- বইয়ের নামঃ মার্ডার ইজ ইজি
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- প্রকাশনাঃ সমতট
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, গোয়েন্দা কাহিনী
মার্ডার ইজ ইজি
১. সহযাত্রিণী
মার্ডার ইজ ইজি (উপন্যাস) – আগাথা ক্রিস্টি
সহযাত্রিণী
ইংল্যান্ড! আবার সেই কতদিন পর ইংল্যাণ্ডের মাটিতে! কেমন লাগবে কে জানে?
জাহাজঘাটে যেতে যেতে লিউক ফিৎস উইলিয়াম নিজেকেই নিজে প্রশ্নটা করলো। একনাগাড়ে বেশি কিছুদিন জলের দেশে বাস করার পর ডাঙ্গায় নেমে জাহাজী ট্রেনে উঠতেই এই চিন্তাগুলোই তাকে বিভোর করে ফেলল।
ইংল্যান্ডে ছুটিতে আসার ব্যাপারটা আলাদা; খুশিমত খরচ করার টাকা (অন্ততঃ প্রথম দিকটায়), পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারা, ঠাট্টা-মস্করা করে সময় কাটানো–যেন খেয়াল-খুশির আনন্দমেলা। ভাবটা যেন–আর কটা দিনই বা আছি, এই তো ফিরে যাওয়ার সময় প্রায় হয়ে এলো, তারই মধ্যে যতটা করে নেওয়া যায়।
কিন্তু এবার ফিরে যাবার আর প্রশ্ন নেই। সেই ভ্যাপসা গরম রাতের ছটফটানি, নির্জন সন্ধ্যায় একাকীত্ব, পুরোনো টাইমস্ বার বার পড়া–এর কোনোটাই আর লিউকের কাছে ফিরে আসবে না। দেশের মানুষ এবার দেশে ফিরে এসেছে। হাতে অখণ্ড অবসর। নিজেকে নিয়ে এবার ও কী করবে এটাই সমস্যা।
ওর কাছে ইংল্যাণ্ডের এই জুন মাসের আবছা নীল আকাশ আর ধারালো হাওয়ায় বিছুটি দুটোই সমান বিরক্তিকর। এর ওপর মানুষ! আর দেখছে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা
নিজের কামরায় চোখ ফিরিয়ে সদ্য কেনা টাইমস, দৈনিক ক্ল্যারিয়ন আর পানচ সবগুলো কাগজ নিয়ে গুছিয়ে বসলো সে। প্রথমেই মন দিলো দৈনিক ক্ল্যারিয়নের ডারবী রেসের পাতায়; আফশোষ হল যদি গতকাল এসে পৌঁছোতে পারতো। যখন ওর উনিশ বছর বয়স, তখন ডারবী দেখেছিল শেষবারের মতো।
ক্লাব সুইপের একটি ঘোড়ার ওপর বাজি ধরেছে লিউক। ক্ল্যারিয়নের ঘোড়দৌড় বিশারদ সেই ঘোড়াটির সম্পর্কে অল্পস্বল্প মন্তব্য করে তার বক্তব্য শেষ করেছিল–এই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় জুজুরে সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। বরঞ্চ বাইরের একটি ঘোড়ার কিন্তু লিউকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবে না বাইরের সেই সম্ভাবনাময় ঘোড়াটি। দ্বিতীয় জুজুবের ওপর ও বাজির সংখ্যা গুণে দেখলো ৪০ঃ১।
সময় দেখলো ঘড়িতে পৌনে চারটে। খেলা শেষ হলো এতক্ষণে : এঃ যদি বাজি ধরতাম ক্ল্যারিগোল্ডের ওপর! দ্বিতীয় সম্ভাবনা হলো ক্ল্যারিগোল্ড।
লিউক এবারে টাইমস খুলে গুরুত্বপূর্ণ খবর দেখতে লাগল। এমন সময় বিশ্রী দেখতে এক কর্নেল আধঘণ্টা বক বক করে তারপর ঘুমিয়ে পড়ল। ভদ্রলোক ঘুমোতেই লিউক বাইরের দিকে তাকাল। সামনেই একটা প্ল্যাটফর্ম। তার একটু দূরে একটা প্ল্যাকার্ডের দিকে ওর নজর
পড়লো। তাতে লেখা আছে :
ডারবীর ফলাফল
দ্বিতীয় জুজুব–প্রথম
মাজেপ্পা-দ্বিতীয়
ক্ল্যারিগোল্ড–তৃতীয়
লিউকের মুখ প্রসন্ন হাসিতে ভরে উঠলো। ইচ্ছেমতো খরচ করার জন্য ১০০ পাউণ্ড। অথচ কত অবজ্ঞা করেছে এই জুজুবকেই ঘোড়দৌড় বিশেষজ্ঞরা। ও কাগজটা ভাজ করে পেছন ফিরতেই একই বোকা বনে গেল। ট্রেন নেই, প্ল্যাটফর্ম শূন্য। আনন্দের উত্তেজনার মাঝে কখন ট্রেনটা এক ফাঁকে চলে গেছে। একজন কুলিকে জিজ্ঞেস করলো–এই হতচ্ছাড়া ট্রেনটা কখন ছেড়ে গেল?
উত্তরে কুলি বললো–কোনো ট্রেন? ৩-১৪ মিনিটের পর আর কোনো ট্রেন তো এখানে থামেনি।
এক্ষুনি এখানে একটা ট্রেন থেমেছিল–বোট এক্সপ্রেস। আমি ওটা থেকে নেমেছি।
কুলিটি বললো-বোট এক্সপ্রেস লণ্ডনের আগে কোথাও থামে না।
কিন্তু থেমেছিল–জোর দিয়ে বলে লিউক–আমি এখানে নামলাম।
একই উত্তর দিলো কুলিটিলণ্ডনের আগে কোথাও থামে না।
আমি বলছি থেমেছিল।
কুলিটি এবার বললো–আপনার এখানে নামা উচিত হয়নি। ও ট্রেনের এখানে থামার কথা নয়।
তোমার মত অত সূক্ষ্ম বুদ্ধি আমার নেই। সে যাই হোক, কথা হচ্ছে এখন কী করি?
তখনও কুলিটি একই ভাবে বললো–আপনার এখানে নামাই উচিত হয়নি।
সে তো মানলাম। মহাজনেরা বলেছেন, যতই কাঁদ না কেন, মৃত অতীত আর ফিরে আসবে না–এ তো জানা কথা। তুমি আমায় কী করতে বলছো?
৪-২৫ মিনিটে একটা আছে, ওটাই আপনার পক্ষে ভালো হবে।
তা হলে ওতেই আমি লণ্ডন যাবো।
লিউক কতকটা নিশ্চিন্ত হয়ে পায়চারি করতে লাগলো। একটা বড় বোর্ডে স্টেশনের নামটা লেখা-ফেনি ক্লেটন-উইচউড আণ্ডার অ্যাশ-এ যাবার জন্য এখানে ট্রেন বদল করুন। কিছুক্ষণ পরেই দুকামরার একটা ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালো। ট্রেন থেকে দুসাতজন লোক নেমে ওভার ব্রিজ দিয়ে প্ল্যাটফর্মে এলো।
শেষ পর্যন্ত লণ্ডনগামী ট্রেনখানি স্টেশনে এসে দাঁড়ালো। তৃতীয় শ্রেণীর কামরাগুলোতে অত্যন্ত ভীড়। প্রথম শ্রেণীর জন্য মাত্র তিনখানি কামরা। প্রথম কামরাটি ধূমপায়ীদের জন্য সংরক্ষিত। সেই কামরাটি পেরিয়ে লিউক দ্বিতীয় কামরার সামনে এসে দাঁড়ালো। সেই কামরায় বেশ কেতাদুরস্ত এক তরুণী বসে, দেখে মনে হলো যেন খুব ক্লান্ত। হয়তো মেয়েটি কোনো নার্সারীর গভর্নেস; কারণ, সঙ্গে তিনটি অল্প বয়সের চঞ্চল ছেলে। পরের কামরায় একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলাকে দেখেই লিউকের নিজের মিলড্রেড পিসিকে মনে পড়লো। মিলড্রেড পিসি দুনিয়ার অন্যান্য সব পিসিদের মতোই খুব ভালো ছিলেন। সেই কামরায় উঠে লিউক একটা জায়গা দেখে বসলো।
পাঁচ সাত মিনিট বাদেই ট্রেনটা আস্তে আস্তে ছেড়ে দিলো। লিউক খবরের কাগজ খুলে আকর্ষণীয় সংবাদগুলোতে আবার চোখ বুলোতে আরম্ভ করলো।
কিন্তু লিউক ধরেই নিয়েছে যে, ও বেশিক্ষণ কাগজে মন দিয়ে থাকতে পারবে না। কারণ; ও এই পিসির জাতকে চেনে। ওর অনুমান যে কতখানি সত্যি, কিছুক্ষণের মধ্যেই তা প্রমাণিত হলো। ভদ্রমহিলা সামান্য একটা ছুতো ধরে একেবারে সরাসরি এই ট্রেনের প্রসঙ্গ আরম্ভ করলেন
মাত্র একঘণ্টা দশ মিনিটে আমরা লণ্ডনে পৌঁছে যাবো। কিন্তু তা সত্ত্বেও সকালের ট্রেনে ভীড় বেশি, কারণ এই ট্রেনে দিনের বেলাকার সস্তা টিকিট পাওয়া যায়। আমিও ভেবেছিলাম ঐ গাড়ীতেই যাবো, কিন্তু ওয়াঙ্কিপু–মানে আমার বেড়াল-আজ সকালে ওকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না, আর এই জন্যই তো সকালের ট্রেনে যেতে পারলাম না।
কোনোরকমে লিউক আস্তে আস্তে তা সত্যি বলেই আবার কাগজের ওপর ঝুঁকে পড়লো। কিন্তু তাতেও তার কথার প্রশমন হলো না।
আর এইজন্যই তো আমি সকাল বেলায় না গিয়ে বিকেলের গাড়িতেই যাওয়া ঠিক করলাম। যদিও প্রথম শ্রেণীতে কখনোই বেশি ভীড় হয় না। তা সত্ত্বেও আমি প্রথম শ্রেণীতে সাধারণতঃ যাতায়াত করি না। বুঝতেই তো পারছেন এত রকম করের বোঝা, বাড়িতে লোকজন দিয়ে কাজ করাতে গেলে তিনগুণ বেশি খরচা, অথচ আয়ের পরিমাণ কমে গেছে। যে ব্যাপারটার জন্য এখন আমি যাচ্ছি, সেটা খুবই একটা মারাত্মক ব্যাপার। তাই নিরিবিলিতে বসে একটু ভেবে নিতে চেয়েছিলাম যে পুরো ঘটনাটা বলতে গিয়ে ঠিক কীভাবে বক্তব্য রাখবো
এবার আর না হেসে লিউক পারলো না।
কিন্তু বুঝতে তো পারছেন প্রতিবেশীদের বিপদে-আপদে যদি খানিকটা অতিরিক্ত খরচপত্র হয়েও যায় তা কিছু অন্যায় নয়। তবে আজকাল নোকজন বড় বেশি বাজে খরচ করে।
লিউকের মুখের দিকে চেয়ে ভদ্রমহিলা সঙ্গে সঙ্গে বললেন–যদিও আমি স্বীকার করি যে সামরিক বাহিনীর অফিসারদের প্রথম শ্রেণীতেই যাওয়া উচিত।
লিউক দেখলো একরাশ কৌতূহল নিয়ে ভদ্রমহিলা লিউকের দিকে তাকিয়ে আছেন। উনি কী জানতে চান ও বুঝতে পারলো। ও বললো–আমি কিন্তু সৈনিক নই।
ওহো, আমি বুঝতেই পারিনি–মানে আপনার রংটা বেশ তামাটে কি না, তাই ভাবলাম আপনি হয়তো পূর্বদেশ থেকে সদ্য ছুটিতে এসেছেন।
ওদেশ থেকে এসেছি ঠিকই, লিউক বলে–তবে ছুটিতে নয়, একেবারে দেশে ফিরে এলাম। আমি ওখানে পুলিশে চাকরি করতাম।
কী আশ্চর্য। আপনি পুলিশের লোক? আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর ছেলে প্যালেস্টাইনে পুলিশবিভাগে মাত্র কদিন আগে যোগ দিয়েছে।
আমি ছিলাম মেয়াংস্ট্রেট-এ-লিউক বলল।
আমাদের একই কামরায় একসঙ্গে যাওয়াটা সত্যিই একটা অদ্ভুত যোগাযোগ।
শুধু লিউক বললো–সত্যিই? কিন্তু মনে মনে বললো-লণ্ডন পর্যন্ত পুরো রাস্তাটাই ভদ্রমহিলা ঘড়ির কাঁটার মতো অবিরাম চালিয়ে যাবেন না কি?–ওর মিলড্রেড পিসিও এমনটাই ছিলেন। পিসি ওর ছেলেবেলায় ওর দারুণ প্রয়োজনের সময় ওকে একবার একটা গোটা পাঁচ পাউণ্ডের নোট দিয়েছিলেন। ইংল্যাণ্ডের বাইরে বিদেশে থাকলে এই পিসিদের অভাব যতটা বোঝা যায়, দেশে থাকলে তেমনি এই পিসিদের মাধুর্য ততটা উপলব্ধি করা যায় না।
যাই হোক, তখনও ভদ্রমহিলা স্মিতমুখে তার কথা বলে চলেছেন–
যা বলছিলাম, মানে আমি আজ সকালেই যাব বলে ঠিক করেছিলাম, কিন্তু আপনাকে তো আগেই বলেছি যে আমি ওয়াঙ্কিপুর জন্য খুবই চিন্তায় ছিলাম। আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় আমি যখন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে পৌঁছব, তখন ওঁদের ছুটি হয়ে যাবে? অর্থাৎ ওঁদের কি কোনো বিশেষ সময় নির্দেশ আছে?
জবাবে লিউক বললো–আমার মনে হয় না ওঁরা কোনো বাঁধা ধরা সময় মেনে চলেন।
সে তো নয়ই। মনে করুন, খুন-জখম, চুরি-বাটপাড়ি ইত্যাদি অপরাধগুলো তো আর সময় মেপে হয় না?
লিউক বললো–সেই তো! ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণের জন্য চুপ রইলেন। খানিকবাদে আবার বলতে আরম্ভ করলেন।
আমার সব সময় মনে হয় যে একেবারে উৎস মুখে গিয়ে সন্ধান করা ভালো। জন রীড এমনিতে খুব ভালো লোক, কিন্তু কি জানেন, আমার ধারণা কোনো জটিল অপরাধের কিনারা করার ক্ষমতা ওর নেই। ধারণাই বা বলছি কেন, আমার স্থির বিশ্বাস খুনের কিনারা করার ক্ষমতা ওর নেই।
খুন?–লিউক প্রশ্ন করলো।
উত্তরে ভদ্রমহিলা বললো–হ্যাঁ, খুন। আমি বুঝতে পারছি আপনি আশ্চর্য হচ্ছেন। আমিও প্রথমটায় হয়েছিলাম; এমন কি বিশ্বাস পর্যন্ত করতে পারিনি। ভেবেছিলাম সবই আমার কল্পনা।
লিউক জিজ্ঞেস করে–আপনি ঠিক জানেন তো যে, এ আপনার কল্পনা নয়?
ভদ্রমহিলা জোর দিয়ে বললেন– কক্ষনো না। একটা হলে হয়তো তাই ভাবতাম, কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ–এতগুলো দেখবার পর আমি নিশ্চিত।
লিউক প্রশ্ন করলো-আপনি কি বলতে চান এতগুলো খুন সত্যিই হয়েছে?
বেশ কয়েকটা; আর সেই জন্যই তো ভাবলাম যে সোজা স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে গিয়ে তাঁদের কাছে সব খুলে বলি।
মনে মনে লিউক ভাবলো যে, ইয়ার্ডের লোকজন ঠিক জানে কেমন আচরণ করতে হবে এই ভদ্রমহিলার সঙ্গে। এই বুড়ীদের ঘটনাপঞ্জী শোনবার জন্য হয়তো বা ইয়ার্ডে একটা আলাদা বিভাগই আছে।
লিউক ভাবছিলো, আশ্চর্য! কেন যে এঁদের এমন সব আজ খেয়াল হয়। হয়তো নীরস গ্রাম্য জীবনের একঘেয়েমী–একটা কিছু নাটকীয় করার ইচ্ছা। শোনা যায়, কোনো কোনো বৃদ্ধা এমনও ভাবেন যে, এ বিশ্ব-সংসারে সবাই মিলে তাদের খাবারে বিষ মেশাচ্ছে। লিউকের তগতভাবে বাধা পড়লো ভদ্রমহিলার গলার শান্ত স্বরে–
জানেন, আমি একবার একটা বইতে পড়েছিলাম–আবার ক্রোম্বি কেস–অবশ্য সেই লোকটাকে সন্দেহ করার আগেই সে বেশ কয়েকজনকে বিষ খাইয়েছিলো। যাকগে, ও হ্যাঁ, কে একজন বলেছিল যে সেই লোকটা যার দিকেই চাইতো–মানে বিশেষভাবে চাইতো, অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সে অসুস্থ হয়ে পড়তো। আমি গল্পটি পড়ে বিশ্বাস করিনি–কিন্তু এখন দেখছি এমন ঘটনা বাস্তবেও সম্ভব।
কী?
চোখের বিশেষ দৃষ্টি।
ভদ্রমহিলার দিকে লিউক তাকালো। মনে হল, কে যেন ওঁর মুখের গোলাপী রঙের অনেকটা শুষে নিয়েছে।
মহিলা জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন।
এই যাঃ, আমরা যে এসে গেলাম। বলেই অস্থির হয়ে উঠলেন। ছাতাটা তুলে নিতে গিয়ে দুএকবার হাত থেকে পড়ে গেলে লিউক ছাতাটা তুলে হাতে দিলো।
আপনাকে ধন্যবাদ; আপনি বড় ভালো লোক। আমার কৃতজ্ঞতা রইল।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ইয়ার্ডের লোকেরা আপনাকে সঠিক পথ দেখাবে।আবার আন্তরিকতার সুর লিউকের গলায়।
আমার নাম পিঙ্কারটন।
লিউক মৃদু হেসে বলল, খুব উপযুক্ত নাম। সঙ্গে সঙ্গে লিউক বলল–আমার নাম লিউক ফিস্ উইলিয়াম্।
ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াতেই লিউক বললো–আপনাকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দেবো?
না, না, অনেক ধন্যবাদ।
আচ্ছা, ঠিক আছে। তাহলে চলি?
অন্তরঙ্গভাবে ভদ্রমহিলা লিউকের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন–জানেন, আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আমার কথা বিশ্বাসই করবেন না।
লিউক এবার লজ্জা পায়–এতগুলো খুন করা তো আর সোজা কথা নয়! খুবই কঠিন।
উনি বললেন-যদি সবার সন্দেহের বাইরে থাকা যায়, তবে খুন করা খুবই সহজ। যে খুনীর কথা বললাম, সে এমনই একজন যাকে কেউ সন্দেহই করবে না।
তা হতে পারে। নমস্কার।–বিদায় জানায় লিউক।
ভীড়ের মধ্যে মিস পিঙ্কারটন হারিয়ে গেলেন। লিউক নিজের মনে ভাবলো–একটু কি ছিটগ্রস্তা? কিন্তু তাও তো মনে হল না। কিন্তু সে যাই হোক, মহিলার স্বভাবটি বড় সুন্দর।
***
শোক-সংবাদ
লিউকের সবচেয়ে পুরনো বন্ধু জিমি লরিমার। লণ্ডনে এলেই ও জিমির কাছেই থাকে। এবারও ও জিমির বাড়িতেই উঠেছে। পরদিন সকাল বেলায় এককাপ কফি নিয়ে খবরের কাগজটার মধ্যে ডুবে গেল। ওর কানেই যাচ্ছিল না জিমির কথা। হঠাৎ কিছুক্ষণ পরে যেন সচেতন হলো।
দুঃখিত জিমি–বল, কী বলছিলে?
কী পড়ছিলে অত মন দিয়ে?
লিউক বললো–গতকাল এক বৃদ্ধা একই ট্রেনে আমার সঙ্গে এসেছিলেন–উনি গাড়ি চাপা পড়েছেন।
ভারী বিশ্রী ব্যাপার।–জিমি বললো।
হা, বেশ ভালো মহিলা। ওঁকে দেখেই আমার মিলড্রেড পিসির কথা মনে হয়েছিলো।
যে গাড়ি চালাচ্ছিল, সে এর জন্য দায়ী। তাকে হয়তো খুনের দায়ে ফেলা যাবে না। আমি তো লণ্ডনে গাড়ি চালাতে গেলে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকি।
তোমার এখন কী গাড়ি?
ফোর্ড, ভি, ৮। তোমায় আমি বলছি
জিমি আলোচনায় বাধা দিয়ে বলে ওঠে–তুমি তখন থেকে গুগুন্ করে কী বলছো বলতো?
লিউক নিজের মনে আবৃত্তি করছিলো–
Fiddle de dee, fiddle de dee.
The fly has married the humble bee.
জিমি জিজ্ঞেস করলো ওর দিকে তাকিয়ে–কী হয়েছে?
লিউক মাথা তুলে কেমন যেন এক অদ্ভূতদৃষ্টিতে বন্ধুর দিকে তাকাতে জিমি একটু ঘাবড়ে গেল।কী হলো লিউক? তোমায় দেখে মনে হচ্ছে যেন ভূত দেখছো?
লিউক বললো–জিমি, শোন জিমি, তোমার কি মনে পড়ে আমার ইংল্যাণ্ডে আসার দিন একজন বৃদ্ধা মহিলার কথা তোমায় বলেছিলাম, যিনি আমার সঙ্গে একই ট্রেনে এসেছিলেন?
সেই যিনি চাপা পড়ে মারা গেলেন?
হ্যাঁ, সেই। শোন জিমি, এই ভদ্রমহিলা পরপর অনেকগুলো খুনের এক অদ্ভুত গল্প বলার জন্য স্টকল্যাণ্ড ইয়ার্ডে যাচ্ছিলেন।
তুমি তো বলোনি আমায় যে ভদ্রমহিলার মাথায় একটু ছিট ছিলো।–জিমি বললো।
আমার মনে হয়নি যে, উনি সে ধরনের ছিলেন।
ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে–বলল, বলে যাও।
বুঝলে, ভদ্রমহিলা পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে ঘটনার সত্যাসত্য স্থির করেছিলেন। যারা খুন হয়েছে তাদের দুএকজনের নামও বলেছিলেন।
জিমি এবার উৎসাহিত হয়ে বলে–আচ্ছা?
লিউক বলে যায়–এই আম্বলবি নামটা আমার মনে ছিলো, কারণ ছেলেবেলায় পড়া বাচ্চাদের এই ছড়াটা আমার মনে ছিলো–
Fiddle de dee, fiddle de dee.
The fly has married the humble bee.
তুমি নিঃসন্দেহে মেধাবী–কিন্তু কী বলতে চাইছো?
আমায় সেই মহিলাটি বলেছিলেন যে, ডাঃ আম্বলবিই হচ্ছেন পরবর্তী শিকার। ভদ্রলোক নাকি খুবই সজ্জন এবং এই জন্যই সেই বৃদ্ধা আরও চিন্তিত ছিলেন।
তারপর?
এই দেখ কাগজটা।–লিউক খবরের কাগজটা দিতেই ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করে–আম্বলবি : ১৩ইজুন, নিজগৃহ, সানগেট, উইচউড আণ্ডার অ্যাশ, আকস্মিক মৃত্যু। জন এডওয়ার্ড আম্বলবি, এম. ডি., জেসমী রোজ আম্বলবির স্বামী। আগামী শুক্রবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া।
–দেখছ জিমি? এ থেকে তুমি কি বুঝলে?
অদ্ভুত কাণ্ড! কিন্তু আমার মনে হয় এটা একই সময়ে দুটো ঘটনা ঘটার এক আশ্চর্য নমুনা মাত্র।
এই ঘটনাটা কি শুধুই তাই?–লিউক আবার পায়চারি আরম্ভ করে।
লিউক হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ায়। ধর সেই বিচিত্র ভদ্রমহিলার সব কথা যদি সত্যি হয়?
এ তুমি বাড়াবাড়ি করছে। এ তো পুলিসওয়ালার মতো কথা।
হয়তো ঠিকই বলেছো। একবারে যে পুলিশ হয়, সে চিরকালই পুলিশ থেকে যায়। আবার ক্রোম্বি যেভাবে দিনের পর দিন সবার নাকের ডগা দিয়ে একটার পর একটা খুন করে যাচ্ছিলো, সেই ঘটনা যদি একবার অজ্ঞাত কুলশীলা বৃদ্ধা মহিলা টের পেয়ে প্রতিকারের জন্য কাউকে বলেন, তাহলে তার কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে?
হেসে জিমি বলে–তা কেউ করবে না।
তবে? ভেবে দেখ, যাকেই তিনি বলবেন, সেই বলবে ওঁর মাথা খারাপ। কিন্তু আমি বলছি জিমি, এ ব্যাপারটাকে এভাবে দেখলে ভুল হবে। সত্যকে হাত চাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা অন্যায়।
জিমি বললো–তাহলে ব্যাপারটা তোমার মতে কী দাঁড়াচ্ছে?
ডাঃ আম্বলবির মৃত্যুর গল্পটা একেবারে আজব নয়। আরও ইঙ্গিতপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে, মিস পিঙ্কারটন এই অবাস্তব ঘটনা বলতে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে যাচ্ছিলেন প্রতিকারের আশায়। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি। আগেই তিনি গাড়ির চাকায় প্রাণ দিলেন এবং গাড়িটা চাপা দিয়ে পালিয়ে গেল।
প্রতিবাদ করে জিমি বললো–কিন্তু তুমি তো জান না যে উনি ইয়ার্ডে পৌঁছতে পেরেছিলেন কিনা?
তা হয়তো হতে পারে, কিন্তু আমার ধারণা মহিলা ইয়ার্ডে যেতে পারেননি।
এ তোমার নিছক অনুমান। মাথা ঝাঁকিয়ে লিউক বললো-না, আমার মোট বক্তব্য–ব্যাপারটার একটা অনুসন্ধান হওয়া উচিত।
তাহলে তুমি কী বলতে চাইছো?
আমার মতে ঘটনাস্থলে গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করাই হবে সবচেয়ে ভালো।
লিউকের দিকে তাকিয়ে জিমি বলে–আচ্ছা লিউক, তুমি কি সত্যিই এ ব্যাপারে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছ?
পুরোপুরি।
কিন্তু যদি এমন হয় যে সমস্ত ব্যাপারটাই এক অলীক কল্পনাবিলাস?
তার চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে?
গম্ভীর হয়ে জিমি বললো–কোনো পথে এগোবে কিছু ঠিক করেছো? সে জায়গায় যেতে হলে তোমায় একটা কারণ দেখাতে হবে?
তা হয়তো হবে।
কোনো হয়তো এখানে খাটবে না। নতুন কেউ গ্রামে এলে ওরা অনেকদূর থেকেই টের পেয়ে যায়।
লিউক জবাব দেয়–ছদ্মবেশই নিতে হবে। বলতো, কোনো বেশ নেওয়া যায়? চিত্রকর?
তখনও লিউক কিন্তু তার সমস্যা নিয়ে চিন্তা করে যাচ্ছিলো।
আচ্ছা, যদি একজন লেখক সাজি, বা জেলে সেজে যাই? এ-ও যদি না হয় অন্ততঃ অন্ধ বা খোঁড়া সেজে যেতে পারি? আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল। কিন্তু জিমি, কোনো না কোনো উপায় নিশ্চয় আছে যার সাহায্যে একজন অচেনা-অজানা লোক কিছুদিনের জন্য গ্রামে গিয়ে থাকতে পারে।
এক মিনিট দাঁড়াও–কাগজটার ওপর খানিকক্ষণ চোখ বুলিয়ে বলে উঠল-হা, আমি ঠিকই ভেবেছিলাম। শোনো লিউক, সব সমস্যার সুরাহা। আমি তোমার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
কী ব্যাপার?
জিমি বললো-প্রথম থেকেই ভাবছিলাম নামটা চেনা–উইচউড-আণ্ডার অ্যাশ-হ্যাঁ, এই জায়গাটাই তো! ওখানে আমার এক আত্মীয় থাকে।
সত্যিই জিমি, তুমি একটি আসল রতন।
বেশ ভালো হল, না?
যাই হোক, তোমার সেই আত্মীয়ের পরিচয়টা দাও।
ওর নাম ব্রিজেট কনওয়ে। বছর দুয়েক হল ও ওখানে লর্ড হুইটফিল্ডের সেক্রেটারীর কাজ করছে।
সেই লোকটা–যার কতকগুলো বাজে সাপ্তাহিক কাগজ আছে?
ঠিকই ধরেছে।
আর তোমার সেই বোন ওর সেক্রেটারী?
আগে ছিল। এখন ওর স্থান আরও উঁচুতেও হুইটফিল্ডের বাগদত্তা।
লিউক বললো-ও।
জিমি বললো-তুমি ওখানে গিয়ে সম্পর্কে ব্রিজেটের এক ভাই হয়ে থাকবে। আমি ওকে বলে সব ব্যবস্থা করে দেবো। কিন্তু তুমি যে কারণে ওখানে যাবে, সেটা হচ্ছে ডাইনীবিদ্যা, বুঝেছো?
ডাইনীবিদ্যা? সে আবার কী?
অর্থাৎ, স্থানীয় ছড়া, কুসংস্কার–এই সব আর কি। উইচউড এই সব ব্যাপারে বেশ বিখ্যাত। ও এমন একটা জায়গা, যেখানে গত শতাব্দী পর্যন্ত ডাইনীদের ধরে পুড়িয়ে মারা হত। তুমি ওখানে যাচ্ছ এই সব ধারাবাহিকতা নিয়ে একটা বই লিখতে। সুতরাং, তোমায় কেউ সন্দেহ পর্যন্ত করবে না।
কিন্তু লর্ড হুইটফিল্ড?
ও কোনো অসুবিধা করবে না। তাছাড়া, ব্রিজেট ওকে মানিয়ে নেবে। আমি ওর হয়ে তোমায় কথা দিতে পারি।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে লিউক বললো–জিমি, তুমি একজন সত্যিকারের করিৎকর্মা লোক। তুমি যদি তোমার সেই বোনের সঙ্গে আমার ব্যবস্থা করে দিতে পারো
সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে–তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও।
আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম।
জিমি বললো–প্রতিদানে শুধু একটা জিনিসই আমি চাই–তোমার সিদ্ধি যদি হয় হন্তার সার্থক সন্ধানে, আমার সাফল্য আসুক মৃত্যুকে খুঁজে বের করার মধ্যে প্রতিদানে এই হলো আমার যাচা।
লিউক বললো–সেই বৃদ্ধা মহিলাকে আমি বলেছিলাম যে সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে এতগুলো খুন করা খুবই কঠিন। উনি বলেছিলেন যে, আমার ধারণা ভুল-খুন করা খুবই সহজ।
আচ্ছা, খুন করা কী অতি সহজ?
***
ঝাঁটা-বিহীন ডাইনী
একটা পুরানো স্ট্যাণ্ডার্ড সোয়ালো গাড়ি চালিয়ে লিউক উইচউড–আণ্ডার অ্যাশে এসে পৌঁছলো। গ্রামে ঢুকতেই পাহাড়ি রাস্তাটার একটা ঢালু জায়গায় কিছুক্ষণের জন্য গাড়িটা থামালো।
লিউক দেখলো সামনে উইচউড গ্রাম সমাহিত আর স্থির হয়ে আছে। গ্রামটিকে আধুনিক যন্ত্র যুগের কলুষতা স্পর্শ করতে পারেনি। লিউকের মনে হচ্ছিলো, ও যেন পৃথিবীর এক সুদূর নির্মল প্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছে।
চিন্তায় পড়লো লিউক। ভাবলোনাঃ, এমন ঘটনা এখানে ঘটতে পারে না-না কি ঘটতেও পারে?
গাড়িতে চাবি দিয়ে সেই আঁকা-বাঁকা পথ ধরে বড় রাস্তায় এসে পড়ল। রাস্তার দুধারে দোকান-পসার, পুরানো বনেদী ঘর-বাড়ি। রাস্তা থেকে একটু এগিয়ে বে-মোটুলি নামে একটা হোটেল পড়ে। তাছাড়া আছে সবুজ মাঠ এবং পুকুর। আর আছে যাদুঘর এবং পাঠাগার। আরও কিছুটা এগিয়ে যেতে সামনে সাদা রঙের বেশ বড় একটা আধুনিক বাড়ি পেলো। ওটা স্থানীয় যুবকদের একটা ক্লাব।
সেখান থেকে জানতে পারলো যে, আরও আধমাইল গেলে অ্যাশম্যানব পাওয়া যাবে। গাড়িটা নিয়ে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ লিউকের চোখে পড়লো, এক দুর্গের ভেতর থেকে একটি তরুণী বেরিয়ে এলো। মেয়েটির মাথায় গুচ্ছ-গুচ্ছ কালো চুলের ঢেউ। মেয়েটিকে দেখে ডাইনী ছবিটা মনে পড়লো।
তন্বীতরুণী মেয়েটি সোজা ওর দিকে এগিয়ে ওকে বললো–আপনিই লিউক ফিৎস উইলিয়াম? আমি ব্রিজেট কনওয়ে।
ওর সঙ্গে লিউক করমর্দন করলো। লিউক মেয়েটিকে যে ডাইনী ভেবেছিলো মেয়েটি মোটেই তা নয়।
আপনার ওপর এভাবে চড়াও হবার জন্য খুবই লজ্জিত কিন্তু জিমি বললো যে, আপনি কিছু মনে করবেন না।
না, না, বরং আপনি এসেছেন বলে খুশীই হয়েছি। ব্রিজেট জবাব দিলো। আরও বললো–জিমির আর আমার কখনও মতের অমিল হয় না। তাছাড়া দেখবার মতো সুন্দর জায়গাও এখানে আছে।
অপূর্ব।
বাড়ির দিকে ওরা দুজনে এগোয়। ওর মনে পড়ে, জিমি বলেছিলো যে, বাড়িটা প্রথমে ব্রিজেটের পূর্বপুরুষদের ছিলো।
লিউক, আন্দাজ করলো ২৮/২৯ বয়স ব্রিজেটের হবে।
বাড়ির ভেতরে ওরা ঢুকলো। দুজন লোক ঘরে বসে কথা বলছিলো। ব্রিজেট আলাপ করিয়ে দিয়ে বললো–গর্ডন, ইনি আমার দূর-সম্পর্কের এক ভাই।
লর্ড হুইটফিল্ড দেখতে ছোটোখাটো, মাথায় চকচকে টাক। পোশাকে-আশাকে কিছুটা গ্রাম্য অগোছালো ভাব। যাই হোক, তিনি লিউককে আন্তরিকতার সঙ্গেই স্বাগত জানালেন। তারপর লর্ড হুইটফিল্ড তাঁর চেয়ারে বসে ছিপ ছিপ করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে লিউককে যেন পরিমাপ করেছিলেন।
আপনি তাহলে বই লেখেন?
এই প্রশ্নে লিউক একটু ঘাবড়ে গেল।
বেশ আত্মতুষ্ট স্বরে বললেন লর্ড-আমি প্রায়ই ভাবি যে আমি নিজেই একখানা বই লিখবো।
আচ্ছা?–জবাব দেয় লিউক।
ঠাট্টা নয়, আমি এত বিচিত্র ধরনের লোকজন দেখেছি যে তাদের নিয়ে খুবই মনোজ্ঞ একটা বই লিখতে পারি।
সে তো ঠিকই, লিউকের জবাব।
ব্রিজেট বললো–তোমার সঙ্গে কার কথা? তুমি তো মহৎ লোক। নাও আর একটু চা খাও।
লর্ড লিউককে জিজ্ঞেস করলেন–তা, এই অঞ্চলের কারুর সঙ্গে আলাপ পরিচয় আছে?
লিউক বললো, না নেই–তবে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে শুধু একটু দেখা করবার আছে। ভদ্রলোক আমার এক বন্ধুর বন্ধু। নাম—আম্বলবি–ডাঃ আম্বলবি।
লর্ড হুইটফিল্ড বললো–ডাঃ আম্বলবির সঙ্গে দেখা করবেন? খুবই পরিতাপের বিষয়।
কেন? পরিতাপ করার মত কী বললাম?
এই তো, সপ্তাহখানেক হলো ভদ্রলোক মারা গেছেন।
লিউক বলে,–আহা, তা হলে তো সত্যিই দুঃখের ব্যাপার।
লিউক কিছুটা আন্দাজের সঙ্গে বলল–ডাঃ আম্বলবি একজন স্পষ্ট বক্তা ছিলেন তাই না? এবং তার ফলে নিশ্চয়ই ওঁর অনেক শত্রু ছিলো?
না, না, সে কথা ঠিক বলা যায় না। ব্রিজেট, কী বল? –লর্ড হুইটফিল্ড বললেন।
ব্রিজেট বলে–আমার তো ধারণা উনি বেশ জনপ্রিয় লোকই ছিলেন। আমার তো মনে হয় যে, ভদ্রলোক একজন অমায়িক লোক।
ব্রিজেটের কথা লর্ড স্বীকার করে বলেন–তা ঠিক, ভদ্রলোক নিঃসন্দেহে জনপ্রিয় ছিলেন–তবে ওঁর মত আরও দুএকজন লোককে আমি জানি, তারাও ওঁরই মতো মোটাবুদ্ধি সম্পন্ন। প্রশ্ন করে লিউক–সেই দুএকজন কি এই গ্রামেই বাস করেন?
লর্ড বললেন–হ্যাঁ, এই গ্রামেই।
একটু ইতঃস্তত করে লিউক বললো–আচ্ছা, এখানে কী ধরনের লোক সবচেয়ে বেশি বাস করে?
ব্রিজেট বললো–বেশির ভাগই সেকেলে লোক–গীর্জার মত পাদ্রী আর তাঁদের যত স্ত্রী-পুত্র, ভাই-বোন, ডাক্তারদের বেলাতেও তাই।
উত্তর শুনে লিউক ঘাবড়ে যায়–কিছু পুরুষ মানুষও নিশ্চয়ই আছে?
তা আছে। তবে মাত্র কয়েকজন। মিঃ অ্যাবট–উকিল; ডাঃ আম্বলবি; মিঃ ওয়েকবেস্টর আর মিঃ এলওয়ার্দি-দারুণ ভালো লোক। এছাড়া আছেন মেজর হর্টন আর তার একপাল কুকুর।
লিউক বললো–আমার বন্ধুরা বলেছিলো যে, এখানে তাদের চেনা একজন মহিলা বাস করেন?
ব্রিজেট হেসে ওঠে–হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে, পিঙ্কারটন।
লর্ড বললো–সত্যিই আপনার কপালটা নিতান্তই খারাপ। সেই ভদ্রমহিলাও মারা গেছেন।
হাল্কা স্বরে লিউক বলে–আপনাদের এখানে দেখছি মৃত্যুর হার বড্ড বেশি।
লর্ড প্রতিবাদ করে ওঠেন–একথা মোটেই সত্য নয়। দুর্ঘটনা সব জায়গাতেই হতে পারে।
লিউক বলে,-ডাঃ আম্বলবিও কি দুর্ঘটনায় মারা যান?
লর্ড বলেন–না, ওঁর হাতে খুব বিষাক্ত ঘা হয়েছিল, কোনো পেরেকে বা ঐ জাতীয় কিছুতে হয়তো হাতে খোঁচা লেগেছিলো এবং ডাক্তারদের যা হয়ে থাকে–প্রথমে খেয়ালই করেননি, ফলে সেই সামান্য ছড়ে যাওয়া থেকে বিশ্রী রকমের ঘা হয়ে গেল আর তাতেই কদিনের মধ্যে ভদ্রলোক মারা গেলেন।
নিয়তির বিধান অলঘ্য।-লর্ড সহজ গলায় বলেন।
.
নিজের ঘরে গিয়ে রাতের পোষাক পরতে পরতে লিউক নিজের মনে বলতে লাগল–সত্যিই কি নিয়তির বিধান? বিষাক্ত ঘা? হয়তো তাই, কিন্তু মৃত্যুটা বড়ই আকস্মিক!–কানে ভাসছিলো ব্রিজেটের কথাগুলো–গত এক বছরে এখানে বেশ কিছু লোক মারা গেছে।
***
লিউকের প্রথম পদক্ষেপ লিউক নিজের পরিকল্পনা গুছিয়ে নিয়ে পরদিন সকালে একেবারে তৈরি হয়ে খাবার টেবিলে এলো।
টেবিলে লর্ড ও ব্রিজেটকে শুভেচ্ছা জানিয়ে লিউক ডিম আর বেকনের একটা ডিস্ টেনে নিয়ে খাওয়ায় মন দিলো। খেতে খেতে ও বললো
বুঝলেন, আর সময় নষ্ট না করে এবার আমার যে জন্য এখানে আসা সে কাজে হাত দেওয়াই উচিত। মুশকিল হচ্ছে লোকজনকে দিয়ে কথা বলানো। সবাই তো আর আপনাদের মতো নয়? আপনারা যেটুকু জানেন সবই গুছিয়ে বলবেন। কিন্তু এই সমস্ত গ্রাম্য কুসংস্কার আপনারা কতটুকুই বা জানেন–অথচ আমার আবার সেগুলোই প্রয়োজন।
লর্ড হুইটফিল্ড বললেন–এইসব ঘটনা অদ্ভুত হলেও সত্যি। শিক্ষা-ব্যবস্থার সম্প্রসারণ না হলে এর হাত থেকে নিস্তার নেই। আপনাকে বলাই হয়নি, আমি এই গাঁয়ে চমৎকার একটা পাঠাগার তৈরি করেছি।
লিউক বললো–খুবই ভালো কাজ করেছেন। আপনি বুদ্ধিমান লোক; নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন যে, অতীতের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনগুলি নিয়ে মগ্ন হয়ে থাকলে মানুষের মোহমুক্তির কোনো আশাই নেই।
এই প্রসঙ্গে লিউক বক্তৃতা দিয়েছিলো, তার কিয়দংশের হুবহু বর্ণনা দেওয়া হলো—
মৃত্যু হচ্ছে কুসংস্কারাচ্ছন্ন গল্পগুলোর প্রধান উৎপত্তিস্থল। কবর দেওয়ার রীতি-নীতি, আচার-বিচার নিয়ে যে কত রকমের কিংবদন্তী আছে! তাছাড়া দেখা গেছে যে, যে কোনো কারণেই তোক গ্রামের লোকেরা মৃত্যু নিয়েই সবচেয়ে বেশি গল্প গুজব করে।
ব্রিজেট বললো–এরা সব সময়ে মানুষের শেষকৃত্বের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায়।
লিউক বলে–আমি তো ভেবেছি যে ওখান থেকেই আমি আরম্ভ করবো। অল্প কিছুদিনের মধ্যে যারা মারা গেছেন, তাদের সম্পর্কে যদি আপনাদের চার্চ থেকে একটা মোটামুটি হিসেব পাই, তাহলে যারা মারা গেছে তাদের আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করবো। আচ্ছা, কাকে দিয়ে আরম্ভ করা যায় বলুন তো? আপনাদের এখানকার পাদ্রীকে দিয়ে?
ব্রিজেট বলে মিঃ ওয়েক অবশ্য এসব ব্যাপারে খুবই উপযুক্ত লোক। উনি আপনাকে অনেক কিছুই বলতে পারেন।
লিউক কিছুক্ষণ চুপ করে বলল–এতো খুব ভালো কথা। আচ্ছা, গত এক বছরের মধ্যে কে বা কারা মারা গেল বলতে পারেন?
ব্রিজেট বললো–প্রথমে গেল কার্টার। ঐ নদীর পারে যে বাড়িতে ছোটো একটা মদের দোকান আছে, সেই বাড়ির মালিক। তারপর মিসেস রোজ, ধোপানী; তারপর গেল টমি পিয়ার্স। এরপর একটি মেয়ে–অ্যামি।
অ্যামি?–পাল্টা প্রশ্ন লিউকের।
অ্যামি গিবস্ এখানে পরিচারিকার কাজ করতো। ওর মৃত্যুতে একটা তদন্ত হয়েছিলো।
কেন?
মেয়েটা অন্ধকারে ওষুধের বদলে কি একটা বিষ খেয়েছিলো।-লর্ড হুইটফিল্ড বললো।
ব্রিজেট বললো–মাথার টুপি রং করবার একটা বোতল রং ছিলো ওর ঘরে। ভুলে রঙের বোতলকে ওষুধের বোতল মনে করে রং খেয়েছিলো।
লিউক বললো–বিশ্রী কাণ্ড তো!
মনে পড়লো লিউকের অ্যামি গিবস?–হ্যাঁ মিস পিঙ্কারটন এ নামও উল্লেখ করেছিলেন। এছাড়া টমি নামে একটি ছোটো ছেলের বিষয়েও বলেছিলেন। এখন পরিষ্কার ওর মনে পড়লো উনি কার্টারের নামও করেছিলেন। বেশ সচেতন গলায় ও বললো–
এইভাবে একই প্রসঙ্গে কথা বলতে নিজেকে বড় ভূতুড়ে মনে হচ্ছে। যেন আমি নিজেই একজন কবরের প্রার্থী। কিন্তু এই নিয়ে লোকজনের কাছ থেকে কথা বের করা বেশ শক্ত।
ব্রিজেট বললো–আমারও তাই মনে হয়।
লিউক বললো–অন্যের ক্ষতিসাধনের চিন্তা যারা করে, তাদের নিয়েও কিন্তু নানা উপকথা প্রচলিত আছে। এখানে ও ধরনের কোনো প্রচলিত গল্প-টল্প আছে নাকি?
লর্ড ও ব্রিজেট বললেন না।
ব্রিজেটের কথার সূত্র ধরে লিউক বললো–সেটা না থাকবারই কথা। আমি প্রথমে চার্চ থেকে আরম্ভ করবো। তারপর যাবো, সেই সেভেন স্টার না কি একটা নাম বললেন সেই মদের দোকানটার আড্ডায়। আচ্ছা, যে বিচ্ছু স্বভাবের ছেলেটি মারা গেল ওর কোনো আত্মীয়-স্বজন আছে?
মিসেস পিয়ার্সের একটা সিগারেটের দোকান আছে হাইস্ক্রীটে।
লিউক বললো–আচ্ছা, আমি তাহলে যাই।
যদি আপত্তি না থাকে, আমি সঙ্গে যাবো।–ব্রিজেট বললো।
নিশ্চয়ই।কিন্তু লিউকের মনে হলো যে, এই কৃত্রিমতা হয়তো বা ব্রিজেটের কাছে ধরা পড়েছে–তাহলে কিন্তু বড়ই লজ্জার ব্যাপার হবে।
যাকগে, একটু বেশি সতর্ক হয়ে কথা বললেই হবে।–নিজেকে সাবধান করে লিউক।
আমি তৈরি। চলো।–নিঃশব্দে ওর পেছনে ব্রিজেট কখন যেন দাঁড়িয়েছে–এতক্ষণ ওর উপস্থিতিটা ও টেরই পায়নি।
ব্রিজেট বললো–তোমাকে রাস্তা দেখিয়ে দেবার জন্যই আমার আসা।
লিউক জবাব দেয়-আমার খুব উপকার করলে।
পেছন ফিরে ও সেই দুর্গ-আকারের বাড়িটা একবার দেখে নিয়ে বিরক্তির স্বরে বললো–কী একটা বীভৎস কাণ্ড। কেউ কি ওঁকে থামাতে পর্যন্ত পারেনি?
ব্রিজেট বললো–প্রতিটি ইংরেজ পুরুষই তার বাড়িটাকে দুর্গ ভাবে। ও বাড়িটাকে দারুণ ভালোবাসে।
উত্তর দেয় লিউক–ঠিকই বলেছো। আমার নাটুকে কথায় আমি লজ্জিত। আমায় ক্ষমা করো।
মিনিট পাঁচেক যাবার পর ওরা চার্চে এসে পৌঁছলো। চার্চের সংলগ্ন পাদ্রীর বাড়ি। অ্যা
লফ্রেড ওয়েক ছোটোখাটো একজন বয়স্ক লোক, মাথায় সুবিশাল টাক।
আলাপ করিয়ে দেয় ব্রিজেট–মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম, আমাদের সঙ্গে অ্যাশম্যানরে আছেন। উনি একটা বই লিখছেন, আর সেই ব্যাপারেই আপনার সঙ্গে একটু আলোচনা করতে এসেছেন।
মিঃ ওয়েক উত্থাপিত প্রসঙ্গে বিশেষ উৎসাহী নন। রোমের পুরাতত্ত্বে ওঁর আগ্রহ। ভদ্রলোক বিনীত স্বরে স্বীকার করলেন যে, ডাইনীতত্ত্বে বা গ্রাম্য ছড়া ইত্যাদি বিষয়ে ওঁর জ্ঞান খুবই সামান্য। তবে উইচউডের কিছু প্রামাণ্য ইতিহাস বললেন।
লিউক খুব হতাশ ভাব দেখিয়ে ও প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে মৃত্যুর প্রাক্-মুহূর্তে যে সব গালগল্প প্রচলিত তাই উত্থাপন করলো।
এই প্রসঙ্গেও মিঃ ওয়েক তার অজ্ঞতা প্রকাশ করে বললেন–মৃত্যুকালীন ভৌতিক অস্তিত্ব যদি বা কিছু থাকেও–সেই সম্পর্কিত গল্প-গাঁথা স্বাভাবিক কারণেই কেউ আমাকে বলবে না–এটা নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারছেন?
