প্রক্রিয়াটাকে আরো সহজ করা যায় না? ধারালো গলায় জিজ্ঞেস করলেন ক্লীয়ন।
ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি–সেলডন বুঝতে পারছেন উত্তরগুলো যেহেতু পছন্দ হচ্ছে না তাই সম্রাট রেগে উঠছেন। তিনিও সতর্কভাবে জবাব দিতে লাগলেন ভেবে দেখুন, বিজ্ঞানীরা কীভাবে বস্তুর পরমাণু নিয়ে কাজ করে। একটা বস্তুতে রয়েছে অগণিত পরমাণু। সেগুলো অবিরাম দিগ্বিদিক ছুটোছুটি করছে। যা অনুমান। করা সত্যিই কঠিন। কিন্তু এই বিশৃঙ্খলার মাঝেও একটা লুকানো নিয়ম আছে। আর তাইতো আমরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনেক প্রশ্নেরই জবাব পেয়েছি। আমরা সমাজবিজ্ঞানীরা পরমাণুর স্থানে মানুষকে নিয়ে ঠিক একই উপায়ে কাজ করার চেষ্টা করি, তবে সেই ক্ষেত্রে নতুন একটা বিষয় যোগ করতে হবে আর তা হচ্ছে মানুষের আবেগ। পরমাণু নিরাবেগ; কিন্তু মানুষ সর্বদাই আবেগ দ্বারা পরিচালিত। মনের বিভিন্ন অবস্থা এবং আবেগ বিবেচনা করতে হলে এত বেশি জটিলতা তৈরি হয় যা সামলনো পুরোপুরি অসম্ভব।
নিরাবেগ পরমাণুর মতো মানুষের মন বা আবেগেরও একটা লুকানো নিয়ম থাকতে পারে?
হয়তোবা। যদি থাকেও তা এত বেশি সূক্ষ্ম, এত বেশি এলোমেলো যে এক্ষেত্রে আমার গাণিতিক বিশ্লেষণ কোনো সাহায্য করতে পারবে না। ভেবে দেখুন গ্যালাক্সিতে বর্তমানে পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহে মানুষ বাস করছে। প্রতিটি গ্রহের রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং সংস্কৃতি। একটা গ্রহের সাথে আরেকটা গ্রহের কোনো মিল নেই। প্রতিটি গ্রহে রয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন মানবসন্তান। প্রত্যেকটি মানুষের রয়েছে সম্পূর্ণ পৃথক মন এবং আবেগ। প্রতিটি গ্রহ, প্রতিটি মানুষ অগণিত উপায়ে, কল্পনাতীত সমন্বয়ে পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ঘটিয়ে চলেছে। সেইজন্যই তো বারবার বলছি কাগজে কলমে সাইকোহিস্টোরিক্যাল বিশ্লেষণ সম্ভব হলেও বাস্তবে তা মোটেই সম্ভব নয়।
সাইকোহিস্টোরিক্যাল মানে?
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের নাম দিয়েছি আমি সাইকোহিস্টোরি।
হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন সম্রাট, হেঁটে কামরার অন্য প্রান্তে চলে গেলেন। ফিরে এসে আবার দাঁড়ালেন সেলডনের সামনে।
উঠে দাঁড়াও! আদেশ করলেন তিনি।
দাঁড়িয়ে তার চেয়ে খানিকটা লম্বা সম্রাটের দিকে তাকালেন সেলডন। দৃষ্টিতে একটা দৃঢ়তা বজায় রাখার চেষ্টা করছেন।
তোমার এই সাইকোহিস্টোরী… বললেন ক্লীয়ন, যদি এটাকে সত্যিকার অর্থে কাজে লাগানো যায়, তাহলে এর উপকারিতা হবে অসীম, তাই নয় কী?
