- বইয়ের নামঃ গুহামানব
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী
গুহামানব
এক
অমন করছেন কেন? শোনা গেল উদ্বিগ্ন নারীকণ্ঠ।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনছে কিশোর পাশা।
বিকেলের ঘন কুয়াশা, প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ের যানবাহন চলাচলের শব্দকে যেন চেপে ধরে কমিয়ে দিয়েছে। পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ড আর রাস্তার ধারের বাড়িগুলোর মাঝখানে ভারি হয়ে ঝুলছে কুয়াশার চাদর। কিশোরের ওপরও পড়ছে যেন এর চাপ। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মাঝে বড় একা একা লাগছিল তার, মনে হচ্ছিল সমস্ত দুনিয়ায় এতক্ষণ সে-ই ছিল একমাত্র মানুষ।
এই সময় কথা বলে উঠল কে যেন, জুতোর আওয়াজ এগিয়ে এল ইয়ার্ডের দিকে।
দুটো ছায়া দেখা গেল, দু-জন মানুষ। ধূসর আলোয় চেহারা অস্পষ্ট। ঝুঁকে হাঁটছেন একজন প্রৌঢ়, পা টেনে টেনে, জুতোর তলা ঘষা খাচ্ছে রাস্তায়। অন্যজন তরুণী, লম্বা চুল এসে পড়ে মুখের অনেকখানি ঢেকে দিয়েছে।
এই যে, একটা বেঞ্চ! স্যালভিজ অফিসের কাছে এসে সঙ্গীকে বসিয়ে দিতে দিতে বলল মেয়েটা, চুপ করে বসুন। তখুনি বলেছিলাম, আমি ড্রাইভ করি, আমাকে দিন। শুনলেন না।
কি হয়েছে? এগিয়ে এল কিশোর।
কপালে হাত রেখে ঘোলা চোখে তাকালেন ভদ্রলোক। আমরা… মেয়েটার হাত ধরলেন। জিজ্ঞেস করো..আমরা কোথায়…
হারবারভিউ লেন, কিশোরকে বলল তরুণী। হারবারভিউ লেনটা খুঁজছি আমরা।
আরও সামনে যেতে হবে আপনাদের, সানসেট পেরিয়ে তারপর… বলল কিশোর। উনি কি অসুস্থ নাকি? ডাক্তার ডাকতে
না বলে উঠলেন ভদ্রলোক। না না, লাগবে না! এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।
তাঁর দিকে ঝুঁকল কিশোর।
ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখ। ঘামছেন। খুব দুর্বল লাগছে। কপাল টিপে ধরলেন। মাথাব্যথা করছে। আশ্চর্য! আগে কখনও করেনি!
ডাক্তার ডাকছি, আবার বলল কিশোর।
জোর করে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক।
না না, লাগবে না, সেরে যাবে… দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে আবার বসে হেলান দিলেন অফিসের দেয়ালে। ভারি, খসখসে হয়ে উঠেছে শ্বাস-প্রশ্বাস। কুঁচকে গেল কপাল। উফ, ব্যথা!
তাঁর হাত ধরল কিশোর। ঠাণ্ডা, ঘামে ভেজা। চোখ স্থির, পাতা। পড়ে না।
হঠাৎ যেন বড় বেশি নীরব হয়ে গেল ইয়ার্ডের ভেতরটা। ভদ্রলোকের কপালে হাত রেখেই গুঙিয়ে উঠল মেয়েটা।
আবার পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। এগিয়ে এলেন মিসেস মারিয়া পাশা, কিশোরের মেরিচাচী।
কি হয়েছে রে, কিশোর?
বোধহয়, মারা গেছেন ভদ্রলোক!
.
প্রচুর আলো, সাইরেনের আওয়াজ, মানুষের হুড়োহুড়ি। কুয়াশার মধ্যে পুরো ব্যাপারটাই অবাস্তব লাগছে কিশোরের কাছে, এখানে নয়, যেন অন্য কোনখানে ঘটে চলেছে ঘটনাগুলো, দূর থেকে দেখছে সে। মেরিচাচীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে সোনালিচুল মেয়েটা।
ইয়ার্ডের গেটের কাছে লোকের ভিড়।
স্ট্রেচারে করে লাশটা অ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় নীরব হয়ে গেল সবাই।
তারপর আবার সাইরেনের তীক্ষ্ণ চিৎকার।
অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে চলল ইয়ার্ডের গাড়ি। ড্রাইভ করছেন। মেরিচাচী। তার আর কিশোরের মাঝে বসেছে মেয়েটা।
পুরো ব্যাপারটা এখনও স্বপ্ন মনে হচ্ছে কিশোরের কাছে।
তবে হাসপাতালে পৌঁছে ঘোর কেটে গেল, আবার যেন ফিরে এল। বাস্তবে। উজ্জ্বল আলোকিত করিডরে লোকজনের চলাফেরা। বড় একটা বসার ঘরের বাতাস সিগারেটের ধোঁয়ায় ভারি।
কিশোর, মেরিচাচী আর মেয়েটা বসল বসার ঘরে। পুরানো ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টানো ছাড়া কিছু করার নেই।
অনেক, অনেকক্ষণ পর এলেন একজন ডাক্তার।
সরি, মেয়েটার দিকে চেয়ে বললেন, কিছু করতে পারলাম না।…আপনার কিছু হয়?
মাথা নাড়ল মেয়েটা।
ময়না তদন্ত করতে হবে, বললেন ডাক্তার। না করে উপায় নেই। এটা একটা অস্বাভাবিক কেস, পথে হঠাৎ মারা যাওয়া। সামনে। তখন কোন ডাক্তারও ছিল না। যা বুঝলাম মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা গেছে। কাটলে বোঝা যাবে। ওর আত্মীয়স্বজনকে কোথায় পাওয়া যাবে?
আবার মাথা নাড়ল মেয়েটা। জানি না। রিসার্চ সেন্টারের ওরা জানতে পারে। ফোঁপাতে শুরু করল। একজন নার্স এসে সরিয়ে নিল তাকে।
বসে আছে কিশোর আর মেরিচাচী।
অনেকক্ষণ পর ফিরে এল মেয়েটা।
সেন্টারে ফোন করে এলাম। ওরা আসছে।
কৌতূহল হচ্ছে কিশোরের, কিসের সেন্টার? কিন্তু জিজ্ঞেস করল না কিছু।
চা খাওয়া দরকার, মেরিচাচী বললেন। উঠে, মেয়েটার হাত ধরে টেনে নিয়ে চললেন কফিশপে।
কিশোর গেল পেছনে।
নীরবে চা খাওয়া চলল কিছুক্ষণ।
খুব ভাল মানুষ ছিলেন, অবশেষে নিচু গলায় বলল মেয়েটা। চেয়ে আছে হাতের খসখসে চামড়ার দিকে। নখের মাথা ক্ষয়া, কোন কোনটা ভাঙা। জানাল, ভদ্রলোক ডাক্তার ছিলেন, জিনেটিসিস্ট। কাজ করতেন গ্যাসপার রিসার্চ সেন্টারে। প্রজনন বিদ্যায় এক্সপার্ট, নানারকম জন্তু-জানোয়ারের ওপর পরীক্ষা চালাতেন। মেয়েটাও ওখানেই কাজ করে।
সেন্টারটার নাম শুনেছি, কিশোর বলল।
উপকূলের ওদিকে, তাই না? স্যান ডিয়েগোর কাছে?
মাথা ঝাঁকাল মেয়েটা। পাহাড়ের মাঝে ছোট একটা শহরে। মরুভূমির দিকে একটা পথ গেছে, ওই পথের কিনারে।
জানি। শহরটার নাম সাইট্রাস গ্রোভ।
এই প্রথম হাসল মেয়েটা। তুমি জানো, কিন্তু অনেকেই জানে না। সেন্টারটার নাম শুনে থাকলেও শহরের নাম জানে না অনেকে।
কিশোর অনেক পড়াশোনা করে, বললেন মেরিচাচী। যা পড়ে মনেও রাখে। আমিই তো ওই শহরটার নাম শুনিনি। প্রতিষ্ঠানটার নামও না। কি হয় ওখানে?
বৈজ্ঞানিক গবেষণা, কিশোর বলল। কৌতূহলী চোখে তার দিকে তাকাল মেয়েটা।
প্লাস্টিকের জিনিস বানানোর ফ্যাক্টরি ছিল ডেনি গ্যাসপারের, আবার বলল কিশোর। কোটি কোটি টাকা কামিয়েছিলেন ব্যবসা করে। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর, কিন্তু কোনদিন হতে পারেনি। তাই, মৃত্যুর আগে উইল করে গেছেন, তার টাকা যেন বিজ্ঞানের গবেষণায় ব্যবহার করা হয়, মানুষের উন্নতির জন্যে।
এসবও জানে! অবাক হয়ে মেরিচাচীর দিকে তাকাল মেয়েটা।
হাসলেন মেরিচাচী। বললাম না, অনেক পড়াশোনা ওর।
ভাল, খুব ভাল। ও হ্যাঁ, এখনও নামই তো বলা হয়নি আমার। লিলি অ্যালজেডো।..
শুনিনি।
শোনার কথাও না। আমি বিখ্যাত কেউ নই।
আমি মারিয়া পাশা। ও আমার ছেলে, কিশোর।
হেসে সামান্য মাথা ঝাঁকাল লিলি।
হ্যাঁ, গ্যাসপার রিসার্চ সেন্টারের কথা বলো। কিসের গবেষণা হয় ওখানে? জিজ্ঞেস করলেন মেরিচাচী।
জন্তু-জানোয়ারের জবাব দিল লিলি। সাদা ইঁদুর, শিম্পাঞ্জী, ঘোড়া এসব।
ঘোড়া? ল্যাবরেটরিতে ঘোড়া রাখে!
ল্যাবরেটরিতে, না, আস্তাবলে। ওখানে রেখেই পরীক্ষা চালানো হয়। আইসোটোপ ব্যবহার করে কি কি সব পরীক্ষা করতেন ডাক্তার ক্লডিয়াস। ক্রোমসম নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। অনেক চালাক বানিয়ে ফেলা হয়েছে একটা ঘোড়াকে। অঙ্ক করতে পারে।
হাঁ হয়ে গেলেন মেরিচাচী।
কিশোরও অবাক।
না না, তেমন জটিল অঙ্ক না, বলল লিলি। প্রথমে দুটো আপেল সামনে রেখে, পরে আরও তিনটা রাখলে, পাঁচবার মাটিতে পা ঠোকে ওটা। তার বেশি কিছু পারে না। ডাক্তার ক্লডিয়াস বলতেন, ঘোড়ার খুলির আকৃতি নাকি ভাল না, বুদ্ধিমান হওয়ার উপায় নেই। শিম্পাঞ্জীর খুলি অনেক ভাল, অনেক জটিল বিষয়ও তাই শিখে ফেলে।
জানোয়ারকে লেখাপড়া শিখিয়ে ওদেরকে দিয়ে কি করাতে চেয়েছিলেন ডাক্তার?
না, কিছু করাবেন না। আসলে, ঘোড়া কিংবা শিম্পাঞ্জীকে কথা বলানোর চেষ্টাও তিনি করছেন না। তিনি চাইছেন মানুষের উন্নতি করতে। কিন্তু সেটা করার জন্যে জানোয়ারের ওপরই তো আগে গবেষণা চালাতে হবে, তাই না? মানুষ কি আর হাসপাতালের গিনিপিগ হতে রাজি হবে?
কেঁপে উঠলেন মেরিচাচী।
মুখ নামাল লিলি। আপনারা অনেক করেছেন। আমি এখন সামলে নিতে পারব। ডাক্তার রুডলফ আর মিসেস গ্যারেট এসে পড়বেন…
ওঁরা না আসা পর্যন্ত আমরা থাকছি, শান্তকণ্ঠে বললেন মেরিচাচী।
লম্বা, কঙ্কালসার, ধূসর চুলওয়ালা একজন মানুষ ঢুকলেন। কফিশপে। ডাক্তার রুভলফ, পরিচয় করিয়ে দিল লিলি। তার সঙ্গে এসেছে একজন মোটাসোটা মহিলা, বয়েস ষাটের কাছে, চোখের পাতায় নকল পাপড়ি লাগিয়েছে, মাথায় আগুনরঙা নকল চুল। মিসেস গ্যারেট। লিলির হাত ধরে নিয়ে গেল মহিলা। ডাক্তার রুডলফ গেলেন। ডাক্তার ক্লডিয়াসকে পরীক্ষা করেছেন যে ডাক্তার তার খোঁজে।
আনমনে মাথা নাড়লেন মেরিচাচী। আজব মানুষ! জন্তু জানোয়ারের সিসটেমে গোলমাল করে দিয়ে আবার কেপে উঠলেন তিনি। কিশোর, ওই কঙ্কাল ডাক্তারটা কি কাজ করে বলে তোর মনে হয়?
কোন ধরনের গবেষণা।
ভ্রুকুটি করলেন মেরিচাচী। গবেষণা না ছাই! বদ্ধ উন্মাদ ওরা! শেষে না ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বানিয়ে বসে! ভাল হবে না। ন্যাচারাল জিনিসকে বদলে দিতে গিয়ে ভাল করবে না, দেখিস, বিপদ ডেকে আনবে; সারা দুনিয়ার জন্যে!
দুই
ডাক্তার ক্লডিয়াসের মৃত্যু সংবাদ খবরের কাগজে প্রকাশিত হলো ফলাও করে। স্ট্রোক হয়ে মারা গেছেন বিজ্ঞানী। তাঁর জীবনের কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত বিবরণীও ছাপা হলো। সব শেষে বলা হলো, জাহাজে করে, তার লাশ দেশে নিয়ে যাওয়া হবে কবর দেয়ার জন্যে।
হপ্তাখানেক বাদেই এক যুগান্তকারী আবিষ্কার করে বসল গ্যাসপার সেন্টার। ঝাঁকে ঝাঁকে রিপোর্টার ছুটে গেল সাইট্রাস গ্রোভ শহরে। সেন্টারের একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ, ডাক্তার জর্জ হ্যারিসন নাকি ওই শহরের সীমান্তে পাহাড়ের গুহায় এক প্রাগৈতিহাসিক জীবের কঙ্কাল আবিষ্কার করেছেন।
দারুণ তো! খবর পড়ে বলে উঠল কিশোর।
পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে লোহালক্কড়ের জঞ্জালের নিচে চাপা পড়েছে। একটা পুরানো মোবাইল হোম ট্রেলার। তাতে তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টার।
মে মাসের এই বিকেলে হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসেছে তিন গোয়েন্দা।
কি দারুণ? জিজ্ঞেস করল সহকারী গোয়েন্দা মুসা আমান।
সাইট্রাস গ্রোভের গুহামানব, খবরের কাগজটা নামিয়ে রেখে বলল কিশোর। আসলে মানুষ কিনা, বোঝা যায়নি এখনও। বয়েস কত, জানা যায়নি, তবে অনুমান করা হচ্ছে অনেক পুরানো। ডাক্তার হ্যারিসনের মত ওটা হোমিনিড। মানুষ, কিংবা মানুষের মত জীব। মানুষের আদিপুরুষ হবে হয়তো।
বুকশেলফের ওপরে রাখা ছোট টেলিভিশন সেটটা অন করল মুসা।
ছবি ফুটতেই পর্দা জুড়ে দেখা গেল একটা হাসিখুশি মুখ। ওর নাম। এলান ফিউজ। বলল, আজ টেলিভিশনে আমাদের অতিথি হয়ে এসেছেন ডাক্তার জর্জ হ্যারিসন। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় সবচেয়ে। পুরানো গুহামানবের কঙ্কাল খুঁজে পেয়েছেন তিনি।
সরে গেল ক্যামেরার চোখ। মোটা একজন মানুষকে দেখা গেল, গোলগাল চেহারা, ছোট করে ছাটা চুল। পাশে বসে আছে ভুড়িওয়ালা, বেঁটে আরেকজন। গায়ে কাউবয় শার্ট, কোমরে চওড়া বেল্ট, তাতে কারুকাজ করা চকচকে বাস্। পায়ে হাইহীল বুট।
ডাক্তার হ্যারিসনের সঙ্গে এসেছেন মিস্টার কিংসলে ম্যাকম্বার, আবার বলল এলান ফিউজ। ব্যবসা করেন। সাইট্রাস গ্রোভে তাঁর জমিতেই কঙ্কালটা পাওয়া গেছে। এ রাইট! রুক্ষকণ্ঠে বলে উঠলেন বিজ্ঞানী। ব্যবসায়ীই। লোকের গলা কেটে টাকা নেয়।
অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি বলল এলান ফিউজ, ডাক্তার হ্যারিসন এখন আমাদেরকে ফসিলটার কথা কিছু বলবেন।…কোথায়। পেয়েছেন, স্যার? কিভাবে?
চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন প্রত্নতত্ত্ববিদ। নেহাত ভাগ্যের জোরেই পেয়েছি বলা যায়। হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। বৃষ্টি সবে থেমেছে তখন। পথের ধারে একফালি জমি, তার পরে পাহাড়। বৃষ্টিতে ঢালের মাটির আস্তর ধুয়ে উঠে গেছে, একটা গর্তের ভেতর থেকে সাদামত কি যেন বেরিয়ে আছে দেখলাম। অন্ধকার হয়ে এসেছে তখন…
তোমার আগেই আমি দেখেছি, বাধা দিয়ে বলল ম্যাকম্বার। আমি দেখার পর…
স্পষ্ট দেখা যায় না, ম্যাকম্বারের কথা না শোনার ভান করে আবার আগের কথার খেই ধরলেন ডাক্তার, আলো দরকার। টর্চ আনতে গেলাম সেন্টারে।
এসে দেখলে শটগান হাতে দাঁড়িয়ে আছি আমি, বলল ম্যাকম্বার। ভাগ্য ভাল, বেশি গোলমাল করোনি, নইলে…
লম্বা করে শ্বাস টানলেন হ্যারিসন। ধৈর্য রাখতে কষ্ট হচ্ছে। ওর জায়গা, তাই ওকে সঙ্গে নিয়েই গেলাম। মুখের ঠিক ভেতরেই পড়ে আছে ওটা, কাদায় দেবে আছে বেশির ভাগ। খুলি দেখেই বুঝলাম
পুরানো! চেঁচিয়ে উঠল ম্যাকম্বার। অনেক পুরানো! হাজার হাজার বছর আগের!
খুলিটার কাছেই ছিল অন্যান্য হাড়, প্রায় পুরো কঙ্কালটাই ছিল, বলে চললেন হ্যারিসন। ভালমত পরীক্ষা করে দেখতে পারিনি এখনও। তবে, আফ্রিকায় যেসব পুরানো ফসিল পাওয়া গেছে, সেগুলোর সাথে অনেক মিল আছে।
কঙ্কালটা কি মানুষের? জিজ্ঞেস করল ফিউজ।
কপালে ভাঁজ পড়ল বিজ্ঞানীর। আধুনিক মানুষের সঙ্গে অনেক মিল আছে বটে। তবে, পুরোপুরি মানুষ বোধহয় বলা যায় না। আমেরিকায় এ যাবৎ যত হোমিনিড পাওয়া গেছে তার মধ্যে এটা সবচেয়ে পুরানো।
সামনে ঝুঁকলেন হ্যারিসন। বলা হয়, আজকের আমেরিকান ইনডিয়ানরা আদিম মংগোলিয়ান যাযাবরদের বংশধর। বরফ যুগের শেষ দিকে সাইবেরিয়া আর আলাসকা থেকে এসেছিল ওরা। আট থেকে দশ হাজার বছর আগে। বেশির ভাগ সাগরের পানিই জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল সে-সময়, সমুদ্র সমতল ছিল অনেক নিচে। সাইবেরিয়া আর আলাসকার মাঝে দূরত্ব এত কমে গিয়েছিল, পা বাড়ালেই এক দেশের মানুষ আরেক দেশে ঢুকে পড়তে পারত। আর তা-ই করেছিল এশিয়ান যাযাবরেরা। শিকার করতে করতে চলে এসেছিল নতুন দেশে। শিকার পাওয়া যেত বেশি, তাই আর ফিরে যায়নি ওরা, ছড়িয়ে পড়ে বিশাল অঞ্চলে। কেউ কেউ চলে যায় একেবারে দক্ষিণ আমেরিকার শেষ মাথায়।
এসবই অবশ্য বিজ্ঞানীদের অনুমান। কেউ কেউ অন্য কথাও বলেন। বরফ যুগের আগে থেকেই নাকি আমেরিকায় মানুষ ছিল। কেউ তো আরও বাড়িয়ে বলে আনন্দ পান। বলেন মানুষের আদি জন্ম এই আমেরিকাতেই, পরে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে গেছে। দেশ ত্যাগ করে চলে গেছে ইউরোপ, এশিয়ায়।
সাইট্রাস গ্রোভে পাওয়া ফুসিলটা কি প্রমাণ করে? জিজ্ঞেস করল ফিউজ।
এখুনি কিছু বলা যাবে না। কত পুরানো, তা-ই জানা হয়নি। আমাদের এই কঙ্কালটা…
এখানে আমাদের কথাটা আসছে কিভাবে? ওটা তো শুধু আমার, গোঁয়ারের মত বলে উঠল ম্যাকম্বার। আমার জায়গায় পাওয়া গেছে। সন্দেহেরও কিছু নেই, ওটা মানুষেরই কঙ্কাল। লাখ লাখ বছর ধরে পড়ে আছে, এই একটু আগে যে হাজার হাজার বলেছে, বেমালুম ভুলে গেছে।
পাগল নাকি! আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না হ্যারিসন, ধমকে উঠলেন।
পাগলের কি আছে? গলা আরও চড়াল ম্যাকম্বার। বিজ্ঞানীদের সন্দেহ থাকতে পারে, কিন্তু আমি শিওর, এই আমেরিকাতেই প্রথম মানুষের জন্ম হয়েছিল। গুহায় যে পড়ে আছে, হয়তো ওটাই প্রথম মানুষ, ওরই বংশধর আমরা। গার্ডেন অভ ইডেন হয়তো সাইট্রাস গ্রোভের ধারেকাছেই কোথাও মাটির তলায় চাপা পড়ে আছে। ব্যাকারসফিল্ড, কিংবা ফ্রেজনোতে…
অ্যাই, তুমি থামবে? হাত নাড়লেন হ্যারিসন।
কেন, ঠিক কথাই তো বলছি…
ঠিক! চেয়ার নিয়ে ঘুরে ম্যাকম্বারের মুখোমুখি হলেন ডাক্তার।
কি করে জানলে, ঠিক? স্টাডিই তো করলাম না…
করার দরকারও নেই। আর করতে দিচ্ছে কে তোমাকে? যেখানে পাওয়া গেছে ওটা, সেখানেই থাকবে, যেভাবে পাওয়া গেছে, সেভাবে। মাইক্রোস্কোপের তলায় রাখা তো দূরের কথা, ছুঁতেও দেব না তোমাকে। তবে হ্যাঁ, লোকে দেখতে চাইলে অবশ্যই দেখাব।
সর্বনাশ! ফসিল নিয়েও ব্যবসা করবে নাকি? শশা দেখাবে? আমিও সেটি হতে দিচ্ছি না। কত পুরানো হাড় ওগুলো…
অনেক অনেক পুরানো, সেটা বুঝতে আর স্টাডি করার দরকার হয় না। দেখেই বলে দেয়া যায়। আমার ওই গুহায়ই জন্মেছিল প্রথম মানুষ, সভ্যতার সূচনা হয়েছিল। আমাদের সবারই আদিপিতা ওই মানুষটি। তাকে দেখার অধিকার সব মানুষেরই আছে।
পয়সা লোটার মওকা পেয়েছ তো, এছাড়া কি বলবে, চামার কোথাকার! রাগে ফেটে পড়লেন হ্যারিসন। কি বলছ বুঝতে পারছ?
পারছি। সরাসরি ক্যামেরার চোখের দিকে তাকাল ম্যাকম্বার। ওটা পৃথিবীর প্রথম মানুষ, বাবা আদমের হাড়, নিশ্চয় আপনারাও বুঝতে পারছেন। আপনাদের সবারই দেখার অধিকার আছে। আমার গুহায় সবাই আমন্ত্রিত। তবে দয়া করে একটু ধৈর্য ধরুন, একটু সময় দিন আমাকে, জায়গাটাকে ঠিকঠাক করে রেডি করে ফেলি। তারপর গুহার মুখ খুলে দেব সবার জন্যে। ক্যালিফোর্নিয়ার সবচেয়ে দর্শনীয় জায়গা হবে
চামারের বাচ্চা চামার! চেঁচিয়ে উঠে দু-হাত বাড়িয়ে ম্যাকম্বারের। ওপর ঝাঁপ দিলেন হ্যারিসন।
দ্রুত সরে গেল ক্যামেরা। এরপর কি ঘটল, টেলিভিশনের দর্শকেরা আর দেখতে পেল, না। তবে নানারকম শব্দ ভেসে এল স্পীকারে। কি ঘটছে স্টুডিওতে, বুঝতে অসুবিধে হলো না কারও।
পর্দায় দেখা দিল এলান ফিউজ। প্রিয় দর্শকবৃন্দ, চমৎকার এই অনুষ্ঠানটি এখানেই শেষ করছি। আরও অনেক কথা জানার ছিল ডাক্তার হ্যারিসনের কাছে, সময়ের অভাবে তা সম্ভব হলো না। এখন দেখবেন ফার্নিচারের রঙের ওপর একটি বিশেষ প্রতিবেদন…
সুইচ অফ করে দিল মুসা। খাইছে! কাণ্ডটা কি কুরল? কিশোর, কে জিতেছে বলে মনে হয়? হ্যারিসন নাকি ম্যাকম্বার? এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কিশোর বলল, ম্যাকম্বার খুব বাজে লোক। হাড়গুলো সরাতে না দিলে…
রাখতে পারবে? বাধা দিয়ে বলল রবিন।
কেন পারবে না? গুহাটা যদি তার সম্পত্তি হয়? স্পষ্ট বোঝা গেল, দু-জনের মাঝে আগে থেকেই খারাপ সম্পর্ক ছিল। নইলে হ্যারিসনকে দেখে শটগান আনতে যাবে কেন ম্যাকম্বার? হ্যারিসনও বদমেজাজী। শেষ পর্যন্ত দু-জনের মাঝে কি যে হয় বলা যায় না।
রক্তারক্তি কাণ্ড, মুসা বলল।
হলে অবাক হব না। ম্যাকম্বার চাইবে কঙ্কাল দেখিয়ে পয়সা কামাতে, আর হ্যারিসন চাইবে তুলে নিয়ে গিয়ে ল্যাবরেটরিতে ঢোকাতে। একজন লোভী, আরেকজন বদমেজাজী। খুনখারাপিও হয়ে যেতে পারে।
তিন
সেদিনের ওই বিচিত্র সাক্ষাত্তারের পর টেলিভিশনে আর একবারও এলেন না ডাক্তার হ্যারিসন। তবে কিংসলে ম্যাকম্বারকে কয়েকবারই দেখা গেল। শো-এর ব্যাপারে কথা বলল। সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, যেখান থেকে যে গেল, সবাইকেই সাক্ষাৎকার দিল সে। বসন্ত গিয়ে গ্রীষ্ম এল। জুলাইয়ের মাঝামাঝি নাগাদ দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার প্রায় প্রতিটি মানুষই জেনে গেল ম্যাকম্বারের গুহামানবের কথা। এরপর শুরু হলো শো-এর বিজ্ঞাপন। জানানো হলো, আগস্টের শুরুতে সাধারণ দর্শকদের জন্যে খুলে দেয়া হবে গুহামুখ।
জুলাইয়ের শেষ দিকে আরও অনেকের মত তিন গোয়েন্দাও সাইট্রাস গ্রোভে যাওয়ার জন্যে তৈরি হলো।
হ্যানসনকে খবর দিল কিশোর।
এক সুন্দর সকালে ইয়ার্ডের গেটে এসে দাঁড়াল রাজকীয় রোলস রয়েস। চড়ে বসল তিন গোয়েন্দা।
একটানা দুই ঘণ্টা দক্ষিণে চলল গাড়ি। তারপর পুবে মোড় নিয়ে উঠে এল পাহাড়ী পথে। পথের ধারে কোথাও কমলা বাগান, কোথাও ঝোঁপঝাড়। খোলা মাঠ আর তৃণভূমিও আছে, তাতে চরছে গরু।
আরও আধ ঘণ্টা পর সেন্টারডেল নামে ছোট একটা শহরে ঢুকল গাড়ি। শহর পেরিয়ে ওপাশে আবার পথ। দুই ধারে ঝোঁপঝাড়, জঙ্গল, মাঠ-মাইলের পর মাইল একই দৃশ্য। অবশেষে একটা সাইনবোর্ড দেখা গেল। তাতে ইংরেজিতে লেখা:
সাইট্রাস গ্রোভে স্বাগতম।
খুবই ছোট শহর, মাত্র কয়েকটা ঘর। একটা সুপারমার্কেট, দুটো পেট্রোল স্টেশন, একটা গাড়ির দোকান, আর একটা ছোট মোটেল আছে নাম-রেস্ট-আ-বিট। শহরের সুইমিং পুলের পাশ কাটাল গাড়ি। পুরানো, ধুলোয় ঢাকা একটা রেল স্টেশনের ধার দিয়ে এসে পড়ল পুরানো শহরের মাঝখানে। পথের একধারে একটা পার্ক, আরেক ধারে কিছু দোকানপাট! একটা ব্যাংক, হার্ডওয়্যারের দোকান, ওষুধের দোকান, আর পাবলিক লাইব্রেরি দেখা গেল। শহরটা ছোট বটে, কিন্তু লোকে লোকারণ্য। মোটেলের কপালে নিওন সাইনে নো ভ্যাকান্সি লেখা। সাইট্রাস গ্রোভ কাফের সামনে লম্বা লাইন, খাবার কেনার জন্যে অধীর হয়ে আছে লোকে।
এ সবই ওই গুহামানবের কল্যাণে, বলল রবিন। কি ভিড় দেখেছ?
হ্যামবার্গার শপের দিকে চেয়ে হাসল কিশোর। মনে হচ্ছে এই খেয়েই থাকতে হবে। থামতে বলল হ্যাঁনসনকে। দিন সাতেক পরে এসে আবার এই জায়গা থেকেই তুলে নিতে বলল।
গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল হ্যাঁনস।
একজন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে, ম্যাকম্বারের বাড়িটা কোথায় জেনে নিল কিশোর।
সহজেই খুঁজে পাওয়া গেল বাড়িটা। সামনে গাড়িবারান্দা, ছোট লন। এককালে সুন্দর থাকলেও এখন তেমন কিছু নেই। দেয়ালে রঙ করা হয়নি অনেকদিন, জানালার পর্দা পুরানো। কিছু কিছু পাল্লার শার্সি উধাও। অযত্নে বেড়ে উঠেছে বাগানের ঘাস।
আমি তো ভেবেছিলাম বড়লোক, রবিন বলল। মনে করেছি, হার্ডওয়্যার আর গাড়ির দোকানটা ওরই।
হলেই বা কি? কিশোর বলল। যা শহর, লোক আছে কয়জন, আর বেচাকেনাই বা কি হবে?
গাড়িবারান্দায় একটা নোটিশ, তাতে লেখা রয়েছে: যারা রাতে থাকার জায়গা চায় তারা যেন বাড়ির পাশ দিয়ে ঘুরে এগোয়।
নির্দেশ পালন করল ছেলেরা। দেখল, একটা পথের ধার থেকে শুরু হয়েছে মাঠ, তার ওপাশে বন। মূল বাড়িটার কাছে একটা গোলাঘর, বয়েসের ভারে ধুকছে, বিবর্ণ। মাঠের ধারে পাহাড়। পাহাড়ের কোলে চমৎকার একটা নতুন বিল্ডিং। ছিমছাম, সুন্দর, আধুনিক। একটা জানালাও নেই। ডাবল ডোর দরজার ওপরে সাইনবোর্ড:
গুহামানবের গুহায় স্বাগতম।
বাহ্! মুসা বলল। মাল কামানোর বেশ ভাল ব্যবস্থা হয়েছে।
কিছু চাই? পেছনে নরম গলায় কথা শোনা গেল।
দেখেই চিনল কিশোর। আরে, লিলি অ্যালজেডো, আপনি!
