অফিসার সামনে, আর সৈনিক দুজন পিছনে। মাঝখানে সেলডন। হোটেলের বাইরে একটা গ্রাউন্ড কার অপেক্ষা করছিল। এমন সুসজ্জিত এবং জাঁকজমকপূর্ণ গাড়ি তিনি আগে দেখেন নি।
এলাকাটা ট্রান্টরের সবচেয়ে অভিজাত বসতিগুলোর একটা। গম্বুজের ছাদ এত উঁচু যে নবাগত কারো কাছে মনে হতে পারে, সে খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছে। এমন কী সেলডন–যিনি উন্মুক্ত গ্রহের খোলা আকাশের নিচে বেড়ে উঠেছেন–তিনিও প্রায় ভুল ভেবে বসেছিলেন যে আসলে দাঁড়িয়ে আছেন অকৃত্রিম সূর্যের আলোর মাঝে। অথচ উপরে তাকালে আলো প্রদানকারী কোনো নক্ষত্র বা মেঘ চোখে পড়বে না। তবে বাতাস বেশ আরামদায়ক এবং সুবাসিত।
জায়গাটা তারা পার হয়ে গেলেন। এর পরেই দেখা গেল গম্বুজের ছাদ ঢালু হয়ে নিচে নেমে এসেছে, চারপাশের দেয়ালগুলো সরে এসেছে অনেকটা কাছাকাছি। কিছুক্ষণ পরেই সেলডন দেখলেন যে তারা একটা আবদ্ধ টানেলের ভিতর দিয়ে চলছেন। খানিকদূর পরপরই চোখে পড়ছে মহাকাশযান এবং নক্ষত্র চিহ্ন। অর্থাৎ এই টানেলগুলো সরকারি ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট।
টানেলের শেষ মাথায় একটা দরজা খুলে গেল। দ্রুত বেগে গ্রাউন্ড কার বেরিয়ে এল খোলা জায়গায় সত্যিকারের উন্মুক্ত প্রান্তর। ট্র্যান্টরের বুকে ২৫০ বর্গ কিলোমিটার স্থান রয়েছে যা একেবারেই প্রাকৃতিক, গ্রহের বাকি অংশের মতো ধাতব গম্বুজ দ্বারা আবৃত করে ফেলা হয়নি, যেখানে মাথার উপরে অকৃত্রিম আকাশ এবং মেঘ চোখে পড়ে। এটাই সম্রাটদের বাসস্থান, এখানেই রয়েছে সম্রাটের প্রাসাদ। সুযোগ পেলে এখানে একটু ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা আছে সেলডনের। প্রাসাদ দেখার জন্য নয়–গ্যালাক্টিক ইউনিভার্সিটিও এখানেই এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এখানেই আছে গ্যালাকিক গ্রন্থাগার।
যাইহোক ট্র্যান্টরের আবদ্ধ পরিমণ্ডলের বাইরে এখানে এই খোলা জায়গায় আকাশ নিষ্প্রভ ধূসর। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাঁপটা লাগল মুখে। জানালা বন্ধ করে দিলেন তিনি।
একটা ঝড়ো দিন শুরু হতে যাচ্ছে।
.
০৩.
