লম্বা ঘাসের আড়াল ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই মিসেস ওয়েসটন তাদের দেখতে পায় এবং বাসায় প্রবেশ করে অপেক্ষা করতে থাকে।
“গ্লোরিয়া চেঁচাতে চেঁচাতে আমার গলা ব্যথা হয়ে গেছে,” কঠোর স্বরে সে বলে। “কোথায় ছিলে তুমি?”
“আমি রোব্বির সাথে ছিলাম,” আড়ষ্ঠ কণ্ঠে গ্লোরিয়া উত্তর দেয়। আমি তাকে। সিনডারেলার গল্পটা বলছিলাম আর তাই খাবারের সময় যে হয়েছে সেটা মনেই ছিল না।”
“বেশ, কিন্তু রোব্বিও যে সেটা ভুলে যাবে সেটাই দুঃখজনক।” তারপরে যেন। তার রোবটের কথা মনে পড়েছে এমনভাবে সে তার দিকে ঘুরে তাকায়।”রোব্বি, এখন তুমি যেতে পারো।তোমাকে এখন আর তার প্রয়োজন নেই।” তারপরে ইচ্ছাকৃতভাবেই রূঢ় স্বরে বলে, “আমি আবার ডাকা না পর্যন্ত তোমার আর আসবার দরকার নেই।”
রোব্বি যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়, কিন্তু গ্লোরিয়া তার হয়ে সাফাই দিতে শুরু করলে ইতস্তত করে, “মা দাঁড়াও, ওকেও তোমায় থাকতে দিতে হবে। সিনডারেলার গল্প বলা আমার এখনও শেষ হয়নি। আমি ওকে কথা দিয়েছি সিনডারেলার গল্প বলবো আর আমি এখন পুরোটা শেষ করিনি।”
“গ্লোরিয়া!”
“মা, সত্যি, ও একদম চুপ করে থাকবে তুমি টেরও পাবে না যে সে বাসায় আছে। একটা কোণায় ও বসে থাকবে এবং কোনো কথা বলবে না, মানে আমি বলছি সে কিছু করবে না। তাই না রোব্বি?”
রোব্বি তার ঢাউস মাথাটা আবেদনের ভঙ্গিতে একবার উপরে নিচে করে।
“গ্লোরিয়া তোমার এই ফাজলামো এখনই বন্ধ করো, না হলে আগামী এক সপ্তাহ তুমি রোব্বির দেখা পাবে না।”
বাচ্চা মেয়েটার চোখে অভিমান ঝিলিক দেয়, “ঠিক আছে! কিন্তু সিনডারেলা ওর প্রিয় গল্প আর আমারও পুরোটা বলা হয়নি।–আর সে যে কি পছন্দ করে গল্পটা।”
পায়ে অসন্তোষ ফুটিয়ে তুলে রোবটটা ফিরে গেলে গ্লোরিয়া আবার গুমরে কেঁদে উঠে।
.
জর্জ ওয়েসটন ব্যাপারটা খুব একটা পাত্তা দেয়না। রবিবার কোনো কিছু নিয়ে মাথা না ঘামানোটাই তার অভ্যেস। একটু পরেই টেবিলে সুস্বাদু খাবার দেয়া হবে; একটা সুন্দর, নরম, আর পুরাতন সোফা রয়েছে খাবার পরে ভাতঘুম দেবার জন্য; টাইমসের নতুন সংখ্যাটাও নাগালে রয়েছে; পায়ে চপ্পল আর উদোম গা; –এরপরেও কেউ কিভাবে অন্য খুটিনাটি বিষয়ে মাথা ঘামায়?
স্ত্রীকে যখন সে হেঁটে আসতে দেখে তখন সে মোটেই খুশী হতে পারে না। তাদের বিয়ের দশ বছর অতিক্রান্ত হবার পরেও, আজও সে তাকে প্রথম দিনের মতোই ভালোবাসে, আহাম্মক আর কাকে বলে? সে যখনই তাকে দেখে তখনই তার হৃদয় প্রেমে আপ্লুত হয়ে উঠে–কিন্তু তারপরেও রবিবারের দুপুরবেলা খাবার পরের সময়টুকু তার কাছে মহার্ঘ্য এবং বিশ্রাম মানে দু’তিন ঘণ্টা নিশ্চিন্ত নির্জনতায় শুয়ে থাকা। মঙ্গল গ্রহে লেফেবব্রে-ইয়োশিদা অভিযানের বিস্তারিত বিবরণের উপরে সে, বেশ গুরুত্বসহকারে মনোনিবেশ করে (এবারের অভিযান লুনার বেস থেকে উৎক্ষেপিত হবে এবং সে জন্য সাফল্য আশা করা যায়) এবং এমন ভাব দেখায় যেন তার কোনো অস্তিত্বই নেই।
মিসেস, ওয়েসটন দুমিনিট ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন, তারপরে অসহিষ্ণুচিত্তে আঃ1ও দুমিনিট এবং শেষে যথারীতি নিরবতায় বিঘ্ন ঘটান।
“জর্জ!”
