- বইয়ের নামঃ গুহামানব
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী
গুহামানব
এক
অমন করছেন কেন? শোনা গেল উদ্বিগ্ন নারীকণ্ঠ।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনছে কিশোর পাশা।
বিকেলের ঘন কুয়াশা, প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ের যানবাহন চলাচলের শব্দকে যেন চেপে ধরে কমিয়ে দিয়েছে। পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ড আর রাস্তার ধারের বাড়িগুলোর মাঝখানে ভারি হয়ে ঝুলছে কুয়াশার চাদর। কিশোরের ওপরও পড়ছে যেন এর চাপ। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মাঝে বড় একা একা লাগছিল তার, মনে হচ্ছিল সমস্ত দুনিয়ায় এতক্ষণ সে-ই ছিল একমাত্র মানুষ।
এই সময় কথা বলে উঠল কে যেন, জুতোর আওয়াজ এগিয়ে এল ইয়ার্ডের দিকে।
দুটো ছায়া দেখা গেল, দু-জন মানুষ। ধূসর আলোয় চেহারা অস্পষ্ট। ঝুঁকে হাঁটছেন একজন প্রৌঢ়, পা টেনে টেনে, জুতোর তলা ঘষা খাচ্ছে রাস্তায়। অন্যজন তরুণী, লম্বা চুল এসে পড়ে মুখের অনেকখানি ঢেকে দিয়েছে।
এই যে, একটা বেঞ্চ! স্যালভিজ অফিসের কাছে এসে সঙ্গীকে বসিয়ে দিতে দিতে বলল মেয়েটা, চুপ করে বসুন। তখুনি বলেছিলাম, আমি ড্রাইভ করি, আমাকে দিন। শুনলেন না।
কি হয়েছে? এগিয়ে এল কিশোর।
কপালে হাত রেখে ঘোলা চোখে তাকালেন ভদ্রলোক। আমরা… মেয়েটার হাত ধরলেন। জিজ্ঞেস করো..আমরা কোথায়…
হারবারভিউ লেন, কিশোরকে বলল তরুণী। হারবারভিউ লেনটা খুঁজছি আমরা।
আরও সামনে যেতে হবে আপনাদের, সানসেট পেরিয়ে তারপর… বলল কিশোর। উনি কি অসুস্থ নাকি? ডাক্তার ডাকতে
না বলে উঠলেন ভদ্রলোক। না না, লাগবে না! এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।
তাঁর দিকে ঝুঁকল কিশোর।
ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখ। ঘামছেন। খুব দুর্বল লাগছে। কপাল টিপে ধরলেন। মাথাব্যথা করছে। আশ্চর্য! আগে কখনও করেনি!
ডাক্তার ডাকছি, আবার বলল কিশোর।
জোর করে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক।
না না, লাগবে না, সেরে যাবে… দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে আবার বসে হেলান দিলেন অফিসের দেয়ালে। ভারি, খসখসে হয়ে উঠেছে শ্বাস-প্রশ্বাস। কুঁচকে গেল কপাল। উফ, ব্যথা!
তাঁর হাত ধরল কিশোর। ঠাণ্ডা, ঘামে ভেজা। চোখ স্থির, পাতা। পড়ে না।
হঠাৎ যেন বড় বেশি নীরব হয়ে গেল ইয়ার্ডের ভেতরটা। ভদ্রলোকের কপালে হাত রেখেই গুঙিয়ে উঠল মেয়েটা।
আবার পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। এগিয়ে এলেন মিসেস মারিয়া পাশা, কিশোরের মেরিচাচী।
কি হয়েছে রে, কিশোর?
বোধহয়, মারা গেছেন ভদ্রলোক!
.
