- বইয়ের নামঃ প্রিক অন মাই থাম্ব
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
প্রিক অন মাই থাম্ব
১-৪. নতুন বছর শুরু
০১.
নতুন বছর শুরু হতে আর বেশী দেরী নেই।
ওয়েস্টের বিরাট হলে এখন জমায়েত হয়েছেন। পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিরা।
মিঃ স্যাটারহোয়াইট খুশী হয়েছেন এই কারণে যে ঘোটরা সবাই এই মুহূর্তে নিদ্রামগ্ন।
তার মনোভাবটাই এইরকম, তিনি মনে করেন, যৌবন অকারণে মানুষকে বিকৃত করে তোলে।
মিঃ স্যাটারহোয়াইটের বয়স বাষট্টি। ঈষৎ ঝুঁকে পড়েছেন বয়সের ভারে, শেষ হয়ে গেছে বুঝি সমস্ত আনন্দ, অন্য মানুষের জীবনযাত্রার প্রতি আছে তার অকারণ কৌতূহল। আর এই আশ্চর্য বোধই তাকে করে তুলেছে বিচিত্র সুন্দর মানুষ। সমস্ত জীবন ধরে তিনি দেখেছেন, সমান পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি। মনে মনে কল্পনা করেছেন অনেক কিছু। এই বয়সে এসেও এখনও পর্যন্ত তিনি ভুলতে পারেননি সেইসব দিনগুলির কথা। তাই বোধহয় সবসময় নতুন কিছুর সন্ধানে ব্যস্ত থাকেন।
তার কাছে জীবন এক রহস্যঘন নাটক। প্রতিটি পলে অনুপলে যেখানে সংযোজিত হচ্ছে একটির পর একটি নতুন অধ্যায়। যুদ্ধরত ঘোড়ার মতো তিনি বিপদের গন্ধ পান। ওয়েস্টে আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে দিচ্ছে হয়তো এমন কিছু ঘটবে সকলকে একেবারে অবাক করে দেবে।
শুরু হয়ে গেছে হাউস পার্টি। জন আজকের অতিথিবৎসল গৃহকর্তা। অত্যন্ত সহৃদয় তিনি। এমন কি তার বিবাহিতা স্ত্রী মেরী লরাকিংও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল আগন্তুক অতিথি অভ্যাগতদের সন্তুষ্টি বিধানে। এসেছেন স্যার রিচার্ড স্কট, এককালে ছিলেন সৈনিক। এখন নিরন্তর দেশভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন, আর জমায়েত হয়েছে আরো অনেক অজানা ব্যক্তিরা। স্যাটারহোয়াইটের চোখে তারা এক-একটি জীবন্ত আগন্তুক বুঝি।
অ্যালেক্স পোর্টার। তার কাছেই এসেছেন স্যাটারহোয়াইট। অনেক জিজ্ঞাসা জমে আছে। এই লোকটিকে কেমন অদ্ভুত মনে হচ্ছে স্যাটারহোয়াইটের। অ্যালেক্স পোর্টারের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। তার মাথায় যথেষ্ট চুল আছে। চোখের তারার রঙ নীল। ভালোবাসেন খেলাধুলো। যে কোন খেলাতে পারদর্শী, মনের মধ্যে নেই কল্পনার মৃদু আভাস। হঠাৎ দেখলে অ্যালেক্স পোর্টারের মধ্যে কোন অস্বাভাবিকত্ব ধরা পড়ে না। আর পাঁচটা ইংরেজ যুবকের মতো হাবভাব তাঁর।
কিন্তু রহস্য জমে আছে বুঝি তার স্ত্রীর অবয়বে। অন্তত স্যাটারহোয়াইটের কথায়, সে এসেছে অস্ট্রেলিয়া থেকে। দুবছর আগে পোর্টার গিয়েছিলে অস্ট্রেলিয়াতে। সেখানেই তার সঙ্গে আলাপ হয়। আর তাকেই জীবনসঙ্গিনী করেন তিনি। বিয়ের আগে মেয়েটি কখনো ইংল্যান্ডে আসেনি। আর অন্যান্য যে সমস্ত অস্ট্রেলিয় তনয়ার সঙ্গে ইতিমধ্যে মিঃ স্যাটারহোয়াইট যোগাযোগ করেছেন তাদের থেকে এই মেয়েটি একেবারে আলাদা।
এই মেয়েটির প্রতি কেন্দ্রাভূত স্যাটারহোয়াইটের সমস্ত একাগ্রতা এখন, প্রচণ্ড প্রাণবন্ত মেয়েটি। সবসময় টগবগ করে ফুটছে। কিন্তু হঠাৎ মিঃ স্যাটারহোয়াইটের মনে হলো যে, মেয়েটি কেন অকারণে তার চুলের রঙ পাল্টায়?