তা অবশ্য ঠিক।
এবার লিউক অকুতোভয়ে বললো–আমি মিস কনওয়েকে বলেছিলাম যে, আপনাদের এখানে যারা সম্প্রতি মারা গেছেন তাদের নামের একটা তালিকা পেলে আমার কাজের খুব সুবিধে হতো। আপনি যদি তেমন একটা কিছু দিতে পারেন তবে তার থেকে বিচার করে আমি কাজ আরম্ভ করে দিতাম।
আমাদের এই চার্চের কর্মী গাই এ ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করতে পারতো, তবে ও কানে শুনতে পায় না। তাছাড়া, বেশ কিছু সংখ্যক দুর্ঘটনাও কয়েকটা প্রাণ নিয়েছে। আমাদের এই গ্রামটার খুবই দুঃসময় চলছে।
লিউক বললো–কেউ কেউ বলে যে কখনো কখনো কোনো ব্যক্তিবিশেষের উপস্থিতির ফলে দুঃসময় দেখা দেয়।
ঠিকই বলেছেন, জোনার সেই পুরাকথা। কিন্তু আমাদের এখানে কোনো বাইরের লোক এসেছে বলে আমার মনে হয় না। যাই হোক, অল্প কয়েকদিন আগেই গেলেন দুজন। ডাঃ আম্বলবি আর ল্যাভিনিয়া পিঙ্কারটন। ডাঃ আম্বলবি একজন সাচ্চা লোক ছিলেন–
শত্রুও নিশ্চয়ই ছিলো?–লিউক কথাটা বলেই যোগ করে–মানে, ওঁর বন্ধুদের কাছ থেকে যতটা শুনেছি তার ওপর নির্ভর করেই এ কথা বলছি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মিঃ ওয়েক।
ভদ্রলোক একেবারে মনখোলা মানুষ ছিলেন। স্থানীয় গরীব মানুষদের মধ্যে খুবই সুনাম ছিলো। তবে এ কথা অস্বীকার করা চলে না যে, ডাঃ আম্বলবির মৃত্যুর ফলে ওঁর পেশাগত অংশীদার ডাঃ টমাসের বহুলাংশেই সুবিধে হবে।
কী রকম?
আমার মনে হয় টমাস খুবই বুদ্ধিমান লোক–ডাঃ আম্বলবিও এই কথাই বলতেন। কিন্তু ওঁদের দুজনের মধ্যে খুব একটা সদ্ভাব ছিলো না। এ নিয়ে হয়তো টমাসের দুশ্চিন্তাও ছিলো। আর এই দুশ্চিন্তাই ওকে আরও দুর্বল করে ফেলতো। মুখ দিয়ে কথাই বের হতো না। এই মাত্র অল্প কদিনেই ওর আচরণে একটা আশ্চর্যরকম পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। যেন, অনেক সতেজ হয়ে উঠেছে–ব্যক্তিত্বও বেড়েছে, একটা আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আধুনিক মতবাদে টমাসের খুব ঝোঁক আর আম্বলবির ছিলো পুরানো পদ্ধতির প্রতি অবিচল নিষ্ঠা। এই নিয়ে এঁদের মধ্যে বেশ কয়েকবার ঝগড়াও হয়েছিলো। তা ছাড়া পারিবারিক ব্যাপার নিয়েও ঝগড়া হয়েছে।
লর্ড হুইটফিল্ড বলেছিলেন যে, ওঁর একরকম বিষাক্ত ঘা হয়েছিলো।
হ্যাঁ, সামান্য একটু ছড়ে গিয়েছিল মাত্র। সেটাই পরে বিষাক্ত হয়ে ওঠে। ডাক্তাররা তাদের পেশার খাতিরে অনেক সময় নানা রকম মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে থাকে।
তা তো নয়ই।–জবাব দেয় লিউক।
হঠাৎ সচেতন হয়ে ওঠেন মিঃ ওয়েক–আমি কিন্তু প্রসঙ্গ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। আমরা মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যত কুসংস্কার আছে, আর অল্প কিছুদিনের মধ্যে এখানে যাদের মৃত্যু হয়েছে-এই নিয়ে আলোচনা আরম্ভ করেছিলাম। ল্যাভিনিয়া পিঙ্কারটন–আমাদের চার্চের একজন সেবিকা ছিলেন। খুবই নিষ্ঠাবতী মহিলা। আর ছিলো সেই হতভাগী মেয়ে আমি গিব। ওর মৃত্যুর মধ্যে আপনি হয়তো কিছু খুঁজে পেলেও পেতে পারেন মিঃ ফিস্ উইলিয়াম্ওঁর মৃত্যু আত্মহত্যা ঘটিত এমন কথা কেউ কেউ বলেছিলো আর এ ধরনের ঘটনায় ভৌতিক-সংস্কার থাকা বিচিত্র নয়।
মূল্যবান খবর দিলেন।–লিউক বলে।
এরপর গেল টমি পিয়ার্স–চার্চে যুগ্মসঙ্গীত করতো ছেলেটি। ছেলেটি ছিলো এক নম্বরের বিচ্ছু। শেষ পর্যন্ত ওকে চার্চ থেকে বিদায় করতে হয়েছিলো। আমরাও ওকে পোস্ট অফিসে টেলিগ্রাম বিলি করার একটা কাজ যোগাড় করে দিয়েছিলাম, কিন্তু সেটা ও রাখতে পারলো না। ওর মার জন্য দুঃখ হয়–মহিলা যেমন পরিশ্রমী তেমনি ভালো মনের মানুষ। মিস ওয়েনফ্লিট ছোকরাকে লাইব্রেরির জানলা-দরজা পরিষ্কার করার একটা কাজ যোগাড় করে দিয়েছিলেন। লর্ড হুইটফিল্ড কিন্তু প্রথমটায় আপত্তি করেছিলেন–সেই বাড়িতে ঢুকতে দিতেই চাননি। অবশ্য পরে রাজী হয়ে গেলেন–কিন্তু রাজী না হলেই ভালো ছিল।
কেন?
ছেলেটা ওই কাজ করতে গিয়েই তো মারা গেল। একেবারে ওপরতলার জানলা পরিষ্কার করছিলো। হয়তো মাথা ঘুরে ওই উঁচু থেকে পড়ে যায়, আর তারপরেই ছেলেটি মারা যায়।
কৌতূহলী হয়ে লিউক বললো–আচ্ছা, ওকে কি কেউ পড়ে যেতে দেখেছিলো?
নাঃ, বাড়ির পেছনে বাগানের দিকটায় পড়েছিলো। মনে হয়, অন্ততঃ আধঘণ্টা ওখানে অজ্ঞান অবস্থায় ছিলো।
প্রথম ওকে কে দেখে?
মিস পিঙ্কারটন। এই ভদ্রমহিলাও মাত্র কদিন আগে গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেলেন। টমি মারা যাবার দিন ইনি বাগানে এসেছিলেন কতকগুলো গাছের চারা নিতে। এসে দেখলেন এই কাণ্ড।
উনি নিশ্চয়ই খুব হতচকিত হয়ে গিয়েছিলেন?–লিউক বলে।
আপনি যতটা ভাবছেন, তার চেয়েও অনেক বেশি…
ব্রিজেট বলে–আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে মিঃ ওয়েক, ওর স্বভাবের মধ্যে একটা বিরক্তিকর নিষ্ঠুরতা ছিলো?
মিঃ ওয়েক বললেন–তা, আমি জানি মিস কনওয়ে কিন্তু ওর অল্প বুদ্ধিই তার জন্য দায়ী। এমন দেখা যায় যে, কোনো পূর্ণবয়স্ক মানুষের দেহে শিশুর মস্তিষ্ক। তাদের মধ্যে যে নিষ্ঠুরতা বিরাজ করে, সে কথা তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না।
ব্রিজেট বললো–আপনি ঠিক বলেছেন। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দেহে শিশুর মস্তিষ্ক বোধহয় প্রকৃতির রাজ্যে দুনিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক দুর্ঘটনা..।
লিউকের মনে হলো যেন বিশেষ কারো কথা ভেবেই ব্রিজেট এ কথাগুলো বললো।
লিউক ফিৎস্ উইলিয়াম ভাবতে বসলো ব্রিজেট কাকে উদ্দেশ্য করে মন্তব্যটা করলো।
***
মিস ওয়েনফ্লিটের সঙ্গে সাক্ষাৎকার
মিঃ ওয়েক বললেন–দেখা যাক আর কার নাম মনে পড়ে-মিসেস রোজ, বেচারা বুড়ো বেল আর এলকি এবং হ্যারি কার্টারের বাচ্চা।
ব্রিজেট বললো-অ্যামি গিব মারা গেল এপ্রিলে।
হ্যাঁ, একটা ভুলের ফলে বেচারার প্রাণ গেল।
লিউক দেখলো যে ব্রিজেট একটু বিরক্ত হলো–অ্যামি গিবসের প্রসঙ্গ উঠলেই ব্রিজেটের ভাবান্তর হয়, অথচ তার কারণটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না।
লিউক মিঃ ওয়েকের কাছে বিদায় নিয়ে বাইরে এসে প্রশ্ন করে–ঠিক করে বলতো এই অ্যামি গিবস্ মেয়েটি কে?
লিউক উত্তরে লক্ষ্য করলো ওর গলায় যেন একটা বাধো বাধো স্বর–অ্যামি ছিলো বাড়ির পরিচারিকা। এত বড় অপদার্থ আমি দুটি দেখিনি।
এই জন্যই কি ওর চাকরিটা গিয়েছিলো?
না। ও মাঝরাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাড়ির বাইরে একটি ছেলের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করতে। গর্ডন এ সমস্ত ব্যাপার পছন্দ করতো না। তাই ওকে নোটিশ দেয় আর এই নিয়ে অ্যামি প্রচণ্ড সোরগোল করে।
ওকি দেখতে ভালো ছিলো?–প্রশ্ন করে লিউক।
খুবই সুন্দরী।
ওই কি সেই টুপির রং খেয়েছিলো ওষুধ মনে করে?
হ্যাঁ।
ওর সত্যিই কি বুদ্ধি কম ছিলো?
মোটেই না, বরঞ্চ-বেশি মাত্রায় বুদ্ধিমতী ছিলো।
আড়চোখে লিউক ব্রিজেটের দিকে তাকালো। প্রতিটি কথায় উত্তর দিচ্ছিলো ব্রিজেট অত্যন্ত একঘেয়ে স্বরে। ওর কোনো উৎসাহ ছিলো না।
ইতিমধ্যে একজন লোক ব্রিজেটকে টুপি তুলে অভিবাদন জানালো। ব্রিজেট তার সঙ্গে লিউকের পরিচয় করিয়ে দিলো।
এ হচ্ছে আমার এক দূর-সম্পর্কের ভাই–মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম। একটা বই লেখার জন্য এখানে এসেছে। আর ইনি হচ্ছেন মিঃ অ্যাবট।
ইনিই সেই উকিল, যিনি টমি পিয়ার্সকে চাকরি দিয়ে রেখেছিলেন। ভদ্রলোকের দিকে লিউক উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো।
কী বই লিখছেন? উপন্যাস?
গণগাঁথা।–ব্রিজেট বলে।
তা হলে তো বেছে বেছে ভালো জায়গাই এসেছেন। খুব উপযুক্ত জায়গা আমাদের এই গ্রাম।
লিউক বলে–আচ্ছা, এ ব্যাপারে আপনি কিছু সাহায্য করতে পারেন না?
নাঃ, তেমন কিছু তো মনে পড়ছে না। হয়তো শুনেছি–তবে
আচ্ছা, এখানে লোকজনেরা কি ভূতে বিশ্বাস করে?
সে ব্যাপারে আমি সত্যিই কিছু জানি না।–উত্তর দেন উকিলমশাই।
কোনো ভূতুড়ে বাড়ি নেই এখানে?
অন্ততঃ, আমার জানা নেই।
লিউক বললো–শুনেছি, এখানে টমি না কি যেন নামে একটি ছেলে ছিলো–আপনার অফিসে এক সময়ে কাজ করতো। লোকে বলে যে, ও নাকি এখনও এখানেই চলাফেরা করে।
মুখ সাদা হয়ে যায় মিঃ অ্যাবটের। উনি বলেন–টমি পিয়ার্স? সেই অতি নচ্ছার পাজি ছেলেটা?
এই ধরনের আত্মা সব সময়ই দুষ্ট প্রকৃতির হয়ে থাকে।
ওর ভূত কে দেখেছেন? ঘটনা কী?
এ ধরনের ঘটনার সাক্ষী হিসেবে বিশেষ কারো নাম বলা যায় না।
আমারও তাই বিশ্বাস।
চতুরতার সঙ্গে লিউক প্রসঙ্গান্তরে যায়।
তাহলে তো টমাসের সঙ্গে আপনার আলাপ হওয়ার দরকার। বেশ ভালো লোক এই টমাস। বৃদ্ধ আম্বলবির মত নয়।
উনি কি খুব প্রতিক্রিয়াশীল ছিলেন?
একেবারে মাথামোটা–একগুয়ের রাজা।
ব্রিজেট প্রশ্ন করে–জল সরবরাহের প্রশ্নে আপনার সঙ্গে শুনেছি দারুণ ঝগড়া ছিলো?
অ্যাবটের মুখ পিঙ্গলবর্ণ হয়ে ওঠে।
আম্বলবি সব সময়ে যে-কোনো প্রগতিমূলক কাজের একেবারে বিরোধী ছিলেন।–কর্কশ স্বরে মিঃ অ্যাবট জবাব দেন। তারপর বলেন যাকগে, এবার আমাকে বিদায় নিতে হচ্ছে। যদি আমাকে দিয়ে কোনো কাজ হয় বলবেন মিঃ–
ফিৎস্ উইলিয়াম।মনে করিয়ে দেয় লিউক।
ওরা এগিয়ে যায়। চলতে চলতে ব্রিজেট বলে আমি তোমার পদ্ধতিটা লক্ষ্য করলাম। তুমি নিজে থেকে যাহোক কিছু বলে লোককে উকে দিয়ে তাদের কাছ থেকে কথা টেনে বের করার চেষ্টা করছে।
লিউক অস্বস্তি বোধ করছিলো। ওর এরপর কী করা উচিত ভেবে ঠিক করার আগেই ব্রিজেট বলে–তুমি যদি অ্যামি গিবসের কথা আরও জানতে চাও তবে তোমায় আমি একজনের কাছে নিয়ে যেতে পারি।
সে কে?
মিস ওয়েনফ্লিট নামে এক ভদ্রমহিলা।
লিউক বলল–তাই নাকি? তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
লিউক যেতে যেতে দেখলো সেই প্রকাণ্ড জর্জিয়ান বাড়ি। ব্রিজেট বললো–এটা হচ্ছে। উইচ হল-এখন ওটাই লাইব্রেরি।
হলের গায়ে একটা ছোটো বাড়ি। ব্রিজেট ফটকের দরজা খুলতেই ভেতর থেকে এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন।
ব্রিজেট বলে-নমস্কার মিস ওয়েনফ্লিট। ইনি মিঃ ফিৎস উইলিয়াম।–লিউক নমস্কার জানায়। ইনি মৃত্যু, গ্রাম্য সংস্কার আর নানা রকম সব বিরক্তিকর ব্যাপারের ওপর একটা বই লিখছেন।
ভদ্রমহিলা বললেন–তাই নাকি? খুব ভালো কথা।
আমি ভাবলাম যে আপনি অ্যামির ব্যাপারে কিছু তথ্য দিতে পারবেন। ব্রিজেট বলে।
ও, অ্যামি? হা হা অ্যামি গিবস্–মিস ওয়েনফ্লিট বলেন।
মহিলা এবার যেন লিউককে যাচাই করে নিতে চাইলেন।
দয়া করে ভেতরে আসুন, আমার পরে বেরোলেও চলবে। আমার তেমন কিছু দরকারী কাজ নেই, বাড়ির জন্য টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনতে যাচ্ছিলাম।
চেয়ার টেনে ওদের বসতে বলে মিস ওয়েনফ্লিট বললেন–আমি নিজে বিড়ি, সিগারেট খাই না, তাই তোমার কাছে সিগারেট নেই।
তারপর ওয়েনফ্লিট বললেন–আপনারা সেই দুর্ভাগিনী মেয়ে অ্যামির সম্পর্কে জানতে চান? মারাত্মক একটা ভুলের ফলে ওর মৃত্যু হলো।
আচ্ছা, এটা কি আত্মহত্যা হতে পারে না?–প্রশ্ন করে লিউক।
ওয়েনফ্লিট বলে ওঠেন–কখনোই না। অ্যামি সে ধরনের মেয়েই ছিলো না।
লিউক জিজ্ঞেস করে–ও কী ধরনের মেয়ে ছিলো?
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–ও বাড়ির পরিচারিকা হিসেবে মোটেই ভালো না। তবে আজকাল একজন কাউকে পেলেই বলতে হবে কপাল ভালো। ও অত্যন্ত একরোখা মেয়ে ছিলো। এ ধরনের মেয়ে আমি খুব একটা পছন্দ করি না; তবে মৃত লোকের নিন্দে মন্দ করা ঠিক নয়।
মাথা নেড়ে লিউক সম্মতি জানায়। মিস পিঙ্কারটনের কথা ওর মনে পড়ে।
মিস ওয়েনফ্লিট না থেমে সমানে বলে চলেন–অ্যামি নিজের প্রশংসা খুব পছন্দ করতো। এখানকার একটা অ্যান্টিক দোকানের মালিক মিঃ এলসওয়ার্দি। ভদ্রলোক জলরং দিয়ে মাঝে মাঝে ছবি আঁকেন। অ্যামির দুএকটা স্কেচ উনি করেছিলেন আর তাতেই নিজের সম্পর্কে ওর ধারণা আরও উঁচু হয়ে গেল। ও যে ছেলেটির বাগদত্তা ছিলো–জিম হারভে–একটা মোটর কারখানার মেকানিক, খুব ভালোবাসতো অ্যামিকে। কিন্তু বাসলে কী হবে, প্রায়ই হারভের সঙ্গে ও ঝগড়া করতো। সেই ভয়ঙ্কর রাত্রির কথা আমি কোনোদিন ভুলবো না। অ্যামি দারুণ ঠান্ডায় বাইরে গিয়ে বিশ্রী সর্দিকাশি বাধিয়ে ফিরলো; সেইদিন বিকেল বেলা ও ডাক্তার দেখালো।
লিউক জিজ্ঞেস করলো–কোনো ডাক্তারকে দেখালো?
ডাঃ টমাস, এবং তিনি ওকে সর্দির জন্য এক শিশি ওষুধ দিয়েছিলেন। ও সেটা কিনে বাড়ি ফিরলো। এই ওষুধে কোনো অনিষ্ট হবে না। ও সকাল সকাল শুতে চলে গেল। তারপর ভোর রাতে–প্রায় একটা নাগাদ গোঙানি আরম্ভ হলো। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। তখন চিৎকার করে ডাকাডাকি করলাম কিন্তু কোনো উত্তর নেই। আমরা ডাকাডাকি করাতে রীড বাড়ির পেছনে গিয়ে দেওয়াল বেয়ে ওপরে ওঠে, ওর ঘরের খোলা জানলা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা খুলে দিলো। আহা বেচারী! কী মর্মান্তিক দৃশ্য! কেউ কিছু আর করতে পারলো না–হাসপাতালে নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মারা গেলো।
কী ভাবে মারা গেল? টুপির পেইন্ট খেয়ে?
হা, ওরা কি একটা বললো, অক্সালিক অ্যাসিড নামে এক ধরনের বিষের ক্রিয়ার ফলে। বোতলটা দেখতে প্রায় সর্দির ওষুধের বোতলের মতোই ছিলো। মারা যাবার পর ওষুধের বোতলটা পাওয়া গেল ওর বেসিনের ওপর আর রঙের বোতলটা ছিলো ওর বিছানার পাশে।
আপনার কি একবারও মনে হয়নি যে এটা আত্মহত্যা?
একবারও না। ও যদি আত্মহত্যা করতে চাইতো, তাহলে আরও ভালো কোনো উপায় অবলম্বন করতে পারতো। ও আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে ছিলো না।
লিউক জিজ্ঞেস করলো–তাহলে আপনার কী মনে হয়?
ওয়েনফ্লিট বললেন–আমার মতে এটা একটা দুঃখজনক ঘটনা।
এমন সময় একটা বেড়াল ওয়েনফ্লিটের কাছে এলো। ওয়েনফ্লিট আদর করে বললো-কি রে ওয়াঙ্কিপু, সারাদিন কোথায় ছিলি?
লিউক বললো–ভারী সুন্দর বেড়াল তো। অনেক দিন যাবৎ পুষছেন না কি?
না না, এটা মিস পিঙ্কারটন নামে আমার এক বান্ধবীর বেড়াল। শয়তান ড্রাইভার ওকে চাপা দিয়ে মেরেছে।
গম্ভীর ভাবে লিউক বেড়ালটাকে একবার আদর করলো।
ব্রিজেট দাঁড়িয়ে পড়ে–এবার কিন্তু আমাদের যেতে হবে।
মিস ওয়েনফ্লিট ওদের বিদায় জানিয়ে বললেন–আশা করি আপনাদের সঙ্গে মাঝে মাঝেই দেখা হবে।
ওদের সঙ্গে বাইরে এলেন মিস ওয়েনফ্লিট। লিউক সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সেই অক্ষত গ্রাম্য সৌন্দর্যের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে বলল–অপূর্ব সুন্দর আপনাদের এই গ্রাম।
মিস ওয়েনফ্লিটের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
যখন ওরা বাইরে এলো ব্রিজেট বললো–তুমি কি তোমার অনুসন্ধানের কাজ আরও চালাবে, না এবার আমরা নদীর পার দিয়ে হেঁটে বাড়ির দিকে যাবো? ঐ পথটা কিন্তু খুব সুন্দর।
হাইড স্ট্রীট ধরে ওরা হাঁটতে আরম্ভ করলো। রাস্তার সব শেষের বাড়িগুলোর একটার গায়ে সোনালী অক্ষরে লেখা রয়েছে–অ্যান্টিক।
লিউক সেই বাড়ির জানলা দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে বললো–খুব সুন্দর একটা রুপোর ডিস্ রয়েছে এখানে। আমার পিসিমার একটা এরকম ছিলো। ওরা এটার দাম কী রকম চাইবে?
ভেতরে গিয়ে জিজ্ঞেস করবো?
ব্রিজেট বললো-এখানে তেমন কিছু পাবে বলে আমার মনে হয় না। এলওয়ার্দি তার জিনিষের দাম খুব ভালো করেই জানে।
দরজা খোলাই ছিল। লিউক বাঁ-দিকের একটা ঘরে ঢুকে একটা রুপোর ডিস্ তুলতেই কুইন অ্যান্ ওয়লনাট ডেস্ক-এর আড়াল থেকে এক ভদ্রলোক ওর দিকে এগিয়ে এলেন।
ও, মিস কনওয়ে, কি ভাগ্য আপনি এসেছেন।
নমস্কার মিঃ এলসওয়ার্দি।
লিউকের সঙ্গে আলাপ হতেই ভদ্রলোক বললো–খাঁটি ইংলিশ রুপোর ডিস, খুব ভালো জিনিস। বিক্রি করতে ইচ্ছে করে না।
ব্রিজেট বললো-খাঁটি শিল্পীর মেজাজ।
এলসওয়ার্দি ব্রিজেটকে বললো–আমার শিল্পী খেতাব সহ্য হবে না। লিউক বলে–কিন্তু আপনি তো একজন শিল্পীও? শুনলাম আপনি জলরঙে ছবিও আঁকেন?
এলসওয়ার্দি জিজ্ঞেস করলো–এ কথা আপনাকে কে বললো? এ জায়গাটা সত্যিই অদ্ভুত-কারুর কিছু গোপন রাখার উপায় নেই এবং এই জন্যই এ জায়গাটা আমার এত পছন্দ।
লিউক এলসওয়ার্দির প্রতি প্রশ্ন করে–মিস ওয়েনফ্লিট আমাদের বললেন যে আপনি নাকি অ্যামি গিবসের কয়েকটি স্কেচ করেছেন?
এলসওয়ার্দি বলেন–ও, অ্যামি? করেছিলাম কি? তা হয়তো করে থাকতে পারি।–তাঁর ভাবভঙ্গির মধ্যে যেন একটা বিচলিত ভাব।
মেয়েটি কিন্তু খুব সুন্দরী ছিলো।–ব্রিজেট বললো।
তারপর এলসওয়ার্দি লিউকের দিকে ফিরে বললেন–আপনার যদি রুপোর তৈরি জিনিষপত্রে আগ্রহ থাকে তাহলে আপনাকে আমি অপূর্ব একজোড়া রূপোর পাখী দিতে পারি।
লিউক বলে-না না, ঠিক আছে। ধন্যবাদ।
মিঃ এলসওয়ার্দি ওদের সঙ্গে দরজা অবধি এসে হাত নেড়ে বিদায় জানালেন।
লিউক মন্তব্য করলো–মিঃ এলসওয়ার্দিকে খুব একটা সুবিধের লোক বলে মনে হয়নি।
ব্রিজেট বললো–ভদ্রলোকের মনটা যেমন নোংরা, অভ্যাসগুলিও তেমনি বিশ্রী।
কতকটা খাপছাড়া ভাবে লিউক বলে–হে ভগবান, এ ধরনের লোকই তো আমার দরকার। এই ব্যাপারে ওর সঙ্গে আরও বিশদভাবে কথা বলা উচিত ছিলো। যাকগে, অন্য আর একদিন ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করবো।
কোনোও উত্তর দেয় না ব্রিজেট। পথে যেতে যেতে হঠাৎ এক ভদ্রলোক ব্রিজেটকে নমস্কার জানায়। তাঁর সঙ্গে তিনটি ডালকুত্তা ছিলো।
লিউক জিজ্ঞেস করে–এই কি সেই মেজর হন এবং তার কুকুর বাহিনী?
ঠিকই ধরেছো।
আচ্ছা, এতক্ষণে কি আমরা উইচউড-এর প্রায় সবার সঙ্গেই দেখা করা শেষ করিনি?
তা করেছি।
আমার কেমন যেন নিজেকে কেউকেটা বলে মনে হচ্ছে!–লিউক বলে।
জিমি লরিমারের কথা লিউকের মনে পড়লো–আমার মনে হয়, ইংল্যাণ্ডের গ্রামে যখন নতুন কোনো লোক যায়, গ্রামে ঢোকবার মাইল খানেক আগে থেকেই সে সবার নজরে এসে যায়।
অতর্কিতে প্রস্তাব করে ব্রিজেট–আমাদের হাতে অনেক সময় আছে; এসো না নদীর পারে একটু বসি?
একটা এলিয়ে পড়া গাছের গুঁড়িতে ওরা দুজনে ঠেস দিয়ে বসে পড়ে।
ব্রিজেট বলে–মেজর হর্টন একেবারে পাকা সামরিক। একটা হুমদারী ভাব আছে। বিশ্বাস করা কঠিন যে, বছর খানেক আগে পর্যন্ত ভদ্রলোক কী দারুণ রকম স্ত্রৈণ ছিলেন। আমি কস্মিনকালে ওঁর স্ত্রীর মতো একজন খাপছাড়া মহিলা দেখিনি। বছর খানেক আগে পাকস্থলীর এক মারাত্মক অসুখে ভদ্রমহিলা ওঁর স্বামী, ডাঃ টমাস আর দুজন নার্সকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত মারা গেলেন আর তার পরেই এই কুকুর কুলের আবির্ভাব।
ব্রিজেট লিউককে জিজ্ঞেস করলো, তোমার এখানে আসবার আসল উদ্দেশ্য কী?
ব্রিজেটের এই ছোট্ট প্রশ্নটা লিউককে আঘাত করলো।
***
টুপির পেইন্ট
লিউক সবেমাত্র সিগারেটে আগুন ধরাতে যাচ্ছিলো, কিন্তু ব্রিজেটের এই আকস্মিক প্রশ্নে ওর হাত দুটি বরফ হয়ে গেলো। জ্বলন্ত দেশলাইয়ের কাঠি পুড়ে হাতে তাপ লাগাতে ওর বাহ্যজ্ঞান ফিরে এলো। ও চমকে উঠে পোড়া কাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো–কী সাংঘাতিক প্রশ্ন। তুমি আমাকে যা একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিলে!–ক্লিষ্টভাবে ও হাসে।
তাই নাকি?
হা।–যাগে সে কথা। বুঝতে পারছি আমার আসল উদ্দেশ্যটা বোঝা সাধারণবুদ্ধি সম্পন্ন যে কোনো লোকের পক্ষেই সম্ভব। আমার এই বই লেখার ব্যাপারটা তুমি বোধ হয় প্রথম থেকেই বিশ্বাস করোনি, তাই না?
তোমাকে দেখার পর আর করিনি।
তার আগে পর্যন্ত করেছিলে?
তা করেছিলাম।
অর্থাৎ আমার গল্পটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি।
মানে বই লেখার মতো বুদ্ধিসুদ্ধি আমার নেই–এই তো? না না, আমাকে আঘাত দেওয়া হবে–একথা ভেবো না, আমার জানা দরকার।
বই হয়তো তুমি ঠিকই লিখতে পারো, তবে এ জাতের বই নয়। পুরানো দিনের আচার, বিচার, সংস্কার–এসব তোমায় মানায় না।
বুঝলাম।–লিউকের মুখে ফুটে উঠে উদ্বেগের রেখা। নিকুচি করেছে। আমি এখানে আসার পর থেকেই তুমি আমাকে ঘাবড়ে দিচ্ছো। তোমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত বুদ্ধিতে ঠাসা!
শুকনো গলায় ব্রিজেট বললো–আমি তার জন্য দুঃখিত। কিন্তু তুমি আমাকে কেমনটি আশা করেছিলে?
বিশেষ কিছু আশা করিনি।
ব্রিজেট শান্ত কণ্ঠে বললো–আমি জানি। তুমি ভেবেছিলে একটা মেয়ে যার বুদ্ধির দৌড় হলো বড়জোর সুযোগ বুঝে তার মনিবকে বিয়ে করা পর্যন্ত।
কতকটা ধৃষ্টতার সঙ্গে লিউক বললো–হতে পারে এমনই কিছু, হয়তো একটা ভেবে নিয়ে ছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো এ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাইনি।
ব্রিজেট বললো–সে কথা আমি বিশ্বাস করি কারণ, ঘটনার একেবারে মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্ত তুমি কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছোও না।
এবার লিউক হতাশ হয়ে বলে–আচ্ছা, লর্ড হুইটফিল্ডও কি ব্যাপার ধরে ফেলেছেন।
না না, গর্ডন কিছুই অবিশ্বাস করে না। ও সহজাত বিশ্বাসী মনের লোক।
যে যাই হোক, আমার অজুহাত কিন্তু মোটের ওপর খুবই কাঁচা।
তোমার ধারণাটা আমার যেন কিরকম মুখস্থ, আমি যেন সবটাই স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি, আর তাতে–খুবই মজাই লাগছিলো।
হ্যাঁ, তা তো লাগবেই। সাধারণতঃ বুদ্ধিমতী মেয়েরা খুব ঠান্ডা মাথায় থোক না তোক নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে।
ব্রিজেট বললো–এ জীবনে যেখান থেকে যতটুকু আনন্দ পাওয়া যায় সেইটুকুই লাভ। আবার বলল–কিন্তু তুমি এখানে কেন এসেছো?
আবার সে একই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে লিউক ব্রিজেটের মুখের দিকে তাকাতেই ওর চোখে চোখ পড়লো। ও কতকটা তন্ময় ভাবে বললো–তোমার কাছে মিথ্যের বোঝা আর না বাড়ানোই ভালো।
খুবই ভালো কথা।
কিন্তু এক্ষেত্রে যা সত্যি তা খুব কদর্যতর শোনো।
লিউক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল–শোন, আমি এখানে এসেছি অনেকটা আন্দাজের ওপর নির্ভর করে। পুরো ব্যাপারটা যেমন অদ্ভুত তেমনই আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব। আমি গিবস্ সেই মেয়েটির মৃত্যুর ঘটনারাশির একটা অংশ মাত্র। আমি জানতে চাই ও ঠিক কীভাবে মারা গিয়েছিলো?
আমিও তাই ভেবেছি।
ওর মৃত্যুর মধ্যে এমন কী আছে যাতে তোমারও কৌতূহল হয়েছে?
ব্রিজেট বললো–আগাগোড়া আমার মনে হয়েছে যে ওর মৃত্যুর মধ্যে একটা অস্বাভাবিকতা আছে, আর তাই আমি তোমাকে মিস ওয়েনফ্লিটের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম।
কেন?
কারণ ঐ ভদ্রমহিলাও আমারই মতো একই কথা ভাবেন।
আচ্ছা!–লিউক আগের ঘটনাগুলো চট করে ভেবে নিলো।–তাহলে উনিও তোমারই মতো ভাবেন যে, এই ঘটনার মধ্যে একটা অন্ধকার দিক আছে?
সম্মতি জানায় ব্রিজেট।
কিন্তু কেন? কারণটা কী?
প্রথম কারণ–টুপির রং।
টুপির রং বলে তুমি কী ইঙ্গিত করতে চাইছো?
আজ থেকে বিশ বছর আগে লোকে টুপি রং করতো। এক এক ঋতুতে এক এক রং; যেমন–গোলাপী, নীল অথবা কালো। কিন্তু আজকাল আর ওসব চলে না।
এমন কি অ্যামি গিবসের মতো মেয়েরাও?
আমি হয়তো বা টুপিতে রং করলেও করতে পারি, কিন্তু অ্যামি করবে না। তাছাড়া আর একটা বিশেষ দিকও আছে, পেইন্টটা ছিলো লাল রঙের।
তাতে কী হলো।
অ্যামি গিবসের চুলের রংও ছিলো লাল-অনেকটা গাজরের মতো।
ব্রিজেট সম্মতি জানিয়ে বলে-গাজরের রঙের চুলের সঙ্গে কেউ লাল রঙের টুপি পরে না। এটা এমনই একটা ব্যাপার যা পুরুষদের বুঝতে পারা সম্ভব নয়, কিন্তু
লিউক বলে–পুরুষদের পক্ষে বুঝতে পারা কঠিন। মিলে যাচ্ছে।
তাড়াতাড়ি করে লিউক বলল–আমি সরকারী গোয়েন্দা নই। জিমি যা তোমায় বলেছে আমি প্রাচ্যে একজন পুলিশ অফিসার ছিলাম, এখন অবসর নিয়েছি।
ও মিস পিঙ্কারটনের সঙ্গে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে তার পরবর্তী ঘটনারাশির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়, আর কেনই বা উইচউডে এসেছে তাও বলে।
তাহলেই দেখো, কী অলীক কাণ্ড! আমি এমন একজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, সে একজন ছদ্মবেশী খুনী, সে হয়তো এখানেই উইচউডে সবার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যদি মিস পিঙ্কারটনের, তোমার আর মিসকী যেন নাম ভদ্রমহিলার? ধারণা সঠিক হয়, তাহলে সেই লোকই অ্যামি গিবসূকে খুন করেছে।
ব্রিজেট বললো বুঝতে পেরেছি।
আচ্ছা, বাইরে থেকে কেউ এসে কি এমন সব কাণ্ড ঘটাতে পারে?
ব্রিজেট বললো–অসম্ভব নয়। রীড এখানকার কনস্টেবল। সদর বাড়ির ছাদ বেয়ে অ্যামির জানলায় উঠেছিলো। জানলা দিয়ে ওর ঘরে যাওয়া মোটেই শক্ত কাজ নয়।
আচ্ছা, যদি ঢুকলোই, কিন্তু ঢুকে কী করলো?
ওষুধের বোতলটা সরিয়ে নিয়ে তার জায়গায় রঙের বোতলটা রেখে দিয়েছিলো।
অর্থাৎ, লোকটা ধরেই নিয়েছিলো যে, অ্যামির ঘুম ভাঙ্গবে আর টুপির রংটাও চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলবে, তারপর লোকে বলবে যে ও হয় ভুল করে ওটা খেয়েছে অথবা আত্মহত্যা করেছে?
হা।
— আচ্ছা, কু-মতলবপ্রসূত কাজ–তেমন কোনো কথা ওঠেনি?
না।
কোনো লোক টুপির রঙের সাহায্যে এটা করেছে তেমন কোনো কথাও ওঠেনি?
না।
তা সত্ত্বেও তোমার মনে এই সন্দেহ হয়েছিল?
মিস পিঙ্কারটনের বুদ্ধি তেমনি একটা প্রখর না থাকায় প্রথমটায় ওঁর কথায় আমি কোনো গুরুত্বই দিইনি। লিউক বললো।
— ব্রিজেট বলে কিন্তু আমি আগাগোড়া ভাবতাম যে উনি খুব দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মহিলা ছিলেন। আচ্ছা, তুমি না বলেছিলে উনি আরও কয়েকটা নাম বলেছিলেন?
লিউক বললো–নাম টমি পিয়ার্স। এছাড়া, কার্টারের নামও বলেছিলেন।
ব্রিজেট বললে–কার্টার, টমি পিয়ার্স, অ্যামি গিবস, ডাঃ আম্বলবি-সবই যেন কেমন অলীক বলে মনে হয়। এরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের থেকে আলাদা ছিলো।
আচ্ছা, এই কার্টার কী করে মারা গেল জানো?
ও নদীতে পড়ে ডুবে মারা যায়। ঐ নদীর ওপরে সরু একটা সাঁকো আছে; সবার ধারণা পা ফসকে গিয়ে নিচে পড়ে যায়।
কিন্তু কেউ একজন খুব সহজেই ওকে ধাক্কা মেরে ফেলেও দিয়ে থাকতে পারে?
তা তো পারেই।
তা হলে এ কথাই দাঁড়াচ্ছে যে নিজেকে সবার সন্দেহের বাইরে রেখে অতি সহজেই এই তিনজনকে খুন করা হয়ে থাকতে পারে?
মিস পিঙ্কারটন কিন্তু তাই সন্দেহ করেছিলেন।
–ব্রিজেট বললো।
লিউক বললো-তুমি কাউকে সন্দেহ করো কিনা, একথা জিজ্ঞেস করা কি অপ্রাসঙ্গিক হবে?
উইচউডে যাদের আমি চিনি বা জানি তাদের সবাইকেই আমার মনে হয়, তারা সুস্থ, সম্মানিত এবং সম্পূর্ণ সাধারণ।
লিউক বলে–আমি জানতাম তুমি একথাই বলবে।
ব্রিজেট বলে–যে কোনো লোক থাকতে পারে; যেমন ধরো-মাংসওয়ালা, রুটিওয়ালা, মুদী, ক্ষেতমজুর বা দুধওয়ালা।
তা হয়তো হতে পারে, তবে আমার মনে হয় যে, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সন্দেহের ক্ষেত্র আরও সীমাবদ্ধ।
কেন?
মিস পিঙ্কারটন বলেছিলেন যে আততায়ীর পরবর্তী শিকারকে তার চোখের শিরশিরে, ঠান্ডা দৃষ্টিতে মেপে দেখতো। ওঁর কথা থেকে আমার ধারণা হয়েছিল। অবশ্য আমারও ভুল হতে পারে।
তুমি হয়তো ঠিকই বলেছে।
লিউক বললো–জানো, তোমায় সমস্ত ব্যাপারটা জানাতে পেরে আমি খুব স্বস্তি পাচ্ছি।
তাতে তোমার উপকারই হবে। আমিও হয়তো কোনো কোনো ব্যাপারে তোমাকে সাহায্য করতে পারবো। কিন্তু এ ব্যাপারে তুমি সত্যিই নিজেকে জড়াবে?
নিশ্চয়ই।
লিউক বললো–লর্ড হুইটফিল্ডের ভূমিকা এ ব্যাপারে কী হবে? তোমার কী মনে হয়।
স্বভাবতই আমরা গর্ডনকে এ ব্যাপারে কিছু বলবো না। বললো ব্রিজেট।
তুমি বলতে চাও যে উনি বিশ্বাস করবেন না?
না না, বিশ্বাস ও ঠিকই করবে। গর্ডন সবকিছুই বিশ্বাস করে। ও দারুণ উৎসাহিত আর উৎফুল্ল হবে এই ঘটনা শুনলে।
তা হলে তো আর ওকে বলা যায় না।
হ্যাঁ, এমন অনাবিল আনন্দ ওকে দেওয়ার উপায় নেই।
লিউক ব্রিজেটের দিকে তাকিয়ে ঘড়ির দিকে দেখে।
ব্রিজেট বলে–এবার আমাদের যাওয়া উচিত।-ও উঠে দাঁড়ায়।
দুজনেই বাড়ির উদ্দেশ্যে নিঃশব্দে পথ চলে।
***
সম্ভাবনা
ওর শোবার ঘরে লিউক বসে। একটা সাদা কাগজ টেনে নিয়ে তাতে কয়েকটা নাম লিখলো–ডাঃ টমাস, মিঃ অ্যাবট, মেজর হর্টন, মিঃ এলসওয়ার্দি, মিঃ ওয়েক, মিঃ জোন, অ্যামির প্রেমিক, কসাই রুটিওয়ালা, মোমওয়ালা ইত্যাদি। ও শিরোনাম দিলো– শিকার, তার নিচে লিখলো–
অ্যামি গিবস : বিষপ্রয়োগ;
টমি পিয়ার্স : জানলা থেকে ধাক্কা;
হ্যারি কার্টার : সরু সাঁকো থেকে ধাক্কা (মাতাল? ওষুধ প্রয়োগ?);
ডাঃ আম্বলবি : রক্তে বিষয়োগ;
মিস পিঙ্কারটন: গাড়ি দিয়ে চাপা দেওয়া;
আরো যোগ করলো ও
মিসেস রোজ
বৃদ্ধ বেন?
একটু থেমে আবার লিখলো
মিসেস হর্টন?
তালিকাটা কিছুক্ষণ দেখে আবার লিখলো–
ডাঃ টমাস : বিরুদ্ধ সম্ভাব্য যুক্তি : ডাঃ আম্বলবির মৃত্যুতে রীতিমত লাভবান। মৃত্যুর পদ্ধতিতে পেশাগত সৌকর্য, যথা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রক্তে বীজাণু প্রয়োগ। অ্যামি গিবস্ যেদিন মারা যায়, সেদিন বিকেল বেলা তার সঙ্গে দেখা করে (ওদের দুজনের মধ্যে কি কিছু ছিলো? ব্ল্যাকমেল?)।
টমি পিয়ার্স : ডাঃ টমাসের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল কিনা জানা যায় না।
হ্যারি কার্টার : কোনো যোগাযোগ আছে বলে জানা যায় না।
যেদিন মিস পিঙ্কারটন লণ্ডনে গেলেন, সেদিন কি ডাঃ টমাস উইচউডে ছিলেন?
একটা বড় নিশ্বাস ফেলে লিউক নতুন করে আরো একটা শিরোনাম লিখলো
মিঃ অ্যাবট : বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুক্তি : (লিউকের ব্যক্তিগত অভিমত-ওকালতি পেশার লোকজন অত্যন্ত খুঁতখুতে, সন্দেহপ্রবণ এবং অমার্জিত হয়ে থাকে)। কিন্তু এক্ষেত্রে ভদ্রলোক অতি প্রাণবন্ত, সহজ, আচরণে মার্জিত। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে গল্প উপন্যাসের চরিত্রের ওপর নির্ভর করলে চলবে না।
ডাঃ অ্যাম্বলবিকে খুন করার উদ্দেশ্য–ওদের দুজনের মধ্যে সবসময়ই একটা অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিলো। অ্যাম্বলবি অ্যাবটকে ঘোরতর অপছন্দ করতেন। মিস পিঙ্কারটন খুব সহজেই এঁদের দুজনের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করে থাকতে পারেন।
টমি পিয়ার্স : অ্যাবটের কাগজপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলো।
হ্যারি কার্টার : কোনো যোগাযোগ পাওয়া যাচ্ছে না।
অ্যামি গিবস : কোনো যোগাযোগ নেই। টুপির রং ব্যবহার করা অ্যাবটের চরিত্রানুগ। যেদিন মিস পিঙ্কারটন খুন হলেন, সেদিন কি অ্যাবট গ্রামে ছিলেন?
মেজর হর্টন : বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুক্তি : অ্যামি গিসের সঙ্গে কোনো সংযোগ ছিলো বলে জানা যায় না। টমি বা কার্টারের ব্যাপারেও তাই। মিসেস হর্টন সম্বন্ধে কোনো সূত্র আছে কি? মৃত্যুর ধরন থেকে মনে হয় যে, আর্সেনিক বিষে ভদ্রমহিলা মারা গেছেন।
বিঃদ্রঃ–টমাস চিকিৎসা করেছে। টমাসের ওপর সন্দেহের আরও একটা কারণ।
মিঃ এলসওয়ার্দি : বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুক্তি : বাজে ধরনের লোক; ব্ল্যাক ম্যাজিক নিয়ে কারবার। অ্যামি গিসের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো। টমি পিয়ার্স বা কার্টারের সঙ্গে কি কোনো সংযোগ ছিলো? জানা যায়নি। আম্বলবির সঙ্গে? হয়তো বা এলসওয়ার্দির মানসিক গঠন নিয়ে বলাবলি করেছেন। মিস পিঙ্কারটন? মিস পিঙ্কারটন যখন খুন হলেন, তখন কি এলসওয়ার্দি উইচউডের বাইরে ছিলো?
মিঃ ওয়েক : বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুক্তি : খুব সম্ভবতঃ খুনী নয়। ধর্মীয় অনুশাসনে খুন করার ব্রত? গল্পে এই পবিত্র পাদ্রীমশাই খুনী হলেও হয়তো হতে পারে।
দ্রষ্টব্য : কার্টার, টমি, অ্যামি–সবাই ধর্মমতের বাইরে। তবে কি স্বর্গীয় আদেশে এদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে?
মিঃ জোনস্ : তথ্য অজানা।
অ্যামির প্রেমিক : অ্যামিকে খুন করার মধ্যে হয়তো যুক্তি আছে; কিন্তু অন্যান্য খুনের কোনো কারণ নেই।
অন্যান্য : নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়।
ওসব লেখাটা পড়ে বলল–একেবারে অসম্ভব। ইউক্লিড কেমন ছন্দবদ্ধভাবে সাজাতে জানে! সবকটি লিস্টই ছিঁড়ে ও একেবারে পুড়িয়ে ফেললো।
নিজের মনে বললো–কাজটা খুব সহজ বলে মনে হয় না।
***
২. ডাঃ টমাস
ডাঃ টমাস
ডাঃ টমাস বেশ রূপবান পুরুষ। গায়ের রং ধবধবে সাদা। তিরিশ বছর বয়স। চোখেমুখে সর্বদাই একটা চমকে ওঠা অভিব্যক্তি। কিন্তু ভদ্রলোক যে অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোক, অচিরেই লিউক তার প্রমাণ প্রায়। ডাঃ টমাসের চেম্বারে আসার অজুহাতে হিসেবে লিউক নিজের গেটে বাতের কথা বলে। ওর অসুখের কথা শুনে টমাস যে ওষুধ দেন তা হার্লি স্ট্রীটের বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ মাত্র সপ্তাহখানেক আগে দিয়েছিলেন।
লিউক বললো–ধন্যবাদ। শুনে আশ্বস্ত হলাম যে আমার অসুখটা সেরে যাবে।
ডাঃ টমাস হেসে বললেন–না, না, তেমন বিপদ আছে বলে মনে হয় না মিঃ ফিস উইলিয়াম্।
লিউক বললো–সে যাই হোক, আপনি কিন্তু আমাকে বেশ নিশ্চিন্ত করলেন।
আসলে আপনার এই অসুখে কোনো রকম জটিলতা নেই।
আমি তো ভেবেছিলাম যে, এই গেঁটে বাতের প্রকোপে জবুথবু হয়ে একেবারেই অথর্ব হয়ে যাবো।
লিউক তাড়াতাড়ি বললো–পুরুষ মানুষেরা সাধারণতঃ এ ভাবেই খুব তাড়াতাড়ি অথর্ব হয়ে পড়ে।
ডাঃ টমাস প্রশ্ন করলেন–আপনি ম্যাজিক নিয়ে একখানা বই লিখেছেন না মিঃ ফিস উইলিয়াম?
লিউক আশ্চর্য হয়ে বললো–আপনি এ কথা কি করে জানলেন?
তিনি বললেন–আমাদের এখানকার মত জায়গায় সব খবরই তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে; তার কারণ আমাদের প্রসঙ্গ বড়ই অল্প।
একদিন হয়তো শুনবেন যে আমি স্থানীয় মৃত আত্মাদের আর ডাইনীদের ডেকে ধরাতলে এনেছি।
আপনার কথাটা কিন্তু বেশ তাৎপর্যপূর্ণ!
