আসলেই বুঝতে পারতেন না, সায়ার। আপনি গণিতবিদ নন, বিজ্ঞানী নন, শিল্পী নন। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অনেক লোক আছে যারা আপনার চেয়ে বেশি জানে, তাদের কাজই হচ্ছে অর্জিত জ্ঞান দিয়ে আপনার সেবা করা। আপনি সম্রাট, আর তারা তাদের সমন্বিত জ্ঞান আপনার পায়ে নিবেদন করতে বাধ্য।
তাই? সে বৃদ্ধ হলে–যার রয়েছে বহু বছরের অর্জিত জ্ঞান, তাহলে আমি কিছু মনে করতাম না। কিন্তু এই সেলডন, আমার সমবয়সী, কেন সে আমার চেয়ে বেশি জানবে।
সে জানে না কীভাবে আদেশ দিতে হয়, কীভাবে লক্ষ কোটি মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণকারী সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
মাঝে মাঝে মনে হয়, ডেমারজেল, তুমি বোধহয় আমার সাথে মশকরা করো।
সায়ার, আত্মরক্ষার সুরে বলল ডেমারজেল।
বাদ দাও। তোমার এই নষ্ট কামানের বিষয়ে ফিরে আসা যাক। কোনদিক দিয়ে সে বিপজ্জনক? গ্রাম্য লোক ছাড়াতো তাকে অন্য কিছু মনে হয় না।
ঠিক, কিন্তু তার রয়েছে সম্পূর্ণ নতুন এবং নিজস্ব এক গণিত।
সেটা কোনো কাজেই আসবে না, সেলডন নিজেই বলেছে।
আপনার কাছে মনে হয়েছে এই গণিত কাজে লাগবে। আপনি ব্যাখ্যা করে বোঝানোর পর আমারও তাই মনে হয়েছে। অন্যদের কাছেও এটা কাজের জিনিস মনে হতে পারে। সেলডন নিজেও এখন এই লাইনে চিন্তা করবে, যেহেতু আমরাই তাকে এই ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছি। কে জানে এই মুহূর্তেই হয়তো সে এটাকে কার্যকরী করে তোলার জন্য চিন্তা ভাবনা শুরু করে দিয়েছে। যদি তাই হয়, যদি গণিতের মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়, সেটা যত হালকাই হোক না কেন, নিমেষেই প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবে যে কেউ। একটা বিষয় খুব অবাক লেগেছে আমার। সেলডন নিজের জন্য ক্ষমতা চায় না। কিন্তু অন্যেরা তাকে স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যবহার করতে পারে।
আমি চেষ্টা করেছি। কোনো লাভ হয়নি।
আপনার সাথে দেখা করার আগে বিষয়টা সে গুরুত্বের সাথে নেয়নি। এখন নেবে। হয়তো আপনাকে সাহায্য করার ইচ্ছা তার নেই, কিন্তু কেউ–যেমন ওয়ি প্রদেশের মেয়র–তাকে বাধ্য করতে পারে।
কেন সে ওয়ি প্রদেশকে সাহায্য করবে, আমাকে করবে না?
