিক রাখা সম্ভব নয়। পরিণামে রোজমেরিকে সেই নারী খুন করেছে। তাহলে আপাততঃ এই রহস্যময় খুনের সঙ্গে ফ্যারাডে দম্পতি এবং আইরিসের নাম সন্দেহের মধ্যে আনতে পারি। আচ্ছা, রুথ লেসিং সম্পর্কে এবার কি বলল।
-রুথকে এই খুনের সন্দেহের বাইরে রাখা যায় অনায়াসে। জর্জ বলেন, রুথ আমার সব কাজ দেখাশোনা করে। বলতে গেলে ও আমাদের পরিবারের একজন। ওর সবকিছুতেই আমি নির্ভরশীল। জানো রেস, ওর মধ্যে যেরকম সততা, আন্তরিকতা এবং কর্তব্য নিষ্ঠার ভাব আছে, পৃথিবীর কোনো মেয়ের মধ্যে তুমি একসঙ্গে এতগুলো গুণ দেখতে পাবে না।
–জর্জ, আমার ধারণা, রেস বলতে থাকে, তোমার মোটিভও এখানে কাজ করেছে।
–আমি? জর্জ হতবাক।
–হ্যাঁ, ওথেলা আর ডেসডেমোনাকে তোমার মনে পড়ে?
–তোমার বক্তব্য আমি বুঝেছি। কিন্তু রোজমেরি এবং আমার মধ্যে সেরকম সম্পর্ক ছিলো না। ও একটু বেপরোয়া ছিল ঠিকই, কিন্তু আমার যে অনুগত ছিলো না, সেটা ভাবা ভুল, ও আমার প্রিয় ছিলো। তবে রোমান্টিক ছিলো না। তবু সে অঘটন ঘটে যাওয়ার পর আমি ভীষণ ভেঙে পড়ি।
তাছাড়া যদি ধরা যায় আইরিস ওকে খুন করেছে, তাহলে আমি কেন কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের করবো।
আমি জানি। তুমি যদি সত্যিই ওকে খুন করবে, তাহলে ঐ চিঠিগুলো পুড়িয়ে না ফেলে নিজের কাছে রেখে দেবে কেন? নিশ্চয়ই তুমি এ নিয়ে আর জল ঘোলা করতে না। যাই হোক, এখন ভাবনা হচ্ছে, চিঠিগুলো লিখলো কে?
তবে খুনী যে স্বয়ং লেখেনি, সেটা নিশ্চয় নিশ্চিত। কারণ তুমি যখন বললে রোজমেরির আত্মহত্যা করার পর সবকিছু শান্তিপূর্ণ ভাবে মিটে গেছে আর যখন সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ হয়েছে রোজমেরি আত্মহত্যা করেছে, তখন মনে হয় না, চিঠিগুলো খুনী লিখেছে? সমস্ত ব্যাপারটা নতুন করে, খুঁচিয়ে তোেলার পেছনে কার স্বার্থ থাকতে পারে।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
একসময় রেস বলে ওঠে–সব কিছু শুনে যা বুঝলাম, তা হলো তর্কের খাতিরে আমরা ধরে নিলাম, রোজমেরি খুন হয়েছিল। তবে সেটা আবার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখতে গেলে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। এছাড়া তোমার স্ত্রী গোপনে যাদের সঙ্গে প্রেম করতেন সেইসব কেচ্ছা প্রকাশ হয়ে পড়বে।
-তাই বলে, তোমার কি ইচ্ছা, একজন খুনী ছাড় পেয়ে যাবে? না, আমি তা হতে দেবো না। আসল সত্যি কি, আমাকে জানতেই হবে।
–বেশ, এই চিঠিগুলি আমি পুলিশের হাতে দিচ্ছি। তারাই চিঠির লেখক বা লেখিকাকে খুঁজে বের করবে। তবে পুলিশ একবার তদন্ত শুরু করলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছাড়বে না।
-আমি কিন্তু পুলিশের দ্বারস্থ হতে চাই না। তাই তো, তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। একটা পরিকল্পনা করেছি খুনীর জন্য।
–কি রকম? রেস কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে।
-ঐরকম একটা পার্টির ব্যবস্থা করেছি লুক্সেমবার্গে। সেদিনকার সব অতিথিরাই সেখান আসবে। আমার ইচ্ছা, তুমিও আমাদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করবে।
-কিন্তু তোমার উদ্দেশ্য?
-সেটা একান্ত গোপনীয় ব্যাপার। তোমাকে আমি ভোলা মনে আসার অনুরোধ করেছি। এলে দেখতে পাবে।
কিন্তু বন্ধু, তুমি আমাকে এই সব ঘটনার মধ্যে জড়াচ্ছে ঠিকই। তবে আমাকে এখনো তুমি অন্ধকারে রেখে দিয়েছে।
-সেটার প্রয়োজন আছে।
-তোমার পরিকল্পনা আমি নেনে নিতে পারছি না জর্জ, দুঃখিত। তোমার পার্টিতে আমি যেতে পারবো না। তুমি এই অবাস্তব পরিকল্পনা থেকে বিরত হও।
–কিন্তু এখন পিছিয়ে আসা সম্ভব নয়। অতএব
-দেখো আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে বলছি, এ কাজের পরিণতি ভালো হবে না। দারুণ বিপজ্জনকও হতে পারে। তোমাকে আমি বারবার সাবধান করে দিচ্ছি, এই পরিকল্পনা ত্যাগ করো।
জর্জ বারটন নীরবে মাথা নাড়লেন।
.
২.৫
দোসরা নভেম্বরের সকাল।
বাতাসে কেমন স্যাঁতসেঁতে ভাব। থমথমে হয়ে আছে চারদিকে, মনে হয় যে কোনো সময় ঝড় উঠতে পারে।
আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জর্জ বার বার ঘড়ি দেখছিল, খাবার খেতে খেতে প্লেট ঠেলে সরিয়ে দিয়ে মুখ ভার করে বসে রইলো আইরিস। লুসিলা পিসি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন আর ঘন ঘন রুমালে চোখ মুছছিলেন।
–প্রিয় জর্জ, আমি জানি, এটা একটা জীবন-মরণের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু সে তো কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। মিসেস ড্রেক বলতে লাগলো, তুমি যে তদন্তের কথা বললে সেটা সময় লাগবে যথেষ্ট, তার মধ্যে যদি কোনো অঘটন ঘটে যায় তাহলে আমি নিজের কাছে দোষী হয়ে থাকবো আজীবন।
-আপনাকে তো আমি কথা দিয়েছি। জর্জ বলে উঠলেন। আপনি ভাববেন না। আমি যখন দায়িত্ব নিয়েছি, তখন আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।
জর্জ উঠে দাঁড়ালেন। মিসেস ড্রেকের পিঠে সান্ত্বনার হাত বুলোতে গিয়ে বললেন, আনন্দ করুন। আমি রুথকে এক্ষুনি টেলিগ্রাম করে দিচ্ছি।
জর্জ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, ওর পেছন পেছন আইরিস এলো।
–জর্জ, আজ রাতের পার্টিটা বাতিল করে দেওয়া তোমার উচিত বলে মনে হয় না। লুসিলা পিসি যেমন ভেঙে পড়েছেন, আমার মনে হয়, আমাদের তার বাড়িতে তার সঙ্গে থাকা উচিত।
–কখনোই নয়। রাগে জর্জের মুখ লাল হয়ে উঠলো। ঐ ধাপ্পাবাজটা আমার জীবনই কেন তিক্ততায় ভরিয়ে দেবে? ও আমাকে একের পর এক ব্ল্যাকমেল করে যাবে, আর আমি মুখ বুজে তা মেনে নেব? আমার মতে, আর একটা পেনিও ওকে দেওয়া উচিত নয়।
-কিন্তু লুসিলা পিসি কি রাজী হবে?
-এটা ওঁরই রোকামির ফল। প্রথমেই যদি ভিক্টরকে বলতেন, নিজের পথ নিজে দেখে নিতে তাহলে আজ এই পর্যায়ে ও এসে পৌঁছাতো না। যাক, তুমি ওকে উৎসাহ দাও। আমি এমন একটা ব্যবস্থা করবো যাতে রাতে তোমরা ভালো করে ঘুমোতে পারো।
জর্জ চলে গেলেন, আইরিস ডাইনিং রুমের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো, টেলিফোন বাজচ্ছে।
-হ্যালো কে? আইরিসের হাতাশা ভাবটা একটু একটু করে কেটে গিয়ে মুখ হয়ে উঠলো নির্মেঘ আকাশের মতো। এ্যানথনি কথা বলছে।
-হ্যাঁ, তোমার প্রিয়তম এ্যানথনি। আজ রাতে পার্টিতে যাওয়ার জন্য জর্জ খুব পীড়াপীড়ি করছেন। কি ব্যাপার প্রিয়তমা, তোমার কি হয়েছে বলো তো? দূরভাষে তোমার দীর্ঘশ্বাস আমার কানে ভাসে, একটা চাপা বেদনা তোমার নিঃশাসে। তোমার কি কিছু হয়েছে?
-না না, কিছু হয়নি এ্যানথনি, আচ্ছা, তুমি একটা সত্যি কথা বলবে আমায়? আইরিসের কণ্ঠে কাতর অনুরোধ।
-শুনে তারপর তো উত্তর দেবো।
–তুমি কখনো রোজমেরির প্রেমে পড়েছিলে?
অপরপ্রান্ত কিছুক্ষণের জন্য নীরব থাকে। তারপরেই আইরিসের কানে ভেসে আসে এ্যানথনির হাসির ধ্বনি।
-এই জন্য কি তোমার মন বিষণ্ণ। তোমার কাছে স্বীকার করছি, রোজমেরির সঙ্গে আমার একটু-আধটু প্রেম হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু যেদিন তোমাকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখলাম, তখন তোমাকে দেখে আমার একটা কথাই মনে হয়েছে যে পৃথিবীতে একমাত্র তুমি-ই আছো আমার জন্য। এর থেকে নির্ভেজাল সত্যি কথা আর কিছু হতে পারে না।
–শুনে সুখী হলাম, এ্যানথনি, ধন্যবাদ।
–ঠিক আছে, আজ রাতে তোমার জন্মদিনের পার্টিতে আমি আসছি। তবে ঐ একই জায়গায় তোমার জন্মদিনের পার্টি বসছে এটা মাথায় ঠিক আমার ঢুকছে না। জর্জ কি করতে চলেছে, একমাত্র ঈশ্বর জানেন। যাই হোক, একটা সুন্দর উপহার নিয়ে আমি যাচ্ছি।
ওদিকে অফিসে এসে জর্জ রুথকে ডেকে পাঠালেন। ওর শান্ত হাসি ভরা মুখ জর্জের চিন্তা কিছুটা প্রশমিত করে।
জর্জ তার হাতে টেলিগ্রামটা দিয়ে দেখতে বললেন। রুথ টেলিগ্রামটা হাতে নিয়ে একটু চুপ করে থাকে।
–আচ্ছা, বছরখানেক আগে ওকে জাহাজে করে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম না?
রুথ মনে করার চেষ্টা করে।
-হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সেদিন ছিল ২৭শে অক্টোবর।
–আশ্চর্য তোমার স্মরণশক্তি।
রুথের স্মরণশক্তি যে প্রখর সেটা নিজে সে ভালো করে জানে। তার মনে আছে একদিন ফোনে রোজমেরিকে ভিক্টর ড্রেকের সঙ্গে অসতর্কভাবে কথা বলতে শুনেছিল। তারপর থেকে রোজমেরির ওপর তার একটা ঘৃণা জন্মেছে।
-কিন্তু তিনশো পাউন্ড। বড্ড বেশি মনে হচ্ছে। রুথ বললো, তার চেয়ে বরং মিঃ অগিঁলভির সঙ্গে আমি যোগাযোগ করবো ভাবছি।
তাদের বুয়েন্স আয়ার্সের এজেন্ট হলেন আলেকজান্ডার অর্গিলভি।
-বেশ, তবে দেরি করো না। ওর মা এখন হিস্টিরিয়া রুগীর মতো করছে। আর রাত কাটানো মুশকিল।
–আমি কি ওঁর সঙ্গে থাকবো?
-না, কঠিন কণ্ঠে জর্জ বললেন। এখনই তার প্রয়োজন হবে না। তবে রুথ, তোমাকে আমার একান্ত প্রয়োজন। রুথের একটা হাত নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আবেগভরা কণ্ঠে বললেন, তুমি একেবারে স্বার্থপর নও।
অর্গিলভির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও রুথ হাত ছাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
অফিসের কাজ শেষ করে জর্জ এলেন লুক্সেমবার্গে। তাকে দেখে প্রধান ওয়েটার চার্লস মিষ্টি হেসে এগিয়ে এলো। চার্লসের কাছে জেনে নিলেন, আজ রাতের ব্যবস্থা সব ঠিক আছে কিনা। চার্লস জানালো, মেনু পর্যন্ত তৈরি। তারপর দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়ালেন।
তাঁকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে চালর্স বললো, মিঃ বারটন, আপনি যে আবার আমাদের কাছে ফিরে আসছেন, তাতে আমরা ভীষণ খুশী।
সেই ভয়ঙ্কর হাসিটা জর্জের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো–আমরা অতীতকে ভুলতে চাই, চার্লস।
তিনি ওখান থেকে অফিসে ফিরে এলেন। রুথ তাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো।
-সকালে মিঃ অগিঁলভির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছিলাম। প্রায় দশ মিনিট আগে তিনি ফোনে জানান যে, ভিক্টর যদি টাকাটা ফেরত দিয়ে দেয় তাহলে তার নামে আদালতে কোনো অভিযোগ করা হবে না। আর আমাদের পাওনা একশো পঁয়ত্রিশ পাউন্ড।
তার মানে টাকাটা ভিক্টর আত্মসাৎ করতে চাইছে।
–আমারও তাই ধারণা। ভিক্টরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা মিঃ অর্গিলভিকে বলেছি। ঠিক করেছি কি?
–আমি নিজেও তাই চাই। কিন্তু তার মায়ের কথা ভেবে অস্থির হচ্ছি। দুষ্টু ছেলে হলেও সে তো মায়েরই ছেলে। লুসিলা পিসি কিভাবে তার ছেলের জেলে যাওয়ার ব্যাপারটা নেবেন তাই ভাবছি।
-তোমার মতো এতো ভালো লোক আর বোধহয় পৃথিবীতে নেই।
রুথের কথায় জর্জ খুশী হলেন। রুথের একটা হাত তুলে নিয়ে চুমু খেলেন।
রুথ ভাবলো, জর্জকে পেলে তারা দুজনেই সুখী হবে।
এদিকে তখন জর্জ ভাবছিলেন, রেসের পরামর্শ মেনে নেবে কি না? সব ভাবনা চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দেবে কি না? পরক্ষণেই মনের সব দ্বিধা কাটিয়ে ওঠেন। পরিকল্পনামাফিকই কাজ হবে।
লুক্সেমবার্গ।
অতিথিদের সবাইকে উপস্থিত দেখে জর্জ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মনে একটু খটকা ছিলো, শেষ পর্যন্ত সবাই আসবে কি না। অবশেষে সবাই তার জালে ধরা পড়েছে। এখন কেবল নাটক শুরু হওয়ার অপেক্ষায়।
হলের একেবারে শেষ প্রান্তে একটা নিরালা জায়গায় তিনটি টেবিল পাতা ছিলো। মাঝের টেবিলটা বড়। দুপাশে দুটি ছোট টেবিল। একটি টেবিলে বসেছিল মাঝবয়সী একজন বিদেশী এবং এক সুন্দরী যুবতী। অপর টেবিলে বসেছিল দুটি যুবক-যুবতী। মাঝের টেবিলটি বারটন পরিবারের জন্য সংরক্ষিত ছিল।
জর্জ অতিথিদের বসার নির্দিষ্ট আসনগুলি অমায়িক ভঙ্গিতে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন।
জর্জের ডানদিকে বসলো সান্দ্রা, তার পাশে ব্রাউন। তার বাঁদিকে বসলো আইরিস, তারপর স্টিফেন, তার পাশে রুথ।
রুথ আর এ্যানথনির মাঝখানে একজনের বসার জায়গা ফাঁকা রইলো। সাতজন বসার উপযোগী টেবিল।
–আমার বন্ধু রেসের আসতে একটু দেরি হতে পারে। তার জন্য অপেক্ষা করতে বারণ করেছে। পৃথিবীর অনেক জায়গা সে ঘুরেছে। আলাপ হলে অনেক চমকপ্রদ গল্প তোমরা শুনতে পাবে।
আইরিস কিন্তু মনে মনে ক্ষুব্ধ হলো ব্রাউনের পাশে না বসতে পেরে। জর্জ ইচ্ছে করেই, এই ব্যবস্থা নিয়েছে। তার মানে জর্জ তাকে বিশ্বাস করেন না এবং পছন্দ করেন না।
আইরিস দেখলো, এ্যানথনি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে।
একটু পরেই তারা নাচের আসরে যায়।
এ্যানথনির সঙ্গে আইরিস যখন নাচ শুরু করলো, তখন আইরিস ফিস ফিস করে তার কানে কানে বললো, এর থেকে বোঝা যায়, জর্জ চায় না, আমরা দুজনে পাশাপাশি বসি।
-তাই তো আমি তোমাকে আড় চোখে লক্ষ্য করছিলাম।
-কিন্তু তুমি যে তাড়াতাড়ি চলে যেতে চাইছে, সেটা হবে না। তুমি জানো, কর্নেল রেসের এখানে আসার কথা আছে।
–আমার ধারণার বাইরে। কিন্তু আমাকে যেতেই হবে।
–উনি কি ধরনের লোক তুমি জানো?
