বাধ্য ছেলের মতো টুপ করে বসে পড়লেন সেলডন। এমনকি জ্বি, সায়ার, বলার সাহসটুকু পর্যন্ত দেখালেন না।
সম্রাট হাসলেন। বেশ ভালো। এবার আমরা দুজন সাধারণ মানুষের মতো কথা বলতে পারি তাই না। সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিলে আমি তো সাধারণ। মানুষই। তুমি কী বলো?
ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টির মন্তব্য নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। সতর্ক সুরে বললেন সেলডন।
ওহ, এত ভয় পাচ্ছ কেন? আমি তোমার সাথে একজন সমমর্যাদার মানুষের মতো কথা বলতে চাই। সেটা করতে পারলে খুশি হব। আমাকে সাহায্য করো।
জ্বি, সায়ার।
শুধু জ্বি বললেই চলবে। তোমার আমার মাঝখানের দূরত্ব কমানোর কোনো উপায় নেই?
সেলডনের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন ক্লীয়ন, আর সেলডনের কাছে মনে হলো কী প্রাণবন্ত দৃষ্টি।
তোমার চেহারা গণিতবিদদের মতো নয়। সম্রাট বললেন।
শেষ পর্যন্ত একটু সাহস করে হাসলেন সেলডন। আমি সঠিক জানি না গণিতবিদের চেহারা কেমন হওয়া উচিত, ইওর ইম্প- ক্লীয়ন সতর্ক করার ভঙ্গিতে একটা হাত তুলতেই বাকি কথাগুলো পেটের ভিতর চালান করে দিলেন সেলডন।
সাদা চুল, বললেন ক্লীয়ন। দাড়ি থাকতেও পারে, আর অবশ্যই বৃদ্ধ।
নিশ্চয়ই এই গণিতবিদরাও একসময় তরুণ ছিলেন।
কিন্তু তখন তাদের তেমন একটা নাম যশ থাকে না। গ্যালাক্সির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে করতে তাদের চেহারা আমি যেমন বললাম সেইরকমই হয়ে যায়।
আমার তাহলে তেমন নাম যশ নেই।
অথচ এখানে যে সম্মেলন হয়েছে সেখানে তুমি বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছ। সুযোগ অনেকেই পেয়েছে। তাদের অনেকেরই বয়স আমার চেয়েও কম। খুব অল্প কয়েকজনই আসলে মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পেরেছে।
নিঃসন্দেহে তোমার তত্ত্ব আমার কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তারাই আমাকে বুঝিয়েছে যে তোমার বক্তব্যের সারকথা হচ্ছে ভবিষ্যতে কী ঘটবে সেটা আগাম বলে দেওয়া সম্ভব।
হঠাৎ করেই ভীষণ ক্লান্ত বোধ করলেন সেলডন। মনে হচ্ছে তার তত্ত্বের ভুল ব্যাখ্যা চলতেই থাকবে। আসলে এই সম্মেলনে আসাই উচিত হয়নি।
ঠিক সেইরকম কিছু না, তিনি বললেন। আমি যা করেছি তা অনেক বেশি সীমিত। প্রতিটি সিস্টেমেই বিভিন্ন কারণে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। অর্থাৎ ভবিষ্যতে কী ঘটবে সেটা বলা অসম্ভব। কম জটিল সিস্টেমের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি। প্রচলিত ধারণা হলো এই যে মানব সমাজের মতো একটা অতি জটিল সিস্টেমে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় খুব দ্রুত এবং সেখানে ভবিষ্যতে কী হবে না হবে সেটা বলা পুরোপুরি অসম্ভব। আমি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি যে মানব সমাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ দ্বারা আমরা অন্তত একটা স্টার্টিং পয়েন্ট নির্বাচন করতে পারব, তারপর নিখুঁত অনুমানের ভিত্তিতে এই বিশৃঙ্খলা কমিয়ে আনা সম্ভব। তারপরে হয়তোবা ভবিষ্যদ্বাণী করা যেতে পারে। কিন্তু তা বিস্তারিত কিছু হবে না হবে অনেকগুলো বিকল্প পথ; সুনিশ্চিত কিছু নয় বরং গাণিতিক সম্ভাবনা।
অসীম ধৈর্যের সাথে কথাগুলো শুনলেন সম্রাট। বললেন, কিন্তু তোমার মূল বক্তব্য তো এটাই যে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব।
আবারো বলছি আমি সেই ধরনের কিছু প্রমাণ করতে পারিনি। শুধু বলেছি যে তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব এর বেশি কিছু না। বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য আমাদেরকে প্রথমেই সঠিক স্টার্টিং পয়েন্ট নির্ধারণ করতে হবে। তারপরে রয়েছে শতকরা একশ ভাগ নিখুঁত অনুমান এবং নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে গাণিতিক বিশ্লেষণ সম্পন্ন করার কাজ। আমার গণিতের সাহায্যে এই সমস্যাগুলোর কোনোটারই জবাব মিলবে না। আর মিললেও তা হবে শুধুই সম্ভাবনা, কোনো অবস্থাতেই ভবিষ্যদ্বাণী হতে পারে না; এটা শুধুই কী হতে পারে তার অনুমান। প্রতিটি সফল রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ এই কাজটা আরো নিখুঁতভাবে করে, নইলে তারা জীবনে সফল হতে পারত না।
কিন্তু তারা সেটা গণিতের সাহায্যে করে না।
সত্যি কথা। তারা সেটা করে অন্তর্জানের সাহায্যে।
গণিতের সাহায্যে যে কেউ নিখুঁতভাবে সম্ভাবনা যাচাই করতে পারবে, তখন। আর অন্তর্জানের উপর নির্ভর না করলেও চলবে।
এটাও সত্যি কথা, কিন্তু আমি শুধু বলেছি যে গাণিতিক বিশ্লেষণ সম্ভব। সেটা যে বাস্তব হবে তা কিন্তু বলিনি।
কোনো বিষয় সম্ভব কিন্তু অবাস্তব হয় কী করে?
মহাবিশ্বের প্রতিটি গ্রহে গিয়ে প্রতিটি মানুষের সাথে দেখা করা তাত্ত্বিকভাবে কাজটা আমার পক্ষে সম্ভব। সে জন্য সময় লাগবে আমি যতদিন বাঁচব তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি। আবার অমর হলেও লাভ নেই। যে হারে পূর্বে জন্মানো। মানুষগুলোর সাথে দেখা করব তার চেয়েও বেশি হারে নতুন মানুষ জন্ম নেবে প্রতিদিন। তারচেয়েও বড়ো কথা আমার সাথে দেখা হওয়ার আগেই বা আমি তাদের কাছে গিয়ে পৌঁছানোর আগেই বহু মানুষ জীবনকাল শেষ করে মারা যাবে।
এই ধরনের ব্যাখ্যা কী তোমার ভবিষ্যৎ গণিতের বেলায়ও প্রযোজ্য?
খানিকটা ইতস্তত করে আবার শুরু করলেন সেলডন। হয়তো বা গাণিতিক সমাধান পেতে হলে আমাদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে। মহাবিশ্বের যাবতীয় তথ্য ধারণ করতে সক্ষম এবং হাইপারস্পেসাল গতিতে কাজ করতে পারে এমন একটা কম্পিউটার থাকলেও লাভ হবে না। ফলাফল কাজে লাগানোর আগেই বহুবছর পার হয়ে যাবে, পরিস্থিতি উন্নয়নের কোনো সুযোগ থাকবে না। তখন প্রাপ্ত ফলাফল হয়ে পড়বে অর্থহীন।