- বইয়ের নামঃ জলদস্যুর দ্বীপ ২
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী, অ্যাডভেঞ্চার
জলদস্যুর দ্বীপ ২
এক
ছোট্ট একটা ল্যাগুন, প্রবেশমুখের কাছে আড়াআড়িভাবে বাঁধের মত গড়ে উঠেছে প্রবাল প্রাচীর, ঢেউ আটকাচ্ছে। ল্যাগুনে ভাসছে ছোট একটা বিমান। এক নজর দেখেই বুঝল কিশোর ও মুসা, ওটা ওদের উভচর, ম্যারাবিনা থেকে যেটা ছিনতাই হয়েছে। মস্ত এক জলচর পাখির মত ভাসছে ওটা পানিতে, দোল খাচ্ছে ছোট ছোট ঢেউয়ে। ওটা থেকে তিরিশ কি চল্লিশ গজ দূরে তীরে পড়ে রয়েছে রবারের ডিঙিটা।
দ্রুত একবার ল্যাগুনের পাড়ের জঙ্গলের দিকে চোখ বুলিয়ে নিল কিশোর, লোকগুলোকে দেখা যায় কিনা দেখছে। নেই। আশ্চর্য! গেল কোথায়? মুসার দিকে ফিরে বলল, কি বুঝলে?
বিগ হ্যামার আর তার দল।
হ্যাঁ। কিন্তু সেকথা বলছি না…
তাহলে?
বুঝলে না? নিচু গলায় বলল কিশোর। এটাই সেই দ্বীপ!
ঝট করে কিশোরের দিকে ফিরল মুসা, চেয়ে রইল। কথাটা একবারও মনে হয়নি তার। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তো, এখন কি করব আমরা?
কি করব… নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। ওমর ভাই থাকলে প্লেনটা আবার দখল করা যেত।
নেই যখন, তা আর করতে পারছি না। অন্য কিছু ভাবতে হবে।
সাগরের দিকে চেয়ে আছে কিশোর। ঢেউয়ের মাথায় এখনও সাদা সাদা ফুটকি। মাথা নাড়ল সে আনমনে। আর কি ভাবব? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল।
প্লেনটা এখনও দখল করা যায় হয়তো, কিন্তু কি করে বের করে নিয়ে যাব ল্যাগুন থেকে? আমি অন্তত পারব না। জায়গা নেই, ওড়ার গতি সঞ্চয় করার আগেই বাঁধের কাছে পৌঁছে যাবে প্লেন। সৈকতও খুব ছোট, ডাঙা থেকে যে উড়ব তারও উপায় নেই।
কি বলতে চাও আসলে?
বলতে চাই, নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল কিশোর, প্লেনটা স্টার্ট দিতে পারব, ওমর ভাইয়ের সঙ্গে থেকে সেটুকু শিখেছি, আগে বাড়াতেও পারব, কিন্তু অত্তোটুকুন জায়গায় ওটা নিয়ে উড়াল দেয়া আমার সাধ্যের বাইরে, ওমর ভাইও পারবে কিনা সন্দেহ। তাছাড়া, উড়তে যদিও বা পারি, নামতে পারব না, নামাতে জানি না। অ্যাকসিডেন্ট করে মরব।
হুঁ! কিন্তু এখন করবটা কি?
অন্ধকারও হয়ে আসছে। এখন আর কিছুই করার নেই, লুকিয়ে থেকে সুযোগের অপেক্ষা করা ছাড়া।
কি সুযোগ?