হয়তো এই ব্যাপারটা অন্য কারো নজরে পড়তো না। কিন্তু আগেই বলেছি আমরা, মিঃ স্যাটারহোয়াইটের আছে প্রচুর পর্যবেক্ষণ শক্তি। তিনি অনেক কৃষ্ণবর্ণ আচ্ছাদিত রমণীকে চেনেন, যাদের চুলের রঙ হলো সোনালী। কিন্তু এর আগে এমন কোন শ্বেতাঙ্গিনীর সন্ধান পাননি, অকারণে যে চুলগুলিকে কালো রঙে রাঙিয়ে তোলে।
এই ঘটনাই ভাবিয়ে তুলেছে তাকে। কি হতে পারে এই রহস্যের অন্তরালে?
পোর্টার অসম্ভব মদ্য পান করে চলেছে। পর্দার আড়াল থেকে মাঝে মধ্যেই লক্ষ্য রাখছে সে, পরীর মতো ফুটফটে উড়ে বেড়ানো স্ত্রী রত্নটির দিকে।
কথাগুলো উড়িয়ে যাচ্ছে।
বলে ওঠে–বারোটা বাজে। হ্যাঁপী নিউ ইয়ার। যদিও ঘড়িটা পাঁচ মিনিট ফাস্ট আছে। কিন্তু আমার মনে হয় এখন থেকেই নতুন বছরের আনন্দ করা উচিত।
সায় দেয় তার স্ত্রী। সকলে মিলে শুরু করে নববর্ষের পার্টি, টুকরো টুকরো কথাগুলো উড়ছে বাতাসে। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে উপস্থিত সবাই আনন্দের অবগাহনে স্নাত হচ্ছে বুঝি।
স্যাটারহোয়াইট কিন্তু কথোপকথনে যোগ দিচ্ছেন না। তার মনের মধ্যে একটাই চিন্তা কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে।
হঠাৎ এখানে আর একটি ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ হয় তার নাম হচ্ছে হেনরী কুইন।
পরস্পর পরিচিত হতে বেশীক্ষণ সময় লাগে না। হেনরী কুইনকেও কেমন অদ্ভুত স্বভাবের মনে হলো স্যাটারহোয়াইটের। এমন কি ইভেসহ্যাম যখন তাকে মদ দিতে গেলো, সবিনয়ে সে সেটি প্রত্যাখ্যান করলো।
ইভেসহ্যাম জানতে চায়–কুইন, আপনি কি আগে এখানে এসেছিলেন?
-হ্যাঁ, দুবছর আগে।
—সত্যি?
-হ্যাঁ, তখন এই বাড়িটা ছিলো চ্যাপেল নামের এক ভদ্রলোকের।
চেনেন কে?
–হ্যাঁ, চিনি।
হঠাৎ ইভেসহ্যামের কথাবার্তার মধ্যে পরিবর্তন দেখা দিলো। যা অনেকের চোখ এড়িয়ে গেলেও স্যাটারহোয়াইটের চোখ এড়াতে সমর্থ হয়নি।
মিঃ কুইন বলতে থাকে–আমার যথেষ্ট পরিচিত ছিলো সেই লোকটি। কিন্তু কি হলো তার সে খবর তো আমি আর পাইনি।
পরিবেশের মধ্যে থমথমে গভীরতা এসে প্রবেশ করে।
কারণ এই লোকটিকে আমি চিনতাম, জীবনের সমস্ত উন্মাদনার মধ্যে, সব সমস্যাকে ফুঙ্কারে উড়িয়ে দেবার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার। আনন্দের সমুদ্রে অবগহন করতো সে।
মিঃ কুইন হাসতে হাসতে বলেন, এমন ভাবেই চলতে থাকে কথাবার্তা। কিন্তু সেই ঘনীভূত পরিবেশটা বোধহয় আগের মতো আর হচ্ছে না।
মিঃ স্যাটারহোয়াইট আবার তাকিয়ে থাকেন। হঠাৎ আর-একটি রমণীর চেহারা নজরে আসে তার। দাঁড়িয়ে আছে সে গ্যালারীর একপাশে, কিন্তু তাকে দেখে চিনতে ভুল হয়নি। সেই-ই হলো ইলিয়েন পোস্টার।
মিঃ কুইনের আবির্ভাব, পোর্টারের সঙ্গে আলাপ হওয়া সবই কি এক সুতোয় গাঁথা বলে মনে হচ্ছে?
