এদিকে হামিন দক্ষতার সাথে কাজ করছে। যথেষ্ট পরিমাণ ক্রেডিট জমা দিয়ে হাতে একটা সুপারকন্ডাকটিভ সিরাময়েড টাইল নিয়ে ফিরে এল। এই টাইল দিয়েই তাদের ভাড়া করা এয়ার ট্যাক্সি চালু করতে হবে।
চলুন, সেলডন। দুই আসনের একটা ছোট বাহনের দিকে ইশারা করে বলল হামিন।
আপনার নাম সই করতে হয়েছে, হামিন?
না, এখানে সবাই আমাকে ভালো করেই চেনে। তাই নিয়ম মেনে সবকিছু করার গরজ দেখায়নি কেউ।
আপনি কী করছেন ওরা জানে?
কেউ জিজ্ঞেস করে নি, আমিও নিজে থেকে কিছু বলিনি। হাতের টাইল একটা ফুটো দিয়ে ঢোকালো হামিন। এয়ার ট্যাক্সি চালু হলো। হালকা কম্পন অনুভব করলেন সেলডন।
আমরা ডি-সেভেন এ যাব।
ডি-সেভেন জিনিসটা কী সেলডন জানেন না তবে অনুমান করলেন এটা বোধহয় কোনো রাস্তার নাম।
অন্যান্য গ্রাউন্ড কারের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে এয়ার ট্যাক্সি চলা শুরু করল। কিছুক্ষণ চলার পর খানিকটা তীর্যকভাবে উপরের দিকে উঠতে লাগল। গতি বাড়ছে। ধীরে ধীরে। তারপর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সোজা উপরে উঠে গেল।
ভেতরে ঢোকার সাথে সাথেই একটা সিট বেল্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেলডনকে আসনের সাথে আটকে নিয়েছে। অনুভব করলেন তিনি পিছনে সিটের আরামদায়ক ফোমের একেবারে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছেন তারপরে যেন প্রিং-এ ধাক্কা খেয়ে আবার ছিটকে বেরিয়ে এলেন।
এটাতো এ্যান্টিগ্র্যাভিটিক বলে মনে হচ্ছে না। তিনি বললেন।
না, জবাব দিল হামিন। এই ঝাঁকুনিটা হচ্ছে ছোট একটা জেট রি অ্যাকশনের কারণে। তবে আমাদের উপরে টিউবের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যথেষ্ট।
সামনে ধীরে ধীরে যা উন্মোচিত হচ্ছে, সেলডনের কাছে মনে হলো যেন অসংখ্য এবং অগণিত গুহা, দূর থেকে মনে হয় চেকারবোর্ডের মতো। অন্যান্য এয়ার। ট্যাক্সিগুলোকে এড়িয়ে হামিন ডি-সেভেন টানেলের খোলামুখের দিকে এগিয়ে চলেছে।
যেকোনো মুহূর্তে আপনি অন্য ট্যাক্সির সাথে ধাক্কা লাগাবেন। গলা পরিস্কার করে বললেন সেলডন।
সেই সম্ভাবনা শতকরা একশ ভাগ ছিল যদি এটা চালানোর জন্য আমাকে নির্ভর করতে হতো নিজের বোধ বুদ্ধি এবং দক্ষতার উপর। কিন্তু এই ট্যাক্সি কম্পিউটার চালিত।–এই যে চলে এসেছি।
ডি-সেভেন টানেলে ঢুকল তারা; মনে হলো যেন টানেলটা তাদের গিলে ফেলল। বাইরের প্লাজার উজ্জ্বল ঝলমলে আলো মুছে গেল, টানেলের ভিতরের আলো নিষ্প্রভ হলুদ।
কন্ট্রোল ছেড়ে সিটে হেলান দিয়ে বসল হামিন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, যাক, ঝামেলা ছাড়াই একটা ধাপ পেরনো গেল। স্টেশনে ধরা পড়ার ভয় ছিল। কিন্তু এখানে আমরা পুরোপুরি নিরাপদ।।
মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলেছে এয়ার ট্যাক্সি। কোনো শব্দ নেই, শুধু একটা মোলায়েম গুঞ্জন। টানেলের দুপাশের দেয়াল সড়াৎ সড়াৎ করে সরে যাচ্ছে পিছনে।
কী রকম গতিতে এগোচ্ছি আমরা? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।
দ্রুত কন্ট্রোলের উপর চোখ বুলালো হামিন। ঘণ্টায় প্রায় তিনশ পঞ্চাশ কিলোমিটার।
ম্যাগনেটিক প্রপালশন?