–ওঁর সম্বন্ধে সঠিক খবর কেউ জানে না।
প্রত্যেকে আবার টেবিলে ফিরে এলো। বাইরে তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে ধীরে ধীরে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। উত্তেজনা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। টেবিলের চারধারে আতঙ্ক দানা বেঁধে ওঠে। কিন্তু জর্জ নিরুদ্বেগ, নিরুত্তাপ, তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না।
হঠাৎ ড্রাম বাজার শব্দ। ঘরের আলো স্তিমিত হলো, সঙ্গে সঙ্গে তিনজোড়া নারী-পুরুষ নাচে মেতে উঠলো। নাচের সঙ্গে সঙ্গে একজন বহুরূপী মুখে নানারকম আওয়াজ করে তাদের মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ বাদে ঘরের আলো জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো।
সেই সময়ে উপস্থিত সকলের মধ্যে অবচেতন মন কথা বলে উঠলো–একটা অঘটন কিছু আবার বোধহয় ঘটে যাচ্ছে। যখন আলোগুলো ম্লান করে দেওয়া হয়েছিল সেই দৃশ্য তাদের কাছে জীবন্ত হয়ে ধরা দিলো। কেন সেই বিপদ ভরা অতীত তাদের মনে আসছে? তবে কি এর আড়ালে কোনো ইঙ্গিত আছে? বীভৎস ছায়াটা একসময় মিলিয়ে গেল।
কেবল জর্জ তার দৃষ্টি স্থির করে বসে আছেন তার উল্টোদিকের খালি চেয়ারটায়। যে কোনো মুহূর্তে সেই খালি চেয়ারে কেউ একজন এসে বসতে পারে। সামনে শ্যাম্পেনের গ্লাস।
–ওঠো জর্জ। আইরিসের ডাকে চমক ভাঙলো জর্জের। আজ এখনো পর্যন্ত তুমি আমার সঙ্গে নাচোনি। এসো, আমরা নাচ করি।
জর্জ উঠে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে শ্যাম্পেনের গ্লাস হাতে তুলে নিলেন।
–আজ আমরা আইরিস মারলের জন্মদিনের উৎসবে এখানে মিলিত হয়েছি। আমরা সকলে তার জীবনের শুভ কামনা করি। আসুন, আমরা এবার একটু পান করি।
প্রত্যেকে হাসতে হাসতে শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দেয়। তারপর তারা নাচতে শুরু করলো –জর্জ-আইরিস, স্টিফেন-রুথ এবং এ্যানথনি-সান্দ্রা।
কিছুক্ষণ বাদে সকলে যার যার আসনে এসে বসলো।
জর্জ হঠাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন।
–তোমরা সকলে জানো, একবছর আগে এখানে এক বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটে। আমরা সেই বিষাদভরা অতীতকে স্মরণ করতে চাই না। কিন্তু রোজমেরিকে আমরা সকলে ভুলে গেছি, একথা আমরা ভাবতে পারি না। তাই বন্ধু, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ, রোজমেরির আত্মার উদ্দেশ্যে স্মরণ করে এসো আমরা শ্যাম্পেনের গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়াই।
জর্জ গ্লাস তুলে নিল হাতে। প্রত্যেকে তাকে অনুসরণ করলো। গ্লাস ঠোঁটে স্পর্শ করল। সবাই।
কয়েক মুহূর্ত পরে দেখা গেল জর্জের দেহটা কেঁপে উঠলো। ওঁর ভারী দেহটা চেয়ারের ওপর এলিয়ে পড়লো। তিনি তার উত্তেজিত দুটি হাত কণ্ঠের ওপর চেপে ধরলেন। ধীরে ধীরে তার মুখের রঙ পাল্টে গেল। নিঃশ্বাস নেবার জন্য আকুলিবিকুলি করলেন।
কিন্তু মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে জর্জের জীবন্ত দেহটা পরিণত হলো একটি নিথর নিস্পন্দ মৃতদেহ।
৩. নিউ স্টকল্যান্ড ইয়ার্ডে
৩.১
নিউ স্টকল্যান্ড ইয়ার্ডে আবার মিলিত হলো দুই পুরোনো বন্ধু, কর্নেল রেস এবং চীফ ইনসপেক্টর কেম্প।
-মনে হয় এই তদন্ত আমাদের খ্যাতির উচ্চশিখরে পৌঁছতে সাহায্য করবে, রেস বলে ওঠে।
গম্ভীর হয়ে কেম্প বলে, মনে রেখো এই কেসের সঙ্গে ফিডারমিনিস্টারের সম্পর্ক জড়িত। অতএব সাবধানে পা ফেলতে হবে।
রেস মাথা নাড়ে। লেডি ফ্যারাডের সঙ্গে সে বহুবার কথা বলেছে। ভদ্রমহিলার বক্তৃতা দেওয়ার ভঙ্গিটা দারুণ। জনসাধারণের মনে আঁচড় কেটে যায়। জনসাধারণের কাছে তার একটা আলাদা পরিচিতি আছে। দেশবাসীর জন্য তারা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে এমন ভাব। কিন্তু তাদের মনেও যে প্রতিহিংসার স্পৃহা জাগে, সেটা কেউ ভাবতেও পারে, না।
-কেম্প, মনে করো লেডি আলেকজান্ডার যদি খুনী হয়? রেস কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে। অবশ্য এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। অথবা তার স্বামীও হতে পারে যার রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত ফিডারমিনিস্টার পরিবারের সংস্পর্শে এসে।
ওদের মধ্যে যে কেউ অপরাধী হোক না কেন, তাকে চরম শাস্তি পেতেই হবে। তার আগে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে পাবলিক প্রসিকিউটর যাতে আসামীর বিপক্ষে ঠিকমত সওয়াল করতে পারে। একবছর আগে সায়ানাইড বিষক্রিয়ায় জর্জ বারটনের স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন, ঐ একইভাবে জর্জ বারটন মারা যান। সত্যি সত্যি তুমি ঐ সন্ধ্যায় লুক্সেমবার্গে ছিলে?
-হ্যাঁ, বারটন আমাকে ঐ পার্টিতে যোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আমি ওর মতো সময় দিতে পারি না। কারণ ও এমন একটা পরিকল্পনা করেছিল খুনীকে ধরার জন্য যেটা তিনি আমাকে পরিষ্কার করে জানাননি। সমস্ত ব্যাপারটা কেমন অস্বস্তিকর মনে হয়েছিল। তাঁকে তোমার কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি যেতে রাজি হননি।
রেস বলে চলে, এসব সত্ত্বেও আমি গতকাল ঐ রেস্তরাঁয় হাজির হয়েছিলাম। ওদের থেকে একটু দূরে আমার টেবিল ছিল। কেউ যেন আমাকে দেখতে না পায়, তাই এই ব্যবস্থা। টেবিলের ধারে ওয়েটারের দল আর বারটনের অতিথিদের দেখেছিলাম। কোনো সন্দেহজনক দৃশ্য বা ঘটনা আমার নজরে পড়েনি।
যাই হোক, তবে ওদের মধ্যে কেউ একজন বা ওয়েটার গিউসেজ বোলমানো হতে পারে। কেম্প বলে, ওর সঙ্গে সকালে দেখা করেছিলাম। ও লুক্সেমবার্গে বারো বছর ধরে চাকরি করছে। স্ত্রী, তিনটি সন্তান নিয়ে তার সংসার। সুনাম আছে যথেষ্ট। তাকে ঠিক সন্দেহ হয় না আমার।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, এখনো পর্যন্ত আমরা আশাব্যঞ্জক কোনো ফল হাতে পাইনি। হতে পারে জর্জ বারটন তাঁর স্ত্রীর খুনীকে অনুমান করতে পেরেছিলেন এবং সেই খুনীকে ধরার জন্য জাল ফেলেছিলেন। কিন্তু খুনী সেটা আগেই টের পেয়ে যায় ফলে আর একটা খুন করে বসে।
তোমার অনুমানটি কিছুটা সত্যি, রেস বলে। তবে আমি লক্ষ্য করেছিলাম, টেবিলের সামনে একটা চেয়ার খালি। মনে হয় আসনটি এমন কোনো একজনের জন্য নির্দিষ্ট করা ছিলো যাকে আশা করা যায় না।
–তাহলে আমাদের সন্দেহের তালিকায় রয়েছে পাঁচজনের নাম। প্রথমে আমাদের মিসেস বারটনের খুনীকে খুঁজে বের করতে হবে। পরবর্তী খুনের জের ধরে বলা যায় রোজমেরিও খুন হয়েছিলেন, আত্মহত্যা করেননি। অবশ্য পুলিশমহল অর্থাৎ আমরা এটাকে আত্মহত্যা বলে ঘোষণা করেছিলাম। তবে এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় দশজনের মধ্যে নয়টি মেয়েই প্রেমঘটিত ব্যাপারে তাদের জীবনে সমাপ্তি টেনেছে। আর পুরুষরা বেশিরভাগ আর্থিক কারণে আত্মহত্যা করে থাকে।
–তাহলে তুমি দেখছি মিসেস বারটনের প্রেমঘটিত ব্যাপারে কিছু জানো। তার সেই প্রেমিকাটি কে? স্টিফেন ফ্যারাডে?
–হ্যাঁ, আর্লস কোর্টের একটি ফ্ল্যাটে তাদের দুজনকে গোপনে মেলামেশা করতে দেখা গেছে। প্রায় ছমাস ধরে এই গোপন প্রেম চলে। মনে হয় তারপরেই তাদের মধ্যে বিরোধ বাঁধে, সম্ভবতঃ ফ্যারাডে মিসেস বারটনের সান্নিধ্যে এসে একসময় ক্লান্তি বোধ করে। যার পরিণতি
-সান্দ্রা ফ্যারাডে কি এসব কিছুই জানতো না? রেস বললো, আমার মনে হয় সে জেনেও চেপে ছিল। কারণ তাহলে তাদের পরিবারের কলঙ্ক বাইরে প্রকাশ হয়ে যাবে।
–তাহলে দুজনকেই এক্ষেত্রে সন্দেহ করা যেতে পারে। কেম্প বলে। আচ্ছা, জর্জের সেক্রেটারি মিস রুথ লেসিং সম্পর্কে তোমার কি ধারণা?
-সে-ও হতে পারে। তবে জর্জের সঙ্গে মেয়েটির খুব ঘনিষ্ঠতা ছিলো বলা যেতে পারে। রুথ প্রায় বারটনের পরিবারের একজন। এবং জর্জ তার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। অবশ্য মিসেস বারটনের অন্য আরো ছেলে বন্ধু ছিল।
-তুমি কি তার সম্বন্ধে কিছু জানো? কেম্প বলে।
–বিশেষ কিছু নয়। আমেরিকান নাগরিক, তাই খুবই বেশি খবর জানা মুশকিল। প্রথমে এখানে সে ক্লারিজে থাকতো। পরে লর্ড ডিউসবারির বাড়িতে থাকে। আকর্ষণীয় চেহারা। মেয়েরা ওর সংস্পর্শে আসে সম্ভবতঃ ওর ঐ সুন্দর চেহারার জন্য।
একটুক্ষণ দুজনেই চুপ।
একসময় কে জিজ্ঞেস করে, জর্জ বারটনের পাওয়া চিঠিগুলো তুমি পড়ে দেখেছো?
-হ্যাঁ দেখেছি, গতকাল রাতে ওঁর বাড়িতে তদন্ত করতে গিয়ে চিঠিগুলো টেবিলের ড্রয়ার থেকে পাই। সস্তার কাগজে, সাধারণ কালিতে লেখা, চিঠিগুলো টাইপ করা, মনে হয় বিশেষজ্ঞদের মতে কোনো শিক্ষিত স্বাস্থ্যবান লোকের লেখা। চিঠিগুলোর ওপর জর্জ বারটন, এবং আইরিস মারলের হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। এছাড়া আরো কয়েকটি হাতের ছাপ পাওয়া গেছে, সেগুলো সম্ভবত ডাক বিভাগের লোকেদের হবে।
–তাহলে ব্যাপারটা বেশ জটিল হয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু চিঠিগুলো যে লিখেছে সে কি নিজের হাতে লিখতে পারতো না?
-হ্যাঁ, পারতো। কিন্তু এ প্রশ্ন কেন?
–তার উদ্দেশ্য ছিলো আত্মহত্যাকে প্রাথমিক পর্যায়ে খুনের কেস হিসাবে চালিয়ে দেওয়া।
–তাহলে স্টিফেন ফ্যারাডেকে ফাঁসি কাঠে ঝোলানো যায়? এটা প্রথম দিকে ধারণা হয়েছিল। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, তাকে অভিযুক্ত করার পক্ষে তেমন জোরালো কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।
তা না হয় হলো। সায়ানাইডের কোনো প্যাকেট বা শিশি কি পাওয়া গেছে।
-হ্যাঁ, টেবিলের নিচ থেকে একটা সাদা প্যাকেট পাওয়া গেছে। তার মধ্যে সায়ানাইডের ক্রিস্টাল ছিলো।
–গতকাল রাতে কেউ কিছু লক্ষ্য করেনি।
–আমি গতকাল রাতে প্রত্যেকের সংক্ষিপ্ত জবানবন্দী নিয়েছিলাম। আজ আবার তাদের জিজ্ঞাসা করা হবে। তবে ঐ রেস্তরাঁয় ওদের দুপাশে যে টেবিল দুটি ছিলো তাদের থেকেও খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি। তারা হলো জেরাল্ড টলিংটন, গ্রেনাডায়ার গার্ডস এবং অনারেবল প্যাট্রিসিয়া ব্রি-উডওয়ার্থ। এছাড়া মেক্সিকোর মিঃ পেড্রো মোরেলম এবং মিস ক্রিস্টিন স্যামনের ঠিাকানাও নিয়েছি। অবশ্য এ ব্যাপারে তারা কোনা আলোকপাত করতে পারবে না তবু যদি কিছু পাওয়া যায় এই আশায়।
.
