আমরা তীর ধরে খানিকটা যাবার পরে ফাংগাসের আক্রমণ থেকে যে মুক্ত নই সে ভুল ভাঙে। আমরা খানিকটা যাবার পর যে ছোট জায়গাটা দেখলাম সেটা সূক্ষ্ম সাদা বালিতে ঢাকা। কিন্তু সেটা সঠিক বলি কিনা তা বোঝা যায় না। তবে এখানে ফাংগাস ছিল না। এই বালি জাতীয় জিনষটা যেদিক দিয়ে চলেছে তার দুপাশে ভয়ঙ্কর ফাংগাসের ঝাড়। ওই গোটা দ্বীপে জঘন্য বীভৎস, আগাছার জঙ্গল, রক্তবীজের রাজত্বের বুক চিরে সাদা সাদা পথ ছিল। এই জায়গাতে আমরা সব জিনিষপত্র নামালাম। তারপর কতগুলো প্রয়োজনীয় জিনিষ নিয়ে পাল খুললাম ও ছোট তাঁবু তৈরি করলাম। সেগুলোর চেহারা ভালো না হলেও উদ্দেশ্য সিদ্ধি হলো। সেখানে আমার চার সপ্তাহ নির্বিঘ্নে কাটাই।
প্রথমে আমার সঙ্গিনীর ডান হাতের মধ্যে একটা ধূসর রঙের মাংসপিণ্ড দেখা যায়। আমি আতঙ্কিত হয়ে কার্বলিক অ্যাসিড ও জল দিয়ে সেটা পরিষ্কার করলাম। সকালে হাত দেখে বেশ ভয় পেলাম কারণ আবার সেখানে আঁচিলের মতো দেখতে পেলাম। হঠাৎ গালের মাঝখানে সোনার মতো ছিল। কানের কাছে, চুলের নিচে স্পর্শ করে ওটা কি আমি অনুধাবন করলাম। আমরা দুজনে আমাদের গালের ওই ক্ষতটা যে কি বুঝতে পারছিলাম। আমরা সেখান থেকে পালাব মনে করেছিলাম। ভাবলাম জিনিষপত্র পানীয় জল নিয়ে আমরা সমুদ্রে পাড়ি দেব। কিন্তু আমরা বুঝতে পারলাম আমরা সংক্রমিত হয়ে পড়েছি। সুতরাং আমরা দ্বীপেই থাকব স্থির করলাম।
একমাস থেকে তিন মাস কেটে গেল–এই ফাংগাসের বাড়ি আমাদের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু যে নিঃসীম আতঙ্কের সঙ্গে আমাদের স্নায়ুর লড়াই চলেছে তাতে ফাংগাসের অগ্রগতিকে আর যাইহোক বীর বলে মনে হয় না।
কখন কখন প্রয়োজনীয় জিনিষের খোঁজে গেছি সেই জাহাজে। সেখানে দেখি ফাংগা একঘেয়ে ভাবে বেড়ে চলেছে। ডেকের একটা গাছ প্রায় আমাদের মাথা ছাড়িয়ে গেছে। ছেড়ে যাবার আশা আমরা ছেড়ে দিয়েছি কারণ আমরা জানি এই অসুখ নিয়ে সুস্থ সমাজে মধ্যে থাকা সম্ভব নয়।
আমরা বুঝতে পারলাম খাবারের রেশন ফুরিয়ে আসছে। তাই খাবার কম করে খরচা করতে হবে। তখন যখন আমরা খাবারের সঞ্চয় শুরু করলাম তখন দেখলাম যে যে রুটির টিনগুলো আমরা ভর্তি ভেবেছিলাম সেগুলো খালি। এছাড়া টুকিটাকি মাংসের টিন, তরিতরকারী ভরসা করার মতো নেই।
পরিস্থিতি জানার পর আমরা সমুদ্রে মাছ ধরলাম। এই ঘটনায় যখন ক্রমশঃ মরিয়া হয়ে উঠেছি, তখন মনে হলো সমুদ্রে মাছ ধরার কথা। মাছ পেলেও আমাদের ক্ষিদের কাছে তা কিছু বোধ হলো না। চার মাস এমনি করে কেটে গেল।
তার পর আমরা ভয়ঙ্কর একটা আবিষ্কার করলাম যেটা ছিল বিস্কুট। কিন্তু ওটা ফাংগাস ছিল। ওটা হাতে নিতে ওর মুখে নেমে এলো মৃতমুখের পাণ্ডুর ছায়া। ওর মুখ গোলাপের মতো লাল হলো। ওর কাছ থেকে সমস্ত ঘটনাটা শুনলাম, যে গতকাল ও নাকি ফাংগাস খেয়ে নিয়েছে এবং ওর ভালো লেগেছে। ওকে আমি বারণ করলাম যে যত খিদেই পাক না কেন ও যেন ফাংগাস স্পর্শ না করে। প্রতিজ্ঞার শেষে সে বললো ওই ফাংগাস খাওয়ার ইচ্ছেটা ওর মনে দমকা হাওয়ার মতো