প্রায় চার ঘণ্টা পর আবার বৈঠার শব্দ শোনা গেল, বোঝা গেল তিনি ফিরে আসছেন। বৈঠায় শব্দ শুনলাম। সেই লোকটি বলল যে, সে আমাদের ছেড়ে চলে যাবার জন্য দুঃখিত। তার প্রেমিকার জন্য তার খুব তাড়া ছিল। সে আমাদের কাছে কৃতজ্ঞ। সে বলে চলল, আমি আর আমার প্রিয়তমা আপনাদের উপকারের কথা নিয়ে আলোচনা করেছি। ভেবেছি– আমাদের হতভাগ্যের কথা। আমরা দুজনে আমাদের জীবনের কথা কারোকে বলতে চাইনি তবু আপনাদের বলছিলাম। এ কাহিনীর শুরু সেদিন যেদিন অ্যালবাট্রস-এর সমুদ্রসমাধি হয়। যে জাহাজটা নিউক্যাসল থেকে সান ফ্রান্সিসকো রওনা হয়ে যায়।
সে বলল যে, উত্তর দিকে থেকে কয়েক ডিগ্রী দূরে জাহাজটা এক ঝড়ের শিকার হয় এবং তার মাস্তুল ভেঙ্গে পড়ে। যখন ভোর হলো, তখন দেখা গেল জাহাজ ফুটো হয়ে গেছে। ফুটো দিয়ে তোড়ে জল ঢুকছে। চারিদিক ক্ৰমে থমথমে হয়ে এলো। নাবিকরা তাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য নৌকা ভাসান। ধ্বংসস্তূপে আমাকে ও আমার সঙ্গিনীকে ফেলে গেল। আমরা তখন জিনিষপত্র গোছগাছ করছিলাম। অন্ধ আতঙ্ক তাদের নির্দয় করে তোলে। আমরা ডেকের উপর দেখলাম যে দিগন্ত রেখা যেন কালো ফুটকির মতো লাগছে। আমরা অনেক কষ্টে একটা ভেলা তৈরি করলাম। ভেলায় প্রয়োজনীয় কয়েকটি জিনিষ নিলাম এবং জাহাজের ভাড়ার থেকে বিস্কুট সঙ্গে পানীয় জল এবং ভেলায় চড়ে নিরুদ্দেশে রওনা দিলাম। আমাদের জাহাজ অনেকটা তলিয়ে গেছে।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে আমরা খেয়াল করলাম আমরা স্রোতের মুখে পড়েছি। সেই স্রোত আমাদের জাহাজ থেকে কোণাকুণি করে নিয়ে চলেছে। প্রায় তিনঘণ্টা পর (হাতঘড়ি দেখে বুঝলাম) জাহাজ ডুবে গেলেও মাস্তুল সমুদ্রের উপরে আছে। আরো কয়েক ঘণ্টা পর তাও ডুবে যায় এবং সন্ধ্যা হয়, কুয়াশা ঘিরে ধরে। এইভাবেই রাত কাটে। পরদিন ভোরে কুয়াশা সরেনি তবে আবহাওয়া অনেক ঠান্ডা। অদ্ভুত ধোঁয়াশার মধ্যে আমরা চারদিন ধরে বেড়ালাম, অবশেষে চতুর্থ দিন সধ্যায় দূর থেকে ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস কানে আসে। ক্রমে সেই শব্দ তীব্র হতে শুরু করে এবং মাঝখানের দু-পাশ থেকে সেই শব্দ আরো কাছে আসে। জলের ওপর থেকে ভেসে উঠলো ভেলা তারপর আমরা শান্ত জলে এসে পড়লাম। ঢেউ-এর গুঞ্জন আমাদের পেছনে এল।
ভোর যখন হলো তখন আমরা সমুদ্রে ভাসছি আবিষ্কার করলাম। আমরা কুয়াশা ভেদ করে একটা প্রকাণ্ড জাহাজের ইস্পাত শরীর দেখতে পেলাম। আমরা ভেবেছিলাম এই কালো দিন শেষ হলো। কিন্তু তখনও দুর্দশার অনেক বাকি ছিল।
ভেলাটা জাহাজের কাছে পৌঁছাতে আমরা জাহাজের পাশে একটা দড়ি ঝুলতে দেখলাম, ওটা বেয়ে উঠলাম। সেই জাহাজে ছিল কঙ্কালের সমারোহ। ওপরে পৌঁছে রেলিং ডিঙিয়ে জাহাজের ডেকে নামলাম। আমি সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব দিইনি, আমার উদ্দেশ্য ছিল জাহাজের লোকেদের ডেকে সাহায্য চাওয়া। অনেক চিৎকারেও কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। তখন জাহাজের পেছনে উঁচু ডেকের কাছে গেলাম। নিচের দরজাটা খুলে উঁকি মারতে একটা বীভৎস পচা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল। বুঝতে পারলাম ভিতরে সকলে মৃত। নিজেকে হঠাৎ খুব একা বলে মনে হলো।