৩.২
গিউসেজ বোলমানো ষোলো বছর ধরে শহরে আছে। মধ্য বয়স্ক লোক, বানরের মতো মুখ। তবে চোখে বুদ্ধির ছাপ। ভালো ইংরাজি বলে।
কেম্প তার কাছে গতকালের রাতের ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে সে বলে, ঐ টেবিলের লোকেদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব ছিল আমার। তাই ঘটনার কথা ভেবে মনে ভীষণ দুঃখ হয়। লোকে বলবে, এই লোকটাই জর্জ বারটনের মদের গ্লাসে বিষ ঢেলে দিয়েছে। জানি, এর পেছনে কোনো সত্যতা নেই, তবু লোকে বলবে। মিঃ গোল্ডস্টেন খুব ভালো লোক। আমাকে বলেছেন কয়েকদিনের জন্য লোকের দৃষ্টির অন্তরালে থাকতে। আমি যে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে সেটা আমার কল্পনার অতীত। সত্যি, এটা আমার দুর্ভাগ্য।
কেম্প তাকে প্রশ্ন করে জানতে পারলো যে চার্লসের সঙ্গে মিঃ বারটন আগে থেকে সব বন্দোবস্ত করে রেখেছিলেন ফরমাসের ব্যাপারে।
–টেবিলের সেই খালি চেয়ারটার সম্বন্ধে তোমার কি ধারণা?
–মিঃ জর্জ বারটন আজ আমাকে বলেছিলেন সন্ধ্যার সময় ঐ আসনে একজন যুবতী মেয়ের আসার কথা আছে।
-যুবতী মেয়ে? কেম্প এবং রেস দুজনে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলো।
-আচ্ছা, তুমি শেষ কখন মিঃ জর্জকে শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিতে দেখেছিলে বলতে পারো?
বলছি, গিউসেজ একটু ভেবে নিয়ে বললো, মিস আইরিস মারলের জন্মদিনের পার্টি উপলক্ষ্যে তারা শ্যাম্পেন পান করে নাচে যোগ দেন। তারপর ফিরে এসে শ্যাম্পেনে পরিপূর্ণ গ্লাসটি হাতে তুলে নেন। প্রত্যেকের গ্লাস শ্যাম্পেনে ভর্তি ছিল। মিঃ বারটন গ্লাসে চুমুক দেওয়ার এক মিনিটের মধ্যে ঘটে যায় সেই মর্মান্তিক ঘটনা।
-ওরা যখন নাচ করছিল তখন অন্য কেউ টেবিলের সামনে এসেছিলো?
–না। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। গিউসেজ বলতে থাকেন, আমাদের নজর এড়িয়ে তার গ্লাসে বিষ মেশানো অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়, স্যার, আমার ধারণা, মিঃ বারটন নিজেই বিষ নিয়ে থাকবেন গ্লাসে। গতবছরে তার স্ত্রীর মৃত্যুর আঘাত ভুলতে তিনি এই ব্যবস্থা নিয়েছিলেন হয়তো।
গিউসেজকে বিদায় জানিয়ে কেম্প ঘড়ির দিকে তাকালো। সাড়ে বারোটায় সময় ফিডার মিনস্টার যাওয়ার কথা। তার আগে টেবিলের লোকেদের মধ্যে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে।
.
৩.৩
আমেরিকান ভদ্রলোক মিঃ মোরেলসকে পাওয়া গেল রিজে। তাঁর স্মরণশক্তি প্রখর। কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় এমন কিছু তার নজরে পড়েনি, যেটা সন্দেহ করার মতো।
সেখান থেকে বিদায় নিয়ে রেসকে সঙ্গে নিয়ে কেম্প এলো ব্রুক স্ট্রিটে।
জেনারেল লর্ড উডওয়ার্থ স্বনামধন্যা প্যাট্রিসিয়া ব্রিস উডওয়ার্থের পিতা। খিটখিটে মেজাজের ভদ্রলোক এবং স্পষ্টভাষী। এইরকম একটা বিশ্রী ব্যাপারে তার মেয়ের জড়িয়ে পড়ার জন্য তিনি বিরক্তি প্রকাশ করলেন। আজকালকার ছেলেমেয়েরা যেন সব জানে এমন তাদের ভাব। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, তিনি তার সলিসিটারের বিনা পরামর্শে মেয়েকে তাদের প্রশ্নের মুখে ছেড়ে দিতে নারাজ।
এমন সময় দরজা খুলে ভেতরে এসে ঢুকলো মিস প্যাট্রিসিয়া ব্রিস উডওয়ার্থ।
-হ্যালো, আপনারা তো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে আসছেন তাই না? আমি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। গতকালের রাতের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন তাই তো? বাবা, তুমি নিশ্চয়ই এই ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত? কিন্তু ডাক্তারের কথা কি তোমার মনে নেই? আমি বরং ওঁদের নিয়ে আমার ঘরে যাচ্ছি।
প্যাট্রিসিয়ার ঘরে গিয়ে ঢুকলো সকলে। আলোচনা বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে চললো। কিন্তু কথা বলে বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না।
-সত্যি ব্যাপারটা ভাবলে অবাক হতে হয়। প্যাট্রিসিয়া বললো। এটা একটা খুন তাই না? কি আশ্চর্য দেখুন, চোখের সামনে খুন হলো, অথচ কিছু টের পেলাম না। ফোন করে মেরিকে জানিয়ে দিয়েছি যে এটা খুনের কেস।
–আপনার কিছু নজরে পড়েনি?
–না, তেমন কিছু মনে হয় না।
এরপর ওরা এলো ক্রিস্টিন স্যামনের কাছে। রীতিমতো সুন্দরী মহিলা। সোনালি চুল এলোমেলো হওয়ায় কপালে উড়ে আসছে। লালচে আঙুল দিয়ে বারে বারে সেগুলো সরিয়ে দিচ্ছিল। ইনসপেক্টর কেম্প বলেছিল, ওর নাকি একটা দারুণ গুণ আছে, সেটা হলো বোবার অভিনয় করতে সে ওস্তাদ।
চীফ ইনসপেক্টর, আপনার যেমন খুশী প্রশ্ন করতে পারেন। আপনাকে সাহায্য করতে পারলে আমি খুশী হবো।
মাঝের টেবিলের পার্টির লোকেদের গতিবিধি এবং আচরণ কি রকম ছিলো জানতে চাইলে ক্রিস্টিন অস্বাভাবিক ভাবে আগ্রহ প্রকাশ করলো।
–ওদের চোখ-মুখ দেখে আমার মনে হয়েছিল, ওরা যেন কোনো কঠিন ব্যাপারে মুখোমুখি হতে চলেছে। জর্জ বারটনের চেহারায় ছিল সংশয়, দ্বন্দ্ব এবং ভয়ের ছাপ। তার ডান পাশে যে লম্বা চেহারার মহিলাটি বসেছিল তার মুখটা পাথরের মতো কঠিন লাগছিল। তার বাঁ পাশের মেয়েটি যেন রাগে ফুঁসছিল, মনে হয় গভীর কালো চোখের যুবকটির পাশে বসতে না পারার জন্য। তার পাশে যে লম্বা চেহারার যুবকটি বসেছিল, তাকে মনে হচ্ছিল, পেটে ভীষণ যন্ত্রণা সত্ত্বেও তাকে জোর করে খেতে আনা হয়েছে।
…সত্যি কথা বলতে কি তখন আমার মনটা ভালো ছিল না। আমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে তিনরাত্রি সমানে বাইরে কাটিয়ে ছিলাম। একঘেঁয়ে ক্লান্তিকর লাগছিল। তাছাড়া আমার পুরুষ বন্ধু পেড্রো এমন একজন লোক যার সঙ্গ পাওয়ার জন্য মেক্সিকোর অনেক মেয়েই পাগল। বারবার যদি ওর মুখ থেকে অন্য মেয়ের নাম উচ্চারিত হয় তাহলে কোন মেয়ের মেজাজ ঠিক থাকে না। তাই আমি ওর কথায় কান না দিয়ে খেতে থাকি এবং খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখছিলাম।
তাহলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানারকম প্রশ্ন করা হলো কিন্তু বিশেষ ফল পাওয়া গেল না।
–তাকে আপনি বলছেন, ওরা যখন নাচতে গিয়েছিল তখন ঐ টেবিলের সামনে কেউ আসেনি, মিঃ বারটনের গ্লাস কেউ স্পর্শ করেনি?
-না, কেউ নয়, অবশ্য একজন ওয়েটার ছাড়া।
–একজন ওয়েটার? কি নাম তার?
–এ্যাপ্রন, বয়স মনে হয় ষোলো-সতেরো হবে। সে হচ্ছে ওয়েটারের মতন, মনে হয় সে ইটালিয়ান, অতিরিক্ত বিনয়ীভাব তার ঐ বানরাকৃতি মুখে।
গিউসেজ বোলমানো তাহলে এই লোকটির কথা বলেছিল। দুজনের বর্ণনা প্রায় মিলে যাচ্ছে।
–ঐ ছেলেটি কি করেছিল?
–টেবিলের নিচে কোনো মহিলার সান্ধ্যভ্রমণের একটি ব্যাগ পড়েছিল। সেটা সে তুলে টেবিলে রেখে দিয়ে চলে যায়।
মিস স্যামন, ব্যাগটি কার বলে আপনার মনে হয়?
একটু থেমে তারপর বললো–সেই কম বয়েসের মেয়েটির হবে। সবুজ জমির ওপর সোনালি কাজ করা ছিলো। আমার পরিষ্কার মনে আছে অন্য দুজন মহিলার ব্যাগের রঙ ছিলো কালো।
–টেবিলের সামনে কে প্রথম ফিরে এসেছিল? ভালো করে ভেবে বলুন।
-সবুজ পোশাক পরা ঐ কিশোরী এবং সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোক। তারপর একে একে টেবিলের সামনে এসে যে যার চেয়ারে বসে। তারপর ঐ পোঢ় ভদ্রলোকটি সকলের উদ্দেশ্যে কি যেন বক্তৃতা দিলো। এবং সকলে হাতে গ্লাস তুলে নিলো। তার কয়েক মুহর্ত পরেই সেই দুর্ঘটনা ঘটলো।
মিস স্যামনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কেম্প ও কর্নেল ফিরে এলো।
প্রত্যেকের কাছে একই জবাব পাওয়া গেল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। সেখানে দেখার কিছু ছিল না, তাই তাদের নজরে পড়েনি। কিন্তু জর্জ বারটনের গ্লাস ভর্তি সায়ানাইড বিষ। বিষের তো হাত পা গজাবে না যে নিজে হেঁটে গিয়ে পড়বে। অতএব যে কোনো একজন এই অপ্রীতিকর ঘটনাটি ঘটিয়েছে। এবার তাহলে সেই ওয়েটারের মতন ছেলেটিকে খুঁজে বের করতে হয়। মনে হয়, এর মধ্যে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। সেই ছেলিটিই মিঃ বারটনের গ্লাসে সায়ানাইড বিষ ঢেলে দিয়ে থাকবে।
–সেইরকম একটা কিছু ঘটে থাকবে সেটা আমারও বিশ্বাস। তবে তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে জোর গলায় বলতে পারি কেম্প, ওটা যে সায়ানাইডের গুঁড়ো ছিল সেটা সে জানতো না।
–অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে কেউ ওর হাতে ওটা ধরিয়ে দিয়েছিল হজমের ওষুধ বা ব্লাডপ্রেসারের ওষুধ বলে। তাহলে প্রশ্ন হলো কে বা কারা তার হাতে দিয়েছিল? ফ্যারাডে দম্পতিরা হয়তো নয়।
-না, ওদের কথা ভাবা অবান্তর।
-এ্যানথনি ব্রাউনকেও সন্দেহ করা যায় না। তাহলে বাকি রইলো মিঃ বারটনের শ্যালিকা এবং ওর সেক্রেটারি।
যাই হোক, আমি এখন ফিডারমিনস্টার হাউসে যাচ্ছি। তুমি নিশ্চয় মিস মারলের সঙ্গে দেখা করতে যাবে? কেম্প জানতে চায়।
-হ্যাঁ, সেখানেই যাবো। তবে মিস মারলের অনুপস্থিতিতে সেখানে যাবো। সেখানে এমন একজন আছে যে তার অনুপস্থিতিতে অনেক কিছু বলতে পারবে। বলা যায় না, কাজে লাগাতে পারে।
.
৩.৪
জর্জ বারটনের অফিসের উদ্দেশ্যে ট্যাক্সি করে কর্নেল রেস ছুটলো।
ওদিকে ফিডারমিনস্টার হাউসে এসে বেল টিপতে গিয়ে চীফ ইনসপেক্টর কেম্পের মুখ কঠিন হয়ে উঠলো। ব্রিটিশ আইনের নিরপেক্ষতা সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল আছে। যদি দেখা যায় স্টিফেন এবং আলেকজান্ডার জর্জ বারটনের মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত তাহলে মনে হয় না ফিডারমিনস্টার পুলিশ এবং বিচারকদের ওপর তার প্রভাব খাটাতে পারবেন। আর তারা যদি নির্দোষ প্রমাণিত হয় তাহলে তাদের তদন্তের কাজ খুব সাবধানে করতে হবে নতুবা ওপরওয়ালার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এইসব চিন্তা মনে আসতেই কেম্প আপাততঃ কি করণীয় সেটা ঠিক করে নিলো। পুলিশের লোকদের কথার জালে ফেলে কিভাবে বোকা বানাতে হয় সেটা অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ লর্ড ফিডারমিনস্টার খুব ভালো করেই জানেন।
একজন বাটলার তাকে বাড়ির পেছনে একটা ঘরে নিয়ে এলো। লর্ড ফিডারমিনস্টার এবং তার মেয়ে-জামাইকে সেখানে দেখতে পেলো।
সান্দ্রার পরনে গাঢ় লাল রঙের পোশাক। শান্ত মুখের ওপর এসে পড়েছে এক টুকরো রোদ। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে, পবিত্র দেবকন্যা যেন।
ভাবলেশহীন মুখে স্টিফেন ফ্যারাডে তার পাশে বসে আছে। দৃষ্টি স্বাভাবিক তার।
–চীফ ইনসপেক্টর, আপনার কাছে আমি কোনো কিছুই গোপন করতে চাই না। লর্ড ফিডারমিনস্টার বলেন। একই রেস্তরাঁয়, একই পরিবারের দুজন লোক খুন হলো। এর সঙ্গে আমার মেয়ে-জামাই দুবারই জড়িয়ে পড়ে। এই কেস যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয় তার জন্য ওরা আপনাকে সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত।
-ধন্যবাদ লর্ড ফিডারমিনস্টার।
-আর একটা কথা চীফ ইনসপেক্টর। আমার বন্ধু কমিশনারের কাছ থেকে জানতে পারি, সেই প্রৌঢ় লোকটির আকস্মিক মৃত্যু হত্যাকাণ্ডজনিত, আত্মহত্যা নয়। তবে সান্দ্রা, তুমিও তো প্রথমে এটাকে আত্মহত্যা বলেই মনে করেছিলে, তাই না?
গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিলো সান্দ্রা, চিন্তিত কণ্ঠে বলতে থাকে–হ্যাঁ, গত গ্রীষ্মকালের পর থেকে মিঃ বারটনের মধ্যে একটা স্বাভাবিক অস্থিরতা লক্ষ্য করেছিলাম। আমরা তখন ধরে নিই যে তিনি স্ত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুটা ভুলতে পারছেন না। স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসতেন তিনি। তাই মনে হয় স্ত্রী বিয়োগের ব্যথা ভোলার জন্য তিনি আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু একথা মনেই আসে না যে কেউ ওঁকে খুন করেছে।
স্টিফেন ফ্যারাডেও স্ত্রীর কথায় সায় দিলো।
–আপনারা আপনাদের ধারণা নিয়ে থাকুন, মনে মনে উচ্চারণ করলো চীফ ইনসপেক্টর কেম্প। কিন্তু মুখে বললো, লেডি আলেকজান্ডার আমার মনে হয় কয়েকটা ব্যাপার আপনি এখনো জানেন না। মৃত্যুর আগে জর্জ বারটন তার দুই বিশ্বাসী লোকের কাছে দুটি গোপন তথ্য প্রকাশ করে যান। তার স্ত্রী সেদিন রাতে আত্মহত্যা করেননি, তাক কেউ বিষ খাইয়ে খুন করেছে, এটা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, এটি হলো প্রথম তথ্য। আর দ্বিতীয়টি হলো, গতকাল লুক্সেমবার্গে মিস আইরিস মারলের জন্মদিন উপলক্ষে জর্জ বারটন যে নৈশভোজের ব্যবস্থা করেছিলেন সেটার অন্তরালে ছিলো একটি উদ্দেশ্য সেটি হলো আড়াল থেকে তার স্ত্রীর খুনীকে সনাক্ত করা।
মুহূর্তের মধ্যে ঘরের মধ্যে একা নীরবতা নেমে এলো। তবে একটা কিছু গোপন করার প্রবণতা তাদের মনের মধ্যে অদ্ভুত ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল, সে ব্যাপারে কেম্প নিশ্চিত।
-কিন্তু মিঃ বারটনের মাথায় এমন একটা উদ্ভট চিন্তা নতুন করে উদয় হলো। স্টিফেন ফ্যারাডে বলে। বিশেষ করে মিসেস বারটন যখন আত্মহত্যা করেছিলেন।
–কিন্তু মিঃ বারটন সেটা মানেন না।
-কেন? লর্ড ফিডারমিনস্টার প্রশ্ন করেন। পুলিশ তো এটাকে আত্মহত্যা ছাড়া কিছু বলেনি। এরকম কোনো সন্দেহের কথা তারা প্রকাশ করেনি।
–কারণ পুলিশের হাতে কোনো প্রমাণ আসেনি, তাই তারা ঐরকম ধারণা করেছিল।
কেম্প দৃষ্টি ঘুরিয়ে এবার সরাসরি প্রশ্ন করে সান্দ্রাকে।
–মিসেস ফ্যারাডে, এক বছরে আপনি কোনো উড়ো চিঠি পেয়েছেন কিনা বলুন তো।
-উড়ো চিঠি? মুহূর্তের মধ্যে সান্দ্রার সুন্দর মুখ পাঁশুটে হয়ে ওঠে। মানে বেনামা চিঠি। না, সেরকম কোনো চিঠি আমি পাইনি।
–বেশ, এবার পরবর্তী প্রশ্নের উত্তর খুব ভেবে দিন। জর্জ বারটনের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি আপনাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতেন?
–তার মনোভাবে ছিলো বন্ধুসুলভ, তিনি নিজে আমাদের বাড়ির কাছে বাড়ি কেনেন। তাঁর অনুরোধেই আমরা বাড়ি কেনার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম।
-এবার বলুন, মিসেস বারটনের সঙ্গে আপনার কি সম্পর্ক ছিলো?
–আমার সঙ্গে তেমন কিছু ছিল না। একটু ইতস্ততঃ করে মিসেস ফ্যারাডে বলে, বন্ধুত্বটা ছিল আমার স্বামীর সঙ্গে। অবশ্য আমার স্বামী যেহেতু একজন ভালো রাজনীতিবিদ, এবং রাজনীতির ব্যাপারে মিসেস বারটনের আগ্রহ ছিলো। ঐ একটা জায়গায় ওদের মিল ছিলো।
-আপনি ভীষণ চতুর মহিলা, মনে মনে কেম্প প্রশংসা না করে পারলো না। মুখে বললো, ওঁদের দুজনের সম্পর্ক সম্বন্ধে আপনি কতটা ওয়াকিবহাল ছিলেন জানি না, তবে একটা প্রশ্ন করি, মিঃ বারটন কি আপনাকে কখনো বলেননি, তাঁর স্ত্রী আত্মহত্যা করেননি।
-না, সেই কারণেই আমি বেশ অবাক হচ্ছি।
–আচ্ছা, লেডি আলেকজান্ডার, মিঃ এ্যানথনি ব্রাউন সম্বন্ধে আপনার কি ধারণা?
–তেমন কিছু নয়। ওর সঙ্গে বিশেষ আমার দেখা হয় না।
–মিসেস বারটনের সঙ্গে ওঁর বিশেষ কোনো ঘনিষ্ঠতা ছিলো বলে আপনার মনে হয়?
–আমি ওঁদের সঙ্গে বন্ধুর মতোই মিশতে দেখেছি। এর বেশি কিছু আমি বলতে পারি না।
স্টিফেন ফ্যারাডের কাছ থেকেও প্রশ্ন করে বিশেষ কোনো সুফল পাওয়া গেল না।
আরো দুএকটা প্রশ্ন করে কেম্প চলে এলো আসল প্রসঙ্গে।
এবার আমরা গতরাতের প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। কথাটা বলে কেম্প তিনজনের মুখের ওপর দিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো।
বলা বাহুল্য গতরাত্রের বিয়োগান্তক ঘটনাকে কেন্দ্র করেই কেম্প প্রশ্ন রাখলো পরপর। তাদের মধ্যে কেউই বলতে পারলো না, সেই খালি চেয়ারটা আসলে কার জন্য নির্দিষ্ট করা ছিলো। তবে ফ্যারাডে দম্পতির কথা থেকে জানা যায়, ক্যাবারের পর ঘরের আনোগুলো নেভা মাত্র জর্জ নাকি সেই খালি চেয়ারের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন কিছুক্ষণের জন্য।
তবে বিভিন্নরকম প্রশ্নের মাধ্যমে কেম্প জানতে পেরেছে যে ফেয়ারহেভেনে আইরিসের জন্মদিনের ডিনার পার্টি সফল করার ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য সান্দ্রাকে জর্জ অনুরোধ করে, সে এবং তার স্বামী যেন তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
কেম্প এবার ফেরার জন্য উঠে দাঁড়ালো–মিঃ ফ্যারাডে, একসময় আপনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ফোন করবেন। আপনাকে জানিয়ে দেবো কখন আমি আবার আপনার সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারবো।
কেম্প বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো, স্টিফেনও জরুরী কাজ আছে বলে সেখান থেকে চলে গেল।
লর্ড ফিডারমিনস্টার কোনো দ্বিধা না করে মেয়েকে প্রশ্ন করলেন, মিসেস বারটনের সঙ্গে স্টিফেনের কি কোনো গোপন সম্পর্ক ছিলো বলে তোমার মনে হয় সান্দ্রা?
সান্দ্রা একই উত্তর দিলো–এ ব্যাপারে সে কিছু জানে না। সেরকম কিছু হলে সে নিশ্চয়ই টের পেতো।
লর্ড ফিডারমিনস্টার কিন্তু কথাটা বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি এবার স্ত্রীর ঘরে এসে ঢুকলেন। তার সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন।
-তোমার মুখে সব শুনে যা বুঝতে পারছি যে একজন খুনীকে আমরা আমাদের পরিবারে গ্রহণ করেছি। তাই তো? লেডি ফিডারমিনস্টার বললেন।
-জানি না। এই মুহূর্তে এককথায় তার বিরুদ্ধে এ মন্তব্য করতে পারছি না। পুলিশের ধারণা মিসেস বারটনের সঙ্গে স্টিফেনের নিশ্চয়ই কোনো অভেদ সম্পর্ক ছিলো। এর থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, তার জন্যই মিসেস বারটন আত্মহত্যা করেছে নয়তো সে। সে যাই হোক, মিঃ বারটন দারুণ কঠোর প্রকৃতির লোক। তিনি তার স্ত্রীর কেচ্ছা জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্য আয়োজন করেছিলেন। আমার ধারণা, স্টিফেন স্বাভাবিক কারণেই সেই ব্যবস্থাটা মনে নিতে না পেরে– যাই হোক, অন্যায় যদি সে করেই থাকে, তাহলেও তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।
দায়িত্ব। তুমি এসব কি বলছো?
–হ্যাঁ, ওদের রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। যেভাবেই হোক আইনের বেড়াজাল ছিঁড়ে ওদের উদ্ধার করতে হবে। আর সে দায়িত্ব তোমার।
তার মানে তুমি বলতে চাইছো আমার মেয়ে খুনী হলেও আমার ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে তাকে রক্ষা করতে হবে। এটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার মান-সম্মান সব মাটিতে মিশে যাবে।
–আর সান্দ্রা গ্রেপ্তার হলে, তার বিচার হলে, তুমি নিশ্চয়ই একজন দামি ব্যারিস্টার হবে।
নিশ্চয়ই, সেটা আলাদা ব্যাপার। তোমার মেয়ে কেন যে সেটা বুঝতে চায় না।
নীরব হলেন লেডি ফিডারমিনস্টার। কি করে বোঝাবেন তিনি, ছেলেমেয়েদের স্বার্থে যে কোনো অপ্রিয় কাজ করতে দ্বিধা হওয়া উচিত নয় কোনো বাবা-মার।
লর্ড ফিডারমিনস্টার বললেন, আমি বিশ্বাস করি না, সান্দ্রা খুন করেছে। স্ত্রীকে আশ্বস্ত করার জন্য বলতে থাকেন, যাই হোক নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ না থাকলে সান্দ্রার বিরুদ্ধে যাতে কোনো অভিযোগ দায়ের না হয় সেদিকটা আমি অবশ্যই দেখবো।
.
৩.৫
কর্নেল রেস যখন অফিসে এসে ঢুকলো তখন রুথ লেসিং একটা বড় ডেস্কের ওপর স্তূপাকারে কাগজের মধ্যে ডুবে ছিলো। পরনে কালো কোট, চোখের কোণে কালো কালি। হাজার চেষ্টাতেও সেটা ঢাকা পড়েনি।
–আপনি এসে ভালো করেছেন, রুথ বলে। আপনার পরিচয় আমি জানি। গতকাল সন্ধ্যায় ডিনার পার্টিতে চেয়ারে বসার পর মিঃ বারটন আপনার কথা বলতে একটু অবাক হয়েছিলাম।
শেষ পর্যন্ত আসবেন তো? কারণ গত বছর রোজমেরির জন্মদিনের পার্টিতেও আপনার আসার কথা ছিলো, কিন্তু আপনি আসেননি।
-কিন্তু আপনি তো এসেছিলেন?
–নিশ্চয়ই। রুথ মনে হয় একটু আঘাত পেলো। তাছাড়া ওটা আমার ডিউটির মধ্যে পড়ে।
–আপনার ওপর জর্জ যে নির্ভরশীল সেটা তার কাছ থেকে আমি শুনেছি।
মেয়েটির ভাবভঙ্গী দেখে রেসের মনে হয়, ও নির্দোষ। অত্যন্ত ঠান্ডা প্রকৃতির মেয়ে।
রুথ ওর দিকে তাকিয়ে বললোহা, আট বছর ধরে ওঁর কাছে কাজ করছি। আপনার সঙ্গে কয়েকটি জরুরী কথা ছিলো। চলুন বাইরে কোথায় মধ্যাহ্ন ভোজন করা যাক। সেসময় কথা বলা যাবে।
রেস্তরাঁর বয়কে খাবার অর্ডার দিয়ে দুজনে বসলো।
–চীফ ইনসপেক্টর কেম্পের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে নিশ্চয়ই।
কর্নেল রেস প্রশ্ন করলো।
-হ্যাঁ, গতরাতে দেখা হয়েছে। চতুর এবং অভিজ্ঞ ভদ্রলোক। একটু চুপ করে থেকে রুথ বলে, আপনার কি মনে হয় সত্যিই তিনি খুন হয়েছেন?
–আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনি বোধহয় একটু সংশয়ের মধ্যে আছেন যে এটি খুন না আত্মহত্যা, রেস তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলো, আপনি গতকাল মিঃ বারটনের সঙ্গে সারাক্ষণ ছিলেন। ওঁকে কি স্বাভাবিক বা উত্তেজিত কিংবা চিন্তিত মনে হয়েছিল আপনার?
-বলা মুশকিল। তবে একটু নিশ্চিন্ত দেখেছিলাম।
রুথ ভিক্টর ড্রেকের ব্যাপারটা সবিস্তারে জানালো। তারপর বললো, সেদিন মিসেস ড্রেকের চোখেও জল দেখেছিলাম। কিন্তু মিঃ বারটনকে ওভাবে ভেঙে পড়তে কখনো দেখিনি, তাই আমার মনে হয়েছিল–
-বলুন, কি মনে হয়েছিল–
–গত বছর ভিক্টর ড্রেককে দক্ষিণ-আমেরিকায় পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলেন মিঃ বারটন। এর আগেও অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, মিঃ বারটন রেগে গেছেন, বিরক্ত হয়েছেন, কিন্তু সেদিনের রাগ ছিল অন্যরকম। গত জুন মাসে একটা টেলিগ্রাম আসে, ভিক্টর তিনশো পাউন্ড দাবি করে। অথচ পরের দিনই ডিনারের পার্টির ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। ফলে তিনি বিরক্ত হয়ে ওঠেন। এছাড়া টেলিগ্রামের বিষয়বস্তু এমন বিশ্রী ধরনের ছিলো যে তাকে অত্যন্ত খারাপ দেখাচ্ছিল।
এবার রুথ প্রশ্ন করলো–আপনি কি মনে করেন গতবছর যে পার্টির দিনে মিসেস বারটন আত্মহত্যা করেছিলেন এটা তারই পুনরাবৃত্তি।
-হ্যাঁ, আপনার অনুমান ঠিক, তবে জর্জ এ ব্যাপারে আপনাকে সবকিছু খুলে জানায়নি বা যে কোনো কারণেই হোক ব্যাপারটা আপনার কাছে গোপন রেখেছিলেন। কারণ তার বিশ্বাস ছিলো, তার স্ত্রী খুন হয়েছেন।
–কেন, আপনি জানেন না, জর্জ কতগুলি বেনামি চিঠি পেয়েছিলেন?
–না, এ সবের কিছুই জানি না।
রেস ওর দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললো, আপনি কি এখনও বলবেন এটা খুন নয়, আত্মহত্যা? ওঁরা দুজনেই আত্মহত্যা করেছেন?
রুথ ভুরু কুঁচকে বলে, এছাড়া কি আর ভাবতে পারি? স্বাভাবিক ভাবে এটাই তো মনে আসে।
একটু চুপ করে থেকে রুথ বলতে থাকে, তবে মিসেস বারটন ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে ওঠার পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। দুর্ঘটনার দিন তার মাথার যন্ত্রণায় তিনি খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন, আমি তখন ক্লোক রুমের বাইরে ছিলাম। লেডি আলেকজান্ডারকে তিনি মাথার যন্ত্রণার কথা বলছিলেন। মিসেস ফ্যারাডে হাত ব্যাগ থেকে একটা ট্যাবলেট বের করে মিসেস বারটনকে দেন।
কর্নেল রেস নির্বাক হয়ে শুনতে থাকে–তিনি সেটা দিলেন?
–হ্যাঁ দিলেন বৈকি।
তাহলে এ কাজ সান্দ্রার। টেবিলের নিচে হাত ঢুকিয়ে মিসেস বারটনের গ্লাসের নাগাল পাওয়া তার পক্ষে কষ্টকর ছিলো না। তাই সে বিশেষ ট্যাবলেট ব্যবহার করে, পরে যেটা মিসেস বারটন তার শ্যাম্পেনের গ্লাসে ফেলে দিয়েছিলেন। অবশ্য এ সবই অনুমান হতে পারে।
-ও হ্যাঁ, রুথ বলে ওঠে, মনে পড়েছে, কেন তিনি চিঠিগুলোর কথা আমাদের বলেননি বা ফ্যারাডেদের বাড়ির কাছে বাড়ি কিনেছিলেন কেন? আসলে তিনি কাউকে বিশ্বাস করতেন না। তার ধারণা ছিল আমাদের মধ্যে কেউ একজন তার স্ত্রীর হত্যাকারী।
-কেন, আপনার দিক থেকে কোনো কারণ আছে রোজমেরিকে খুন করার ব্যাপারে?
