এইরকম ইতিহাস জেনে কী লাভ হবে? প্রতিটি গ্রহ–একটাও বাদ দেওয়া যাবে না–প্রতিটি গ্রহের ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া, আন্তঃক্রিয়া সাইকোহিস্টোরীর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একজন মানুষ কীভাবে পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহের পূর্ণ ইতিহাস পর্যালোচনা করে সম্ভ্যাব্য আন্তঃক্রিয়া নির্ধারণ করবে? অসম্ভব। এবং তিনি আরো একবার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন যে সাইকোহিস্টোরী পুরোপুরি তাত্ত্বিক, বাস্তবে পরিণত করা যাবে না।
মৃদু একটা ঝাঁকুনির ফলে সেলডন ধারণা করলেন বোধহয় এয়ার ট্যাক্সির গতি কমছে।
কী হলো? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
আমার ধারণা যথেষ্ট দূরে আসা গেছে, হামিন বলল, এবার পানাহার এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হওয়ার জন্য খানিকটা বিরতির ঝুঁকি নেওয়া যায়।
পরবর্তী পনেরো মিনিট এয়ার ট্যাক্সির গতি ধীরে ধীরে কমল। সামনে একটা আলোকিত চতুর। আরো অনেকগুলো ট্যাক্সির মাঝে খালি জায়গা দেখে সেখানে ল্যান্ড করল হামিন।
.
১২.
মনে হলো হামিন তার অভিজ্ঞ চোখে এক পলকে পুরো এলাকা, অন্যান্য ট্যাক্সি, ডিনার করতে আসা নারী পুরুষ সকলের উপর নজর বুলালো। সেলডন নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছেন যদিও জানেন না কীভাবে তা সম্ভব। তিনি হামিনকে অনুকরণ করার চেষ্টা করলেন।
ছোট একটা টেবিলে বসে বোতাম টিপে খাবারের অর্ডার দেওয়ার পর প্রশ্ন করলেন সেলডন, সব ঠিক আছে? কণ্ঠস্বর অপরিবর্তিত রাখার চেষ্টাও করলেন।
মনে হয়। বলল হামিন।
কীভাবে বুঝলেন?
হামিনের গভীর চোখ দুটো এক মুহূর্তের জন্য সেলডনের উপর স্থির হলো। অভিজ্ঞতা, বলল সে। আমার মতো দীর্ঘদিন সংবাদের পেছনে ছুটে বেড়ালে আপনিও এক পলক তাকিয়েই বলে দিতে পারবেন, এখানে কোনো খবর নেই।
মাথা নাড়লেন সেলডন। স্বস্তি বোধ করছেন। হয়তো কথাগুলো হামিন বলেছে ঠাট্টার ভঙ্গিতে তারপরেও তাতে যথেষ্ট পরিমাণ সত্য আছে।
কিন্তু স্যান্ডউইচে প্রথম কামড় দিয়েই তার স্বস্তি পুরোপুরি উবে গেল। মুখ ভর্তি খাবার আর চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে হামিনের দিকে তাকালেন তিনি।
মাই ফ্রেন্ড, এটা রাস্তার ধারের সস্তা হোটেল। বলল হামিন। সস্তা, দ্রুত পাওয়া যায় এবং জঘন্য স্বাদ। এই খাবারগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন এবং অত্যন্ত কড়া ছত্রাকের নির্যাস মেশানো। ট্রান্টরিয়ান জিহ্বা এই স্বাদে অভ্যস্ত।
বেশ পরিশ্রম করে মুখের খাবারটুকু পেটে চালান করলেন সেলডন। কিন্তু হোটেলে-।
আপনি তখন ছিলেন ইম্পেরিয়াল সেক্টরে, সেলডন। সেখানে খাবার আমদানী করা হয় এবং সবচেয়ে উন্নতমানের মাইক্রোফুড ব্যবহার করা হয়। দামও অত্যন্ত বেশি।
স্যান্ডউইচ আবার মুখে তুলবেন কিনা ভাবছেন সেলডন। তার মানে যতদিন ট্র্যান্টরে থাকব…