ও, কিশোর। তোমরাও দেখতে এসেছ।…তা তোমার মা কেমন আছেন?
হাসল কিশোর। ভাল।
কথা শুনেই বোধহয়, বাড়ির পেছনের দরজা খুলে বেরোল একজন মোটা-খাটো মহিলা, পাতলা চুল।কে রে, লিলি?… কি চায়?
জেলডা আন্টি, ও কিশোর পাশা, পরিচয় করিয়ে দিল লিলি।
ওর কথাই বলেছিলাম। ওরা সাহায্য না করলে খুব বিপদ হত সেদিন রকি বীচে।
মুসা আর রবিনের পরিচয় দিল কিশোর।
গুহামানব দেখতে এসেছে, লিলি বলল, আন্টি, ওদের থাকার ব্যবস্থা করা যায় না?
মহিলার পেছনে উঁকি দিল আরেকজন। কিংসলে ম্যাকম্বার।
আবার পরিচয় করানোর পালা।
তোমাদের কথা লিলির কাছে শুনেছি, বলল ম্যাকম্বার। জায়গা দিতে পারলে খুশিই হব। কিন্তু বাড়িতে তো হবে না। অবশ্য গোলাঘরের মাচায় শুতে পারো। ঘরের পেছনে অনেক জায়গা, ব্যবহার করতে পারবে। একটা পানির কলও আছে ওখানে। কুঁচকে এল লোকটার ধূর্ত চোখের পাতা। ভাড়াও খুব কম নেব তোমাদের কাছ থেকে। একরাতের জন্যে, এই দশ ডলার। কি বলো, অ্যাঁ? তিনজনের জন্যে।
কি বলছ, আংকেল! চেঁচিয়ে উঠল লিলি।
তুমি চুপ করো, মেয়ে, বলেই স্ত্রীর দিকে তাকাল ম্যাকম্বার। চোখ সরিয়ে নিল জেলড়া।
দশ ডলারে এখানে কোথাও থাকার জায়গা পাবে না, আবার বলল ম্যাকম্বার।
বনের মধ্যে গিয়ে থাকলেই তো পারি? কিশোরের দিকে চেয়ে বলল রবিন।
পয়সাও লাগবে না…
না না, সেটা উচিত হবে না, তাড়াতাড়ি বলে উঠল ম্যাকম্বার। জায়গাটা নিরাপদ না। যখন-তখন আগুন লাগে। শুকনো মৌসুম। দাবানলের ভয় আছে।
মানিব্যাগ থেকে দশ ডলারের একটা নোট বের করে বাড়িয়ে ধরল। কিশোর। নিন। আজ রাতের ভাড়া।
গুড, নোটটা নিয়ে পকেটে ভরল ম্যাকম্বার। কণ্ঠে খুশির আমেজ। লিলি, যাও তো, পানির কলটা দেখিয়ে দিয়ে এসো।
দেখো, ছেলেরা, সাবধান থাকবে, হুশিয়ার করল মিসেস ম্যাকম্বার। ঘরে আগুনটাগুন লাগিয়ে দিয়ো না আবার।
সিগারেট খাও নাকি? জিজ্ঞেস করল ম্যাকম্বার।
না, মুখ গোমড়া করে জবাব দিল মুসা। এই, কিশোর, এদের বিরক্ত করছ কেন? বনে না থাকি, পার্কে গিয়েও তো:..
পার্কে থাকা নিষেধ, বাধা দিয়ে বলল ম্যাকম্বার। মুচকি হেসে ঘরে ঢুকে গেল সে।
ছেলেদের নিয়ে চলল লিলি। রাগে, লজ্জায় লাল হয়ে গেছে গাল।
খুব খারাপ লাগছে আমার। দেখো, কালও যদি থাকো, টাকা দেবে না। আমার কাছে কিছু আছে। চাইতে এলে ভাড়াটা আমিই দিয়ে দেব আংকেলকে।
আরে, রাখুন তো। ওসব ভেবে মন খারাপ করবেন না, কিশোর বলল। টাকাটা কোন ব্যাপার না।
কিন্তু আংকেল যখন এরকম ছ্যাচড়ামি করে না, আমার খুব খারাপ লাগে, তিক্ত কণ্ঠে বলল লিলি। কিছু বলতেও পারি না…আমাকে মানুষ করেছে ওরাই। কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। আমার বাবা-মা। আমার তখন আট বছর বয়েস।
বিষণ্ণ কণ্ঠে কিশোর বলল, আপনার আর আমার অনেক মিল। আমার বাবা-মাও কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে।
তাই নাকি? তাহলে মেরিআন্টি…
আমার চাচী। নিঃসন্তান। মায়ের আদর দিয়ে মানুষ করছে আমাকে। অপরিচিত কারও কাছে আমাকে ছেলে বলেই পরিচয় দেয়।
ও! দীর্ঘশ্বাস ফেলল লিলি। তাহলে তো মা-ই!
ছেলেরা, ভাবছে, ম্যাকম্বার দম্পতি কি যত্ন নেয় না এতিম মেয়েটার? তার শীর্ণ হাত-পা, রুক্ষ চুল, রক্তশূন্য চেহারা..
গোলাঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল লিলি। পেছনে তিন গোয়েন্দা।
ধুলোয় মলিন ঘরের মাঝে ঝকঝকে নতুন একটা পিকআপ ট্রাক আর একটা ফোরডোর সিডান কার, বড় বেমানান। ঘরের কোনায় কোনায় জমে আছে জঞ্জাল, পুরানো হলদেটে খবরের কাগজের স্তূপ, বাক্স। ওয়ার্কবেঞ্চের ওপরে আর আশপাশে পড়ে রয়েছে মরচে ধরা যন্ত্রপাতি-করাত, হাতুড়ি, বাটালি, এসব।
পেছনের দেয়ালের কাছ থেকে মাচায় উঠে গেছে কাঠের সিঁড়ি।
চালার নিচের অন্ধকার, গুমট মাচায় উঠে এল ছেলেরা। একধারে জানালা একটা আছে বটে, তবে ধুলো আর মাকড়সার জালে এমনই মাখামাখি, আলো আসার পথও নেই। ধাক্কা দিয়ে পাল্লা খুলল কিশোর। হুড়মুড় করে এসে ঢুকল বাইরের তাজা, ঠাণ্ডা বাতাস।
তোয়ালে-টোয়ালে কিছু লাগবে? নিচ থেকে জিজ্ঞেস করল লিলি।
না, মুসা জবাব দিল। দরকারী জিনিস সব নিয়ে এসেছি আমরা।
মইয়ের গোড়ায় দাঁড়িয়েই আছে লিলি। যেতে ইচ্ছে করছে না যেন। আবার বলল, একটু পরেই সেন্টারে যাব আমি। জানোয়ারগুলো দেখতে চাইলে তোমরাও আসতে পারো।
ওপর থেকে মাচার ফোকর দিয়ে মুখ বের করে বলল কিশোর, আর্কিওলজিস্ট ভদ্রলোককে চেনেন নিশ্চয়? গুহামানবকে যিনি পেয়েছেন?
ডাক্তার হ্যারিসন? চিনি। দেখা করতে চাও? বাড়ি থাকলে ওনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি।
তাহলে তো খুব ভাল হয়। কঙ্কালটার বয়েস কত জানা গেছে? কি করে গুহায় এল?
মুখ বাঁকাল লিলি। সবাই ওটার কথা জানার জন্যে পাগল। বিচ্ছিরি দেখতে। নিশ্চয় গরিলার মত ছিল চেহারা।-খবরদার! গুহার ধারেকাছে যেয়ো না। শটগান নিয়ে পাহারা দেয়, আংকেল। রান্নাঘরের দরজার পেছনে লুকিয়ে বসে থাকো। গুলি খেয়ে মরবে শেষে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। ভীষণ বদরাগী লোক।…ওই গুহামানব নিয়ে কিছু একটা ঘটবে এখানে, বলে দিলাম, দেখো। খুব খারাপ কিছু!
চার
ম্যাকম্বারের বাড়ি থেকে আধ মাইল দূরে একটা পাহাড়ের ওপর ছোটবড় কিছু বাড়ির সমষ্টি গ্যাসপার রিসার্চ সেন্টার। ঘন সবুজ লন। কাঁটাতারের বেড়া নেই, এ ধরনের সেন্টারে সাধারণত যেমন থাকে। তবে পাথরের গেটপোেস্ট আছে, তাতে শক্ত পাল্লা। লিলির পেছন পেছন গাড়িপথ ধরে বাড়ির গেটে এসে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।
গেট খুলে ভেতরে ঢুকল ওরা। সদর দরজায় কোন পাহারা নেই। পাল্লায় টোকা দেয়ারও প্রয়োজন মনে করল না লিলি, ঠেলা দিয়ে খুলে ফেলল।
কোন এনট্রি হল নেই। বড় একটা লিভিং রুমে সরাসরি এসে ঢুকল ওরা। ঘরেই আছেন জর্জ হ্যারিসন। পায়চারি করছিলেন, ওদের দেখে থামলেন।
তিন গোয়েন্দার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল লিলি।
ভ্রুকুটি করলেন ডাক্তার। ও, তোমরাও ভণ্ডামী দেখতে এসেছ?
গুহামানবকে দেখতে, স্যার, জবাব দিল মুসা!
কি যে কাণ্ড! পাগল হয়ে গেছে লোক! আবার পায়চারি শুরু করলেন হ্যারিসন। দলে দলে আসবে। মাড়িয়ে শেষ করে দিয়ে যাবে সবকিছু। পাহাড়ের নিচে নিশ্চয় আরও ফসিল আছে। আমার বন্দুক থাকলে…
সব্বাইকে গুলি করে মারতে, বলল শান্ত একটা কণ্ঠ।
ঘুরে তাকাল ছেলেরা।
লম্বা, বিষণ্ণ চেহারার একজন লোক ঘরে ঢুকেছেন। কঙ্কালসার দেহ। কিশোর চিনল। রকি বীচ হাসপাতালে দেখেছে। সেদিন পরেছিলেন মলিন একটা ধূসর স্যুট। আজ পরনে রঙচটা খাকি হাফপ্যান্ট আর পোলো শার্ট। ফায়ারপ্লেসের ধারে একটা আর্ম-চেয়ারে বসে তাকিয়ে রইলেন নিজের হাড়সর্বস্ব হাঁটুর দিকে।
ডাক্তার রুডলফ, লিলি বলল, কিশোর পাশার সঙ্গে নিশ্চয় পরিচয় আছে?
অবাক হলেন ডাক্তার। আছে কি?
রকি বীচ হাসপাতালে যেদিন মারা গেলেন ডাক্তার ক্লডিয়াস, লিলি মনে করিয়ে দিল, আমাকে সাহায্য করেছিল ও। আপনি যখন ঢুকলেন তখনও ছিল। মনে নেই?
ও হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে, হাসলেন ডাক্তার। হাসলে তার বয়েস কম মনে হয়। কেমন আছ?
ভাল, মাথা কাত করল কিশোর।
ডাক্তার রুডলফও আর্কিওলজিস্ট, লিলি জানাল। একটা বই লিখছেন।
আবার হাসলেন ডাক্তার।
আল ম্যানও তো আপনারই লেখা, তাই না? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ওপরে উঠে গেল রুডলফের ভুরু। তুমি ওটা পড়েছ?..
হ্যাঁ। লাইব্রেরিতে পেয়েছিলাম। দারুণ লেখা, তবে মন খারাপ হয়ে যায়। এভাবে সব সময়ই যদি মানুষকে মানুষের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়…
খুব খারাপ, তাই না? কিশোরের বাক্যটা শেষ করলেন রুডলফ। জন্ম থেকেই আমরা নিষ্ঠুর, পৈশাচিকতা ভালবাসি। সেটাই আমাদের, মানে মানুষের বৈশিষ্ট্য। বড় মগজ থাকায় আর সোজা হয়ে হাঁটতে পারি। বলে এসব করার সুবিধে হয়েছে।
ফালতু কথা! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন ডাক্তার হ্যারিসন। ভায়োলেন্স মানুষের বৈশিষ্ট্য নয়, জন্ম থেকে নিষ্ঠুর হয় না মানুষ। সব তালগোল পাকিয়ে ফেলছ তুমি।
তাই নাকি? বাঁকা চোখে সহকারীর দিকে তাকালেন রুডলফ। বেশ, ডেনি গ্যাসপারের কথাই ধরা যাক। মানুষের উন্নতি চাইতেন তিনি, তার কারণেই সৃষ্টি হয়েছে এই গ্যাসপার সেন্টার; কিন্তু তাই বলে কি তাঁকে নিষ্ঠুর বলা যাবে না? নিশ্চয় যাবে। রীতিমত খুনী ছিলেন। বিগ-গেম হান্টার ছিলেন। শিকার মানেই খুন, আর খুন মানেই পৈশাচিকতা, কিংবা ভায়োলেন্স, যা-ই বলো। ম্যানটেলপিস-এর দিকে দেখালেন। সেখানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে শিংওয়ালা একটা জন্তুর স্টাফ করা মাথা, মৃত চোখদুটো চেয়ে আছে জানালার দিকে। কয়েকটা বুককেসের ওপরের দেয়ালে সাজানো রয়েছে বাঘ, পুমা আর একটা বিশাল জলমহিষের মাথা। ভালুক, সিংহ আর চিতার চামড়া আছে। কয়েকটা। এখন যুগ পাল্টেছে, তাই মানুষের পরিবর্তে জন্তু শিকার করে তার মাথা কিংবা চামড়া এনে ঘরে সাজিয়ে রাখা হয়। বহুকাল আগে কি হত? অন্য কোন শিকার না পাওয়া গেলে মানুষ মানুষকেই মারত। আমরা যেমন মুরগীর ঠ্যাঙ চুষি, তেমনি করে মানুষের হাড় চুষত সে-কালের মানুষেরা।
সব গুবলেট করে ফেলছ! খেঁকিয়ে উঠলেন হ্যারিসন।
তারমানে ঠিকই বলছি, হাত তুললেন রুডলফ। তোমার রেগে যাওয়া মানেই, নিজের যুক্তির স্বপক্ষে জবাব খুঁজে না পাওয়া।
ঠিক এই সময় ঘরে ঢুকলেন টাকমাথা, ছোটখাটো একজন মানুষ। আবার শুরু করেছ! নাহ্, তোমাদের নিয়ে আর পারা গেল না। মানুষ নিষ্ঠুর হোক বা না হোক তাতে কি এসে যায়?
আগন্তুকের পরিচয় দিল লিলি, ইনি ডাক্তার এনথনি রেডম্যান, ইমিউনোলজিস্ট। অনেকগুলো সাদা ইঁদুর আছে ওঁর।…স্যার, এদেরকে ওগুলো দেখাতে চাই। দেখাব?
দেখাও, তবে হাত দিতে পারবে না, অনুমতি দিলেন ডাক্তার রেডম্যান।
না, দেব না।
আরেকটা হলরুমে ঢুকল ছেলেরা।
ওঅর্করুম, ল্যাবরেটরি, সব জায়গায়ই যাওয়া যায় এখান থেকে। ওই যে, একটা দরজা দেখাল লিলি, ওটার ওপাশে ডাক্তার রেডম্যানের ল্যাবরেটরি।
দরজা ঠেলে ছোট একটা ওয়াশরুমে ঢুকল ওরা। চারটে সার্জিক্যাল মাস্ক বের করে একটা নিজে নিয়ে বাকি তিনটে তিনজনকে দিল লিলি। পরে নাও। মাস্ক মুখে লাগিয়ে ভারি একজোড়া রবারের দস্তানা পরে নিল সে।
দেখাদেখি তিন গোয়েন্দাও মুখোশ পরল।
আরেকটা দরজা ঠেলে বড় একটা ঘরে এসে ঢুকল ওরা। রোদের আলোয় আলোকিত। দেয়াল ঘেঁষে রাখা আছে সারি সারি কাঁচের খাঁচা। ভেতরে অসংখ্য সাদা প্রাণী ছুটাছুটি করছে।
বেশি কাছে যেয়ো না, সাবধান করল লিলি, ছুঁয়ো না। ইঁদুরগুলোকে খাওয়ানোয় মন দিল সে।
এগুলো বিশেষ ধরনের ইঁদুর, খানিক পরে আবার বলল। ওদের ইমিউনিটি নষ্ট করে দিয়েছেন ডাক্তার রেডম্যান…
এক মিনিট, হাত তুলল মুসা। ইমিউনিটিটা কি?
এক কথায় ব্যাখ্যা করা যাবে না, বলল রবিন। রোগ-প্রতিরোধ। ক্ষমতা জাতীয় কোন ব্যাপার।
হ্যাঁ, বলল লিলি। অনেকটা তাই। ছুঁলে ওগুলোর মধ্যে রোগ সংক্রমণ ঘটতে পারে, খুব সহজে। ইনফেকশন প্রতিরোধের ক্ষমতা প্রায় নেই বললেই চলে এখন ওদের।
হুঁ, মাথা দোলাল মুসা। তারমানে রোগে ধরলেই মরবে?
কয়েকটা ইতিমধ্যেই মরেছে, লিলি জানাল। জীবদেহে একধরনের বিশেষ কোষ তৈরি হতে থাকে, যেগুলো রোগজীবাণু খেয়ে ফেলে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ওই কোষই দেহের ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। ওই ইমিউন রিঅ্যাকশন থেকেই তখন বাতে ধরে মানুষকে, পাকস্থলীতে ঘা হয়, এমন কি কোন কোন ক্ষেত্রে পাগলামি রোগেও ধরে।
খাইছে! আঁতকে উঠল মুসা। আল্লারে! কি সাংঘাতিক!
ইমিউনিটি না থাকলে বসন্ত রোগ ঠেকাতে পারব না আমরা, রবিন বলল, হাম হবে…
জানি, বলল লিলি। সেজন্যেই ইমিউনিটি নিয়ে গবেষ করছেন ডাক্তার রেডম্যান, যাতে ইচ্ছেমত ইমিউন কন্ট্রোল করতে পারি আমরা, রিঅ্যাকশন না হয়, অন্য রোগে আক্রান্ত না হই…
চমৎকার আইডিয়া! কিশোর বলল। বই-টই লিখছেন নাকি?
এখনও না। তবে ইচ্ছে আছে। ডাক্তার রুডলফ লিখছেন, ডাক্তার হ্যারিসনও লখছেন তার ঘরে কেবিনেটে বন্দি মানুষটাকে নিয়ে।
কেবিনেটে বন্দি? ভুরু কোঁচকাল রবিন।
মানুষের ফসিল, বুঝিয়ে বলল লিলি। আফ্রিকায় পেয়েছিলেন হাড়গুলো। জোড়া লাগিয়ে লাগিয়ে আস্ত কঙ্কাল বানিয়ে ফেলেছেন।
এখানকার গুহায় পাওয়া গুহামানবকে নিয়েও তাই করতে চান বোধহয়? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ, লিলির কণ্ঠে অস্বস্তি, কিন্তু ম্যাকম্বার আংকেল দিতে রাজি না।
উঁদুরগুলোকে খাওয়ানো শেষ হলে আবার ওয়াশরুমে ফিরে এল ওরা। মাস্ক-গ্লাভস খুলে সিংকের পাশে একটা ঢাকনাওয়ালা পাত্রে ফেলল লিলি। তিন গোয়েন্দাও তাদের মাস্ক খুলে রাখল। তারপর এসে ঢুকল আবার হলরুমটায়।
এবার শিম্পাঞ্জীগুলো দেখবে, চলো, লিলি বলল।
একটা করিডরের শেষ মাথায় ডাক্তার ক্লডিয়াসের ল্যাবরেটরি। রেডম্যানের ঘরটার চেয়ে বড়। জানালার কাছে একটা খুঁচায় দুটো শিম্পাঞ্জী গম্ভীর হয়ে বসে আছে। খাঁচার ভেতরে নানারকমের খেলনা রয়েছে। ছোট একটা ব্ল্যাকবোর্ড আছে, রঙিন চক দিয়ে ওটাতে লেখে ওরা।
লিলিকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল শিম্পাঞ্জী দুটো। খাঁচার ফাঁক দিয়ে। হাত বের করল বড়টা।
আরে, রাখ, রাখ, খুলছি! এগিয়ে গিয়ে খাঁচার দরজা খুলে দিল। লিলি। শিম্পাঞ্জীটা বেরিয়ে এসে তার হাত ধরল।
ভাল আছিস? জিজ্ঞেস করল লিলি। রাতে ভাল ঘুম হয়েছে?
চোখ বুজে মানুষের মতই মাথা কাত করে সায় জানাল শিম্পাঞ্জীটা। তারপর দেয়ালঘড়ি দেখিয়ে এক আঙুল দিয়ে বাতাসে
একটা অদৃশ্য চক্র আঁকল।
ও, অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছিস।
তিরিং করে মস্ত এক লাফ দিয়ে হাততালি দিল জানোয়ারটা।
দ্বিতীয় শিম্পাঞ্জীটাও বেরিয়ে এসে একটা টেবিলে উঠে বসেছে।
এই, খবরদার! ধমক দিল লিলি।
তাকের ওপর রাখা কেমিক্যালের বোতলগুলোর দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে ওটা। কয়েকবার তাকিয়ে সেদিকে লিলির কোন আগ্রহ
দেখে, লাভ হবে না বুঝতে পেরে টেবিল থেকে খালি একটা বীকার নিয়ে লাফ দিয়ে নামল মাটিতে। খেলতে শুরু করল।
রেফ্রিজারেটর থেকে ফল আর দুধ বের করল লিলি, তাক থেকে বড় বাসন নামাল।
আপনার কথা বোঝে ওরা? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
বোঝে। ইঙ্গিতে অনেক কিছু বোঝাতেও পারে। ডাক্তার ক্লডিয়াস শিখিয়েছেন। বোবা ইস্কুলে যেভাবে সাইন ল্যাঙগোয়েজ শেখানো হয়, তেমনি।
ডাক্তার সাহেব তো নেই, রবিন বলল। এখন এগুলোর কি হবে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল লিলি। জানি না। বোর্ডের মেম্বাররা আগামী মাসে মিটিঙে বসে ঠিক করবেন। কয়েকটা শিম্পাঞ্জী ইতিমধ্যেই মরে গেছে। অনেক দাম দিয়ে কিনে আনা হয়েছিল ওগুলোকে। ছলছল করছে তার চোখ।
টেবিলে খাবার দিল লিলি। ছোট চেয়ারে উঠে বসে খেতে শুরু করল শিম্পাঞ্জীগুলো।
খাওয়া শেষ হলে ওগুলোকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে আবার খাঁচায় ভরল লিলি। চেঁচামেচি, বাদপ্রতিবাদ অনেক করল ওরা, বড়টা তো লিলির হাতই আঁকড়ে ধরে রাখল, খাঁচায় বন্দি থাকতে রাজি নয়।
থাক, কোমল গলায় বলল লিলি, আমি আবার আসব।
একটা ব্যাপার লক্ষ করেছে কিশোর, ল্যাবরেটরিতে ঢোকার পর লিলির আচরণ অন্যরকম হয়ে গেছে। অথচ ম্যাকম্বারের বাড়িতে থাকার সময় মনমরা হয়ে থাকে।
ডাক্তার ক্লডিয়াসকে মিস করছে ওরা, লিলি বলল। আমিও। এখানে ঢুকলে তার জন্যে খারাপ লাগে। খুব ভাল মানুষ ছিলেন। হাসিখুশি। অসুস্থ হয়েও হাসি যায়নি মুখ থেকে।
আগে থেকেই অসুস্থ? কিশোর ধরল কথাটা। আমি তো ভেবেছিলাম, রকি বীচে হঠাৎ করেই স্ট্রোকটা হয়েছে।
হঠাৎ করেই হয়েছে। তবে কিছু কিছু লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। এখানে থাকতেই। চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়তেন। হয়তো শিম্পাঞ্জীগুলো তখন বাইরে রয়েছে, জিনিসপত্র তছনছ করছে, খেয়াল করতেন না। সেদিন তার সঙ্গে আমার যাওয়ার কারণই ছিল এটা। বুঝতে পারছিলাম, একা এতটা পথ যেতে পারবেন না।
কেন গিয়েছিলেন রকি বীচে? এমনি, সাধারণ কথাচ্ছলেই প্রশ্নটা করল কিশোর, কিছু ভেবে নয়।
কিন্তু চমকে উঠল লিলি, লাল হয়ে গেল গাল।
ইয়ে…তিনি…আমি জানি না, আরেক দিকে মুখ ফেরাল লিলি। দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল।
চট করে একে অন্যের দিকে তাকাল মুসা আর কিশোর।
ব্যাপার কি? নিচু গলায় বলল মুসা।
নাক কুঁচকাল কিশোর। মিথ্যে বলছে। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার। কিন্তু কেন? কি লুকানোর চেষ্টা করছে?
পাঁচ
লিভিংরুমে ফিরে দেখা গেল, বিজ্ঞানীদের একজনও নেই। সোফার কভার ঝেড়ে, সোজা করছে মোটা এক মহিলা। কালোচুল এক তরুণ জানালা-দরজার কাঁচ মোছায় ব্যস্ত।
অ, লিলি, মহিলা বলল। তোমার বন্ধু নাকি? ভাল।
মহিলাকে চিনল কিশোর। মিসেস গ্যারেট। মাথায় এখন একটা ছাই-সোনালি উইগ। তবে চোখের পাপড়ি আগেরগুলোই আছে।
ছেলেদের সঙ্গে মহিলার পরিচয় করিয়ে দিল লিলি।
হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে, কিশোরের সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে বিচিত্র শব্দ করল মিসেস গ্যারেট, ছানাকে আদর করার সময় মুরগী যেমন কঁক-কঁক করে অনেকটা তেমনি। তুমি সেই ছেলেটাই তো। খুব ভাল ছেলে। মানুষের খারাপ সময়ে যে উপকার করে সে-ই তো ভাল মানুষ। জানো, তখন হাসপাতালে হালের কথা খুব মনে পড়ছিল। ও, হাল কে চেনো না? হাল গ্যারেট। আমার স্বামী, শেষ স্বামী। ওর মত মানুষই হয় না।
বকবক করে চলল মিসেস গ্যারেট।
কয়েক মিনিটেই জানা হয়ে গেল ছেলেদের, মোট তিনজন স্বামী বদল করেছে মহিলা। প্রথমজন ছিল বীমার দালাল, দ্বিতীয়জন চিত্রপরিচালক, আর তৃতীয়জন, তার পছন্দের মানুষ এবং শেষ স্বামী-একজন পশুচিকিৎসক।
সব মানুষই ভাল হয় না, বলে গেল মিসেস গ্যারেট, সবাই বাঁচে না বেশিদিন। আমার স্বামীদের বেলায়ও তাই হয়েছে। কম বয়েসে মারা গেল। তারপর এসে এখানে হাউসকীপারের চাকরি নিলাম। ডাক্তারগুলোকে প্রথম প্রথম খুব ভয় পেতাম, একেকজনের একেক রকম স্বভাব, অদ্ভুত। আবোলতাবোল বকে, আর সুযোগ পেলেই বসে বসে গালে হাত রেখে ভাবে। বলো দেখি কি কাণ্ড! তবে একবার ওদের স্বভাব বুঝে ফেললে আর কোন অসুবিধে নেই। বলে একটা, করে আরেকটা। ডাক্তার রুডলফের কথাই ধরো। মুখে নিষ্ঠুরতা, পৈশাচিকতা, খুন এসব ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। অথচ একটা মাছি মারতে পারবে না, মারলে কেঁদে বুক ভাসাবে। ডাক্তার হ্যারিসন হয়েছে। তার উল্টো। খুনটুন এসব কথা শুনলেই আঁতকে ওঠে। অথচ যা বদমেজাজী, মানুষ খুন করতেও হাত কাঁপবে বলে মনে হয় না।…লিলি, ওকে তোমার আংকেলের সামনে বেশি যেতে দিও না। কখন যে কি ঘটাবে কে জানে।
আমি বুঝি, মিনমিন করে বলল লিলি।
কাজে মন দিল আবার মিসেস গ্যারেট।
ভেজা ব্রাশ বালতির পানিতে ফেলে ঘুরে দাঁড়াল তরুণ। লিলিকে বলল, আমার সঙ্গে পরিচয় করালে না? এগিয়ে এল।
লজ্জা পেল লিলি। ও, হ্যাঁ, কিশোর, ওর নাম বিল উইলিয়ামস। সেন্টারে কাজ করে, আমার মত।
হেসে হাত বাড়িয়ে দিল বিল। হাই। পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।…লিলি, গতরাতের জন্যে আমি লজ্জিত। টায়ার পাংচার হয়ে আটকে গিয়েছিলাম…আমার জন্যে বেশি অপেক্ষা করোনি তো?
ওসব কথা থাক, বলে ছেলেদের নিয়ে আরেকটা দরজার দিকে রওনা হলো লিলি।
লাইব্রেরিতে ঢুকল ওরা। তারপর ছোট একটা চৌকোনা ঘর পার হয়ে বেরিয়ে এল বাড়ির একপ্রান্তে।
ওখান থেকে পঞ্চাশ মিটার দূরে আস্তাবল। নীরবে সেদিকে এগোল লিলি।
প্রিয় ঘোড়াটার কাছে এসে মেজাজ ভাল হয়ে গেল তার। ঘোড়ার নাম রেখেছে পাইলট। মুসার বেশ পছন্দ হলো নামটা।
গলায় হাত বোলাতে বোলাতে নিচু স্বরে ওটার সঙ্গে কথা বলল লিলি। চারটে আপেল মাটিতে রেখে জিজ্ঞেস করল, ক-টা?
চারবার পা ঠুকল ঘোড়াটা।
লক্ষ্মী ছেলে, বলে চারটে আপেলই পাইলটকে উপহার দিয়ে দিল লিলি।
আস্তাবল থেকে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। লিলি রইল ভেতরে, ঘোড়ার সেবাযত্ন শেষ হতে সময় লাগবে।
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে শহরের দিকে চলল ছেলেরা, খিদে পেয়েছে।
রাস্তায় লোকের ভিড় আরও বেড়েছে। স্ন্যাকসের দোকানের সামনে এসে লাইন দিতে হলো তাদের। সাধারণ হ্যামবার্গার জোগাড় করতেই লেগে গেল এক ঘণ্টার বেশি।
খাওয়া সেরে শহর দেখতে চলল। দোকানিদের দম ফেলার অবকাশ নেই। আগামী দিন গুহামুখ খুলে দেয়া হবে। পিঁপড়ের মত পিলপিল করে বাইরে থেকে আসছে লোক। তাদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সব ক-জন দোকানি। তার ওপর রয়েছে দোকান সাজানোর কাজ। কয়েকটা দোকানের সামনের কাছে বড় করে আঁকা হয়েছে গুহামানবের ছবি, পরনে পশুর ছাল, হাতে মুগুর। একটা দোকানের ছবি তো আরেক কাটি বাড়া। চুল ধরে এক গুহামানবীকে টেনে নিয়ে চলেছে ভয়ানক চেহারার এক উন্মত্ত গুহামানব। প্রায় সমস্ত দোকানের সামনেটাই রঙিন কাগজের ত্রিকোণ পতাকা কেটে সাজানো হয়েছে।
গুহামুখ খোলার অনুষ্ঠান হবে ছোট পার্কটায়। তাই রঙিন বাল্ব দিয়ে সাজানো হচ্ছে গাছগুলোকে। স্ট্যাণ্ডগুলোয় নতুন করে রঙ করা হচ্ছে। অটোমেটিক স্পৃিঙ্কলার সিসটে আছে একটা, নিদিষ্ট সময়ে ওটার ঝাঁঝরিগুলোর মুখ খুলে যায়, বৃষ্টির মত পানি ঝরে পড়ে পার্কের গাছপালার ওপর।
পুরানো রেলস্টেশনের কাছে আস্তানা গেড়েছে এক আইসক্রীম। ফেরিওয়ালা। ছোট ট্রাকে করে আইসক্রীম এনেছে। ভাল বিক্রি।
কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ম্যাকম্বারের গোলাবাড়িতে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা।
সেখানেও উত্তেজনা।
লম্বা, রগ বের হওয়া একজন লোক তার ওঅভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে কাজে ব্যস্ত, যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে করতে বিড়বিড় করছে আপনমনে। ঠিক হচ্ছে না। মোটেই উচিত হচ্ছে না। পস্তাবে, দেখো, পস্তাবে বলে দিলাম।
কাছে এগোল ছেলেরা। উঁকি দিয়ে দেখল, ভ্যানের দেয়াল ঘেঁষে একটা আলমারি বসানো। একটা গ্যাসের চুলা আর ছোট একটা রেফ্রিজারেটরও রয়েছে। আর আছে একটা বিছানা, নিখুঁতভাবে বিছানো। অবাক হয়ে ছেলেরা ভাবল, শুকনো ঢেঙা লোকটা ওই ভ্যানের মধ্যেই বাস করে নাকি?