এরকম কঠিন একটা প্রশ্নের সামনে পড়ে রুথ একটু ঘাবড়ে গেল। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, সে তো আপনিই ভালো জানেন। জর্জকে আমি ভালোবাসতাম। তিনিও আমাকে ভালোবাসতেন তবে আমার মতো নয়। রোজমেরির আগে আমি ওঁকে ভালোবাসি। আমার মনে হতো, আমি ওঁর আদর্শ স্ত্রী হওয়ার পক্ষে উপযুক্ত। কিন্তু তিনি রোজমেরিকে ভীষণ ভালোবাসতেন, তবু তিনি অসুখী ছিলেন।
..সবাই বলতো, রোজমেরি আকর্ষণীয়, সুন্দরী। কিন্তু আমি তাকে পছন্দ করতাম না। তার মৃত্যুর খবরটা আমাকে দুঃখ দিয়েছিলো বটে তবে আমার মন দুঃখে ভরে যায়নি। তাই মনে হয় ওঁর আকস্মিক মৃত্যুতে আমি খুশী হয়েছিলাম।
–আচ্ছা মিস লেসিং, এমন তো হতে পারে, বাইরের কেউ গোপনে জর্জের গ্লাসে সায়ানাইড মিশিয়ে সরে পড়েছিল। গতকাল রাতের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করুন, মিস লেসিং।
হঠাৎ রুথের মুখের রঙ পাল্টে গেল। কেমন কাঁপা কাঁপা গলায় বললোনা, কিছুই মনে পড়ছে না।
জর্জ কি তবে জানতে পেরেছিলেন কে ঐ চিঠি পাঠিয়েছিল? তার উদ্দেশ্য কি ছিল? তাই কি জর্জ খুনীকে ধরার জন্য গতকাল ফাঁদ পেতেছিলেন? আর সে জন্যই কি রুথ তার মুখ চিরজীবনের মতো বন্ধ করে দিলো?
সঙ্গে সঙ্গে রেস একথাও ভাবে, না রুথ ভয় পাওয়ার মতো মেয়ে নয়। জর্জের থেকে সে অনেক বেশি বুদ্ধি ধরে। প্রয়োজন হলে সে অনায়াসে সেই ফাঁদ এড়িয়ে যেতে পারতো?
অতএব রুথের নাম সন্দেহের তালিকা থেকে আপাততঃ বাদ দেওয়া যেতে পারে।
.
৩.৬
কর্নেল রেসকে দেখে লুসিলা ড্রেক চোখের জলে রুমাল ভিজিয়ে দিলেন। জর্জ বারটন ছিলেন বাড়ির কর্তা। তার মৃত্যুর পর বাড়িতে দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলতে আর কেউ নেই। দুঃখ হওয়াই স্বাভাবিক?
মিসেস ড্রেক চেয়েছিলেন এই গ্রীষ্মে আইরিস যেন জর্জের দেখাশুনা করার ভার নেয়। কিন্তু সে নিজেই যেন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল এ বাড়িতে, তার রক্তহীন সাদা মুখ দেখে মনে হয় সব সময় যেন সে ভয়ে সিটিয়ে আছে।
এরপরে প্রায় পনেরো মিনিট ধরে তিনি তাঁর একমাত্র পুত্র ভিক্টর ড্রেকের গুণকীর্তন শোনালেন।
তারপ তিনি ফিরে এলেন অন্য প্রসঙ্গে। রোজমেরির মৃত্যু এবং তার উইলে শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করে যাওয়াটা বেশি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার কাছে। অবশ্য টাকাটাই সব নয়। বেচারি রোজমেরির সেই মর্মান্তিক মৃত্যুর স্মৃতি আজও কেউ ভুলতে পারেনি। এমন কি আইরিসের ব্যাপারেও তিনি চিন্তিত।
রেস তার দিকে কৌতূহলী দৃটিতে তাকায়।
-রোজমেরির বিরাট সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী যে আইরিস, এটা এখন সবাই জানে। তাই আমি আইরিসের যুবক বন্ধুদের প্রতি কড়া নজর রাখি ভয়ে ভয়ে। অথচ তাদের বাড়িতে আসতে বললে আসবে না, জর্জও আইরিসের ব্যাপারে চিন্তিত ছিলো। তাই তো আইরিসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এ্যানথনি ব্রাউনকে ঠিক পছন্দ করতেন না।
এমন সময় দরজায় মদু আওয়াজ হলো।
কর্নেল রেস সেদিকে তাকালো। মিস আইরিস মারলে দাঁড়িয়ে। চোখে মুখে একটা উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট। তার শান্তশিষ্ট চেহারাটা। সেই উত্তেজনাকে কিছুতেই আড়াল করতে পারছে না।
-প্রিয় আইরিস, তুমি এসে গেছো? লুসিলা বললেন, তুমি কর্নেল রেসকে চেনো। ভারী চমৎকার লোক।
আইরিস এগিয়ে এসে রেসের সঙ্গে করমর্দন করে।
–আপনাদের কোনো সাহায্যে যদি লাগতে পারি, সেইজন্যই আমার আসা।
–আপনার মহানুভবতার জন্য ধন্যবাদ। আইরিস বললো, আপনারা কি নিয়ে যেন আলোচনা করছিলেন?
লুসিলা করুণ চোখে তাকালেন। তিনি যে আইরিসের কাছে ব্রাউনের প্রসঙ্গ চাপা দিতে চাইছেন সেটা বুঝতে রেসের দেরি হলো না।
আইরিস ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসি টেনে বললো, আমার ধারণা, আপনারা বোধহয় এ্যানথনি ব্রাউনকে নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
–হ্যাঁ, লুসিলা এবার জবাব দিলেন, তার সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না এই কথাই আমি বলছিলাম।
আমি তাকে খুব শীগগির বিয়ে করতে যচ্ছি, অতএব পরে অনেক কিছু জানার সুযোগ পাবো।
-ওঃ আইরিস, তোমার কি হয়েছে বলো তো? এখনও জর্জের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হয়নি। তুমি বারবার এ কঠিন কথা বলছো কেন?
আমি দুঃখিত। ক্লান্ত স্বরে আইরিস বলে।
এ প্রসঙ্গ চাপা দেওয়ার জন্য কর্নেল রেস বলে উঠলো–মিস মারলে, আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিলো আমার।
আইরিস অবাক চোখে তাকালো তার দিকে। তারপর বললো–আসুন।
একটা ছোট ঘরে তারা এসে বসলো।
কয়েক মুহূর্ত রেসের দিকে তাকিয়ে থেকে আইরিস বললোগতকাল আমাদের পার্টিতে আপনি এলেন না কেন। জর্জ আপনাকে আশা করেছিল।
-না, আমি জানি, জর্জ আমাকে আশা করতে পারে না। কারণ তিনি বেশ ভালো ভাবেই জানতেন, আমি আসছি না।
-তাহলে ঐ খালি চেয়ারটা? ওটা কার জন্য নির্দিষ্ট করা ছিল কর্নেল রেস?
–আমার জন্য নয় এটা বলতে পারি।
–তাহলে কি ঐ খালি চেয়ারটা রোজমেরির জন্য নির্দিষ্ট ছিল? হ্যাঁ, রোজমেরি।
আইরিস কথা বলতে বলতে জোরে জোরে শ্বাস নেয়–ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। ঐ চিঠিগুলোই জর্জের মনে বিশ্বাস এনে দিয়েছিল যে রোজমেরি আত্মহত্যা করেনি। সেইজন্য সে গতকাল রাতে পার্টির ব্যবস্থা করেছিল।
…আমার কি মনে হয় জানেন? আমার মনে হয় রোজমেরি আমাকে কিছু বলতে চায়। আমার যতদূর মনে হয়, কতকাল জর্জ রোজমেরির স্বাস্থ্য পান করেছিল। তারপর সে মারা যায়। খুব সম্ভব রোজমেরি এসে তাকে নিয়ে যায়।
কিন্তু মৃত ব্যক্তির আত্মা শ্যাম্পেনের গ্লাসে সায়ানাইড বিষ মেশাতে পারে না মিস মারলে।
–জর্জ খুন হয়েছে। পুলিশের ধারণা এইরকম। কারণ অন্য কিছু ভাবা যায় না। কিন্তু রোজমেরি খুন হয়নি। সেই কারণেই এটা অবান্তর। রোজমেরি যে আত্মহত্যা করেছিলেন, তার স্বপক্ষে প্রমাণ আছে যথেষ্ট। আমি আসছি।
আইরিস ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল। একটু পরেই ফিরে এসে কর্নেলের হাতে একটা ভাঁজ করা চিঠি দিলো।
-এটা পড়লেই সব বুঝতে পারবেন।
দুবার চিঠিটা পড়লো কর্নেল, প্রিয়তম লিওপার্ড।
চিঠিটা ফেরত দিয়ে রেস বললো-কার উদ্দেশ্যে চিঠিটা লিখেছিলেন আপনি জানেন?
স্টিফেন ফ্যারাডেকে। রোজমেরি তাকে ভালোবাসতো। কিন্তু স্টিফেন তার সঙ্গে নিষ্ঠুরের মতো বিশ্বাসঘাতকতা করে। তাই মনে হয় সেদিন সবার সামনে সে তার নিজের জীবনকে নষ্ট করে দেয়। তার একটা পুরোনো ড্রেসিং গাউনের পকেট থেকে প্রায় ছমাস আগের চিঠিটা পেয়েছিলাম। জর্জকে জানাতে সাহস হয়নি। কারণ জর্জের বিশ্বাস ছিলো, রোজমেরি জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তাকে ভালোবেসে গিয়েছিল। তাই তো আমি তার বিশ্বাসে ফাটল ধরাতে চাইনি। তবে আপনি জর্জের বন্ধু, চীফ ইনসপেক্টর কেম্প আপনার বন্ধু। আপনাদের ব্যাপারটা জানানোর জন্যই চিঠিটা দেখালাম।
–এটা একটা প্রমাণপত্র বুঝলেন? চিঠিটা আমাকে দিলে ভালো হয়।
চিঠিটা কর্নেলের হাতে তুলে দিলো আইরিস।
.
৩.৭
কর্নেল রেসকে সাদর অভ্যর্থনা জানালো মেরি ব্রিজ ট্যালবট।
প্রিয় বন্ধু, কি খবর তোমার? সেই যে এলাহাবাদ থেকে পালালে আর দেখা পেলাম না। নিশ্চয়ই কোনো কারণে আবার আবির্ভূত হয়েছে।
রেস হাসলো, বললো-যে পরিচারিকাটি আমাকে তোমার কাছে দিয়ে গেল সে-ই বেটি আর্কডেল?
-হ্যাঁ, তবে বলো না যেন ও একজন গুপ্তচর কিংবা রাজনৈতিক—
না না, সেরকম কিছু নয়।
এমন সময় হুইস্কির ট্রে হাতে বেটি আর্কডেল ঘরে এসে ঢুকলো, মিসেস ব্রিজ ট্যালবট তাকে বললো, তোমাকে কর্নেল রেস কিছু জিজ্ঞাসা করতে চায়। ঠিক ঠিক উত্তর দিও।
সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
–তুমি তো মিঃ জর্জ বারটনের বাড়িতে কাজ করতে। আজকের কাগজটা পড়েছো?
-হ্যাঁ, পড়েছি। কি রকম আশ্চর্য ব্যাপার দেখুন স্বামী-স্ত্রী দুজনেই একই জায়গায় মারা যান। আমি মিসেস বারটনের মৃত্যুর পর সেখান থেকে চলে আসি। তবে সত্যি বলছি স্যার, মিসেস বারটনের আত্মহত্যার কথা আমি ভাবতে পারি না।
-কেন, একথা বলছো? তুমি এমন কোনো খবর জানো নিশ্চয়ই যেটা আমাদের কাজে হয়তো খুব জরুরী হতে পারে।
বেটি একটু ইতস্ততঃ করে বললো–এরকম ধারণা হওয়ার পেছনে একটা কারণ আছে। সেদিন মিসেস বারটনের ঘরের দরজা খোলাই ছিল। আমি তার ঘরের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। এ্যানথনি ব্রাউন, যেটা তার আসল নাম নয়, তার সঙ্গে তিনি তখন কথা বলছিলেন। লোকটির যেমন ভদ্র চেহারা তেমনি নম্র কথাবার্তা। সে নিচু গলায় মিসেস বারটনকে কি যেন বললো। তারপর হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে একটা বিশ্রী কথা বললো যেটা তার মুখ থেকে আশা করা যায় না। তার কথামতো কাজ না করলে মিসেস বারটনকে খতম করে দেবে। পরক্ষণেই সিঁড়ি দিয়ে মিস আইরিসকে আসতে দেখে আমি সেখান থেকে চলে যাই। এই প্রথম আপনাকে আমি কথাটা বললাম।
তুমি কি লোকটির আসল নাম বলতে শুনেছিলে?
–ব্রাউনকে বলতে শুনেছিলাম, টনির কথাও ভুলে যাও। টনি কিন্তু সম্পূর্ণ নামটা বলতে পারবে না। চেরী জ্যাম প্রস্তুতকারকরা বলতে পারবে।
-ঠিক আছে। মনে পড়লে আমাকে খবর দিয়ো। একটা ঠিকানা লেখা কার্ড এবং এক পাউন্ডের একটা নোট রেস তার হাতে তুলে দিলো।
বেটি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই মেরি ব্রিজ ট্যালবট ঘরে এসে ঢুকলো। চেরী জ্যাম তৈরি করতে কি কি উপকরণ লাগবে রেস তার কাছে জানতে চাইলো। উত্তরে জানতে পারলো যে চেরী জ্যাম মিহি করতে হলে মোরেলো চেরীজ অবশ্যই লাগবে।
ঠিক নামটা তাহলে খুঁজে পেয়েছে কর্নেল। সে ওখান থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে এলো। দেখলো বেটি তার জন্য অপেক্ষা করছে।
–আচ্ছা তার নাম কি টনি মোরেলো ছিল?
-হা হা, ব্রাউনকে বলতে শুনেছি, মিসেস বারটন যেন ঐ নামটা ভুলে যান। ব্রাউন একথাও বলেছিল যে সে জেলও খেটেছে।
একটু হেসে কর্নেল ওখান থেকে চলে এলো, কাছাকাছি পাবলিক টেলিফোন বুথে ঢুকে কেম্পের সঙ্গে যোগাযোগ করলো।
.
৩.৮
প্রায় আধঘণ্টা পরে ভীত সন্ত্রস্ত ষোলো বছরের এক ওয়েটারের সঙ্গে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে চীফ ইনসপেক্টর কেম্প বিরক্ত হয়ে ওঠেন। লুক্সেমবার্গ রেস্তরাঁর ছেলেটি তার কাকা চার্লসের সৌজন্যে চাকরিটা পায়। তার কাজে ছিলো না ক্লান্তি, ছিল না কোনো অভাব অভিযোগ। খুব শীগগির তার পদোন্নতি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু মিঃ জর্জ বারটনের খুনের ব্যাপারে পুলিশ তাকে সন্দেহ করে।
-বিশ্বাস করুন আপনি, ছেলেটি বলে। পাশের টেবিলে মঁসিয়ে রবার্ট সসের জন্য তাগাদা দিচ্ছিলেন। সসের শিশি নিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে যেতে চোখে পড়লো একটা লেডিজ ব্যাগ মেঝের ওপর মিঃ বারটনের টেবিলের সামনে পড়ে আছে। আমি ঐ টেবিলে খাবার দিতে গিয়ে দেখেছিলাম ব্যাগটা মিস মারলের হাতে। তাই তাড়াহুড়োতে মিস মারলের চেয়ার ভেবে ব্যাগটা হয়তো ভুল করে অন্য কোথাও রেখে থাকবো। অন্য কোনো মতলব আমার ছিলো না।
কেম্প তাকে সাবধান করে দিলো–ভবিষ্যতে যেন এরকম ভুল হয়।
সার্জেন্ট পোলক তাকে জানালো, লুক্সেমবার্গের মিঃ বারটনের রহস্যজনক মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু বলার জন্য মিস কেলা ওয়েস্ট দেখা করতে চায়।
দূর থেকে মিস কেলা ওয়েস্টকে দেখে কেম্পের মনে হলো, কোথায় যেন দেখেছে। পরিচিত মনে হচ্ছে? ভদ্রমহিলা সামনে আসতে তার ভুল ভাঙলো।
গতকাল রাতে লুক্সেমবার্গে একজন লোক মারা গেছেন, কাগজে পড়লাম মিঃ জর্জ বারটন। অবশ্য ভদ্রলোককে আমি আদৌ চিনি না।
-তাহলে?
