সোভেলডাউনের কাছে তারা যখন গাড়ি চড়ে এগোচ্ছে–জ্বলন্ত শরত্বনানী চতুর্দিক থেকে তাকে পরিবেষ্টিত করে আছে। উচ্ছ্বসিত হয়ে জন চিৎকার করতে থাকে, লন্ডনের বাইরে চলে আসা কী কম খুশীর। একবার ভেবে দেখো জাদা, এই বিকেলবেলা আমাদের অন্ধকার ঘরে বসে চা পানের কথা আর এখানের মনোরম দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।
আবছা আলোয় ঘেরা বসার ঘরের কথা মনে আসতেই আকুল হয়ে ওঠে জাদার মনপ্রাণ তার মনে হতে লাগল-হায়, এখনই যদি সে সেখানে পৌঁছে যেতে পারতো। বীরাঙ্গনার মতোই মুখ নিয়ে সে বলে ওঠে, পল্লীর রমণীর সৌন্দর্যের কোনো তুলনা করা কি চলে?
খাড়া পাহাড় থেকে নীচের দিকে নেমে এসেছে, ফেরার আর কোনো দ্বিতীয় পথও নেই। জাদার যেন মনে হতে লাগল, সে যেন অন্ধকার কারাগারে বন্দী হতে চলেছে। এ বন্দী জীবনের কোনো শেষ আছে কি? হার্লি স্ট্রিটে ফিরে যাওয়া তার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব, কারণ সে এখন দুঃস্বপ্নের গহ্বরে ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে।
গাড়ি চালাতে চালাতে জার্দার দৃষ্টি চলে যায় খানিকটা দূরে, যেখানে হেনরিয়েটা এবং মিডগে একটা লম্বা লোকের সঙ্গে বসে কথা বলতে ব্যস্ত। হেনরিয়েটাকে দেখেই সে একটু আশ্বস্ত হয়, হেনরিয়েটার ওপর জার্দার অগাধ আস্থা ছিল, সে ভাবতে থাকে যে-কোনো অবস্থা থেকে উদ্ধার যদি করতে কেউ পারে সে হেনরিয়েটা। হেনরিয়েটাকে দেখে জন মনে মনে খুশী হয়। গন্তব্যস্থলে পৌঁছে জন এবং জার্দা হেনরিয়েটার অভ্যর্থনায় বড়ই প্রীত হয়। জন মুখে কিছু বলল না, কিন্তু মনে মনে এটাই উপলব্ধি করলে যে, হেনরিয়েটা এখানে না এলে ছুটির সমস্ত আনন্দটাই মাঠে মারা যেত।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বেরিয়ে আসেন, সাদর অভ্যর্থনা জানান জন এবং জার্দাকে। জাদার ব্যাপারে তিনি একটু বেশি আতিথেয়তা করলেন। যা তিনি সচরাচর অতিথিদের সঙ্গে করেন না। তিনি এমন একটা ভাব দেখাতে লাগলেন যে, জাদাকে পেয়ে তার খুশীর অন্ত নেই। জনকেও তার উপযুক্ত সম্বর্ধনা জানালেন। তার আচার-ব্যবহারে এটাই প্রস্ফুটিত হচ্ছিল যে, প্রধান অতিথি–জাদাই, সহযাত্রী হিসেবে তার পাশে থাকছে জন। জার্দা এ ব্যাপারটার জন্য মানসিক দিক থেকে একেবারে প্রস্তুত ছিল না, তাই সে মনে মনে একটু ক্ষুণ্ণই হয়।
লুসি বললেন, এডওয়ার্ডের সঙ্গে তোমাদের চেনা-পরিচিতি আছে তো?