ছেলেদের দেখে ভ্রুকুটি করল লোকটা। তোমরাও ভাল বলবে না।
চেঁচাতে শুরু করল কে জানি।
ডাক্তার জর্জ হ্যারিসন। জানালাশূন্য নতুন বাড়িটার বাইরে দাঁড়িয়ে মুঠো পাকিয়ে শাসাচ্ছেন কাউকে। চেঁচিয়ে বললেন, তুমি..তুমি একটা। জন্তু!
ডাবলডোর খুলে গেল, দরজায় দেখা দিল ম্যাকম্বার। হাতের শটগান নেড়ে কড়া গলায় বলল, ভাগো! যাও এখান থেকে!
পিছিয়ে এলেন হ্যারিসন। জন্মের পর পরই খাঁচায় ভরা উচিত ছিল তোমাকে, জন্তু কোথাকার। ভেবেছ কি তুমি, অ্যাঁ? তোমার জায়গায় পাওয়া গেছে বলেই কি ওই হাড় তোমার সম্পত্তি? কেন, তোমার জায়গায় আলোও তো আছে, বাতাস আছে, রোদ আছে, ওগুলোও কি তোমার হয়ে গেল? ওই হোমিনিডটা আটকে রাখার কোন অধিকার নেই তোমার।
ভাল হবে না বলে দিচ্ছি, পাল্টা জবাব দিল ম্যাকম্বার।বেআইনীভাবে ঢুকেছ আমার জায়গায়, মাফ করে দিলাম। ভাগো এখন। দেখতে চাইলে কাল এসো। আর সবার মত পাঁচ ডলারের। টিকেট কিনে। যাও।
গলা টিপে ধরেছে যেন কেউ, এমনভাবে ফাঁসাস করে উঠলেন হ্যারিসন। ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে গটমট করে হাঁটতে শুরু করলেন।
হেসে ছেলেদের বলল ম্যাকম্বার, খুব রেগেছে।
উচিত হচ্ছে না! গোঁ গোঁ করে বলল ভ্যানের মালিক।
তোমাকে কে জিজ্ঞেস করছে? ধমক দিল ম্যাকম্বার। তোমার। কাজ তুমি করো। এই যে, ছেলেরা, আসবে নাকি। দেখতে চাও, কেমন সাজিয়েছি?
ঘুরে ভেতরে ঢুকে গেল আবার ম্যাকম্বার।
ছেলেরা গেল তার পেছনে। ভেতরে ঢুকেই হা হয়ে গেল।
জাদুঘর সাজিয়েছে বটে ম্যাকম্বার। বড় বড় ছবি। হাড় আর কঙ্কালের ছবি আছে, এনলার্জ করা ফটোগ্রাফ আছে। আছে নানারকম রঙিন ছবি, আদিম পৃথিবীর প্রাকৃতিক দৃশ্য। জলাভূমি থেকে বাষ্প উঠছে, উঁচু পাহাড় থেকে ঝরে পড়ছে ঝর্না, রুক্ষ সৈকতে ভাঙছে সাগরের ঢেউ-মাথায় ফেনার মুকুট।
ঘরের মাঝখানে অনেকগুলো টেবিল। তার ওপর সাজানো কাঁচের বাক্সে নানারকম প্রতিকৃতি। কোথাও বরফযুগের দৃশ্য, বরফে ঢেকে রেখেছে আমেরিকার একাংশ, কোথাও গলতে শুরু করেছে বরফ। বেরিয়ে পড়েছে গভীর হ্রদ, উঁচু উপত্যকা। একটা বাক্সে দেখা গেল। কয়েকজন উলঙ্গ রেড ইনডিয়ান শীত থেকে বাঁচার জন্যে আগুনের কাছে জড়সড় হয়ে আছে। আরেকটা বাক্সে বিশাল এক রোমশ ম্যামথ। হাতিকে আক্রমণ করেছে গুহামানবের দল।
ক্লাসিক হয়েছে, না? গর্বের হাসি ফুটল ম্যাকম্বারের মুখে। আসল জিনিস ওই ওদিকে।
দরজার ঠিক উল্টো দিকে একটা মঞ্চ তৈরি হয়েছে, চারটে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। মঞ্চের পরে পাহাড়ের উলঙ্গ ঢাল, তাতে রয়েছে সেই গুহামুখটা। উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত প্রবেশপথ।
সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে উঠল তিন গোয়েন্দা। গুহামুখ দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল।
দম বন্ধ করে ফেলল কিশোর।
কেঁপে উঠল রবিন।
পুরো কঙ্কালটা নেই, আংশিক। খুলির বেশির ভাগই রয়েছে, কালের ক্ষয়ে বাদামী, কুৎসিত। বীভৎস ভঙ্গিতে যেন তাকিয়ে রয়েছে শূন্য অক্ষিকোটর। ওপরের চোয়ালটা আছে, মাঢ়ীতে বিকট দাঁতের সারি। গুহার মেঝে থেকে ঠেলে বেরিয়ে আছে মাটিতে গাঁথা পাঁজরের কয়েকটা হাড়। তার নিচে শ্রোণীর হাড়ের খানিকটা, তারও নিচে পায়ের কয়েকটা হাড়। একটা হাতের হাড় লম্বা হয়ে পড়ে আছে, পাঁচ আঙুলের তিনটে উধাও, দুটো রয়েছে একেবারে গুহামুখের ধারে। যেন মৃত্যুর আগে হাত বাড়িয়ে কিছু ধরার চেষ্টা করছিল।
গুহার ছাতে আলো ঝোলানো হয়েছে। কঙ্কালের কাছে জ্বলছে একটা কৃত্রিম অগ্নিকুণ্ড। তারও পরে যেন নিতান্ত অবহেলায় ফেলে রাখা হয়েছে কয়েকটা ন্যাভাজো কম্বল আর ইনডিয়ান কায়দায় তৈরি বেতের ঝুড়ি।
ডাক্তার হ্যারিসনের রাগের কারণ বুঝতে অসুবিধে হলো না ছেলেদের। আদিম রূপ দিতে গিয়ে পুরো ব্যাপারটাকেই হাস্যকর করে তুলেছে ম্যাকম্বার, অনেক কিছু বেমানান। চোখে আরও লাগে কঙ্কালের। চারপাশে আধুনিক বুটের অসংখ্য ছাপ। বোধহয় ইলেকট্রিশিয়ান আর টেকনিশিয়ানদের জুতোর।
কেমন বুঝছ? হেসে জিজ্ঞেস করল ম্যাকম্বার। আচ্ছা, আরেক কাজ করলে কেমন হয়? একজোড়া মোকাসিন যদি রেখে দিই ওটার পায়ের কাছে? ভাবখানা, জুতো খুলে শুয়েছে, ঘুমিয়ে পড়েছে? প্রশ্নের জবাব নিজে নিজেই দিল আবার। না, ভাল হবে না। বেমানান লাগবে।
অস্ফুট শব্দ বেরোল রবিনের মুখ থেকে।
আবার বলল ম্যাকম্বার, আমার মনে হয় না, এত আগে মোকাসিন পরত মানুষ। না?
জবাব দিল না ছেলেরা।
ঘুরে মঞ্চ থেকে নেমে আরেকদিকে রওনা হলো। এক জায়গায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে অনেকগুলো চকচকে রিঙ, তাতে খাটো শেকল দিয়ে আটকানো প্লাস্টিকের গুহামানবের প্রতিকৃতি। কিছু টি-শার্ট আছে, বুকে গুহামানবের ছবি ছাপা।
ওগুলো বিক্রির জন্যে, জানাল ম্যাকম্বার। আজ তো দিতে পারবে না, বিক্রি শুরু হয়নি। কাল এসো।…চলো, বেরোই। সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দরজার দিকে এগোল সে। চলতে চলতেই বলল, দরজায় তালা লাগিয়ে রাখব। রাতে পাহারা দেবে জিপসিটা।
ভ্যানের কাছে যাকে দেখলাম? কিশোর বলল।
হ্যাঁ। ওর নাম ফ্রেনটিস, সংক্ষেপে ফ্রেনি।
বাইরে বেরিয়ে দরজায় তালা লাগাল ম্যাকম্বার। আসলে জিপসি নয় ও
গাড়িতে বাস করে তো, জিপসিদের মত যাযাবর, তাই লোকে ওর নাম রেখেছে জিপসি ফ্রেনি।
নিজের বাড়ির দিকে চলে গেল ম্যাকম্বার।
ভ্যানের দরজা খুলে উঁকি দিল ফ্রেনি। আমাকে দারোয়ান রেখেছে বেতন দিয়ে, বেশ, পাহারা দেব। কিন্তু ভাল করছে না। মানুষটা এসব পছন্দ করবে না। আমার হাড় নিয়ে এসব করলে আমি কি সহ্য করতাম?
কিন্তু ও জানছে কিভাবে? বলল মুসা। ও তো মরা, তাই না? ওকে নিয়ে কে কি করল না করল তাতে ওর কিছুই যায়-আসে না।
তাই নাকি? রহস্যময় শোনাল জিপসির কণ্ঠ।
ছয়
ডিনারও সারতে হলো হ্যামবার্গার দিয়েই। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে আইসক্রীম কিনে খেল তিনজনে। তারপর এসে উঠল গোলাঘরের মাচায়। খোলা জানালা দিয়ে দেখল সূর্যের অস্ত যাওয়া আর চাঁদের উদয়। বাতাস ঠাণ্ডা। তৃণভূমির ওপর হালকা ধোয়ার মত উড়ছে কুয়াশা।
স্লীপিং ব্যাগ টেনে নিল ছেলেরা। ঘুমিয়ে পড়ল।
অন্ধকারে দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল কিশোরের। কে যেন ঢুকেছে গোলাঘরে। ভীত জানোয়ারের মত গোঙাচ্ছে। উঠে বসে কান পাতল সে।
মুহূর্তের জন্যে থামল গোঙানি, তারপর আবার শুরু হলো।
নড়েচড়ে মুসাও উঠে বসল। ফিসফিসিয়ে বলল, কে?
জবাব না দিয়ে মাচার ফোকরের কাছে গিয়ে নিচে উঁকি দিল কিশোর। অন্ধকার।
এই, ছেলেরা, শুনছ? খসখসে ভাঙা কণ্ঠস্বর। আছ ওখানে?
জিপসি ফ্ৰেনি। এগোতে গিয়ে কিসের সঙ্গে পা বেধে ধুড়স করে পড়ল।
ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
টর্চের জন্যে হাত বাড়াল মুসা। স্লীপিং ব্যাগের পাশেই তো ছিল। গেল কই? হাতড়ে হাতড়ে বের করে নিয়ে এসে মই বেয়ে নামল কয়েক ধাপ। নিচের দিকে মুখ করে জ্বালল।
একটা খালি বাক্সে পা লেগে পড়ে গেছে ফ্ৰেনি। উঠে তাকাল আলোর দিকে। তোমরাই তো? কণ্ঠে আতঙ্ক। জবাব দিচ্ছ না কেন? তোমরা তো?
হ্যাঁ, জবাব দিল কিশোর।
মই বেয়ে নেমে এল তিনজনে।
ম্যাকম্বারের পিকআপে হেলান দিয়ে কাঁপছে জিপসি।
কি হয়েছে, জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মড়া…মড়াটা! ভয়ে ভয়ে বলল ফেনি। বলেছিলাম না, পছন্দ করবে না!
হয়েছেটা কি? মুসা জানতে চাইল।
ও উঠে চলে গেছে। কাল যখন গিয়ে দেখবে কঙ্কলটা নেই, আক্কেল হবে ম্যাকম্বারের। দোষ দেবে আমার। বলবে আমি সরিয়েছি। আসলে তো হেঁটে চলে গেছে। নিজের চোখে দেখলাম।
গোলাঘরের দরজা খোলা। পাহাড়ের ঢালে নতুন বাড়িটা, মানে ম্যাকম্বারের মিউজিয়ামটার দিকে তাকাল ছেলেরা। চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছে-দরজা লাগানো। তালা আছে কিনা বোঝা যায় না।
স্বপ্ন দেখেননি তো? মোলায়েম গলায় বলল রবিন।
না, মাথা নাড়ল লোকটা। গাড়ির মধ্যে শুয়ে ছিলাম। দরজা খোলার শব্দ শুনে উঁকি দিয়ে দেখি একটা গুহামানব। গায়ে পশুর ছাল জড়ানো। চোখ দুটোও দেখেছি। ভয়ঙ্কর। সোজা আমার দিকেই চেয়ে ছিল। জ্বলছিল কয়লার মত। লম্বা লম্বা চুল। গাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেল মাঠের দিকে।
চোখ বুজল জিপসি, যেন চোখ বুজলেই স্মৃতি থেকে দূর হয়ে যাবে ভয়ানক দৃশ্যটা।
চলো তো দেখি, কিশোর বলল সঙ্গীদের।
কাছাকাছি রইল ওরা। যেন ভয়, যে কোন মুহূর্তে জীবন্ত হয়ে উঠে। এসে সামনে দাঁড়াবে প্রাগৈতিহাসিক মানুষটা।
দেখা গেল, মিউজিয়ামের দরজা বন্ধ।
কথাবার্তার আওয়াজ শুনে দরজা খুলে বেরোল ম্যাকম্বার। কি হয়েছে? এই, তোমরা এখানে কি করছ?
দেখছি, জবাব দিল কিশোর। আপনার দারোয়ান মাঠের ওদিকে কাকে নাকি যেতে দেখেছে।
মিসেস জেলা ম্যাকম্বারও উঁকি দিল পেছনে।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এগিয়ে এল ম্যাকম্বার। কি হয়েছে? ফ্রেনিকে জিজ্ঞেস করল। হ্যারিসন এসেছিল নাকি?
গুহামানব, বলল জিপসি, চলে গেছে।
কি পাগলের মত বকছ? ধমক লাগাল ম্যাকম্বার। জেলডা, চেঁচিয়ে বলল, চাবি আনো তো।
তালা খুলে মিউজিয়ামে ঢুকল ম্যাকম্বার। আলো জ্বালল। এগিয়ে গেল গুহামুখের দিকে। পেছনে চলল ছেলেরা।
কই, ঠিকই তো আছে। আগের মতই তাকিয়ে আছে শূন্য কোটর। বিকট নীরব হাসিতে ফেটে পড়ছে যেন একটিমাত্র চোয়াল। বুকের পাঁজর, হাত-পায়ের হাড়, সব ঠিক আছে।
জিপসির দিকে ফিরল ম্যাকম্বার। কি দেখেছ? এই তো, কঙ্কাল তো এখানেই।
হেঁটে গেছে! বিড়বিড় করল ফ্রেনি। আমি দেখেছি। গায়ে পশুর ছাল। বড় বড় চুল। হেঁটে চলে গেল মাঠের ওপর দিয়ে।
তোমার মাথা। যত্তোসব।
আলো নিভিয়ে সবাইকে নিয়ে মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে এল ম্যাকম্বার। যাও, ভালমত পাহারা দাও, ধমক দিয়ে বলল ফ্রেনিকে।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখার জন্যে বেতন দিই না আমি তোমাকে।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল আবার জেলডা আর ম্যাকম্বার।
আপনমনে কি বলতে বলতে ভ্যান থেকে একটা ফোল্ডিং চেয়ার বের করল জিপসি। শটগান হাতে পাহারায় বসল।
গোলাঘরে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা।
নিশ্চয় স্বপ্ন দেখেছে, মুসা মন্তব্য করল।
বোকা মনে হয় লোকটাকে, বলল রবিন।
আমার মনে হয় না, মাথা নাড়ল কিশোর।
তাহলে সত্যি দেখেছে কিছু?
হতে পারে। হয়তো কেউ বেরিয়েছিল মিউজিয়াম থেকে।
কিভাবে? মুসার প্রশ্ন। দরজায় তালা ছিল।
চাবি জোগাড় করে নিয়েছে, স্লীপিং ব্যাগের ওপরে বসে খোেলা জানালা দিয়ে চন্দ্রালোকিত মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। রাতের আকাশের পটভূমিকায় ওপাশের বনকে ঘন কালো দেখাচ্ছে। চাঁদের আলোয় সাদা লাগছে ঘাসের ওপরে জমা শিশিরকে, যেন সাদা চাদর। তাতে কালো কালো ছোপ এক সারিতে এগিয়ে গেছে বনের দিকে।
এর একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে, ভাবল কিশোর। হেঁটে গেছে। কেউ। পায়ের চাপে ঘাস বসে গেছে, শিশির ঝরে গেছে ওখান থেকে। ফলে কালো দেখাচ্ছে।
নামতে গিয়েও থেমে গেল কিশোর। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে জিপসি ফ্ৰেনি। বগলে শটগান। মাঠের দিকে ফিরে কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করছে।
ভ্যানে গিয়ে ঢুকল ফ্রেনি। বেরিয়ে এল একটা কম্বল নিয়ে। ভাল করে গায়ে জড়িয়ে আরাম করে বসল চেয়ারে।
ফ্রেনির বিশ্বাস, সে গুহামানব দেখেছে, আনমনে বলল কিশোর।
বাইরে তাকাল মুসা। জ্যোৎস্নায় আলোকিত তৃণভূমির দিকে চেয়ে অস্বস্তি জাগল মনে। ওকে দোষ দেয়া যায় না। বেশি ভয় পেলে জেগে থেকেও দুঃস্বপ্ন দেখে মানুষ।
সাত
পরদিন শনিবার।
আগে ঘুম ভাঙল কিশোরের, মাচা থেকে নেমে বেরিয়ে এল গোলাঘরের বাইরে। উজ্জ্বল রোদে এখন আর রাতের মত কালো দেখাচ্ছে না বন, রহস্যময় লাগছে না। তৃণভূমির ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল সে। মাটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। কিন্তু একটা পায়ের ছাপও চোখে পড়ল না। কালো দাগগুলোও মুছে গেছে নতুন করে শিশির জমায়।
তিরিশ মিটারমত এগিয়ে দেখল এক জায়গায় ঘাস বেশ পাতলা। কালো মাটি দেখা যায়। হাঁটু গেড়ে বসে ভালমত দেখে কেঁপে উঠল উত্তেজনায়।
মুসা এসে যখন তার পাশে দাঁড়াল, তখনও একইভাবে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর।
কী? জিজ্ঞেস করল মুসা। কিছু পেলে?
পায়ের ছাপ। এখান দিয়ে হেঁটে গেছে কেউ, খালি পায়ে। বেশিক্ষণ হয়নি।
ঝুঁকে মুসাও দেখল ছাপ। সোজা হয়ে তাকাল বনের দিকে। চেহারা ফ্যাকাসে।
খালি পায়ে!…তারমানে জিপসি সত্যি দেখেছিল…
জবাব দিল না কিশোর। উঠে হাঁটতে শুরু করল বনের দিকে।
কিছুই না বুঝে তার পিছু নিল মুসা।
মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটছে কিশোর। ধীরে ধীরে আবার ঘন হয়ে এসেছে ঘাস, আর একটা ছাপও চোখে পড়ল না তার। বনের কিনারে চলে এসেছে। গাছের নিচ দিয়ে চলে গেছে পায়ে চলা পথ। সেখানে ছাপ নেই। ঘন হয়ে বিছিয়ে রয়েছে পাইনের কাটা।
এখানে দেখা যাবে না, বলল কিশোর। আরও এগোলে…
এক মিনিট, বাধা দিয়ে বলল মুসা। এখনি যাবে? হয়তো ঝোঁপের মধ্যে এখনও লুকিয়ে রয়েছে…আমি বলি কি চলো আগে কিছু। খেয়ে আসি? বেলা হলে, ভিড় বেড়ে গেলে হয়তো পাওয়াই যাবে না কিছু। শেষে না খেয়ে মরব।
মুসা, এটা খুব জরুরী! বলল কিশোর।
কার জন্যে? চলো, আগে পেট ঠাণ্ডা করি। বনের ভেতর। সারাদিনই খোঁজা যাবে, সময় তো আর চলে যাচ্ছে না।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফিরতে হলো গোয়েন্দাপ্রধানকে।
গোলাঘরের কাছে পৌঁছুল ওরা। ম্যাকম্বার বেরোল। মর্নিং, বয়েজ। দারুণ সকাল, তাই না? মনে হচ্ছে, মিউজিয়ামে আজ দিনটা কাটবে ভাল। ভ্যানের দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে ডাকল, অ্যাই, ফ্রেনি।
দরজায় দেখা দিল জিপসি। হাতে খাবারের প্লেট।
আর গুহামানব দেখেছ, রাতে? হেসে জিজ্ঞেস করল ম্যাকম্বার।
না। একটাই যথেষ্ট, ভেতরে ঢুকে গেল ফ্রেনি।
রেগে উঠল ম্যাকম্বার। অ্যাই, আবার ঢুকলে যে? এখনও খাওয়াই শেষ করোনি, কাজ করবে কখন?
ওদের কথা শোনার জন্যে আর দাঁড়াল না তিন গোয়েন্দা, চলল শহরের দিকে।
কাফের সামনে ভিড় হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই।
অনেক কষ্টে গুতোগুতি করে ভেতরে ঢুকে তিনটে চেয়ার দখল করল ছেলেরা। খাবারের অর্ডার দিল। লোকের কোলাহল ছাপিয়ে কানে আসছে ব্যাণ্ডবাদকদের বাজনা, মহড়া দিচ্ছে। মেইন রোডে গাড়ির সারি। কয়েকটা টেলিভিশন স্টেশনের ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে পার্কের একধারে।
খাবার এল। চামচ দিয়ে সবে মুখে তুলেছে ছেলেরা, এই সময় ঢুকলেন ডাক্তার রুডলফ। সঙ্গে ডাক্তার রেডম্যান, ইমিউনোলজিস্ট। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিশোরের ওপর চোখ পড়তেই হাসলেন রুলফ।
ওঁদের এখানে বসতে বললে কেমন হয়? বন্ধুদের পরামর্শ চাইল কিশোর।
ভাল, মুসা বলল। জিজ্ঞেস করো আগে, বসবেন কিনা।
উঠে গিয়ে আমন্ত্রণ জানাল কিশোর। সানন্দে রাজি হলেন দুই ডাক্তার। কোন টেবিল খালি নেই, জায়গা পেয়ে খুশিই হলেন।
থ্যাংক ইউ, বসতে বসতে বললেন ডাক্তার রুডলফ।
পাগল খানা হয়ে গেছে শহরটা। কতদিন এরকম থাকবে কে জানে। আমার মনে হয় সারাটা গরমই এভাবে যাবে। শীত পড়লে, তারপর গিয়ে কমতে শুরু করবে লোক। খানিকটা মাখন নিজের প্লেটে তুলে নিয়ে বললেন, এমনিতে সেন্টারেই নাস্তা সারি আমরা। কিন্তু আজকাল হ্যারিসনের যা মেজাজ-মরজি। তার সঙ্গে বসে খেয়ে আর আরাম নেই। ওর দুঃখটাও বুঝি। হাতের কাছে রয়েছে গবেষণার এমন লোভনীয় জিনিস, অথচ হাত লাগাতে পারছে না…
হ্যাঁচচো করে উঠলেন রেডম্যান। নাকচোখ মুছে ছেলেদের দিকে চেয়ে হাসলেন, সর্দির জ্বালায় আর বাঁচি না। রুডলফের দিকে ফিরে বললেন, যা-ই বলল, হ্যারিসন বাড়াবাড়িই করছে।
মাথা খারাপ হয়ে গেছে বেচারার, নরম গলায় বললেন রুডলফ। প্রায় আস্ত একটা কঙ্কাল, অথচ ছুঁতে দেয়া হচ্ছে না ওকে, কল্পনা। করো। ওর জায়গায় আমি হলে আমারও একই অবস্থা হত।
ডাক্তার হ্যারিসন কি করতে চাইছেন? জিজ্ঞেস করল রবিন। কার্বন ফরটিন টেস্ট?
কার্বন ফরটিন দিয়ে বোধহয় কাজ হবে না এটাতে। বুঝিয়ে বললেন রুডলফ, কার্বন ফরটিন রেডিওঅ্যাকটিভ এলিমেন্ট, প্রাণীর হাড়ে থাকে। জীব বা উদ্ভিদ মারা যাওয়ার সাতান্নশত বছর পরে হাড়ে এই এলিমেন্ট কমে অর্ধেক হয়ে যায়। আরও সাতান্নশো বছর পরে তার অর্ধেক। এভাবে কমতে কমতে চল্লিশ হাজার বছর পরে হাড়ে কার্বন আর থাকেই না। তখন পরীক্ষা করেও আর কিছু বোঝা যায় না।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল রবিনের। আপনার কি ধারণা ফসিলটার বয়েস চল্লিশ হাজারের বেশি?
হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বয়েস কত, সেটা বোঝার আরও উপায় আছে, কার্বন ফরটিন টেস্ট ছাড়াও। কিন্তু পরীক্ষার জন্যে ল্যাবরেটরিতে তো আনতে হবে…।
ওই যে এসে গেছে আমাদের নাস্তা, ওয়েইট্রেসকে দেখে বলে উঠলেন রেডম্যান। যাক, বাবা, পাওয়া গেল।
কিছুক্ষণ নীরবতা। চুপচাপ খাচ্ছে সবাই।
আচ্ছা, হঠাৎ জিজ্ঞেস করল কিশোর, ডাক্তার ক্লডিয়াস কি নিয়ে গবেষণা করতেন?
প্রয়াত বিজ্ঞানীর কথা উঠতেই গম্ভীর হয়ে গেলেন ডাক্তার রুডলফ। ব্রিলিয়ান্ট লোক ছিল।–মস্ত ক্ষতি হয়ে গেল আমাদের।
হয়তো হয়েছে, কথার পিঠে বললেন রেডম্যান। কিন্তু জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিঙের বিপদও আছে। এটম নিয়ে গবেষণা করে শেষে যেমন এটম বোমা বানিয়ে ফেলা হলো। জিন নিয়ে গবেষণা চালালে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন তৈরি হয়ে যাওয়ার ভয় আছে।
ডাক্তার ক্লডিয়াস নাকি মানুষের দৈহিক উন্নতির চেষ্টা করছিলেন? কিশোর বলল। লিলি বলেছে আমাদের ঘোড়া আর শিম্পাঞ্জীকে নাকি ইতিমধ্যেই অনেক বুদ্ধিমান বানিয়ে ফেলা হয়েছে।
কিছুটা, বললেন রুডলফ।
এসব গবেষণায় শেষকালে ক্ষতিই হয় বেশি, রেডম্যান বললেন। প্রকৃতি যাকে যেভাবে তৈরি করেছে, সেভাবেই থাকতে দেয়া উচিত। নইলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা।
তা ঠিক। কিন্তু ক্লডিয়াসের উন্নতির কথা একবার ভেবে দেখো। ক্ষতি না করে সত্যি সত্যি যদি প্রাণিদেহের উন্নতি করা যায়, কি সাংঘাতিক ব্যাপার হবে! ছেলেদের দিকে ফিরে বললেন রুডলফ,
বেঁচে থাকলে গ্যাসপার পুরস্কার পেয়ে যেত ক্লডিয়াস। এক বছর পর পর দেয়া হয় এই পুরস্কার। দশ লাখ ডলার।
সেটা তো গেল, মুসা মুখ খুলল এতক্ষণে। এরপর কে পাবেন?
ত্যাগ করলেন রুডলফ। কি জানি। পাকস্থলীর আলসার কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়, সেটা নিয়ে গবেষণা করছে রেডম্যান। সফল হলে সে পাবে। কিংবা মানুষের অরিজিন আবিষ্কার করতে পারলে ডাক্তার হ্যারিসন পাবে…
বাঁচবে অনেকদিন, বাধা দিয়ে বললেন রেডম্যান। ওই যে, আসছে।
জানালার দিকে ঘুরে তাকাল অন্যেরা। সোজা কাফের দিকে আসছেন হ্যারিসন।
ভেতরে ঢুকতেই হাত নেড়ে তাকে ডাকলেন রুডলফ।
কিশোরের পাশে একটা খালি চেয়ার টেনে এনে বসলেন। হ্যারিসন। হউফ করে মুখ দিয়ে বাতাস ছেড়ে বললেন, অনেক চেষ্টা করলাম। গভর্নরকে পাওয়া গেল বটে, কথা বলতে পারলেন না। ব্যস্ত। লাঞ্চের পর আবার রিঙ করতে বলেছেন।
গভর্নর এসে কি করবে? গুহা থেকে তোমাকে কঙ্কালটা বের করে এনে দেবে? ঝাঁঝাল কণ্ঠে বললেন রুডলফ।
এই তো, যাচ্ছে লেগে! ঝগড়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি বললেন রেডম্যান, এই, ইউজেন, কি মনে হয় তোমার? কাজ হবে?
