“না, সোনা,” সে উত্তর দেয় এবং আড়ালের গ্লানি কোনোমতে লুকিয়ে বলে, “পুতুলনাচে তারা রোবটদের ঢুকতে দেয় না। কিন্তু তুমি বাসায় এসে তাকে গল্পটা বলতে পারবে।” শেষের কথাগুলো কোনোমতে হড়বড় করে সে বলে এবং দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
পুতুলনাচ আসলেই জাঁকজমকপূর্ণ একটা প্রদর্শনী, নাচ দেখে উত্তেজনায় ফুঁসতে ফুঁসতে গ্লোরিয়া ফিরে আসে।
আকাশে উড্ডীন জেট-কার ভূগর্ভস্থ গ্যারেজে পার্ক করা পর্যন্ত সে কোনো মতে অপেক্ষা করে, “বাবা, রোব্বিকে আমি না বলা পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করো। সে দেখলে খুশীতে পাগল হয়ে যেত।– বিশেষ করে চিতা-মানবের সাথে সিংহ-মানবের যুদ্ধের দৃশ্যটা।” সে আবার হাসতে শুরু করে, “বাবা, চাঁদে কি সত্যিকারের সিংহ-মানুষ থাকে?”
“মনে হয় না, অন্যমনস্ক কণ্ঠে ওয়েসটন বলে।”এগুলো সব রূপকথা। গাড়ি পার্ক করতে সে আজ অন্যান্য দিনের চাইতে কম সময় নেয়। সময় হয়েছে সত্যের মুখোমুখি হবার।
বাগানের উপর দিয়ে গ্লোরিয়া দেয়। “রোব্বি।- রোব্বি!”
পোর্চের নিচে লেজ নাড়তে নাড়তে গম্ভীর বাদামী চোখে তাকিয়ে থাকা একটা লোমশ কুকুর দেখে সহসা সে থমকে দাঁড়িয়ে যায়।
“ওমা, কি সুন্দর কুকুর!” সিঁড়ির ধাপগুলো টপকে, সে সাবধানে এগিয়ে যায় এবং তাকে আদর করে।”বাবা, এটা কি আমার জন্য?”
তার মা ইতিমধ্যে বাসা থেকে বের হয়ে এসে তাদের সাথে যোগ দেয়। “হ্যাঁ, গ্লোরিয়া সোনা। খুব সুন্দর না- নরম আর কী ভীষণ লোমশ। খুব শান্ত। বাচ্চা মেয়েদের সে ভীষণ পছন্দ করে।”
“ও কি খেলতে পারে?”
“অবশ্যই। সে অনেক রকমের খেলাও জানে। তুমি কি এখন কোনো খেলা দেখতে চাও?”
“এখনই। আমি চাই রোব্বিও দেখুক।- রোব্বি!” সে কুটি করে, অনিশ্চিত চোখে তাকায়। “আমি লিখে দিতে পারি সে তার ঘরে গোজ হয়ে বসে আছে, পুতুল নাচ দেখতে নিয়ে যাইনি বলে বাবুর রাগ হয়েছে বাবা, ওকে শান্ত করার দায়িত্ব তোমার। সে হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করবে না, কিন্তু তুমি কিছু বললে সে সেটা শুনবে।”
ওয়েসটনের ঠোঁট শক্ত হয়ে যায়। সে তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখে সে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।
সটান ঘুরে গিয়ে গ্লোরিয়া চিৎকার করতে করতে বেসমেন্টের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায়, “রোব্বি- দেখে যাও বাবা মা আমার জন্য কি নিয়ে এসেছে। রোব্বি, তারা আমার জন্য একটা কুকুর নিয়ে এসেছে।”
এক মিনিট পরেই হাসিখুশী মেয়েটা ভয়ার্ত মুখ নিয়ে উপরে উঠে আসে। “রোব্বি ঘরে নেই। কোথায় গেছে সে?” কেউ তার প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় না এবং খুকখুক করে একটু কেশে জর্জ ওয়েসটন সহসাই ভেসে যাওয়া একটুকরো মেঘ আগ্রহভরে দেখতে থাকে। গ্লোরিয়ার গলায় কান্না এসে থমকে থাকে, “মা, রোব্বি কোথায়?”