কেন?
ইতিমধ্যেই আপনার সম্পর্কে গুজব রটেছে যে আপনি না কি টমি পিয়ার্সের প্রেতাত্মাকে এনেছেন।
পিয়ার্স? ও, সেই ছেলেটি যে জানলা থেকে পড়ে গিয়েছিলো?
হা।
আমি ভেবে পাচ্ছি না একথা কী করে রটলো; আমি সেই উকিল ভদ্রলোকের কাছে প্রসঙ্গটা করেছিলাম–কী যেন নাম–অ্যাবট।
হ্যাঁ, অ্যাবটের কাছ থেকেই গল্পটা রটেছে।
তা হলেই বুঝুন।
আপনি নিজে ভূতে বিশ্বাস করেন?
না, তবে আকস্মিক অথবা বীভৎস মৃত্যুর ক্ষেত্রে নানা রকম অদ্ভুত লক্ষণের কথা জানি–সে সম্পর্কে আমি বেশি আগ্রহী। যেমন ধরুন, প্রচলিত আছে যে, কোনো খুন হওয়া তোক নাকি তার কবরে বিশ্রাম করতে পারে না। আমি ঠিক বুঝতে পারি না যে এসব কথা লোকে কী করে ভাবতে পারে!
টমাস্ বলেন–আজকাল বেশির ভাগ লোকই এই সমস্ত গল্প বিশ্বাস করে না।
বেশ প্রশান্তিময় আপনাদের এই গ্রাম। কোনো দুষ্কার্য হবার মত জায়গা এটা নয়;তবে হতে পারে যদি কেউ সেই ছোট্ট টমিকে জানলা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে থাকে।
মনে হচ্ছে ছেলেটা একেবারে নচ্ছার ধরনের ছিলো, ওকে এই দুনিয়া থেকে সরানো হয়তো বা জনহিতকর কাজ হিসেবে নেওয়া যেতে পারে।
তা হয়তো সত্যি; তবে এই ধরনের জনহিতকর কাজ করাতো আর সম্ভব নয়।
লিউক বললো–আপনার কি মনে হয় না যে বেছে বেছে অপ্রয়োজনীয়দের অপসারণ সমাজের পক্ষে মঙ্গলদায়ক?
তা কথাটা মন্দ বলেননি।
লিউক বলে–অর্থাৎ আপনি গুরুত্ব দিচ্ছেন না। আমি কিন্তু দিচ্ছি। কোনো মানুষ যদি প্রগতির বিরুদ্ধে কাজ করে, আমার মতে তাকে অপসারণ করা উচিত।
ডাঃ টমাস বলেন–স্বীকার করেছি। কিন্তু কোনো মানুষ উপযুক্ত আর কোনো মানুষ উপযুক্ত নয় তার বিচার কে করবে?
লিউক স্বীকার করে-সেটা একটা কঠিন কাজই বটে।
ডাঃ টমাস বলেন–আমার কাজ হচ্ছে স্বাস্থ্যহীনের স্বাস্থ্য ফিরিয়ে দেওয়া এবং আমি স্বীকার করছি যে, সেটাই একটা প্রচণ্ড রকম দুরূহ কাজ।
লিউক বললো–আচ্ছা, তর্কের খাতিরে ধরা যাক যে মৃত হ্যাঁরী কার্টার
ডাঃ টমাস চমকে উঠলেন–কার্টার? আপনি সেই সেভেন স্টারএর বাড়িওয়ালার কথা বলছেন?
হ্যাঁ, সেই লোকটাই। আমি লোকটাকে চিনি না। তবে আমার বোন মিস কনওয়ে ওর সম্বন্ধে বলেছিলেন।
হ্যাঁ, ও খুব মদ খেতো, বউ-মেয়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতো।
তার মানে ও বিদায় হওয়ায় পৃথিবী ভারমুক্তই হয়েছে?
এ কথাটা খুব একটা অযৌক্তিক নয়।–টমাস মন্তব্য করলো।
ও নিজে পড়ে না গিয়ে কেউ যদি ধাক্কা দিয়ে ওকে নদীতে ফেলে দিয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে যে সে একরকম জনহিতকর কাজই করেছে।
টমাস বললো–আপনি যেসব পদ্ধতির কাজ বলছেন,সেখানকার লোকজনদের ওপর প্রয়োগ করেছেন?
লিউক হেসে বললো–না, না, এটা আমার অভিমত। কখনও প্রয়োগ করে দেখিনি।
হঠাৎ লিউক বললো–বলুন তো, আপনি নিজে কখনো এমন লোক দেখেছেন যাকে দেখে খুনী বলে মনে হয়েছে?
টমাস তীব্রস্বরে বলে উঠলেন–সত্যিই কী অসাধারণ প্রশ্ন!
তাই কি? একথাটা কি অস্বীকার করতে পারেন যে, একজন ডাক্তারকে কত রকমের বিচিত্র চরিত্রের লোকজন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়? তাঁর পক্ষে একজন নেশাগ্রস্ত খুনী চিনে বের করা তুলনামূলক ভাবে অনেক সহজ।
রাগত স্বরে টমাস বলেন–খুন করা যাদের নেশা তাদের সম্পর্কে আপনার জ্ঞান দেখছি একেবারেই মামুলি। কিন্তু আমি আপনাকে বলছি শুনে রাখুন, নেশাগ্রস্ত খুনীকে চিনতে পারা দুনিয়ার কঠিনতম কাজের মধ্যে একটি।
আপনি ঠিক বলছেন কি?
নিশ্চয়ই ঠিক বলছি। একজন নেশাগ্রস্ত খুনী যখন খুন করে, সে তখুন ধরে নেয় যে, সে আত্মরক্ষার্থে খুন করছে। অবশ্য এমন খুনীও আছে, যারা আপনার আমার মত স্বাভাবিক এবং সাধারণ মানুষ।
আপনি হয়তো একদিন আবিষ্কার করে বসবেন যে আমি নিজেই গোটা পাঁচ ছয় খুন করেছি।
ডাঃ টমাস হাসলেন–আমার মনে হয় না তেমন ঘটনা ঘটবে মিঃ ফিৎস উইলিয়াম।
দুজনেই হেসে উঠলো।
লিউক দাঁড়িয়ে উঠে নমস্কার করে বললো–আমি আপনার অনেকটা সময় নষ্ট করে দিলাম।
ঠিক আছে, আমি মোটেই ব্যস্ত নই। বাইরে কারুর সঙ্গে কথা বলতে পারলে বেশ ভালো লাগে।
আমিও ভাবছিলাম যে–হঠাৎ লিউক থেমে যায়।
কিছু বলছিলেন?
মিস কনওয়ে যখন আমাকে এখানে পাঠান তখন আমাকে বলেছিলেন যে আপনি অত্যন্ত মেধাবী লোক।
নিজের প্র্যাকটিস আরম্ভ করার দিক থেকে একেবারে খারাপ নয়–ভালো অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়।
কিন্তু এমন একটা আবদ্ধ জায়গায় কি জীবন কাটিয়ে দিতে পারবেন? শুনেছি, আপনার অংশীদার ডাঃ আম্বলবির খুব একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিলো না? আচ্ছা, উনি নিশ্চয়ই এখানে বহুদিন বাস করেছেন?
বলতে গেলে সারাজীবন।
লিউক পরিহাসের সুরে বলল–শুনেছি উনি খুব সুন্দরী একটি মেয়ে রেখে গেছেন।
টমাস বললেন–তা–ঠিকই শুনেছেন।
তারপর বললেন–আমরা যে অপরাধতত্ত্ব নিয়ে কথা বলছিলাম, তার ওপর লেখা একখানা ভালো বই আপনাকে আমি দিতে পারি। বইখানা জার্মান ভাষায় অনুবাদ, Kreuzheimmer-এর হীনতা এবং অপরাধ।
লিউক বললো-ধন্যবাদ।
ডাঃ টমাস বইখানা বের করে লিউকের হাতে দিয়ে বললেন–এই নিন। এর কোনো কোনো বিষয় সত্যিই খুব চমকপ্রদ। যদিও বিষয়গুলির বেশির ভাগই কেবলমাত্র মতামত সর্বস্ব, কিন্তু বেশ মজাদার; যেমন ধরুন, ফ্রাঙ্কফুর্টের কসাই Menzheld-এর ছোটোবেলাকার জীবন। তারপর আর একটা অধ্যায় আছে খুনী নার্স Anna Helm-এর ওপর, খুব ভালো লাগবে।
লিউক বললো–ওকে যখন পুলিশ ধরলো, তার আগেই ডজনখানেক খুন নির্ঘাৎ করে ফেলেছিলো।
ডাঃ টমাস বললেন–হ্যাঁ, ওর ব্যক্তিত্বের মধ্যে একটা সহানুভূতি মাখানো ভাব ছিলো। ছেলেমেয়েদের প্রাণ দিয়ে দেখাশোনা করতো; আবার তাদের পর পর মৃত্যুতে একেবারে ভেঙ্গে পড়তো। অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব।
আমার ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে এই সমস্ত লোক কী করে খুনখারাপি করে সেরে যেতে পারে।
খুব একটা আশ্চর্যের কিছু নয়; ব্যাপার খুবই সহজ।–ডাঃ টমাস বললেন।
কী সহজ?
সেরে যেতে পারা।–তারপর হেসে বললেন–কেবল মাত্র যদি সাবধান হওয়া যায়। আসল কথা সাবধান হতে পারাটা। একজন বুদ্ধিমান লোক কখনোই এ সমস্ত ব্যাপারে ভুল করবে না এবং ভুল না করলেই সেরে যেতে পারে।
কথা শেষ করে ডাঃ টমাস ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন।
নিজেকে একজন বুদ্ধিমান লোক ভাবতো লিউক আর ডাঃ টমাসকে ভেবেছিলো সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন একজন লোক। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সেই ধারণা পালটে গেল। ডাক্তারের এ শিশুসুলভ হাসি–কোনো পাকা বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের।
***
মিসেস পিয়ার্সের জবানবন্দী লিউকের ফুটবল খেলার পাতা খুললেই আক্ষেপ হয় যে, একটুর জন্যও একশো কুড়ি পাউণ্ডের বাজিটা জিততে পারলো না। মিসেস পিয়ার্স ওর এইকথায় সহানুভূতি জানিয়ে বলেন যে, তার স্বামীও এভাবে মাঝে মাঝেই নিরাশ হয়ে থাকেন। এইরূপ কথোপকথনের দ্বারা দুজনের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
মিসেস পিয়ার্স বলেন–মিঃ পিয়ার্স ফুটবল খেলায় একজন অদম্য উৎসাহী, আর যেমন বললাম –বহুবার হতাশও হয়েছেন। তবে কপালে না থাকলে জেতা যায় না।
লিউকও এই কপালতত্ত্বে আন্তরিক সায় দিয়ে বলে–যখন আসে তখন কষ্ট দুঃখ সব একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে আসে।
কথার মতো একটা কথা বলেছেন–আমি মর্মে মর্মে একথা জানি। মিসেস পিয়ার্স বলেন–বিশেষ করে যে মহিলার স্বামী আর আট ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘর আর আটটির মধ্যে দুটিই কবরের তলায়–সে কথা ভালো করেই জানে।
লিউক বলে–সে তো জানবেই। আপনার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে দুজনই বুঝি মারা গেছে?
মিসেস পিয়ার্স বলেন–একটি তো মাত্র এই মাসখানেক আগেই গেল।
আহা, বড়ই দুঃখের ব্যাপার তো?
শুধুই দুঃখের কী বলছেন? কী যে দারুণ আঘাত পেয়েছিলাম। টমি যে এভাবে চলে যাবে, একথা ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করিনি। বেঁচে থাকতে ও আমায় অনেক জ্বালিয়েছে, কিন্তু এভাবে চলে গেল?
সমবেদনা জানিয়ে লিউক প্রসঙ্গটা ভালো মেয়ে এমা থেকে টমিতে সরিয়ে আনলো।
আপনার ছেলে বুঝি অল্পদিন আগেই মারা গেছে?
হ্যাঁ, একটা দুর্ঘটনা ঘটলো–যে বাড়িতে আমাদের লাইব্রেরি–সেই বাড়ির জানলা সাফ করছিলো। আর পা হড়কে সেই উঁচু থেকে পড়ে গেল।সেই দিনকার ঘটনার বর্ণনা দেন মিসেস পিয়ার্স।
লিউক জিজ্ঞেস করে–আচ্ছা, কেউ কি একথা বলেছে যে, ওকে জানলার আলসেতে দাঁড়িয়ে নাচানাচি করতে দেখা গেছে?
মিসেস পিয়ার্স বললেন–অল্পবয়সী ছেলেরা বয়স অনুযায়ীই আচরণ করবে; তাই নিয়ে খুঁত খুঁতে স্বভাবের মেজর হর্টন অত হৈ চৈ না করলেই পারতেন।
মেজর হর্টন?
হ্যাঁ, এক দঙ্গল কুকুর নিয়ে ভদ্রলোক থাকেন। দুর্ঘটনা ঘটার পর উনি বলেন যে টমি খুব অসাবধান ছিলো; কিন্তু আমার মন বলে যে ও নিশ্চয়ই হঠাৎ কিছু একটা দেখে এতই চমকে উঠেছিলো যে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়। তবে এই বয়সের ছেলেরা এমনটা তো হয়ই–কিন্তু ওর মনটা খারাপ ছিলো না।
না না, সে তো ছিলোই না; তবে কথা কি জানেন মিসেস পিয়ার্স? আমরা এই মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকেরা প্রায়ই ভুলে যাই যে আমরাও একদিন ছোটো ছিলাম।
একটু হেসে লিউক জিজ্ঞেস করে–যাদের কাছে কাজ করতো তাদের সঙ্গে বুঝি দুষ্টুমি করতো?
মিসেস পিয়ার্স উত্তর দেন-ও তাদের নিয়ে একটু মজা করতো-ব্যস এইটুকুই। আমাদের হাসাবার জন্য ও কখনও বা মিঃ এলসওয়ার্দির কখনও বা চার্চের পরিচালক মিঃ হবসের গলার নকল করতে তাদের মতো কথা বলতো। আবার কখনও বা বাগানের মালীদের কাছে গিয়ে খোদ লর্ডের অনুকরণ করে ওদের হাসাতো। এজন্যই তো লর্ড ওকে ছাঁটাই করেছেন; তবে ওর ওপর কোনো রাগ-বিদ্বেষ ছিলো না। পরে লর্ড নিজেই ওকে আর একটা চাকরি যোগাড় করে দিয়েছিলেন।
কিন্তু আর কেউ ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতো না?
না তা করতো না। কারও নাম করা উচিত নয়; তবে যেমন ধরুন মিঃ অ্যাবট সবার সঙ্গেই খুব ভালো ব্যবহার করেন; ওঁকে নিয়ে কথা বলা উচিত নয়।
টমি কি ওঁর সঙ্গে কোনো ঝামেলায় পড়েছিলো।
মিসেস পিয়ার্স বলেন–ঠিক তা নয়, তবে কথা হচ্ছে যে, যেসব কাগজপত্র খুব প্রয়োজনীয় এবং গোপনীয়, তেমন কাগজপত্র টেবিলের ওপর না রাখাই ভো উচিত–অন্ততঃ আমি তো তাই বুঝি।
লিউক বলে–সে তো নিশ্চয়ই।
খুব খাঁটি কথা। আমারও ওই একই কথা; মিঃ পিয়ার্সও এই কথাই বলেন। টমি কিন্তু সেইসব কাগজপত্র পড়েও দেখেনি।
আচ্ছা, ওগুলো কী ছিলো? উইল?
না না, ওসব নয়। তেমন কিছু দরকারী কাগজ নয়–একটা ব্যক্তিগত চিঠি, একজন মহিলার লেখাটমি নামটা পর্যন্ত দেখেনি। তাইতো বলি, তুচ্ছ একটা ব্যাপার নিয়ে এতটা হৈচৈ না করলেই হতো।
মিঃ অ্যাবট বুঝি সহজেই সব কিছুতে দোষ ধরেন? লিউক জিজ্ঞেস করে।
তাই তো মনে হয়। শুনেছি ভদ্রলোকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করাটা বেশ শক্ত। এই তো দেখুন, ডাঃ আম্বলবির সঙ্গে দারুণ খটাখটি ছিলো, দুজনের সম্পর্ক ছিলো যেন একেবারে সাপে-নেউলে। কিন্তু এখন যদি মিঃ অ্যাবটের সেই সমস্ত কথা মনে পড়ে, তাহলে নিশ্চয়ই ওঁর খুব খারাপ লাগবে কারণ, মারা গেলে তার ওপর আর রাগ বিরক্তি দেখাতে নেই; অথচ দেখুন, রূঢ় কথা একবার বলে ফেললে তা তো আর ফেরত নেওয়া যায় না।
লিউক বললো-খুবই সত্যি কথা। আম্বলবিকে কঠিন কথা বলা আর তার মৃত্যু; আবার টমির সঙ্গে খারাপ আচরণ করা–তার কয়েকদিন পরে সেও মারা গেল। আমার মনে হয়, এ ধরনের পর পর দুটো অভিজ্ঞতার ফলে মিঃ অ্যাবট ভবিষ্যতে নিজের জিভকে সংযত করবেন।
মিসেস পিয়ার্স বললেন–সেভেন স্টারস-এর হ্যারী কাটার জলে ডুবে মরবার কয়েকদিন আগে ওর সঙ্গেও দারুণ কথা কাটাকাটি হয়েছিলো। তবে এর জন্য মিঃ অ্যাবটকে দোষ দেওয়া যায় না। হতভাগী মিসেস কার্টার! কী কষ্ট করেই সে ওর সঙ্গে ঘর করতো! কার্টার মারা যাওয়ায় একদিক থেকে ওর ভালোই হয়েছে।
কার্টারও একটা মেয়ে রেখে গেছে না?
মিসেস পিয়ার্স বলেন–ও এই কথা। কিন্তু আমি কিছুতেই গুজব ছড়াবো না।
আগ্রহভাবে লিউক অপেক্ষা করলো।
আমি কখনোও বলি না যে একমাত্র কথার কথা ছাড়া আর কিছু আছে। লুসী কার্টার একদিক থেকে দেখতে শুনতে বেশ ভালো মেয়ে। তবে লোকে যা বলে তাও তো অস্বীকার করা যায় না–বিশেষ করে কার্টার গিয়ে ওর বাড়িতে এমনভাবে গালমন্দ আর চেঁচামেচি করার পর।
লিউক বললো–মিঃ অ্যাবটকে দেখলেই মনে হয় যে ভদ্রলোক অল্পবয়স্কা সুন্দরী মেয়েদের খুবই পছন্দ করেন।
মিসেস পিয়ার্স বলেন–সব পুরুষের ক্ষেত্রেই একথা খাটে। তা সত্ত্বেও যে ভদ্রলোক–সে ভদ্রলোকই থাকে; তবে শেষ পর্যন্ত সবই লোকের চোখে পড়ে। এমন ছোটো জায়গায় কিছুই গোপন থাকে না।
লিউক বলে–এই জায়গাটা কিন্তু খুব সুন্দর; একেবারে নিষ্পাপ বলে মনে হয়। আপনাদের এখানে তো জমকালো এক নতুন ইনস্টিটিউট রয়েছে।
মিসেস পিয়ার্স বললেন–লোকে অবশ্য বলে যে বাড়িটা খুব সুন্দর। আমাদের মহামান্য লর্ড সাহেব এই জায়গাটার জন্য অনেক কিছুই করেছেন, এ কথা আমরা সবাই জানি।
প্রশ্ন করে লিউক–কিন্তু ওঁর প্রচেষ্টা খুব একটা সার্থক হয়নি, তাই না?
শত হলেও উনি তো আর মিস ওয়েনফ্লিট বা মিস কনওয়ের মত অভিজাত ভদ্র নন। অবশ্য উনিই এখন লর্ড সাহেব হয়েছেন–ধনী হয়েছেন, কিন্তু তাতেই কি সব হয়, বলুন?
না, তা হয় না।
এইসব কথা বললাম বলে কিছু মনে করবেন না। আমি জানি যে আপনি ওই ম্যানর হাউসে থাকেন এবং একটা বই লিখছেন। তবে আপনি তো মিস কনওয়ের আত্মীয়; আর সেটাই হলো আসল কথা। মিস কনওয়ে ওই অ্যাশম্যানরের মালকিন হবেন শুনে আমরা সবাই খুব আনন্দিত।
দেখতেই পাচ্ছি যে আপনারা তাতে যথার্থ আনন্দিত।
লিউক এবার বিদায় জানিয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো।–এই হতচ্ছাড়া গ্রাম আমাকে যেন গ্রাস করতে বসেছে। দেখতে কেমন সুন্দর, শান্ত হাসিখুশী, নিষ্পাপ–অথচ এখানেই একের পর এক বিচিত্র খুনের প্রবাহ বয়ে চলেছে। না কি আমি নিজেই পাগল হয়ে গেলাম?
ও একবার অপাঙ্গদৃষ্টিতে হাই স্ট্রীটের দিকে তাকালো। ওর কাছে সবই যেন কেমন অসত্য বলে মনে হলো। আপন মনে ও বলে উঠলোনা, এসব ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়। তার পরমুহূর্তেই আবার ভাবলো এখানে সব কিছুই ঘটা সম্ভব; খুন, জখম, নিষ্ঠুরতা, ডাইনীতত্ত্ব–সবই এখানে সম্ভব।
মাথা তুলে লিউক দূরে তাকিয়ে দেখতে পেলো দুটো অস্পষ্ট দেহ চলেছে। দূরত্ব সত্ত্বেও ও দুজনকেই চিনতে পারলো। একজন এলসওয়ার্দি অপরজন ব্রিজেট। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেন ওরা দুজন এক স্বপ্নরাজ্য থেকে নেমে এসে নিঃশব্দে ঘাসের ওপর দিয়ে বেড়ালের মত লাফিয়ে চলেছে। এইভাবে দেখে ওর ব্রিজেট সম্পর্কে অদ্ভুত পুরানো অনুভূতিই আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।
নিজের মনে ও বললো–আমাকেই ডাইনীতে পেয়েছে! এ আর কিছুই নয়–ডাইনীর প্রভাব!
নিশ্চল হয়ে ও দাঁড়িয়ে রইলো। ওকে এক অদ্ভুত ভাবনা নিথর করে দিলো। প্রশ্ন জাগলো ওর মনে–এই রহস্যের কিনারা কে করতে পারবে? কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।
***
রোজ আম্বলবি
লিউক পেছনে সামান্য শব্দ হতে চমকে একেবারে ঘুরে দাঁড়ালো। একটি অপরূপ সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি সামনা সামনি হতেই যেন কতকটা বিব্রত হয়ে পড়লো।
প্রশ্ন করলো মেয়েটি–আপনিই মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম?
হ্যাঁ,আমিই
আমার নাম রোজ আম্বলবি। ব্রিজেট বললো যে, আমার বাবার পরিচিত কয়েকজনকে আপনি চেনেন।
লিউক আমতা আমতা করে বললো–সে বহুদিন আগের ব্যাপার। আপনার বাবার বিয়ের আগে তারা ওঁকে চিনতেন–উনি তখন পূর্ণবয়স্ক যুবক ছিলেন।
রোজ আম্বলবি নিরাশ হয়ে বললো–আপনি তো একটা বই লিখছেন তাই না?
হ্যাঁ, এই আর কি–গ্রাম্য আচার-বিচার সংস্কার ইত্যাদির ওপর ছোটোখাটো একটা নোট লিখছি।
শুনে কিন্তু মনে হচ্ছে যে বইটা দারুণ হবে।
মোটেই না, বরঞ্চ ঘোলা জলে ডোবার মতোই এক নৈরাশ্যময় ব্যাপার হবে।
না না, তা কেন হতে যাবে?
লিউক হেসে রোজ আম্বলবিকে বললো–কেউ কেউ আছে যারা একটা উৎসাহোদ্দীপক বিষয়েও একেবারে জলো করে ফেলে, আমি তাদেরই একজন।
কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে তেমনটি হবে কেন?
তা জানি না, তবে আমার মনে হচ্ছে তেমনই একটা কিছু হবে।
রোজ আম্বলবি হেসে বলে–আচ্ছা আপনি এই সংস্কার, কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন?
খুব কঠিন প্রশ্ন-উত্তর দেওয়া শক্ত। তবে কথা হচ্ছে যে, বিশ্বাস না থাকলেও তাতে উৎসাহ থাকতে বাধা নেই।
তা অবশ্য নেই।-রোজ বলে।
আপনি নিজে এসব বিশ্বাস করেন?
না, না, আমার বিশ্বাস নেই; তবে সুসময়, দুঃসময় মানি।
সরাসরি লিউক প্রশ্ন করে–ভাগ্য?
দুর্ভাগ্য–সৌভাগ্য–এসব মানি। দেখুন না, পরপর কত লোক মারা গেলেন। এই তো মাত্র সেদিন বাবা চলে গেলেন, মিস পিঙ্কারটন গাড়ি চাপা পড়লেন, সেই ছোট্ট ছেলেটা জানলা থেকে পড়ে গেলো; এই সব চোখে দেখে আমার মনে হয় এই জায়গাটার ওপর দুগ্রহ ভর করেছে।
আপনি তাহলে ঘটনাগুলিকে এভাবে দেখছেন?
আমি জানি যে এগুলো বাজে ধারণা; বাবা হয়তো এমনিতেই মারা যেতেন–কিন্তু হঠাৎই চলে গেলেন। তার ওপর আবার মিস পিঙ্কারটনও গেলেন। উনি কয়েকটা কথা বলেছিলেন। –শিউরে উঠলো রোজ আম্বলবি।
উনি কী বলেছিলেন? ভদ্রমহিলা খুব হাসিখুশি স্বভাবের ছিলেন।
রোজ বলল–আপনি চিনতেন? ওঁকে আমার খুব ভালো লাগতো। কিন্তু আমার অনেক সময় সন্দেহ হতো যে ওঁর মাথায় কোনো গণ্ডগোল আছে কি না।
কেন?
কারণ উনি প্রায়ই কতকগুলো অদ্ভুত কথা বলতেন। সর্বদা ওঁর একটা ভয় ছিলো যে, বাবার একটা কিছু বিপদ ঘটবে। আমার কিন্তু মনে হয় মিঃ লিউক যে, ওঁর একটা তৃতীয় চোখ ছিলো; এবং এ থেকেই হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাবার একটা বিপদ-আপদ ঘটবে।
লিউক বলে–কখনো কখনো মানুষ ভবিষ্যৎকে দেখতে পায় এবং ঐ দেখতে পাওয়াটা সব সময়ে ভুতুড়ে কাণ্ড নয়।
আমার তাই মনে হয়।
লিউক বলে–দুশ্চিন্তা করবেন না। যা ঘটার ঘটে গেছে। অতীতের জন্য দুর্ভাবনা করে কোনো লাভ নেই।
তা ঠিক, কিন্তু রোজ ইতস্ততঃ করে বলে–আপনার বোনের জন্য আমার চিন্তা হয়।
আমার বোন? ব্রিজেট?
হ্যাঁ, মিস পিঙ্কারটনও ওকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলেন। ব্রিজেটের জীবন নিয়ে ওঁর একটা আতঙ্ক ছিলো।
লিউক ঘাবড়ে গেলো। সেই লোকটার সঙ্গে ব্রিজেট একা আসে। এলসওয়ার্দির কুৎসিত মাংসল হাত দুখানা ওর মানস চক্ষে, ভেসে ওঠে, না না,-এ হতে পারে না। এলওয়ার্দি একজন সাধারণ দোকানদার–কারও ক্ষতি করার মত শক্তি ওর নেই।
বুঝতে পেরে রোজ বললো-এলসওয়ার্দিকে আপনার ভালো লাগে?
একেবারেই না।
জিওফ্রে মানে, ডাঃ টমাসও ওকে পছন্দ করেন না।
আপনি?
আমিও না। দেখলেই কেমন বিকট মনে হয়। শুনেছি ডাইনীদের মাঠেও নাকি কি সব অদ্ভূত পুজো-পার্বণ করে আর তাতে ওর অনেক বন্ধু লণ্ডন থেকে এসে যোগ দেয়। টমি পিয়ার্স ছিলো ওদের একজন চেলা।
প্রশ্ন করে লিউক–টমি পিয়ার্স?
হা!
এসব কবেকার ঘটনা?
অনেক দিন আগের–মনে হয় গত মার্চ মাসের।
এই গ্রামে যা কিছুই ঘটতো, তার সবকিছুর মধ্যেই টমি পিয়ার্স থাকতো।
ও দারুণ কৌতূহলী ছিলো; সব কিছুই ও জানতে চাইতো।
শেষকালে ও বোধ হয় একটু বেশি জেনে ফেলেছিলো–গম্ভীর হয়ে লিউক বললো।
রোজ বললো–ও অতি জঘন্য চরিত্রের ছেলে ছিলো।
তার মানে ওর মৃত্যুতে কেউ খুব একটা দুঃখিত হয়নি?
আমার তো তাই মনে হয়।
শুনেছি তাঁর দুঃখ ভুলবার জন্য আরও ছ-ছজন বিদ্যমান। ভদ্রমহিলার জিভখানা কিন্তু খুব জোরালো।
হা, অত্যন্ত বেশি কথা বলে।
ওঁর দোকান থেকে কটা সিগারেট কিনে এখানকার প্রতিটি লোকের নাড়ি-নক্ষত্র আমার জানা হয়ে গেছে।
রোজ বলে–এ সমস্ত জায়গার এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় দোষ–সবাই সবার সব কিছু জানে।
লিউক বলে–না না, তা হতেই পারে না। একজনের সবটুকু সত্য অন্য আর একজন কখনোই পুরোপুরি জানতে পারে না।
রোজ বলে–সত্যি কথাই বলেছেন।
এমন কি একজনের নিকটতম পরমাত্মীয় সব কথা জানতে পারে না।
রোজ বলে–আপনার কথাই ঠিক; তবে এসব ভয় পাইয়ে দেবার মত কথা আর বলবেন না।
এতে আপনি ভয় পান?
রোজ বললো–পাই। তারপর হঠাৎ বললো–এবার আমায় ফিরতে হবে। আপনার যদি সময় হয়-একবার আমাদের বাড়িতে আসুন না।
তারপর রোজ আম্বলবি চলে গেল।
লিউক বেশ কিছুক্ষণ অপসৃয়মাণ রোজের দিকে তাকিয়ে রইল। বড় একা মনে হলো নিজেকে। কিন্তু ও নিজেকে প্রশ্ন করলো–এই ইচ্ছে আমার হলো কেন? একথা সত্যি যে রোজ আম্বলবি মাত্র অল্প কদিন আগে ওর বাবাকে হারিয়েছে, কিন্তু ওর মা আছে-তা ছাড়া আছে একজন সুদর্শন এবং প্রতিষ্ঠাবান পুরুষও যার বাগদত্তা। তাহলে লিউক ফিৎস্ উইলিয়াম, তোমার এই মহৎ বাসনার কারণ কী? এ কি পুরুষের চিরন্তন রক্ষকের ভূমিকা? কিন্তু আজকাল এটা একেবারেই অচল। ভিক্টোরিয়ান যুগের ভাবধারা এই আধুনিক যুগে আঁকড়ে থাকার নামই অস্বাভাবিকতা।
লিউক নিজেকে বললো–সে যাই হোক, মেয়েটিকে আমার ভালো লেগেছে। টমাসের মত ধূর্ত আর চতুর লোকের পক্ষে ও একেবারেই বেমানান।
তারপর লিউক রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থেমে গেল। লিউক দেখল এলসওয়ার্দি সেই পথেই আসছেন। এলসওয়ার্দি বলল
ও, মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম! নমস্কার, নমস্কার।
প্রত্যুত্তরে লিউক নমস্কার জানিয়ে বলে–প্রাকৃতিক শোভা দেখছিলেন বুঝি?
এলসওয়ার্দি বললো-না না, তা নয়। আমি প্রকৃতিকে সযত্নে এড়িয়ে চলি। আমি সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করি যে প্রকৃতিকে এড়াতে না পারলে কোনো লোকই নিজেকে উপভোগ করতে পারে না।
কিন্তু তা কী করে সম্ভব?
পথ আছে। এমন সুন্দর ছোট্ট জায়গায়ও আনন্দ পাবার মতো বহু রকমের উপায় আছে, আর সেই উপায়ও আমার জানা আছে। আমি জীবনকে উপভোগ করি মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম।
সে তো আমিও করি।
একটা কথা বলি শুনুন। মানুষের চরিত্রে পরিপূর্ণ সুস্থতা এবং স্বাভাবিকতা একটা ভয়ানক রকমের একঘেয়েমী।
কতকটা কুষ্ঠরোগীর বাঁকা চাহনির মতো। যোগ করে লিউক।
খুব ভালো কথা বলেছেন; আপনার বুদ্ধির ধার আছে। সে যাই হোক্, আপনি বেড়াতে বেড়িয়েছেন সুতরাং আপনাকে আর আটকে রাখবো না।
আপনার যেমন অভিরুচি–লিউক কথাটা বলে একটু ঝুঁকে বিদায় জানায়।
নিজের মনে লিউক ভাবে–আমি বোধহয় বড্ড বেশি কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠেছি–আসলে লোকটা একটা প্রথম শ্রেণীর গাধা।
আরও তাড়াতাড়ি পা চালায় ও। যখন ও রোজ আম্বলবির সঙ্গে কথা বলছিলো, তখন মেঘশূন্য আকাশে সূর্যের আলো ছিলো; এখন আবার বেশ ঘন হয়ে মেঘ করেছে।
লিউক রাস্তার কোণে এসে বাঁক নিতেই একটা সবুজ মাঠে এসে পড়লো। ও শুনেছে, এই মাঠটাকে ডাইনীদের চারণভূমি বলা হয়।
ও ব্রিজেটকে দেখে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। লিউক প্রায় ছুটে ব্রিজেটের কাছে পৌঁছলো।
ব্রিজেট?
ব্রিজেট মুখ তুলে লিউকের দিকে তাকালো। ওর মুখখানা দেখে লিউকের বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেন ও অন্য আর এক দুনিয়ায় বাস করছে।
লিউক বলল–তুমি–তুমি ভালো আছো তো?
কোনো উত্তর দিলো না ব্রিজেট। লিউকের মনে হলো যেন ওর প্রশ্নটা সুদূর পথ অতিক্রম করে ব্রিজেটের কাছে তখনও পৌঁছয়নি।
ব্রিজেট কিছুক্ষণ পর উত্তর দিলো–আমি তো ভালোই আছি। ভালো না থাকার মতো, কিছু কি হয়েছে?
হেসে উঠলো লিউক–আমি নিজেই কি আর জানি যে, কী হয়েছে? তবে হঠাৎ তোমার সম্পর্কে একটা দুশ্চিন্তা দেখা দিলো।
কেন?
সব ব্যাপারেই আমার মাত্রা জ্ঞানটা একটু কমে গেছে, ঘণ্টা খানেকের জন্যেও তুমি যদি আমার চোখের আড়াল হও আমার তখন মনে হয় যে, এরপর হয়তো দেখবো তোমার মৃতদেহটা যে-কোনো খানা-খন্দে পড়ে আছে–যেমন নাটক বা গল্পে হয়ে থাকে।
ব্রিজেট বললো–কিন্তু নায়িকারা কখনো খুন হয় না।
তা হয়না, কিন্তু মাঝপথে লিউক থেমে যায়।
তুমি যেন কী বলতে চাইছিলে?
না, কিছু না।
নিজের কথার সূত্র ধরে ব্রিজেট বলে যায়-নায়িকারা নানারকম বিপদের সম্মুখীন হতে পারে কিংবা ঘরের মধ্যে আটকে রেখে বিষাক্ত গ্যাস ছেড়ে হত্যা করবার চেষ্টাও হতে পারে। এমনকি জলে ডুবিয়ে পর্যন্ত খুন করার চেষ্টাও সম্ভব–কিন্তু তারা কখনোই মারা যেতে পারে না।
লিউক বলে–এটাই কি সেই ডাইনীদের মাঠ?
হ্যাঁ।
লিউক ওকে বললো–এখন তোমার হাতে একগাছি ঝাটা দরকার।
ধন্যবাদ। মিঃ এলসওয়ার্দিও প্রায় এইরকমই একটা কথা বলছিলেন।
তার সঙ্গে তো আমার একটু আগেই দেখা হলো।
তুমি কি তার সঙ্গে কোনো কথা বলেছে?
হ্যাঁ, আমার মনে হয় ও আমাকে রাগাবার চেষ্টা করছিলো?
তুমি রেগেছিলে?
লিউক বললো–লোকটা কেমন যেন অদ্ভুত। কখনো মনে হবে যে, ও একটা নেহাই বাজে লোক। আবার মনে হয় যতটা বাজে ভাবা যায় ততটা বাজে নয়।
ব্রিজেট লিউককে বললো-তোমারও একথা মনে হয়েছে?
তুমি তাহলে আমার সঙ্গে একমত?
হ্যাঁ।
ব্রিজেট বলে–ভদ্রলোক সত্যিই যেন কেমন বিচিত্র ধরনের। আমার মনে হয় যে এখানে যদি সত্যি সত্যিই কোনো খুনী থাকে, তাহলে তাকে আমি চিনতাম। গভীর ভাবে অনুধাবন করবার চেষ্টা করেছি–কে সেই লোক? একটা সত্যিই যে–যেই হোক না কেন সে একজন উন্মাদ।
লিউক বললো তুমি কি একথা বিশ্বাস করো না যে, একজন আততায়ী ঠিক তোমার আমার মতই সুস্থ ও স্বাভাবিক হতে পারে?
না, এ জাতীয় খুনী তা হবে না। আমার যতদূর ধারণা–এই খুনী একজন উন্মাদ আর সে ধারণা থেকেই এলসওয়ার্দির ওপর আমার সন্দেহ হয়েছে।
তুমি লক্ষ্য করেছে ওর হাত দুটো কি কুৎসিত?
হাত দুটো ওর সাদা নয়–কেমন যেন সবুজ।
দেখে তাই মনে হয় বটে। তবে তাকে তুমি খুনী সাব্যস্ত করতে পারো না।
সে তো ঠিকই। দরকার-অকাট্য প্রমাণের।
লিউক বললো–প্রমাণ! এই প্রমাণেরই সবচেয়ে বড় অভাব। লোকটা অত্যন্ত সতর্ক, একজন চতুর খুনী! চতুর উন্মাদ!
আমি তোমার কাজে খানিকটা সাহায্য করবার চেষ্টা করছিলাম।
এলসওয়ার্দির ব্যাপারে?
হ্যাঁ, আমার মনে হলো, এলসওয়ার্দিকে কায়দা করতে তোমার চেয়ে আমি ভালো পিরবো এবং আমি আরম্ভও করেছি।
কী করলে বলো।
আমার ধারণা, কতকগুলো বাজে ধরনের বন্ধুবান্ধব নিয়ে তৈরি ওর একটা চক্র আছে। কিছুদিন পর পর তারা সব এখানে আসে উৎসব করতে।
আমার মনে হয়, ওরা কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে নেচে নেচে শয়তানের পুজো করে।
ওই রকমই করে এবং তাতে ওরা দারুণভাবে মেতে ওঠে।
লিউক বলে–আমিও কিন্তু একটা খবর দিতে পারি। টমি পিয়ার্স এই উৎসবের সঙ্গে জড়িত ছিলো। ওর ভূমিকা ছিলো একজন ছোটোখাটো যাজকের।
এ ঘটনা তাহলে ওর জানা ছিলো?
তা ছিলো।
তোমার কি মনে হয়, ও এসব ঘটনা লোকের কাছে বলে বেড়াতো?
হয়তো বলতো; তা না হলে বলে দেবার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করতো।
ব্রিজেট বললো–সমস্ত ব্যাপারটাই যেন কেমন অবাস্তব বলে মনে হয়। কিন্তু এলসওয়ার্দির কথা মনে হলেই এমন অবাস্তব ঘটনার কার্যকারণ খুঁজে পাওয়া যায়।
ঠিক বলেছো।
এ পর্যন্ত যতগুলো খুন হয়েছে, তার মধ্যে দুজনের সম্পর্কে একটা যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গেল–টমি পিয়ার্স আর অ্যামি গিব।
সেই মাতাল আর আম্বলবি–এই দুজনেরও কি এই ঘটনার সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো?
আপাততঃ কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।
মাতালের সঙ্গে হয়তো নেই, তবে আম্বলবিকে সরাবার একটা উদ্দেশ্য থাকলেও থাকতে পারে।
ব্রিজেট বলে–খুবই সম্ভব। আমার আজ সকালের প্যাটো কিন্তু বেশ ভালোই কাজে এসেছে। আমি সকালেই বললাম যে, আমার এক প্ৰ-মাতামহীকে ডাইনীবিদ্যা চালাবার জন্য প্রায় পুড়িয়ে মারবার ব্যবস্থা হয়েছিলো, তারপর আর কথা নেই–আমাকে একেবারে নিজের দলের বলে ধরে নিয়েছে। আমার তো মনে হয় যে, ওদের পরবর্তী উৎসবে ও হয়তো আমাকে নিমন্ত্রণ করে বসবে।
দোহাই ব্রিজেট, একটু সাবধানে থেকো।
ব্রিজেট লিউকের দিকে তাকালো। লিউক বললো–কিছুক্ষণ আগেই আমার আম্বলবির মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো। আম্বলবির মেয়ে বলেছিলো যে, মিস পিঙ্কারটন তোমার সম্পর্কে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন।
লিউকের কথা শুনে ব্রিজেট ধপ করে বসে পড়লো।
কী বললে? আমায় নিয়ে মিস পিঙ্কারটনের উদ্বেগ ছিলো?
রোজ আম্বলবি তো সেই কথাই বললো।
রোজ আম্বলবি বললো?
হ্যাঁ।
ও আর কী বলেছে?
আর কিছু না।
তোমার ঠিক মনে আছে তো?
হুবহু।
কিছুক্ষণ চুপ করে ব্রিজেট বললো-তাহলে এই ব্যাপার।
মিস পিঙ্কারটনের আস্ববিকে নিয়ে উদ্বেগ ছিলো এবং ভদ্রলোক মারাও গেলেন। এখন শুনি তোমায় নিয়েও তার দুশ্চিন্তা ছিলো—
হেসে উঠলো ব্রিজেট। হঠাৎ হাত হাত-পা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো-ভেবো না, শয়তান তার নিজের ব্যাপারে খুব হুশিয়ার থাকে।
***
মেজর হর্টনের পারিবারিক জীবন
লিউক একটা চেয়ারে বসে বললো–বেশ ভালো ব্যবস্থাই করে দিয়েছেন; তবে আপনার অনেকটা সময় আমার জন্য নষ্ট হলো।
মিঃ জোনস বললেন–ও কিছু নয় মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম–আমাদের এখানে কোনো বাইরের লোক এলে আমরা খুব আনন্দিত হই।
আপনাদের এই জায়গা কিন্তু ভারী অদ্ভুত। নানারকম আচার-বিচার আর সংস্কারের আড়তখানা।
মিঃ জোনস বললো যে, কুসংস্কার দূর করার জন্য যে উপযুক্ত শিক্ষার প্রয়োজন, তেমন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন নেই।
মিঃ জোনস্ লিউকের কথায় একটা আঘাত পেয়ে বললেন–লর্ড হুইটফিল্ড এখানকার জন্য প্রচুর করেছেন; এখানকার ছেলেমেয়েদের যাতে কোনো অসুবিধায় না পড়তে হয় সেদিকে দৃষ্টি রেখে উনি নানারকম সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন।
ওঁর শৈশবের বঞ্চনা কিন্তু এই বিপুল সম্পদ আয়ত্ত করার পথে বাধা হয়নি।–লিউক বললো।
ওঁর যোগ্যতা ছিলো, তাই সব বাধা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন।
যোগ্যতা না ভাগ্য?
একই প্রসঙ্গের জের টেনে লিউক বলে–এই কার্টারের কথাই ধরুন না। ও হয়তো পুরো সপ্তাহের সাতদিনের মধ্যে ছদিনই রাতে মত্ত অবস্থায় সেই পুলের ওপর দিয়ে ফিরতো; অথচ দেখুন, হঠাৎ এক রাতে পা হড়কে নদীতে পড়ে প্রাণটা দিলো। সেই একই ব্যাপার–কপালের লেখা।
ম্যানেজার বললেন–কিছু কিছু লোকের তাতে মঙ্গলই হয়েছে।
তার মানে?
মানে ওর স্ত্রী এবং মেয়ে বেঁচে গেছে।
তা অবশ্য ঠিক।
একজন কেরানী হাতে কাগজপত্র নিয়ে ঢুকলো। লিউককে দিয়ে দুএকটা সই করিয়ে ওর হাতে চেকবই দিলো। লিউক চেকবইটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
অনেক উপকার করলেন। এবারের ডারবীর খেলায় আমার ভাগ্যটা সুপ্রসন্ন ছিলো। আপনি কিছু পেয়েছেন না কি?
মিঃ জোনস্ বললেন উনি জুয়া খেলেন না–তার কারণ, মিসেস জোস্ ঘৌড়দৌড় বিশেষভাবে অপছন্দ করেন।
এখান থেকে কেউ যান কি?
মেজর হর্টন যান, উনি পাকা রেসুড়ে। এছাড়া, মিঃ অ্যাবটও প্রায়ই যান।
লিউক ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। ওর সন্দেহভাজন তালিকা থেকে মিঃ জোকে বাদ দেওয়াই সমীচীন মনে করলো। সে যাই হোক এখানে আসার পরিশ্রম বৃথা যায়নি লিউকের। উকিল মিঃ অ্যাবট এবং মেজর হর্টন–দুজনেই ডারবী খেলার দিন উইচউডে ছিলেন না। সুতরাং দুজনেই সেদিন লণ্ডনে গিয়ে মিস পিঙ্কারটনকে চাপা দেওয়ার সুযোগ ছিলো।
যদিও লিউক ডাঃ টমাসকে আর সন্দেহ করে না–তবুও ওর মনে হলো যে, সেদিন যদি ডাঃ টমাস উইচউডেই থেকে থাকেন তা হলে ও যেন আরও খুশী হয়।
এবার রইলো এলসওয়ার্দি। এলসওয়ার্দি কি ডারবী খেলার দিন উইচউডেই ছিলো? যদি তাই হয় তাহলে ওর ওপর থেকে সন্দেহটা অনেক হাল্কা হয়ে যায়।
নিজের গাড়িটা নিয়ে লিউক হাই স্ট্রীটের পিওয়েল গ্যারেজের দিকে রওনা হলো। গাড়িটার দুএকটা দোষ সারাবার ছিলো। লিউক একজন মিস্ত্রী দিয়ে গাড়িটা ঠিক করাতে করাতে গাড়ির ত্রুটি নিয়ে কথা বলতে লাগলো।
কে যেন দূর থেকে ডাকলো-জিম, একবার এদিকে এসো।
জিম হারভে! তাহলে এই সেই ছেলে যে অ্যামিকে ভালোবেসেছিলো। ছেলেটি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এলো।
লিউক জিজ্ঞেস করলো–এবারের ডারবী খেলায় কিছু পেলেন?
না স্যার, ক্ল্যারিগোল্ডের ওপর বাজি ধরেছিলাম।
দ্বিতীয় জুজুবের ওপর খুব বেশি কেউ বাজি ধরেনি তাই না?
ঠিকই বলেছেন। কাগজে যারা ভবিষ্যদ্বাণী করে, তারা পর্যন্ত বলেছিলো যে জুজুবের জেতার কোনো সম্ভাবনা নেই।
লিউক বললো–ঘোড়দৌড় খুব অনিশ্চিত খেলা; কখনো ডারবীর খেলা দেখেছেন?
না স্যার, তেমন কপাল থেকে আসিনি।
সহানুভূতি জানিয়ে লিউক বিদায় নিলো। তালিকা থেকে জিম হারভেও বাদ পড়লো। লিউক বাড়ির পথ ধরলো। আগের বারের মতো এবারেও একই জায়গায় মেজির হর্টনের সঙ্গে দেখা হলো।
আমার নাম হর্টন-মেজর হর্টন। কালকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি মানর হাউসে। টেনিস খেলার আমন্ত্রণ, মিস কনওয়ে আমন্ত্রণ করেছেন। উনি আপনার বোন–তাই না?
হা।
লিউক বললো–সুন্দর কুকুর–কী বলেন? কিন্তু এটা মেয়ে। আমার পছন্দ বুলডগ। এই তো কাছেই আমার বাড়ি–আসুন না, একটু বিয়ার-টিয়ার খাবেন?
রাজী হয়ে লিউক হাঁটতে আরম্ভ করলো মেজরের সঙ্গে। বাড়িতে দরজায় তালা ছিলো না; দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে একটা ঘরের ভেতর দিয়ে ওরা কুকুরের গন্ধে ভরা ছোটোখাটো একখানা ঘরে পৌঁছলো। ঘরের প্রতিটি দেওয়ালে সারি সারি বইয়ের তাক। বইয়ের তাকে তাকে বিভিন্ন সাইজের রুপোর কাপ সাজানো। ম্যাণ্টপেসের ওপর একখানা বড় তেলরঙে আঁকা ছবি।
লিউকের দৃষ্টি অনুসরণ করে মেজর বললেন–ইনি আমার স্ত্রী–একজন সত্যিকারের মহীয়সী মহিলা; মুখে কী দারুণ অভিব্যক্তি লক্ষ্য করেছেন?
