“মা, আমরা কি খুব শীঘ্রি শহরে পৌঁছে যাব?” ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া নাকের ডগা ঘষতে ঘষতে সে জানতে চায়, কিন্তু তার চোখ জানালার কাঁচের উপরে তার নিঃশ্বাসের কারণে জমা হওয়া কুয়াশার গায়ে আটকে থাকে, কিভাবে আস্তে আস্তে সেটা অদৃশ্য হয়ে যায়।
“আর আধ-ঘণ্টা সোনা।” তারপরে, গলায় ঈষৎ উৎকণ্ঠা ফুটিয়ে তুলে, “আমাদের বেড়াতে যাওয়া নিয়ে তুমি খুশী হওনি? শহরের উঁচু উঁচু ইমারত তার প্রাণবন্ত লোকজন আর হাজারটা দর্শনীয় বস্তু দেখতে দেখতে তুমি আনন্দেই থাকবে, তোমার মনে হয় না? আমরা সেখানে প্রতিদিনই পুতুলনাচ দেখতে যেতে পারি এবং সার্কাস আর সমুদ্র সৈকতে এবং–”
“হ্যাঁ,মা,” অনুৎসাহিত কণ্ঠে সম্মতি জানায় গ্লোরিয়া। এই মুহূর্তে তাদের বিমানপোত মেঘের রাজ্যের ভিতর দিয়ে অতিক্রম করছে, এবং গ্লোরিয়া সাথে সাথে মেঘের নিচে মেঘের ভেসে যাবার দর্শনীয় দৃশ্য দেখতে মগ্ন হয়ে যায়। একটু পরেই তারা আবার পরিষ্কার আকাশের নিচে দিয়ে যেতে থাকে, এবং সে তার মায়ের দিকে তাঁকিয়ে কোনো গোপন কথা বলছে এমন রহস্যময় একটা বাতাবরণ তৈরী করে।
“মা, আমি জানি আমরা কেন শহরে যাচ্ছি।”
“তুমি জানো?” মিসেস, ওয়েসটন বিভ্রান্তবোধ করেন। “কেন যাচ্ছি, সোনা?”
“তুমি আমাকে বলনি, কিন্তু আমি জানি, তুমি আমাকে চমকে দিতে চেয়েছিলে।” এক মুহূর্তের জন্য সে নিজেই নিজের মানসিক শক্তির তীব্রতা উপভোগ করে এবং শেষে উচ্ছল ভঙ্গিতে হেসে উঠে। “আমরা রোব্বিকে খুঁজতে নিউইয়র্ক যাচ্ছি, তাই না?- এবার গোয়েন্দাদের সাহায্যে।
গ্লাস থেকে পানি খাবার সময়ে জর্জের কানে কথাটা পৌঁছায়, তার ফলাফল হয়, ভয়াবহ। প্রথমে দম আটকে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা, ফোয়ারার মতো মুখ থেকে পানি বের হয়ে আসে এবং শেষে শ্বাসরোধকারী কাশির দমক। ঝামেলা শেষ হলে, ভিজা গায়ে সে উঠে দাঁড়ায়, মুখ টকটকে লাল এবং সাংঘাতিক বিরক্ত।
মিসেস. ওয়েসটনের চেহারায় কোনো ভাব ফুটে উঠে না, কিন্তু গ্লোরিয়া উদ্বিগ্ন কণ্ঠে একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলে, সে বহু কষ্টে নিজেকে সামলে রাখে।
“হয়তো,” কর্কশ, বিকৃত কণ্ঠে সে বলে। “এখন দয়া করে একটু চুপ করে বসবে!”
.