কেন হবে না? ভুরু নাচালেন রুডলফ। রাস্তা কিংবা স্কুল বানানোর দরকার হলে তখন তো লোকের জায়গা নিয়ে নেয় সরকার। ফসিলটাকে বাঁচানোর জন্যে কেন পারবে না? গভর্নরকে বলব, এলাকাটাকে রিজার্ভ এরিয়া বলে ঘোষণা করতে। আশপাশে নিশ্চয় আরও ফসিল আছে। ওগুলো নষ্ট হতে দেয়া যায় না… পার্কে ব্যাণ্ড বেজে উঠতেই থেমে গেলেন বিজ্ঞানী।
ঘড়ি দেখলেন রেডম্যান। দশটা বাজতে পাঁচ। অনুষ্ঠানের সময় হয়ে এল। দেরি করে ফেলেছ, ইউজেন। ঠেকাতে পারবে না ওদের।
আট
অনুষ্ঠান শুরু হতে কিছুটা দেরি হয়ে গেল।
তিন ডাক্তার আর তিন গোয়েন্দা পার্কে পৌঁছে দেখল, মঞ্চে উঠে বসেছে ম্যাকম্বার। পাশে তার স্ত্রী জেলডা। পরনে সাদা-কালো প্রিন্টের পোশাক, হাতে কনুই-ঢাকা সস্তা দস্তানা। তার পাশে বসেছে শুকনো এক লোক, গায়ে রঙচঙে জ্যাকেট। কড়া রোদের জন্যে কুঁচকে রেখেছে। চোখ।
ওয়েসলি থারগুড, লোকটাকে দেখিয়ে নিচু কণ্ঠে তিন গোয়েন্দাকে বললেন রুডলফ। এখানকার মেয়র। ওষুধের দোকানটার মালিক। অনুষ্ঠানের সভাপতি। বক্তৃতা দেয়ার খুব শখ।
কালো স্যুট আর পাদ্রীর আলখেল্লা পরা একজন এসে উঠলেন মঞ্চে, মেয়রের পাশে বসলেন। গির্জার পাদ্রী, বুঝতে অসুবিধে হলো না ছেলেদের।
একে একে শহরের আরও কয়েকজন গণ্যমান্য লোক এসে জায়গা নিল মঞ্চে। তাদের মাঝে রয়েছে মোটেলের মালিক, সুপারমার্কেটের ম্যানেজার, এসিসটেন্ট ম্যানেজার। মঞ্চে মহিলা উঠল আরেকজন, এখানকার একমাত্র গিফট শপের মালিক। খাবার বিক্রি করতে করতে দেরি করে ফেলল কাফের মালিক। ছুটে আসতে দেখা গেল তাকে। তারপর এল গ্যারাজের মালিক, সামনের সারিতে জায়গা না পেয়ে মন খারাপ হয়ে গেল তার। অগত্যা বসতে হলো পেছনের সারিতে।
দোকানপাট সব বন্ধ করে দিয়ে এসেছে, রুডলফ বললেন। সারা শহরের লোক এসে জমেছে এখানে। টাকা কামানোর ভাল মওকা পেয়েছে ম্যাকম্বার।
পার্কের ভেতরে লোক গিজগিজ করছে। পা রাখার জায়গা নেই। এদিক-ওদিক চেয়ে কিশোর দেখল, ক্যাম্পফায়ার গার্ল আর বয়স্কাউটদের। আরও রয়েছে জুনিয়র চেম্বার অভ কমার্সের তরুণেরা।
পরনে কালো স্যুট, আর হ্যাঁটে সাদা পালক গোঁজা কয়েকজন জড় হয়ে আছে এক জায়গায়। সেদিকে তাকিয়ে আছে কিশোর, এই সময় পাশে এসে দাঁড়াল মিসেস গ্যারেট। প্রশ্ন না করেই জেনে গেল কিশোর, লোকগুলো নাইটস অভ কলাম্বাস-এর সদস্য।
পার্কের কিনারে ট্রাক এনে দাঁড় করিয়েছে আইসক্রীমওয়ালা। চুটিয়ে ব্যবসা করছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে বেলুনওয়ালা, হাতে একগুচ্ছ গ্যাস-ভর্তি বড় বেলুন। ঘিরে রেখেছে তাকে বাচ্চারা।
যখন বোঝা গেল, মাননীয় আর কেউ আসার নেই, ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়াল মেয়র। গম্ভীর ভঙ্গিতে টোকা দিল মাইক্রোফোনে, হাত তুলে ইশারা করল জনতাকে নীরব হওয়ার জন্যে।
লিলিকে দেখতে পেল কিশোর। মেয়েটার চোখে উৎকণ্ঠা, অধিকাংশ সময়ই যেমন থাকে।।
মাননীয় জনতা! শোনা গেল মেয়রের খড়খড়ে কণ্ঠ।
সম্বোধনের কি ছিরি!–ভাবল কিশোর।
মাননীয় জনতা! আবার বলল মেয়র। দয়া করে থামুন আপনারা, চুপ করুন। আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হতে যাচ্ছে। প্রথমেই অনুরোধ করব, পাদ্রীর দিকে ফিরে একবার মাথা ঝোকাল মেয়র, মিস্টার ডেভিড ব্যালার্ডকে। আমাদের নতুন প্রতিষ্ঠানের জন্যে যেন দোয়া করেন তিনি। তারপর ব্যাণ্ড বাজাবে সেন্টারডেল হাইস্কুলের ছেলেরা, তোমরা। অনুষ্ঠান শেষে মার্চ করে এগোবে, পেছনে দল বেঁধে যাব আমরা। মিউজিয়ম ওপেন করবে আমাদের মিস লোটি হাম্বারসন। থেমে জনতার ওপর চোখ বোলাল মেয়র। লোটি, তুমি কোথায়?
এই যে, এখানে! ভিড়ের মধ্য থেকে বলে উঠল একটা পুরুষকণ্ঠ। লোটি, যাও।
সরে জায়গা করে দিল লোকে। এগিয়ে এসে মঞ্চে উঠল পাতলা একটা মেয়ে, এত রোগা, মনে হয় ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে। মাথায় সোনালি চুল। সে মঞ্চে উঠলে চেঁচিয়ে স্বাগত জানাল জনতা।
হঠাৎ চালু হয়ে গেল পার্কের অটোমেটিক স্পিঙ্কলার সিসটেম, বৃষ্টির মত জনতার ওপর ঝরে পড়তে লাগল পানি।
শুরু হলো চেঁচামেচি, হই-হট্টগোল। ঠেলাঠেলি, হুড়াহুড়ি।
কিশোরের মুখে এসে লাগল পানির ছিটা, মাথা ভিজল, কাপড় ভিজল। মুসার দিকে ফিরল। তাকে অবাক করে দিয়ে হাঁটু ভাজ হয়ে পড়ে যেতে শুরু করল মুসা।
কি ঘটে পুরোটা দেখার সময় পেল না কিশোর, তার দেহও টলে উঠল। বোঁ করে উঠল মাথার ভেতর। মনে হলো শূন্যে ভেসে চলেছে। সে, অনন্ত শূন্য, অসীম অন্ধকার।
শীত শীত লাগল। নড়েচড়ে উঠল কিশোর। ভেজা মাটিতে মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে সে। নাকে সুড়সুড়ে অনুভূতি। চোখ মেলে দেখল, একটা ঘাসের ডগা ঢুকেছে নাকে। থেমে গেছে স্পিঙ্কলার, পানি ছিটানো বন্ধ।
উহহ! গুঙিয়ে উঠল একটা পরিচিত কণ্ঠ।
ফিরে চেয়ে দেখল কিশোর, চোখ মেলছে রবিন। মুসা পড়ে আছে, মাথা ডাক্তার হ্যারিসনের কোমরে ঠেকে আছে।
বিড়বিড় গোঙানী, ফোঁসফোঁস, চিৎকার, নানারকম বিচিত্র শব্দ। একে একে হুশ ফিরছে জনতার।
ঢং ঢং করে বেজে উঠল গির্জার ঘণ্টা, সময় জানাচ্ছে।
চট করে ঘড়ি দেখল কিশোর। আরি! চল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে! এগারোটা বাজে! কোন অদ্ভুত কারণে পুরো চল্লিশটি মিনিট বেহুশ হয়ে ছিল পার্কের লোক।
স্পৃিঙ্কলার সিসটেম! বিড়বিড় করল কিশোর। গোলমালটা ওটাতেই। কোন রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল পানিতে, বেহুশ করার জন্যে।
পার্কের কিনারে চেঁচিয়ে কাঁদছে কয়েকটা বাচ্চা। বেলুনওয়ালার হাতে একটা বেলুনও নেই। গুচ্ছসহ উড়ে গেছে, আকাশের অনেক ওপরে বিন্দু হয়ে গেছে এখন ওগুলো।
মাথা ঝাড়া দিয়ে মাথার ভেতরের ঘোলাটে ভাবটা দূর করার চেষ্টা করল কিশোর। টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়াল। রবিনকে উঠতে সাহায্য করল।
এই সময় ছুটে আসতে দেখা গেল জিপসি ফ্রেনিকে। যেন দিন দুপুরে ভূতে ধরেছে!
মিস্টার ম্যাকম্বার! চেঁচিয়ে উঠল সে। মিস্টার ম্যাকম্বার। সর্বনাশ হয়ে গেছে! গুহামানব!…নেই! চলে গেছে!…নিয়ে গেছে!
নয়
একনাগাড়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে চলল সীমাহীন ব্যস্ততা।
শেরিফের লোকেরা ছবি তুলছে, সূত্র খুঁজছে, পাউডার ছিটিয়ে আঙুলের ছাপ নিচ্ছে। মিস্টার আর মিসেস ম্যাকম্বারের বক্তব্য রেকর্ড করছে টেলিভিশনের লোকেরা। কথা বলবে কি? রাগে, ক্ষোভে পাগল হয়ে গেছে ম্যাকম্বার। মাথার চুল ছিঁড়ছে, হাত-পা ছুড়ছে থেকে থেকেই।
ডাক্তার হ্যারিসনের সাক্ষাৎকার নিল রিপোর্টাররা। ম্যাকম্বারের মত এতটা না হলেও তিনিও অস্থির।
মেয়রের সাক্ষাৎকার নিল। এমনকি জিপসি ফ্রেনিকেও ঘেঁকে ধরল টেলিভিশন আর খবরের কাগজের রিপোর্টাররা।
কি জানি এল! জানাল জিপসি। পাহারা দিচ্ছিলাম, মিস্টার ম্যাকম্বারের কথামত। পেছনে আওয়াজ শুনে ফিরে চাইলাম…আরিব্বাবা, দেখি কি, সাংঘাতিক এক জীব! একচোখা! এত বড় চোখ!…আর, হাতির মত দাঁত। মানুষ না, বুঝেছেন, মানুষ হতেই পারে না। তারপর আর কিছু মনে নেই। চোখ মেলে দেখলাম, মাটিতে পড়ে আছি। মিউজিয়ামের দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকে দেখি, মড়াটা নেই! গায়েব!
বেশি টেনে ফেলেছে, ভিড়ের ভেতর থেকে বলল একজন।
কিন্তু মদ স্পর্শও করেনি ফ্রেনি। আর গুহামানবের কঙ্কাল গায়েব, এটাও সত্যি।
সাক্ষাৎকার নিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে গেল রিপোর্টাররা।
দু-জন লোককে পাহারায় রেখে শেরিফও চলে গেল।
ধীরে ধীরে কমে এল জনতার ভিড়। যাকে দেখতে এসেছিল, সে-ই নেই, থেকে আর কি করবে?
ডেপুটি শেরিফের সঙ্গে কথা বলছে ম্যাকম্বার।
কাছাকাছিই ছিল তিন গোয়েন্দা, ভিড় কমলে এগোল মিউজিয়ামের দিকে।
সরি, বয়েজ, ছেলেদের দেখে বলল ডেপুটি শেরিফ। ভেতরে ঢুকতে পারবে না।
ডাবলডোরের ফাঁক হয়ে থাকা পাল্লার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, চাবি ছিল লোকটার কাছে, না? যে কঙ্কাল চুরি করেছে?
বিস্ময় ফুটল ডেপুটির চোখে। চট করে তাকাল একবার খোলা। দরজার দিকে।
দরজায় কোন দাগটাগ নেই তো, তাই বলছি, বুঝিয়ে বলল কিশোর। তারমানে, তালা কিংবা কজা ভেঙে ঢোকেনি চোর। তাহলে দাগ থাকতই।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল ডেপুটি শেরিফ, বোধহয় ভাবল ছেলেটার নজর বড় কড়া, গুরুত্বপূর্ণ আরও কিছু চোখে পড়ে যেতে পারে। তাই হেসে সরে দাঁড়াল। অল রাইট, শার্লক হোমস। ভেতরে গিয়ে দেখার খুব ইচ্ছে? যাও, দেখে বলো আমাকে যা। যা বোঝে।
মিউজিয়ামের ভেতরে গিয়ে ঢুকল তিন গোয়েন্দা।
ভেতরের জিনিসপত্র যেমন ছিল, তেমনই আছে, নাড়াচাড়া বিশেষ হয়নি। তবে সব কিছুর ওপরই কালি আর পাউডারের আস্তর। ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টদের কাজ। আঙুলের ছাপ খুঁজেছে।
সারা ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে, আলোকিত গুহার ভেতরে এসে উঁকি দিল কিশোর। এখানেও সব কিছু আগের মতই আছে, শুধু কঙ্কালটা নেই। ওটা যেখানে ছিল সেখানকার মাটিতে গর্ত, দাগ, এলোমেলো আলগা মাটি ছড়িয়ে আছে। এখানেই এক জায়গায় একটিমাত্র পায়ের ছাপ চোখে পড়ল, বিশাল ছাপ।
রাবারসোল জুতো পরেছিল, আনমনে বলল কিশোর। ম্যাকম্বারের ছিল কাউবয় বুট, আর জিপসি ফ্রেনির পায়ে লেইসড-আপ জুতো, চামড়ার সোল। চোরের পায়ে ছিল স্বীকার জাতীয় কিছু, সোল আর গোড়ালিতে তারা তারা ছাপ।
মাথা ঝাঁকাল ডেপুটি। ঠিকই বলেছ। জুতোর ছাপের ছবি তুলে নেয়া হয়েছে। কাজে লাগতে পারে ভেবে।
পকেট থেকে ফিতে বের করে ছাপ মাপতে বসল কিশোর। বারো। ইঞ্চি। লম্বা লোক, মন্তব্য করল সে।
হাসি ফুটল ডেপুটির মুখে। বাহ, ভালই তো, কাজ দেখাচ্ছ। গোয়েন্দা হওয়ার ইচ্ছে?
হয়েই আছি, ব্যাখ্যা করার দরকার মনে করল না কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। এত কষ্ট করে এত সব কাণ্ড করতে গেল কেন চোর? স্পৃিঙ্কলার সিসটেমে কেমিক্যাল ঢেলে দিয়ে ঘুম পাড়াল পুরো শহরকে…
ঠিকই বলেছ, কথার মাঝে বলল ডেপুটি, মনে হয় কেমিক্যালই ঢেলেছে। পানির স্যাম্পল নিয়ে ল্যাবরেটরি টেস্টের জন্যে পাঠানো হয়েছে। পানির ট্যাংকও পরীক্ষা করা হবে। ওখান থেকেই স্পিঙ্কলারে পানি যায়।
সাইন্স ফিকশন সিনেমার মত লাগছে, বলল কিশোর। পুরো শহরকে ঘুম পাড়িয়ে বিকট জন্তুর রূপ ধরে গিয়ে চড়াও হয়েছে জিপসি ফ্রেনির ওপর। তাকেও ঘুম পাড়িয়েছে কোনভাবে। কিংবা হয়তো পার্কের রাসায়নিক বাস্পই বাতাসে ভেসে গিয়ে লেগেছে তার নাকে। যেভাবেই হোক, বেহুশ হয়েছে। চোর তারপর আরামসে মিউজিয়ামে ঢুকে কঙ্কালটা তুলে নিয়ে চলে গেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, কেন? সাধারণ লোকের কাছে ওই হাড়ের কোন মূল্য নেই। দর্শকদের কাছ থেকে পয়সা আদায় করা যায়, তবে যেখানে যে অবস্থায় পাওয়া গেছে, সেভাবে থাকলে। ওই হাড়ের ওপর দু-জনের আগ্রহ বেশি। একজন হ্যারিসন, অন্যজন ম্যাকম্বার। কিন্তু চুরিটা যখন হয়, তখন দু-জনেই পার্কে বেহুশ হয়ে পড়ে ছিল।
সোনা চুরি যায়, অলঙ্কার চুরি যায়, মুখ বাঁকাল ডেপুটি, কিন্তু হাড়ি চুরি যেতে দেখলাম এই প্রথম।
কিশোর, রবিন বলল, কি মনে হয়? চোরকে ধরতে পারবে?
চুপ করে রইল কিশোর। ভাবছে।
রবিনের প্রশ্নের জবাব দিল ডেপুটি, অনেক চুরিরই সমাধান হয় না। রহস্য রহস্যই থেকে যায়। এটাও তেমনই কিছু হবে। পুরানো কয়েকটা হাড়ের পেছনে সময় নষ্ট করবে কে?…চলো, বেরোই। আর কিছু দেখার নেই।
ডেপুটির পিছু পিছু বেরিয়ে এল ছেলেরা।
গোলাঘরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে ম্যাকম্বার। কাছেই রয়েছে জেলা আর লিলি। লিলির হাতে চিঠিপত্রের বাণ্ডিল আর একটা ম্যাগাজিন। এইমাত্র ডাকে এসেছে।
ম্যাকম্বারের হাতে একটা চিঠি। চেহারা থমথমে।
ডেপুটি আর ছেলেরা কাছে যেতেই নড়ে উঠল ম্যাকম্বার। চিঠিটা ডেপুটির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, পড়ন! পড়ে দেখুন! রাগে খসখসে হয়ে গেছে কণ্ঠস্বর।
চিঠিটা হাতে নিল ডেপুটি।
দেখার জন্যে কাছে ঘেঁষে এল ছেলেরা।
কাগজটায় উজ্জ্বল রঙে বড় বড় অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা:
আমার কাছে আছে গুহামানব।
ফেরত চাইলে ১০,০০০ ডলার লাগবে।
টাকা না দিলে এমন জায়গায় লুকাব,
কোনদিনই আর খুঁজে পাবে না।
পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় থাকো।
চারটে শব্দের বানান ভুল, বিড়বিড় করল কিশোর। তবে একটা ব্যাপার শিওর হওয়া গেল, টাকার জন্যে চুরি করেছে ওই হাড়।
দশ
দশ হাজার! চেঁচিয়ে উঠল লিলি।
নাক দিয়ে বিচিত্র শব্দ করল ম্যাকম্বার। হারামজাদাকে ধরতে পারলে… দাঁতে দাঁত চাপল সে।
এ ম্যাকম্বারের কাছ থেকে খামটা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল ডেপুটি। ডাকঘরের ছাপ দেখল.। নোটটা পড়ল আরেকবার।
ব্যাটা ইংরেজিতে কাঁচা, বলল সে। বানান ভুল দেখছ না। তবে ভেবেচিন্তে কাজ করে। চিঠি পোস্ট করে দিয়েছে গতকালই, সেন্টারডেল থেকে। চিঠিটা পকেটে রাখল।মিস্টার ম্যাকম্বার, মিউজিয়ামের চাবি কার কাছে?
পকেট থেকে চাবির গোছা বের করে দিল ম্যাকম্বার। আরেক গোছা আছে রান্নাঘরের বোর্ডে ঝোলানো। লিলি, দেখ তো গিয়ে আছে কিনা।
বাড়ির দিকে চলে গেল লিলি। খানিক পরেই উত্তেজিতভাবে ফিরে এসে জানাল, নেই। চাবির রিঙে ট্যাগ লাগানো থাকে তো। চোরের বুঝতে অসুবিধে হয়নি…
কোনটা কোন তালার চাবি, লিলির বক্তব্য শেষ করে দিল। ডেপুটি। দরজা খোলা রেখেছিলেন, তাই না, মিস্টার ম্যাকম্বার? বিড়বিড় করে নিজেকেই যেন বোঝাল, রাখবেনই তো। এ শহরের সবাই রাখে। ঘরে ঢুকে চাবি বের করে আনতে কোন অসুবিধে হয়নি চোরের।
খুব হতাশ হয়ে ঘরে ফিরল ম্যাকম্বার দম্পতি।
গোলাঘরের মাচায় চড়ে জানালার ধারে বসল তিন গোয়েন্দা।
ভাবছি, কিশোর বলল, চাবি যে রান্নাঘরে থাকে, চোর সেটা কিভাবে জানল?
সে-ই জানে, বলল মুসা। তাছাড়া জানার দরকারই বা কি? লোকে রান্নাঘরেই চাবি রাখে বেশি। আর দরজাও যখন ভোলা রাখে। এখানকার লোকে…
সহজেই যে-কেউ ঢুকে নিয়ে যেতে পারে, এই তো? আরও একটা ব্যাপার বেশ অবাক লাগছে। গুহার মধ্যে জুতোর ছাপ।
ভুরু কোঁচকাল রবিন। তাতে অবাক হওয়ার কি আছে? টেনিশ শূ কিংবা রানিং পরেছিল চোর। তাতে কি?
গতরাতে গুহার ভেতরে কি কি ছিল মনে আছে? কিশোর বলল। ম্যাকম্বার যখন দেখাচ্ছিল আমাদেরকে?
মুসা আর রবিন দু-জনেই অবাক হলো।
হাড়ের আশপাশের মাটি মাড়ানো ছিল। চোখ বন্ধ করে দৃশ্যটা মনে করার চেষ্টা করছে যেন কিশোর। তারপর, রাতে দুঃস্বপ্ন দেখল জিপসি ফ্রেনি। বলল, গুহা থেকে বেরিয়ে গেছে গুহামানব। ম্যাকম্বার মিউজিয়ামের দরজা খুলল। গুহার ভেতরে কঙ্কালটাকে জায়গামতই দেখলাম। তখন কি পায়ের ছাপ ছিল?
ভ্রূকুটি করল দুই সহকারী গোয়েন্দা।
মুসা বলে উঠল, না না, ছিল না, ঠিক বলেছ। তারমানে…তারমানে, মুছে সমান করে ফেলা হয়েছিল।
আসছি। মাচা থেকে নেমে প্রায় দৌড়ে গিয়ে ম্যাকম্বারের ঘরের সামনে দাঁড়াল কিশোর। দরজায় ধাক্কা দিল। জেলডা খুলল। পেছনে উঁকি দিল তার স্বামী। তাদের সঙ্গে কি যেন কথা হলো কিশোরের। আবার মাচায় ফিরে এল সে।
ম্যাকম্বার বলল, সে মোছেনি, জানাল কিশোর। জিপসিকে দিয়েও মোছায়নি।
তাহলে রাতে অন্য কিছু ঢুকে মুছে এসেছে, বলল মুসা। কিভাবে? দরজায় তালা ছিল। যদি-যদি না কঙ্কালটা…অসম্ভব!
তবে, তৃণভূমিতে একটা ছাপ রেখে গেছে, যে-ই হোক, কিশোর বলল। শহরে যাচ্ছি আমি। গতকাল আসার সময় একটা হবি শপ দেখেছি। কিছু জিনিস কিনে আনব। তোমরা এখানেই থাকো, চোখ রাখো।
আবার মই বেয়ে নেমে চলে গেল কিশোর।
ফিরে এল আধ ঘণ্টা পর। হাতে একটা প্যাকেট। প্ল্যাস্টার অভ প্যারিস, বলল সে। পায়ের ছাপের একটা ছাঁচ তৈরি করব।
গোলাঘরের ওয়ার্কবেঞ্চে বসে কাজ শুরু করল সে। ঘরেই পাওয়া গেল রঙের একটা খালি টিন আর কয়েক টুকরো বিভিন্ন মাপের কাঠ।
টিনে প্লাস্টার অভ প্যারিস ঢেলে তাতে পানি মিশাল কিশোর। ছোট একটা কাঠের দণ্ড দিয়ে ঘুঁটে ঘন কাইমত করল।
কি প্রমাণ করবে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
জানি না, জবাব দিল কিশোর। হয়তো কিছুই না। খালি পায়ে একজন লোক যে হেঁটে গিয়েছিল, আপাতত সেই প্রমাণ রাখব। পরে আর ছাপটা না-ও থাকতে পারে। নষ্ট হয়ে যেতে পারে, মুছে যেতে পারে, কত কিছুই হতে পারে।
ছাপের ছাঁচ তুলতে চলল ওরা।
ওটার পাশে বসে কাজ করে চলল কিশোর।
এত কষ্ট করে কি হবে বুঝতে পারছি না, দেখতে দেখতে বলল মুসা।
হ্যাঁ, কেউ তো আমাদের করতে বলেনি, বলল রবিন। মক্কেল নেই। কিশোর, তোমার কি মনে হয়? ম্যাকম্বার আমাদেরকে ভাড়া করবে?
ওর মত লোককে কি মক্কেল হিসেবে পেতে চায় তিন গোয়েন্দা? পাল্টা প্রশ্ন করল কিশোর।
না, তা অবশ্য চায় না, মুসা হাত নাড়ল। পাজি লোক। ওর বউটাও। ওই দুটোকে সহ্য করে কিভাবে লিলি, বুঝি না।
জোরে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। হবি শপের মালিক মহিলা। লিলির মাকে চিনত। মিসেস অ্যালজেড্ডা নাকি খুব সুন্দরী ছিলেন। জেলড়া তাঁকে দেখতে পারত না। সেই সোধই নাকি নিচ্ছে এখন লিলির ওপর। ম্যাকম্বারও নাকি খুব বাজে ব্যবহার করে লিলির সঙ্গে, মহিলাই বলল। থাকাখাওয়ার টাকা পর্যন্ত নেয়। নিচ্ছে লিলির মা-বাবা মরার পর থেকেই।
বিস্মিত হলো রবিন। তা কি করে হয়? তখন তো বয়েস ছিল মাত্র আট। টাকা দিত কোত্থেকে, কিভাবে? ব্যাংকে টাকা রেখে গিয়েছিলেন। লিলির বাবা-মা?
হলিউডে একটা বাড়ি আছে ওদের। ওটা ম্যাকম্বারই ভাড়া দেয়, টাকাও সে-ই নেয়।
ও। কিন্তু হবি শপের মহিলার মুখ খোলালে কি করে? এত কথা জানলে।
সহজ। জানতে চাইল, আমরা কোথায় উঠেছি। ম্যাকম্বারের মাচার কথা শুনেই গেল রেগে। আমাকে আর প্রশ্ন করতে হলো না। নিজে নিজেই অনেক কিছু বলল। বলল, জিপসি ফ্রেনি লেখাপড়া জানে না। মহিলার সন্দেহ, কোন বেআইনী কাজ করে জিপসি। সেটা জানে ম্যাকম্বার। আর তাই সুযোগ পেয়ে বিনে পয়সায় খাঁটিয়ে নিচ্ছে। লোকটাকে।
তবে চিঠিটা জিপসি লেখেনি, এটুকু শিওর হওয়া গেল। লিখতেই তো নাকি জানে না।
কাউকে দিয়ে লিখিয়ে তো নিতে পারে। তবে মনে হয় না তা করেছে। এত চালাক না সে। আজ সকালে যা করল, সেটাও অভিনয়। মনে হয়নি। সত্যি ভয় পেয়েছিল। তাকে সন্দেহের খাতা থেকে বাদ দিচ্ছি।
তারমানে কেসটা নিচ্ছি আমরা? মুসার প্রশ্ন, আমাদের মক্কেল কে? লিলি?
মক্কেল কি থাকতেই হবে? মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আমাদের কাজ হলো রহস্যের কিনারা করা। অনেক রহস্য আছে এখানে। ফসিল চুরি গেল। স্পৃিঙ্কলার সিসটেমে ওষুধ ঢেলে সারা শহরকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হলো। কোন গোয়েন্দার আগ্রহ জাগাতে এ-ই কি য েই নয়?
রবিন হাসল। যথেষ্টর চেয়েও বেশি। পকেট থেকে নোটবুক আর কলম বের করে লিখতে শুরু করল। মুখে বলল, গুহামানব চুরি। পানিতে রহস্যময় ওষুধ। মুক্তিপণের টাকা চেয়ে চিঠি, লেখায় বানান ভুল। তবে সেটা ইচ্ছে করেও করে থাকতে পারে, বিশেষ কারও ওপর সন্দেহ ফেলার জন্যে। মুখ তুলল হঠাৎ। হ্যারিসন? কঙ্কালটা হয়তো তিনিই চুরি করেছেন। তারপর মুক্তিপণের টাকা চেয়ে নোট পাঠিয়েছেন। চুরির উদ্দেশ্য অন্যরকম বোঝানোর জন্যে।
চুরিটা যখন হয়, মুসা মনে করিয়ে দিল, তখন তিনি আমার পাশে বেহুশ হয়ে ছিলেন। আমার পরে ঘুম ভেঙেছে তাঁর। কাকে সন্দেহ করব? পুরো শহরই তো তখন পার্কে ঘুমিয়েছিল।
সবাই যে ছিল অনুষ্ঠানে, শিওর হচ্ছি কি করে? প্রশ্ন রাখল কিশোর। এত লোকের মধ্য থেকে কোন একজন সহজেই সরে পড়তে পারে।
চুপ, সাবধান করল রবিন। লিলি আসছে।
ফিরে দেখল কিশোর, মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে আসছে মেয়েটা। তাড়াতাড়ি জিনিসপত্রগুলোকে আড়াল করে বসল সে, ছাঁচটা যাতে লিলির চোখে না পড়ে। ও এলে হেসে বলল, এই যে, আপনিও এসেছেন।…আমরা চুরির ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম।
মাথা ঝাঁকাল লিলি। এখানে অনাহূত কিনা বোঝার চেষ্টা করল। চোখে সেই চিরন্তন অস্বস্তি। বসল তিন গোয়েন্দার দিকে মুখ করে। আমি সেন্টারে যাচ্ছি। ভাবলাম, তোমরাও যদি আসো…দেখতে চাও…
গেলে তো ভালই হয়, কিশোর বলল। কিন্তু…
ইচ্ছে না থাকলে এসো না, বাধা দিয়ে বলল লিলি। ভাবলাম, হয়তো বসে বসে বিরক্ত হচ্ছ, কিছু করার নেই… সামান্য উসখুস করে বলল, আসলে…দশ হাজার ডলার। অনেক টাকা। আঙ্কেল ম্যাকম্বার কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করেছেন, কিভাবে জোগাড় করা যায়..
এত ভাবনার কিছু নেই তার, রবিন বলল। জ্যান্ত মানুষ ধরে নিয়ে গিয়ে তো আর জিম্মি করেনি।
না, তা করেনি। তবে ভীষণ খেপে গেছে আঙ্কেল। আমার ভয় করছে। তার অনেক টাকার ক্ষতি! সবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করেছে।
কিন্তু আপনার তো কোন দোষ নেই, বলল কিশোর।
দোষটা টাকার। অনেক টাকা আসত কঙ্কালটা দেখাতে পারলে। হার্ডঅয়্যারের দোকান থেকে তার একআনাও আসে না।
দোকানে যান নাকি?
যাই, যখন সেন্টারে কাজ থাকে না। বেচাকেনায় সাহায্য করি। তবে বাধ্য হয়ে যেতে হয়, ভাল লাগে না একটুও। ভাল লাগে সেন্টারে কাজ করতে। সেখানে কেউ গালমন্দ করে না। ডাক্তার হ্যারিসন মাঝে মাঝে চেঁচায়, হাসি ফুটল লিলির ঠোঁটে, তবে তাতে মনে করার কিছু নেই। ডাক্তারের স্বভাবই ওরকম। এমনিতে খুব ভাল মানুষ। আমাকে প্রায়ই বলে আমার কলেজে ভর্তি হওয়া উচিত, স্যান ডিয়েগোতে, অথবা অন্য কোথাও।
ঠিকই তো। হন না কেন? জিজ্ঞেস করল রবিন।
সেখানে যেতে গাড়ি লাগে। কোথায় পাব? জেলডা আন্টিকে একদিন বলেছিলাম, সোজা মানা করে দিয়েছে। মেয়েমানুষের বেশি পড়ে নাকি লাভ নেই, অযথা টাকা নষ্ট। তাছাড়া, আমার মায়ের পরিণতির কথাও নাকি আমার মনে রাখা উচিত।
মানে? মুসার প্রশ্ন।
মানে, কলেজে গেলেই নাকি নাক উঁচু স্বভাবের হয়ে যায় মেয়েরা। বেশি লেখাপড়া শিখে আমার মার-ও নাকি এমন হয়েছিল। এই শহরে আর মন টেকেনি। চলে গিয়েছিল বড় শহরে। আমার বাবাকে বিয়ে করেছিল। আর সেজন্যেই নাকি কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে ওরা।
গরু নাকি মহিলা! ফস করে বলে ফেলল মুসা।
আচ্ছা, তোমরাই বলল, চোখ ছলছল করছে লিলির, এটা কোন। কথা হলো? এ শহরে থাকলেই যে কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যেত না, তার কোন গ্যারান্টি আছে? আর বলে কিনা, কলেজে গেলে উন্নাসিক হয়। আমি তো দেখেছি আমার মাকে, কত ভাল ছিল। সুন্দরী ছিল। আমার বাবাও ভাল ছিল। খুব সুন্দর শানাই বাজাত। শানাই খুব ভাল লাগে আমার। এখানে তো টিভি আর রেডিও ছাড়া কিছুই নেই। ভাল মিউজিক শোনার উপায় নেই।
থেমে দম নিল লিলি। তারপর আবার বলল, আমি এখান থেকে পালাতে চাই। টাকা জমাচ্ছি। সেন্টারে চাকরি করে যা পাই, তা থেকে। একশো ডলার জমিয়েছি। হলিউডে যে বাড়িটা আছে, সেটার ভাড়া তো আঙ্কেলই নিয়ে যায়, আমার থাকা-খাওয়ার খরচ বাবদ।
কত ভাড়া আসে, জিজ্ঞেস করেছেন কখনও? কিশোর বলল। সব টাকা লাগে আপনার খাওয়ায়? আপনি এখান থেকে চলে গেলে তো বাড়িভাঁড়ার কানাকড়িও পাবে না আপনার আঙ্কেল।
অবাক মনে হলো লিলিকে। কিন্তু আমি তো সেটা করতে পারব না। ভীষণ রেগে যাবে ওরা। আমাকে আর জায়গা দেবে না।
কি হবে তাতে? মুসা বলল। বাড়িভাঁড়ার টাকা দিয়েই তো আপনি চলতে পারবেন।
বলছি বটে পালাব, কিন্তু কোথায়, সেটাও ভাবি। যাওয়ার কোন জায়গা নেই আমার।
কেন, হলিউডে চলে যাবেন, পরামর্শ দিল রবিন। আপনার নিজের বাড়িতে।
তা কি করে হয়? ওটাতে লোক থাকে। তারা যাবে কোথায়? উঠে দাঁড়াল লিলি। ওখানে যেতে পারব না। আগে টাকা জমাই, তারপর দেখি কোথায় যাওয়া যায়।…তা তোমরা আসবে নাকি? যাবে। সেন্টারে?