লিউক বললো-হা, দারুণ!
মেজর লিউকের দিকে একটা বিয়ারের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে একই কথার পুনরুক্তি করলেন,–একজন সত্যিকারের মহীয়সী-বছরখানেক হলো আমায় ছেড়ে চলে গেছেন, তারপর থেকে আমি আর আগের আমি নেই।
লিউক বললো-তাই না কি?
মেজর একটা চেয়ার দেখিয়ে লিউককে বললেন–ওটার ওপর বসুন।
নিজেও একখানা হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বললেন–ওঁর মৃত্যুর পর থেকে আমি অনেক বদলে গেছি।
লিউক বলে–আপনি নিশ্চয়ই ওঁর অভাব বোধ করেন?
মেজর বললেন–পুরুষদের প্রতি পদক্ষেপেই স্ত্রীর প্রয়োজন; স্ত্রী না থাকলে তারা একেবারে উচ্ছন্নে যায়।
কিন্তু একথা—
আরে ভাই, আমি জেনেশুনেই বলছি একথা। তবে সব বিয়েই প্রথম দিকটা সুখের হয় না। কিন্তু আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যায়। তবে তার জন্য দরকার উপযুক্ত শৃঙ্খলাবোধ। জীবনের সব স্তরেই শৃঙ্খলাই হচ্ছে আসল। আপন মনে মেজর বলে চলেন–মেয়েরা অতি বিচিত্র প্রাণী। কখনো কখনো মনে হয় যে, অন্যকে আনন্দ দেবার মত কোনো ক্ষমতাই ওদের নেই; কিন্তু একথা সত্যি যে, ওরা পুরুষকে সোজা রাখতে পারে।
কোনো মন্তব্য না করেই লিউক শুনে যায়।
মেজরের প্রশ্ন–বিয়ে করেছেন?
না।
যখন করবেন তখন বুঝতে পারবেন। তবে একটা কথা জেনে রাখুন–বিবাহিত জীবন অতি মধুর।
আজকালকার পাইকারী হারে বিবাহ-বিচ্ছেদের যুগে কারও কাছ থেকে বিয়ের প্রশস্তি শুনতে খুব ভালো লাগে।–লিউক বললো।
আরে দূর! আজকালকার প্যানপেনে ছেলেমেয়েদের কথা আর বলবেন না। কোনোরকম প্রতিকূল অবস্থার সামনে ওরা দাঁড়াতেই পারে না-বীরত্ব বলতে কিছু নেই ওদের।
তবে একটা কথা; লিডিয়ার মতো মহিলা হাজারে একজন মেলে। ওকে এখানে সবাই খুব ভালোবাসতো আর শ্রদ্ধাও করতো।
তা তো বটেই?
ও কোনোরকম অসভ্যতা বরদাস্ত করতো না। আমাদের বাড়িতে একবছরের মধ্যে ঝি-চাকর-পাঁচক মিলে পনেরো জনের বদল-ফেরত হয়েছে। ভেবে দেখুন সংখ্যাটা-পনেরো জন।
ঝি-চাকরদের সঙ্গে না বনলে পত্রপাঠ ঘাড় ধরে বিদায় করাই ছিলো ওঁর একটা বিশেষ পদ্ধতি।
সবসময়ই কি তাই করতেন?–প্রশ্ন করে লিউক।
ঠিক তা নয়, বেশির ভাগই নিজেরাই বিদায় নিতো–লিডিয়া বলতো যে, এটাই সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি।
বুদ্ধিটা খুবই ভালো, তবে এর ফলে কখনো কোনো অসুবিধায় পড়েননি?
আমার ব্যক্তিগত কোনো অসুবিধা হয় না। তবে অসুবিধায় পড়লে তাও করতে হয়, উপায় তো নেই।
উনি বুঝি খুব দুর্বল ছিলেন?
মেজর বললেন–ওর খুব উদ্যোগ ছিলো, সহজে কোনো কিছু ও ছেড়ে দিতো না; কিন্তু বেচারা কি ভোগাই না ভুগলো। ডাক্তাররা পর্যন্ত বুঝতে পারলো না–আর ডাক্তারগুলোও হয়েছে যতসব অকর্মার ধাড়ী। এই আম্বলবির কথাই ধরুন না–এখানে সবাই ভাবতো যে, ও বুঝি খুব ভালো ডাক্তার। আমিও মুখের ওপর স্পষ্ট বলে দিয়েছিলাম যে ওকে দিয়ে চলবে না। এরপরই টমাসকে দেখাই।
তাকে আপনার পছন্দ হয়েছিলো?
সব মিলে মিশে সে বেশ চালাক-চতুর লোক। লিডিয়াকে যদি কেউ বাঁচাতে পারতো, তো টমাসই পারতো। দিন দিন বেশ ভালোর দিকেই যাচ্ছিলো–হঠাৎ একদিন বেড়ে উঠলো।
খুব কষ্ট হতো?
খু-উ-ব। গ্যাস্ট্রাইটিস হয়েছিলো কিনা, দারুণ যন্ত্রণা। শহীদের মতো মৃত্যুকে তিলে তিলে বরণ করে নিলো। দুজন হাসপাতালের নার্স রেখেছিলাম; সব সময় রোগীর জন্য এটা চাই, ওটা চাই করে অস্থির করতো। এই হাসপাতালের নার্সগুলোকে আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না।
লিউক জিজ্ঞেস করলো–আচ্ছা উইচউডে মিসেস হর্টনের অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিলো?
মেজর বললেন–এখানকার লোকজন খুবই ভালো। হুইটফিল্ড তার নিজের বাগানের আঙুর, পিছ পাঠিয়েছিলেন। তাছাড়া মাঝেমাঝে আমাদের গ্রামের দুই বুড়ী–হনরিয়া ওয়েনফ্লিট আর ল্যাভিনিয়া পিঙ্কারটনও এসে ওর মাথার কাছে বসে থাকতেন।
মিস পিঙ্কারটন বুঝি প্রায়ই আসতেন?
হ্যাঁ, ভদ্রমহিলা একেবারেই বুড়ী। তবে মহিলা বড় ভালো ছিলেন। তবে দারুণ খুঁতখুঁতে।
ঘাড় নাড়ে লিউক।
মেজর বলতে থাকেন–এখানে বেশির ভাগই মহিলা–ভালো করে এক হাত গলফ খেলার মতো সঙ্গী পর্যন্ত পাওয়া দুষ্কর।
কেন, অ্যান্টিক দোকানে কম বয়সের এক ভদ্রলোক আছেন, তিনি কেমন?–প্রশ্ন করে লিউক।
মেজর বললেন–ওকে দিয়ে গল হয় না–একেবারে মেয়েলী স্বভাবের লোক।
উনি কি অনেকদিন ধরে উইচউডে আছেন?
তা–বছর দুই হবে। একদম বাজে লোক। কিন্তু মজার কথা হলো যে, লিডিয়া ওকে পছন্দ করতো।
লিউক জিজ্ঞেস করলো–আচ্ছা, স্থানীয় সলিসিটার অ্যাবট কেমন লোক? আইনের ব্যাপারে কি খুব ঝানু? আইনের ব্যাপারে ওঁর কাছে গেলে কেমন হয়।
সবাই বলে যে ও বেশ উঁদে উকিল, তবে আমার ভালো জানা নেই। আমার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিলো একবার। আমার মতে, লোকটা খুব অভদ্র; অবশ্য তাতে ভালো উকিল হতে বাধা নেই।
তা তো ঠিকই–তবে আমিও শুনেছি যে, ভদ্রলোক বেশ ঝগড়াটে স্বভাবের এবং এখানকার বহু লোকের সঙ্গেই সদ্ভাব নেই।
আম্বলবির সঙ্গে ওর ঝগড়ার কথা শুনেছেন?
ওদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিলো?
একেবারে তুলকালাম, তবে আমি তাতে মোটেই আশ্চর্য হইনি। আম্বলবিটা ছিলো একটা প্রথম শ্রেণীর গবেট।
ওঁর মৃত্যুটা কিন্তু খুব দুঃখের।–বলে লিউক।
কার? আম্বলবির? হ্যাঁ, তা ঠিক–সাধারণ বুদ্ধির অভাব। রক্ত বিষাক্ত হওয়া অত্যন্ত মারাত্মক। এ থেকেই বোঝা যায় ও কোনো দরের ডাক্তার ছিলো।
লিউক কোনো মন্তব্য না করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে পড়লো।
দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে?–হ্যাঁ তাইতো। আপনি যেন কোথায় ছিলেন? মেয়াংস্ট্রেটে? ওদিকটায় কখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি। শুনলাম, এখানকার লোকদের আচারবিচার নিয়ে একটা বই লিখছেন?
হ্যাঁ, তা একখানা
মেজর বলেন–এই ব্যাপারে আপনাকে আমি বেশ মজার কিছু কিছু ঘটনা বলতে পারি। আমি যখন ভারতবর্ষে ছিলাম–আরেব্বাস!
মেজর হর্টনের মতো অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানদের অতি মুখরোচক বিষয় হলো–ভারতীয় ফকির, আম, দড়ির খেলা ইত্যাদির গল্পে। দশ মিনিট ধরে এসব গল্প শুনে লিউক এবার রাস্তায় পা বাড়ালো।
হঠাৎ লিউকের মনে হলো, ভদ্রলোক কি সত্যিই ব্যথিত, না কি সবটাই একটা বড় ধাপ্পা?
***
শক্তি পরীক্ষা
সেদিন বিকেলবেলায় টেনিস খেলা উৎরোলো বেশ ভালোভাবেই। সবসুদ্ধ আটজন খেলোয়াড় –লর্ড হুইটফিল্ড নিজে, ব্রিজেট, লিউক, রোজ আম্বলবি, মিঃ অ্যাবট, ডাঃ টমাস, মেজর হন এবং ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের মেয়ে হেটি জো–মেয়েটি সব সময়ে কারণে-অকারণে হাসে।
সেদিন বিকেলবেলায় দ্বিতীয়ার্ধের খেলায় একদিকে লর্ড হুইটফিল্ড এবং রোজ আর অন্যদিকে লিউক এবং ব্রিজেট পরপর তিনটে গেম খেললো–ফলাফল হলো সমান-সমান। কিন্তু তিনটে গেমের পর হঠাৎ যেন লিউকের খেলাও খুলে গেল; ফলে ওদের দল অচিরেই পাঁচ-তিনে জিতলো, আর এর ফলে লর্ড হুইটফিল্ডের মেজাজও গেল বিগড়ে। এরপর থেকেই ব্রিজেটের খেলা নেমে গেল হাস্যকর পর্যায়ে। বল মারা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিও হলো এবং ফলাফলও তেমনটাই হলো–লিউকরা আট-ছয়তে হারলো।
লিউকের কাছে ব্রিজেট ক্ষমা চায়।–আমি সত্যিই খুব দুঃখিত! একেবারে যেন হতক্লান্ত হয়ে পড়েছি।
লিউক ব্রিজকে বললো–তোমাদের শাক-সজির বাগানটা একটু দেখিয়ে দাও তো?
শাক-সজির বাগান দিয়ে কী হবে?
বাঁধাকপির পাতা খেতে ইচ্ছে করছে।
কচি মটরশুটিতে কাজ চলবে?
আরোও ভালো হবে।
টেনিস কোর্ট থেকে বেরিয়ে ওরা দুজনে তরকারির বাগানে এলো।
ব্রিজেট বললো–নাও, প্রাণভরে এবার মটরশুটি খাও।
লিউক বললো–তুমি অমন বিশ্রী করে খেললে কেন?
ব্রিজেট বললো–আমি তো বলেছি যে, দুঃখিত; আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাছাড়া, আমার টেনিস খেলা কিছু উল্টোপাল্টা।
উল্টোপাল্টা হওয়ারও একটা সীমা আছে যতটা তুমি দেখাতে চেয়েছো ততটা কিছুতেই হতে পারে না। কিন্তু কেন এমন করলে?
খুব সহজ কারণে; আমার আগেই ভাবা উচিত ছিলো যে গর্ডন হেরে যাওয়া পছন্দ করে না।
কিন্তু আমার দিকটা ভেবেছো? আমি যদি জিততে চাই?
হে আমার প্রিয় বন্ধু তোমার চাওয়া না চাওয়া আমার কাছে আদৌ মূল্যবান নয়।
হেঁয়ালী না করে একটু পরিষ্কার করে বলবে?
শোন, কেউ নিজের রুজি রোজগারের সঙ্গে ঝগড়া করে না–গর্ডন আমার জীবিকা, তুমি তা নও।
এবার লিউক একেবারে ফেটে পড়ল–ঐ সৃষ্টিছাড়া বিদ্ঘুটের মধ্যে তুমি কী এমন দেখলে যে ওকে বিয়ে করতে চাইছো? কেন তোমার এই মতিচ্ছন্নতা?
কারণ, ওর সেক্রেটারী হিসেবে আমি মাইনে পাই সপ্তাহে ছপাউণ্ড; যখন স্ত্রী হবো তখন সব কিছুর অধীশ্বরীও হবো আমি নিজে।
কিন্তু তখন তোমার কাজটা হবে কিঞ্চিৎ অন্য ধরনের।
ব্রিজেট বলে–সংসারের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েই কি অতি নাটুকেপনা করবে? তুমি যদি ভেবে থাকো যে গর্ডন তার বউয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাবে, তাহলে খুব ভুল করবে। ও একেবারেই বাচ্চাদের মতো–ওর দরকার একজন মা-স্ত্রী নয়। ও চায় এমন একজনকে, যে সর্বদা ওর আশেপাশে থাকবে, ওর সব বড় বড় কীর্তিকাহিনীর কথা মন দিয়ে শুনবে।
তোমার জিভটা বড়ই অশালীন।
ব্রিজেট বলে–আবার ভুল করছে। আমি নিজেকে রূপকথা দিয়ে ভোলাই না–নিজের অবস্থা সম্পর্কে আমি সচেতন। তোমার অতি সেকেলে মনটা হয়তো ভাবছে যে, আমি কি জঘন্য এক জীব–যে টাকার জন্য নিজেকে বিক্রী করেছে এবং এই ভাবনাটাই তোমার কাছে আত্মপ্রসাদের মতো।
তুমি একটি আস্ত সুচতুর শয়তান।
নির্বোধ শয়তান হওয়ার থেকে চতুর শয়তান হওয়া ঢের ভালো।
তাই না কি?
ঠিক তাই। আমার ভালোভাবেই সেটা জানা আছে।
কী জানো?
আমি জানি একজন পুরুষমানুষকে ভালোবাসতে হলে কি অসীম মূল্য দিতে হয়। তুমি জনি কর্নিশকে চেনো? ওর জন্য একেবারে পাগল ছিলাম। বিয়ের কথাও ছিলো একেবারে পাকা। কিন্তু কী হলো? এক গোলগাল উত্তরে বিধবাকে বিয়ে করবার জন্য আমাকে ঝেড়ে ফেলতে ওর মোটেই অসুবিধা হয়নি। এমন একটা জব্বর উদাহরণ একজনের প্রেমরোগ সারাবার পক্ষে বেশ ঝাঁঝালো ওষুধ।
লিউক বললো–তা হয়তো সত্যি।
হয়তো নয়, তা-ই সত্যি। প্রশ্ন করে লিউক-তুমিও কি সেই একই সেকেলে মনের পরিচয় দিচ্ছো না?
ব্রিজেটের দিকে লিউক অপাঙ্গদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে; ওর চোখে-মুখে এক অব্যক্ত ব্যথা ফুটে ওঠে–যেন ওর ভেতরটা জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে। ও বলে,-সত্যিই আমার অধিকার আছে–একান্ত অধিকার–শুধু তোমার ওপর। কী যেন বলছিলে তখন যে, ভালোবাসা এত তীব্র যেন আঘাত করে?
ব্রিজেট অবাক হয়ে প্রশ্ন করতে চায়–তুমি!
হ্যাঁ, খুব আশ্চর্য হচ্ছে না? এমন একটা ঘটনা শুনে বেদম হাসি পাচ্ছে? আমি এখানে এলাম একটা বিশেষ কাজ নিয়ে। তুমি এসে দাঁড়ালে; তোমাকে দেখামাত্রই আমার মধ্যে কি যেন একটা হয়ে গেল–অনেকটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো হয়ে গেলাম। তুমি আমাকে একেবারে গ্রাস করে ফেলেছো। তুমি যদি হুকুম করো যে–এই মুহর্তে একটা ব্যাঙ হয়ে যাও।তৎক্ষণাৎ একটা ব্যাঙ হয়ে লাফাতে আরম্ভ করবো।
ব্রিজেটের দিকে লিউক এগিয়ে আসে।
ব্রিজেট কনওয়ে, আমি তোমায় পাগলের মতো ভালোবাসি। যাকে আমি বালোবাসি, আমি চাই না তার একটা ভুড়িওয়ালা জবুথবু লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাক।
তুমি আমাকে কী করতে বলো?
আমার কথা হয়তো হেসেই উড়িয়ে দেবে–কিন্তু আমি নাচার। তোমার উচিত ওকে বাদ দিয়ে আমাকে বিয়ে করা।
এ কথা শুনলে কে না হাসবে? তবু তো আকাশ ফাটিয়ে হাসিনি। আশ্চর্য! গর্ডনের মতো তুমিও হেরে গেলে রেগে যাও?
হঠাৎ ব্রিজেটের কাঁধ দুটো করে লিউক ঝাঁকুনি দেয়।–তোমার মুখে কি কিছুই বাধে না?
আমার প্রতি তোমার আকর্ষণ যতই তীব্র হোক না কেন, একথা কিন্তু সত্যি যে তুমি আমায় খুব একটা পছন্দ করো না।
তোমায় আমি একেবারেই পছন্দ করি না।
ব্রিজেট বলে–দেশে ফিরে এসেই বিয়েথা করে স্থিতু হবে–এমন একটা আশা নিয়েই তো তুমি ফিরেছিলে?
হাঁ।
নিশ্চয়ই আমার মত একজনকে নিয়ে নয়?
তোমার মত মেয়ের কথা আমার চিন্তায় ছিলো না।
আমি জানি ছিলো না–তোমার এই ধাতটাকে আমি খুব ভালো করেই চিনি।
আহা ব্রিজেট, তোমার কি দারুণ বুদ্ধি!
তোমার দারুণ পছন্দ হলো একটা শান্তশিষ্ট ভালো মেয়ে–যে পা থেকে মাথা পর্যন্ত নির্ভেজাল ইংরেজ।
অহো! বড়ই মধুর দৃশ্য!
সুন্দর–সে আমি জানি। চলো টেনিস কোর্টে ফেরা যাক।
এবার তোমার শেষ কথাটা বলতে পারো।
থমকে দাঁড়ায় দুজনেই। লিউক ব্রিজেটের কাঁধ থেকে হাতটা সরিয়ে নেয়। দুজনের চোখে মুখেই কি যেন এক না-বলা অভিব্যক্তি।
ব্রিজেট আচমকা ঘুরে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলে গেল। পৌঁছানো মাত্র পরের গেমটা শেষ হলো।
ব্রিজেট একটু জেদই করে–আমি বড্ড ক্লান্ত, আর খেলতে পারছি না। তুমি আর মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম, মিস জোস্ আর মেজর হর্টনের বিরুদ্ধে খেলো।
কিন্তু কিছুতেই রোজ রাজী হয় না; শেষে চারজন পুরুষ নিজেদের মধ্যে জুটি বেঁধে খেলতে নামে। তারপর আসে চা।
কদিন আগে লর্ড হুইটফিল্ড ওয়েলারম্যান ক্রেইৎস রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে গিয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিলেন ডাঃ টমাসের কাছে এবং যথারীতি নিজেকে জাহির করলেন।
বুঝতেই পারছেন যে, আমায় একটা কাগজ চালাতে হয়।–লর্ড বললেন-কাগজে কী বেরোবে, তার মান সম্পর্কে আমায় সদা সতর্ক নজর রাখতে হয়। এই যুগটাই হচ্ছে গিয়ে বিজ্ঞানের যুগ এবং এই বিজ্ঞানকে জনসাধারণের কাছে সহজপাচ্য করে দেওয়াও আমার একটা পবিত্র দায়িত্ব।
কিন্তু তাতে ফললাভ অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করীর মতো হতে পারে।–ডাঃ টমাস ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলেন।
এমন ভাবে আমাদের কাজ করতে হবে যাতে বিজ্ঞানকে আমরা সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে পারি।-বলেই চলেন লর্ড–অর্থাৎ, প্রতিটি মানুষকে হতে হবে বিজ্ঞানসম্মত।
অর্থাৎ গবেষণা সচেতন হতে হবে।-ব্রিজেট গম্ভীর ভাবে বলে ওঠে।
যা দেখে এলাম, তার প্রত্যেকটিই দেখবার মতো, বোঝবার মতো ব্যাপার। আমি অবশ্য ওয়েলারম্যানকে বলেছিলাম একজন সাধারণ কর্মচারী সঙ্গে দিতে; কিন্তু তা কিছুতেই শুনলেন। শুধু তাই নয়, আমার কাগজে এ সম্পর্কে প্রথম লেখাটা উনি নিজে লিখবেন বলে কথাও দিলেন। ব্রিজেট আলোচনার গতি বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য প্রস্তাব করে–আর দুএক হাত খেললে কেমন হয়?
খেলা শেষ হলে সবাইকে বিদায় জানিয়ে রোজ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। লিউকও পেছনে প্রস্তুত হয়।
চলুন, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। আপনার সঙ্গে গাড়ি আছে? ব্যাটগুলো আমায় দিন।
না না, আমায় পৌঁছে দিতে হবে না। এই তো কাছেই আমার বাড়ি।
তা হোক, আমার নিজেরই একটু হাঁটতে ইচ্ছে করছে।
এতক্ষণ কি আপনার খুব খারাপ লাগছিলো?
বাঃ, আপনি বুঝেও কি চমৎকার না বোঝার ভান করতে পারেন। আমার মনে হচ্ছে, যেন মেঘাচ্ছন্ন এক অন্ধকার রাজ্য থেকে স্বচ্ছ ঝলমলে আলোর দেশে এলাম।
এ কথা কিন্তু আন্তরিকভাবে সত্যি। আমরা যখন ম্যানর থেকে বেরোই তখন কিন্তু আকাশ ভরা মেঘ ছিলো; অথচ দেখুন কোথায় উড়ে গেলো সেই মেঘ।
কী আশ্চর্য, দেখুন, দুদিক থেকেই এটা সত্যি। দুনিয়াটা দেখছি এখনও বেশ বাসোপযোগী।
ঠিক বলেছেন।
মিস আম্বলবি, আপনার দুএকটা ব্যক্তিগত ব্যাপারে একটু নাক গলাতে পারি?
আপনার মতো লোক কখনও তা করতে পারে না।
আমার সম্পর্কে অতটা উচ্চাশা রাখবেন না। আমি বলছিলাম কি-ডাঃ টমাস কিন্তু খুব ভাগ্যবান লোক।
রোজ বললো–আপনিও তাহলে শুনেছেন?
কেন? এটা কি গোপন ব্যাপার? তাহলে কিন্তু আমি যথার্থই লজ্জিত।
রোজ বলে–তা নয়, তবে আমাদের এ অঞ্চলে কিছুই গোপন থাকতে পারে না।
তাহলে এ কথা সত্যি যে, আপনি ডাক্তারকে বিয়ে করছেন?
স্বীকার করে রোজ–তবে আমরা এ কথা কখনো সামাজিক ভাবে ঘোষণা করিনি। বুঝতেই পারছেন, মাত্র কদিন হলো বাবা মারা গেছেন–এই সময়ের বিয়ের কথা বলা অত্যন্ত শ্রুতিকটু মনে হবে।
আপনাদের এই ব্যাপারে আপনার বাবার অমত ছিলো?
ঠিক অমত নয়–তবে কতকটা তাই।
লিউক বলে–উনি বোধহয় ভাবতেন যে, এখনো বিয়ে করার বয়স আপনার হয়নি।
মুখে সেই কথাই উনি বলতেন।
লিউক এবার সরাসরি প্রশ্ন করেন–আপনার কি মনে হয়, ওঁর অমত করার অন্য কোনো কারণ ছিলো?
রোজ বললো–হ্যাঁ, বাবার আচার-আচরণে এটা স্পষ্ট ছিলো যে উনি–উনি জিওফ্রেকে ঠিক পছন্দ করতেন না।
ওঁরা কি পরস্পরের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন?
কখনো কখনো এ কথাও মনে হতো।
এবং, আমার মনে হয় আপনি ওঁর অত্যন্ত প্রিয়জন ছিলেন–তাই আপনাকে হারাবার ভয়ও ছিল।
ঠিক তা নয়, বাবা আর জিওফ্রে–ওঁরা দুজনেই দুজনের একেবারে বিপরীত এবং কখনো কখনো ওঁদের মধ্যে প্রচণ্ড মতবৈষম্য দেখা দিতো। জিওফ্রে এই ব্যাপারটা বেশ ভালোভাবেই নিতো কিন্তু ওর ওপর বাবার অনমনীয় মনোভাবের জন্য ও যেন কেমন মনমরা হয়ে থাকতো। আমার বাবা কখনো ওকে বুঝতেই চেষ্টা করেননি।
আচ্ছা, এমন কিছু নেই তো যার ফলে হয়তো আপনার বাবা ওঁকে সঠিক কারণেই অপছন্দ করতেন? যেমন ধরুন, জিওফ্রের কি অতিরিক্ত পরিমাণে মদের নেশা বা রেসখেলা–এসব ছিলো?
না না, জিওফ্রের এসব দোষ কিছুই নেই। রেস খেলার ও কিছুই বোঝে না। আমার ধারণা ডারবীতে কোনো ঘোড়াটা প্রথম হলো তাও জানে না।
আশ্চর্য! আমি কিন্তু ডারবী খেলার দিন এপসমে ডাঃ টমাসকে পরিষ্কার দেখেছি।
রোজ বললো–আপনার মনে হলো আপনি জিওফ্রেকে দেখেছেন? কিন্তু তা একেবারেই অসম্ভব। প্রথমতঃ ওর যাবার উপায়ই ছিলো না কারণ ও সেদিন প্রায় সারাদিনই অ্যাশওয়াল্ড, গ্রামে ছিলো একটা ডেলিভারী কেস নিয়ে।
কী অদ্ভুত স্মরণশক্তি আপনার।
হেসে বলে রোজ-আমার বিশেষ করে মনে থাকার কারণ, ওই বাচ্চাটার ডাকনাম রাখা হয়েছে জুজুব।
ঘাড় নাড়ে লিউক।
তাছাড়া, রেস খেলা জিওফ্রের দারুণ একঘেয়ে লাগে, ও একদম সহ্য করতে পারে না। যাগে ওসব আলোচনা–আমাদের বাড়ি আসবেন না? মা কিন্তু আপনাকে দেখলে খুশী হবেন।
কী করে জানলেন?
ওকে নিয়ে রোজ একটা ঘরে ঢুকলো। একজন ভদ্রমহিলা একটা চেয়ারে জবুথবু হয়ে বসে আছেন।
মা, ইনিই মিঃ ফিৎস উইলিয়াম।
মিসেস আম্বলবি দাঁড়িয়ে নমকার করলেন। রোজ ঘরের বাইরে চলে গেল।
আপনি আসাতে খুব ভালো লাগছে মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম। রোজ বলেছিলো যে, আপনার কোনো কোনো বন্ধু না কি আমার স্বামীকে চিনতেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ, মিসেস আম্বলবি।
আপনার সঙ্গে আমার স্বামীর দেখা হলো না–যদি হতো, দেখতেন কী সুন্দর চরিত্রের মানুষ। ডাক্তার হিসেবে ছিলেন অতি মহৎ। যে সমস্ত রোগীদের জন্য ডাক্তাররা জবাব দিতেন, তাদের পর্যন্ত সারিয়ে তুলেছেন স্রেফ ব্যক্তিত্বের গুণে।
লিউক বলে–আমি ওঁর সম্পর্কে অনেক গল্পও শুনেছি। সবাই ওঁকে খুব শ্রদ্ধা করতো।
আপনি কি বিশ্বাস করেন মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম যে, এই দুনিয়াটা একটা শয়তানের কারখানা?
একথা শুনতে লিউক প্রস্তুত ছিলো না। ওর কাছে কথাটা একটু আচমকাই মনে হলো। হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে কথাটা সত্যি।
না, আমার প্রশ্ন–আপনি নিজে জানেন কি না? আপনার চারিদিকে সর্বদা শয়তান ঘুরে বেড়াচ্ছে–আপনি সে সম্পর্কে সচেতন? এবং, এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত আছেন? আমার স্বামী জানতেন এবং তিনি সর্বদা ন্যায় বিধানের জন্য লড়তেন।
আন্তরিকতার সঙ্গে লিউক বলে–আমি জানি।
তিনি জানতেন যে আমাদের এই জায়গায় কি ঘৃণ্য একটা শয়তানী চক্র ছিলো।–বলতে বলতে মিসেস আম্বাব কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তিনি বললেন–কিছু মনে করবেন না।–লিউকের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন–এখানে যতদিন আছেন, সময় করে মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ি আসবেন। রোজ আপনাকে খুব পছন্দ করে। আপনি এলে ওর খুব ভালো লাগবে।
আমারও ওকে ভালো লাগে। ওর মতো ভালো মেয়ে আমি স্মরণকালের মধ্যে খুব কমই দেখেছি।
ও খুব যত্ন নিয়ে আমাকে দেখাশোনা করে।
ডাঃ টমাস খুব ভাগ্যবান পুরুষ।
লিউকের হাত ছেড়ে দিয়ে উনি বলেন–হ্যাঁ, তবে আমি যেন বুঝে উঠতে পারছি না।
লিউক বিদায় নিয়ে চলে এলো। বাড়ি ফেরবার পরে ওর ওখানকার আলাপ আলোচনাগুলো সারাক্ষণ মনে আসছিলো। মিসেস আম্বলবির কথাগুলো ওর মনে পড়লো।–এখানে একটা শয়তানী চক্র আছে।বার বার একথা বলে উনি কি বোঝাতে চাইছিলেন? এ কি শুধুই স্বামীর শোকে সন্তপ্ত মনের বিকার না আরও তাৎপর্যময়?
উনি কি কিছু জানেন? তার স্বামী মৃত্যুর আগে যা জানতেন–তেমন কিছু?
লিউক মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে–এই রহস্য আমাকে ভেদ করতেই হবে।
নিজের মনকে শাসন করে ও ব্রিজেটের সঙ্গে সেদিনকার দৈত-যুদ্ধের ঘটনাটা মন থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।
***
৩. মিস ওয়েনফ্লিটের বক্তব্য
লিউক পরদিন সকালবেলা একটা সিদ্ধান্ত নেয়। বই লিখতে আসার বাহানা আর ধোপে টিকবে না; সুতরাং উইচউডে আসার পেছনে যা সত্যিকারের কারণ, তা-ই সামনে রেখে তদন্ত চালিয়ে যাবে।
ও ঠিক করে মিস ওয়েনফ্লিটের সঙ্গে দেখা করবে। উনি যা যা নিজে জানতেন, ইতিমধ্যেই লিউক ওঁর কাছ থেকে সব শুনেছে। কিন্তু এবার ও বের করার চেষ্টা করবে উনি যা অনুমান করেন ও সন্দেহ করেন।
ও চার্চে গিয়ে উপস্থিত হয়। এভাবে হঠাৎ লিউককে দেখে ভদ্রমহিলার ব্যবহারে কোনোরকম অস্বাভাবিক আচরণ দেখা গেল না। ফলে অনেক সহজ হলো লিউকের পক্ষে সরাসরি প্রসঙ্গে আসতে।
আপনার কাছে বলতে আর দ্বিধা নেই মিস ওয়েনফ্লিট যে আমি শুধুমাত্র একখানা বই লিখতে এখানে আসিনি–একথা আপনি নিশ্চয়ই সন্দেহ করেছেন?
মিস ওয়েনফ্লিট সম্মতি জানান।
অ্যামি গিবস্ নামে মেয়েটির মৃত্যুর কারণে তদন্তের জন্যই আমি এখানে আসি।
অর্থাৎ, পুলিশ থেকে আপনাকে পাঠিয়েছে?
না না, আমি সাদা পোশাকের টিকটিকি নই।–লিউক একটু হেসে বলে–বরঞ্চ বলতে পারেন, আমি সেই গল্পেপড়া বিখ্যাত সখের গোয়েন্দা।
আচ্ছা! আপনাকে তাহলে নিশ্চয়ই ব্রিজেট কনওয়ে আনিয়েছে?
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–ব্রিজেট অত্যন্ত দক্ষ মেয়ে আর খুব উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন। ওর জায়গায় যদি আমি হতাম, তাহলে কিন্তু এমন একটা সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারতাম না। কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে ঘটনাগুলো না জানা থাকলে কর্মপন্থা ঠিক করা এক দুরূহ কাজ।
কিন্তু আপনার তো জানা আছে, আছে না?
কী বলছেন মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম? আমি কী করে জানবো? বিশেষ করে আমার মত যারা একা থাকে এবং যেখানে কারও সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার পর্যন্ত সুযোগ নেই।
তা সত্ত্বেও লিউক প্রশ্ন করে–কিন্তু আপনার মন নিশ্চয়ই জানে কী ঘটেছে?
এবারও মিস ওয়েনফ্লিট অসম্মতি জানিয়ে প্রশ্ন করলো-আমরা কি পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সওয়াল জবাব করছি?
লিউক হেসে বলে-বুঝতে পারলাম। আপনি চান যে, আপনার কাছে সোজাসুজি সব ব্যাপারটা রাখি। বেশ, তাই হবে। আচ্ছা, আপনি কি মনে করেন অ্যামি গি খুন হয়েছিলো?
ওঁর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে আমি মোটেই নিঃসন্দেহ নই–সব ব্যাপারটার ভেতরে একটা গভীর সন্দেহের কারণ আছে বলেই আমি মনে করি।
কিন্তু আপনি এ কথা বলবেন যে ও স্বাভাবিক কারণে মারা গিয়েছিলো?
না, তা বলবো না।
তাহলে কি মনে করেন যে ওর মৃত্যুর কারণ কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনা?
না, তাও আমার মনে হয় না। নানা রকমের
লিউক প্রশ্ন করে–নিশ্চয়ই আত্মহত্যা বলে মনে করেন না?
অসম্ভব।
তাহলে? আপনি ভালো করেই জানেন যে এটা খুন?
হ্যাঁ, আমি ঠিক তাই মনে করি।
বেশ। এবার তাহলে কার্যকারণ বিশ্লেষণ করা যাক।
কিন্তু আমার এই ধারণার পেছনে কোনো প্রমাণ আমি দিতে পারবো না–সবটাই আমার অনুমান মাত্র।
তাতে কিছু এসে যায় না। আমরা শুধুই আলোচনা করছি মাত্র এবং দুজনের কে কী। ভাবছি, কী সন্দেহ করছি–এটা পরস্পরকে বলছি।
মিস ওয়েনফ্লিট সম্মতি জানান।
লিউক প্রশ্ন করে-কে খুন করতে চাইতে পারে?
ও যে ছেলেটিকে ভালোবাসতো, তার সঙ্গে ওর ঝগড়া হয়েছিলো গ্যারাজে বসে। জিম হারভে ছেলেটির নাম-অত্যন্ত ভালো ছেলে। শুনেছি কোনো কোনো ছেলে তার বান্ধবীর ওপর পাশবিক অত্যাচার করে কিন্তু জিম সেইরকম ছিলো না। তা ছাড়া যেভাবে খুন করা হয়েছে জিম হলে সেভাবে করতোও না। পাইপ বেয়ে জানলায় উঠে ঘরের ভেতর ঢুকে কাশির ওষুধের বোতল সরিয়ে তার জায়গায় বিষভরা শিশি রেখে দেওয়া। মানে, ঠিক এমন
লিউক বললো–হঠাৎ রেগে যাওয়া কোনো প্রেমিকের কাজ বলে মনে হয় না, তাই না? ঠিকই বলেছেন। অ্যামিকে খুন করেছে এমন একজন, যে ওকে পথের কাঁটা ভেবে একেবারে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছে এবং এমন ভাবে ভেবেচিন্তে সরিয়েছে, যাতে মনে হতে পারে যে, মৃত্যুর কারণ দুর্ঘটনা। আমাদের সমস্যা এবং প্রশ্ন–কে সেই একজন?
না, সত্যিই তেমন কারও কথা আমি ভাবতেই পারছি না।
ভালো করে ভেবে দেখেছেন?
না না, বিশ্বাস করুন—
ও অন্য প্রশ্ন করে–কোনো অভিসন্ধি আছে বলে আপনার মনে হয়?
কী অভিসন্ধি থাকতে পারে? আমি তো বুঝতে পারছি না।
ও কি উইচউডের সর্বত্র ঘোরাঘুরি করতো?
লর্ড হুইটফিল্ডের ওখানে কাজ করার আগে ও বছর খানেক হর্টনদের বাড়িতে ছিলো।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, কেউ একজন ওকে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিলো এবং যতটুকু আমরা জেনেছি, তার থেকে অনুমান করা যায় যে,–প্রথমতঃ সেই কেউ একজন হচ্ছে পুরুষ মানুষ, তার দৃষ্টিভঙ্গী মোটামুটি সেকেলে। দ্বিতীয়তঃ লোকটির শরীর সুগঠিত এবং শক্তিশালী–তার প্রমাণ মেলে দেওয়াল বেয়ে বাড়ির বাড়ির ছাদে উঠে মেয়েটির ঘরের জানলার মধ্য দিয়ে ঢোকার মধ্যে। আমার বক্তব্যের সঙ্গে আপনি একমত?
পুরোপুরি–মিস ওয়েনফ্লিট বলেন।
আচ্ছা, আমি নিজে যদি ওই জানলায় উঠে দেখি, আপনি কিছু মনে করবেন না তো?
মনে করবো কেন? এতো খুব ভালো কথা।
লিউককে সঙ্গে নিয়ে একটা ছোট্ট দরজা দিয়ে বার বাড়ির উঠোনে গিয়ে উপস্থিত হলেন। লিউক অল্পায়াসেই ছাদে উঠে গেল এবং ওখানে দাঁড়িয়ে খানিকটা চেষ্টা করে জানলার শার্সি খুলে তার ভেতর দিয়ে হল ঘরের ভিতরে ঢুকলো। কিছুক্ষণ পরেই মিস ওয়েনফ্লিটের কাছে ফিরে এলো।
যতটা কঠিন বলে মনে হয়েছিলো ততটা কঠিন নয়, হাতে পায়ে একটু জোর থাকলেই হলো। আচ্ছা জানলার বাইরে কোনো রকম চিহ্ন বা ছাপ পাওয়া যায়নি?
মিঃ ওয়েনফ্লিট বললেন–মনে তো হয় না। তাছাড়া, পুলিশের লোকও তো উঠেছিলো ওখানে।
ওকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে এলেন মিস ওয়েনফ্লিট।
লিউক জিজ্ঞেস করে–অ্যামি গিবসের ঘুম খুব গাঢ় ছিলো কিনা আপনি জানেন?
মিস ওয়েনইফ্লিট বলেন–সকালে ওকে ঘুম থেকে জাগানো এক দুরূহ ব্যাপার ছিলো। কোনো কোনোদিন বার বার ওর দরজায় টোকা দিয়ে ওর সাড়া পেতাম না; তবে কথা হচ্ছে যে, যে শুনেও শুনতে চায় না–তাকে আর কে শোনাতে পারে বলুন?
সে তো ঠিকই। আচ্ছা, ওই লোকটি–এলওয়ার্দি–ওর সঙ্গে কি এই মেয়েটির কোনো ব্যাপার-স্যাপার কিছু ছিলো?-প্রশ্নটা করেই সঙ্গে সঙ্গে জুড়ে দেয়–আমি কিন্তু স্রেফ আপনার মতামত জানতে চাইছি।
হা ছিলো।
লিউক মাথা নাড়ে–আপনার কি মনে হয় এলসওয়ার্দিকে ও ব্ল্যাকমেল করতো?
এবারও সেই একই কথা; অর্থাৎ আমার মত যদি চেয়ে থাকেন তাহলে বলবো, ওর পক্ষে তা সম্ভব।
আপনি কি জানেন, মারা যাবার সময় ওর কাছে অনেক টাকাকড়ি ছিলো কিনা?
মিস ওয়েনফ্লিট বললেন–আমার মনে হয় না। ওর কাছে বেশি টাকা থাকলে আমি অন্ততঃ জানতে পারতাম।
মৃত্যুর আগেই কোনো মোটা খরচপত্র করেছিলো কি না জানেন?
যতদূর জানি–করেনি।
তাহলে তো আর ব্ল্যাকমেলতত্ত্ব দাঁড়াচ্ছে না। অবশ্য আরও একটা সূত্র আছে–মেয়েটি হয়তো বিশেষ কোনো ধরনের ঘটনা জানতো।
কোনো ধরনের ঘটনা?
এমন কিছু, যা উইচউডের কোনো ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে অত্যন্ত মারাত্মক। ধরুন, এখানকার বেশ কয়েকটা বাড়িতে মেয়েটি কাজ করত; কাজ করতে গিয়ে সেই বাড়ির কারো একজন সম্পর্কে ও এমন সব তথ্য জেনে ফেললো যা সেই লোকটির আয় উপার্জনের ক্ষতি করতে পারে। ধরুন, মিঃ অ্যাবটের মতো কেউ একজন।
মিঃ অ্যাবট?
লিউক আবার বলে–অথবা ধরুন, ডাঃ টমাসের কোনো গাফিলতি বা ডাক্তার হিসেবে কোনো অপরাধমূলক কাজে প্রশ্রয়দান?
কিন্তু তা কি–মিস ওয়েনফ্লিট বলতে গিয়ে থেমে যান।
লিউক বলে যায়–আপনিই বলেছেন যে অ্যামি গিবস্ ঝি-এর কাজ করতো এবং মিসেস হর্টন যখন মারা যান, তখন ও ওই বাড়িতেই কাজ করতো।
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–আপনি কী বলছেন মিঃ ফিস উইলিয়াম? এর মধ্যে আবার হর্টনদের এনে টানাটানি করছেন কেন? বছর খানেকেরও বেশি হয়ে গেল মিসেস হর্টন মারা গেছেন।
সেই কথাই তো বলছি।
অ্যামি গিবস্ তখন ও বাড়িতেই কাজ করতো।
বুঝলাম। কিন্তু হর্টনরা এর মধ্যে আসে কী করে?
মিসেস হর্টন তো মারাত্মক ধরনের গ্যাস্ট্রাইটিসে মারা গেছেন, তাই না?
হ্যাঁ।
ওর মৃত্যু কি আকস্মিক হয়েছিলো?
আমার কাছে তাই মনে হয়েছিলো। ও বেশ ভালো হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু একেবারেই হঠাৎ একদিন রোগটা প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেল এবং তাতেই মারা গেল।
ডাঃ টমাসও কি খুব আশ্চর্য হয়েছিলেন?
কার বেশ কয়েকটা, এমন সব তথ্য জেনে কেউ একজন
সঠিক জানি না–হয়তো হয়েছিলো!
কিন্তু আপনার নিজের কাছে কি এই মৃত্যুটা অদ্ভুত মনে হয়নি?
তা হয়েছে। ওর চোখেমুখে মৃত্যুর কোনো চিহ্নই ছিলো না–বরঞ্চ অনেকটা সুস্থই মনে হয়েছিলো।
এই অসুস্থতা সম্পর্কে ভদ্রমহিলা কি কিছু বলতেন?
বলতেন যে নার্সরা ওকে বিষ খাওয়াচ্ছে।
আপনি নিশ্চয়ই এসব কথার কোনো গুরুত্বই দেননি?
না, দিইনি। আমি ধরে নিয়েছিলাম যে, এই মনোভাব অসুস্থতার ফল।
লিউক বলে–ভদ্রমহিলা কি ওর স্বামীকে সন্দেহ করতেন?
না না, স্বামীর ওপর কোনো সন্দেহ ওর ছিলো না।
মিস ওয়েনফ্লিট বললেন–আপনার কি তাই মনে হয়?
দুনিয়ার বহু স্বামীরাই তাদের বউকে খুন করে পার পেয়েছে। তাছাড়া, শুনেছি যে স্ত্রীর মৃত্যুতে ভদ্রলোক অনেক টাকাও পেয়েছেন।
তা পেয়েছেন।
এ থেকে আপনার কী মনে হয় মিস ওয়েনটি?
মিস ওয়েনফ্লিট বললেন–আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মেজর হন তাঁর স্ত্রীর প্রতি একান্ত অনুরক্ত ছিলেন; স্বপ্নেও এসব বাজে চিন্তাও ওঁর মাথায় আসেনি।
লিউক বললো-বুঝলাম। আপনি যখন বলছেন তখন হয়তো এ কথাই ঠিক। তেমন কিছু হলে নিশ্চয়ই আপনার চোখে পড়তো।
আচ্ছা, অ্যামি গিবস্ সম্পর্কে পিঙ্কারটন কী ভাবতেন?
বলা খুব কঠিন। ল্যাভিনিয়ার একটা অদ্ভুত ধারণা ছিলো।
কী ধারণা?
ও মনে করতো যে উইচউডে কিছু একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটছিলো।
আচ্ছা, উনি কি ভাবতেন যে টমি পিয়ার্সকে কেউ জানলা থেকে ফেলে দিয়েছিলো?
একথা আপনি কী করে জানলেন মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম?
লিউক বলে–যেদিন উনি খুন হয়েছিলেন, সেদিন আমরা একই সঙ্গে লণ্ডনে যাচ্ছিলাম।
ও আপনাকে ঠিক কী বলেছিলো?
উনি বলেছিলেন যে উইচউডে বড্ড বেশি পরিমাণ লোক মারা যাচ্ছিলো। কয়েকটা নামও উনি করেছিলেন–অ্যামি গিবস, টমি পিয়ার্স এবং কার্টারের নাম। তাছাড়া, উনি ডাঃ আম্বলবির নাম করে বলেছিলেন যে, তারও দিন অতি সীমিত। এমন একজন লোক যার চোখে একটা বিচিত্র দৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায় যে, সেই-ই খুনী। সেই লোকটি যখন আম্বলবির সঙ্গে কথা বলেছিলো, তখন তার চোখের সেই দৃষ্টি উনি দেখতে পেয়েছিলেন এবং তার সঙ্গে কথা বলেছিলো যে, আম্বলবির মৃত্যু আসন্ন।
মিস ওয়েনফ্লিট বললেন–কী সর্বনাশ! এবং তার পরেই সে মারা গেল।
প্রশ্ন করে লিউক–কে সেই লোক? বলুন মিস ওয়েনফ্লিট। আপনি নিশ্চয়ই জানেন–বলুন সে কে?
আমি জানি না–ও আমায় বলেনি।
কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারেন, কে হতে পারে? ওঁর মনে কার কথা ছিলো সে সম্পর্কে অন্ততঃ একটা ধারণা আপনার আছে।
মাথা নিচু করেন মিস ওয়েনফ্লিট।
এবার তাহলে বলুন।-জোর দেয় লিউক।
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–কী করে আপনি আমাকে এমন একটা কাজ করতে বলছেন–যা অত্যন্ত অন্যায়। না জেনে শুধুমাত্র অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কাউকে দোষারোপ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
হেরে গিয়েও কিন্তু লিউক মাথা ঠিক রাখতে জানে। ও যে আবার এই ব্যাপার নিয়ে এখানে আসবে–ওর আচরণের মধ্যে তেমন আভাস দিয়ে বলে–
আপনার বিবেক যা নির্দেশ দেয়, সেই অনুযায়ী আপনি চলুন। যাই হোক, আমাকে আপনি প্রচুর সাহায্য করেছেন–ধন্যবাদ।
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন-আমাকে দিয়ে আর যদি কোনো উপকার হয়, আনায়াসে বলবেন।
নিশ্চয়ই বলবো। আমাদের যা যা কথাবার্তা হলো, কাউকে বলবেন না।
না না, এর একটি কথাও কেউ জানতে পারবে না।
একথার অন্যথা যে হবে না লিউক জানে। আবার ভদ্রমহিলা বললেন–ব্রিজেটকে আমার ভালোবাসা জানাবেন। মেয়েটি ভারী সুন্দর আর বুদ্ধিও রাখে প্রচুর। ও সুখী হোক।
উনি বললেন–লর্ড হুইটফিল্ডের সঙ্গে বিয়েতে ও সুখী হোক–বয়সের পার্থক্যটা বড়ই বেশি।
হুঁ, তা খানিকটা বেশিই।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন মিস ওয়েনফ্লিট–এক সময়ে ওর সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল।
আশ্চর্য হয়ে লিউক ওঁর দিকে তাকায়।
বহুকাল আগের কথা, তখন ও সবেমাত্র ওপরের দিকে উঠেছে। ওর লেখাপড়ায় আমিই সাহায্য করেছিলাম। ওর মধ্যে যে বড় হবার একটা অদম্য স্পৃহা ছিলো, তা নিয়ে আমার গর্বের শেষ ছিলো না। তারপর বললো–অবশ্য আমার বাড়ির লোকেরাই ওর সম্পর্কে বদনাম রটালো। সেই যুগে শ্রেণী বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট ছিলো। ওর উন্নতির দিকে আমি সব সময়ে সচেতন ছিলাম। কিন্তু আমার নিজের লোকেরাই ভুলটা করলো।
লিউকের মনে পড়লো সেও মিস ওয়েনফ্লিটকে একেবারে বৃদ্ধের পর্যায়ে ভেবেছিলো। কিন্তু এখন বুঝতে পারলো যে ভদ্রমহিলার বয়স হয়তো ষাটের নিচে।
মরুকগে, আমার কী?–ও নিয়ে চিন্তা করা আমার কী দরকার? তার চেয়ে যে কাজে এসেছি–তাই-ই করি।
***
লিউকের মনোসংযোগ
অ্যামি গিবসের মামী মিসেস চার্চ একজন নিতান্তই অপ্রীতিকর মহিলা। টিকালো নাক, অস্থির তাকানো আর ঘনঘনে বাচনভঙ্গী-এই সব মিলে মহিলাকে দেখেই অস্বস্তিকর মনে হলো লিউকের।
আমি যে প্রশ্নগুলো করবো, আপনার কাজ হবে তার যতদূর সম্ভব সঠিক উত্তর দেওয়া। যদি কিছু গোপন করেন, তার ফলাফল খুব খারাপ হবে।
আজ্ঞে, বুঝতে পেরেছি। আমি যতটুকু জানি তার সবটাই আপনাকে বলবো। আমি এর আগে কক্ষনো পুলিশী ঝামেলায় পড়িনি।
আমি আপনার বোনঝি-র সম্পর্কে সব কথা জানতে চাই–কে কে ওর বন্ধু ছিলো, কী পরিমাণ টাকা ছিলো, সাধারণত যে সমস্ত কথাবার্তা বলতে তার বাইরে কিছু বলেছিলো কি না। প্রথমেই শুরু করা যাক, কারা ওর বন্ধু ছিলো।
মিসেস চার্চ বললেন–আপনি কি ওর পুরুষ বন্ধুদের কথা বলছেন?
