এর পরে ঘটনা সংক্ষিপ্ত। সমুদ্রযাত্রায় বাকি পথটা ডাক্তারের কেবিনে পাড়ি দিতে হলো। ডাক্তার ওষুধ দিয়ে সারালেন এরপর জাহজের ১০৫ নং বার্থ সর্বকালের জন্য বুক করা হলো এই বলে যে আমরা দুঃখিত ওটা আগে থেকে ভর্তি হয়ে গেছে। বার্থটা জলে ডুবে আত্মহত্যা করা ওই বিদেহী আত্মার জন্য সুসংরক্ষিত। তবে আমি আর কখনও কামশ্চাকায় উঠিনি।
৩. মৃত মানুষের আঙুল
প্রাতঃরাশ সাজানো হতেই মিসেস হিগিনসনের হাত থেকে ট্রে-টা নিয়ে ক্যরোশার হলঘরে চলে এলো।
মিসেস হিগিনসন তাকে সর ফেলতে নিষেধ করলো। কিন্তু ক্যরোশার হাত চলকে দুধ পড়ে গেল তার লজ্জাবরণীর উপর। কিন্তু তখন তার তা পরিষ্কার করার সময় নেই, তারপর দোতলায় গিয়ে দেখবে মিস্ আমানদা রেগে আছেন।
মিস আমানদার ঘরের সামনে এসে ক্যরোশা দাঁড়িয়ে পড়ল। তার নিজেকে কেমন যেন দুর্বল লাগছে। সে ক্লান্ত বোধ করলেও নিজের সাজপোশাক ঠিক করল টুপিটাকে মাথার পেছনে ঠেলে দিল। পেয়ালাটাকে একটু সরিয়ে দিলো। এখানে আজ ওর প্রথম দিন।
ক্যরোশা এরপর ট্রে তুলে নিয়ে অন্য দরজায় সংকেত দিলো। ওদিক থেকেও সাগ্রহে সাড়া আসল যেন তার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। ক্যরোশার আজ কাজের প্রথম দিন ছিল। সে ঘরের ভেতরে এসে বিছানার পাশে ছোট টেবিলে রাখলো।
মিসেস আমানদা বৃদ্ধা। মোটা, অসম্ভব ফ্যাকাসে। ওই মহিলা গত ৪০ বছরের মধ্যে হাঁটাচলা করা তো দূরের কথা বিছানার থেকে ওঠেননি। মুখটা রক্তশূন্য, পর পর বালিশ রেখে তিনি এমন ভাবে শুয়ে আছেন দেখলে মনে হয় মাথার নিচে কারোটি বলতে কিছু নেই। গলা পর্যন্ত সুতির চাদর দিয়ে ঢাকা। সারা দেহে তুষারের পাহাড়ের মতো খাঁজখোঁজ। সমস্ত অবয়বের মধ্যে কেবল কোটরে ঢোকা কুকুতে চোখ দুটো সজীব।
উনি ক্যরোশাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে সে নতুন কিনা। উত্তর এলো যে হ্যাঁ, সে অত্যন্ত কমবয়সী। মাত্র ১৬ বছর বয়স তার! যখন তাকে তার গিন্নিমা বয়সের কথা বলল সে বেশ অবাকই হলো।
মিস আমানদা তিন-তিনটে ঘড়ি একসাথে বেজে ওঠায় সে খুব ভয় পেল। কিন্তু ক্যরোশা চমকে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল ঘরে থেকে সে পালায়, কিন্তু পা-দুটো ঝিমঝিম করল। তাই সে নড়তে সাহস পর্যন্ত পায়নি। তাছাড়া ব্যাপারটা খুব অশোভন।
মিস আমানদার হাসিমুখ যেন রাগিয়ে দিল তাকে। আমানদা বললেন যে, তাকে দেখতে ভালো নয় তবে বয়সটা কম হলে সবাই পছন্দ করছে, তাকে খুব সুন্দর দেখতে ছিল। কালো চুল, ফুলের মতো মসৃণ গা। তার বিয়ের প্রস্তাব একশোটা এসেছিল। কিন্তু তিনি পঙ্গু হয়ে রয়েছেন। ক্যরোশা কি করবে বুঝতে পারছিল না। কিন্তু বুড়ির জন্য তার কোনো অনুকম্পা জাগছিল না। সেই মুহূর্তে মিসেস হিগিনসনের কাছে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু আমানদার অনুমতি ছাড়া যাওয়া অসম্ভব।
