.
০৬.
চোখ তুলে তাকালেন সেলডন। সামনে এক তরুণ দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টিতে একই সাথে প্রকাশ পাচ্ছে রাগ এবং তিরস্কার। পাশে আরো এক তরুণ–প্রথম জনের চেয়ে দ্বিতীয়জনের বয়স বোধহয় কিছুটা কমই হবে। দুজনেই লম্বা চওড়া শক্তিশালী।
পোশাক পরিচ্ছদ পুরোপুরি ট্র্যান্টরিয়ান। চোখ ধাঁধানো রং, কোমরে চওড়া বেল্ট, বিশাল বারান্দাওয়ালা গোলাকার টুপি। বারান্দার দুপ্রান্ত থেকে দুটো উজ্জ্বল গোলাপী রংয়ের রিবন চলে গেছে ঘাড়ের পিছনে।
সবকিছু মিলিয়ে কৌতুক বোধ করলেন। হেসে উঠলেন তিনি।
সামনে দাঁড়ানো তরুণ কড়া ধাতানি দিল, হাসছিস কেন, ব্যাটা গাইয়া ভূত?
সম্বোধনটা এড়িয়ে গেলেন সেলডন। ভদ্রভাবে বললেন, হাসির জন্য দুঃখিত। আসলে তোমার পোশাক দেখে বেশ মজা লাগছে।
আমার পোশাক? তাই? আর তুই কী পড়েছিস? এগুলো কোনো জামা কাপড় হলো? সেলডনের জ্যাকেটের ল্যাপেল ধরে হালকা একটা টান দিল তরুণ। নিঃসন্দেহে তরুণের পোশাক পরিচ্ছদের তুলনায় তারটা অনেক বেশি পুরনো আর নিষ্প্রভ মনে মনে ভাবলেন সেলডন।
আসলে এগুলো আউটওয়ার্ল্ডের পোশাক। আর এগুলো ছাড়া পড়ার মতো অন্য কিছু আমার নেই।
বেড়াতে আসা লোকজন এখন পার্ক ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। বিপদের গন্ধ পেয়েছে সবাই এবং তখন আশেপাশে থাকার কোনো আগ্রহ নেই। তার নতুন বন্ধু হামিন চলে গেলেও অবাক হবেন না সেলডন। কিন্তু সেটা দেখার জন্য বেয়াড়া কিসিমের তরুণের উপর থেকে চোখ সরানো নিরাপদ মনে হলো না তার কাছে।
তুই আউটওয়ার্ল্ডার? জিজ্ঞেস করল তরুণ।
হ্যাঁ, সেইহেতু আমার পোশাকগুলোও তাই।
সেইহেতু? এটা আবার কোন ধরনের শব্দ? তোর নিজ গ্রহের?
আমি আসলে বলতে চাচ্ছি যে সেই কারণেই আমার পোশাকগুলো তোমার কাছে অদ্ভুত মনে হচ্ছে। আমি বেড়াতে এসেছি।
কোন গ্রহ থেকে?
হ্যালিকন।
তরুণের ভুরু জোড়া এক হয়ে গেল। কখনো নাম শুনিনি।
খুব একটা বড়ো গ্রহ না।
সেখানে ফিরে যাচ্ছিস না কেন?
যাব। আগামীকাল।
না, এখুনি যাবি।
তরুণ তার সঙ্গীর দিকে তাকালো। সেলডনও তাকালেন। তখনই চোখের কোণা দিয়ে হামিনকে দেখতে পেলেন তিনি। নতুন বন্ধু তাকে ফেলে চলে যায়নি। পার্কে শুধু তিনি হামিন আর দুই তরুণ।
আমি আজকের দিনটা ঘুরে বেড়াব। আগামীকাল ফিরে যাব।
না, সেটা করা যাবে না এক্ষুনি ফিরে যাবি।
হাসলেন সেলডন। না, যাব না।
সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করল তরুণ, মারভী, এই পোশাকগুলো তোর ভালো লেগেছে?
