যাইহোক, বললেন সম্রাট। যদি তোমাকে ভবিষ্যদ্বাণী করার দায়িত্ব দেওয়া হয়, তা গাণিতিকভাবে প্রমাণিত হোক বা না হোক। আমার অফিসাররা বেশ দক্ষ, ভালোভাবেই জানে কোন কথা বললে জনগণ কোন পথে চলবে। তোমার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো থেকে তারা ভালোগুলো বেছে নেবে যেন আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায়।
এই কাজের জন্য আমাকে প্রয়োজন কেন? আপনার অফিসাররাই কাজটা আরো ভালোভাবে করতে পারবে।
সরকারি অফিসাররা কাজটা ফলপ্রসূভাবে করতে পারবে না। এছাড়াও অফিসারদেরকে যখন তখন বক্তৃতা বিবৃতি দিতে হয়, জনগণ তাদেরকে বিশ্বাস করে না।
আমাকে কেন বিশ্বাস করবে?
তুমি একজন গণিতবিদ। তুমি ভবিষ্যত নির্ণয় করবে গণিত দিয়ে। অন্যদের মতো অন্তর্জানের সাহায্যে না।
কিন্তু আমি সেরকম কিছুই করব না।
কে বলতে পারে? সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন ক্লীয়ন।
দুজনেই নীরব। সেলডনের মনে হলো তিনি একটা ফাঁদে পড়েছেন। সম্রাট যখন সরাসরি আদেশ দেবেন তখন প্রত্যাখ্যান করা কী ঠিক। প্রত্যাখ্যান কলে হয় বন্দীত্ব অথবা মৃত্যুদণ্ড। বিচার অবশ্য একটা হবে। তবে সেটা হবে লোক দেখানো। সম্রাটের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস কারো হবে না।
কাজ হবে না এভাবে। শেষ পর্যন্ত বললেন তিনি।
কেন?
যদি আমি এমন কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করি যা অর্জন করতে হলে এই প্রজন্ম এমনকি হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত শেষ হয়ে যাবে; তাতে কোনো লাভ হবে না। এক শতাব্দী পরে সুখ সমৃদ্ধি আসতে পারে এই ধরনের আশ্বাসে মানুষের কী আসে যায়।
সঠিক ফলাফল পেতে হলে আমাকে আরো তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ করতে হবে। সেলডন বলে চলেছেন। খুব কাছাকাছি সময়ের সম্ভাব্য পরিণাম নির্ণয় করতে হবে। শুধু যেগুলো জনগণের মনোযোগ আকৃষ্ট করবে। আজ হোক, কাল হোক–তবে খুব শিঘ্রই কোনো একটা সম্ভাব্য পরিণাম আর বাস্তবে পরিণত হবে না। সাথে সাথেই আমার প্রয়োজনীয়তা ফুরাবে, সেই সাথে আপনার জনপ্রিয়তাও হ্রাস পাবে পুরোপুরি। শুধু তাই নয়, তখন আর সাইকোহিস্টোরী সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণের কাছ থেকে কোনো সমর্থন পাওয়া যাবে না, আমি সেটাকে যতই নিখুঁতভাবে বাস্তবে পরিণত করিনা কেন, লাভ হবে না কোনো।
বস্তার মতো নিজেকে একটা চেয়ারে ছুঁড়ে ফেললেন ক্লীয়ন, ভুরু কুঁচকে তাকালেন সেলডনের দিকে। তোমরা গণিতবিদরা তাহলে শুধু এইই করতে পারো। শুধু অসম্ভব আশা জাগাতে পারো যা কখনো সত্যি হবে না।
আসলে সায়ার, আপনি নিজেই অসম্ভব আশার কথা বলছেন। প্রচণ্ড সাহস নিয়ে কথাটা বলেই ফেললেন সেলডন।
তোমার পরীক্ষা নেওয়া যাক। ধরো তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম যে তোমার গণিতের সাহায্যে বিশ্লেষণ করে বলো আমি গুপ্তঘাতকের হাতে খুন হবো কিনা। কী জবাব দেবে?
সাইকোহিস্টোরী যদি সবচেয়ে নিখুঁতভাবে কাজ করেও তবু আমার গাণিতিক বিশ্লেষণ এই ধরনের নির্দিষ্ট প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে না। কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর সবগুলো সূত্র মিলিয়েও মাত্র একটা ইলেকট্রনের আচরণ কেমন হবে সেটা বের করা যায়নি, যা বের করা গেছে সেটা হলো অনেকগুলো ইলেকট্রনের একটা গড় আচরণ।
তোমার গণিত তুমিই ভালো বুঝবে আমার চেয়ে। তার সাহায্যে একটা চমৎকার উত্তর দাও দেখি। আমি কী গুপ্তঘাতকের হাতে খুন হব?।
আপনি আমার জন্য একটা ফাঁদ তৈরি করেছেন, সায়ার। মৃদু গলায় জবাব দিলেন সেলডন। হয় আমাকে বলে দিন কী ধরনের জবাব আপনার পছন্দ, আমি সেইভাবেই বলব অথবা নির্ভয়ে আমার নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ দিন।
তুমি নির্ভয়ে বলো।
আপনি কথা দিচ্ছেন?
তুমি কী লিখিত চাও? ব্যঙ্গ মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন ক্লীয়ন।
আপনার মুখের কথাই যথেষ্ট। যদিও সেলডনের ঠিক বিশ্বাস হলো না।
কথা দিলাম তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। নির্ভয়ে বলো।
গত চার শতাব্দীর সম্রাটদের অর্ধেকই নিহত হয়েছেন গুপ্তঘাতকের হাতে, কাজেই আমার সিদ্ধান্ত গুপ্তঘাতকের হাতে আপনার নিহত হওয়ার সম্ভাবনা আধাআধি।
একটা গাধাও এইরকম জবাব দিতে পারবে। রাগের সাথে বললেন ক্লীয়ন। এখানে গণিতের কোনো মারপ্যাঁচ নেই।
আমি আপনাকে অনেকবার বলেছি যে এইধরনের বাস্তব সমস্যার কোনো সমাধান দিতে পারে না আমার গণিত।
তোমার কী মনে হয় না যে আমার হতভাগ্য পূর্বপুরুষদের ঘটনাবলী থেকে ভালো শিক্ষা পেয়েছি?
লম্বা দম নিলেন সেলডন। না, সায়ার। ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা হচ্ছে যে আমরা ইতিহাস থেকে কিছুই শিখিনি, শিখতে পারি না। এই যেমন আপনি আমাকে এইভাবে দেখা করতে দিয়েছেন। যদি আপনাকে খুন করার পরিকল্পনা থাকত আমার যদিও আসলে নেই। শেষের কথাগুলো দ্রুত যোগ করলেন তিনি।
নির্দয় ভঙ্গিতে হাসলেন ক্লীয়ন। আসলে আমাদের কাজের ধারা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই। প্রযুক্তি আজকে কোথায় এসে পৌঁছেছে সেটাও জান না বোধহয়। তোমার অতীত বর্তমান সবকিছুই আমাদের নখদর্পণে। এখানে পৌঁছার সাথে সাথে স্ক্যান করা হয়েছে তোমাকে। তোমার অভিব্যক্তি এবং কণ্ঠস্বর বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তোমার মন-মানসিকতা আমরা পড়ে ফেলেছি খোলা বইয়ের মতো। অর্থাৎ তোমার মাথার ভেতরে কী চিন্তা ভাবনা আছে সবই আমরা জানি। যদি ক্ষতিকর কিছু থাকত তাহলে তোমাকে আমার কাছে আসতেই দেওয়া হতো না। সত্যি কথা বলতে কী হয়তো জীবিত থাকতে না।