নিঃসন্দেহে এর উপকারিতা হবে কল্পনাতীত। অনাগত ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে সেটা জানতে পারলে তোক অতি সাধারণ সম্ভাবনা–তাই হবে। মানবজাতির এগিয়ে চলার চমৎকার দিকনির্দেশনা–যা আগে কখনো তৈরি হয়নি। কিন্তু… থেমে গেলেন সেলডন।
বেশ? অধৈর্য ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন সম্রাট।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ গুটিকয়েক ব্যক্তি ছাড়া সাইকোহিস্টোরিক্যাল বিশ্লেষণের ফলাফল সাধারণ মানুষের কাছ থেকে গোপন রাখতে হবে। তাদেরকে জানানো যাবে না।
জানানো যাবে না! বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলেন সম্রাট।
সহজ ব্যাপার। একটু বুঝিয়ে বলতে দিন। সাইকোহিস্টোরিক্যাল বিশ্লেষণ তৈরি করে যদি তার ফলাফল জনসমক্ষে প্রচার করা হয় তাহলে মানবজাতির আচরণ এবং আবেগের ভেতর একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। অন্যদিকে ভবিষ্যত না জেনে শুধু মানবিক আবেগ ও আচরণের উপর নির্ভর করে সাইকোহিস্টোরিক্যাল বিশ্লেষণ যে বিশ্লেষণের ফলাফল মানুষের কাছে গোপন থাকে সেটা হয়ে পড়ে অর্থহীন। বুঝতে পেরেছেন?
সম্রাটের চোখগুলো আলোকিত হয়ে উঠল। হেসে উঠলেন গলা ছেড়ে।
সেলডনের কাঁধে হাত রাখলেন তিনি, তার ভারী হাতের ওজনে সেলডন খানিকটা ঝুঁকে পড়লেন।
তুমি বুঝতে পারছ না? বললেন ক্লীয়ন, বুঝতে পারছ না তোমার গুরুত্বটা কোথায়। তোমাকে ভবিষ্যদ্বাণী করতে হবে না। শুধু একটা ভবিষ্যত বেছে নাও চমৎকার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত, তারপর এমনভাবে ভবিষ্যদ্বাণী কর যা মানুষের আবেগ এবং আচরণকে এমনভাবে পাল্টে দেবে যেন তুমি যে ভবিষ্যত বেছে নিয়েছ সেটা অর্জিত হয়। খারাপ ভবিষ্যদ্বাণী না করে একটা সমৃদ্ধিশালী ভবিষ্যত বেছে নেওয়াই ভালো।
ভুরু কুঁচকালেন সেলডন। আপনার কথা বুঝতে পেরেছি, সায়ার। কিন্তু সেটাও অসম্ভব।
অসম্ভব?
সত্যি কথা বলতে কী আরো বেশি অবাস্তব। কেন বুঝতে পারছেন না আপনি যদি মানুষের আবেগ এবং আচরণ থেকে অনুমান করতে না পারেন যে অদূর ভবিষ্যতে কী হবে, তাহলে আপনি বিপরীত কাজটাও করতে পারবেন না। অর্থাৎ ভবিষ্যত অনুমান করে আপনি বলতে পারবেন না মানুষের আবেগ এবং আচরণ কেমন হবে।
ক্লীয়নকে হতাশ দেখালো। আর তোমার গবেষণাপত্রগুলো?… ওগুলো কী কাজে লাগবে?
ওগুলো শুধুই গাণিতিক উপস্থাপনা, গুটিকয়েক পণ্ডিত কিছুটা আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু এটাকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার কোনো পরিকল্পনা আমার নেই।
জঘন্য। রাগের সাথে বললেন ক্লীয়ন।
হালকা একটু কাঁধ ঝাঁকালেন সেলডন। এখন আরো বেশি করে অনুভব করছেন যে এখানে আসা তার ঠিক হয়নি। যদি সম্রাটের মনে হয় যে তিনি তাকে বোকা বানিয়েছেন, তখন কী হবে?
আর ক্লীয়নের চেহারা দেখে তো মনে হয় তিনি সেইরকমই ভাবছেন।