ওর কি মেয়ে বন্ধু ছিলো?
আজ্ঞে বলতে গেলে না থাকারই মতো। আমি তাদের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ রাখতো না। তবে ওই গ্যারাজে জিম হারভে নামে একটি ছেলে আছে, তার সঙ্গেই ওর ব্যাপার-স্যাপার চলছিলো। ছেলেটি কিন্তু বেশ ভালো।
বাধা দেয় লিউক–আর কোনো বন্ধু ছিলো?
আবার সেই নোংরা ধূর্ত চাহনি–ওহো, আপনি সেই ভদ্রলোকের কথা বলছেন, যার খেলনা, পুতুলের দোকান আছে? আমার ওই লোকটাকে মোটেই ভালো লাগতো না-সোজা কথা। নিজের ইজ্জত নিজের হাতে। যেখানে-সেখানে চুকচ্ছুক করা আমি পছন্দ করি না–কিন্তু বলবো কাকে? আজকালকার মেয়েগুলো কি ভালো কথায় কান দেয়? যা মনে হয় তাই-ই করে। কিন্তু পরে পস্তায়।
অ্যামি অনুতাপ করতো?
না, তা মনে হয় করতো না।
মৃত্যুর দিনে আমি গিয়েছিলো ডাঃ টমাসের কাছে–এই সমস্ত কারণেই কি ওখানে গিয়েছিলো?
না না, আপনি যা ভাবছেন তেমন কোনো রোগের জন্য ও ডাক্তারের কাছে যায়নি, এ আমি সঠিক করে বলতে পারি। ও কদিন সর্দিকাশিতে ভুগছিলো, সেই জন্যেই গিয়েছিলো।
আপনার কথাই মেনে নিচ্ছি। কিন্তু ওর আর এলসওয়ার্দির মধ্যেকার ব্যাপার কতদূর এগিয়েছিলো?
মিসেস চার্চ বলেন–সে কথা আমি বলতে পারবো না–অ্যামি ওর গোপন ব্যাপার আমায় কখনো বলতো না।
লিউক বলে–কিন্তু ওরা তো অনেকটাই এগিয়েছিলো?
এই ভদ্দর লোককে এখানকার কেউ ভালো বলতো না। শহর থেকে বন্ধু-বান্ধব এনে কি সমস্ত করতো-টরতো সবাই মিলে ওই ডাইনী মাঠে।
অ্যামি যেতো?
একবার গিয়েছিলো বলে জানি। সারারাত ওখানে ছিলো। লর্ড হুইটফিল্ডের কাছে ধরাও পড়েছিলো। লর্ড খুব বকেছিলেন, আমিও মুখে মুখে জবাব দিয়েছিলো, তাতেই তো ওর চাকরিটা গেল।
ও যাঁদের বাড়ি কাজ করতো, তাদের সম্পর্কে আপনার সঙ্গে কোনো গল্পগুজব করতো?
খুব একটা করতো না।
মেজর হর্টনের বাড়িতেও কিছুদিন কাজ করেছে–না?
তা–প্রায় বছর খানেক হবে।
ছাড়লো কেন?
ভালো মাইনে পেয়ে গেলো। সেই সময়ে ম্যানরে কাজ খালি ছিলো–ওঁদের মাইনে অনেক ভালো ছিলো।
মাথা নাড়ে লিউক।–আচ্ছা, মিসেস হর্টনের মৃত্যুর সময় ওতত ওই বাড়িতেই কাজ করছিলো–তাই না?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
উকিল মিঃ অ্যাবট-তাঁর বাড়িতেও ও কাজ করছে?
না, মিঃ অ্যাবটের বাড়িতে একজন লোক আর তার বউ–এই দুজনে মিলে কাজ করতো। তবে, মিঃ অ্যাবটের বাড়িতে ও একবার গিয়েছিলো–কেন গিয়েছিলো বলতে পারবো না।
এ অঞ্চলের আর কোনো লোকের কাছে ও যাতায়াত করতো?
যা বলেছি তার বাইরে আর কিছু বলতে পারবো না।
মিসেস চার্চ, মনে রাখবেন আমি সত্যি কথা শুনতে চাই।
কিন্তু সেই লোকটা মোটেই ভদ্দরলোক ছিলেন না; আমিও ওকে বলেছিলাম যে, আর নিজেকে অত নিচে নামাস না।–কিন্তু শুনলে তো
মিসেস চার্চ, হেঁয়ালি রেখে স্পষ্ট করে বলবেন?
আপনি সেভেন স্টাপ-এর নাম শুনেছেন? মোটেই ভালো বাড়ি নয় ওটা।–ওই বাড়ির মালিক হলে গিয়ে হ্যারি কার্টার–একটা আস্ত ছোটোলোক; সব সময়ে মদে চুর হয়ে থাকতো।
সেও অ্যামির বন্ধু ছিলো?
দুএকদিন ওর সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলো।
লিউক অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়–টমি পিয়ার্স নামে একটা ছোটো ছেলেকে চিনতেন?
কাকে? মিসেস পিয়ার্সের ছেলেকে? খু-উ-ব ভালো করে চিনতাম–হাড়বজ্জাত ছিলো।
ওর সঙ্গে কি অ্যামির ঘন ঘন দেখাশুনো হতো।
না না, অ্যামির সঙ্গে বজ্জাতি করতে গেলে ওর কান আর আস্ত থাকতো না।
মিস ওয়েনফ্লিটের কাছে ও খুশী মনে ছিলো?
ওখানে মাইনেপওর ভালো ছিলো না, আর খুব একঘেঁয়েমি ছিলো।
ও অন্য কোথাও চলে যেতে পারতো না?
লণ্ডনের কথা বলছেন?
কিংবা, দেশের অন্য কোনো অঞ্চলে?
মিসেস চার্চ বলেন–অ্যামি উইচউডের ওই সব কাণ্ডকারখানা ছেড়ে যেতে চাইতো না।
ওই সব বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?
জিম আর সেই খেলনা-পুতুলের দোকানের ভদ্দরলোকদের সঙ্গে ওর দহরম-মহরমের ব্যাপার।
মিসেস চার্চের কাছে জানার মতো আর বিশেষ কিছু নেই। কিন্তু তবুও শেষ বারের মতো আন্দাজে একটা ঢিল ছুঁড়লো।
বুঝতেই পারছেন যে, এই সমস্ত প্রশ্ন আপনাকে কেন করলাম। দুর্ঘটনার ফলে ও মারা গেছে–এটা ঠিক মেনে নিতে পারছি না এবং তা যদি না হয়, তাহলে বুঝে নিন যে এটা কী হতে পারে।
মিসেস চার্চ বলেন–হত্যাকাণ্ড।
ঠিক। ধরে নিন যে, আপনার বোনঝি এক হত্যাকাণ্ডের ফলে মারা গিয়েছিলো–কাকে আপনি সন্দেহ করেন?
মিসেস চার্চ বললেন–আচ্ছা, পুলিশকে খুনীর হদিস বলতে পারলে পুরস্কার পাওয়া যাবে?
তা হয়তো পাওয়া যেতে পারে।
কিন্তু একেবারে ঠিক ঠিক বলতে পারবো না–তবে ঐ খেলনার দোকানের লোকটাকে আমার যেন কেমন মনে হয়। ক্যাস্টর মামলার কথা মনে করে দেখুন–সেই মেয়েটার খুনের খুঁটিনাটি সব প্রমাণ পেলো ক্যাস্টর সৈকতের সেই বাংলো বাড়িটায়, আর তা থেকেই অন্য মেয়েদের খুনের কথা সব বেরিয়ে পড়লো। এই এলসওয়ার্দিও হয়তো এমনই একজন।
আপনার তাই মনে হচ্ছে?
হতেও তো পারে; বলুন পারে কি না?
লিউক স্বীকার করে, হা হতেও পারে। তারপর বলেন–আচ্ছা ডারবী খেলার দিন বিকেলে এলসওয়ার্দি কোথাও বাইরে গিয়েছিলো? এটা কিন্তু খুব দরকারী।
চিন্তিতভাবে মিসেস চার্চ বলেন–ডারবীর দিনে?
হ্যাঁ, দিন পনেরো আগের এক বুধবার।
মিসেস চার্চ বলেন-তা বলতে পারবো না। তবে বুধবার এমনিতেই ওর দোকান সকাল সকাল বন্ধ হয়। সেদিন ও সাধারণতঃ শহরে যায়।
ওহো, আগেই বন্ধ হয়?
উঠে পড়ে লিউক। মানুষ হিসেবে মহিলাকে ওর মনে হয়েছে অত্যন্ত নিম্নশ্রেণীর। তবে বিচ্ছিন্নভাবে পরচর্চার মধ্য থেকে কিছু কিছু দরকারী খবর ও সংগ্রহ করতে পেরেছে।
নিজের মনে ও সমস্ত খবরগুলো পর্যালোচনা করে। ওই চারজনের নামই ঘুরে ফিরে মনে আসছে–টমাস, অ্যাবট, হর্টন আর এলসওয়ার্দি। মিস ওয়েনফ্লিটের কথাবার্তা থেকেও এই চারজনের যে-কোনো একজনকেই সন্দেহ হচ্ছে। কোনো মাংসওয়ালা, বা রুটিওয়ালা অথবা মোমবাতি বিক্রেতা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়।
প্রথমেই দেখতে হবে যে, মিস ওয়েনফ্লিট-এর নাম বলতে অনিচ্ছার কী কারণ; ভদ্রমহিলার বিচার-বিবেচনা অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ এবং মানবিক। ওঁর ধারণা যে মিস পিঙ্কারটন যাকে সন্দেহ করেন সেই লোকে কে তা ওঁর জানা; কিন্তু আবার বলছেন যে সেটা ওঁর বিশ্বাস মাত্র–সত্যি না-ও হতে পারে।
কাকে সন্দেহ করেন মিস ওয়েনফ্লিট?
মিস ওয়েনফ্লিটের ভয় যে, ওঁর দোষারোপের ফলে একজন নিরপরাধ লোকের ক্ষতি হতে পারে। এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় সেই লোকটি সমাজে উচ্চ প্রতিষ্ঠিত এবং আশেপাশের সবাই তাকে সম্মান করে।
সুতরাং, এইদিক থেকে বিচার করলে আর এলসওয়ার্দিকে সন্দেহ করা চলে না। উনি উইচউডে নতুন এসেছেন; তাছাড়া, সুনামও নেই।
এবার আর কে কে আছে দেখা যাক। মেজর হর্টন তার স্ত্রীকে বিষ খাওয়াতে পারেন কিনা এই প্রসঙ্গ উঠতেই মিস ওয়েনফ্লিট বিরক্তির সঙ্গেই এই সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেন। মিসেস হর্টনের মৃত্যুর পরের খুনগুলো নিয়ে মিস ওয়েনফ্লিট যদি কোনোরকম সন্দেহ করতেন হর্টনকে, তাহলে বিষ প্রয়োগের প্রশ্নে এতটা নিঃসন্দেহ হতে পারতেন না।
এবার বাকি থাকছেন ডাঃ টমাস আর মিঃ অ্যাবট। পেশার দিক থেকে দুজনেই স্বাধীন এবং পদমর্যাদাসম্পন্ন। দুজনেই মোটামুটি জনপ্রিয় এবং প্রতিবেশীদের মধ্যে সুপরিচিত। এই সব তথ্যের দিক থেকে বিচার করলে দুজনকেই সমানভাবে সন্দেহ করা চলে।
মিস পিঙ্কারটন নিশ্চিতভাবে জানতেন সেই লোকটিকে। তার প্রথম প্রমাণ ওঁর নিজের মৃত্যু এবং দ্বিতীয় প্রমাণ ডাঃ আম্বলবির মৃত্যু। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে যে, মিস পিঙ্কারটন সেই লোকটির নাম মিস ওয়েনফ্লিটের কাছে বলেননি।
স্বগতোক্তি করে লিউক–ধরে নেওয়া যাক যে, এলসওয়ার্দিই খুনী, এবং এটা আমার বেশ ভালো করেই জানা। এবার আসা যাক, একের পর এক যারা খুন হয়েছে : এক নম্বর–মিসেস হর্টন। মিসেস হর্টনকে খুন করার পেছনে এলসওয়ার্দির কী উদ্দেশ্য চরিতার্থ হলো বোঝ কঠিন। মিসেস হর্টন এলসওয়ার্দির কাছ থেকে কি সব তুকতা ওষুধ নিয়েছিলো। সেই ওষুধের সঙ্গে খুব সহজেই কিছু আর্সেনিক মিশিয়ে দেওয়া মোটেই কঠিন ছিলো না। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে কেন?
এবার আসা যাক অ্যামি গিবসের প্রসঙ্গে। এলওয়ার্দির কী অভিসন্ধি থাকতে পারে অ্যামিকে খুন করার পেছনে? সহজেই যে কারণটা মনে আসে, তা হলো এই যে, আমি কোনো বিষয়ে আশাহত হয়েছিলো এবং তার জন্য ভয় দেখিয়েছিলো। হয়তো বা লর্ড হুইটফিল্ড উইচউডে বেশ প্রভাবশালী এবং ব্রিজেটের মতে তিনি একজন যথার্থ চরিত্রবান লোক। এলওয়ার্দির সেই সব অসামাজিক বীভৎস কাণ্ডকারখানার কথা জানাজানি হয়ে গেলে লর্ড হুইটফিল্ড ছেড়ে দিতেন না। অতএব, সরাও অ্যামিকে। যেভাবে খুন করা হয়েছে, তাতে মনে হয় না যে স্রেফ খুন করার আনন্দে খুন করা হয়েছে।
এরপর কে? কার্টার? কার্টার মরলো কেন? মাঝরাতের পিশাচ সাধনার কথা তো ওর জানবার কথা নয়। এমন হতে পারে যে, ওর সুন্দরী তরুণী মেয়েটি এসব ভুতুড়ে ব্যাপারের সঙ্গে জড়িত ছিলো। এলসওয়ার্দি হয়তো মেয়েটির ওপর পাশবিক অত্যাচার করতো তাতে কার্টার খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিলো তার জন্যই তাকে খুন করা হয়েছে।
এরপর টমি পিয়ার্স। টমিকে কেন এলসওয়ার্দি মারতে গেল? টমি সেই মাঝরাতের পৈশাচিক পুজো-পার্বণের ব্যাপারে ছিলো এবং সবাইকে বলে দেবে বলে ভয় দেখিয়েছিলো। হয়তো বা বলেছিলোও সুতরাং, টমির মুখ বন্ধ করার প্রয়োজন ছিলো।
ডাঃ আম্বলবিকে কেন খুন করলো? খুবই সহজ কারণে। ডাক্তার হিসেবে আম্বলবি ধরে ফেলেছিলো ওর মানসিক বৈকল্যের ব্যাপার। তার ফলেই আম্বলবির জীবনাবসান। এলসওয়ার্দি কী উপায়ে ডাঃ আম্বলবির রক্ত বিষিয়ে দিতে পারলো?
সবার শেষে মিস পিঙ্কারটন। বুধবার তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধের দিন। এলসওয়ার্দি সেদিন দোকান বন্ধ করে শহরে চলে গেল। ওর গাড়ি আছে না কি? যাকগে, এলসওয়ার্দি টের পেয়েছিলো যে, মিস পিঙ্কারটন ওকে সন্দেহ করেন সুতরাং তিনি হয়তো খুন হন।
মাথা নাড়তে নাড়তে লিউক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর আবার যুক্তির সাগরে ডুব দেয়।
অ্যাবট হতে পারে? ভদ্রলোক সুচতুর এবং আত্মবিশ্বাসী-খুনীরা সাধারণতঃ এমন হয়ে থাকে। আমি গিবস একবার এর সঙ্গে দেখা করেছিলো। কী কারণ হতে পারে? অ্যামি দেখা করতে চেয়েছিলো কেন? আইনের পরামর্শ নেবার ব্যাপারে? কে যেন বলেছিলো যে–জনৈক মহিলার কাছ থেকে একটা চিঠি এসেছিলো যেটা টমি দেখে ফেলেছিলো। সেই চিঠি কি অ্যামি লিখেছিলো? না কি মিসেস হর্টন? হয়তো অ্যামি সেই চিঠি হাত করেছিলো। এরা ছাড়া কে আর এমন মহিলা থাকতে পারে–যার চিঠি দৈবক্রমে টমি দেখে ফেলতে ভদ্রলোক রেগে অগ্নিশর্মা হয়েছিলেন? অ্যামি কেমন করে মারা গেল? হ্যাট পেইন্ট খেয়ে? কিন্তু টমি পিয়ার্সকে মারলো কেন?–স্বাভাবিক কারণ। চিঠিটা দেখে ফেলেছিলো বলে।
কিন্তু কার্টার? সম্ভবতঃ কার্টারের মেয়ের সঙ্গে একটা কিছু হয়েছিলো। অ্যাবটের পক্ষে সেই কেলেঙ্কারির কথা জানাজানি হওয়া ভয়ানক ক্ষতিকর হতো। কার্টারের যা মোটাবুদ্ধি আর উগ্র মেজাজও হয়তো অ্যাবটুকে শাসিয়েছিলো। অতএব কার্টারও খতম হলো।
এবার আম্বলবি। অ্যাবটের মতো ধূর্ত প্যাচালো উকিলের বিরুদ্ধে আম্বলবির মতো সহজ-সরল লোকের জেহাদ ঘোষণা। এর ফলে তার মৃত্যু।
এরপর পিঙ্কারটন। যে লোকটি ধরেই নিয়েছিলো যে, যে সব সন্দেহের অতীত তারই ওপর মিস পিঙ্কারটনের সন্দেহ হলো। মিস পিঙ্কারটন সেই ভয়াবহ গোপন কথাটি জেনে ফেললেন। কিন্তু তাহলেও হাতে কোনো প্রমাণ ছিলো না। স্বভাবতই তিনি প্রমাণ যোগাড়ের চেষ্টায় ছিলেন। অ্যাবটন লোকচরিত্র খুব ভালোই বোঝে। অতএব পিঙ্কারটন খুন হলেন।
চিন্তাসূত্রে লিউকের ছেদ পড়ে। মেজর হর্টনও যে একজন সার্থক খুনী হতে পারেন, সেই সম্ভাবনার সূত্র ধরতে ওর কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হয়।
হর্টন ওঁর স্ত্রীকে খুন করেছিলো। একথা ধরে নিয়েই হর্টনের প্রসঙ্গ আরম্ভ করা যাক। হর্টনের খুন করার পেছনে যথেষ্ট কারণ ছিলো এবং স্ত্রীর মৃত্যুতে ওঁর প্রচুর লাভও হয়েছিলো। সুনিপুণ হাতে স্ত্রীকে হত্যা করার জন্য স্ত্রীর প্রতি অস্বাভাবিক অনুরাগ খুব একটা প্রয়োজনীয় ছিলো না।
এরপর অ্যামি গিবস। সহজ ব্যাপার। অ্যামি যে সময়ে ও বাড়িতে কাজ করতো; কিছু একটা হয়তো দেখে ফেলেছিলো। মেজরের পক্ষে স্ত্রীর চায়ের সঙ্গে কোনো বিষ মিশিয়ে দেওয়া কিছু কঠিন কাজ ছিলো? প্রথম দিকে আমি হয়তো বুঝতে পারেনি; কিন্তু যখন বুঝেছে তখন হ্যাট পেইন্টের সাহায্যে ওকেও সরানো মেজরের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক।
এরপর কার্টার। অ্যামি হয়তো কার্টারকে কিছু বলেছিলো; অতএব, আরো একটা সাদাসিধে খুন।
এবার টমি পিয়ার্স। সম্ভবতঃ অ্যাবটের অফিসে ও যে চিঠিটা দেখেছিলো সেটা হয়তো মিসেস হর্টনের লেখা। উনি হয়তো লিখেছিলেন যে, ওর স্বামী তাঁকে বিষ খাইয়ে মারবার চেষ্টা করেছিল? অতএব মেজর বুঝতেই পেরেছিলেন টমি ওঁর পক্ষে বিপজ্জনক। তাই টমিকে খুন করা হলো।
এবারই হলো আসল এবং কঠিনতম সমস্যা। আম্বলবি। কী উদ্দেশ্য? দুরুহ ব্যাপার। মিসেস হর্টনকে প্রথমদিকে আম্বলবিই দেখেছিলেন। রোগের ধরন দেখে হয়তো কিছু একটা আঁচও করেছিলেন; ফলে হর্টন স্ত্রীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে টমাসকে এনেছিলো। কিন্তু তাহলে একদিন বাদে আম্বলবির বিপদ এলো কেন? মুশকিল। তাছাড়া ওঁর মৃত্যুর পদ্ধতিও ঠিক ছকে মিলছে না। বিষিয়ে যাওয়া আঙ্গুলের সঙ্গে মেজরের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
লিউকের চিন্তার ভারে ভুরু-কপাল কুঁচকে আসে।
আমার মনে হয় না এ সব এলওয়ার্দির কাজ–ওদেরই মধ্যে কেউ একজন–কে জানে, আবার হতেও পারে, ওর কথাই সবার মনে আসে। মিস ওয়েনফ্লিট মূর্খ নন, কাকে সন্দেহ করেন ভদ্রমহিলা? অ্যাবটকে না টমাসকে? নিশ্চয়ই এই দুজনের একজনকে। যদি একটু কায়দা করে ওঁকে সরাসরি প্রশ্ন করি-বলুন এদের মধ্যে কে?–হয়তো উত্তরটা পেয়ে যেতে পারি।
কিন্তু মিস ওয়েনফ্লিটের ভুল হতে পারে। উনি যে সঠিক বলেছেন, সেকথা তো প্রমাণ করার উপায় নেই–যেমন মিস পিঙ্কারটন প্রমাণ করেছিলেন নিজের প্রাণের বিনিময়ে। আমার প্রয়োজন অকাট্য প্রমাণ। যদি আর একটা তেমন ঘটে মাত্র আর একজনের জীবন বলি হয় তাহলেই হয়তো বুঝতে পারতাম…
লিউক চিন্তায় ছেদ টানে। কী সর্বনাশ! আমি একজনের মৃত্যু কামনা করছি?
***
ড্রাইভারের অসম আচরণ
সেভেন স্টারস্ বার-এ শেষ পর্যন্ত বেশ বিব্রত হয়েই লিউক ওর বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দেয়।
অগত্যা কাউন্টারের ওপাশের মেয়েটির মনোরঞ্জনে মন দিলো। এই মেয়েটি যে লুসি কার্টার এটা ও প্রথমেই অনুমান করেছিলো।
লিউক পরিষ্কার বুঝতে দেয় যে, ও মেয়েটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। মিস কার্টারও খিলখিল করে হেসে বলে–আপনি কি সত্যিই আপনার সঙ্গে বেড়াতে যেতে বলছেন না ওটা শুধুই কথার কথা?
লিউক এক চুমুকে বাকি বিয়ারটুকু শেষ করে উঠে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে ও নদীর ওপর যেখানে পায়ে চলার জন্য সাঁকো আছে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়।
পেছন থেকে হঠাৎ কে যেন কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে–এই সেই জায়গা। এখান থেকেই হ্যারি পড়ে গিয়েছিলো।
ও পেছন ফিরেই লোকটিকে চিনতে পারলো। ওই লোকটি কিছুক্ষণের আগেই ওর পাশে বসে মদ খাচ্ছিলো। সেই-ই এখন সানন্দে এগিয়ে এসেছে মৃত্যুদৃশ্যের বর্ণনায়।
ঐতো, ওখানে একেবারে কাদার মধ্যে মাথাটা পুরো ডুবে গিয়েছিলো।–লোকটি বললো।
ওখান থেকে পড়ে যাওয়াটা ভারী অদ্ভুত।–বললো লিউক।
লোকটি বলেও একেবারে পাঁড় মাতাল অবস্থায় ছিলো।
তা হয়তো ছিলো; কিন্তু ঐ অবস্থায় তো ও প্রতিদিন থাকতো।
সে আপনি যথার্থ বলেছেন–হ্যারি প্রায় সব সময়েই মদের ঘোরে থাকতো।
লিউক বললো–কেউ হয়তো ওকে ওখান থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলো।
তা হবে। তবে এমন কাজ কে করতে যাবে? আমার তো মাথায় আসছে না!
মাতাল অবস্থায় ও যখন যাকে গালাগাল করতো, তাদের মধ্যেই হয়তো কেউ কেউ ওর শত্রু ছিলো।
তা সত্যি। কিন্তু সেজন্য ওকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে–তা মনে হয় না।
লিউক প্রসঙ্গ বদলে বলে যেভাবেই ঘটে থাক–ঘটনাটা কিন্তু খুব দুঃখের।
ওর বউ আর মেয়ে লুসি খুব একটা দুঃখিত বলে আমার মনে হয় না। বৃদ্ধ লোকটি বলে।
হ্যারি কার্টারকে নিয়ে আলোচনায় ছেদ টেনে ওরা পরস্পরকে বিদায় দেয়।
ওল্ড হলের দিকে লিউক পা বাড়ায়। বাড়ির সামনের দুটো ঘরে লাইব্রেরি; ঘর দুটো পেরিয়ে ও পেছনের দিকে যায়। একটা ঘরের দরজায় লেখা আছে-মিউজিয়াম। সেইখানে আছে রোম দেশের কিছু টাকা পয়সা, কিছু বাসনপত্র। এছাড়া আছে মেজর হর্টনের দেওয়া কিছু ভারতীয় দেব-দেবী–যার মধ্যে আছে বিকট দর্শন এক বুদ্ধমূর্তি। আর রয়েছে কিছু মিশরীয় সন্দেহজনক পুঁতির মালা।
লিউক আবার হলে ঢোকে। সেখানে কাউকে না দেখতে পেয়ে উপরে উঠে যায়। ওর মতে বেশির ভাগ ঘরগুলোই বাজে জবরজং লটবহরে ভর্তি। কোথাও কোথাও আবার রাখা আছে মান্ধাতার আমলের গল্প-উপন্যাসের বই।
জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় লিউক। টমি হয়তো জানলার ওপর দাঁড়িয়ে পরিষ্কার করছিলো। এমন সময় একজন কেউ এখানে এলো। সেই লোকটি কথায় কথায় একেবারে কাছে এগিয়ে এলো। অতঃপর-অতর্কিতে এক ধাক্কা।
ও নিজের মনে বলে–যে কেউ অতি সহজেই এসে কাজ হাসিল করে চলে যেতে পারে।
মিস ওয়েনফ্লিট বগলে একগাদা বই নিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসেন। মুখে চোখে একটা পরিতৃপ্তি-মাখানো ব্যস্ততার ছাপ। লিউককে দেখে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার চোখ।
আরে, মিঃ ফিস্ উইলিয়াম্! আমাদের মিউজিয়ামটা দেখেছেন? যদিও দেখবার মতো বিশেষ কিছুই নেই; তবে লর্ড হুইটফিল্ড বলেছেন যে ভালো ভালো কিছু দর্শনীয় জিনিষ উনি এনে দেবেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, বলেছেন লণ্ডনের বিজ্ঞান-মন্দিরে যেমন আছে, তেমনি আধুনিক, কিছু কিছু দ্রষ্টব্য–এ্যারোপ্লেন, রেল-ইঞ্জিনের মডেল–এইসব আর কি।
এগুলো আনলে মিউজিয়ামের চেহারা অনেক ভালো হবে।
তা হবে। আমি একথা মানি না যে, মিউজিয়াম কেবলমাত্র অতীতের আস্তানা। আপনার কী মত?
তা হয়তো নয়।
ওসব ছাড়া আরও নানা রকম জিনিষপত্র আসবে–যেমন, খাবারদাবার এবং সেগুলোর। গুণগত তাৎপর্য; কোন খাদ্যে কী কী ভিটামিন ইত্যাদি। লর্ড হুইটফিল্ড উপযুক্ততার মতবাদে দারুণ বিশ্বাসী।
এই ধরনের কথাই উনি সেদিন বলেছিলেন।
আমার মতে বর্তমানই হলো আসল। লর্ড হুইটফিল্ড কিন্তু বলেছিলেন যে, একদিন উনি ওয়েলারম্যান গবেষণাগারে কী কী সব জীবাণু, জীবাণুতত্ত্ব এবং সে সব নিয়ে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা দেখে এসেছেন–যেটা আমার বুদ্ধিতে কুলালো না।
লিউক বললো,–লর্ড হুইটফিল্ডও হয়তো কিছুই বোঝেননি। ওঁর চেয়ে আপনার মাথা অনেক পরিষ্কার।
মিস ওয়েনফ্লিট বললেন–এ আপনি নেহাই আমার প্রশংসা করলেন মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম।
লিউক বললো–মিউজিয়ামটা একটু ঘুরে ঘুরে দেখে ওপরতলার সেই জানলাটা দেখতে গিয়েছিলাম।
অর্থাৎ যেখান থেকে টমিযেন শিউরে ওঠেন মিস ওয়েনফ্লিট-উঃ কী ভয়াবহ সেই ব্যাপার।
হ্যাঁ, ব্যাপারটা সুন্দর নয় মোটেই। অ্যামির মামী মিসেস চার্চের ওখানে ঘণ্টাখানেক ছিলাম। ভদ্রমহিলা মোটেই সুবিধের নয়।
আপনি ঠিকই ধরেছেন।
আমাকে বাধ্য হয়েই বেশ কিছুটা কড়া হয়ে কথাবার্তা বলতে হয়েছে। আমার ধারণা, মহিলা ধরেই নিয়েছিলো যে, আমি একজন পুলিশের কোনো কর্তাব্যক্তি।
মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম, ওকে সব বলে আপনি কি ঠিক কাজ করলেন?
সঠিক বুঝতে পারছি না। তবে, একদিন না একদিন আমাকে বলতেই হতো। আসল ঘটনা। জানবার জন্য সোজাসুজি প্রশ্ন আমাকে করতে হতোই।
মাথা নাড়েন মিস ওয়েনফ্লিটজানেন তো, এসব জায়গায় যে-কোনো খবর আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে!
অর্থাৎ, আপনি বলছেন যে, যখন আমি রাস্তা দিয়ে যাবো, লোকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলবে–ওই চললো টিকটিকি? ওতে বিশেষ কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না, বরঞ্চ এর ফলে আমি হয়তো আরও বেশি খবর পাবো।
আমি কিন্তু সে কথা ভাবছি না। আমার ভয়, সেই লোকটি টের পেয়ে যাবে। সে বুঝে ফেলবে যে আপনি ওর পেছনে লেগেছেন। –মিস ওয়েনফ্লিটের কথায় একটা দমচাপা আর্তি।
লিউক বলে–তা হয়তো বুঝতে পারবে।
সেটা যে কি ভয়ানক হবে বুঝতে পারছেন না? অত্যন্ত বিপজ্জনক।
লিউক বলে–আপনি বলতে চান, হত্যাকারী এবার আমার ওপর চড়াও হবে?
মজার কথা কি জানেন, এদিকটা আমি একেবারে ভেবে দেখিনি। আপনি হয়তো ঠিকই ভেবেছেন। দেখা যাক্, তাই যদি ঘটে তাতে আমার লাভ সবচেয়ে বেশি।
আপনি কি বুঝতে পারছেন না যে, সেই লোকটা–লোকটা প্রচণ্ড ধূর্ত আর শেয়ালের মতো সতর্ক?
লিউক বলে–আপনার কথাই হয়তো ঠিক।
মিস ওয়েনফ্লিট যেন আঁতাকে ওঠেন–সত্যি বলছি। আমার মোটেই ভালো লাগছে না। আমি খুব শঙ্কিত।
আপনি ভয় পাবেন না। আমি সাবধানে চলবো। কিন্তু ভেবে দেখুন, বিভিন্ন সম্ভাবনাগুলো গুছিয়ে আমি এমন এক জায়গায় এনেছি যে এখন আমার মোটামুটি একটা ধারণা হয়েছে যে, কে খুন করে থাকতে পারে…
চকিতে চোখ তুলে তাকান ভদ্রমহিলা।
লিউক প্রশ্ন করলো–মিস ওয়েনফ্লিট, ডাঃ টমাস আর মিঃ অ্যাবট–এই দুজনের মধ্যে কাকে আপনার খুনী বলে মনে হয়?
মিস ওয়েনফ্লিট হাঁফ ছাড়েন–ওঃ। আমি জানি না কিছু জানি না। বলেই আচমকা ঘুরে দাঁড়ান। লিউক বুঝতে পারে না।
লিউক বলে–আপনি কি বাড়ি যাচ্ছেন?
না, এই বইগুলো নিয়ে মিসেস আম্বলবির বাড়ি যাচ্ছিলাম। আপনার ম্যানরে ফেরবার পথেই বাড়িটা। চলুন, আরও কিছুটা পথ একসঙ্গেই যাওয়া যাবে।
সেই ভালো চলুন।
পেছন ফিরে লিউক বাড়িটার রাজকীয় গঠনের দিকে একবার তাকিয়ে বলে–আপনার বাবার আমলে বাড়িটা হয়তো আরও কত সুন্দর ছিলো।
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন-আমরা সবাই মিলে এই বাড়িটায় খুব সুখে ছিলাম। অন্য আর পাঁচটা বাড়ির মতো এই বাড়িটাও যে ভাঙ্গা হয়নি, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।
সেটা কিন্তু সত্যিই দুঃখের হতো।
এবং, সত্যি কথা বলতে কি–এই নতুন বাড়িগুলো খুব একটা সুন্দর হয় না।
আমারও মনে হয় এই বাড়িগুলো বেশিদিন টিকবে না।
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–তবে একথা সত্যি যে, আধুনিক বাড়িগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে খুব একটা পরিশ্রম করতে হয় না, পুরানো বাড়ির দাওয়া বারান্দা এত বড় বড় হয় যে, শুধু মেঝে মুছতেই দম শেষ।
সম্মতি জানায় লিউক।
মিস ওয়েনফ্লিট ইতস্ততঃ করে বলেন–এমন সুন্দর বিকেল–আমার বড় ভালো লাগছে। চলুন, আপনার সঙ্গে বরং আর একটু এগিয়ে যাই। হাওয়াটা খুব ভালো লাগছে।
লিউক এ প্রস্তাবে সানন্দে আগ্রহ দেখায়। কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না, এমন বিকেলকে কী করে সুন্দর বলা যায়।
অবশ্য মিস ওয়েনফ্লিটের মধ্যে বেশ স্ফুর্তির ভাব। লিউকের সঙ্গে যেতে যেতে একনাগাড়ে গল্প করে যাচ্ছিলেন।
লর্ড হুইটফিল্ডের বাড়ির গেটে ঢুকতেই দুধারে দুটো কারুকার্য করা মনোরম থাম দিয়ে সাজানো। থাম দুটোর ওপরে দুটো বিশালাকায় গোলাপী পাথরের আনারস। এত কিছুর মধ্যে আনারস কেন?–এ প্রশ্নের সমাধান লিউক করতে পারেনি। তবে শুনেছে যে, লর্ড হুইটফিল্ডের মতে আনারসের মধ্যে একটা বিদগ্ধ আর উন্নত রুচির পরিচয় আছে।
ওরা গেটে ঢুকতেই শুনতে পেলো কেউ একজন রেগে প্রচণ্ড চিৎকার করছে। একটু এগোতেই দেখলো লর্ড হুইটফিল্ড একজনকে ধমকাচ্ছেন।
যাও, তোমার চাকরি গেল। শুনছো, তোমাকে আর আমি রাখবো না।
এইবারের মতো মাফ করে দিন হুজুর।
না, মাফ আমি করবো না। আমার গাড়ি নিয়ে বাইরে যাওয়া। তার ওপর গাড়িতে বসেই মদ খেয়ে ফুর্তি করা–হ্যাঁ, তুমি করেছে–অস্বীকার কোরো না। পই পই করে বলেছি, আমার জমিদারিতে তিনটে ব্যাপার কিছুতেই করা চলবে না–মাতলামো, দুশ্চরিত্রতা আর অবাধ্যপনা।
লোকটিও বললো-বুড়ো বেজন্মা–সব সময়ে এই কোরো না, সেই কোরো না! তোর কথা শুনে বমি আসে। তোকে চিনতে আমার বাকি আছে। আমার আর তোর মধ্যে ফারাক কোথায় রে?
লর্ড হুইটফিল্ড একেবারে ছাইয়ের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন।
এত স্পর্ধা তোমার? কোনো সাহসে তুমি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছো?
মোটর চালকটি রুখে এগিয়ে যায়। লিউক ততক্ষণে এগিয়ে আসে; গাড়ির চালককে ধমক দেয়-যাও এখান থেকে।
ড্রাইভারটি বলে–আমি লজ্জিত। কি করে যেন আমার মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গেল।
লোকটি বিদায় হতেই লর্ড হুইটফিল্ড রাগে ফেটে পড়েন,–কী নির্লজ্জ অসভ্যতা! আমায়! শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গে এহেন বর্বরতা! ওই লোকটার শিগগিরই একটা কিছু ঘটবে। ছোটো বড় বোধ নেই–কাকে কী সম্মান দিতে হয় তা পর্যন্ত জানে না। বলতে বলতে চুপ করে যায়। এতক্ষণে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা মিস ওয়েনফ্লিটের দিকে চোখ পড়ে। –হনরিয়া তুমি? এঃ, আমার ভাবতেই লজ্জা করছে যে, এমন একটা ন্যাক্কারজনক ঘটনা তোমার চোখে পড়লো।
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–লোকটির তখন জ্ঞানগম্যি ছিলো না লর্ড হুইটফিল্ড।
ও পুরো মাত্রায় মাতাল ছিলো–একেবারে পাঁড় মাতাল।
কেবল মাত্র একটু রেগে ছিলো এই যা।–ফোড়ন কাটে লিউক।
লর্ড হুইটফিল্ড বলেন–তোমরা জানো ও কী করেছে? আমার ছোটো গাড়িটা ব্রিজেট নিজেই চালিয়ে আমাকে লাইনে নিয়ে গিয়েছিল; আর সেই ফাঁকে আমার গাড়ি বের করে ওই লুমি কার্টার না কি যেন নাম মেয়েটার, তাকে নিয়ে ও বেড়াতে গিয়েছিলো।
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন,–অত্যন্ত অন্যায় করেছে।
বলো, অন্যায় নয়?–লর্ড বললেন।
কিন্তু আমি জানি এরজন্য ওকে অনুতাপ করতে হবে।
আমি ওকে অনুতাপ করিয়ে ছাড়বো।
আপনি তো ওকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেইছেন।–মনে করিয়ে দেয় মিস ওয়েনফ্লিট।
লর্ড হুইটফিল্ড বলেন–ওই লোকটার ওতেই শেষ হবে না। তারপর বলেন, চলো না হনরিয়া, বাড়িতে গিয়ে একটু শেরী খাওয়া যাক।
আপনি বললেন এই-ই যথেষ্ট লর্ড, কিন্তু এই বইগুলো নিয়ে আমাকে একবার এক্ষুনি মিসেস আম্বলবির কাছে যেতে হবে। চলি। মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম–আশা করি, এবার আপনি নিরাপদ বোধ করবেন।
লিউকের আত্মনিবেশ ভাঙ্গে লর্ড হুইটফিল্ডের কথায়।
ওই হনরিয়া ওয়েনফ্লিট–অত্যন্ত বুদ্ধিমতী আর কাজের মহিলা।
আমারও তাই মনে হয়।
আজকের মতো তখন ও মোটেই রোগা আর এত বিশীর্ণ ছিলো না-রীতিমত সুন্দরী ছিলো। এখন যেন ভাবতেও কেমন লাগে। তখন ওরাই ছিলো এখানকার সম্ভ্রান্ত পরিবার।
তাই নাকি?
কর্নেল ওয়েনফ্লিটের তখন এখানকার জনমানসে দারুণ প্রভাব; সবাই ওঁকে সেলাম ঠুকে চলত। অত্যন্ত রক্ষণশীল প্রকৃতির লোক ছিলেন, তেমনি ছিলেন গর্বিত।
তারপর বললেন–হনরিয়া যখন আমাকে বিয়ে করবে বলে পরিবারের সবাইকে বললো, তখন যেন একেবারে তপ্ত কড়ায় ঘি পড়লো। ও নিজেকে পরিবর্তন পন্থী বলতো। জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে ছিলো। তাছাড়া, ও যা ভাবতো, তা আরম্ভ করবার চেষ্টা করতো।
ও, তাহলে ওর পরিবার থেকে এমন সুন্দর সম্ভাবনাকে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিলো?
ঠিক তা নয়, আসলে একটা সামান্য কারণে আমাদের মধ্যে একটা কথা কাটাকাটি হয়েছিলো। ওর কতকগুলো অতি বিচ্ছিরি বেড়াল আর কতকগুলো বিরক্তিকর ক্যানারী ছিলো। পাখিগুলো সব সময়ে কিচিরমিচির করতো। অতি বিরক্তিকর। তারপর সেই একটা পাখির ঘাড় মটকাবার ঘটনাটা ঘটায়–সে এক বিশ্রী ব্যাপার। যাকগে, অতীতের চর্বিতচর্বণ করে কী-ই-বা হবে? ও ভুলে যাওয়াই ভালো।
কথাগুলো এমনভাবে বললো যেন মনে হলো একটা দুর্বল চিন্তার বোঝা শরীর থেকে। ঝেড়ে ফেলে দিলেন। তার পরেই বললেন,–মনে করবেন না যে, ও আমাকে তার জন্য কোনোদিন ক্ষমা করবে। অবশ্য না করাটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু আমার মনে হয় আপনার ওপর ওঁর কোনো রাগ নেই।–বললো লিউক।
আপনার কি তাই মনে হয়? কি জানেন, আমি হনরিয়াকে শ্রদ্ধা করি। ও একজন সত্যিকারের মহিলা–আজকালকার দিনেও এটা মূল্যবান। ওরই নিপুণ পরিচালনায় লাইব্রেরিটা এত ভালো চলছে। ওঁর গলার স্বর পালটে যায় চোখ তুলে তাকাতেই–ওই, ব্রিজেট এগিয়ে আসছে।
***
আনারস-রহস্য
লিউকের পেশী শক্ত হয়ে উঠল ব্রিজেটকে আসতে দেখেই। টেনিস খেলার পর থেকে আর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি ওদের মধ্যে।
ব্রিজেট হাল্কা গলায় বললো–গর্ডন, আমি ভেবেই পাচ্ছিলাম না যে তোমার হঠাৎ কী হলো।
লর্ড হুইটফিল্ড বললেন,–এই খানিকটা কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করতে হলো। রিভার্সটা এত বড় বেয়াদব যে আজ বিকেলে ও আমার রোস্ নিয়ে বেরিয়েছিলো।
ঠাট্টা করে ব্রিজেট–রাজকীয় রসনা।
এই নিয়ে রসিকতা মোটেই ভালো নয় ব্রিজেট। ঘটনা অত্যন্ত গুরুতর। ও একটা মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলো।
আমার বিশ্বাস, ও যদি একা একা গাড়ি নিয়ে বেড়াতে যেতো, তাহলে সব আনন্দই মাটি হতো।
আমার অধীনে থাকতে গেলে উন্নত চারিত্রিক মান বজায় রেখে চলতে হবে।
একটি মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে গেলেই কেউ দুশ্চরিত্র হয় না।
হা, হয়। যখন আমার গাড়ি নিয়ে যায়।
সেটা অবশ্যই দুশ্চরিত্রার অপরাধ থেকেও জঘন্য। একেবারে নরকীয় পাপ। তবে কিনা যৌবনের দাবীকে তুমি একেবারে অস্বীকার করতে পারো না গর্ডন। বিশেষ করে এমন ভরাট গ্রীষ্মের প্রারম্ভে তার ওপর যদি আবার পূর্ণচন্দ্রমার মায়াজাল হাতছানি দেয়।
কী সর্বনাশ! তাই নাকি?-বলে লিউক।
ব্রিজেট বলে–বে মোটলিতে তিনটি কিস্তুতের আবির্ভাব ঘটেছে। আমি আশঙ্কা করছি এরা সবাই আমার শ্রীমান এলার্দির সাঙ্গপাঙ্গ। কিংবদন্তীর লেখক বলেন–কে যেন কানে কানে বলে গেল যে আজ রাতে হেথাকার ডাইনীর প্রান্তরে উদযাপিত হবে এক আনন্দ লহরিত উৎসব।
লর্ড হুইটফিল্ড বলেন–এ আমি কিছুতেই হতে দেবো না।
প্রিয়তম আমার, এক্ষেত্রে নিতান্তই তুমি অক্ষম।
অধর্ম এই হল্লা আমি এখানে কিছুতেই হতে দেবো না। স্ক্যাণ্ডাল পত্রিকায় আমি সব ফাঁস করে দেবো।
ব্রিজেট বলে–অতঃপর ডাইনীতত্ত্বের বিরুদ্ধে লর্ড হুইটফিল্ডের জেহাদ–গ্রাম্য জীবনের শান্ত পরিবেশে কুসংস্কারের প্রভাব অদ্যাবধি বিদ্যমান।
ব্রিজেটের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে লর্ড বাড়ির ভেতর চলে গেলেন।
নিজের আখের সম্পর্কে তোমার আরও যত্ন নেওয়া উচিত।–লিউকের গলায় আনন্দের অভিব্যক্তি।
কী বলতে চাও?
চাকরিটা যদি খোয়া যায়, তাহলে কিন্তু পস্তাবে। বিবাহহাৎসব নামক অনুষ্ঠানটি পর্যন্ত তোমার সরস ব্যঙ্গোক্তিগুলো একটু রয়ে সয়ে ব্যবহার কোরো।
আহা লিউক, তুমি কী মহান আর দারুণ পরোপকারী।
ব্রিজেট বললো-আজ সারাদিন তুমি কী করলে?
সেই গতানুগতিক ব্যাপার-খবর সংগ্রহ।
কিছু পেলে?
রাজনৈতিক ভাষায় হা এবং না–দুটোই বলা চলে। ভালো কথা বাড়িতে কোনো যন্ত্রপাতি পাওয়া যাবে?
তা হয়তো যাবে। কিন্তু কী ধরনের যন্ত্রপাতি?
এই ছোটোখাটো কিছু? আচ্ছা, আমি নিজেই দেখে নিচ্ছি।
একটা পেয়েছি। ওতেই কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে।
তুমি জোর করে কোথাও দরজা খুলে ভেতরে ঢোকবার মতলব করছো না কি?
হতে পারে।
মনে হচ্ছে, যেন তুমি ব্যাপারটা গোপন করতে চাইছো?