“হুমমম?”
“জর্জ, কথা আছে, শোনো বলছি! কাগজটা নামিয়ে রেখে একবার আমার দিকে তাকাবে?”
কাগজটা মেঝেতে ছুঁড়ে দিয়ে ওয়েসটন উদ্বিগ্ন চোখে স্ত্রীর দিকে তাকায়, “কি হয়েছে, সোনা?”
“জর্জ তুমি ভালো করেই জানো কি হয়েছে। ব্যাপার গ্লোরিয়া আর জবড়জং যন্ত্র।”
“কোনো জবড়জং যন্ত্র?”
“ভাব দেখলে গা জ্বলে যায়, তুমি জানো না আমি কিসের কথা বলছি। রোবট, গ্লোরিয়া যেটাকে আদর করে রোব্বি বলে ডাকে। এক মুহূর্তের জন্যেও হতভাগাটা গ্লোরিয়ার পিছু ছাড়ে না।”
“বেশ কথা, কেন সে সেটা করবে? সেটাতো তার করার কথা না। আরেকটা কথা সে মোটেই কোনো জবড়জং যন্ত্র না। টাকা দিয়ে এর চাইতে ভালো অনুভূতিসম্পন্ন রোবট কেনা সম্ভব না আর আমার ছয়মাসের বেতন খর্চা গেছে জবড়জংটা কিনতে। অবশ্য, সেটা তার তুল্যমূল্যআমার অফিসের অর্ধেক লোকের চাইতে সে চালাক, আর বুদ্ধিমান।”
সে মেঝে থেকে কাগজটা কুড়িয়ে নেবার একটা চেষ্টা করে কিন্তু তার স্ত্রী তার চাইতে অনেক বেশী চটপটে সে অনায়াসে সেটা তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়।
“জর্জ আমার কথা মন দিয়ে শোনো, আমি আমার মেয়েকে একটা যন্ত্রের জিম্মায় ছেড়ে দিতে পারব না। আর সেটা আইনস্টাইনের মতো চালাক হলেও আমার তাতে বয়েই গেছে। একটা ধাতব টুকরো দিয়ে একটা বাচ্চা মেয়েকে পাহারা দেবার কোনো মানে হয় না।”
ওয়েসটন ভ্রু কোঁচকায়, “এই মহান সিদ্ধান্তটা তুমি ঠিক কখন নিলে? গত দু’বছর ধরে ধাতব টুকরোটা গ্লোরিয়ার সাথে সাথে আছে আজকের আগে তোমাকে দুশ্চিন্তা করতে দেখেছি বলে আমারতো মনে পড়ে না।”
“শুরুতে ব্যাপারটা আলাদা ছিল। পুরো ব্যাপারটাই ছিল অনন্য, আমার কাজের বোঝা অনেক কমিয়ে দিয়েছিল, এবং তখন সেটাই ছিল কেতাদুরস্ত। কিন্তু এখন, আমি ঠিক জানি না। প্রতিবেশীরা–”
“যা বাবা, প্রতিবেশীরা আবার কোথা থেকে আসলো, এর মাঝে। আচ্ছা, শোনো। সেবকয়ার চাইতে একটা রোবট অনন্ত গুণ বেশী বিশ্বস্ত। রোব্বিকে কেবল একটা কাজের জন্যই প্রস্তুত করা হয়েছে। আর সেটা হল বাচ্চাদের সঙ্গ দেয়া। তার সম্পূর্ণ ‘মানসিকতা’ কেবল এই উপলক্ষকে মাথায় রেখে তৈরী করা হয়েছে। স্নেহময় আর বিশ্বস্ত হওয়া ছাড়া সে আর কিছু জানেই না। সে একটা যন্ত্র আর তাকে সেভাবেই তৈরী করা হয়েছে। মানুষের ক্ষেত্রে কথাটা তুমি এভাবে। বলাতে পারবে না।”