হয়তো সম্ভব। তবে একদিন, দুইদিন বা সাতদিনে সেটা হবে না। আরো বেশিদিন লাগবে। তিনি আছেন মাত্র একদিন। আগামীকাল ফিরে যাচ্ছেন নিজ গ্রহে। কাজেই সময়টা উপভোগ করা যাক। কে জানে জীবনে আর কখনো ট্র্যান্টরে আসা হবে কি না।
তবে একটা অস্বস্তি রয়েই গেল। সম্রাটের সাথে তিনি যেভাবে কথা বলেছেন সেটা বোধহয় ঠিক হলো না। হাজার হোক এই লোকটাই গ্যালাক্সির হর্তাকর্তা। ইচ্ছে হলেই তাকে বন্দী বা হত্যা করতে পারে। অথবা সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে এমন পর্যদস্ত করবেন যার চেয়ে মৃত্যুই অধিক শ্রেয় মনে হবে।
তার হোটেলের রুমে একটা কম্পিউটার আছে। রাতে ঘুমানোর আগে সেই কম্পিউটারের এনসাইক্লোপেডিক অংশে প্রথম ক্লীয়নের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের জন্য একবার ঢু মেরেছিলেন। সেখানে সম্রাটের অতি উচ্চমাত্রার প্রশংসা করা হয়েছে। সন্দেহ নেই পূর্ববর্তী সম্রাটরা ভালো মন্দ যাই করুক না কেন জীবিতকালে তারাও একইরকম প্রশংসা পেয়েছেন। এটা নিয়ে মাথা ঘামাননি তিনি। তাকে সবচেয়ে যা অবাক করেছে সেটা হলো সম্রাট ক্লীয়নের জন্ম রাজপ্রাসাদে এবং তিনি আজ পর্যন্ত এক সেকেন্ডের জন্যও প্রাসাদ এলাকা ছেড়ে বেরোন নি। হয়তো নিরাপত্তার কারণে। সেলডনের মনে হয়েছে সম্রাট আসলে বন্দী, কেউ স্বীকার করুক বা না করুক। হয়তো এটা গ্যালাক্সির সবচেয়ে বিলাসবহুল আরামদায়ক কয়েদখানা, কিন্তু আসলে তিনি বন্দী।
যদিও সম্রাটের আচার-ব্যবহার যথেষ্ট ভালো এবং পূর্বপুরুষদের মতো রক্তলোলুপ এইকথা তার শত্রুও বলবে না। তবু তাকে খেপিয়ে তোলাটা অনুচিত। আগামীকাল হেলিকনে ফিরে যাচ্ছেন এই ভাবনাটাই তার দেহ মনে স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিল। যদিও তার নিজ গ্রহে এখন শীতকাল এবং এই সময়টাতেই সেখানকার প্রকৃতি সবচেয়ে জঘন্য রূপ ধারণ করে।
উজ্জ্বল আলোর দিকে চোখ তুলে তাকালেন তিনি। যদিও এখানে কখনো বৃষ্টি হয় না, তথাপি বাতাসে জলীয় উপাদান যথেষ্ট। সামান্য দূরে একটা ফোয়ারা; গাছ পালাগুলো সবুজ এবং সেগুলো সম্ভবত কখনো শুষ্কতার মুখোমুখি হয়নি। হঠাৎ ঝোঁপঝাড়গুলো এমনভাবে নড়ে উঠছে যেন ওগুলোর ভেতর দিয়ে কোনো প্রাণী ছুটে যাচ্ছে। এমনকি তিনি মৌমাছির গুঞ্জনও শুনতে পেলেন।
পুরো গ্যালাক্সিতে ট্র্যান্টরকে মনে করা হয় ধাতু এবং সিরামিকের কৃত্রিম বিশ্ব, আর এই ছোট জায়গাটা সত্যিকার অর্থেই আকর্ষণীয়।
