টরেন্স আবছা অন্ধকারে বসার ঘরে মায়ের কাছে এগিয়ে এসে পাংশু মুখেই জিজ্ঞাসা করল, বাবাকে কেন গুলি করা হল?
এটা নিছক একটা দুর্ঘটনা বাবা, এ ব্যাপারে কিছুই আমি বলতে পারি না।
এটা শুধুই এক দুর্ঘটনা নয় মা, যা সত্যি নয় তা বলছ কেন? বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। এটা খুন। খবরের কাগজে বড় বড় হরফে অবশ্য তাই উল্লেখ করেছে।
সে শুধু মাথা নাড়ে, বুড়ো মানুষের মতো অদ্ভুতভাবে মাথা নাড়তে থাকে। আমি বাইরে থেকে একটা কাগজ কিনে এনেছিলাম। আমার মনে সন্দেহ দানা বেঁধে ছিল যে, এমন কিছু আছে যা তোমরা আমাদের কাছ থেকে লুকোতে চাইছ, তাই যদি না হয় তবে মিস কলিন্স খবরের কাগজ লুকিয়ে রাখতে গেল কেন?
টরেন্সের কাছে কোনো জিনিষ লুকিয়ে বোধহয় রেহাই নেই। সেই অদ্ভুত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর ছেলেটি যতক্ষণ না সন্তুষ্ট হবে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে আসল কথা ঠিক পেট থেকে বার করে ফেলবে।
বাবাকে কেন হত্যা করা হল মা?
জাদা এখন বিকারগ্রস্ত রুগীর মতো কান্নায় ভেঙে পড়ে। আমাকে এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করো না বাবা–এ বিষয়ে কোনো কথা তুলো না–এ বিষয়ে কোনো কথা বলার ক্ষমতা আমার নেই…সত্যি এই ঘটনাটা খুব ভীতিপ্রদ।
কিন্তু আমার মনে হয় আসলে ঘটনাটা কী ঘটেছিল সেটা কি সামনে বেরিয়ে আসবে, ঘটনাটা ঘটার পেছনে যে কারণ কাজ করেছে, সেটা জানারও প্রয়োজন আছে।
জাদা মনের দিক থেকে এতটাই যুক্তিবাদী নিস্পৃহ স্বভাবের যে চিৎকার করে কাঁদতে এবং হাসতেও তার মনে সাধ জেগেছিল। জাদা মনে মনে ভাবে, ছেলে কাউকে গ্রাহ্য করতে পারে না–সে কিছুই গ্রাহ্য করে না–প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে সে লোককে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। সে একটি বারের জন্যেও চোখের জল ফেলেনি, চোখ দিয়ে নিজের অজান্তে এক ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়েনি। পিতার এইভাবে মৃত্যুটা সে মেনে নিতে পারেনি, সে ঠিক যেন এক প্রস্তর মূর্তি।
টরেন্স তার মাসী এলসির প্রবোধবাণীকে ব্যঙ্গ করে উড়িয়ে দেয়, একটা ছোট্ট বালকের মনও যে এমন কঠোর মনোভাবের হতে পারে, কেউ বোধহয় সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। টরেন্সের মনে সর্বদা একটা চিন্তাই ঘুরপাক খেত যে, সে বড় একা। তার মনের সঙ্গে কারো মিল ছিল না। কিন্তু সেটা ছিল তার নিছক এক কল্পনা। আজ বাবাকে হারিয়ে তার মনে সত্যিই এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল যে, এই জগতে সে বড়ই একা।
কিন্তু আজ সে একটু অন্যরকম ভাবে চিন্তা করার চেষ্টা করছে। কোনো প্রশ্নের সদুত্তর দেবার মতো তার কাছে আর কেউ রইল না, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তার প্রশ্নের জবাবও কেউ দিতে পারবে না–তাই প্রশ্নের জবাবও অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
আগামীকাল, মঙ্গলবার সে এবং নিকোলাস নাইট্রোগ্লিসারিন তৈরির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। অত্যন্ত আগ্রহ এবং উৎসাহের সঙ্গে সে কাজে অগ্রসর হয়েছিল এবং আজ তার মধ্যে সেই পূর্বের উৎসাহ আর নেই। সে নাইট্রোগ্লিসারিন তৈরি করল কি করল না, তাতে কিছু যায় আসে না।
টরেন্স নিজে এই বিষয়ে যথেষ্ট শোকাহত। এই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সে আর ভয় পায় না, একটি ছেলের বাবাকে যখন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়…সে ভাবে, আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে..
কিছু একটা যেন তার মনকে নাড়া দিয়ে উঠল–শেকড় গজাল-ধীরে ধীরে ক্রোধে মাথা তুলে দাঁড়াল।
বেরিল কলিন্স শোবার ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল, তার চোখমুখ ফ্যাকাসে রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছিল, নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলে উঠল, ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ এসেছেন। জার্দা যেন হাঁফাতে হাঁফাতেই করুণ দৃষ্টিতে কলিন্সের মুখের দিকে একবার তাকাল। বেরিল সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, তিনি বলেছেন যে, তিনি আপনাকে খুব বেশি বিরক্ত করবেন না, এই অকারণে ভয় পাবার মতো কিছু হয়নি। তার গতানুগতিক প্রশ্নের বাণ তিনি এবার ছুঁড়তে শুরু করে দেবেন, ডক্টর ক্রিস্টোর চিকিৎসার পসার সম্বন্ধে এবং আর যদি বাকি থেকেও থাকে সবই আমি জবাব দিতে পারব। শুধুমাত্র যাবার আগে আপনার সঙ্গে হয়তো একবার দেখা করতে পারেন।
তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আচ্ছা চলি।
মিসেস তাড়াতাড়ি প্রস্থান করে। জার্দা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শুধু বলে ওঠে, কলিন্স বরাবরই সাহায্য করে আসছে, সে যথেষ্ট বাস্তব!
মিসেস প্যাটারসন সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, নিশ্চয়, চমৎকার সেক্রেটারী সাদাসিধে গরীব ঘরের মেয়ে, নয় কী? জনের মতো আকর্ষণীয় পুরুষের কাছে এই রূপটাই আকর্ষণীয়।
জার্দা তার দিকে তাকিয়ে মুহূর্তের মধ্যে যেন দপ করে জ্বলে ওঠে।
তুমি কি বলে চলেছ এলসি? তুমি ভাবছ সুন্দরী সেক্রেটারি হলে জন তাকেই মন দিয়ে বসত, প্রেম করত তার সঙ্গে? না কখনও না, কখনও না–জন কোনদিন সেই চরিত্রের লোক ছিল না।
একথা তো নিঃসন্দেহে বলা যায় বোন, জন সে ধরনের লোক কোনোদিনই ছিল না, কিন্তু এই কথাটা অত্যন্ত সাধারণের ভাষায় বলা হয়ে গেল–সাধারণ লোক তো ঐরকম স্বভাবেরই হয়ে থাকে। মিসেস প্যাটারসন বলে যান।
রোগী দেখার ঘরে ইন্সপেক্টরের দৃষ্টি চলে গেল বেরিল কলিন্স-এর যুদ্ধং দেহী’ ভাবের দিকে। এটাই তো স্বাভাবিক। সে ভাবে, ডাক্তার এবং কলিন্স-এর মধ্যে যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি নেই–এই ব্যাপারটা স্পষ্ট। ডাক্তারের কাছে কলিন্স মিষ্টি স্বভাবের হলেও হতে পারে, কিন্তু তাতে করে খুব বেশি জল ঘোলা হবে না এটাও ঠিক।