চ্যাটার হামিন। লোকটাকে খানিকটা বিব্রত দেখালো। বেশ সাদামাটা নাম।
চ্যাটার বা হামিন নামটা কখনো শুনিনি। তবে এভাবে বলা যায় যে হ্যারিস বা সেলডনের মতো প্রচলিত নামগুলোর ভিড়ে আপনার নামের একটা নতুনত্ব আছে নিঃসন্দেহে।
চেয়ার ঘষটে ঘষটে সেলডন আরো কাছাকাছি গিয়ে বসলেন। খানিকটা স্থিতিস্থাপক সিরাময়েড টাইলস-এর মেঝেতে ঘ্যাষ করে একটা শব্দ হলো।
আমার পোশাকগুলোও একেবারে সাদামাটা। ট্র্যান্টরিয়ান পোশাক পরার কথা মাথাতেই আসেনি।
আপনি যেকোনো মুহূর্তে কিনে নিতে পারবেন।
আমি আগামীকালই চলে যাচ্ছি। তাছাড়া ওগুলো কেনার সামর্থ্য আমার নেই। গণিতবিদরা বড়ো বড়ো সংখ্যা নিয়ে কাজ করলেও সংখ্যার মতো তাদের আয় হয় না। আমার ধারণা আপনিও একজন গণিতবিদ–হামিন।
না। ওই বিষয়ে আমি অ-আ কিছুই জানি না।
ও। সেলডন হতাশ। এই যে বললেন আমাকে গণিত সম্মেলনে দেখেছেন।
দর্শক হিসেবে ছিলাম। আমি একজন সাংবাদিক। হাতের টেলিপ্রিন্টারগুলো জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে রাখল হামিন। নিউজ হলোকাস্টে সংবাদ সরবরাহ করি। এই কাজ করে করে আমি ক্লান্ত।
এই কাজ আর ভালো লাগে না?
মাথা নাড়ল হামিন। এই গ্রহ সেই গ্রহ ঘুরে ঘুরে আবোল-তাবোল সংবাদ সংগ্রহ করে করে বিরক্তি ধরে গেছে।
কিছুটা হিসেবী দৃষ্টিতে সেলডনের দিকে তাকালো সে। তবে মজার মজার ঘটনাও ঘটে। আমি শুনেছি যে আপনাকে কয়েকজন ইম্পেরিয়াল গার্ড-এর সাথে প্রাসাদে দেখা গেছে। আপনি নিশ্চয়ই সম্রাটের সাথে দেখা করতে যাননি?
সেলডনের মুখের হাসি মুছে গেল। ধীরে ধীরে বললেন, দেখা হলেও সংবাদে প্রচার করার জন্য সেই কথা আপনাকে বলব না।
না, না, সংবাদপত্রে প্রকাশ করার জন্য নয়। আপনি হয়তো জানেন না, তাই আমার কাছ থেকে জেনে নিন–সাংবাদিকতা পেশার প্রথম নিয়ম হলো সম্রাটের কোনো খবরই প্রচার করা যাবে না যদি না সেই খবর প্রচার করার জন্য অফিসিয়ালি আমাদের হাতে দেওয়া হয়। পদ্ধতিটা ভুল। কারণ গুজব তো এমনিতেই ছড়ায়, এতে করে আরো বেশি ছড়ায়।
কিন্তু বন্ধু, আপনি যদি সেটা প্রচার নাই করেন তাহলে জানতে চাইছেন কেন?
ব্যক্তিগত কৌতূহল। বিশ্বাস করুন আমার যে পেশা তাতে অনেক অনেক বেশি জানতে হয়। যাইহোক, আপনার বক্তৃতা পুরোটা না শুনলেও এটুকু বুঝতে পেরেছি। যে আপনার গবেষণার মূল বক্তব্য হচ্ছে ভবিষ্যতের পূর্বানুমান বা ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভব।
মাথা নেড়ে বিড়বিড় করলেন সেলডন, ভুল।
মাফ করবেন?
