কিছুটা শ্রান্তি জড়ানো থাকলেও ঘুম চোখ থেকে উধাও হয়েছিল। পরের দিন দেখলাম ব্যাপারটা ঠিক নয়। এটা খোলা দেখতে আমি ভয় পেলাম না অবাক হলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমার মাথায় ঢুকছিল না কিভাবে এটা খুলল। তাছাড়া কাঁচের মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম যে সফেদ ঢেউগুলো এমন কিছু উত্তাল নয় যে চাপে খুলে যাবে। জানালাটা খোলে কিনা দেখার জন্য চুপচাপ দাঁড়ালাম।
কিছুক্ষণ পর একটা অস্ফুট চাপা গোঙানি শুনতে পেলাম। চকিতে ঘুরে ওপারের বিছানার পর্দা সরিয়ে হাত বোলাতেই বুঝতে পারলাম কে যেন শুয়ে আছে। যেন হিমঘরের মতো হাতটা। সমুদ্র ঝঝির থেকে একটা আঁঝালো গন্ধ ভেসে এলো। মানুষের হাতের মতো জিনিষটা মসৃণ, বরফের মতো ঠান্ডা। হাতটা ধরে টানতেই পার্থিব শক্তিতে প্রচণ্ড জোরে লোকটা মেঝেতে আছড়ে ফেললো। ভয় পাবার আগে অচেনা লোকটা দরজা খুলে বিদ্যুৎবেগে ছুটতে শুরু করল, সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে আমি ওকে অনুসরণ করলাম। ঠিক আগে জাহজের পেছন দিয়ে ছায়ামূর্তি ছুটে যাচ্ছে। পরক্ষণে ছায়াটাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। শুনতে পেলাম না জলে ঝাঁপ দেওয়ার শব্দ, আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম।
কোনোরকমে কেবিনে ফিরলাম। দেশলাই হাতড়ে হাতড়ে জ্বালিয়ে দেখলাম পোর্টফোলিওটা খোলা বুকের ভেতরের আতঙ্কে শরীরে কেঁপে উঠল। যেটা আগে কখনও অনুভব করিনি। বার্থটা খুব ভালো করে পরীক্ষা করলাম। ভালো করে দেখার জন্য পর্দাটাকে টেনে সরালাম। বিছানা শুকনো হাড়ের মতো খটখটে ছিল। পোর্টফোলিওটা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগালাম এবং শক্ত ও কাঠের লাঠিটাকে পেতলের গর্তের মধ্যে গুঁজে দিলাম। সারা রাত আলো জ্বালিয়ে পাহারা দেবার ভঙ্গিতে বসে রইলাম। রাত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি।
ভোরের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পোশাক পাল্টে ডেকে চলে এলাম। সমুদ্রের উপর ঠান্ডা বাতাস বুক ভরে নিলাম।
ডাক্তার আমার মুখের অবস্থা দেখে বুঝতে পারলেন যে রাতে আমার ভালো ঘুম হয়নি। তাই তিনি আমায় ঔষধ দিতে চান। তিনি আমার কথা অবিশ্বাস করলেন না বরং আমি যে তার কথা বিশ্বাস করি এটা তিনি বললেন। তাকে আমি আমার কেবিনে থাকতে বললাম। সে বলল, ভূতের সঙ্গে লড়ার দুঃসাহস আমার নেই।
ডাক্তারবাবু বলতে চান জাহাজে এমন কেউ নেই যার সঙ্গে আমি আমার কেবিনে থাকতে পারব। আমি কিন্তু একটি রাত একা কাটাতে চাই। এরজন্য আমি ক্যাপ্টেনের শরণাপন্ন হলাম। তাকে বললাম যে যদি আলোগুলো তিনি জ্বালিয়ে রাখেন তাহলে আমি একাই চেষ্টা করব। ক্যাপ্টেন বললেন যে, তিনি সহযোগিতা করবেন। তার ধারণা কোনো বদমাইশ লোক নিচের কেবিন থেকে অদ্ভুত কাণ্ড ঘটাচ্ছে এবং যাত্রীদের মনে আতঙ্ক তৈরি করছে।