জানি না। তবে কোন না কোন সুযোগ পেয়েও যেতে পারি। চলো, কাটি এখান থেকে। ওরা যে-কোন সময় এসেপড়তে পারে। নিশ্চয়ই ব্যাটারা গুপ্তধন শিকারে বেরিয়েছে।
উল্টোদিকের ঢাল বেয়ে দ্রুত নেমে চলল দুজনে, উদ্দেশ্য, বনে গিয়ে ঢুকবে। কিন্তু ভাগ্য ওদের নেহায়েত খারাপ। খানিক দূর এগোতে এগোতেই পড়ল আরেক বিপদে।
ঘন একটা নারকেল কুঞ্জ থেকে বেরিয়েই লোকটার গায়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল কিশোর। ফ্যাকাসে চেহারার হালকা-পাতলা এক লোক, উল্টোদিক থেকে আসছিল। লোকটাকে চেনে না দুই গোয়েন্দা, কিন্তু তার হাবভাব, চেহারা আর হাতের রাইফেল দেখে অনুমান করতে কষ্ট হলো না, সে কে।
আরে, আরে, টেনে টেনে কথা বলে লোকটা, কি অবাক কাণ্ড! তোমরা! এসো, এসো, হ্যামার দেখলে খুব খুশি হবে। বলছিল, তোমরা এসেও পড়তে পারো।
শান্ত চোখে লোকটার দিকে চেয়ে আছে কিশোর। ভয় পাচ্ছে না, ভেতরে ভেতরে জমে উঠছে ঠাণ্ডা রাগ। তুমি ইমেট চাব?
বা-বাহ, নামও তো জানো দেখছি। এসো, অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। আলো থাকতে থাকতেই যাওয়া দরকার, নইলে পাথরে পিছলে পড়ে ঠ্যাং ভাঙবে।
অসহায় বোধ করল দুই গোয়েন্দা, কিছু করার নেই, নীরবে চলল লোকটার সঙ্গে। ল্যাগুনের এক ধারে ছোট্ট একটা খোলা জায়গায় নিয়ে এল তাদেরকে চাব, পাথরের তূপ আড়াল করে রেখেছে, তাই জায়গাটা আগে দেখতে পায়নি মুসা কিংবা কিশোর। তিনজন বসে আছে ওখানে। হ্যামারের পাশে বসেছে লম্বা এক লোক, কোটরে বসা চোখ ঘোলাটে। তাদের উল্টোদিকে বসেছে কুচকুচে কালো বিশাল এক নিগ্রো, বেশভূষা দেখে অন্য সময় হলে হেসে ফেলত মুসা, কিন্তু এখন। হাসি আসছে না। চানাচুর কিংবা সাবানের বিজ্ঞাপন করার জন্যে যেন সং সেজেছে লোকটা, মাথায় চূড়াওয়ালা টুপিটা শুধু নেই।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল নিগ্রো, কড়া চোখে তাকিয়ে রয়েছে বন্দিদের দিকে। এমনিতে ঝুলে থাকা ঠোঁট আরও ঝুলে পড়েছে। হাতের মোটা মোটা আঙুল মুঠো পাকাচ্ছে আর খুলছে ধীরে ধীরে। বিস্মিত।
তো, এসে গেছ, কিশোরের দিকে চেয়ে বলল হ্যামার।
তাই তো মনে হয়, নাকি? বাঁকা জবাব দিল কিশোর।
যা জিজ্ঞেস করব, সোজা জবাব দেবে, নইলে… কি করবে মুঠো পাকিয়ে দেখাল হ্যামার। ধমকে উঠল, আরগুলো কোথায়?
কোথায়, আমারও জানতে ইচ্ছে করছে, বলল কিশোর।
জানো না বলতে চাও? মিথ্যে বললে বিপদে পড়বে। কোথায় ওরা?
মিথ্যে বলার দরকার নেই। তা ছাড়া, ভীষণ ক্লান্ত বোধ করছে কিশোর। যা খুশি ঘটে ঘটুক, পরোয়া করে না আর। মিছে কথা বলব কেন? বোধহয় ডুবে মরেছে ওরা, খসখসে কণ্ঠে বলল সে। ঝড়ের আঘাতে ভেঙে পড়েছে প্লেন, সাগরে পড়ে চুরমার হয়েছে। আমরা দুজন বেঁচে গেছি। ব্যস, যা জানি বললাম।
দীর্ঘ এক মুহূর্ত নীরবতা। কিশোরের বলার ধরনে এমন কিছু রয়েছে, তার কথা অবিশ্বাস করতে পারল না শত্রুরা।