-শুনুন ইনসপেক্টর কেম্প, স্পটলাইটে আমার ছবিসহ নাম ঠিকানা ছাপানো হয়। ঐ ছবিটা মিঃ ববারটনকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। তিনি আমাকে যোগাযোগ করে বলেছিলেন যে লুক্সেমবার্গে একটা ডিনার পার্টির ব্যবস্থা করেছেন। ঐ পার্টিতে একটা দারুণ চমক দিতে চান। তারপর একটা ছবি আমাকে দেখিয়ে বলেন, এই ছবির সঙ্গে আপনার অদ্ভুত মিল আছে, একটু আধটু অমিল যেটা আছে সেটা মেক-আপ করে পার্টিতে যেতে বলেন।
হ্যাঁ ঠিকই রোজমেরির ফটোর সঙ্গে এই তরুণীর অদ্ভুত একটা মিল আছে। কেম্প মনে মনে ভাবলো।
-কিন্তু আপনি গতকাল রাতে ঐ পার্টিতে এলেন না কেন?
–গতকাল রাত আটটার সময় মিঃ বারটন বা অন্য কেউ আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল, পার্টি বাতিল করা হয়েছে। পরের দিন আমাকে খবর দেওয়া হবে। অথচ আজ সকালেই কাগজ দেখে চমকে উঠলাম।
মিস ওয়েস্ট বিদায় নিলো।
এবার সার্জেন্ট প্রশ্ন করলো–কে ওঁকে পার্টিতে আসতে বারণ করেছিলো বলে আপনার মনে হয়?
–সেটা কোনো পুরুষের কণ্ঠস্বর?
তা মনে হয় না। তবে ফোনে দ্রুত কথা বললে গলার স্বর চেনা দুষ্কর হয়ে ওঠে।
.
৩.৯
দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ও সন্দেহ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে স্টিফেন ফ্যারাডে চীফ ইনসপেক্টর কেম্পের ঘরে এসে ঢুকলো। তার পাশে বসে আছে একজন ইউনিফর্ম পরা লোক, যার হাতে প্যাড আর পেনসিল।
মিঃ ফ্যারাডে, আজ আপনাকে ডেকেছি আপনার জবানবন্দী নেওয়ার জন্য, তারপর ওটা আপনি সই করে দেবেন। আপনি মনে করলে আপনার সলিসিটারের সামনেও দিতে পারেন।
–আমি বুঝতে পারছি না, আমার নতুন করে জবানবন্দী নেওয়ার কি আছে।
-হ্যাঁ, এর আগে যেটা নিয়েছিলাম সেটা একটা প্রাথমিক মামুলি আলোচনা মাত্র। তাছাড়া মিঃ ফ্যারাডে, এ কেসের ব্যাপারে আপনারও কিছু জানার থাকতে পারে।
এবার টাইপ করা একটি চিঠির নকল কেম্প তার হাতে দিয়ে বলে-পড়ে দেখুন। মিসেস বারটনের পোশাকের মধ্যে থেকে এই চিঠি পাওয়া যায়। মিস আইরিস মারলের কাছ থেকে চিঠিটা আমরা পাই। আপনি নিশ্চয়ই এবার অস্বীকার করবেন না, মিসেস রোজমেরির সঙ্গে আপনার কোনো ঘনিষ্ঠতা ছিলো না।
চিঠিটার ওপর চোখ রাখে স্টিফেন।
-এটা যে আমাকে লেখা হয়েছে তার কোনো উল্লেখ নেই। প্রতিবাদ করে ওঠে স্টিফেন।
–আর্লস কোর্টের ২১, ম্যালাড ম্যানসনের জন্য আপনি একসময় ভাড়া গুণে যেতেন তাই নয় কি?
তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, প্রথমে মিসেস বারটনের সঙ্গে প্রেম করি এবং পরে তাকে খুন করি। কিন্তু পুলিশের রিপোর্টে, এটি আত্মহত্যা হিসাবে অভিযুক্ত হয়েছে।
–কিন্তু মিঃ বারটন সেটা মেনে নেননি। তাই তিনি নিজেই তদন্ত শুরু করে দিয়েছিলেন।
এবার কেম্প অন্য প্রশ্ন করলো–আচ্ছা মিঃ ফ্যারাডে, আপনার স্ত্রী কি এসব ব্যাপার জানতেন?
-না, নিশ্চয়ই না।
–আপনি কি কখনো সায়ানাইড ব্যবহার করতেন? মানে ফটোগ্রাফির কাজে লাগানোর জন্য?
-না, একেবারেই নয়। কারণ ফটোগ্রাফি সম্পর্কে আমার মোটেই ধারণা নেই।
তখনকার মতো স্টিফেন ফ্যারাডেকে বিদায় দিলো কেম্প।
কেম্প এবার তার সহকারীর উদ্দেশ্যে বলে-কর্নেল রেস যেভাবে এ কেসের ব্যাপারে এগোচ্ছেন, তার অনুমান যদি ঠিক হয় তাহলে ফ্যারাডে দম্পতিকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে।
.
৩.১০
এ্যানথনি ব্রাউনের ঘরে এসে ঢুকলো কর্নেল রেস। অস্বাভাবিক লম্বা চেহারা, ধূসর লোহা রঙের চুল, মুখটা যেন ব্রোঞ্জে খোদাই করা।
-কর্নেল রেস গতকাল রাতে আপনি এক বিশেষ অতিথি ছিলেন, কিন্তু আপনি এলেন না। বারটন বলেছিল—
না, ঐ খালি চেয়ারটা আমার জন্য ছিলো না। রেস বলতে থাকে। জর্জের পরিকল্পনা ছিলো অন্যরকম। ক্লো ওয়েস্ট নামের এক অভিনেত্রীর জন্য ঐ চেয়ারটা ছিলো।
এ্যানথনি ব্রাউন বিস্মিত হলো।
–একজন নবাগতা অভিনেত্রী যার চেহারার এবং মুখের সঙ্গে মিসেস বারটনের দারুণ মিল আছে। তাকে রোজমেরির একটা ফটো দেওয়া হয়। এমন কি মৃত্যুর দিন তিনি যে পোশাক পরেছিলেন সেই পোশাক তাকে গতকাল রাতে পরার জন্য দেওয়া হয়। তার মানে জর্জের পরিকল্পনা ছিলো, মিসেস রোজমেরির প্রেতাত্মার অভিনয় করিয়ে সেদিনের প্রকৃত ঘটনার আলোকপাত করা।
-কর্নেল রেস না হেসে পারছি না। আমি অনুভব করি, বেচারা রোজমেরির আত্মা অমন যত্রতত্র ঘুরে বেড়াবার নয়।
-কেন, একথা বলছেন?
–তিনি খুন হয়েছিলেন, আত্মহত্যা নয়।
তাকে মৃত্যু ভয় দেখানো হয়েছিল, এটাও বলা যেতে পারে? মিঃ ব্রাউন আপনি কি টনি মোরেলোর খবর জানেন?
এ্যানথনির মুখ শুকিয়ে যায়। সে চেয়ারে বসে পড়ে। সে আস্তে আস্তে বলে, আপনি জানলেন কি করে? আমার এই গোপন পরিচয় আপনি আমেরিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন নিশ্চয়ই?
সে যাই হোক, আপনার আসল নাম টনি মোরেলো কিনা বলুন? আর মিসেস বারটন আপনার গোপন পরিচয় জেনে ফেলেছিলেন বলে তাকে হত্যা করার হুমকি দেন। কি, আমি ঠিক বলছি তো?
–আমি তাঁর মুখ বন্ধ করার জন্য একথা বলেছিলাম। টনি খোলখুলি স্বীকার করলো।
এত সহজে যে কাজ হাসিল হবে সেটা ভাবতে পারেনি রেস। তবু তাকে বাজিয়ে দেখার জন্য বললো, আপনার সম্বন্ধে সব কিছু জানি আমি, মিঃ মোরেলো।
বড়ই দুর্ভাগ্য তাহলে আমার। এ্যানথনি ব্যঙ্গ করে বলে, তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যে এরিকসন এরোপ্লেনে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করার জন্য আমার যে শাস্তি হিসাবে জেল হয়েছিল সেটা মিসেস বারটন জানতেন বলে তাকে আমি খুন করি। তারপর জর্জ বারটন আমাকে সন্দেহ করতেন বলে তাকেও আমি খুন করি? তারপর বিরাট ধন সম্পত্তির লোভে এবার খুন করার চেষ্টায় আছি মিস আইরিস মারলেকে, তাই তো? কিন্তু এসবের কোনো প্রমাণ আপনার হাতে নেই।
–আপনার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগে আপনাকেই দোষী হিসাবে সন্দেহ করেছিলাম। কিন্তু আপনার সঙ্গে এখন কথা বলে আমার সে ধারণা পাল্টে গেছে। আপনি আমাদের বন্ধু। খুন আপনি করতে পারেন না।
এক বুক স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো মিঃ ব্রাউন। মুখে হাসি ফুটলো।
-এবার বলুন মিঃ ব্রাউন, মিঃ এবং মিসেস বারটনকে কারা খুন করেছে বলে আপনার মনে হয়?
-কে বা কারা তাদের খুন করতে পারে এরকম কোনো ধারণা আমার নেই। যদি সন্দেহ করতে হয় তাহলে গতকাল পার্টির সকলকে দোষী মনে করতে হয়। তবে মিস রুথ লেসিংকে আমার সবচেয়ে বেশি সন্দেহ হয়।
–এরকম সন্দেহর মূলে কোনো কারণ আছে?
-না, তবে তাকেই আমার সম্ভাব্য খুনী বলে মনে হয়। অবশ্য দুটি ব্যাপারের ক্ষেত্রে সে এমন একটা জায়গায় বসেছিল যে সেখান থেকে ওঁদের শ্যাম্পেনের গ্লাসে সায়ানাইড মেশানো অসম্ভব। এদিক থেকে বিচার করলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, ওঁরা আত্মহত্যা করেছিলেন। তবে যখন ওদের কথা মনে ভাবি, একান্তে বসে নিজের মনে আলোচনা করি, ঐ বেনামী চিঠিগুলো কে লিখেছিল? আর তার চিঠি লেখার উদ্দেশ্য-ই বা কি?
.
৩.১১
লুসিলা ড্রেক তার এক প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে অন্য জায়গায় চা খাওয়ার জন্য বেরিয়েছেন। সেই অবসরে এ্যানথনি ব্রাউন এলভারস্টন স্কোয়ারে এসে হাজির হলো। উদ্দেশ্য আইরিসের সঙ্গে নিভৃতে কিছু কথা বলা।
-এ্যানথনি, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? আইরিসের কণ্ঠে অনুযোগের ছোঁয়া। তোমার সঙ্গে যে অনেক কথা ছিল এ্যানথনি।
আইরিসের কাছে বসে এ্যানথনি বলে–কি হয়েছে প্রিয়তমা? তোমাকে খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে?
গতকাল রাতের কথা, তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না। চীফ ইনসপেক্টর কেম্পের অভিযোগ, লুক্সেমবার্গের সেই অভিশপ্ত টেবিলের নিচে ছোট্ট একটা কাগজের প্যাকেট পাওয়া গেছে, তাতে সায়ানাইডের গুঁড়ো লেগে ছিল।
-এর জন্য এত ভয় পাওয়ার কি আছে? এ্যানথনি হাল্কা ভাবে কথাটা বলে। খুনী নিশ্চয়ই জর্জের সামনের গ্লাসে সায়ানাইডের গুঁড়ো ঢেলে দেবার পর প্যাকেটটা সবার অলেক্ষ্য টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে থাকবে।
–আসলে তা নয়। আইরিসের চোখে ভয়। ঐ প্যাকেটটা আমিই টেবিলের নিচে ফেলে দিয়েছিলাম।
এ্যানথনি চমকে ওঠে।
–শোন এ্যানথনি, মৃত জর্জকে নিয়ে যখন সকলে ব্যস্ত তখন চোখের জল মুছতে গিয়ে হাত-ব্যাগ খুলে রুমাল বের করতে যাই। কিন্তু ব্যাগ খুলে আমি হতবাক হয়ে পড়ি। কাগজের খালি প্যাকেট। তখনি আমার মনে পড়ে রোজমেরির মৃত্যুর পর হাত-ব্যাগ থেকে পাওয়া সায়ানাইডের খালি প্যাকেটটার কথা। কিন্তু কি করে এটা এলো? কিন্তু বাড়ি থেকে বেরোবার সময় আমার সেই হাত-ব্যাগে কেবল প্রসাধনের কিছু জিনিস ছিল। এছাড়া অন্য কিছু ছিল না, আমার ভালো করে মনে ছিল। রুমাল বের করতে গিয়ে কাগজের প্যাকেটটা টেবিলের নিচে পড়ে যায় ব্যাগ থেকে। ওটা তোলার ইচ্ছা হলো না। কেবল মনের মধ্যে একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিলো, এটা যদি প্রকাশ হয়ে পড়ে তাহলে আমাকেই সকলে খুনী বলে ধরবে। কিন্তু এ্যানথনি, আমি তো তাকে খুন করিনি?
–এটা কেউ লক্ষ্য করেনি।
–হ্যাঁ, রুথ লেসিং এমনভাবে তাকিয়েছিল যেন কোনো উদ্দেশ্য নেই তার।
প্যাকেটের ওপর তোমার হাতের ছাপ থাকতে পারে?
–না, রুমাল দিয়ে সেটা ধরেছিলাম।
–তাহলে তুমি যখন ক্যাবারে নাচের জন্য টেবিলে হাত-ব্যাগটা রেখেছিলে তখনই তোমার অনুপস্থিতিতে কেউ এই কাজটা করে থাকবে। তুমি একবার ক্লোকরুমেও তো গিয়েছিলে। সেখানে তোমার সঙ্গে কে ছিলো?
সান্দ্রা ফ্যারাডে আর রুথ লেসিং ছিলো। হাত ধোয়ার জন্য ব্যাগটা কাঁচের টেবিলে রেখে বেসিনের সামনে একবার গিয়েছিলাম।
তাহলে ও দুজনের মধ্যে যে কোনো একজন এই কাজ করেছে। তবে দুজনের মধ্যে রুথের সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু রুথের যদি তোমার প্রতি সায়ানাইড প্রয়োগের কোনো ইচ্ছা থাকতো, সে তোমার অজান্তে অবশ্যই করতে পারতো। কিন্তু সেটা সে করেনি। তার মানে রুথ একাজ করেনি। তাহলে কি কোনো ওয়েটার? রুথ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য কোনো ওয়েটার ভাড়া করেছিল?