ব্যাপারটা কি জানো, আমার নিজের অবস্থা খুব একটা স্বচ্ছ ও স্বাভাবিক নয়। শনিবারের সেই ঘটনার পর নিজে থেকেই হয়তো আমার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু মুশকিল হয়েছে যে, এক মদমত্ত খুনীকে খুঁজে বের করবার উজ্জ্বল সম্ভাবনার ফলে এখানে বাধ্য হয়ে থেকে যেতে হচ্ছে। তবে, বেল-মোটলি অতিথিশালায় গিয়ে ওঠবার মতো কোনো যুৎসই কারণ যদি বলতে পারো, তাহলে না হয় ওখানেই যাই।
ব্রিজেট বলে–নাঃ, তা সম্ভব নয়। বিশেষ করে তুমি যখন আমার দূরসম্পর্কের ভাই। তাছাড়া ওখানে মাত্র তিনখানা ঘর। সব ঘর এখন এলসওয়ার্দির সাঙ্গপাঙ্গতে ভর্তি।
অতএব, এখানেই থেকে যেতে হচ্ছে তাতে তোমার যত কষ্টই হোক না কেন।
কষ্ট আর কি, এমন দুচারজন নিরেট লোকজনকে নিয়ে আমি অনায়াসে চালিয়ে নিতে পারি।
লিউক বলে–এ কিন্তু তোমার একান্তই রূঢ় অভিব্যক্তি। বস্তুতঃপক্ষে, তোমার চরিত্রে মমতাবোধের কোনো রকম বালাই নেই।
তারপর লিউক নিজের ঘরে চলে যায়। ওর মাথায় অনেক চিন্তা। ঘরে গেলেও বিছানায় যায় না।
রাত বারোটার সময় টেনিস খেলার জুতো পড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে লাইব্রেরি ঘরের জানলা দিয়ে গলে বাইরে বের হয়।
লিউক ইচ্ছা করেই ঘুরপথ ধরলো এলসওয়ার্দির বাড়ি যাবার জন্য। আজ গ্রীষ্মের রাত। এমন রাতে এলসওয়ার্দি ও তার বন্ধুরা কিছুতেই ঘরে থাকবে না। সেই সুযোগে এলসওয়ার্দির বাড়িঘর মনের সাধ মিটিয়ে খুঁজে নিতে পারবে।
দুএকটা দেওয়াল টপকে ও বাড়ির পেছন দিকটায় এসে উপস্থিত হলো। যন্ত্রপাতির মধ্যে থেকে একটা যন্ত্র বেছে নিয়ে রান্নাঘরের একটা জানলার পাল্লা নিয়ে কিছুক্ষণ খুটখাট করতেই জানলাটার ছিটকিনিটা খুলে গেল। সার্সিটা ওপরে ঠেলে সহজে ভেতরে গিয়ে উপস্থিত হলো।
অতি সাবধানে মিনিট পনেরো ধরে খোঁজাখুঁজির পর ও নিশ্চিন্ত হয় যে, বাড়ি একেবারে ফাঁকা, বাড়ির মালিক অন্যত্র আপন কাজে ব্যাপৃত।
লিউক ঘরের প্রতিটি কোণ এবং অংশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে। এছাড়া দুএকখানা পাকা হাতে আঁকা ছবি দেখে লিউক অবাক হয়ে যায়। আলমারির একেবারে দেওয়াল ঘেঁষে রাখা কয়েকখানা বই দেখে ও বেশ উৎসাহ বোধ করলো।
এগুলো ছাড়া আরও তিনটে জিনিস ও পেলো। প্রথমটা, একটা নোটবই। তাতে লেখাটমি পিয়ার্সের সঙ্গে একটা মীমাংসা করো–লেখার তারিখ ছেলেটির মৃত্যুর আগের দিন। দ্বিতীয়ত, পেনসিল দিয়ে আঁকা অ্যামি গিবসের একখানা ছবি। ছবিটার মুখে গভীর লাল রং দিয়ে একটা ক্রশ চিহ্ন। তৃতীয়টি–এক বোতল কাশির ওষুধ। বিচ্ছিরিভাবে দেখলেই এর কোনোটাই সঠিক কোনো প্রমাণ দেয় না, কিন্তু এই নিদর্শনগুলো একত্র করলে একটা অর্থ বহন করে।
যখন লিউক জিনিষপত্র গোছগাছ করছিলো, তখন বাইরের দরজায় চাবি খোলার শব্দ পেয়েও কিছুক্ষণ টর্চের আলো নিবিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলো। ওর আশঙ্কা এলসওয়ার্দিই এসেছে। যদি তাই হয়, তবে তার সোজা ওপরে উঠে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
এলসওয়ার্দি পাশের একটা দরজা খুলে ঢোকে। এলসওয়ার্দি একটি সুইচ টিপে হল ঘরের আলো জ্বালায়।
হলঘর পেরিয়ে যাবার সময় লিউক ওর মুখখানা দেখতে পেয়ে আতঙ্কে একেবারে শিউরে ওঠে।
তাকে চেনবার উপায় নেই মুখ দেখে। ঠোঁটের দুই কোণে বজ বজ করে একরাশ ফেনা, চোখের দৃষ্টিতে উদ্ভ্রান্তি, চলার সময়ে মনে হচ্ছিলো যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নাচছে। এলসওয়ার্দির দুটো হাতেই ঈষৎ বাদামী লাল রং–যেমন রক্ত শুকিয়ে গেলে হয়ে থাকে।
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যাবার একটু পরেই নিভে যায় হলের আলো।
লিউক হলঘরের ভেতর দিয়ে রান্নাঘরের সেই জানলা দিয়ে বেরিয়ে আসে। বাইরে এসে একবার বাড়িটার দিকে তাকায়–সমস্ত বাড়ির ভেতরটা একেবারে নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে থম্ থম করছে।
লিউক মনে মনে বলে,–লোকটা একেবারে বদ্ধ উন্মাদ। ওর মনে কী আছে কি জানি! ওর হাতে ওটা নিশ্চয়ই রক্তের দাগ!
বেশ কিছুক্ষণ বাদে ও অ্যাশম্যানরে ফিরে আসে। বাড়ির প্রান্তসীমায় ঢোকবার জন্য ছোটো একটা গলিপথে পা দিতেই শুকনো পাতার খস্ খস্ শব্দে চমকে একবারে ঘুরে দাঁড়ায়।
কে ওখানে?
আগাগোড়া কালো কাপড়ে ঢাকা একটা লম্বা মূর্তি। তা দেখে লিউকের মনে হল যেন হৃৎপিণ্ডটা থেমে গেছে। কিন্তু কাছে আসতেই ঢাকনার আড়ালের মুখখানা চিনতে পেরেই বলে–ব্রিজেট? ওঃ, আমাকে একেবারে চমকে দিয়েছিলে।
ব্রিজেট প্রশ্ন করে–তুমি কোথায় গিয়েছিলে? তোমাকে আমি বেরিয়ে যেতে দেখেছি।
এবং তারপর থেকেই আমায় অনুসরণ করছো?
পারিনি; কারণ তুমি অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিলে।
তুমি অত্যন্ত দায়িত্বহীনের মতো কাজ করেছে। রাগ করে লিউক।
ব্রিজেট জিজ্ঞেস করে–কিন্তু তুমি গিয়েছিলে কোথায়?
এলসওয়ার্দির বাড়ি তোলপাড় করছিলাম। লিউকের কণ্ঠে স্ফূর্তির আভাস।
দম বন্ধ হয়ে আসে ব্রিজেটের–কিছু পেলে ওখানে।
বুঝতে পারছি না, তবে বজ্জাতটাকে আর একটু ভালো করে চিনতে পেরেছি–বিশেষ করে ওর যৌনরুচি সম্পর্কে। তাছাড়া গোটা তিনেক জিনিষ পেয়েছি, যেগুলো থেকে কিঞ্চিৎ ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে।
বেশ মন দিয়ে ব্রিজেট রাতের অভিযানের গল্প শোনে।
ব্রিজেটের সারা অঙ্গ থর থর করে কেঁপে ওঠে–কী ভয়ানক কাণ্ড!
চটে যায় লিউক,–কিন্তু তোমার এভাবে একা একা বেরিয়ে আসা উচিত হয়নি ব্রিজেট। যে কেউ তোমার মাথায় একটা বাড়ি দিয়ে ফেলে দিতে পারতো।
ব্রিজেট বলে–তোমার ক্ষেত্রেও তো একই কথা খাটে।
না খাটে না, আমি আত্মরক্ষা করতে পারি।
এক ঝলক মত্ত হাওয়া ভেঙ্গে পড়ে। আচমকা লিউক বলে ওঠে–মাথা থেকে ওই বোরখাটা সরাও তো।
লিউকের আচরণে অস্থিরতা চনমন করে ওঠে। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে শেষ পর্যন্ত লিউক বলে–
চলো বাড়ি যাই।
দাঁড়াও।
কেন?
কারণ, তোমাকে দুএকটা কথা বলা দরকার। আসলে এই কথা বলবার জন্যই ম্যানরের বাইরে এসে অপেক্ষা করছিলাম।
লিউক বলে–তুমি কী বলতে চাও?
বলতে চাই যে আমি হুইটফিল্ড-ঘরণী হবার ইচ্ছেকে বিসর্জন দিয়েছি।
লিউক বলে–সত্যি বলছো?
হ্যাঁ, লিউক।
তুমি আমাকে বিয়ে করবে?
করবো।
কিন্তু কেন?
জানি না, তবে তুমি আমার যতসব বিজাতীয় আখ্যায় ভূষিত করেছে, আমার ধারণা সেগুলো আমার ভালোই লেগেছে।
ওর হাত দুটো বুকে টেনে চুমু দিয়ে লিউক বলে–এ দুনিয়াটা একটা সত্যিকারের পাগলের কারখানা।
কিন্তু তুমি খুশী হলে তো লিউক?
খুশী হয়েছি একথা ঠিক বলা যায় না।
তুমি কি আমাকে নিয়ে কখনো খুশী হতে পারবে?
তা জানি না; তবে ঝুঁকি নেবো।
লিউক ব্রিজেটের একখানি হাত নিয়ে নিজের হাতে ধরে বললো–জানো সোনা, এই ব্যাপারটায় আমরা দুজনেই সমান বিদঘুঁটে। চলো, বাড়ি যাই, সকাল হলে হয়তো দুজনেই স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
হঠাৎ ব্রিজেট লিউককে সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে আঁতকে উঠে বলে–লিউক, লিউক, দেখো এখানে এটা কী?
একটা ঢিবির মতো পড়ে থাকা কিসের সঙ্গে যেন ব্রিজেটের জুটো ঠোক্কর খেলো।
লিউক বিদ্যুৎ গতিতে ব্রিজেটের হাত সরিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পরীক্ষা করেই ওপরের গেটের পিলারের দিকে তাকায়। আর সেখানে সেই আনারসটা নেই। ও উঠে দাঁড়ায়।
এই সেই ড্রাইভার রিভার্স–বেঁচে নেই…।
নিশ্চয়ই এই বিশাল পাথরটা–বেশ কিছুদিন থেকেই ওটা আলগা হয়ে গিয়েছিলো। এমনকি হতে পারে যে, হাওয়ার দাপটে ওটা ওর ওপর এসে পড়েছিলো?
মাথা নাড়ে লিউক–বাতাসের অত জোর হতে পারে না। আসলে ঘটনাটা এভাবেই সাজানো হয়েছিলো–এমন কিছু একটা বোঝাবার জন্য যাতে দুর্ঘটনা মনে হয়। কিন্তু টিকলো না–আবার সেই খুনী।
না, লিউক না।
নির্ঘাত তাই। তুমি জানো ওর মাথার চটচটে রক্তের মধ্যে কী পেলাম?–গুড়ো গুঁড়ো বালি। অথচ, এখানে কোথাও বালির চিহ্ন নেই। আমি তোমাকে বলছি ব্রিজেট, কেউ এখানে দাঁড়িয়েছিলো আর ও যেমনি বাড়িতে যাবার জন্য গেটের তলা দিয়ে ঢুকতে যাবে, তখন একটা কিছু দিয়ে ওকে আঘাত করে যার ফলে ও মারা যায় এবং তারপর এই আনারস সে ঠেলে ওর ওপর ফেলে দেয়!
ব্রিজেট বলে–লিউক, তোমার হাতভর্তি রক্ত…
লিউক বলে–আরও একজনের হাতেও এই রক্ত লেগে আছে। জানো, আজই সন্ধ্যাবেলা কী ভাবছিলাম? ভাবছিলাম, আর একজন যদি কেউ খুন হতো তাহলেই সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যেতো। এবং, আমরা জেনেছি! এলসওয়ার্দি। ও রাতে বাইরে গিয়েছিলো এবং ফিরেও এসেছিলো রক্তমাখা হাতে–চোখে মুখে খুনীর মতো এক উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি নিয়ে…
পড়ে থাকা লোকটিকে দেখে ব্রিজেটের সারা শরীর থর থর করে কেঁপে ওঠে। ও বলে–আহা রে, বেচারা রিভার্স।
লিউক বলে–হতভাগ্য। লোকটার কপাল নেহাতই মন্দ। কিন্তু ব্রিজেট, এই শেষ–এবার আমরা টের পেয়ে গেছি; ওর আর নিস্তার নেই।
ব্রিজেট যেন একটু একটু টলছে লিউক দেখলো। ও দুহাতে ব্রিজেটকে জড়িয়ে ধরলো।
ব্রিজেট বলে–লিউক আমার দারুণ ভয় করছে…
ভয় পেয়োর না লক্ষ্মীটি। এই শেষ–এখানেই এর শেষ।
আমার মনে কখনো কোনো কষ্ট দিয়ো না। আমি আঘাতে আঘাতে একেবারে জর্জরিত।
আমরা দুজনেই দুজনকে আঘাত করেছি। এবার থেকে আর কোনো আঘাত নয়।
***
লর্ড হুইটফিল্ডের ভাষ্য
ডাঃ টমাস আর লিউক রোগী পরীক্ষা করার ঘরে মুখোমুখি বসে।
আশ্চর্য! দারুণ বিস্ময়কর মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম। আপনি কি সত্যিই একথা নিজে বিশ্বাস করেন?
নিঃসন্দেহে। আমার স্থির বিশ্বাস এলসওয়ার্দি একজন বিপজ্জনক নেশাগ্রস্ত খুনী।
আমি যদিও ওকে খুব একটা লক্ষ্য করিনি, তবে হতেও পারে যে লোকটা হয়তো কিছুটা অন্য ধরনের।
আমি কিন্তু বলবো যে, ওর চেয়ে অস্বাভাবিকতার মাত্রা কল্পনা শক্তিকে ছাড়িয়ে যায়।
আপনার স্থির বিশ্বাস যে রিভার্স খুন হয়েছে?
নিশ্চিত। আপনি নিজে ওর মাথায় বালি পাননি?
ডাঃ টমাস বলেন–আপনি বলবার পর আমি দেখেছিলাম, স্বীকার করছি যে আপনার কথা সত্য।
এ থেকেই তো প্রমাণ হয় যে, দুর্ঘটনাটা ছিলো একটা সাজানো ব্যাপার। আসলে ওকে হত্যা করা হয়েছিলো বালির বস্তা দিয়ে আঘাত করে অথবা ঐ জাতীয় একটা কোনো উপায়ে।
তা প্রমাণ হয় না।
কী বলছেন আপনি?
ডাঃ টমাস বললেন,-এ অঞ্চলে প্রচুর বালির ঢিবি ছড়িয়ে রয়েছে। এমনও তো হতে পারে যে, সেদিন রিভার্স ওইরকম একটা বালির ঢিবিতে শুয়েছিলো? তাতেও তো ওর চুলে বালি পাওয়া যেতে পারে?
শুনুন মশাই, আমি বলছি যে ওকে খুন করা হয়েছে।
আপনি সেকথা আমাকে বলতে পারেন, কিন্তু তাতেই তো আর আপনার বক্তব্য সত্যি হয়ে যাবে না। ডাঃ টমাস শুকনো গলায় বলেন।
লিউক বলে–মনে হচ্ছে যে, আমি যা বলছি তার একটি কথাও আপনি বিশ্বাস করছেন না।
মৃদু হেসে টমাস–মিঃ লিউক, একথা আপনাকে স্বীকার করতেই হবে যে, পুরো ব্যাপারটাই আরব্য-উপন্যাসের মত অবিশ্বাস্য। আপনি নিতান্তই গায়ের জোরে বলছেন যে, এলওয়ার্দি সেই ঝি মেয়েটিকে, ছোটো ছেলেটাকে, আমার সহকারীকে এবং শেষকালে রিভার্সকে পর পর খুন করেছে।
আপনি বিশ্বাস করেন না?
ডাঃ টমাস বলেন–আম্বলবির রোগ সম্পর্কে অন্ততঃ আমার নিজের জানা ছিলো। এলওয়ার্দির মতো লোকের পক্ষে ওভাবে মৃত্যু ঘটানো প্রায় অসম্ভব; অথচ ওর অপরাধ প্রমাণ করবার মতো কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণও আপনার নেই।
আমি সঠিক বলতে পারবো না ও কী করে করতে পেরেছিলো–লিউক স্বীকারোক্তি করে, তবে সমস্ত ঘটনাই মিস পিঙ্কারটনের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়। একবার যখন জেনেছি যে, কে খুনী। তখন সাক্ষ্যপ্রমাণও জোগাড় করে ফেলবো।
ডাঃ টমাস বলেন–তা যদি করতে পারেন তাহলে অবশ্য সবচেয়ে ভালো হবে। তবে, যদি এমন হয় যে, আপনার ধারণা আগাগোড়া এক ভুলের…
বাধা দেয় লিউক। আপনি কি আমার বক্তব্যের সবটাই অবিশ্বাস করেন?
এই পাইকারী হারে খুন?–সত্যিকথা বলতে কি লিউক, এ আমি বিশ্বাস করি না।
বিরক্ত হয় লিউক–আপনি কি ভেবে দেখেছেন যে আমি নিজে একজন পুলিশের লোক? পুরোপুরি শৌখিন খেয়াল নয়।
ডাঃ টমাস হেসে বলেন–জানি, মেয়াংস্ট্রেটেও?
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই!
লিউক রাগ চেপে নিয়ে ডাঃ টমাসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ব্রিজেটের কাছে যেতেই ব্রিজেট জিজ্ঞেস করে–কেমন কথাবার্তা হলো?
ও আমাকে আদৌ বিশ্বাস করেনি। অবশ্য ভালো করে ভেবে দেখতে গেলে ওকে দোষ দেওয়া যায় না।
কেউ কি বিশ্বাস করবে?
এখন হয়তো করবে না, তবে আমার পুরানো বন্ধু বিলিবোনসের সঙ্গে আগামীকাল দেখা করার পর চাকা ঘুরে যাবে। ওর এই লম্বাচুলওয়ালা এওয়াদি সম্পর্কে খোঁজখবর করলেই সব ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যাবে।
ব্রিজেটের ভেতরটা শিরশির করে ওঠে–দোহাই লিউক, একটু সাবধান হও।
আমি খুবই সতর্ক আছি। পাথরের আনারস দিয়ে সাজানো গেটের তলা দিয়ে হাঁটি না। রাত-বিরেতে বন-জঙ্গলে যাই না আর খাবারদাবারও বেশ সাবধানে খাই–এসব পথ আমার ভালো করে জানা আছে।
আচ্ছা, এখানকার পুলিশকে বললে কিছু সুরাহা হয়?
জবাব দেয় লিউক–মনে হয় না–তার চেয়ে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডেই যাওয়া ভালো।
মিস পিঙ্কারটনও এই কথা ভেবেছিলেন।
তা ঠিক,আমি সবরকম বিপদের জন্যই তৈরি থাকবো।
আমি কাল গর্ডনকে সঙ্গে করে ওই বদমাসটার দোকানে গিয়ে ওকে দিয়ে জিনিষপত্রের দরদাম করবো।
যাতে এলসওয়ার্দি হোয়াইট হলের সিঁড়ির মুখে আমাকে খুন করার জন্য লুকিয়ে থাকতে না পারে?
হা, সেই জন্যই।
লিউক বিব্রত হয়ে বলে–হুঁইটফিল্ড সম্পর্কে
ব্রিজেট বাধা দিয়ে তাড়াতাড়ি বলে–ওসব তুমি ফিরে আসা পর্যন্ত থাক। পরে এক সময়ে বলা যাবে।
আচ্ছা, ভদ্রলোক কি খুব রেগে যাবেন? তোমার কী মনে হয়?
ব্রিজেট বলে–তা–ওর খুব মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে।
লর্ড হুইটফিল্ড সন্ধ্যাবেলাটা প্রচণ্ড খুশীর মেজাজে ছিলেন। মোটর ড্রাইভারের মৃত্যুতে আনন্দে একেবারে ডগমগ করছিলেন।
পোর্টে ভরা দামী কাঁচের গ্লাসটা আলোর দিকে ধরে তার দিকে তাকিয়ে বললেন–আমি তোমাদের আগেই বলেছিলাম যে, লোকটা শেষ পর্যন্ত পস্তাবে। কাল সন্ধ্যাবেলায়ই একথা বলিনি?
হ্যাঁ, বলেছিলেনই তো।
দেখলেন তো, আমি ঠিক কথা বলেছিলাম কিনা? আমার বেশির ভাগ কথাই এমন আশ্চর্যজনক ভাবে সত্যি বলে প্রমাণিত হয়।
এটা সত্যিই আপনার গৌরবের বিষয়।
শুনুন, আমি ধর্মকে মেনে চলি। ভালো আর মন্দ–দুটোতেই আমার সমান বিশ্বাস; আর বিশ্বাস রাখি সেই শাশ্বত সুবিচারের ওপর। স্বর্গীয় বিচার কতটা একেবারে ধ্রুব সত্য, মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম, এখানেও সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
আমারও সুবিচারের ওপর আস্থা আছে।–যোগ দেয় লিউক।
মার কথা মনে হলো, সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সদাচরণ কর, সৃষ্টিকর্তাও তোমার সঙ্গে সদাচার করবেন।
সে তো নির্জলা সত্য।–লিউক হাই তুলতে তুলতে বলে।
লর্ড হুইটফিল্ড বলেন–আশ্চর্য! পরমাশ্চর্য ব্যাপার। যে ন্যায়পরায়ণ তার শত্রুরা যেভাবেই হোক নিঃশেষ হয়ে যাবেই। কালকের ঘটনাটাই দেখুন না। লোকটা আমাকে গালাগাল দিলো, এমনকি আমার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলতে যাচ্ছিলো। অথচ কী হলো? আজ ও কোথায়?
নাটকীয় ভঙ্গীতে নিজেই জবাব দিলো–মৃত্যু! ঈশ্বর-প্রদত্ত চরম শাস্তি!
লিউক বললো–একপাত্র বেশি মদ খাওয়া রাগের মাথায় দুচারটে ছোটোবড়ো কথা বলার পক্ষে দণ্ডটা বোধহয় একটু বেশিই হয়ে গেছে।
লর্ড হুইটফিল্ড অস্বীকার করেন–এই রকমই হয়। পাপের শাস্তি অতি দ্রুত ফলে এবং তা আসেও অতি ভয়াল মূর্তিতে। এইভাবেই এর প্রতিবিধান হয় মিঃ ফিস্ উইলিয়াম্।
আমার কিন্তু সব সময়েই মনে হতো যে, এটা কিছুটা বাড়াবাড়ি রকম নিষ্ঠুরতা।
কক্ষনো নয়, আপনি ভুল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। এলিসা ছিলেন এক মহান স্বর্গীয় পুরুষ; তাঁকে অপদস্থ করে কারোরই আর বেঁচে থাকার অধিকার থাকতে পারে না।-এবং, আমার বিশ্বাস, আমার ক্ষেত্রেও ওই একই কারণ।
বিমূঢ় দৃষ্টিতে লিউক তাকায়।
লর্ড হুইটফিল্ড বলেন–প্রথমটায় আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না, কিন্তু প্রতিবারই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। যারাই আমার শত্রু এবং বিরোধী, তারাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়?
লর্ড হুইটফিল্ড গম্ভীর ভাবে মাথা ঝাঁকান।
বার বার ঘটলো। একটা ঘটনা একেবারে এলিসার মতো–একটা বাচ্চা ছেলে ও–আমার কাছে সেই সময়ে চাকরি করতো। একদিন ওকে এই বাগানেই ধরে ফেললাম। জানেন, ও তখন কী করছিলো? একগাদা লোক যোগাড় করে আমার অনুকরণ করে আমাকে ব্যঙ্গ করেছিলো। আমার বাড়িতে বসে আমাকেই অপমান? আর কাউকে নয়, আ-মা-কে! জানেন ওর কী হলো? দশ দিনও কাটলো না–একটা উঁচু জানলা থেকে পড়লো আর মরলো।
তারপর এই গুণ্ডাটা–কার্টার! লোকটা যেমন মাতাল ছিলো, তেমনি ছিলো ওর অশ্রাব্য মুখ। ও এখানে এসে আমাকে গালাগাল করে গেল! ওরই বা কী হলো? এক সপ্তাহের মধ্যে পাঁকের মধ্যে ডুবে মারা গেল। আমার এখানে একটি ঝি ছিলো–সেও একদিন চিৎকার করে আমাকে যা-নয়-তাই বলে গালমন্দ করলো; কয়েক দিনের মধ্যে ওরও শাস্তি হলো-ভুল করে ওষুধের বদলে বিষ খেলো। এইরকম অজস্র উদাহরণ আছে। আম্বলবি! জল সরবরাহ নিয়ে আমার পরিকল্পনার বিরোধিতা করে বসলো আর রক্তে বিষক্রিয়ার ফলে শেষ হলো। এই রকমটাই হয়ে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ। মিসেস হর্টন–আমার সঙ্গে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করেছিলেন একবার। কিছু দিনের মধ্যে তিনিও মারা গেলেন।
অপলক দৃষ্টি লিউকের চোখে। ওর মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে সাপের মতো কুটিল সন্দেহ। বিদ্যুতের মতো ওর মাথায় খেলে যায় পুরানো অনেক কথা। একদিন মেজর হর্টন বলেছিলেন–লর্ড হুইটফিল্ড অত্যন্ত সহৃদয় ব্যক্তি। একদিন নিজের বাগানের আঙুর আর পিচফল পাঠিয়েছিলেন।–এই লর্ড হুইটফিল্ডই দয়াপরবশ হয়ে টমিকে লাইব্রেরির জানলা
পরিষ্কার করার কাজে লাগিয়ে ছিলেন। আবার এই লর্ডই ওয়েলারম্যান ক্রেইৎস গবেষণাগারে গিয়ে নানারকম বিষাক্ত রসায়ন আর জীবাণু সম্পর্কে সর্বসমক্ষে জাহির করেছিলেন। আম্বলবির মৃত্যুর কয়েকদিন আগে ওখানে গিয়েছিলেন। এই সব ঘটনা বিশ্লেষণ করলে একই দিকেরই নির্দেশ পাওয়া যায়–আর ও নিজে এমন মূর্খ যে, এই সম্ভাবনার কথা ওর মনেই আসেনি–এমনকি সামান্য সন্দেহ পর্যন্ত করেনি…।
তখনো মৃদু মৃদু হাসছিলেন লর্ড হুইটফিল্ড, আত্মতুষ্টিতে পরিপূর্ণ সেই হাসি। একটু এগিয়ে লিউককে বললেন–ওরা সবাই একে একে মরলো।
***
৪. লন্ডনে শলাপরামর্শ
পুলিশ-মহলে বিলিবোন্স্ নামে খ্যাত স্যার উইলিয়াম ওসিংটন বন্ধুর দিকে কতকটা হতভম্বের মতো তাকিয়ে বলেন–মেয়াং-এ অপরাধীদের শায়েস্তা করেও তোমার সাধ মেটেনি। দেশে ফিরেও আমাদের কাজে বাগড়া দিয়ে বেড়াচ্ছো?
মেয়াং-এ অপরাধীরা এমন পাইকারী হারে খুন করে না। এক্ষেত্রে আমার মাথাব্যথার কারণ এই যে একটা লোক প্রায় আধডজন খুন করেও দিব্যি খোলা হাওয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে–এমনকি কেউ তাকে সন্দেহ পর্যন্ত করছে না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন স্যার উইলিয়াম–কখনো কখনো এমনটা ঘটে। এক্ষেত্রে খুন করার বিশেষত্ব কী? স্ত্রী খুন করা?
না না, এ লোকটা তা নয়; তা নিজেকে এখনও ভগবান বলে মনে করেনি, তবে অচিরেই করবে।
পাগল নাকি?
নিঃসন্দেহে।
ওহো, কিন্তু আইনের চোখে পাগল নয় এবং সেটাই আসল কথা।
তবে আমার ধারণা, ও জানে যে ওর কাজের কী পরিণাম। বললো লিউক।
সে কথাই তো বলছি।
আমি তাই তোমার কাছ থেকে দুএকটা ঘটনা জানতে চাই। ডারবি খেলার দিন বিকেল পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিলো। মিস পিঙ্কারটন নামে এক বৃদ্ধা মহিলাকে হোয়াইট হলের সামনে একটা গাড়ি চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। আমি চাই যে, এই ব্যাপারটার একটু বিশদ তদন্ত হোক।
স্যার উইলিয়াম বললেন–ঐটুকু সহজেই তোমার জন্য করতে পারি–বিশ মিনিটের বেশি লাগবে না।
কথামতই কাজ হলো।
আজ্ঞে হ্যাঁ, এই ঘটনার একেবারেই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আমার মনে আছে। তাছাড়া এই ফাইলে লেখাও আছে।–লিউককে ফাইলটা দিয়ে বললো-তদন্ত-সাপেক্ষ একটা বিচার হয়েছিলো–মিঃ স্যাচের ভেরেল বিচারক। গাড়ির চালক নিরুদ্দেশ।
ওকে পরে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো?
আজ্ঞে না।
গাড়িটা কী গাড়ি ছিলো?
যতদূর মনে হয় ওটা রোলস্ ছিলো। বড় গাড়ি এবং গাড়ির চালক ছিলো পেশাদার চালক।
নম্বর যোগাড় করতে পেরেছিলেন?
ওখানেই ভুল হয়ে গেছে। একটা নম্বর পাওয়া গিয়েছিলো-এফ. জেড. এক্স ৪৪৯৮। এক ভদ্রমহিলার এই নম্বরটা মনে ছিলো, কিন্তু পরে দেখা গেল সেই নম্বরটা ভুল।
কী করে জানলেন যে সেই নম্বরটা ভুল?–লিউকের কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ।
অফিসারটি হেসে ফেলেন–এফ. জেড, এক্স. ৪৪৯৮ হচ্ছে লর্ড হুইটফিল্ডের গাড়ি। যখন এই ঘটনাটা ঘটে সেই সময়ে এই গাড়িটা বুসিংটন হাউসের ঠিক বাইরে দাঁড়িয়েছিলো আর গাড়ির ড্রাইভার তখন চা খাচ্ছিলো। এই ঘটনার সঙ্গে কোনোরকমেই ওকে জড়ানো সম্ভব নয়, তা ছাড়া সাড়ে ছটা নাগাদ লর্ড হুইটফিল্ড বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত গাড়িটাও তখন থেকে নড়েনি।
ও, আচ্ছা।-মন্তব্য করে লিউক।
হাঁফ ছেড়ে লোকটি বলেন–এই রকমই হয়। ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে সব বিবরণটুকু নেবার আগেই অর্ধেক এর ওপর সাক্ষী হাওয়া হয়ে যায়। স্যার উইলিয়ামও একথা স্বীকার করেন।
আবার অফিসারটি বলেন–আমরা নানাভাবে আরও খোঁজাখুঁজি করেছি। এমন পর্যন্ত ধরে নিয়েছিলাম যে হয়তো নম্বরটা এফ. জেড. এক্স ৪৪৯৮-এর কাছাকাছি কোনো নম্বর হতে পারে। হয়তো এমনও হতে পারে যে, ভদ্রমহিলা যে নম্বরটা দেখেছিলেন তার প্রথম দুটো সংখ্যা হয়তো ৪৪ দিয়ে আরম্ভ। আমরা এই জাতীয় নম্বরের সম্ভাব্য সব গাড়ীরই খোঁজ করেছি। কিন্তু সবকটি গাড়িরই খতিয়ান সন্তোষজনক।
লিউকের দিকে স্যার উইলিয়াম্ স-প্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকান, লিউকও মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
ঠিক আছে মশায়, আপনি এবার আসুন।-স্যার উইলিয়াম্ বলেন।
স্যার উইলিয়াম্ লোকটি চলে যেতে লিউকের দিকে তাকিয়ে বলেন–কিছু বুঝতে পারলে ফিৎস্?
লিউক বললো–সবই হুবহু ছকের মত মিলে যাচ্ছে। স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের ধুরন্ধরদের এই জঘন্য খুনের কাহিনী শোনাবার উদ্দেশ্যে পিঙ্কারটন এখানে আসছিলেন। যদিও আমি জানি না তোমরা ওঁর কথায় কর্ণপাত করতে কিনা–হয়তো করতে না
সম্ভবতঃ করতাম। উড়ো খবর, গল্প–কিছুই আমরা উপেক্ষা করি না এই আশ্বাস তোমায় দিতে পারি।
খুনীও হয়তো এমনটাই আশঙ্কা করেছিলো, তাই সে আর ঝুঁকি নেয়নি। পিঙ্কারটনকে চিরতরে সরিয়ে দিলো; আর যদিও বা জনৈক ভদ্রমহিলা তার গাড়ির নম্বরটা দেখে ফেলেছিলো। কিন্তু কেউ তাকে বিশ্বাস পর্যন্ত করলো না।
বিলিবোনস লাফিয়ে উঠলো–তুমি কী বলছো?
হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। আমি বাজি রেখে বলতে পারি যে, হুইটফিল্ড ওঁকে গাড়ি চাপা দিয়েছিলেন। ড্রাইভার চা খেতে গিয়েছিলো–হয়তো সেই সময়ে বা অন্য কোনো পথে ও ড্রাইভারের কোট গায়ে চাপিয়ে টুপিটা মাথায় দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলো। আমি বলছি বিলি, ওই-ই একাজ করেছে।
অসম্ভব।
মোটেই না। হুইটফিল্ড আমার জানার মধ্যে অন্ততঃ সাতটা খুন করেছে–হয়তো আসলে তার চেয়েও বেশি।
এ…অসম্ভব।
আরে ভাই, ও নিজে কাল রাতে কবুল করেছে।
তাহলে তো বলতে হবে লোকটা ঘোর উন্মাদ?
পাগল ঠিকই, তবে অত্যন্ত ধূর্ত ও শয়তান। ওকে বুঝতে দিলে চলবে না যে, আমরা ওকে সন্দেহ করি।
বিলিবোনস বলে–কিন্তু এ যে একেবারে অবিশ্বাস্য..
লিউক বলে,–কিন্তু সত্যি। বিলি, তুমি আমার বহুকালের বন্ধু। আমরা দুজনেই এ ঘটনার একেবারে মূলসুদ্ধ টেনে বার করবো। শোনো, সব ব্যাপারটা তোমায় গুছিয়ে বলি।
ওরা দুজনে দীর্ঘসময় ধরে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে।
***
লিউক পরদিন সকালে গাড়ি নিয়ে উইচউডে ফিরে আসে।
উইচউডে পৌঁছে প্রথমেই মিস ওয়েনফ্লিটের বাড়িতে গাড়ি থামালো। মিস ওয়েনফ্লিট লিউককে দেখে খানিকটা বিস্মিত হয়ে সাদরে ওকে ডেকে বসালেন।
এমন সাত সকালে আপনাকে বিরক্তি করছি বলে দুঃখিত।
লিউক সময় নষ্ট না করে সরাসরি প্রশ্ন করলো-আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে এসেছি মিস ওয়েনফ্লিট, আমি জানি, ব্যাপারটা নিতান্তই ব্যক্তিগত; তার জন্য আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
আপনার যা ইচ্ছে জিজ্ঞেস করতে পারেন, কারণ আমি জানি যে একান্ত প্রয়োজন না হলে আপনি জিজ্ঞেস করতেন না।
লিউক বলে–ধন্যবাদ। লর্ড হুইটফিল্ডের সঙ্গে আপনার বিয়েটা কেন ভেঙ্গে গিয়েছিলো?
এর সঠিক উত্তর আমার জানা দরকার।
মিস ওয়েনফ্লিট আঁৎকে উঠে বলেও আপনাকে কিছু বলেছে?
একটা পাখি নিয়ে কী যেন বলছিলেন–পাখিটার ঘাড় মটকে দেওয়া হয়েছিলো বা ঐ জাতীয় কিছু উত্তর দেয় লিউক।
এই কথা বলেছে? শেষ পর্যন্ত স্বীকার করলো তাহলে? অদ্ভুত ব্যাপার তো!
আপনি আমাকে সব কথা খুলে বলুন।
হ্যাঁ, আপনাকে সবই বলবো; গর্ডনকে কিন্তু দয়া করে কিছু বলবেন না। এসব ঘটনা বহুকাল আগের–আর সবই তো শেষ হয়ে গেছে। আমি সেই মরা অতীতকে আর খুঁচিয়ে তুলতে চাই না।–মিস ওয়েনফ্লিট বলেন।
সম্মতি জানায় লিউক–আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, একথা আমি কখনো উচ্চারণ করবো না–একেবারে ব্যক্তিগত সন্তুষ্টির জন্য আমি জানতে চাইছি।
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন,ধন্যবাদ, শুনুন তাহলে। আমার একটা ছোটো ক্যানারী পাখি ছিলো; পাখিটাকে আমি খুব ভালোবাসতাম। যদিও আমি একথা বুঝি যে, একজন পূর্ণবয়স্ক দায়িত্বশীল লোকের পক্ষে এটা সহ্য করা কঠিন।
লিউক বললো–আমি জানি।
গর্ডন পাখিটাকে খুব হিংসে করতো। একদিন ভীষণ রেগে গিয়ে ও বললো–তুমি আমার চেয়ে পাখিটাকে বেশি ভালোবাসো।–এবং আমিও তরুণী মেয়েদের স্বভাবসুলভ চপল ভঙ্গীতে পাখিটাকে আঙুলের ওপর তুলে নিয়ে বলেছিলাম–একটা বুড়ো খোকার চেয়ে আমি তোকে নিশ্চয়ই বেশি ভালোবাসি ডিকি!–আর তার ফল হলো অত্যন্ত বীভৎস। গর্ডন পাখিটাকে আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে একেবারে ঘাড় মটকে মেরে ফেললো। সে কি প্রচণ্ড আঘাত! আমি জীবনে কখনো ভুলতে পারবো না!
প্রশ্ন করে লিউক–এইজন্যই আপনি বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, এই ঘটনার পর আমার মনটা সত্যিই ওর ওপর একেবারে বিরূপ হয়ে উঠলো। দেখুন, মিস ফিৎ, ওয়েনফ্লিট একটু ইতস্ততঃ করে বলেন–কেবলমাত্র হিংসা বা রাগ থেকে যদি এ কাজ ও করতো, তাহলে হয়তো আমি এতটা ভয় পেতাম না; কিন্তু আমি যেন দেখলাম, ঘাড় মটকাবার সময়ে ওর চোখে এক বিজাতীয় আনন্দ এবং এই কারণেই আমি এত ভয় পেয়েছিলাম।
লিউকের কথা প্রায় অনুচ্চারিত।–অতদিন আগেও, সেই তরুণ বয়সেও…
আপনি আগাগোড়াই জানতেন যে লর্ড হুইটফিল্ড একের পর এক এতগুলো খুন করেছে, তাই না?
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন, সঠিক জানতাম না। যদি জানতাম, তাহলে নিশ্চয় আমি আপনাকে বলতাম। কিন্তু সবসময়েই আমার মনে একটা ভয় ছিলো।
তা সত্ত্বেও একটা ছোটো ইঙ্গিত পর্যন্ত আমাকে দিলেন না?
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–কী করে বলবো বলুন? বলা কি যায়? আমি যে একদিন ওকে ভালোবাসতাম।
লিউক শান্ত গলায় বললো-বুঝতে পারছি।
তারপর মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–ব্রিজেট যে এ বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে, তার জন্য আমি সত্যিই খুশী। ও তো আপনাকেই বিয়ে করছে?
হা।
মিস ওয়েনফ্লিট পরমুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে যান। ওঁর চোখেমুখে ফুটে ওঠে দুশ্চিন্তার ছাপ।–কিন্তু খুব সাবধানে থাকবেন। আপনারা দুজনেই অত্যন্ত সতর্ক থাকবেন।
আপনি কি হুইটফিল্ডের কথা বলছেন?
হা। এখনই ওকে কিছু বলার দরকার নেই।
কপাল কোঁচকায় লিউক।-আপনার একথাটা আমাদের দুজনের মনঃপূত হবে বলে মনে হয় না।
ওঃ, কিন্তু না বললে ক্ষতি কী? আপনি বুঝতে পারছেন না যে, ও কত বড় উন্মাদ! একেবারে উন্মত্ত! এক মুহূর্তের জন্যও ও এসব সহ্য করবে না। ব্রিজেটের যদি কিছু হয়।
ওর কিছুই আমি হতে দেবো না।
তা জানি, কিন্তু একটু ভেবে দেখুন, ওর সঙ্গে আপনি পাল্লা দিয়ে পারবেন না। ও যে অত্যন্ত মারাত্মক রকমের ধূর্ত। ব্রিজেটকে এখনই এখান থেকে সরিয়ে নিন–সেই একমাত্র পথ। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি আপনারা দুজনেই বিদেশে চলে যান।
লিউক বলে–যদি যেতে হয়, ব্রিজেটকে পাঠিয়ে দেবো, কিন্তু আমি এর হেস্তনেস্ত না করে নড়বো না।
আমিও ভেবেছিলাম, আপনি এমনটাই বলবেন। কিন্তু আর দেরি করবেন না। ওকে এই মুহূর্তে সরিয়ে আনুন।
লিউক বলে–হয়তো ঠিকই বলেছেন।
হয়তো নয়, আমি জানি আমি ঠিক বলছি। এক্ষুনি পাঠিয়ে দিন, না হলে হয়তো বড্ড দেরি হয়ে যাবে।
***
ভগ্ন প্রতিশ্রুতি
ব্রিজেট লিউকের গাড়ির আওয়াজ পেয়েই বাইরের সিঁড়িতে ছুটে এসে বললো–আমি ওকে সব বলে দিয়েছি।
কী বলছো–লিউক হতচকিত, ব্রিজেটের নজর এড়ালো না।
লিউক তোমার কী হয়েছে? তোমাকে দেখে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে?
লিউক বলে–আমার ধারণা ছিলো যে আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি অপেক্ষা করবে এবং এমন কথাই তুমি দিয়েছিলে।
জানি, কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম যে সব কথা স্পষ্ট করে বলে দেওয়াই ভালো। এই বিয়েকে কেন্দ্র করে ও সমস্ত রকম ব্যবস্থাপত্র একেবারে পাকা করে ফেলেছিলো, এমনকি, হনিমুন কোথায় হবে সে জায়গা পর্যন্ত ঠিক করতে যাচ্ছিলো, কাজেই আমার না বলে আর উপায় ছিলো না।
একটু থেমে ব্রিজেট বললো–ভদ্রতার দিক থেকেও ওকে সব কথা বলা দরকার ছিলো।
লিউক বললো বুঝতে পারছি যে তোমার দিক থেকে তুমি ঠিকই করেছে।
আমার মনে হয় সাধারণ ভদ্রতাবোধের দিক থেকেও ঠিক করেছি।
লিউক বললো–কখনো কখনো এমন সময় আসে যখন ভদ্রতাবোধের অনুশাসন মেনে চলা যায় না।
তুমি কী বলছো লিউক?
লিউক বলে–আমি তোমাকে এক্ষুনি সব কথা বুঝিয়ে বলতে পারছি না। যাকগে, হুইটফিল্ড তোমার বক্তব্য কী ভাবে নিলো?
ব্রিজেট বললো–অত্যন্ত ভালোভাবে নিয়েছে। সত্যি, এত শান্তভাবে নেবে বুঝতে পারিনি। জানো লিউক, কেবলমাত্র ওর বাইরেটা দেখে আমি হয়তো ওকে অহেতুক ছোটো করছি। এখন মনে হচ্ছে, ওর অন্তঃকরণটা সত্যিই উদার, মহান।
লিউক বললো–আমরা যেটা আদৌ সন্দেহ করিনি সেদিকে ও হয়তো খুবই মহৎ। শোনো ব্রিজেট, যত শীঘ্র সম্ভব তোমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।
সে তো হবেই। আমি আজই আমার জিনিষপত্র বেঁধে নেবো। তুমি আমাকে শহর পর্যন্ত পৌঁছে দিও। এলসওয়ার্দি যদি দলবল নিয়ে বিদায় হয়ে থাকে, তাহলে হয়তো আমরা দুজনেই বেস্-মোটলি হোটেলে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারবো।
লিউক বলে–না, তা হবে না। তুমি লন্ডনে চলে যাও। তোমাকে আমি একটু পরেই সব বুঝিয়ে বলছি–ততক্ষণ আমি হুইটফিল্ডের সঙ্গে একটু দেখা করে আসি।
সেই ভালো। এখানে সব কিছুই যেন কেমন জান্তব, তাই না? এই জায়গাটায় আমার দমবন্ধ হয়ে আসছিলো।
লিউক বললো–সে যাই হোক, ওর সঙ্গে দর কষাকষিটা তোমার ভালোই হয়েছে। যা হয়ে গেছে, তা নিয়ে আর হা-হুঁতাশ করে লাভ নেই।
লিউক ঘরে ঢুকতেই দেখলো যে ঘরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত হুইটফিল্ড পায়চারী করছেন।
এই যে ফিৎস উইলিয়াম্ এসে গেছেন?
দেখুন, আমি যে দুঃখিত বা অনুতপ্ত–এমন কোনো কিছুই আমি বলতে আসিনি, কারণ সেটা নেহাৎই ভণ্ডামী বলে মনে হতে পারে। তবে একথা বুঝতে পারছি যে, আপনার দিক থেকে দেখলে বলতে হবে, আমি অত্যন্ত অন্যায় করেছি। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, এমনটাও কখনো কখনো ঘটে থাকে।
লর্ড বলেন-বুঝেছি, বুঝেছি।
থামে না লিউক–ব্রিজেট আর আমি দুজনেই আপনার সঙ্গে প্রতারণা করেছি; কিন্তু ঘটনাকে অস্বীকার করে লাভ নেই–আমরা দুজনে দুজনকে পছন্দ করি, সুতরাং এ ব্যাপারে আর কিছু করবার ছিলো না। সবচেয়ে ভালো হবে ঘটনার বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে এখান থেকে আমাদের চলে যাওয়া।
লর্ড বললেন–ঠিকই বলেছেন। এ ব্যাপারে আপনাদের কিছু করার নেই।
লর্ড হুইটফিল্ডের কথাটা সুরটা যেন অনেকটা বেসুরো মনে হলো। তিনি কিছুক্ষণ ধরে যাচাই করার ভঙ্গীতে লিউকের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
তীব্রস্বরে লিউক বলে ওঠে–আপনি কী বলতে চান?
বলতে চাই যে আপনাদের কিছু করার নেই; অর্থাৎ অনেক দেরি হয়ে গেছে।–লর্ড হুইটফিল্ড বলেন।
এক পা এগিয়ে গিয়ে আবার একই প্রশ্ন করে লিউক–বলুন আপনি কী বলতে চান?
লর্ড বললেন–হনরিয়া ওয়েনফ্লিটকে জিজ্ঞেস করুন, ও বুঝতে পারবে। তাছাড়া ওর সব জানাও আছে, আমার সঙ্গে ও এ নিয়ে একবার কথা বলেছিলো।
উনি কী বুঝতে পারবেন?
বুঝতে পারবে যে পাপের শাস্তি অনিবার্য! ন্যায়ের দণ্ড অমোঘ! ব্রিজেটকে আমি ভালোবাসতাম; আজ আমি সেজন্য দুঃখিত। অপর পক্ষে, আমি আপনাদের দুজনের জন্যও দুঃখবোধ করছি।
আপনি আমাদের ভয় দেখাচ্ছেন?–প্রশ্ন করে লিউক।
লর্ড হুইটফিল্ড কথাটা শুনে যথার্থ আঘাত পেয়েছেন বলে মনে হলো।
না না, ভাই, ভয় দেখাচ্ছি না। ব্রিজেটকে আমি যখন স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চেয়েছিলাম, ও পূর্ণ দায়িত্বের সঙ্গে তা গ্রহণ করেছিলো। বিধান অমান্য করলে তার শাস্তি অবধারিত…
লিউক বলে–অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন যে, ব্রিজেটের একটা কিছু ঘটবে? আপনি যদি তেমন কিছু পরিকল্পনা করে থাকেন, তাহলে এখানেই আপনার খেল খতম। নিজের ভালো যদি চান, তাহলে সাবধান। আপনার জারিজুরি সবই আমি ধরে ফেলেছি।
হুইটফিল্ড বলেন–আমাকে নিজে কিছুই করতে হবে না–আমি এক সুবিশাল শক্তির যন্ত্র মাত্র। সেই শক্তি যে শাস্তির বিধান দেবেন, তাই-ই ঘটবে।
আপনি সেই বুজরুকীকে বিশ্বাস করেন?
