তাই কী, ডেমারজেল? মানুষ কিন্তু এগুলো বিশ্বাস করে।
মানুষ অনেক কিছুই বিশ্বাস করে, সায়ার।
কিন্তু এই ধরনের ব্যাপার-স্যাপারগুলো একটু বেশিই বিশ্বাস করে। যাইহোক ভবিষ্যদ্বাণী পরবর্তীকালে সত্য হোক বা না হোক, কোনো ব্যাপার না। যদি একজন গণিতজ্ঞ আমার জন্য জনগণের কাছে প্রচার করে যে অনাগত দিনগুলোতে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে সুখ-সমৃদ্ধি-শান্তি, ভবিষ্যতে এম্পায়ার হয়ে উঠবে আরো সমৃদ্ধিশালী–সেটা ভালো হবে না?
শুনতে বেশ ভালোই লাগে, কিন্তু তাতে কী লাভ হবে, সায়ার?
জনগণ যদি বিশ্বাস করে, তাহলে তারা সেই অনুযায়ী আচরণ করবে। অনেক মতবাদই শুধু মানুষের গভীর বিশ্বাসের কারণে বাস্তবে পরিণত হয়েছে। এই মতবাদগুলো আসলে মানুষের ভয়, শঙ্কা দূর করে তাদেরকে প্রশমিত করে তোলে। এই জাতীয় কথা তুমিই আমাকে বুঝিয়েছিলে।
বলেছিলাম, সায়ার। সতর্ক পর্যবেক্ষণে সম্রাটের দিকে তাকিয়ে আছে ডেমারজেল, বোঝার চেষ্টা করছে কীভাবে বললে সীমা লঙ্ঘন করা হবে না। যদি তাই হয়, তাহলে তো যেকোনো ব্যক্তিই মতবাদগুলো প্রচার করতে পারে।
যেকোনো ব্যক্তিকে জনগণ সমানভাবে বিশ্বাস করবে না, ডেমারজেল। অন্যদিকে একজন গণিতজ্ঞ তার মতবাদ প্রচার করবে গাণিতিক সূত্র এবং বিশ্লেষণের ভিত্তিতে–যা সাধারণ মানুষ বুঝবে না অথচ বিশ্বাস করবে ঠিকই।
বরাবরের মতোই আপনি অসম্ভব বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন, সায়ার। সত্যি কথা, আমরা এখন সমস্যাসঙ্কুল কঠিন সময়ের আবর্তে হাবুডুবু খাচ্ছি। এই সময় জনগণকে শান্ত রাখা প্রয়োজন। তার জন্য এমন কৌশল অবলম্বন করতে হবে যাতে করে অর্থ ব্যয় বা সামরিক শক্তি কোনোটাই প্রয়োগ করতে না হয়। যেহেতু সমসাময়িক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এই দুটো পদ্ধতিতেই লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণই বেশি।
ঠিক, ডেমারজেল। উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন সম্রাট। হ্যারি সেলডনকে খুঁজে বের করো। আমি জানি তোমার হাত এই বিশাল গ্রহের সব জায়গাতেই ছড়ানো, এমনকি সেইসব স্থানেও যেখানে আমার সৈনিকরা পর্যন্ত যেতে ভয় পায়। হ্যারি সেলডনকে আমার সামনে নিয়ে এসো। আমি তার সাথে কথা বলতে চাই।
তাই হবে, সায়ার। বলল ডেমারজেল। সম্রাট অবশ্য জানেন না যে তার চীফ অব স্টাফ এরই মাঝে হ্যারি সেলডনকে খুঁজে বের করে ফেলেছে। একটা কথা নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিল ডেমারজেল–এই চমৎকার কাজের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রীকে একটা প্রশংসাসূচক ধন্যবাদ জানাতে হবে।
.
০২.