আমানদা জিজ্ঞাসা করলো তার কোনো প্রেমিক বন্ধু আছে কিনা। ক্যরোশা সম্মতি জানাল। মিস আমানদা ক্যরোশার মুখের দিকে তাকাতে সে অস্বস্তি বোধ করল। ওর ডান হাতের কড়ে আঙুলটা আলাদা আর ভীষণ ছোট! ক্যরোশার মনে হলো অস্থিবিহীন একটা সোহাগী সাপ তার হাতকে পেঁচিয়ে উঠছে।
ক্যরোশাকে বললেন যে, তুমি যা ভাবো, আর পাঁচজন বুড়ির মতো সে ততটা খারাপ নয়। খাওয়া পরা ছাড়া মানুষের জীবনে আরও অনেক কিছু আছে, যার কথা আমি ভাবি। ক্যরোশা শুধু যুবতী হয়ে ভাবছে–এতটা স্বার্থপর যেন সে না হয়।
ক্যরোশা তার কথায় চমকে উঠল। তার প্রেমিকের নাম ডোনাল্ড, সে বলল। ডোনাল্ড লম্বা, ভালো স্বাস্থ্য। ক্যরোশার কাছ থেকে মিস আমানদা জিজ্ঞাসা করলেন কেমন করে তার প্রেমিক তাকে ভালোবাসে।
এইসব করোশারের মোটেই ভালো লাগছিল না। সে পালিয়ে যেতে চাইছিল, ছায়া ঘর, রোগশয্যা ঘড়ি ও ডান হাতের বাঁকা আঙুল সব কিছুই তাকে ক্লান্ত করে তুলল।
হঠাৎ মনে হলো মিস আমানদার উৎসাহ যেন এক ছুঁয়ে নিভিয়ে দিয়েছে। ক্যরোশার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ক্যরোশাকে নিচে যেতে বলা হলো।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ক্যরোশা চোখের জল আটকে রাখলো। ডোনাল্ডকে তার ডাকতে ইচ্ছে করল। যাকে সে ভালোবাসে। রান্নাঘরে ঢুকে ক্যরোশা দ্রুত হিগিনসনকে পাশ কাটিয়ে গেলো। সে চৌবাচ্চায় গিয়ে জল দিয়ে মুখ ধুতে লাগল,তার খেতে ইচ্ছে করছিল না।
হিগিনসন বুঝতে পারল বুড়ি তাকে কিছু বলেছে। সে বলল যে বুড়ির কাছে কাজ করা খুব মুশকিল। এটা খুব অদ্ভুত। এখানে প্রতিটা পদক্ষেপ মেপে চলতে হয়, কেউ এখানে বেশিদিন থাকে না। বিশেষত কমবয়সী মেয়েরা। তারা কিছুদিন পর নকল করতে থাকে ম্যাডামকে। একবার একটি মেয়ে মিস আমানদার গলার স্বর নকল করত। হঠাৎ দুদিন যেতে না যেতে সে আত্মহত্যা করে গলায় দড়ি দিয়ে। কোথাও কোনো কারণ নেই। অন্য লোক তো দূরের কথা, পুলিশ কিছু বুঝতে পারল না, ক্যরোশার দুচোখ ভরে জল আসছিল। মিসেস হিগিনসন তাকে বুড়ির কথায় কান না দিতে বললেন।
যতটা সময় গেল ক্যরোশার মাথার যন্ত্রণা বাড়তে লাগল। সে অন্যমনস্ক হলো। সে বাসনকোসন ধুলো, কুটনো কুটল তারপর তার কাজ সারল। দু-একটা মামুলি কথা ছাড়া মিস আমানদা মুখ খোলেননি। ও যেন একটা চিন্তার মধ্যে ছিল। তার শুধু মনে হচ্ছিল যে আটটায় ডোনাল্ড তার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে।