- বইয়ের নামঃ মিস্টিরিয়াস ইভেন্টস
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
মিস্টিরিয়াস ইভেন্টস
১. অন্ধকারে কণ্ঠস্বর
আলোবিহীন একটা অন্ধকার রাত। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে আমাদের জাহাজ ভাসছে। জাহাজের বর্তমান অবস্থা বলা যাচ্ছে না কারণ হালকা কুয়াশার আড়ালে সূর্যদেব লুকিয়ে আছেন। এই কুয়াশা কখনও মাস্তুল ঘিরে, কখনও নিচে নেমে এসে বিস্তৃত সমুদ্রকে আড়াল করছে। বাতাস নেই, তাই হাতলটা স্থির রেখে ডেকের উপর আমি একা ছিলাম, আমাদের নাবিক দল তিনজন–দুজন পুরুষ, একজন কিশোর। তারা তাদের কেবিনে ঘুমোচ্ছিল। আর উইল–আমার বন্ধু এবং এই জলযানের ক্যাপ্টেন, জাহাজের বাঁ দিকে পিছনের অংশে ছোট কেবিনের বাঙ্কে সে শুয়ে আছে।
হঠাৎ চারিদিকের অন্ধকার ভেদ করে একটা চিৎকার ভেসে এল–জাহাজে কেউ আছেন? আমি ভয় পেলাম। আবার কথাটি ভেসে এল। সে বলল যে, সে একজন বৃদ্ধা মানুষ। সে নির্ভয়ের আশ্বাস দিল।
কথার মাঝখানের ছোট্ট বিরতিটা কানে বাজালো, কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ অনেকদিন পর বুঝতে পেরেছিলাম। আমি জানতে চাইলাম যে তাহলে জাহাজের কাছে কেন আসছেন না, সে বলল যে, ভালো হবে। তারপর সব চুপ হয়ে গেল। একমুহূর্ত কান পেতে শুনতে পাওয়া গেল না। আপনি কোথায় জিজ্ঞাসা করতে কোনো উত্তর না পেয়ে সন্দেহ জেগে উঠল তার মনে। একই সঙ্গে পা দিয়ে আঘাত করে নিচের কেবিনে শোওয়া উইলকে জাগাতে চেষ্টা করলাম। তারপর ডেকের কিনারায় ফিরে এলাম। হলদে আলোয় ছড়িয়ে পড়লো বিশালতম নিঃস্তব্ধতা। হঠাৎ ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর অস্ফুট চিৎকার কানে এল, কেউ যেন অন্ধকার সমুদ্রে আচমকা বৈঠা ডুবিয়েছে। যখন আলোর প্রথম ঝলক ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন জলের উপর কিছু ছিল যা এখন নেই। আমি বললাম যে এটা কোন্ ধরনের ঠাট্টা। রাতের অন্ধকারে নৌকার বৈঠা বেয়ে এগিয়ে যাবার অস্পষ্ট শব্দ। শুধু ডেকের পাটাতনের দরজার দিক থেকে কানে এলো উইলের কণ্ঠস্বর যে জর্জ কি হয়েছে, আমি উইলকে ডাকলাম। উইলকে আমি পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম, উইল অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করল এবং বললেন যে নৌকায় কে আছেন। দুবার কথার পর উত্তর এলো।
সে বলল যে, আগে আলোটা সরিয়ে নিন। উইলের নির্দেশে আমি আলোটা সরিয়ে নিলাম। লোকটিকে কাছে আসতে বলল, উত্তরে বৈঠার শব্দ হয়েই চলল। তারপর মোটামুটিভাবে ছ বাঁও দূরে এসে সেই শব্দ আবার থেমে গেলো। উইল বলল যে জাহাজের পাশে আসুন। এখানে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। লোকটি শর্ত দিলেন যে আলো ফেলতে না পারার। আমি তাকে বললাম যে এর কারণ কি? উইল আমার কাঁধে হাত রাখলো, এক মিনিট থেমে চাপাস্বরে উইল বলল,… বলে রেলিং-এর উপর ঝুঁকে পড়লো।
উইল বলল যে, এটা ভারী অদ্ভুত ব্যাপার। আপনি হঠাৎ কোথা থেকে এলেন। আপনার মনের মধ্যে কি আছে সেটা বোঝা যাবে না। আপনি বললেন আপনি একা, সেটা না দেখলে। বিশ্বাসযোগ্য হবে না। আলোটায় আপনার আপত্তি কি?
ওর কথা শেষ হতেই আবার বৈঠার ছপছপ শুনতে পেলাম তারপর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো এখন অনেক দূর থেকে এবং সে স্বর অত্যন্ত করুণ ও চূড়ান্ত হতাশায় ভরা।
সে বলল যে, সে ভীষণ ক্ষুধার্ত এবং সে ভীষণ দুঃখিত তাদের বিরক্ত করার জন্য।
উইল তাকে বললেন যে, তাকে সে তাড়িয়ে দিতে চায়নি। যখন তিনি চাইছেন তা, তাহলে আমরা আলো লুকিয়ে রাখছি।
উইল বলল, ব্যাপারটা অদ্ভুত তবে মনে হয় ভয় পাওয়ার মতো তেমন কিছু নেই। আমি বললাম তা নেই। মনে হয়, এই বেচারা লোকটা বোধহয় জাহাজডুবি হয়ে আশেপাশে কোথায় উঠেছে এবং পাগল হয়ে গেছে।
উইলের কথামতো আলোটা লুকিয়ে রাখলাম। তারপর রেলিং-এ ঝুঁকে পড়ে কান পাতলাম। আলোটা রেখে আমি ফিরে এলাম উইলের পাশে। বারো গজ দূরে এসে বৈঠার শব্দ থামল।
লোকটিকে কাছে আসার জন্য অনুরোধ করা হলো। সে বলল যে, তাদের কাছে যে সে খাবার চাইছে তার দাম দেবার ক্ষমতা তার নেই। উইল বলল, যত খুশি খাবার আপনি নিয়ে যান। সে বলল যে, ভগবান আপনাদের এর পুরস্কার দেবেন। উইল বললেন যে, আপনি যার কথা বললেন তিনি কে? সে বলল যে, সে তার প্রেমিকাকে একা দ্বীপে রেখে এসেছে। সে বলল যে, কোন দ্বীপে তার মনে নেই। উইল বলল যে, তার জন্য একটা নৌকা পাঠানো যায় না। সে বলল যে, তার কর্ম চোখে দেখা যায় না, সে অত্যন্ত দায়ে পড়ে এসেছে। তার কারণ সে চোখে দেখতে পাচ্ছে না।
রেলিং-এর কাছে উইল ফিরে এলো। দুহাতই খাবারে পরিপূর্ণ। সে জাহাজের পাশে লোকটিকে আসতে বলল। তার বলার সুরে এক সনির্বন্ধ আকুতি খুঁজে পেলাম, তখন হঠাৎ বিদ্যুতের মতো খেয়াল হলো বেচারী বৃদ্ধ মানুষটা এই ঘন অন্ধকারে যে জিনিষগুলোর অভাবে কষ্ট পাচ্ছে সেগুলো উইলের হাতে ধরা রয়েছে। আর তা হলেও কোন ভয়ে আমাদের জাহাজের পাশে সেগুলো অদম্য ইচ্ছাকে টুটি টিপে সে সংযত করেছে। সেই ব্যক্তি পাগল নয় বরং সে অসহ্য আতঙ্কের মুখোমুখি হয়েছে।
আমি মনে করলাম উইল আবেগে ভাসছে। উইল বলল যে, একটা বাক্স নিয়ে জলে ভাসিয়ে দিতে যাতে সে লোকটার কাছে পৌঁছে যায়। আমি খানিকপর অস্পষ্ট চিৎকার শুনতে পেলাম এবং বুঝলাম বাক্সটা যথাস্থানে পৌঁছেছে, লোকটি আমাদের শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিল, উইল ও আমার মনে হলো লোকটি আবার ফিরে আসবেন। উইল বলল যে, যতদিন মাছ ধরছি এরকম অদ্ভুত ঘটনা আমার কাছে এই প্রথম। সময় বয়ে চলল। আমাদের চোখে একফোঁটা ঘুমের আমেজ নেই।