কিছু না।
বেশ, ভবিষ্যদ্বাণী–নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী–সম্রাট বা যেকোনো সরকারি কর্মকর্তাকে আকৃষ্ট করবে। তাই ধরে নিচ্ছি সম্রাট প্রথম ক্লীয়নকে খুশী করার জন্য তাকে কিছু। ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে এসেছেন।
এ ব্যাপারে আমি আলোচনা করতে চাই না। কঠিন গলায় বললেন সেলডন।
সামান্য একটু কাঁধ ঝাঁকালো হামিন। বোধহয় ইটো ডেমারজেলও সেখানে ছিল।
কে?
ইটো ডেমারজেলের নাম শুনেননি আপনি?
কখনোই না।
ক্লীয়নের প্রতিচ্ছবি–ক্লীয়নের অপচ্ছায়া–ক্লীয়নের কুমন্ত্রণাদাতা–ক্লীয়নের হিংসাত্মক পরিকল্পনার রূপদানকারী। ডেমারজেলকে এইসব নামেই অভিহিত করা হয়।
দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন সেলডন। হামিন বলে যাচ্ছে, হয়তো আপনি তাকে দেখেননি, কিন্তু সে ওখানে ছিল। আর যদি সে মনে করে আপনি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবেন।
আমি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি না। জোরে জোরে মাথা নেড়ে সেলডন বললেন। আমার বক্তৃতা শুনলেই আপনি বুঝতেন যে আমি শুধু তাত্ত্বিক সম্ভাবনার কথা বলেছি।
কোনো ব্যাপার না। যদি সে মনে করে আপনি পারবেন, তাহলে আপনাকে ছাড়বে না।
ছেড়েই তো দিয়েছে। এখন আপনার সাথে কথা বলছি।
এটাকে ছেড়ে দেওয়া বলে না। সে জানে আপনি কোথায়। কোথায় যাবেন, কী করবেন সবই সে জানবে। যখন প্রয়োজন হবে ঠিকই আপনাকে তুলে নিয়ে যাবে। যদি মনে করে আপনাকে দিয়ে উপকার হবে তখন আপনাকে নিংড়ে কাজ আদায় করবে। যদি মনে করে কোনো কাজ হবে না তখন আপনাকে নিংড়ে জীবন বের করে নেবে।
আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?
না শুধু সতর্ক করে দিচ্ছি।
আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না।
তাই? একটু আগেই তো বললেন একটা ভুল হয়েছে। সেই ভুলটা কী আপনার গবেষণার ফলাফল সম্মেলনে উপস্থাপন করা যার কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যায় পড়তে হচ্ছে?
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলেন সেলডন। হামিনের অনুমান সঠিক–ঠিক সেই মুহূর্তেই তিনি বিপদের গন্ধ পেলেন।
আগন্তুকদের কোনো ছায়া মাটিতে পড়েনি কারণ আলো অনেক বেশি মৃদু এবং ছড়ানো। শুধু চোখের কোণে একটা নড়াচড়া ধরা পড়ল।
.
পলায়ন
ট্র্যান্টর… প্রথম গ্যালাক্টিক এম্পায়ার-এর রাজধানী… সম্রাট প্রথম ক্লীয়নের আমলে ট্র্যান্টরের জৌলুস এবং সুখ্যাতি আরো ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। তথ্য প্রমাণ থেকে জানা যায় সেই সময় এই গ্রহ সকল ক্ষেত্রে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছায়। দুইশ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটারের পুরো গ্রহটা ছিল অগণিত গম্বুজওয়ালা ধাতব ছাদ দিয়ে আচ্ছাদিত, সুবিশাল নগরীগুলোর বিস্তৃতি ছিল ভূ-স্তরের অনেক গভীরে একেবারে কন্টিনেন্টাল শেলফ পর্যন্ত। জনসংখ্যা ছিল চল্লিশ বিলিয়ন।
… যদিও ট্র্যান্টরের ভাগ্যাকাশে ধ্বংসের লক্ষণগুলো পরিস্কার ফুটে উঠেছিল (এবং সবাই সেটা অন্তরের অন্তঃস্থলে উপলব্ধিও করেছিল) তথাপি অধিবাসীরা মনে করত এই গ্রহ সুখ, সমৃদ্ধি এবং প্রাচুর্যে ভরপুর এক জাগতিক স্বর্গ এবং বিশ্বাসই করতে পারেনি যে…
—এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা