সে বলছিল যে, সে সমুদ্র ভীষণ ভালোবাসে। সে একজন ভদ্রলোককে জানত যে বিশেষ একটা বাস ধরার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা ব্রডওয়েতে অপেক্ষা করতো। সেও তার মতো আটলান্টিক পাড়ি দেবার জন্য একটা বিশেষ জাহাজের জন্য অপেক্ষা করতো। সেটার নাম ছিল কামশ্চাকা। সেটা তেমনি বড় এক সুন্দর। নানা ধরনের সুযোগসুবিধা ও অসম্ভব দ্রুতগতির জন্য সেটা তার প্রিয় ছিল। জীবনে একবারই তার সঙ্গে কামশ্চাকা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। তারপর থেকে আর তার ছায়া মাড়ায়নি।
গ্রীষ্মের এক উষ্ণ সকালে যে কোন কারণে দেরী করে ফেলে। তখন জাহাজ ছাড়তে মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। আসন না থাকলেও পূর্ব পরিচয়ে সে একটা টিকিট জোগাড় করে। একজন পরিচিত স্টুয়ার্ট দেখে মাঝপথে ধরতে সে বলল, ১৩৫ নং বার্থ।
বিস্ময়ে একেবারে স্তব্ধ হয়ে স্টুয়ার্ট মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আমার পোর্টমানটা ও লম্বা কালো ওভারকোট আর কম্বলটা তুলে নিলো। তার মুখের অভিব্যক্তি সে কোনোদিন ভুলবে না। তাকে দেখে তার মনে হলো যে সে হয়তো কেঁদে ফেলবে নয়তো আমার হাত থেকে পোর্টমানটা ফেলে দেবে। কেঁদে ফেললে কিছু হবে না কিন্তু পোর্টমাল্টা ফেলে দিলে খুবই ক্ষতি হবে। কেননা ওর মধ্যে তার বন্ধু বান পিকিনসের দেওয়া দুবোতল শেরী আছে।
এগিয়ে ও নিচু গলায় বলল যে, আসুন আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। হারমিস যেন একটা নেশার ঝোঁকে রয়েছে। আমি নিঃশব্দে ওকে অনুসরণ করলাম, ১৩৫ নং বার্থটা জাহাজের পেছনে বাঁ-পাশে, অন্যান্য জাহাজের নিজস্ব বা নিভৃত কেবিনগুলো যেমন হয় এটা ঠিক সেই রকম। এতে উল্লেখযোগ্য কোনো বৈশিষ্ট্য নেই।
এটা নিচের বার্থ তাই চওড়া বেশি ওপরের বার্থের থেকে। এখানে বহুবার যাতায়াত করেছি, কখনও নিচের কেবিনে থাকতে হয়নি। আমার মনটা প্রথম থেকেই খিঁচড়ে ছিল, সমুদ্র ঝঝির সোঁদা গন্ধে আমার দম বন্ধ হচ্ছিল।
লটবহর নামিয়ে হারমিস এমন মুখ করে তাকিয়ে ছিল যেন তার খুব দরকারী কাজ আছে। আমি তাকে ভালো বকশিস দিতে সে বলল যে, সে ভালো বার্থের জন্য চেষ্টা করবে। মুদ্রাটা পকেটে পুরতে তার মুখটা এমন হলো যাতে আমি অবাক হলাম। মনে মনে ভাবলাম যে হয়তো ওদের বকশিসের হার বেড়ে গেছে তাই ও সামান্য কটা টাকায় খুশী হয়নি। আমার মনে হলো মাল পেটে পড়লে ওর মেজাজটা ঠিক হবে। কিন্তু আমার অনুমান যে কত ভুল ওর প্রতি যে অবিচার আমি করেছিলাম।
সারাদিনে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটলো না। আমরা বন্দর ছেড়ে যাত্রা শুরু করি। আবহাওয়া ভারী চমৎকার ছিল। যাত্রার প্রথম দিন সবাই সমুদ্রকে ভালোবাসে এবং হালকা পায়ে ঘুরে বেড়ায়। টেবিলে আড্ডা বসেছিল আবার ফাঁকাও হলো। ফায়ার আইল্যাণ্ড পেরোবার পর ভারী চমৎকার একটা ঝিরঝিরে হাওয়া বইছিল। চোখে পড়ছিল তিমি ও ভাসমান তুষার শিলা। কিন্তু যারা আটলান্টিক বহুবার পার করেছেন তাদের কাছে এসব কোনো নতুন মনে হবে না। তাদের কাছে সব চাইতে আনন্দদায়ক ডেকের কুর্সিতে গা এলিয়ে ধূমপান করা।