ডিনার শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। মিঃ কুইন বসেছেন চেয়ারে, সকলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে ঘুরে ফিরে যাচ্ছে।
এক-একজন এক-একরকম ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। কেউ-বা অনেক বেশী কথা বলছে, কেউবা চুপচাপ বসে রাতের আহার সারছে, কেউ-বা আনন্দের আতিশয্যে হাততালি দিচ্ছে। মিঃ স্যাটারাহোয়াইট বেশ বুঝতে পারছেন, কোথায় যেন রহস্য যবনিকা ধীরে ধীরে খুলছে তার আবরণ।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে একটি শব্দ শোনা যায়। অ্যালেক্স পোর্টার যেন কিছু বলতে চাইছেন, ইলিয়েন, আমাকে ক্ষমা করো, আমাকে ক্ষমা করো। তুমি আমাকে সত্যি কথা বলো, ঈশ্বরের দোহাই, তোমাকে অনেকদিন থেকে আমি চিনি, অ্যালেক্সকেও আমি জানতাম। কিন্তু এই মুহূর্তে সব কথা বলতে পারছি না, অ্যালেক্স।
.
০২.
গ্লাসের ওপর ছায়া
লেডি সিনথিয়া বললেন, আমার কথা শোন। এই সপ্তাহে গ্রীনওয়েজ হাউজে মিঃ এবং মিসেস আনকারটন একটি পার্টি দেবে।
দেখতে দেখতে এসে যায় সেই পার্টির মুহূর্তটি। সুসজ্জিত অতিথি অভ্যাগতদের সমাগমে ভরে উঠেছে ব্যাঙ্কওয়েট হল। আগের মত মিঃ স্যাটারহোয়াইট ব্যস্ত আছে তার নিরীক্ষণের কাজে। অনেক নতুন মানুষের সংস্পর্শে আসতে হবে তাঁকে এই পার্টিতে। মনে মনে ঈষৎ উৎকণ্ঠিত তিনি বুঝি। ঐ তো দেখা যাচ্ছে সকলকে। হাজির হয়েছে পুরোনো পরিচিতরা। তার মধ্যে নতুন কেউ কেউ এসে সন্ধ্যায় এই অনুষ্ঠানকে আরো বেশী সাফল্যমণ্ডিত করে তুলেছে নাকি?
প্রিভি গার্ডেনে তখন সান্ধ্য আসর জমে উঠেছে। সেখানে হাজির আছেন অনেকেই মিঃ স্যাটারহোয়াইট তাকিয়ে দেখলেন প্রিভি গার্ডেনে। সাজানো লনে বসে আছে রিচার্ড স্কট এবং মিঃ আনকারটন। টেবিলে সবেমাত্র ফেনিল সুরার মূৰ্ছনা।
পোর্টার কিছু কথা বলছে বুঝি ওদের সঙ্গে।
হঠাৎ দেখা গেল কোন এক উত্তেজনার ঘটনা ঘটে চলেছে। হঠাৎ সশব্দে কিছু বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ছুটে যান সকলে সেখানকার কাছাকাছি।
পোর্টার চিৎকর করে ওঠে–ঈশ্বরের দোহাই, কি ঘটনা ঘটলো?