এডওয়ার্ড এ্যাঙ্গক্যাটেল
কে? জন সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে ওঠে, না, কই মনে কিছু করতে পারছি না তো।
বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের রক্তিম আভায় তার নীল চোখের তারাও সুন্দর হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। যার চোখে পড়বে সেই বলে উঠবে কোনো এক দিগ্বিজয়ী বীর জাহাজ থেকে ধরণীর বুকে নেমে এসে সকলকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে, এবং শুভ সংবাদে সকলকে প্রসন্ন করে তুলেছে। তার কণ্ঠস্বরে যেমন রয়েছে আন্তরিকতার ছাপতেমনি হৃদয়কেও ছুঁয়ে যাচ্ছে এবং মুহূর্তের মধ্যে উপস্থিত সকলকেই চুম্বকের মতো নিজের দিকে আকর্ষণ করতে থাকে।
জনের প্রতিভা যেন সকলকে আড়ালে রেখে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে থাকে। এডওয়ার্ড যে এতক্ষণ কুশানী নায়কের মতো আপন প্রভাব বিস্তার করে বলে উঠেছিল সে যেন হঠাৎ কার নিষ্প্রভ হয়ে ওঠে, জীবন্ত থেকে ছায়ায় পরিণত হতে খুব বেশি সময় নিল না।
রান্নাঘর সংলগ্ন উদ্যানে হেনরিয়েটা এবং জাদা বেড়াচ্ছিল। হেনরিয়েটা জাদাকে বলে ওঠে, লুসি হয়তো আমাদের রক গার্ডেন এবং অটাম বর্ডার দেখানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠবে, আমার মনে হয় কিচেনগার্ডেন কিন্তু অনেক ভালো এবং শান্তিপূর্ণ জায়গা। শশার মাচার ওপর। বসে এখান থেকে অনেক দৃশ্য চোখে পড়ে এবং মনের সুখে গল্পও করা যায়। এদিকটা কেউ বড় একটা মাড়ায় না, সেই জন্যই বোধহয় বেশ নিঝুম নিরিবিলি।
জাদার সঙ্গে মনের কথা বলতে বলতে হেনরিয়েটা কাঁচা মটর তুলে তুলে খেতে থাকে কিন্তু জাদার এসবে কোনো সুখ নেই। সে-যে লুসি এ্যাঙ্গক্যাটেলের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে পেরেছে এতেই তার আনন্দ। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলকে দেখে এবারও বেশ ভীতিপ্রদ লাগছিল। দশ মিনিট ধরে হেনরিয়েটা তার কাছে এমন সব প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল, চার উত্তর জাদার জ্ঞাত। হেনরিয়েটা তাকে বোকা প্রতিপন্ন করার জন্য তো প্রশ্ন করে না। সে শুধু মন খুলে লোকের সঙ্গে আলাপ জমায়, তাই জার্দাও খুশী হয়, সে ভাবে ছুটিটা বোধহয় খুব খারাপ যাবে না।
জেনা এখন নাচের ক্লাসে ভর্তি হয়েছে, তার জন্য যে নতুন ফ্রকটা কেনা হয়েছে জার্দা তার সবিস্তারে বর্ণনা দিয়ে যায়। সে এমনি আরও সংসারের দু-একটা কথা নিয়ে হেনরিয়েটার সঙ্গে সুদীর্ঘ আলোচনায় বসে যায়। হেনরিয়েটাও তাকে সস্নেহে উপদেশ দেয়।
জাদাকে খুশী করা সত্যিই খুব সহজ ব্যাপার এবং জার্দা খুশী হয়ে তার চেহারার আমুল পরিবর্তন হয়ে যায়।
শশার মাচায় বসে থাকতে থাকতে তারা একই সঙ্গে সূর্যাস্ত প্রত্যক্ষ করছে, গ্রীষ্মকালের উত্তাপ মনে মনে সেও উপভোগ করছে।
নীরবতা নেমে আসে হঠাৎ করে। জাদার মুখের অভিব্যক্তি যে এক লহমায় হারিয়ে যায়। সে যেন দুঃখের ছবির মতোই বসে রইল। হেনরিয়েটার কথা শোনা মাত্রই সে লাফিয়ে ওঠে।
হেনরিয়েটা–এ্যাঙ্গক্যাটেলদের তুমি যখন ঘৃণার চোখে দেখ, তখন তুমি এখানে আস কোন্ উদ্দেশ্যে?