আসলেই কী সম্রাট তার সাথে দেখা করবেন, এই ব্যাপারে সেলডন নিশ্চিত নন। বড়ো জোর চতুর্থ বা পঞ্চম মাত্রার কোনো কর্মকর্তা এসে দাবী করবে যে সে সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলছে।
কতজন মানুষ সম্রাটকে দেখেছে? হলোভিশনে নয়, সরাসরি, সামনাসামনি। কতজন মানুষ সম্রাটের সত্যিকার নশ্বর দেহটা দেখেছে–যে সম্রাট কখনো এই ইম্পেরিয়াল গ্রাউন্ড ছেড়ে বাইরে যান নি।
সংখ্যাটা নেহায়েতই অপ্রতুল। পঁচিশ মিলিয়ন বাসযোগ্য গ্রহ, প্রতিটি গ্রহেই বিলিয়ন বিলিয়ন মানব সন্তান এবং এই কোয়াড্রিলিয়ন মানব সন্তানদের মাঝে কয়জন রক্ত-মাংসের সম্রাটের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পেরেছে? কয়েক হাজার।
এবং এই বিষয়ে আসলেই কী কেউ মাথা ঘামায়? সম্রাট এম্পায়ার-এর প্রতীক ছাড়া কিছুই না, মহাকাশযান এবং নক্ষত্র চিহ্নের মতোই, তবে অনেক বেশি অবাস্তব এবং অবিশ্বাস্য। আসলে এখন এম্পায়ার বলতে সম্রাটকে বোঝায় না, বোঝায় তার সুবিশাল সেনাবাহিনী এবং নীতিহীন কর্মকর্তাদের যারা এম্পায়ারের জনগণের উপর যন্ত্রণাদায়ক বোঝার মতো চেপে বসেছে।
কাজেই তিনি যখন ছোট এক কামরায় এক সুদর্শন তরুণের মুখোমুখি হলেন, ভেবেই পেলেন না সম্রাটের অফিসারদের ভেতর এইরকম একজন লোক কোত্থেকে এলো যে কি না তার দিকে দাম্ভিকভাবে না তাকিয়ে ভদ্র সৌজন্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কামরাটা একেবারেই সাধাসিধে। আসবাবপত্র তেমন কিছুই নেই। মাঝখানে একটা টেবিল, যার কিনারায় তরুণ বসে আছে। এক পা মাটিতে আরেক পা ঝোলানো। সেলডনের অভিজ্ঞতায় বলে যে, সম্রাটের অফিসাররা সবসময়ই গম্ভীর আর রাগী–ভাবখানা যেন পুরো গ্যালাক্সির বোঝা তারা কাঁধে নিয়ে রেখেছে। অফিসারদের পদমর্যাদা যত কম তারা তত বেশি গম্ভীর আর রাগী।
এই তরুণ তাহলে খুবই উঁচু পর্যায়ের কেউ হবে। তার ক্ষমতা নিশ্চয়ই এত বেশি যে সেটা প্রকাশ করার জন্য ভুরু কুঁচকে রাখতে হয় না।
সেলডন বুঝতে পারছেন না কেমন আচরণ করা উচিত। সবচেয়ে ভালো হয় বোধহয় চুপ করে থাকলেই, লোকটাই প্রথম কথা বলুক।
তুমি হ্যারি সেলডন, গণিতবিদ। তরুণ অফিসার বললেন।
জ্বি স্যার। সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন সেলডন।
মশা তাড়ানোর ভঙ্গিতে একটা হাত নাড়লেন তরুণ। বলা উচিত সায়ার, তবে আমি আনুষ্ঠানিকতা পছন্দ করিনা। সারাদিন এইসবের মাঝেই থাকতে হয়, এগুলো আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। এখানে শুধু আমি আর তুমি, কাজেই আনুষ্ঠানিকতা বাদ। বসো, প্রফেসর।
পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো সেলডনের। কারণ অর্ধেক বক্তব্য শুনেই বুঝে ফেলেছেন যে এই তরুণ আর কেউ নন, সম্রাট প্রথম ক্লীয়ন স্বয়ং। এবার ছবিতে, হলোভিশনে দেখা সম্রাটের ছবির সাথে তরুণের চেহারার কিছুটা মিল খুঁজে পাচ্ছেন। ছবিতে অবশ্য দেখা যায় তার পরনে চোখ ধাঁধানো রাজকীয় পোশাক, চেহারায় সীমাহীন মাহাত্ম এবং গাম্ভীর্য।
অথচ সামনে যে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে সে একেবারেই সাধারণ।
একটুও নড়লেন না সেলডন।
সামান্য ভুরু কুঁচকালেন সম্রাট, তিনি সর্বদা নির্দেশ দিয়ে তা পালন হতে দেখেই অভ্যস্ত। কাজেই না চাইতেই গলা দিয়ে স্বভাবসুলভ নির্দেশের সুর বেরিয়ে এল, আমি তোমাকে বসতে বলেছি। ওই চেয়ারে, জলদি।