হুড়োহুড়ি শুরু করে গেছে। আইরিশ হাতে একটি পিস্তল নিয়ে চিৎকার করে বলে আমি এটিকে এক্ষুণি এখান থেকে পেলাম।
মিঃ স্যাটারহোয়াইট আরো এগিয়ে আসেন। আনকারটন এবং স্কটের দিকে দাঁড়িয়ে হাঁটু মুড়ে কিছু বলতে চেষ্টা করেন তিনি।
স্কট তখন বিড়বিড় করে বলেন–একজন ডাক্তারকে ডাকুন।
ডাক্তার ডাকার আর সময় নেই। তার আগেই দেখা গেল যে জিমি অ্যালেনসাম আর ময়রা স্কটের রক্তাক্ত দেহটা সেখানে পড়ে আছে।
রিচার্ড স্কট ছোটাছুটি করতে শুরু করেন। তার মতো লৌহকঠিন মানুষের হৃদয় বুঝি এই মুহূর্তে কিছুটা ভারাক্রান্ত হয়েছে ঘটনার আকস্মিকতায়। পুলিশকে খবর দিতে হবে।
চোখে মুখে ফিরে এসেছে হারানো প্রত্যয়।
পোর্টার আবার ফিরে পাচ্ছেন তাঁর গম্ভীরতা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে হাজির হলেন ইনসপেক্টর ইনফিল্ড।
সকলে বসে আছে লাইব্রেরীতে। ইনসপেক্টরকে দেখে মনে হচ্ছে চতুর মুখের মানুষ তিনি। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। জীবনের অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। তাই এইসব ঘটনা আর কোন বিস্ময় উদ্রেক করতে পারে না তার ভাবলেশহীন মুখে। তিনি এখন শুনছেন মেজর পোর্টার এবং মিঃ স্যাটারহোয়াইটের বক্তব্য। আনকারটন বসে আছেন চেয়ারের মধ্যে। আর তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে শূন্য চোখে।
ইনসপেক্টর বলতে শুরু করলেন–ভদ্রমহোদয়গণ, আমাদের মনে হচ্ছে যে এর মধ্যে কোথাও একটি রহস্য লুকিয়ে আছে। আসুন তো, আমরা প্রিভি গার্ডেনের সেই ঘটনার অকুস্থলে পৌঁছাই।
–চলুন, যাওয়া যাক ইনসপেক্টর।
–আপনারা শুনেছিলেন, দুটি গুলির শব্দ আর একজন মহিলার আর্তনাদ, তাই তো?
–ঠিকই বলেছেন।
–আপনারা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়েছিলেন এবং প্রিভি কাউন্সিলে পৌঁছানোর পরে কাউকে পালিয়ে যেতে দেখেননি। অবশ্য চারিদিকে এমন ঘন ঝোঁপ আছে যে, কোন লোক যদি বসে থাকে তবে তার চেহারা আপনাদের চোখের সামনে উদ্ভাসিত হবে না।
মিঃ আনকারটন, আপনি তো বসেছিলেন প্রিভি গার্ডেনের চেয়ারে। আপনিও কি সামনে কিছু দেখেননি যা আপনার মনের মধ্যে সংশয়ের উদ্রেক করতে পারে?
ইনসপেক্টরের এই কথা শুনে ভয়ের একটা ছবি দ্রুত সরে যায় আনকারটনের মুখের ওপর থেকে। তিনি আমতা করে বলেন-তেমন কিছু দেখিনি স্যার। তবে মনে হয়েছিল কোন কোন মানুষের মধ্যে বুঝি কিছুটা বিহ্বলতার ছাপ রয়েছে।
ইনসপেক্টর আবার বলতে শুরু করেন তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এইরকম মিঃ এবং মিসেস আনকারটন, ও লেডি সিনথিয়া বসেছিলেন লনের ওপরে। মিঃ স্কট ছিলেন বিলিয়ার্ড রুমে যার একটি দরজা লনের দিকে খোলা আছে। ছটা বেজে দশ মিনিট বাদে মিসেস স্যাভারটন বেরিয়ে এসেছিলেন ঘর থেকে। তখন তিন সমাগত ভদ্রলোকের সঙ্গে দুটি একটি করে কথা বলছিলেন। তারপর প্রিভি গার্ডেনের দিকে এগিয়ে যান।
দুমিনিট বাদে গুলির শব্দ শোনা গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতর ছুটে যান। আর আনকারটন ছুটে আসেন প্রিভি গার্ডেনের দিকে।