আপনি যান, বলল কিশোর। গোলাঘরে যেতে হবে আমাদের। কয়েকটা জিনিস নিয়ে, তারপর আসছি।
লিলিকে চলে যেতে দেখল ছেলেরা।
পালানোর সাহস আছে ওর? মুসা বলল।
কি জানি, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। এখানে থাকতেও চায় না, আবার অচেনা জায়গায় যেতেও ভয়।
ছাঁচ তোলার কাজটা শেষ করতে বসল সে।
তৈরি হয়ে গেল ডান পায়ের চমৎকার একটা প্রতিকৃতি।
দারুণ হয়েছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
হুম্ম্, দেখতে দেখতে আপনমনে মাথা দোলাল কিশোর। গুহামানবের পায়ে গণ্ডগোল ছিল।…দেখো, এই যে বুড়ো আঙুল। তারপর অনেক ফাঁক। এর পরে বাকি তিনটে আঙুল। মাঝের দ্বিতীয় আঙুলটা গেল কই? বুড়ো আঙুল আর বাকি তিনটের চাপে পড়ে ওপরে উঠে গিয়েছে। ছাপ পড়েনি মাটিতে।
গুহামানবের ছাপ! অবাক হয়েছে রবিন।
ঠিক মানাচ্ছে না, না? জুতো ঠিকমত পায়ে না লাগলে এবং সেই জুতো অনেক দিন পরলেই কেবল আঙুলের এরকম গোলমাল হয়।
ফিতে বের করে ছাঁচটা মাপল কিশোর। নয় ইঞ্চি।
মিউজিয়ামে চোর যে ছাপ রেখে গেছে, সেটা অনেক বড়, বলল সে। এটা ছোট।
ঢোক গিলল মুসা। তারমানে বলতে চাইছ, এটা গুহামানবের?
গুহামানব মরা, বলল কিশোর। অনেক বছর আগে মরেছে। আর মরা মানুষ কখনও উঠে হাঁটে না। এই ছাপটা আর যারই হোক, মরা মানুষের নয়।
এগারো
আস্তাবলে পাওয়া গেল লিলিকে, ঘোড়ার যত্ন নিচ্ছে। বিল উইলিয়ামও। আছে সেখানে, একটা স্টলে হেলান দিয়ে কাজ দেখছে।
চুরির খবর শুনলাম, তিন গোয়েন্দাকে দেখে বলল বিল। আমার কপাল খারাপ, এমন একটা অনুষ্ঠান মিস করেছি। সর্দিতে কাহিল হয়ে শুয়ে ছিলাম বাড়িতে।
তাই নাকি? বলল কিশোর। এখন কেমন?
অনেকটা ভাল। এসব অসুখ বেশিক্ষণ থাকে না।
পার্কে যা-তা কাণ্ড হয়ে গেল, মুসা বলল। পৌনে এক ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল সবাই।
ঘুম পেয়েছিল, কি আর করবে? রসিকতার সুরে বলল বিল। লিলির দিকে চেয়ে বলল, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলো। আমি যাই। নীরবে চলে গেল সে, রবারসোল জুতোয় শব্দ হলো না।
রানিং শূ পরেছে, নিচু গলায় বলল মুসা।
অনেকেই পরে, লিলি বলল।
ঘোড়ার গা ডলা শেষ করল সে। আস্তাবল থেকে বেরিয়ে ল্যাবরেটরির দিকে রওনা হলো।
সঙ্গে চলল তিন গোয়েন্দা।
ডাক্তার ক্লডিয়াসের ল্যাবরেটরিতে ঢুকল ওরা। লিলিকে দেখে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল শিম্পাঞ্জী দুটো, খাঁচার ভেতরে লাফালাফি শুরু করল।
আরে, থাম, থাম, হাসতে হাসতে বলল লিলি। খুলে দিল খাঁচার দরজা। দুই লাফে বেরিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল শিম্পাঞ্জী দুটো।
হয় ওদের মানুষ হওয়া উচিত ছিল, কিংবা আপনার শিম্পাঞ্জী, হেসে বলল মুসা।
খুব ভাল ওরা, তাই না? কি মিষ্টি। আমাকে খুব ভালবাসে। ডাক্তার ক্লডিয়াসকে আরও ভালবাসত।
না বাসলেই বরং অবাক হতাম, রবিন বলল।
কিশোর কিছুই বলছে না। মরহুম বিজ্ঞানীর ডেস্কের কাছে দাঁড়িয়ে টেবিলের জিনিসপত্র দেখছে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকটা চোখে পড়ল তার। খুলে পাতা ওল্টাতে লাগল। এক জায়গায় এসে আটকে গেল দৃষ্টি।
একটা পাতায় ছাপা রয়েছে, এপ্রিল ২৮। পরের পৃষ্ঠাটায় মে ১৯। মাঝখানের এতগুলো পাতা গায়েব।
বিশটা পৃষ্ঠা নেই, বিড়বিড় করল কিশোর। ইনটারেসটিং। আচ্ছা, মে-র শুরুতে কি মারা গিয়েছিলেন ডাক্তার ক্লডিয়াস?
আরেকদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে লিলি। ইয়েমে-রই কোন একদিন, জোর নেই কণ্ঠে।
পাতাগুলো ছিঁড়ল কেন?
আ-আমি জানি না, একটা শিম্পাঞ্জীকে বাহুতে নিয়ে দোলাচ্ছে লিলি, মানুষের বাচ্চাকে যেভাবে দোলায় মা।
রবিন আর মুসা চেয়ে আছে তার দিকে, সতর্ক, কৌতূহলী দৃষ্টি।
সেদিন রকি বীচে ডাক্তার ক্লডিয়াসের সঙ্গে কেন গিয়েছিলেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর। তার সঙ্গে এই ছেঁড়া পাতার কোন সম্পর্ক আছে?
না।…আমার মনে হয় না।
শিম্পাঞ্জীর কোন ব্যাপার?
হতে পারে। তার কাজকর্মের ব্যাপারে তেমন কিছু জানতাম না, শুধু জানোয়ারগুলোকে দেখাশোনা করতাম। সঙ্গে গিয়েছিলাম, কারণ কারণ তিনি ভাল বোধ করছিলেন না।
হারবারভিউ লেনের কোথায় যেতে চাইছিলেন? কে থাকে ওখানে?
লিলির চোখে অস্বস্তি বাড়ল। কেশে গলা পরিষ্কারের চেষ্টা করল অযথা। দু-গালে অশ্রুধারা।
আজ আমার ভাল্লাগছে না, অবশেষে বলল সে। কিছু মনে কোরো না। তোমরা আজ যাও।
ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে এল ছেলেরা। ওয়ার্করুমে দেখা হলো মিসেস গ্যারেটের সঙ্গে। ছাপার পোশাকের ওপরে দোমড়ানো একটা অ্যাপ্রন পরেছে। মাথায় উইগ-কালো চুলের মাঝে সাদা একটা ব্রেখা।
সব ঠিক আছে তো? হেসে জিজ্ঞেস করল মহিলা।
কিশোরের মনে হলো, বেশি কথা বলা এবং বেশি মিশুক যেহেতু, নিশ্চয় মূল্যবান তথ্য জানাতে পারবে মিসেস গ্যারেট। চেহারাটাকে বিষণ্ণ করে তুলল চোখের পলকে। লিলির মন খারাপ করে দিয়ে এসেছি। ডাক্তার ক্লডিয়াসের কথা তুলেছিলাম। কাঁদতে আরম্ভ করল।
আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মহিলা। ডাক্তারকে খুব ভালবাসত। আমরা সবাই বাসতাম। ভাল লোক ছিল।
লস অ্যাঞ্জেলেসে সেদিন কেন গিয়েছিল, জানেন? মারা গেল যেদিন। কোন আত্মীয় থাকে ওখানে?
জানি না। কথা খুব কম বলত তো, কিছু জানার উপায় ছিল না। আমার মনে হয়, জানোয়ারগুলোর ব্যাপারে কোন কিছু। যা কাণ্ড করত না ওগুলোকে নিয়ে। সন্তানের মত ভালবাসত। কোনটা মরে গেলে দিনের পর দিন তো সন্তানের মত ভাল।কান কিছু। যা কাওছ।
কটা মরেছে?
অনেকগুলো। লাশগুলো কেটে-চিরে দেখত ডাক্তার। জ্যান্ত জানোয়ারের অপারেশনও করত। ওগুলো যখন ঘুমিয়ে থাকত, প্রায়ই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত। কি যেন ভাবল মিসেস গ্যারেট। ওগুলো তখন ঘুমাতও কেন জানি খুব বেশি। এখন অনেক সজীব হয়েছে।
ঝনঝন করে কি যেন ভাঙল হলরুমে।
হায়, হায়, কি ভাঙল। দরজার কাছে ছুটে গেল মহিলা। আরে, বিলি। হাতে জোর নেই?
বেরিয়ে এল বিল উইলিয়ামস। এক হাতে ঝাড়, আরেক হাতে ভাঙা সাদা একটা ডিশ জাতীয় পাত্র। তেমন কিছু নষ্ট করিনি। খালিই ছিল।
খালি ছিল বলে দাম নেই নাকি? আরও হুঁশিয়ার হয়ে কাজ করবে।
ছেলেদের দিকে আলতো মাথা নুইয়ে হাঁটতে শুরু করল বিল।
মার্কেট থেকে ওগুলো কখন আনবে? পেছন থেকে চেঁচিয়ে। জিজ্ঞেস করল মিসেস গ্যারেট।
আমি এখন পারব না! চেঁচিয়েই জবাব দিল বিল। এত ক্যাট ক্যাট করে! চলে গেল দরজার বাইরে।
নাকমুখ কুঁচকে বিচিত্র শব্দ করল মহিলা।
বাইরে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা।
ড্রাইভওয়েতে পার্ক করা আছে একটা পুরানো দুই-দরজার সিডান গাড়ি। তাতে উঠছে বিল। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে অপেক্ষা করল। ছেলেরা কাছে এলে বলল, বুড়ি হলে মেয়েমানুষগুলো একেকটা শয়তান হয়ে যায়, বাঁকা হাসল সে। ছেলেদেরকে লিফট দিতে চাইল।
থ্যাংকস, বলল কিশোর। ওদিকে যেতে চাই না। দেখল, পেছনের সীটে গাদাগাদি হয়ে আছে ম্যাগাজিন, কাদামাখা বুটজুতো, দোমড়ানো একটা কাগজের বাক্স, একটা স্কুবা মাস্ক, আর একটা ওয়েট স্যুট।
মাথা ঝাঁকিয়ে, গাড়ি নিয়ে চলে গেল বিল।
বড় বেশি আজেবাজে কথা বলে, তিক্ত কণ্ঠে বলল মুসা। একজন মহিলাকে শ্রদ্ধা করতে জানে না। ওর মা বুড়ো হয়নি?।
হুঁ! মুসার কথা কিশোরের কানে গেছে বলে মনে হলো না। খানিক আগে মিসেস গ্যারেটের সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে ভাবছে।
ডাক্তার ক্লডিয়াস এতটা চাপা স্বভাবের না হলে ভাল হত, অবশেষে বলল সে। রকি বীচে কেন গিয়েছিলেন, মিসেস গ্যারেটকে একথা বললে, আমরা জানতে পারতাম। পেটে কথা থাকে না মহিলার। ওদিকে লিলি হয়েছে উল্টো। কথাই বের করা যায় না তার কাছ থেকে। আমি শিওর, লিলি অনেক মিথ্যে কথা বলেছে। কেন? কি গোপন করছে?
গুহামানব সম্পর্কে কিছু? রবিন বলল।
কে জানে?
গোলাঘরের কাছে পৌঁছে জেলডাকে পেছনের বারান্দায় দেখল কিশোর।
গোলাঘরের দিকে চলল ওরা।
ওখানে পৌঁছে জেলডাকে দেখা গেল তার বাড়ির পেছনের বারান্দায়।
ছেলেদের দেখেই চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, লিলিকে দেখেছ?
দেখেছি, জবাব দিল রবিন। সেন্টারে।
হুম। হতচ্ছাড়া জানোয়ারগুলোর কাছে। সুযোগ দিলে এই ঘরের মধ্যেই এনে তুলত ওগুলোকে। সাফ বলে দিয়েছি, ভাড়া দিতে না পারলে এখানে কারও জায়গা হবে না।
তা তো নিশ্চয়ই, মোলায়েম স্বরে বলল কিশোর। আচ্ছা, ম্যাডাম, স্পিঙ্কলার সিসটেমের পানি যে নিয়ে গেছে পরীক্ষা করতে, করেছে? কোন খবর এসেছে? কিছু পাওয়া গেছে?
পাওয়া যায়নি। ট্যাংকের পানিতেও না, স্পৃিঙ্কলারেও না! শেরিফ তো অবাক। বলল, সারা শহর নাকি পাইকারী সম্মোহনের শিকার হয়েছিল।
বারো
জেলা ম্যাকম্বার ভেতরে চলে যেতেই চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ছাড়ল কিশোর। পাইকারী সম্মোহনে আমার বিশ্বাস নেই। মরহুম বিজ্ঞানীও অস্থির করে তুলেছে আমাকে।
মরা মানুষেরা অস্থির করেই, মুসা বলল। সেজন্যেই তো ওদের। কাছে ঘেঁষতে নেই…
সে কথা বলছি না। আমি ভাবছি ছেঁড়া পাতাগুলোর কথা। নিশ্চয় মূল্যবান কিছু ছিল ওগুলোতে। ইস, ডাক্তার ক্লডিয়াসের অফিসের কাগজপত্র আর কয়েকটা ফাইল যদি পড়তে পারতাম।
পারবে না, রবিন নিরাশ করল। মূল্যবান কাগজপত্র আলমারিতে তালা দিয়ে রাখাই স্বাভাবিক।
হুঁ, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর। তারপর উজ্জ্বল হলো চোখের তারা। বিল কিন্তু আজ পার্কে যায়নি, সকালে। ওই সময়ে শহরের আর কে কে অনুপস্থিত ছিল?
রবিনের কপালে ভাঁজ পড়ল। আমাদের চেনা সবাইই তো ছিল…শুধু, বিল আর জিপসি ফ্রেনি বাদে।
আচ্ছা, জিপসিকে বাদ দিচ্ছি কেন আমরা? মুসা বলল। ওর কথা ভাবছি না কেন? হয়তো বোকা সেজে থাকা তার একটা ভান।
না, মাথা নাড়ল রবিন। অনেক বছর ধরে আছে সে এখানে। ফন্দিবাজ হলে অনেক আগেই লোকের চোখে পড়ত।
আমারও তাই মনে হয়, কিশোর একমত হলো। গতরাতে কাউকে সত্যি সত্যি দেখেছে সে। তার প্রমাণও পেয়েছি আমরা। পায়ের ছাপ। লোকটা কোথায় গেল, দেখা হলো না কিন্তু।
মাঠের ওপারে বনের দিকে তাকাল মুসা। চলো না, গিয়ে দেখি এখন।
ছাপটার কাছে এল ওরা প্রথমে। তারপর সোজা হাঁটতে লাগল। বনের মধ্যে এক জায়গায় খোলা মাটি পাওয়া গেল, নরম। পায়ের ছাপও মিলল সেখানে।
সাবধানে এগিয়ে চলেছে তিন গোয়েন্দা। ভয়, যেন গাছের আড়ালে ঘাপটি মেরে আছে বিপদ।
অবশেষে পাতলা হয়ে এল বন। বনের কিনারে এসে দাঁড়াল ওরা। সামনে আবার তৃণভূমি আর বৈচিঝোঁপ। পুরানো একটা ভাঙা বিল্ডিং দেখা গেল। দেয়ালের লাল ইটের পাঁজর বেরিয়ে পড়েছে এখানে সেখানে, কোথাও কোথাও ধসে পড়েছে। লাল টালির ছাতের বেশির ভাগটাই ধসা। থামের মাথা বেরিয়ে আছে।
গির্জা ছিল, অনুমান করল রবিন।
জবাব দিল না কেউ।
বাড়িটার দিকে এগোল ওরা।
বিশাল কাঠের দরজার একটা পাল্লা কজা খুলে পড়ে গেছে, আরেকটা আছে জায়গামত। পড়ে থাকা পাল্লাটা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল। ওরা।
গুহামানব গতরাতে এখানেই ঢুকেছিল? প্রশ্ন করল মুসা।
কি করে বলি, চিহ্ন খুঁজছে কিশোর। কোন চিহ্নটিহ্ন তো দেখছি না।
এক মুহূর্ত দ্বিধা করে গির্জার সামনের দিকে এগোল রবিন। একধারে খানিকটা উঁচু জায়গা, দুটো সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠতে হয়।
মঞ্চ, বলল রবিন। দেখো, ওই যে আরেকটা দরজা। ঘর আছে। ভেস্ট্রি হতে পারে, পাদ্রীরা তাদের আলখেল্লা বোধহয় ওখানেই রাখত।
দাঁড়িয়ে আছে ছেলেরা। মাত্র দুটো সিঁড়ি ডিঙানোর সাহস নেই যেন। নীরবে চেয়ে আছে দরজাটার দিকে। কি আছে ওপাশে?
একটা শব্দ শোনা গেল। হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুত হয়ে গেল ওদের। দরজার ওপাশে কে জানি নড়ছে। মড়মড়, খসখস আওয়াজ। ঝমঝম করে কি যেন পড়ল। তারপর আবার নীরবতা। এক পা পিছিয়ে গেল মুসা। বিপদ দেখলেই ঘুরে দেবে দৌড়।
সাহস দেখাল রবিন। পা বাড়াল সিঁড়িতে ওঠার জন্যে। খপ করে তার হাত চেপে ধরল মুসা। যেয়ো না! ফিসফিস করে বলল। হয়তো ওটাই…
কোটা, খুলে বলার দরকার হলো না, বুঝল রবিন। গুহামানবের কথা বলছে মুসা। তার ধারণা, গুহা থেকে জ্যান্ত হয়ে উঠে চলে এসেছে। ওটা।
অসম্ভব! নিচু গলায় বলল কিশোর। এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। উঠল উঁচু জায়গাটায়। হাত রাখল দরজার নবে।
শিউরে উঠল হঠাৎ। সে ঘোরানোর আগেই ঘুরতে শুরু করেছে দরজার নব। গুঙিয়ে উঠল মরচে ধরা কজা, খুলতে শুরু করল পাল্লা!
তেরো
আরে, তোমরা! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন ডাক্তার রেডম্যান। খুব চমকে দিয়েছ যা হোক। এখানে কি করছ?
কাঁপছে তখনও কিশোর। জোর করে হাসল। এই একটু ঘুরে দেখতে এসেছি।
ঠিকই আন্দাজ করেছে রবিন। ওটা ভেস্টিরুমই। তারপরে গির্জার হল। সব শেষে আরেকটা ছোট ঘরের পরে বেরোনোর দরজা। খোলা। দেখা যাচ্ছে মঞ্চ থেকেই।
আসা উচিত হয়নি, বললেন ডাক্তার। এটা প্রাইভেট প্রোপার্টি। ওয়ারনারদের সম্পত্তি। পাহাড়ের ওদিকে বিরাট বাড়ি আছে ওদের। অনুমতি নিয়ে আমি এসেছি। বাইরের কারও আনাগোনা এখানে পছন্দ করে না ওরা। সিঁড়ির ওপর বসলেন তিনি। তবে, তোমাদের দোষ দেয়া যায় না। এ-বয়েসে আমিও ওরকম ছোঁক ছোঁক করতাম। পুরানো বাড়ির কত ভাঁড়ার আর চিলেকোঠায় যে চুরি করে ঢুকেছি।
জোরে হাঁচি দিলেন ডাক্তার। নাক টানলেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে নাক-চোখ মুছে বললেন, ইস, হতচ্ছাড়া এই সর্দি আর গেল না। অ্যালার্জি আছে আমার। আর এটাই আমাকে ইমিউনিটির ব্যাপারে আগ্রহী করেছে। উঠে দাঁড়ালেন। যাওয়া দরকার। শরীরটা ভাল লাগছে না। শহরে যাবে, নাকি আরও ঘোরাঘুরি করবে? তবে করাটা উচিত হবে না। বুড়ো ওয়ারনার পছন্দ করে না এসব। একটা শটগান। আছে, দেখলেই ওটা নিয়ে তাড়া করে লোককে। বিশেষ করে তোমাদের বয়েসী ছেলেদের।
শটগান আরও একজনের আছে, হেসে বলল কিশোর। জনাব কিংসলে ম্যাকম্বারের।
চলো, ফিরেই যাই, মুসা বলল।
ডাক্তার রেডম্যানের সঙ্গে বেরিয়ে এল ওরা।
অ্যালার্জির ব্যাপারে আগ্রহ? বুনোপথ ধরে চলতে চলতে বলল কিশোর। কিন্তু আপনি তো ইমিউনোলজিস্ট। অ্যালার্জি বিশেষজ্ঞদের
অ্যালির্জিস্ট বলে না? তাই তো জানি।
ঠিকই জানো। তবে একটার সঙ্গে আরেকটার যোগাযোগ আছে। ইমিউনিটিও একধরনের অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন।
তাই নাকি? রবিন বলল।
মাথা ঝাঁকালেন ডাক্তার। আমাদের শরীর নিজেকে বাঁচানোর জন্যে নানারকম উপায় করে রেখেছে। প্রয়োজনে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে। ওই অ্যান্টিবডি ক্ষতিকারক ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়া নষ্ট করে দেয়। ধরো, তোমার হাম হলো। তখন তোমার শরীরের ভেতরে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে, ওই রোগের জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করার জন্যে। রোগ সেরে যাওয়ার পরেও ওই অ্যান্টিবডির খানিকটা তোমার শরীরে থেকেই যাবে। ফলে সহজে আর হাম হবে না।
কিংবা ধরো, বিশেষ কোন কিছুতে তোমার অ্যালার্জি আছে। এই, কোনধরনের ফুলের রেণুতে। ওসবের সংস্পর্শে এলেই প্রতিক্রিয়া হবে। তোমার শরীরে, অ্যান্টিবডি তৈরি শুরু হবে। যেহেতু কোন জীবাণু পাবে না নষ্ট করার মত, রিঅ্যাকশন করে বসবে তখন ওই অ্যান্টিবডি। একধরনের রাসায়নিক দ্রব্য বেরোতে থাকবে, যাকে বলে হিসটামিন। হয়তো তখন নাক ফুলে যাবে তোমার, চোখ দিয়ে পানি পড়বে।
শরীরের এই ইমিউন সিসটেমই অনেক রকম ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে রাখে আমাদের। তবে কখনও কখনও এই সিসটেম শারীরিক ক্ষমতার আওতার বাইরে চলে যায়। আর তখনই দেখা দেয় বিপদ। নানারকম মারাত্মক অসুখ দেখা দেয়।
যেমন, গেঁটে বাত। সর্দি-কাশি। আজকাল বলা হয়ে থাকে, ক্যানসার নাকি ইমিউন রিঅ্যাকশনের জন্যেই হয়ে থাকে। তবে সেটার প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।…এমনকি, ইমিউনিটিই মানুষের মাঝে অপরাধ প্রবণতা জাগিয়ে তোলার জন্যে দায়ী।
অপরাধ প্রবণতা? প্রতিধ্বনি করল যেন মুসা।
অনেক সময় ভয়ের প্রতিক্রিয়া থেকে জন্ম নেয় অপরাধ, ব্যাখ্যা করলেন ডাক্তার। ধরো, কোন বিপজ্জনক জায়গায় বেড়ে উঠছে। একজন মানুষ। সারাক্ষণ ভীতির মাঝে কাটাতে হয় তাকে। ফলে শরীরে গড়ে ওঠে ভয়কে রোধ করার বিশেষ ব্যবস্থা। স্বভাব বদলে যায় মানুষটার। অনেকটা বুনো জানোয়ারের মত হয়ে ওঠে। নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে আক্রান্ত হওয়ার আগেই আক্রমণ করে বসে। গম্ভীর হয়ে গেছেন রেডম্যান। শরীরের এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা আমাদের জন্যে। খুবই দরকারী, আবার মস্ত বড় হুমকিও বটে। ল্যাবরেটরিতে ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালাচ্ছি আমি। ওগুলোর ইমিউন সিসটেম নষ্ট করে দিয়ে ভরে রেখেছি জীবাণু-নিরোধক কাঁচের বাক্সে। দেখেছি, ইমিউন সিসটেম নিয়ে অপ্রতিরোধ্য অবস্থায় যেগুলো থাকে, সিসটেম ছাড়াগুলো তার চেয়ে বেশি বাঁচে। ইমিউন থেকে জন্ম নেয় যেসব রোগ, তেমন রোগ স্পর্শ করে না ওগুলোকে।
কল্পনা করো এখন, ইমিউন ছাড়া, কিংবা ভিন্ন ইমিউন সংযোজিত মানুষের কথা। কত মারাত্মক রোগ থেকে বেঁচে যাবে। যদি সফল হতে পারি! মাথা নাড়লেন ডাক্তার। আর কি সব ছাইপাঁশ নিয়ে আছে অন্য ডাক্তাররা। ক্লডিয়াসের কথাই ধরো। কি করতে চেয়েছে? বুদ্ধিমত্তায় পরিবর্তন ঘটাবে, আহা! তাতে কি কচুটা হবে? হ্যারিসনটা আছে পুরানো হাড়গোড় নিয়ে। কখন কোটার জন্ম হয়েছে জানলে কি পৃথিবীর রূপ বদলে যাবে? যত্তোসব, এনার্জি লস!
বনের বাইরে বেরিয়ে এল ওরা।
ছেলেদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে, বিদায় নিয়ে সেন্টারের দিকে রওনা হলেন রেডম্যান।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ নীরবতার পর মুসা বলল, আমি শিওর, এবারকার গ্যাসপার পুরস্কার ডাক্তার রেডম্যানই পাবেন।
আনমনে মাথা ঝাঁকাল শুধু কিশোর। খাওয়ার জন্যে কাফেতে চলল ওরা।
শহরের ভিড় অনেক কমে গেছে। কাফে প্রায় খালি। আরাম করে বসে খেতে খেতে আলোচনা চালাল ছেলেরা।
জটিল এক রহস্য, মুখ বাঁকিয়ে বলল মুসা। কি কাণ্ড রে, বাবা! সারা শহর একসাথে ঘুমিয়ে পড়া! ওদিকে গুহা থেকে গায়েব হয়ে গেল গুহামানব।
পায়ের ছাপের ছাঁচটা, কিশোর বলল, ডাক্তার হ্যারিসনকে দেখালে কেমন হয়?
কি হবে তাতে? প্রশ্ন রাখল রবিন। গুহামানব যে নয়, এটা তো আমরাই জানি।
তা জানি। তবে, কি থেকে কি বেরোয় কে জানে।
হ্যাঁ, চেষ্টা করতে দোষ নেই।
খাওয়া শেষ করে গোলাঘরে ফিরে এল ছেলেরা। ছাঁচটা নিয়ে চলল গ্যাসপার সেন্টারে।
ওয়ার্করুমেই পাওয়া গেল ডাক্তার হ্যারিসনকে। কাগজ আর বইপত্র বোঝাই ডেস্কের সামনে বসে আছেন। ছেলেদের দেখে মুখ তুলে তাকালেন। ওদের ভয় ছিল, দেখেই ফেটে পড়বেন। সেসব কিছু করলেন না। হাতের বইটা বন্ধ করে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার?
কিছু পরামর্শ চাই, স্যার, খুব বিনীতভাবে বলল কিশোর, কিংবা বলতে পারেন, কিছু তথ্য। রাতে মিস্টার ম্যাকম্বারের গোলাঘরের মাচায় থাকি আমরা। গতরাতে একটা কাণ্ড ঘটেছে, সেখানে থাকায় শুনতে পেয়েছি।
জিপসি যে গুহামানব দেখেছে, সেই গল্প বলল কিশোর। শেষে পায়ের প্রতিকৃতিটা বের করে দিল।
একনজর দেখেই ওটা টেবিলে রেখে হাসলেন ডাক্তার। প্রাগৈতিহাসিক মানুষের ছাপ পেয়েছ ভেবে খুশি হলে নিরাশ হতে হবে। বেশিদিন খালি পায়ে হাঁটলে পায়ের পাতা ছড়িয়ে যায়, আর এটাতে ছড়ানো তো দূরের কথা, একটা আঙুলই অস্পষ্ট। তারমানে খুব। টাইট জুতো পায়ে দেয়।
কিন্তু জিপসি বলল একজন গুহামানবকে দেখেছে, রবিন বলল। লম্বা লম্বা চুল। পরনে পশুর ছাল।
শব্দ করে হাসলেন এবার হ্যারিসন। গুহামানবেরা যে পশুর ছাল পরতই, এটা কি শিওর? জানো? জিপসি কি দেখেছে কে জানে, তবে গুহামানব হতেই পারে না। পায়ের ছাপই সেটার প্রমাণ। এটা কোন হোমিনিডের পায়ের ছাপ নয়। অনেক বড়।
বড়? অবাক হলো মুসা। কিন্তু মাত্র নয় ইঞ্চি।
তারমানে ওই পায়ের মালিকের উচ্চতা পাঁচ ফুট তিন-চার ইঞ্চি। গুহায় যে কঙ্কালটা ছিল, তার চেয়ে অনেক বড়।…দাঁড়াও, দেখাচ্ছি। আফ্রিকায় একটা কঙ্কাল পেয়েছি আমি। হোমিনিড়। প্রায় বিশ লাখ বছর আগের। এখানে যেটা পাওয়া গেছে, তার চেয়ে কিছু ছোট। তবু ধারণা করতে পারবে।
একটা বড় কেবিনেটের দরজা খুললেন ডাক্তার।
ভেতরে তাকিয়েই স্থির হয়ে গেলেন। নেই! ফিসফিসিয়ে বললেন কোনমতে। তারপর চেঁচিয়ে উঠলেন। নেই! নেই ওটা! চুরি করে নিয়ে গেছে!
চোদ্দ
সেই বিকেলে ম্যাকম্বারকে একহাত নিল কিশোর।
ভাড়া চাইতে এলে বলল, ওরা চলে যাচ্ছে। লোকের ভিড় নেই। বাইরেই ক্যাম্প করে রাত কাটাবে।
একধাক্কায় মাচার ভাড়া অর্ধেক করে ফেলল ম্যাকম্বার। পাঁচ ডলার, রাতপিছু।
তাতেও রাজি হলো না কিশোর।
শেষে, তিন ডলারে রফা হলো। টাকা গুনে দিয়ে হাসতে হাসতে মাচায় এসে উঠল মুসা আর রবিনকে নিয়ে।
অন্ধকারে শুয়ে রইল ওরা কিছুক্ষণ, নীরবে। ভাবছে, দিনের ঘটনাগুলোর কথা।
নীরবতা ভাঙল মুসা, অবাক কাণ্ড! এই কঙ্কাল চোর এতদিন ছিল কোথায়?
