- বইয়ের নামঃ স্পার্কলিং সায়ানাইড
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- প্রকাশনাঃ সমতট
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, ভূতের গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী
স্পার্কলিং সায়ানাইড
১. আইরিস মারলে
১.১
স্মৃতি ভীষণ ভয়ঙ্কর, বড়ই বেদনাদায়ক, ফতে আক্রান্ত হন রোজমেরি। হাসিখুশী সুন্দরী রোজমেরিকে মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে গেল বোন আইরিস মারলের কাছ থেকে, নীল বর্ণ মুখ, আঙুলগুলো মুঠোর মধ্যে বন্দী।
তবে কি রোজমেরি আত্মহত্যা করেছিলেন? ভাবতেও মন চায় না আইরিশের।
মৃত্যুর কারণ জানার জন্য অনুসন্ধান চললো এবং একদিন তা শেষও হলো। তারপর থেকে আইরিস ঐ ভয়ঙ্কর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় না। কেবল নিজের মনকে বুঝিয়েছেন, ভুলে যাও।
কিন্তু ভুললে তাকে চলবে না। এটা তিনি বুঝতে পারছেন।
আগের দিন জর্জের সঙ্গে সেই বিস্ময়কর সাক্ষাৎকার। জর্জের আচরণ, তার অন্যমনস্কতা, তার আচ্ছন্ন ভাব, তার সন্দেহজনক আচরণ, এসবের মধ্যে কি কোনো অর্থ লুকিয়ে নেই?
তার প্রিয় বোন রোজমেরি। তার মনে পড়ে যায় সুদূর অতীতের কথা। যখন তারা বাচ্চা ছিলেন তখনকার কথা স্মৃতি পটে ভেসে ওঠে, রোজমেরি তার থেকে ছবছরের বড় ছিলেন।
মনে পড়ে কত বিচ্ছিন্ন ঘটনা, টুকরো টুকরো দৃশ্য। রোজমেরির সখ ছিলো, শূকরের লেজের মতো বেনী দোলানো।
রোজমেরি বোর্ডিং-এ থেকে পড়াশুনা করতেন। ছুটিতে বাড়িতে আসতেন। যখন আইরিস স্কুলে ঢুকলেন তখন রোজমেরি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে চলে এসেছেন। তখন তার পরিবর্তন এসেছে সবকিছুতেই। আগের সেই হ্যাঁবলা ক্যাবলা রোজমেরি নেই। পোষাকে-আশাকে ফুটে উঠেছে, রুচির আভাস, কোমল কণ্ঠস্বর, মাধুর্যভরা চেহারা। গাঢ় নীল দুটি চোখে অন্তর্ভেদী চাউনি, সোনালি চুল মাথায়, যেন এক নিখুঁত সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি। এক পাগল করা রূপ।
তারপর থেকে দুজনের দেখা খুব কমই হতো।
তখন আইরিসের চলছে স্কুল জীবন, আর রোজমেরি এদিকে একা একা জীবনকে উপভোগ করছে। ছুটিতে আইরিস বাড়ি এলেও তাদের মধ্যে একটা ব্যবধান থেকে গেল। হয়তো ছবছরের ব্যবধান।
একদিন জর্জ বারটনের সঙ্গে রোজমেরির বাগদান পর্বচুকলো, কেনাকাটা, বিয়ের আয়োজনে কয়েকটা দিন হুল্লোড়ে কেটে গেল।
কিন্তু ঐ অল্প বয়সে আমার মনে এটা প্রশ্ন জেগেছে–রোজমেরি কেন তার থেকে পনেরো বছরের বড় জর্জকে স্বামী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন? এটা কি তার দয়া দেখান, না কি বোকামির পরিচয়?