হ্যাঁ। আমার ধারণা হ্যালিকনেও এই জিনিস আছে।
আছে। মাত্র একটা লাইন। ইচ্ছে থাকলেও কখনো চড়ার সৌভাগ্য হয়নি। কোনো ধারণাই ছিল না যে জিনিসটা এমন হবে।
ট্র্যান্টরের ল্যান্ড সারফেসের উপর থেকে শুরু করে গভীর তলদেশ পর্যন্ত মহাসাগরগুলোর দুর্গম তলদেশ পর্যন্ত এইরকম অসংখ্য টানেল মৌমাছির চাকের মতো ছড়িয়ে আছে। দূরের যাত্রার জন্য এটাই ট্র্যান্টরে একমাত্র এবং প্রধান মাধ্যম।
কতক্ষণ লাগবে?
প্রথম গন্তব্যে পৌঁছতে পাঁচ ঘণ্টার কিছু বেশি লাগবে।
পাঁচ ঘণ্টা! মুখ বাঁকালেন সেলডন।
চিন্তা করবেন না। প্রতি বিশ মিনিট পর পর রেস্ট এরিয়া আছে। ইচ্ছে হলেই সেখানে থেমে টানেল থেকে বেরনো যাবে, হাঁটাহাঁটি করে নিতে পারব। খাবারসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা আছে।
তারপর দুজনেই নিশ্চুপ। আবার আলোচনা শুরু হলো যখন সেলডন হঠাৎ একটা আলোর চমক দেখে সোজা হয়ে বসলেন। তার কাছে মনে হলো তিনি বোধহয় আরো দুটো এয়ার-ট্যাক্সি দেখেছেন।
ওটা একটা রেস্ট এরিয়া। অনুচ্চারিত প্রশ্নের জবাব দিল হামিন।
আপনি আমাকে যেখানে নিয়ে যাচ্ছেন সেই জায়গাটা কী আসলেই নিরাপদ?
অন্য অনেক জায়গার চেয়ে নিরাপদ। অন্তত ইম্পেরিয়াল ফোর্স সরাসরি আপনার গায়ে হাত দিতে পারবে না। তবে ভাড়াটে খুনী বা অপহরণকারী পাঠিয়ে আপনার ক্ষতি করতে পারে সেজন্য তো কিছুটা সতর্ক থাকতেই হবে। আমি আপনার জন্য দেহরক্ষীর ব্যবস্থা করে দেব।
ভাড়াটে খুনী? অস্বস্তির সাথে বললেন সেলডন। ওরা কী আসলেই আমাকে খুন করতে চায়?
আমি নিশ্চিত যে ডেমারজেল আপনাকে খুন করতে চায় না। সে আপনাকে নিজের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু শত্রুতো আরো অনেকেই আছে। তারা আপনাকে মেরে ফেলতে পারে, অথবা কোনো ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটে যেতে পারে।
মুখ ঘুরিয়ে নিলেন সেলডন। মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা আগেই তিনি ছিলেন অনুন্নত এক গ্রহ থেকে আসা অপরিচিত এক গণিতজ্ঞ। চমৎকার সব দৃশ্য দেখে সময় কাটাচ্ছিলেন। চেয়েছিলেন নিজ গ্রহে ফিরে যাওয়ার আগে অনভ্যস্ত গ্রাম্য চোখ দিয়ে প্রাণ ভরে দেখবেন এই সুবিশাল গ্রহের অতি উন্নত জৌলুশ এবং চাকচিক্য। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তিনি এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, পিছনে ছুটে আসছে ইম্পেরিয়াল ফোর্স। ঘটনার ভয়াবহতায় কেঁপে উঠলেন তিনি।