ঠোঁট দিয়ে শ… শ… শ শব্দ করার মতো একটা ভঙ্গি করল হামিন। কাউকে বুঝতে দেবেন না যে আপনি আরো ভালো স্বাদে অভ্যস্ত। ট্র্যান্টরে কিছু কিছু স্থানে বেশি আভিজাত্য দেখানো একজন আউটওয়ার্ল্ডার হওয়ার চেয়েও বিপজ্জনক। নিশ্চিত থাকুন, সব জায়গার খাবারই এমন বিস্বাদ না। রাস্তার ধারের এই হোটেলগুলোর নিচু মানের খাবার সরবরাহ করার একটা অখ্যাতি আছে। আপনি যদি এই স্যান্ডউইচটা হজম করতে পারেন, তাহলে ট্র্যান্টরে অন্য কোথাও গিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। আর খাবারে আপনার কোনো ক্ষতিও হবে না। পচে যায়নি, দুদিন আগের বাসী খাবারও না, শুধু স্বাদটা একটু কড়া। বিশ্বাস করুন কিছুদিন পর আপনি এটাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন। অনেক ট্র্যান্টরিয়ানকেই আমি চিনি যারা মূল্যবান সুস্বাদু খাবার মুখে নিয়েই থুঃ করে ফেলে দেয় কারণ তাতে এইরকম কড়া স্বাদ গন্ধ থাকে না।
এখানে কী প্রচুর খাদ্য উৎপাদন করা হয়? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন। তার আগে অবশ্য দেখে নিলেন কথা শুনে ফেলার মতো কাছাকাছি কেউ আছে কিনা। আমি শুনেছি যে আশেপাশের বিশটা গ্রহ থেকে শয়ে শয়ে ফ্রেইট শিপ ট্র্যান্টরের প্রতিদিনের খাবার সরবরাহ করে।
আমিও জানি। এবং শত শত ফ্রেইট শিপ ট্র্যান্টরের বর্জ্য নিয়ে যায়। গল্পটা আরো মুখরোচক হবে যদি আপনি বলেন যে সেই একই শিপগুলো বর্জ্য বহন করে নিয়ে যায় যেগুলো খাবার বহন করে নিয়ে আসে। এটা সত্যি যে আমরা বিপুল পরিমাণে খাদ্য আমদানী করি, কিন্তু তার অধিকাংশই বিলাসী এবং মূল্যবান। এবং আমরা বিপুল পরিমাণে বর্জ্য রপ্তানী করি, অত্যন্ত যত্নের সাথে সেগুলোর ক্ষতিকারক প্রভাব দূর করে কার্যকরী উপাদানে পরিণত করা হয়–যেমন জৈব সার যার প্রতিটা কণা অনেক গ্রহের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান আমাদের কাছে যেমন। মূল্যবান খাদ্য। কিন্তু আমি যা বললাম তা হলো মূল ছবির একটা অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র।
তাই?
সাগরের মাছ ছাড়াও এখানে আছে ফল এবং টাটকা শাকসজীর বাগান, পোলট্রি, খরগোস এবং বিশাল বিশাল মাইক্রো অর্গানিজমের ফার্ম–সাধারণত বলা হয় ছত্রাকের খামার, যদিও উৎপাদন অত্যন্ত কম। এবং আমাদের বর্জ্যগুলো অধিকাংশই এই উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য এখানেই ব্যবহার করা হয়। আসলে অনেক দিক দিয়েই ট্র্যান্টর সুবিশাল এবং অতিরিক্ত বেড়ে উঠা একটা স্পেস সেটলম্যান্টের মতো। আপনি কখনো ওগুলোতে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, অবশ্যই।
স্পেস সেটলম্যান্টগুলো হচ্ছে আবদ্ধ শহরের মতো যার ভেতরে সবকিছুই কৃত্রিম উপায়ে রিসাইকল করা হয়। কৃত্রিম ভেন্টিলেশন, কৃত্রিম দিনরাত ইত্যাদি ইত্যাদি। পার্থক্য শুধু এক জায়গাতে। সেটা হলো সবচেয়ে বড়ো সেটলম্যান্টের জনসংখ্যা দশ মিলিয়নের কাছাকাছি আর ট্র্যান্টরের জনসংখ্যা তার দশহাজার গুণ বেশি। অবশ্য আমাদের সত্যিকার মধ্যাকর্ষণ আছে। আর কোনো স্পেস সেটলম্যান্টই আমাদের মাইক্রোফুডের মতো উন্নত মাইক্রোফুড তৈরি করতে পারবে না। আমাদের এখানে। যে ঈষ্ট ভেট, ফাঙ্গাল ম্যাট, এলগি পন্ড আছে সেগুলো আয়তনে এত বিশাল যে বাইরের কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। আর আমরা কৃত্রিম উপায়ে খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করার ব্যাপারে অত্যন্ত দক্ষ।