সেদিন ভীষণ ক্লান্তি বোধ করাতে নিচের কেবিনে আসতে আমার কেবিনে আর একজন সহযাত্রীর দেখা পেলাম, যার আমার মতো একটা পোর্টমানটা রয়েছে, ওপরের বার্থে সুন্দর করে গোছানো একটা ভাঁজ করা কম্বল, ছড়ি আর ছাতা। আমার স্বাধীনভাবে যাওয়া হবে না ভেবে দুঃখ পেলাম।
আমি ডাকলাম লোকটা কখন ঢুকল, এবং ঢুকলো যখন এত তাড়াতাড়ি কি করে ঘুমিয়ে পড়লো। দেখে মনে হলো যে লোকটা বেশ লম্বা, রোগা, ফ্যাকাশে চেহারা। বালি রঙের কটা চুল, ধূসর চোখ। পুরানো ধাঁচের একটু বেশি পোশাক পরা, সব মিলিয়ে ভদ্রলোকের উপস্থিতি যেন কেমন সন্ধিগ্ধ।
এইধরনের চরিত্রের বাস ওরাল কীটে, আঙ্গলাইসে যে একের পর এক শ্যাম্পেন উড়িয়ে চলেছে। এই ধরনের চরিত্রের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হবে ঘোড়দৌড়ের মাঠে, এধরনের দুটো-একটা চরিত্রকে আমি এড়িয়ে চলাই পছন্দ করি। আমি ওর আগে শোবো, এবং ওর পরে উঠবো বা তার বিপরীত কাজ করবো। কারণ ওর সঙ্গে আলাপ করার আমার প্রবৃত্তি নেই। দূর থেকে ওর কার্যবিধির ওপর নজর রাখব। তা করতে হয়নি কারণ প্রথম রাতের পর ১০৫ নং, ওকে দেখিনি।
বেশ গাঢ় ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎ মাঝখানে এটা প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। শব্দ শুনে মনে হলো যে আমার সহযাত্রী ওপরের বার্থ থেকে মেঝেতে লাফিয়ে পড়েছে। পরক্ষণেই ছিটকিনি খোলার শব্দ শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খোলার আওয়াজ। তারপর প্যাসেজে দ্রুত ছুটে যাওয়া পায়ের শব্দ কানে এলো। কেন জানি না জাহাজটা বেশ জোরে দুলছিল এবং প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। জাহাজের ক্যাচকেচে আওয়াজ আমাদের উত্যক্ত করে তুললো। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে আমি দরজা ভেজিয়ে শুয়ে পড়লাম। অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে আমি উঠলাম। যখন উঠলাম তখন বেশ অন্ধকার।
বেশ স্যাঁতসেতে আবহাওয়া–আমার শীত করতে লাগল। আমি ভাবলাম যে কাল ক্যাপ্টেনের কাছে প্রতিবাদ জানাব যে সমুদ্র ঝঝির গন্ধের জন্য। আমি সহযাত্রীর আওয়াজ শুনতে পেলাম এবং তার জন্য আমি কিছু করলাম না কারণ আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম।
ঘুম ভাঙল পরের দিন ভোরে। জাহাজটা ভীষণ দুলছিল। বেশ ঠান্ডা লাগছিল। কিন্তু জুন মাসে কেন যে এত শীত করছিল কে জানে। কম্বলের ভেতর দিয়ে পোর্টফোলিওর দিকে তাকাতে অবাক হয়ে গেলাম। ওটা খোলা ছিল। আমি বন্ধ করে ওপর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেই ভদ্রলোক মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। আমি এই সুযোগে কেটে পড়তে চাইলাম। তাই আমি তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টে ডেকে চলে এলাম। তখন সাতটা বাজে। দেখলাম, এক ডাক্তার রেলিং-এ ভর দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছেন। যিনি জাতিতে আইরিশ। কালো চুল এবং টলটলে নীল দুটো চোখ।