আপনার কী হবে আর এখন কী করতে চাইছেন?
চিন্তিত গলায় জবাব দিল হামিন। আমাকে ওরা ছেড়ে দেবে না। দেখা যাবে কোনো একদিন কোনো গুপ্তঘাতক আড়াল থেকে আমাকে মেরে পালিয়ে গেল।
কথাগুলো বলার সময় হামিনের বলার ভঙ্গি বা কণ্ঠস্বর পুরোপুরি স্বাভাবিক থাকল কিন্তু সেলডন কুঁকড়ে গেলেন।
আপনাকে দেখে তো মনেই হচ্ছে না আপনি… আপনি… একটুও ভয় পেয়েছেন।
আমি ঘাগু ট্র্যান্টরিয়ান। এই গ্রহটাকে অন্য অনেকের চেয়ে ভালোভাবে জানি। আমি অনেক মানুষকে চিনি, জানি যাদের বেশিরভাগই আমার কাছে কোনো না কোনো কারণে ঋণী। আমি অত্যন্ত সাবধানী লোক এবং নিজেকে রক্ষা করতে পারব এই বিশ্বাস আমার আছে।
শুনে খুশী হলাম এবং আশা করি আপনি আসলেই নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন, হামিন, কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না, কেন আপনি এই ঝুঁকি নিচ্ছেন। আমি আপনার কে? কেন সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষের জন্য নিজের বিপদ ডেকে আনছেন?
কন্ট্রোল নিয়ে খেলা করতে লাগল হামিন, জবাব দেওয়ার আগে সময় নিচ্ছে। তারপর সরাসরি তাকালো সেলডনের দিকে।
আমি আপনাকে রক্ষা করতে চাইছি ঠিক একই কারণে যে কারণে সম্রাট আপনাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল–আপনার ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা।
প্রচণ্ড হতাশ হলেন সেলডন। তাকে রক্ষা করার পেছনে বন্ধুত্ব বা মানবিক কোনো কারণ নেই। পুরোটাই স্বার্থ। আসলে তিনি শিকার, শুধু এক শিকারীর খপ্পর থেকে আরেক শিকারীর হাতে পড়েছেন। ক্রোধের সাথে জবাব দিলেন, এই সম্মেলনে আমার প্রবন্ধ উপস্থাপন করাটাই চরম ভুল। এটা আমার জীবন শেষ করে দিয়েছে।
না, এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। সম্রাট এবং তার অফিসাররা আপনাকে চায় এক কারণে, তারা চায় আপনাকে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে, নিজেদের বংশধরদের জন্য সুখ, সমৃদ্ধি এবং আরামআয়েশের ব্যবস্থা বজায় রাখতে। যেন সম্রাটের শাসন বজায় থাকে এবং পরবর্তীকালে তার ছেলেও একইভাবে শাসন করতে পারে। কিন্তু আমি চাই আপনার এই ক্ষমতা দিয়ে যেন গ্যালাক্সির মঙ্গল করা যায়।
পার্থক্যটা কোথায়? তিক্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।
এবার হামিনও রেগে উঠল। পার্থক্যটা কোথায় সেটা যদি বুঝতে না পারেন তাহলে আপনার লজ্জিত হওয়া উচিত। যে সম্রাট এখন আমাদের শাসন করছেন তার জনের আগে, তিনি যে রাজবংশের প্রতিনিধি সেই বংশের সূত্রপাতের অনেক অনেক আগে মানব সভ্যতার জন্ম। হয়তোবা গ্যালাক্সির পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহের বয়সের চেয়েও প্রাচীন মানব সভ্যতা। কিংবদন্তী আছে যে এক সময় মানব জাতি শুধু একটা গ্রহেই বাস করত।
কিংবদন্তী!
হ্যাঁ, কিংবদন্তী। কিন্তু সেটা সত্যি না হওয়ার পেছনে তো আমি কোনো কারণ দেখিনা। হয়তো বিশ হাজার বা তারও বেশি বছর আগে ঘটনা এমনই ছিল। নিশ্চয়ই হাইপারস্পেশাল যোগাযোগের জ্ঞান-বুদ্ধি মাথায় নিয়েই মানব জাতির জন্ম হয়নি। শুরুতে নিশ্চয়ই আলোর গতির চেয়ে হাজার গুণ বেশি দ্রুত যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা ছিল না এবং তারা নিঃসন্দেহে একটা মাত্র প্ল্যানেটরি সিস্টেমে বন্দী হয়ে ছিল। আর গ্যালাক্সির গ্রহগুলোতে যে মানবসভ্যতা গড়ে উঠেছে তা আমি, আপনি বা সম্রাট এবং আমাদের পরবর্তী বংশধরদের মৃত্যুর পরেও বহু বহু বছর টিকে থাকবে। এমনকি হয়তোবা এই এম্পায়ার ধ্বংস হয়ে যাবে, কিন্তু মানবজাতি ঠিক তাদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখবে। সেই ক্ষেত্রে, কেন একজনের কথা ভাবব, কেন সম্রাট এবং তরুণ যুবরাজ-এর জন্য চিন্তিত হব? এম্পায়ার কীভাবে চলছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। গ্যালাক্সির কোয়াড্রিলিয়ন মানবসন্তানের কী হবে? কী হবে তাদের?
মানব জাতি তার পথ চলা চালিয়ে যাবে।
আপনি কী কোনো তাগিদ অনুভব করছেন না যে তাদের একটা দিকনির্দেশনা দরকার নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য।
যে কেউ মনে করতে পারে এখন যেভাবে চলছে সেইভাবেই নিজেদের অস্তিত্ব ভালোভাবে টিকিয়ে রাখা যাবে।
মনে করতে পারে। সে কী আপনি যে ভবিষ্যদ্বাণীর কথা বলছেন তার কৌশলটা বলতে পারবে?
আমি এই কৌশলটাকে বলি সাইকোহিস্টোরী। তাত্ত্বিকভাবে পারবে।
আর আপনি এই তত্ত্বকে বাস্তবে পরিণত করার কোনো প্রয়োজন বোধ করছেন না।
আমি চাই, হামিন। কিন্তু ইচ্ছা এবং সামর্থ্যের মাঝে অনেক ফারাক। সম্রাটকে আমি বলেছি যে সাইকোহিস্টোরীকে বাস্তব কৌশলে পরিণত করা যাবে না, আপনাকেও একই কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি।
আপনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন?
না, আমি তা চাই না, বরং ট্র্যান্টরের সমান শিলাখণ্ড হাতে নিয়ে সেগুলো ওজন অনুযায়ী সাজানোর চেষ্টা করাও অনেক ভালো। আমি জানি সাইকোহিস্টোরী এমন একটা কাজ যা আমি সাত-জনমেও শেষ করতে পারব না।
মানব জাতির সত্যিকার অবস্থা জানতে পারলে আপনি চেষ্টা করবেন?
অবান্তর প্রশ্ন। মানবজাতির সত্যিকার অবস্থা আবার কী? আপনি কী দাবী করছেন যে আপনি সেটা জানেন?
হ্যাঁ, জানি। এবং মাত্র পাঁচ শব্দেই আপনাকে পুরোটা বলে দিতে পারি। আবার সামনে তাকালো হামিন। মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল টানেলের দেয়ালের পরিবর্তনহীনতা, কীভাবে সেগুলো চোখের সামনে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। পরক্ষণেই পিছিয়ে যাচ্ছে সাঁ করে। তারপর হাসি মুখে শব্দ পাঁচটা বলল।