ঠিক সেই সময়ে আপনি মানে মিঃ স্যাটারহোয়াইট এসে হাজিরে হয়েছিলেন সেখানে। স্যাভারটন ছিলেন প্রিভি কাউন্সিলে। তার হাতে ছিল একটা পিস্তল যার থেকে দুটি গুলি নিক্ষেপ করা হয়েছিল। তাই মনে হচ্ছে যে তিনি প্রথমে গুলিটি নিক্ষেপ করেন পেছনের বেঞ্চি থেকে। তারপর ক্যাপ্টেন অ্যালেনসন গুলিবিদ্ধ হয়ে গোঙাতে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আবার তাকে গুলি করা হয়েছিল। আমার মনে হচ্ছে তার সঙ্গে এবং মিঃ রিচার্ড স্কটের সঙ্গে বোধহয় হতভাগ্য ব্যক্তিটির পূর্ব পরিচয় ছিল।
পোর্টার বলে ওঠে–এটা একেবারে মিথ্যে কথা। পোর্টারের কণ্ঠস্বরের মধ্যে কেমন একটা কর্কশতা মেশানো আছে। তার দিকে ইনসপেক্টর চোখ তুলে তাকালেন। কিন্তু মুখে কোন কথা বললেন না।
মিঃ স্যাটারহোয়াইট জানতে চাইলেন–ভদ্রমহিলা কি জবানবন্দী দিয়েছে?
তিনি বলেছেন যে কিছুক্ষণ আগেই তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন প্রিভি গার্ডেনে। তারপর হঠাৎ করে গুলির শব্দ কানে আসে তার। তিনি দেখতে পান যে পিস্তলটি পড়ে আছে তার পায়ের কাছে। কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে সেটিকে কুড়িয়ে নিয়েছিলেন, অবশ্য এই কথার কোন সম্মানজনক ইঙ্গিত নেই তার বক্তব্যের মধ্যে।
কিছুক্ষণ পরে ইনসপেক্টর আবার বলতে শুরু করেন-মনে হচ্ছে তাঁর কথার মধ্যে কোথায় যেন মিথ্যে লুকিয়ে আছে। গোপন করার চেষ্টা করছেন তিনি।
পোটার বলেন–তিনি যদি তাই বলে থাকেন তাহলে এটাই সত্যি কথা। কেননা আমি তো আইরিশ হ্যাঁভারটনকে চিনি।
ইনসপেক্টর বলেন–অনেক কথা বলা হয়েছে, আমার কিছু কাজ করতে হবে।
পোটার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসেন মিঃ স্যাটারহোয়াইটের দিকে।
-আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন?
হঠাৎ এই বক্তব্যে তিনি বিচলিত হতে থাকেন। কিন্তু কোন কথা বলেন না।
এর পরেই ইনসপেক্টর ব্যস্ত হয়ে পড়েন তার নিজস্ব কাজে। ভয় এবং বিহ্বলতার ছায়া তখন গ্রাস করেছ সমস্ত পরিবেশকে। কোথায় হারিয়ে গেছে আগের সেই উৎসবমুখর আনন্দ ঝংকার।
.
০৩.
কি ঘটতে পারে?
মিঃ স্যটারহোয়াইটকে খুব বিরক্ত মনে হলো। যদিও দিনটা শুরু হয়েছিলো দুর্ভাগ্যের মধ্যে দিয়ে। তার অন্তরালে যে লুকিয়ে ছিলো এমন ভয়ের ছায়া কে খবর রাখতো তার? জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন তিনি কয়েকটি উড়ন্ত ছোট্ট পাখির দিকে। সামনে গ্রামের পরিপূর্ণ পরিবেশে তার বেশ ভালোই লাগছে সময় কাটাতে।
হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া ঐ ঘটনাটা বেশ ভাবিয়ে তুলেছে তাকে বোধহয়। তিনি এই মুহূর্তে দৃষ্টি নিবন্ধ রেখেছেন আকাশর কোণে দৃশ্যমান নীল নীলিমার দিকে। অনেক কিছু ভাবনার অনুরণন ঘটে গেছে তার মনের মধ্যে।
খুঁজতে খুঁজতে তাঁকে পৌঁছতে হলো বেলটস অ্যাণ্ড মটলে নামে সরাইখানাতে। সেখানেই বোধহয় রাত্রিবাস করতে হবে তাকে।
সোফিয়ারকে পথনির্দেশ করে দিলেন তিনি। সোফিয়ার গাড়ি চালাতে শুরু করে। এখনও চল্লিশ মাইলের মতো পথ পার হলে তবে ঐ সরাইখানাতে পৌঁছতে পারবেন।
একটি অদ্ভুত কথা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তার। কেন তিনি এসেছেন বেলটস অ্যাণ্ড মটলেতে? এর সঙ্গে ঐ রহস্যের কি সম্পর্ক আছে?