এই আন্তরিক সহযোগিতার জন্য ক্যাপ্টেনকে ধন্যবাদ জানালাম। তিনি একটা ছুতোর দিয়ে বিছানাপত্তর খুলে কাঠের স্ক্র খুলে ভালো করে পরীক্ষা করলেন। কোন জায়গায় তক্তা খুলে গেছে, তাও পোলাম না। পোর্টফোলিওর কোথাও ত্রুটি নেই।
শর্তানুযায়ী রবার্ট টাকা দিল। ছুতোরটি আমায় বলল যে, চার-চারটে তাজা প্রাণ নষ্ট হয়ে গেছে। মিছিমিছি দেরি না করে যেন আমি অন্য কেবিনে যাই। আমি গণ্ডা তিনেক ভ্রু দিয়ে দরজা সেঁটে দিচ্ছি।
আমি এটা করব একটা রাত, বললাম। রাত দশটায় ক্যাপ্টেন আমার ঘরে এলেন। তিনি সবদিক নিরীক্ষণ করলেন এবং মউজ করে চুরুট জ্বালালেও, ভেতরে অন্ধকার থাকার জন্য দেওয়ালে লণ্ঠন ঝুলিয়ে রাখলাম। এখান থেকে কোনো মানুষের ঢোকা বা বেরুনো সম্ভব নয়, যদি তা ঘটে মনে হবে তা অতিপ্রাকৃতিক কিছু।
ক্যাপ্টেন বললেন যে এই কেবিনের ওপরের বার্থে যে ভদ্রলোক ছিলেন তিনি পাগল হয়ে যান। সারাদিন তিনি চুপচাপ থাকতেন। একদিন হঠাৎ সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলেন। আমরা জাহাজ থামিয়ে নৌকা নামিয়ে তার কোনো খোঁজ পেলাম না। ভদ্রলোক পাগল ছিলেন বলে কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি। এর পর দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটল। শোনা যায় পোর্ট জোন থেকে গলগল করে জল ঢুকছে। অনেক কষ্ট করে তা যদিও বন্ধ করা গেল গন্ধটাকে তাড়ানো গেল না।
আমি বললাম সকালে গন্ধটা ছিল না কিন্তু হঠাৎ আবার পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎ লণ্ঠনটা নিভে গেল। তখন জাহাজটা দুলছে। হঠাৎ কি হলো আমরা দেখতে যাব। হঠাৎ আর্তনাদ করে পোর্টজোনের দিকে ছুটে গেলাম। ক্যাপ্টেনকে সাহায্য করার জন্য আমরা প্রাণপণ শক্তিতে পোর্টহোলকে ঠেলে রাখার চেষ্টা করলাম। প্রচণ্ড ধাক্কায় আমি কুর্সিটার উপর ছিটকে পড়ি এবং ক্যাপ্টেনকে দরজার গায়ে আছড়ে ফেলল যেন কেউ।
আমরা দেখলাম পোর্টহোলটা খোলা। উপরের বার্থে যেন কিছু দেখা যাচ্ছিল।
উপরের বার্থে দেখা গেল যেন দীর্ঘদিন জল ঢুকে থাকা ঠাণ্ডা ও মসৃণ। দুর্মর শক্তিতে পিছোল হাতটাকে আমি আঁকড়ে রাখলাম। পলকের জন্য ভয়ঙ্কর দুটো চোখ অন্ধকারে জ্বলে উঠল, অসহ্য যন্ত্রণায় আমি ঝাঁকিয়ে উঠলাম, একটা ছায়ামূর্তি দরজার দিকে গেল। ক্যাপ্টেনকে সরিয়ে দিয়ে, ক্যাপ্টেন আগে থেকে তৈরি থেকে তাকে একটা ঘুসি মারতেই তিনি শক্ত মেঝেতে পড়ে গেলেন।
আমি আঁৎকে উঠলাম, নিঃশব্দ, মনে হলো ছায়ামূর্তিটা দরজার সামনে দাঁড়ানো এবং পোর্টহোল দিয়ে বেরিয়ে গেল।
হাতটাতে যন্ত্রণা হচ্ছিল। কোনোরকমে আলো জ্বালোম। ক্যাপ্টেন আঘাতে খুব ভয় পেয়েছিলেন। তাকে জলের ঝাঁপটা দিয়ে সুস্থ করা হলো।