এগোচ্ছিল। অথচ তার মনে এর আগে ওগুলো খাবার কোনো ইচ্ছে জাগেনি। আমি তারপর পথ দিয়ে এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ বালি থেকে বিচিত্র শব্দ পেলাম। ফাংগাসের একটা ঝাড় আমার কনুই-এর কাছে নড়াচড়া করছিল। সেদিকে তাকিয়ে মনে হলো ঝাড়টার আকৃতির সঙ্গে কোন বিকৃতদেহ মানুষের মিল রয়েছে। মাথায় এই চিন্তাটা আসার সঙ্গে সঙ্গে একটা বিশ্রী শব্দ এলো। জিনিষটার মাথা আকারহীন একটা ধূসর বল। বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘুরে দাঁড়িয়ে একটা ফাংগাসের তাল আঁকড়ে ধরলাম। তারপর কিছুতেই আমার আর তৃপ্তি হয় না। গোগ্রাসে খাওয়ার মাঝখানে সকালের আবিষ্কারের কথাটা আমাকে ভাবল। তারপর নিজের প্রতি ঘৃণায় ফাংগাসের টুকরোটা ফেলে দিলাম। আমাকে দেখে ও সব বুঝলো এবং সে আমাকে নীরব সহানুভূতি জানাল। আমি তাকে সমস্ত ঘটনা বললাম। কিন্তু অদ্ভুত ফাংগাসটার কথা গোপন করে গেলাম। আমি আতঙ্কের বোঝা বাড়ালাম না।
আমি বুঝলাম আমি যা দেখেছি তা ওই সমুদ্রের মধ্যে দাঁড়ানো জীর্ণ জাহাজের যাত্রীদের কোনো একজনের ভয়াবহ পরিণতি, আর একই পরিণতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।
এরপর আমরা ঐ জঘণ্য খাদ্য এড়িয়ে চললেও দিনের পর দিন উদ্দাম গতিতে ফাংগাসের পরগাছা দেহটাকে দখল করলো। আমরা বংশবৃদ্ধিতে বাধা দিতে পারলাম না। সুতরাং দেহ দিনে দিনে ফাংগাসে পরিণত হলো। আমরা বুঝতে পারলাম যে পুরুষ-নারী বুঝতে পারলাম।
আর দিনের পর দিন আমাদের লড়াই একটা ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। ঐ কালান্তিক ফাংগাস মুখে দেবার কামনা আমরা রুখতে পারবো না।
এক সপ্তাহ আগে আমরা বিস্কুট খেয়েছি এবং তিনটি মাছ ধরেছি। আজ রাতে মাছ ধরতে এসে আপনাদের নৌকা দেখতে পেলাম। তখন আপনাদের ডেকে আপনাদের দেওয়া খাবার খেলাম। পতিত দুই আত্মাকে সহানুভূতি ও দয়া করবার জন্য ভগবান আপনাদের বঞ্চিত করবেন না।
জলে বৈঠা ডোবানোর শব্দ পাওয়া গেল, শেষবারের মতো কণ্ঠস্বর এলো। হালকা কুয়াশা ভেদ করে আসা ভৌতিক স্বরে বিষণ্ণতা এলো–আমি বিদায় নিলাম।
আমি দেখলাম যে ভোর হয়ে এসেছে। চাপা আলোয় নৌকা দূরে যেতে দেখলাম। মনে হলো একটা পাতের ভেলা ভাসছে। বৈঠা দুটো জল ঠেলে চলল। আমার দৃষ্টি পড়ল মাথার উপর। বৈঠা জলে ডুবলো। নৌকাটা আলোর বৃত্তের বাইরে, ঐ জিনিষটা স্পঞ্জের বলের মতো কয়াশায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
২. ভৌতিক প্রতিচ্ছবি
কারোর চুরুট চাওয়ার পর আমি চকিতে লোকটার দিকে ফিরে তাকালাম। পরক্ষণেই আমি ওকে চিনতে পারলাম। বছর পঁয়ত্রিশ-এর ব্রিসবেন। মাথায় জফুটের মতো, হয়তো একটু বেশি হবে। বেশ দোহারা চেহারাটি, বেশ চওড়া কাঁধ। হাতের পেশী এত শক্ত যে বাদাম ভেঙে ফেলতে পারে। বুকটা ইস্পাতের মতো কঠিন। ভেতর থেকে খুবই শক্তিশালী। আয়ত নীল চোখ, খাড়া নাক এবং পাতলা গোঁফ, পরিষ্কার চিবুক, সব মিলিয়ে চেহারাটা পুরুষালী। ব্রিসবেন যখন কথা বলে তখন সবাই একমনে তার কথা শোনে।