আরো গুটিকয়েক মানুষ পার্কে আছে। সকলের মাথাতেই হালকা রঙের টুপি, কয়েকটা আবার ভীষণ ঘোট। সামান্য দূরেই অতিশয় সুন্দরী এক তরুণী বসে আছে, যদিও ভিউয়ারের উপর ঝুঁকে থাকার কারণে সেলডন তার মুখ দেখতে পেলেন না। মন্থর পায়ে এক লোক পেরিয়ে গেল তাকে, যাবার সময় কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। গিয়ে বসল একেবারে মুখোমুখি চেয়ারটায়। পায়ের উপর পা তুলে মুখ ঢাকল একগাদা টেলিপ্রিন্টারে। পরনে গোলাপি রঙের আঁটোসাঁটো ট্রাউজার।
অদ্ভুত ব্যাপার, ট্র্যান্টরের পুরুষ অধিবাসীদের ভেতর রঙচঙে পোশাক পরার প্রবণতা আছে, অথচ মেয়েরা পরিধান করে আটপৌরে সাদা পোশাক। এমন পরিচ্ছন্ন আবহাওয়াতে হালকা পোশাক পরিধান করাই যুক্তিযুক্ত। খানিকটা আমুদে ভঙ্গিতে নিজের হেলিকনিয়ান পরিচ্ছদের দিকে তাকালেন। বহুব্যবহারে ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে সেগুলো। ট্র্যান্টরে তো তিনি আর থাকছেন না কিন্তু যদি থাকতেন তাহলে সবার আগে কিনতে হতো নতুন পোশাক। অন্যথায় সকলের কৌতুক আর হাসির খোরাক হয়ে পড়তেন তিনি। এই যেমন সামনের টেলিপ্রিন্টারওয়ালা তার দিকে এখন আরো বেশি কৌতূহল নিয়ে তাকাচ্ছে। আউটওয়ার্ল্ডের পোশাক তাকে আগ্রহী করে তুলেছে নিঃসন্দেহে।
মানুষকে হাসিয়ে ভিতরে ভিতরে তিনি হয়তো দার্শনিক হয়ে উঠতে পারতেন, কিন্তু ব্যাপারটা তিনি উপভোগ করতেন না।
সেলডনও এবার কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালেন। লোকটা বোধহয় নিজের সাথেই তর্ক করছে। একবার মনে হলো তার সাথে কথা বলবে, পরমুহূর্তেই সিদ্ধান্ত বদলে পিছিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই আবার মনে হলো কথা বলবে। শেষ পর্যন্ত ফলাফল কী দাঁড়াবে সেলডন ভেবে পাচ্ছেন না।
লোকটা লম্বা, চওড়া কাধ, মেদহীন কাঠামো। গাঢ় রংয়ের চুলের মাঝে ছিটেফোঁটা সোনালি রংয়ের আভা। মসৃণভাবে কামানো গাল, গম্ভীর অভিব্যক্তি, দেখেই বোঝা যায় প্রচণ্ড শক্তিশালী অথচ শরীরের কোথাও মাংসপেশীর বাহুল্য নেই। রূঢ় মুখমণ্ডলে আমুদে ভাব কিন্তু সেখানে সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটাও নেই।
নিজের মনের সাথে তর্কযুদ্ধে লোকটা বোধহয় হেরে গেল (অথবা জিতল), কারণ কথা শুরু করার জন্য সে খানিকটা সামনে ঝুঁকে এসেছে। সেলডন বুঝতে পারছেন লোকটাকে তার পছন্দ হবে।
মাফ করবেন, আপনি কী সেই গণিত সম্মেলনে ছিলেন, প্রতি দশ বছরে যেটা অনুষ্ঠিত হয়? প্রথম কৌতূহলী প্রশ্ন।
হ্যাঁ, ছিলাম। জবাব দিলেন সেলডন।
আহ্, মনে হয়েছিল আমি আপনাকে ওখানে দেখেছি। কিছুটা পরিচিত মনে হলো বলেই আপনার কাছাকাছি বসেছি। মাফ করবেন, বোধহয় আপনাকে বিরক্ত-
মোটেই না, আমি এখন অলস সময় কাটাচ্ছি।
ঠিক আছে দেখা যাক আমি যা জানি সেটা কতখানি সঠিক। আপনি প্রফেসর সেলডন।
সেলডন। হ্যারি সেলডন। প্রায় সঠিক বলেছেন। আপনি?