আমি আমার ভেলার কাছে এলাম যেখানে আমার বাগদত্তা চুপ করে বসে আছে। আমাকে ডেকে সে বলল যে, জাহাজে কেউ আছে কিনা, আমি বললাম যে আমার মনে হয় জাহাজে কেউ নেই। যদি ও একটু অপেক্ষা করে তাহলে মই খুঁজতে পারি যাতে ও উপরে উঠে আসতে পারে। একটু পরে ডেকের অন্য প্রান্ত থেকে একটা দড়ির মই খুঁজে পেলাম। ওটা নিচে ঝুলিয়ে দিলাম। মিনিটখানেকের মধ্যে ও আমার পাশে উঠে এলো।
আমরা কেবিন ও অন্যান্য ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজলাম কিন্তু প্রাণের স্পন্দন পাওয়া গেল না। কেবিনের সব জায়গায় ফাংগাসের ঝাড় দেখা গেল। কিন্তু ও বলল এসব পরিষ্কার করা যাবে।
তারপর আমরা জাহাজের পেছনে এলাম। দুজনে মিলে কেবিন ঘসে মেজে পরিষ্কার করে তুললাম। তারপর জাহাজে আমরা খাবার খুঁজলাম এবং তা পেলাম। এবং পানীয় জলের পাম্পটা সারিয়ে তুললাম যাতে পানীয় জলের সমস্যা মিটল তবে স্বাদটা মধুর ছিল না। বেশ কদিন আমরা সেখানে ছিলাম কিন্তু আমরা ভাবতে পারিনি ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কি অভিশাপ লুকিয়ে আছে। আমরা কেবিনের দেওয়ালে ও মেঝেতে, জায়গায় জায়গায় গজিয়ে ওঠা ফাংগাসের আগাছাগুলো পরিষ্কার করে ফেলেছিলাম কিন্তু আশ্চর্য যে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টায় সেগুলো আগের অবস্থায় ফিরে আসছে। এটা আমাদের মধ্যে হতাশা তৈরি করলো। আমরা কার্বলিক অ্যাসিড দিয়ে ওগুলো নির্মূল করে তুললাম। কিন্তু সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতে তা আগের সঙ্গে অন্য জায়গাতেও ছড়িয়ে পড়লো। যেন আমরা হাত দেবার ফলেই ওগুলো থেকে অসংখ্য বীজাণু চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সাতদিন পর দেখা গেল ওর বালিশ, মুখের কাছে জড়িয়ে আছে ফাংগাস। সে আমার কাছে এটা দেখালে আমি ঠিক করলাম যে ঐ মুহূর্তে জাহাজ ছেড়ে চলে যাব যাতে জলের চেয়ে ডাঙায় ভালো করে বাঁচতে পারি।
নিজেদের সামান্য জিনিষ গুছিয়ে নিলাম। আমার সঙ্গিনীর শালের মধ্যে থাকা ফাংগাসগুলো নিজের হাতে সরিয়ে দিলাম।
ভেলাটা জাহাজের গায়ে ভাসছিল, ওটা চালাতে অসুবিধে হতে পারে বলে জাহাজের ডেক থেকে একটা ছোট নৌকো জলে ভাসানো হলো। নৌকা করে আমরা ডাঙার দিকে রওনা হলাম। ডাঙার কাছাকাছি আসতে দেখলাম ফাংগাস দূষিত রাজত্ব অবাধে বিস্তার করেছে, কোনো কোনো জায়গায় ওগুলো বীভৎস অকল্পনীয় টিবির মতো হয়ে আছে। স্থির গাছের পাতা বাতাসে যেমন কেঁপে ওঠে, সেগুলো থরথর করে কাঁপছে। এখানে ওখানে সেগুলোর চেহারা মোটা আঙুলের মতো, কোথাও কোথাও সমতলে মসৃণভাবে বিশ্বাসঘাতী রূপ নিয়ে ওরা ছড়িয়ে পড়েছে, দু-এক জায়গায় ফাংগাসগুলো বেড়ে উঠেছে ও জঘন্য ভাবে কেঁপে উঠছে।