প্রথম দিনের পার্টিতে দেখা হওয়ার পর মিঃ কুইন যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তার সঙ্গে তো আর যোগাযোগ হচ্ছে না। এসব কথাই ভাবতে ভাবতে পথ পার হয়ে আসেন স্যাটারহোয়াইট।
কুইনের সঙ্গে আবার দেখা করতেই হবে।
মনে হচ্ছে, এইসব ঘটনার অন্তরালে রহস্য লুকিয়ে আছে যা না জানা পর্যন্ত রাত্তিরে ঘুম হবে না মিঃ স্যাটারহোয়াইটের।
অবশেষে চোখে পড়লো তার। বাতাসের মধ্যে দেখা হচ্ছে বেলটস অ্যাণ্ড মটলের সাইনবোর্ড।
.
০৪.
আকাশ জোড়া চিহ্ন
এইমাত্র বিচারক শেষ করলেন তাঁর ভাষণ-ভদ্রমহোদয়গণ, আমি যা বলতে চলেছি শেষ হয়ে এসেছে। আমার হাতে অনেক তথ্য প্রমাণাদি আছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি যে ১৩ই সেপ্টেম্বর শুক্রবার দিন একটি চিঠি লেখা হয়েছিল। যে চিঠির বয়ান অনুসারে সমস্ত দোষ স্বীকারও করে নেওয়া যেতে পারে।
দাঁড়িয়ে ছিলেন মিঃ স্যাটারহোয়াইট কোর্ট ঘরেতে। থমথম করছে সমস্ত মুখমণ্ডল তাঁর। প্রচণ্ড উত্তেজনাকে দমন করে শুনতে চাইছেন বিচারকের শেষ রায়টি।
এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিচার ব্যবস্থা তাকে মোটেই আকর্ষণ করে না। তবে এই ঘটনাটি একেবারে আলাদা কেননা এর সঙ্গে ভদ্রলোকের জীবন আর স্যার জর্জ বার্নালের সেই তরুণী স্ত্রীটি, তার কথাও ভাবতে হবে বৈকি।
আলবর্নের পথে হাঁটতে হাঁটতে এসব কথা ভাবছিলেন মিঃ স্যাটারহোয়াইট।
তারপর দেখা হয়ে গেল মিঃ কুইনের সঙ্গে কোর্টের মধ্যেই। দুজনেই বোধ হয় একই পথের পথিক। কিন্তু তাদের পথের সীমানা অনেক পাল্টে গেছে এখন।
মিঃ কুইনকে দেকে স্যাটারহোয়াইটের চোখে মুখে উত্তেজনার ছায়া ফুটে ওঠে। মিঃ কুইন কি একজন পাকা অভিনেতা। কত সহজে সংগোপন করেন তিনি মনের যে কোন বোধ।
পথচলতি একটি কাফেতে বসলেন দুজনে। বেশ কিছু কথা বোধ হয় বলতে হবে।
মিঃ স্যাটারহোয়াইট বলতে শুরু করেন, এইমাত্র আমি ওল্ড বেইলি থেকে এলাম।
মিঃ কুইন আগ্রহভরে জানতে চান–কি রায় দিয়েছেন বিচারক?
-কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে কি?
–আছে অবশ্যই।
কথাটা শেষ না করইে মিঃ কুইনের দিকে অর্থপূর্ব দৃষ্টি মেলে দিলেন মিঃ স্যাটারহোয়াইট।
–মনে হচ্ছে, অপরাধীর প্রতি আপনার কোন সহানুভূতি রয়ে গেছে?