আজ নিয়েছে, না আগেই নিয়েছে, কে জানে, রবিন বলল।
ডাক্তার তো বললেন, মাস তিনেক ধরে আর কেবিনেট খুলে দেখেননি। এর মাঝে যে কোন সময় চুরি হয়ে থাকতে পারে।
হ্যাঁ, সায় জানাল কিশোর। ডাক্তার ক্লডিয়াসের মৃত্যুর সময়ও হতে পারে।
গুঙিয়ে উঠল মুসা। আবার ক্লডিয়াস। তাঁর সঙ্গে কঙ্কাল চুরির কোন যোগ থাকতে পারে না। তিনি শুধু সেন্টারে ওটার কাছাকাছি বাস করতেন, ব্যস।
লিলির ব্যাপারটা ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না, বলল কিশোর। সে জানে, সেদিন হারবারভিউ লেনে কেন যাচ্ছিল, কিন্তু বলছে না।
হ্যাঁ, জানে, রবিন বলল। দেখলে না, কথা বলার সময় আরেকদিকে চেয়ে ছিল। তারমানে মিছে কথা বলছিল?
আর কেনই বা ডাক্তার ক্লডিয়াসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক থেকে পাতাগুলো নিখোঁজ হলো? কি লেখা হয়েছিল ওগুলোতে? তিনিই ছিঁড়েছেন, না অন্য কেউ?
অ্যাই, শোনো, উত্তেজনা ফুটল রবিনের কণ্ঠে। হারবারভিউ লেন আমি চিনি। কাল ওখানে গিয়ে খোঁজ নিলে কেমন হয়? আমি একাই নাহয় যাব। খুব ছোট লেন। হয়তো কোন তথ্য জানতে পারব। বের করে ফেলতে পারব, কার কাছে যাচ্ছিলেন ক্লডিয়াস।
ভালই হয়, কিশোর বলল। আমি সেন্টারে গিয়ে চেষ্টা করব তাঁর কাগজপত্র পড়ার।
তাহলে আমি যাব সেন্টারডেলে, উঠে বসল মুসা।
ওখানে কি? জানতে চাইল রবিন।
জানি না। তবে সাইট্রাস গ্রোভের পাশের শহর ওটা। আর ওখান থেকেই এসেছে মুক্তিপণের চিঠি। খোঁজ নিলে আমিও হয়তো কোন তথ্য জানতে পারব।
খুব ভাল হয়, বলল কিশোর।
গির্জার ঘড়িতে ঘণ্টা বাজল।
আর কোন কথা হলো না, ঘুমিয়ে পড়ল ওরা।
সবে যেন চোখ মুদেছে কিশোর, আর অমনি ঝাঁকাতে শুরু করল। তাকে মুসা।
কী? চোখ না খুলে জিজ্ঞেস করল সে।
আর কত ঘুমাবে? আটটা বাজে, মুসা বলল।
ওঠো, ওঠো। রবিন আগেই উঠেছে।
বাইরের কলে হাতমুখ ধুয়ে নিল ওরা। ভীষণ ঠাণ্ডা। গায়ে কাঁপুনি তুলে দেয়।
কাফেতে এসে পেট ভরে নাস্তা খেল। তারপর তিনজন চলে গেল তিনদিকে।
সেন্টারের দরজায় এসে দাঁড়াল কিশোর। পাল্লা খোলা। ভেতর থেকে মিসেস গ্যারেটের কণ্ঠ কানে আসছে।
কসম খেয়ে বলতে পারি, জোরগলায় বলছে মহিলা, গতকাল ছিল না ওটা ওখানে। কত খোঁজা খুঁজেছি।
ভেতরে উঁকি দিল কিশোর। মিসেস গ্যারেটকে দেখা গেল। ধূসর একটা উইগ পরেছে আজ, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল।
বললামই তো, পাবে, খোজো ভালমত, বলল আরেক মহিলা। একে আগে দেখেনি কিশোর। নীল ইউনিফর্ম পরেছে, তার ওপরে সাদা। অ্যাপ্রন। হাতে পালকের ঝাড়ন।
আমি বলছি, খুঁজেছি, রেগে গেল মিসেস গ্যারেট। এখানে
অন্তত দশবার খুঁজেছি। কাল ছিল না।
আর তর্ক না করে কাঁধ ঝাঁকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে ঝাড়ন হাতে চলে গেল দ্বিতীয় মহিলা।
ফিরে তাকিয়ে দরজায় কিশোরকে দেখল মিসেস গ্যারেট। লিলিকে খুঁজছ? নেই।
ডাক্তার হ্যারিসন আছেন?
আছে। মুখ হাউপ! গাল ফুলিয়ে দেখাল মহিলা। তার ঘরে।
মহিলাকে ধন্যবাদ দিয়ে সেখানে চলল কিশোর। ওয়ার্করুমের কাছাকাছি আসতেই কানে এল ডাক্তারের উত্তেজিত চিৎকার, ধমক। ধুড়ম-ধাড়ম করে কি যেন ফেলা হচ্ছে।
দরজায় দাঁড়িয়ে দ্বিধা করল কিশোর। টোকা দিল।
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। কী? চেঁচিয়ে উঠলেন হ্যারিসন। কি চাই?
ওকে ধমকাচ্ছ কেন? ভেতর থেকে বলল একটা শান্ত কণ্ঠ, ডাক্তার রুডলফ। আর্মচেয়ারে বসে আছেন।
আবার চিৎকার করার জন্যে মুখ খুলেও থেমে গেলেন হ্যারিসন, কিশোরকে অবাক করে দিয়ে হাসলেন। সরি। এসো, ভেতরে এসো।
ঘরে ঢুকল কিশোর।
সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বই, কাগজপত্র। টাইপরাইটার রাখার টেবিলটা কাত হয়ে পড়ে আছে। মেশিনটাও মেঝেতে।
কিশোরের দিকে চেয়ে হাসলেন ডাক্তার রুডলফ।
দেখে হাটো। পা রাখার তো আর জায়গা রাখেনি।
লজ্জিত হলেন হ্যারিসন। টেবিলটা সোজা করে তার ওপর তুলে রাখলেন মেশিনটা। খসে পড়ে গেল রোলারের ভাঙা একটা গোল মাথা। মেঝের ওপর দিয়ে গড়িয়ে চলে গেল।
দূর! সেদিকে চেয়ে আবার চেঁচিয়ে উঠলেন হ্যারিসন।
জিনিসপত্র নষ্ট করার ওস্তাদ ও, সহকর্মীকে দেখিয়ে বললেন রুডলফ।
করব না তো কী? প্রতিবাদ করলেন হ্যারিসন। কার মাথা ঠিক থাকে। এতসব গণ্ডগোল। তার ওপর ম্যাকম্বারের বাচ্চা দিয়েছে মেজাজ আরও খারাপ করে। বলে বেড়াচ্ছে, আমিই নাকি তোক দিয়ে তার কঙ্কাল চুরি করিয়েছি। যাতে লোকে অন্যরকম ভাবে, সেজন্যে নাকি মুক্তিপণের নোট পাঠিয়েছি। তারপর, আমার কঙ্কাল আমিই লুকিয়ে রেখে রটিয়েছি চুরি গেছে। শয়তান কোথাকার! কিশোরের দিকে তাকালেন। অন্যকে যে বলছে, শুধু তাইই না। আমাকে ফোন করেও বলে এ কথা। ব্যাটাকে খুন করব আমি।
ও বলে বলুক না, তোমার কি? বোঝানোর চেষ্টা করলেন। রুডলফ। কে বিশ্বাস করছে ওর কথা?
এখান থেকেও যে কঙ্কাল চুরি গেল, সাবধানে বলল কিশোর, অবাক লাগছে না আপনার?
অবাক! মাথাই খারাপ হয়ে গেছে আমার।
তারমানে, গুহামানবকে যে চুরি করেছে, এটাও সে-ই করেছে, এমনও তো হতে পারে।
ঝট করে চোখ তুললেন হ্যারিসন। তাই তো। একথা তো ভাবিনি। কিন্তু কে? আমার কঙ্কালটার কথা তো সেন্টারের বাইরের কেউ জানে না। মিসেস গ্যারেট আর ডাক্তার রুডলফ, এই তো।
কেন, লিলি জানে তো।
ও জানলেও কিছু হবে না। ভীতুর ডিম। হোমিনিড চুরি করার সাহস ওর হবে না। আরে তাই তো..এখন মনে পড়ছে। আমার ওপর চোখ রাখত মেয়েটা। হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। আলমারি কিংবা টেবিলের আড়াল থেকে…অদ্ভুত! ভাবিনি তো আগে।
হেসে উঠলেন রুডলফ। ব্যঙ্গ করে বলল, ভেবেছে, সত্যিই পাগল হয়ে গেল কিনা লোটা, দেখি তো। নাহলে আর কি কারণ? পরক্ষণেই বদলে গেল কণ্ঠস্বর, দেখো, ওকে সন্দেহ করবে না বলে দিলাম। বাচ্চা মেয়ে। স্কুলের গন্ধও যায়নি গা থেকে। ও চুরি করবে না।
তাহলে কে করেছে? এমনভাবে বললেন হ্যারিসন, যেন রুডলফ জানেন।
তবে লিলির জানাশোনা আছে অনেকের সঙ্গে, বলল কিশোর। সেন্টারের বাইরেও লোকের সঙ্গে পরিচয় আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে।
চোখের পাতা সরু হয়ে এল হ্যারিসনের। তোমার এত আগ্রহ কেন?
আমি আর আমার দুই বন্ধু গোয়েন্দা, সহজ গলায় বলল কিশোর।
গোয়েন্দা? হাসলেন হ্যারিসন।
হ্যাঁ, পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার নাম লেখা কার্ড বের করে দিল কিশোর।
আই সী, পড়ে বললেন ডাক্তার। ভালই হলো। এখন আমার। সবচেয়ে বেশি দরকার গোয়েন্দার। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। লিলিকে সন্দেহ করছ তো? অহেতুক। চুরি করার সাহস ওর হবে না।
ডাক্তার ক্লডিয়াস পছন্দ করতেন ওকে, মনে করিয়ে দিল কিশোর। কঙ্কাল চুরি আর ডাক্তার ক্লডিয়াসের রকি বীচে যাওয়ার পেছনে কারও যোগাযোগ থাকতে পারে।
তা কি করে হয়? প্রতিবাদ করলেন ডাক্তার রুডলফ। সেটা তো তিনমাস আগের ঘটনা। গুহামানবের কঙ্কাল তখনও পাওয়াই যায়নি।
ডাক্তার ক্লডিয়াস রকি বীচে কেন গিয়েছিলেন, কিছু বলতে পারবেন?
না, জবাব দিলেন হ্যারিসন। চাপা স্বভাবের ছিল। কাউকে কিছু বলত না।
আমার মনে হয় লিলি জানে। কিন্তু সে-ও কম চাপা নয়। বলে না। আরেকটা ব্যাপার, ডাক্তার ক্লডিয়াসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকের মাঝখানের অনেকগুলো পাতা ছেঁড়া। এপ্রিলের শেষ আর মে-র শুরুর। ওগুলোতে নিশ্চয় কোন সূত্র ছিল।
রুডলফের দিকে তাকালেন একবার হ্যারিসন, মাথা ঝাঁকালেন।
ক্লডিয়াসের ঘরের কোন কাগজ সরানো হয়নি। যেমন ছিল, তেমনি আছে। অন্তত আমরা ধরিনি।
দেখার জন্যে তিনজনেই চলল ডাক্তার ক্লডিয়াসের ল্যাবরেটরিতে।
কাগজপত্র আর নোটের অভাব নেই। অসংখ্য ফাইল। সুন্দর করে সাজানো-গোছানো, ডাক্তার হ্যারিসনের কাগজপত্রের মৃত এলোমলো নয়।
তিনটে ফাইলের ওপরের টাইটেল দৃষ্টি আকর্ষণ করল কিশোরের-রিঅ্যাকশন টাইমস, ম্যানুয়্যাল ডেকসটারিটি, আর কমুনিকেশন স্কিলস। কিছু নোটবুক আছে। ওগুলোর ওপরে লেখা রয়েছে কেমিকেল স্টিমুলেশন, এক্স-রে এক্সপোজার টাইমস, ইত্যাদি। কিছু কিছু লেখা পড়তে পারলেও মানে কিছুই বুঝল না কিশোর।
বোঝাতে হলে আরেকজন জিনেটিসিস্ট লাগবে, বললেন রুডলফ।
একমত হলো কিশোর। তবু, বোঝা যায় এমন কিছুও পাওয়া যেতে পারে। যার সঙ্গে যোগাযোগ আছে গুহামানব অন্তর্ধান রহস্যের।
পাতার পর পাতা উল্টে চলল তিনজনে। খালি খসখস শব্দ।
কিছুক্ষণ পর মুখ তুলল কিশোর। এপ্রিলের দশ তারিখের পর আর কোন গবেষণার নোট নেই।
হাতের খাতাটার শেষ পৃষ্ঠাটাও উল্টে দেখলেন হ্যারিসন। ঠিকই বলেছ। এটাতে শেষ লেখা রয়েছে পঁচিশে মার্চের নোট। ব্যস।
আরও অনেক খাতা, ফাইল, নোটবুক ঘাঁটল ওরা। এপ্রিল ১০-এর পরে আর কিছু পাওয়া গেল না।
কিন্তু এর পরেও তো কাজ করেছে, বললেন হ্যারিসন। রোজই করেছে। ওসব দিনের নোটগুলো কই?
অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকের কাগজের যা দশা হয়েছে, তা-ই হয়েছে, মন্তব্য করল কিশোর।
ওয়ার্কবেঞ্চের ওপর গাদা করে রাখা আছে অনেকগুলো ম্যাগাজিন। সবচেয়ে ওপরেরটা তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাল কিশোর। ভেতরে একটা স্লিপ পাওয়া গেল। প্রোপার্টি অভ দ্য ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট লাইব্রেরি ছাপ মারা।
স্লিপটা যেখানে পাওয়া গেল সেই পৃষ্ঠা পড়ে বলল কিশোর, সোডিয়াম পেনটোগ্যাল মগজের ওপর কি ক্রিয়া করে তা-ই পড়ছিলেন ডাক্তার ক্লডিয়াস।
সোডিয়াম পেনটোথ্যাল একটা অ্যানাসথেটিক, বললেন রুডলফ। অনুভূতি নষ্ট করে। বেহুশ করে দেয়।
আরেকটা ম্যাগাজিন তুলে নিল কিশোর। জানাল অভ দি আমেরিকান মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের একটা কপি। নাইট্রাস অক্সাইডের ওপর একটা লেখা ছেপেছে।
আরেকটা অ্যানাসথেটিক, বললেন হ্যারিসন! দাঁতের ডাক্তাররা। হরদম ব্যবহার করে। ওরা বলে একে লাফিং গ্যাস।
আরও ম্যাগাজিন আছে, তাতে আরও আরটিক্যাল। সব কটাতেই কোন না কোন অ্যানাসথেটিকের ওপর লেখা রয়েছে।
ঠিকই আছে, বললেন রুডলফ। শিম্পাঞ্জীর ওপর অপারেশন চালাত তো, অ্যানাসথেটিকের দরকার ছিল।
এবং গতকাল পুরো শহরকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, কাউকে উদ্দেশ্য করে বলল না কিশোর কথাটা। মনের ভাবনাটাই মুখ ফুটে বেরিয়ে গেছে।
অনেক খোঁজাখুঁজি করা হলো। কিন্তু ল্যাবরেটরিতে অ্যানাসথেটিকের কোন নমুনা পাওয়া গেল না। ইথার, সোডিয়াম পেনটোথ্যাল, এমনকি নোভাকেনও নেই।
সেন্টার থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। লিলির কথা ভাবছে। নোটগুলো কি সেই গায়েব করেছে? যদি করে থাকে, কেন করেছে? পাতাগুলো কি নষ্ট করে ফেলেছে? আবার প্রশ্ন, কেন? কঙ্কাল চুরিতে তার কোন হাত আছে? আছে, এ কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না, এতটাই নিরীহ।
কিন্তু সত্যি কি এতটা নিরীহ?
পনেরো
দুপুর নাগাদ মুসার মনে হলো, অযথা সময় নষ্ট করছে। সাইট্রাস গ্রোভের চেয়ে বড় সেন্টারডেল শহর, অন্যরকম। দুটো সুপারমার্কেট আছে, চারটে পেট্রোল স্টেশন। ওষুধের দোকানের সামনে সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ল না মুসার। পড়ার কথাও নয়, কি খুঁজতে এসেছে তা-ই জানে না।
ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছে মুসা, এই সময় চোখে পড়ল ধূলিধূসরিত পুরানো গাড়িটা। শাঁ করে তার সামনে দিয়ে গিয়ে মোড় নিয়ে নামল আরেকটা শাখাপথে।
ড্রাইভিং সীটে বিল উইলিয়ামস।
সরু পথের দু-ধারে গাছের সারি। তার ভেতর দিয়ে এগিয়ে একটা পুরানো বাড়ির গাড়িবারান্দায় ঢুকল গাড়ি। দরজা খুলে নামল বিল, হাতে বাদামী কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট।
দাঁড়িয়ে আছে মুসা। মিনিট দুয়েক পর বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বিল।
গাড়িতে উঠে আবার এগিয়ে আসতে লাগল মুসা যেখানে আছে সেদিকে।
আরেকদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখল মুসা, যাতে বিল দেখতে না পায়। দেখল না বিল। চলে গেল সাইট্রাস গ্রোভের দিকে।
বাড়িটার দিকে এগোল মুসা। গাড়িবারান্দায় এসে দাঁড়াল। এখন কি করবে?
আরেকটা গাড়ি এসে থামল গাড়িবারান্দায়। দরজা খুলে নামল একজন মোটা, বয়স্কা মহিলা।
কিছু চাও? জিজ্ঞেস করল।
না, ম্যাম, দ্বিধা করছে মুসা। সন্তোষজনক একটা জবাব খুঁজছে মনে মনে। বিল উইলিয়ামসকে খুঁজছিলাম। সাইট্রাস গ্রোভে ফিরে গেলে একটা লিফট নিতাম আরকি। ওকে এখানে ঢুকতেও দেখলাম। কিন্তু আমি আসতে আসতে চলে গেল।
ডাকলেই পারতে। আজ আর আসবে না।
ঠিক আছে। দেখি, বাসেই চলে যাব। এতে
হ্যাঁ, তাই যাও। গাড়ির ট্রাঙ্ক খুলে জিনিসপত্র নামাতে শুরু করল মহিলা। মুদি দোকানে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে তাকে মাল নামাতে সাহায্য করল মুসা।
পাশে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল মুসা, আপনি কি মিসেস উইলিয়ামস?
বিলির মা মনে করেছ? না, আমি তার বাড়িওয়ালী। আমার এখানে একটা রুম ভাড়া নিয়ে থাকে সে।
হাতের প্যাকেটগুলো রান্নাঘরের টেবিলে নামিয়ে রাখল মুসা।
সাইট্রাস গ্রোভে থাকো তুমি? জিজ্ঞেস করল মহিলা। জবাবের অপেক্ষা না করেই বলল, গতকাল ওই কাণ্ডটা যখন ঘটল, পার্কে সবাই ঘুমাল, তখন কোথায় ছিলে। আমি শিওর, পানিতে কোন ঘাপলা ছিল। পানি পরীক্ষা করে দেখা উচিত ছিল।
করেছে তো। ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গিয়ে। কিছু পায়নি।
মাথা নাড়ল মহিলা। যে-ই করেছে, জঘন্য কাজ করেছে। কাল বিলির ওপর খুব রাগ লাগছিল। অসুখের আর সময় পেল না। সারাটা সকাল শুয়ে রইল বিছানায়। এমনিতে অসুখ খুব একটা হয় না তার। কাল সাইট্রাস গ্রোভে গিয়ে দেখে আসতে পারলে তার মুখ থেকেই সব শুনতে পারতাম। কঙ্কালটা দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে আমারও ছিল, ভিড়ের কথা শুনেই যাইনি। গাড়ি পার্ক করারই নাকি জায়গা ছিল না।
না গিয়ে ভালই করেছেন। সাংঘাতিক ভিড় হয়েছিল। ঠিক আছে, যাই এখন, দরজার দিকে পা বাড়াল মুসা।
বিলি এলে কিছু বলব? কি নাম তোমার?
না, কিছু বলার দরকার নেই। আমার নাম মুসা।
আচ্ছা।
বাস ধরে সাইট্রাস গ্রোভে ফিরে এল মুসা।
গোলাবাড়ির পেছনে বসে বসে তখন ভাবছে কিশোর। মুসার মুখে সব শুনে বলল, সত্যি তাহলে কাল অসুস্থ ছিল বিল। আমার তো সন্দেহ হচ্ছিল, চুরিতে সে-ও জড়িত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে শক্ত অ্যালিবাই রয়েছে তার।
ঘাসের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল মুসা।
একইভাবে বসে নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে চলল কিশোর।
বিকেল চারটেয় ফিরে এসে দু-জনকেই ওই অবস্থায় পেল রবিন।
খবর ভাল? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ডক্টর ফিল ডিকসনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন সেদিন ডক্টর ক্লডিয়াস, জানাল রবিন। হারবারভিউ লেনে থাকেন ডক্টর ডিকসন। অ্যানাসথেটিস্ট। সান্তা মনিকার সেইন্ট ব্রেনড্যান হাসপাতালে চাকরি করেন। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, ডক্টর ক্লডিয়াস কি কোন ব্রিফকেস ফেলে গেছেন? মার্থা নাড়লেন। বললেন, সেদিন সারা দিন অপেক্ষা করেছেন ডক্টর ক্লডিয়াসের জন্যে। পরে অবশ্য তাঁর মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছেন।
অ্যানাসথেটিস্ট? ডক্টর ক্লডিয়াসের বন্ধু ছিলেন?
তাই তো বললেন। ডক্টর ক্লডিয়াস সেদিন কেন দেখা করতে চেয়েছিলেন, বলতে পারলেন না। কথায় কথায় তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এমন শক্তিশালী কোন অ্যানাসথেটিক আছে কিনা, যেটা নিমেষে কয়েকশো লোককে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারে?
কি বললেন? আগ্রহে সামনে ঝুঁকল কিশোর।
নেই। গতকালকের কথা তিনি শুনেছেন।
হুম।
বাড়ির পেছনের দরজা খুলে বেরোল লিলি। ছেলেদের দিকে একবার মাথা নুইয়ে হনহন করে চলল গোলাঘরের দরজার দিকে।
পেছনে বেরোল ম্যাকম্বার। ডেকে জিজ্ঞেস করল, লিলি, কোথায়। যাচ্ছ?
আন্না ফিঙ্গার দাওয়াত দিয়েছে, তার সঙ্গে সাপার খেতে, না ফিরে জবাব দিল লিলি।
তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরো।
পিকআপটা বের করে নিয়ে চলে গেল লিলি।
সেদিকে তাকিয়ে রইল ম্যাকম্বার।
উঠে এল কিশোর। কাশি দিয়ে ম্যাকম্বারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, চোরের আর কোন খবর আছে?
চোখ পাকিয়ে জবাব দিল ম্যাকম্বার, থাকলেও তোমাকে বলতাম না। দুপদাপ পা ফেলে চলে গেল বাড়ির ভেতরে।
বিকেলের একটা অংশ কাফেতে বসে খেয়ে আর অ্যানাসথেটিকের ব্যাপারে আলোচনা করে কাটাল ছেলেরা। বাকি সময় কাটল শহরে ঘোরাঘুরি করে।
মাঝরাতের পর বাড়ি ফিরল লিলি। মাচায় শুয়ে ইঞ্জিনের শব্দ শুনল ছেলেরা। বাড়ির ভেতরে ম্যাকম্বারের কড়া গলা শোনা গেল-এতক্ষণ কোথায় কাটিয়ে এসেছে লিলি, জিজ্ঞেস করছে। দড়াম করে বন্ধ হলো। দরজা-জানালা, তারপর মেয়েকণ্ঠের কান্না আর ফোঁপানি।
লিলির সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার করে ওরা, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল মুসা।
চলে যায় না কেন? বয়েস তো যথেষ্ট হয়েছে, রবিন বলল, অত ভীতু কেন?
এরপর আর তেমন কিছু ঘটল না। ঘুমিয়ে পড়ল ছেলেরা।
পরদিন, সোমবার, খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠল ওরা। ম্যাকম্বারের বাড়িতে কেউ ওঠেনি, কোন নড়াচড়া নেই। কাফেতে নাস্তা সারল।
মেইন রোড ধরে হাঁটছে, এই সময় চোখে পড়ল পিকআপ নিয়ে পেট্রোল স্টেশনে ঢুকছে লিলি।
গতরাতে বান্ধবীকে নিয়ে নিশ্চয় হাওয়া খেতে বেরিয়েছিল ও, রবিন অনুমান করল। গতকাল টাংকি ভরেছে ম্যাকম্বার, দেখেছি। আজ সকালেই এত তেলের দরকার হলো…
টুং টুং করে ঘণ্টা বাজল দু-বার। পাম্প বন্ধ করে, ট্যাংক থেকে হোস বের করে, ট্যাংকের মুখে ক্যাপ লাগাল লিলি। টাকা গুনে দিল অ্যাটেনডেন্টের হাতে।
স্টার্ট নিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেল পিকআপ।
দুই গ্যালনের কিছু বেশি, চলমান গাড়িটার দিকে চেয়ে আছে। কিশোর। তারমানে অন্তত চল্লিশ মাইল। সেন্টারডেল পর্যন্ত যাওয়া যাবে, তাই না?
হয়তো ওখানে কোন বান্ধবী-টান্ধবী থাকে, মুসা বলল। কিংবা হয়তো কাল রাতে বেশি ঘোরাঘুরি করে তেল খরচ করে ফেলেছিল। এখন চাচার ভয়ে আবার ভরে রেখেছে।
আচ্ছা, ওকে সন্দেহ করছি কেন? নিজেকেই প্রশ্ন করল যেন · কিশোর। আর করছিই যখন, সরাসরি জিজ্ঞেস করে ফেললেই পারি। দ্বিধা কিসের?
মিছে কথা বলবে, রবিন বলল। আগেও বলেছে।
বড় বেশি নিঃসঙ্গ। কে জানে, তেমন করে যদি জিজ্ঞেস করতে পারি, মনের ভার লাঘব করার জন্যেও সব বলে দিতে পারে। জিজ্ঞেস করতে অসুবিধে কি?
কিছু না। তবে তুমি একা যেয়ো। আমি থাকছি না সামনে। কথায় কথায় ভ্যাক ভ্যাক করে কেঁদে ফেলে। এত কান্না আমার সয় না। খুব খারাপ লাগে।
আমারও, মুসা বলল।
ঠিক আছে, আমি একাই যাব, বলল কিশোর।
ম্যাকম্বারের বাড়ি পৌঁছে দেখল ওরা, লিলি পিকআপ রেখে সেন্টারে চলে গেছে। দুই সহকারীকে রেখে কিশোরও চলল সেন্টারে। দরজায় পৌঁছেই দাঁড়িয়ে গেল। লিলির চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে।
দেরি হয়েছে কে বলল? চেঁচিয়ে উঠল লিলি। মোটেই দেরি হয়নি।
দরজার কাছ থেকে সরে এসে লিভিংরুমের জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল কিশোর।
কেউ নেই। শুধু দেয়ালে বসানো পশুর মাথাগুলো শূন্য নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে।
কি করেছ সেটা শোনার আমার দরকার নেই, আবার চেঁচাল লিলি। আরেকবার ফোন করো। বলল, এটা একটা রসিকতা।
কিশোরের মনে পড়ল, ল্যাবরেটরির বাইরে, হলরুমে যাওয়ার পথে দেয়ালে ঝোলানো একটা টেলিফোন আছে। টেলিফোনে কথা বলছে লিলি।..
মিথ্যুক! আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল লিলি। এরকম করা মোটেই উচিত হয়নি তোমার। আমার কি হবে ভেবেছ? .খানিক নীরবতা। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, বেশ, দেখো, আমি কি করতে পারি।
খটাশ করে রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ হলো।
জানালার কাছ থেকে সরে গেল কিশোর।
মুহূর্ত পরেই ঝটকা দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল লিলি।
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসেছে। ডান-বা কোনদিকে না তাকিয়ে ধুপধাপ করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে, প্রায় দৌড়ে গেল গেটের দিকে।
পিছু নিল কিশোর। ডাকল না।
মাঠ পেরিয়ে ম্যাকম্বারের গোলাঘরে ঢুকে পিকআপটা বের করল লিলি। ঝাঁকুনি খেতে খেতে গিয়ে পথে উঠল গাড়িটা। ছুটল শহরের দিকে।
গোলাঘরের দিকে এগোল কিশোর। দরজায় বেরিয়ে এল মুসা আর রবিন।
গেল কই? জিজ্ঞেস করল মুসা।
জানি না, কিশোর জবাব দিল। খুব রেগেছে। অবশেষে করতে চলেছে কিছু একটা।
শুধু ও-ই না, রবিন বলল। মিনিট দশেক আগে ম্যাকম্বারও খুব। রেগেমেগে বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। ওর স্ত্রী পেছন থেকে ডাকছিল। গুহামানবের পেছনে আর টাকা নষ্ট না করতে বলল। শুনলই না যেন ম্যাকম্বার। শহরের দিকে চলে গেল।
মুক্তিপণ। এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল কিশোর, মুক্তিপণের টাকা দিতে গেছে। ঘটনা ঘটতে আরম্ভ করেছে ভালমতই।
ষোলো
চলো, যাই। দেখি, কি করে সামলায় ম্যাকম্বার। বলেই রওনা হলো কিশোর।
কিভাবে করবে? পেছন থেকে বলল মুসা। গাড়ি তো নিল না!
গেলেই দেখব।
মেইন রোড ধরে হেঁটে কাফেটা প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছিল ছেলেরা, এই সময় দরজায় বেরোল ম্যাকম্বার। তার সঙ্গে রয়েছে কাফের মালিক, মিস্টার মরিসন। পেছনে আরও দু-জন বেরোল। একজনকে চেনে কিশোর, এখানকার ওষুধের দোকানের মালিক।
দ্রুতপায়ে ব্যাংকের দিকে হাঁটতে লাগল চারজনে। মাঝপথে তাদের সঙ্গে মিলিত হলো মোটেলের মালিক।
যা আন্দাজ করেছিলাম, নিচু কণ্ঠে বলল কিশোর। শহরের সব ব্যবসায়ী একজোট হয়ে গুহামানবের পেছনে টাকা ঢেলেছে। মুক্তিপণের টাকাও সবাই ভাগাভাগি করে দেবে।
পার্কের একটা বেঞ্চে বসে ব্যাংকের ওপর চোখ রাখল কিশোর। জানালার ভেতর দিয়ে দেখা গেল, তাড়াহুড়ো করে ডেস্ক থেকে উঠে আসছে ব্যাংকের ম্যানেজার। পাঁচজনের সঙ্গেই হাত মেলাল। তারপর ওদেরকে নিয়ে গেল পেছন দিকের একটা কামরায়।
এবার কি করব? জিজ্ঞেস করল রবিন।
অপেক্ষা, জবাব দিল কিশোর। বেশিক্ষণ বসে থাকতে হবে না।
পাঁচ মিনিট পর, গির্জার ঘড়িতে যখন দশটার ঘণ্টা বাজছে, ব্যাংক থেকে বেরিয়ে এল ম্যাকম্বার। হাতে ক্যানভাসের তৈরি একটা টাকা রাখার বটুয়া। সঙ্গে বেরোল কাফের মালিক।
দ্রুতপায়ে হেঁটে গেল দু-জনে কাফের পাশের পার্কিং লটে। একটা ফোক্সওয়াগেনে চড়ে চলে গেল।
এবারও বেশিক্ষণ লাগবে না, বলল কিশোর।
ব্যাংকের দরজায় দেখা দিল আরও দু-জন, ম্যাকম্বারের সঙ্গে যারা ঢুকেছিল। তাদের পেছনে বেরোল ম্যানেজার। সবাই উদ্বিগ্ন। আস্তে
আস্তে হেঁটে গিয়ে কাফের কাউন্টারের উল্টোদিকের বুথে বসল। বসেই আছে ছেলেরা।
গির্জার, ঘড়িতে সোয়া দশটা বাজল, সাড়ে দশটা। ফিরে এসে পার্কিং লটে ঢুকল ফোক্সওয়াগেন। গাড়ি থেকে নামল ম্যাকম্বার আর তার সঙ্গী। ম্যাকম্বারের হাতে বটুয়াটা নেই। ক্লান্তপায়ে হেঁটে গিয়ে কাফেতে ঢুকল দু-জনে।
যাব নাকি? বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল কিশোর। পার্ক থেকে বেরিয়ে পথ পেরোল। রবিন আর মুসা চলল তার পেছনে।
বুথের মানুষগুলো ছাড়া আর কেউ নেই কাফেতে, শুধু একজন। ওয়েইট্রেস পাত্রে চিনি ঢালছে। ছেলেদের দিকে একবার চেয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল ম্যাকম্বার।
বড়দের কাছ থেকে খানিক দূরে বসল ছেলেরা।
ম্যাকম্বার আরেকবার এদিকে তাকাতেই আন্তরিকতার ভঙ্গিতে হাসল কিশোর। জিজ্ঞেস করল, চোরের ফোন আসবে?