প্রচুর আলো, সাইরেনের আওয়াজ, মানুষের হুড়োহুড়ি। কুয়াশার মধ্যে পুরো ব্যাপারটাই অবাস্তব লাগছে কিশোরের কাছে, এখানে নয়, যেন অন্য কোনখানে ঘটে চলেছে ঘটনাগুলো, দূর থেকে দেখছে সে। মেরিচাচীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে সোনালিচুল মেয়েটা।
ইয়ার্ডের গেটের কাছে লোকের ভিড়।
স্ট্রেচারে করে লাশটা অ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় নীরব হয়ে গেল সবাই।
তারপর আবার সাইরেনের তীক্ষ্ণ চিৎকার।
অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে চলল ইয়ার্ডের গাড়ি। ড্রাইভ করছেন। মেরিচাচী। তার আর কিশোরের মাঝে বসেছে মেয়েটা।
পুরো ব্যাপারটা এখনও স্বপ্ন মনে হচ্ছে কিশোরের কাছে।
তবে হাসপাতালে পৌঁছে ঘোর কেটে গেল, আবার যেন ফিরে এল। বাস্তবে। উজ্জ্বল আলোকিত করিডরে লোকজনের চলাফেরা। বড় একটা বসার ঘরের বাতাস সিগারেটের ধোঁয়ায় ভারি।
কিশোর, মেরিচাচী আর মেয়েটা বসল বসার ঘরে। পুরানো ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টানো ছাড়া কিছু করার নেই।
অনেক, অনেকক্ষণ পর এলেন একজন ডাক্তার।
সরি, মেয়েটার দিকে চেয়ে বললেন, কিছু করতে পারলাম না।…আপনার কিছু হয়?
মাথা নাড়ল মেয়েটা।
ময়না তদন্ত করতে হবে, বললেন ডাক্তার। না করে উপায় নেই। এটা একটা অস্বাভাবিক কেস, পথে হঠাৎ মারা যাওয়া। সামনে। তখন কোন ডাক্তারও ছিল না। যা বুঝলাম মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা গেছে। কাটলে বোঝা যাবে। ওর আত্মীয়স্বজনকে কোথায় পাওয়া যাবে?
আবার মাথা নাড়ল মেয়েটা। জানি না। রিসার্চ সেন্টারের ওরা জানতে পারে। ফোঁপাতে শুরু করল। একজন নার্স এসে সরিয়ে নিল তাকে।
বসে আছে কিশোর আর মেরিচাচী।
অনেকক্ষণ পর ফিরে এল মেয়েটা।
সেন্টারে ফোন করে এলাম। ওরা আসছে।
কৌতূহল হচ্ছে কিশোরের, কিসের সেন্টার? কিন্তু জিজ্ঞেস করল না কিছু।
চা খাওয়া দরকার, মেরিচাচী বললেন। উঠে, মেয়েটার হাত ধরে টেনে নিয়ে চললেন কফিশপে।
কিশোর গেল পেছনে।
নীরবে চা খাওয়া চলল কিছুক্ষণ।
খুব ভাল মানুষ ছিলেন, অবশেষে নিচু গলায় বলল মেয়েটা। চেয়ে আছে হাতের খসখসে চামড়ার দিকে। নখের মাথা ক্ষয়া, কোন কোনটা ভাঙা। জানাল, ভদ্রলোক ডাক্তার ছিলেন, জিনেটিসিস্ট। কাজ করতেন গ্যাসপার রিসার্চ সেন্টারে। প্রজনন বিদ্যায় এক্সপার্ট, নানারকম জন্তু-জানোয়ারের ওপর পরীক্ষা চালাতেন। মেয়েটাও ওখানেই কাজ করে।
সেন্টারটার নাম শুনেছি, কিশোর বলল।
উপকূলের ওদিকে, তাই না? স্যান ডিয়েগোর কাছে?
মাথা ঝাঁকাল মেয়েটা। পাহাড়ের মাঝে ছোট একটা শহরে। মরুভূমির দিকে একটা পথ গেছে, ওই পথের কিনারে।
জানি। শহরটার নাম সাইট্রাস গ্রোভ।
এই প্রথম হাসল মেয়েটা। তুমি জানো, কিন্তু অনেকেই জানে না। সেন্টারটার নাম শুনে থাকলেও শহরের নাম জানে না অনেকে।