–আমার মনে হয় মার্টিন ওয়াইল্ডে একজন সুন্দর চেহারার যুবা পুরুষ যার সব কথা আমরা বিশ্বাস করতে পারি।
–তাই কি? জিজ্ঞাসা করেন মিঃ কুইন। আমাকে ক্ষমা করবেন।
–মার্টিন ওয়াইল্ডের সম্বন্ধে অনেক কিছু বলা হলো। কিন্তু তার কাজের প্রতি আমরা বোধ হয় নজর দিতে পারিনি।
স্যাটারহোয়াইট দ্বিধাগ্রস্ত চিত্তে বলেন, কোন সাক্ষী আছে?
–আমরা বোধ হয় ঠিকমতো সাক্ষীর পেছনে অন্বেষণ করছি না।
মিঃ স্যাটারহোয়াইটের স্ব-আরোপিত গম্ভীরতা আবার ফিরে এসেছে। তিনি আবার বলতে শুরু করেন–আমি বারানাবাসদের সঙ্গে কথা বলেছি। এক অদ্ভুত পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছে তারা।
মিঃ কুইনের মুখে ফুটে ওঠে আগ্রহী হাসির ঝিলিক।
–এমন কোন প্রমাণ সত্যি সত্যি দেখাতে পারেন মিঃ স্যাটারহোয়াইট, আমি বিশ্বাস করবো।
মিঃ স্যাটারহোয়াইট টেবিল চেপে ধরেন দুহাতে।
মিঃ কুইন স্যাটারহোয়াইটকে একেবারে অবাক করে দিয়ে বলতে শুরু করেন তার কাহিনী
-সত্যি কথা বলতে কি, সেদিন ঘটে যাওয়া সেই আশ্চর্য ঘটনা আমার মনের মধ্যেও তোলপাড় করেছিলো। কিন্তু আমি সন্তর্পণে সন্ধ্যার সমাবেশে আগত অতিথিদের প্রত্যেকের জীবন ইতিহাস সংগ্রহ করেছি। তার ফলে কয়েকটি আশ্চর্য ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে আমার। সত্যি কথা বলতে কি, যাকে আপনারা অভিযুক্ত বলে সন্দেহ করেছেন সেই আইরিশের হয়তো খুব একটা দোষ নেই এই খুনের কাণ্ডে। আমরা পরিস্থিতির স্বীকার বলতে পারি। কেননা তার সঙ্গে গোপন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল জিমি অ্যালেনসনের আর সেই সম্পর্কের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছিলো ময়রা স্কট।
একটা ত্রিভুজ প্রেমের ঘটনা বলা যেতে পারে। যদিও আইরিশ অনুরক্ত ছিল জিমি অ্যালেনসনের প্রতি, উড়ে এসে জুড়ে বসা ঐ ময়রা স্কটকে সহ্য করতে পারেনি সে। একজন তাকে দিতে চেয়েছিলো অপার্থিব ভালোবাসা। অন্যজন তার হৃদয় রাঙিয়ে দিয়েছিল কামনাতে। এই দুয়ের মধ্যে পড়ে তার মনের মধ্যে যেসমস্ত ভাবনা অনুরণিত হয়। তার ফলেই দ্বিধাবিহ্বল চিত্তে অবশেষে এই পথ বেছে নিয়েছিল।
আইরিশের মনের মধ্যে তখন জমেছে এই ঘটনার ঘনঘটা মেঘের সমাবেশ। কিছুতেই স্থির করতে পারছে না সে, কি করবে। একবার ভাবছে, ছুটে চলে যায় তার প্রথম প্রেমিকের কাছে যে তার জীবনকে ভরিয়ে তুলবে অনাস্বাদিত আনন্দে। পরমুহূর্তেই অন্যতর চেতনায় পরিপ্লাবিত হচ্ছে তার মন। সে ভাবছে, যদি কামনা বাসনা না থাকে তাহলে জীবনে বেঁচে থাকার অর্থ আর কি হতে পারে।
