তার সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল। আমি যখন বললাম ১০৫ নং বার্থের ওই স্যাঁতসেতে ঘরটা আমার; তখন তিনি যেভাবে দেখলেন সেটা একটা অদ্ভুত লাগল। ডাক্তার বললেন যে, নিচের ওই কেবিনটা সম্পর্কে অনেক অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। আমি বললাম এই নিয়ে আমারও অভিযোগ কম নয়। যে এইখানে আলো বাতাস অত্যন্ত কম। অবশ্য ডাক্তার আমাকে ভয় পাওয়াতে চাইছিলেন না। স্যাঁতসেতে কুয়াশায় আমার খুব একটা অসুবিধা হবে না। ডাক্তার আমাকে সহযাত্রী সম্পর্কে প্রশ্ন করলে আমি বললাম যে, একজন ছিলেন, তবে তাকে ঠিক সুবিধার মনে হচ্ছিল না। সে মাঝ-রাত্তিরে দরজা খুলে বেরিয়ে গেছিল।
ডাক্তার বললেন যে সে কি আবার ফিরে এসেছিল। আসলে আমি দেখিনি কেননা শীতে আমি কম্বলের নিচে ছিলাম। সকালে উঠে আমি পোর্টফোলিওটা খোলা দেখি।
ডাক্তার বললেন যে, সম্প্রতি নানাকারণে জাহাজটির দুর্নাম ঘটেছে এবং তিনি আমাকে তার কেবিনে যেতে অনুরোধ করলেন।
আমি অবাক হলাম জাহাজ সম্পর্কে ওভাবে বলাতে। আমি ডাক্তারবাবুকে ধন্যবাদ জানালাম। আমার জানতে ইচ্ছে করছিল তিনি কেন জাহাজ সম্পর্কে এটা বললেন। তবে ঘর ঝাড়পোছ করে বাস করতে আমি আগ্রহী ছিলাম। আমি জিজ্ঞাসা করছিলাম যে, কেন তিনি একথা বললেন?
তিনি বললেন যে, সমুদ্র মানুষকে সংস্কারবাদী হতে সাহায্য করে। এর আগে তিনজন যাত্রী তিনবার ১০৫ ঘরে ঘুরিয়ে থাকার পর আত্মহত্যা করেছে।
মনে মনে আমি একটু অবাক হলাম। কিন্তু তিনি ঠাট্টা করছিলেন না, বরং গভীর চিন্তায় ভরা মুখটা কাঁপছিল। আমি তার প্রস্তাবে আগ্রহী হলাম না। কেবিনে থেকে যারা আত্মহত্যা করেছেন তাদের থেকে যে আমি আলাদা এটা প্রমাণ করতে চাইছিলাম। ডাক্তার প্রতিবাদ না– করে প্রস্তাবটা একবার বিবেচনা করতে চাইলেন।
প্রাতঃরাশের সময় একটা বই নিয়ে আমার জন্য তিনি নিচের কেবিনে গেলেন। দেখলাম উপরে বার্থের পর্দাটা আগের মতো টাঙানো রয়েছে। কোনো শব্দ পাচ্ছিলাম না। আমি বইটা নিয়ে আসছিলাম, ভদ্রলোক ঘুমোচ্ছেন ভেবে! জাহাজের ক্যাপ্টেনে আমায় ডেকে বললেন যে আমার সহযাত্রীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার মনে হলো ভদ্রলোক সমুদ্রে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। এটা ক্যাপ্টেনকে বলতে তিনিও সহমত হলেন। কারণ এটা নিয়ে চারজন হলো। আমি আগের দিন রাত্রির ঘটনাটা তাকে বললাম। ক্যাপ্টেন বললে যে, তিনজনের মধ্যে যে দুজন যাত্রী আছে তাদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হলেন। ওরা মাঝ-রাত্তিরে দরজার ছিটকিনি খুলে প্যাসেজ দিয়ে ছুটতে শুরু করেন। জাহাজ থামিয়ে নৌকা থামিয়ে হদিশ পাওয়া যায়নি। গত রাত্তিরের ভদ্রলোক সম্পর্কে কেউ কিছু দেখতে বা শুনতে পায়নি। রবার্ট বা একটু আগে যে স্টুয়ার্টটি আমায় ডেকে আনল সে অত্যন্ত কুসংস্কারবাদী। তার ধারণা জাহাজে অদ্ভুত কিছু ঘটেছে। সকালে নিচের কেবিনে পরিষ্কার করতে গিয়ে সে সেটা ফাঁকা দেখে। কিন্তু ওর ধারণা জাহাজে অদ্ভুত কিছু ঘটেছে যার জন্য লোকটি নেই।