১৯৯৮ এনো ডোমিনো, নিউইয়র্ক শহর, শহরের ইতিহাসে দর্শনার্থীদের জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আর আসেনি। গ্লোরিয়ার বাবা-মা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে, সুযোগের সদ্ব্যবহারে সচেষ্ট হয়।
স্ত্রীর কাছ থেকে আসা একটা সরাসরি নির্দেশের বলে, জর্জ ওয়েসটন একমাসের জন্য তার ব্যবসায়িক কাজকর্ম শিকেয় তুলে রেখে যাতে সে সময় ব্যয় করতে পারে যা তার ভাষ্যমতে “তুচ্ছ আমোদপ্রমোদে মগ্ন রেখে গ্লোরিয়াকে ধ্বংসের দ্বারপান্তে নিয়ে যাওয়া।” ওয়েসটনদের অন্যান্য কাজের মতো আমোদপ্রমোদের ব্যাপারটাও দক্ষ, ব্যাপক আর ব্যবসায়ী মনোভাব গ্রহণ করে। একমাস যেতে দেখা যায় দর্শনীয় আর প্রমোদ-রঞ্জনের কোনো উসিলা তারা বাদ রাখেনি।
প্রায় আধ মাইল উঁচু রুজভেল্ট ভবনের শীর্ষে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়, যাতে সেখান থেকে উঁচু নিচু বাড়ির ছাদের অবাধ দৃশ্যপট যা ধীরে ধীরে লঙ আইল্যান্ডের মাঠ আর নিউ জার্সির সমভূমিতে গিয়ে মিশে যাবার দৃশ্য সম্ভ্রম জাগানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে পারে। তারা চিড়িয়াখানায় যায় সেখানে সত্যিকারের জীবন্ত সিংহ দেখে গ্লোরিয়া সেদিকে ভয়মিশ্রিত চোখে তাকিয়ে থাকে (অবশ্য সত্যিকারের মানুষের বদলে কাঁচা মাংস তাদের খেতে দিতে দেখে সে যারপরনাই বিরক্ত হয়), এবং ক্রমাগত ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে ‘তিমি’ দেখবে বলে।
বিভিন্ন জাদুঘরও তাদের কৃপাধূলি থেকে বঞ্চিত হয় না, সাথে বাদ যায় না একটাও পার্ক, সমুদ্র সৈকত আর অ্যাকুরিয়াম।
হাডসন নদীর উজানে তারা স্টিমারে করে নৌ-বিহারে বের হয়। স্টিমারটা আবার উত্তাল বিশের দশকের অপ্রচলিত উপকরণে সজ্জিত। স্ট্রাটোস্ফিয়ারে সে প্রদর্শনী সফরে যায় যেখানে আকাশ বেগুনী বর্ণের সেখানে তারা ফুটে আছে আর অনেক নীচে ঘোলাটে পৃথিবীকে দেখায় একটা বিশাল অবতল বাটির ন্যায়। লঙ আইল্যান্ডের কাছে পানির নিচে কাঁচের আবরণযুক্ত সমুদ্রগামী জুবোজাহাজে তারা ঘুরতে বের হলে, সবুজ আর স্রোতময় পৃথিবীতে আকর্ষক আর সেই সাথে কৌতূহলী নানা সামুদ্রিক জীব তাকে অবাক হয়ে দেখে আর তারপরেই হুটোপুটি তুলে পালিয়ে যায়।
অনেকটা গতানুগতিক ভাবনা থেকে, মিসেস.ওয়েসটন তাকে বিশালাকৃতির, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে নিয়ে যায় কল্পনার আরেকটা জগৎ উন্মুক্ত করার অভিপ্রায়ে।
মাস শেষ হয়ে আসতে থাকলে, বস্তুতপক্ষে, ওয়েসটন দম্পতি মেনে নেয় যে হারিয়ে যাওয়া রোব্বিকে গ্লোরিয়ার মন থেকে মুছে ফেলতে সম্ভাব্য সবকিছুই তারা করেছেন– কিন্তু সাফল্যের সম্ভাবনা নিয়ে তারা খুব একটা উৎসাহিত বোধ করেন না।
ঘটনা হল, গ্লোরিয়া যেখানেই যাক না কেন, সেখানে উপস্থিত রোবট তা সে যে ধরনেরই হোক না কেন তার প্রতিই তার অকুণ্ঠ আর একতরফা মনোযোগ আকর্ষিত হয়। তার সামনে যতই চমকপ্রদ প্রর্দশনী অনুষ্ঠিত হোক, বা তার শিশুতোষ চোখে যতই অভিনব দেখাক, চোখের কোণে যদি সে কোনো ধাতব গতিবিধির আলামত সনাক্ত করতে পারে তবে সাথে সাথে সে সেই দিকে হাঁটা ধরবে।