করি, কারণ তাই-ই সত্যি। সে আমার বিরুদ্ধাচরণ করবে তাকেই শাস্তি পেতে হবে–আপনি বা ব্রিজেট তার ব্যতিক্রম হতে পারেন না।
এখানেই তো ভুল করলেন। ভাগ্য চিরকাল কারো সুপ্রসন্ন থাকে না। এক সময় ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায়। আপনার সেই সময় উপস্থিত হয়েছে।
লর্ড বললেন–ওহে যুবক, আপনি জানেন না, কার সম্পর্কে আপনি কথা বলছেন। এ বিশ্বচরাচরে কিছুই আমাকে ছুঁতে পারে না।
পারে না বুঝি? এবার সব টের পাবেন। এখন থেকে একটু হিসেব করে পা ফেলবেন হুইটফিল্ড।
এবার লর্ড হুইটফিল্ডের আর আগেকার সেই শান্ত, স্থির ভঙ্গীটা আর নেই।
এতক্ষণ আমি অসীম ধৈর্য নিয়ে সব শুনে গেছি; কিন্তু আমারও সহ্যের একটা সীমা আছে। বেরিয়ে যান এখান থেকে।
তা যাচ্ছি এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাচ্ছি। কিন্তু পরে যেন বলবেন না যে, আমি আপনাকে সতর্ক করে দিইনি।
লিউক বেরিয়ে একছুটে ওপরে উঠে গেল। সেখানে একজন ঝি ব্রিজেটের জামাকাপড় গুছিয়ে দিচ্ছিলো আর ব্রিজেট তার তদারকী করছিলো।
এত জলদি হয়ে গেল?
এই, আর দশ মিনিট।
মিনিট দশেক বাদে ফিরে এসে দেখে ব্রিজেট প্রস্তুত।
আমরা কি এখন যাবো।
চলো, আমি তৈরি।
সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময়ে দেখলো পাঁচক ওপরে উঠছে।
মেমসাহেব, মিস ওয়েনফ্লিট। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।
মিস ওয়েনফ্লিট? কোথায়?
বসবার ঘরে-সাহেবের সঙ্গে কথা বলছেন।
ওরা বসবার ঘরে সোজা চলে যায়; লিউক একেবারে গা ঘেঁষে ব্রিজেটের পেছনে থাকে।
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে লর্ড হুইটফিল্ড মিস ওয়েনফ্লিটের সঙ্গে কথা বলছিলো, হাতে একখানা ছুরি-ফলাটা লম্বা আর কিঞ্চিৎ বাঁকানো।
নিখুঁত হাতের কাজ। আমার কাগজের একজন সাংবাদিক মরক্কো থেকে এটা আমাকে এনে দিয়েছিলো। মরক্কোয় রিফ জেলায় তৈরি। কিন্তু আরবী জিনিষ হলেও কী দারুণ ধার!–লর্ড হুইটফিল্ড ছুরিটার ধার পরীক্ষা করছিলেন–মুখে তৃপ্তির দ্যুতি।
মিস ওয়েনফ্লিট বললো-দোহাই গর্ডন, ওটা সরিয়ে রাখো।
তারপর লর্ড বললেন–এই ছুরিটাকে স্পর্শ করেও আমি আনন্দ পাই।
মিস ওয়েনফ্লিটকে অত্যন্ত ফ্যাকাসে আর উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিলো।
বাঃ, এই যে ব্রিজেট, এসে গেছো? লক্ষ্মী মেয়ে।
লর্ড বললেন–হ্যাঁ, এই তো ব্রিজেট এসে গেছে; মনের সাধ মিটিয়ে ওর সঙ্গে গালগল্প করে নাও হনরিয়া, ও আর আমাদের মধ্যে বেশিক্ষণ নেই।
মিস ওয়েনফ্লিট ঝঙ্কার দিয়ে ওঠেন–তার মানে কী?
মানে? মানে হচ্ছে যে, ও লন্ডনে চলে যাচ্ছে, কী? ঠিক বলেছি?–এই হলো আসল মানে।
লর্ড আবার বলেন–তোমাকে একটা সুসংবাদ দিচ্ছি হনরিয়া, ব্রিজেট শেষ পর্যন্ত আর আমাকে বিয়ে করছে না; ফিৎস উইলিয়ামকেই বেছে নিয়েছে। জীবনের গতি বড়ই বিচিত্র! আচ্ছা তাহলে তোমরা গল্প-গুজব করো, আমি চলি।
লর্ড হুইটফিল্ড বাইরে চলে যান।
কী সর্বনাশ! কী দারুণ সর্বনাশ!–মিস ওয়েনফ্লিটের কথার মধ্যে হতাশা, আতঙ্ক এতই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ব্রিজেট বেশ বিস্মিত হয়ে যায়। ও বলে–কী যে হচ্ছে! আমি খুব লজ্জিত এবং আন্তরিক দুঃখিত।
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–ও দারুণ রেগে গেছে! এখন কী হবে? আমরা এখন কী করবো?
ব্রিজেট বলে–কী করবো মানে? আপনি কী বলতে চাইছেন?
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–তোমাদের আজই ওকে বলা উচিত হয়নি।
ব্রিজেট বললো–কী বলছেন? না বলে আমরা কী করতাম?
এক্ষুনি না বললেও চলতো। যতক্ষণ না তোমরা এখান থেকে নিরাপদে চলে যেতে পারছো, ততক্ষণ অপেক্ষা করা উচিত ছিলো।
সেটা তর্ক-সাপেক্ষ। আমার মতে এই জাতীয় বিরক্তিকর ব্যাপার যত তাড়াতাড়ি শেষ করা যায় ততই মঙ্গল।
ওঃ বুঝতে পারছে না, এই ব্যাপার যদি কেবল তাই-ই হতো তাহলে।
পুরো কথা শেষ না করে স-প্রশ্ন চোখে লিউকের দিকে তাকান।
লিউকও নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে বলে যে,–এমনও বলা উচিত হয়নি।
বিড় বিড় করে মিস ওয়েনফ্লিট ও আচ্ছা বলে থেমে যান।
ব্রিজেট বলে–আপনি কি কোনো বিশেষ কারণে আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন মিস ওয়েনফ্লিট?
ও হ্যাঁ, আমি বলতে এসেছিলাম যে, এখানে তো আর থাকাটা ভালো দেখায় না। কিন্তু ঠিকঠাক করে কোনো একটা ভালো জায়গায় যেতে হলে দুএকদিনের সময়েরও প্রয়োজন–এই দুএকটা দিন তোমরা আমার ওখানেই থেকে যাও।
আপনার সুবিবেচনা মনে রাখবার মতো। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
দেখ, আমার ওখানে আর যাই হোক, তোমার পক্ষে অত্যন্ত নিরাপদ আর
কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ব্রিজেট বলে–নিরাপদ?
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–না, এই বলছিলাম যে, আরামে থাকতে পারবে; তবে এখানে যেমন বিলাস-ব্যসনের মধ্যে বাস করছো, ততটা না হলেও আমার ওখানেও গরম জলের কালে গরম জল পাবে; আর আমার ঝি এমিলি মোটামুটি ভালোই রান্না করে।
ব্রিজেট বলে–ও কথা বলছেন কেন মিস ওয়েনফ্লিট? আপনার ওখানে বেশ আরামেই থাকতে পারবো।
তবে, তোমার পক্ষে সবচেয়ে ভালো হবে শহরে চলে যাওয়া।
ব্রিজেট বললো–তাতে একটু অসুবিধে আছে। আমার কাকীমা আজ সকালেই একটা ফুলের মেলা দেখতে চলে গেছেন। আমি এখনও তাকে এখানকার ঘটনা কথা কিছুই বলতে পারিনি; তবে আমি ওকে একটা চিঠি দিয়ে জানাতে পারি যে, আমি ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকবো।
তুমি কি লন্ডনে তোমার কাকীমার ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকবে?
হ্যাঁ, তাছাড়া ওখানে আমার কেউ নেই; তবে খাওয়ার জন্য আমাকে বাইরে যেতে হবে।
কী সর্বনাশ! তুমি একা ওই ফ্ল্যাটে থাকবে? তা কিন্তু উচিত হবে না। ওখানে একা থাকা ঠিক নয়।
ব্রিজেট বলে–ভয় নেই, আমাকে কেউ খেয়ে ফেলবে না। তাছাড়া, আমার কাকীমা কালকেই ফিরে আসবেন।
দুশ্চিন্তা, ভয়ে মিস ওয়েনফ্লিট মাথা নাড়েন।
লিউক বললো, ব্রিজেট, তার চেয়ে তুমি একটা হোটেলে গিয়ে থাকো।
ব্রিজেট বললো–কেন? তোমাদের সব হলো কী? আমাকে কি তোমরা অসহায় শিশু পেয়েছো?
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন-না না, ভুল বুঝো না। তোমাকে কেবল কিছুটা সাবধান হয়ে থাকতে বলছি, তার বেশি নয়।
কিন্তু কেন? কী হয়েছে? ব্যাপারই বা কী?
লিউক বললো–ব্রিজেট শোন, আমি তোমার সঙ্গে দুএকটা কথা বলতে চাই, কিন্তু এখানে তা সম্ভব নয়। আমার সঙ্গে গাড়িতে এসো, কোথাও একটা নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে কথা বলবো।
ও মিস ওয়েনফ্লিটের দিকে তাকিয়ে বলে–আপনি যদি কিছু মনে না করেন, ঘন্টা খানেক বাদে আপনার বাড়ি আমরা আসতে পারি? কয়েকটা ব্যাপারে আপনার পরামর্শ দরকার।
নিশ্চয়ই আসবেন, আমি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকবো।
লিউক মিস ওয়েনফ্লিটকে ধন্যবাদ জানিয়ে ব্রিজেটকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। চলতে চলতে বলে-বাক্সপত্র পরে এক সময়ে নিয়ে আসা যাবে, এখন চলো।
সামনের দরজা দিয়ে ওরা দুজনে বেরিয়ে আসে। লিউক ব্রিজেটকে গাড়িতে উঠতে বলে এবং নিজে ব্রিজেটের পাশে বসে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে তীব্র গতিতে ভেতরের রাস্তাটা পেরিয়ে গেটের বাইরে এসেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, বাব্বা। শেষ পর্যন্ত তোমাকে নিরাপদেই এ বাড়ির বাইরে বের করে আনতে পেরেছি।
তুমিও কি পাগল হয়ে গেলে লিউক? এই ঢাক-ঢাক-গুড়-গুড়, এখন আমাকে কিছু বলতে পারছো না,–এসবের মানেটা কী?
ধরতে পারো ব্যাপারটা যথার্থই কঠিন। যার ছাদের নিচে তুমি বসবাস করছে, সে যদি নিজেই একজন খুনী হয়, তখন ব্যাপারটা গুছিয়ে বলা কঠিন ব্যাপার বৈকি।
***
মিলে-মিশে করি কাজ ব্রিজেট প্রায় এক মিনিট নিশ্চল থেকে বললো–গর্ডন? মাথা নেড়ে লিউক সম্মতি জানায়।
গর্ডন? গর্ডন খুনী? এমন উদ্ভট কথা জীবনে কখনো শুনিনি।
তোমার এই কথা মনে হলো?
ঠিক এই কথাই মনে হলো, কারণ গর্ডনকে দেখেছি–ও একটা মাছি পর্যন্ত মারতে চায় না।
লিউক বলে–হতে পারে, যদিও আমার জানা নেই। কিন্তু একথা সত্যি যে ও ক্যানারীটাকে মেরেছিলো এবং আমার স্থির বিশ্বাস যে, বেশ কিছুসংখ্যক মানুষ ও খুন করেছে।
কিন্তু লিউক, আমি কিছুতেই একথা বিশ্বাস করতে পারছি না।
জানি, শুনতে অবিশ্বাস্যই মনে হয়; তাছাড়া আমার মাথাতেও ঘুণাক্ষরে এ চিন্তা আসেনি– এমন কি গত পরশু পর্যন্ত আমি কোনো রকম সন্দেহ পর্যন্ত করিনি।
কিন্তু আমিও যে গর্ডনকে আগাগোড়া চিনি। আমি জানি ও কেমন মানুষ। ও একেবারে নিপাট, ভালো মানুষ–বড় বড় কথা বলে, কিন্তু তাতে ওকে কেবল করুণা করা চলে, আর কিছু নয়।
লিউক বলে–এখন থেকে ওর সম্পর্কে তোমার ধারণা পাল্টাতে হবে ব্রিজেট।
তাতে কোনো লাভ নেই লিউক, আদতেই আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। তোমার মাথায় কী করে এমন এক অসম্ভব চিন্তা এলো?–কেন, দুদিন আগেও তো তুমি নিশ্চিত ছিলে যে এলসওয়ার্দিই খুনী?
লিউক বলে–জানি জানি, তুমি ভাবছো যে, আগামীকাল হয়তো আমি সন্দেহ করবো টমাসকে, তার পরদিন হয়তো হর্টনকে। তবে তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো–আমি অতটা তালকানা নই। তবে যদি ভালো করে অনুধাবন কর, তাহলে দেখতে পাবে যে প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে অন্যান্য কার্যকারণের পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য আছে। এখন বুঝতে পারছি, মিস পিঙ্কারটন কেন স্থানীয় পুলিশের কাছে যেতে চাননি। ওরা ওঁকে একেবারে হেসেই উড়িয়ে দিতো; কাজেই স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডই ওঁর শেষ ভরসা ছিলো।
কিন্তু পর পর এতগুলো খুন করার পেছনে গর্ডনের কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? না না, এ একেবারেই অসম্ভব কথা।
মানছি, কিন্তু একথা তো তুমি জান যে গর্ডন হুইটফিল্ড নিজেকে কী বিশাল একজন কেষ্ট-বিচ্ছু ভাবে?
ব্রিজেট বলে–তবুও আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা লিউক, তোমার হাতে কোনো প্রমাণ আছে?
প্রথম প্রমাণ ওর নিজের কথা। গত পরশু রাতে ও আমাকে বলেছিলো যে, যে-ই ওর বিরুদ্ধাচরণ করেছে, তাকেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।
এছাড়া, আরো কী আছে বলো?
ওই কথাগুলো ও যেভাবে বলেছিলো, সেই ভঙ্গীটাই হলো আসল; কথার সুরে ছিলো নিস্তরঙ্গ, শান্ত আত্মতুষ্টির আমেজ যেন বহুদিনের এক বদ্ধমূল বিশ্বাস থেকে প্রত্যেকটি কথা বলেছিলো। আর তখন ওর চোখমুখের প্রতিটি রেখায় যে হাসির সূক্ষ্ম প্রকাশ আমি দেখেছি তা যদি তুমি দেখতে, সমস্ত শরীরে একেবারে শিহরণ জাগানো অভিব্যক্তি। তারপর যেসব লোক ওর বিরুদ্ধাচরণের জন্য মারা গেছে, তাদের নামের তালিকা আর বিবরণ দিলো। মিসেস হর্টন, অ্যামি, টমি পিয়ার্স, হ্যারি কার্টার, আম্বলবি আর সেই ড্রাইভার রিভার্স।
আতঙ্কিত হয়ে ব্রিজেট বলে ওঠে–যারা সত্যি সত্যি মারা গেছে ও তাদেরই নাম করলো?
হা, হুবহু সেই নামগুলো। এবারে বিশ্বাস করলে তো?
ওঃ ভগবান! না করে পথ নেই? কিন্তু এর পেছনে ওর কী উদ্দেশ্য ছিলো।
একেবারে তুচ্ছ কারণ এবং সেটাই হচ্ছে আরো ভয়ঙ্কর। মিসেস হর্টন ওকে একবার কড়া কড়া কথা শুনিয়েছিলো; টমি পিয়ার্স একদিন ওকে অনুসরণ করে বাগানের মালীদের হাসিয়েছিলো; হ্যারি কার্টার কবে একবার ওকে খুব গালাগাল করেছিলো; অ্যামি গিবস্ অত্যন্ত অভব্য আর অভদ্র আচরণ করেছিলো ওর সঙ্গে; আম্বলবি জনসমক্ষে ওর বিরোধিতা করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলো আর রিভার্স মিস ওয়েনফ্লিট এবং আমার সামনে ওকে শাসিয়েছিলা।
আতঙ্কে ব্রিজেট বলে ওঠে–কী ভয়ানক নির্মমতা–কী নিদারুণ…
এছাড়া বাইরের কিছু প্রমাণ আছে; যে গাড়ি মিস পিঙ্কারটনকে লন্ডনে চাপা দিয়েছিলো, সেটা ছিলো রোলস্ এবং সেই গাড়ির নম্বর আর হুইটফিল্ডের গাড়ির নম্বর এক।
এতেই তো সব প্রমাণ হয়ে যায়।আস্তে আস্তে ব্রিজেট বলে।
একথা সহজেই বোঝা যায়। লর্ড-এর মতো একজন বিত্তশালী ক্ষমতাবান লোকের সম্পর্কে কিছু বললে সহজে কেউ বিশ্বাস করবে না; বরঞ্চ ওর কথাই আগে বিশ্বাস করে নেবে।
তাহলেই দেখো, মিস পিঙ্কারটনেরও এই একই অসুবিধে ছিলো।
ব্রিজেট বলে–মিস পিঙ্কারটন দুএকবার আমাকেও কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন, আমি তখন বুঝে উঠতে পারিনি–মনে হয়েছিলো যেন কোনো বিপদ-আপদ থেকে আমাকে সাবধান করতে চেয়েছিলেন। এখন তার অর্থ বুঝতে পারছি।
এভাবে একত্র করলে দেখবে সবই ছকে মিলে যাচ্ছে। মিসেস হর্টনকে আঙুর পাঠালো হুইটফিল্ড, ওদিকে ভদ্রমহিলা ধরেই নিয়েছিলেন যে, নার্সরাই ওঁকে বিষ খাওয়াচ্ছে। ওয়েলারম্যান ক্রেইৎস গবেষণাগার দেখতে যাওয়ার মধ্যেও ওই একই উদ্দেশ্য। যেভাবেই হোক, ও সেখান থেকে কোনোরকমে একটা জীবাণু যোগাড় করে এনে আম্বলবির হাতের ক্ষতস্থানে সংক্রামিত করেছে।
আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না যে কী করে সেটা সম্ভব হলো।
আমিও জানি না। কিন্তু একথা ভুললে চলবে না যে একটা যোগসূত্র ছিলো।
তা চলবে না, তোমার কথায় বলা যায় যে, মিলে যাচ্ছে। তাছাড়া, অন্যের কাছে যা একেবারে অসম্ভব, ওর কাছে তা নয়, কারণ ওকে কেউ সন্দেহই করবে না।
তবে আমার ধারণা মিস ওয়েনফ্লিট সন্দেহ করেছিলেন। খুব আলগা করে কথায় কথায় সেই গবেষণাগারের প্রসঙ্গে দুএকটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন যে, আমি সেই ইঙ্গিত ধরে এগোতে পারবো।
উনি তাহলে প্রথম থেকেই জানতেন?
অন্ততঃ একটা দৃঢ় সন্দেহ ছিলো। তবে, এককালে ভালোবাসতেন বলে একটা অসুবিধেও ছিলো।
ঘাড় নাড়ে ব্রিজেট।-হা, এর থেকেই অনেক ঘটনার হিসেব পাওয়া যায়। গর্ডন একবার আমাকে বলেছিলো যে, ওদের দুজনের বিয়ে হবার কথা একেবারে ঠিক হয়ে গিয়েছিলো।
কি জানো, উনি মনে মনে চেয়েছিলেন যে, গর্ডন যেন সেই লোক না হয়; কিন্তু দিনে দিনে উনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ও-ই আসলে সেই লোক। আমাকে কিছু কিছু ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন কারণ ওর বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু করতে গিয়ে মিস ওয়েনফ্লিটের কিছুতেই মন সরছিলো না। একদিক থেকে মেয়েরা সত্যিই অদ্ভুত! আমার তো বিশ্বাস যে, ভদ্রমহিলা এখনও লোকটাকে অন্তর থেকে ভালোবাসেন…
ব্রিজেট দুএক মিনিট গভীর চিন্তায় ডুবে থেকে হঠাৎ প্রশ্ন করে–সেদিন ট্রেনে মিস পিঙ্কারটন তোমাকে ঠিক কী বলেছিলেন এবং কিভাবে আরম্ভ করেছিলেন বলো তো?
লিউক বলে-বলেছিলেন যে উনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে যাচ্ছেন। এছাড়া গ্রামের পুলিশটির সম্পর্কে বলেছিলেন যে, এমনিতে নাকি লোকটি ভালো, তবে খুনের তদন্ত করার যোগ্যতা নেই।
এই বলেই কী কথা আরম্ভ করেছিলেন?
হা।
তারপর বলো।
তারপর উনি বলেছিলেন–বুঝতে পারছি আপনি আশ্চর্য হচ্ছেন, প্রথমটায় আমিও হয়েছিলাম–বিশ্বাসই করতে পারিনি। এমনও মনে হয়েছিলো যে, আমি সব কল্পনার চোখে দেখছি।
তারপর?
আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম যে, উনি ঠিক জানেন কিনা যে কল্পনার দৃষ্টিতে দেখেননি। এর জবাবে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে উনি বললেন–কক্ষনো না। প্রথমটায় হয়তো মনে হতে পারতো; কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থবার যখন একই ঘটনা ঘটলো তখন আর কোনো সন্দেহ রইলো না। মন্তব্য করলো ব্রিজেট–অপূর্ব! বলল, বলে যাও।
আমি অবশ্য একটু ঠাট্টা করেই বলছিলাম যে উনি নিশ্চয়ই ঠিকই দেখেছেন। আসলে আমার মনোভাব তখন ছিলো একেবারে খাঁটি একজন অবিশ্বাসী টমাসের মতো।
জানি এমনই হয়। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। আমারও হয়তো একই মনোভাব হতো, নিজেকে ওই বৃদ্ধার থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমতী ভাবতাম। যাই হোক, তারপর কী নিয়ে আলোচনা করলে?
বিষপ্রয়োগ করে খুন করার প্রসঙ্গে ওয়েলসের সেই অ্যাবারক্রোম্বি মামলার কথা তুলে বললেন যে, উনি সেই খুনীর চোখের জিঘাংসাময় বিশেষ দৃষ্টির কথা তখন বিশ্বাস করেন নি, কিন্তু এখন করেন, কারণ অনুরূপ দৃষ্টি উনি নিজেই প্রত্যক্ষ করেছেন।
তোমার কি মনে আছে যে, কথাগুলি উনি ঠিক কী বলেছিলেন?
লিউক বললো–উনি একেবারে নিখুঁত মহিলাসুলভ স্বরে বলেছিলেন–আমি যখন প্রথম এ খবর পড়ি, তখন আদৌ বিশ্বাস করিনি, কিন্তু ঘটনাটা সত্যি।আমি তখন প্রশ্ন করেছিলাম–কী সত্যি?–উত্তরে উনি বলেছিলেন, একজনের চোখের বিশেষ দৃষ্টি।–ব্রিজেট বিশ্বাস করো, যেভাবে উনি কথাগুলো বলেছিলেন তাতে আমার হৃৎকম্প আরম্ভ হয়েছিলো।
লিউক, সবকিছু আমাকে বিশদ করে বলো। থেমো না।
তারপর যারা খুন হয়েছে তাদের এক করে বর্ণনা দিলেন; অ্যামি গিব, কার্টার, টমি পিয়ার্স–টমি নাকি ছিলো এক দুরন্ত ডানপিটে শয়তান আর কার্টার ছিলো মাতাল। এরপর বলেছিলেন–কিন্তু এবার, এইতো মাত্র গতকাল–ডাঃ আম্বলবির দিকে–ভদ্রলোক অতি সজ্জন আর সত্যিকারের ভদ্রলোক।–আরো বলেন যে, উনি যদি আম্বলবির সঙ্গে দেখা করে তাকে সাবধানও করে দিতেন, তাহলেও কোনো লাভ হতো না কারণ, আম্বলবি ওঁর কথা আদৌ বিশ্বাস করতেন না, উপরন্তু হাসাহাসি করতেন।
ব্রিজেট বলে-বুঝেছি, বুঝতে পারছি।
লিউক চমকে ওঠে–কী হয়েছে ব্রিজেট? তুমি কী এতে ভাবছো?
মিসেস আম্বলবি একদিন আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, সে কথাটা মনে পড়ে গেল। যাকগে, তুমি কী বলছিলে বলো।
আমি বলেছিলাম যে, এতগুলো খুন করে পার পাওয়া খুব কঠিন। উত্তরে উনি বলেছিলেন—মোটেই নয়—ওখানেই ভুল করেছেন। যদি সবার সন্দেহের বাইরে থাকা যায়, তবে খুন করা খুবই সহজ। যে খুনীর কথা বললাম, সে এমনই একজন যে, তাকে কেউ সন্দেহই করবে না।
থেমে যায় লিউক। ব্রিজেটের সারা শরীর কেঁপে ওঠে।–খুন করা সহজ? সত্যিকথা অতি সহজ! এখন বুঝতে পারছি কথাগুলো কেন তোমার মনে গেঁথে আছে। আমি শুনলে আমারও থাকত সারা জীবন ধরে। গর্ডন হুইটফিল্ডের মতো একজনের পক্ষে-হ্যাঁ, খুব সহজ কাজই বটে।
কিন্তু ওর কাঁধে এই খুনের দায় চাপানো অত্যন্ত কঠিন।
তোমার তাই মনে হয়? আমি এ ব্যাপারে তোমাকে সাহায্য করতে পারি।
কিন্তু ব্রিজেট, আমি বারণ করছি।
তুমি তা করতে পারো না। সব শোনার পর কেউ চুপচাপ ঘরের কোণে বসে থাকতে পারে না, আমিও এর মধ্যে থাকছি। শোনো লিউক, আমি স্বীকার করেছি যে, বিপদের মধ্যে পা বাড়াচ্ছি, কিন্তু উপায় নেই; আমার যতটুকু করণীয় সেটুকু আমাকে করতেই হবে।
ব্রিজেট!
না লিউক, এ নিয়ে আর কথা নয় এর মধ্যে আমি থাকবোই। মিস ওয়েনফ্লিটের নিমন্ত্রণ নিলাম, আপাততঃ ওখানেই থাকবো।
কিন্তু ব্রিজেট, দোহাই তোমার!
বিপদ আমার একার নয়, আমাদের দুজনেরই–সে কথা আমি জানি। লিউক, আমরা দুজনেই একই পথের পথিক।
***
দস্তানা চাপিয়ে হাতে কেন যাও বন পথে
ওরা গাড়ির মধ্যে সারাক্ষণ যে আতঙ্কময় পরিবেশে কাটিয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে মিস ওয়েনফ্লিটের বাড়িটাকে মনে হচ্ছিল যেন এক প্রশান্তির আবাস।
লিউক বললো–আপনি যে অনুগ্রহ করে এখানে ওকে রাখছেন, এই ব্যবস্থাই–আমার সবচেয়ে ভালো মনে হচ্ছে মিস ওয়েনফ্লিট। আমি কিন্তু বেল-মোটলিতেই থাকবো, আর ওখান থেকে ব্রিজেটের দিকে নজর রাখবারও সুবিধে হবে–ও শহরে গেলে এ সুযোগ পেতাম না। তাছাড়া শহরে গিয়ে একজনের কী অবস্থা হয়েছিলো জানেনই তো।
মিস ওয়েনফ্লিট জিজ্ঞেস করলেন–আপনি পিঙ্কারটনের কথা বলছেন?
হা। যদিও একথা বলতে পারেন যে, শহরে জন-অরণ্যের মধ্যে নিরাপত্তা অনেক বেশি।
তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে যে মানুষ পরস্পরকে হত্যা করতে চায় না–এই শুভবুদ্ধিই
নিশ্চয়ই। সভ্যতার সুফলের ওপর নির্ভর তো করতেই হবে।
গম্ভীর ভাবে মাথা দোলান মিস ওয়েনফ্লিট।
জিজ্ঞেস করে ব্রিজেট–মিস ওয়েনফ্লিট আপনি কতদিন হলো টের পেয়েছেন যে, গর্ডন হত্যাকারী?
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া একটু কঠিন। যাই হোক, বলা যেতে পারে, আমার অন্তরের অন্তঃস্থল বেশ কিছুকাল আগে থেকে জানতো; কিন্তু আমি সেকথা মানতে চাইনি কারণ, আমি বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি; তাই নিজেকে একথা বোঝাতাম যে, একজন লোকের সম্পর্কে এ ধরনের চিন্তা করা অন্যায় এবং পাপ।
সরাসরি লিউক প্রশ্ন করে–আচ্ছা, আপনার নিজের জন্য ভয় ছিলো না?
মিস ওয়েনফ্লিট বললেন–অর্থাৎ, আপনি জানতে চাইছেন যে, গর্ডন যদি টের পেতে যে, আমি সব জানি, তাহলে সে আমাকে সরিয়ে ফেলতো কিনা?
হা।
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–তেমন একটা সম্ভাবনা সম্পর্কে আমি সর্বদা সচেতন ছিলাম এবং সেজন্য সতর্কও থাকতাম। মনে হয় না যে, আমার দিক থেকে গর্ডন কখনো বিপদের আশঙ্কা করেছে।
একথা মনে হবার কারণ?
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–কারণ, গর্ডন বোধহয় একথা বিশ্বাস করে যে আমি কখনো এমন কিছু করতে পারি না যাতে ওর কোনোরকম বিপদ হতে পারে।
লিউক প্রশ্ন করে–অত্যন্ত দুঃসাহসের পরিচয় দিয়ে আপনি তো ওকে সাবধান পর্যন্ত করেছিলেন–করেননি?
হ্যাঁ, আকার-ইঙ্গিতে আমি ওকে একথা বলতে চেয়েছিলাম যে, ও যাদের ওপর কোনো কারণে অসন্তুষ্ট, বেছে বেছে তারাই একের পর এক দুর্ঘটনায় মারা গেছে–এ ব্যাপারটা কেমন যেন অদ্ভুত।
তাতে ও কী বললো?–জানতে চায় ব্রিজেট।
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–ওর প্রতিক্রিয়া দেখে খুব আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। আমি যা বলতে চেয়েছিলাম, ও তার কাছেই গেলো না-বরঞ্চ মনে হলো ও যেন বেশ খুশী। বললো–ও তোমার চোখেও তাহলে পড়েছে?–আরো সঠিক করে বলা যায় যে, ও আত্মচর্চায় পরিপূর্ণ বিভোর।
লিউক বলে–একেবারে আস্ত পাগল।
মিস ওয়েনফ্লিট বললেন–সম্পূর্ণ সত্যি বলছেন। এছাড়া ওর সম্পর্কে আর কোনো ব্যাখ্যা নেই। ওর নিজের কাজের জন্য ও দায়ী নয়।
কথা বলতে বলতে লিউকের কাঁধে একখানা হাত রেখে মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–মিঃ ফিস্ উইলিয়াম্ ওরা কি ওকে ফাঁসী দেবে?
না না, হয়তো ব্রডমুরে পাঠাবে।
মিস ওয়েনফ্লিট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন–তবু ততো বেঁচে থাকবেন। আমি তাতেই খুশী।
লিউক বললো–কিন্তু তেমন জায়গায় পৌঁছতে আমাদের অনেক দেরি, যদিও আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে ব্যাপারটা এনেছি এবং তা থেকে এটুকু বলতে পারি যে, ওরা ওদের সাধ্যমত চেষ্টা করবে। কিন্তু একথা ভুললে চলবে না যে আমাদের হাতে সাক্ষী-প্রমাণ অতি সামান্যই আছে।
ব্রিজেট বললো–প্রমাণ আমরা যোগাড় করে ফেলবো।
ব্রিজেটের দিকে মিস ওয়েনফ্লিট চকিতে তাকান এবং ওঁর তাকানোর ভঙ্গী দেখে লিউকের মনে হলো যে, এমনই একটা ভঙ্গী এর আগেও ও যেন কোথায় দেখেছে। প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করেও কিছুতেই মনে এলো না।
মিস ওয়েনফ্লিট বললেন-তোমার খুব আত্মবিশ্বাস ব্রিজেট! সেইজন্যেই হয়তো যোগাড় করে ফেলতে পারবে।
লিউক বলে–ব্রিজেট, আমি গাড়িটা নিয়ে যাচ্ছি, ম্যানর থেকে তোমার জিনিষপত্রগুলো নিয়ে আসি।
ব্রিজেট বলে–আমিও যাবো।
আমাকে কি একটি শিশু পেয়েছো যে মার মতো আচরণ করছো আমার সঙ্গে? তোমার নিরাপত্তাধীনে আমি কিছুতেই থাকবো না।–কথাগুলো লিউক রেগে বললো।
মিস ওয়েনফ্লিট বলে—ব্রিজেট, আমার মনে হয়, দিনের বেলা গাড়িতে ভয়ের কোন কারণ নেই।
ব্রিজেট বলে–আমি কি বোকা দেখুন! এইসব কাণ্ডকারখানা আমার মাথাটাকেও ঘুলিয়ে দিয়েছে।
সেদিন রাতে মিস ওয়েনফ্লিটও পাহারা দিয়ে আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন। এখন অস্বীকার করে লাভ নেই–বলুন, দেননি আপনি?
লিউকের কথা স্বীকার করে মিস ওয়েনফ্লিট বললেন–আপনি যে ওকে তখন একেবারেই সন্দেহ করেননি মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম। গর্ডন যদি টের পেতো যে আপনার এখানে আসার মূল কারণ খুনের তদন্ত করা, তাহলে আপনার ওপর বিপদ নেমে আসতে পারতো। সেই জন্যই সেই নিরিবিলি সরু রাস্তায় আপনাকে একা যেতে দিতে ভরসা পাইনি-পাছে কিছু বিপদ ঘটে এই ভয়ে। মনে রাখবেন যে, ও অত্যন্ত ধূর্ত। যতটা আপনি ভাবতে পারেন তার চেয়েও অনেক বেশি চালাক–একজন সত্যিকারের বুদ্ধিমান।
আপনার সত বাণী মনে রাখবো।
লিউক বলে–ঠিক করে বলুন তো মিস ওয়েনফ্লিট, আমার কি সত্যিই কোনো বিপদ হতে পারে।
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–আমার মনে হয়, আসল বিপদ হলো ব্রিজেটের। ব্রিজেটের প্রত্যাখ্যান ওকে চরম অপমান করেছে। আমি নিঃসন্দেহ যে ব্রিজেটের ওপরই প্রথমে আক্রমণ হবে।
খানিকটা বিচলিত হয়ে লিউক বলে–আমার কথা শোন ব্রিজেট, তুমি এক্ষুনি–এই মুহূর্তে বিদেশে কোথাও চলে যাও।
ব্রিজেট বলে–আমি কোথাও যাচ্ছি না। লিউক আর আমি দুজনেই এই ঘটনার মধ্যে জড়িত।
লিউক বললো–সিংহের গুহা থেকে নিরাপদে ফিরে বেল-মোটলি থেকে তোমায় আমি ফোন করবো।
তাই কোরো।
শোন লক্ষ্মীটি, তুমি একদম দুশ্চিন্তা কোরো না। খুব পাকা খুনীরাও তাদের পরিকল্পনাতে কাজে লাগাতে কিছুটা সময় নেয়। আমার স্থির বিশ্বাস, আগামী দু-একদিন আমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ। সুপারিনটেন্টে ব্যাটল আজই লণ্ডন থেকে এসে যাচ্ছেন, তখন থেকেই হুইটফিল্ডের ওপর নজর রাখা হবে।
অর্থাৎ, সব কিছু সুসংবদ্ধ অবস্থায় আছে। অতএব, আমাদের আর কোনো রকম অতি নাটুকেপনা করার দরকার নেই।
লিউক ব্রিজেটের কাঁধে একখানা হাত রেখে বললেন–ব্রিজেট, লক্ষ্মীসোনা। তোমার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো যদি তুম হুট-হাট করে কিছু না করো।
বসবার ঘরে প্রবেশ করতেই ব্রিজেট দেখতে পেলো, মিস ওয়েনফ্লিট ঘরের টুকিটাকি জিনিষপত্র নিয়ে খুটখাট করছেন আর আপন মনে কথা বলছেন।
দেখো তো কাণ্ড! এখনো পর্যন্ত তোমার ঘরটা গুছিয়ে দেওয়া হলো না। বেশ তাজা এক কাপ চা করে দেবো। যা একটা ঝড়ঝাপ্টা তোমার ওপর দিয়ে গেল!
কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেবো আমার জানা নেই মিস ওয়েনফ্লিট! কিন্তু এখন সতিই আমার চায়ের কোনো দরকার নেই।
খেয়ে দেখো, একবার খাঁটি লপচুঙ–সউচ চা।
ঠিক তখনই এমিলি এসে দরজায় দাঁড়ালো,-মেমসাহেব, আপনি আমাকে কি কুঁচি দেওয়া বালিশের ঢাকনাটা পরাতে বললেন?
ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেলেন মিস ওয়েনফ্লিট। এই সুযোগে ব্রিজেট উঠে জানালা দিয়ে হাত গলিয়ে পুরো চা টা ফেলে দিলো।
অতিথিকে ঠিকমতো পরিচর্যা করা হলো না মনে করে মিস ওয়েনফ্লিট যেন খানিকটা হতাশ হলেন।
ব্রিজেট তাড়াতাড়ি করে বললো–কে জানে লিউক কতক্ষণে আসবে।
ওঁকে নিয়ে ভেবো না। মিঃ ফিস্ উইলয়াম নিজেকে রক্ষা করবার ক্ষমতা রাখেন।
সে আমি জানি। লিউক যথেষ্ট শক্ত লোক।
এই সময়ে টেলিফোনটা বেজে উঠতেই ছুটে গিয়ে ব্রিজেট ধরতেই অন্য প্রান্ত থেকে লিউকের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে-হ্যালো, ব্রিজেট তুমি? আমি বেস-মোটলি থেকে কথা বলছি, তোমার বেরোবার পরিকল্পনাটা দুপুর পর্যন্ত মুলতুবী রাখতে পারবে? কারণ, ব্যাটল এইমাত্র এসে পৌঁছলো-বুঝতে পারছো তো, কার কথা বলছি?
স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের সেই সুপারিনটেটে তো?
হা। ভদ্রলোক কতকগুলো বিষয় নিয়ে এক্ষুনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
আমার দিক থেকে কোনো অসুবিধে নেই; তবে তুমি যখন আসবে, আমার জিনিষপত্রগুলো সঙ্গে নিয়ে এসো, আর তখনই শোনা যাবে ভদ্রলোকের সঙ্গে তোমার কী কথাবার্তা হলো।
ঠিক আছে, তাহলে তা-ই ঠিক রইলো–ছাড়ছি।
আচ্ছা।
টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রেখে ব্রিজেট মিস ওয়েনফ্লিটকে ওদের দুজনের কথাবার্তার আনুপূর্বিক বর্ণনা দেয়।
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন,–কিছু পুরানো কাপড়চোপড় নিয়ে কাছেই এক মহিলার বাড়ি যাচ্ছি। যাবে নাকি আমার সঙ্গে? খাওয়ার আগেই আমরা ফিরে আসবো।
ব্রিজেট রাজী হয়ে যায়।
পেছনের দরজা দিয়ে ওরা বেরিয়ে যায়। মিস ওয়েনফ্লিটের হাতে দস্তানা এবং মাথায় একটা ঘাসের টুপি।
নিজের মনে ব্রিজেট বললো–আমরা যেন সেজেগুজে একেবারে বণ্ড স্ট্রীটে যাচ্ছি।
ওরা পর পর দুটো মাঠ পেরিয়ে একটা সরু গোছের ভাঙ্গাচোরা রাস্তা ধরে গিয়ে পড়ে এক রুক্ষ ধূসর জঙ্গলের পথে।
ব্রিজেটের তখন দুটো কবিতার লাইন মনে ওঠে,
দস্তানা চাপিয়ে হাতে কেন যাও বনপথে,
অয়ি, ধূসর-বরণ কৃশাঙ্গী ভালোবাসা যার নেই বরাতে!
মিস্ ওয়েনফ্লিটের কথায় ওর চিন্তায় ছেদ পড়ে।
কথাগুলোর মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা না থাকলেও কী যেন একটা অজানা স্পর্শে ব্রিজেট চোখ মেলে তাকায়। মিস ওয়েনফ্লিট ব্রিজেটের দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করেন-তোমার খুব ঘুম পাচ্ছে, না?
ব্রিজেটের এবার আর ভুল হয় না। ভদ্রমহিলার প্রশ্নের প্রচ্ছন্ন সুর সেই প্রায় অদৃশ অনুভূতিকেই এবার সাকার করে তোলে।
তাহলে ও ঠিকই ভেবেছিলো। ও ভেবেছিলেন যে একান্ত গোপনে, কারুকে না বলে ও নিজেই সেই ক্ষীণ সন্দেহের সত্য-মিথ্যে যাচাই করে নেবে। ও ধরেই নিয়েছিলো যে, ওর সন্দেহের কথা কেউ টের পায়নি; তাছাড়া, এত তাড়াতাড়ি যে আক্রমণ আসবে, তাও ছিলো ওর চিন্তার বাইরে। খোকা!–একেবারে ও নিরেট মূর্খ!
চট করে মনে পড়লো–চা!–চায়ের মধ্যে কিছু ছিলো। আমি চা খাইনি সেটা জানে না। এই সুযোগ নিতে হবে! ঘুমের ভান করতে হবে। চায়ের মধ্যে কী থাকতে পারে?-বিষ?-নাকি শুধুই ঘুমের ওষুধ? আশা করছে যে আমার ঘুমিয়ে পড়া উচিত–কথা থেকে সেটা পরিষ্কার।
ও আস্তে আস্তে আবার চোখের পাতা বন্ধ করে যথাসাধ্য ঘুমের ভান করে বলে–পাচ্ছে দারুণ। কী আশ্চর্য! কখনো আমার এত ঘুম পায় না।
মিস ওয়েনফ্লিটের মাথাটা অতি ধীরে দোলে।
ও মিস ওয়েনফ্লিটের ওপর নজর রাখে চোখের সূক্ষ্ম ফাঁক দিয়ে, আর চিন্তা করে–যাই আসুক না কেন সহজে আমার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না। কিন্তু ওকে দিয়ে সর্বপ্রথম কথা বলাতে হবে–ওর স্বীকারোক্তি যে দরকার।
গলার স্বর এবার কিছুটা চড়িয়ে আতঙ্কিত সুরে বলে-বুঝতে পারছি না আমার কি হলো!…কেমন যেন লাগছে…অত্যন্ত খারাপ লাগছে।
চতুর্দিকে চকিতে একবার দেখে নিলেন মিস ওয়েনফ্লিট। জায়গাটা একেবারে জনমানব শূন্য। গ্রামের থেকে বেশ খানিকটা দূর-চিৎকার করলে কারুর কানে পৌঁছবে না।
ধারে কাছে কোথাও কুঁড়েঘর পর্যন্ত নেই। কাঁপা কাঁপা হাতে মহিলা পুরানো কাপড়ের মোড়কটা আঁটছেন–মোড়কটা খুলে যেতে একটা বড় উলের পোশাক টেনে বের করে আবার কী যেন একটা খুঁজছেন–তখনও হাতে দস্তানা।
দস্তানা চাপিয়ে হাতে, কেন যাও বন পথে–কেন? দস্তানা কেন?…ঠিক, ঠিক। সমস্ত ব্যাপারটাই নিখুঁতভাবে পূর্বপরিকল্পিত।
কাগজের মোড়কটা খুলতেই তার মধ্য থেকে সেই ছুরি বেরিয়ে এলো। অতি সাবধানে হাতে ধরা, যাতে লর্ড হুইটফিল্ডের আজ সকালের হাতের ছাপ নষ্ট না হয়ে যায়। এইজন্যই হাতে দস্তানা?
ব্রিজেটের গা গুলিয়ে উঠলো। গলাটা ঈষৎ খরখরে করে নিস্তেজ স্বরে ও জিজ্ঞেস করে–ওটা কী? ছুরি?
মিস ওয়েনফ্লিট সঙ্গে সঙ্গে হেসে ওঠেন। সে হাসি বড় সাংঘাতিক। উনি বলেন–এটা তোমার জন্য ব্রিজেট, একান্তই তোমার জন্য। দীর্ঘকাল ধরে আমি তোমায় ঘৃণা করে এসেছি, তুমি হয়তো সে কথা জানোও না।
ব্রিজেট বললো–কেন? আমার গর্ডন-এর সঙ্গে বিয়ে হবার কথা ছিলো। সেইজন্য?
মিস ওয়েনফ্লিট বললেন–তুমি চালাক–অত্যন্ত চালাক মেয়ে; এবং তুমিই হবে ওর বিরুদ্ধে এক জলজ্যান্ত সাক্ষ্য। তোমার দেহ থেকে মাথাটা কাটা অবস্থায় এখানে পাওয়া যাবে এবং তার সঙ্গে পাওয়া যাবে ওরই ছুরি, আর সেই ছুরির হাতলে পাওয়া যাবে ওরই হাতের ছাপ! আজ সকালে এই ছুরিটা দেখতে চাওয়া কি দারুণ বুদ্ধির খেলা বলো তো? এবং তোমরা যখন ওপরে ব্যস্ত তারই ফাঁকে ছুরিটাকে রুমালে জড়িয়ে ব্যাগের মধ্যে রেখে দেওয়া কত সহজ কাজ! সমস্ত ব্যাপারটা যে এত সহজে হবে ভাবতেই পারিনি।
ব্রিজেট বললো–ওটা পেরেছেন কারণ আপনি একেবারে শয়তানের মতো ধূর্ত।
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–ঠিকই বলেছো, ছোটবেলা থেকেই আমার প্রচণ্ড বুদ্ধি। গর্ডন এলো–একজন সাদা-মাটা মুচির ছেলে; কিন্তু ওর খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিলো। তখন থেকেই আমি জানতাম ও একদিন মাথা তুলে দাঁড়াবে–আর ওই কিনা আমাকে প্রত্যাখ্যান করলো! আমাকে প্রত্যাখ্যান। সবকিছু ঘটেছিলো সেই বিশ্রী বিরক্তিকর পাখিটাকে কেন্দ্র করে।
গর্ডন র্যাগ প্রত্যাখ্যান করলো আমাকে কর্নেল ওয়েনফ্লিটের মেয়েকে। সেদিনই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে আমি এর প্রতিশোধ নেব। দিনের পর দিন রাতের পর রাত ভেবেছি; আর দিন দিন আমাদের অবস্থাও পড়ে যেতে লাগলো–আমরা গরীব হয়ে গেলাম, বাড়িটাও বিক্রি হয়ে গেলো–ওই কিনলো! আমাকে সাহায্য করার জন্য ও আমারই বাড়িতে আমাকে একটা চাকরি দিলো। আর তখন ওর ওপর আমার আরও বেশি ঘৃণা হলো। কিন্তু বুঝতে দিইনি আমার অন্তরের ইচ্ছে। ছোটোবেলায় আমি এই একটা প্রচণ্ড দামী শিক্ষা পেয়েছিলাম যে, মনের কথা মনেই চেপে রাখতে হয়।
প্রথম কটা বছর শুধু ভাবতাম কী করি…। প্রথমে ঠিক করেছিলাম ওকেই খুন করবো এবং তখন থেকেই লাইব্রেরিতে বসে সারাদিন ধরে সবার চোখ এড়িয়ে অপরাধতত্ত্বের বই পড়তে আরম্ভ করলাম। আমার সেই পড়াশোনার ফল কয়েকবারই হাতে-নাতে পেয়েছি–যেমন, অ্যামির বিছানার পাশে বোতল পাল্টাপাল্টি করে রেখে ওর ঘরের তালা ছোট্ট একটা কাঠি দিয়ে বাইরে থেকে বন্ধ করা। ওঃ, সেই মেয়েটার কী নাক ডাকিয়ে ঘুম। অত্যন্ত বিরক্তিকর।
ভদ্রমহিলা একটু দম নেন, তারপর বলেন–কী যেন বলেছিলাম?
ব্রিজেটের চরিত্রের একটা বড় গুণ–যা দিয়ে লর্ড হুইটফিল্ডকে ও খুশী করতে পেরেছিলো, তা হচ্ছে অন্যের কথা নিঃশব্দে সোনার মত ধৈৰ্য্য এবং এক্ষেত্রেও সেই একই গুণ কাজে এলো।
যদিও ওয়েনফ্লিট একজন উন্মাদিনী, খুনী, কিন্তু একথা সত্যি যে, তারও একজন নীরব শ্রোতার বড্ড প্রয়োজন। মিস ওয়েনফ্লিটকে কথা বলাবার জন্য যতটুকু দরকার ব্রিজেট মেপে ঠিক ততটুকু বলে-আপনি বলেছিলেন যে প্রথমে আপনি গর্ডনকে খুন করবেন ভেবেছিলেন।
হ্যাঁ, মনে করেছিলাম; কিন্তু সেটা আমার ভালো লাগলো না, একেবারেই গতানুগতিক মনে হলো। ওকে এমন শাস্তি দেওয়া ঠিক করলাম, যাতে ও খুনী হিসেবে চিহ্নিত হয়, যাতে নিজে নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও পরস্পর কতগুলো খুনের দায় ওর ঘাড়ে চাপে। আমার অপরাধের জন্য ও ফাঁসির দড়িতে ঝোলে অথবা ও পাগল হয়ে যায়। একটা পাগল হিসেবে কয়েদখানায় থাকে…এটা যদি হয়, তাহলেই সবচেয়ে ভালো।
ভদ্রমহিলা খুক খুক করে হেসে ওঠেন। এ হাসি বড়ই মর্মবিদারক হাসি!