ক্যাপ্টেন আমাকে বললেন যে, জাহাজ সম্পর্কে একটা গুজব রটেছে যে এই জাহাজে যাত্রীরা আত্মহত্যা করছে। কিন্তু আপনি এ ব্যপারটা কারোকে জানাবেন না। এই খবর শুনলে যাত্রীরা চঞ্চল হয়ে উঠবে। তাই আপনি জাহাজের কর্মচারী কেবিনে থাকতে পারেন, এরজন্য আপনাকে একটুও কুণ্ঠিত হতে হবে না।
ক্যাপ্টেনকে জানালাম, আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমি বললাম যে, সহযাত্রীর জিনিষগুলো সরিয়ে যদি ঘরটা পরিষ্কার করা হয় তাহলে আমি স্বচ্ছন্দে এখানে থাকতে পারব। সহযাত্রীর কথা কারোকে বলব না।
অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও আমি ক্যাপ্টেনের সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম না।
সন্ধেবেলায় ডাক্তার আমার মত না পাল্টানোর কথা শুনে খুশী হলেন না। আমি কেবিনে ঢুকে একটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। আমার সহযাত্রীর মুখটা যেন বারবার মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল খুঁজলে তাকে জাহাজের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে। আমি পোশাক পাল্টানোর সময় হঠাৎ পোর্টফোলিওটা খোলা দেখলাম। দেখে মেজাজ যেন সপ্তমে চড়ে গেল। তখন আমি স্টুয়ার্ট রবার্টের খোঁজে নিচে নামলাম। আমি তাকে ধিক্কার জানিয়ে বললাম যে, জাহাজ যদি রাত্রিতে একপাশে কাত হয়ে থাকে এবং প্রচণ্ড ঢেউয়ে যদি জল ঢুকতে থাকে তখন ১০টা লোক আপ্রাণ চেষ্টা করে এটা বন্ধ করতে পারবে না। আমি তোমার নামে ক্যাপ্টেনের কাছে নালিশ করব।
রবার্ট বলল যে এ জাহাজে কেউ এ পোর্টফোলিওটা রাত্তিরে বন্ধ করে রাখতে পারে না। পেতলের ভারি ছিটকিনি দিয়ে আটকালে?
রবার্ট বলল, আপনি নিজে দেখুন ঠিক আছে কিনা। রর্বাট বলল যে, রাত্রিতে এটা আপনা থেকে খুলে যায়।
আমি বললাম, তাই যদি হয় তাহলে আমি তাকে এক পাউণ্ড বকশিস দেব। আমি রবার্টের কথা বিশ্বাস করলাম না। ব্যাপারটা আমি ওর চালাকি বুঝলাম। মিনিটের মধ্যে পোশাক পাল্টে আমি শুয়ে পড়লাম। নানারকম চিন্তা আসছিল মাথায়–এফোড় ওফোঁড় হয়ে ভাবছি এবং প্রায়ই আমার চোখ পোর্টফোলিওর দিকে পড়ছে।
ঘন্টা-দেড় ঘন্টা নাগাদ একটা ঝিমুনির মতো এলো এবং একটা ঠান্ডা বাতাসে যেন উড়িয়ে দিল। আমার গায়ে সমুদ্রের জলের ছাট লাগল। চমকে উঠে বসতে গিয়ে লাফিয়ে নামতে যাব, হঠাৎ জোর আছাড় খেয়ে গদিমোড়া কুসিটায় পড়লাম, ওটা পোর্টফোলিওর নিচে ছিল। আমি দেখলাম পোর্টফোলিওটা খোলা।