এখন আগের মতো নেই কেন?
কারণ ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। আমি আপনাকে অবক্ষয়ের কথা বলেছি।
ভুরু কুঁচকালেন সেলডন। মানুষ নিশ্চয়ই বসে বসে ভাবে না, আমরা শেষ হয়ে যাচ্ছি। কাজেই এক্সপ্রেসওয়ে গোল্লায় যাক।
না, তা করে না। আসলে কিছু করার নেই। হয়ে গেছে। বগিগুলোর রঙ চটে গেছে। নষ্ট বগিগুলো পাল্টানো হয়েছে, এখনো হচ্ছে। ম্যাগনেটগুলো রিপ্লেস করা হয়েছে, কিন্তু সবই করা হয় যেনতেন প্রকারে এবং অনেক দিন পরপর। আসলে সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় ক্রেডিটের যোগান দেওয়া যাচ্ছে না।
ক্রেডিট গেল কোথায় তাহলে?
অন্য খাতে। গত শতাব্দীগুলো ছিল যুদ্ধবিগ্রহে পরিপূর্ণ। এখন নেভী অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় আকারে অনেক বড়ো এবং তার পেছনে ব্যয় করতে হচ্ছে প্রচুর। ছোটখাটো একটা যুদ্ধ বা বিদ্রোহ দেখা দিলেও ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে যায় শতগুণ।
কিন্তু ক্লীয়ন ক্ষমতায় আসার পর থেকে তো সেরকম অস্থিরতা বিশৃঙ্খলা নেই। গত পঞ্চাশ বছর থেকেই আমরা বেশ শান্তিতে বসবাস করছি।
কিন্তু শান্তি আছে বলেই সৈনিকরা তাদের বেতন কমাতে দেবে না। অ্যাডমিরালরা চায় না পুরনো আমলের যুদ্ধযানের নেতৃত্ব দিতে বা তাদের পদবী। নিচে নেমে যাক। আর তা করতে গিয়ে সমাজের কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড অবহেলিত হচ্ছে। এটাকেই আমি বলছি অবক্ষয়। নিশ্চয়ই আপনিও একমত হবেন? আপনার কী মনে হয় না এইধরনের দৃষ্টিভঙ্গি বা বিশ্লেষণ সাইকোহিস্টোরীতে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে?
অস্বস্তি নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন সেলডন। তারপর বললেন, ভালো কথা, আমরা যাচ্ছি কোথায়?
স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়।
হাহহা, তাইতো এই সেক্টরের নামটা চেনা চেনা লাগছে। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আমি শুনেছি।
অবাক হইনি। ট্র্যান্টরে একশোর বেশি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান আছে এবং স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয় সেগুলোর মধ্যে প্রথম সারির একটা।
আমি কী ওখানেই থাকব?
কিছুদিনের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পবিত্র ধর্মশালার মতো। ওখানে কেউ আপনাকে ছুতে পারবে না। নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন।
তা না হয় হলো, কিন্তু যারা আগে থেকেই আছে তারা কি আমাকে খুশী মনে মেনে নেবে?
নেবে না কেন? আজকাল ভালো একজন অঙ্কশাস্ত্রবিদ পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। ওরা আপনাকে কাজে লাগাতে পারবে। আপনিও ওদেরকে কাজে লাগাতে পারবেন।
তার মানে, বলতে চাইছেন আমি যেন ওখান থেকেই সাইকোহিস্টোরি ডেভেলপম্যান্টের কাজ শুরু করি।
আপনি আমাকে কথা দিয়েছেন। গম্ভীর গলায় বলল হামিন।
আমি শুধু চেষ্টা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। বললেন সেলডন এবং মনে মনে। ভাবলেন এটা হচ্ছে বালি দিয়ে রশি তৈরি করার প্রতিশ্রুতির মতো।
.
১৫.
আলোচনা খুব বেশি হলো না। সেলডন বাইরে তাকিয়ে স্ট্রিলিং সেক্টরের ঘরবাড়ি দেখতে লাগলেন। ভবনগুলোর কিছু কিছু একেবারেই নিচু আবার কয়েকটা এত উঁচু যেন আকাশ ছুঁড়ে উঠে গেছে। দালানকোঠার মিছিলে হঠাৎ হঠাৎ ছেদ টেনেছে। প্রশস্ত সড়ক। এছাড়াও নিয়মিত দূরত্বে অনেকগুলো সরু গলি চোখে পড়ল।
সেলডন ধারণা করলেন ভবনগুলো যেমন উপরে উঠেছে তেমনি মাটির নিচেও নেমেছে। সম্ভবত উপরে যত উঁচুতে উঠেছে মাটির নিচে নেমেছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। ধারণাটা মাথায় আসার সাথে সাথে তিনি সেটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসও করলেন।
অনেকক্ষণ থেকেই দৃশ্যাবলী দেখছেন সেলডন। হঠাৎ সচেতন হলেন। কারণ বাইরে দিনের আলো কেমন যেন ম্লান হয়ে আসছে। ঝট করে হামিনের দিকে ঘুরলেন। মুখে কিছু না বললেও সেলডনের প্রশ্নটা ধরতে পারল হামিন।
বিকেল গড়িয়ে রাত নামছে।
সেলডনের ভুরু উঁচু হলো সেই সাথে ঠোঁটের কোণাগুলো বেঁকে গেল নিচের দিকে। চমৎকার। আমি কল্পনার চোখে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি পুরো গ্রহটা ধীরে ধীরে অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে, আবার এখন থেকে ঠিক কয়েক ঘণ্টা পর আলোকিত হচ্ছে।
হামিন তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ছোট করে হাসল। কল্পনাটা সঠিক হয়নি, সেলডন। পুরো গ্রহে কখনোই একসাথে রাত নামে না–বা দিন হয় না। পুরো গ্রহেই আলোর হ্রাস বৃদ্ধির মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা আছে। আসল দিন রাতের মতো। গম্বুজের উপরে ঠিক যেভাবে রাত শেষে ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফোটে আর দিন হয় ঠিক সেইরকম। যেন ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে দিনরাতের পার্থক্যের মিল থাকে।
মাথা নাড়লেন সেলডন। তাহলে নিজেদেরকে চারপাশে আবদ্ধ করে রেখে আসল প্রকৃতির নকল করার দরকারটা কী?।
আমার ধারণা মানুষ এইভাবেই চায়। ট্র্যান্টরিয়ানরা নিজেদের এইভাবে ঢেকে রাখতে চায় কিন্তু সেটা মনে রাখতে চায় না। আসলে ট্র্যান্টরিয়ান সাইকোলজির ব্যাপারে আপনার ধারণা কম।
লজ্জা পেলেন সেলডন। তিনি একজন হ্যাঁলিকনিয়ান। এবং হ্যালিকনের বাইরে শুধু ট্র্যান্টর কেন লক্ষ লক্ষ বাসযোগ্য গ্রহের কোনোটার ব্যাপারেই কিছু জানেন না। তিনি কীভাবে সাইকোহিস্টোরি বিজ্ঞানকে বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য করে তুলবেন।
মানুষের সংখ্যা যাইহোক না কেন–প্রয়োজনীয় সবটুকু জ্ঞানার্জন কী সম্ভব?
একটা ধাঁধার কথা মনে পড়ল সেলডনের। ধাঁধাটা এইরকম : তুমি কী অত্যন্ত ছোট এক টুকরা প্লাটিনাম তুলতে পারবে। তার জন্য যতজন মানুষ লাগে লাগুক। শর্ত একটাই তুলতে হবে খালি হাতে কোনো যান্ত্রিক কৌশল ব্যবহার করা যাবে না।