তোমাকে একটু আগেই বলেছি যে আমি অপরাধতত্ত্বের ওপর বেশ কিছু বই পড়েছি। ওখান থেকেই আমি ঠিক করলাম যে, কাকে খুন করা দরকার। প্রথম দিকে লোকে ওকে খুব একটা সন্দেহ করুক–এ আমি চাইনি। একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করেছি যে খুন করে আমি আনন্দ পেতাম। সেই খুঁতখুঁতে মহিলা লেডি হর্টন–ভদ্রমহিলা এমনিতে আমাকে পছন্দ করতেন, দরকারে সাহায্যও করতেন; কিন্তু একদিন আমার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বুড়ী বলে উল্লেখ করলেন। এর ঠিক কিছুদিন পরেই গর্ডনের সঙ্গেও ভদ্রমহিলার ঝগড়া হলো–আমার মনটা একেবারে নেচে উঠলো। ভাবলাম একই ঢিলে দুই পাখি মারবো। কী মজাটাই না করলাম। ওঁর বিছানার পাশে বসে ওঁর চায়ে আমি নিজেই বিষ মেশালাম, আর আমিই আবার বাইরে এসে নার্সদের বললাম যে, লর্ড হুইটফিল্ডের পাঠানো আঙুর মিসেস হর্টনের মুখে তেতো লেগেছে। কিন্তু এ কথার প্রতিবাদ করার জন্য সেই মহিলা আর বেঁচে রইলেন না।
তারপর একে একে অন্যদের। যখনই শুনতাম যে গর্ডন কারও ওপর রেগে গেছে, তখনই একটা করে দুর্ঘটনা ঘটানো এমন কিছু কঠিন নয়। আর ও এমন বোকা–এমন নিরেট মূর্খ। আমিই ওকে বিশ্বাস করিয়েছিলাম যে, ও এমনই একজন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ওর বিরুদ্ধাচরণ করলেই তার শাস্তি অনিবার্য। অতি সহজেই ও বিশ্বাস করেছিলো। আহা রে, আমার প্রাণের গর্ডন। সব কিছুতেই ওর অনড়, অটল বিশ্বাস–এমনই মোটা বুদ্ধি ওর!
মনে পড়ে ব্রিজেটের, সেও একদিন লিউককে বলেছিলা–গর্ডন?–সে সবই বিশ্বাস করে।–সহজ?–সত্যিই সহজ। বাগাড়ম্বর সম্পন্ন মূর্খ গর্ডন।
কিন্তু না। থামতে দিলে চলবে না–ওর আরও অনেক শোনার আছে।
ব্রিজেট বলে কিন্তু এসব আপনি করলেন কী করে? আমি কিছুতেই বুঝতে উঠতে পারছি না।
এতো সহজ ব্যাপার। অ্যামিকে যখনই ওর ম্যানর থেকে তাড়িয়ে দিলো, আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে রেখে দিলাম। হ্যাট পেইন্ট দিয়ে কাজ হাসিল করার বুদ্ধিটা আমার ভালোই খেটেছিলো; তার ওপর বাইরে থেকে দরজায় তালা বন্ধ করার কৌশলটাও আরও কাজে দিলো। সর্বোপরি, আমার সুবিধে ছিলো যে, খুন করার পেছনে আমার কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না। উদ্দেশ্য ছাড়া যে কেউ খুন করতে পারে, একথা চিন্তাই করা যায় না। কার্টারের ক্ষেত্রেও খুব সহজেই কাজ হাসিল করা গেছে। চারিদিকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন, অস্পষ্ট; তার মধ্য দিয়েও টলতে টলতে আসছিলো। পুলের ওপর অপেক্ষা করছিলাম, ওখান থেকে দিলাম এক ধাক্কা– বিদুৎগতিতে–ব্যাস! রোগাপটকা হলেও আমার গায়ে বেশ জোর আছে।
তারপর ব্রিজেটের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন–জানো, লোকজন যে সত্যিই এতো বোকা একথা আমি আগে জানতাম না।
ব্রিজেট বলে-ডাঃ আম্বলবির ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই খুব অসুবিধে হয়েছিলো?
তা হয়েছিলো। না হবার সম্ভাবনাই ছিলো বেশি; কিন্তু গর্ডন ওয়েলারম্যান ক্রেইৎস গবেষণাগারে গিয়েছিলো–এই কথা ও যখন সবার কাছে বলে বেড়াতে আরম্ভ করলো তখনই একটা বুদ্ধি আমার মাথায় এলো। ভাবলাম এটা কাজে লাগানো যায় কিনা–সেই অনুযায়ী ওয়াঙ্কিপু-র কানের ঘা-টা দেখাবার জন্য একদিন ডাঃ আম্বলবিকে ডাকলাম। উনি যখন ওয়াঙ্কিপু-র কানে ব্যাণ্ডেজ বাঁধছিলেন, তখন আমার হাতের কাঁচি দিয়ে ডাঃ আম্বলবির হাতটা খানিকটা চিরে দিলাম–যেন হাত ফসকে লেগে গেছে। এমন ভাব করলাম যেন লজ্জায় দুঃখে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে গেছি. একটা ব্যাণ্ডেজ এনে ওঁর কাটা জায়গাটা বেঁধে দিলাম। আগে থেকেই ব্যাণ্ডেজের কাপড়ে ওয়াঙ্কিপু-র কানের পুঁজ-রক্ত খানিকটা মিশিয়ে রেখেছিলাম। ফলও ফললো।
ল্যাভিনিয়া পিঙ্কারটন। ও টের পেয়েছিলো। টমিকে সেই অবস্থায় ওই প্রথম দেখতে পায়। তারপর গর্ডন আর আম্বলবির মধ্যে যেদিন কথা কাটাকাটি হলো, সেদিন আমি আম্বলবির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম–তাও ওর নজরে পড়লো, দেখলাম, ও আমাকে একদৃষ্টে-একমনে লক্ষ্য করছে। তখনই বুঝে গেলাম ও জেনে গেছে। একথাও জানতাম যে, ও কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না; তবে আবার এ কথাও মনে হলো যে, কেউ যদি–বিশেষ করে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের লোকেরা ওর কথা বিশ্বাস করে তাহলেই ঝামেলা। আমি জানতাম সেদিন ও কোথায় যাচ্ছিলো। একই ট্রেনের অন্য একটা কামরায় আমি ওকে অনুসরণ করলাম। তার পরের ব্যাপারটা খুব সহজেই ঘটলো। হোয়াইট হলের সামনে রাস্তা পেরোবার জন্য ও দাঁড়ালো। ওর চোখ এড়িয়ে ঠিক ওর পেছনে আমিও গিয়ে দাঁড়ালাম। যেই একটা বড় গাড়ি এলো, গায়ের জোরে ভীড়ের মধ্য থেকে দিলাম একটা প্রচণ্ড ধাক্কা। আমার শরীরে প্রচণ্ড শক্তি। ও একেবারে সামনের চাকার তলায় পিষে গেলো। আমার পাশের মহিলাকে বললাম যে আমি গাড়ির নম্বর দেখতে পেয়েছি, এবং গর্ডনের গাড়ির নম্বরটা বললাম। ধরেই নিলাম যে ওই মহিলা পুলিশকে এই নম্বরই বলবে।
এই সেদিন লিউক ফিৎস্ উইলিয়ামের সামনেই রিভার্স কী কাণ্ডটাই না করলো গর্ডনের সঙ্গে! আর কৌতুকের ব্যাপার হলো; আমিই সঙ্গে করে লিউককে নিয়ে ও জায়গা দিয়ে যাচ্ছিলাম! তখন পর্যন্ত ভেবে পাচ্ছিলাম না যে, গর্ডনের ওপর কী করে লিউকের সন্দেহ জাগিয়ে তুলি। এবার সুযোগ পেয়ে গেলাম; রিভার্স মরলেই লিউক বাধ্য হবে গর্ডনকে সন্দেহ করতে।
আর এবার? এবারই হলো আসল মার–এই মারেই গোটা নাটকের নিখুঁত পরিসমাপ্তি। –ব্রিজেটের কাছে এবার উঠে সরে এসে বলেন–আমাকে তাচ্ছিল্য করলো গর্ডন। আমার জায়গায় ও তোমাকে বিয়ে করতে চাইলো। সারাটা জীবন ধরে কেবলই হতাশা-কিছুই পেলাম না কিছু না।
অয়ি, ধূসর-বরণ কৃশাঙ্গী ভালোবাসা যার নেই বরাতে।
মিস ওয়েনফ্লিট ব্রিজেটের গায়ের ওপর ঝুঁকে পড়েন; মুখে মৃদু হাসি, চোখে উন্মাদনা…ছুরির ফলাটা ঝকঝক করছে।
ব্রিজেট সর্বশক্তি দিয়ে বাঘিনীর মতো এক লাফে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মিস ওয়েনফ্লিটকে ফেলে দিয়ে ওঁর কব্জি সজোরে চেপে ধরে।
ওয়েনফ্লিট আচম্বিত আক্রমণে হতচকিত হয়ে মাটিতে পড়ে যান; কিন্তু নিজেকে পরমুহূর্তেই সামলে নিয়ে প্রতি আক্রমণ করেন। গায়ের জোরে এই দুজনের মধ্যে কোনো তুলনাই করা চলে না।
সময় যতই যায়, ওয়েনফ্লিটের জোরও যেন ততই বাড়তে থাকে। চিৎকার করে ওঠে ব্রিজেট।
লিউক..বাচাও…বাঁচাও।
কিন্তু ওকে বাঁচাতে কেউ আসে না। মরিয়া হয়ে ওয়েনফ্লিটের কব্জিতে প্রচণ্ড জোরে চাপ দিতেই হাত থেকে ছুরিটা পড়ে যাওয়ার আওয়াজ পেলো। আর সঙ্গে সঙ্গেই সেই পাগলিনীর দুটো হাত ওর গলায় বেড়ির মতো চেপে বসে ওর প্রাণশক্তিকে চাপ দিয়ে বের করে দিতে চাইলো। শেষবারের মতো এক আর্ত-চিৎকার বেরিয়ে এলো ব্রিজেটের গলা থেকে…।
***
মিসেস আম্বলবির জবানবন্দী
সুপারিনটেন্টে ব্যাটল-এর চেহারা দেখে ভালই লাগলো লিউকের। লিউক বেশ সতর্কতার সঙ্গে ভদ্রলোককে যাচাই করে। ও জানে যে, এদের ওপর আস্থা রাখলে সুফল পাওয়া যায়।
তদন্তে আসার ব্যাপারটাকে কি একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে গেল না?
মৃদু হেসে ব্যাট বললেন–কিন্তু মিঃ ফিস্ উইলিয়া, ঘটনাটা তো মারাত্মক আকারও নিতে পারে? বিশেষ করে লর্ড হুইটফিল্ডের মতো লোক যেখানে জড়িত, কোনো রকম ভুলভ্রান্তি হয়ে গেলে তার ফলাফল বিপজ্জনক হতে পারে।
ঠিক বলেছেন। আপনি কি একা এসেছেন?
না না,আমার সঙ্গে একজন গোয়েন্দা অফিসার আছেন। উনি আপাততঃ সেভেন-স্টার-এ অপেক্ষা করছেন; ওর প্রধান কাজ হলো লর্ড হুইটফিল্ডের ওপর নজর রাখা।
ও, আচ্ছা।
মিঃ ব্যাটল জিজ্ঞেস করেন–মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম, বলুন তো আপনি কি পুরোপুরি নিঃসন্দেহে?–অর্থাৎ, আপনি যাকে নিয়ে আশঙ্কা করছেন, সেখানে কোনো ভুলভ্রান্তির অবকাশ নেই তো?
ঘটনা যা সংগ্রহ করতে পেরেছি, তাতে মনে হয় না, যে আমার সন্দেহ অমূলক। আপনাকে কি ঘটনাগুলো বলবো?
না, তার দরকার হবে না, আমি স্যার উইলিয়ামের কাছে সবই শুনেছি।
তাহলে বলুন আপনার কী মনে হয়? লর্ড হুইটফিল্ডের মতো লোক যেন এমন সব কাণ্ড করতে পারেন, সেটা নিশ্চয়ই আপনার কাছে অভাবিত মনে হচ্ছে?
মিঃ ব্যাটল বললেন–খুব কম জিনিষই আমার আছে অভাবিত বলে মনে হয়। আমার মতে অপরাধ-বিজ্ঞানের অসম্ভব বলে কোনো কথা নেই। আপনি যদি একজন বৃদ্ধা মহিলা অথবা স্কুলের একটা ছোট্ট মেয়েকে অপরাধী বলে সন্দেহ করেন, তাহলেও আপত্তি করব না–আমি বরঞ্চ যাচাই করে দেখবো।
আপনি যখন স্যার উইলিয়ামের কাছে আগের সব ঘটনাই শুনেছেন, তখন তার আর পুনরাবৃত্তি না করে বরঞ্চ আজ সকালে যা যা ঘটেছে, তার একটা মোটামুটি বর্ণনা দিচ্ছি।
আজ সকাল বেলায় লর্ড হুইটফিল্ডের বাড়িতে যে ঘটনাগুলো ঘটেছিলো, লিউক তার আনুপূর্বিক বর্ণনা দেয়।
গভীর মনোযোগ দিয়ে ব্যাটল সব শুনে বললেন–আপনি বলছেন যে, ও ছুরির ধার পরীক্ষা করছিলো? ছুরিটা নিয়ে কি কারো দিকে কোনো রকম ইঙ্গিত করেছিলো বা কাউকে ভয় দেখাতে চাচ্ছিলো?
খোলাখুলি ভাবে তেমন কিছু করেনি; তবে কেমন যেন একটা কুৎসিত ভাবে ধারটা পরীক্ষা করছিলো–চোখে-মুখে কেমন যেন একটা বিজাতীয় আনন্দের ভাব ছিলো। মিস ওয়েনফ্লিটও হয়তো সেটা লক্ষ্য করেছেন।
ও, আপনি সেই ভদ্রমহিলার কথা বলছেন যিনি একেবারে ছোটবেলা থেকে লর্ড হুইটফিল্ডের পরিচিতা-যাঁর সঙ্গে ওর বিয়ে হবার কথা ছিলো?
ঠিকই ধরেছেন।
ব্যাটল বললেন–আপনি মিস কনওয়ের নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত থাকতে পারেন মিঃ ফিটস উইলিয়াম। আমি এক্ষুনি কাউকে ডেকে ওঁর ওপর নজর রাখতে বলে দিচ্ছি। ওঁর সঙ্গে যদি লর্ড হুইটফিল্ড-এর গতিবিধির ওপরও জ্যাকসন সতর্ক দৃষ্টি রাখে, তাহলে আর কোনো বিপদ ঘটবে বলে মনে হয় না।
এতক্ষণে সত্যিই আমি নিশ্চিত হলাম।
ব্যাটল বললেন–মিস কনওয়েকে নিয়ে আপনার দুশ্চিন্তার কারণ আমি বুঝতে পারছি মিঃ ফিস্ উইলিয়াম্। একটা কথা বলছি আপনাকে,–এই কেসটা খুব একটা সহজ বলে আমার মনে হয় না। লর্ড হুইটফিল্ডকে মনে হচ্ছে অত্যন্ত ধূর্ত লোক। আমার মনে হচ্ছে, ও যতক্ষণ পারবে ততক্ষণ আগাগোড়া মিথ্যে কথা বলবে–একেবারে শেষ পর্যন্ত।
শেষ পর্যন্ত বলছেন কেন?
এক শ্রেণীর অপরাধী আছে, যারা নিজেকে প্রচণ্ড বুদ্ধিমান ভাবে; তারা কিছুতেই ধরা পড়বে না–এমন একটা চেতনা ওদের গর্বিত করে তোলে। লর্ড হুইটফিল্ডও মনে হচ্ছে সেই শ্রেণীর অপরাধী। তবে, শেষ পর্যন্ত ওকেও আমরা ধরে ফেলবো।
লিউক বলে–আপনার কথাই যেন সত্যি হয়; তবে আমি যদি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি–আমাকে বলবেন।
নিশ্চয়ই বলবো।
এক্ষুনি কি করণীয় কিছু ভেবেছেন?
ব্যাটল বলেন–এই মুহূর্তে কিছু করার আছে বলে মনে হয় না। এই জায়গাটা আর তার পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে আমি কিছু কিছু খবর চাই। সন্ধ্যাবেলায় আপনার সঙ্গে আর একবার খানিকক্ষণ পরামর্শ করতে পারবে তো?
অনায়াসে।
তখন আপনাকে ভালো করে বলতে পারবো যে অবস্থাটা কী!
লিউক ঘড়ির দিকে তাকায়। দুপুরবেলার খাওয়ার আগে একবার ব্রিজেটের কাছে যাবে কিনা ভাবে। পরে ওর মনে হয় যে, যাওয়াটা উচিত হবে না; ও গেলে মিস ওয়েনফ্লিট ওকেও খেয়ে যেতে বলবেন, আর তাতে ভদ্রমহিলার খুবই অসুবিধে হবে। ও ওর নিজের কাকীমা, জেঠিমাদের দেখে এইটুকু বুঝেছে যে এই মধ্যবয়স্কা মহিলারা ঘর-সংসার তত্ত্বাবধানের ব্যাপারে বড়ই খুঁতখুঁতে হয়ে থাকেন। আচ্ছা, মিস ওয়েনফ্লিটও কি কারো পিসি বা মাসি?-হতেও তো পারেন।
হোটেলের বাইরে লিউক বেরিয়ে আসে। কে যেন একজন কালো পোশাক পরা ওকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।
মিস ফিৎস্ উইলিয়াম।
আরে, মিসেস আম্বলবি?–এগিয়ে এসে লিউক মিসেস আবির হাত দুখানা ধরে।
আমি ভেবেছিলাম, আপনি চলেই গেছেন।
না, থাকবার জায়গাটা শুধু বদল করেছি মাত্র–আমি এখন থেকে এই হোটেলেই আছি।
আর ব্রিজেট? শুনেছিলাম যে ও অ্যাশম্যানর থেকে চলে এসেছে।
হ্যাঁ, ও-ও বেরিয়ে এসেছে।
মিসেস আম্বলবি বলেন–আমি সত্যিই খুব নিশ্চিন্ত হলাম। উইচউড থেকে চলে গিয়ে ও সত্যিই ভালো করেছে।
না যায়নি, এখানেই আছে। ও মিস ওয়েনফ্লিটের কাছে রয়েছে।
লিউক দেখলে যে কথাটা শুনেই মিসেস আম্বলবির মুখে একটা আতঙ্কের ছাড়া পড়লো।
হনরিয়া ওয়েনফ্লিটের সঙ্গে আছে? কিন্তু কেন?
মিস ওয়েনফ্লিট ওকে দুচারদিন ওখানেই থাকতে বলেছেন।
মিসেস আম্বলবি বললেন–মিঃ লিউক আমার হয়তো একথা বলার অধিকার নেই–হয়তো কিছুই বলা উচিত নয়; আমি নিজেই দুঃখ-শোকে একেবারে জর্জরিত। আমি যা বলবো, শুনে হয়তো আপনার মনে হবে যে, আমি বাজে কথা বলছি; আপনার একথাও মনে হতে পারে, যে অসুস্থতার ফলে আমি যা-তা বলছি।
লিউক বলে–আপনি কী বলতে চাইছেন?
দুষ্কার্য সম্পর্কে আমার একটা বিশ্বাসের কথা।
লিউক অপেক্ষা করে থাকে উনি কী বলেন শোনার জন্য।
কী প্রচণ্ড এক শয়তানি! উইচউডের আকাশে-বাতাসে সব সময়ে এক শয়তানের খেলা চলেছে; আর ওই মহিলাই হচ্ছে এই সব শয়তানির মূল কারণ এ সম্পর্কে আমার আর কোনো সন্দেহই নেই।
লিউক যেন এক ধাঁধায় পড়ে যায়–আপনি কোনো মহিলার কথা বলছেন?
মিসেস আম্বলবি বলেন–হনরিয়া ওয়েনফ্লিট একটা আস্ত শয়তান! ল্যাভিনিয়া পিঙ্কারটনকেও কেউ বিশ্বাস করেনি; কিন্তু আমরা দু জনেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলাম। ও আমার চেয়ে বেশি জানতো…একটা কথা মনে রাখবেন মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম, কোনো মহিলা যদি জীবনে অসুখী হয়, সে যে-কোনো ধরনের দুষ্কার্য করতে পারে।
লিউক বলে–তা হয়তো পারে।
লিউক ভদ্রমহিলার যাওয়ার পথে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ওর মাথায় কেবলই ঘুরছে যে মিসেস আম্বলবি হনরিয়াকে শয়তান বললেন কেন। আরও একটা কথা কী যেন বললেন ভদ্রমহিলা?–পিঙ্কারটনকেও কেউ বিশ্বাস করেনি। তার মানে দাঁড়াচ্ছে যে পিঙ্কারটন ওঁর সন্দেহের বিষয়ে মিসেস আম্বলবিকে সব খুলে বলেছিলেন।
লিউকের চোখের সামনে ফুটে উঠলো ট্রেনের কামরায় একটি উদ্বিগ্ন মুখ, যেন আকুল কণ্ঠে বলছে–সেই একজনের কী নির্মম চোখের দৃষ্টি।ভদ্রমহিলার মুখ-চোখ যেন সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছিলো এই কথা বলার সময়ে। যে কী অভিব্যক্তি চোখ-মুখের। লিউক মুহূর্তের জন্য দেখেছিলো, ভদ্রমহিলার সেই শান্ত মুখখানার মধ্যে নিমেষেই কী বিরাট পরিবর্তন! চোখের দৃষ্টি তার হয়ে উঠলো মরা মাছের মতো স্থির আর নিশ্চল।
কিন্তু ঠিক এই রকম একটা মুখভঙ্গী, আর সেই একই চোখের দৃষ্টি আমি দেখেছি–দুএকদিনের মধ্যেও দেখেছি–কোথায়…? কখন? আজ সকালেই কি? ঠিকই তো! মিস ওয়েনফ্লিট! উনি যখন নিজের বাড়ির বসবার ঘরে ব্রিজেটের দিকে তাকিয়ে ছিলেন সেই সময়ে!
ল্যাভিনিয়া পিঙ্কারটনও বিশেষ কোনো লোকের–না, না, কোনো ব্যক্তি বিশেষের চোখের দৃষ্টির কথা বলেছিলেন। হয়তো ওঁর ক্ষেত্রেও একই জিনিষ ঘটেছিলো; উনি যেমনটা দেখেছিলেন, তেমনটা নিজের অভিব্যক্তির মধ্যেও ফুটে উঠেছিলো।
লিউক হাঁটা ধরলো মিস ওয়েনফ্লিটের বাড়ির দিকে। লিউকের মন বলতে লাগলো–মিস পিঙ্কারটন কক্ষনো কোনো পুরুষমানুষের কথা বলেননি–তুমি নিজেই ধরে নিয়েছিল লিউক, সে পুরুষ–কিন্তু উনি তা বলেননি–হ্যায় ভগবান, আমি কি পাগল হয়ে গেলাম? আমি যা ভাবছি তা কখনোই হতে পারে না…এ কিছুতেই সম্ভব নয়। আমার ভাবনার মধ্যে কোনো মাথামুণ্ডুই নেই কিন্তু সে যাই হোক, আমাকে এক্ষুনি ব্রিজেটের কাছে যেতে হবে, নিজের চোখে দেখতে হবে ও নিরাপদে আছে কিনা। সেই দুটো হালকা বাদামী রঙের চোখ আর চোখের সেই বিচিত্র ভয়াল দৃষ্টি! নাঃ, আমি সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছি। আসলে হুইটফিল্ড অপরাধীও ছাড়া আর কেউ নয়। ও নিজেও একরকম স্বীকারই করেছিলো।
কিন্তু তা সত্ত্বেও লিউক মিস ওয়েনফ্লিটের বাড়ির দিকেই চললো।
ছোটোখাটো সেই ঝি-মেয়েটি লিউককে হতচকিত হয়ে দরজা খুলে দিয়ে ভয়ে ভয়ে বললো–মিস ওয়েনফ্লিট আমাকে বলতে বলেছেন যে, উনি বাইরে চলে গেছেন। আমি এক্ষুনি দেখে আসছি উনি সত্যি সত্যি চলে গেছেন কিনা।
মেয়েটিকে ঠেলে দিয়ে লিউক প্রায় ছুটে হুড়মুড় করে বসবার ঘরে গিয়ে ঢুকলো আর এমিলি দৌড়ে ওপরের তলায় গিয়েই একছুটে নেমে এসে প্রায় দম-ফুরোনো গলায় বললো–সেই নতুন মেম সাহেবও বেরিয়ে গেছেন।
মেয়েটির কাঁধ দুটো ধরে ঝাঁকিয়ে লিউক বললো–কোনো দিকে গেছে? কোথায় গেছে?
ঢোক গিলে মেয়েটি বললো–আমি তো সব সময়ে রান্নাঘরে ছিলাম; সামনের দরজা দিয়ে গেলে আমি নিশ্চয়ই দেখতে পেতাম। ওঁরা পেছনের দরজা দিয়েই গেছেন।
প্রায় ছুটে ছোট একটা বাগান পেরিয়ে লিউক রাস্তায় এসে পড়লো। ওর সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটিও সদর দরজা পর্যন্ত ছুটে আসে। একজন লোক কিছুটা দূরে বড় একটা কাঁচি দিয়ে গাছের মাথা হেঁটে দিচ্ছিলো; লিউক এগিয়ে গিয়ে লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো যে, সে দুজন মহিলাকে যেতে দেখেছে কিনা।
লোকটি বললো–দুজন মহিলা? হ্যাঁ, বেশ কিছুক্ষণ আগেই গেছে, আমি তখন ওই বেড়ার নিচে বসে খাচ্ছিলাম–তবে, ওঁরা আমায় দেখেছেন বলে মনে হয় না।
কোনো দিকে গেছেন?
লোকটা লিউকের দিকে তাকিয়ে বললো–ওই মাঠের ভেতর দিয়ে ওঁদের যেতে দেখেছি; তার পরে ওঁরা কোথায় গেছেন লক্ষ্য করিনি।
লোকটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবার ও রীতিমতো ছুটতে আরম্ভ করে।বড্ড দেরি হয়ে গেছে, বড্ড দেরি হয়ে গেছে, যেভাবেই হোক ওদের ধরতে হবে।-ও কি পাগল হয়ে গেল কি?
ও পর পর দুটো মাঠ এভাবে পেরিয়ে গেল। সামনে একটা ছোটো পাড়গেয়ে মেঠো পথ। কোনো দিকে এবারে যাবে বুঝতে না পেরে ও একটু দাঁড়ায়, আর তখনই শুনতে পায়, সেই আকুল আর্তনাদ–লিউক, লিউক…বাঁ-চা-ও!
লিউক দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যেদিক থেকে আওয়াজ আসছিলো, সেদিকে ছুটতে আরম্ভ করলো। আরও কিছুটা এগোতেই একটা হুটোপাটি আর তার সঙ্গে একটা গোঙানীর আওয়াজ শুনতে পেলো।
বনবাদাড় পেরিয়ে প্রচণ্ড বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও এক উন্মত্ত মহিলার শক্ত বেড়ির মত বসা হাত দুখানা টেনে ধরতেই তার সে কী ভীষণ চীৎকার। মহিলার সমস্ত শরীর তখন থর থক্ করে কাঁপছে, মুখ দিয়ে সাবানের ফেনার মতো গাঁজলা বেরোচ্ছে। সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁকুনি দেওয়াতে মহিলা শেষ পর্যন্ত লিউকের হাতের মধ্যেই এলিয়ে পড়লেন।
***
নতুন দিগন্ত
কী যে হচ্ছে, আমি তার কিছুই বুঝতে পারছি না।-গাম্ভীর্য বজায় রাখার চেষ্টা সত্ত্বেও লর্ড হুইটফিল্ড ভেতরে অস্থির, হতাশ ভাবটা গোপন রাখতে পারলেন না। হুইটফিল্ড ঘটনারাশির আকস্মিকতায় একেবারে হতচকিত এবং হতভম্ব।
ব্যাটল অবস্থাটা আন্দাজ করতে পেরে শান্ত স্বরে বললেন-আমরা সমস্ত ব্যাপারটা অনুসন্ধান করে দেখেছি তাতে দেখা যাচ্ছে যে, ওয়েনফ্লিট পরিবারের প্রায় সকলের মধ্যেই একটা মানসিক বৈকল্যের লক্ষ্মণ প্রথম থেকেই ছিলো; তার ওপর এই মহিলার ছিলো গগনচুম্বি উচ্চাকাঙ্ক্ষা। প্রথমতঃ কোনো দিকেই সে উচ্চাশা ফলপ্রদ হয়নি, তার ওপর ভালোবাসার ক্ষেত্রেও পেলো এক প্রচণ্ড আঘাতআবার বললেন–শুনলাম, আপনিই ওকে সেই আঘাত দিয়েছিলেন।
এই আঘাত কথাটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না।–আরো গম্ভীর হবার চেষ্টা করে। লর্ড হুইটফিল্ড বললেন।
তৎক্ষণাৎ কথাটা সংশোধন করে সুপারিনটেন্টে ব্যাট বললেন–অর্থাৎ, আপনিই বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছিলেন?
তা–তা দিয়েছিলাম।
ব্রিজেট বললা–কেন দিয়েছিলে আমাদের বলো গর্ডন।
লর্ড হুইটফিল্ড বললেন–ঠিক আছে, যদি একান্তই শুনতে চাও বলছি। হনরিয়ার একটা ক্যানারী পাখি ছিলো–ও খুব ভালোবাসতো পাখিটাকে। পাখিটার একটা অভ্যাস ছিলো হনরিয়ার ঠোঁট থেকে চিনির টুকরো টুকরে তুলে নেওয়া। একদিন ঐভাবে নিতে গিয়ে পাখিটা হনরিয়ার ঠোঁট কামড়ে দেয় আর তাতে রেগে গিয়ে ও পাখিটার ঘাড় মটকে ওটাকে মেরে ফেললো। সেই দৃশ্য দেখার পর ওর ওপর আমার ধারণা গেল পান্টে। কিছুতেই আর আগে মন নিয়ে ওকে দেখতে পারলাম না এবং ওকেও সেই কথাই বললাম যে, আমরা বোধহয় পরস্পর এতদিন ভুল করেছি।
ব্যাটল বললেন–সেই থেকে আরম্ভ। ও নিজেই মিস কনওয়েকে বলেছে যে, সেই থেকে ওর লক্ষ্য ছিলো প্রতিশোধ নেওয়া–ওর বুদ্ধিবৃত্তি সবই এই দিকেই নিয়োগ করেছিলো।
একটা খুনী হিসেবে আমাকে ধরিয়ে দেবার জন্য? এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না।
কিন্তু গর্ডন, এ কথা সত্যি। তুমি নিজেই তো আশ্চর্য হয়েছিলে দেখে, যে-লোক তোমার বিরুদ্ধাচরণ করতো, অচিরেই সে মারা যেতো।–ব্রিজেট বললো।
তার একটা অন্য গূঢ় কারণ। তুমি একথাটা বোঝবার চেষ্টা করো গর্ডন, টমি পিয়ার্সকে জানলা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া বা অন্যান্য যারা একের পর এক খুন হয়েছে, তার পেছনে নিয়তির কোনো হাত নেই–সবই হনরিয়া ওয়েনফ্লিটের কাণ্ডকারখানা।
লর্ড হুইটফিল্ড অস্বীকার করে বলেন–আমার কাছে সবই কেমন একটা ধাঁধার মতো লাগছে।
আপনিই তো বললেন যে আজই কে একজন আপনাকে ফোন করেছিলো?–প্রশ্ন করেন ব্যাট।
হ্যাঁ, বারোটা নাগাদ। বললো। আমি যেন তক্ষুণি শর জঙ্গলে যাই। ব্রিজেট তুমি না-কি খুব জরুরী বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলে?
ব্যাটল বলেন–তাহলেই দেখুন, ওখানে একবার গেলে আর দেখতে হতো না; যাকে বলে, একেবারে স-প্রমাণ ধরা পড়ে যেতেন। ভেবে দেখুন, মিস কনওয়ের ঘাড় থেকে মাথা কাটা, পাশেই পড়ে আছে আপনার ছুরি; ছুরির হাতলে আপনার আঙুলের পরিষ্কার ছাপ–সর্বোপরি যে সময়ে খুনটা হয়েছে সেই সময়েই আপনাকে ওই অঞ্চলে দেখা গেছে। দাঁড়াবার মতো একটুকরো মাটিও থাকতো না আপনার পায়ের নিচে-যে কোনো জুরি আপনাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতো।
আমাকে? এমন কেউ আছে যে আমার সম্পর্কে, এসব উদ্ভট কথা বিশ্বাস করতো?–লর্ড হুইটফিল্ডের কণ্ঠস্বরে বিস্ময়, ব্যথা-একীভূত।
ব্রিজেট বললো–অন্ততঃ আমি করতাম না গর্ডন, কখনো আমি তোমার সম্পর্কে একথা মেনে নিতে পারতাম না।
কথা শেষ করেই লর্ড হুইটফিল্ড বাইরে বেরিয়ে গেলো।
লিউক বললো–ব্রিজেট, এবার তুমি বলো, ওয়েনফ্লিটকে তুমি কেন সন্দেহ করলে?
ব্রিজেট ব্যাখ্যা করে–আমি প্রথমে সন্দেহ করলাম, যখন তুমি বললে যে, গর্ডন খুনী। কথাটা আমি বিশ্বাস করিনি কারণ ওর বাইরেটা আর ভেতরটা–দুটোই আমার জানা। এটা স্বীকার করি যে, ও আড়ম্বরশালী, মোটাবুদ্ধি সম্পন্ন ও আত্মকেন্দ্রিক লোক; কিন্তু ওর মন ফুলের মতো নরম আর ও অস্বাভাবিক রকম দয়ালু। একটা শুয়োপোকা মারতে পর্যন্ত ওর হাত ওঠে না। শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম যে ওর পক্ষে ক্যানারী পাখির ঘাড় মটকে মেরে ফেলার কথা সবটাই মিথ্যে-ভুল। দ্বিতীয়তঃ গর্ডন একদিন গল্পচ্ছলে আমাকে বলেছিলো যে, ও-ই ওয়েনফ্লিটকে বিদায় করেছিলো। অথচ তোমার কাছে শুনলাম ঠিক তার উল্টোটা। কিন্তু ক্যানারীর গল্প কিছুতেই সত্যি হতে পারে না, অমন একটা কাজ গর্ডনের পক্ষে একেবারে অসম্ভব। জানো? ও শিকারে পর্যন্ত যায় না, কারণ রক্ত দেখলেই ওর শরীর গুলিয়ে ওঠে।
সুতরাং একথা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম যে, গল্পের ওই অংশটুকু পুরোপুরি মিথ্যে।
এরপর মনে প্রশ্ন জাগলো, আর কী কী ও বলে থাকতে পারে? একটা ব্যাপার সহজেই বোঝা যায় যে মহিলা অত্যন্ত অহঙ্কারী; কেউ ওকে প্রত্যাখ্যান করেছে–এ চিন্তা ওর গর্ববোধকে প্রচণ্ড আঘাত করবেই; এবং তার ফলে রেগে গিয়ে প্রতিহিংসা নেবার চেষ্টা করাটা বিচিত্র নয়–বিশেষ করে লর্ড হুইটফিল্ড আবার যখন সামাজিক ও আর্থিক ক্ষেত্রেই উত্তর জীবনে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করলো। তাই গর্ডনের মতো একজন মোটাবুদ্ধির মানুষের কাঁধে এক মিথ্যে বোঝা চাপিয়ে দেওয়া বা মিথ্যে জাল জড়িয়ে ফেলা ওয়েনফ্লিটের মতো মেয়েমানুষের পক্ষে অতি সহজ। আমার মন বললো–আপাতঃ দৃষ্টিতে যতই কঠিন হোক, এমন যদি হয়ে থাকে যে, এই মহিলাই সবগুলো খুন এমন ফন্দি করে করেছে, যাতে করে গর্ডনকে দিয়ে সহজেই বিশ্বাস করানো যায় যে, পর-পর সবকটা মৃত্যুই এক ঐশ্বরিক অমোঘ বিধান?–ওর পক্ষে গর্ডনকে একথা বিশ্বাস করানো মোটেই দুঃসাধ্য নয়। তোমাকে আমি এর আগেই বলেছি যে, গর্ডন সব কিছুই বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করে। তারপরে ভাবলাম–ওর পক্ষে কি এতগুলো খুন করার সুযোগ ছিলো?–অনুধাবন করে দেখলাম–হ্যাঁ ছিলো। একজন মাতালকে একটা ছোট্ট ধাক্কা দেওয়া, একটা বাচ্চা ছেলেকে জানলা থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া
ওর পক্ষে কঠিন কিছু নয়। আমি গিবস্ তো ওর বাড়িতেই ছিলো। মিসেস হর্টনের অসুস্থতার সময়ে ও প্রতিদিন ওখানে যাতায়াত করতো। ডাঃ আম্বলবির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিছু কঠিন ছিলো। এটা চিন্তা করে বের করতে পারিনি যে, ও ওয়াঙ্কিপু-র কানের ঘা থেকে ব্যাণ্ডেজ বাঁধবার কাপড় দূষিত-করে ডাঃ আম্বলবির হাতে বেঁধে দিয়েছিলো। মিস পিঙ্কারটনের মৃত্যুটা আরো রহস্যময় মনে হয়েছিলো। কারণ ওর মতো একজন মহিলা ড্রাইভারের পোশাক পরে একটা রোলস্ চালাবে–একথা স্বপ্নেরও অগোচর। কিন্তু পর মুহূর্তে মনে হলো–নাঃ তার তো দরকার নেই। ওর পুরানো পদ্ধতি অবলম্বন করে অতি সহজেই ভীড়ের মধ্যে আত্মগোপন করে একটা ছোট্ট ধাক্কা দিয়েই তো কাজ হাসিল করা যায়–এবং হয়েছিলোও তাই। গাড়িটা পালিয়ে যাওয়ার আরো একটা সুযোগের পেয়ে গেল; পাশের এক মহিলাকে ও একটা নম্বর বললো এবং সেই নম্বর লর্ড হুইটফিল্ডের রোলসের নম্বর।
যদিও একথা সত্যি, যে ব্যাখ্যা তোমাদের দিলাম, তার এতটা নিখুঁত রূপরেখা সেই সময়ে আমরা মাথায় ছিলো না। তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, গর্ডন খুনী নয়। তাই যদি হয়, তাহলে এতগুলো খুন কে করলো? উত্তরটাও সহজেই মাথায় এলো। এমন একটা কেউ, যে গর্ডনকে ঘৃণা করে। কে গর্ডনকে ঘৃণা করতে পারে? হনরিয়া ওয়েনফ্লিট ছাড়া আর কে-ই বা হতে পারে?
একটা ব্যাপার জানতাম যে মিস পিঙ্কারটনের সন্দেহ অমূলক নয়–নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে সেকথা মহিলা প্রমাণ করেছিলেন। এই জন্যই তোমাকে বলতে বলেছিলাম যে, মিস পিঙ্কারটন ঠিক কী কী বলেছিলেন। তোমার কাছ থেকে শুনে যখন আবিষ্কার করলাম যে মিস পিঙ্কারটন একবারও কোনো পুরুষমানুষের কথা বলেননি, তখনই বুঝে গেলাম যে, আমার চিন্তাধারার মধ্যে কোনো অসঙ্গতি নেই এবং সে কারণেই সাগ্রহে মিস ওয়েনফ্লিটের নিমন্ত্রণে আমি রাজী হয়ে গেলাম।
লিউক বেশ রাগতস্বরে বললো–আমাকে এর বিন্দুবিসর্গ না বলে?
কী করে তোমায় বলি বলো? তুমি যে একেবারে ধরে বসেছিলে যে গর্ডনই হত্যাকারী; আর সে জায়গায় আমি তো তখনো অনুমানের সাগরে সাঁতার কাটছি! ভাবতেও পারিনি যে আমার কোনো বিপদ আসতে পারে-বরঞ্চ ভেবেছিলাম যে, হাতে আমার প্রচুর সময়…,–বলতে বলতে ব্রিজেট শিউরে ওঠে–উঃ, লিউক! সে কী জান্তব দৃশ্য!…ওর সেই অস্বাভাবিক চোখ আর খুক খুক করে অমানুষিক হাসি।
লিউকও একটু কেঁপে ওঠে সেই দৃশ্যের বীভৎসতায়।
আমিও কোনোদিন ভুলতে পারবো না যে, কী দারুণ এক মুহূর্তে আমি ওখানে গিয়ে পড়েছিলাম।
লিউক ব্যাটলকে জিজ্ঞেস করলো–এখন মহিলার অবস্থা কী?
একেবারে ভেঙ্গে খান্ খান্ হয়ে গেছে। এদের ক্ষেত্রে এমনটাই হয়। নিজেদের যারা খুব চালাক মনে করে, তারা যে মুহূর্তে বুঝতে পারে যে ওদের চালাকি ধরা পড়ে গেছে, তখন আর দেখতে হয় না-একবারে ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।
লিউক বলে–পুলিশ হিসেবে আমি ব্যর্থ। হরিয়া ওয়েনফ্লিটকে আমি ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করিনি। আমার জায়গায় আপনি হলে এমনটা ঘটতো না।
ব্যাটল বলেন–সে কথা বলা যায় না; হতেও পারে আবার না-ও হতে পারে; তবে আপনার বোধ হয় মনে আছে আমি বলেছিলাম যে, অপরাধ-বিজ্ঞানে অসম্ভব বলে কোনো শব্দের স্থান নেই। মনে পড়ে, আমি তখন অবিবাহিত মহিলার কথাও উল্লেখ করেছিলাম?
হ্যাঁ, মনে আছে। তাছাড়াও আপনি চার্চের পাদ্রী, স্কুলের ছোট্ট মেয়েদের কথাও বলেছিলেন।
হেসে ব্যাটল বলেন–ও কথা বলে আপনাকে একথাই বোঝাতে চেয়েছিলাম যে, যে-কোনো শ্রেণীর লোকই অপরাধী হতে পারে।
একমাত্র গর্ডন ছাড়া। চলো লিউক, দেখি গর্ডন কোথায়।–ব্রিজেট বললো।
ওরা গিয়ে দেখে পড়বার ঘরে বসে লর্ড হুইটফিল্ড কতকগুলো নোট মেলাচ্ছেন।
ব্রিজেট আনত-স্বরে বলে–এখন তুমি তো সবই জেনে গেছে। এবার কি আমাদের ক্ষমা করতে পারবে?
ব্রিজেটের দিকে লর্ড হুইটফিল্ড তাকান–চোখের দৃষ্টিতে মমতা মাখানো।
সে কি কথা ব্রিজেট! নিশ্চয়ই পারবো। সত্যকে স্বীকার করার মতো সৎ সাহস আমার আছে। কাজের মধ্যে ডুবে থেকে আমি তোমাকে অবহেলা করেছি। আমার অবস্থা কিপলিং-এর সেই বিখ্যাত উক্তির সঙ্গে মিলে যায়। সেই লোকই দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে, যে একা পথ চলার সাহস রাখে।–আমার জীবনের পথও একলা চলো রের পথ। তারপর বললেন-আমার ওপর যে গুরুদায়িত্ব, তা আমাকে একাই বহন করতে হবে। আমার চলার পথে থাকবে না কোনো মধুভাষিণী সঙ্গী, আমার গুরুভার লাঘব করতে আসবে না কোনো প্রসারিত হাত। আমি নিরবিচ্ছিন্নভাবে শুধু চলবো, কেবল চলবো–একা, সঙ্গিবিহীন। এই অবিরত চলা শেষ হবে সেদিন–যেদিন চলতে চলতে পথভ্রান্তে পড়বো মুখ থুবড়ে।
গর্ডন! তোমার স্বভাবের কোনো তুলনা নেই–সত্যিকারের মাধুর্যমণ্ডিত তোমার স্বভাব।-বলে ব্রিজেট।
এটা মধুর-স্বভাবের প্রশ্ন নয়। এসব বাজে কথা বলে সময় নষ্ট কোরো না–আমি অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ।
আমি জানি তুমি খুবই ব্যস্ত।
আমার কাগজের এই সংখ্যায় একটা প্রামাণ্য প্রবন্ধ ছাপতে দিচ্ছি–বিষয়বস্তু হলো– মহিলাদের অপরাধবৃত্তি-যুগে যুগে।
সপ্রশংস চোখে ব্রিজেট লর্ড হুইটফিল্ডের দিকে তাকিয়ে বলে–অপূর্ব! এর চেয়ে ভালো আর কোনো বিষয় হতে পারে না।
বুকটা টান করে লর্ড হুইটফিল্ড বলেন–ঠিক আছে, এবার তোমরা অনুগ্রহ করে নিজের কাজে যাও, আমার সময় নষ্ট কোরো না–আমার কাঁধে কাজের বোঝা।
নিঃশব্দে লিউক আর ব্রিজেট বেরিয়ে যায়।
ব্রিজেট বলে–ওর স্বভাবটা সত্যিই মিষ্টি।
ব্রিজেট, আমার ধারণা, তুমি ওই লোকটিকে সত্যিই ভালোবাসতে।
জানো লিউক, সত্যিই ওকে ভালোবাসি।
লিউকের দৃষ্টি জানলা পেরিয়ে বাইরে চলে যায়। ও বলে–আর উইচউডে যেতে ভালো লাগছে না। মিসেস আম্বলবির ভাষায় এ জায়গাটা শয়তানের আড়ৎ। সমস্ত গ্রামটাকে অ্যাশরিজ যেন একেবারে গিলে খাচ্ছে।
অশরিজের কথায় মনে হলো–তোমার সেই এলসওয়ার্দির কী হলো?
লজ্জা পেয়ে লিউক হেসে ওঠে–ওর হাতের সেই রক্তের কথা বলছো?
হা।
শুনলাম ওরা নাকি একটা সাদামুর্গী বলি দিয়েছিলো।
কী প্রচণ্ড বিরক্তিকর!
তবে কদিনের মধ্যেই ও একটা ঝামেলায় পড়বে–ব্যাটল ওর পেছনে লেগেছে।
বেচারা মেজর হর্টন! স্ত্রীকে মারবার কোনো পরিকল্পনাই ওঁর ছিলো না। একই কথা মিঃ অ্যাবটের ক্ষেত্রেও। সেই চিঠিটি হয়তো এক মহিলা কোনো মামলার নিষ্পত্তির জন্য লিখেছিলো; আর ডাঃ টমাস একেবারেই একজন সাদাসিধে মামুলি ডাক্তার।
ও একটা প্রথম শ্রেণীর গর্দভ।
রোজ আম্বলবিকে বিয়ে করবে বলে তুমি নেহাৎ গায়ের জ্বালায় ওকে গালাগাল দিচ্ছো!
রোজ একবার ওর পক্ষে বাঁদরের গলায় মুক্তোর হার।
হাত হতোস্মি! তুমি কি পাগল হলে?
মোটেই না।
ব্রিজেট কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেজিজ্ঞেস করে–আচ্ছা লিউক, তুমি কি এখন আমাকে পছন্দ করো?
ওর দিকে লিউক এগোবার চেষ্টা করতেই ব্রিজেট ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে-না লিউক, আমাকে ভালোবাসো কিনা জিজ্ঞেস করিনি–পছন্দ করো কিনা তা-ই–জানতে চেয়েছি,
পছন্দ? এখন তোমায় বেশ পছন্দ করি; আর ভালোও বাসি।
আমিও তোমাকে পছন্দ করি লিউক…
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ওরা দুজনেই হেসে ওঠে। এই হাসি সব পাওয়ার হাসি।যেমন শিশুরা সদ্য-পাতানো বন্ধুত্বের আনন্দে পরস্পরের গলা জড়িয়ে হেসে ওঠে।
ব্রিজেট বলে-ভালোবাসার থেকেও বড় জিনিষ হলো পছন্দ-এ স্থায়ী। আমাদের দুজনের এই সম্পর্ক যেন স্থায়ী হয় লিউক। তা না হলে আমরা যদি দুজনেই দুজনকে কেবলমাত্র ভালোবাসি, আর সেই ভালোবাসার তাগিদে বিয়ে করি এবং কিছুদিন বাদেই ছাড়াছাড়ি করে আবার আর একজনকে বিয়ে করি–এমনটা আমি চাই না লিউক।
ও ব্রিজেট! আমি জানি তুমি কী চাও। কঠিন বাস্তবতা। আমিও তাই চাই ব্রিজেট। আমাদের এই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে কঠোর বাস্তবের ওপর ভিত্তি করে–এ সম্বন্ধ অটুট, কখনোই ভাঙ্গবার নয়।
সত্যি বলছ লিউক?
হা গো হা! এবং এই বাস্তব চেতনা এত প্রকট ছিলো বলেই তোমাকে ভালোবাসতে গিয়েও প্রথমটায় অতো ভয় পেয়েছিলাম।
আমারও ভয় ছিলো লিউক।
এখনো সেই ভয় আছে?
না, এখন আর নেই।
মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আমরা দুজনে কাছাকাছি হয়েছিলাম। আমরা সেই অধ্যায় পেরিয়ে এসে এবার দুজনে জীবনের পথে পা বাড়িয়ে এগিয়ে চলবো…