এ্যানথনির মন তখন দ্বিধা সংকোচে ভরে গেছে। সে বললো–আমাদের এখুনি চীফ ইনসপেক্টর কেম্পের কাছে যেতে হবে। নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে রাখা যায় না। তাছাড়া আইন বলতেও কিছু আছে।
-এ্যানথনি, তুমি এটা করতে পারো না। আইরিস ভয়ে আঁৎকে ওঠে। তাহলে ওরা আমাকেই খুনী বলে ধরে নেবে।
-না, তুমি ভুল ভাবছে। সত্যি কথা বললে ওরা বিশ্বাস করবে। তাছাড়া পরে যদি জানাজানি হয় তাহলে হাজার যুক্তি দেখালেও তুমি রেহাই পাবে না। ওরা বেরোনোর জন্য পা বাড়াতেই কলিংবেল বেজে উঠলো।
-এ্যানথনি আমার যাওয়া হবে না, জর্জের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যাপারে রুথের সঙ্গে আলোচনা আছে। এটা তোমাকে বলা হয়নি।
-আইরিস কাজটা অত্যন্ত জরুরি। মিসেস ড্রেকের সঙ্গে রুথ এ ব্যাপারে আলোচনা করতে পারে। তুমি যদি এখন না যাও তাহলে দুঃখের সীমা থাকবে না তোমার। রুথকে অতকথা বলার পর সে বলে–ঠিক আছে মিঃ ব্রাউন, আপনারা যান। আমি মিসেস ড্রেকের সঙ্গে আলোচনা করে নেবো।
.
৩.১২
গোল মার্বেল পাথরের টেবিলের সামনে বসেছিল তারা তিনজন।
কর্নেল রেস, চীফ ইনসপেক্টর কেম্প এবং এ্যানথনি ব্রাউন।
এ্যানথনি ওদেরকে ব্যাপারটা বোঝাবার চেষ্টা করছিল। কেম্প তার যুক্তিগুলি খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলো।
-এটা এমন একটা কেস, তুমি জানো, অপরাধী কে, কিন্তু প্রমাণ করতে পারো না। চীফ ইনসপেক্টর বলে ওঠে।
তার মানে আপনি জানেন, খুনী কে? এ্যানথনি কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে।
–হ্যাঁ, লেডি আলেকজান্ডার ফ্যারাডেকে আমার ধারণা।
কারণ? রেস জানতে চায়।
-ভদ্রমহিলা অত্যন্ত পরশ্রীকাতর ও অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারী। কেম্প বলতে থাকে। মনে হয় মিঃ বারটনকে কেউ ইঙ্গিত করে থাকবে। ফলে তার মনে সন্দেহ জাগে। অবশ্য সন্দেহটা হওয়া স্বাভাবিক। ফ্যারাডে পরিবারের ওপর নজর রাখার প্রয়োজন না হলে কেউ তাদের পাড়ায় বাড়ি কিনতে আসে? ধৈর্য ধরার মতো মহিলা তিনি নন। আমার যতদূর ধারণা, একমাত্র তার পক্ষেই মিঃ বারটনের গ্লাসে সায়ানাইড বিষ মেশানো সম্ভব। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজটা করেছে বলে কারো নজরে পড়েনি।
এবার কেম্প এ্যানথনির দিকে তাকালো। মিঃ ব্রাউন, মিস মারলেকে তার কাহিনী শোনাবার জন্য এখানে নিয়ে আসাতে আমি খুব খুশী হয়েছি।
–আমি কাজটা দ্রুত করতে চেয়েছিলাম। ব্রাউন জবাব দেয়। তবে একটা কথা আপনি ঠিকই বলেছেন চীফ ইনসপেক্টর, এ কেসের বিচার কখনো হতে পারে না। বেনামী চিঠিগুলো কে লিখলো, কোন উদ্দেশ্যে লিখেছিলো, জর্জ বারটন কেন খুন হলো ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর আমরা জানতে পারলাম না। তবে এ ব্যাপারে আমাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই বলে আমার মনে হয়।
–এ সন্দেহ কি আপনার এখনো আছে মিঃ ব্রাউন? রেস প্রশ্ন করে।
–রুথ লেসিংকে আমার সন্দেহ হয়। এ্যানথনি জবাব দেয়।
-হ্যাঁ, আপনার সন্দেহ অমূলক নয়। মিসেস বারটনকে খুন করে জর্জ বারটনকে বিয়ে করার পথ পরিষ্কার করেছিল সে। কিন্তু দ্বিতীয় খুনের বেলায় তাকে তো দায়ী করা যায় না। সে কেন তার প্রেমিককে খুন করবে। তাছাড়া মিস মারলের হাত থেকে প্যাকেটটা পড়ে যেতে দেখে সে কেনই বা মুখে হাত চাপা দিয়ে অবাক চোখে তাকিয়েছিল? তবে আমার ধারণা যদি সত্যি হয় তাহলে কে জর্জ এবং রোজমেরি বারটনকে খুন করেছে সেটা বলতে পারি।
–আপনি জানেন? কে সে?
এ্যানথনি বড় বড় চোখে তাকায়।
–আমার মনে হয় মিস মারলেই অপরাধী। শান্তস্বরে রেস বলে।
এ্যানথনি উত্তেজিত হয়ে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সে সংযত করে। যুক্তি দিয়ে ওদের কাছ থেকে সব জানতে হবে। সে বলে–কেন তাকে আপনার সন্দেহ হলো কর্ণেল রেস?
–ভাগ্যগুণে মিসেস বারটন বিরাট সম্পত্তির একমাত্র অংশীদার ছিলেন। মিস মারলের ঐ সম্পত্তির ওপর কোনো দাবী ছিলো না। মিস মারলে ভালো করেই জানতেন যে মিসেস বারটন কেবল নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে সব সম্পত্তি আইরিস পাবে। ইনফ্লুয়েঞ্জায় যখন মিসেস বারটনের মানসিক অবস্থা দারুণ বিপন্ন তখন সুযোগ বুঝে মিস মারলে কাজটি হাসিল করেন।
..এছাড়া আর একটা কারণ আছে। আচ্ছা মিঃ ব্রাউন, এই কেসের সঙ্গে ভিক্টর ড্রেককে জড়িয়ে দিতে পারেন না?
–ভিক্টর ড্রেক? অবাক হয় এ্যানথনি।
–হ্যাঁ, এটা মারলে পরিবারের দুর্বলতা বলে আমি জানি।
–যাই হোক, এখন ব্যাপার হলো জর্জের গ্লাসে সে কি করে সায়ানাইডের গুঁড়ো মেশালো?
এ্যানথনির চোখ দুটো উত্তেজনায় জ্বলছিল। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। কাঁপা কাঁপা হাতে সিগারেট ধরায়।
এতক্ষণ চীফ ইনসপেক্টর কেম্প ওদের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সব শুনছিলেন।
এ্যানথনি রাগে গজরাতে থাকে–এখন দেখছি সমস্ত ব্যাপারটা উল্টে গেল। নতুন করে প্রথম থেকে ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে হবে। জর্জ বারটন আমার চোখের সামনে বসেছিল। তারই মাঝখানে অঘটন ঘটে গেল। কিন্তু কি করে হলো, আমাকে জানাতেই হবে। হতে পারে যখন সবাই নাচে ব্যস্ত ছিল তখন অপরাধী কাজটা সম্পন্ন করে। কিন্তু জর্জ তার গ্লাসে চুমুক দিয়েছিলেন এবং স্বাভাবিক ছিলেন। অতএব তাকে বিষ প্রয়োগ করা হয়নি অথচ বিষক্রিয়ার ফলেই তার মৃত্যু হয়।
ঘরের অন্য দুজন এ্যানথনিকে নীরবে লক্ষ্য করছিল। সে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে মাথার ওপর হাত দুটো রেখে আর বিড়বিড় করছে
-হা, হ্যাঁ, ঠিক তাই…সেই ব্যাগ..সেই ওয়েটার…
ওয়েটার? কেম্প সতর্ক হয়েই ছিলো। হ্যাঁ, ওয়েটার। তবে সে ঠিক ওয়েটার নয়। যাদু কিংবা কোনো সম্মোহন শক্তির দ্বারা আমাদের মধ্যে কেউ সেই মুহূর্তে ওয়েটারের ছদ্মবেশে কাজ হাসিল করে থাকবে। একটু থেমে কেম্পের হাত ধরে বলে-বিশ্বাস হলো না, না? আসুন আমার সঙ্গে। দেখুন বাইরের জগৎটা কি ভয়ঙ্কর।
ওদের দুজনকে নিয়ে এ্যানথনি ব্রাউন ঘর থেকে বেরিলয় করিডোরের সামনে টেলিফোনের সামনে এগিয়ে গেল।
.
৩.১৩
চীফ ইনসপেক্টর কেম্প এবং কর্নেল রেস কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে ছিলো এ্যানথনির দিকে। সে কি করতে চায় সেটাই দ্রষ্টব্য। এ্যানথনি কিছুটা খুশী হয়েছে এই ভেবে যে ওদের দুজনকে সে বোঝাতে পেরেছে। তাই তারা শ্রদ্ধা ও যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে তার কথা শুনছে। হঠাৎ অশুভ একটা আশঙ্কায় সে চমকে উঠলো। আইরিসকে একা ছেড়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। আইরিস একটু আগে ভয়ে ভয়ে তাকে জানিয়েছিল। আর একটু হলে সে গাড়ি চাপা পড়তো। ওকে চাপা দেওয়ার জন্যই ড্রাইভার ইচ্ছে করে অসতর্ক ভাব দেখিয়ে ওকে চাপা দিয়ে খতম করতে চেয়েছিল। তার মানে ওর মুখ চিরকালের জন্য কেউ বন্ধ করতে চাইছে।
আমাদের এক্ষুনি একবার এলভারস্টন স্কোয়ারে যেতে হবে।
এ্যানথনি রাস্তায় নেমে সংক্ষেপে আইরিসের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতার কথা ওদের জানায়। একটা ট্যাক্সিতে তারা উঠে বসলো।
–ঈশ্বর আপনাকে সময় মতো মনে করিয়ে দিয়েছেন বলে তাকে ধন্যবাদ জানাই। এতো তাড়াতাড়ি তৃতীয়বার আক্রমণ করাটা কিন্তু বাঞ্ছনীয় নয় কেম্প মন্তব্য করে।
সে যাই হোক, রেস বলে, তৃতীয় বার আক্রমণের ফলে আসল অপরাধীকে ধরার সুযোগ আমাদের এসে গেছে।
জর্জ বারটনের বাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ালো।
পারলার মেড সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দিলো।
মিস আইরিস বাড়ি ফিরেছে?
এ্যানথনি তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে প্রশ্ন করলো।
–হ্যাঁ, স্যার। তিনি আধঘণ্টা হলো বাড়ি ফিরেছেন। ইভান্স গভীর বিস্ময়ে কথাটা বললো।
এ্যানথনি ছুটে বাড়ির মধ্যে ঢোকে। পেছনে কেম্প এবং রেস।
ড্রয়িংরুমে তখন লুসিলা ড্রেক ড্রয়ারে কি যেন খুঁজছিলেন আর আপন মনে বলছিলেন– কোথায় যে গেল মিসেস মারকাসের চিঠিটা?
–আইরিস কোথায়?
এ্যানথনির আচমকা প্রশ্ন শুনে তিনি ফিরে তাকালেন। অবাক দৃষ্টি তার। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সহজভাবে বললেন, মাফ করবেন, আপনার পরিচয়?
রেস এবার সামনে এসে দাঁড়ায়।
তাকে দেখে লুসিলা ড্রেক খুশীতে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন।
-ওঃ আমার প্রিয় কর্নেল। আমি আপনাকে আরো একটু আগে আশা করেছিলাম। আপনার সঙ্গে জর্জের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আলোচনা করার ইচ্ছা ছিল।
মিসেস ড্রেক একবার কথা বলতে শুরু করলে থামতে চান না। তার কথার মাঝখানেই রেস জানাতে চাইলো-মিস মারলে কোথায়?
-আইরিস? বেচারি। এত ঝামেলা সহ্য করার মতো তার কি বয়েস হয়েছে? মাথা ধরেছে বলে ওর ঘরে চলে গেছে। বোধহয় বিশ্রাম নিচ্ছে। আমি ওকে বললাম, যাও তুমি বিশ্রাম নাও গিয়ে। আমি আর রুথ সব সামলে নেবো। রুথের একটুও ক্লান্তি নেই। মুখ বুঝে সব হুকুম মেনে কাজ করছে।
–মিস লেসিং এখন কোথায়?
কেম্প জানতে চায়।
মিনিট দশেক আগে চলে গেছে সে বেচারী। ওর হাতে এখন…
ইতিমধ্যে এ্যানথনি কখন যে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে কেউ টের পায়নি। সে বিরক্ত হয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে বলে, আপনারা কি গল্প করবেন, না কি আমাকে একটু সাহায্য করবেন।
অতএব ওরা দুজন ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসে।
তিনজনে পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে আসে। চরাতলায় উঠতে গিয়ে এ্যানথনি থমকে দাঁড়ায়, মৃদু পায়ের শব্দ সিঁড়ির ধাপে ধাপে নিচে নেমে আসে। সে দেরি না করে ঝট করে কেম্পকে নিয়ে পাসের বাথরুমে ঢুকে যায়।
পায়ের শব্দটা মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ওরা অপেক্ষা করলো। তারপর চারতলায় উঠে আইরিসের ঘরের দরজায় এসে ধাক্কা দেয়।
কোনো সাড়া না পেয়ে এ্যানথনির সন্দেহটা আরো ঘনিয়ে ওঠে। চাবির গর্তে চোখ রাখলো সে। সারা ঘর ধোয়ায় ভর্তি।
ততক্ষণে কর্নেল রেস হন্তদন্ত হয়ে চারতলায় উঠে এলো।
দরজা ভাঙা ছাড়া উপায় নেই। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর দরজা খুলে গেল। ঘরের মধ্যে ঢুকে দ্রুত চোখে বুলিয়ে নিয়ে রেস চিৎকার করে ওঠে–ঐ তো মিস মারলে ফায়ারপ্লেসের কাছে পড়ে আছেন। আপনি ওঁকে দেখুন। আমি ততক্ষণ ঘরের জানলাগুলো খুলে দিই।
গ্যাসের আগুনের সামনে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে আইরিস। মনে হয় ইতিমধ্যে অনেক গ্যাস তার পেটের মধ্যে চলে গেছে। মুখ এবং নাক কেমন বিশ্রী দেখাচ্ছিল। এ্যানথনি আর রেস তাকে ধরাধরি করে নিয়ে এলো ঘরের মাঝখানে।
ততক্ষণে জানলাগুলি খুলে দেওয়ায় ঘরের গ্যাস বেরিয়ে গেছে বেশ কিছুটা।
–মিঃ এ্যানথনি, ঘাবড়াবার কিছু নেই। রেস তাঁকে পরীক্ষা করে বলে, আপনি বরং ডাক্তারকে খবর দিন।
হলঘরে চলে এলো এ্যানথনি। রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল করতে গিয়ে বাধা পায়। পেছনে লুসিলা ড্রেক। এ্যানথনি একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে।
-কি হয়েছে? আমি জানতে চাই? লুসিলা ড্রেক অস্থির হয়ে ওঠেন। আইরিস কি অসুস্থ?
বন্ধ এবং গ্যাসপূর্ণ ঘরে গ্যাসের আগুনের সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল আইরিস।
–আইরিস? মিসেস ড্রেকের গলা থেকে আর্ত চিৎকার বেরিয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত ও কি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলো? এটা বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার নয়। আমি মানতে রাজী নই।
–আপনাকে জানতেও হবে না। এ্যানথনির ঠোঁটে ব্যঙ্গের হাসি। শ্লেষের সুরে বললো, কেন, এটা কি মিথ্যে?
.
৩.১৪
আইরিস ক্লান্ত চোখে এ্যানথনির দিকে তাকায়।
–এত সব কাণ্ডকারখানা কি করে হলো দয়া করে আমায় বলবে কি, টিম?