সে নিজেই বলেছে যে একজন মানুষের মন এবং আচরণ ব্যাখ্যা করা অসম্ভব।
ভুরু কুঁচকে চিন্তা করছেন ক্লীয়ন। তুমি কী আসলেই মনে করো যে এই সাইকোহিস্টোরী কার্যকরী করে গড়ে তোলা সম্ভব। সেলডন কিন্তু নিশ্চিন্ত যে একেবারেই অসম্ভব।
হয়তো কিছুদিন পরেই সে উপলব্ধি করতে পারবে যে আসলে তার ধারণা ভুল। ছিল।
তবে তো ওকে ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হয়নি।
না, ছেড়ে দিয়ে ঠিক কাজ করেছেন, সায়ার। বন্দী করে রাখলে হয়তো সাইকোহিস্টোরীর অগ্রগতি করার কোনো চেষ্টাই সে করত না। ছেড়ে দেওয়াই ভালো হয়েছে। তবে পুরোপুরি চোখের আড়াল হতে দেওয়া যাবে না। পিছনে সব সময় লোক লাগিয়ে রাখতে হবে। যেন আমাদের শত্রুরা তাকে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যবহার করতে না পারে। আর যখন সে তার বিজ্ঞান চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে তখনই তাকে আমাদের কজায় নিয়ে আসব। তখন হয়তো জোর খাঁটিয়ে লাভ হবে।
কিন্তু যদি আমাদের কোনো শত্রু তাকে তুলে নিয়ে যায়, বলা ভালো এম্পায়ারের শত্রু, যেহেতু আমিই এম্পায়ার, অথবা যদি সে স্বেচ্ছায় শত্রু পক্ষকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেয়–এগুলোও আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
অবশ্যই, সায়ার। আমি চেষ্টা করব যেন এইধরনের কিছু না ঘটে। যদি ঘটেই যায় তখন ব্যবস্থা আছে। আমরা যদি তাকে ব্যবহার করতে না পারি তাহলে অন্য কেউই পারবে না।
অস্বস্তি বোধ করছেন ক্লীয়ন। পুরো ব্যাপারটা আমি তোমার হাতে ছেড়ে দিচ্ছি ডেমারজেল। তবে এমন যেন না হয় যে আমরা শুধু একটা বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়ে ফেলি। হয়তো দেখা যাবে যে তার ধারণা শুধু তাত্ত্বিকভাবেই সম্ভব কিন্তু বাস্তবে একেবারেই অকেজো।
হতে পারে, সায়ার। কিন্তু নিরাপত্তার খাতিরে ধরে নিতে হবে যে সেলডন ভবিষ্যতে মূল্যবান সম্পদে পরিণত হবে। পরে যদি আমাদের ধারণা ভুল হয় তাহলে কিছু সময় নষ্ট হওয়া ছাড়া তেমন বড়ো কোনো ক্ষতি হবে না। অন্যদিকে আমরা গুরুত্ব দিলাম না কিন্তু এই লোক বিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে ফেলল, তখন আমাদের সব হারাতে হবে।
বেশ। তবে আমার বোধহয় বিস্তারিত সবকিছু জানার প্রয়োজন নেই। যদি সেটা অপ্রীতিকর কিছু হয়।
আমরা শুধু আশা করতে পারি যে সেরকম কিছু ঘটবে না।
.
০৫.
সম্রাটের সাথে দেখা করার পর পেরিয়ে গেল একটা সন্ধ্যা, পুরো একরাত এবং পরবর্তী ভোরের কিছু অংশ। অন্তত ইম্পেরিয়াল সেক্টরের ফুটপাত, চলমান করিডোর, খোলা চত্বর এবং পার্কের আলোর পরিবর্তন দেখে সেলডনের কাছে সেরকমই মনে হলো।
এই মুহূর্তে তিনি বসে আছেন একটা ছোট পার্কের প্রাস্টিকের ছোট আসনে। বসার সাথে সাথেই আসনটা তার দেহ কাঠামোর সাথে মিলিয়ে আকৃতি পরিবর্তন করে মিশে গেল শরীরের সাথে। বেশ আরামদায়ক। আলো দেখে মনে হচ্ছে এখন মধ্য সকাল। তরতাজা বাতাস যথেষ্ট ঠাণ্ডা হলেও গায়ে হুল ফোঁটানোর মতো নয়।
ট্র্যান্টরের প্রকৃতি কী সবসময় এইরকম আরামদায়ক থাকে? প্রাসাদ এলাকার অকৃত্রিম মেঘলা দিনের কথা মনে পড়ল তার। একই সাথে মনে পড়ল হেলিকন তার নিজ গ্রহের মেঘ, বৃষ্টি, উষ্ণতা, তুষারপাতের দিনগুলোর কথা। অবাক হয়ে ভাবলেন প্রকৃতির এইরকম বৈচিত্র্যের জন্য কি কারো মনে হাহাকার তৈরি হয় না। ট্র্যান্টরের পরিবেশ একঘেয়ে রকমের আরামদায়ক। মনে হয় যেন চারপাশে কিছুই নেই। দিনের পর দিন এখানে বাস করে কেউ হাহুতাশ করবে এও কী সম্ভব?