মিসেস. ওয়েসটন হাঁটু মুড়ে বসে মেয়েকে আলতো করে কাছে টেনে নেন, “গ্লোরিয়া মন খারাপ করে না। আমার মনে হয়, রোব্বি চলে গেছে।”
“চলে গেছে। কোথায়? সে কোথায় চলে গেছে, মা বলো?”
“কেউ জানে না, সোনা। সে হঠাৎ কোথায় যেন চলে গেছে। আমরা তাকে কত খুঁজলাম, কত খুঁজলাম কিন্তু কোথাও পেলাম না।”
“তুমি বলতে চাও সে আর কখনও ফিরে আসবে না?” আতঙ্কে তার চোখ বড়বড় হয়ে উঠে।
“আমরা হয়তো শীঘ্রই তাকে খুঁজে পাব। না পাওয়া পর্যন্ত আমরা তাকে খুঁজেই যাব। আর যতক্ষণ আমরা তাকে খুঁজে না পাই সে সময়টুকু তুমি তোমার নতুন কুকুরের সাথে খেলতে পারো। একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখো! ওর নাম হল বজ্র আর সে-”
কিন্তু গ্লোরিয়ার চোখের পাতা ছাপিয়ে বর্ষা নামে, “এই পঁচা কুকুরের আমার কোনো দরকার নেই। আমাকে রোব্বি এনে দাও। আমি চাই তুমি আমাকে রোব্বি এনে দেবে।” শব্দকে হার মানায় তার অনুভূতির তীব্রতা, এবং তার অসংলগ্ন কথা পরিণত হয় তীক্ষ্ণ বিলাপে।
সাহায্যের আশার মিসেস, ওয়াটসন তার স্বামীর দিকে তাকায়, কিন্তু সে তাকে গোমড়া মুখে শরীরের ভার বদল করে তীব্র আগ্রহে স্বর্গের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে, আবার ঝুঁকে সান্ত্বনা দেবার কাজ আরম্ভ করে, “গ্লোরিয়া কাঁদছ কেন, শুধুশুধু? রোব্বি একটা যন্ত্র ছিল, একটা বাতিল পুরাতন নোংরা যন্ত্র। প্রাণ বলে তার কিছুই ছিল না।”
“সে মোটেই কোনো যন্ত্র ছিল না!” অবুঝের মতো ভয়ঙ্কর আর্তনাদ করে উঠে গ্লোরিয়া। “সে আমার আর তোমার মতোই একজন ছিল আর সে আমার বন্ধু ছিল। আমার ওকেই চাই। ওহ মা, ওকে আমার কাছে এনে দাও।”
গ্লোরিয়াকে তার দুঃখের কাছে সমর্পণ করে তার মা যন্ত্রণাক্লিষ্ট মনে পরাজয় মেনে নেয়।
“কেঁদে কেঁদে আপনিই শান্ত হবে,” সে তার স্বামীকে বলে। “বাচ্চাদের শোকের স্থায়িত্ব বেশীক্ষণ না। কয়েকদিন পরে তার মনেই থাকবে না যে ওরকম তাল রোবটের অস্তিত্ব কখনও ছিল।”
কিন্তু কয়েক দিন যেতে বোঝা যায় মিসেস. ওয়েসটন একটু বেশীই আশাবাদী হয়েছিলেন। গ্লোরিয়ার কান্না বন্ধ হয়, তার কথা মতোই কিন্তু সেইসাথে মেয়েটার হাসিও বন্ধ হয়ে যায় আর যত দিন যায় মেয়েটা ততই নিশ্চুপ আর মনমরা হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে তার মনমরা ভাবের কাছে মিসেস.ওয়েসটন নতি স্বীকার করেন। কিন্তু স্বামীর কাছে পরাজয় মানতে হবে এই একটা মাত্র কারণে তিনি মেয়ের দাবী মেনে নেন না।