আইরিস সোফার ওপর শুয়েছিল। নভেম্বর মাস। সূর্যের প্রখর আলোয় হঠাৎ যেন লিটল প্রায়রস সাহসী হয়ে উঠলো।
কর্নেল রেস বসে আছে উইনডো সীলের ওপর। এ্যানথনি তাকে একবার লক্ষ্য করলো। তারপর বলতে শুরু করলো।
–আমি এই ক্ষণটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সেটা বলতে আমার দ্বিধা হচ্ছে না। নিজের বুদ্ধির জাহির যদি না করি তাহলে সেটা নিজের ওপর ভীষণ অবিচার করা হবে।
..রোজমেরির মৃত্যু আত্মহত্যা বলে স্বীকৃতি পেয়েছিল। কিন্তু আসলে ওটা আত্মহত্যা নয়। তাই জর্জ ওঁর স্ত্রীর মৃত্যুকে স্বীকার করে নিতে পারেননি বলে নিজেই গোপনে তদন্ত শুরু করেছিলেন। রোজমেরির খুনীও তাকে খুন করলো। তবে এর পাশাপাশি কয়েকটি প্রশ্ন বিতর্কের সৃষ্টি করে। যেমন, (ক) বিষপ্রয়োগে জর্জের মৃত্যু হতে পারে না, (খ) জর্জকে বিষপ্রয়োগ করেই খুন করা হয়েছে, (গ) জর্জের গ্লাস কেউ স্পর্শ করেনি, (ঘ) জর্জের গ্লাস নিশ্চয়ই কারো হাতের মধ্যে এসে থাকবে।
..ব্যাপারটা খুব ভালো করে খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে–সেই রাতের পার্টির সমস্ত গ্লাস এবং কফির কাপগুলো ছিলো একই মাপের এবং একই ডিজাইনের। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে।
যেমন, আমি, কেম্প আর রেস তিনজনে একটা গোল মার্বেল টেবিলের সামনে বসে চা খাচ্ছিলাম। ঘরে ঐ ধরনের আরো টেবিল আছে। রেস চা খাচ্ছিলেন বিনা চিনিতে, কেম্প চিনি মেশানো চা খাচ্ছিলেন আর আমি কফি পান করছিলাম। কোনো একটা অজুহাতে আমি ওদেরকে টেবিল ছেড়ে বাইরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। কেম্প তার হাতের পাইপটা তার চায়ের প্লেটের পাশে রেখে বাইরে গেলেন। আমি তাদের অলক্ষ্যে পাইপটা নিয়ে আমার প্লেটের পাশে রাখলাম। পরে সবাই ঘরে ফিরে এলো। কেম্প তার ফেলে যাওয়া পাইপ লক্ষ্য করে সেই চেয়ারটায় বসলেন। চায়ের কাপে ঠোঁট লাগালেন। কেমন বিস্বাদ ঠেকলো। সেইরকমই রেস তার কাপে ঠোঁট লাগিয়ে মুখ বিকৃত করবেন। এক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী বিকৃতির আদান-প্রদান দেখা যাবে। এবার বিতর্ক হলো, চায়ের কাপে চিনি ছিলো না, আবার বলা যেতে পারে, হ্যাঁ, চিনি ছিলো। এই বিতর্কের মূলে কাজ করছে কেম্পের কাপটা। কারণ ঘর ছেড়ে তিনি যখন চলে যান তখন ছিলো এক কাপ, পরে তিনি এসে বসেন অন্য কাপের সামনে। তার মানে এখানে কাপের প্রভেদ দেখা যাচ্ছে।
…সেদিন রাতে লুক্সেমবার্গে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। আইরিস, তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, ক্যাবারে নাচে যোগ দিতে যাওয়ার সময় তুমি ভুল করে তোমার ব্যাগটি টেবিলের নিছে ফেলে রেখে যাও। সেটা তুলে দিয়েছিলো রেস্তেরাঁর একটি অনভিজ্ঞ ছেলে। পরিচিত ওয়েটার হলে ঠিক খেয়াল করে তোমার জিনিস তোমার চেয়ারের সামনে টেবিলে রাখতো। কিন্তু এক্ষেত্রে ছেলেটি না জেনে ব্যাগটি মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে ভুল করে তোমার বাঁ পাশে রেখে দেয়। ফলে ক্যাবারে থেকে ফিরে তুমি যথারীতি তোমার ব্যাগ লক্ষ্য করে যে চেয়ারটায় বসলে আসলে ওটা নির্দিষ্ট চেয়ার নয়। তুমি বসেছিলে জর্জের চেয়ারে। আর জর্জ বসলেন তোমার চেয়ারে। এবার জর্জ গ্লাসে চুমুক দিলেন, যেটি তোমার জন্য নির্দিষ্ট ছিলো। ঐ গ্লাসে অনায়াসে বিষ মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
…এবার সমস্ত ব্যাপারটা ভালো করে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখো। আসলে তুমি ছিলে আততায়ীর দ্বিতীয় লক্ষ্য। কিন্তু জর্জের দুর্ভাগ্য। একটু ভুলের জন্য তার প্রাণটা গেল। এই ভুল শব্দটা পাল্টে দিলো সব কিছু। নতুবা সৃষ্টি হতো একই রকম, গতবছর পার্টির পুনরাবৃত্তি ঘটা এবং তোমার দিদির মতো তোমার খুন হওয়াটাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হতো। ব্যাপারটা আরো সত্যি বলে প্রমাণিত হতো, এই কারণে, যে তোমার ব্যাগে সায়ানাইডের প্যাকেট পাওয়া গিয়েছিল। তুমি যে আত্মহত্যা করেছে সেটাই জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যেতো।
…এ সবের মূলে কি জানো, অর্থ। অর্থই অনর্থের মূল। রোজমেরির মৃত্যুর পর তুমি পেয়েছে তার বিশাল সম্পত্তি। তারপর তুমি যদি অবিবাহিত অবস্থায় মারা যেতে তাহলে এই সম্পত্তির মালিক হতো তোমার নিকট আত্মীয়া লুসিলা পিসি। তাই সব দিক থেকে বিচার করে আমি বলছি, এই খুনের জন্য দায়ী লুসিলা ড্রেক। মিসেস ড্রেকের মৃত্যুর পর এই সম্পত্তি আইনগতভাবে পাবে ভিক্টর ড্রেক। অতএব স্পষ্ট ভাবে বলা যায়, প্রথম খুনের জন্য দায়ী হলো ভিক্টর ড্রেক।
-কিন্তু আমি জানি, প্রায় এক বছরের কাছাকাছি সে দক্ষিণ আমেরিকায় বাস করছে।
-সেটা কি সত্যি? ঘুরে ফিরে সেই চিরন্তন প্রেম কাহিনী এসে যাচ্ছে স্বাভাবিক ভাবে। রুথ লেসিং এবং ভিক্টর মেলামেশা করতে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবে প্রেমে পড়বে। তাদের মধ্যে ভালোবাসা বিনিময় হবে।
রুথ বলেছে, রোজমেরির মৃত্যুর আগেই ভিক্টরকে দক্ষিণ আমেরিকাগামী এস.এস. ক্রিস্টোবল জাহাজে তুলে দিয়ে এসেছে সে। এবং এই ব্যাপারটা একমাত্র রুথ জানতো। ভালো করে খোঁজ নিলে দেখা যাবে রোজমেরির মৃত্যুর আগে সে ইংলন্ডে ছিলো। তাছাড়া জর্জের মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে বুয়েন্স এয়ার ছেড়ে ভিক্টর নিউইয়র্ক চলে যায়। টেলিগ্রাম পাঠানো কোনো দুষ্কর ব্যাপার নয়। যে টেলিগ্রাম লুসিলা পিসি পেয়েছিলেন, যাতে টাকা দাবী ছিলো, সেটা ভিক্টর কোনো বন্ধুকে দিয়ে পাঠাবার ব্যবস্থা করে থাকতে পারে। এর থেকে সে প্রমাণ করতে চেয়েছিল সে আছে অনেক অনেক দূরে। অথচ
…অথচ সেদিন রাতে লুক্সেমবার্গে সে আমার টেবিলের পাশে বসেছিল। ঠিক আমার টেবিলের পেছনে। জেলে থাকার সময় ওর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল অল্প। আমি তাকে মাংকি কলেমন হিসাবে জানতাম। কিন্তু সে যে ভিক্টর ড্রেক সেটা আমার অজানা ছিলো। বহুদিন দেখা না হওয়ার ফলে সে আমাকে চিনতে পারলো না।
..একসময় সে উঠে পাবলিক টেলিফোনের বুথের দিকে এগিয়ে গেল। আপনাদের এক প্রস্থ ওয়েটারের পোশাক দেখিয়েছিলাম, মনে আছে নিশ্চয়ই। ওয়েটারের পোশাক পরে সে সহজেই একটা গ্লাসে শ্যাম্পেন ঢালার অজুহাতে সায়ানাইড বিষ মিশিয়ে দেয়। যেহেতু সে ওয়েটার তাই কেউ তাকে সন্দেহ করলো না।
–আর রুথ? আইরিসের কণ্ঠে দ্বিধা।
-হ্যাঁ, রুথও এই ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করেছে। তুমি যখন ক্লোকরুমে গিয়েছিলে তখন রুথ তোমার ব্যাগে পাকেটটা ঢুকিয়ে দেয়, ঠিক রোজমেরির ক্ষেত্রে এটা হয়েছিলো। বেনামে চিঠিগুলো লিখেছিলো জর্জ। সে চেয়েছিলো জর্জের মনে সন্দেহের দানা বাঁধতে, যে তুমি রোজমেরিকে খুন করেছে। ফলে রুথের পরামর্শে জর্জ দ্বিতীয়বার লুক্সেমবার্গে পার্টির ব্যবস্থা করেছিল। ওয়েটারের ভুল হয়েছিল বলে তুমি এ যাত্রা রক্ষা পেলে আইরিস। নতুবা জর্জের পরিবর্তে তোমার চিরতরে ঘুমোনোর কথা ছিল। এর থেকে রুথ প্রমাণ করতো যে রোজমেরিকে তুমি খুন করেছিলে বলে অনুশোচনায় ভুগছো। শেষে সহ্য করতে না পেরে নিজে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
–কিন্তু মেয়েটিকে আমি এখনও পছন্দ করি। ও জর্জকে বিয়ে করবে বলেছিলো।
আইরিস বললো।
-হ্যাঁ, ওর ঐ ভালো স্বভাব হয়তো চিরদিন অটুট থাকতো, জর্জ বারটনের আদর্শ স্ত্রী হতে পারতো, যদি না সে ভিক্টরের সঙ্গে মেলামেশা করতো। আসলে কি জানো, মেয়েরা প্রথম দিকে ফুলের মতো সুন্দর পবিত্র থাকে।
-তাহলে এতসব ব্যাপার ঘটানো হলো টাকার জন্য?
আইরিস আঁৎকে ওঠে।
–তুমি টাকার মর্ম বুঝবে না, আইরিস। তোমার মনে তো কোনো প্যাঁচ নেই। তুমি কি করে বুঝবে। কিন্তু এ দুনিয়ায় টাকাই সবার মূলে। টাকা থাকলে যে কোনা লোক দুনিয়াকে হাতের মুঠোয় আনতে পারে। ঐ টাকার জন্য ভিক্টর হয়ে উঠেছিলো জঘন্য নরকের কীট। কিছুটা টাকার মোহে এবং রোজমেরিকে ঘৃণা করতে বলে রুথও আংশিকভাবে এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তোমাকে গাড়ি চাপা দিয়ে মারতে চেয়েছিল এই রুথ লেসিং।
এ্যানথনি একটুক্ষণ থেমে আবার বলতে থাকে–জর্জের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা সেরে সে লুসিলা পিসির কাছ থেকে বিদায় নেয়। সে কিন্তু নিজের বাড়িতে ফেরে না। সোজা চলে আসে তোমার ঘরে। তোমাকে একা পাওয়ার সুযোগটা সে খুঁজছিলো। পেয়েও গেল সে। সে তোমাকে জর্জের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সব আয়োজনের কথা শোনাতে থাকে।
-হ্যাঁ, আইরিস বলতে থাকে। রুথ তারপর একটা রবারে জড়ানো টর্চ হাতে নিয়ে বললো, বাঃ, জিনিসটা ভারী সুন্দর দেখতে তো! তারপরের কথা আমার মনে নেই।
জানি, তুমি কিছু বলতে পারবে না। এ্যানথনি বলে–পরেরটুকু আমি বলছি। তোমার হাতের টর্চ নিয়ে তোমাকে সে আঘাত করে। তুমি জ্ঞান হারাও। তোমার সংজ্ঞাহীন দেহটা সে তখন টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় গ্যাস ফায়ারের কাছে। তোমার মুখটা ঘুরিয়ে দেয় গ্যাস ফায়ারের দিকে, তারপর সুইচ অন করে দেয়। মনে হয়, এসব কাণ্ডের কথা লুসিলা পিসি টের পাননি। তাহলে নিশ্চয়ই তিনি ছুটে এসে বাধা দিতেন।
-পুলিশ কি ভিক্টর ড্রেককে ধরতে পেরেছে?
-হ্যাঁ, আজ সকালে সে নিউইয়র্ক থেকে ফিরছিল। তখন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। জবাব দিলো কর্নেল রেস।
–এ্যানথনি এক কাজ করলে হয় না, আইরিস বলে। রোজমেরির সম্পত্তি নিয়ে কম তো অঘটন ঘটলো না। এতই যখন ঝামেলা ঐ অর্থ নিয়ে, তখন আমার ইচ্ছে, ওর থেকে একটা পেন্সও নেবো না।
-খুব ভালো কথা বলেছো, বরং ঐ অর্থ আমরা কোনো সৎ কাজে ব্যয় করবো। তাছাড়া আমার নিজের আয় নেহাত মন্দ নয়। তোমাকে স্ত্রী হিসাবে যথেষ্ট সুখে রাখতে পারবো বলে আমার বিশ্বাস।
কর্নেল রেসের ঠোঁটে হাসির ঝিলিক দেখা দিলো।
চীফ ইনসপেক্টর কেম্প তখন যাওয়ার জন্য এগিয়ে ছিলেন। মুখ ঘুরিয়ে বললেন–আমার যতদূর মনে হয়, আপনারা নিশ্চয়ই ফ্যারাডেদের চায়ের নিমন্ত্রণে যোগ দিচ্ছেন না।
এ্যানথনি মাথা নাড়লো, অর্থাৎ তার যাওয়ার ইচ্ছে নেই। এতদিন পর মন থেকে তার দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে। খুশীতে ভরে আছে তার হৃদয় মন। বহুদিন পর আইরিসকে একান্ত আপন করে কাছে পেয়েছে। সে এই মুহূর্তটিকে নষ্ট হতে দিতে চায় না।
রেস ওদের কাছ থেকে বিদায় নিলো।
-আচ্ছা এ্যানথনি, আইরিস সরাসরি তাকালো এ্যানথনির চোখের দিকে, তুমি কি করে বুঝলে, আমি খুন করিনি, অথচ ওঁরা তো ধরে নিয়েছিলো, আমি খুনী।
শোন প্রিয়তমা, আমার ভালোবাসাই আমার মনে এ বিশ্বাস এনেছে। এ্যানথনি বলে, আমার অন্ততঃ অনুমান তাই।
এ্যানথনি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে আইরিসের নীল চোখ আর রক্ত লাল কম্পমান ঠোঁটের দিকে। আইরিস লজ্জা পায় চোখ নামিয়ে নেয়।
অনেকক্ষণ নীরবে কেটে যায়। একসময় স্বপ্ন ভঙ্গ হয় এ্যানথনির।
–আশা করি তিনি আর আমাদের কাছাকাছি নেই, তাই না?
–তিনি মানে কে? কার কথা বলছো এ্যানথনি?
-এই প্রশ্নের উত্তর তো তোমার কাছে আছে আইরিস। রোজমেরি…আমার ধারণা, তিনি জানতেন যে, তখন তুমি ভীষণ বিপদের মধ্যে পড়ে আছে।
রোজমেরি, তোমাকে জানাই অজস্র ধন্যবাদ, বিদায়। –একেই বলে স্মৃতিচিহ্ন। কান্না ভেজা কন্ঠে আইরিস বলে, তার ভালোবাসা যেন আমরা কখনো বিস্মৃত না হই। ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করি।