ঝুলে পড়ল ম্যাকম্বারের নিচের চোয়াল, বন্ধ হলো আবার।
টাকা দিয়ে দিয়েছেন, না? আবার জিজ্ঞেস করল কিশোর।
লাফ দিয়ে টুল থেকে নেমে এসে কিশোরের শার্টের কলার চেপে ধরল ম্যাকম্বার। তুমি কি করে জানলে?…চোরের সঙ্গী নাকি? লক্ষ করেছি, সারাক্ষণ চোখ রাখো আমার ওপর। কেন?
কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করল না কিশোর। শান্তকণ্ঠে বলল,, চোরের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
অ্যাই, কিং, কি করছ? বাধা দিল কাফের মালিক।
রাগে গোঁ গোঁ করে উঠল ম্যাকম্বার, কিন্তু কলার ছেড়ে দিল।
অপরাধ নিয়ে কারবার আমার আর আমার বন্ধুদের হবি, নাটকের সংলাপ বলছে যেন কিশোর। তবে আমরা নিজেরা অপরাধ করি না, অপরাধীকে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করি। রহস্যের সমাধান করি।
কথার ধরন দেখে বড় বড় হয়ে গেল ম্যাকম্বারের চোখ। ফিরে গিয়ে টুলে বসল।
আপনি কি মনে করেন কঙ্কালটা কোথায় রেখেছে জানাবে। আপনাকে চোর? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
জবাব দিল না ম্যাকম্বার।
কিন্তু কাফের মালিক বলল, শিওর হওয়ার উপায় নেই। না-ও বলতে পারে।
অন্য কারও হাতে যদি পড়ে টাকাটা? একসময় বলল ব্যাংক। ম্যানেজার। পিকনিক করতে আসে অনেকেই। হয়তো কারও চোখে পড়ে গেল…
থামো তো! হাত তুলল ম্যাকম্বার। কপালে ঘামের বিন্দু জমছে।
কনুইয়ে ভর রেখে কাত হলো রবিন। লোকগুলোকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, সিনেমায় দেখি, বাস স্টেশনের লকারে জিনিস লুকিয়ে রাখে কিডন্যাপাররা। এখানে তো তেমন বাস স্টেশনও নেই। সবাই নামে। ওষুধের দোকানের সামনে।
ঝট করে সোজা হলো কিশোের। কিন্তু রেল স্টেশন আছে।
পিনপতন নীরবতা নামল কাফের ভেতরে। পার্কের শেষ মাথা ছাড়িয়ে ওপাশে পুরানো রেল স্টেশনটা, মরিসন আর ম্যাকম্বারের মুখ ঘুরে গেল সেদিকে। সেই একই রকম রয়েছে ধুলোয় ঢাকা পোডড়া বাড়িটা।
হঠাৎ লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কাফের মালিক।
চোখের পলকে টুল ছাড়ল অন্যেরা। দরজায় আগে পৌঁছল ম্যাকম্বার। ছুটে বেরোল। তার পেছনে অন্যেরা।
কাফে থেকে বেরিয়ে ছেলেরাও দৌড় দিল স্টেশনের দিকে।
বাড়িটার বারান্দায় উঠে জানালার ময়লা কাঁচের মধ্য দিয়ে ভেতরে তাকাল ম্যাকম্বার।
হাত দেবেন না! চেঁচিয়ে সাবধানে করল কিশোর। আঙুলের ছাপ লেগে যাবে।
জানালার কাছ থেকে সরে ছুটে গিয়ে দরজার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ম্যাকম্বার। কাঁধের ধাক্কায় ছুটে গেল পাল্লার মরচেধরা কজা। মড়মড় করে উঠল তক্তা।
দেখতে দেখতে ভিড় জমে গেল সেখানে। সুপারমার্কেট থেকে দৌড়াদৌড়ি করে এল লোক। মেয়েরা বেরিয়ে এল ঘর থেকে। সে-পথ দিয়েই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন ডাক্তার হ্যারিসন, সঙ্গে ডাক্তার রুডলফ। হট্টগোল শুনে দু-জনেই নেমে এলেন। ওষুধের দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন ডাক্তার রেডম্যান।
আবার দরজার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ম্যাকম্বার। বেশিক্ষণ সইতে পারল না পুরানো দরজা। ছিটকে খুলে গেল। স্টেশনের বারান্দায় ওঠার জন্যে হুড়াহুড়ি লাগিয়েছে লোকে।
সরো! ধমকে উঠল ম্যাকম্বার। কোন কিছুতে হাত দেবে না।
স্থির হয়ে গেল সবাই।
পুরানো, দোমড়ানো একটা ট্রাংক পাওয়া গেল ঘরের ভেতরে।
ধুলোতে দাগ দেখে বোঝা গেল, জানালা দিয়ে ঢুকিয়ে মেঝের ওপর দিয়ে টেনে আনা হয়েছে ওটা।
কি ওটাতে? জিজ্ঞেস করল কে যেন।
ট্রাংকের ডালা তুলেই সোজা হয়ে গেল মরিসন। অস্ফুট একটা শব্দ বেরোল মুখ থেকে।
ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন হ্যারিসন। দেখলেন ট্রাংকে কি আছে। কতগুলো হাড়, কোষ্টা কোন জায়গার সহজে বোঝার উপায় নেই। খুলির শূন্য কোটরদুটো চেয়ে আছে ছাতের দিকে।
হাঁ হয়ে গেলেন ডাক্তার। মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে। পাঁই করে ঘুরলেন ম্যাকম্বারের দিকে। কি এ সব?
কি ভেবে পিছিয়ে গেল ম্যাকম্বার।
হ্যারিসনের বাহুতে হাত রাখলেন রুডলফ! শান্ত হও। থামো। ম্যাকম্বারের দিকে ফিরে বললেন, এগুলো এখানে এল কিভাবে?…আফ্রিকায় পাওয়া হোমিনিডের কঙ্কাল…।
বাজে কথা! চেঁচিয়ে উঠল ম্যাকম্বার। এটা আমার গুহামানব!
কড়া কিছু বলতে গিয়েও সামলে নিলেন হ্যারিসন। তাই নাকি। দেখো তাহলে ভাল করে, লেবেল লাগানো আছে প্রত্যেকটা হাড়ে। নাম্বার, তারিখ, আর কোন্ জায়গায় কোন্টা পাওয়া গেছে, লেখা আছে। পড়ে দেখো।
মিস্টার মরিসন! বাইরে থেকে ডাকল কেউ। মিস্টার ম্যাকম্বার!
সরে পথ করে দিল জনতা। ভেতরে ঢুকল কাফের কাউন্টারম্যান।
ফোন এসেছে। বলল, স্টেশনঘরে ট্রাংকের মধ্যে আছে… ট্রাংকের ভেতরে চেয়েই হাঁ হয়ে গেল। এই তো!
শুনলে তো? হ্যারিসনের দিকে চেয়ে হাত নাড়ল ম্যাকম্বার। ওগুলো আমার হাড়। আমার গুহামানবের। চোরটা নইলে জানল কিভাবে? ভুরু কুঁচকে গেল হঠাৎ। জ্বলে উঠল চোখ। শয়তান! ধাপ্পাবাজ! ধাপ্পা দিয়েছ আমাকে! দু-হাত বাড়িয়ে ডাক্তারের গলা টিপে ধরতে এল সে। তাকে ধরে ফেলল মরিসন।
ছাড়া পাওয়ার জন্যে ধস্তাধস্তি করতে লাগল ম্যাকম্বার, চেঁচিয়ে বলল, তুমি ব্যাটাই গুহায় গিয়ে কঙ্কালটা গেড়ে রেখে এসেছিলে। তারপর এমন ভাব দেখিয়েছ, যেন পেয়েছ ওখানে। লোকের নজর পড়ক, বড় ধরনের আলোড়ন হোক, এটা চেয়েছ। আর সেজন্যে। ব্যবহার করেছ আমাকে।
ব্যাটা বলে কি? মিথ্যুক কোথাকার, ঘুসি পাকিয়ে এগোতে গেলেন হ্যারিসন, আটকালেন রুডলফ।
ঘরে ঢুকল ডেপুটি শেরিফ। এগিয়ে এল। একটা ব্যাপার লক্ষ। করল এই সময় কিশোর, ভিড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে এদিকে চেয়ে আছেন রেডম্যান। হাসছেন মিটিমিটি। হ্যারিসনের দুরবস্থা দেখেই বোধহয় তার কালো চোখে খুশির ঝিলিক।
সতেরো
হ্যারিসন সম্মানী লোক, বললেন রুডলফ। সে এরকম কাজ করতে পারে না।
নিশ্চয় করেছে! চেঁচিয়ে উঠল ম্যাকম্বার। চোরটা নাহলে জানল কিভাবে হাড়গুলো এখানে আছে?
আগে বাড়ল কিশোর। শান্তকণ্ঠে বলল, চোরই রেখেছে এগুলো এখানে।
শুনলে তো, হাঁদারাম… ম্যাকম্বারের দিকে চেয়ে মাথা নাড়লেন হ্যারিসন।
এক মিনিট, স্যার, হাত তুলল কিশোর। শুনুন। দুই সেট ফসিল ছিল না?
হ্যাঁ, বললেন হ্যারিসন।
পরশু রাতে মিউজিয়ামের সামনে পাহারা দিচ্ছিল জিপসি ফ্রেনি। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল, জেগে উঠল একটা শব্দে। গোলাঘরের মাচায় শুয়েছিলাম আমরা, তার ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল। নেমে এসে শুনলাম একটা গুহামানবকে নাকি মাঠের দিকে চলে যেতে দেখেছে। সে। লম্বা লম্বা চুল, গায়ে ছাল জড়ানো।
কি দেখেছে ফ্রেনি? গুহামানব তো হতেই পারে না। হয়তো গুহামানবের রূপ ধরে এসে তাকে ধোঁকা দিয়েছিল কেউ। মিস্টার ম্যাকম্বারের রান্নাঘর থেকে চাবি নিয়ে এনেছিল, মিউজিয়ামে ঢুকে গুহার কঙ্কালটা তুলে তার জায়গায় রেখে দিয়েছিল আফ্রিকান কঙ্কালটা। দ্বিতীয় কঙ্কালটা নিয়ে বেরিয়ে এসে, দরজায় তালা লাগিয়ে চলে গিয়েছিল মাঠের ওপর দিয়ে।
পাগল! বলে উঠল ম্যাকম্বার। ওই পাগলামি কে করতে যাবে?
ডাক্তার হ্যারিসনের ওপর যে দোষ চাপাতে চায়, তাকে খেলো করতে চায়। সে জানে, আগে হোক, পরে হোক, গুহার কঙ্কাল বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করতে আসবেই। লেবেল দেখলেই বুঝবেন, ওটা আফ্রিকান, ডাক্তার হ্যারিসন আফ্রিকায় যেটা পেয়েছেন।
মাথা নাড়লেন রুডলফ। তাতে কিছু হত না। গুহামানবের ছবি নিয়েছে হ্যারিসন, ফটোগ্রাফ। আফ্রিকান হোমিনিডের সঙ্গে আমেরিকানটার পার্থক্য আছে।
ছবি দেখে কি সত্যি বোঝা যায়? প্রশ্ন তুলল কিশোর। তাছাড়া কঙ্কালের বেশির ভাগই ছিল মাটির তলায়। আফ্রিকান হোমিনিডই ওখানে রেখে যে ফটো তোলেননি ডাক্তার হ্যারিসন, তার কি প্রমাণ? বোঝার উপায় আছে?
তাই তো সে করেছে, চেঁচিয়ে উঠল ম্যাকম্বার। সে ওটা রেখেছে। তারপর কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। মাঝখান থেকে আমাদের দশ হাজার ডলার গচ্চা। হ্যারিসনের দিকে ফিরল। সহজে ছাড়ব তোমাকে ভেবেছ? কেস করব আমি তোমার নামে। জেলের ভাত না খাইয়েছি তো… রাগে কথা আটকে গেল তার। গটগট করে বেরিয়ে গেল।
জ্বলন্ত চোখে তার দিকে তাকালেন হ্যারিসন। তারপর কুঁকলেন ট্রাংক থেকে হাড়গুলো বের করার জন্যে।
সরি, ডাক্তার হ্যারিসন, বাধা দিল ডেপুটি। এগুলো এখন ছুঁতে পারবেন না। আমাদের কাছে থাকবে। আদালতে হাজির করার দরকার হতে পারে।
মুখ বিকৃত করে ফেললেন হ্যারিসন। তারপর ম্যাকম্বারের মত বেরিয়ে গেলেন তিনিও।
উত্তেজনা শেষ। পাতলা হতে লাগল ভিড়।
তিন গোয়েন্দা রাস্তায় বেরিয়ে এল, উজ্জ্বল রোদে।
হেসে বলল মুসা, হয়ে গেল কেসের সমাধান।
না, হয়নি, বলল কিশোর। এখনও জানি না আমরা, কে ওই গুহামানব। জানি না, কে ঘুম পাড়াল পার্কভর্তি লোককে। আমেরিকান ফসিলটার কি হলো, তা-ও জানি না।
ম্যাকম্বারের বাড়ির দিকে চলল তিনজনে। অর্ধেক পথ পেরিয়েছে, ওই সময় তাদেরকে ডাকল বিল উইলিয়ামস। পথের মোড়ে গাড়ি রেখে তাতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কি হয়েছে ওখানে? স্টেশনের দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল সে। এত লোক?
চোরাই কঙ্কালটা পাওয়া গেছে, একটা ট্রাংকের ভেতরে, জবাব দিল রবিন।
তাই নাকি? চোর ধরা পড়েছে? মুক্তিপণের টাকা দিয়েছে ম্যাকম্বার?
দিয়েছে, কিশোর বলল। সকালে।
ভাল করেছে। ঝামেলা গেল। আবার ট্যুরিস্ট জমাতে পারবে।
ঝামেলা আছে। হঠাৎ কি মনে হলো কিশোরের, অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। লিলিকে দেখেছেন?
মাথা নাড়ল বিল। না। কেন?
না, কয়েকটা কথা ছিল। মনে হয় সেন্টারডেলে গেছে। আপনিও ওখানে যাচ্ছেন নাকি?
হ্যাঁ। যাবে?
দরজা খুলে ড্রাইভিং সীটে বসল বিল। বাঁকা হয়ে ঘুরে খুলে দিল পেছনের দরজা।
ডুবুরীর যন্ত্রপাতি সীটের একধারে ঠেলে দিয়ে উঠে বসল মুসা, তার পাশে রবিন। কিশোর বসল সামনে, বিলের পাশে।
চলতে শুরু করল গাড়ি। দোকানপাট আর স্টেশন ছাড়িয়ে এল। সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে চলল। ড্রাইভিং বোর্ডে উঠে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা।
দারুণ মজা, না? ওদের দেখিয়ে বলল বিল। আমারও খুব ইচ্ছে করে। ইস, যদি সাঁতার জানতাম।
শহর থেকে বেরিয়ে আঁকাবাঁকা পথ ধরে সেন্টারডেলের দিকে ছুটেছে গাড়ি। পেছনে তাকাল কিশোর। মুসার হাতে স্কুবা মাস্কটা। চোখাচোখি হলো দু-জনের। কথা হয়ে গেল ইঙ্গিতে। মাস্কটা আবার সীটে নামিয়ে রেখে পেছনে হেলান দিল মুসা।
আড়চোখে বিলের মুখের দিকে তাকাল কিশোর।
হাসি ফুটেছে বিলের ঠোঁটে। ফাঁক হয়ে আছে সামান্য, শিস দেয়ার ভঙ্গিতে।
দু-জনের মাঝখানে সীটের ওপর পড়ে রয়েছে কয়েকটা চিউইং গামের মোড়ক, একটা প্লাস্টিকের বাক্স-ঢাকনাটা নেই, খালি একটা কোকাকোলার টিন, একটা সবুজ বলপেন, খালি একটা খাম-উজ্জ্বল সবুজ রঙে উল্টোপিঠে লেখা রয়েছে কিছু, বোঝা যায়।
উল্টে নিয়ে পড়ল কিশোর। একটা লিস্ট। ওপরে পেট্রোল পাম্প আর একটা অটো সার্ভিস সেন্টারের নাম লেখা রয়েছে। লিস্টের সবচেয়ে নিচের নামটা দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার:
এ সাইনস সার্ভিস, ওঅ্যাডলি রোড।
খামটা রেখে দিল কিশোর। বলল, আপনি সাঁতার জানেন না, না?
না।
তাহলে ওই ডুবুরীর যন্ত্রপাতিগুলো কার?
আমার এক বন্ধুর।
তাই? কিশোরের কণ্ঠে এমন কিছু ছিল, তার দিকে না তাকিয়ে পারল না বিল।
শহর ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে এসেছে গাড়ি। পথের দুই ধারে গাছপালা। ব্রেকে পা রেখে কান পেতে কি শোনার চেষ্টা করছে বিল। কিসের শব্দ?
কই?
ইঞ্জিনে গোলমাল…শুনছ না?
পথের পাশে গাড়ি রাখল বিল। দরজা খুলে বেরোতে শুরু করল।
পেছনের সীটে ভুরু কোঁচকাল মুসা। কই, আমি তো কিছু শুনতে পাচ্ছি না?
কান ভাল না আরকি তোমাদের, গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে জানালা দিয়ে ছেলেদের দিকে তাকাচ্ছে বিল। মুখে রহস্যময় হাসি।
জোরে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর! ডুবুরীর যন্ত্রপাতির মানে এখন। পরিষ্কার হয়েছে। ক্লডিয়াসের ল্যাবরেটরি থেকে এমন কোন অ্যানাসথেটিক চুরি করা হয়েছে, যেটা ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারে পার্কভর্তি লোককে। তারপর হারিয়ে যায়, কোন চিহ্ন থাকে না। কিন্তু আপনি ওই গ্যাসের মধ্যে শ্বাস নিতে চাননি, এমনকি আপনার চামড়ায় লাগুক তা-ও চাননি। সেজন্যেই মুখে লাগিয়েছিলেন মাস্ক, পরেছিলেন। ওয়েট স্যুট। আর আপনাকে ওই পোশাকে দেখে জিপসি ভাবল একচোখা, দাতাল কোন দানব। পলকের জন্যে দেখেছিল তো, ঠিক বুঝতে পারেনি।
চেয়ে আছে বিল। চেহারায় কোন পরিবর্তন নেই।
লিলি আজ সকালে আপনার সঙ্গেই দেখা করতে গিয়েছিল। কোথায় ও?
স্প্রে করার ছোট প্লাস্টিকের বোতলটা অনেক দেরিতে দেখল কিশোর। ড্রাইভিং সীটের পাশেই কোথাও লুকিয়ে রেখেছিল, বের করে হাতে নিয়েছে বিল। ওটার মুখ সই করল কিশোরের দিকে।
চেঁচিয়ে উঠে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল মুসা।
স্প্রে করল বিল।
হালকা ভেজা ভেজা কিছু এসে লাগল ছেলেদের নাকেমুখে।
পরক্ষণেই পিছিয়ে গিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল বিল। আরও সরে গেল পেছনে।
অসাড় হয়ে এল কিশোরের হাত-পা। শরীরে এক বিন্দু শক্তি নেই। মাথাটা গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে সীটের একপাশে। ঘন হয়ে নামছে। অন্ধকারের চাদর, ঢেকে দিচ্ছে সবকিছু। জ্ঞান হারাল সে।
আঠারো
কিশোরের হুঁশ ফিরল। নাকে লাগছে ভাপসা গন্ধ। কাছেই জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে কারা যেন, নড়ে উঠল কেউ।
ঘন অন্ধকার।
উঠে বসল কিশোর। হাতে লাগল মাটি। অন্ধকারে গুঙিয়ে উঠল কেউ।
কে? হাত বাড়াল কিশোর।
গায়ে হাত লাগতেই চেঁচিয়ে উঠল একটা নারীকণ্ঠ।
লিলি? বলল কিশোর। লিলি অ্যালজেড্ডা?
ছাড়ো! চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটা। আমাকে ছেড়ে দাও।
কাছেই গুঙিয়ে উঠল মুসা। বিড়বিড় করে কি বলল রবিন।
আমি, কিশোর, শান্তকণ্ঠে বলল সে। মুসা, তুমি ভাল আছ? রবিন?
আ-আমি…ভাল, জবাব দিল মুসা। আল্লাহ্ রে, কোথায় এলাম?
রবিন? আবার ডাকল কিশোর।
ভাল।
লিলি, জিজ্ঞেস করল কিশোর, কোথায় রয়েছি জানেন?
পুরানো একটা গির্জার মাটির তলার ঘরে। লাশ রাখত আগে এখানে। ফুঁপিয়ে উঠে নাকি গলায় কাঁদতে শুরু করল লিলি। আর কোনদিন বেরোতে পারব না গো! কেউ আমাদের বাঁচাতে আসবে না! হায় হায় গো, এবার মরব!
মারছে রে! গুঙিয়ে উঠল আবার মুসা। শুরু হলো! থামুন না, প্লীজ!
লিলি, প্লীজ, মাথা ঠাণ্ডা করুন, অনুরোধ করল কিশোর।
বেরোনোর নিশ্চয় পথ আছে। কোনদিক দিয়ে এনেছে আমাদেরকে?
সিঁড়ির মাথায় ঢাকনা আছে একটা, ট্র্যাপডোর। ওই পথে। খানিক আগে উঁকি দিয়েছিল বিল, আমি জেগে গেছি দেখে আরেক দফা স্প্রে করে গেছে নাকের ওপর। জোরে জোরে শ্বাস টানল লিলি। কান্না থেমেছে। সকালে কথা কাটাকাটি হয়েছে ওর সঙ্গে। ওকে বলেছি, কঙ্কালটা ফিরিয়ে না দিলে শেরিফকে সব বলে দেব।
সেজন্যেই এনে ভরে রেখেছে? জানতে চাইল মুসা।
হ্যাঁ। কেঁপে উঠল লিলির কণ্ঠ। প্রথমবার হুঁশ ফিরলে অন্ধকার দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। জোরে চেঁচাতেও সাহস হয়নি। যদি কোন ফাঁকফোকর থেকে সাপ কিংবা অন্য কিছু বেরিয়ে আসে। চিৎকার শুনে ঢাকনা তুলল বিল। সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম। ফোকরের কাছাকাছি যেতেই আবার আমার নাকে ওষুধ ছিটাল সে। আবার বেহুশ। হয়ে গেলাম।
ওষুধটা নিশ্চয় ডাক্তার ক্লডিয়াসের আবিষ্কার, তাই না? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হ্যাঁ। ওটার নাম রেখেছিলেন এফ-টোয়েন্টি থ্রি। এপ্রিলের তেইশ তারিখে আবিষ্কার করেছেন তো, সেজন্যে। নানারকম পরীক্ষা। চালানোর ফলে শিম্পাঞ্জীগুলো খুব দ্রুত বেড়ে উঠছিল, তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে মরে যাচ্ছিল। সেটা ঠেকানোর জন্যে ওষুধ আবিষ্কারের চেষ্টা করছিলেন তিনি। বানিয়ে বসলেন বেহুশ করার ওষুধ।
এ-ব্যাপারে আলোচনা করার জন্যেই হারবারভিউতে যাচ্ছিলেন, তাই না? বলল কিশোর, অ্যানাসথেটিস্টের কাছে। কিন্তু কাজ শেষ করে যেতে পারলেন না। আচ্ছা, ফরমুলাটার কথা আপনিই বিলকে জানিয়েছেন তাই না? পার্কের লোককে ঘুম পাড়িয়ে গুহামানব চুরি করার ফন্দিটা কার?
আবার কান্না আশা করেছিল কিশোর, কিন্তু কাঁদল না লিলি। বলল, ফন্দিটা বিলের। ফরমুলাটার কথা আমি বলেছি। টাকার দরকার ছিল। কয়েকশো ডলার। তাহলে এখান থেকে চলে যেতে পারতাম। কিন্তু বেঈমানী করল সে।
এসব কথা তো পরেও জানা যাবে, নাকি? বলে উঠল মুসা। এখন বেরোনোর চেষ্টা করা দরকার।
কারও কিছু বলার অপেক্ষা না করেই হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়িটা বের করল সে। সাবধানে উঠতে শুরু করল। পিছু নিল রবিন। ওপরে উঠে মাথা ঠেকে গেল ট্র্যাপডোরে। দুই হাতে ঠেলে দেখল মুসা, উঠল না ঢাকনাটা।
আর কোন পথ নেই? জানতে চাইল রবিন।
না, নিচ থেকে জবাব দিল লিলি। কাঁদতে শুরু করল। আমরা…আমরা ফেঁসেছি ভালমত…বিল এসে খুলে না দিলে…হায় হায়, কেন একাজ করতে গেলাম গো…
আহ, কি শুরু করলেন? বলল কিশোর। এখান থেকে ঠিকই বেরিয়ে যাব আমরা। থামুন তো।
এই, মুসা, বলল রবিন। গালে বাতাস লাগছে। এই যে, এই দেয়ালটায় ফাঁকটাক কিছু আছে। সিঁড়ির পাশের দেয়ালের কথা বলল সে।
দেয়ালে হাত বুলিয়ে দেখল দু-জনে। পুরানো ইট, ভেজা ভেজা। নখ দিয়ে খোঁচা দিলেই নরম মাটির মত নখের ভেতর ঢুকে যায়। বেরিয়ে থাকা একটা ইটের মাথা ধরে হ্যাঁচকা টান মারল মুসা। তাকে অবাক করে দিয়ে খুলে বেরিয়ে এল ওটা। ফোকরে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে দেখল সে, ওপাশে আরেক সারি হঁট। দুই সারি হঁট দিয়ে তৈরি হয়েছে। দেয়াল।
কাজে লেগে গেল দু-জনে। সহজেই খুলে আসছে একের পর এক ইট। জোরে ঠেলা দিলে কোন কোনটা খুলে পড়ে যাচ্ছে অন্যপাশে। ছোট একটা ফোকর হয়ে গেল দেখতে দেখতে। আলো আর বাতাস এখন দুইই আসছে ওপথে।
মানুষ বেরোনোর মত একটা ফোকর করে ফেলল ওরা। দু-জনের আঙুলের মাথাই রক্তাক্ত, ব্যথা নিশ্চয় করেছে, কিন্তু টের পেল না। উত্তেজনায়।
উঠে এসে কিশোরও হাত লাগাল।
ফোকরের ভেতর দিয়ে মাথা গলিয়ে দিল মুসা। মাত্র দু-তিন ফুট নিচে মাটি। দেয়ালের বাকি অংশটা মাটির তলায়। সেটা বরং ভালই হলো ওদের জন্যে।
খুব সহজেই বেরিয়ে চলে এল ওরা।
সারা গায়ে ধুলো-ময়লা আর শ্যাওলা, ভূত সেজেছে যেন। একেকজন। হাতে-পায়ে আঁচড়ের দাগ, কোন কোনটা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। লিলির চোখ লাল, কেঁদে কেঁদে ফুলিয়ে ফেলেছে চোখমুখ।
চলো, শয়তানটাকে ধরি গিয়ে, বলল লিলি। পালানোর আগেই। নইলে লোকের সর্বনাশ করবে সে। এফ-টোয়েন্টি থ্রির ফরমুলা এখন তার হাতে।
আরও ওষুধ বানিয়ে মানুষকে ঘুম পাড়াবে ভাবছেন? বলল মুসা।
তাই তো করবে। ঘুম পাড়াতে পারলে কত কিছুই করা সম্ভব। পকেটের টাকা লুট করা থেকে শুরু করে অনেক কিছু..চলো, জলদি চলো।
বনের ভেতর দিয়ে দৌড়ে চলল ওরা। বনের শেষে মাঠ পেরিয়ে গোলাবাড়িতে পৌঁছে দেখল, ম্যাকম্বারের গাড়িটা আছে। ইগনিশন কী লাগানোই আছে। পেছনের সীটে এক গাদা প্যাকেট, টিন। এইমাত্র বোধহয় মুদির দোকান থেকে এসেছে ম্যাকম্বার।
এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ড্রাইভিং সীটে উঠে বসল লিলি। মোচড় দিল চাবিতে।
আরে, দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমাদেরকেও নিয়ে যান, বলতে বলতেই একটানে পেছনের দরজা খুলে ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে দিল মুসা। রবিনও উঠল। কিশোর উঠে বসেছে লিলির পাশে।
দরজায় দেখা দিল জেলডা ম্যাকম্বার। চেঁচিয়ে উঠল।
কিন্তু কানই দিল না লিলি। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে। গীয়ার বদলে টান দিল গাড়ি। একটানে উঠে চলে এল পথের ওপর। ছুটে চলল শহরের দিকে।
যাচ্ছি কোথায়? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরল লিলির। গতি কমিয়ে মুখ ফেরাল কিশোরের দিকে, ভা-ভাবছি সেন্টারডেলে…
ওখানে গেছে বিল, কি করে জানলেন?
আর কোথায় যাবে… থেমে গেল লিলি। দ্বিধায় পড়েছে।
সামনে কোথাও গাড়ি রেখে আগে শেরিফকে ফোন করুন, রামর্শ দিল কিশোর। চোখ বন্ধ করে বার দুই চিমটি কাটল নিচের, ঠোঁটে। বিলের গাড়িতে যে খামটা দেখেছিল, সবুজ কালিতে তাতে লেখা ঠিকানাগুলো মনে করার চেষ্টা করল। চোখ মেলল হঠাৎ। ওঅ্যাডলি! ওঅ্যাডলি রোডটা কোথায় জানেন?
সেন্টারডেলে। ইনডাস্ট্রিয়াল এরিয়ায়।
তাহলে সেখানেই! চেঁচিয়ে উঠে দু-আঙুলে চুটকি বাজাল কিশোর। খামে আরেকটা নাম দেখেছি…হ্যাঁ, সাইনস সার্ভিস। নিশ্চয় কোন কেমিকেল কোম্পানির নাম। এফ-টোয়েন্টি থ্রি বানাতে কেমিকেল দরকার। যেহেতু নাড়া একটা পড়েছে, আমরা জেনে গেছি, অনেক বেশি ওষুধ বানিয়ে এখন হাতে রাখতে চাইবে সে, পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যে।…সে বানাতে জানে তো?
জানে, জবাব দিল লিলি। কলেজে কেমিস্ট্রি ছিল।
তাহলে আর কোন সন্দেহ নেই। সেন্টারডেলেই গেছে সে। তাড়াতাড়ি ফোন করে আসুন।
টেলিফোন বুথের সামনে গাড়ি রেখে পকেট হাতড়াল লিলি। ইসসি, একটাও নেই।
এই যে, নিন, পকেট থেকে কয়েন বের করে দিল রবিন।
কয়েন ফেলে ডায়াল করার পরে প্রায় ত্রিশ সেকেণ্ড অপেক্ষা করতে হলো লিলিকে। তারপর রিসিভার তুলল কেউ ওপাশে। হ্যালো, আমি লিলি অ্যালজেডো। কিংসলে ম্যাকম্বারের…হা হা, আমিই। শুনুন, একটা খবর আছে। গুহামানবের কঙ্কাল বিল চুরি করেছে। হ্যাঁ, সেন্টারে কাজ করে যে সে-ই। তাকে ধরতে এখন সেন্টারডেলে যাচ্ছি। ওঅ্যাডলি রোডে, সাইনস সার্ভিস কোম্পানিতে আছে। আমরা যাই, আপনারা আসুন।
রিসিভার নামিয়ে রেখে গাড়িতে এসে উঠল লিলি। আমাদেরকে যেতে মানা করছিল। লাইন কেটে দিয়েছি।
সেন্টারডেলের দিকে গাড়ি ছুটল।
শহর থেকে বেরোতেই গ্যাস পেডালে জোরে চেপে বসল লিলির পা। এক লাফে গাড়ির গতি বেড়ে গেল অনেক। তীব্র গতিতে ছুটল। শাই শাই করে পাশ দিয়ে সরে যাচ্ছে গাছপালা। ফ্লোরবোর্ডে পা চেপে ধরেছে ছেলেরা। কোন মোড়টোড় এলে চাপ আরও বাড়ায়। শরীর সোজা রাখতেই হিমশিম খাচ্ছে। তারপরেও গতি বাড়িয়েই চলেছে লিলি। শান্তশিষ্ট ভীতু মেয়েটা অকস্মাৎ খেপে গিয়েছে।
সবাই নীরব।
পথের পাশের সাইনবোর্ড জানিয়ে দিল, সেন্টারডেলে প্রবেশ করেছে গাড়ি। ব্রেক চেপে ধরল লিলি। কর্কশ আর্তনাদ তুলল টায়ার। গাড়ির গতি স্বাভাবিক গতিবেগে নামিয়ে আনল সে, নইলে পুলিশের ঝামেলায় পড়তে হবে। এখন কোন বাধা আসুক, এটা চায় না।
দুটো সুপারমার্কেটের পাশ কাটিয়ে এসে ডানে মোড় নিল লিলি। পথের দুই ধারে ছোট ছোট দোকানপাট, তার পরে বাড়িঘর। মাঝে মাঝে গজিয়ে উঠেছে বিরাট বিরাট বিল্ডিঙ।
এটাই ওঅ্যাডলি রোড, জানাল লিলি। সাইনস সার্ভিস খুঁজে বের করতে সময় লাগল না। পার্কিং লটে বিলির পুরানো গাড়িটা নেই।
আসেনি নাকি? চিন্তিত কণ্ঠে বলল লিলি।
এক কাজ করুন, নিচের ঠোঁটে বারবার চিমটি কাটছে কিশোর।
শেরিফের অফিসে চলুন। হয়তো এসে ধরে নিয়ে গেছে ওকে।
সামনে এগিয়ে মোড় নিতেই দেখা গেল দুটো গাড়ি। সাইনস সার্ভিসের সীমানার মধ্যে, একটা গুদামের সামনে। শেরিফের গাড়ির পাশেই বিলের পুরানো গাড়িটা। বিল দাঁড়িয়ে আছে শেরিফের গাড়ির জানালার ধারে, হাতে স্প্রে-বটল। স্টীয়ারিং হুইলে মাথা রেখে পড়ে আছে একজন লোক, বোধহয় বেহুঁশ।
ইঞ্জিনের শব্দে মুখ ফিরিয়ে চেয়েই প্রায় দৌড়ে গিয়ে নিজের গাড়িতে উঠল বিল। স্টার্ট দিল। বিকৃত করে ফেলেছে মুখচোখ। গো গোঁ করে উঠেই বন্ধ হয়ে গেল ইঞ্জিন। আবার চাবি ঘোরাল সে। স্টার্ট নিতে চাইছে না ইঞ্জিন, থেমে থেমে যাচ্ছে। অবশেষে স্টার্ট নিল। নড়ে উঠল গাড়ি।
গ্যাস পেডালে পা চেপে ধরল লিলি। সোজা এগিয়ে যাচ্ছে বিলের গাড়ি সই করে। প্রচণ্ড জোরে গুঁতো লাগাল পুরানো গাড়িটার পেটে। ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙল, ধাতুর সঙ্গে ধাতুর সংঘর্ষে শব্দ হলো বিকট।
ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল তিন গোয়েন্দা।
যখন চোখ মেলল, দেখল, ম্যাকম্বারের গাড়ির বাম্পারে আটকে গেছে বিলের গাড়ির পেছনের চাকা। দুটো গাড়ির কোনটাই নড়তে পারছে না।
মুখ খারাপ করে গাল দিয়ে উঠল বিল। দরজা খুলে স্প্রে-বটল হাতে দৌড়ে এল লিলির দিকে।
পেছনের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল মুসা। বিলকে সই করে ছুঁড়ে মারল হাতের জিনিসটা।
বিলের ঠিক কপালে লাগল ওটা। টলে উঠল সে। হাত থেকে খসে পড়ল বোতল। সে নিজেও হুমড়ি খেয়ে পড়ল পথের ওপর।
সাইরেনের শব্দ শোনা গেল।
ঘ্যাঁচ করে এসে থামল শেরিফের দ্বিতীয় আরেকটা গাড়ি, বিলের কয়েক ফুট দূরে। পিস্তল হাতে লাফিয়ে নামল অফিসার। ভুরু কুঁচকে তাকাল পড়ে থাকা দেহটার দিকে, তারপর ছেলেদের দিকে ফিরল।
টমেটোর টিন, স্যার, হাসিতে বত্রিশ দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। মুসার। গাড়ির পেছনের সীটে রাখা ছিল। তুলে মেরে দিয়েছি।
উনিশ
পরদিন, বুধবার, সকাল।
গ্যাসপার রিসার্চ সেন্টারের চত্বরে বসে রৌদ্রোজ্জ্বল সুইমিং পুলের দিকে তাকিয়ে আছে ডেপুটি শেরিফ। খুব সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করছে। ডিউটি না থাকলে এতক্ষণে গিয়ে নেমে পড়ত পানিতে।
বিলের বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ জোগাড় করেছি, বলল সে। ট্রাংকের গায়ে তার আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। ওটা চুরি করে এনেছে তার বাড়িওয়ালীর স্টোররুম থেকে।
বসে থাকা সকলের ওপর চোখ বোলাল ডেপুটি। জেলডা আর কিংসলে ম্যাকম্বার পাশাপাশি বসেছে। সকালে ফোন করেছিল তাদেরকে রুডলফ, এখানে আসার জন্যে, অবশ্যই ডেপুটির অনুরোধে। আগের রাতটা মিসেস গ্যারেটের বাড়িতে কাটিয়েছে লিলি, দু-জনেই এসেছে এখন। মুষড়ে পড়েছে লিলি, তার বাহুতে হাত রেখে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে মহিলা।
আগের দিন সারাটা বিকেল সেন্টারডেলে শেরিফের লোকের সঙ্গে কাটিয়েছে তিন গোয়েন্দা, এখানে-ওখানে গেছে। তারপর সাইট্রাস গ্রোভে ফিরে এসেছে লিলির সঙ্গে।
ওয়ার্করুম থেকে বেরিয়ে এলেন ডাক্তার রুডলফ আর ডাক্তার হ্যারিসন। সুইমিং পুল থেকে গা মুছতে মুছতে এসে তোয়ালে গায়ে জড়িয়েই চেয়ারে বসলেন ডাক্তার রেডম্যান।
আমার গুহামানবের কি হলো তাই বলুন, জিজ্ঞেস করল ম্যাকম্বার। কখন পাব?
ট্রাংকের হাড় তোমার না! চেঁচিয়ে উঠলেন হ্যারিসন। ওগুলো আমার। আফ্রিকান হোমিনিড।
দুটো কঙ্কাল ছিল, দুই আঙুল তুললেন ডাক্তার রুডলফ। আরেকটা কোথায়?
এই চোরনীটাকে জিজ্ঞেস করছেন না কেন? বুড়ো আঙুল দিয়ে লিলিকে দেখাল জেলডা। চোরের দোসর। কোথায় লুকিয়েছে, বলুক।
ঝট করে মাথা তুলল লিলি। রাগে চোখ জ্বলছে। জানি না!
আরি, আবার তেজ দেখায়। এটা এখানে কেন? হাজতে ভরা হয়নি কেন? ধরে আচ্ছামত কয়েক ঘা লাগালেই পেট থেকে সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসবে কথা। জানে না, হুহ!
জামিনে মুক্তি দেয়া হয়েছে, বলল ডেপুটি।
জামিন! খেঁকিয়ে উঠল ম্যাকম্বার। ওর জামিন হতে গেল কে?
আমি, শান্তকণ্ঠে বললেন হ্যারিসন।
তুমি? তুমি হওয়ার কে?
ওর বস্। আসলে জামিন হওয়ার তো কথা ছিল তোমার। গেলে তো না।
যাইনি বলে কি মহা অন্যায় করে ফেলেছি নাকি?
ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলল জেলডা। আর যাবই বা কেন? চোরের শাস্তি হওয়া উচিত।
হ্যাঁ, তা তো হওয়াই উচিত, মুখ ছুটে গেল লিলির। আমার চেয়ে বড় বড় চোরেরা আছে এখানেই। তাদের জন্যেই আজ আমার এ দশা। নইলে লস অ্যাঞ্জেলেস কিংবা স্যান ডিয়েগোতে কলেজে পড়ার কথা এখন আমার।
এহ, আবার কলেজে পড়ার শখ। টাকা পাবে কোথায়? চুরি করে?
চুরি তত তোমরা করেছ! মুখের ওপর বলল লিলি। আমার বাবার ইনসুরেন্সের টাকাগুলো গেল কোথায়?
জোঁকের মুখে নুন পড়ল যেন, কুঁচকে গেল জেলডা।
থামল না লিলি, বলল, আর আমার বাড়িভাড়া? হলিউডের বাড়িভাড়া কত আসে জানি না আমি, না? কত টাকা লাগে আমার খেতে, থাকতে?
কেশে গলা পরিষ্কার করল ম্যাকম্বার। আহহা, অযথা রাগ করছিস তুই, লিলি। একেবারে বদলে গেছে ম্যাকম্বারের কণ্ঠস্বর, গলায় যেন মধু ঝরছে। যেতে চাইলে যাবি, কলেজে ভর্তি হতে চাইলে হবি, সে তো ভাল কথা। আমরাই সব ব্যবস্থা করে দেব। স্যান ডিয়েগো, কিংবা ওশনসাইড, যেখানে খুশি গিয়ে লেখাপড়া কর। বাড়ি ভাড়া করে দেব, খরচ দেব। আর কি চাস?
আমার বাবা মারা যাওয়ার পর কত টাকা বাড়িভাড়া এসেছে, তার হিসেব চাই। ইনসুরেন্সের টাকা কত পাওয়া গেছে, কতটা আমার পেছনে খরচ হয়েছে, তার হিসেব চাই। সেটা বাদ দিয়ে যা থাকবে সব চাই আমার।
কত আর থাকবে, হাত ওল্টাল জেলড়া। কয়েকশো। বড় জোর হাজারখানেক।
বেশ। তাহলে উকিলের কাছেই যাব আমি। এসে হিসেব-নিকেশ করুক। যদি একহাজার বাকি থাকে, সেটা আর নেব না, দান করে দেব তোমাদেরকে।
নাহয় পাঁচ হাজারই হবে, তাড়াতাড়ি বলল জেলডা।
মুচকি হাসল ডেপুটি। হাত তুলল, থামুন, থামুন। লিলি বড় হয়েছে। ও যদি উকিলের কাছে যেতে চায় যাক না। আপনাদের অসুবিধে কি?
না না… আমতা আমতা করল ম্যাকম্বার। আমাদের আর অসুবিধে কি? গেলে যাক না…
হ্যাঁ, এখন তো বড় হয়েছে, মুখ কালো হয়ে গেছে জেলডার।
পেলেপুষে বড় করেছি। এখন পাখা গজিয়েছে। আট বছরের যখন ছিল…
আহা রে, কি আমার মায়া রে! মুখ বাঁকাল, লিলি। এনেছ তো টাকার লোভে। দয়া কিংবা মায়া দেখিয়ে নয়।
আচ্ছা, ওসব কথা পরে হবে, বাধা দিলেন ডাক্তার রুডলফ।
আসল কথায় আসা যাক। কঙ্কালটা…
আমার কঙ্কাল আমাকে দিয়ে দেয়া হোক, বলে উঠল ম্যাকম্বার, ব্যস, আর কিছু চাই না।
সরি, বলল ডেপুটি, এই কেসের মীমাংসা হওয়ার আগে দেয়া যাবে না।
অন্য কঙ্কালটাও লাগবে? মানে, এই কেসের জন্যে। যদি দরকার হয়, বলুন।
একসঙ্গে সবগুলো মুখ ঘুরে গেল কিশোরের দিকে।
বনের মধ্যে পুরানো একটা গির্জায় পাওয়া যাবে ওটা, আবার বলল কিশোর। তাই না, ডাক্তার রেডম্যান?
পাথর হয়ে গেলেন যেন রেডম্যান।
ডাক্তার হ্যারিসনকে খেলো করতে চেয়েছিলেন। ডাক্তার ক্লডিয়াস মৃত, তার পরে যার গ্যাসপার পুরস্কার পাওয়ার কথা, তার দুর্নাম করে দেয়া গেলে পুরস্কারের তালিকায় সহজেই নাম উঠে যাবে আপনার। দশ লক্ষ ডলার, সোজা কথা তো নয়। মিউজিয়ামে সে-রাতে আপনিই ঢুকেছিলেন। মিস্টার ম্যাকম্বারের রান্নাঘর থেকে চাবি চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডাক্তার হ্যারিসনের আফ্রিকান হোমিনিডের কঙ্কালটা আগেই চুরি করেছেন, সেটা মিউজিয়ামে রেখে অন্যটা তুলে নিয়ে চলে গেছেন। আফ্রিকান কঙ্কালটা আমেরিকানটার জায়গায় রেখে এমনভাবে আশপাশের মাটি সমান করে দিয়েছেন, যাতে কিছু বোঝা না যায়।
মিউজিয়াম থেকে বেরোনোর সময় শব্দ করে ফেলেছিলেন। তাতে জেগে যায় জিপসি ফ্রেনি। তবে সেরকম কিছু ঘটতে পারে ভেবে তৈরিই হয়ে গিয়েছিলেন আপনি। গায়ে পশুর ছাল জড়িয়ে নিয়েছিলেন, সেন্টারে আছে ওরকম ছাল, কয়েক ঘণ্টার জন্যে একটা তুলে নিয়ে যেতে অসুবিধে হয়নি আপনার। মাথায় পরেছিলেন উইগ, মিসেস গ্যারেটের। সে কারণেই উইগটা অনেক খুঁজেও পাননি মিসেস গ্যারেট, পরদিন আবার যথাস্থানেই পেলেন। তারমানে কাজ শেষ করে এনে আবার জায়গামত রেখে দিয়েছিলেন আপনি। আর আপনার ওই বিকট সাজসজ্জা দেখে জিপসি ভাবল, বুঝি গুহামানবটাই জ্যান্ত হয়ে উঠে চলে যাচ্ছে।
যতসব আবোলতাবোল কথা! বললেন বটে রেডম্যান, কিন্তু গলায় জোর নেই।
আপনাকে প্রথমে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ রেখেছিলাম, বলে গেল কিশোর। স্টেশনের ঘরে ট্রাংকে কঙ্কালটা পাওয়ার পর আর পারলাম না। ডাক্তার হ্যারিসনের দুর্দশা দেখে কেমন খুশি হয়েছিলেন, মনে আছে? হাসি ফেটে পড়ছিল আপনার চোখেমুখে। ঢাকতে পারেননি। দেখে ফেলেছিলাম। তারপর থেকে নতুন করে ভাবতে বসলাম। পশুর ছাল আর উইগ নির্দেশ করল সেন্টারের দিকে। আমি, মুসা আর রবিন যখন সেদিন গির্জায় গিয়েছিলাম, আপনিও ছিলেন ওখানে। আমাদের দেখে ভয় পেয়ে যান, যদি কঙ্কালটা দেখে ফেলি? তাই ওখানে থাকতেই দেননি। নানারকম কথা বলে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের।
তোমার বকর বকর থামাবে? জোর করে হাসলেন রেডম্যান।
বকর বকর নয়, স্যার, প্রমাণ দিতে পারি। বেশি ভেবেচিন্তে কাজ। করেন আপনি, আর তা করতে গিয়েই ভুল করে সূত্র রেখে গেছেন। গুহামানবের পায়ে জুতো থাকার কথা নয়, সেটা বোঝানোর জন্যেই আপনিও পরেননি। সে-রাতে আমেরিকান কঙ্কালটা নিয়ে গির্জায় যাওয়ার সময় মাঠের ধারে নরম মাটিতে আপনার পায়ের ছাপ রেখে গেছেন। সেটার ছাঁচ তুলে এনেছি আমি। আপনার ডান পায়ের একটা আঙুলে দোষ আছে, বুড়ো আঙুলের পরেরটা..।
সবগুলো চোখ ঘুরে গেল রেডম্যানের খালি পায়ের দিকে। তাড়াতাড়ি পা চেয়ারের নিচে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করলেন ডাক্তার, এবং আরেকটা ভুল করলেন। সবাই দেখল, যা দেখার। আর প্রতিবাদ করে লাভ হবে না বুঝেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। যাই, কাপড় পরে ফেলি। আমার উকিলকেও খবর দিতে হবে।
এনথনি, এমন একটা কাজ তুমি করতে পারলে! বিষণ্ণ শোনাল ডাক্তার রুডলফের কণ্ঠ।
তার দিকে তাকালেন না রেডম্যান। ধীরপায়ে হাঁটতে শুরু করলেন ঘরের দিকে। পিছু নিল ডেপুটি।
আমার উকিলকেও খবর দেয়া দরকার, বাঁকা চোখে ম্যাকম্বারের দিকে চেয়ে বললেন হ্যারিসন। একটা ইনজাংকশন জারি করাতে হবে। দ্বিতীয়বার আর আমেরিকান হোমিনিড নিয়ে খেলা জমাতে দেব না তোমাকে, ম্যাকম্বার।
উঠে দাঁড়ালেন তিনি। গুনগুন করে উঠলেন মনের সুখে।
পারবে না! চেঁচিয়ে উঠল ম্যাকম্বার। ওগুলো আমার হাড়!
কে বলল? রসিকতা করলেন রুডলফ। তোমার হাড় তো তোমার গায়েই রয়েছে। বলতে পারো, তোমার কোন নিকট আত্মীয়ের হাড়। তবে সেটা প্রমাণ করতে হবে আদালতে। তার আগে আর গুহামানবের হাড় নিয়ে গুহায় ঢোকাতে পারছ না।
বিশ
দিন সাতেক পর।
হলিউডের বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারের অফিসে, তার বিশাল ডেস্কের সামনে বসে আছে তিন গোয়েন্দা।
ডেস্কের অন্য পাশে বসে গভীর মনোযোগে একটা ফাইল পড়ছেন পরিচালক। গুহামানবের কেস ফাইল। যত্ন করে টাইপ করে এনেছে রবিন।
টেরিফিক! অবশেষে মুখ তুলে বললেন পরিচালক। ফাইল বন্ধ করতে করতে বললেন, আরেকটু হলেই ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছিল বিল উইলিয়ামস।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। বেশি হেলাফেলা করে ফেলেছিল, সাবধান থাকলে তাকে ধরা কঠিন হত। ডাক্তার ক্লডিয়াসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকের পাতাগুলো সে-ই নষ্ট করেছিল। যাতে কেউ না জানতে পারে, হারবারভিউ লেনে একজন অ্যানাসথেটিস্টের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন ক্লডিয়াস। সেটা জানত শুধু লিলি। তার মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থাও করে ফেলেছিল বিল।
বোকা মেয়ে, বললেন পরিচালক।
গাফিলতির জন্যেই ধরা পড়ল বিল, আবার বলল কিশোর। গাড়ির পেছনের সীটে ডুবুরীর যন্ত্রপাতি ফেলে রাখল। এমন কি সবুজ বলপেনটাও ফেলে দেয়নি, যেটা দিয়ে মুক্তিপণের টাকা চেয়ে চিঠি, লিখেছিল। ইচ্ছে করেই বানান ভুল করেছিল, যাতে সবাই ভাবে, অল্প শিক্ষিত লোকের কাজ।
মুক্তিপণের টাকা সে নিয়েছিল সাইট্রাস গ্রোভ আর সেন্টারডেলের মাঝের একটা রেস্ট এরিয়া থেকে, ওখানেই টাকা রেখে আসার নির্দেশ দিয়েছিল ম্যাকম্বারকে। টাকার বটুয়া তার গাড়ির বুটেই পাওয়া গেছে। জুতোজোড়াও, যেগুলো পরে গুহামানবের কঙ্কাল চুরি করতে গিয়েছিল।
তাকে সন্দেহ করলে কিভাবে?
সাইট্রাস গ্রোভে যত ঘটনাই ঘটেছে, কোনটা ঘটার সময়ই সামনে। ছিল না সে। সেটা চোখে পড়ার মত। পার্কে সারা শহরের লোক যখন বেহুশ, তখনও সে সেখানে ছিল না। স্টেশনে ট্রাংকটা যখন পাওয়া গেল, তখনও সে সেখানে এল না। অথচ কাছাকাছি যারা ছিল, সবাই এসেছে, কেউ না এসে পারেনি। স্বাভাবিক কৌতূহল।
যেদিক থেকেই ভাবা হোক, সন্দেহ পড়ে তার ওপর। সেন্টারে। তার অবাধ যাতায়াত। লিলির সঙ্গে ভাব। ম্যাকম্বারের রান্নাঘর থেকে চাবি চুরি করা তার জন্যে সহজ। ডাক্তার ক্লডিয়াসের আবিষ্কৃত ফরমুলাটা লিলির কাছ থেকে জেনে নিতে পারে সে অনায়াসে।
কঙ্কাল চুরির সময় সে যে তার বাসায় ঘুমাচ্ছিল, এই অ্যালিবাইও ততটা জোরাল ছিল না, যতটা মনে হয়েছে। বাড়িওয়ালীকে বলেছে, সে তার ঘরে ঘুমাবে। বাড়িওয়ালী দেখতে যায়নি, সত্যি সে ঘুমাচ্ছিল কিনা। সে আছে কিনা, এই খোঁজ নেয়ারও দরকার মনে করেনি। পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে চলে এসেছিল বিল। বাড়িওয়ালী এসে তার ঘরে উঁকি দিতে পারে, এই আশঙ্কা করেনি, কারণ, যতদিন সে থেকেছে ওবাড়িতে, কোনদিন, কোন কারণে একবারের জন্যেও তার ঘরে উঁকি দিতে আসেনি মহিলা।
গাড়ি নিয়ে সোজা সাইট্রাস গ্রোভে চলে গেল বিল, পানির ট্যাংকের কাছে। শহরের লোক তখন সবাই পার্কে, উত্তেজিত, কেউ লক্ষ করল না তাকে। অটোমেটিক স্পৃিঙ্কলারের টাইমার সেট করল সে, পানিতে ওষুধ মেশার ব্যবস্থা করে বেরিয়ে এল ট্যাংক হাউস থেকে। ঠিক দশটা বিশ মিনিটে আপনাআপনি চালু হয়ে গেল স্পৃিঙ্কলার সিসটেম।
সিসটেম চালু হতেই সে সোজা চলে গেল মিউজিয়ামে। পরনে স্কুবা স্যুট, মুখে মুখোশ। স্প্রে-বটল থেকে ওষুধ ছিটিয়ে বেহুশ করল জিপসি ফ্রেনিকে। কঙ্কালটা চুরি করে নিয়ে পালাল। হাড়গুলো একটা বস্তায় ভরে নিয়ে এল স্টেশনের ঘরে, ওখানে আগেই রেখে গেছে ট্রাংকটা। হাড়গুলো ট্রাংকে ভরে বেরিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দিল। ডুপ্লিকেট একটা চাবি আগেই বানিয়ে নিয়েছিল। চুরির কাজটা খুব সহজেই সারল সে, কারণ তখন শহরের সব লোক ঘুমাচ্ছে পার্কে। পুলিশের কাছে নিজেই বলেছে এসব বিল, দম নেয়ার জন্যে থামল কিশোর। তারপর বলল, লিলির সাহায্যেই ল্যাবরেটরি থেকে অ্যানাসথেটিক চুরি করেছে সে। লিলিকে বলেছিল, কঙ্কালটা চুরি করে নিয়ে গিয়ে কোন মিউজিয়ামে বিক্রি করে দেবে। তাতে হাজারখানেক ডলার আসতে পারে। অর্ধেক দেবে লিলিকে।
কিন্তু যখন ম্যাকম্বারের কাছে দশ হাজার ডলার দাবি করে বসল বিল, লিলি আঁতকে উঠল। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করল। কাজ হলো না। এমন কি লিলির পাঁচশো ডলার দিতেও রাজি হলো না সে। সব টাকাই নিজে মেরে দিতে চাইল। তাতেই আরও বেশি রেগেছে লিলি।
বোকা মেয়ে, আবার বললেন পরিচালক।
তবে, পরে উকিল আর শেরিফের সামনে সব বলে দিয়েছে লিলি। সে-ই এখন সরকার পক্ষের প্রধান সাক্ষী। নিজের কুকর্মের জন্যে লজ্জিত। সব দিক বিবেচনা করে বিচারক তাকে জেলে না ঢুকিয়ে একটা ফাইন করে ছেড়ে দেবেন বলে মনে হয়।
কিন্তু কঙ্কাল চুরির আইডিয়াটা প্রথমে কার মাথায় এসেছিল?
বলা যায়, দু-জনেরই। কথায় কথায় একদিন ফরমুলাটার কথা বিলকে বলল লিলি। ক্লডিয়াসের মৃত্যুর পর ফরমুলাটা গোপন করে ফেলার পরামর্শ দিল লিলিকে বিল। তার মনে হয়েছিল, এই ফরমুলা দিয়ে অনেক কিছু করা সম্ভব। তখনও আর কেউ জানে না ওই ফরমুলার কথা, একমাত্র লিলি আর সে ছাড়া। তাই, অন্য কেউ জানার আগেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক থেকে পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলল, ফরমুলাটা চুরি করল।
হুঁ, মাথা দোলালেন পরিচালক, অনেক কিছুই করা সম্ভব ওই অ্যানাসথেটিক দিয়ে। ব্যাংকের সমস্ত লোককে ঘুম পাড়িয়ে ব্যাংক লুট করা যায়, জুয়েলারীর দোকান সাফ করে দেয়া যায়, হাজারটা অপরাধ করা যাবে ওই একটিমাত্র অ্যানাসথেটিকের সাহায্যে। কিন্তু একটা ব্যাপার, পানিতে মিশিয়ে দিল, অথচ ল্যাবরেটরি টেস্টে কিছু পাওয়া গেল না কেন?
সেটা ওই অ্যানাসথেটিকের আরেকটা বিশেষত্ব। ছড়ানোর কয়েক সেকেণ্ড পরই সমস্ত লক্ষণ মুছে যায়। একেবারে উবে যায়। কোন টেস্টেই আর ধরা পড়ে না।
খুব বিপজ্জনক। আচ্ছা, রেডম্যানের কি হলো?
এ সম্মানিত লোক, আর অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে তাকেও জেলে ঢোকাননি বিচারক। তবে ফাইন করা হয়েছে। গ্যাসপার সেন্টার থেকে চাকরি গেছে তার। যা বদনাম হয়েছে, আর কেউ তাকে নেবে কিনা, সে-ব্যাপারেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। জেল খাটার চেয়ে বড় শাস্তি হয়েছে তার।
সবচেয়ে বড় মার তার জন্যে, রবিন বলল, বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এবারকার গ্যাসপার পুরস্কারটা তাকেই দেয়া হবে। কারণ, জনহিতকর অনেক বড় গবেষণা করছিল রেডম্যান। বেশি লোভ করতে গিয়ে সব দিক হারাল লোকটা।
হুঁ। ইউনিভারস্যাল ফেইলিং অভ ক্রিমিনালস, গম্ভীর হয়ে বললেন পরিচালক। সব অপরাধীই ভাবে, সে ধরা পড়বে না।…হাড়গুলোর কি
দুই সেটই রয়েছে শেরিফের অফিসে, কেবিনেটে তালাবন্ধ, বলল কিশোর। বিলের কেস পুরোপুরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত থাকবে ওখানেই। ইতিমধ্যে গভর্নরের সঙ্গে দেখা করেছেন ডাক্তার হ্যারিসন। গভর্নরকে বুঝিয়েছেন, পুরো জায়গাটাকে রিজার্ভ এরিয়া ঘোষণা করার পরামর্শ দিয়েছেন। ওখানে আরও হাড় পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। মূল্যবান বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হবে সেগুলো। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছেন গভর্নর।
ম্যাকম্বারের কি অবস্থা?
প্রায় পাগল। মাথায় চুল ছেঁড়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। তাকেও কোর্টে হাজির করিয়ে ছাড়তে পারত লিলি, কিন্তু ছোটবেলায় তাকে একটা আশ্রয় তো অন্তত দিয়েছে তারা, এই ভেবে আর উকিলের কাছে যায়নি। ইনসুরেন্সের টাকার কথা আর তোলেনি। তবে হলিউডের বাড়িটার দখল নিয়ে নিয়েছে সে। ভাড়াটেদের নোটিশ দিয়ে দিয়েছে। ওরা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে বাড়িটাকে গার্লস বোর্ডিং বানাবে লিলি। তার মতই যারা অনাথ, তাদেরকে জায়গা দেবে ওখানে, খুব সহজ শর্ত আর কম ভাড়ায়। নিজেও ওখানেই থেকে কলেজে পড়বে।
খুব ভাল আইডিয়া, মাথা নাড়লেন পরিচালক। খুব ভাল। আর। একটা প্রশ্ন। ফরমুলাটার কি হলো?
বিলের পকেটে ছিল। ধরা পড়ার পর চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে। তার কথা, সে যখন পেল না, আর কারও হাতে পড়তে দেবে না।
আহ্হা, গেল একটা মহামূল্যবান আবিষ্কার। তবে এক হিসেবে বোধহয় ভালই হলো। মানুষের উপকারে যেমন আসত, অপকারেও লাগানো যেত ওই ওষুধ। অনেকক্ষণ পর চেয়ারে হেলান দিলেন পরিচালক। মুসার দিকে চেয়ে বললেন, তারপর, মুসা আমান, তুমি তো একেবারে চুপ। কি ব্যাপার? খিদে পেয়েছে?
না, স্যার, নড়েচড়ে বসল মুসা। এমনি। ওরাই তো সব বলছে। আমি আর কি বলব…
তোমার টিন ছোঁড়াটা কিন্তু সময়মত হয়েছিল, মৃদু হাসলেন পরিচালক। নাহলে বিলকে ধরা হয়তো কঠিন হয়ে যেত। যাই হোক, চমৎকার এই কেসের সমাধান উপলক্ষে ফুটকেক আর আইসক্রীম হয়ে যেতে পারে, কি বলে?
না, স্যার, কি দরকার… মাথা চুলকে বলতে গিয়েও থেমে গেল মুসা। দরজা খুলে ঘরে ঢুকেছে বেয়ারা। দুই হাতে উঁচু হয়ে আছে। অনেকগুলো বাক্স। বুঝল, আগেই অর্ডার দিয়ে রেখেছেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। হাসিতে ঝকঝকে সাদা দাঁত বেরিয়ে গেল সহকারী গোয়েন্দার। বলল, থ্যাংকিউ, স্যার, থ্যাংকিউ।
হাসিটা সংক্রমিত হলো সবার মাঝে।