বর্তমান কাহিনী যে সময়ের, সেই সময় হ্যারি সেলডন ছিলেন নিতান্তই অখ্যাত তরুণ এক গণিতবিদ। সম্রাট প্রথম ক্লীয়নের মতো তার বয়সও বত্রিশ বছর, তবে তার উচ্চতা মাত্র ১.৭৩ মিটার। মসৃণ নিভাজ মুখমণ্ডলে সর্বদাই একটা সতেজ হাসি খুশি ভাব, ঘন বাদামী চুল, প্রায় কালোই বলা যায় এবং পোশাকে-আশাকে তখনো একটা গ্রাম্য প্রাদেশিকতার ছোঁয়া রয়ে গিয়েছিল।
পরবর্তী যুগে যে মানুষগুলোর কাছে তিনি আধা ঈশ্বরে পরিণত হন, সেই মানুষগুলোর কাছে তার এই তরুণ বয়সের চেহারা কল্পনা করাও ধর্মদ্রোহিতার সামিল। ভবিষ্যতের বংশধরদের সামনে তিনি ছিলেন হুইলচেয়ারে বসা পক্ককেশ অশীতিপর বৃদ্ধ। বলিরেখাপূর্ণ মুখ, উজ্জ্বল দীপ্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। আর তার পিতৃসুলভ স্নেহময় মুখমণ্ডল থেকে ফুটে বেরুচ্ছে নির্ভেজাল জ্ঞানের উজ্জ্বল প্রভা। তবে সেই বৃদ্ধ বয়সেও তার মুখে সতেজ হাসি-খুশি ভাবটা বজায় ছিল।
এই মুহূর্তেও তার চোখ দিয়ে খুশির ঝিলিক বেরুচ্ছে। গণিত সম্মেলনে তিনি তার গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন। বাঘা-বাঘা গণিতবিদরা কিছুটা হলেও আকৃষ্ট হয়েছে। বৃদ্ধ অস্টারফি মাথা নেড়ে বলেছেন, চমৎকার, ইয়ং ম্যান। চমৎকার। অস্টারফির প্রশংসা পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।
বর্তমান ঘটনায় অবশ্য হ্যারি সেলডন খানিকটা বিমূঢ়। খুশি হবেন না শঙ্কিত হবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না।
লেফটেন্যান্ট আলবান ওয়েলিস, পরিচয়পত্র দেখালো সামনে দাঁড়ানো সম্রাটের গার্ড রেজিমেন্টের অফিসার। আপনি কী আমার সাথে একটু আসবেন, স্যার?
ওয়েলিস সশস্ত্র নিঃসন্দেহে। সেলডন জানেন এদের সাথে তাকে যেতেই হবে। তবে দু-একটা প্রশ্ন করে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করতে তো কোনো দোষ নেই। তাই তিনি বললেন, কোথায়, সম্রাটের সাথে দেখা করার জন্য?
প্রাসাদে নিয়ে যাব, স্যার। আমাকে শুধু এতটুকুই বলা হয়েছে।
কিন্তু কেন?
কারণটা আমাকে জানানো হয়নি। শুধু কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে। আপনাকে প্রাসাদে নিয়ে যেতে হবে, যেভাবেই হোক।
দেখে তো মনে হয় গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তেমন কোনো অপরাধ। করেছি বলে তো মনে পড়ে না।
বরং বলুন যে আপনাকে সসম্মানে গার্ড অব অনার দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দয়া করে আর দেরী করবেন না।
দেরী করলেন না সেলডন। ঠোঁট দুটো জোরে চেপে রাখলেন। ভাবখানা এমন, মুখ ফসকে যেন আর কোনো প্রশ্ন বেরিয়ে না পড়ে। মাথা নেড়ে পা বাড়ালেন সামনে। সম্রাটের সাথে দেখা হলে বা একটা রাজকীয় সংবর্ধনা পেলেও তিনি খুশী হবেন না। তার আসল উদ্দেশ্য এম্পায়ার অর্থাৎ মানবজাতির কল্যাণ এবং সুখ শান্তির জন্য আজীবন সাধনা করা–কোনো সম্রাটের ব্যক্তিগত তল্পিবাহক হতে পারবেন না তিনি।