তারপরে, একদিন সন্ধ্যেবেলা, গটগট করে বসার ঘরে ঢুকে হাত হাত ভাঁজ করে বসে পড়েন এবং তাকে দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে তিনি রাগে অন্ধ হয়ে গেছেন।
তার স্বামী খবরের কাগজের উপর দিয়ে বকের মতো মাথা বের করে তার দিকে তাকায়, “এখন আবার কি হল, গ্রেস?”
“বাচ্চাটার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি না, জর্জ। আজকেই আমি কুকুরটা ফেরত পাঠিয়ে দেব, ঠিক করেছি। গ্লোরিয়া বলছে, সে কোনোমতেই ওকে সহ্য করতে পারছে না। এই মেয়ের পাল্লায় পড়ে মাঝখানে আমার পাগল হবার দশা।”
ওয়েসটন কাগজটা সরিয়ে রাখে, তার চোখে আশার হাল্কা দ্যুতি দেখা যায় কি যায় না, “আমাদের–আমাদের বোধহয় রোব্বিকে ফিরিয়ে আনাই উচিত। তুমি জানো যে কোনো সময়ে সেটা করা সম্ভব। তুমি বললে আমি এখন ওদের সাথে—”
“না!” নির্মম ভঙ্গিতে সে উত্তর দেয়। “আমি ওকথা শুনতেও চাই না। এত সহজে আমরা হাল ছেড়ে দিতে পারি না। একটা রোবটের সাহচর্যে আমার মেয়ে বড় হবে না এই কথাটা বুঝতে তার যতদিন সময় লাগে লাগুক, ক্ষতি নেই।”
ওয়েসটন হতাশ ভঙ্গিতে ভাঁজ করা খবরের কাগজটা পুনরায় উঠিয়ে নেয়। “আর সেই সময়ে আমার মাথার সব চুল সাদা হয়ে যাবে।”
“জর্জ, তোমার সহযোগিতার তুলনা হয় না,” নিষ্প্রাণ উত্তর ভেসে আসে। “গ্লোরিয়ার আসলে দরকার আবহাওয়া পরিবর্তন। এখানে থাকলে সে কখনও রোব্বির কথা ভুলতে পারবে না। কিভাবে ভুলবে, এখানের প্রতিটা গাছ পাথরে যে রোব্বির স্মৃতি মিশে আছে। আমি বাবা জন্মেও এমন কথা শুনিনি। একটা ফালতু রোবটের জন্য কিনা একটা মেয়ে নাওয়াখাওয়া শিকেয় তুলেছে।”
“এসব তো বুঝলাম, আসল কথাটা বলো। আবহাওয়া পরিবর্তন বলতে তুমি ঠিক কি বোঝাতে চাইছো?”
“আমরা ওকে নিউইয়র্কে নিয়ে যাব।”
“শহরে! আগষ্ট মাসে! তোমার কোনো ধারণা আছে আগষ্ট মাসে নিউইয়র্কের আবহাওয়া সম্বন্ধে? মানুষ বাসের অযোগ্য।”
“লক্ষ লক্ষ লোকতো থাকছে।
“তাদের যাবার জন্য এই রকম কোনো জায়গা নেই, তাই থাকছে। নিউইয়র্কে তাদের কোনো কাজ না থাকলে তারা সেখানে মুততেও যেত না।”
“বুঝলাম, কিন্তু আমরা যাচ্ছি। আমি বলি কি আজই রওয়ানা দিলে কেমন হয় বা যত শীঘি আমরা বন্দোবস্ত করতে পারি। শহরে একবার গেলে, গ্লোরিয়া সময় কাটাবার জন্য প্রচুর বন্ধু আর অসংখ্য আকর্ষণীয় বস্তু খুঁজে পাবে এবং তখন আর তার ফালতু রোবটটার কথা মনেই থাকবে না।”
“রক্ষা করো, ঈশ্বর, সংসারের নিগৃহীত অংশীদার ককিয়ে উঠে, “শহরের রাস্তায় এখন পীচ পর্যন্ত গলে আছে।”
“আমাদের যেতেই হবে, অবিচলিত কণ্ঠে উত্তর ভেসে আসে।”গত মাসে গ্লোরিয়ার ওজন পাঁচ পাউন্ড কমেছে এবং আমার বাচ্চা মেয়ের স্বাস্থ্য তোমার আরামের চাইতে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।”।
“মুশকিল হল, তার রোবট বিদায় করার আগে তোমায় মেয়ের স্বাস্থ্যের কথা তুমি একবারও ভাবনি,” সে বিড়বিড় করে নিজেকেই শোনায়।
.