প্রথমবারের মতো কথা বলল মারভী। মোটেই না। জঘন্য। বমি আসতে চায়।
ওকে এভাবে ঘুরে বেড়াতে দেওয়া যায় না। জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
অবশ্যই না, এলেম।
এলেম হাসল, বেশ, মারভী কী বলেছে, তুই শুনেছিস।
এবার হামিন কথা বলল, তোমরা দুজনেই শোনো, এলেম এবং মারভী। যথেষ্ট মজা হয়েছে। এখন চলে যাচ্ছ না কেন?
এলেম সেলডনের উপর খানিকটা ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল। সোজা হয়ে ঘুরল। তুমি কে?
সেটা তোমার জানার কোনো দরকার নেই। কড়া গলায় জবাব দিল হামিন।
তুমি ট্র্যান্টরিয়ান? জিজ্ঞেস করল এলেম।
এটাও জানার দরকার নেই।
পোশাক পরিচ্ছদ ট্র্যান্টরিয়ানদের মতো। সেই কারণেই তোমাকে কিছু বলব না আমরা। খামোখা বিপদ ডেকে এনোনা নিজের জন্য।
আমি থাকছি। অর্থাৎ তোমাদের দুজনের বিরুদ্ধে আমরা দুজন। লড়াইটা ঠিক তোমাদের মনের মতো হবে না। এক কাজ করো, আমাদের দুজনকে সামলানোর জন্য তোমরা বরং আরো সঙ্গী সাথী ডেকে নিয়ে আসো, যাও।
আমারও মনে হয় আপনার চলে যাওয়া উচিত, হামিন। সেলডন বললেন। ভালো মানুষ বলেই বিপদে সাহায্য করতে চাইছেন, কিন্তু আমার জন্য আপনি কেন আহত হবেন।
এরা আবার কী বিপদ ঘটাবে, সেলডন। দুই পয়সার চামচা সব।
চামচা! রাগে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল এলেম। সেলডনের মনে হলো হ্যালিকনের চেয়ে ট্র্যান্টরে চামচা শব্দটার অর্থ বোধহয় অনেক বেশি অপমানজনক।
শোন, মারভী, চিৎকার করে বলল এলেম, তুই এই ব্যাটাকে সামলা, আমি সেলডনের বারোটা বাজাচ্ছি। ওকেই আমাদের দরকার। এখুনি-
জ্যাকেটের ল্যাপেল ধরে টেনে তোলার জন্য হাত বাড়ালো সে। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে মনে হবে আত্মরক্ষার জন্য হাত বাড়িয়েছেন সেলডন, তার চেয়ার খানিকটা পিছনে সরে গেল। বাড়ানো হাত দুটো ধরে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। চেয়ারটা মাটিতে পড়ে গেল।
চোখের পলকে ঘটে গেল ঘটনাগুলো। দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল এলেম।
সেলডন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন এলেমের দিকে। তারপর পাশে তাকালেন মারভীর জন্য।
এলেম নিথর পড়ে আছে, মুখ বিকৃত হয়ে গেছে ব্যথায়। বুড়ো আঙ্গুল দুটো ভেঙেছে, ব্যথা পেয়েছে কুচকীতে, মেরুদণ্ডের দুচারটা হাড়ও বোধহয় নড়ে গেছে।
হামিন পিছন দিক থেকে মারভীর গলা পেচিয়ে রেখেছে আরেক হাত দিয়ে মুচড়ে ধরেছে তার ডান হাত। আরেকটু উপর দিকে তুললেই হাতটা ভেঙ্গে যাবে। মারভীর মুখ টকটকে লাল হয়ে গেছে। হাসফাস করছে নিঃশ্বাস নেবার জন্য। চকচকে ধারালো ছোট একটা ছুরি পড়ে আছে মাটিতে।
বজ্ৰ-আটুনি কিছুটা ঢিলা করল হামিন। নিখাদ বিস্ময়ের সাথে বলল, আপনি ব্যাটাকে জঘন্যভাবে আহত করেছেন।
তাইতো মনে হয়। বললেন সেলডন।
আরেকটু বেকায়দা ভঙ্গিতে পড়লে ঘাড় ভাঙত।
কী ধরনের গণিতবিদ আপনি?
হ্যালিকনিয়ান গণিতবিদ। এগিয়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা ছুরিটা তুললেন সেলডন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললেন, জঘন্য এবং বিপজ্জনক।