অবশ্য রোজমেরির নিজের যথেষ্ট টাকা ছিলো, পল কাকার টাকা। আসলে তিনি ওদের আসল কাকা ছিলেন না। আইরিস যতটুকু শুনেছেন, তাদের মায়ের সঙ্গে পল বেনেটের ভালোবাসা ছিল। তাদের মা অন্য একজন গরীব লোককে পছন্দ করেন। পল বেনেট তার সেই পরাজয় রোমান্টিক মনোভাব নিয়ে মেনে নেন এবং সেই থেকে তাদের পরিবারে পল কাকা হিসাবে থেকে যান। রোজমেরির কাছে তিনি ছিলেন ধর্ম পিতা, তাঁর মৃত্যুর পর জানা যায়, তার সমস্ত অর্থ সম্পত্তির একমাত্র মালিকানা হলেন তার ছোট্ট ধর্ম কন্যা রোজমেরি।
আইরিসের কখনও মনে হয় না, রোজমেরি জর্জকে ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু তাকে দেখে বোঝা যেতো না যে তিনি দাম্পত্য জীবনে অসুখী। রোজমেরির বিয়ের এক বছর পর মারা যান মা ভায়োলা মারলে। মায়ের মৃত্যুর পর আইরিস চলে আসেন দিদি-জামাইবাবুর সংসারে। তখন তার বয়স সতেরো, তখনই তিনি উপলব্ধি করেন দিদি এবং তার স্বামীর প্রকৃত সম্পর্কের কথা।
অবশ্য ঐ বয়সে আইরিসের গভীর ভাবে চিন্তা করার মত ক্ষমতা জন্মায়নি। তাদের মা তাদের ঠিক মত যত্ন করতে পারতেন না কারণ তিনি ছিলেন রুগ্ন। কাজের লোকের ওপর তাকে ভরসা করতে হতো, কিন্তু মেয়েরা কাছে এলে তিনি তার ভালোবাসা উজার করে দিতেন। আইরিসের যখন পাঁচ বছর বয়স তখন অতিরিক্ত মদ্যপান করার জন্য অসময়ে মারা যান হেকটর মারলে। আর সতেরো বছর বয়সে তিনি মাকে হারালেন।
দিদির বাড়িতে তার মন বসতো না, কিন্তু এক বছর না হলে অন্য কোথাও চলে যেতে পারবেন না। তিনি এইসময় ফরাসি আর জার্মান ভাষা শিখতে লাগলেন। ডোমেস্টিক সায়েন্সের ক্লাসও শুরু করলেন। এক এক সময় হাতে কাজ থাকতো না, তখন আপন মনে বসে থাকতে হতো।
তখন রোজমেরি মার্কেটিং ককটেল পার্টি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত। তার সঙ্গে গল্প করার সময় কোথায়। একই বাড়িতে দুই বোনের বাস ছিল, অথচ অন্তরঙ্গতা ছিল না বললেই চলে। এ অবস্থায় দিদি রোজমেরির সম্পর্কে তিনি কতটুকু জানতে পারেন? তবু তাকে ঘাঁটতে হবে অতীতের ফেলে আসা দিনগুলিকে।
ঘটনাটা ঘটার এক সপ্তাহ আগে আইরিস ভুলতে পারবেন না সেই দিনটির কথা। চোখ বন্ধ করে স্মৃতি রোমন্থন করলেন আইরিস।
রোজমেরির বসার ঘরে ঢুকে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়া
তিনি কি দেখেছেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। রোজমেরি লেখার টেবিলের ওপর মাথা হেঁট করে কাঁদছেন। কেন এই কান্ন? আগে তো কখনো কাঁদতে দেখেননি। দারুণ ভয়ে পেয়ে যান আইরিস।
তবে রোজমেরির শরীর ক্লান্ত ছিল। কারণ দুদিন আগে ফ্লু থেকে উঠেছেন তিনি।
আইরিস নিজেকে সামলাতে না পেরে জোরে কেঁদে ওঠেন।
রোজমেরি ধাতস্থ হয়ে দাঁড়ালেন, এলোমলো চুলগুলি কপালের ওপর থেকে সরিয়ে দিলেন, সম্ভব মতো নিজেকে সহ্য করে নিয়ে রোজমেরি বললেন-ও কিছু না, ঘর থেকে দৌড়ে পালিয়ে গেলেন।