শহরে যাবার কথা শুনতেই গ্লোরিয়ার মাঝে একটা পরিবর্তন দেখা যায়। সে ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা কথা বলে না তবে যখন বলে তখন তার কণ্ঠে একটা প্রাণবন্ত সুর খেলা করে। তার হাসি আবার ফিরে আসে এবং আগের মতোই সে খাওয়াদাওয়া করা শুরু করে।
মিসেস. ওয়েসটন আনন্দে পারলে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ান আর কি এবং উত্তেজনায় অধীর হয়ে তার দ্বিধাগ্রস্ত স্বামীকে দু’কথা শোনাবার কোনো সুযোগ হাতছাড়া করেন না।
“জর্জ, খেয়াল করেছো, জামাকাপড় গুছাতে সে নিজে থেকেই কেমন সাহায্য করছে এবং সারাক্ষণই বকবক করে আমার কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে যেন বেড়াতে যাওয়া ছাড়া এ পৃথিবীতে আর কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। আমি তোমাকে বলেছিলাম না–তার পছন্দ প্রতিস্থাপিত করতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“হুমমম,” দ্বিধাগ্রস্ত উত্তর, “আমিও তাই চাই।”
প্রারম্ভিক ব্যাপারগুলো খুব সহজেই মিটে যায়। তাদের শহরের বাসাকে সাফসুতরো করার বন্দোবস্ত করা হয় আর গ্রামের বাসা দেখাশুনা করতে এক বৃদ্ধ দম্পতির উপরে দায়িত্ব দেয়া হয়। অবশেষে যাত্রার দিন যখন আসে গ্লোরিয়া আবার সেই পুরান প্রাণোচ্ছল মেয়েতে পরিণত হয় এবং এই কয়দিন সে একবারের জন্যেও রোব্বির নাম মুখে আনেনি।
হাসিখুশী মনেই ঘূর্ণায়মান-ট্যাক্সি নিয়ে পরিবারটা বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওয়ানা দেয় (ওয়েসটন তার নিজের ঘূর্ণায়মান জেট-কার ব্যবহার করতেই যদিও বেশী স্বচ্ছন্দ্যবোধ করে কিন্তু মুশকিল হল সেটাতে কেবলমাত্র দুজন বসতে পারে। আর মালপত্র রাখবার কোনো বন্দোবস্ত নেই) এবং অপেক্ষমাণদের সারিতে গিয়ে দাঁড়ায়।
“গ্লোরিয়া এসো,” মিসেস.ওয়েসটন তার মেয়েকে ডাকেন। “আমি জানালার পাশে তোমার জন্য একটা সীট রেখেছি যাতে তুমি নিচের দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে যেতে পারো।”
আক্ষরিক অর্থে খুশীতে লাফাতে লাফাতে সে দুসারি সিটের মাঝের সরু পথটা দিয়ে ছুটে গিয়ে, ডিম্বাকৃতি পরিষ্কার স্বচ্ছ পুরু কাঁচের গায়ে নাক চেপ্টে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, এবং সহসা পেছন দিকে থেকে মোটরের কাশির মতো শব্দ ভেসে আসতে, তার দেখার উত্তেজনার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীকে পাথরের মতো নিচের দিকে খসে পড়তে দেখে ভীত হবার মতো বয়স তার এখনও হয়নি এবং তার ওজন। যে হঠাৎ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে সেটা নিয়ে উত্তেজিত হবার পক্ষে তার বয়সটা একটু কমই। পৃথিবীটা একটা জোড়াতালি দেয়া পালের আকৃতি পেতে সে কাঁচ থেকে তার নাক সরিয়ে নিয়ে মায়ের মুখোমুখি হয়।