এই টানাপোড়েনের মধ্যে চলতে চলতে আইরিশ বোধহয় নিজের সমস্ত চিত্তগ্রাহিকাকে একেবারে হারিয়ে ফেলেছিল। আর পরিণত হয়েছিল অদ্ভুত মানবী সত্তায়। এমনটি ঘটে থাকে অনেক ক্ষেত্রে।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ তার মধ্যে ছেদ টেনে স্যাটারহোয়াইট মন্তব্য করেন–যদিও তিনি সহ্য করতে পারছেন না মিঃ কুইনের এই বক্তব্যকে। এর মধ্যে কোথায় যেন বিষণ্ণতার সুর বাজছে। যে রহস্য সমাধানের সমস্ত কৃতিত্ব তারই করায়ত্ত হওয়ার কথা। তা হওয়া সম্ভব হচ্ছে না শুধুমাত্র মিঃ কুইনের উপস্থিতির জন্যে।
মিঃ কুইন আরো বলতে শুরু করেন, খুজতে খুজতে আমি হাজির হয়েছিলাম আইরিশের গ্রামের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে যেসব ঘটনার কথা আমি শুনলাম তাতেই মনে হতে পারে সে আইরিশকে যদিও আমরা অভিযুক্ত করতে বলছি এই খুনের অন্তরালে আততায়ী হিসেবে কিন্তু তার মনের মধ্যে বোধহয় একধরনের কোন অভীপ্সা ছিল না। আসলে সেই সন্ধ্যাতে, প্রাইভেট পার্টিতে সাজানো প্রেক্ষাপটটি ছিল এই রকমের-অ্যালেনসন এসে সশব্দে গুলি করে হত্যা করবে ময়রা স্কটকে। আর তার জীবনের পথের এই কাটাটিকে সরিয়ে সে অচিরেই লাভ করবে আইরিশের হৃদয়। কিন্তু কেমন যেন সব হয়ে গেল। তখন তারা দুজনে বসে গল্প করছিলো পার্টিতে, তখন হঠাৎ আইরিশ বুঝতে পারে অ্যালেনসনের মনোভঙ্গিটি। আর সঙ্গে সঙ্গে সে তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল পিস্তলটি। ঘটনার বিহ্বলতায় আইরিশ অবাক হয়ে যায়। ঠিক এই মুহূর্তে ময়রা স্কট পার্টিতে এসে প্রবেশ করে। সেই অকুস্থলে তখন তাদের দুজনের মধ্যে শুরু হয়েছিলো দ্বন্দ্বযুদ্ধ। হয়তো দুজনকে বাঁচাতেই এমনতর হত্যকারিণীর ভূমিকায় হাত রাঙাতে হয়েছিল আইরিশকে। সে এক বীভৎস বিহ্বল অবস্থা। ঘরের মধ্যে প্রশস্ত লনে জমে উঠেছে আনন্দের উৎসব, যখন আমরা ব্যস্ত ছিলাম পেগের পর পেগ শ্যাম্পেন গলাধঃকরণ করতে তখন পিয়ানোতে বসে ডরোথি স্মিথ তার সুরেলা কণ্ঠস্বরে ভরিয়ে দিয়েছিলো রাতের বাতাস। তখনই হঠাৎ সমস্ত কিছুর বুক বিদীর্ণ করে ছুটে গিয়েছিল তপ্ত সীসার বুলেট। আর দু-দুটো মৃত্যু আবিষ্কৃত হয়েছিল আইরিশের পায়ের তলায়।
ময়রাকে সে গুলি করে হত্যা করতে চায়নি, সরাতে চায়নি তার প্রিয়তম অ্যালেনসনকে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে আজ তাকে দু-দুটি হত্যকাণ্ডের একমাত্র অভিশাপ মাথায় নিয়ে পৃথিবীকে চিরবিদায় জানিয়ে চলে যেতে হচ্ছে। এর থেকে দুঃখের কাহিনী আর কি হতে পারে, স্যাটারহোয়াইট।
শেষ হয়ে গেল মিঃ কুইনের অনুসন্ধান পর্ব। ততক্ষণে সন্ধ্যা এসে থেমেছে সেখানে। মিঃ স্যাটারহোয়াইট পাইপে অগ্নি সংযোগ করে ভাবতে লাগলেন, না, জীবনে আর কোন রহস্য সন্ধানে তিনি আর ছুটে যাবেন না। কেননা মানুষের জীবনের প্রতিটি পলে অনুপলে জড়িয়ে আছে কত রহস্য গাথা কে তার খবর রাখে?